তালিবানরা ইসলাম ধর্ম মানে না

তালিবান শাসন এখন সারা আফগানিস্তান জুড়ে প্রতিষ্ঠিত। তালিবানদের একক ক্ষমতায় পঞ্জশিরের আহমেদ মাসুদ ও আমরুল্লা সালেহর প্রতিরোধ ভাঙ্গা সম্ভব নয় দেখে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সরাসরি পঞ্জশিরের উপর বোমাবর্ষণ করে। এই ঘটনা একসঙ্গে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। এতে প্রমাণ হল যে, পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী তালিবানদের হয়ে আফগানিস্তানের মানুষদের বিরুদ্ধে সরাসরি অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে। আবার তালিবানদের সমর্থন ও স্বীকৃতির মাধ‍্যমে চীন প্রমান করল, তারা তাদের স্বার্থে যে কোন জঙ্গী গোষ্ঠীকে মদত দিতে পারে। আবার পাকিস্তানকে “বিশ্বস্ত বন্ধু” বলে বাইডেন প্রশাসনের প্রকাশ‍্য বার্তা এবং আমেরিকার বর্তমান সরকারের কর্মপদ্ধতি প্রমাণ করে যে এই প্রশাসন এমনকি আমেরিকার জনসাধারণের মানসিকতা বুঝতে অক্ষম। ওয়াশিংটন পোষ্টের মত কাগজও বলছে, আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে সৈন‍্য সরানোর সিদ্ধান্ত (যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে নেওয়া) সঠিক হলেও বর্তমান প্রশাসন যেভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে তালিবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে পালিয়ে গেল তাতে আমেরিকার বিদেশনীতির চরম ক্ষতি হল। অথচ বাইডেন প্রশাসন এখনো পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য সহ সমস্ত রকম সাহায‍্য করে যাচ্ছে। এতে তারা বিশ্বের অন‍্যান‍্য দেশের কাছে প্রমাণ করে দিল, তারা মুখে গণতান্ত্রিক মূল‍্যবোধের কথা বললেও আমেরিকা জঙ্গী তোষনকারী দেশ এবং ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ হিসেবে আমেরিকার আর কোন বিশ্বাসযোগ‍্যতা রইল না। এভাবে চললে মহাশক্তিধর ‘সুপার পাওয়ার’ তকমা থেকে যে আমেরিকার নাম বাদ যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এবার আসি তালিবান সরকারের আফগানিস্তান শাসনের শুরুতে। তালিবানরা সরকার গঠনের আগে গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা – বিশেষতঃ মহিলাদের লেখাপড়া, চাকরীর স্বাধীনতা দেওয়ার ব‍্যপারে অনেক বড় বড় কথা বলেছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, পাকিস্তানের প্রত‍্যক্ষ মদতে তালিবানদের পাস্তুন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের মানষজন সরকার গঠনে প্রাধান্য পেল। সরকারের প্রধান হল হাক্কানি নেটওয়ার্ক থেকে। ফলে, তালিবান সরকারের বকলমে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসন প্রতিষ্ঠার পথেই আফগানিস্তান এগিয়ে গেল। মনে হয়, প্রথম তালিবান সরকারের থেকেও এই দ্বিতীয় তালিবান সরকারের শাসন আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের আরো খারাপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
একটি দেশের ক্ষমতায় ব‍্যপকভাবে নাক গলানোর জন‍্য যে অর্থনৈতিক শক্তির প্রয়োজন তা পাকিস্তানের নেই। পশ্বিমী দেশগুলির থেকে সাহায‍্য এবং ঐ দেশগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ব‍্যবসা বাণিজ্য ছাড়া পাকিস্তানের দিনগুজরান অসম্ভব। এজন‍্য প্রথমেই তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য করার সর্ত রেখেছে যে তা করতে হবে পাকিস্তানের টাকা – যার কোন মূল‍্য আন্তর্জাতিক বাজারে নেই। এতে আফগানিস্তানের সমূহ ক্ষতি। পাকিস্তানের চাপে তালিবানদের পাস্তুন গোষ্ঠী, যেখানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব, ক্ষমতা দখল করায় আফগানিস্তানের অন‍্যান‍্য জনগোষ্ঠী যেমন হাজারা, তাজিক, উজবেকরা অসন্তুষ্ট, তেমনি ইরান ও রাশিয়াও এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখছে। তালিবানদের বড় অংশও এইভাবে পাখিস্তানের হস্তক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়। তালিবানদের মধ‍্যে গন্ডগোল শুরু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এর মধ‍্যেই তাদের একমাত্র এ‍্যজেন্ডা – কাশ্মীর দখল ও ভারতের খন্ডিতকরন – এর জন‍্য জঙ্গী মনোভাবাপন্ন পাকিস্তান তালিবানদের প্ররোচনা দিতে শুরু করেছে। যত সময় গড়াবে, তত পাকিস্তানের উপর তালিবানদের নির্ভরতা বাড়তে থাকবে এবং পাকিস্তানের চাপও বাড়বে। শেষমেষ এই চাপ ব্ল‍্যাকমেলের পর্যায়ে যাবে। কারন তালিবান তাদের অন‍্য বন্ধু রাষ্ট্র চীনের থেকে তাদের অর্থনীতি, বিশেষতঃ পরিকাঠামো উন্নয়ণে বিশেষ সাহায‍্য পাবে না। চীনের বৈদেশিক সাহায্যের নীতি নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, তারা নিযেদের স্বার্থসিদ্ধির জন‍্য নরম সুদে ধার দিয়ে সাহায্য গ্রহনকারী দেশকে ঋণ ফাঁদে জড়িয়ে দেয়! এখানে চীনের স্বার্থ হল ভারত ও পাকিস্তানের উপর চাপ রাখার জন‍্য বাগরাম এয়ারপোর্টের পূর্ণ সত্ত্ব এবং আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে সড়ক নির্মান করে মধ‍্য এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সড়ক সংযোগ। এতে আফগানিস্তানের জনগনের আর্থিক বিকাশের সুযোগ নেই। কারন চীন এসব কাজে নিজের দেশের মানষজনকে নিয়োগ করে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই করেছে।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান ভারতে ইসলাম বিপন্ন বলে অনেক কাল্পনিক অভিযোগ করে। কিন্তু এই পাকিস্তান চীনে উইঘুর মুসলমানদের উপর অমানুষিক অত‍্যাচারের পরেও এ ব‍্যপারে সম্পূর্ণ নীরব। এভাবে পাকিস্তান তার কাজের মাধ‍্যমে নিজেদের এক ‘বর্বর দেশ’ (rouge country) তে পরিণত করেছে। সম্প্রতি EU পাকিস্তানের সঙ্গে ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহনের যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছে। যদি রাষ্ট্রসংঘ অদুর ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে “বর্বর দেশ” ঘোষণা করে তাহলে এই উপমহাদেশের সবকটি দেশের পক্ষেই মঙ্গল। পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সমাজনীতি, পুরোটাই নির্ভর করে কিভাবে ভারতের ক্ষতিসাধন করা যায় তার উপর। এই নীতি রূপায়নে পাকিস্তান যে ধর্মকে আঁকরে ধরেছে তা এখন পৃথিবীর বেশীরভাগ রাষ্ট্রের কাছে (এমনকি ইসলামিক রাষ্ট্রের কাছেও) ধর্ম বিকৃতি মনে হচ্ছে। একটু বিশদে ব‍্যখ‍্যা করা যাক।
ধ্রুপদী ইসলামী আইন অনুযায়ী পৃথিবীতে তিন ধরনের রাষ্ট্র আছে। দার-আল-ইসলাম – যেখানে ইসলামী আইন মোতাবেক রাষ্ট্র শাসিত হয়। দার-আল-সুলহ – যেগুলি অমুসলিম রাষ্ট্র হলেও সেখানে মুসলমানদের ধর্মাচরনে বাধা দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, এই রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রগুলির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চুক্তি সম্পাদিত আছে। দার-আল-হার্ব – যে রাষ্ট্রগুলি ইসলামী রাষ্ট্র নয় এবং যাদের সঙ্গে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অনাক্রমণ বা শান্তি চুক্তি নেই।
এই তিন প্রকার দার অর্থাৎ স্থানের কথা কিন্তু কোরান বা হাদাশে পাওয়া যায়না। একমাত্র কোরানে অপ্রত‍্যক্ষভাবে দার-আল-সুলহ এর উল্লেখ আছে। আবু আল ফদলের বক্তব‍্য অনুযায়ী, কোরানে দুই দার-এর উল্লেখ আছে। মানব জীবনের পরবর্তী স্তরের দার ও ভোগবিলাসী মানব জীবনের দার। এর মধ‍্যে প্রথমটি অবশ‍্যই উৎকৃষ্টতর। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধজয় ও রাজ‍্য দখলের পর এই তিন ধরনের দার-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দার-আল-ইসলামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আবু হানিফা এবং তাঁর শিষ‍্যদ্বয়, আবু ইউসুফ ও আল-সায়বানীর বক্তব‍্যে। ইসলামী রাষ্ট্রগুলির মধ‍্যেকার বিভাজন ও রাজনৈতিক মতানৈক‍্যের কারনে এখনকার সময়ে দার-আল-ইসলাম ও দার-আল-হার্ব এর পৃথকীকরন শুধু অবাস্তবই নয়, যুদ্ধবাজদের রাজনৈতিক অপচেষ্টা মাত্র। ইসলামী রাষ্ট্রগুলির মধ‍্যেও ধর্ম পালনের বিস্তর প্রকারভেদ, পাশ্চাত‍্য ও প্রাচ‍্যের অমুসলিম দেশগুলির মুসলমান নাগরিকদের অবাধ ধর্মাচরন এই দুই দারকেই অকেজো করে দিয়েছে। বিশেষতঃ ইসলামী রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রসংঘে যোগদানের পর এখনকার আধুনিক বিশ্বে দার-আল-সুলহ ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র নাই। সুরা ৪:৯০ অনুযায়ী এমন রাষ্ট্র যার সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের অনাক্রমণ নীতি প্রযোজ‍্য, আল্লা তেমন রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার অনুমতি দেন না।
এত কথা বলার কারন একটাই। যে ইসলামের দোহাই দিয়ে অসামাজিক ও অমানবিক কাজের ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা ইসলাম ধর্ম অনুমোদিত তা জানা। এবার আফগানিস্তানের তালিবানী ফতোয়াগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক। অশিক্ষা, কুশিক্ষার আলোতে দেশবাসীকে আচ্ছন্ন করে রাখলে তারা নিজেদের ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা হারাবে। সেজন‍্য তালিবানী শিক্ষামন্ত্রী বললেন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি – এসবের কোন মূল‍্য নেই! মনে পড়ে গেল হীরকরাজার দেশের এক অবিস্মরনীয় উক্তি : “যত জানে, তত কম মানে”। দেশের মানুষ শিক্ষা পেলে প্রশ্ন করবে; ভালোমন্দ বুঝতে শিখবে – বিশেষতঃ নারীরা। আরেকটা কথা, মেয়েদের অশিক্ষিত রাখলে তাদের সন্তানরাও অশিক্ষিত থাকবে – এমন সম্ভাবনাই বেশী। ফলে, তালিবান রাজত্বে উচ্চশিক্ষা প্রথমেই বন্ধ হল। যে কোন ধর্ম-শিক্ষা সম্পন্ন করলে তা মানষকে সহিষ্ণুতা শেখায়। সুতরাং যুদ্ধবাজ তালিবান এবং তাদের পালক পিতা পাকিস্তান কখনোই আফগানিস্তানের নাগরিকদের যথার্থ ধর্ম-শিক্ষার সুযোগ দেবেনা। পক্ষান্তরে তারা মোল্লা-মৌলভী মারফৎ নিজেদের সুবিধার্থে বিভিন্ন বাধা-নিষেধ ও বিদ্বেষ ছড়ানো ফতোয়া জারি করবে। ইতিমধ্যে সে কাজও শুরু হয়েছে। তালিবানরা সরকার গঠনের আগে মেয়েদের পড়াশোনা ও খেলাধুলা এবং চাকরীতে বাধা দেবেনা বলে প্রতাশ্রুতি দিয়েছিল। সরকার গঠন করতে না করতেই তারা মেয়েদের খেলাধুলা ও চাকরী বন্ধ করতে শুরু করল। মেয়েদের পড়াশোনার জায়গায় হাজারো বাধানিষেধ আরোপ করে পড়াশোনাও কার্যত বন্ধ করে দিল। এটা খুব অদ্ভুত যে এইসব অশিক্ষিত মোল্লারা তাদের কাজকে শরিয়তের দোহাই দিয়ে সমর্থন করতে বলে! এখানে পরিষ্কারভাবে বলা যাক যে কোরানে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, যেসব অমুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মের কারনে মুসলিমদের উপর অত‍্যাচার করা হয় এবং তাদের ধর্মাচরনে বাধা দেওয়া হয়, সেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে ক
য়ন সাচ্চা মুসলমান সম্পর্ক রাখবে না। তাদের থেকে সুবিধা নিলে সেই মুসলমানের আল্লার নির্দেশে দোজখ প্রাপ্তি হবে। সুতরাং, উইঘুর ধ্বংস দের উপর অত‍্যাচার ও তাদের মসজিদ ধ্বংস করার পরেও চীনের সঙ্গে তালিবানদের দোস্তি ও চীনের থেকে সুবিধা গ্রহন করে তালিবান নেতৃত্ব অত‍্যন্ত গর্হিত পাপ করেছে এবং ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছে! পাকিস্তান সরকারও এই একইদোষে দুষ্ট। কজন মুসলমান ধর্ম যাজক এরজন‍্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন! আসলে rogue state পাকিস্তান এই মূহুর্তে সারা বিশ্বজুড়ে জঙ্গী যোগান দেওয়ার কাজে লিপ্ত। এই জঙ্গীদের পরিকল্পনা হচ্ছে ধর্মের নামে নাশকতা চালিয়ে যাওয়া। এতে কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিশ্বের ইসলাম ধর্মী সাধারণ মানুষ। আমাদের সৌভাগ‍্য যে বেশীরভাগ ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের চাল ধরে ফেলেছে। ফলতঃ, এখনো অব্দি বিশ্বব‍্যপী ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আওয়াজ তুলেও পাকিস্তান সেভাবে ইসলামী রাষ্ট্রগুলির থেকে মদত পায়নি। উপরন্তু হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও পাস্তুনদের নিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল আশেপাশের ইসলামীদেশের কাছে ভালো ঠেকবে না। শুধু তাই নয়, তালিবানের মধ‍্যে হাজারা ও তাজিকরাও এদের কর্তৃত্ব বেশীদিন মানবেনা। কোন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কথায় মজে গিয়ে এখনো অব্দি বর্তমান তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। পক্ষান্তরে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইরান ওউজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান তাদের অসন্তুষ্টি ব‍্যক্ত করেছে। রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত জঙ্গীদের নিয়ে পাকিস্তানের মদতে গঠিত সরকারকে একমাত্র স্বীকৃতি দিয়েছে চীন। এমনকি তালিবানের ঘোষিত সদর দপ্তর কিছুদিন আগেও যে দেশে ছিল, সেই কাতার অব্দি ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে চলছে।
জঙ্গী তালিবানদের উপর পাকিস্তানি শাসন বন্ধ করার জন‍্য; এই বিশ্বকে স্থায়ীভাবে জঙ্গী সন্ত্রাস মুক্ত করার জন‍্য, অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রসংঘের যে যে উপায় অবলম্বন করা উচিৎ তার প্রথমেই এই পাকিস্তান নামের বর্বর দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর তত্বাবধানে ভেঙ্গে দিয়ে জঙ্গী উৎপাদন ও তার সাপ্লাই চনটিকেই ধ্বংস করে দিতে হবে। অবশ‍্যই প্রবল বাধা আসবে চীনের থেকে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সেই বাধার সফল মোকাবিলা করতেই হবে বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন‍্য। আর হ‍্যাঁ, আফগানিস্তানের সকল নাগরিকের মুক্ত ভোটাধিকার প্রয়োগে যে সরকার তৈরী হবে তাকেই রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ।

আফগানিস্তানে বাইডেনের দাদাগিরির পরিসমাপ্তি

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যে নাটক শুরু হয়েছিল তা ক্লাইমাক্সে পৌঁছালো ১৫ই আগষ্ট,২০২১এ বিনা রক্তপাতে কাবুল দখলের মধ‍্যে দিয়ে। শুরুটা অবশ‍্য করে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আফগানিস্তান থেকে ধাপে ধাপে সৈন‍্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। কাতারের দোহাতে এনিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীতে অতিমারী ও নির্বাচনের গুরুত্বে এই সৈন‍্য অপসারণ প্রক্রিয়া আর বিশেষ এগোয়নি। আফগানিস্তানের শেষ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি তখন থেকেই বলতে থাকেন যে পাকিস্তানের জঙ্গীরা আফগানিস্তান দখলের চক্রান্ত করছে। এমনকি আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই কথাকে পাত্তা না দিয়ে পাকিস্তান দ্বারা লালিত-পালিত তালিবানগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ‍্যে বাইডেন প্রশাসন তাদের সৈন‍্য অপসারণ প্রক্রিয়ার ব‍্যপারে শুধু তাদের সঙ্গেই কথা বলে। ফলে, তালিবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ‍্যে শুধু এগিয়েই যায়নি, তারা আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। আমেরিকার ইচ্ছে ছিল, তারা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী আফগান সৈন‍্যদল তৈরী করতে আফগান সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে তালিবান, আইসিস বা অন‍্য কোন জঙ্গী সংগঠন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজ করতে পারবেনা। প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ না বলা কথা থাকে। এখানে আমেরিকা তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রাখার ব‍্যবস্থা হিসেবে তালিবানদের দূর্বল দেখতে চাইলেও নির্মূল করতে চায়নি।
ফলে, ২০০১ সালে যখন তালিবান আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো তখন তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও তাদের মধ‍্যে সমন্বয় রেখে তাদের সংগঠন টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয় পাকিস্তান এবং একাজে তারা তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগায়। তালিবানের মাদক চোরাচালানের ব‍্যবসা সম্প্রসারণের পেছনে পাকিস্তানের অবদান প্রচুর। তাছাড়া, ওয়াহাবী ইসলামের চিন্তাধারায় সুন্নি তালিবান পাকিস্তানের মধ‍্যে সহমর্মিতার সন্ধান পায়।
এদিকে আমেরিকায় গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ই বোঝা গিয়েছিল যে আমেরিকান মুসলমানেরা একযোগে বাইডেনকে ভোট দিয়েছে। বাইডেনের ডেপুটি কমলা হ‍্যারিসের কথাবার্তায় পরিষ্কার যে তারা পাকিস্তান ও ভারতের মধ‍্যে তুলনায় পাকিস্তানকে অধিকতর বন্ধু মনে করে। কাশ্মীর প্রশ্নেও কমলা হ‍্যারিসের অবস্থান সন্দেহজনক। যাই হোক, আফগানিস্তানে বাইডেন প্রশাসন প্রথম থেকেই তালিবানদের সাথে ও তাদের বিশেষ বন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা এবং পাকিস্তানের উপর নির্ভর করে এখন এমন অবস্থায় পড়েছে যে তাতে বাইডেনের ভোট ব‍্যাঙ্কের তেমন ক্ষতি না হলেও কিন্তু বিশ্বের দরবারে আফগানিস্তানের থেকে আমেরিকার শর্তহীন পলায়ন তাকে বিশ্ব-দাদাগিরির মর্যাদা থেকে এক ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। এমনকি অন্তিম পর্যায়ে তালিবানের ধমকে ভীত সন্ত্রস্ত মনোভাব দেখিয়ে তাদের দাবিমত বাইডেন ৩০শে আগষ্টের মধ‍্যে আমেরিকার সৈন‍্যদের আফগানিস্তানের থেকে বের করে আনল। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এমনকি বিমান, হেলিকপ্টার ফেলে আমেরিকা পালিয়ে গেল। তারপর কুড়ি বছরের যুদ্ধ শেষে বাইডেন পরাজিত সৈন‍্যদলের নেতার মত সংবাদ মাধ‍্যমে বার্তা দিলেন যে তিনি কত দ্রুততার সঙ্গে এই ‘পলায়ন’ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করেছেন! প্রথম থেকেই আমেরিকা পরিকল্পনা করেছিল যে তারা তালিবানের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কারন তারা আলোচনা পর্বে তালিবান ছাড়া আর কোন আফগান গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কথা বলেনি। অথচ ২০০১ সালে যখন তালিবানদের তারা হঠিয়ে দেয়, তারপর থেকে আফগানিস্তানে জনগোষ্ঠীগুলির রাজনৈতিক ও সামাজিক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবার কুড়ি বছরেও আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারগুলি যদি শক্তিশালী সৈন‍্যদল তৈরী করতে না পারে তার দায় কিন্তু আমেরিকার সরকার এড়াতে পারে না। অধিকন্তু মহিলা সহ নাগরিকদের অধিকার এফং আইনের শাসন, যা তালিবান জমানায় একেবারেই ছিল না সেটি অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব আফগান সরকারের প্রাপ‍্য। আমেরিকা হটাৎ একদিন মনে করল যে তাদের অনেক অর্থ খরচ হচ্ছে এবং তাদের সৈন‍্যদলের প্রাণহানি হচ্ছে, তাই রাতারাতি তালিবানদের ডেকে তাদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমেরিকার পলায়ন – আর যাই হোক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের নাক গলানোর অভিপ্রায়ে চরম আঘাত করল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পেট্রোলিয়াম কেনার টাকা মেটানোর জন‍্য প্রধান মাধ‍্যম হল আমেরিকান ডলার! এটাই তাদের দাদাগিরি। ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ভারত ইরান থেকে তেল আনলে তা ভারতের টাকায় মেটাতে পারে। ইরানের সঙ্গে আমাদের দেশের এই চুক্তির সবচেয়ে বেশী বিরোধিতা করেছে আমেরিকা। অবশ‍্যই অন‍্য যুক্তি সাজিয়ে। এই সব দাদাগিরি এখন বন্ধ হবে। আবার বন্ধু হিসেবে আমেরিকা যে একদম বিশ্বাসযোগ‍্য নয়, তাও প্রমানিত হয়ে গেল। আরো বোঝা গেল যে আমেরিকার ধারনা,কথা ও কাজে স্বচ্ছতার বড়ই অভাব।
এখানে আফগানিস্তানের নাগরিকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী, তাদের পরিচয় ও ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। আফগানিস্তানের মানুষজন সতেরোটির বেশী গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর মধ‍্যে সংখ‍্যা ও প্রতিপত্তির দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হল পাস্তুন, তাজিক, উজবেক, হাজারা, তুর্কমেন ও বালুচগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীগুলিতে এমন নেতারা আছেন যারা প্রত‍্যেকেই নিজের নিজের গোষ্ঠীর মধ‍্যে যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি রাখেন। কিন্তু আমেরিকা ও ন‍্যাটো বাহিনী এই গোষ্ঠীগুলির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে শুধু তালিবানদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে – তাঁরা তালিবানদের হাতেই শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের নক্সা করেছে বলেই মনে হয়। কে এই তালিবান? তালিবান কথাটির অর্থ হল ‘ছাত্র’। তালিবানরা মূলতঃ আফগান হলেও তারা একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত নয়। এদের মধ‍্যে অল্পসংখ‍্যক অআফগানও থাকতে পারে। এরা বিশেষতঃ পাকিস্তানের, এবং অল্প কিছু ক্ষেত্রে ভারতের মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ওয়াহাবী মতের সুন্নি মুসলমান যাদের তৈরী করা হয়েছে দেওবন্দী ইসলামী আন্দোলন এবং সাভরিক সংগঠন ও সন্ত্রাসের মাধ‍্যমে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য। এরা বেশীরভাগই পাস্তুনগোষ্ঠীর।ফলে, এরা ওয়াহাবী সুন্নি মুসলমান অধ‍্যুষিত পাকিস্তানের সঙ্গে ধর্মীয় একাত্মতা অনুভব করে। ২০১৬ সাল থেকে এদের উচ্চতম নেতা মৌলভী হাইবাতুল্লা আখুন্তজাদা। এদের মধ‍্যে পাস্তুন ছাড়া বেশ কিছু সংখ‍্যক তাজিকও আছে। এদের শিক্ষা, ঐতিহ্য ও চিন্তাধারা জিহাদধর্মী। এরা ইসলামী মৌলবাদ ও অসহিষ্ণুতার ধারক এবং বাহক। এরা বাইরে যতই দেখাক যে আইসিস এদের শত্রু, চিন্তাধারা, ভাবাদর্শ এবং কাজকর্মে কিন্তু তা দেখা যায়নাহ ভারতের ক্ষতি করা যাদের জিহাদের মূখ‍্য উদ্দেশ‍্য সেই জৈশী মহম্মদ ও আল কায়দা এদের বন্ধু। এছাড়া এরা হাক্কানি নেটওয়ার্কেরও ঘনিষ্ঠ। চীন, তুরষ্ক, কাতার ও বিশেষতঃ পাকিস্তান এদের আফগানিস্তানের একচ্ছত্র ক্ষমতায় দেখতে চায়। এরা এবার আফগানিস্তানে যে ইসলাভী এমিরেটস এর কথা বলছে, ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে এরা একই কাজ করেছিল। ২০০১ সাল অব্দি এদের অত‍্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহিলাদের সামান‍্যতম স্বাধীনতা এরা দেয়না। মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এরা বিরোধী। বহু হাজার মানুষ, লক্ষাধিক, এদের দ্বারা নিহত হয়। বিশেষতঃ মহিলাদের এরা নির্দয়ভাবে হত‍্যা করে। ২০০১ সালে আমেরিকা ও ন‍্যাটো বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে এরা পিছু হটতে বাধ‍্য হয়। এখানে উল্লেখ‍্য যে সে সময়ও নর্দার্ন এ‍্যালায়েন্স পঞ্জশির এলাকায় তালিবানদের রুখে দিয়েছিল। এবারেও তারা একই ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তালিবানরা এবারে ক্ষমতায় এসে ফলেছে শরিয়তী আইন মোতাবেক এরা দেশ চালাবে! নারী স্বাধীনতাও তারা দেবে শরিয়তী আইন মোতাবেক! কিন্তু এটা বলছে না যে শরিয়তী আইনের ব‍্যখ‍্যা এরা নিজেদের মত করবে। তাই এদের সাধারণ স্বাধীনচেতা আফগান জনগন বিশ্বাস করছে না। মার্কিন ও ন‍্যাটো বাহিনীর অবস্থানের সময় আফগানদের দেশত‍্যাগের ঐকান্তিক চেষ্টাই তার প্রমাণ।
তালিবানরা অত‍্যাচার ও ভয়ের বাতাবরন তৈরী করতে পারে। কিন্তু একটা দেশকে কি করে শাসন করতে হয় সেটা এদের জানা নেই। যখন প্রথমবার ২০০১ সালে তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে বিতারিত হল, তখন এক প্রান্তিক জায়গায় তারা বিদ্রোহী যোদ্ধা হিসেবে আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে। এদের রক্ষণাবেক্ষণ, ট্রেনিং ও অন‍্যান‍্য কৌশলগত সাহায্য – সব কিছুই পাকিস্তান যোগায়। এদের বেশীরভাগ মানুষ পাস্তুন হওয়ায় পাকিস্তানেরও সুবিধা হয়। পাকিস্তানের উদ্দেশ‍্য একটা। তা হল, এদের নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তান প্রসুত জৈশী মহম্মদ ও অন‍্যান‍্য ভারতবিরোধী জঙ্গী সংগঠনগুলিকে যুক্ত করে ভারত থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ অন‍্যান‍্য নেতৃবৃন্দ এবং ফৌজীরা সরাসরি সেকথা বলছেও। এই উদ্দেশ‍্যে এদের সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদার লালন-পালনও পাকিস্তান করছে। এখন পাকিস্তান একারনেই ইসলামিক সন্ত্রাসের আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে। এই সন্ত্রাস দমনের জন‍্য যখন বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের সাহায্য নেয় তখন মার্কিনীদের উদ্দেশ‍্য নিয়ে বিশ্ব-জনমতের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, এই তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে ক্ষমতাচ‍্যুত হওয়ার পর এদের অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করার লক্ষ‍্যে এদের পৃথিবী জুড়ে মাদক চোরাচালানের ব‍্যবসা ও তোলাবাজির কাজে পাকিস্তান পুরোদস্তুর সহযোগিতা করেছে। এখন তালিবানদের ‘ভালো’ সার্টিফিকেট দেওয়া এবং বিভিন্ন দেশ, বিশেষতঃ ইসলামিক দেশগুলি যাতে তালিবান সরকারকে মান‍্যতা দেয়, তার জন‍্য পাকিস্তান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মত।
আফগানিস্তানের আশরফ গণি সরকারের অযোগ‍্যতা ও পাহাড়প্রমান দূর্ণীতির পর পশ্চিমী দেশগুলির আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারনে আফগানিস্তানের অথনীতি এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। বিদেশী সাহায‍্য ছাড়া এই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই। আজ তালিবানদের কাছে সবচেয়ে বড় চ‍্যালেঞ্জ আফগান জনসাধারণের মুখে খাবার যোগানো। এই মূহুর্তে চীন তাদের রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও বিপুল পরিমান বিনিয়োগ যে করবে না তা বলাই বাহুল‍্য। যে জন‍্য পাকিস্তান দ্বারা প্রতিপালিত তালিবান নেতৃত্ব একাধিকবার ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলে ভারতের চলতে থাকা বিনিয়োগগুলি বন্ধ না করতে অনুরোধ করেছে। এক্ষেত্রেও ভারতকে অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। কারন দেশ শাসন সম্পর্কিত তাদের ঘোষিত নীতিই তালিবানদের আধুনিক সভ‍্য সমাজের কাছে সন্দেহভাজন করে তুলেছে। আবার পাকিস্তান তাদের ‘পালক পিতা’ হলেও পাকিস্তানের অর্থনীতি এমন যে তাদের নিজেদেরই বিদেশী সাহায্য ছাড়া চলেনা। সুতরাং পাকিস্তানের দিক থেকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবেনা ধরে নিয়ে তালিবান পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ২৬৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী যাতে সাধারণ আফগানরা এবং অবশ‍্যই তালিবানরা, পাকিস্তানের মাটি ব‍্যবহার করতে পারে। তাজিকিস্তানের সঙ্গে ১৩৫৭ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও তাদের সঙ্গে তালিবানের সম্পর্ক খারাপ। তাছাড়া তালিবান বিরোধী নর্দার্ন এ‍্যালায়েন্সকে তাজিকিস্তান সাহায্য করছে। এরপর ইরানের সঙ্গে ৯২১ কিলোমিটার সীমান্ত ইরান বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে ৮০৪ কিলোমিটার ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও ঐ দুই দেশের সঙ্গে তালিবানদের সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। চীনের সঙ্গে ৯১ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও চীন নিজের প্রয়োজনে তা ব‍্যবহার করতে পারে। তালিবানের প্রয়োজনে নয়। যদিও পাকিস্তান সর্বদা তালিবানদের প্ররোচিত করবে ভারতবিরোধী কাজের জন‍্য, তবু তালিবান ভৌগলিক কারনে পাকিস্তানের মাটি ব‍্যবহার করেই ভারতে আসতে পারবে। এই মূহুর্তে আফগানিস্তানে তালিবানের যে অবস্থা তাতে অতি বড় মূর্খও ভারত আক্রমণের ঝুঁকি নেবে না। সুতরাং ঢালাও আন্তজার্তিক সাহায‍্য না পেলে তালিবানের একমাত্র বাঁচার রাস্তা পাকিস্তানকে দোহন করা।
এই আশঙ্কা থেকে পাকিস্তান তার সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্তকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সিল করার প্রস্তাব দয়। তালিবান তৎক্ষণাৎ সে প্রস্তাব নস‍্যাৎ করে দেয়। তারা যুক্তি দেয়, এতে দু দেশের সাধারণ নাগরিকদের অসুবিধা হবে। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের গরিষ্ট অংশই পাস্তুন। আবার তালিবানরাও পাস্তুন। ফল, তালিবান তাদের অসুবিধা দুর করার জন‍্য পাকিস্তানীদের উপরেই নির্ভর করবে। আর একানেই রয়েছে পাকিস্তানের মৃত‍্যুবাণ। কিভাবে?
আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক চাহিদার কিয়দংশ মেটানোর ক্ষমতাও পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের নেই। তালিবান তার শিকার খুঁজবে পাকিস্তানের মধ‍্যেই। তালিবানের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে সহজ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তান স্বাভাবিক কারনেই তাতে বাধা দেবে। আর তখনই শুরু হবে সংঘর্ষ। এমতাবস্থায় পাকিস্তান হয়ত জৈশী মহম্মদ ও অন‍্যান‍্য জঙ্গীগোষ্ঠীর সহযোগিতায় ভারতে অনুপ্রবেশ ও নাশকতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। রিবর্তিত পরিস্থিতে ভারত সরকারের উচিৎ শক্ত হাতে এসবের মোকাবিলা করা – প্রয়োজনে বারবার পাকিস্তানের অভ‍্যন্তরে ঢুকে জঙ্গী ঘাঁটিগুলি ভেঙ্গে দেওয়া ও আইএসআইয়ের logistic support networkগুলি নষ্ট করে দেওয়া। এই সময় আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে ভারতের চানক‍্যনীতি অনুযায়ী সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। চীন পাকিস্তানকে মদত দেয় তার অর্থনৈতিক করিডোর তৈরীর জন‍্য। যখন আফগানিস্তানে চীনের বন্ধু সরকার থাকবে তখন পাকিস্তানের মত একটি জঙ্গী তোষনকারী দেশের দায় চীন নেবেনা।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানে তালিবান সরকার প্রতিষ্ঠার পিছনে পাকিস্তানের অবদান ও আমেরিকার সরকারের আত্মহনন যেমন দায়ী, তেমনি বেশীদিন যদি তালিবান আফগানিস্তানের মসনদে থাকে তবে তা পাকিস্তানের স্থায়ীত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। এখানে ভারতের বিচক্ষণ ভূমিকা থাকা আবশ‍্যক।

তালিবানিস্থান ও তার প্রভাব

১৫ই আগষ্ট,২০২১ এর নাটকীয় পটপরিবর্তনের মধ‍্যে দিয়ে আফগানিস্তানে নতুন করে তালিবানি যুগের সুচনা হল। আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে আমেরিকা ও ন‍্যাটো বাহিনী নিরাপত্তা দিলেও আফগান সরকারের পাহাড়প্রমাণ দূর্ণীতি ও স্বজনপোষনের কারনে আফগানিস্তান সরকার কুড়ি বছর সময় পেলেও শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরী করতে পারেনি। তার ফলে তালিবান বাহিনী প্রায় বিনা রক্তপাতে কাবুল-কান্দাহারসহ আফগানিস্তানের ৯৫% জায়গা দখল করতে সক্ষম হল। এর কারন পরপর আলোচনার শেষে এই ঘটনাপ্রবাহ প্রতিবেশী দেশগুলির উপর কি প্রভাব ফেলতে পারে তা ব‍্যখ‍্যা করার চেষ্টা করা সম্ভব হবে।
আফগানিস্তান সরকারের দূর্ণীতির কারনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উপর রাজনৈতিক কন্ট্রোল প্রায় ছিলই না। উপরন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই আমেরিকা তার পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে বড় রকমের ভুল করে বসেছিল। তালিবানদের দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা ও তাদের নীতির কথা মনে থাকলে এই গোষ্ঠীকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়ার মত কাজ অতিবড় মূর্খও করবেনা। বারাক ওবামা লাদেন নিধনে সাফল‍্য পেয়ে এতটাই সন্তুষ্ট ও আত্মতৃপ্ত ছিলেন যে তালিবানদের ধ্বংস করার কোন চেষ্টাই আর করেননি। হয়ত ভবিষ‍্যতে রাশিয়া বা চীনের বিরুদ্ধে তাদের ব‍্যবহার করার সুপ্ত ইচ্ছা এক্ষেত্রে কাজ করে থাকতে পারে। পরবর্তীতে ট্রাম্প প্রশাসন তালিবানদের মাদক পাচার ব‍্যবসা ও তোলবাজির বিরুদ্ধে কোন ব‍্যবস্থা নেয়নি। আবার পাকিস্তানের মাধ‍্যমে তালিবানদের ট্রেনিং ও অন‍্যান‍্য লজিস্টিক সহায়তা তারা করে গেছে। ভারতের কুটনৈতিক চ‍্যানেল এ ব‍্যপারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরব হলেও তা আসল সত‍্যিটা খানিক আড়াল করেছে মাত্র। কারন, ন‍্যাটো এবং আমেরিকার আর্থিক অনুদান যে পাকিস্তান আল কায়েদা ও তালিবান জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ, বিস্তার এবং আধুনিকীকরনে ব‍্যবহার করছে তা আমেরিকা জানত না – একথা কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করবেনা। পক্ষান্তরে, আমেরিকা ও ন‍্যাটো দেশগুলি চেয়েছে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও কাশ্মীরে টেনশান এবং জঙ্গী কাজকর্ম অব‍্যহত থাকুক। তারা মনে করেছে এর ফলে এই উপমহাদেশে অসন্তোষ ও জঙ্গী কাজকর্ম চলতে থাকলে তাদের অস্ত্র ও অন‍্যান‍্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বাড়বে আর ভারতকে পাকিস্তানের মত বেশী করে তাদের মুখাপেক্ষী করে রাখা যাবে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমী দেশগুলি কখনো চায়নি যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ‍্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক। সেকারনে পরপর এমন সরকারকে তারা পাকিস্তানে বহাল রাখতে চেয়েছে যারা ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদকেই মূলমন্ত্র হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশের জন্মকে না মানতে পেরে পাকিস্তান এবং তাদের এজেন্টরা “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” শ্লোগান তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “দিল্লীর এজেন্ট” বলে প্রচার করছে। ভারত বিরোধী ও ভারতের বিভাজনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বানিয়ে পাকিস্তান শুধু আল কায়েদা বা তালিবান নয়, বিশ্বের তাবৎ ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলির আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে।
যখন ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন‍্য অপসারণের কথা ঘোষণা করে তখন থেকেই পাকিস্তান আল কায়েদা ও তালিবান জঙ্গীদের আফগানিস্তান দখলের ব্লুপ্রিন্ট তৈরী করে। এই সময় অতিমারী ও নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন অত‍্যন্ত ব‍্যস্ত হয়ে পরায় সুষ্ঠুভাবে সেনা অপসারণের কোন পরিকল্পনা ট্রাম্প করতে পারেননি। পরবর্তীতে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে সৈন‍্য তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেন। এর দুটি প্রাথমিক কারন অনুমান করা য
আয়। প্রথম হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে আমেরিকান ও ন‍্যাটো বাহিনীর বিপুল খরচ বহন কর
আ অত‍্যন্ত কঠিন হয়ে পরেছিল। দ্বিতীয়তঃ, বাইডেন প্রশাসন এই উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের মধ‍্যে পাকিস্তানকে অধিকতর নিকট সহযোগী মনে করে। বিশেষতঃ ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ‍্যারিসের কথাবার্তা ও কাজকর্ম সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। সেই পূর্বনির্ধারিত ধারনা থেকে আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন আন্তর্জাতিক নীতিতে কয়েকটি বালখিল‍্যসুলভ ভুল সিদ্ধান্ত নিল।
আফগানিস্তানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হল হাজারা, পাস্তুন, উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন ও বালুচ। এছাড়া আরো কিছু ছোট ছোট গোষ্ঠীও আছে। এইসব বড় গোষ্ঠীর সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন সৈন‍্য অপসারণের ব‍্যপারে কোন বৈঠক করেছে বলে জানা যায়না। শুধু তাই নয়, উত্তরের পঞ্জশির অঞ্চল, যা আগের তালিবান সরকার দখল করতে পারেনি; এমনকি সোভিয়েত রাশিয়াও পঞ্জশিরের উপর রাজ করতে পারেনি। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগানরা অত‍্যন্ত স্বাধীনচেতা প্রকৃতির। পঞ্জশির তার ব‍্যতিক্রম নয়। এই দূর্গম এলাকায় সেখানকার জাতীয় বীর আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে প্রথমবার তালিবান বাহিনীকে রুখে দিয়েছিল। তারপর ওসামা বিন লাদেনের চক্রান্তে এই আহমদ শাহ মাসুদকে হত‍্যা করা হয়। সেজন‍্য এখন তাদের নেতা এবং আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমেদ মাসুদ এদের নেতা। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, এবারও তালিবান বিনাযুদ্ধে পঞ্জশির দখল করতে পারবেনা। আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহ তাঁর দলবল সহ এই আহমেদ মাসুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তিনি আফগানিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। এই মুহূর্তে পঞ্জশিরের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা বাগলানের তিনটি জায়গা – পুল-ই-হিসার, দেহ-সালাহ এবং বালুতে এদের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের লড়াই অব‍্যহত। ওদিকে রাশিয়ার ঘনিষ্ট তাজিকিস্তান তালিবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এবারের পরিস্থিতি আগের বারের থেকে খানিকটা ভিন্ন। প্রথমতঃ, বাইডেন প্রশাসন তালিবানদের সঙ্গে ছাড়া আর কোন আফগান গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় বসেনি! অধিকন্তু, পাকিস্তান যে আফগানিস্তানে জঙ্গীদের মদত দিচ্ছে তা জানা সত্বেও আমেরিকা পাকিস্তানকে বিশ্বাস করেছে! ফলে, তালিবান হুমকির কাছে শর্তবিহীন নতিস্বীকার করে মার্কিন সৈন‍্য অপসারণের কাজ ৩১শে আগস্টের মধ‍্যেই করবে বলে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে। এদিকে তালিবানদের সমর্থন করে চীন এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সমর্থ হল। সঙ্গে রাশিয়াও তালিবানদের প্রতি এখনো পযর্ন্ত নরম মনোভাব নিয়ে চলছে। বাইডেনের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বে আমেরিকার দাদাগিরির অবসানের সুচনা হল। এখন বাইডেন প্রশাসনের অবস্থা সাপের ছুঁচো গেলার মত। না পারছে তালিবানদের গিলতে; না পারছে উগরে ফেলতে। এগুলেও বিপদ, আবার পিছলেও বিপদ।
এবার আসি পাকিস্তান-যোগের কথায়। পাকিস্তানের অর্থনীতি বিদেশী সাহায্য ছাড়া দেউলিয়া হওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সাহায্য পাওয়া বিদেশী মুদ্রার প্রায় পুরোটাই দুটি খাতে ব‍্যয় করছে। একটি হল, ভারতের বিরুদ্ধে ব‍্যবহারের জন‍্য অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি ও অন‍্যটি হল তালিবান, আল কায়দা, জৈশি মহম্মদ ইত‍্যাদি জঙ্গী সংগঠনগুলির লালন, পালন ও ট্রেনিং। কয়েকদিন আগে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জৈশি মহম্মদ ও লস্কর-ই-তৈবার মত জঙ্গী গোষ্ঠীগুলি তালিবানের সমর্থনে মিছিল বের করেছে। প্রথম থেকেই তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালিবানদের দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সর্বোপরি ইমরানের দলের এক নেত্রী নীলম ইরশাদ শেখ এক টিভি সাক্ষাতকারে বলেছে যে, ভারত থেকে কাশ্মীরকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন করতে পাকিস্তানের সঙ্গে তালিবানরাও যোগ দেবে। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান ফৈজ হামিদের সঙ্গে তালিবানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মোল্লা বেরাদরের বৈঠক হয়েছে। বলা হচ্ছে, তালিবান প্রধান হায়বাতুল্লা আখুন্দজাদা পাকিস্তানে বসেই তার কার্যকলাপ চালাচ্ছে। এসবই পাকিস্তান করে চলেছে ভারতকে ভাঙ্গার বাসনা নিয়ে। কিন্তু তাদের কয়েকটি মারাত্মক ভুলের জন‍্য পাকিস্তানকেই চরম মূল‍্য দিতে হবে। কিভাবে?
প্রথমতঃ তালিবান এমন একটি জঙ্গীগোষ্ঠী যারা যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়া আর কিছুই জানে না। দেশ শাসন ও অন‍্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ধারনা বা বোধ, কোনটাই তাদের নেই। ফলে সম্পূর্ণ আফগানিস্তান তাদের দখলে এলে তারপর তারা নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বাড়াতে চাইবে। এরজন‍্য ভারতের কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে পাকিস্তানের বালুচিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে তাদের শাসন আগে কায়েম করতে হবে। মহিলাদের সঙ্গে আচরনসহ বিভিন্ন কারনে পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাঁধা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কান তাদের ‘শরিয়তী শাসন’ পাকিস্তান মানেনা। ওদিকে আবার আফগানিস্তান থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ‍্যক শরণার্থী পাকিস্তানে ঢুকছে। পাকিস্তানের তালিবান মদতের কারনে তার সঙ্গে আফগান সীমান্ত বন্ধ করা অসম্ভব। পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর চাপে বিপর্যস্ত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে পাশ্চাত‍্যশক্তিগুলির অর্থসাহায‍্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ। উপরন্তু অর্থনৈতিক করিডোরের জন‍্য পাকিস্তানের উপর চীনে নির্ভরতা অনেকটা কমে যাবে যদি আফগানিস্তানের তালিবানিদের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকে। বিশ্বের জঙ্গী সাপ্লাইয়ের কারখানা পাকিস্তানকে সেই অর্থে চীন সহ কোন দেশই বিশ্বাস করে না। এমতাবস্থায় পাকিস্তান চেষ্টা করে যাবে যাতে আফগান শরণার্থীদের বড় অংশকে ভারতবিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে এই ধরনের মানসিকতার কোন মানুষ শরণার্থী হয়ে আসবেনা। যারা আসবে তারা তালিবান-বিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষ। জঙ্গী মানসিকতার বিরোধী বলেই তারা দেশ ছেড়ে অন‍্য দেশে শরণার্থী হয়ে আসছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের পরিকল্পনা ব‍্যর্থ হতে বাধ‍্য। আবার তালিবান তাদের তোলাবাজির জন‍্য পাকিস্তানকেই সহজ শিকার হিসেবে পাবে। আর তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের বিবাদ শুরু হলেই তালিবান পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করার চেষ্টা করবে। তখন এই পুরো অঞ্চলটায় চীনের দাদাগিরি বাড়বে – একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এদিকে ক্রমশঃ তালিবানের দখলে থাকা আফগানিস্তানে যেভাবে মহিলা ও সাধারণ মানুষের উপর অত‍্যাচার আর ফতোয়ার মাত্রা বাড়ছে তাতে রাশিয়ার তাঁবে থাকা তাজিকিস্তান তালিবানের বিরুদ্ধে চলে গেছে। মনে রাখতে হবে যে আফগানিস্তানের জাতিগোষ্ঠীর মধ‍্যে ৪৬ শতাংশ মানুষ তাজিক – যাদের সঙ্গে তাজিকিস্তান একাত্মতা অনুভব করে। পাকিস্তানের শত চেষ্টাতেও তাজিকিস্তান তালিবানদের দখলকে স্বীকার করেনি, উপরন্তু তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি এক জঙ্গী হানায় কাবুলে তেরোজন মার্কিন সেনা সহ প্রায় দেড়শো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর দায় এর মধ‍্যেই সরাসরি বাইডেন প্রশাসনের উপর পড়েছে। তালিবান জঙ্গীদের উপর নরম থাকায় বাইডেন প্রশাসনকেই এর জবাব দিতে হবে। তালিবান অবশ‍্য এই নাশকতার দায় আইসিসের উপর চাপিয়েছে। তবে এই মূহুর্তে তালিবান কন্ট্রোলে থাকা কাবুলে আইসিস এসে নাশকতা চালিয়ে চলে গেল- এমন গল্প বিশ্বাস করার মানুষ খুঁজে পাওয়া শক্ত। আবার পাকিস্তান ও বাইডেন প্রশাসন মিলিতভাবে ‘ভাল তালিবান’ আর ‘খারাপ তালিবান’ তত্ত্ব খাড়া করার অক্ষম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
এখনো অব্দি ভারতের ভূমিকা এ ব‍্যপারে যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে। ভারত শত উস্কানিতেও কোন বেফাঁস মন্তব‍্য করেনি। আর তার একমাত্র প্রায়োরিটি রেখেছে আফগানিস্তানে আটকে পরা ভারতীয়দের ও আফগান নাগরিকদের মধ‍্যে শিখ ও হিন্দু, যারা ভারতে আসতে চায়, তাদের ভারতে নিয়ে আসা। এদিকে ভারতীয় দুতাবাসে ভাঙ্গচুর ও বহু ভারতীয় ভিসা লুঠপাট করার ঘটনার পর ভারত শুধু ই-ভিসা ছাড়া আর সব ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। ফলে, ওই লুঠ করা ভিসা ব‍্যবহার করে কোন অবান্ছিত মানুষ ভারতে ঢুকতে পারবেনা।
পরিশেষে বলি, আন্তজার্তিক স্বীকৃতি না পেলে ও অর্থ সাহায্য না মিললে পাকিস্তান ও তালিবান – কারো পক্ষেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যত তারা চাপে মধ‍্যে পড়বে, তত শরিয়তী আইনের নামে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকবে। ফল, একমাত্র শক্তিশালী রাষ্ট্র যে এখনোসতালিবানের সঙ্গে আছে, অর্থাৎ চীন – সেও তাদের সম্পর্কে নতুন করে পর্যালোচনা করতে বাধ‍্য হবে।

কোভিড ১৯ এর জেরে মানুষের হয়রানি

কোভিড ১৯ এর দাপট এখনো পুরোদমে সারা দেশ জুড়ে চলছে। একের পর এক ‘ভ‍্যারিয়েন্ট’ আর ‘স্ট্রেইন’ আবিষ্কার হচ্ছে। ল‍্যাটিন অক্ষরের নামে পরপর ভ‍্যারিয়েন্ট বেরিয়েছে। আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা (আবার ডেল্টা+ ও চলছে)। এখন শুনছি ল‍্যমডা আর এফসাইলনও বেরিয়েছে! মনে হয়, হমস্ত ল‍্যাটিন অক্ষরই একের পর এক আসবে। অর্থাৎ জিটা অব্দি আমাদের এই ভোগান্তি চলবে! মানুষের ভোগান্তি ত শুধু অতিমারী নয়, এই অতিমারীতে কারুর সর্বনাশ ত কারুর পৌষমাস। যেদিন থেকে দেশে ভ‍্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে যত না মানুষকে ভ‍্যাকসিন দেওয়া হয়েছে; রাজনীতি হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশী। কোথাও বলা হচ্ছে, দেশের সব মানুষকে বিনাপয়সায় ভ‍্যাকসিন দিচ্ছেন প্রধাণমন্ত্রী! অর্থাৎ ১৪০×২ = ২৮০ কোটি ভ‍্যাকসিন ‘বিনাপয়সা’য় দেওয়ার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর! অথচ এমন কোন ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা অন‍্য সরকারী ঘোষণায় নেই। এটি চাটুকারীতার নিম্নরুচির রূপ মাত্র। এদিকে রাজ‍্যে বলা হচ্ছে, মূখ‍্যমন্ত্রী নিজে রাজ‍্যের সব মানুষকে ভ‍্যাকসিন দেবার দায় নিয়েছেন! এমন কথা রাজের কোন সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে নেই। আর এটা কোন রাজ‍্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেও চাটুকারীতা ‘গল্পের গরু গাছে’ তুলেছে। কিছু স্বঘোষিত ‘প্রথম শ্রেণী’র সংবাদ মাধ‍্যমও একাজে নেমে নিজেদের খেলো করছে। কেন্দ্রীয় সরকার অগ্রাধিকার মূল‍্যে (preferencial price) কিনে তারপর বিভিন্ন রাজ‍্যে চাহিদা অনুযায়ী পাঠাচ্ছে। আর রাজ‍্য সরকারের উপর দায়িত্ব বর্তায় সঠিক ম‍্যানেজমেন্টের মাধ‍্যমে এর প্রয়োগ করা। আবার দেশের ও রাজ‍্যের বড় সংখ‍্যক মানুষ বাজারের বেসরকারী টিকাকরণ কেন্দ্র থেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে টীকা নিচ্ছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার, টীকার যোগান বিভিন্ন রাজ‍্যে যে সর্বদা জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে তা নয়। কিসের ভিত্তিতে রাজ‍্যে রাজ‍্যে কত সংখ‍্যক টীকা পাঠানো হচ্ছে তার কোন স্বচ্ছ নিয়ম জানানো হচ্ছেনা। আবার রাজ‍্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গাফিলতিতে যে টীকাকরণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তারও যথেষ্ট উদাহরণ আছে। যেমন বেশ কিছুদিন কোভ‍্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও কোভ‍্যাকসিন টীকা দেওয়া যায়নি টীকা না থাকার দরুন। ‘বাজারী’ মাধ‍্যম যথারীতি কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘গালাগাল’ শুরু করার পর জানা গেল, পৌরসভা দ্বিতীয় ভ‍্যাকসিন প্রাপকদের কোটা সরিয়ে রেখে প্রথম ডোজের কোভ‍্যাকসিন দেওয়ার সরকারী নির্দেশ না মেনে প্রথম ডোজেই টীকা খরচ করে ফেলেছে! এটা পৌরসভার গাফিলতি। আশ্চর্য লাগে, বিষয়টা জানাজানি হবার পরে ‘বাজারী’ সংবাদ মাধ‍্যম একদম চুপ করে গেল! অদ্ভুত প্রবৃত্তি। বোঝাই যাচ্ছে, কোভিড১৯ এর ব
ইরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের মত করে লড়াই করছে – আর সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি চাটুকারদের সহযোগীতায় এর থেকে রাজনৈতিক ফয়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এবার আসি অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রে কোভিড১৯ এর প্রভাবে। বিভিন্ন রাজ‍্যে রাজ‍্য সরকারগুলির উপর কোভিড১৯ এর আচরনবিধি তৈরী ও তা পালনের দায়িত্ব ন‍‍্যস্ত আছে। শুধু বিদেশে উড়ান সংক্রান্ত এবং আন্তররাজ‍্য রেল চলাচলের ব‍্যপারটা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করছে। ফলে, আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনের ব‍্যপারগুলি রাজ‍্য সরকার নিজের মত করে নিয়ম ও তা পালন করার নির্দেশ দিচ্ছে। যেমন উত্তরপ্রদেশে গাড়ী চলাচলে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন ইটারী হাউসের মধ‍্যে বসে খাওয়া নিষেধ। তবে, খাবার প‍্যাক করে নিয়ে যাঔয়া ও হোম ডেলিভারী চালু আছে। এদিকে দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ। কাঁচা বাজার খোলা। সেখানে কোন বাধানিষেধ নেই। আবার আমাদের রাজ‍্যে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট সব খোলা। যানবাহন চলছে। শুধু লোকাল ট্রেণ বন্ধ! এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? যেসব খোলা আছে তাতে সংক্রমণ হচ্ছেনা, এমনকি ভিড় বাসেও সংক্রমণ বাড়বে না – শুধু লোকাল ট্রেণ (দুরপাল্লার ট্রেণ চলছে) চললেই তাতে সংক্রমণ বাড়বে! এমন অবাস্তব যুক্তির কারন কি? এখানে উল্লেখ‍্য, মহারাষ্ট্র, যেখানে সংক্রমণ সর্বাধিক, তারাও লোকাল ট্রেণ চালু করেছে।
এই অদ্ভুত খেয়ালী সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ‍্যবিত্তের পেটে শুধু যে টান পরেছে তাই নয়, আপামর রাজ‍্যবাসীই ভুগছে। প্রথমতঃ, এইসব মানুষের রুজি রোজগারের জন‍্য যাতায়াতের সবচেয়ে শস্তা মাধ‍্যম লোকাল ট্রেণ। ফলে তারা অনেক বেশী টাকা খরচ করে সড়কপথে যাতায়াত করতে বাধ‍্য হচ্ছে অথবা রুজি রোজগার হারাচ্ছে। আবার দুধ, কাঁচা তরকারী ও লোকাল মাছের যোগানের প্রধান মাধ‍্যম ছিল লোকাল ট্রেণ। সেজন‍্য শহরে এইসব জিনিষের যোগানে ঘাটতি হচ্ছে। এর ফলে এইসব নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অস্বাভাবিক মূল‍্যবৃদ্ধি হচ্ছে। তেমনি উৎপাদনের জায়গায় পরিবহনের অভাবে চাষীরা ফসলের সঠিক মূল‍্য পাচ্ছেনা। এদিকে আবার পরিবহন-জ্বালানীর সরকারী শুল্কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অনিয়ন্ত্রিত মূল‍্যবৃদ্ধির শিকার দেশের আমজনতা। আর ‘অতিরিক্ত লাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’ যা আমাদের দেশের ব‍্যবসায়ীদের প্রধান ধর্ম, তা এখন নির্বাচিত সরকারের কাজ হয়েছে। ফলে, সরকার যদি শতকরা পাঁচভাগ শুল্ক বাড়ায়, ব‍্যবসায়ীরা কুড়িভাগ মূল‍্যবৃদ্ধি করে! ফলে অত‍্যাবশ‍্যকীয় পণ‍্য ছাড়া আর সব পণ‍্যের বিক্রিতে চরম মন্দা।
আমাদের দেশের বরিষ্ট নাগরিকদের শতকরা একভাগ মাত্র পেনশন পান। এখানে আমেরিকার মত সোশ‍্যাল সিকিউরিটির কোন সংস্থান নেই। এই নাগরিকদের জীবনধারনের জন‍্য ব‍্যাঙ্কের জমানো টাকার সুদের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই সুদ সরকার ক্রমশঃ কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারের বক্তব‍্য, তাহলে ব‍্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা কম সুদে ব‍্যাঙ্গের থেকে টাকা ধার নেবে! এইসব অর্থনীতিবিদরা কোথায় জন্মায় কে জানে! সুদ কমিয়ে মানুষের হাতের নগদের যোগান হ্রাস করলে বাজারের দ্রব‍্যের চাহিদা হ্রাস পাবে। তার ফলে কোন লগ্নিকারী দ্রব‍্যের চাহিদা হ্রাস পেলে তা উৎপাদনের জন‍্য ব‍্যাঙ্কঋণ নেবেনা। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে। আবার আমাদের সরকার (কেন্দ্র-রাজ‍্য উভয়ই ) অনুৎপাদক অনুদানে দেদার টাকা খরচ করছে। তাতে সরকারী কোষাগারে যে টান পড়ছে তা মেটানোর জন‍্য প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় করই বৃদ্ধি করছে। এভাবেই কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারের ভুল নীতির ফলে আমজনতা – বিশেষতঃ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলশ্রেণীর মানুষের উপর অত‍্যধিক চাপ বেড়েছে।
এরপর আসি ভবিষ‍্যত প্রজন্মের পড়াশোনার প্রশ্নে। সেই ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ‍্যালয় – সব স্তরের ক্লাসরুম লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল; তারপর এখন অব্দি এসব খোলার নামগন্ধ নেই! উঁচু ক্লাসের কিছু কিছু মাঝখানে খুললেও কয়েকদিনের মধ‍্যে সেসব বন্ধ করে দেওয়া হল। সিনেমা হল, খেলার মাঠ, পার্ক, বাস, অটো, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল – সব খোলা। এই অদ্ভুত মানসিকতার কোন ব‍্যখ‍্যা দেওয়া যায়না। এমনকি দুরপাল্লার ট্রেণ, বিমান সব চলছে। মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে! শুধু ক্লাশরুমে পড়াশোনা বন্ধ। শিক্ষকরাও এখন “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করছেন। চল্লিশ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে প্রত‍্যক্ষভাবে জরিত থাকার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যে, আমাদের দেশে যা পরিকাঠামো, তাতে অনলাইনে প্র‍্যাকটিক‍্যালসহ সবরকম শিক্ষা দেওয়া ও নেওয়া একটি হাস‍্যকর প্রচেষ্টা মাত্র।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমেরিকায় শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও নীতির বাস্তবায়ন সর্বদা অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের হাতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এর দায়িত্ব কোন আই এ এস অফিসারের হাতে! এদের না আছে অভিজ্ঞতা, না আছে জ্ঞান। ফলে এরা কর্তাভজা নীতি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভুরা যা চান তাতেই সায় দেন! এরা সর্বদা হীনমণ‍্যতায় ভোগায় নিজেদের জাহির করার জন‍্য অনেক ক্ষেত্রেই ‘গবুচন্দ্র’ মন্ত্রীর মত নিদান দেন। আর অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ‘হবুচন্দ্র’ রাজা রাজনীতিক তা অনুমোদন করেন। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ত বটেই, আমেরিকাও তাদের সমস্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি নার্শারী ক্লাশও খুলে দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশে “খেলা”, “মস্তি” সব হবে – শুধু পড়াশোনা বন্ধ!
এরপর আসি আমাদের দেশের শিক্ষাব‍্যবস্থাকে নিয়ে সেরা রসিকতায়। দশ ক্লাস ও বারো ক্লাসের বিনা পরীক্ষায় ‘পাশ’ ও ‘নম্বর’ পাওয়ার কথায়! শিক্ষার হর্তা-কর্তা-বিধাতারা ভুলে গেছেন যে, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং মূল‍্যায়ণ একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পদ্ধতি এবং পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ আবশ‍্যিক। আর তা নাহলে পরীক্ষা এবং পুরো শিক্ষা পদ্ধতিটিই তার বিশ্বাসযোগ‍্যতা হারায়। এক্ষেত্রে অতিমারীর দোহাই দিয়ে পুরো শিক্ষাপদ্ধতি ও তার বিশ্বাসযোগ‍্যতাই নষ্ট করে দেওয়া হল। প্রথমতঃ, যদি স্কুলের পরীক্ষার ভিত্তিতে নম্বর দিতে হয় তবে স্কুল থেকে sent up করা সমস্ত ছাত্রছাত্রীই স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করেছে ধরে নিতে হবে। তা নাহলে তাদের sent up হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন স্কুলের মান ও পরীক্ষার নম্বরের মানের মধ‍্যেও কোন সাম‍্যতা নেই। তারপর পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল CBSEতে ০.৬৩% ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে! কিভাবে হল? মূল‍্যায়নের পদ্ধতিতে কোন স্বচ্ছতা নেই। আবার আমাদের রাজ‍্যের ক্ষেত্রে ফেলের সংখ‍্যার শতকরা হার আরো বেশী। নম্বর পাওয়া – পাশ-ফেল পুরো পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ‍্যতা চ‍্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। সবচেয়ে বড় কথা, এইসব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষায় গিয়ে কি করবে? অতিমারীর দোহাই দিয়ে অযোগ‍্য প্রশাসকদের গাফিলতিতে দেশের শিক্ষাব‍্যবস্থা ধ্বংস করার বীজ রোপন করা হল। উচ্চপদস্থ মানুষজন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের সন্তান সন্ততিদের ইউরোপ, আমেরিকায় পড়তে পাঠাবে। তাদের ব‍্যক্তিগত কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু সাধারন ঘরের ছাত্রছাত্রীরা তাদের ভবিষ‍্যত ধ্বংসের চিত্রনাট‍্যের কুশীলব হয়ে রইল – এটাই দুঃখের।
অনেক হয়েছে। WHOর নিদান মেনে এখুনি সমস্ত স্কুল, কলেজ খোলা হোক।যদি সব সতর্কতা মেনে সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্লাসরুম পঠন-পাঠন শুরু করা যায়, তখন আগের অতিমারীর ব‍্যাচের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় ট্রেণিং দিয়ে দুবছরের মধ‍্যে তাদের ঘাটতির জায়গাগুলি make-up করা যেতে পারে। অন‍্যথায় আমাদের দেশের শিক্ষাব‍্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আর ফেরানো যাবেনা।

গণতন্ত্রের নামে দেশাত্মবোধের বিরোধীতা রাজনীতি নয়

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট যে শিশু ভূমিষ্ট হয়, এখন তার পঁচাত্তরতম জন্মদিন পূর্ণ হতে চলেছে। প্রথম পঁচিশ বছর কেটেছে শৈশবে, দেহের পূর্ণতা পেতে এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত‍্যঙ্গের উন্নতিকল্পে। পরের পঁচিশ বছর কাটলো বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণের চেষ্টায়। আর শেষ পঁচিশ বছর পূর্ণতা প্রাপ্ত দেশ উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের পরের পঁচিশ বছরের কর্মসূচী হোক “নাগরিকের কর্তব‍্যবোধ”।
আমরা অর্থাৎ ভারতের জনগণ স্বাধীনতার আগে থেকেই এক অদ্ভুত আত্মঘাতী রাজনীতির শিকার। কেমন করে? যেমন ধরা যাক, বড় নেতার কাউকে অপছন্দ। তাই বড় নেতা ও তার দলবল (বলা ভাল, স্তাবককুল) অপছন্দের নেতাকে সরাতে দরকারে শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হয়না। এই ঔদ্ধত্ব ও স্তাবকতা ভারতীয়দের মজ্জাগত। ইতিহাসে তার ভূরিভূরি প্রমাণ আছে। এখানে নির্দিষ্ট পরিসরে সেসব আলোচনার জায়গা নেই। তবে এটা না বললেই নয় যে এর ফলে আমাদের দেশের অগ্রগতি ব‍্যহত হচ্ছে। এই জায়গাতেই মানসিকতার বদল দরকার। কারন, দেশের উন্নতির প্রথম সোপান হল সমাজের উন্নতি। আর সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন আমাদের কর্তব‍্যবোধ ও সচেতনতা আসবে।
স্বাধীনতা উত্তর যুগে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ‍্যে একটা ধারনা হয়েছে – যে সরকার (অবশ‍্যই দলীয়) যত বেশী অনুদান দেবে সেই সরকারই তত ভালো কাজ করছে! এটি কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ‍্যের পরিপন্থী। সরকার যখন এ ধরনের অনুদান বাড়াবে, তখন তার অর্থভান্ডারের উপর অনুৎপাদক খরচের বোঝা বৃদ্ধি পাবে। আর এই অতিরিক্ত অর্থের যোগানের জন‍্য সরকার সাধারণ মানুষের উপর বিভিন্ন খাতে করের বোঝা বাড়াবে। এর ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ণ, কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা – সবই বাধা পাবে। তথাকথিত ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির থিওরী আউরে কিছু নোবেল প্রাইজ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে সেই ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি মেনে চলা সরকারগুলি যে তাদের দেশের দারিদ্র ঘোঁচাতে পেরেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবশ‍্য রাজনৈতিক দল হিসেবে কম‍্যুনিষ্টরা সর্বদা এই অনুদান প্রথাকে সমর্থন করে। তার কারন দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, এতে দরিদ্র জনসাধারণের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের সরকারি টাকায় অনুদানের মাধ‍্যমে দলীয় কন্ট্রোলে রাখা যায়। দ্বিতীয়তঃ, দরিদ্র জনগনের পক্ষে সরকারি ও দলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কোন দেশেই এই পদ্ধতিতে দেশের ও সমাজের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।
এবার আসি অন‍্যান‍্য কর্তব‍্যবোধের কথায়। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে সামাজিক বৈষম‍্যের শিকার। সমাজে একদল মানুষ শুধুমাত্র জন্মের ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবে আর অন‍্যেরা বঞ্চিত থাকবে – এতে শুধু যে সামাজিক সাম‍্য ব‍্যহত হচ্ছে তাই নয়, সামাজিক উত্তেজনা ও হিংসার ঘটনা ঘটছে। এতে দেশাত্ববোধের মূলেও কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। এর জন‍্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্ণধারদেরই শুধু নয়, সমস্ত দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে।
সমাজের সকল স্তরে সার্বিক কর্তব‍্য ও দায়িত্ববোধ না থাকলে একটি জাতি শুধুমাত্র স্বাধীন দেশের পতাকাসম্বল করে বিশ্বের দরবারে কোন ছাপ ফেলতে পারেনা। সবচেয়ে আগে যে বোধটা দেশের প্রত‍্যেক নাগরিকের মধ‍্যে থাকা প্রয়োজন তাহল দেশাত্মবোধ। আমাদের ভারতীয়দের মধ‍্যেই দেশাত্মবোধের ধারনায় ফারাক আছে। এই অবস্থার জন‍্য বর্তমান সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষই দায়ী। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর সংসদে বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী একদিন সন্ধ‍্যায় অটলজীকে জরুরী তলব করলেন। তারপর অটলজী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। অটলজী বেরিয়ে যাবার পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাংবাদিক বৈঠকে জানানো হল, রাষ্ট্রসংঘে কাশ্মীর প্রশ্নে তোলা বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করবেন বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী এবং অটলজীর রাজনৈতিক দর্শনের ফারাক বিস্তর। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জানতেন যে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও অন‍্যান‍্যদের মুখের উপর জবাব দেওয়ার যোগ‍্যতম ব‍্যক্তি হলেন অটলবিহারী। আর অটলবিহারীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যতই রাজনৈতিক দূরত্ব থাকুক, দেশের স্বার্থে তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁরা একমাত্র দেশের স্বার্থকেই প্রাধান‍্য দিয়েছিলেন। আর এখন! পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর উপর জঙ্গী হামলার ঘটনাকে অস্বীকার ও বিকৃত করার চেষ্টায় বেশ কিছু বিরোধী নেতৃত্বের ভূমিকা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এখন রাজনীতি সর্বদা বিরোধীতায় শুরু আর বিরোধীতায় শেষ হয়। একমাত্র কম‍্যুনিষ্ট দলগুলিই যেকোন ভারতবিরোধী কাজে উল্লসিত হয় বা নীরব থেকে বুঝিয়ে দেয় যে তারা ভারত সরকারের সঙ্গে নেই। ১৯৬২ সালের চীনা আগ্রাসনের সময় থেকে সাম্প্রতিক জঙ্গী হানা, এমনকি লাদাখ-প‍্যাংগং লেকের ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ নিন্দায় তারা ব‍্যপৃত ছিল। এই ট্রেন্ড এখন বিরোধী নেতাদের মধ‍্যে বহুলাংশে দেখা যাচ্ছে। আসলে রাজনীতি এখন পেশা হওয়ায় এবং তার জন‍্য কোন যোগ‍্যতামান না থাকায় নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের মধ‍্যে শুধু যে প্রগলভ বা রুচিহীন কথাবার্তার চল হয়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক বিরোধীতা করতে গিয়ে কখন যেন দেশের বিরোধীতা করা হচ্ছে। রাজনীতির মান বাড়ানোর জন‍্য দেশের স্বার্থে এদের কর্তব‍্য ও দায়িত্ববোধের শিক্ষার আশু প্রয়োজন।
আবার ব‍্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অথবা রাজনীতিগত লাভ-ক্ষতির বিচারে সমাজের তথা দেশের প্রতি কর্তব‍্যবোধও জলাঞ্জলী দেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব‍্যক্তিগত লাভ ও সুযোগসুবিধা বৃহত্তর সমাজের লাভের চেয়ে আছ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সমাজে মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে বিশেষসুবিধাভোগের প্রত‍্যাশী। আমাদের দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধাভোগের প্রত‍্যাশী। দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে শিক্ষা ও চাকরীর সংরক্ষণের পঁচাত্তর বছর পরেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষজন সমাজের বৈষম‍্য দূরীকরনের চেষ্টার পরিবর্তে এই বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন ব‍্যতিরেকেও পাওয়ার প্রত‍্যাশী। একই রকমভাবে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু সম্প্রদায়ের জন‍্য সরকার প্রদত্ত অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুযোগসুবিধা এই অনুদানের রাজনীতিতে ভোটের অংকে ব‍্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষকে সুবিধা দিলেও আখেরে দেশের মধ‍্যে সামাজিক বৈসম‍্য ও বিভেদের সূচনা করেছে। বিভিন্ন কারনে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত এই বৈসম‍্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আসলে শ্রেণীবিশেষের মানুষকে বিভিন্ন রকমের অনুদান দিয়ে খুশী রাখা রাজনৈতিক লাভের জন‍্য ফলপ্রসু হলেও তা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ণের পরিপন্থী। কিভাবে? সরকারী কোষাগারের অর্থ দিয়ে ব‍্যক্তি বা সমষ্টিগত কিছু মানুষকে অনুদান দিলে ঐ মানুষদের শ্রমবিমুখ করে তোলা হয় আর সেই সঙ্গে সরকারী কোষাগারের যে অর্থ উন্নয়নের জন‍্য ব‍্যয় হওয়ার কথা তাও নষ্ট হয়। অনুন্নয়ণ কর্মসংস্থানকে ব‍্যহত করে এবং অনুদান মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। এভাবে সমাজে কর্মবিমুখতার সঙ্গেসঙ্গে কর্তব‍্যবোধেরও অভাব দেখা দেয়। আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা প্রকৃতপক্ষে তাই।
ম‍্যালথাসিয়ান তত্ত্বের এক অদ্ভুত প্রয়োগ আমাদের দেশে লক্ষ‍্য করা যায়। সমাজের যে গোষ্ঠীর কাছে সরকারী অনুদান বেশী পৌঁছায় তাদের জনসংখ‍্যা বৃদ্ধির হার বাকি অংশের চেয়ে বেশী। এর বড় কারন, অনুদানের নিশ্চিতকরন যেমন ঐ জনগোষ্ঠীকে বংশবৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা করেছে, তেমনই তাদের জনসংখ‍্যা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন‍্য রাজনীতিকরা দেশের উন্নয়নের চেয়ে এদের অনুদান বৃদ্ধি করে ‘ভোটযুদ্ধে’ জিতে ক্ষমতার মধুভান্ড ভোগ করার সহজ সরল পথটাই বেছে নিচ্ছে। ফলে, খাদ‍্যভান্ডারের উপর চাপ পড়ছে। খাদ‍্যদ্রব‍্যের অস্বাভাবিক মূল‍্যবৃদ্ধি হচ্ছে। আবার এইসব প্রক্রিয়ার ফলে এধরনের মানুষের মধ‍্যে দেশের ও সমাজের প্রতি কর্তব‍্যবোধের বিকাশই হয়নি। এরা ব‍্যক্তি বা দলবিশেষের প্রতিই বিশ্বস্ত থাকছে।
এর প্রতিফলন আমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। সংবাদমাধ্যমগুলোর, এমনকি সোশালমিডিয়া অব্দি তাদের সঠিক
সংবাদ পরিবেশনের বদলে ব‍্যক্তিবিশেষ বা রাজনৈতিক দলের প্রচারেই যত্নবান হচ্ছে। বিশেষ সংবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে বা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে জনমত গঠন করার মত অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে এদের তথাকথিত সংবাদ পরিবেশন দেশের ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে।
আগে সমাজে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কথার গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এইসব ‘বিক্রিত’ সংবাদমাধ‍্যমের প্রচারের ঢক্কানিনাদে তারা ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করেন যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে তাদের দলীয় স্বার্থে মুখখোলা বা কলম ধরা – অন‍্য সময় তাঁরা কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রামগ্ন থাকেন! আজকাল আবার সব প্রফেশানের মানুষজন ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে বিবেচিত হন! সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে ধরে খেলোয়ারাও নাকি বুদ্ধিজীবী! এর ফলে এদের বিশ্বাসযোগ‍্যতাও নষ্ট হয়ে গেছে। এদের কাছে সমাজের সাধারন মানুষের কোন প্রত‍্যাশাও নেই আর এইসব মানুষজনদের কর্তব‍্য শুধু বুদ্ধি করে নিজের আখের গুছোনোর মধ‍্যেই সীমাবদ্ধ।
আজ, স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে এসে দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ‍্য হচ্ছি, কোন রাজনীতিক, কোন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলছেন না যে, আমরা ভারতীয়রা যদি ভারতীয়ত্ব জলাঞ্জলী দিই, তাহলে ভারতের অস্তিত্বই থাকবেনা – সেক্ষেত্রে আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকবেনা। আর আমাদের সমাজের, দেশের প্রতি প্রত‍্যেক নাগরিকের কর্তব‍্যবোধ যদি জাগ্রত হয়, আমরা যদি ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে দেশের ও সমাজের স্বার্থে কাজ করি, তবে আমাদের ভারত আবার “জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। এতে কিন্তু ভারতবাসী হিসেবে আমাদের সবার গুরুত্ব বাড়বে।

রাজ‍্য সরকারের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড একটি রাজনৈতিক চাল

পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্চশিক্ষার জন‍্য স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্ত বিজ্ঞজনেরা যথারীতি তাদের মালিকের পক্ষে এই প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে আকাশকুসুম বোঝাতে লেগেছে। এই প্রকল্পের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার আগে প্রকল্পটি কি, কেন আর কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার সম্পর্কে না জেনেই অনেকে খুশীতে গদগদ হচ্ছেন; আবার কেউ কেউ নিন্দায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন! সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি একটি রাজনৈতিক গিমিক যা অনুধাবনে বিরোধীরাও সক্ষম নয়।
একের পর এক এমন মনভোলানো পরিকল্পনা গত দশ বছরে রাজ‍্য সরকার চালু করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এমন কিছু প্রকল্প এনেছে যাতে কাজের থেকে অকাজ বেশী হয়েছে। এমনই একটি স্কীম এই রাজ‍্য সরকারের নবতম স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প। এটি আদতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি অঙ্গীকার পত্র যা গেজেটে ৩০শে জুন,২০২১ এ প্রকাশিত হয় এবং পরদিন থেকেই কার্যকর হয়। এই প্রকল্পটি নিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এটি কিন্তু ব‍্যাঙ্ক কৃষককে টাকা ঋণ দিল আর কৃষক টাকা নিয়ে শোধ দিলনা – তখন সরকার ব‍্যাঙ্কের ঋণ মুকুব করে দিল – এমন নয়। এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে একটি ঘোষণাপত্র যাতে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে পশ্চিমবঙ্গে দশ বছর বা তার বেশীদিন ধরে বসবাসকারী ছাত্র-ছাত্রী বা তার অভিভাবক থাকলে তারা বিভিন্ন ব‍্যাঙ্ক থেকে প্লাস্টিক কার্ড যা আদতে ক্রেডিট কার্ড পাবে এবং এই কার্ডে শর্ত সাপেক্ষে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবে। এই ঋণ পনেরো বছর বা চাকরী পাওয়ার পর, যেটি আগে হবে, পরিশোধ করতে হবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বহু বছর আগে থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের স্টাডি লোনের ব‍্যবস্থা ব‍্যাঙ্কগুলি থেকে চালু আছে যা রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের নিয়ম মেনে ব‍্যাঙ্কগুলি উৎসাহী ও যোগ‍্য ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে থাকে। সুতরাং এটি নতুন কিছু নয়। এখানে কয়েকটি চমক দেখানোর চেষ্টা হয়েছে মাত্র।
যে ব‍্যাঙ্কগুলি ক্রেডিট দেবে তাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদেশে ক্রেডিট দেওয়ার কথা নয়। তারা রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের নির্দেশ ও গাইডলাইন মেনে চলে। এরা কেউই পশ্চিমবঙ্গের সরকারের অধীনস্ত নয়। এখানে রাজ‍্য সরকারের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়। রাজ‍্য সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা কো-অপারেটিভ ব‍্যাঙ্কগুলির উপর রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের তীক্ষ্ণ নজর ও পর্যবেক্ষণ থাকার কারনে তারাও রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের গাইডলাইনের বাইরে কিছু করতে পারবে না। এদিকে রাজ‍্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের ভূমিকা অনুচ্চারিত! বিদেশে পড়ার ব‍্যপারেও এই ঋণ নাকি পাওয়া যাবে! তাতে কেন্দ্রীয় সরকার, রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক, ঋণগ্রহীতা ও ঋণ দেওয়া ব‍্যাঙ্কের ভূমিকা থাকে। এখানে রাজ‍্য সরকারের ভূমিকা কি? সে ত গ‍্যারান্টারও নয়!
হ‍্যাঁ, এই ধরনের ক্রেডিট ঋণের সুদ ৬.৫-৭.৫% হওয়ায় এই ঋণগ্রহীতাদের সুদের ২.৫-৩.৫% রাজ‍্যসরকার দেবে এবং ঋণগ্রহীতাকে ৪% সুদ দিতে হবে। আর ৪ লাখ টাকার উপরে যে ৫% মার্জিন মানি দেওয়ার কথা,সেটি স্টাডি লোনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ‍্য। এমনকি ছাত্রদের নিজেদের খরচে ইন্সিওরেন্স অবধি এক। প্রায় পুরো প্রকল্পটিই চালু স্কীমকে টুকে দেওয়া। শুধু তফাতের জায়গাগুলি বলছি। প্রথমেই আসি, এধরনের লোনের ক্ষেত্রে ৬.৫-৭.৫% সুদের ব‍্যপারটায়। এখানে সরকার যে ২.৫-৩.৫% সুদ মেটাবে তার জন‍্য সরকারের সঙ্গে ব‍্যাঙ্ক নিশ্চয়ই আলাদা চুক্তি করবে। শুনতে ভালো। কিন্তু ওর বাস্তবায়ন কতটা হবে! ঋণ দেওয়ার ব‍্যাঙ্কগুলি রাজ‍্য সরকারের অধীন নয় এবং তারা তাদের নিজেদের নিয়মে কোল‍্যাটারাল সিকিউরিটি চাইবে। কারন, ঋণ খেলাপের দায়িত্ব ঋণ দানকারী ব‍্যাঙ্কের অফিসারদের উপর বর্তায়। এদিকে রাজ‍্য সরকার গ‍্যরান্টার হলে যে বাস্তব অসুবিধাগুলো আছে সেগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রাজ‍্য সরকার কিন্তু কোন ব‍্যক্তিবিশেষ বা কোম্পানি নয় যে তার সম্পদ সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে মর্টগেজ রাখবে। অর্থাৎ কোন ছাত্রের ঋণের কোল‍্যাটারাল সিকিউরিটি রাজ‍্য সরকার দিতে পারে না। আবার ব‍্যাঙ্কও এই ধরনের সিকিউরিটি নেবে না কারন তা কার্যকর করার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। সুতরাং, রাজ‍্য সরকার যদি এই ঋণের কো-গ‍্যরান্টার (ছাত্র বা অভিভাবক গ‍্যরান্টার) হয় তাহলে, সম্পূর্ণ ঋণের সরকারের ভাগের সুদ মেটানোর বাৎসরিক সংস্থান রাজ‍্য সরকারের বাজেটে আলাদাভাবে থাকতে হবে। যতদূর জানি, আমাদের রাজ‍্য বাজেটে এ ধরনের সংস্থান আলাদাভাবে দেখানো হয়নি।
এরপর আরেক জায়গায় স্টাডি লোনের সঙ্গে এই প্রকল্পের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কোন চাকরীর পরীক্ষা, যেমন IAS, IPS, WBCS, SSC ইত‍্যাদির ট্রেণিং নেওয়ার বেসরকারী ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার জন‍্যও ঋণ মিলবে! ফি ছাড়াও থাকা-খাওয়া ও বইপত্র ইত‍্যাদি কেনার জন‍্য যথাক্রমে ২০% ও ৩০% ঋণ মিলবে! তারপর যদি সেই ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় কৃতকার্য না হতে পারে তবে সে পনেরো বছরের নির্দিষ্ট সীমার মধ‍্যে কিভাবে ঋণ শোধ করবে? সেক্ষেত্রে রাজ‍্য সরকারের ভূমিকা কি? তারা কি ঋণ পরিশোধ ও সুদের দায়িত্ব নেবে? যদি না নেয়, তবে কোন ভরসায় ব‍্যাঙ্ক এই ধরনের ঋণ দেবে? বিশেষতঃ যেখানে ঋণের কোন সিকিউরিটি নেই।
এবার শেষ তফাৎটির কথা বলি। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, ক্লাশ টেন পাশ করার পরই কোন ছাত্র বা ছাত্রী এই ঋণের আবেদন করতে পারবে! অর্থাৎ হায়ার সেকেন্ডারী ক্লাসে পড়ার জন‍্যও এই ঋণ পাওয়া যাবে। কাজেই একে শুধু উচ্চশিক্ষার জন‍্য ঋণ বলা যাবেনা। এই ঋণ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কীম নাম দিয়ে রাজ‍্য সরকার এমন একটি প্রকল্প ঘোষণা করে দিল যার উপর সরকারের কোন কার্যকরী কন্ট্রোলিং ভূমিকা নেই। এটা অনেকটা রাজ‍্যের মানুষের সুবিধার নাম দিয়ে ব‍্যাঙ্কের বিভিন্ন স্কীম ঘোষণা করার মত! সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্রেডিট কার্ড রাজ‍্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক নয়, ব‍্যাঙ্কগুলি একমাত্র রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের অনুমোদন সাপেক্ষে দিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে রাজ‍্য সরকার বুদ্ধিমানের মত এমন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যেটা প্রায় ৯০ শতাংশ হচ্ছে বহু বছর ধরে চালু স্টাডি লোনের নামান্তর মাত্র। শুধু তফাৎগুলি এখানে আলাদাকরে উল্লেখ করা হল।
কি অদ্ভুত ছেলেভোলানো বিজ্ঞপ্তি! ক্রেডিট কার্ড দেবে ব‍্যাঙ্ক যে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের নিয়মে চলে। ব‍্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ইস‍্যু করা, ঋণ প্রদানের নিজস্ব পদ্ধতি ও নিয়ম নীতি আছে। মানলাম, সেসব মেনেই ব‍্যাঙ্কগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের ঋণ দিল। এবার এই ঋণের পদ্ধতিগত রিলিজের কথা যা বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, তার সঙ্গে কিন্তু প্রচলিত স্টাডি লোনের কোন তফাৎ নেই।
এবার আসি এই সরকারী আদেশনামার অসারতার বিষয়ে। এখানে দশ ক্লাশ পাশ করার পর কোন ছাত্র এগারো ক্লাশে ভর্তি হয়ে ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তির পরীক্ষার প্রাইভেট কোচিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হলেও তার ঋণ পাওয়ার যোগ‍্যতা হবে! তারপর সেই ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার ঋণ মেটানোর ক্ষমতা না থাকায় রাজ‍্য দেওয়ার কি সেই দায়িত্ব নেবে? মনে হয়না। দ্বিতীয় একটি বিষয় হল, ছাত্রদের ঋণের টাকা সুদসমেত ফেরৎ দেওয়ার দায়িত্ব – এই ধরনের গ্রুমিং না থাকার কারনে অনাদায়ী ঋণ বাড়ার আশঙ্কায় কোন ব‍্যাঙ্ক এই ঋণ দিতে আগ্রহী হবেনা। আবার HOIদের উপর ছাত্রদের ঋণ পাওয়ার প্রাথমিক কাগজপত্র পরীক্ষা করে সরকারের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করার দায়িত্ব থাকায় তাঁরা অসুবিধায় পরবেন। কারন বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক চাকরীর পরীক্ষা ও বৃত্তিগত কোর্সে ভর্তির ট্রেনিং ইন্সটিটিউটগুলির স্থায়ীত্ব ও স্বচ্ছতা কিভাবে HOIরা বিচার করে সন্তুষ্ট হবে! কারন ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে তাদের Head of the Institutionএর কাছে কাগজপত্র যেমন আধার কার্ড, দশ বছর রাজ‍্যে থাকার রেকর্ড ও যেখানে ভর্তি হবে তার অফার লেটার, ফি স্ট্রাকচার সব জমা দেবে। HOI সেগুলি সঠিক থাকল (?) তা উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করবে (যদিও উচ্চমাধ‍্যমিক উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীন নয়)। তারপর ছাত্র-ছাত্রীদের ব‍্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে হবে! ব‍্যাঙ্ক সন্তুষ্ট হলে তবেই ঋণ পাওয়া যাবে। যেহেতু ব‍্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে নয়, তারা তাদের ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা চাইবে। রাজ‍্য সরকার সেই নিশ্চয়তা দিলে তার জন‍্য তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণের বাজেট allocation রাখতে হবে। এই বিজ্ঞপ্তি বেরোনোর পর বাজেট পেশ হলেও এমন কোন allocation নেই এবং তা কোন provision ও নেই।
তাহলে নিট ফল কি দাঁড়ালো? প্রথমতঃ HOIএর উপর চাপ বাড়ানো হল, তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিং করতে বলা হল যাতে তারা বেশী সংখ‍্যায় আবেদন করে। ছাত্ররা যদি তাদের আবেদনের কাগজপত্র ঠিকমত আপলোড করতে না পারে তবে বদনাম হবে HOIদের! আবার যদি ঋণের আবেদনের বৃহদাংশ ঋণের সিকিউরিটির অভাবে এবং অস্বচ্ছতার কারণে বাতিল হয় ত বদনাম হবে ব‍্যাঙ্কের! তখন শাসকদল তার রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে পারবে। তারা প্রচার করবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ব‍্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ঋণ দিচ্ছেনা – যদিও রাজ‍্য সরকার তাদের আর্থিক দায়িত্ব নিতে রাজী(!)।
সুতরাং রাজ‍্য সরকার এমন একটি প্রকল্প আনলো যাতে তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ল, আবার সেইসঙ্গে এইধরনের ঋণ বিশেষ মঞ্জুর না হওয়ায় সরকারের উপর সুদের আর্থিক চাপও বাড়লনা। এটি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল যা অন‍্য অনেক তথাকথিত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পরবে আবার রাজ‍্যের শাসক দলকে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডও দেবে।

নব মূল‍্যায়নে শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায়

ভারতের স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে অন‍্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্র, যিনি তাঁর ১২০ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে ভারত তথা বাংলার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন – স‍্যার আশুতোষ মূখোপাধ‍্যায় ও শ্রীমতি যোগমায়া দেবীর দ্বিতীয় সন্তান শ্রী শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায়।
শ‍্যামাপ্রসাদের জীবনে তাঁর মা, মহিয়সী নারী যোগমায়া দেবীর গভীর প্রভাব পড়েছিল। মা ই তাঁকে শিখিয়েছিলেন সর্বদা সত‍্য ও ন‍্যায়ের জন‍্য লড়াই করতে। এই লড়াইয়ে তিনি আপোষহীন ছিলেন বলেই তাঁকে বারবার দল ও চেয়ার, মন্ত্রীত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। তাঁর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর ব‍্যক্তিগত কোন সংঘাত ছিলনা। নেহরু যখন দেশের স্বার্থের পরিপন্থী অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, শ‍্যামাপ্রসাদ তখনই তার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। বিবেক সায় না দেওয়ায় তিনি কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতার ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারার বিরোধিতা করে মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন। এতে যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে তারাই তাঁর নামে কুৎসা করেছে। তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠা করেন যা আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি রূপে পরিচিত। সুতরাং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল‍্যাটফর্ম তৈরীর কৃতিত্ব কিন্তু শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায়ের প্রাপ‍্য।
শ‍্যামাপ্রসাদের শিক্ষা ও শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে আবেগ ছিল লক্ষ‍্যণীয়। স্বল্প সময়ের মধ‍্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে দিয়েছিলেন। এর জন‍্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। একজন জাতীয়তাবাদী শিক্ষানুরাগী, যাঁর প্রথম প্রেম ছিল আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষায় সমাজকে শিক্ষিত করে তোলা এবং সর্বস্তরে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো – শুধু এই আলোতেই শ‍্যামাপ্রসাদের নব-মূল‍্যায়ন করা যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতকস্তরে ইংরেজিতে প্রথম হওয়ার পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায়ও প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর ল এর স্নাতক হন। এরপর তিনি লন্ডনের লিঙ্কন ইন্ থেকে ব‍্যারিস্টার-এট-ল হন। তিনি মাত্র তেত্রিশ বছর বয়েসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কণিষ্ঠতম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁকে উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে শুধু হিন্দুদের নেতা হিসেবে চিহ্নিতকরণ যে কত বড় মিথ‍্যা তা তিনি উপাচার্য হিসেবে তাঁর কাজের মধ‍্যেই প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর সময়ই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন vernacular বিষয়ে পঠন-পাঠন শুরু হয়। তাঁর উদ‍্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের islamic history কোর্স চালু হয়। তাঁর পিতা স‍্যার আশুতোষ মূখোপাধ‍্যায়ের উপাচার্য থাকার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে industrial chemistry চালু হলেও তাঁর সময়ই তা বিস্তার লাভ করে। তিনি যে industrial physics এর সূচনা করেছিলেন, আজ সেখানেই তা information technology নামে পরিচিত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ক গবেষণা বিভাগ শুরু করেন। তিনি শিক্ষায় উৎকর্ষতা বাড়ানোর জন‍্য ছাত্রদের মধ‍্যে বিদেশের অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে exchange programme চালু করেন। medicine এবং engineering এর সিলেবাস পরিবর্তন করে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের উপযোগী করে তোলেন। তিনি সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পরা ছাত্রদের জন‍্য বিভিন্ন স্কলারশিপের প্রচলন করেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষন দেওয়ার জন‍্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। সেই প্রথম, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলায় ভাষন দেওয়া হয়। তাঁর শিক্ষাজগতের প্রতি অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে।
শ‍্যামাপ্রসাদ উপাচার্য হওয়ার পরেই ম‍্যাট্রিক পরীক্ষা মাতৃভাষায় দেওয়ার উদ‍্যোগ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় থিওরীর সঙ্গে আলাদাভাবে প্র‍্যাকটিকাল পরীক্ষা নেওয়ার বিধি চালু করেন। শ‍্যামাপ্রসাদ বালিগঞ্জে জীববিদ‍্যা, প্রাণীবিদ‍্যা, নৃতত্ত্ব, শরীরবিদ‍্যা ইত‍্যাদি সকল প্রাণ-বিদ‍্যা অধ‍্যয়ণের বিষয়গুলিকে আলাদাভাবে অধ‍্যয়ণের সুযোগ করে দেন। এর পাশেই তিনি ফলিত রসায়ণের জন‍্য আলাদা ভবন নির্মানের নির্দেশ দেন।
যদিও শ‍্যামাপ্রসাদ বিজ্ঞানের লোক ছিলেন না, তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাকে অত‍্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তিনিই প্রথম এগ্রিকালচারাল সায়েন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ‍্যক্রমের মধ‍্যে আনেন। তাঁর বন্ধু মেঘনাদ সাহা নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে উচ্চতর গবেষণা করার জন‍্য সাহায্য চাইলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ‍্যামাপ্রসাদের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৯৫০ সালেই এই কাজের জন‍্য একটি গবেষণাকেন্দ্র তৈরী হয়। সেটি এখন সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কলকাতায় কেন্দ্রীয় গ্লাস ও সিরামিক রিসার্চের অটোনমাস কেন্দ্র গঠনেও তিনি অনেক সাহায‍্য করেন। তখন শ‍্যামাপ্রসাদ কমার্সও ইন্ডাস্ট্রীর মন্ত্রী। এটি এখন CSIR এর অধীন একটি ‘flagship institute’। তিনিই প্রথম CSIR এর সহ-সভাপতি। শ‍্যামাপ্রসাদ ন‍্যাশনাল ফিজিক‍্যাল ল‍্যাবোরেটরী গঠনে পরিকল্পনা ও সফল রূপায়ণ করেন। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত IACS, Kolkata, এর বিস্তারে শ‍্যামাপ্রসাদ সক্রিয়ভাবে সাহায‍্য করেন।
ভারতের ইতিহাসে নেহরুইয়ান সোশালিষ্ট রাজনীতির কম‍্যুনিষ্ট কন্ট্রোল ও সোশাল সায়েন্স কন্ট্রোল থাকায় আমরা সত্তরের দশক থেকে আমরা পত্রপত্রিকায় ও পাঠ‍্যপুস্তকাদিতে কম‍্যুনিষ্টসুলভ বিকৃত ইতিহাস রচনার পরিচয় পেতে শুরু করি। এই প্রেক্ষাপটেও শ‍্যামাপ্রসাদের সঠিক মূল‍্যায়ণ প্রয়োজন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জিতে আসার পরে মতবিরোধের জেরে অল্পদিনের মধ‍্যে পদত‍্যাগ করে আবার নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে আসেন। এখানেই কংগ্রেসের নেতারা তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পান। তারপর ১৯৪১-৪২ সালে তিনি ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টির সঙ্গে মিলিজুলি সরকারের মন্ত্রী হলেন। ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতি ও পীড়নের প্রতিবাদে এই মন্ত্রীসভা থেকেও তিনি পদত‍্যাগ করেন। এরপর প্রবল বন‍্যায় মেদিনীপুরের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে তিনি সাহায‍্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মহাবোধী সোসাইটি, রামকৃষ্ণ মিশন ও মারোয়ারী রিলিফ সোসাইটির সঙ্গে মিলে ত্রাণ বিলিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। ঐ সময় শ‍্যামাপ্রসাদ বাঙ্গালী হিন্দু ও বাংলায় বসবাসকারী হিন্দু অবাঙ্গালী উভয়ের কাছেই নেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। অবশ‍্য তার পিছনে একটি ইতিহাস আছে। তিনি দেখলেন যে, ব্রিটিশ লালিত, উগ্র ধর্মান্ধতার নিরিখে ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ বিভাজনকারী মুসলিম লীগ ও তার নেতা মহম্মদ আলী জিন্না ও তার দলবল ভারত ভাগ করে দুটো আলাদা মুসলিম খন্ড নিয়ে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনের লালসায় উন্মাদ। সঙ্গে ব্রিটিশের প্রশ্রয়ে লালিত নেহরুর প্রতি গান্ধীজীর অন্ধ সমর্থন শ‍্যামাপ্রসাদের মনে ‘হিন্দুদের বলির পাঁঠা’ করার ভীতির উদ্রেক করে। তিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় নেতা হয়ে ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে মিলিতভাবে, গঠিতব‍্য পাক-ই-স্তানের হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির দাবী তোলেন। এরথেকে আজকের পরিস্থিতিতে মূল‍্যায়ন করতে বসে সহজেই বলা যায় যে, তখনকার রাজনীতিকদের মধ‍্যে তাঁর মত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আর একজন নেতাও ছিলেন না। শ‍্যামাপ্রসাদ কিন্তু আদতে হুগলী জেলার জিরাতের লোক। তবুও পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দূরবস্থা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এটাই রাজনৈতিক ও সামাজিক দূরদৃষ্টি।
১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম বাংলা ভাগের কথা বলেছিলেন। এর পিছনের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে শ‍্যামাপ্রসাদের সঠিক মূল‍্যায়নে সুবিধা হবে। জওহরলাল নেহরুর স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ভারতবর্ষে বসবাসকারী মুসলমানদের ধন, সম্পত্তি, ধর্ম ও প্রাণ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে তৈরী থাকলেও পাক-ই-স্তানে অনুরূপ আইন নির্মানে জিন্না, লিয়াকত আলীদের কোন আগ্রহ ছিলনা। এদিকে শরৎ চন্দ্র বোস ও হুসেইন শাহিদ সুরাবর্দীরা দাবী করলেন বঙ্গপ্রদেশকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র তৈরী হোক। বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের ধারনা ছিল, এইভাবে গঠিত রাষ্ট্রে তারাও নেহরু ও জিন্নার মত নেতা হতে পারবে আবার সেইসঙ্গে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হওয়ায় তারা ধর্মীয় প্রভাব বজায় রেখে মুসলিম শাসনের আরো একটি রাষ্ট্র পাবে। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে এই নেতারা সত‍্যকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখান। এই সময়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখিতভাবে শ‍্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করেন। শ‍্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ করে হিন্দু প্রধান অঞ্চলকে ভারতভুক্তির প্রস্তাব পেশ করেন। অকাট‍্য যুক্তি সাজিয়ে তিনি লর্ড মাউন্টব‍্যাটেনকে চিঠি লেখেন। তাঁর দাবীর সমর্থনে জনমত বাড়তে থাকে। এতেই বঙ্গীয় মুসলিম নেতাদের স্বার্থে আঘাত পড়ে। তারা জিন্নার ডাইরেক্ট অ‍্যাকশানের ডাকে বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ‍্যায়ের সূচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৬ই আগস্ট জিন্নার ডাকে কলকাতায় যে হিন্দু নিধন শুরু হয়, তাতে বৃটিশ রেকর্ড অনুযায়ী চার হাজার মানুষের মৃত‍্যু হয় ও এক লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়। যেহেতু সুরাবর্দীর সরকার এই হত‍্যালীলার মদতদাতা সেহেতু তার পুলিশ হিন্দুদের কোন নিরাপত্তা দেয় না। এরপর যখন হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন কংগ্রেসের পক্ষে গান্ধীজী তাঁর পেটেন্ট শান্তির বাণী বিতরন করে হিন্দুদের থামান। তখন মুসলমানরাও প্রতিরোধের ভয়ে পিছিয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে বঙ্গের বেশ কয়েকটি মুসলমান অধ‍্যুষিত জায়গায় হিন্দুনিধন শুরু হয়। এর মধ‍্যে সবচেয়ে বিভৎস নোয়াখালী কিলিং। ওই বছরের লক্ষীপূজোর দিন নোয়াখালীতে হিন্দুনিধন, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ ও সম্পত্তি লুঠ করা শুরু হয়। এটি একতরফাভাবে সংঘটিত হয়। এর একমাত্র কারন যারা অত‍্যাচারিত তাদের ধর্ম হিন্দু! পৃথিবীর ইতিহাসে আর এমন কোন ধর্মীয় কারনে হত‍্যার উদাহরণ নেই। আশ্চর্যের কথা, কংগ্রেস লালিত কম‍্যুনিষ্ট ইতিহাসবিদরা এর জন‍্য শ‍্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাবকে দায়ী করেন। দেশবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, জিহাদী ইসলামের সমর্থনকারী কম‍্যুনিষ্টদের বর্তমান দুরবস্থার জন‍্য তাদের এই নীতিই দায়ী। এই সময়ে গান্ধীজীকে মুসলিম লীগ নেতারা বিদ্রুপ করতেন। সেইজন‍্য তিনি নেতৃত্ব বজায় রাখার তাগিধে মুসলমানদের কিছু না বলে হিন্দুদের ইসলামের নামে অত‍্যাচার সহ‍্য করার (!) পরামর্শ দেন। কিন্তু এই ঘটনাগুলির ফলে জওহরলাল নেহরু থেকে লর্ড মাউন্টব‍্যাটেন ও শেষে বৃটিশ সরকারও বাংলা ভাগ মেনে নিতে বাধ‍্য হন। একমাত্র মুসলিম নেতারা মানতে আজো তা মনে মনে মানতে পারেনি। বাঙ্গালী হিন্দুরা যে ভারতের মধ‍্যে তাদের সেফ হোমল‍্যান্ড পেয়েছে তার পুরোপুরি কৃতিত্ব শ‍্যামাপ্রসাদের। পরবর্তীতে কাশ্মীরের যে বিশেষ ক্ষমতার বিরোধীতা করে তিনি ও কে সি নিয়োগী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত‍্যাগ করেন, তাঁর সেই দাবী বর্তমান সরকার পুরণ করেছে। নেহরুর সঙ্গে লিয়াকত আলীর চুক্তি নেহরু মানলেও জিন্না মানেননি। শ‍্যামাপ্রসাদ শুধু যে একজন ভবিষ‍্যৎ দ্রষ্টা, দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন তাই নয়, সমাজসেবা ও শিক্ষার বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
ভারতের ইতিহাসে শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায়ের নতুন করে মূল‍্যায়ণ করা প্রয়োজন।

জাল ভ‍্যাকসিনকান্ডের আসল নায়ক কারা

আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন সরাসরি শাসকদলের অঙ্গুলীহেলনে চালিত হয়, তা একটি পরীক্ষিত সত‍্য। সেটা একমাত্র শাসকের সমর্থক ও সুবিধা পাওয়া সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর সবাই মেনে নেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তবু প্রশাসনের কিছুটা ঋজুতা ছিল। কিন্তু তথাকথিত বামফ্রন্টের নামে সিপিএম পার্টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল পোস্টিং, প্রমোশান, সর্বোপরি অপছন্দের আধিকারিকদের অফিসার-অন-কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া এসবে রাজ‍্য প্রশাসন ধীরে ধীরে অভ্রস্ত হয়ে উঠল। পঞ্চায়েত ও পুরসভার মাইনে রাজ‍্য সরকার দেয় বলে তাদের পুরো কন্ট্রোল এভাবেই ঐ রাজনৈতিক দল নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। একটি বিখ‍্যাত দৈনিক কাগজকে ধমকে,চমকে, বিতর্কিত অগ্নিকাণ্ডের পর সেও ঐ রাজনৈতিক দলের নেতাদের কন্ট্রোলে চলে এলো। সেই শুরু। বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই প্রথম পুলিশের নীচু তলায় দলের আনুগত‍্য বাড়াতে সক্ষম হল। পুরষ্কার-তিরষ্কারের নতুন স্কিম তৈরী হল। তারপর ধীরে ধীরে উপরতলার আধিকারিকদের ধরা হল। IAS, IPS, WBCS, WBPSরা শুধু তাদের আনুগত‍্যের জার্সিটা পাল্টে নিল। দু তিন বছরের মধ‍্যে “সিপিএম এর মেধাবী ছাত্রী”র তাঁবে চলে এলো পুরো রাজ‍্য প্রশাসন। ইতিমধ‍্যে ঘটল ‘পার্কস্ট্রীট কান্ড’। সেই খবরের সম্প্রচারে যার পর নাই রুষ্ট হয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো সংবাদমাধ্যমগুলোর খানিকটা ‘স্ক্র টাইট’ দিলেন। ব‍্যবহৃত হলো দোধারী তলোয়ার। বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ বিশেষ সংবাদপত্র বিপননে বাধা, সঙ্গে বিজ্ঞাপন বন্ধ – এমনিই নরম মেরুদন্ডের বাংলা প্রচার মাধ‍্যম – একদম নুয়ে পড়ল।
যত সময় অতিবাহিত হল, সংবাদমাধ্যমগুলোর উপর শাসকের চাপ বৃদ্ধি পেতে পেতে তা এমন জায়গায় চলে গেল যে, “বাবু যত বলে, পারিষদদলে বলে তার শতগুণ”। এই সংবাদমগুলি যত স্তাবকতা করতে লাগল, তত তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমতে লাগল। কিন্তু প্রশাসনিক বিজ্ঞাপন দাক্ষিণ‍্যে এদের লাভের অঙ্ক আরো স্ফীত হল। এদের গ্রাহকসংখ‍্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে এরা এদেরই মত কিছু মেরুদন্ডহীন মানুষজনকে শোবিজনেস থেকে, কাউকেবা আনকোরা অবস্থায় তুলে এনে তাদের “বুদ্ধিজীবী” ছাপ মেরে তাদের মুখ দিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে লাগল। সংবাদপত্র ও বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে এদের অবমূল‍্যায়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও, সংবাদমাধ‍্যমের লাভ বৃদ্ধি পেতে লাগল। এদের আর নির্ভিক, নিরপেক্ষ ইত‍্যাদি ভেকধারী হওয়ার প্রয়োজন রইল না। এরা শাসকের বা প্রশাসনের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়, এমন খবর প্রচারের স্পর্ধা হারিয়ে ফেলল। এমনকি, যদিও প্রচার করতে বাধ‍্য হয়, তবে এমনভাবে তা পরিবেশন করে যাতে আসল খবরটাই নষ্ট হয়ে যায়। এমনই একটি ঘটনার খবর হল দেবাঞ্জন কান্ড।
এই দেবাঞ্জন দেব IAS, জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং কোলকাতা পৌর নিগমে কর্মরত এই পরিচয়ে জাল টীকাকরন কেন্দ্র খুলে মানুষকে টীকা দেওয়ার নামে ধোঁকা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, শাসকদলের লোকসভা সদস‍্যা শ্রীমতী মিমি চক্রবর্তী এখানে টিকা নিয়ে সার্টিফিকেট না পাওয়ায় তাঁর ব‍্যক্তিগত সচিবকে দিয়ে থানায় FIR দায়ের করেন এবং তার ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করে জানতে পারে যে এই দেবাঞ্জন দেব একটি জাল IAS এবং সে কোলকাতা পৌর নিগমের কোন অফিসার নয়! সে জাল টীকাকেন্দ্র কোলকাতা পৌর নিগমের নামে চালাচ্ছিল এবং মানুষজনকে বিনামূল‍্যে টীকা (!) দিচ্ছিল। পুলিশ ঐ ক‍্যাম্প বন্ধ করে তদন্ত শুরু করে। এই জালিয়াতকে ধরার কৃতিত্ব সংবাদমাধ্যম লক্ষ‍্যণীয়ভাবে শাসকদলের সাংসদ তথা শাসকদলের উপর দেয়! দেবাঞ্জন কত বড় জালিয়াত এবং শিক্ষক থেকে আরো কত মানুষজনকে সে ঠকিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরন দেওয়া শুরু হল! এরসঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ‍্য নিয়ে যে ধোঁকা দেওয়া হল তার কি সম্পর্ক তার কোন ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়না। সুতরাং সন্দেহ করার যথেষ্ট কারন আছে যে তদন্ত প্রভাবিত হচ্ছে এবং আসল জায়গা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। করন এটি কোন সাধারণ জালিয়াতি নয়। সবচেয়ে বড় কথা, যারা জাল টীকা পেয়েছেন তাঁদের নাকি কোভিশিল্ড নয়, অ‍্যামিকাসিন৫০০ নামের অ‍্যান্টিবায়োটিক পুশ করা হয়েছে! এই অ‍্যান্টিবায়োটিক বশী হলে ইউরিক অ‍্যাসিড বৃদ্ধি পায়। এতে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সরাসরি মৃত‍্যু হয় না। এদিকে সরকার নাকি দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে “অনিচ্ছাকৃত মৃত‍্যু” ঘটানোর অভিযোগ আনছে!
অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন। প্রথম, একটি বা দুটি জাল ভায়ালে অ‍্যামিকাসিন পাওয়া গেলেও এটা কিকরে বলা যায় যে, একাধিক ক‍্যাম্প করে কয়েক হাজার মানুষকে জাল টীকা দেওয়া সবাই একই জিনিষ পেয়েছেন? জৈব বা অজৈব ক্ষতিকারক কিছু ত থাকতেই পারে। আবার যদি এতে মৃত‍্যু হয়ও তা অনিচ্ছাকৃত বলে লঘুকরণ করায় অন‍্য ‘গন্ধ’ পাওয়া যেতেই পারে। আবার দেখা যাচ্ছে এই জাল IASটি বহুদিন ধরে ঘুরন্ত নীলবাতি (যা জয়েন্ট সেক্রেটারীরা পান না) গাড়িতে বডিগার্ড সহ চলাফেরা করতেন। কোলকাতা পৌর নিগমের মূল ভবনে নাকি এর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে পার্কিংলটে তার গাড়ি থাকার কথা। আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই লোকটি সাধারণ চিটিংবাজ হলে এভাবে দিনের পর দিন পৌর নিগমের উচ্চপদস্থ আমলা সেজে সাধারণ কর্মচারীদের চোখে ধূলো দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ অতি উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ ও প্রোটেকশান না থাকলে এভাবে পার পাওয়া যায় না। আমরা একাধিক ছবিতে নিগমের মেয়র ও মন্ত্রী জনাব ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ছবি দেখেছি। শুধু তাই নয়, তালতলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ট‍্যাচু উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও স্থানীয় এমএলএ মহাশয়ার নামের সাথে এই জাল আধিকারিকের নামও প্রস্তর ফলকে জ্বলজ্বল করছিল। আচ্ছা, এটা কি বিশ্বাসযোগ‍্য যে পৌর নিগমের মেয়র, ডেপুটি মেয়র তাদের নিগমের উচ্চপদস্থ আমলাকে চেনেননা! এই ঘটনা জানাজানি হতে বালখিল‍্য বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এই জালিয়াতের নামে কালো কালি লেপে দওয়া হয়েছে। পরে এই ফলক খুলে নেওয়া হয়। আবার দেখা যাচ্ছে, এক অনুষ্ঠানে এই জালিয়াত মঞ্চ আলো করে সিনিয়ার মন্ত্রী শ্রী সুব্রত মূখোপাধ‍্যায়ের পাশে বসে আছে! এই সব সরকারী অনুষ্ঠানে যারা ফলক লাগানোর দায়িত্ব পান তারা খসরা ফলক তৈরী করে প্রধান অনুষ্ঠানকারী, এক্ষেত্রে মেয়র, বা তার সচিবকে দেখিয়ে অনুমোদন করে নেন। এটাই দস্তুর। এমন জালিয়াতি সখানে ধরা না পরাটাই বিস্ময়ের। মন্ত্রীরা কোন অনুষ্ঠানে থাকলে তার একটা প্রোটোকল থাকে। এছাড়া আলাদা সিকিউরিটি চেকিং থাকে। পুলিশ এই জাল IAS তথা জাল পৌর নিগম আধিকারিক সম্পর্কে কিছু জানত না বললে তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কেই প্রশ্ন জাগে। এদিকে
সমস্ত সংবাদমাধ্যম এই জাল IAS কে জালিয়াত প্রমাণ করতে ও রাজ‍্য পুলিশের তৎপরতার পক্ষে মূহুর্মূহ প্রচার করতে ব‍্যস্ত। এখন তাদের তোতাপাখি ‘বুদ্ধিজীবি’কুল শীতঘুমে আছেন! পুরো ব‍্যপারটাই মনে হয় আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন‍্য।
আজ মানুষকে ভাবতে হবে যে দেবাঞ্জন সামান্য ৪২০ ধারার চিটিং বাজী, এমনকি অনিচ্ছাকৃত খুণের চেষ্টার অপরাধী কি? সে কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ‘টীকাকরন’ করছিলনা। বরঞ্চ সে তার টীকাকরন কেন্দ্র চালানো এবং তার প্রচারের জন‍্য টাকা খরচ করেছে। এখানে প্রশ্ন দুটি। এক, কেন সে এটা করেছে এবং দুই, কে তাকে এর জন‍্য অর্থ দিয়েছে এবং কি উদ্দেশ্যে দিয়েছে। এই দৃষ্টিকোনে তদন্ত চালানোর ক্ষমতা রাজ‍্যের CID বা যতই SIT গঠন করা হোক, কারোরই নেই। এমনকি রাজ‍্যের বিরোধীদল বিজেপিও তা বুঝেছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের অনেক নেতা রাজনৈতিক কারনে CBI তদন্ত চেয়েছেন। এটা CBIএর এক্তিয়ারেও পড়ে না। একমাত্র NIA এই তদন্ত করতে পারে। কারন, এখানে এমন শক্তির জড়িত থাকার সম্ভাবনা যারা দেশের মানুষের ক্ষতি করতে চায়। এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ‍্য নয় যে, একজন সাধারণ জালিয়াত শুধু নাম কেনার জন‍্য এত টাকা খরচ করে ভূয়ো টীকাকরনকেন্দ্র চালাবে। এর কর্মপদ্ধতি লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, এই শ্রীমান প্রথমে রাজ্রের ক্ষমতাশালী মানুষজন, মূলতঃ শাসকদলের VIPদের কাছে নিজেকে আস্থাভাজনকরেছে, তারপর সে এই জাল টীকার ফাঁদ পেতেছে। সে কিন্তু একটি নয়, পরপর বিভিন্ন টীকাকেন্দ্র খুলে জাল টীকা দিচ্ছিল। অর্থাৎ তার প্রধান উদ্দেশ‍্য ছিল এই জাল টীকা দেওয়া। তার বাজেয়াপ্ত করা কোন ভায়ালে অ‍্যামিকাসিন৫০০ পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয় যে সে অন‍্য কিছু, যেমন ক্ষতিকারক ভাইরাস বা অন‍্য জৈব বা অজৈব ক্ষতিকারক কিছু প্রয়োগ করছিল না?
এখানে কিছু ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে মালদার সুলতানপুর চেকপোষ্ট দিয়ে একজন চীনা নাগরিক হান জুনওয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ভারতে প্রবেশ করার পর ধরা পড়ে। তার এক শাকরেদ সুন জিয়াং উত্তর প্রদেশে কিছুদিন আগে ধরা পড়ে। এই হান জুনওয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট থাকায় ভারত সরকার তার ভিসার আবেদন নামঞ্জুর করে। তখন সে নেপাল ও বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে চীন থেকে নেপাল হয়ে বাংলাদেশের মধ‍্যে দিয়ে ভারতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে। তার কর্মপদ্ধতিই বলে সে অসৎ উদ্দেশ‍্যেই একাজ করেছে। আমরা এও লক্ষ‍্য করেছি যে, চীন ইউহানের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের ল‍্যাবোরেটরীতে ভাইরাসের থেকে জৈব অস্ত্র বানানোর প্রক্রিয়ার সাথে সাথে অন‍্য অনেক রকমভাবে ভারতে নাশকতামূলক কাজকর্ম বাড়াতে চাইছে। একাজে সে ইতিমধ‍্যেই পাক-ই-স্তানকে ঘোষিত দোসর হিসাবে পেয়েছে। আবার, কিছুদিন আগে নিউটাউনে রাজ‍্য পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত দুই দুষ্কৃতির পাক-ই-স্তান যোগ এবং ড্রাগ মাফিয়া যোগের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তারপর আর তদন্তের বিষয়ে কিছু শোনা যাচ্ছে না! ভূয়ো টীকাকরন শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, মহারাষ্ট্রেও ধরা পড়েছে।
এসব থেকে একটি জিনিষ খুব পরিষ্কার। আমাদের দেশকে অস্থির করতে বিদেশী শত্রুরা কোমর বেঁধে নেমেছে। আর এ কাজে তাদের ‘পঞ্চম স্তম্ভ’ এই দেশেরই কিছু মানুষ। নাহলে শুধু বিদেশীদের পক্ষে আমাদের দেশের অভ‍্যন্তরে লাগাতার নাশকতা চালানোর চেষ্টা করাও সম্ভব ছিলনা। কে বলতে পার, এইসব দেবাঞ্জনরা তাদের সহযোগী হিসেবে নেমেছে কিনা। টাকার সংস্থানও নিশ্চয়ই বিদেশী শক্তির থেকে আসছে। আশ্চর্য হচ্ছে, আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি বড় অংশ বুদ্ধিহীণ অমেরুদন্ডী প্রাণীর মত “কাকে নিয়ে গেল কান” বলে চিল চীৎকারে কাকের পিছনে ছুটতে লেগেছে। সুতরাং এই দেবাঞ্জনদের পিছনের আসল কুশীলবদের ধরার জন‍্য একমাত্র NIA তদন্তই যথার্থ হতে পারে। তাতে কোন রাজনৈতিক নেতা যদি জড়িয়ে যান তাহলে তাঁকে বাঁচানোর জন‍্য যথার্থ তদন্ত না করা বা তদন্তের পরে লঘু ধারায় চার্জসিট দেওয়া কি দেশের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী নয়?
এখানে তদন্তের আরো একটি সম্ভাব‍্য দিকের আলোচনা করাও জরুরী। সেটি হল ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদীজী বা বিজেপি যাতে কোনওভাবে ক্ষমতায় না আসতে পারে তার রাস্তা প্রশস্ত করা। কিভাবে? ধরা যাক, এই ধরনের ভূয়ো টীকাকরন ক‍্যাম্প যা দেবাঞ্জন দেব কয়েকটি জায়গায় সংঘটিত করার পর কয়েক হাজার (আনুমানিক) মানুষের শরীরে টীকার নামে অজানা কিছু ঢুকিয়ে দিল। মহারাষ্ট্রেও জাল টীকাকরন কেন্দ্র থেকে এমন অনেকে টীকা নিয়েছেন। হয়ত আরো জায়গায় জাল টীকা দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল একটি সংগঠিত কাঠামোতে পুলিশ, প্রশাসন ও বড় মিডিয়া হাউসগুলির মিলিত প্রচেষ্টায় চলে। যদি এই ভূয়ো টীকা নেওয়ার পর কয়েকজনেরও মৃত‍্যু হয় তবে এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশে সব একসঙ্গে গেল গেল করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে রব উঠবে মোদী টিকা দিয়ে দেশের মানুষদের খুণ করছে! “মোদী হটাও – দেশ বাঁচাও”। এতে হয়ত দেশে রাজনৈতিক পালা বল হত, কিন্তু বিদেশী শক্তি দেশের অভ‍্যন্তরে যে বিভেদ তৈরীতে সক্ষম হবে তাতে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। দেশের স্থায়িত্বের বিনিময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ দেশদ্রোহিতার নামান্তর। তবে, ধন‍্যবাদ শাসকদলের সাংসদকে তার এই জাল টীকার কার্যকলাপের মৌচাকে আঘাত করার জন‍্য। এটা খুবই চিন্তার কথা যে, কি বিরোধী, কি সরকার – কেউই এর কার্যকরী ও সঠিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চাইছে না। NIA কে দিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান আশু প্রয়োজন।

গান্ধীজীর বার-এট-ল ডিগ্রী কোথায়

আধুনিক ভারতের ইতিহাসে কোন অবিসংবাদী জননেতার নাম করতে হলে রাজনীতির পক্ষপাত ছাড়া মানুষ একটিই নাম করবে- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি ‘মহাত্মা গান্ধী’ বা ‘বাপুজী’ নামেই আপামর ভারতবাসীর কাছে পরিচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিনগুলিতে যে মানুষটির ডাকে আসমুদ্র হিমাচলের মানুষ আন্দোলিত হয়েছে, যে মানুষটির ‘অসহযোগ’ ও ‘অহিংস’ আন্দোলন শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ছিল সংশয়াতীত। এই মানষটির সমাজ-চেতনা, সামাজিক ধ‍্যান-ধারনা, দেশগঠনের ভাবনা ও ‘অহিংসা’ এবং সত‍্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা তাঁকে ‘মহাত্মা’ আখ‍্যা দিয়েছে।
এমন একজন মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া আমার মত কোটি কোটি মানুষের কাছে আবশ‍্যিক। অথচ বিভিন্ন ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের গ্রন্থগুলিতে তাঁর জীবন ও কর্মধারার মধ‍্যে কিছু ধোঁয়াশা লক্ষ‍্য করা যায়। এই ধোঁয়াশাগুলি যদি তথ‍্য সহযোগে মুক্ত করা যায়, তবে আমাদের জাতীয় নেতা এবং দেশের জনক গান্ধীজীর প্রতি সুবিচার করা হবে।
গান্ধীজী ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর কাথিয়াবার এজেন্সির পোরবন্দর শহরে করমচাঁদ ও তাঁর চতুর্থ স্ত্রী পুতলীবাইয়ের কণিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। আর ৭৮ বছর বয়েসে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর পরিবার,মা-বাবা, ভাই-বোন সম্পর্কে সমস্ত তথ‍্য থাকায় তাঁর পরিবার সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারনা আছে। তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু তথ‍্য পাওয়া গেলেও অপেক্ষাকৃত কম জানা আছে। হ‍্যাঁ, তিনি আলফ্রেড হাইস্কুল, রাজকোটে ১৮৮০ থেকে ১৮৮৭ সাল অব্দি পড়াশুনা করেন এবং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভাবনগর স্টেটের সামালদাস আর্টস কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ‍্যেই তিনি কলেজ যাওয়া বন্ধ করেন এবং কলেজ ড্রপআউট হন। এর মধ‍্যে তিনি তেরো বছর বয়েসে বিবাহ করেন এবং তারপর তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। তাঁর জীবনীকারদের থেকে এবং তাঁর নিজের আত্মজীবনী থেকে যেটুকু জানা যায় তা হল, গান্ধীজী ছাত্র হিসেবে অতি সাধারন মানের ছিলেন এবং কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে গ্র‍্যজুয়েশান কমপ্লিট করতে পারেননি। কলেজ ড্রপআউট হয়ে তিনি স্থির করলেন, লন্ডন গিয়ে তিনি ব‍্যরিস্টারী ডিগ্রী করবেন। গান্ধীজীর মা পুতলীবাই তাঁর কণিষ্ঠ পুত্রের বিদেশ যাত্রায় রাজি ছিলেন না। কিন্তু গান্ধীজী সকল বাধা উপেক্ষা করে মুম্বাই (তখনকার বোম্বে) হয়ে লন্ডন পৌঁছালেন এবং তাঁর আত্মজীবনী অনুযায়ী তিনি ‘ইনার টেম্পল’এ ভর্তি হলেন। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন, ফ‍্যাকাল্টি অফ ল কিন্তু ব‍্যারিস্টারদের ডিগ্রী দেয়। আর ল যাঁরা প্র‍্যকটিস করেন, অ‍্যাটর্নি ও বিচারকদের চারটি ইন্ এ বিভক্ত হয়ে তাদের মেম্বার হতে হয়। এই চারটি ইন্ হল – গ্রে’জ ইন্, লিঙ্কনস ইন্, মিডল টেম্পল, এবং ইনার টেম্পল। এই চারটি ইন্ এ ল এর ছাত্ররা লেকচার শোনে। সেখানে ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট সংখ‍্যক ‘ডিনার’ হোষ্ট করতে হয়। ডিনারের পর লেকচার ও আলাপচারিতার মাধ‍্যমে ছাত্রদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। পুরো ডিনার সংখ‍্যার মধ‍্যে ছাত্রদের ন‍্যূনতম সংখ‍্যার ডিনারে উপস্থিত থাকা বাধ‍্যতা মূলক। রেকর্ড থেকে জানা যায় যে গান্ধীজী এই ইনার টেম্পলে ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তবে তাঁর নাম রেকর্ড করা ছিল “Informal auditing student” হিসেবে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের খাতায়! এই ব‍্যপারে ইনফরম‍্যাল অডিট স্টুডেন্টের ব‍্যখ‍্যাও দেওয়া আছে। অডিট স্টুডেন্ট তাঁরাই যারা জ্ঞান আহরনের জন‍্য ক্লাস করেন, কিন্তু তাঁদের মূল‍্যায়ণ হয় না এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের গ্রেড পাওয়ার কথা নয়। ফলে গ্রেড, তা পাশ বা ফেল যাই হোক না কেন, অডিট স্টুডেন্টদের পাওয়ার প্রশ্ন আসে না। আর ইনফর্মাল স্টুডেন্ট মানে ফর্মাল স্টুডেন্ট নন – এটাই ত স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, যে চারটি ইন্ এর কথা বলা হয়েছে, তারা লএর ছাত্রদের, যারা ভবিষ্যতে বার-এট-ল হবেন, তাঁদের ট্রেনিং দেয় এবং এই ট্রেনিং ইংল‍্যান্ড ও ওয়েলশে প্র‍্যাকটিস করার জন‍্য আবশ‍্যিক। এই ইন্ গুলি ট্রাষ্টিবোর্ডের অধীনে কাজ করে, এরা কিন্তু ল গ্র‍্যাজুয়েটের ডিগ্রী দেয়না। ডিগ্রী একমাত্র দিতে পারে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন। সেখানে আবার গান্ধীজীর রেজিষ্ট্রেশান ইনফর্মাল অডিট স্টুডেন্ট হিসেবে। পুরো ব‍্যপারটাই কেমন ধোঁয়াশা। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন‍্য গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে মনোনিবেশ করা গেল। কারন, গান্ধীজী রাজা হরিশ্চন্দ্রের ন‍্যায় নীতি ও সততার আদর্শে অনুপ্রাণিত। সেখানে তিনি ভারতে ফিরে আসার আগে ইংল‍্যান্ডের হাইকোর্টে তার নিজের নাম নথিভূক্ত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর আত্মজীবনীর ২৪তম অধ‍্যায়ে লেখা, “I passed my examinations, was called to the bar on 10th June 1891 and enrolled in the High Court on the 11th. On 12th, I sailed for home”। এখানে কয়েকটি কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। “called to the bar” এবং আরেকটি কথা, “keeping terms” এর অর্থ করলে দাঁড়ায় যে, ইনার টেম্পলে ২৪টি ডিনার ক্লাসের মধ‍্যে ন‍্যূনতম ৬টি ডিনার ক্লাস যা বাধ‍্যতামূলক, তা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইনার টেম্পলের এই criteria তিনি পূর্ণ করেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীর ব‍্যপারে গান্ধীজীর আত্মজীবনী যেমন নির্দিষ্ট করে কিছু বলে না; তেমনি তাঁর জীবনীকারেরা যেমন, ডি জি টেন্ডুলকার, রবার্ট পেইন, বি আর নন্দা ও জিওফ্রে অ‍্যাশ এবং অন‍্যান‍্যরা কিছু বলেননি। আবার ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের প্রাক্তনীদের তালিকায় গান্ধীজীর নাম আছে – পরিচয় ভারতের স্বাধীনতা ও অসহযোগ আন্দোলনের পুরোধা। এদিকে আবার গান্ধীজী অডিট স্টুডেন্ট ছিলেন; যাদের সম্পর্কে ইউনিভার্সিটিতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে, “In this case audit indicates that the individual merely has received teaching, rather than being evaluated as having a given standard of knowledge of the subject. The term ‘audit’ is Latin, translated as ‘he/she hears’. In other words, the audit student has experience the course, but has not be assessed”।
এরপর গান্ধীজী দেশে ফিরে এসে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে বোম্বে হাইকোর্টে রেজিষ্টার্ড হলেন। সেখানে আবেদন পত্রে গান্ধীজী পরিষ্কার ভাষায় নিজেকে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে উল্লেখ করলেন। হাইকোর্ট যখন সেই আবেদন গ্রহন করেছিল তখন নিশ্চয়ই তারা সঠিক কাগজপত্রের ভিত্তিতেই তা করেছে বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ গান্ধীজীর ব‍্যারিষ্টারী ডিগ্রী পাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথায়? কিভাবে? সে জিনিসটা কোন জীবনীকার পরিষ্কার করে বলেননি। এমনকি তাঁর আত্মজীবনীতেও তা পাওয়া যায় না। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে ঐ ২৪ তম অধ‍্যায়ে যেটুকু বলা আছে তার বাইরে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী নিয়ে আর কোন কথা নেই। এমনকি ইনার টেম্পলে তাঁর সামাজিক ও আর্থিক অসুবিধা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও ল পড়ার ব‍্যপারে বা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ে কোন কথা নেই! এদিকে ২০০৩ সালে লেখা একটি নথি থেকে জানা যায় যে, গান্ধীজী লন্ডনের হাইকোর্টে ১১ই জুন রেজিষ্টার্ড হওয়ার কথা বললেও তার লন্ডনের কোর্টে সওয়াল করার রেকর্ড পাওয়া যায় না। এছাড়া ঐ নথি থেকে এও নিশ্চিতভাবেই জানা যায় যে, কোর্টের যে চারটি ইন্ আছে তারা কোন ল ডিগ্রী দিতে পারে না। সুতরাং গান্ধীজীর ইনার টেম্পল থেকে ব‍্যরিষ্টারী পাশ করার সুযোগ ছিল না। আবার “Informal auditing” ছাত্র হওয়ায় ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে ডিগ্রী পাওয়াও সম্ভব নয়। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতেও তাঁর ল ডিগ্রী পাওয়ার ব‍্যপারে কিছু কথা নেই। ওদিকে লন্ডনের হাইকোর্টেও গান্ধীজীর রেজিষ্টার্ড হওয়ার প্রামাণ্য নথি পাওয়ার প্রশ্ন নেই কারন তিনি সেখানে বার কাউন্সিলের সদস‍্য হননি। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ১১ই জুন তিনি রেজিষ্ট্রি করার আবেদন করেছিলেন আর ১২ই জুন দেশে ফিরে আসেন! সুতরাং আবার ধোঁয়াশা। কিছুই পরিষ্কার হল না।
পরিশেষে আসি গান্ধীজী সম্পর্কে ডঃ বি আর আম্বেদকারের কথায়। তিনি কিন্তু গান্ধীজীর বম্বে হাইকোর্টের সওয়াল প্রত‍্যক্ষ করে মন্তব‍্য করেছিলেন, সওয়াল করতে গিয়ে গান্ধীজীর নাকি হাঁটু কাঁপত! আবার ডঃ আম্বেদকার ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের সব কটিতেই উপস্থিত থাকলেও রাজনৈতিক কারনে গান্ধীজী শুধু দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ঐ বৈঠকে তিনি কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।ঐ বৈঠকে গান্ধীজীর সওয়াল সম্পর্কে মন্তব‍্য করতে গিয়ে পরবর্তী এক সময়ে ডঃ আম্বেদকার বলেন যে, গান্ধীজী তাঁর ল পয়েন্টে সওয়াল না করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস‍্যুগুলিকে তুলে ধরেন। অবশ‍্য এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, হরিজনদের সংরক্ষণ নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে ডঃ আম্বেদকারের তীব্র মতবিরোধ ছিল। ডঃ আম্বেদকার সংরক্ষণের পক্ষে এবং গান্ধীজী তার বিপক্ষে মত পোষন করতেন। যাক, সে ভিন্ন কথা। আমরা ঐ সময়ের অন‍্য ল গ্র‍্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে, যেমন জওহরলাল নেহেরু, মহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী বা হুসেইন সুরাবর্দীদের ক্ষেত্রে কিন্তু বার-এট-ল এর ডিগ্রীতে এমন ধোঁয়াশা দেখা যায় না।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে গান্ধীজীর বার-এট-ল হিসেবে শিক্ষাগত যোগ‍্যতায় একটা ধোঁয়াশা আছে। এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে উনি এই ডিগ্রী অর্জন করেননি। প্রামান‍্য নথি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও গান্ধীজীর আত্মজীবনী – এই সবগুলিই একসঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধোঁয়াশা দেখা যায়। একজন ভারতবাসী এবং গান্ধীজীর গুণগ্রাহী মানুষ হিসেবে এই প্রার্থনাই করি যে আরো তথ‍্য দিয়ে এই ধোঁয়াশা দুর করা উচিত। কারন, আমাদের জাতির জনকের স্থান সমস্ত রকম সমালোচনার ঊর্ধে। বোম্বে হাইকোর্টে গান্ধীজীর আবেদন অনুযায়ী যদি ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের থেকে তাঁর বার-এট-ল পরীক্ষায় বসার এবং গ্রেড লাভের নথি পাওয়া যায়, তাহলে সব বিতর্কের ও ধোঁয়াশার অবসান হতে পারে। সরকারের তরফে এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও নথি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশের অপেক্ষায় রইলাম।

ভারতের বিভেদের রাজনীতির মূল কোথায়

আজকাল আমরা সেজেগুজে থাকা ‘সাজানো’ বিদ্বান মানুষদের কাছে প্রায়শঃই একটি কথা শুনি – দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ দল ‘বিভেদের রাজনীতি করছে! এই ‘বিভেদ’এর রাজনীতি কি এবং কিভাবে দেশে বিভেদের রাজনীতি এল, কখন শুরু হল, তার বিশদ ব‍্যখ‍্যার প্রয়োজন আছে।
এখানে গত একশ বছরে দেশের ঐতিহাসিক চরিত্র, স্বাধীনতার পটভূমি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দেশের সংবিধাধ ও তার বেআইনিভাবে সংশোধন উল্লেখে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যে সাংবাদিকসুলভ আষাঢ়ে গল্পের সঙ্গে উদ্দেশ‍্যমূলক প্রচারের রাস্তায় হাঁটা হয়নি।
যখন স্বাধীনতার আন্দোলন ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক কলেজ ড্রপ-আউট ইনফরমাল ল-ইয়ার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন দিশা দিলেন। কিভাবে? ১৯২০ সালে, যখন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ব্রিটিশরাজে বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হচ্ছে, তখন তিনি এমন একটি পদক্ষেপ করলেন যে তার সুদুরপ্রসারী ফলাফল দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিপন্থী হল। এই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী পরবর্তীতে জাতির জনক হিসেবে চিহ্নিত হন। গান্ধীজী কংগ্রেস পার্টির স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে দেশের মুসলমান সমাজকে জুড়ে দিয়ে সকলের অবিসম্বাদী নেতা হতে চেয়েছিলেন। তার জন‍্য পুরোপুরি মুসলমানদের একটি ধর্মীয় আন্দোলনকে তিনি হিন্দু অধ‍ু‍্যষিত কংগ্রেস পার্টি তথা দেশের তাবৎ হিন্দুদের হয়ে সমর্থন করেন। আন্দোলনটি হচ্ছে খিলিফৎ আন্দোলন। তুরষ্কে খলিফার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করার ইসলামী প্রয়াস। তিনি মুসলিম ভ্রাতৃদ্বয় সৌকত আলী ও মহম্মদ আলী এবং আবুল কালাম আজাদের মত মুসলিম নেতাদের তাঁর প্রবর্তিত ‘অসহযোগ’ আন্দোলন সমর্থন করার শর্তে খিলাফত আন্দোলনকে হিন্দুদের সমর্থন করার ডাক দেন। খিলাফত একটি ধর্মীয় আন্দোলন। এই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের জন‍্য একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর আন্দোলনকে আমজনতার সমর্থন করার যুক্তি দিয়ে তিনি ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন। এর মাসুল এখনো এই উপমহাদেশের আপামর জনসাধারন দিয়ে যাচ্ছেন। ঐ সময় গান্ধীজীকে মানুষ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে বারবার একগুঁয়েমীর প্রমাণ রেখেছেন। নিজের মতামতকেই একমাত্র গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলন সারা ভারতে কৌতুহলের সৃষ্টি করলেও তা যে বৃটিশরাজকে খুব অসুবিধায় ফেলে স্বাধীনতা পেতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। আর চরকা কেটে প্রতীকী প্রতিবাদ করা যায় – কার্যকরী প্রতিবাদ নয়। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির কারণগুলি আলাদা।
গান্ধীজীর এই ঐতিহাসিক ভুলের মাশুল আমরা কিভাবে দিচ্ছি? প্রথমতঃ খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে দেশের সংখ‍্যাগরিষ্ট হিন্দু জনগণের কোনভাবেই কোন যোগসূত্র থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র গান্ধীজীর বৃহত্তর নেতা হওয়ার ইগো পরিতৃপ্তির জন‍্য মুসলিম নেতাগোষ্ঠীর ধর্মীয় আন্দোলনকে হিন্দুদের সমর্থন করা তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি হাস‍্যকর সিদ্ধান্ত। অতঃপর খিলাফত আন্দোলন তেমন গতি পেল না। ওদিকে এর পীঠস্থান তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক অটোমান সাম্রাজ‍্যের অবসানের পর খলিফার শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগও ১৯২৪ সালে শেষ করে দিলেন। এদিকে গান্ধীজীকে মুসলমান নেতারা ব‍্যবহার করেছিলেন, নিজেরা ব‍্যবহৃত হননি। হুসেইন সুরাবর্দী, মহম্মদ আলী জিন্নার মত নেতারা দেখলেন যে আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে নিতে হলে মুসলমান সমাজের নেতা হতে হবে। তখন মুসলমানদের তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করার কাজ শুরু হল। এর প্রথম পর্বে যে মোপালা বিদ্রোহ শুরু হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন আলী মুসলীয়ার, কুঞ্জ আহমেদ হাজী ইত‍্যাদি, তাতে লর্ড কার্জনের বৃটিশ পার্লামেন্টে উল্লিখিত তথ‍্য থেকে জানা যায় যে অন্ততঃ ২৫০০ জন মোপালা বিদ্রোহী মারা গেছিল এবং দশ হাজার হিন্দু নাগরিকদের বিদ্রোহীরা হত‍্যা করে শুধুমাত্র মুসলমান না হওয়ার অপরাধে। অন্ততঃ এক হাজার হিন্দুকে বলপূর্বক ইমসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়, অজস্র হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হন ও হিন্দুদের ধনসম্পত্তি লুঠ করা হয়। মালাবারের ইয়ারানাদ, ভাল্লুবাঁধ এই দুটি তালুকের একটি হিন্দু বাড়িও অক্ষত ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ কিভাবে হিন্দুনিধনে পর্যবসিত হল সেকথা লুকানোর জন‍্য কমু‍্যনিষ্ট প্রভাবিত ইতিহাসে এই হত‍্যাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তখনো গান্ধীজী মোপালা বিদ্রোহকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে হিন্দু জনগণের উপর মুসলমান বিদ্রোহীদের অত‍্যাচারকে গুরুত্বহীন করতে চেষ্টা করেন। এই সময় বেশ কিছু কংগ্রেসের নেতা মোপালা বিদ্রোহকে সমর্থনের বিপক্ষে মত দেন। তখন গান্ধীজী জনসমর্থন হারানোর ভয়ে পিছিয়ে যান। গান্ধীজী সাময়িকভাবে পিছু হটেন। কিন্তু তিনি ভারতের হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নেতা হওয়ার নেশায় ভারতকে এক দ্বিজাতিতত্ত্বের দোরগোড়ায় এনে দিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, অল্প শিক্ষিত গান্ধীজীর তুলনায় (উনি ম‍্যাট্রিক পাশ করার পর ভাবনগরের কলেজ ড্রপ আউট, পরবর্তীতে উনি ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১ অব্দি informal auditing ছাত্র হিসেবে ছিলেন। যদিও ব‍্যরিস্টার হিসেবে তিনি মুম্বাই হাইকোর্টে রেজিস্টার্ড ছিলেন, লপাশ করার কোন formal ডিগ্রি ওনার ছিলনা) তখনকার শিক্ষিত, ব‍্যরিস্টার মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক দুরদর্শিতা অনেক বেশী ছিল। শুধু তাই নয়, গান্ধীজীর নিজের নীতি – তা যতই অবাস্তব হোক, সেটাই অনুসরণ করার একগুঁয়েমীর মূল‍্য ভারতবাসীকে দিতে হয়েছে। মোপলা বিদ্রোহ ও তার দমনের সয়ই বোঝা গিয়েছিল মুসলিম নেতাদের প্রভূত্ব করার উদগ্র কামনা এবং হিন্দুদের প্রতি অসহনশীলতা, আর তা সফল করার সোজা উপায় ছিলহিন্দুদের হত‍্যা, ধর্ষন ও তাদের সম্পত্তি দখল অথবা তাদের ধর্মান্তরকরণ। মনে রাখতে হবে, আধুনিক ভারতে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কের সুচনা হয় এই মোপালা বিদ‍্রোহের সময়ই। এর দায় গান্ধীজী এড়াতে পারেন না। পরবর্তীকালে ১৯৪৬-৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় আরো প্রকটভাবে গান্ধীজী হিন্দুনিধন আটকানোর জন‍্য কোন কার্যকরী ভূমিকা নেননি। এমনকি মুসলিম নেতাদের দ্বারা গ্রেট ক‍্যলকাটা কিলিং এর সময় তিনি হিন্দুদের উপর অত‍্যাচারের সময় কোন বাধা দেননি। পক্ষান্তরে, যখন হিন্দুরা প্রতিরোধ শুরু করে তখন তিনি নিজে ছুটে এসে শান্তির বাণী ছড়ালেন। একই রকমভাবে নোয়াখালীর হিন্দুনিধনের সময় তিনি হিন্দুদের বাঁচানোর কোন চেষ্টা করেননি। সুতরাং একথা আজ মানতে হবে, প্রথমদিকে ভারতের সংখ‍্যাগরিষ্ট মুসলিমরা মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে না নিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বিশেষতঃ গান্ধীজীর একাধিক ভুল পদক্ষেপ ক্রমশঃ জিন্না, সুরাবর্দী, সৌকত আলীদের মুসলিম জনগণের মধ‍্যে গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
আমাদের একটি বদ্ধমূল ধারনা দেওয়া হয়েছে যে গান্ধীজী সব রকম অস্পৃশ‍্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার কোর্টে সওয়াল করতে গিয়ে তাঁর বক্তব‍্য পাওয়া যায়, “We are fellow members of the Empire. You should not be discriminating against us. We are not like these black people. We are better than they are. We are different from them. And you should not treat us like them.” অর্থাৎ তাঁর বক্তব‍্য ছিল, আমরা ভারতীয়রা বৃটিশদের মতই মহান সাম্রাজ‍্যের প্রজা। সুতরাং ব্রিটিশ সাদা চামড়ার মানুষদের মতই আমাদের ব‍্যবহার পাওয়া উচিৎ। কিন্তু কালো চামড়ার মানুষরা নিকৃষ্ট। তাদের থেকে ভারতীয়রা উৎকৃষ্ট। সুতরাং তারা বৃটিশদের সমান। তবে তিনি যে কালো মানুষদের নিকৃষ্ট মনে করতেন তা তাঁর বক্তব‍্যে পরিষ্কার।
গান্ধীজী সর্বদা হিন্দুদের মধ‍্যে বিভিন্ন socio-economic বিভেদ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। অহিংস উপায়ে হিংসার মোকাবিলা করার মত অবাস্তব পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ‍্যে বিভিন্ন sect এর বিভেদ নিয়ে হয় তাঁর কোন ধারনা ছিলনা, নাহয়, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের নেতা হিসেবে থাকার বাসনায় সর্বদা মুসলমানদের একটা ইউনিট হিসেবে দেখেছেন। সেটা মুসলমানদের মধ‍্যে communal feeling তৈরীতে প্রভূত সাহায‍্য করেছে। জিন্না যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে তিন টুকরো করে তার দুটুকরো মুসলমানদের দেওয়ার যুক্তি দিলেন, তখন গান্ধীজী মৌখিকভাবে তার বিরোধীতা করলেও ‘ডাইরেক্ট অ‍্যকশান’ এর নামে হিন্দু নিধন থামানোর চেষ্টা করেননি। ফলে, দেশভাগ হল। স্বাধীনতা এলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ ) দুটিই ইসলামিক রাষ্ট্র হল, ভারত হিন্দুদের বাসভূমি হিসাবে রইল। তখন বিশেষতঃ গান্ধীজীর প্রভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতকে সকল ধর্মের মানুষের বাসস্থান হিসেবে ঘোষণা করল! ফলে ভারতীয় মুসলমানদের homeland হলেও ভারতীয় হিন্দুদের কোন homeland হলনা। ভারতের সংবিধানে সকল নাগরিকের ধর্মপালনের সমান অধিকার স্বীকৃত হল। মৌলিক অধিকার ২৫,২৬ এবং সরকারের কর্তব‍্য ২৯,৩০ ধারায় সংবিধানে লিপিবদ্ধ হল।
তারপর কাবেরী, গঙ্গা, যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়ালো। কংগ্রেসের, বিশেষভাবে নেহেরুর soft peddaling এর কারনে কাশ্মীরের একটা বড় অংশ পাকিস্তানের কবলে চলে গেল।১৯৬২ সালে চীনের আগ্রাসনের কাছে ভারত পর্য‍্যুদস্ত হল। গান্ধীজীর অহিংস নীতি তাঁর যোগ‍্য শিষ‍্য জওহরলাল নেহেরু পালন করতে গিয়ে দেশের বিদেশনীতিকে যার পর নাই পর্যু‍্যদস্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে পরপারে চলে গেলেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অল্প সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করার সুযোগ ছিল না। তারপর জওহরলাল নেহেরুর উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্বে আসীন হলেন তাঁর কণ‍্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি কংগ্রেসের মধ‍্যে সোশ‍্যালিষ্ট লবির সাহায‍্য নিয়ে বয়ষ্ক ও প্রাচীনপন্থী নেতাদের তাড়ালেন। একাজে তাঁকে প্রত‍্যক্ষ ও অপ্রত‍্যক্ষভাবে যথেষ্ট মদত দিলেন দেশীয় কমু‍্যনিষ্ট ও সোভিয়েত রাশিয়া। ইন্দিরা গান্ধীর একমাত্র ধ‍্যান জ্ঞান ছিল কি করে রাজনৈতিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা যায়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর সম্মুখীন হলেন, দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে কার্যকরীভাবে একনায়কতন্ত্রী ব‍্যবস্থায় দেশকে নিয়ে গেলেন। সেই সময় তিনি পার্লামেন্টকে avoid করে ভারতের সংবিধানের এমন দুটি সংশোধন করলেন যা ভারতের অস্তিত্বের ভিত্তিই নাড়িয়ে দিল। এতে একাধারে সংফিধানের মৌলিক ধারাগুলির বিরোধীতাই করা হল তাই শুধু নয়, সংবিধানের বিভিন্ন ধারার মধ‍্যে স্ববিরোধীতার সুচনা হল! তিনি ভারতকে “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “প্রজাতান্ত্রিক” রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেন। যেহেতু তখন পার্লামেন্ট বন্ধ করে রেখেছিলেন, পার্লামেন্টে আলোচনা সাপেক্ষে এই সংশোধন হয়নি। কিন্তু তারপর যে সকল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার এসেছে তারা কেন এই সংশোধনী দুটি বাতিল করল না; অন্ততঃ সংশোধন করল না তা বোঝা গেল না। আসলে এই “বেআইনী” সংশোধনের উদ্দেশ‍্য অনেক গভীরে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ ব‍্যখ‍্যার ব‍্যপারটা তাঁর সোশালিষ্ট ও কমু‍্যনিষ্ট বন্ধুদের হাতে ছেড়ে দিলেন।
এই প্রসঙ্গে বহুচর্চিত একটা জিনিস ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাইবেল এবং কোরান দুটি ধর্মগ্রন্থেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষদের ধর্মচ‍্যুত মানুষ হিসেবে দেখা হয়। এদের স্থান বিধর্মীদের চেয়েও নীচে। সেজন‍্য কোন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বা মুসলমান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হয় না। যেজন‍্য কোন দেশে মুসলমান সংখ‍্যাধিক‍্যের কারনে যখন সেই দেশ ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়, পথমেই ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী কম‍ু‍্যনিষ্টদের তারা বিনাশ করে। যাক সে কথা। এই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার টার্গেট করা হল হিন্দুদের। এখানে একটা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে যে, ভারতের প্রথম কমু‍্যনিষ্ট পার্টি গঠনের দিন থেকে তারা দুটি বিষয়ে কখনো বিচু‍্যত হয়নি। পথম, ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা; দ্বিতীয়, জেহাদী ইসলামকে প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে তোল্লা দেওয়া। এর হাজার উদাহরণ আছে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধী যখন “ধর্মনিরপেক্ষতা” দেশের মানুষদের গেলানোর দায়িত্ব তাঁর সোশ‍্যালিষ্ট ও কমু‍্যনিষ্ট বন্ধুদের দিলেন, তখন থেকেই ভারতীয় কমু‍্যনিষ্টদের সৃষ্ট “ধর্মনিরপেক্ষতা” প্রচারের আলোতে এলো। এর যে রূপ আমরা দেখলাম তাতে নিশ্চিতরূপে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্খিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রেখে manipulative democracy শুরু হল। এখন তার কদর্যতম রূপ আমরা প্রত‍্যক্ষ করছি। যাক, ফিরে আসি ধর্মনিরপেক্ষতায়। যেহেতু মুসলিম ও খৃষ্টানদের ধর্ম বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ঐ দুই ধর্মকে, বিশেষতঃ ইসলাম ধর্মকে সরকারী স্তরে তোল্লা দিয়ে শুরু হল সরাসরি হিন্দু ধর্মের বিরোধীতা। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে হিন্দুদের মস্তিষ্ক প্রক্ষালন বিশেষ ব‍্যপকভাবে শুরু হল। এই কাজ, সঙ্গে দেশের প্রাচীন ইতিহাস চর্চা বন্ধ করে মুসলিম আক্রমনকারী শাসকদের মহত্ব ও দেশ গঠনে তাদের অবদান নতুন করে কমু‍্যনিষ্ট প্রভাবিত ইতিহাস বই রচনায় জায়গা করে নিল। এর একটি চরম নির্লজ্জ উদাহরন হল মোপলা বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে সিপিআইএমএর নিকৃষ্ট মিথ‍্যায় ভরা ‘দলিল’। এখানে হিন্দু নিধনকারী জেহাদীদের দেশপ্রেমিক দেখিয়ে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে যে গণহ‍্যা সংঘটিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে একটি কথাও খরচ করা হল না! সেইশুরু। তারপর, কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিত, যারা ট্র‍্যডিশানালি কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, তাদের হত‍্যা, ধর্ষণ, ধনসম্পত্তি লুঠ করে কাশ্মীরকে মুসলমান সংখ‍্যাগরিষ্ট জেহাদী স্বর্গরাজ‍্যে পরিণত করা হল।
তারপর ধীরে ধীরে যখন হিন্দুরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল তখন হিন্দুদের মধ‍্যে দলিত, পিছড়ে বর্গ, অতি পিছড়েবর্গ – এই সব শ্রেণী বিন‍্যাসে হিন্দু একীকরণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হল।তার সাথে দেশে সরকারী সহায়তায় ও অর্থানুকুল‍্যে মসলমানদের উন্নয়নের নামে ইসলামিক কনসোলিডেশান শুরু হল। মদত দিল চীন ও পাকিস্তান। তাদের ব‍্যপারে মৌণব্রত অবলম্বন করে নিজেদের ঘৃণ‍্য কাজ চালিয়ে যেতে লাগল কংগ্রেস ও কমু‍্যনিষ্টরা। তারপর ধীরে ধীরে মার খেতে খেতে হিন্দু একীকরণ শুরু করার কাজ যে সংগঠণগুলি শুরু করল তাদের উপর সরকারী, জেহাদী ও কমু‍্যনিষ্টদের আক্রমণ নেমে এলো। তা সত্বেও আজ হিন্দু কনসোলিডেশান প্রাধান‍্য পাচ্ছে। যত আক্রমণ নেমে আসছে, হিন্দুদের জোটবদ্ধ হওয়া তত গতি পাচ্ছে।
পরিশেষে একটি কথা বলার আছে। যে মূহুর্তে ভারত আবার টুকরো করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে তখন কয়েকটি নতুন জেহাদী রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যেখানে কংগ্রেস ও কমু‍্যনিষ্ট কোন দলেরই অস্তিত্ব থাকবে না। সুতরাং দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে ১৯৭৬ সালে কালো দিনের সাহায‍্য নিয়ে সংবিধানে যে দুটি পরিবর্তন করা হয়েছিল তা বাতিল করা আশু প্রয়োজন। রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া কোন রাষ্ট্র থাকেনা। সুতরাং ভারতের রাষ্ট্রধর্ম হোক হিন্দুত্ব যা সকল religion কে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কোন ‘ইসলামিক সেকুলারিজম’ ভারতের টুকরো টুকরো হওয়াকে আটকাতে পারবে না।