কেনিয়ার জঙ্গলে

চরৈবেতি। আবার সুটকেস গুছিয়ে, আধুনিক নাম লাগেজ গুছিয়, বেড়িয়ে পড়লাম আফ্রিকার জঙ্গল দেখতে। কলকাতা থেকে দিল্লীতে প্লেন পাল্টে সোজা নাইরোবি। এয়ার ইন্ডিয়ার ভালো সার্ভিস। সেখানে ইমিগ্রেশান সেরে বাইরে আসার মুখে দেখলাম Karibu Kenya (কেনিয়ায় স্বাগত)। বাইরে আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সোজা হোটেলে পৌঁছলাম রাত আটটা নাগাদ। উল্লেখ‍্য, কেনিয়ার সময় আমাদের থেকে আড়াই ঘন্টা পেছনে। হোটেলে ঘর মিলল সাততলায় – Sarova Panafric। এখানে ডিনারের পর সারা দিনের ধকলের পর দুগ্ধফেননিভ শয‍্যায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা বুঝিনি! পরদিন সকালে wake-up call এ ঘুম ভাঙ্গল। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ব্রেকফাস্টে ডিইনিং হলে পৌঁছলাম। প্রায় পঞ্চাশ রকম আইটেম। টোস্ট, বাটার আর ডিম দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে দু কাপ বিখ‍্যাত কেনিয়ান কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের জন‍্য বরাদ্দ গাড়ি ৪×৪ টয়োটা ল‍্যান্ড ক্রুজার। এই গাড়ির দু দিকে তিনজন করে ছজন বসতে পারে। প্রত‍্যেকের পাশে জানালা আছে। এছাড়া যখন জঙ্গল সফারিতে (এরা বলে গেম ড্রাইভ) যাওয়া হয়, তখন গাড়ির উপরের হুডটা যান্ত্রিকভাবে খানিক উঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, গাড়ির সব সওয়ারি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে চারপাশ দেখতে পারে। এখানে উল্লেখ‍্য যে, গেম ড্রাইভের জন‍্য কয়েকটি নির্দিষ্ট সংস্থা আছে। এরা প্রত‍্যেকেই রেজিস্টার্ড। এদের থেকেই সবাইকে গাড়ি নিতে হবে। এরা জঙ্গলে গেলে প্রত‍্যেক ড্রাইভার কাম গাইডের মধ‍্যে জন্তু-জানোয়ারের অবস্থান নিয়ে ওয়াকিটকিতে খবর আদান-প্রদান হতে থাকে। যার জন‍্য গেম ড্রাইভে এক যায়গায় দ্রষ্টব‍্য কিছু দেখলে সব গাড়ি সেখানে চলে যায়। এদের শৃঙ্খলাপরায়ণতা প্রশংসনীয়। একজনের দেখা হলে সে সরে গিয়ে পেছনের গাড়িকে জায়গা করে দেয়। আমাদের দেশের ড্রাইভারদের এটা শিক্ষনীয়।
           সকালে নাইরোবি থেকে রওনা দিয়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা বাদে Amboseli পৌঁছে AA Amoseli লজে পৌঁছলাম। মালপত্র রেখে লাঞ্চে গেলাম। গরু আর শুয়োরের মাংস ছাড়া কিছু শাক পাতা আর মোটা চালের ভাত। কোনরকমে খিদে মেটানোর জন‍্য ঐ শাকপাতা আর ভাত খেলাম! তারপর Amboseli ন‍্যাশনাল পার্কে তিন ঘন্টার জন‍্য গেম ড্রাইভে বেরোলাম। আগে থেকে বুকিং না থাকায় আমাদের গেটের সামনে প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। তার পর পার্কে ঢুকতে পারলাম। জঙ্গলের মধ‍্যে সব কাঁচা রাস্তা, গাড়িতে ঝাকুনি খেতে খেতে এগোলাম। মাঝে মধ‍্যে আমাদের ড্রাইভার-কাম-গাইড মরিস বলতে লাগল কোথায় কি দেখা যাচ্ছে! তারা সর্বদা গেম ড্রাইভে আসা অন‍্য ড্রাইভারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে। প্রথমে ঘাড়ে এবং পিঠে কালো চুল ওয়ালা গরুর মত দেখতে একদল প্রাণীকে দেখলাম। মরিস জানালো এরা ওয়াইল্ডি বিস্ট! এরা অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। সিংহ, চিতা বিশেষ ভাবে এদেরকেই শিকার করে। এরা তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে না। জিরাফ আর জেব্রা এদের থেকে যেমন দ্রুত দৌড়াতে পারে, তেমনি তারা অনেক বেশি সতর্ক। এছাড়া একপাল হাতি দেখলাম – আফ্রিকার বিশাল চেহারার লম্বা দাঁতওয়ালা হাতি। এরা যুথবদ্ধভাবে ছিল। আমাদের গাড়িকে দাঁড় করিয়ে এরা রাস্তা পার হল (ছবি নম্বর ১)। খানিক এগিয়ে একদল জিরাফের দেখা পেলাম। তারা শুকনো ঘাস খাচ্ছিল। মরিসের কাছ থেকে শুনলাম, ওদের জীভ খুব শক্ত হওয়ায় ওরা শুকনো ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে। ওরা প্রচন্ড গরমে রোদে থেকেও খুব সতেজ। তার কারন ওদের গায়ের সাদা কালো ডোরা! কালো যেমন সূর্যের আলো শোষণ করে তেমনি সাদা রং আলো প্রতিফলিত করে। তারপর দেখলাম তিনটি জেব্রা। দুটি পূর্ণ বয়স্ক আর একটি ছোট। মনে হল একটি পরিবার। সবচেয়ে কাছের বড় জেব্রাটি আমাদের গাড়িকে খানিকক্ষণ দেখে তারপর মনে হল আমাদের দেখানোর জন‍্য সে ক‍্যাট ওয়াক করতে করতে দুরে চলে গেল। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। সাধারণ মানের ডিনারের পর বিশ্রাম ও ঘুম। পরদিন সকাল ছটায় রেডি হয়ে টোস্ট, ওমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্টের পর লাগেজ গুছিয়ে সোজা গাড়িতে। ঠিক আটটায় গাড়ি ছাড়ল। আমরা ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে Ambosoliর Sentrim Camp এ পৌঁছলাম। এদের ব‍্যবস্থা অনেক উন্নত। ক্লোক রুমে মালপত্তর রেখে গাড়িতে উঠে চললাম সারা দিনের Amboseli গেম রাইডে। এবার মরিস আগে থেকে আমাদের সকাল দশটার মধ‍্যে এন্ট্রি পারমিট করিয়ে রাখায় আমরা সময়ের পনেরো মিনিট আগেই জঙ্গলে ঢুকলাম।
               প্রথমে চোখে পড়ল বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ।গাঢ় বাদামী চামড়ার হরিণকে বলে এ‍্যান্টিলোপ টোপী। এরপর এগিয়ে গিয়ে আগের দিনের থেকে বেশি সংখ‍্যায় হাতির পাল, জিরাফ, জেব্রা দেখলাম। আর ছিল অজস্র ওয়াল্ডি বিস্ট। হটাৎ একসময় মরিস ফোনে কথা বলার পর গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত অন‍্য রাস্তায় নিয়ে এল! তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দূরে দেখালো একটি পূর্ণ বয়ষ্ক সিংহি। প্রথমে সে শুয়ে ছিল। গাছের ছায়া পেয়ে গরমে ক্লান্ত সিংহি বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারপর বসল, শেষে এত গাড়ি দেখে বোধহয় বিরক্ত হয়ে আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভিতরে অনেকটা দূরে চলে গেল! তারপর নির্দিষ্ট এক জায়গায় এসে আমরা অর্থাৎ সব গাড়ির আরোহীরা আমাদের সঙ্গে আনা লাঞ্চ প‍্যাকেট খুলে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর ফেরার পালা। বিকেলে হোটেলে ফিরে নিজেদের নির্দিষ্ট তাঁবুতে গেলাম। খানিকক্ষণ বাদে আমাদের মালপত্র ক্লোক রুম থেকে এসে পৌঁছলো। আমাদের দলের মধ‍্যে আমাদের তাঁবুটাই সবচেয়ে দূরে। একদম জঙ্গলের পাশে। তাঁবু পেছনের দরজা খুলে দেখলাম দুটো চেয়ার আর ছোট একটা টেবিল আছে। তাঁবু শুধু নামেই। সুন্দর পরিপাটি খাট-বিছানা, সব আধুনিক ব‍্যবস্থা সহ টয়লেট, লাগেজ রাখার জায়গা, গরম জলের ইলেক্ট্রিক কেটলি ও চা, কফি, চিনি এবং সুগার ফ্রি সব সাজানো। চেন টেনে নেট দেওয়া জানালা খোলা-বন্ধ করা যায়! আমি দু কাপ কফি (কেনিয়ার বিখ‍্যাত কিলিমাঞ্জারো রোষ্টেড কফি) নিয়ে পেছনের বারান্দায় বসলাম। কিছু দূরে দুটি হরিণ আপন মনে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিল। সন্ধে হতে ভিতরে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দিলাম। এই অঞ্চলে ডিনার টাইম সন্ধে সাতটা থেকে রাত নটা। আমরা বাড়িতে রাত দশটায় খাই। যেহেতু কেনিয়া আমাদের থেকে আড়াই ঘন্টা পেছনে, এই ডিনারের সময়টা আমাদের খুব স‍্যুট করেছিল। রাতে ডিনারে মাছের ফ্রাই আর ডিম ছাড়া আমাদের খাবার বলতে সাদা ভাত ও রুটি। অনেক আইটেম ছিল বিফ, পর্কের। তবে, কেনিয়ার কোথাও খাবারের সঙ্গে জল দেয় না! আলাদা করে দু-তিন ডলার দিলে ৫০০ ml এর ছোট বোতল দেয়।সব হোটেলে প্রতিদিন এক লিটার করে জল দিত আর গেম ড্রাইভে জল ত ফ্রি। এছাড়া আমি কেনিয়া সফরের জন‍্য আলাদা করে এক বাক্স (৫০০ml এর ২৪ বোতল জল একটি মল থেকে দরদাম করে ৬ ডলারে কিনেছিলাম। তাতেই আমাদের খাবার জল নিয়ে কোন অসুবিধা হয়নি। কেনিয়া ভ্রমণে এ ব‍্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
            পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম লেক এলিমেন্টাইটার কোলে Sentrim Elementaita Camp এর উদ্দেশ‍্যে।লেকের কোল ঘেঁসে আমাদের ছোট ছোট বাংলোর আদলে লাক্সারি  তাঁবু। আমরা লাঞ্চ সেরে লেকের কোল ঘেঁষে আমাদের ডবল বেড বাংলোর উঠোনে চেয়ারে বসে লেকের উপর প্রচুর পাখির সমাবেশ দেখলাম! বেশিরভাগ পাখিই সাদা রংয়ের। এরা আবার উড়তে উড়তে ছোঁ মেরে অত‍্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে লেকের জলের উপরিভাগে থাকা মাছ শিকার করছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের বনফায়ারের আয়োজন ছিল। তিন-চার রকমের হুইস্বি, ভদকা ছাড়াও রাম ছিল। ও রসে বঞ্চিত আমি গ্লাস তিনেক ভার্জিন মোজিটো ও এক গ্লাস ব্লু লেগুনের সঙ্গে যথেষ্ট কাজু, পেস্তার সদ্ব‍্যবহার করলাম!
            পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর মাসাইমারার দিকে রওনা দিলাম। পথে এ অঞ্চলের একমাত্র মিষ্টি জলের লেক Naivasaয় এক ঘন্টার বোট রাইডের সময় বহু রকমের পাখি দেখলাম। আর দেখলাম জলের মধ‍্যে দেহ ডুবিয়ে শুধু মাথা আর পিঠের উপরিভাগটুকু দেখা যাচ্ছে এমন অনেক জলহস্তি! আমাদের স্থানীয় গাইড বলল, এরা নাকি দিনের বেলা এভাবে ডুবে থেকে খাবার হজম করে! পরে মাসাই নদীতে এমন অনেক দৃশ‍্য দেখেছি।
             আমরা মাসাইমারার Mara Sentrim Camp এর নির্দিষ্ট কটেজে উঠলাম। এদের নাম ও দাম অনুযায়ী ব‍্যবস্থাপনা কিন্তু মোটেই আশানুরূপ নয়। এদের বাথরুমের গরম-ঠান্ডা জলের মিশ্রণ ঠিকমত কাজ করে না। বিছানা দুজনের পক্ষে শুধু ছোটই নয়, বিছানার ম‍্যাট্রেস মোটেই আরামদায়ক নয়। এখানে পোকার উপদ্রব যথেষ্ট। যাক সে কথা। আমরা পৌঁছে জিনিষপত্র রেখে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করেই মাসাইয়ের জঙ্গলে ঢুকলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড মরিস জানালো আজ যেদিকে যাচ্ছি, কাল সে দিকে যাব না! তবে, জানা গেল দি গ্রেট মাইগ্রেশান নাকি আগের সপ্তাহে হয়ে গেছে! এই সময় তাঞ্জানিয়ার জঙ্গল থেকে জন্তু জানোয়াররা দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে কেনিয়ার জঙ্গলে আসে। একই জঙ্গল – কেনিয়ায় নাম মাসাইমারা আর তাঞ্জানিয়ায় নাম সেরেঙ্গেটি। অবশ‍্য সেরেঙ্গেটির জঙ্গল মাসাইমারার থেকে কয়েকগুণ বড়। জঙ্গলের মাঝে বয়ে চলেছে মাসাই নদী।
            ঘন্টা দুয়েকের জঙ্গল সফারিতে দেখলাম অসংখ‍্য জেব্রা, দশ বারো প্রজাতির হরিণ, ওয়াল্ডি বিস্ট এবং হাতির পাল (ছবি নং ১)। আর দেখলাম জিরাফের পরিবার! জিরাফের cat walk দেখার মত। আমরা ভিডিও তুলে রাখলাম।
                পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমরা প‍্যাকড লাঞ্চ নিয়ে সকাল সকাল মাসাই ড্রাইভে জঙ্গলে ঢুকলাম। এদিনও প্রচুর জেব্রা, আর হরিণ, ওয়াইল্ডি বিস্ট দেখলাম। একটি সিংহ বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ায়ে ছিল। তারপর আস্তে আস্তে খানিকটা কাছে, ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু দূরে  সাত-আটটা জেব্রা একদম চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে পড়তে সিংহটা সরাসরি তাদের দিকে তাকালো। আবার কয়েকটি জিরাফ খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে লক্ষ‍্য করতে লাগল! আমরা রুদ্ধশ্বাসে ক‍্যামেরা রেডি রাখলাম ‘কিল’ দেখার উত্তেজনা নিয়ে। কিন্তু প্রায় মিনিট দশেক এভাবে কাটার পর সিংহটা ওখানে প্রথমে বসল, তারপর শুয়ে পড়ল। বোঝা গেল পশুরাজের পেট ভর্তি। তখন জেব্রা আর জিরাফরা নাজেদের গন্তব‍্যে এগোল। বিকেল নাগাদ আমরা জঙ্গলের একদিকে মাসাইদের গ্রামে গেলাম তাদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে। সে এক ভিন্ন গল্প। আমরা মাসাইমারার জঙ্গলের একদম শেষ প্রান্তে তাঞ্জানিয়ার সঙ্গে জঙ্গলের শেষ সীমায় পৌঁছে ছবি তুললাম (ছবি নং ২)। তারপর ক‍্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম।

ডঃ নারায়ণ চক্রবর্তী

জলই জীবন

            পৃথিবীর সব ভাষাতেই বলা হয় – “জলই জীবন”। প্রবহমান প্রাণের স্পন্দনের অন‍্যতম শর্ত হল – জল। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষ জানে না যে, পৃথিবীর সমগ্র জলের পরিমাণের মাত্র ২.৭% জল পানীয়! গত ৪০-৫০ বছর ধরে জলের অপচয় বিষয়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরন করা হচ্ছে! ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন UNICEF এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে জল-বিশেষজ্ঞ হিসেবে গিয়েছি, সেখানেও জল সংরক্ষণের ব‍িষয়ে জোর দেওয়া হত। কিন্তু মানুষের লোভ এবং স্বাচ্ছন্দের জন‍্য উন্মত্ততা বর্তমান প্রজন্মকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে!
