ওমিক্রন ভাইরাসে অতিরিক্ত ভীতি অমূলক

করোনা ভাইরাসের সাম্প্রতিকতম জিন মিউটেড রূপ B.1.1.529 যার সাধারণ নাম ওমিক্রন, সেই ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন দেশের মত আমাদের দেশেও শোরগোল শুরু হয়েছে। আমাদের পত্রপত্রিকাগুলি এ বিষয়ে স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞের মত তাদের কল্পিত করোনা ঢেউ ও তার পরবর্তী লকডাউন(!), ইত‍্যাদি বিষয়ে নানা কথা ছড়াতে শুরু করেছে। ব‍্যপারটা কি? সত‍্যিই এর থেকে আমাদের অতিরিক্ত বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা তা বিশ্লেষণ করাই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য।
প্রথমে ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের ইতিহাস ব‍্যখ‍্যা করা যাক।
ইম্পিরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট ডঃ টম পিকক প্রথম এই নতুন ভাইরাসটির জেনম সিকোয়েন্সিং করতে গিয়ে দেখেন, SARS-CoV2 এর স্পাইক প্রোটিনের প্রায় ছাব্বিশ জায়গায় মিউটেশান হয়েছে। এটি সেজন‍্য স্বাভাবিকভাবেই “odd cluster” মিউটেশান। অর্থাৎ এটির সংক্রমণের তীব্রতা খুব একটা বেশী হওয়ার কথা নয়। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ‍্যালয়ের প্রফেসর রবি গুপ্তাও এর সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে, সণাক্তকরণের ব‍্যপারে তিনি জানিয়েছেন যে, এটি ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট প্রজাতির হলেও এর অ‍্যান্টিবডি সণাক্তকরণ ক্ষমতা কম। স্পাইক প্রোটিনের এস্ জিনের অনুপস্থিতির কারনে এখনকার rtPCR কিটে এর সণাক্তকরণ সম্ভব নাও হতে পারে। ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের জেনেটিক ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ফ্রাঙ্কো ব‍্যাঁলো বলেছেন, এটি ‘সিঙ্গল বার্সট্’ মিউটেশানে সৃষ্ট। তার ফলে এর আলফা বা ডেল্টা অ‍্যান্টিবডি শণাক্তকরণের ক্ষমতা কম। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা একটি ব‍্যপারে মোটামুটি সহমত পোষন করছেন যে, SARS-CoV2 এর মত এই নবতম রূপের ওমিক্রন ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা নেই।
২০২০ সালের প্রথম থেকেই আমি বলে এসেছি যে, এই RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হল জিন মিউটেশান করে পৃথিবীতে টিঁকে থাকা। আবার যত বেশী মিউটেড ভাইরাসের জন্ম হবে, তত তার মারণ ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এইভাবে ধীরে ধীরে এই RNA ভাইরাস একসময় মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এখন দেখা যাচ্ছে, মানবদেহ থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে ভাইরাস বেঁচে থাকার জন‍্য সিঙ্গল বার্সট্ মিউটেশান করছে। আর এর জন‍্য ওমিক্রন ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা অনেক কম। এর মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষমতাও দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কথা। একমাত্র HIV, ক‍্যান্সার ইত‍্যাদির মত মারণ রোগের উপস্থিতিতে মানবদেহে ইমিউনিটি কম থাকার কারনে এটি মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। এখনো অব্দি এর সংক্রমণের ধারা অনুধাবন করলে একথা ‘অসত‍্য’ বলা যায়না।
গত ১১ই নভেম্বর বটসওয়ানায় এই ভাইরাসের প্রথম দেখা মেলে। তার তিনদিন বাদে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ভাইরাসে আক্রান্তের সন্ধান মেলে। হংকংয়ে যে রোগীর দেহে গত ১৩ই নভেম্বর ওমিক্রন ভাইরাসের সংক্রমণ মেলে তার কয়েকদিন আগে সেই রোগীর rtPCR টেষ্টের রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ ছিল। কিন্তু কম্পালসারী কোয়ারেন্টাইনের সময় তার দ্বিতীয়বার টেষ্টের রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ আসে। এরপর জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে তার সংক্রমণ ওমিক্রন ভাইরাসের জন‍্য বলে জানা যায়। এখানে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তা হল, এখনো পর্যন্ত যেসব মানুষ এই নতুন মিউটেড ভাইরাসে আক্রান্ত তারা কোয়ারেন্টাইনে থাকলেও তাদের কারো শারীরিক অবস্থা গুরুতর নয়। এখনো পযর্ন্ত কোথাও মৃত‍্যুর খবর নেই। আবার ওমিক্রন ভাইরাসের বর্তমান rtPCR টেষ্ট ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতার জন‍্য অসতর্ক মানুষের পক্ষে এই ভাইরাস মারাত্মক। শুধু এই কারনের জন‍্যই এখনো অব্দি প্রায় তেরোটি দেশে এর ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই একটি কারনের ছন‍্যই WHO এই ভ‍্যারিয়েন্ট সম্পর্কে পৃথিবীতে সতর্কবার্তা দিয়েছে। ভবিষ‍্যতে যদি এই ভ‍্যারিয়েন্টের মারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় – অবশ‍্যই আরো মিউটেশানের পর, তখন এর সণাক্তকরণের অসুবিধাজনিত কারনে সংক্রমিতের কোয়ারেন্টাইন হওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়ে সংক্রমনের অতিবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। যদিও এতসব ‘হয়ত’, ‘কিন্তু’র পর, এমন চিন্তার বাস্তবসম্মত ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়নি; তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে সুযোগসন্ধানী সংবাদমাধ‍্যমগুলি টিআরপি রাড়ানোর লোভে অনেক প্রকারের ভীতিপ্রদ সংবাদ প্রচার করতে শুরু করেছে। তবে, এই মূহুর্তে সতর্কতার প্রয়োজন থাকলেও কোনরকম বিধিনিষেধের আওতায় দেশকে আনলে পরে আমাদের দেশের অর্থনীতির উপর সূদুরপ্রসারী খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ‍্য। সংবাদমাধ্যমে এমন কথাও দেখা গেল যে, এই ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট নাকি এমন ভাইরাস যার উপর বাজারের পরীক্ষিত ও স্বীকৃত কোন ভ‍্যাকসিনই কাজ করবেনা! উপযুক্ত সম্মান সহকারে জানতে চাই, সংবাদমাধ‍্যম এই তথ‍্য কোন গবেষনাগারের কোন পরীক্ষায় পেয়েছেন! এমনকি কোনো স্থীকৃত জার্নালে এমন তথ‍্য এখনো পাওয়া যায়নি। সুতরাং ভুতের ভয় না দেখিয়ে আমাদের সংবাদমাধ‍্যমগুলি ভুতের স্বরূপ প্রকাশ করলেই সঠিক কাজ করতেন।
এখানে আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। এখনো পযর্ন্ত ব‍্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ জিনোম সিকোয়েন্সিং না দেখে এবং ওমিক্রন ভাইরাসের সঙ্গে তার ম‍্যাচিং না করিয়ে এই বিশেষ ডেল্টা প্রজাতির ভাইরাসের চিহ্নিতকরন সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ে মনোনিবেশ করেছেন। একটি হল এই ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি মার্কার সণাক্ত করা – যাতে এর সণাক্তকরণ দ্রুত হয় এবং তার ব‍্যয় মানুষের সাধ‍্যের মধ‍্যে থাকে। অপরটি হল এই ভাইরাসের উপর ভ‍্যাকসিনের প্রভাব পরীক্ষা করা। এর জন‍্য সময় প্রয়োজন। তবে, মেডিক‍্যাল সায়েন্সের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটুকু বলা যায় যে, ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের প্রজাতিগুলির উপর যেসব ভ‍্যাকসিন সফল হচ্ছে তাদের ওমিক্রন ভাইরাসের উপর সফল না হওয়ার কোন কারন নেই। অর্থাৎ এই ভাইরাসও ভ‍্যাকসিনে কাবু হবে। নাহলে, ভ‍্যাকসিনের পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে সহজেই এই ভাইরাসকে কাবু করার ব‍্যপারে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুতরাং এই ভয়ের ব‍্যপারটাই অমূলক।
বলা হচ্ছে, স্পাইকপ্রোটিনের মধ‍্যে এই প্রথমবার এত বেশী পরিবর্তন দেখা গেল এবং প্রথমবার ফ‍্যুরিন ক্লিভেজ পাওয়া গেল। এতে ভীত হওয়ার ব‍্যপার নেই। কারন, RNA ভাইরাস প্রজাতি না পাল্টালে বিপদ নেই। যত জিন মিউটেশান হয়, ভাইরাস নিজে বেঁচে থাকার জন‍্য তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়লেও হোস্ট বডির ক্ষতি করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়! এক্ষেত্রেও একই ব‍্যপার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর সেজন‍্যই এত ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংক্রমিত কোন মানুষের এখনো পর্যন্ত মৃত‍্যু হয়নি। কিন্তু SARS-CoV2 সংক্রমণের শুরুতে যে তিন ব‍্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের সকলের অল্পদিনের মধ‍্যেই মৃত‍্যু হয়েছিল। এর সঙ্গে এখন আরেকটি ব‍্যপার যোগ হয়েছে। বিশ্বে এত বিপুল সংখ‍্যক মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় এই প্রজাতির সব মিউটেড ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের দেহে অ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়ে গেছে। সেজন‍্য, সংক্রমণের সংখ‍্যা বৃদ্ধি পেলেও সংক্রমণের মাত্রা অর্থাৎ তীব্রতা কমেছে। আরো একটি কথা জানা দরকার – কোন ভাইরাস জিন মিউটেট করে প্রজাতি বদল করতে পারে না। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ও এশিয়ান মানুষের মিলনে ইউরেশীয় মানুষ জন্ম নেয়; গরিলা নয়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণের তীব্রতা হ্রাস পাওয়া একটি পরীক্ষিত সত‍্য।
তা হলে আমাদের করণীয় কি?
করণীয় হচ্ছে, অযথা ভয় না পেয়ে আমরা সর্বদা অফশ‍্য পালনীয় সতর্কতা মেনে চলব। অর্থাৎ, বাড়ির বাইরে বেরোলে বা বাড়ির মধ‍্যে বাইরের মানুষের উপস্থিতিতে মাস্ক যথাযথভাবে পরে থাকা। ফাইরে থাকলে আধঘন্টা থেকে একঘন্টা অন্তর হাত স‍্যানিটাইজ করাহ সামাজিক স্থানে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা। এবং সর্বোপরি ভ‍্যাকসিনেশানের ডোজ যথাযথভাবে ও যথা সময়ে নেওয়া। ইউরোপ, আমেরিকায় শিশুদের ভ‍্যাকসিনেশান শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে যত তাড়াতাড়ি সম্বভ শিশুদের ব‍্যাকসিনেশান শুরু করা উচিৎ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে কাজ করার পর বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমে সাবান দিয়ে স্নান করা – সঙ্গে বাইরে পরার পোষাক আলাদা করে পৃথক স্থানে রাখা।
এই কটি নিয়ম মেনে চললে ওমিক্রন ভাইরাস কিছুদিনের মধ‍্যেই মানুষের হাতে পরাস্ত হবে – সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *