পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে ক্রমশঃ পঙ্কিল আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে, সেকথা অনেকবার লিখেছি। রাজনৈতিক অসততা ও ভোগলিপ্সার সঙ্গে যখন অযোগ্য, অসৎ হাতে প্রশাসনের দায়িত্বভার বর্তায়, তখন এভাবেই নোংরা পঙ্কিল স্রোতে সততা, মনুষ্যত্ব ও সমাজ সেবার ভড়ং ভেসে যায়।
আমি ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দেখে আসছি। ১৯৬৭র ভোটে বামপন্থীদের উত্থান ও তৎপ্রসুত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় থেকে রাজ্যের রাজনীতিতে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন দেখা যায়। সমকালীন গল্প, উপন্যাস, যেমন সমরেশ বসুর বিবর,পাতক ইত্যাদিতে তার ছাপ পাওয়া যায়। তারপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ ধরে নিয়েছে যে, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সরকারি টাকা নয়ছয় করা - রাজনীতিকদের একটি আবশ্যিক বাধ্যবাধকতার মত! এর বড় উদাহরণ হল, সারদা-নারদার মত টাকা আত্মসাৎ করা রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী পর্যায়ে ভোটে জিততে কোন অসুবিধা হয়নি। আর একথা সত্যি যে, রাজনীতিতে নির্বাচন লড়তে, দল চালাতে, তার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড রূপায়ণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সে অর্থ যে প্রথাগত বামপন্থী ভড়ংয়ের কৌটো ঝাঁকিয়ে খুচরো 'তোলা' তুলে সম্ভব নয়, তা এখন বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও বোঝে। সুতরাং কার "ঘনিষ্ঠ"র বাড়ি থেকে একুশ কোটি টাকা বেরোলো, তা নিয়ে মিডিয়া তার টিআরপি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে; তবে তাতে আপাতদৃষ্টিতে দলের কোন রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
তবে, এখনকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিষয়টির গুরুত্ব অন্য রকম। তৃণমূলের সুপার-হেবিওয়েট মন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় সেক্রেটারি জেনারেল, যদিও তৃণমূল দলে সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড বলে কিছু হয় না, অভিজ্ঞতার নিরিখে মন্ত্রীসভায় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পরেই যার স্থান, সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি (যারা 'পাবলিক মানি' নয়ছয় ও আর্থিক অপরাধের তদন্ত করে) গত ২৩শে জুলাই, গ্রেপ্তার করেছে। রাজনীতিক ও নেতা-মন্ত্রীরা আগেও আর্থিক অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমনকি বিহারের প্রাক্তণ মূখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এই কারনে দীর্ঘদিন অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছেন। এতে কোন নতুনত্ব নেই। এতে রাজনৈতিক দলের ইমেজ নষ্ট হয় না। কারন, এত কিছুর পরেও লালু প্রসাদ যাদবের প্রতিষ্ঠিত এবং এখন তার পুত্র তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে পরিচালিত আরজেডি গত বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের ভোটে শুধু বৃহত্তম দল হিসেবেই উঠে আসেনি, ক্ষমতাসীন নীতিশ কুমার-বিজেপির জোট সরকারের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে! কাজেই শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগ থাকলে তৃণমূল দলের চিন্তার বিশেষ কারন ছিল না। এক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারি বা বেনিয়ম নয় - এটি তদন্তাধীন অবস্থায় সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বলা যায় - চুড়ান্ত সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক অবক্ষয়ের নিদর্শন - অবশ্য সব অভিযোগ যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।
এই ঘটনায় তৃণমূল দলের প্যানিক বাটন টেপার জন্যই একথার সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। প্রথমে দলের হয়ে মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সংবাদ-মাধ্যমের কাছে প্রেস কন্ফারেন্স করে জানালেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার (বোধহয় বলতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপি) যে প্রতিহিংসার বশে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তাদের দলের নেতাদের (বহুবচন) বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন, তার কারনে যদি কেউ, অর্থাৎ, অভিযুক্ত, অসুস্থ হন বা তাদের কোন ক্ষতি (!) হয়, তবে 'দল' ছেড়ে কথা বলবে না। এই বক্তব্যের পর্যালোচনা করলেই 'প্যানিক বাটন' তত্ত্ব প্রমাণিত হয়!