               গত ১৪ই এপ্রিল, ২০২৩ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী শহর কেপটিউনকে পৃথিবীর প্রথম রাজধানী শহর হিসেবে খরা-প্রবণ বলে ঘোষণা করা হয়। এই সঙ্গে সেখানে প্রশাসন পানীয় জল সরবরাহ করতে অপারগ বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। বুঝুন অবস্থা! কেন্দ্রীয় সরকারের National Aquifer Mapping & Management Programme (NAQUIM) যে সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট পেশ করেছে সেটি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দুই চব্বিশ পরগণা ও হাওড়া জেলার পক্ষে ভয়াবহ। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে কলকাতায় ৭ থেকে ১০ মিটারের মধ‍্যে ভূগর্ভস্থ জল পাওয়া যেত। বর্তমানে তা ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৫ থেকে ১৬ মিটার নীচে নেমে গেছে! ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আলিপুর, বালিগঞ্জ, কালিঘাট ও  পার্কসার্কাস অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ১৪ থেকে ১৬ মিটারে নেমে গেছে!  বাঁশদ্রোণী, গড়িয়া অঞ্চলে, যেখানে আগে ভূগর্ভের ৫ – ৬ মিটারের মধ‍্যে জল পাওয়া যেত, সেখানে এখন ৮ থেকে ১১ মিটারে জল মিলছে! যেজন‍্য রাজ‍্য-সরকার ব‍্যক্তি মালিকানার বাড়িতে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ব‍্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু এখনো সরকারের তরফে কোন comprehensive  কার্যকরী প্ল‍্যান করতে দেখা যাচ্ছে না। যেমন, KMC নিজেই ২৬৪ টি ডিপ টিউবওয়েল এবং প্রায় ১০,০০০ শ‍্যালো টিউবওয়েল চালু রেখেছে, যার থেকে গড়পরতা ৪ হাজার লক্ষ লিটার জল তোলা হচ্ছে।   
            পশ্চিমবঙ্গের “চালের ভান্ড” বলে পরিচিত বর্ধমানে এই ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ার পরিমাণ সর্বাধিক! এই জেলায় উন্নয়নের নামে যেমন ব‍্যপকহারে নগরায়ণ হয়েছে, তেমনি পাম্প করে যথেচ্ছভাবে মাটির তলার জল তোলা হয়েছে, এমনকি সেচের কাজেও পাম্প করে প্রচুর জল তোলা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই জেলার এবং পার্শবর্তী বীরভূমের নদীগুলি গ্রীষ্মকালে প্রায় জলশূণ‍্য হয়ে পড়ছে! এভাবে চললে অদূর ভবিষ‍্যতে এই রাজ‍্যেও কেপটাউনের মত পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে!    
                   রাজ‍্যের ৩৪১ টি ব্লকের মধ‍্যে প্রায় ৮০% ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলস্তর বিপজ্জনকভাবে নামছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে রাজ‍্য বা কেন্দ্র, কোন সরকারই এখনো পর্যন্ত ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত নেয়নি। দ্রুত ও দীর্ঘ নগরায়নের প্রভাবে বৃহত্তর কলকাতায় ভূগর্ভের জলস্তর ৭ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে – এমনই ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় জানা যায়। আবার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ার কারনে বিভিন্ন নদী, জলাশয়ে গ্রীষ্মকালে জলস্তর অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা উচিৎ। দ্রুত নগরায়নে জলের চাহিদা বাড়ায় যেমন ভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি জলস্তর নেমে যাওয়ার কারনে জলে লবণাক্ততা সহ বিষাক্ত রাসায়নিক – যেমন আর্সেনিক, সীসা ইত‍্যাদির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, পেটের রোগ, চামড়ার রংয়ের পরিবর্তন  এমনকি শরীরের ঘা পযর্ন্ত হচ্ছে! যেহেতু এই বিষ জলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষের শরীরে ঢুকছে, এর পুঞ্জীকৃত বিষক্রিয়ায় মৃত‍্যু পযর্ন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু সংবাদ এখানে তুলে ধরছি – পাণীয় জলের সমস‍্যার প্রতিবাদে সিউড়িতে বিক্ষোভ ; প্রতি বাড়িতে কল থাকলেও নলে জল না আসায় দেবেনন্দপুরে রাস্তা অবরোধ; আর্সেনিকমুক্ত জল প্রকল্পের ৮০% মেশিন বিকল, চলছে অবৈধ কারবার; বিদ‍্যুৎ ও পানীয় জলের সমস‍্যায় সাগরদত্তে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ ; গরম পড়তেই উখড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে পানীয় জলের সংকট; পানীয় জলের দাবীতে সাহাপুরে বাসিন্দাদের অবরোধ; রতুয়ার শ্রীপুর ২ পঞ্চায়েতে পরিস্রুত পানীয় জলের সংকট; গরমের দাপট বাড়তেই তীব্র পানীয় জলের সংকট জয়নগরে ; কেতুগ্রামের সীতাহাটি পঞ্চায়েতে ছয়টি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার ভুগছে তীব্র জল সংকটে; দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লক্ষ্মীনারায়ণপুরে জল সংকট। বাড়ি বাড়ি কল থাকলেও নেই জল! ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী।
                 আরেকটি বড় ক্ষতি চাষাবাদের। সেখানে চাষের প্রয়োজনে শ‍্যালো পাম্পের ব‍্যবহার যত বেশী হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর ততো নীচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে বড় গাছের গোড়া শুষ্কতায় ভূগে দ্রুত মৃত‍্যুর দিকে ঢলে পড়ছে। বিশেষভাবে দুই চব্বিশ পরগনায় আম, লিচু এবং পেয়ারা চাষে এর প্রভাব লক্ষ‍্য করা গেছে। যত সময় যাচ্ছে, এই সমস‍্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
                 একথা সত‍্যি যে, সারা বিশ্বেই আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগরায়ণের চাহিদা বৃদ্ধির কারনে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ অ‍্যাকোয়াফার লেভেলকে রিচার্জ করার জন‍্য আমাদের দেশে বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক কারনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। এখন দ্রুত নগরায়ণের কারনে বড় গাছ কেটে ফেলার জন‍্য বৃষ্টিও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সেজন‍্য খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে সমস‍্যা আরো মারাত্নক হচ্ছে। বিশেষভাবে তামিলনাড়ুতে এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন‍্য rain water harvesting ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার কিছু সুফলও মিলেছে।
              আমরা এখুনি সতর্ক হয়ে যদি বহুমূখী পরিকল্পনায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর রিচার্জিংয়ের ব‍্যপারে যত্নবান না হই, তাহলে আগামী দিনে রাজ‍্যে চিরস্থায়ী খরা নেমে আসবে! প্রথমত, উন্নয়নের নামে বৃক্ষছেদন ও নগরায়ণের নামে বহুতল ফ্ল‍্যাট বাড়ি বানানো বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। তাছাড়া, প্রতিটি বড় গাছ কাটার সময় ঐস্থানের আশেপাশে অন্ততঃ দশটি একই ধরনের গাছ লাগানো বাধ‍্যতামূলক করা উচিৎ। তাছাড়া, যে সব পাবলিক টয়লেট ও মিউনিসিপালিটির কল দিয়ে জলের অপচয় হয়, তা বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। বিশেষভাবে ব‍্যবহার করার সময় ছাড়া অন‍্য সময় যাতে কলে জল না আসে, সেই পদ্ধতি ব‍্যবহার করা দরকার। নগরায়ণের প্রশ্নে  ভার্টিকাল এক্সপানশান অপেক্ষা হরাইজন্টাল এক্সপানশানের উপর জোর দেওয়া উচিৎ। সম্প্রতি আইসল‍্যান্ডে আমি দেখেছি, একমাত্র রাজধানী রিকিয়াভিক ছাড়া অন‍্য কোথাও বহুতল বাড়ি নেই! সেখানে তিনতলার চেয়ে উঁচু বাড়ি দেখিনি। বহুতল বাড়ির সংখ‍্যা যত বাড়বে, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর তত নামবে। কারন, বড় শহর ছাড়া অন‍্য সব জায়গায় নদীর জল শোধন করে নলের মাধ‍্যমে সর্বত্র পাঠানো সম্ভব নয়। ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গেলে আরেকটি সমস‍্যা হল, মাটির বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়া। এর ফলে, যেমন ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়বে, তেমনি এইসব বাড়ির দেওয়ালে দ্রুত ফাটল দেখা দেবে।
          ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় সেচের জন‍্য খরচের পরিমাণ বাড়ছে, সেইসঙ্গে বিদ‍্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। জমির ফসলের পরিমাণ কমছে।
             তার সঙ্গে এই রাজ‍্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত জলাভূমি বুজিয়ে ইট-কাঠ-পাথরের নির্মাণ করে শুধু ভূগর্ভস্থ জলস্তরকেই নীচে ঠেলে দেওয়া নয়, জল-দূষণ অত‍্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে! কলকাতার পূর্বদিক জুড়ে যে বিশাল জলাভূমি একসময় কলকাতাকে তার পানীয় জলের স্তর ঠিক রেখে, বিভিন্ন অ‍্যাকোয়াফারের প্রাকৃতিক ফিল্টারের মাধ‍্যমে জলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায‍্য করত, এবং সেইসঙ্গে বায়ুদূষণ কমিয়ে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখত, তা বুজিয়ে দিতে দিতে আজ পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় ৫% জলাভূমিও অবশিষ্ট নেই। উচ্চ-আদালতের নির্দেশে জলাভূমি বুজিয়ে বাড়ি তৈরী করা বেআইনি – এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকোর দিয়ে জলাভূমি বোজানো চলছে! শুধু কলকাতা নয়, সারা রাজ‍্যে উন্নয়নের জোয়ারে এই একই অবস্থা! যে ভাবে রাজ‍্যের বিভিন্ন জেলায় মাটির নীচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে, তার ফলে আর ১৫-২০ বছরের মধ‍্যে রাজ‍্যে জলের খরা অবশ‍্যাম্ভাবী।
             আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিয়ে ওরিগনের ক্রেটার লেককে সংরক্ষণ করে ক্রেটার ন‍্যাশনাল পার্ক তৈরী করেছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে এই লেকের জলে আর্সেনিক দূষণ পাওয়ার পরসে দেশের সরকার নড়েচড়ে বসে। কিন্তু আমাদের সরকার – কাকস‍্য পরিবেদনা! কলকাতা, দুই চব্বিশ পরগণা সহ রাজ‍্যের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক, সীসা সহ e-coli ও আরো অনেক প্রাণঘাতী বিষের প্রদূষণ বাড়তে থাকলেও রাজ‍্য, কেন্দ্র – উভয় সরকারই কমিটি, আইন এসব করেই ক্ষান্ত! কোন কার্যকরী সুরাহার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের হৃদয় – কলকাতা, তার পার্শবর্তী জেলাগুলি ধীরে ধীরে মঙ্গলগ্রহের মত জলশূণ‍্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে! অন্ততঃ কেপটাউন মিউনিসিপালিটির মত কবে শুনব KMC বিজ্ঞপ্তি জারি করছে – জনগণকে আর পাণীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব নেওয়া হবে না! তবু, তার আগে জলের অপচয়টুকু কি বন্ধ হবে না!

পারভেজ মুশারফ : স্বৈরতন্ত্রী যুদ্ধবাজ দেশপ্রেমিক

গত ৫ই ফেব্রুয়ারী,২০২৩ এ দুবাইয়ের হাসপাতালে পাকিস্তানের স্বঘোষিত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান পারভেজ মুশারফের ৭৯ বছর বয়সে মৃত‍্যু কোন ব‍্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে তাঁর মৃত‍্যুর সঙ্গেসঙ্গে এই উপমহাদেশের মানুষের চরম ক্ষতিকারী একজন স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবাজ সমরনায়কের সব কার্যকলাপ ধুয়ে মুছে যায় না – বিশেষতঃ পাক-ই-স্তানের বর্তমান চরম দুরবস্থার সূত্রপাত তাঁর অদূরদর্শী যুদ্ধবাজ কাজকর্মের জন‍্যই।
মুশারফের পাক-ই-স্তান সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘ সার্ভিসের শুরু হয় তাঁর দুই বন্ধু আলী কুলী খান ও আব্দুল আজিজ মির্জার সঙ্গে ১৯৬৪ সালে। তাঁরা তিনজনই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নেন। মুশারফ প্রথমে আর্টিলারী বাহিনীতে গেলেও ১৯৬৫ ও ১৯৭১এর যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখানোয় তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হকের নেকনজরে পড়েন এবং তাঁর দ্রুত পদোন্নতি হতে থাকে। তাঁকে কাশ্মীর সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়। তিনি পাক-ই-স্তানের মর্যাদাপূর্ণ মেডেল ইমতিয়াজ সনদ পান। পাক-ই-স্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মুশারফের অভিজ্ঞতা পাক-ই-স্তানের পক্ষে অত‍্যন্ত লাভজনক হয়।
