আমআদমি পার্টির কাছে পশ্চিমবঙ্গের মাটি কতটা ঊর্বর

পাঁচ রাজ‍্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কারভাবে রাজনীতির আঙ্গিনায় উঠে এসেছে। চার রাজ‍্যে বিজেপির জয় এবং কেন্দ্রশাসিত দিল্লীর বাইরে প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ‍্য পাঞ্জাবে আপের উত্থান। তারপরই উচ্ছসিত আপ নেতৃত্বের ঘোষণা – পশ্চিমবঙ্গ তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক টার্গেট। তখন থেকেই বাঙ্গালীদের আপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কথা শুরু হয়েছে! আপের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বলার মত সময় এখনো না এলেও এ বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে। প্রথমে বলতে হয়, আপ (আম আদমি পার্টি) গঠনতন্ত্র ও সংগঠনে অন‍্য আঞ্চলিক দলগুলির থেকে আলাদা কিছু নয় – যেমন অন‍্য আঞ্চলিক দলগুলি একজন সুপ্রিমো দ্বারা চালিত হয়, তেমনি আপও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল।
কে এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল? ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের অফিসার কেজরিওয়াল আই আই টি খড়্গপুর থেকে মেকানিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ বি টেক পাশ করার পর ১৯৯৫ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে (ইনকাম ট‍্যাক্স) যোগ দেন। চাকরীতে তিনি বিভিন্ন কারনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন

এবং তিনি ২০০৬ সালে চাকরীতে পদত‍্যাগ করলেও তা মামলা-মকদ্দমার পর ১৯১১ সালে গৃহীত হয়। চাকরী জীবনেও কেজরিওয়ালের চাকরী অপেক্ষা সামাজিক ন‍্যায়ের জন‍্য লড়াই করার প্রবণতা অনেক বেশী লক্ষ‍্য করা যায়। চাকরী করার সময় কেজরিওয়াল কখনোই সরকারী আধিকারিকের চাকরীর প্রতি যে বিশ্বস্ততা দেখানোর কথা তা দেখাননি। তিনি আন্না হাজারের ‘সরকারীস্তরে এবং রাজনীতিতে দূর্ণীতি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন। সেখানে সহযোগী হিসেবে পান সহকর্মী মণীশ শিশোদিয়াকে। তারপর বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দূর্ণীতির বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লীতে। সরকারের right to information (RTI) বিল পাশ করাতে তাঁর আন্দোলন যথেষ্ট গুরুত্ব দাবী করে। কিন্তু, তারপর দুটি NGO পরিচালনার ব‍্যাপারে (যার একটি নন-রেজিষ্টার্ড) এবং আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের সাদা জামায় কালির ছিটে লাগে। আন্না হাজারের অরাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের মধ‍্যে দিয়ে যার সামাজিক প্রতিষ্ঠা, সেই কেজরিওয়ালের পুরো লড়াই রাজনীতির ময়দানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন‍্য – এই উদ্দেশ‍্য যখন সামনে এলো তখন শুধু যে তিনি আন্নার থেকে সরে গেলেন তাই নয়, তাঁর আন্দোলন রাজনৈতিক সততার পরাকাষ্ঠা আর থাকলো না। যে অচলায়তনের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই, তিনি সেই অচলায়তনেরই অংশ হয়ে গেলেন। কেজরিওয়াল জনলোকপাল বিলের খসড়া তৈরীর কমিটিতে থাকলেও এবং প্রথমদিকে আন্না হাজারে, অরুন্ধতী রায়ের মত সমাজ-জীবনে দূর্ণীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষরা তাঁর সঙ্গে সাথ দিলেও পরে কেজরিওয়ালের NGOতে ফোর্ড ফাউন্ডেশান সহ বিদেশী এজেন্সির ফান্ডিং করার ব‍্যাপারে কেজরিওয়াল কোন সঠিক ব‍্যখ‍্যা না দিতে পারার কারনে তাঁরা কেজরিওয়ালের বিরোধীতা করেন।
এত কথা বলার উদ্দেশ‍্য একটাই। যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে গেলে মমতা ব‍্যানার্জীর কর্মপদ্ধতি জানতে হবে, তেমনি কেজরিওয়ালের কর্মপদ্ধতি জানলে আপের কর্মপদ্ধতি জানা যাবে। মমতা ব‍্যানার্জী ও কেজরিওয়ালের মধ‍্যে মিলের জায়গাটা হল, দুজনেই জন-আন্দোলনের ভিত্তির উপর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এবং দুজনেই ব্ল‍্যাকমেলিংয়ে সিদ্ধহস্ত। রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রতিশ্রুতির খেলাপ দুজনের রেকর্ডেই আছে! শুধু মমতা ব‍্যানার্জী প্রথম থেকেই রাজনীতির আঙ্গিনায় আছেন আর কেজরিওয়াল অরাজনৈতিক, দূর্ণীতি বিরোধী আন্দোলনে পরিচিতি পেয়ে রাজনীতির আঙ্গিনায় তার ফসল তুলেছেন। যে রাজনৈতিক ভন্ডামী ও অসততার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করে নেতৃত্বের দাবীদার হয়েছেন, পরবর্তী সময়ে সেই ভন্ডামী ও অসততার পরিকাঠামোর মধ‍্যে তিনি মধু আহরনের অন্বেষণে মনোনিবেশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি সুচারুভাবে পরিকল্পিত দ্বিচারিতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পরপর দুবার দিল্লীতে কেজরিওয়ালের আপ কিভাবে অভূতপূর্ব সাফল‍্য পেল। এ ব‍্যাপারে বলতে হয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেজরিওয়ালের অবস্থান বদল য়থেষ্ট কার্যকরী হয়েছে। কেজরিওয়ালের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দী বিজেপি এবং কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল হওয়ায় সব ইস‍্যুতে তারা সহজে নিজেদের অবস্থান বদল করতে পারেনা – এটা সব সর্বভারতীয় দলের ক্ষেত্রেই হয় – তাদের নীতির স্বচ্ছতা বজায় রাখার বাধ‍্যবাধকতা থাকে। বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে জাতীয় কংগ্রেস যত পিছিয়ে পড়েছে ততই তারা জেহাদী ও মৌলবাদী শক্তি এবং দেশবিরোধী কম‍্যুনিষ্টদের হাত ধরেছে। তার ফলে, শিক্ষিত, শান্তিপ্রিয় ভারতীয় মুসলমানদের অসহায়তা বেড়েছে এবং তাতে বিজেপির ও আঞ্চলিক দলগুলির লাভ হয়েছে। কারন, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি দেখলে বোঝা যায় যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিমুখী। এক্ষেত্রে মুসলিম ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলির পক্ষে গিয়েছে। এই আঞ্চলিক দলগুলি প্রায় সকলেই কপট ইসলামপ্রেমী ‘সেকুলার’ ভেকধারী। এভাবেই দিল্লীর বিধানসভা ভোটে আপের সমর্থনে মুসলিম ভোট প্রায় একচেটিয়াভাবে পড়েছে কারন এই ভোটারদের কাছে অন‍্য অপশান ছিলনা! অন‍্যদিকে দিল্লীতে কেজরিওয়ালের দূর্ণীতি বিরোধী ইমেজ আপের পক্ষে হিন্দু মধ‍্যবিত্তদের একাংশের ভোট পেয়েছে যা দিল্লীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ‍্য – ভারতের অন‍্য জায়গায় তার প্রভাব পড়ার কথা নয়। আবার ‘ফ্রি সার্ভিস’ দেওয়ার যে টেকনিক আপ দেখিয়েছে, যেমন বিদ‍্যুত, জল – এসবের জন‍্য নিম্নবিত্তদের অধিকাংশ সমর্থন আপের দিকে গেছে। এখানে মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রশাসিত দিল্লী বিধানসভার ক্ষমতা ও গন্ডি অনেক সীমিত। সে তুলনায় পাঞ্জাব বিধানসভা একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ‍্যের এবং তার ক্ষমতার গন্ডি অনেক বেশী। পাঞ্জাবের পুলিশ প্রশাসন, পঞ্চায়েত ও কৃষি প্রশাসন কেজরিওয়ালের আপের কাছে এক নতুন পরীক্ষা।
আপের পাঞ্জাব বিধানসভার নির্বাচনে অভুতপূর্ব সাফল‍্যলাভের ব‍্যাখ‍্যা যারা করছেন তাঁদের অধিকাংশের ব‍্যাখ‍্যাই পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ায় সঠিক কারন বলা হয়নি। আপের এই জয়ের কারন কিন্তু দিল্লীর নির্বাচন জয়ের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দিল্লীর শাসন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আপ নেতৃত্বের সঙ্গে জেহাদী ও কম‍্যুনিষ্ট ‘টুকরে গ‍্যাং’য়ের যোগাযোগ ছিলই। এদের একটি নীতি খুব পরিষ্কার – ম‍্যাকিয়াভেলীর তত্ত্ব অনুযায়ী এরা শত্রুর শত্রুকে বন্ধু হিসেবে জড়িয়ে ধরে। সেভাবেই এরা দিল্লীতে বিজেপি বিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আপের পক্ষে ভোট করেছে। পাঞ্জাবের খেলা আবার অন‍্যরকম। দিল্লীর প্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে চলা তথাকথিত কৃষক আন্দোলনের সময় প্রকাশ পায় যে এই আন্দোলন শুধু ভারত বিরোধী জেহাদীশক্তি ও কম‍্যুনিষ্টদের মদতেই নয়, এই আন্দোলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল আরেক ভারত বিরোধী শক্তি – খালিস্তানীরা। খালিস্তানীদের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের উপর রাগের সবচেয়ে বড় কারন হল, বর্তমানে বাতিল হওয়া কৃষি আইন। এই আইনের ফলে সংগঠিত ও ক্ষমতাশালী কৃষক লবির কৃষিপণ‍্যের মূল‍্য ও বন্টন ব‍্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হচ্ছিল। আমরা জানি যে, খালিস্তানী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে পাঞ্জাবের এই কুলাক শ্রেণী। কেজরিওয়াল ও আপ এই কৃষক আন্দোলনকে খুল্লামখুল্লা সমর্থন করায় এই শ্রেণী দেখল বিজেপির সঙ্গে থাকা শিরোমণি অকালি দল অপেক্ষা আপ তাদের অনেক কাছের। তারা বিভিন্ন কারনে কংগ্রেসের উপরেও অসন্তুষ্ট ছিল। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরকারী প্রশাসনকে দূর্ণীতিমুক্ত করার ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলো। যদি কৃষক আইনের জন‍্য জনসাধারনের বিরূপতা বিজেপিকে সইতে হত তা হলে, যেখানে এই আন্দোলন হয়েছে সেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি এত সংখ‍্যাগরিষ্টতা পেত না। পাঞ্জাবের ভোট নিয়ন্ত্রণ করেছে খালিস্তানী শক্তি। আমার অভিমত হল, এখান থেকেই আপের আসল পরীক্ষা শুরু হল। কারন, রাজ‍্যে ক্ষমতা দখল করেই দূর্ণীতি উপড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে – সেই দূর্ণীতিগ্রস্ত ব‍্যবস্থার অংশীদার হয়ে – ক্ষমতার অলিন্দে বসে ভারতে কোন রাজনৈতিক দল সফল হয়নি। তাছাড়া, পাঞ্জাবে আপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক খালিস্তানী শক্তিও দূর্ণীতি দুর করার ব‍্যাপারে আগ্রহী নয়। এই খালিস্তানীদের চাপ আপ সরকারের উপর ক্রমশঃ বাড়তে থাকলে কত দূর পর্যন্ত তা সামাল দেওয়ার দক্ষতা আপ দেখায় সেটাও পর্যবেক্ষণ করার ব‍্যাপার। এর অবিসম্বাদী ফল হল, দু বছর বাদে আপের জনপ্রিয়তায় ভাঁটার টান আসতে বাধ‍্য।
এবার আসি কেজরিওয়াল তথা আপের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঘোষিত প্রবেশের সম্বন্ধে কিছু কথায়। পশ্চিমবঙ্গে গত সাতান্ন-আটান্ন বছর ধরে পাঁচ-ছয় রকম স্তরে নির্বাচনে রিগিং হয়ে আসছে। এখন ত পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনও সন্দেহের ঊর্ধে থাকেন না! একমাত্র ২০১১ সালে এখানে রিগিং করেও শেষরক্ষা করা যায়নি। অন‍্য রাজ‍্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন একদম আলাদা। এই দীর্ঘ সময়ে সব সময়, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে সর্বদা শাসকদলের (যখন যে দল ছিল) প্রার্থী জিতেএসেছে। সুতরাং, এখানে শাসক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন জেতা অসম্ভব। বিশেষত পঞ্চায়েত ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন, যার দায়িত্ব রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনের – সেই নির্বাচনগুলি কতটা নির্বাচন ও কতটা অন‍্য কিছু – তা সময়ের দলিলে লিপিবদ্ধ থাকছে। এমতাবস্থায়, আপের দুই প্রধান অস্ত্র, অনুদান ও দূর্ণীতি দূরীকরণ, পশ্চিমবঙ্গে কাজ করবে না। কারন, তৃণমূল কংগ্রেসের কর্ণধার মমতা ব‍্যানার্জীর অনুদান নীতি, তার নাটকীয় ঘোষণা ও তাঁবেদার বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির প্রচার – এতকিছুর সঙ্গে আপ পাল্লা দিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ও দূর্ণীতিগ্রস্ত প্রশাসনের সঙ্গে এ রাজ‍্যের মানুষ এতটাই পরিচিত যে, আপের প্রচার নতুন করে তাঁদের মনে দাগ কাটতে পারবে না। বিশেষতঃ অরুন্ধতী রায়রা আগেই কেজরিওয়ালের NGOতে বিদেশী অনুদানকে কাটমানির পর্যায়ে ফেলে দেওয়ায় আপ মমতা ব‍্যানার্জীর নিজের মাঠে তাঁর স্টাইলে খেলতে এলে তাদের পরাজয় অবশ‍্যম্ভাবী। হয়ত প্রথমবার বলে NOTAর সমসংখ‍্যক ভোট আপ পেতে পারে! সব রাজ‍্যের সব মানুষই যে অনুদানজীবি – তা ভাবার কারন নেই। সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গে ৫০০ টাকা লক্ষ্মীর ভান্ডারের অনুদানের জন‍্য তৃণমূল জিতেছে ধরে নিলে বলতে হয়, গোয়ায় ৫০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও সেখানে তৃণমূলের খাতা না খুলতে পারার কারন কি? আসলে প্রতিটি রাজ‍্যের পরিস্থিতি, চাহিদা ভিন্ন। পাঞ্জাবে খালিস্তানি ফ‍্যাক্টর কাজ করেছে। সেই ফ‍্যাক্টর ইউপিতে না থাকায় সেখানে কাজ করেনি। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষতঃ মহম্মদ সেলিম সিপিএমের রাজ‍্য সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় এবং মমতা ব‍্যনার্জীর ” দুধেল খাই” নীতির প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের জেহাদী মুসলিম ভোট আপের দিকে যাওয়ার কোন কারন নেই।
সুতরাং, আপের সর্বাধিক বৃদ্ধি হয়ে গেছে। অন্ততপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অদূর ভবিষ‍্যতে তার রাজনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবণা নেই।