কেন্দ্রের সরকার বা বিজেপি দলের সঙ্গে কিন্তু এই ইডি অনুসন্ধানের কোন সম্পর্ক নেই। অনুসন্ধান চলছে মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে। কোন ভারতীয় নাগরিক - মন্ত্রী, সান্ত্রীসহ সকলেই - ভারতীয় আইন মোতাবেক, আদালত নির্দেশিত অনুসন্ধানকারী সংস্থাকে এভাবে ভয় দেখিয়ে, শর্ত আরোপ করে অনুসন্ধানকারী সংস্থার কাজে বাধা দিতে পারেন কি! এ ত আদালতের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ! তৃণমূল দলের যে কোনো আইনজ্ঞ কোন আইনে এই সমালোচনা ও শর্ত আরোপ করা যায়, তা জানালে তাকে সেলাম জানাবো। অবশ্য এসব কথা কতটা ভয় থেকে আর কতটা হতাশা থেকে বলা হচ্ছে তা অনুমানের বিষয়। কারন, বক্তব্য রাখা মন্ত্রী নিজেও বোধহয় "প্রতিহিংসা" তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তার প্রমাণ হল, তৃণমূলের স্বীকৃত মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেছেন যে, আইনি পদক্ষেপে 'দল' কোন বাধা দেবে না; এবং দোষী প্রমাণিত হলে 'দল' তাকে কঠোর শাস্তি দেবে! লক্ষ্য করার বিষয়, দলের সুপ্রিমো মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করেননি; উপরন্তু তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এখনো মন্ত্রীত্ব এবং দলের সর্বভারতীয় মহাসচিবের পদে বহাল রেখেছেন! যদিও উচ্চ আদালতের বিচারপতি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে দুর্ণীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রীদ্বয় পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পরেশচন্দ্র অধিকারীকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানো হবে, সে আশায় আগেই "সততার প্রতীক" পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জল ঢেলে দিয়েছেন।
এখনো পর্যন্ত ইডির এই অনুসন্ধানে যা প্রকাশ পেয়েছে তার ফল তৃণমূল দলের পক্ষে মারাত্মক। কিভাবে এবং কেন? তা জানতে গেলে বাঙ্গালীর মানসিকতা ও সামাজিক এবং সাংসারিক বোধ সম্পর্কে ধারনা থাকা দরকার। রাজনীতিকদের সাধারণ আর্থিক দুর্ণীতি নিয়ে বাঙ্গালী যে মাথা বিশেষ ঘামায় না - যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ - গোছের চিন্তাধারা, তা প্রমাণ হয়, নির্বাচনের সময় সারদা-নারদার প্রভাব না পড়ায়। কিন্তু বাঙ্গালী নৈতিক শ্খলনজনিত (moral turpitude) অপরাধকে সর্বদা নিন্দা করে।এই নিন্দার ক্ষেত্রবিশেষে কারন ভিন্ন হলেও অভিমুখ একই থাকে। পার্থর ক্ষেত্রে এই নৈতিক শ্খলনজনিত খবরে জড়িয়েছে অর্পিতা মূখোপাধ্যায় ছাড়াও আরো কয়েকজন 'ঘনিষ্ঠ' মহিলার নাম। এদের প্রত্যেকের কাছেই হিসাব বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে অর্পিতা মূখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের 'ঘনিষ্ঠ' সম্পর্কের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে পার্থর বাড়ি থেকে অর্পিতার নামে স্থাবর সম্পত্তির দলিল পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে কথোপকথনের জন্য বিশেষ মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়া, অর্পিতার বাড়িতে পাওয়া সম্পত্তির মধ্যে বিপুল পরিমাণ টাকা ও অলংকার ছাড়াও প্রচুর বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গেছে। অর্পিতা কিসের জন্য ঘনঘন বিদেশযাত্রা করতেন, কার সঙ্গে, কি কারনে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অর্পিতা ইতিমধ্যেই পার্থর নাম এবং সম্পর্ক নিয়ে ইডির কাছে মুখ খুলেছে। সুতরাং, বিদেশ সফর জনিত আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা তাও বিচার্য বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ যে, অর্পিতা ও পার্থর নাম মিলিয়ে পার্থ বোলপুরে তার একটি বাংলোর নাম রেখেছে "অপা"। এসব নোংরামো বাঙ্গালী কতটা সইবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। এদিকে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের খামে অর্পিতার বাড়িতে প্রচুর টাকা মিলেছে। তৃণমূলের পক্ষে মারাত্মক খবর হল, অর্পিতার কাছে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের একটি গোপন কালো ডায়েরির খোঁজ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ইডির সিজার লিস্টে ছত্রে ছত্রে দুর্ণীতি, শিক্ষিত বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের হৃদয় বিদারক চাকরি চুরি, এসবের প্রমাণ। একটি অন্য দপ্তরে উচ্চপদে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি এটুকুই বলতে পারি যে, এত বড় দুর্ণীতি এবং সামাজিক দুষ্কর্মের খবর মূখ্যমন্ত্রী জানতেন না, তা অবিশ্বাস্য! পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের modus operandi সম্বন্ধে যে ধারনা আছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের সরকারে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোনো দপ্তরের কোনো কাজ হয় না - সমস্ত বিভাগীয় মন্ত্রীরা জনসমক্ষে একে মূখ্যমন্ত্রীর "অনুপ্রেঢ়না" বলে অভিহিত করেন! সুতরাং, শিক্ষা দপ্তরের এই পাহাড়প্রমাণ দুর্ণীতির "অনুপ্রেঢ়না" কে? কেউ কি জবাব দেবেন? এভাবে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পরল! এইসব কর্মকান্ডে যে টাকা পাওয়া গেছে তা বাঙ্গালীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শিক্ষিত যুবশক্তিকে ধ্বংস করে ভাতাজীবি হতে বাধ্য করার চক্রান্তের ফসল। জাতি ধ্বংসের জন্য দায়ী এই নেতৃত্ব। তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে পার্থর সঙ্গে দল ও দলনেত্রীর পৃথকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে তা যেমন দল ও দলনেত্রীকে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা, তেমনই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে অর্পিতা মুখোপাধ্যায় অপরিচিত নন - তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি এবং মমতার নিজের মুখ থেকে অর্পিতার প্রশংসার ক্লিপিংস সংবাদ-মাধ্যমে ঘুরছে। এখানেই শেষ নয়, তৃণমূল দলের সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানে এই অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মঞ্চ আলো করে বসে থাকার ছবি প্রমাণ করে যে, দলের কাছে এবং দলনেত্রীর কাছে অর্পিতা অপরিচিত - এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা। অর্পিতার উপার্জনের কোন নির্দিষ্ট সূত্র জানা না গেলেও তার মডেলিং ও অভিনয়ের প্রশংসা মমতার মুখ থেকে শোনার পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওড়িয়া সহ গোটা চারেক ছবিতে ছোট পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে! এর জন্য মূখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা দৃষ্টিকটু লেগেছে।
ইডি অনুসন্ধানের অন্য একটি অভিমুখ অবশ্যই নোটবন্দী পরবর্তী পুরোনো নোট জমা করার মধ্যে নিহিত আছে। সমাজে ব্যপকভাবে বিস্তৃত এক কলুষিত নেটওয়ার্কের অভিযোগের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ২০১৪-১৬ সালের মধ্যে শিক্ষাদপ্তরের নিয়োগে এই সব ঘুষের বিপুল টাকা এসে থাকলে নোটবন্দীর পরের ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোটে এই টাকা পাওয়া গেল কিভাবে? এটা তখনই সম্ভব, যদি ভালো এবং ব্যপক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, পেট্রোল পাম্প, সর্বপরি সাধারণ মানুষের মাধ্যমে পুরোনো বাতিল নোট জমা দিয়ে তা নতুন নোটে পরিবর্তন করা হয়! এই রহস্যের উদঘাটন জরুরী। এভাবেই সব চোর, জোচ্চোর,বাটপার, অপরাধীরা সব কালো টাকার পুরোনো নোটকে নতুন নোটে বদলে নেওয়ায় সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে, প্রায় সব পুরোনো নোট বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এভাবে কালো টাকার ভান্ডার নষ্ট করা যায়নি। রাজনীতি প্রযোজিত এই সামাজিক ব্যাধি দুর করার দায়ীত্ব ইডির উপর। এই সরকারের আমলের অপরাধের গণতন্ত্রীকরণের কুশীলবদের শণাক্ত করা জরুরী।
আবার অর্পিতার মায়ের কথায় আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট। তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর মেয়ের মডেলিং ও অভিনয় ছাড়া আর কোন 'কাজ'-এর কথা জানেননা। সেইসঙ্গে এও স্বীকার করেছেন যে, মেয়ের মুখে তিনি মেয়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কথা মেয়ের কাছেই শুনেছেন! এখানেই অনেক না বলা কথা বলা হল! আবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় অনুসন্ধান ও তার পরবর্তী পর্যায়ে যখন অনুসন্ধানকারী দলের কাছ থেকে মোবাইলে কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন, পরপর চারবার তিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়কে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন! মমতা ফোন ধরেননি। এর দুটো কারন হতে পারে। দলের এবং মন্ত্রীসভার গায়ে এভাবে কালি লাগায় তিনি অসন্তুষ্ট, বিরক্ত; অথবা তিনি ভয় পেয়েছেন। প্রথমটি হলে, চার্জসিটে এভাবে পার্থর বিরুদ্ধে বহু গুরুতর অভিযোগ ও প্রমাণ থাকায় এবং পরিষদীয় ও শিল্প এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রীর পদে আসীন পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার দলের সর্বভারতীয় মহাসচিব! এহেন গুরু দায়িত্বে থাকা মানুষের জন্য যদি দলের গায়ে কালি লাগে, খুব স্বাভাবিকভাবেই মমতা তাকে মন্ত্রীসভা থেকে এবং দলের পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। যদি আদালতে পার্থ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারে তবে তাকে পুনরায় সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মমতা তা না করায় বোঝা যাচ্ছে যে,মমতা পার্থকে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কেন? কারন অবশ্যই আদালতে পার্থ যদি রাজসাক্ষী হয় এবং……। এই ভয় থেকেই মমতার অবস্থা ছুঁচো গেলার মত - না পারছেন পার্থকে ফেলতে, না পারছেন গিলতে!
পার্থ উপাখ্যানের আরেকদিক হল, এই দুর্ণীতি শুধু আর্থিক নয়, এর সামাজিক ও মানবিক দিক হল - অভিযোগ আছে, এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে যোগ্য ও সফল প্রার্থীদের শিক্ষকতার চাকরীতে নিয়োগ না করে অযোগ্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছে। এই সরকারের প্রশাসনিক বদলী থেকে ধরে চুক্তিভিত্তিক চাকরীর ক্ষেত্রেও প্রচুর ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই কদিনের অনুসন্ধানে ঘুষের সম্পত্তির পরিমাণ ১২০ কোটির বেশী বলে প্রাথমিক অনুমান করা হচ্ছে। এই টাকা শুধু অর্পিতা নয়, জেলায় জেলায় এমন বহু 'অর্পিতা'র সন্ধান পাওয়া যাবে। বিদেশী যোগাযোগ ও হাওলা সম্পর্কও বেরিয়েছে! কে জানে, বিদেশীদের সঙ্গে মিলে এই দেশে ধ্বংসাত্মক কাজে, যেমন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ইত্যাদির মত কাজে এই অর্থের অংশ ব্যবহার হত কিনা। একজন বরিষ্ট মন্ত্রীর এমন "ঘনিষ্ঠ" বান্ধবীদের সংখ্যা অনুসন্ধানের সঙ্গেসঙ্গে যত বাড়বে, তত কাদাঘাটা, নোংরা তথ্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মমতাদেবী তবু পার্থকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানোর দুঃসাহস দেখাতে না পারায় তাঁর দুর্বলতা ছাড়া আর কোন কারন নেই।
পার্থ গ্রেপ্তার হওয়ার পর IPGMRএ ভিআই পি 'রোগী' হিসেবে ভর্তি হয়ে গেল! এই ভর্তি হওয়ার নাটক আর তার নেপথ্য কাহিনীর পরতে পরতে ছলচাতুরী ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর প্রচেষ্টা প্রবল। পার্থর গ্রেপ্তারের পর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত পুলিশ রিমান্ডের আদেশ দিলেও পরে কোন অদৃশ্য কারনে সেই আদালত দুটি আদেশ দেয়। ২৩শে জুলাইয়ের সেই আদেশে পার্থকে IPGMRএ ভর্তি করার কথা বলা হয় এবং অন্যটিতে ইডির উপর আদেশ হয় যে পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার আইনজ্ঞ সেখানে পার্থর সঙ্গে উপস্থিত থাকবে! এমন অদ্ভুত আদেশকে ইডি তৎক্ষণাৎ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানালে গুরুত্ব অনুধাবন করে মহামাণ্য জজ বিবেক চৌধুরী ২৪ তারিখ দু পক্ষের সওয়াল জবাবের পর এই দুই আদেশ দেশের আইনের পরিপন্থী বলে বাতিল করে দেন। আর ইডির উপর আদেশ হয় যে, ২৫ তারিখ সকালেই পার্থকে দরকার হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে AIIMS, ভুবনেশ্বরে নিয়ে গিয়ে সব শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে তার রিপোর্ট ঐ দিনই দাখিল করতে হবে। তিনি এর সঙ্গে IPGMRএর ক্ষমতাশালী অভিযুক্ত ভিআইপিদের মেডিক্যালি সুরক্ষা দেওয়ার জায়গা বলে কটাক্ষ করেন। যথারীতি AIIMS, ভুবনেশ্বরের রিপোর্টে পার্থর কিছু বয়েসজনিত ক্রনিক অসুবিধে ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না! তারা জানিয়ে দিল, পার্থকে হাসপাতালে ভর্তি রাখার কোনো প্রয়োজন নেই - অথচ, IPGMR পার্থকে ICUতে রেখেছিল। এতেই বোঝা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালকে কিভাবে মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ করে অভিযুক্ত ভিআইপিদের রক্ষা করার কাজে লাগানো হচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার - স্বাস্থ্য বিভাগ, যার অধীনে IPGMR, তার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়! এরপরও পার্থ কান্ডের দায় মমতা সরকারের উপর না পড়ার কারন আছে কি? এখন এটাই দেখার যে, যেসব ডাক্তাররা পার্থর চিকিৎসা করে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করিয়েছিলেন, তারা সমাজের কাছে কতটা অপরাধী হলেন এবং ইডির জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় তাদের ফেলা হয় কিনা। কারন কার আদেশে তারা এসব করছিলেন, সেটিও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের চালাকি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের চেষ্টার অভিযোগ নতুন করে গতি পেল। যেহেতু পার্থ শারীরিক দিক থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মত সুস্থ আছে, তৃণমূল দলের রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দু সপ্তাহ কাটিয়ে দিলে জুডিশিয়াল কাস্টডি হয়ে যায় বলে তখন অভিযুক্তর কিছুটা সুরাহা মেলে। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে IPGMRএর নাটক শুরু হয়েছিল। কিন্তু বহু অভিনয়ে দীর্ণ একই স্ক্রিপ্ট এবার মঞ্চস্থ করা গেলনা। অবশ্যই দেশের আইনি ব্যবস্থাকে এর জন্য বাহবা দিতে হবে।
যেভাবে শিক্ষায় চাকরী দেওয়ার ব্যপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তেমন সব চাকরীর ক্ষেত্রেই, এমনকি সিভিক পুলিশের বিনা ট্রেণিংয়ের অস্থায়ী চাকরীতে পর্যন্ত অনুসন্ধান শুরু হলে থলে থেকে আরো অনেক বিড়াল বেরোবে। কয়লা, গরুপাচার, বালি খাদানের অবৈধ বালি পাচার, চাকরি চুরি - ইত্যাদি বিভিন্ন কেলেঙ্কারীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীর গায়ে অবৈধ সম্পর্কের তকমাও লাগতে চলেছে। সম্প্রতি মমতা বন্দোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, একশোটা চাকরীর মধ্যে একটাও কি নিজের লোককে দেওয়া যায় না! জানিনা, দেশের অন্য কোন রাজনীতিক এমন অসাংবিধানিক কথা বলতে পারেন কিনা। সংবিধান মোতাবেক শপথ নিয়ে এভাবে সংবিধান বিরোধী কাজের সাফাই কিন্তু চাপের মধ্যে ধৈর্য্য হারানোর লক্ষণ। এই চাপ দল ও দলনেত্রী কতদিন সামলাতে পারেন সেটাই দেখার।