কলকাতা বইমেলা ও কিছু প্রশ্ন

৪৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা সবে শেষ হল। ১৯৭৬ সালে ময়দানে এখনকার মোহরকুঞ্জে প্রথম বইমেলা শুরু হয়। এটি প্রথমে ছিল কলকাতাস্থিত পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স গিল্ডের একটি প্রশংসনীয় উদ‍্যোগ। এই মূহুর্তে বইয়ের সম্ভারে এই আন্তর্জাতিক বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডনের বইমেলার পরেই। অবশ‍্য জনসমাগমের হিসেবে কুড়িলক্ষের বেশী হওয়ায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক বইমেলা।
আমি ১৯৭৬ সাল থেকে টানা প্রায় ত্রিশ বছর প্রতিটি বইমেলায় উপস্থিত থেকেছি। মেলার মূল উদ্দেশ‍্যের সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ করে বই পড়া ও কেনার আনন্দ উপভোগ করেছি। মনে আছে, ১৯৭৮ সালে, ভারতীয় আর্কিটেকচারের উপর একটি মূল‍্যবান প্রামাণ‍্য বই এক স্টলে রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কেউ আমায় বাধা দেয়নি – কেউ এগিয়ে এসে বলেনি বইটা দেব; অর্থাৎ, “না কিনলে সরে পরুন” গোছের ভাব – যা পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে। মেলার শেষ দিনে বইটা পড়ে যখন যথাস্থানে রাখছি, একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আপনার পড়া শেষ হল?” আমি তৃপ্তির হাসি নিয়ে বললাম,”হ‍্যাঁ”। উনি হেসে বললেন,” আমরা লক্ষ‍্য করেছি, আপনি রোজ এসে বইটা পড়েন। আপনার সুবিধার জন‍্য আমরা এই বইটা একই জায়গায় রেখেছি”। আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে বললাম,”ধন‍্যবাদ। আসলে এত দামী বই কেনার ক্ষমতা আমার নেই। তাই রোজ এসে আমি বইটা পড়ে নিলাম” – এই ছিল বইমেলার মর্মার্থ (spirit)। তখন বইমেলায় প্রবেশমূল‍্য লাগত পঞ্চাশ পয়সা! পরবর্তী সময়ে প্রবেশমূল‍্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সিজন টিকিটের বন্দোবস্ত হয়। ধীরে ধীরে বইমেলার কলেবর স্ফীত হতে থাকে। মানবিক মূল‍্যবোধের সামাজিক অবক্ষয়, যা রাজনীতির প্রত‍্যক্ষ‍ হস্তক্ষেপের আবহে এ রাজ‍্যে প্রসার লাভ করে, তা বইমেলাতেও ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হতে থাকে। ক্রমশঃ শুধু পাঠক নয়, উদ‍্যোক্তাদের চিন্তাধারায়ও অনেক পরিবর্তন আসে। ময়দানের পর, মিলনমেলা ঘুরে, এখন কলকাতা বইমেলার স্থায়ী জায়গা হয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক, বিধাননগর। বেশ কয়েকবছর মেলায় ঢুকতে কোন প্রবেশমূল‍্য লাগে না। আগে মেলার পাশে নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রাখার ব‍্যবস্থা ছিল – ঘন্টাপ্রতি কুড়িটাকা হিসেবে। এবারের অভিজ্ঞতা, মেলার উল্টোদিকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পার্কিং – সত্তর টাকা ঘন্টা, কোন রসিদ দেওয়া হয় না! এটা সরকার, পুলিশ ও গিল্ডের অগোচরে হয়েছে বলে কি মনে হয়? আসলে মেলা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র বদল হয়েছে। প্রথমে এই মেলায় স্টল দেওয়া যেত একমাত্র পাবলিশার হলেই – সাধারন বই বিক্রেতাদের স্টল দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ২০০০ সাল থেকে শুধু পাবলিশার্সরাই নয়, বই বিক্রেতারাও স্টল দিতে পারেন। এতে মেলায় অংশগ্রহণের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব অপেক্ষা অর্থনৈতিক লাভের আকাঙ্খা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা অন‍্যরকম প্রভাব মেলায় পড়েছে। মেলার দর্শক চরিত্র বদলে গিয়ে মেলার বই বিক্রির সংখ‍্যার কি বৃদ্ধি হয়েছে – এটাই মূল প্রশ্ন। কারন, বইমেলার উদ্দেশ‍্য দুটি – বইয়ের প্রকাশক ও ক্রেতা-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগের মাধ‍্যমে মতবিনিময় এবং বই পড়ার উৎসাহ প্রদান করা।
মেলার চাকচিক‍্য, ব‍্যাপ্তি ও প্রচারের ক্রমবৃদ্ধিতে গিল্ডের প্রয়াস যেমন মাণ‍্যতা পায়, তেমনি সরকারী দাক্ষিণ‍্য ও আনুকুল‍্য এর একটা বড় কারন। এখানেই বইমেলার সবচেয়ে বড় চরিত্রগত পরিবর্তন লক্ষ‍্য করা গেল। গত ৫০-৬০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমাজ জীবনে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কাজের ব‍্যাপারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবান্ছিত হস্তক্ষেপ সুবিদিত। সেজন‍্য আমাদের কলকাতা বইমেলা যত সরকারী দাক্ষিণ‍্যের বেড়াজালে নিজেকে সঁপে দিয়েছে ততই সে তার লক্ষ‍্য থেকে একটু একটু করে সরে গিয়েছে। রাজনীতির মোড়কে বইমেলাকে মুড়ে ফেলার উদ‍্যোগ রাজ‍্যসরকারের উচ্চতম স্তর থেকে শুরু হওয়ায় তা রোধ করার ক্ষমতা গিল্ডের ছিল না। গিল্ড সে চেষ্টাও করেনি। আবার বইমেলার ব‍্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম বৃদ্ধির ফলে এই মেলা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল মেলায় পরিণত হল! এর থেকে লাভের কড়ি সংগ্রহের বিভিন্ন রকম বন্দোবস্ত শুরু হল – আর তার ফলে বইমেলা তার চরিত্র খুঁইয়ে এক অদ্ভুত জনসমাগমের মেলায় পরিণত হল!
এবারের, অর্থাৎ ৪৫তম কলকাতা বইমেলায় দু বছর বাদে পা রেখে যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ‍্য করেছি, তা প্রথমেই বলি, বই ছাড়া অন‍্য জিনিষের প্রাচুর্য! যেমন, ভোজনরসিক বাঙ্গালীর জন‍্য ভারতীয়, চাইনিজ, ও আরো অনেক ফিউশানধর্মী খাবারের দোকান। পুরো মেলার মধ‍্যে এই দোকানগুলিতেই ক্রেতা ও ভোক্তার ভিড়। এছাড়া বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রয়াত মানুষজনের নামে মুক্ত ও বদ্ধ মঞ্চ! এগুলির কয়েকটি জায়গায় গিয়ে আমার উপলব্ধি – এগুলিতে ব‍্যক্তি বিশেষের আত্মপ্রচার ও বিশেষ ‘ইজম’ ভিত্তিক প্রচার হচ্ছে যা, বইমেলায় বই দেখতে ও পড়তে আসা মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন। এছাড়া, বইমেলায় পটশিল্পী তাঁর পট ও ছবির পসরা সাজিয়ে বিক্রির উদ্দেশ‍্যে বসেছেন! এমনকি জাঙ্ক জুয়েলারী বিক্রির দোকানও দেখেছি! যত মানুষ বই দেখছেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী মানুষ, বিশেষতঃ যুবক-যুবতীর দল মোবাইলে সেল্ফি তুলতে ব‍্যস্ত। বাবা-মার হাত ধরে খুঁদে পড়ুয়ার দল, যারা বই দেখে, গন্ধ আস্বাদন করে বই কিনত, তাদের সংখ‍্যা অতি নগণ্য। বইমেলায় নয়টি প্রবেশদ্বার থাকায়, প্রবেশমূল‍্য ব‍্যতীত এই মেলায় দর্শক সমাগমের সঠিক হিসেব পাওয়া সম্ভব নয়। তবে, একটি ব‍্যাপার পরিষ্কার – বইমেলা তার দর্শক চিত্রে বদল ঘটিয়েছে। এখন বই বিক্রেতা ত বটেই, প্রকাশকরা পর্যন্ত বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচিত হওয়ার সময় দিতে নারাজ – অনেকটা ভোগ‍্যপণ‍্যের বাজারের মত – ফেল কড়ি, মাখো তেল – গোছের! তাঁদের বই বিক্রি একমাত্র উদ্দেশ‍্য বলে মনে হয়। আবার বইমেলার ক্রেতা চরিত্রের আমূল পরিবর্তন নজরে আসে। বইমেলায় ঘুরতে আসা, সেল্ফি তোলা, ও বিভিন্ন খাবারের দোকানে ভিড় করা মানুষের সংখ‍্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পকেটমারও হাজির! এক অভিনেত্রী-কাম পকেটমার ধরাও পরেছে। আগে বইচোর (এদের চোর বলতে আমার দ্বিধা আছে) ধরা পরত – এখন ভোগের সামগ্রীর মেলার চরিত্র অনুযায়ী পকেটমার ধরা পরছে! এইসঙ্গে ভালো বই দেখা, কেনা ও পড়ার মানুষের সংখ‍্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিভিন্ন দেশের প‍্যাভেলিয়ানগুলির মধ‍্যে নজর কাড়ার কথা থিম কান্ট্রি বাংলাদেশের প‍্যাভেলিয়ানের। সেখানে ভিড় আছে। হয়ত তাদের বই বিক্রিও হচ্ছে। এখানে একটা কথা অবশ‍্যই বলা উচিৎ – বইমেলা আসলে বইয়ের সাথে পাঠকের পরিচিত হওয়ার মেলা। কারন, কলেজস্ট্রীটে বই কিনলে বইমেলায় দেয় ১০% এর বেশী ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু কলেজস্ট্রীটে বই বাছার ও বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সুতরাং, বই চয়ন করার জায়গা হল বইমেলা। বইমেলার এই রূপটাই এবারের বইমেলায় খুঁজে পাওয়া গেল না। উচ্চমধ‍্যবিত্তের ড্রইংরুমে সাজানোর জন‍্য বই কেনা ও সরকারী দাক্ষিণ‍্যে ‘অনুপ্রাণিত’ ছোট, বড়, মেজ, সেজ কিছু আধিকারিকের দাপাদাপি দৃশ‍্যমান! এর মধ‍্যে পুলিশের দায়িত্ব পালন যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের বইয়ের দাম টাকায় লেখা এবং বাংলাদেশের টাকার আন্তর্জাতিক মূল‍্যমান ভারতীয় টাকার তুলনায় কম। তবু তারা তাদের দেশের টাকার হিসেবে ভারতীয় টাকায় ১০% ছাড় দিয়ে তাদের বই বিক্রি করছে – অতিরিক্ত মুনাফা লাভের অনৈতিক প্রয়াস। এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। এই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সময় বাংলাদেশের ঢাকার দুটি জায়গায় তাদের সর্ববৃহৎ বইমেলা – ‘একুশে বইমেলা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কোন ভারতীয় প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই! এর কারন বোঝা যায়না – অংশগ্রহণে অসুবিধা কোথায়?
শুধু বাংলাদেশই নয়, আরো কয়েকটি দেশের প‍্যাভেলিয়ানে ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও বইয়ের সম্ভার দেখা যায়নি! আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুবিশাল প‍্যভেলিয়ান জুড়ে কোন বইয়ের দেখা পেলাম না। হতে পারে এদের উদ্দেশ‍্য অন‍্য! তবে, বইমেলার মূল উদ্দেশ‍্য, বইপড়ার চেতনাবৃদ্ধির কোন প্রচেষ্টা এসব জায়গায় দেখা যায়নি। এছাড়া, লিটল্ ম‍্যগাজিন ও ছোট ছোট পাবলিশার্সদের যে উৎসাহ, উদ্দীপনার মধ‍্যে স্টল দেওয়া এবং সেখানে উৎসাহী পাঠকদের আনাগোনা কয়েক বছর আগেও দেখা যেত, তা এখন সম্পূর্ণভাবে অদৃশ‍্য।
এবারের বইমেলায় ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ‘বইমেলা’ নামের একটি হুজুগে বিনোদনকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। অবশ‍্য নবীন ও প্রবীন লেখকদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান মেলা প্রাঙ্গনে হয়ে চলেছে অনেকটা বাহ‍্যিক আচার অনুষ্ঠানের মত – মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অভাব প্রায় সব ক্ষেত্রেই। এর থেকে কয়েকটি ব‍্যাপার সহজেই প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ, এই সময়ে লেখার ও বিষয়ের গুনাগুণের উপর জনপ্রিয়তা নির্ভর করেনা – করে, কোন সংবাদ-মাধ‍্যম প্রমোট করছে তার উপর! শুধু প্রবন্ধের ক্ষেত্রেই নয়, গল্প, উপন‍্যাস, কবিতা – সবক্ষেত্রেই তা প্রযোজ‍্য। ফলে গুণমানের অবমূল‍্যায়নের সাথে বই পড়ার অভ‍্যাস – বিশেষতঃ বাঙ্গালীর – নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন যেকোন মুদ্রিত বাংলা সংস্করণের বিক্রির সংখ‍্যা দেখলেই বোঝা যায়। গল্প-উপন‍্যাস এমনকি গান,কবিতায়ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির বদলে ‘ইজম’ এর বহিঃপ্রকাশ – যা মানুষের সৃজনশীলতাকে গোলাম বানানোর চেষ্টায় পরিণত হচ্ছে। এগুলো পাঠককে গেলানোর চেষ্টার অবিসম্বাদী ফল হল – বাঙ্গালী পাঠক ধীরে ধীরে বই পড়ার অভ‍্যাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
আবার বিভিন্ন রকম কারনে বইয়ের অস্বাভাবিক মূল‍্যবৃদ্ধি এই নেগেটিভ চিন্তাধারায় খানিকটা ইন্ধন জুগিয়েছে। পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মনন, চিন্তনের সুস্থ বহিঃপ্রকাশের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ‍্যম হল সৃজনশীল, রাজনীতিমুক্ত চিন্তা, যা লেখার মাধ‍্যমে আমজনতার কাছে পৌঁছায়। এক সময় এই কৃষ্টি-ঐতিহ‍্য বাঙ্গালীর ছিল। কিন্তু, বাংলার রাজনীতিমুক্ত চিন্তা-ভাবনা ও সৃজনশীলতার ঐতিহ্য যদি আবার কখনো ফিরে আসে, তাহলে বাঙ্গালী আবার তার বইপ্রীতির জগতে ফিরে আসবে। কারন, সামাজিক-মাধ‍্যম ও বৈদ‍্যুতিন-মাধ‍্যম কখনোই বইয়ের প্রতিস্থাপক নয়। তবে, সবচেয়ে প্রথমে ব‍্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দাক্ষিণ‍্যের মোহ ত‍্যাগ করে এই সৃষ্টির জগতকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। আমাদের সবার এই দায়িত্ব থাকলেও প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ডের।

বঙ্গ রাজনীতিতে জাতীয়দল ব্রাত‍্য

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ভারতের অন‍্য রাজ‍্যগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যে কারনে স্বাধীনতা উত্তর যুগে বিধান রায় ও প্রফুল্ল সেনের পর সর্বভারতীয় কোন দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সিংহাসনে বসতে পারেনি (সিদ্ধার্থ রায়ের ১৯৭২ সালের নির্বাচনে বিতর্কিত জয় বাদ দিলে)। এইজন‍্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চরিত্র ও চাহিদা বুঝে রাজনীতি না করলে এই রাজ‍্যে রাজনৈতিক সাফল‍্য পাওয়া দুষ্কর। যদি পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য গঠনের পর থেকে রাজনৈতিক পটভূমি ও ইতিহাসের দিকে তাকানো যায়, তাহলে শুরু থেকেই এ রাজ‍্যের বঞ্চনার ইতিহাসের কাহিনী পাওয়া যাবে। প্রথমে এ রাজ‍্যের সফলতম মূখ‍্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে নেহরু গোড়াতে ডঃ রায়কে এই চেয়ারে বসাতে চাননি – পরে অবশ‍্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বসাতে বাধ‍্য হয়েছিলেন। তারপর বহুবার রাজ‍্যের উন্নয়ণের প্রস্তাবে নেহরু সরকারের অসহযোগীতায় ডঃ রায় বিরক্তি প্রকাশ করেন। একবার তিনি তাঁর চিকিৎসার দ্বারা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে সুস্থ করার বিনিময়ে সে দেশের সরকারের থেকে রাজ‍্যের উন্নয়ণের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায‍্য গ্রহণ করেন! তখন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর অবিরাম বহমান স্রোতে পশ্চিমবঙ্গ দিশেহারা। যদিও পাঞ্জাবে একই রকম উদ্বাস্তু সমস‍্যা হয়েছিল, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায‍্যের পরিমাণ অনেক বেশী সদর্থক ও কার্যকরী হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক সেবা কাজে নিযুক্ত সেবামূলক সংস্থা সেখানে অনেক বেশী সক্রিয় ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘ ছাড়া আর কোন সংস্থা কার্যকরী সাহায‍্যের হাত বাড়ায়নি। তাছাড়া, ভারতের অন‍্য কোন রাজ‍্যকে এই রাজ‍্যের মত ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত সামলাতে হয়নি। এই দুবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের বদলা নিতে পাকিস্তান তাদের হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর চরম অত‍্যাচার করে দেশ ছাড়তে বাধ‍্য করে। পূর্বপাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার তাদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে উদ্বাস্তু হিসেবে হিন্দুরা ভারতে পালিয়ে আসতে থাকে। যদিও কিছু শরণার্থী আসাম ও ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন, তবু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের শতকরা নব্বইভাগের বেশী উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সত‍্য বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, নেহরু ও তাঁর পরবর্তী কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রীয়স্তরে যেমন এই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কোন সঠিক পরিকল্পনা করেননি, তেমনই তাঁদের জন‍্য কোন আর্থিক সাহায‍্য মেলেনি। রাজ‍্যের সরকারও সেভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ কিছু শরণার্থীকে পান্ডব বিবর্জিত, জনমানবশূণ‍্য, চাষের অযোগ‍্য শুখা জায়গা দন্ডকারণ‍্যে পাঠিয়ে এই সমস‍্যা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পশ্বিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলিও এদের হিন্দু-বাঙ্গালী পরিচয় এবং সেকারনেই উদ্বাস্তু হয়ে আসা হতভাগ্য মানুষদেরকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-বাঙ্গালী সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু সমাজে এদের বাংলা ভাষাগত উচ্চারণের পার্থক‍্যের কারনে এই হতভাগ‍্য মানুষদের বিদ্রুপ ও অবহেলার শিকার হতে হয়েছে! সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এদের সঙ্গে এপার বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীদের(এদেশী) আলাদা করার প্রয়াস করা হয় – পাঞ্জাবীদের সঙ্গে এখানেই বাঙ্গালীদের তফাৎ। এই অভাগা মানুষরা যখন ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হয়ে অর্থ, সম্পদ, মান-সম্মান, সমস্ত কিছু খুঁইয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তখন তাদের প্রতি সহমর্মীতা দূরের কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসহযোগীতা করা হয়েছে। এই বাস্তবতার এক অপ্রত‍্যক্ষ প্রমাণ হল পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় অস্বাস্থ‍্যকর পরিবেশে উদ্বাস্তু কলোনী গড়ে ওঠা – এই উদ্বাস্তু পরিবারদের বাঁচার সামাজিক মূলধন বলতে সংঘবদ্ধতাই একমাত্র অবশিষ্ট ছিল।
এই সময় পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিস্টরা রাজনৈতিক জমি শক্ত করার কাজে মনোনিবেশ করে। তারা এইসব উদ্বাস্তু পরিবারের থেকে কর্মী সংগ্রহ করার উদ্দেশ‍্যে এদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহার করতে শুরু করে এবং এদের উন্নয়ণের ও বাসস্থান এবং খাবার সংস্থানের জন‍্য সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। তখন উদ্বাস্তুরাও সরকারী এবং সামাজিক অবহেলায় সব আশা ভরসা হারিয়ে এদেরকেই খরকুটোর মত আঁকড়ে ধরে। তারপর কম‍্যুনিস্টরা যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলো তখন তাদের আদর্শগত দ্বন্দ সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ তৈরী হলো! সবচেয়ে বড় দ্বন্দের কারন, এই উদ্বাস্তু পরিবারের প্রায় সবাই কম‍্যুনিস্টদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভোটার আর এদের মধ‍্যে প্রচুর অল্পবয়সী সক্রিয় কম‍্যুনিস্ট কর্মী থাকলেও তাদের সকলের মুসলমান বিদ্বেষ ছিল – যা পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। এদিকে ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা শুরু থেকেই জেহাদী ইসলামের সমর্থন ও পাকিস্তানের পক্ষে সওয়াল করে আসছে; শুধু তাই নয়, আদর্শগতভাবে তারা হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের এই অবস্থান যে সমর্থন পাবে না – সেটা বুঝেই তারা এক অদ্ভুত শব্দ – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ – আমদানী করল। যদিও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইসলাম এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম স্বীকৃত নয়, তবু তারা এটি হিন্দুদের অবশ‍্য পালনীয় একটি কর্তব‍্য – যা তাদের কৃষ্টি ও সভ‍্যতার মেরুদণ্ড – এমন প্রচার শুরু করল! বেঁচে থাকার তাগিধে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি কোন আপত্তি করার সাহস পেল না।তারপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের (committed intellectuals) দিয়ে গল্প-উপন‍্যাস লেখানো, সিনেমা, থিয়েটার দেখানো ইত‍্যাদি শুরু হল যেখানে ইসলামী ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের প্রেম ও পরিণতিতে ইসলামী পরিবারের উদারতার কথা প্রচার করা হতে লাগল। যদি ভিন্ন ধর্মীয় ছেলে মেয়ের প্রেমের গল্প দেখানো হয়, সেখানে সমকালীন সাহিত‍্যে কোন হিন্দু ছেলের সঙ্গে ইসলামী মেয়ের প্রেম এবং সেখানে মেয়ের পরিবার ধর্মীয় উদারতা দেখিয়েছে – এমন একটি গল্প-উপন‍্যাস বা সিনেমা আমার চোখে পড়েনি। কম‍্যুনিস্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গে যে সব পরিবর্তন হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল দলদাস ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করা। এই বুদ্ধিজীবীরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হবেন এমন কোন কথা নেই – তবে তাদের দলদাস সংবাদ-মাধ‍্যম বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রচার করেছে আর এরাই দলের নীতি জনগনকে ‘গেলানো’র দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মাধ‍্যমেই বাঙ্গালী হিন্দুদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মাহাত‍্য বোঝানো শুরু হল। বঙ্গীয় হিন্দু বাঙ্গালীদের উদ্বাস্তু ও এদেশীরা উভয়েই ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্টদের এই চালে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ‍্য হল। সমাজজীবনে এবং অর্থনৈতিকভাবে কোন সাহায‍্য না পাওয়ায় যেমন সর্বভারতীয় দলগুলির থেকে বাঙ্গালীরা মুখ ফিরিয়ে নিল তেমনি কম‍্যুনিস্ট নিষ্পেষণ ও ভোটের হিংসা বাঙ্গালীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল। বাঙ্গালীর আল্ট্রা কম‍্যুনিস্টদের হিংসায় প্রতিবাদী চরিত্র অবধি নষ্ট হল। “কম‍্যুনিস্ট প্রচার নাৎসী প্রচারকেও হার মানায়” বলে প্রবাদ আছে। কয়েকবছর আগে চীনে গিয়ে আমি সাংহাইয়ের চাকচিক‍্যের আড়ালে জিয়ান থেকে বেজিংয়ের বিভিন্ন অনুন্নয়ণের ছবি দেখেছি। এনিয়ে ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের কথা বলতে দেখিনি। যেমন রাশিয়ার ইউক্রেনের উপর দখলদারীর আক্রমণ বিষয়ে কম‍্যুনিস্টরা আর তাদের প্ল‍্যান্টেড বুদ্ধিজীবীদের ভাষা বন্ধ হয়ে আছে!
আবার ২১শে ফেব্রুয়ারীকে বাংলা ভাষা দিবস বলে দলদাস বুদ্ধিজীবী – সংবাদ-মাধ‍্যমের পশ্চিমবঙ্গ আর সোশ্যাল মাধ‍্যম জুড়ে সেকি লাফালাফি! বাংলা ভাষা নিয়ে আমার জানা আন্দোলনগুলির কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল বাঙ্গালী জাতি হিসেবে শতধাবিভক্ত – ভাষা হিসেবেও তাই! বিশুদ্ধ বাঙ্গালী আর বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা – দুইই অস্তিত্বহীন! পশ্চিমবঙ্গে ভাষা দিবসের নামে যা হয়, তা অন‍্য একটি রাষ্ট্রের প্রচার মাত্র। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতীতত্ত্বের (হিন্দু ও মুসলমান) ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান, দুটি খন্ডিত অংশ নিয়ে পাকিস্তান তৈরীর পর থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানে এবং দুই অংশেরই রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম। এই ধর্মের সুযোগ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের লাঞ্ছনা ও ইজ্জত হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সর্বস্ব খুঁইয়ে ভারত ভূখন্ডে (প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গে) উদ্বাস্তু হয়ে আসার ঢল নামে। তাঁদের সম্পত্তি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা দখল করলেও আইন হিন্দুদের কোন সুরাহা দিল না (কুখ‍্যাত এনিমি প্রপার্টি আইন)। প্রথম ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে সংশোধনী এনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদায় সরকারী ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব পেশ করেন সংসদ সদস‍্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁকে সমর্থন জানান পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হিন্দু সদস‍্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টপাধ‍্যায়। যে কথা বলা হয় না তাহল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন‍্যান‍্য ইসলামী বাঙ্গালী সদষ‍্যরা, যারা মুসলিম লীগের সদস‍্য, তারা মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের নেতৃত্ত্বে বাংলা ভাষার জন‍্য আনা এই সংশোধনীকে বিরোধীতা করে খারিজ করেন। সুতরাং বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলন সে দেশের মুসলমান বাঙ্গালীর আন্দোলন নয়! গোল বাঁধল ১৯৫০ সালের পর – যখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে চাকরী ও অন‍্যান‍্য সরকারী সুবিধার জন‍্য একমাত্র উর্দু ভাষাকে স্বীকৃতি দিল। বাংলা ভাষা সরকারের কাছে শুধু গুরুত্বহীণ হয়ে গেল তা নয়, বাংলায় শিক্ষাপ্রাপ্ত উর্দু না জানা সিংহভাগ পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকের (ধর্ম নির্বিশেষে) ভাষার কারনে অর্থনৈতিক বৈষম‍্যের শিকার হওয়ার উপক্রম হল। তখন মুজিবুর রহমানসহ মুসলীম লীগ নেতারা প্রমাদ গুনলেন। এই কারনেই, মূলতঃ অর্থনৈতিক বঞ্চনার ভয়ে তাঁরা বাংলাকে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন শুরু করলেন। এটা ভাষা আন্দোলন নয় – উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানকে ভাতে মারার চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন। বহু বছর আগে ‘দি স্টেটসম‍্যান’ কাগজে প্রখ‍্যাত লেখক আব্দুল গফ্ফর খান এই লাইনেই একটি লেখা লিখেছিলেন। যে কারনে বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলনের পুরোধা গণপরিষদের হিন্দু সদস‍্যদের ২১শে ফেব্রুয়ারীর সম্মাননা অনুষ্ঠানে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় না। এটি উর্দুভাষী ইসলামীদের বিরুদ্ধে বাংলাভাষী ইসলামীদের ক্ষমতা দেখানোর লড়াইয়ের একটি অধ‍্যায়।
আবার দেখা যাচ্ছে, বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের অন‍্য যে রাজ‍্যে থিতু হয়েছে, সেখানেই তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন‍্য লড়াই করেছে। আসামে ১৯৬০-৬১ সালে যখন মূখ‍্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা রাজ‍্যে অহমীয়া ভাষাকেই একমাত্র সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, হিন্দু উদ্বাস্তু অধ‍্যুষিত বরাক উপত‍্যকার মানুষ তীব্র ক্ষোভে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে এই হিন্দু বাঙ্গালীদের ১১ জনকে অসম পুলিশের বাহিনী গুলি করে হত‍্যা করে। তারপর প্রতিবাদের আগুন তীব্রতর হওয়ায় চালিহা বরাক উপত‍্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে বাধ‍্য হন। এ সময় আন্দোলনে কোন বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহনের প্রমাণ মেলে না! পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলি ও ভাড়াটে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন অন‍্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলন বলে চালান; আর ১৯৬১র ১৯শে মে’র বাংলা ভাষার জন‍্য বাঙ্গালীর আত্মবলিদানকে ভুলে যান, তখন তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত ইসলামী সেকুলারিজমকে আপামর বাঙ্গালীর হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার গূঢ় অভিপ্রায় প্রতীয়মান হয়। এভাবে ছত্রিসগড়ের দন্ডকারণ‍্য, কর্ণাটকের রায়চুড় জেলা, বিহারের মানভূম ও ঝাড়খন্ডের শিকার জেলায় উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা পড়াশোনার মাধ‍্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনে ভাড়াটে সংবাদ-মাধ‍্যম ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনগুলিকে ভাষা আন্দোলন বলে না, কারন এগুলি তাদের এ‍্যাজেন্ডায় নেই!
ভারতে বাংলা ভাষার জন‍্য যে কটি আন্দোলন হয়েছে, তার সবকটিই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীর নেতৃত্বে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কুটচালে এই বাংলার ‘এদেশী’ বাঙ্গালী এই আন্দোলনে কখনো সামিল হননি। এর কারন একটাই, কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল দল ত বটেই, পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত বামপন্থীরাও তাদের রাজনৈতিক সুবিধার জন‍্য সামাজিক পরিবেশে হিন্দু বাঙ্গালীদের বিভক্ত করে রেখেছে। অথচ, এরাই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও কার্যকরী শিক্ষার উন্নতি না করে শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে মুসলমান সমাজকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে।
এইভাবে ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্ট প্রভাবে রাজনীতি বাঙ্গালীর সমাজনীতিতেও ঢুকে গেল। রাজ‍্যের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনে কেন্দ্রের ঔদাসীন‍্য এবং কম‍্যুনিস্ট দলতন্ত্র কায়েমের ঘটনা রাজ‍্যের সাধারন মানুষকে সরকারী তথা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ‍্য নির্ভর করে তুলতে বাধ‍্য করল। প্রথমে উদ্বাস্তু পরিবারের জন‍্য হলেও পরে রাজ‍্যের অর্থনীতির বন্ধ‍্যাত্বের কারনে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীই সরকারী দাক্ষিণ‍্য ও ভাতাজীবী হওয়ার দিকে ঝুঁকে গেল। কম‍্যুনিস্টদের নেতৃত্বে যখন প্রকৃত ভদ্রলোক বাঙ্গালী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এলেন এবং তিনি ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার আফিমের বদলে বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করলেন। তখন বাঙ্গালীর মানসিক গঠনের পরিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ায় বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোটে বামপন্থী দলকে হটিয়ে মমতা ব‍্যানার্জীর আঞ্চলিক দলকে রাজ‍্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলো। ইতিমধ্যে ভোটে হিংসা ও সরকারী প্রশাসনকে ব‍্যবহার করে বারবার নির্বাচন জেতা কম‍্যুনিস্টদের অত‍্যাচারে হিন্দু-মুসলমান সবারই মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। শুধু বুদ্ধদেববাবুর সততা ও সমাজের উন্নয়নের প্রকল্প ব‍্যর্থ হল! মমতা ব‍্যানার্জী ক্ষমতা দখলের পর কম‍্যুনিস্ট কায়দায় প্রশাসন ও সংবাদ-মাধ‍্যমকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে দলদাসে পরিণত করে একই কায়দায় নির্বাচনে বিভিন্ন পর্যায়ের অসততা ও ভীতির আশ্রয় নিয়ে তাঁর দলের জয়লাভ সুনির্দিষ্ট করলেন! কখনো কেন্দ্রীয় সরকারের কোন সদর্থক পদক্ষেপ না থাকায় এবং জাতীয় দলগুলির নেতৃত্বকে এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোন কার্যকরী সাহায‍্য না করায় তাদের রাজ‍্য নেতৃত্ব রাজনৈতিক জোকারে পর্যবসিত হলেন! এতে অবশ‍্যই তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজ‍্য নেতৃত্ব ও রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কুটনীতির সাফল‍্য দায়ী – ক্ষতি অবশ‍্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীর। মমতাদেবী পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে সরকারী দাক্ষিণ‍্য নির্ভর হিন্দু বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার অক্সিজেন হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করলেন – সঙ্গে অবশ‍্যই ইসলামী ধর্ম নিরপেক্ষতার তাস খেলতে লাগলেন। তার বড় কারন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারনে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামী ভোটারের সংখ‍্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কম‍্যুনিস্টদের কায়দায় তিনিও তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চরিত্রের মধ‍্যে তফাৎ ঘুচিঁয়ে দিয়ে দল ও প্রশাসনকে সমার্থক করার প্রয়াস করলেন।
আমরা বাঙ্গালী হিন্দুরা এখনো ঘটি, বাঙ্গাল, অসমীয়া বাঙ্গালী, বিহারী বাঙ্গালী, প্রবাসী বাঙ্গালী ও সেকুলার বাঙ্গালী ইত‍্যাদি মেরুদন্ডহীণ কয়েকটি ক্লীবশ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ‍্যে তুচ্ছ দলাদলিতে মগ্ন – সমষ্ঠীস্বার্থ সম্পর্কে জ্ঞানহীন জীব হয়েই রইলাম। কিন্তু ইসলামীরা, বাঙ্গালী হোক বা না হোক – প্রথমে তারা ইসলামী, শেষেও তারা ইসলামী। তাদের কাছে হিন্দুরা “মালাউন”। সুতরাং হিন্দু-মুসলিম সামাজিক ঐক‍্য সোনার পাথরবাটি মাত্র – ধর্মকে কার্যকরীভাবে ভুলতে পারলেই শুধু বাঙ্গালী ঐক‍্য সম্ভব। এখন তার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মধ‍্যে কোন জাতিগত একতা না থাকায় বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদের বোধও তৈরী হয়নি। সেজন‍্য জাতীয় স্বার্থ, বিদেশনীতি, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বাঙ্গালীর বর্তমান প্রজন্মের মধ‍্যে অনুপস্থিত। ভাতাজীবী বাঙ্গালী, ও ইসলামী ঐক‍্যের সমন্ধয়ে বাঙ্গালীর থেকে কোন জাতীয়তাবাদী বা সর্বভারতীয় দলের সমর্থন পাওয়ার কথা নয়, কারন, বাঙ্গালী নিজের মূল থেকে উৎপাটিত হওয়ায় তার মধ‍্যে ভারতীয়ত্ব খোঁজা বাতুলতা মাত্র। সেজন‍্য সুবিধাবাদী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাফল‍্য পাওয়া অদূর ভবিষ‍্যতে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। বাঙ্গালীর ভবিতব‍্য গর্বিত ক্রীতদাসের ভাতাজীবী জীবন!

শিক্ষায় মাৎস‍্যন‍্যায় চলছে চলবে

মেকলে প্রবর্তিত ভারতে শিক্ষানীতির অভিমুখ ছিল ভারতীয়দের ইংরেজী ভাষাজ্ঞান দিয়ে তাদের করনিকবৃত্তির জন‍্য তৈরী করা। কারন ইংরেজ শাসকের বুদ্ধির সঙ্গে নেটিভ হাতের মেলবন্ধন এই বিশাল দেশকে শাসনের জন‍্য দরকার ছিল। স্বাধীনতার পরে নেহরুভিয়ান নীতির প্রভাবে গঠিত শিক্ষানীতির অভিমুখ বদলে হয়ে গেল “সমাজবাদী শিক্ষা” তার সঙ্গে শিক্ষার গণতন্ত্রীকরনের নামে শিক্ষার রাজনীতিকরন!
ব‍্যাপারটা খোলসা করে বলতে গেলে বলতে হয়, শুরু থেকেই ভারতে শিক্ষার অভিমুখ ভুল দিকে গিয়েছে। নেহরুর একটা রোমান্টিক বন্ধন ছিল ‘সমাজবাদী’ কথাটার উপর! তাঁর কন‍্যা এবং পৌত্রের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে “সাম‍্যবাদী” “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে জেহাদী মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছিল। শিক্ষার অঙ্গনে এই নীতির প্রবেশের ছাড়পত্র সরকারী আনুকুল‍্যেই শুরু হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতার অব‍্যবহিত পরবর্তী পর্যায়ে বুনিয়াদী ও প্রাথমিক শিক্ষায় জোর দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা অবহেলা করে শিক্ষাখাতে খরচের সিংহভাগ নিয়োজিত হল IIT, IIM স্থাপনে! একটি বাড়ি তৈরী করার সময় ভিতের দিকে নজর না দিয়ে প্রথমেই উচ্চতম তলের নির্মানের চেষ্টা হলে বাড়ির যে অবস্থা হয়, আমাদের শিক্ষা ব‍্যাবস্থারও সেই হাল হল। একটি জাতির ভিত সুদৃঢ় করতে প্রয়োজন তার উৎকৃষ্ট ও সর্বব‍্যপী প্রাথমিক শিক্ষা ব‍্যবস্থা। ইউরোপ, বিশেষতঃ ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, এমনকি এশিয়ার জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর তার উদাহরণ। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে প্রাথমিক স্তর থেকে সার্বজনীন শিক্ষার জন‍্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। Top heavy শিক্ষাব‍্যবস্থায় অর্থব‍্যয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা সমাজের সার্বজনীন উপকারে আসেনি। তাছাড়া, দেশের সুদীর্ঘ সময়কালের শাসক পরিবারের ধারনা ছিল, শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের শিক্ষার উপরে জোর দিলেই স্বাক্ষরতার হার বাড়বে! এই ধারনা রাজনৈতিক ফয়দা নেবার চেষ্টায়। তাদের ধারনা ছিল আমজনতার স্বাক্ষরতা পাওয়া শিক্ষায় মোক্ষলাভ। উচ্চশিক্ষা elitist মাত্র! এই ধারনার বশবর্তী হয়ে ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষার মাদ্রাসা খুলতে সরকারী দাক্ষিণ‍্য মঞ্জুর করা হল। আবার শিক্ষা ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্টদের নিয়ন্ত্রনাধীন হওয়ায় তারা তাদের রাজনৈতিক এ‍্যজেন্ডাগুলি রূপায়নের জন‍্য শিক্ষা বিভাগকে আঁকড়ে ধরল।
শুরু হল শিক্ষার জেহাদীকরন! মাদ্রাসা শিক্ষার রাশ ইসলামী শিক্ষাবিদদের হাতে না গিয়ে তা গেল মোল্লা, মৌলভী যারা ভারতবিদ্বেষী ত বটেই, হিন্দুবিদ্বেষীও বটে, তাদের হাতে। সেখানে প্রকৃত সহিষ্ণুতার শিক্ষা, যা ইসলামের একটি মূল কথা, না শিখিয়ে ছাত্রদের মধ‍্যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদের বীজ রোপনের প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে সাফল‍্য পেতে শুরু করল। কাশ্মীর ও বালুচিস্তান সম্পর্কে নেহরুর অহংকারীভাবে নেওয়া নির্বোধ নীতির ফলে ভারতে জেহাদীর সংখ‍্যা বাড়তে লাগল। সঙ্গে চলল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন। ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা শুরু থেকেই জেহাদী ইসলামের সমর্থক ও হিন্দুধর্মের বিরোধী হওয়ায় দেশে শিক্ষা ব‍্যবস্থায় ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার আমদানী করা হল। দেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের শুরু থেকেই হিন্দুদের ধর্মীয় ঐতিহ‍্য পালনের সুযোগ সাধারন স্কুলগুলিতে কমিয়ে বা বন্ধ করে দেওয়া হল। কিন্তু মুসলমানদের স্কুলে ধর্মপালনের ব‍্যাপারে বাধা ত নয়ই, বরং উৎসাহ দেওয়া হতে লাগল। একথা মনে রাখা দরকার যে এ কাজ ভারতের হিন্দু-মুসলমান সাধারন মানুষরা করেনি। সরকারে অধিষ্ঠিত কংগ্রেস দল তাদের সহযোগী কম‍্যুনিস্টদের সঙ্গে মিলে এভাবে শিক্ষায় ধর্মীয় মেরুকরন শুরু করল।
কিন্তু দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থায় বুনিয়াদী থেকে উচ্চতম স্তর অব্দি নির্দিষ্ট সিলেবাস গলাধঃকরন করে পরীক্ষার সময় যে ছাত্র সেটা যত বেশী উগরে দিতে পারবে তার নম্বর তত বেশী! এই শিক্ষায় আর যাই হোক, বোধবুদ্ধির বিকাশ হয় না – স্বাধীন চিন্তার বিকাশও হয় না। এর ফলে দেশের শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশকে আজগুবি ধর্মনিরপেক্ষতার এবং সাম‍্যবাদের ছাঁচে ঢালাই করে নিতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের পক্ষে সহজ হল। আর সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ভারতীয়ত্বের শিক্ষা না পাওয়ায় দেশের মানুষের মধ‍্যে জাতীয়তাবাদের (nationalism) বোধ কম বা অবলুপ্ত হল। ফলে চরিত্র গঠনের শিক্ষার অভাবে দেশে সমস্ত স্তরে দূর্ণীতি মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেল।
বিশেষতঃ সমাজসেবার নামে নির্বাচনে জিতে কে কত সরকারী অর্থ আত্মস্মাৎ করতে পারে তার জন‍্য হিংস্র প্রতিযোগীতা শুরু হল। ইসলামী ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় ধীরে ধীরে দেশে জেহাদী হিংসা ও তার বিপরীতে হিন্দু প্রতিরোধ বৃদ্ধি পেল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও এই হিন্দুস্তান অর্থাৎ ভারতে ইসলামকে অতিরিক্ত সুবিধা ( এটা মনে রাখা দরকার, শুরুতে ভারতীয় মুসলমানরা অতিরিক্ত কোন সুবিধা দাবী করেনি) দিয়ে জেহাদের রাজনীতি শুরু করার দায়িত্ব পুরোপুরি নেহরু ও পরবর্তী সব কংগ্রেস সরকারের। এর ফলে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মুসলমান নাগরিকরা। একদিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে জেহাদী ও তাদের সহযোগীরা ভারতের অস্তিত্বের মূলে আঘাত করছে, প্রতিবেশী রাস্ট্রের পক্ষে নাড়া লাগাচ্ছে; অন‍্যদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যা এই সব ভারতীয় মুসলমানদের রক্তে। কিভাবে ধান্দাবাজীর রাজনীতি দেশকে বিষিয়ে দিয়েছে তার একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ফারুখ আবদুল্লার মেয়ে একজন হিন্দুকে বিয়ে করার পর ফারুখ তাঁর জামাইয়ের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের নির্দেশ পাঠালে জামাই তাতে অসম্মত হন। তখন রুষ্ট ফারুখ আবদুল্লা তাঁর মেয়েকে ত‍্যাজ‍্যকন‍্যা ঘোষণা করেন। এই ফারুখ আবদুল্লা আবার কোলকাতায় এসে মঞ্চ আলো করে হাতে হাত মিলিয়ে বিরোধী ঐক‍্যের জন‍্য ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দেন! এইসব তথাকথিত বিরোধী নেতা নেত্রীদের সঠিক শিক্ষার অভাবে এরা সচেতনভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে নিজেদের ক্ষুদ্রব‍্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উপায় খোঁজেন। সরকার বিরোধী আন্দোলন কখন যে দেশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, তা বোঝার ক্ষমতা এদের অশিক্ষা-কুশিক্ষার কারনে সম্ভব হয় না।
এখন কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক দলের সরকার আছে তারা নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করলেও এখনো তার বাস্তবায়ন হয়নি।এই শিক্ষানীতিতে পূর্বের দূর্বলতাগুলি দূর করে প্রাথমিক স্তর থেকে মেধার বিকাশ ও সেইসঙ্গে জাতীয় ঐতিহ‍্যের উত্তরাধিকার বহন করার শিক্ষা দেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। শুভ প্রস্তাব – বাস্তবায়নের আশায় রইলাম। এখানে প্রাথমিক স্কুলশিক্ষা অবৈতনিক করার প্রস্তাব রাখা হলেও তা বাস্তবায়নের পরিকাঠামো নির্মাণ এই মূহুর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের জন‍্য সরকারের যে ভূমিকা দরকার তা কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্য সরকারের মধ‍্যে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষা নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ব‍্যবসা। এর থেকে দুধ দোয়ানোর জন‍্য সব পক্ষই উদগ্রীব। গত ৩৫-৪০ বছরে শিক্ষকদের, বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষায়, বেতন যেমন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, সে অনুযায়ী শিক্ষকদের শিক্ষাদান অপেক্ষা দলীয় কাজে সময় দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। বিশেষতঃ কম‍্যুনিস্ট শাসিত রাজ‍্যগুলিতে এই প্রবণতা বেশী থাকলেও অন‍্যান‍্য দল শাসিত রাজ‍্যগুলি তার ব‍্যতিক্রম নয়। এর সবচেয়ে বড় কারন শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতি। কোথাও দলদাস নিয়োগ হয় ত কোথাও অর্থ বা অন‍্য কিছুর বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে! এক্ষেত্রে যোগ‍্যতা ধর্তব‍্যের মধ‍্যে আনা হচ্ছে না। এদিকে বিভিন্ন রাজ‍্য সরকারের বিভিন্ন স্তরের নিয়োগের জন‍্য বিভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ কমিশন আছে। তার ফলে, অল্প হলেও যেমন খুশী তেমন নিয়োগে অসুবিধা হচ্ছে – বারবার আদালতের আদেশে সরকারের মুখ পুড়ছে। এই অসুবিধা সব রাজনৈতিক দলের। সেজন‍্য বিভিন্ন রকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে! নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের ট্রেণিংয়ের কথা বলা হলেও তাদের নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ কিছু বলা নেই। অবশ‍্য এ বিষয়ে বলার কথা UGCর। কিন্তু UGCর সাম্প্রতিক একটি বিজ্ঞপ্তি – ন‍্যাশনাল হায়ার এডুকেশান কোয়ালিফিকেশান ফ্রেমওয়ার্কের খসড়া তারা সব রাজ‍্যকে পাঠিয়ে গত ১৩ই ফেব্রুয়ারির মধ‍্যে মতামত জানাতে বলে! সঙ্গে হায়ার এডুকেশানের ইন্সটিটিউশানাল ডেভেলপমেন্ট প্ল‍্যানেরও খসড়া পাঠানো হয়। শিক্ষায় রাজনীতিকরনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই খসড়া ও তাতে রাজ‍্যের প্রতিক্রিয়া।
এখানে একটি ব‍্যাপার লক্ষ‍্যণীয় – তা হল, কংগ্রেসী রাজত্বে শিক্ষা যে মানুষের মস্তিষ্ক ও চরিত্র গঠনের ট্রেণিং নয়, শুধুমাত্র কম‍্যুনিস্ট ধারনা মোতাবেক মানব সম্পদ উন্নয়নের জন‍্য, তা বোঝাতেই দপ্তরের নাম পাল্টে মানব সম্পদ উন্নয়ণ দপ্তর করা হয়! আমার আগের ধারনার সঠিক প্রতিফলন এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া, বৈচিত্র্যের মাঝে সমন্বয়ের জন‍্য যে দপ্তর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, তা নির্বোধের মত কেন্দ্র-রাজ‍্য উভয়ের যৌথ নিয়ন্ত্রণে এল। কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না – এর ফলে প্রতিটি রাজ‍্য এবং কেন্দ্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই দপ্তরকে ব‍্যবহার করার সুযোগ পেল।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষাকে তার পরিচিত সেট-আপের থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। তাদের পূর্ববর্তী সরকারের অনুগত শিক্ষক বাহিনী শিক্ষার জগতে তাদের রাজনৈতিক চেতনার উত্তরসূরী হিসেবে ছাত্রকুলকে দীক্ষিত করার কাজকে শিক্ষক হিসেবে প্রধান কর্তব‍্য বলে মনে করতেন। এছাড়া এই শিক্ষককুল তাদের পক্ষে সমাজে যতটা রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতেন, তার থেকে প্রকৃত শিক্ষাদানে ব‍্যপৃত থাকতেন অনেক কম সময়! সেজন‍্য এই সরকার তাদের প্রভাব খর্ব করার জন‍্য কয়েকটি পদক্ষেপ করে। প্রথমে তারা নিজেদের প্রতি অনুগত শিক্ষকদের বিশেষ বিশেষ চেয়ারে, যেমন, উপাচার্য, প্রিন্সিপাল বা প্রধান শিক্ষক পদে বসাতে শুরু করেন। অবশ‍্য এ কাজ এখন সারা দেশ জুড়েই চলছে। এটা পরিষ্কার বোঝা যায় এই খসড়া পাঠানোর মধ‍্যে দিয়ে। এখন আমাদের রাজ‍্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায় শিক্ষক সংখ‍্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। সেজন‍্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মেয়াদবৃদ্ধি থেকে ধরে বিভিন্ন নাম দিয়ে শিক্ষিত যুবকদের অত‍্যন্ত কম বেতনে নিয়োগ করা হচ্ছে। এতে সরকারের অর্থ শিক্ষায় ব‍্যয় না করে অন‍্য খাতে ব‍্যয় করা, বেকারদের সরকারী নীতির দ্বারা শোষণ করা এবং চাকরীর স্থিরতায় প্রশ্ন চিহ্ন রেখে তাদের দলদাস হিসেবে ব‍্যবহার করা, বিভিন্ন নিয়োগ আয়োগকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা – এতগুলি উদ্দেশ‍্য সাধিত হল! বিনিময়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মান নষ্ট হল। নিকৃষ্টমানের শিক্ষক নিয়োগে নিকৃষ্টমানের শিক্ষাদান হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কিছু এসে যায় না। শিক্ষা যে ব‍্যবসা নয়, তা দেশের নেতারা আজও বোঝেননি। ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকারের আমলে ঘোষিত শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ছিল ১:১৮। এখনো কাগজে কলমে তাই। কিন্তু এই খসড়ায় বিজ্ঞান ছাড়া অন‍্য বিভাগে১:৩০ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগে ১:২৫ মাত্র। তা হলে যেসব রাজ‍্যে এবং কেন্দ্রীয় সংস্থায় শিক্ষক সংখ‍্যা ভালো তাদের ব‍্যাপক ছাঁটাইয়ের পথে যেতে হবে! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারে এই অনুপাতের চেয়েও শিক্ষকসংখ‍্যা কম এবং যারা প্রতিনিয়ত শিক্ষায় সংকোচন করে চলেছে তারা একই পথের পথিক হয়ে এই খসড়া প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছে – যা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক বাধ‍্যবাধকতায়। অর্থাৎ প্রতিবাদ করার জন‍্য প্রতিবাদ। এটা শিক্ষা নিয়ে চরম রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রতিফলন। আশ্চর্যের বিষয়, সব সরকার বিশাল বিশাল অট্টালিকা বানাচ্ছে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর জন‍্য! কিন্তু অধিকাংশ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ণের সঠিক পরিকল্পনা বা তার রূপায়ন হচ্ছে না।
এভাবে শিক্ষায় রাজনীতিকরন ও সরকারী উদাসীনতার ফলে এখন শিক্ষা বিভাগের পরিচালনা করা যে অসম্ভব হয়ে পড়েছে তা সব সরকারই বুঝতে পারছে। সেজন‍্য নিজেদের তৈরী করা সংকট থেকে মুক্তিলাভের জন‍্য তারা শিক্ষা সংকোচন ও তার বেসরকারীকরনের রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করবে। যদিও নতুন শিক্ষানীতিতে স্কুলশিক্ষার বেসরকারীকরন করার কথা বলা নেই, উচ্চশিক্ষায় কিন্তু সরকারের তরফে বেসরকারী বিনিয়োগ করতে আপত্তি থাকছে না। আমি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকায় দেখেছি, অধিকাংশ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান সরকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক নিচে। তাছাড়া এইসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও শিক্ষার খরচ অত‍্যন্ত বেশী, এদের অবকাঠামোর মানও অত‍্যন্ত খারাপ। শিক্ষার খরচ প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধারণ মধ‍্যবিত্ত মানুষের আয়ত্তের বাইরে! আমাদের দেশে এখনো পযর্ন্ত যে সব বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ‍্য। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বিপদ আরো বড়। এখানে এখনো পযর্ন্ত সরকারের চিন্তাভাবনার স্তরে আছে স্কুল শিক্ষার বেসরকারীকরন। এতে দুন স্কুলের মত প্রথম সারির বিদ‍্যালয় হয়ত ভবিষ‍্যতে হবে শুধুই উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাশালীদের জন‍্য। সাধারন মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু স্কুল শিক্ষার সংকোচন অবশ‍্যম্ভাবী। পরিশেষে বলি, একটি জাতিকে শেষ করার জন‍্য বিনা অস্ত্রে – শুধুমাত্র তাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে ধ্বংস করাই যথেষ্ট। আর কম‍্যুনিষ্টদের জানাই, মাও-জে-দং চীনের ক্ষমতা দখলের পর যে দুটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা হল খাদ‍্য এবং শিক্ষা।

স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি কার স্বার্থে

আমাদের দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থা ও শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বেড়ে চলেছে – কেন্দ্র, রাজ‍্য উভয়ক্ষেত্রেই। তবু অন‍্যান‍্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার অন‍্যান‍্য পীঠস্থানগুলি উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; সেখানে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান এবং তাদের বিশ্বের অন‍্যান‍্য দেশের নিরিখে র‍্যাঙ্কিংয়ের অধোগমন অব‍্যাহত। এর কারন অনুসন্ধানের জন‍্য প্রথমেই যা লক্ষ‍্য করা গেল তা হল, শিক্ষাঙ্গনকে উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতির আঁতুরঘর বানানো। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ – ইউরোপ, আমেরিকায় – উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গনে বিচরণ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই দেশের মত শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির জন‍্য ব‍্যবহার করার বিষয় কোথাও দেখতে পাইনি।
প্রথম থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর নাম মৌলানা আবুল কালাম আজাদ – যিনি ভারতে নয়, মধ‍্যপ্রাচ‍্যে শিক্ষালাভ করেন। এই নিয়োগের মধ‍্যে দিয়েই শিক্ষাকে অবহেলা করার সূত্রপাত হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী – কারোর বলার মত শিক্ষাগত যোগ‍্যতা না থাকায় তাঁরা শিক্ষামন্ত্রকের বিষয়ে উন্নতির জন‍্য নীতিগত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারন মোতাবেক নিতেন। এই সময়, অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের পরের দিকে এবং রাজীব গান্ধীর পুরো সময়ে ও তারপরেও দলের হাল রাজীবের পত্নী সোনিয়া গান্ধীর হাতে থাকার সময়ে ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ন্ত্রণ করার মত জনসমর্থন না থাকলেও ভারতের বামপন্থীরা, বলা ভালো, কম‍্যুনিস্টরা বিভিন্ন বিভাগে কংগ্রেসের দালালী করার মধ‍্যে দিয়ে ক্ষমতার মধুভান্ডের ভাগ এবং বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের বিষয়ে তাদের জায়গা দেওয়ার ব‍্যাপারে সফলভাবে লবিং করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে হয়ত গান্ধী পরিবারের ধারনা ছিল – এই দপ্তরে কোন উল্লেখযোগ্য মধুভান্ড নেই! সেজন‍্য সমাজবাদীর ভেকধারী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী শিক্ষার নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ণে তাঁদের কাছের কম‍্যুনিস্টদের উপরেই নির্ভর করেছিলেন। এর আগে একাধিক লেখায় দেখানো হয়েছে যে, তাসখন্দে ১৯২০ সালে ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম দিন থেকেই এরা জেহাদী ইসলামকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। ক্রমে ভারতের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে এবং পরে স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে হিন্দু গণহত‍্যার নিন্দা না করে ও পাকিস্তান গঠনের জন‍্য ভারতের মধ‍্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এরা নিজেদের ভারত বিরোধী চরিত্রের প্রমাণ দেয়। ২২শে আগস্ট, ১৯৪৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় তদানীন্তন কম‍্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীর বক্তব‍্য প্রচারিত হয়, যেখানে তিনি জেহাদী মুসলিম তোষনের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি এ‍্যটলী অব্দি পি সি যোশী ও তাঁর কম‍্যুনিস্ট পার্টিকে বৃটিশদের সহযোগী বলেছেন। কম‍্যুনিস্টদের INA ও সুভাষচন্দ্র বসুর বিরোধীতা, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের বিরোধীতা, হিন্দু ও তাদের জন‍্য লড়াই করা হিন্দু মহাসভার নেতা শ‍্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিরোধীতা এবং সেইসঙ্গে জিন্নার মুসলিম লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসার বহু নিদর্শন আছে। একটি ব‍্যাপারে কম‍্যুনিস্টদের প্রশংসা করতে হয় – যতই ভারত ও হিন্দুবিরোধী এবং জেহাদী মুসলিমদের, বিশেষতঃ ভারতের বিরুদ্ধে লিপ্ত জেহাদীদের সমর্থন করার ফলে তাদের ভারতীয় রাজনীতিতে জনভিত্তি ক্ষীয়মাণ হতে থাকুক, তারা তাদের এই ভারতবিরোধী নীতি থেকে বিচ‍্যুত হয়নি।
এবার শিক্ষার ব‍্যাপারে কংগ্রেসী পরিবারতন্ত্রের কৃপায় তাদের প্রবেশকে তারা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের এজেন্ডা ও নীতির প্রসারে ব‍্যবহার করতে লাগল। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত‍্যেকটিতে শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র মানদন্ড ছিল কোন কম‍্যুনিস্ট দলের প্রতি বিশ্বস্ততা! এমনকি উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ পদগুলিও এভাবে পূর্ণ করা হতে লাগল। ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করার সময় এক কম‍্যুনিস্ট দলের অন‍্যতম শীর্ষ নেতার জামাইকে আই আই এম আহমেদাবাদের ডিরেক্টর পদে বসানো হল। এটা একই সঙ্গে কম‍্যুনিস্টদের গুণ এবং বিরোধীদের অপদার্থতা যে, ধীরে ধীরে শুধু কম‍্যুনিস্ট শিক্ষক নিয়োগই নয়, বিভিন্ন বিষয়, বিশেষতঃ ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত বিষয়গুলির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস নিজেদের মত করে বদলে ফেলতে লাগল। যেমন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ঢোকানো হল চীন ও রাশিয়া। ইতিহাসের স্কুল লেভেল থেকেই সিলেবাসের অভিমুখ বদলে দেওয়া হল। ১২শ শতাব্দীর আগের, অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের গুরুত্ব সিলেবাসের ভার কমানোর নামে কমিয়ে দেওয়া হল। বাড়ানো হল ইসলামী যুগের ইতিহাস। এটার উদ্দেশ‍্য, দেশের হবু নাগরিকদের মধ‍্যে যাতে জাতীয় অস্মিতার বোধ তৈরী না হয় – তাহলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রভাব তাদের মধ‍্যে পড়বে না। তাছাড়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগ্রামকে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকরভাবে দেখানো হল। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন ছিল বিনা প্ররোচনায় আক্রমণকারী – একথা অনুচ্চারিত থেকে গেল। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে ভারতের কৃষ্টি ও সভ‍্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হল বিদেশী সভ‍্যতাকে – আধুনিকতার নামে এইভাবে দেশের নতুন প্রজন্মের ব্রেনওয়াস করা শুরু হল। অদ্ভুত একটি দলিত-মুসলিম ঐক‍্যের তত্ত্ব প্রচার করা শুরু হল। এই চেষ্টা প্রথমে দলিত সম্প্রদায়কে ভারত বিদ্বেষী করার জন‍্য মুসলিম লীগের প্রচেষ্টা ছিল। এভাবে মিথ‍্যা প্রচার সম্বৃদ্ধ কিম্ভুত কিমাকার সিলেবাসে শিক্ষা পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের মধ‍্যে দেশাত্মবোধক চেতনার বিকাশ পরিকল্পিতভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল। এইসঙ্গে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পাঠ নেওয়া হিন্দু ছাত্ররা নিজেদের ধর্মকে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি অন‍্য ধর্ম অর্থাৎ ‘ইসলাম’কে সম্মান জানানো তাদের আধুনিক শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে দেখতে লাগল। বিশেষভাবে কম‍্যুনিস্ট শাসিত কেরল, বাংলা ও ত্রিপুরায় এবং তার সাথে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলিতে এদের দাপাদাপি বেড়ে গেল। একটু লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায় যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বামপন্থী রাজনীতির আঁতুরঘর বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন JNU, হায়দ্রাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। গত দু এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংবাদের শিরোনামে এসেছে শুধুমাত্র অ-শিক্ষাজনিত দেশবিরোধী রাজনীতি ও বামপন্থী এ‍্যজেন্ডার সমর্থনে আন্দোলনকারী হিসেবে।
এখানে অল্প কথায় বলে নিই – এই একই সময়ে একটি নতুন বিষয় দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলিতে চালু হয় – জার্নালিজম ও মাস কম‍্যুনিকেশান। সংগঠনবৃদ্ধির পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে এই বিষয়ের পাঠদানকারী শিক্ষক থেকে ছাত্র, সবেতেই বামপন্থীদের বিপুল সংখ‍্যাধিক‍্য হওয়ায় কয়েক বছরের মধ‍্যে সংবাদ মাধ‍্যমগুলি (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক দুইই) বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কর্মীতে ভরে গেল। এই সময় বামপন্থীরা বাংলা ও ত্রিপুরায় ক্ষমতায় থাকার ফলে এই দুই রাজ‍্যের সংবাদ মাধ‍্যম ত বটেই, কেন্দ্রের কংগ্রেসের কাছাকাছি থাকা জাতীয় সংবাদ মাধ‍্যমগুলির মালিকপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক কারনে কংগ্রেস অনুমোদিত শিক্ষার বামপন্থায়ণ সমর্থন করার নীতি নিল। সংবাদপত্র ও বৈদ‍্যুতিন গণমাধ‍্যমগুলিতে বামপন্থীমুখের সংখ‍্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করল – তথাকথিত বিশিষ্ট ব‍্যক্তিত্ব চয়ন ও বিশেষজ্ঞ চয়নেও বামপন্থী সংখ‍্যাধিক‍্য দেখা গেল। অবশ‍্য সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এদের মধ‍্যে অনেকে ব‍্যক্তিগত সমীকরনের কারনে বামপন্থার বিরোধীতা করতে লাগল। এই পুরো সময় ধরে অন‍্য রাজনৈতিক দলগুলি আশ্চর্যজনকভাবে শিক্ষার এই বামপন্থায়ণ ও তার গূঢ় উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। এখনো তাদের তরফে কোন সদর্থক পদক্ষেপ নজরে আসেনি।
এইভাবে কম‍্যুনিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাধ‍্যম হল শিক্ষা বিভাগ। এখানে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর সময়ে শিক্ষানীতিতে একটি বিষয়ে অভিমুখের কোন বদল হল না। আমাদের দেশে বৃটিশ আমলে আধুনিক শিক্ষানীতি প্রথম শুরু করেন মেকলে সাহেব। তাঁর শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল – ইংরেজী শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করা, এছাড়া শিক্ষার মধ‍্যে কঠোরভাবে সিলেবাসভিত্তিক নোটসর্বস্ব শিক্ষা – যা ছাত্ররা মুখস্ত করে পরীক্ষায় উগরে দেবে! এর ভিত্তিতেই ছাত্রদের মূল‍্যায়ণ। সতর্ক দৃষ্টি ছিল যাতে দেশাত্মবোধক চেতনা এবং দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে ছাত্ররা বিশেষ শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ না পায়। এর কারন হল দেশীয় নেটিভদের ততটুকু শিক্ষাদান যাতে তারা দেশ শাসনে সাহেবদের হাত হিসেবে হুকুম তামিল করতে পারে। এই শিক্ষায় বুদ্ধির বিকাশ ও সঠিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা বিকাশের কোন চেষ্টা ছিল না। পরবর্তীতে কম‍্যুনিস্টরা যখন কংগ্রেসের সহযোগীতায় দেশের শিক্ষানীতির দায়িত্ব নিল তখন তাদের উদ্দেশ‍্য ছিল নেতা তৈরী করা নয়, ক‍্যাডার তৈরী করা। এই উদ্দেশ‍্য নিয়ে তারা মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষানীতির কোন মৌলিক পরিবর্তন করল না। শাসক সর্বদা হুকুম তামিলদার প্রজা চায় – প্রজার প্রশ্ন করা শাসকের নাপসন্দ। এ কারনে সত‍্যিকারের শিক্ষার বদলে সেই নির্দিষ্ট সিলেবাস মুখস্তের শিক্ষা চলতে লাগল! সঙ্গে জুড়ল বিদেশী কম‍্যুনিস্টদের গুণগান, অবশ‍্য বিশেষ কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা ও কংগ্রেসের সর্বশক্তিমান পরিবারের সদস‍্যদের আত্মত‍্যাগের কাহিনীও সিলেবাসে ঢুকল! বলা হল, এটাই আসল স্বাধীনতা সংগ্রাম! অর্থাৎ বৃটিশদের থেকে এই ভারতীয় শিক্ষায় উত্তরণ হল অশিক্ষা থেকে কুশিক্ষায় সন্তরন।
এই বিষবৃক্ষের ফল যথা সময়ে ফলতে শুরু করল। প্রথাগত শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভের সঙ্গে শিক্ষিতদের শিক্ষাগত যোগ‍্যতার কারনে রোজগার করতে পারার কোন সম্পর্ক রইল না। ফলত শিক্ষার গুরুত্ব কমতে লাগল – শিক্ষা আলঙ্কারিক শোভার মত ডিগ্রি পাওয়ায় পর্যবসিত হল। এদিকে যথার্থ যোগ‍্যতা না থাকায় ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিশ্বের শিক্ষার দরবারে সকল প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পরতে লাগল। এই ব‍্যধি দূর করার চেষ্টা না করে দেশের নেতা, নেত্রী থেকে আমলারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিদের ছোট বয়স থেকে আমেরিকা, ইউরোপ বা নিদেনপক্ষে এশিয়ার সেরা শিক্ষার জায়গা জাপান, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ায় নামী, দামী শিক্ষায়তনে ভর্তি করিয়ে দিলেন! আমি কম‍্যুনিস্ট সহ বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রীদের মধ‍্যে এই ধারা লক্ষ‍্য করেছি। এরা আবার বিদেশী ডিগ্রিধারীদের (তা সে মামুলি শিক্ষায়তন থেকে হলেও) দেশের ডিগ্রিধারীদের তুলনায় বড় মনে করেন! ইংরেজের দাসত্বের মানসিক বন্ধন এদের ঘোঁচেনি। আমাদের দেশের এই শিক্ষা ব‍্যবস্থা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা নয় – হলও না। এদিকে, শিক্ষিত বেকারের সংখ‍্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষকদের উন্নত বেতন বরাদ্দের কোন খামতি হল না! যেমন প্রশাসনিক পদের অফিসারদের যোগ‍্যতা বিচার না করে সময়ের সাথে সাথে উচ্চতর পদে নিয়োগ হয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেই একই ব‍্যাপার দেখা গেল। আবার, ছাত্রদের মূল‍্যায়ণে তাদের মুখস্ত বিদ‍্যার প্রতিফলন হলেও এধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার মূল‍্যায়ণ করা যায় না।
এইভাবে স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি যখন মানুষের বিশ্বাস হারাতে চলেছে তখনই এল অতিমারীজনিত লকডাউন। তার ফলে সমস্ত শিক্ষায়তনে প্রায় দু বছর শিক্ষাদান বন্ধ থাকল, শুধু ‘অনলাইন শিক্ষা’র মত ছেলেভোলানো শিক্ষাদান খেলা চলল। কিন্তু যথাসময়ে পরীক্ষা সমাধা হল! আচ্ছা, ল‍্যবোরেটরী নির্ভর বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলির হাতে-কলমে কোন ক্লাশ হল না, কিন্তু পরীক্ষা হল! এই ভোজবাজীর শিক্ষা ব‍্যবস্থা পি সি সরকারের ম‍্যাজিককেও হার মানায়।
আবার ডাক্তারী শিক্ষার ক্লাশও একই কারনে বন্ধ। ছাত্ররা কিভাবে অনলাইনে ক্লিনিক‍্যাল ও সার্জারীর মত বিষয় আয়ত্ত করল তাও এক ধাঁধা! এভাবে মৃতপ্রায় শিক্ষা ব‍্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করা হল। ফলে, এই মূহুর্তে দেশে সমস্ত স্তরে ছাত্রসংখ‍্যা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে এই শিক্ষানীতির প্রবক্তাদের উদ্দেশ‍্য সফল হয়েছে।
কংগ্রেস দল চেয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু গান্ধীজী ও তাদের দলের শীর্ষ পরিবারকে ঘিরে লেখা হোক – ছাত্ররা তেমন ইতিহাসই জানুক। আর কম‍্যুনিস্টদের সুচতুর নীতিতে ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ‍্য সম্পর্কে যেমন শিক্ষিত যুব সমাজের সঠিক ধারনা তৈরী হল না, তেমনি ইসলামী দখলদারীকে নরমভাবে দেখিয়ে মুঘলদের ভারতীয় বানানোর অপচেষ্টা করা হল। বিদেশী স্থপত‍্যবিদদের বিধানেও তাজমহলের নির্মানে কোন মৌলিক চিন্তার পরিচয় না থাকলেও তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দেওয়া হল! এভাবে কম‍্যুনিস্টদের শতাব্দী প্রাচীন নীতি – ভারতবিদ্বেষ ও হিন্দুবিদ্বেষের আগুন জ্বালানোর আবহ তৈরীর চেষ্টা হতে লাগল। এর ফলে তথাকথিত শিক্ষিত যুবসমাজকে উত্তেজিত করে দেশবিরোধী শক্তির হাত শক্ত করার চেষ্টা হল। ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থী ব‍্যখ‍্যা অনুযায়ী হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষার স্কুল, কলেজ খোলার ব‍্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। একইসঙ্গে মুড়ি মুড়কির মত বিভিন্ন জায়গায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, মাদ্রাসা খুলে ইসলামী শিক্ষায় সরকারী সহযোগীতা শুরু হল। মাদ্রাসা শিক্ষা বুনিয়াদী স্তর থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হল। ফলে, দেশে হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদনা হ্রাস পেলেও ইসলামী ধর্মীয় উন্মাদনা বৃদ্ধি পেল। যেমন ভগবানের ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষ ঋদ্ধ হয়, তেমনি যথার্থ আল্লার ধর্মীয় শিক্ষায়ও মানুষ ঋদ্ধ হয়। কিন্তু এইসব মাদ্রাসার মাধ‍্যমে আল্লার শিক্ষা নয়, মৌলভীদের শিক্ষা যা বিধর্মীদের ঘৃণা করতে শেখায় – ভারতকে শত্রুদেশ ভাবতে প্ররোচিত করল। এর ফলে হিন্দু বিরোধীতার আগুনের স্পর্শে মুসলিম বিরোধীতার আগুন জ্বলল। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা হল। এটাই এই শিক্ষানীতির প্রণেতারা চেয়েছিলেন! অথচ ভারতীয় মুসলমানদের জন্ম, ধর্মকর্ম সবই ভারতে। তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মতই ভারতীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের দেশের স্থায়ীত্ব বিরোধী কাজকর্ম হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারন মানুষ প্রত‍্যাখ‍্যান করায় শিক্ষার দ্বারা ব্রেনওয়াশের কংগ্রেস-কম‍্যুনিস্ট যৌথ কৌশল তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বে ধ্বস নামালো।
সে কারনে একটি নতুন শিক্ষানীতি ও সেইসঙ্গে শিক্ষার অভিমুখ বদল করার আশু প্রয়োজন হল। মেকলের শিক্ষানীতি থেকে বর্তমান শিক্ষানীতি অব্দি যে জিনিষটার অভাব ছিল, মেধার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা শুরু হল। এই শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা গৃহীত হওয়ার পর এখনো চালু হয়নি বলে এর ভালোমন্দ বিচারের সময় এখনো আসেনি। অবশ‍্য কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের ও UGCর বিভিন্ন সার্কুলারে এ সম্বন্ধে এখনো অনেক ধোঁয়াশা বিদ‍্যমান। সময় এর উত্তর দেবে। তবে, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করা আশু প্রয়োজন – না হলে কোন শিক্ষা ব‍্যবস্থাই সার্থক হবে না।

বাঙ্গালীর জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের মূলে রাজনৈতিক অসততা

         বাঙ্গালী জাতি হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে যে একতা ও দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছিল, তার উপর স্বাধীণতার অব‍্যবহিত পূর্বেই আঘাত হানা শুরু হয়েছিল। এই আঘাতের জন‍্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও তার সহযোগী দলগুলি যেমন দায়ী, তেমনি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দও একই রকম দায়ী। বাঙ্গালী অস্মিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে বৃটিশের ধামাধরা দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ইংরেজরা দেশের শাসনভার ছেড়ে যেত না - এ‍্যাটলের একটি ছোট্ট কথাতেই তা পরিষ্কার। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ভারতের স্বাধীনতায় গান্ধীজীর অবদান কতটা - তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "minimal"। এটা নিয়ে পেইড ইতিহাসবিদরা কিছু বলেন না। গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের নেতারা সুভাষচন্দ্র বসুকে ভয় পেতেন। সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে জার্মানী ও জাপানের সহযোগীতায় সশস্ত্র বিপ্লবের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাতে তাঁর নেতৃত্বে শুধু হিন্দুরাই নয়, বহু দেশপ্রেমিক মুসলমান মানুষও শামিল হয়েছিলেন।নেতাজীর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সততাকে ভয় ও ঈর্ষা করতেন স্বয়ং গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা।  এই ভয় দেশের স্বার্থে নয়, তা ব‍্যক্তিস্বার্থে - নেতৃত্বের মধুভান্ড হারানোর ভয়! এই কংগ্রেসের নেতারাই কিন্তু মহম্মদ আলী জিন্নাকে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারন করার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কখনো শামিল হতে দেয়নি। গান্ধীজী ও তাঁর পেটোয়া হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের মধ‍্যে একটা কোটারি তৈরী করে সর্বদা চালিয়েছে। এরাই জিন্নাকে একঘরে করার নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকায় শেষে জিন্না বাধ‍্য হয়ে রাজনীতিতে ভেসে থাকার জন‍্য মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলিম কার্ড খেললেন। গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামী কংগ্রেসের নেতারা বারবার এই কৌশল নিয়েছে। তারপর মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগের দাবীতে সরব হল। খন্ডিত ভারতের নেতৃত্ব পাওয়ার প্রস্তাবে গান্ধীজী প্রথমে প্রতিবাদ অনশন করলেও সে আন্দোলন তাঁর অন‍্য আন্দোলনগুলির মতই কিছুদিন চলার পর বন্ধ হল! গান্ধীজী একসময় জেহাদী মুসলিম নেতাদের প্রাধান‍্য দিয়ে নিজের নেতৃত্ব টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ দ্বারা প্রত‍্যাখাত হলেন। তাঁর কায়দা চতুর রাজনীতিক জিন্না ধরে ফেলেছিলেন।
         একটি তথ‍্য এখানে অত‍্যন্ত খুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল ভারতের স্বাধীনতা কেন ১৯৪৭ সালে এসেছিল। এর মূল কারন হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ, নির্বাচনে চার্চিলের পরাজয়, সুভাষের INAর চাপ এবং ভারতের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খন্ডিত ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের মাধ‍্যমে বৃটিশদের কাছের দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দুই দেশের শাসনভার অর্পনের মাধ‍্যমে ভারতে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বজায় রাখা। এসব কারনের সম্মিলিত ফল হল ভারতের স্বাধীনতা লাভ। এখানে একটি ব‍্যপার অবশ‍্য লক্ষণীয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে যে দুটি প্রদেশ বৃটিশদের সবচেয়ে বেশী বেগ দিয়েছে সেই দুটি - পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন! যদিও মুসলমান জনসংখ‍্যা অবিভক্ত ভারতের অন‍্যান‍্য প্রদেশেও ভালো সংখ‍্যায় উপস্থিত ছিল। বাংলাকে পুরোটাই পাকিস্থানে দিয়ে দেওয়ার আলোচনায় গান্ধীজী ও তাঁর প্রিয় কংগ্রেস নেতাদের থেকে কোন আপত্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। এই সময় শ‍্যামাপ্রসাদ যুক্তি দিয়ে বোঝান যে হিন্দু সংখ‍্যাগরিষ্ট বাংলাকে পাকিস্তানে দিয়ে দিলে এই বিপুল সংখ‍্যক হিন্দুর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বরং বাংলাকে খন্ডিত করে হিন্দু অধ‍্যুষিত পশ্চিম অংশকে ভারতের প্রদেশ হিসেবে ভাগ করা অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ তার বাঙ্গালী মুসলমান সদস‍্য সমর্থকদের দিয়ে হিন্দু বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। এই সময় মুসলিম লীগের কিছু নেতা, যেমন হুসেইন সুরাবর্দী জিন্নাকে টেক্কা দেওয়ার জন‍্য 'দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং' এর মাধ‍্যমে নিজেদের ব‍্যক্তিগত স্বার্থে সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের প্ররোচিত করে। দুঃখের বিষয় হল, সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বিপুল অংশ সেই প্ররোচনায় পা দেয়। এর সঙ্গে খুণ,লুঠতরাজ ও ধর্ষন ত আছেই। দুঃখের কথা, হিন্দু ধর্মীয় স্থান থেকে প্ররোচনা না দিলেও মসজিদ ও মজলিস থেকে তাদের এই ঘৃণ‍্য কাজের ধর্মীয় সমর্থন দেওয়া হতে লাগল। এখানেই বাঙ্গালী ঐক‍্য - যা বাঙ্গালীর গর্ব এবং বৈশিষ্ট‍্য ছিল - চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। দুই ভিন্ন ধর্মের বাঙ্গালীর মধ‍্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা জন্ম নিল। বাংলায় যে হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে দাঙ্গাগুলি ঘটেছিল তার কারন কিন্তু লোভ ও অন‍্যের সম্পত্তি গ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে অত‍্যাচারের লিপ্সা। এই পাশবিক প্রবৃত্তিকে স্বাভাবিকতার স্বীকৃতি দেওয়ার জন‍্য ধর্মকে আশ্রয় করা হয়েছিল। যার জন‍্য ক্ষতিগ্রস্ত হল ধর্মের গ্রহণযোগ‍্যতা। আর এই কাজের জন‍্য প্রয়োজন ছিল উচ্চ প্রশাসনিক মহলের সমর্থন এবং আত্মিক অনুমোদন। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই দুটোই সহজে পাওয়া গিয়েছিল। এটি ঐতিহাসিক সত‍্য যে হুসেইন সোরাবর্দী ও মুসলিম লীগের অন‍্যান‍্য নেতৃবৃন্দ দুটি কারনে এই গণহত‍্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের ভারতে অন্তর্ভূক্তি - যা তারা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছাড়া ভাবতে পারেনি। দ্বিতীয় কারন হল মহম্মদ আলী জিন্নাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে বার্তা দেওয়া যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ অধিকতর মুসলিম দরদী! সেইসঙ্গে বহু বাঙ্গালী মুসলমান, যারা এত বছর হিন্দু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এসেছে, তাদের মনে হিন্দুবিদ্বেষের বীজ বপন করার জন‍্য ধর্মের নামে - ইসলামের নামে - বিভেদের আগুন জ্বালালেন মসজিদ, মহল্লা থেকে জিহাদে হিন্দু নিধনের ডাক দিয়ে। এইভাবে বাঙ্গালীদের মধ‍্যে একটি স্থায়ী বিবাদের সূচনা হয়। এর ফলে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ‍্যে যেমন মুসলমান বিদ্বেষ চলে এলো তেমনি বাঙ্গালী মুসলমানদের পশ্চিমী মুসলমানরা ছোট জাত বলে তাচ্ছিল‍্য করার সুযোগ পেল। তখন থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী সংস্কৃতির গোলামী করা ছাড়া উপায় থাকল না। সেজন‍্য এখনো বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ‍্যে কোরআন, হাদিশের থেকে ব‍্যাখ‍্যার মাধ‍্যমে হিন্দু বিরোধী জেহাদ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ‍্য, বাংলাদেশের (আগের পূর্ব পাকিস্তান ) বাঙ্গালী মুসলমানদের একাংশ এই ফাঁদে না পড়ে, বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সভ‍্যতার ধারক-বাহক হয়ে সংখ‍্যালঘু হিন্দু বাঙ্গালীদের রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে চেষ্টা চালাচ্ছে - যদিও এই প্রচেষ্টা মহৎ, কিন্তু এর প্রভাব সাম্প্রদায়িক জেহাদের তুলনায় এখনো কম।
              আবার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একটি বড় অংশ কম‍্যুনিস্ট শাসনের প্রভাবে কম‍্যুনিজমকেই বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক জ্ঞানে পুজো(!) করছে। ভারতীয় কম‍্যুনিজমের জন্ম, আদর্শ ও অভিমুখ সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ ধারনা না থাকার কারনে তারা গড্ডালিকা প্রবাহে কম‍্যুনিজমে দীক্ষা নেয়! পারিপার্শিকতার প্রভাবে বিশেষতঃ যুবা বয়সে কম‍্যুনিজম একটি রোমান্টিক মিথ্ তৈরী করে। এইসব "শুনে কম‍্যুনিষ্ট"রা সর্বদা দাদা অথবা দিদি নির্ভর। এখানে প্রবাদপ্রতিম পদার্থবিদ শ্রী সত‍্যেন বসুর জীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সত‍্যেন বসুর পদযুগল স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। যে সময়ের ঘটনা, তখন পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিস্টদের স্বর্ণযুগ চলছে। ঐ সময় শিক্ষা জগতে কোন নিয়োগ, উন্নতি - কিছুই কম‍্যুনিস্টদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ত বটেই, অধ‍্যাপকরা পর্যন্ত নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবীদের জন‍্য কৌটো নেড়ে বা রসিদ দিয়ে চাঁদা তুলতেন। তাঁরা কলকাতায় বিপ্লব করতেন কিউবা ও কোরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! অধ‍্যাপকরা তাঁদের উন্নতির শর্টকাট রাস্তা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এমনই একজন পদার্থবিদ‍্যার অধ‍্যাপক ছিলেন বি ডি নাগচৌধুরী। তাঁর পৌরহিত‍্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল।

বিষয় – পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ পরীক্ষা করে আমেরিকা কিভাবে তেজস্ক্রিয় ছাই ছড়িয়ে পৃথিবীর ক্ষতি করছে। প্রধান বক্তা অরাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ‍্যাপক সত‍্যেন সেন। তিনি শুধু বিজ্ঞান আলোচনা করা হবে – এই প্রতিশ্রুতিতে সভায় আসতে সম্মত হন। বক্তারা, বিশেষতঃ অধ‍্যাপক নাগচৌধুরী, মার্কিন সরকারের সবিশেষ মুন্ডুপাত করার পর শেষে বলতে ওঠেন স‍ত‍্যেন বসু। তিনি তথ‍্য সহযোগে জানান যে, সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত সরকার যে পরিমাণ পারমাণবিক বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছে তা মার্কিন বিস্ফোরণের তুলনায় বহুগুণ বেশী। তাঁর একটিই জিজ্ঞাস‍্য ছিল যে, এর প্রতিবাদে ঐ সভার অধ‍্যাপক ও বিদগ্ধজনেরা কটি প্রতিবাদ সভা করেছেন! সভায় গুঞ্জন ওঠে – শেষে সভা তালকাটা পরিবেশে শেষ হয়। এভাবেও বাঙ্গালীদের মনে ভ্রান্ত ধারনা ঢুকিয়ে বিদ্বেষের বিষ গেঁথে দেওয়া শুরু হয়।
সত‍্যি বলতে কি, শুরু থেকে বাঙ্গালীদের মধ‍্যে জাতিগত ও ধর্মগত বিদ্বেষ ছিল না। এমনকি বাঙ্গালীদের মধ‍্যে বর্ণগত পরিচয় বল্লাল সেনের আগে ছিল না। তখন বর্ণভেদ ছিল কর্মের ভিত্তিতে – জন্মের ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ উচ্চ ও নিম্ন বর্ণে উত্তরণ ও অবনমন ছিল বাস্তব। আবার বাঙ্গালী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা সকলেই হিন্দু ছিলেন – এটি ঐতিহাসিক সত‍্য। বাঙ্গালীদের মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারন রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ। সেজন‍্য বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ‍্যে চেহারায় ও কথাবার্তায় শুধু মিল নয়, তাদের DNAতেও সাদৃশ‍্য আছে। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে বাঙ্গালী হিন্দু, বাঙ্গালী মুসলমান, এমনকি এই হিন্দুদের মধ‍্যে সমস্ত জাতপাতের মানুষজন ভাই-বোন। এটাই ঐতিহাসিক সত‍্য। কিন্তু গত প্রায় একশ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে এবং ধর্মীয় সুবিধাবাদের চাদরে ভাই-বোন ও ভাই-ভাইয়েরসম্পর্কটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন একাংশ বাঙ্গালী আরবী সভ‍্যতার পদলেহনকারী; অপর অংশ আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে দেশবিরোধী শক্তির কমিশন এজেন্ট অথবা দেশভক্তের মুখোশের আড়ালে অবাঙ্গালী বানিয়াদের অনুচর ইত‍্যাদি। এইভাবে বাঙ্গালী পরিচয়টাই আজ অবলুপ্তির পথে।
তারপর গত দশ বারো বছর ধরে বাংলার মাটিতে চলছে অন‍্য খেলা। দুই বাংলাতেই রাজনীতিকদের লক্ষ‍্য সংখ‍্যাগুরু বাঙ্গালীর ইচ্ছাতে সুরসুরি দিয়ে ভোটযুদ্ধে জেতা। তারপর ক্ষমতার মধুভান্ড দখল করা বা দখলে রাখা। এজন‍্য তারা চটজলদি সমাধানের মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। প্রথমে বাংলাদেশের কথা বলা যাক। সেখানে বর্তমান সরকার বাঙ্গালী অস্মিতার কথা ও সংখ‍্যালঘু হিন্দুদের চোখের মণির মত রক্ষা করার কথা বললেও কখনো দেশবিরোধী জেহাদী সংস্কৃতির বাহকদের – যারা ইসলামের নামে আরবী সংস্কৃতি, সে দেশের মানুষের উপর তালিবানী কায়দায় চাপাতে চায় – তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ইতস্ততঃ করে। অবশ‍্যই সংখ‍্যাগুরু ভোটব‍্যঙ্কের কথা মাথায় রাখার জন‍্য এই ঢিলেমী। ফলে, সে দেশে মাঝেমধ‍্যেই সংখ‍্যালঘু হিন্দুরা বক্সিংয়ের পাঞ্চিং ব‍্যাগের মত ব‍্যবহৃত হয়। অনেক বাঙ্গালী মুসলমান এর সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ না করলেও ভয়ের পরিবেশে নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।
আবার পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টা অন‍্য। এখানে মানুষ মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত। সকলেই নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে গর্বিত – যা অবশ‍্যই বাঙ্গালী অস্মিতার অবক্ষয়ের বড় কারন। একভাগ তথাকথিত আন্তর্জাতিক কম‍্যুনিজমের আদর্শে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। এরা কোনো ধর্ম সম্বন্ধেই জ্ঞান না থাকায় সহজেই হিন্দুধর্মের নামে কুৎসা রটনাকে ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাচ্ছিল‍্য এবং অবমাননাকর বহিঃপ্রকাশকে প্রগতিশীলতা মনে করে। আরেকভাগ বাঙ্গালী বাঙ্গালীয়ানাকে বিসর্জন দিয়ে কোরআন, হাদীসের জেহাদী রূপান্তরকে মোক্ষ করে বাঙ্গালীস্থানকে পাক-ই-স্তান বানানোর কারিগর হিসেবে নিজেদের দেখতে চায়। এই দুই ধরনের বাঙ্গালী এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে শাসকানুকুল‍্য পাচ্ছে – কারন এদের মিলিত ভোটেই শাসকের নির্বাচনে জয়লাভ সুগম হচ্ছে। উপরের দুই দলের ক্রিয়াকর্মের প্রভাবে আরেক ধরনের বাঙ্গালীকুল মাথাচাড়া দিয়েছে। তারা নিজেদের একমাত্র দেশভক্ত এবং হিন্দুধর্মের একমাত্র ঠিকাদার হিসেবে বাঙ্গালী ঐতিহ‍্যের পরিপন্থী আচরণ করছে এবং অবাঙ্গালী বানিয়াগোষ্ঠীর তাঁবেদারী করে জেহাদী বাঙ্গালীকুলের মতই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। এখানে একটি ব‍্যাপার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল যেমন শাসকদলের ভোটব‍্যাঙ্ক হিসেবে মদতপ্রাপ্ত, তেমনি তৃতীয়দলও শাসকের প্রচ্ছন্ন মদতে শক্তিশালী থাকছে। কারন তৃতীয়দলের আচরণ ও ক্রিয়াকর্ম প্রথম ও দ্বিতীয়দলকে শাসকের পক্ষে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।
এবার আসি আমাদের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির ভূমিকায়। তারা এই তিন বিভাগের মানুষদের থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকুল হবে এমন মানুষদের বেছে নিয়ে তাদের ‘বুদ্ধিজীবি’ তকমা দিয়ে এমন প্রচার চালাচ্ছে যে, এই ‘সর্বজ্ঞ’ মানুষেরা যা বলছে তা যেন ধ্রুবসত‍্য! এই ‘বুদ্ধিজীবি দলে ভিড় করা মানুষদের মধ‍্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, চিত্রনাট্য লেখক থেকে মায় খেলোয়ার অব্দি আছেন! আচ্ছা, আগে কেউ কখনো কে এল সায়গল, হেমন্ত মূখার্জী, মান্না দে, উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনকে কেউ ‘বুদ্ধিজীবি’ হিসেবে কল্পনা করেছেন! আসলে পুরোটাই একটি প্ররোচনার প‍্যাকেজ। বাঙ্গালীকে শতধা বিভক্ত করে তার জাতিগত সত্তাকে নষ্ট করে দাও। বাঙ্গালী না থাকলে রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, শিক্ষা থেকে বিনোদন – সমস্ত জায়গায় অন‍্য সংস্কৃতি দখলদারি কায়েম করতে পারবে। বাঙ্গালীর মেধা, মনন ও যোগ‍্যতা তার বিপক্ষে গেল। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বহু বাঙ্গালী সেকারনে এই ব‍্যক্তিস্বার্থসঞ্জাত রাজনৈতিক নোংরামো থেকে সরে থাকছে। এদের সংখ‍্যা যখন আরো বাড়বে তখন হয়ত বাঙ্গালীর সুদিন আসতে পারে। অন‍্যথায় তার ধ্বংস অনিবার্য। শেষে বলি, সম্মিলিত বাঙ্গালী বিরোধীতার বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র হাতিয়ার ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী ঐক‍্য ও তার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো অর্থগৃধ্নু সংবাদ-মাধ‍্যম বর্জন করা। তবে,তার জন‍্য উপযুক্ত বাঙ্গালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। গুলিস্তাঁ বরবাদ করনেকো একই উল্লু কাফি হ‍্যায়, হর শাখ পর উল্লু বৈঠা হ‍্যায় ত গুলিস্তাঁকো ক‍্যয়া হোগা।

আত্মহণনকারী বাঙ্গালী

একটা খুব সাধারণ প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বিদেশী বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল – “তোমাদের দেশে বাঙ্গালী কারা?” উত্তর দিয়েছিলাম,”যারা বাংলায় বাস করে”। বন্ধু আবার প্রশ্ন করল,”কোন বাংলা – বাংলাদেশ নাকি ভারতের একটি অঙ্গরাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গ?” আমার তাৎক্ষণিক উত্তর – দুটোই। বন্ধু বলল, “তোমাদের বাঙ্গালীদের দুটি আলাদা দেশ; আলাদা কালচার; আবার তোমরা ভারতীয়রা সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আর বাংলাদেশ ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্র। তোমাদের মধ‍্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশী। এমনকি খাদ‍্যাভ‍্যাসেও প্রচুর তফাৎ”। বুঝলাম, আমার বন্ধুটি বাঙ্গালী জাতির ব‍্যপারে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। সেই থেকে তার বক্তব‍্য বাঙ্গালী হিসেবে আমায় নাড়া দিয়েছে।
জাতি হিসাবে গুজরাতিদের ভাষা, কালচার ইত‍্যাদি এক। মারাঠি থেকে কানাড়ি, তামিলি, ওড়িয়া – সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ‍্য। একটি জাতি তখনই জাতি হিসেবে বিকশিত হয়, যখন তার জাতিসত্ত্বা ও জাতির অস্মিতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুই দেশের তথাকথিত বাংলায় কথা বলা মানুষদের জাতিসত্ত্বায় প্রচুর তফাৎ আর বাঙ্গালী অস্মিতার প্রকাশ দেখি শুধু রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। এর কারন, গত একশ বছরের বাঙ্গালীর ইতিহাস ও তার সামাজিক অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা জল খাওয়ার কথা বলে, উত্তর ভারতীয়রা পানি পিতে হ‍্যায় আর বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা পানি খায়! আচ্ছা, বলুন ত বাঙ্গালী ঐতিহ্য কি? দুজন পরিচিতের দেখা হলে হাত জোড় করে নমষ্কার ও প্রতি নমষ্কার জানানো পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী শিষ্টাচার। আবার বাংলাদেশের দুই বাঙ্গালী তখন এক হাত বুকে ঠেকিয়ে আসলাম ওয়ালেকুম ও আলেকুম সালাম বলে। কোনটা বাঙ্গালীর সঠিক শিষ্টাচার! দুই বাংলার বাঙ্গালীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলনকারী শহীদদের স্মরণে ভাষা দিবস পালন করে আর একই রকম বাংলা ভাষার জন‍্য আসামে আন্দোলনকারী শহীদদের কথা তারা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না! বাঙ্গালী জাতির কর্মকান্ড এমনই অদ্ভুত যুক্তিহীন দ্বিচারিতায় ভরা।
নিরপেক্ষভাবে এর কারন বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও জানি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারনে সমালোচিত হতে হবে! প্রথমে বলি, উইন্সটন চার্চিলের নির্বাচনে পরাজয়ের পর এ‍্যাটলী বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী না হলে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা আসত না। এমনকি, স্বয়ং এ‍্যাটলী ভারতের স্বাধীনতার কারন হিসেবে গান্ধীজীর অবদানকে “নূন‍্যতম” বলে অভিহিত করেন। ভারতের স্বাধীনতার পিছনে প্রধান কারনগুলি হল – বৃটেনের উপর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, ভারতের দিকে দিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, INAর কর্মকান্ড, এবং মিত্রশক্তির অন‍্যান‍্য সহযোগী যেমন আমেরিকা ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক চাপ। তখন ইংরেজ সরকার চাইল বশংবদ নেটিভ নেতৃত্বের হাতে ভারতের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দায় থেকে মুক্তি পেতে। এর মধ‍্যে নূন‍্যতম অবদান গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন – যা চার্লস্ এ‍্যাটেনবরোর “গান্ধী” ছবিতেও দেখানো হয়েছে। এভাবে ভারত খন্ডিত করে স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গান্ধীজী প্রতিবাদ-অনশন করলেও পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোন অদৃশ‍্য অঙ্গুলীহেলনে ভারতভাগের পক্ষে রাজি হয়ে গেলেন, সেই ইতিহাস আজও অজানা। বাঙ্গালী সুভাষ ও বাঙ্গালী শ‍্যামাপ্রসাদের মৃত‍্যুর ইতিহাস আজও রহস‍্যময়। এতে কার লাভ হয়েছে তা সবাই জানলেও কার ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে চর্চা হয়েছে কি? বিধানচন্দ্র রায়কে বাঙ্গলার উন্নয়ণের প্রশ্নে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার যদি পর্যাপ্ত সাহায‍্য করত তাহলে তাঁকে উন্নয়ণের জন‍্য জন এফ কেনেডির সফল চিকিৎসার বিনিময়ে সাহায‍্য চাইতে হত না! ভারত খন্ডিত হওয়ায় যে দুটি রাজ‍্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা হচ্ছে বাংলা ও পাঞ্জাব। এই দুটি রাজ‍্যে ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় যে ক্ষতি হয়েছিল, মানুষের প্রাণহানি ও সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল, শুধু ধর্মীয় কারনে সেখানে যে গণহত‍্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর শ্লীলতাহানির মত হাজার হাজার পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক সাহায‍্য ও পুনর্বাসন নীতির দরকার ছিল তার থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রশ্নাতীতভাবে বঞ্চিত হয়েছিল। বাংলা ভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের (সুরাবর্দী ছিলেন তাদের নেতা) মুসলমান নেতৃত্বের অনুগামীদের অত‍্যাচারে সম্পত্তি হারানো (এনিমি প্রপার্টি আইনে!), ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তরকরন ও খুনের রক্তস্রোত বইয়ে বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে এবং আসাম ও ত্রিপুরায় যে হিন্দু বাঙ্গালী শরণার্থীরা আশ্রয় নিতে আসে – পৃথিবীর যে কোন আইনে তারা ধর্মীয় শরণার্থী। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে এবং তাদের ‘ধর্মীয় শরণার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করতে জওহরলাল নেহরু সরকার অস্বীকার করে। আর এই ব‍্যপারটা তারপরেও ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের কাছে হারার পরে পুনরাবৃত্তি হয়। হিন্দু বাঙ্গালীদের সেখানে বক্সিংয়ের ‘পাঞ্চিং ব‍্যাগ’ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয়েছে। ভারতের অন‍্য কোন রাজ‍্যের এই অভিজ্ঞতা হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ঘৃণিত ঔদাসীন‍্যের সুযোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গের কম‍্যুনিস্টরা। তারা এই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে শরণার্থীদের মধ‍্যে কম‍্যুনিজমের তত্ত্ব প্রচারের মাধ‍্যমে বাঙ্গালীর এই অংশকে তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করার চেষ্টা করতে লাগল। এই হতভাগ্য ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার নূন‍্যতম রসদ জোগাড়ে সাহায‍্য করার বিনিময়ে এদেরকে কম‍্যুনিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেওয়ার নামে ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মকে বিদ্রুপ ও অমান‍্য করার পাঠ দিতে শুরু করল। এইভাবে নরম ব্ল‍্যাকমেলিংয়ের প্রভাব এপারের হিন্দু বাঙ্গালীর মননে পড়তে শুরু করল। ইতিমধ্যে ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের দখলদারি কম‍্যুনিস্টদের হাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙ্গালী হিন্দুদের গৌরবের ইতিহাস, বাঙ্গালীর নিজস্ব, ঐতিহ্যবাহী উৎসব ইত‍্যাদিকে সমাজজীবন থেকে মুছে দিতে তৎপর হল। এই ভাবে বাঙ্গালী হিন্দুদের শ্লো পয়জনিং পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। পেটের জ্বালায়, বাঁচার তাগিদে এরাও নিজেদের জাতিসত্ত্বা ভুলে কম‍্যুনিস্টদের ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ‍্য হল। বাঙ্গালী হিন্দুদের নব‍্য প্রজন্ম পুজোআর্চায় অবিশ্বাসী কম‍্যুনিস্ট, কিন্তু মুসলিম বন্ধুর ডাকে রমজানের ইফতারে মাথায় টুপি পরে হাজির হতে লাগল। এরা জানে না যে ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এই বাঙ্গালী আপরুচি খানার নামে গরুর মাংসের স্বাদ ও উপকারিতা নিয়ে লেকচার দিয়ে তার প্রগতিশীল মনের পরিচয় দিল। আবার তাদের কাউকে মুসলমান বন্ধুকে শুয়োরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা বোঝাতে দেখা গেল না! ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দু বাঙ্গালীর আত্মবিস্মরণ তখন থেকে দ্রুততর হল। আবার অন‍্যদিকে মুসলমান বাঙ্গালীদের গরিষ্ঠ অংশ পূর্বপাকিস্তান,অধুনা বাংলাদেশে রয়ে গেল। আর একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে থেকে গেল – ফলে তারা ভারতের বাসিন্দা হয়ে ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পরল। এদিকে পূর্বপাকিস্থানের হিন্দু বাঙ্গালীদের স্বার্থের জন‍্য ধর্মের নামে ক্রমবর্ধমান অত‍্যাচার সইতে হল। দুটো বিকল্প তাদের সামনে ছিল – ধর্মান্তর বা ধন সম্পত্তি ফেলে রেখে একবস্ত্রে ভারতে শরণার্থী হওয়া। এর মূল দায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রতি তাদের বিমাতৃসূলভ আচরণ এই হতভাগ‍্য মানুষগুলোকে বাধ‍্য করেছিল কম‍্যুনিস্টদের ঝান্ডার পিছনে দাঁড়াতে। বিনিময়ে তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল হিন্দুত্বের অস্মিতা। সেইসঙ্গে কম‍্যুনিস্টরা এদের ইসলামী সেকুলারিজমের ধারাপাত মুখস্ত করিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের নামে মহান চিন ও রাশিয়ার বিপ্লবের পাঠ নিতে বাধ‍্য করল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ‍্যক্রম থেকে জাপান ও সুইজারল্যান্ডের বদলে চিন ও রাশিয়ার অন্তর্ভূক্তির মাধ‍্যমে এদের সেকুলারিজমে ব‍্যপটাইজেশান হল। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর বই থেকে হিন্দুধর্ম ও পুরোহিতদের অসম্মান ও বিদ্রুপ করা শেখানো হতে লাগল। আশ্চর্যজনকভাবে মুসলিম ও খ্রীষ্টান ধর্ম নিয়ে কিছু বলা হল না। পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রীকে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন‍্য দল থেকে ভর্তসনা করা হল, কিন্তু অন‍্য এক মুসলিম মন্ত্রীকে হজ যাত্রার জন‍্য ছুটি দেওয়া হল! পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা এভাবেই ইসলামী সেকুলারিজমকে গ্রহণ করল। বাঙ্গালী বিপ্লবীদের শৌর্য, নেতাজী সুভাষ, রাসবিহারী বসু ও শ‍্যামাপ্রসাদ মূখার্জীদের মেধা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় গদি হারানোর ভয়ে ভীত ভারতের শাসককুল জওহরলাল ও প‍্যাটেলভাইদের নেতৃত্বে (অবশ‍্যই গান্ধীজীর সমর্থনে) প্রথম থেকেই বাঙ্গালী তথা স্পষ্ট বক্তা উত্তর-পূর্বের মানুষদের সঙ্গে বৈষম‍্যমূলক আচরন করেন। এর অবিসংবাদী ফল স্বরূপ বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ‍্যে কেন্দ্রবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। ভিন্ন কারনে দুই বাংলার বাঙ্গালীদের মধ‍্যে অনুন্নয়ণ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও পূর্ববাংলায় ধর্মের নামে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজকে ঐক‍্যবদ্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে মৌলভী-মুয়াজ্জিমদের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেখানে সংখ‍্যালঘু বাঙ্গালীদের উপর ধর্মের দোহাই দিয়ে অত‍্যাচার করা হয়েছে, তার আসল উদ্দেশ‍্য ছিল ধন-সম্পত্তি ও জমি-বাড়ি লুঠ করা – দস‍্যুবৃত্তির রকমফের। এর প্রতিবাদে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রতিবাদ করলে মৌলবাদী শক্তি মৌলানা-মৌলভীদের একাংশকে এদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার কাজে নামায়। তারপর ধীরে ধীরে ‘ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা তৈরী করে ইসলাম প্রসারের নামে শিশু বয়স থেকেই মগজ ধোলাই করে হিন্দু (কাফের)দের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে ঘৃণার বীজ বপন শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে সেখানকার জনগোষ্ঠী তাদের বাঙ্গালী সত্ত্বা হারিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের নামে আরবী কালচারের গোলামে পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মধ‍্যে হিন্দু উদ্বাস্তু অংশকে যেমন কম‍্যুনিষ্টরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় দীক্ষিত করেছিল, তারাই আবার ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি মরিচঝাঁপিতে হতভাগ্য মানুষগুলোর গণহত‍্যার মধ‍্যে দিয়ে উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল হিন্দু বাঙ্গালীদের একটি বড় অংশের কাছে কম‍্যুনিষ্টরা খলনায়কে রূপান্তরিত হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক সত‍্য হল, এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে কম‍্যুনিস্টরাই এখানে এনে বসিয়েছিল! তারপর থেকে উদ্বাস্তু পরিবারের একটি বড় অংশ কম‍্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় কম‍্যুনিস্টরাও উদ্বাস্তুদের প্রাপ‍্য অনেক সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিল। ভোটব‍্যাঙ্কের রাজনীতিতে এই লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার জন‍্য কম‍্যুনিস্টরা বাংলাদেশের মুসলমান নাগরিকদের এদেশে যাতায়াতের সুযোগ করে দেওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসন হাতে থাকার সুবাদে তাদের ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ড করিয়ে দিতে মনোযোগী হল। সেইসঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের অপ্রত‍্যক্ষ সহায়তায় এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের সহযোগীতা করার ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে কম‍্যুনিস্টরা তাদের ভোটব‍্যাঙ্কের প্রাধান‍্য অক্ষুন্ন রাখল। এতে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে টেনশান শুরু হল। তারপর সময় যত গড়ালো, কম‍্যুনিস্টদের রাজ‍্য থেকে হটানোর জন‍্য আঞ্চলিক দল তৃণমূল সৃষ্টির শুরু থেকেই তারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোটব‍্যাঙ্ক টার্গেট করে রাজনীতি শুরু করল। বাঙ্গালী জাতিটাকেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও আঞ্চলিক ভাগে ভেঙ্গে দেওয়ার কম‍্যুনিস্ট তত্ত্বকে তৃণমূল অত‍্যন্ত সুচারুভাবে প্রয়োগ করল। কম‍্যুনিস্টদের উপর প্রত‍্যাশার চাপবৃদ্ধি, অনুন্নয়ণের ফলে উদ্ভুত বিপুল বেকারত্ব ও সর্বোপরি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন কম‍্যুনিস্টদের হিন্দু, মুসলমান উভয় বাঙ্গালী ভোটব‍্যাঙ্কেই ধ্বস নামালো। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের কম‍্যুনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর একটু একটু করে বোঝা গেল যে, সম্মিলিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসনের প্রভাবে বাঙ্গালীর জাত‍্যাভিমান ও বাঙ্গালী অস্মিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর থেকে তৃণমূল আঞ্চলিক দল হওয়ার সুবাদে তার কোন সর্বভারতীয় নীতির বাধ‍্যবাধকতা না থাকায় এবং ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মত একজন সুপ্রিমো দ্বারা দল পরিচালিত হওয়ার কারনে তারা “যখন যেমন তখন তেমন” নীতিতে ভোটব‍্যাঙ্ক রাজনীতি নিয়ে চলতে লাগল। প্রথম নির্বাচন তৃণমূল জেতে কম‍্যুনিস্টদের অপছন্দ করার জন‍্য ভোট পাওয়ায় এবং তৃণমূলের কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে জোটের কারনে। এরপর কংগ্রেসের এম এল এ ভাঙ্গানো, সিপিএমে ভাঙ্গন ধরানো – এসবে পরিষ্কার হল, রাজ‍্যে ক্ষমতায় আসতে এবং ক্ষমতায় থাকতে গেলে জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় নিদান বড় কথা নয়, আসল হল “আপনা ধান্দা জিন্দাবাদ” নীতি। আর কিছু দিলে কিছু পাওয়া যাওয়ার ‘ব‍্যবসা’ – এই নীতিতে একে একে রাজ‍্যের সবকটি বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমকে রাজ‍্যসরকার তথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হল। নতুন করে সমাজে সংস্কার (!) শুরু হল। হিন্দু বাঙ্গালীদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দেগে দেওয়া হল। এই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ হল, হিন্দুদের সার্বজনীন পুজোগুলিকে পুজো না বলে ‘উৎসব’ বলা হতে লাগল – যেমন দূর্গাপুজো হল শারদোৎসব, কালীপূজো হল দেওয়ালী আর সরস্বতী পূজো বসন্ত পঞ্চমী উৎসব! আর এই উৎসব উদযাপনের মধ‍্যে দিয়ে বিকৃত মূর্তির প্রতিমাকে আর্টের উদাহরণ হিসেবে দেখা হতে লাগল। আসলে পূজোর পরিবেশকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন আমোদ-প্রমোদ ও উপভোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সংবাদ-মাধ‍্যমের ঢক্কানিনাদে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পূজোর সময় উৎকট উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। এইভাবে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লঘুকরনের সাথে সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে যাতে কোনভাবে লঘুকরন করা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হল।
এইভাবে বাঙ্গালী হিন্দু তার বাঙ্গালী সত্ত্বার অনেকটাই হারিয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে আত্মহণনের পরাকাষ্ঠা দেখাল – সেইসঙ্গে তার বাঙ্গালী জাত্মাভিমানকে জলাঞ্জলি দিল। আবার বাংলাদেশের সংখ‍্যাগরিষ্ট মুসলমান বাঙ্গালী তাদের যে জাত‍্যাভিমান দেখাল তা আরবী সংস্কৃতির মিশেলে বাঙ্গালী অস্মিতার সৌরভ বিবর্জিত এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিল। এর প্রভাবে এবং সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দখলদারির মহিমায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিরাপত্তাহীণতায় এবং অপর অংশ সুবিধাবাদী নীতির প্রভাবে বাঙ্গালীর মধ‍্যে বিভেদের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরল। এভাবে জেহাদী ও বিপরীত-জেহাদী রাজনীতির জাঁতাকলে নিজেদের ধরা দেওয়ার ফলে আজ বাঙ্গালী অস্মিতা মূমুর্ষ অবস্থায় দেহ রাখার অপেক্ষায় আছে।

প্রশাসক তুমি কার জন‍্য

ইংরেজ প্রদত্ত ভারতের ডোমিনিয়ান স্ট‍্যাটাসের সময় থেকে আভরা দেশের প্রশাসনিক দায়িত্বের জন‍্য ICS ও IPSদের সার্ভিস রুল পুরোটাই ব্রিটিশদের থেকে ধার করে চালিয়েছি। তারপর প্রজাতন্ত্র লাভের পর সর্বভারতীয় সার্ভিস এ‍্যক্ট ১৯৫১ তৈরী হয়। আর তারপর প্রশাসনিক অফিসার ICSদের যেমন IAS অর্থাৎ সিভিল সার্ভিস থেকে তা প্রশাসনিক সার্ভিস হল, তেমনি IPSও IASদের সার্ভিস রুল (এ‍্যক্ট নয়) পরিবর্তন করা হল। এটি১৯৫৪ সালে সার্ভিস এ‍্যক্টের অংশ হিসেবে চালু করা হল। তখন বিভিন্ন রাজ‍্যে কর্মরত ও নির্দিষ্ট IASদের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করলে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা দ্বারা গৃহীত হলে, অন‍্য রাজ‍্যে স্থায়ীভাবে বদলি করে দেওয়া যেত। এভাবেই ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন উজ্জ্বলকান্তি রায়কে স্থায়ীভাবে অন্ধ্র ক‍্যাডার থেকে পশ্চিমবঙ্গ ক‍্যাডারে বদলী করেন। তারপর ১৯৬৮তে আবার যখন ক‍্যাডার রুল পরিবর্তন করা হয় তখন এই ব‍্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। যেহেতু এই ক‍্যাডারে চাকুরীরতদের কেন্দ্রীয় সরকারের সার্ভিস রুল দ্বারা govern করা হয় সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার যখন সার্ভিসে যা পরিবর্তন করেন সেটা এই ক‍্যাডারে চাকরীরতদের উপর প্রযোজ‍্য হয়।
এই ঘটনার উল্লেখ করে শুধু এটুকু বলা যায় যে, এই ক‍্যাডার পোষ্টগুলি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সৃষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের চয়ন, তাদের ট্রেণিং ও প্লেসমেন্ট করে। প্রতি রাজ‍্য শুধু তাদের নিদিষ্ট ক‍্যাডারের প্রয়োজন অনুযায়ী অফিসারের সংখ‍্যা জানাতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার তার মধ‍্যে যতটা সম্ভব পুরণ করার চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যসরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এই অফিসারদের প্লেসমেন্ট দেয়। এক্ষেত্রে রাজ‍্যসরকারের ভূমিকা সীমিত। এছাড়া শেষ সংশোধনী অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট শতকরা হিসেবে রাজ‍্যের প্রশাসনিক অফিসারদের, যেমন WBCS, মধ‍্যে থেকে পদোন্নতির মাধ‍্যমেও IAS ও IPS হওয়া এখন একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। যদিও রাজ‍্যের অফিসারদের এই ধরনের পদোন্নতি সংক্রান্ত রাজ‍্যের সুপারিশের পরে শেষে তাদের নিয়োগপত্র আসে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে। এই ক‍্যাডারদের নিয়োগপত্রের শুরুতে থাকে – “The President of India is pleased to appoint…….”। আবার রাজ‍্য সরকারের অফিসার, যেমন WBCS, নিয়োগের সময় নিয়োগপত্র শুরু সময় লেখা থাকে – “The Governor is pleased to appoint……….”। এর থেকে এটা পরিষ্কার হল যে এই ক‍্যাডার পোষ্টগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। এজন‍্য এই অফিসাররা যে যে রাজ‍্যে কর্মরত, সেসব রাজ‍্য কর্মচারীদের মত না হয়ে এদের মহার্ঘভাতা, বাড়িভাড়াভাতা ইত‍্যাদি কেন্দ্রীয় হারে পেয়ে থাকেন।
আরো একটি প্রশ্ন উঠছে – রাজ‍্যসরকার নাকি এইসব রাজ‍্যে কর্মরত ক‍্যাডার অফিসারদের বেতন দেন! এমন প্রচার করে আমাদের রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি নিজেদের শুধু খেলো নয়, হাস‍্যাষ্পদ করেছে। আসলে এই অফিসারদের বেতন ইত‍্যাদি রাজ‍্যের প্ল‍্যান-এক্সপেন্ডিচার বাজেটের অন্তর্গত। আর প্ল‍্যান-এক্সপেন্ডিচারের বেতন ইত‍্যাদিসহ একটি বড় অংশ মিটিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। একমাত্র নন্-প্ল‍্যান এক্সপেন্ডিচার অংশ রাজ‍্যের এক্তিয়ার। সেখানেও আমাদের রাজ‍্যসরকার একটি সূক্ষ্ম চাল চেলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার দু এক বছরের মধ‍্যে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি কেন্দ্রীয় অর্থ বন্টন ব‍্যবস্থাকে সরলীকরনের নামে বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক অর্থাৎ, হেড অনুযায়ী রাজ‍্যগুলিকে অর্থমঞ্জুর না করে এ‍্যাডহক ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ ও অর্থ রিলিজ করেন। ফলে, কেন্দ্র হয়ত এক কাজের জন‍্য অর্থ দিচ্ছে, কিন্তু রাজ‍্যসরকার সেই অর্থ অন‍্য খাতে ব‍্যবহার করলে তাতে আইনী বাধা থাকে না। আর এইভাবেই কেন্দ্রের দেওয়া টাকায় রাজ‍্যের প্রকল্পগুলি রাজ‍্যের নামে চলতেই পারে – সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থকরা সোশাল মিডিয়ায় যতই বিপ্লব করুন, রাজ‍্যসরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার আইনতঃ কোন দোষ দিতে পারবে না। কিন্তু এখানে একটা ব‍্যপার পরিষ্কার। কেন্দ্রীয় IAS ও IPS অফিসার যারা এই রাজ‍্যে কর্মরত, তাদের বেতন, ভাতা সবই কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আসে। এই অফিসারদের কর্মরত অবস্থায় রাজ‍্যসরকারের অধীনে থাকলেও এদের চাকরী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। এই কারনে প্রাইজ পোস্টিং সহ পদোন্নতির সুপারিশ ও অন‍্যান‍্য স্বার্থের প্রয়োজনে এরা অনেক সময় রাজ‍্যসরকারের রাজনৈতিক তাঁবেদারী করে থাকেন। এদের যদি কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজন ও ক্ষেত্র বিশেষে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ডেকে নেয় তাহলে তাতে রাজ‍্যসরকারের যুদ্ধংদেহী ধরনের প্রতিবাদের কারন কি?
এই ব‍্যপার বুঝতে গেলে আমাদের বর্তমান রাজ‍্যসরকারের মোডাস অপারেন্ডি বোঝা প‍্রয়োজন। রাজ‍্যের বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রীদের ক্ষমতা অসীম মনে হলেও সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা, এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রী পর্যন্ত শুধু পরামর্শ দিতে পারেন; সরকারের নীতি নির্ধারণ করতে পারেন – আইনগত যথার্থতা ও তার রূপায়নের ভার থাকে বিভাগীয় সচিব অর্থাৎ IASদের হাতে। এমনকি বিভাগের অর্থনৈতিক দায়িত্ব সচিবের হাতে – মন্ত্রীর নয়। সংবিধান অনুযায়ী চললে তাই। কিন্তু রহস‍্য লুকিয়ে এদের কর্মপদ্ধতিতে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই IAS সচিবকুল নিজেদের জাত্মাভিমান নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন! সরকারী নীতি অনুযায়ী বিভিন্নস্তরের অফিসারদের জন‍্য গাড়ি ও তার খরচ নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট তেল খরচ ও ভাড়াগাড়ী হলে তার খরচও নির্দিষ্ট। এটি অর্থ দপ্তরের থেকে সার্কুলার দিয়ে জানানো থাকে। অথচ প্রতি বিভাগের সচিবের জন‍্য বিভাগের গাড়ি ছাড়াও বিভাগীয় কর্পোরেশান থেকে গাড়ি বরাদ্দ হয়। জানিনা এমন ক’জন বিভাগীয় সচিব আছেন যার জন‍্য বিভাগের থেকে একটিমাত্র গাড়ি নির্দিষ্ট আছে। বরঞ্চ একসঙ্গে একাধিক গাড়ি চড়ার ক্ষমতা এইসব সচিবরা আয়ত্ব করেছেন। কোন বিভাগীয় মন্ত্রী এতে আপত্তি করেছেন বলে জানিনা। কারন একটাই – প্রশ্নাতীত আনুগত‍্য। তাহলেই সব ঠিক রহেগা!
IASদের কাজ হল সরকারী প্রশাসন সাধারন মানুষের স্বার্থ বজায় রেখে আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে চালানো। তাঁরা people’s servant। কিন্তু কার্যক্ষেত্র এদের ঠাটবাট, চলনে বলনে দেখি এরা বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে চাকরী করতে আসে যে people are their servants। এটি কিন্তু পরাধীন দেশের বৃটিশ সিস্টেমের উত্তরাধিকার। এরা নিজেদের ইগো আর ভ‍্যানিটি নিয়েই থাকে – এমনকি অধীনস্ত কর্মচারীদেরও প্রাপ‍্য সম্মানটুকু দেয় না। তবে, একটি ব‍্যপারে তারা অতিমাত্রায় সচেতন। সেটা হল যথা সময় যথা স্থানে তৈলমর্দন। রাজ‍্যের তথাকথিত শাসনকর্তারা, যারা সর্বদা “অনুপ্রেঢ়না” চালিত, জানেন যে, তাঁদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। যদি বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা যায় তাহলে শুধু পকেটনয়, আরো অনেক কিছু ভর্তি করা যেতে পারে। তবে, একাজের জন‍্য তারা পুরস্কার ও তিরস্কার নীতির টোপ ঝুলিয়ে এইসব প্রশাসকদের, জেলাস্তর থেকে বিভাগীয়স্তর পযর্ন্ত কন্ট্রোল করে। এই অফিসাররাও পোস্টিংয়ের সুবিধা সহ অন‍্যান‍্য সুবিধার জন‍্য রাজনীতিবিদদের তাঁবেদারী করতে আগ্রহী হয়। কোন অফিসারের ‘সততার চুলকানি’ উঠলে তা দমন করার রাস্তাও রাজ‍্যসরকারের হাতে আছে। তাহল তথাকথিত রসকষহীণ স্থানে বদলি – এমনকি অফিসার-অন-স্পেশাল ডিউটি করে বসিয়ে রাখা। এভাবেই এই কেন্দ্রীয় অফিসারদের রাজ‍্যসরকার তার তাঁবে করে রেখে দেয়।আবার যখন সেট-ইনএ থাকা কোন অফিসারকে কেন্দ্রীয় সরকার বদলি (বলা হয় ডেপুটেশান; কারন এরা এখন স্থায়ীভাবে রাজ‍্যে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী) করে, তখন স্বাভাবিক কারনেই সেট-ইন বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কায় রাজ‍্যসরকার তাদের ছাড়তে চায় না। এখানে রাজ‍্যসরকারের ডাবল স্ট‍্যান্ডার্ড প্রকাশ পাচ্ছে। রাজ‍্যের ধামাধরা বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে, রাজ‍্যসরকার এই IAS, IPSদের ছেড়ে দিলে সরকারের প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে! এটি অত‍্যন্ত হাস‍্যকর যুক্তি। কারন রাজ‍্যসরকারের ‘সুপ্রিমো’ থেকে পায়াভারী মন্ত্রী, সকলেই বলেছেন যে, মাস্টাররা শিক্ষাঙ্গনে রাজ‍্যসরকারের হুকুম তামিল করতে বাধ‍্য – কারন রাজ‍্যসরকার তাদের বেতন দেয়! এইভাবে বেতন দেয় বলে আজকে রাজ‍্যসরকারের অধীনস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অবস্থা নবান্নের করণিকদের চেয়েও অধম! তাহলে সেই একই যুক্তিতে IAS, IPSদের নিয়োগ থেকে বেতন সবই কেন্দ্রীয় সরকার দেয় বলে তারা কেন কেন্দ্রের হুকুম মানবেন না – আর কোন যুক্তিতে রাজ‍্যসরকার ও তার ধামাধরা সংবাদ-মাধ‍্যম এজন‍্য কেন্দ্রের বিরোধীতা করে। কোন যুক্তিতে এই অফিসারদের কেন্দ্রে ডেপুটেশানে যেতে হলে ‘মাননীয়া’র অনুমতি নিতে হবে তা কিন্তু কেউ স্পষ্ট করে বলছেন না। যে সং সাজা মাধ‍্যমগুলি এত লাফালাফি করছে তাদের উদ্দেশ‍্যে বলি – চরিত্র আগেই বিকিয়ে দিয়েছেন, এখন মেরুদন্ড হারিয়ে কি পেলেন!
IAS, IPSদের সার্ভিস রুল কেন্দ্রীয় সরকারের বিচার্য বিষয়। রাজ‍্যসরকারী কর্মচারীদের চাকরী ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি থাকলে তাঁরা স্টেট অ‍্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব‍্যুনালে (SAT) আপীল করতে পারেন। কিন্তু IAS, IPSদের ক্ষেত্রে অন‍্য কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীর মত একই কারনে সেন্ট্রাল অ‍্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব‍্যুনালে (CAT) যেতে হয়। তাহলে রাজ‍্যে থাকতে অধিকাংশ IAS, IPS এত আগ্রহী কেন? কারন পরিষ্কার – প্রাইজ পোষ্টিং – রাজ‍্যের মধ‍্যে যা সম্পূর্ণভাবে রাজ‍্যসরকারের এক্তিয়ারভূক্ত। আর এই পোষ্টিংএই ত যত গুড়,মধু! কারন এই অফিসারদের সঙ্গে রাজ‍্যসরকার চালানো রাজনৈতিক দলের ‘সেটিং’ একবার হয়ে গেছে। তা নষ্ট হলে নতুন অফিসারের সঙ্গে সেটিং করা শুধু সময়সাপেক্ষ নয়, অনিশ্চয়তাও আছে। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারের জায়গায় রাজ‍্যের এই প্রতিবাদী হস্তক্ষেপ। যদি কেন্দ্রীয় সরকার এ ব‍্যপারে পিছিয়ে যায়, তাহলে পর্দার পিছনে অন‍্য রাজনৈতিক খেলা সম্পর্কে জনমানসের ধারণা আরো বদ্ধমূল হবে।
এবার এই প্রশাসনিক পদগুলি – বিশেষতঃ IASদের কাজকর্ম এবং এদের রাখার যৌক্তিকতা বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। ICS কুল ছিল বৃটিশদের দ্বারা সৃষ্ট এবং শুধু তাদের স্বার্থ দেখা ও ভারতীয় “নেটিভ”দের দমিয়ে রাখার কাজের জন‍্য তারা নিয়োজিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর নাম পাল্টে এই সার্ভিস হল IAS। এক্ষেত্রে কাজের ধারা ও তার অভিমুখ সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা করতে গেলে যে সুদূরপ্রসারী দুরদৃষ্টি থাকা দরকার তা তদানীন্তন শাসকদের মধ‍্যে দেখা যায়নি। বৃটিশ সিস্টেমের উপর কিছু কসমেটিক ও সিম্বলিক পরিবর্তন করা হল মাত্র। ব‍্যপারটা কেমন দাঁড়ালো? গাউন পরিহিত বৃটিশ ভদ্রমহিলা যদি গাউনের উপর ভারতীয় মহিলাদের ব্লাউজ পরেন তবে যেমন দেখায় তেমন দাঁড়ালো – না ঘরকা না ঘাটকা। এই নতুন শ্রেণী যারা আমলা নামে অভিহিত হল তারা রাজনৈতিক নেতাদের ‘হাত’ হিসেবে নেতাদের হুকুম তামিল করতে লাগল – বিনিময়ে নিজেদের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিতে লাগল। এই সার্ভিসের মত পৃথিবীর কোথাও এমন টাইম বাউন্ড প্রমোশান সহ স্থায়ী চাকরীর দেখা মেলে না। এদের কার্যকারিতা বিচারের গন্ডি না থাকায় যদি সমাজের উন্নয়ণ এদের কার্যকারিতার পরিমাপ হয়, তাহলে এরা কেউ পাশ করার যোগ‍্যতা অর্জন করবে না। এই প্রশাসককুল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের সেবার বদলে রাজনৈতিক বসদের সেবাকেই ‘সার্ভিস রুল’ মনে করল। ঔদ্ধত‍্য, আত্মম্ভরীতা ও দূর্ণীতি ধীরে ধীরে পুরো সার্ভিসটাকেই নষ্ট করে দিল। যে কোন চাকরীতে মূল‍্যায়ন হয়। শুধু এদের হয়না। এদের প্রভূত্ব সমাজের সব স্তরে লক্ষ‍্য করা যায়। এরা বিনা ট্রেণিংয়ে সব বিষয়ের ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসাবে সরকারী নোট দেন! এর ফলে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সামাজিক অনুন্নয়ন ও বৈষম‍্যের চিত্র সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে।
এখন এ ধরনের সার্ভিস সারা বিশ্বেই অচল। পরিবর্তে বিশেষজ্ঞের যুগ। এখন দায়িত্ব দিয়ে বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের মাধ‍্যমে এই IASদের প্রতিস্থাপন করার সময় এসেছে। এমন অচল, স্থবির ব্রিটিশ উত্তরাধিকার দেশবাসীকে কতদিন বইতে হবে কে জানে।

করোনায়িত পশ্চিমবঙ্গে সবাই লাভের কড়ি গোছাতে ব‍্যস্ত

করোনায়িত পশ্চিমবঙ্গ। কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউ সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ‍্যেও অপ্রতিরোধ‍্য। অপ্রতিরোধ‍্য বললাম বটে, তবে সত‍্যিই কি প্রতিরোধের চেষ্টা সরকার বা আমজনতা – কারোর মধ‍্যে আছে কি? অনেক সংবাদ-মাধ‍্যম ঘোষিত বোদ্ধা – বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন রকমের জ্ঞান দিয়ে আসছেন। এরমধ‍্যে আমজনতা সরকারী বিধিনিষেধের ছাড়ের মধ‍্যে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমিক সিরিজের সাময়িক বিনোদনের খোরাক পেয়ে যাচ্ছেন!
যেমন ধরুন সরকারী ছাপ মারা বিশেষজ্ঞ কমিটির মতে খোলা জায়গায় জলশা বা যাত্রা দেখতে গেলে করোনা সেখানে কবাডি খেলতে গেলেও কাউকে ছুঁতে পারবে না। আবার সিনেমা, থিয়েটার অর্ধেক দর্শক নিয়ে চললে কোন ভয় নেই, কিন্তু তার বেশী দর্শক এলেই করোনা সুনামির গতিতে আছড়ে পরবে! আবার বিয়ে সহ অন‍্য অনুষ্ঠান বাড়িতে ২০০ জন নিমন্ত্রিত অভ‍্যাগত এলে করোনা বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি পর্যন্ত করবে না! যদি নিমন্ত্রিত ২০১ জন হয়ে যায় তাহলে করোনার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পরবে! প্রথমে সেলুন, বিউটি পার্লার ও রেষ্টুরেন্ট বন্ধ করার আদেশ দিলেও তাঁরা, অর্থাৎ রাজ‍্যের করোনা বিশেষজ্ঞরা, দিব‍্যচক্ষে জানলেন এদের বাণিজ্য করার সময় কমিয়ে দিলে করোনা কোন ক্ষতি করতে পারবে না! দোকানপাট, আধুনিক শপিংমল ৫০% ক্রেতা নিয়ে অনুমতি আছে। তবে, ১০০% কতজনে হবে তার কোন মাপ নেই! অর্থাৎ কত সংখ‍্যার ৫০% তা কেউ জানে না! পরিবহন ও লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিবহন ক্ষেত্রে বাস, ট্রেনের সংখ‍্যা কমিয়ে যাত্রীসংখ‍্যা কমানো যায় – এই তত্ব প্রথম জানা গেল! আবার দেখুন, ফুটবল, ক্রিকেট সহ বিভিন্ন খেলাধূলা চললে নাকি করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারন নেই! বোধহয় এরা ধরে নিয়েছেন যে, করোনা খেলোয়ারদের সমীহ করে ছেড়ে দেবে!
কিন্তু হ‍্যাঁ। রাজ‍্যে পড়াশুনা একদম বন্ধ থাকবে – স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ‍্যালয়, গবেষণা – সব। শিক্ষা মনেহয় এরাজ‍্যে বাহুল‍্যমাত্র। ডিগ্রি পাওয়ার সুবন্দোবস্ত কিন্তু করা আছে। দু বছর অ-শিক্ষায় রাজ‍্য চলছে। এবার তৃতীয় বছরটাও এভাবে চালাতে পারলে মোটামুটিভাবে একটি প্রজন্মের শিক্ষার ভিত্তিই নষ্ট করে দেওয়া যাবে। বিশ্বব‍্যাঙ্কেরগ্লোবাল ডিরেক্টার জেমি সাবেত্রাও অবিলম্বে স্কুল, কলেজ খোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন। এই বন্ধে ক্ষতি সাধারন মানুষের – ক্ষতি মনুষ‍্যত্বের। লাভ কার? সেই লাভের কান্ডারীর খোঁজ করতে গিয়ে কয়েকটি অদ্ভুত তথ‍্য এবং তার বিশ্লেষণে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিল। প্রথম প্রশ্ন, অনলাইন স্টাডির ধারনা – এর প্রচারে জানলাম যে দেশে, বিদেশে শিক্ষাদান ও শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিচিতি থাকার সুবাদে আমার জানার যেটুকু ভাঁড়ার তা নিতান্তই সেকলে,অচল! এখন শিক্ষাদান বিষয়ে বিজ্ঞ হলেন বলিউড তারকা থেকে প্রাক্তণ ক্রিকেট খেলোয়াড়! অভিনেতার থেকে জানতে পারলাম যে আধুনিক শিক্ষাদানের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি এক ক্লাশে দু জন শিক্ষকদ্বারা শিক্ষাদান! “বিজ্ঞাপনের গরু গাছে চড়ে” প্রবাদটি জানা থাকলেও জানা ছিলনা যে, এইসব অনলাইন টিউশান ক্লাশ করানো কোম্পানীগুলি ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকদের কতটা মূর্খ মনে করে। এদের বিজ্ঞাপনের কালোয়াতি প্রচারে মনে হয় সর্বজ্ঞ শিক্ষক ও সর্বজ্ঞ ছাত্র-ছাত্রী তৈরী করার জন‍্যই অনলাইন ক্লাসের কোম্পানীগুলির জন্ম হয়েছে – যেখানে শিক্ষক (কোন একটি বিষয়ের) বলছেন, ছাত্র যদি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরী ক্ষায় পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে ঐ শিক্ষকও ইঞ্জিনিয়ার হলেন! পরশুরামের ছাগলাদ‍্য ঘৃত দাওয়াইয়ের কথা মনে পড়ল! তবে, এরা যখন বহু কোটি টাকা খরচ করে এত বিজ্ঞাপন করছে, তখন এদের বিনিয়োগের পরিমাণ কল্পনা করলে অন্ততঃ এটা বোঝা যাবে যে এরা লাভের ব‍্যবসা করতে এসেছে – টাকা ওড়াতে নয়। আবার এদের খদ্দের বা ‘মুরগী’ যাই বলা যাক, সেই টার্গেট সংখ‍্যা অনেক কমে যাবে যদি স্কুল, কলেজ খুলে গিয়ে শিক্ষাদান আবার করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যায়। সুতরাং এইসব কোম্পানী চাইবে, যেকোন মূল‍্যে ক্লাশরুম শিক্ষা – বিশেষতঃ স্কুলশিক্ষা বন্ধ থাকুক। কারন, এদের ‘খদ্দের’ স্কুল লেভেলেই বেশী। তারা কি ধরনের ‘তালা’ ব‍্যবহার করে এই রাজ‍্যে ক্লাশরুম শিক্ষা বন্ধ রেখেছে তা অনুমানসাপেক্ষ হলেও সাধারণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেজন‍্য এমন ধারনা করা অমূলক নয় যে, করোনার দোহাই অন‍্য সব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন‍্য ব‍্যবহার না করে শুধু শিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রেই ব‍্যবহার করা হচ্ছে – বিশেষতঃস্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে। অথচ, যত হাস‍্যকর পদ্ধতিতেই হোক না কেন, পরীক্ষা হয়েচলেছে যথারীতি!
দেখা যাচ্ছে, মদের দোকান ও বার খোলা রাখতে সরকারী বিশেষজ্ঞরা খুবই দরাজ। এই রাজ‍্যে করোনা ভাইরাস বোধহয় মদের নাম শুনলেই উল্টো রাস্তায় দৌড়ে পালায়। করোনা জুজুর ভয়ে মানুষের বাইরের কাজকর্ম যত কমবে, মদ বিক্রি তত বাড়বে – এই সাধারণ সূত্রে সরকারী কোষাগার যে মদ বিক্রির থেকে পাওয়া আবগারী শুল্কের প্রভাবে স্ফীত হচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। আবার, যেখানে যতই স্ফূর্তি করুন, নিমন্ত্রণ খান, রাত দশটার মধ‍্যে আপনাকে আপনার রেজিষ্টার্ড খোঁয়ারে – মানে, আপনার বাড়িতে ফিরতে হবে। রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা অব্দি রাজ‍্যের বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাস রাস্তাঘাট, বায়ুমন্ডল – মানে খোলা আকাশের নীচে – সমস্ত কিছুর দখল নেয়! আর সকাল পাঁচটা বাজার একমিনিটেরও কম সময়ে ভাইরাসগুলি কোথায় লুকিয়ে পড়ে তা বোধহয় ঐ বিশেষজ্ঞরাই জানেন! এতে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেলেও সেখানে কারোর যেমন পৌষমাস, তেমনি যাদের গাড়ি ছাত্রছাত্রী, আইটি ও কলসেন্টারের কর্মীদের পরিবহন দেয় তাদের সর্বনাশ।
একটি বেসরকারী ব‍্যাঙ্কের শাখায় পাশবই আপডেট করতে গিয়ে জানলাম যে করোনার কারনে গত ছ মাস ধরে পাশবই আপডেট করা যায়না! পোষ্টঅফিসে রেজিষ্টার্ড পোষ্ট, স্পীডপোস্ট সহ প্রায় সব পোস্টাল সার্ভিস বন্ধ – অজুহাত করোনা! কদিন আগে দেখলাম, একটি শিশুকে তার মা খাওয়ানোর সময় ভয় দেখাচ্ছিল যে, তাড়াতাড়ি না খেলে করোনা এসে শিশুটিকে ধরবে! শুনলাম এভাবে ভয় দেখানোর জন‍্য শিশুটি নাকি তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। সাম্প্রতিকতম যে আন্দোলন বাসমালিকরা করছেন তা হল করোনার জন‍্য বাসভাড়া বৃদ্ধি! আবার কেন্দ্রীয় সরকারও পিছিয়ে নেই। তাদের সংখ‍্যাতত্ত্বের মাহাত‍্যে দেশের অর্থনীতি নাকি এখন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাওয়া দৌড়ের থেকেও দ্রুত ছুটছে! তবুও কেন ব‍্যাঙ্কের আমানতে সুদের হার ক্রমশঃ কমছে তা বোধগম‍্য নয়। এখানে একটা কথা পরিষ্কার – মন্ত্রী-সান্ত্রী সবাই ধরে নিয়েছেন যে জনগণ হচ্ছে গোবর-গনেশ, তাকে যা বোঝানো যায় তাই বুঝবে!
এ রাজ‍্যের ভূক্তভোগী মাত্রই জানেন, নিজের বসতবাড়ি বানানো বা সম্প্রসারণের জন‍্য কাজ শুরু করতে গেলে স্থানীয় “সিন্ডিকেট” নামক এক সংঘবদ্ধ তোলাবাজির শিকার হতে হয়। এদের এলাকাভিত্তিক ‘রেট’ হয়। আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলছে, এই রেট করোনা উপলক্ষ‍্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তোলাবাজরাও মানুষ – করোনার সঙ্গে যোঝার রসদ তাদেরও চাই! পোষ্ট অফিসের অনেকটা কাজকর্ম বন্ধ – কোন আদেশবলে তা জানা নেই। বলা হচ্ছে করোনায়িত সমাজে এখন স্পীডপোষ্ট, রেজিষ্ট্রীপোষ্ট ইত‍্যাদি প্রকারের কাজকর্ম বন্ধ। অবশ‍্য বেসরকারী ক্ষেত্রে এগুলো সবই চালু আছে – অবশ‍্যই উচ্চতর মূল‍্যে। সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছে মোদ্দা ব‍্যপার দাঁড়ালো, সরকারী পোষ্টাল বিভাগের গঙ্গাযাত্রা আর সেইসঙ্গে চড়া দামে বেসরকারী পোষ্টাল সার্ভিসের পুষ্টিকরন! অবশ‍্য এর জন‍্য করোনা দায়ী – দুর্জনে বলে করোনা অজুহাত মাত্র।
তবে হ‍্যাঁ, যতই করোনার আস্ফালন চলতে থাকুক – যতই ডাক্তার, সিস্টার, স্বাস্থ‍্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ুন, নির্বাচন – সে উচ্চতম থেকে নিম্মতম স্তর – সব জায়গায় চালু থাকছে। ভোটপ্রচারে প্রার্থী দলবলসহ প্রচারে বেরোলে তাদের দেখেই বোধহয় করোনা লজ্জাবতীলতার মত একদিকে নুয়ে পড়ে থাকবে! করোনার ঘোষিত তৃতীয় ঢেউয়ের মধ‍্যেই কলকাতা পুরসভার নির্বাচন ‘সম্পন্ন’ হল। আর তারপর কয়েকদিনেই দেশের সব বড় শহরের মধ‍্যে সংক্রমণের সংখ‍্যায় কলকাতা প্রথম স্থানে পৌঁছে গেল। তারপর হাইকোর্টের গুঁতোয় বিধাননগর, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও চন্দননগর পৌরনিগমগুলির নির্বাচন তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে বাধ‍্য হল! বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় প্রার্থীদের প্রচারে কিন্তু কোন কার্যকরী বাধানিষেধ আরোপ হল না! অর্থাৎ আরো তিন সপ্তাহ প্রচার চলতে পারে! বাড়ি বাড়ি প্রচার চলবে – শুধু এইসব প্রার্থী, তাদের কর্মী ও ভোটারদের করোনা ধরবে না!
এবার করোনাকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণে আসা যাক – সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব ও তার দোহাই। এটা ঠিক যে, সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব সাধারণভাবে যতটা না কর্মচারীদের উপর পড়েছে, তার চেয়ে অনেক মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে। সেখানে কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করা থেকে ধরে চাকরী হারানোর প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে করোনা এবং তৎসংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারী বাধানিষেধের কারনে, মানুষের দুর্গতি অপরিসীম। সরকার নাকি এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্মী প্রকল্প – ভান্ডার ইত‍্যাদি অনেক প্রকল্প দিয়েছে – একটা এমন প্রকল্প মনে পড়েনা, যেখানে এই কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের জন‍্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিজায়ী শ্রমিকের (কারা পরিজায়ী তার সংজ্ঞা রাজ‍্য সরকারের নথিতে আছে কি?) জন‍্য অনেক কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিয়েছে – সরকারের পোঁ ধরা সংবাদ-মাধ‍্যম; কিন্তু এই পরিজায়ীদের মধ‍্যে কতজন আবার তাঁদের পুরোনো কর্মসংস্থান দেওয়া রাজ‍্যে ফিরে গেছেন, কেন গেছেন – এসব তথ‍্য রাজ‍্য সরকারের কাছে নেই।
রাজনীতি সর্বস্ব – এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই – নীতিতে বিশ্বাসী শাসক, যে সর্বদা ধামাধরা মোসাহেববেষ্টিত, তার বধির কর্ণকুহরে অনাহার, অর্ধাহারে থাকা, বিনা চিকিৎসায় ভুগতে থাকা মানুষের হাহাকার পৌঁছায় না।
এবার ডাবল স্ট‍্যান্ডার্ড দেখানো বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যম আর রাজনীতিকদের করোনা হাতিয়ার করে মিথ‍্যে ইমেজ তৈরীর প্রচেষ্টার কথা বলে এবারের মত শেষ করব।
রাজ‍্যের সুপ্রিমোর নাম ও ছবিসহ ফলের ঝুড়ি (!) এবং আরো কিছু জিনিষ নাকি সব করোনা পজিটিভ রোগীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে – মহান সরকারের মানবিকতা মহতী উদ‍্যোগ! কার্যক্ষেত্রে সংবাদ-মাধ‍্যম মারফৎ জানা গেল, সৌরভ গঙ্গোপাধ‍্যায় ও সুকান্ত মজুমদারের কাছে এসব পাঠানো হয়েছে। এই প্রচারকে ১০০% রিডাকসান সেলে বিক্রি হওয়া বাংলার বুদ্ধিজীবি(!) রা অনুপ্রাণিত বাহবায় ভরিয়ে দিল। এখানে আমার জানা দুটো ঘটনার উল্লেখ করছি। আমার এক পূর্ব কলকাতার বন্ধুর এই সময়ে করোনা পজিটিভ হওয়ার পর সে গৃহ-অন্তরীন হয়। এছাড়া আমার পরিবারের এক যুব সদস‍্য করোনা পজিটিভ হয়ে প্রায় একই সময় গৃহ-অন্তরীন হলেও তাদের কারো কাছেই কোন ফলের ঝুড়ি ত দূরস্ত্, কোন সৌজন‍্যবার্তা অব্দি আসেনি। অবশ‍্য তারা ‘সেলিব্রিটি’ বা রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব নয়। সুতরাং তথাকথিত সেলিব্রিটিকে যুক্ত করে প্রচার পাওয়ার মাধ‍্যম অবশ‍্যই করোনা – যা নবতম রূপ ওমিক্রন।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের বক্তব‍্য অনুযায়ী ওমিক্রন আরটিপিসিআর-এ ধরা পরে না। এর জন‍্য যে জিনণ সিকোয়েন্সিং দরকার তার টেষ্টের সুযোগ এখানে সীমিত। অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ‍্যমে রোজ যে বহু হাজার পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে তা নিশ্চয় ওমিক্রন নয় – ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট! তাহলে এখানে ওমিক্রন ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? পুরো ব‍্যপারটাতেই কেমন এলোমেলো যুক্তির গন্ধ। সুতরাং সাধু সাবধান। নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ‍্য নিজে বাঁচান। “ধান্দাবাজী জিন্দাবাদ”এর দর্শন থেকে শতহস্ত দূরে থাকুন।

ভারতীয় উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের ফল

ভারত আর পাকিস্তান দুটি দেশ একসঙ্গে ৭৫ বছর আগে স্বাধীনতা পেয়েছে। তারপর পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সংবিধান এতবার সংশোধন করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের সামরিক সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর সবকিছুই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আজ, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর, এর কারন খুঁজতে বসে প্রথমেই যে কথাটা মনে হচ্ছে তাহল, “আমরা যা নই তাই সেজে সবার চোখে যে দিই ধুলো”। আমাদের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই আমাদের নেতারা তাদের মুখগুলিকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে দেশপ্রেমের অভিনয় করে গেছেন।
জাত-পাতের রাজনীতি ভারতের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই দেশের রাজনীতিতে অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মত প্রবহমান। গান্ধীজির অসহযোগীতায় ভীমরাও রামজী আম্বেদকারের মত একজন যথার্থ গুণী, বিদ্বান মানুষকে দেশের স্বার্থে সঠিকভাবে ব‍্যবহার করা হয়নি। গান্ধীজি মুখে অন্তজ ও অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের জন‍্য সহানুভূতি দেখালেও তাদের যথার্থ সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়নের জন‍্য কোন সার্থক প্রয়াস করেন নি। গান্ধীজি তাঁর অহঙ্কার ও প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট থাকার কারনে (যা ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রায় অধিকাংশের মধ‍্যেই দেখা যায়) তিনি শুধু সুভাষচন্দ্র নয়, শ‍্যামাপ্রসাদকেও তাঁর যোগ‍্য স্থানপ্রাপ্তিতে প্রত‍্যক্ষ‍্যে বা পরোক্ষে বাধা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ‍্যের – বিশেষতঃ বাংলার মানুষদের অগ্নিগর্ভ স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মবলিদান তাঁকে বিচলিত করেনি। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি তাঁর অহংকার প্রসূত ঘৃণা তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধেই প্রশ্ন তোলে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির থেকে অধিক গুরুত্ব দিতেন তাঁর অহিংস আন্দোলনের পথকে! পৃথিবীর অন‍্য কোন দেশে অহিংসার মাধ‍্যমে স্বাধীনতা আসেনি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর ব্রিটেনের অর্থনীতি ও ঐ সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি – সর্বোপরি উইনস্টন চার্চিলের সাধারণ নির্বাচনে পরাজয় আর তার সঙ্গে জাপানের আত্মসমর্পণ – এসবের যথেষ্ট সম্পর্ক আছে। গান্ধীজি সারা দেশের নেতা ছিলেন ; কিন্তু তাঁর কাছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে এই অঞ্চলগুলি থেকেই সিংহভাগ নেতৃত্ব ক্ষমতার শীর্ষে আসেন। গান্ধীজি তাঁর অহিংস আন্দোলনকে একমাত্র গুরুত্ব দিলেও কখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন সহিংস আন্দোলনের প্রতিবাদ করেননি। কেন? এর একটি ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়। তাহল, গান্ধীজির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব মানুষের নেতা হওয়ার ইচ্ছের জন‍্য তিনি মুসলমান নেতাদের সাম্প্রদায়িক কাজকর্মের ব‍্যপারে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তিনি এই নেতাদের প্রতি সফট ফিলার যা সাদা বাংলায় নৈতিক ঘুষ বলা যায় তা দিয়ে গেছেন। এরজন‍্য একাধিকবার কংগ্রেসকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। তবে, গান্ধীজি একাই এভাবে মুখোশের আড়ালে রাজনীতি করেছেন তা নয়, আরেকজনের নাম অবশ‍্যই বলতে হয় – যিনি গান্ধীজির সবচেয়ে স্নেহধন‍্য শিষ‍্য জওহরলাল নেহরু। বিলেতের ব‍্যরিস্টার নেহরু কোনদিনই সাধারন জননেতা ছিলেন না। তাঁকে জননেতা বানানো হয়েছিল। তাঁর বিলেতি আচার আচরণ, দেশের কৃষিজীবি ও শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে যোজন দূরত্বে থাকা নেহরু, গান্ধীজির প্রত‍্যক্ষ পক্ষপাতিত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। যেহেতু কোন সংগ্রামী আন্দোলনের মধ‍্যে দিয়ে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নেহরু প্রধানমন্ত্রীর গদীতে আসীন হননি, সেসময়কার সম্ভ্রান্ত ও ধনী মানুষদের মত তাঁর উন্নাসিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং সমাজের সব শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে চলার মানসিকতা ছিলনা। ফলে, তিনি কংগ্রেসের coterieর নেতা হিসেবে দেশের ক্ষমতায় নিজের coterieকেই প্রমোট করেন। আর তার জন‍্যই স্বাধীনতার সময় থেকেই দেশে যোগ‍্য ক‍্যাবিনেটের অভাব ছিল। পরবর্তীতে অবশ‍্য ধীরে ধীরে কিছু যোগ‍্য মানুষ দেশের শাসনক্ষমতার অলিন্দে এলেও গোষ্ঠীতন্ত্র এখনো আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল কথা।
আবার অযোগ‍্য মানুষের হাতে ক্ষমতা গেলে যা হয় তা শুরু থেকেই আমাদের দেশেও চালু ছিল। তাহল, ক‍্যালিবারের বদলে চাটুকারিতা ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গুণ হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। সুখ-স্বাচ্ছন্দভোগের এমন উপায় চিরস্থায়ী করার জন‍্য বংশগতভাবে গদী ধরে রাখার পরিকল্পনা শুরু হল। এই কাজে সুবিধে পাওয়ার জন‍্য সংবিধানকে হাতিয়ার করে তার বিকৃত ব‍্যখ‍্যা করা শুরু হল। প্রথমে ১৯৪৭ সালে কিন্তু আমরা ইংরেজ সাম্রাজ‍্যের ডোমিনিয়ন স্ট‍্যটাস পাই। পরে ১৯৫০ সালে আমরা ভারতকে প্রজাতন্ত্র (republic) হিসেবে ঘোষণা করি। আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান নাম Sovereign Socialust Secular Democratic Republic of India (Union of States)। এই নাম মেনে আমাদের রাষ্ট্রের স্বরূপ বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব! কারন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক সংজ্ঞা অনুসারে কয়েকটি বিপরীতধর্মী শব্দের সমাহার ও তৎসহ বাস্তব বিশেষণে ভূষিত হয়ে আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা ব‍্যখ‍্যা করতে গেলে বলতে হয়, এটি এমন একটি রাষ্ট্র যে, তার স্বরূপ সর্বদা ব‍্যখ‍্যা নির্ভর যা কিনা ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত যেকোন পরিবর্তন হতে পারে!
প্রথমে আসি Democratic Republic অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (!) এর ব‍্যখ‍্যায়। গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত সরকার দেশ চালালেও দেশের শাসনপ্রক্রিয়ায় জনগণের সকল প্রকার অংশগ্রহণ স্বীকৃত। সরকার তার কাজের সবরকম স্বচ্ছতা জনগণের কাছে জানাতে বাধ‍্য। প্রজাতন্ত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পদের নির্বাচন প্রত‍্যক্ষ না হয়ে অপ্রত‍্যক্ষ হতে পারে। যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অপ্রত‍্যক্ষভাবে হয়। আবার রাজতন্ত্র বা বংশগত শাসন গনতন্ত্রে থাকলেও তা প্রজাতন্ত্রে সম্ভব নয়। যদিও গণতন্ত্রে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র (যেমন গ্রেট ব্রিটেন) সম্বন্ধে কিছু বলা নেই, তবু গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় বংশগতভাবে শাসনভার পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেজন‍্য এই দুটি আপাত নিরীহ বাক‍্য ব‍্যবহার করে প্রথমেই জনগণের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার প্রশ্নে জল ঢালা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার সময় থেকেই স্বার্থান্বেষী অযোগ‍্য মানুষজন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ভিড় করার পর তাদের মনে সাধ জাগলো, যদি এই ক্ষমতার মধুভান্ড বংশপরম্পরায় কুক্ষিগত করা যায়! এজন‍্য যতক্ষণ গণতন্ত্র তাদের কাজের পরিপন্থী না হচ্ছে ততক্ষণ গণতন্ত্রের ধারক আর যখন তাদের কাজের স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে তখন প্রজাতন্ত্রের দোহাই – অর্থাৎ, যখন যেমন তখন তেমন, করার সুযোগ নেওয়া শুরু হল। গণতন্ত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার – এই চিন্তাধারার পরিপন্থী ‘আরক্ষণ নীতি’কে সমাজের সকল ক্ষেত্রে স্থায়ীত্ব দেওয়া হল। এই সময় আমরা গণতান্ত্রিক থাকলাম না! শাসকের ভোটবাক্সের স্বার্থে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সংজ্ঞা এবং বয়স – দুইই পরিবর্তিত হল। পরবর্তীকালে স্বতঃস্ফূর্ত মতদান প্রক্রিয়ায় বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন স্তরে ‘হস্তক্ষেপ’ শুরু হল। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, যতদিন পর্যন্ত জওহরলালের কোন বংশধর স্থায়ীভাবে প্রধানমন্ত্রীত্বের গদীতে না বসেছেন ততদিন পর্যন্ত কংগ্রেস পার্টি দেশের সুস্থিরতা ব‍্যহত করতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এর থেকে একটি জিনিষ খুব পরিষ্কার যে, ভারতের স্বাধীনতা আর যাই হোক, গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
জরুরী অবস্থার সময় দেশের মধ‍্যে বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের বন্ধুদল কম‍্যুনিষ্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পারিবারিক শাসন কায়েম করার সুবিধের জন‍্য ভারত রাষ্ট্রকে Socialist ও Secular রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধানে সংশোধনের মারফৎ অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে করে দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে তাদের রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মতার মূল ভিত্তিটাই পাল্টে দেওয়া হল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে plebiscite ছাড়া তা করা যায় না। আশ্চর্য লাগে, এখনো অব্দি পরবর্তী কোন সরকার এ ব‍্যপারে পদক্ষেপ করেনি। এতে কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলির গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানোকে সাধারণ মানুষ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
যে পটভূমিতে ভারত ত্রিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল, ধর্মের (religion) ভিত্তিতে সেই বিভাজন মেনে নেওয়ায় যেমন পাকিস্তান (পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশও একই পথের পথিক) যথার্থভাবে মুসলিম রাষ্ট্র, তেমনি ভারতও যুক্তিগ্রাহ‍্যভাবে হিন্দুরাষ্ট্র হওয়ার কথা; অন্ততঃ ডোমিনিয়ন স্ট‍্যটাস দেওয়ার তথ‍্য অনুযায়ী। কিন্তু ভারতীয় শাসক তার কন্ট্রোল্ড গণতন্ত্রে মুসলমান নাগরিকদের তোষন করার প্ল‍্যান অনুসারে ভারতে সর্বধর্ম-সমন্বয়ের সোনার পাথরবাটি তুলে ধরলেন! আইন মোতাবেক তা করা যায় না। এমন নয় যে সেই রাষ্ট্রে অন‍্য ধর্মালম্বীরা থাকতে পারবে না বা তাদের কোন বৈষম‍্যের শিকার হতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গান্ধীজির মদতে জওহরলাল নেহরু ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে মানতে চাননা। তাঁর এই অযৌক্তিক কাজের খেসারত আজ দেশের সব ধর্মের নাগরিকদের দিতে হচ্ছে। এর কারন একটাই। গান্ধীজি এবং তাঁর মানস-পুত্র জওহরলাল এই দেশটাকে তাদের দখলদার মৌরুসীপাট্টা হিসেবে দেখেছিলেন। শুধু সাধারণ নির্বাচনে জিতে কোন সরকার এভাবে রাষ্ট্রের গঠন পাল্টে দিতে পারেনা। এর জন‍্য কোন বিশেষ plebisciteও করা হয়নি। তাহলে ত উত্তর কোরিয়ার বংশানুক্রমে শাসন করা শাসককেও সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ধারক ও বাহকের তকমা দিতে হয়!
আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া যাবে না। তাহলে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলি থাকা সত্বেও ধর্মের ভিত্তিতে কি করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে? সরকার কিভাবে এটা চালিয়ে যাচ্ছে আর আইনের চোখে তা গ্রাহ‍্য হচ্ছে!
এই ধরনের ধর্মীয় ও জাতিগত সংরক্ষণ ও আর্থিক উপঢৌকনে এই গোষ্ঠীগুলির সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের কোন ছবি ধরা পড়ে না। উপরন্তু এই ধরনের প্রকল্প সমাজের ও দেশের স্থায়ীত্বের ভিত্তিমূলেই আঘাত করছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা তার সাক্ষ‍্য বহন করে। এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য। যখন ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে বা ভারতের পক্ষে বসবাসের জন‍্য মতদান করে ছিলেন, তখন তাঁরা কি ভারতে ‘সংখ‍্যালঘু’ তকমা পাওয়ার দাবীদার ছিলেন? যেমন পাকিস্তানে বা অধুনা বাংলাদেশে সে দেশের ধর্মীয় ‘সংখ‍্যালঘু’দের অধিকার, এই ভারতেও সেই একই অধিকার থাকা উচিৎ। অত‍্যন্ত দুঃখজনক হলেও এর দায় কিন্তু কংগ্রেসের – বিশেষতঃ একটি বংশের। আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” নাড়া লাগানো মানুষদের প্রভাবিত করেছে এই নেহরু-গান্ধী পরিবারের ভারতে রাজত্ব করার লিপ্সা।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জাতি,ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের সব নাগরিককে যথার্থ দেশাত্মবোধের পরিচয় দিতে হবে। দেশের সব নির্বাচিত পদের মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে হবে (একবার বা দুবারের বেশী একজন ব‍্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে)। যেকোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ও তার পরিবারের সকল উপার্জন subject to public scruitiny করতে হবে। অবশ‍্য এসব হলে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের জনসেবার উৎকট, উদগ্র কামনা কতটা অবশিষ্ট থাকে তা দেখার বিষয়। তবে, একটা কথা, বিড়ালের গলায় কে ঘন্টা বাঁধবে!