মুশারফের জীবন ও কর্মপদ্ধতি অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, অন‍্যান‍্য পাক-ই-স্তানী সমরনায়ক ও রাজনীতিবিদদের মতই তিনি পাক-ই-স্তানের জন্মের পর থেকেই সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে দখল করা এবং ভারতকে সামরিকভাবে ব‍্যতিব‍্যস্ত রেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন! পাক-ই-স্তানকে বিপর্যয় ও ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন‍্য ভারত বিরোধীতা ও কাশ্মীর দখলের জিগির তোলা হত। মুশারফের সময় বারবার কাশ্মীর সমস‍্যাকে রাষ্ট্রসংঘে নিয়ে যাওয়া ও পাশ্চাত‍্য দেশের মিমাংসা করার জন‍্য ভারতীয় ভুখন্ড কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকার তকমা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এটা করতে গিয়ে পাক-ই-স্তানকে জঙ্গী তৈরী থেকে যে বিভিন্ন বিধ্বংসী কাজে মদত দিতে হত তার খরচ জোগাতে পাক-ই-স্তানের অর্থনীতির উপর চাপ পড়া শুরু হয় এই মুশারফের শাসনকালেই।
সামরিক বাহিনীর শিক্ষা মুশারফকে নির্মম ও হৃদয়হীন যোদ্ধা হিসাবে তৈরী করলেও তাঁর এই দুই স্বভাবের প্রতিফলন অসামরিক ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে! তিনি যাকে শত্রু মনে করতেন তার সঙ্গে কুটনৈতিক সৌজন‍্য ততদিন বজায় রাখতেন, যতদিন না সুযোগ আসে সেই শত্রু নিকেশ করার! এখানে উল্লেখ‍্য, আমরা ইতিহাসে যেভাবে মুঘল দরবারের বিশ্বাসঘাতকতা ও পিছন থেকে ছুরি মারার ঘনঘটা দেখি, পাক-ই-স্তানের জন্মের পর থেকে সেখানেও লিয়াকত আলীর থেকে একই নোংরামোর পরম্পরা দেখা যায়! এই পরম্পরার আদর্শ চরিত্র পারভেজ মুশারফ। নওয়াজ শরীফের প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় পাক-ই-স্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর অযৌক্তিকভাবে অসামরিক ব‍্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টার জন‍্য শরীফ তাকে বরখাস্ত করেন। সে সময় নওয়াজ শরীফ তাঁর ভাই এবং মন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সুপারিশক্রমে দুজন সিনিয়ার সেনানায়ককে টপকে মুশরফকে চার তারা অফিসারে উন্নীত করে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন! এই সময় মুশারফ আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে গণতান্ত্রিক মূল‍্যবোধের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাহির করেন! পাক-ই-স্তানের জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের চেয়ারম‍্যান হিসেবে শরীফ মুশারফকেই নিয়োগ করেন এবং মুশারফের সিনিয়র এবং নৌবাহিনীর অধ‍্যক্ষ বুখারীকে বরখাস্ত করেন।
ইতিমধ‍্যে মুশারফ সেনাপ্রধান হওয়ার পরেই তাঁর কাশ্মীর ফ্রন্টের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করে শরীফকে কাশ্মীর আক্রমণের ব‍্যাপারে রাজী করান এবং বিনা প্ররোচনায় ভারতের কাশ্মীর আক্রমণ করেন! কারগিল ফ্রন্টে এই হটাৎ আক্রমণের কারনে ৫০০ মত ভারতীয় সেনা শহীদ হন। তারপর পাল্টা আঘাতে পাক-ই-স্তান সেনাবাহিনী দ্রুত পিছু হটে। কারগিল যুদ্ধ স্মৃতি মিউজিয়ামে গেলে দেখা যাবে, সিভিলিয়ানের ছদ্মবেশে পাক-ই-স্তানী সেনারা কার্গিলে ঢুকে যুদ্ধ করেছে – মৃতদের কাছে সেনাবাহিনীর পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে! এমন নোংরামো আগে কখনো হয়নি। সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে মুশারফের মস্তিষ্ক-প্রসুত! মুশারফের পরিকল্পনায় এই যুদ্ধ হলেও তার হারের দায় মুশারফ নওয়াজ শরীফের উপর চাপায়! অথচ, তার উপর বিশ্বস্ততার সুযোগ নিয়ে নওয়াজ শরীফ মুশারফকে কারগিল যুদ্ধের সম্মতি দিলেও যুদ্ধের কয়েকমাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং নওয়াজ শরীফের যৌথ প্রচেষ্টায় লাহোর-পাঞ্জাব বাসযাত্রা শুরু হয়!
যাই হোক, মুশারফের এই অপকর্মের দায় শরীফের উপর চাপিয়ে মুশারফ সেনাবাহিনীর সাহায‍্যে শরীফকে গদিচ‍্যুত করে নিজেকে পাক-ই-স্তানের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ঘোষণা করেন! কালক্রমে মুশারফ বলপূর্বক ভোট-জালিয়াতি করে নির্বাচনে জিতে নিজেকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন! ইতিমধ‍্যে ভারতের হাতে তার অ‍্যাডভেঞ্চারের শখ মিটে যাওয়ার পর ২০০১ সালের জুলাই মাসে আগ্রায় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ও মুশারফের মধ‍্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া স্থির হয়। এই চুক্তিতে দু দেশের সেনা নিয়ন্ত্রণ, পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার-রোধ ও অনাগ্রাসন ইত‍্যাদির বিশদ ব‍্যাখ‍্যা থাকে। সেখানে রাজি হওয়ার পরেও দুই দেশের প্রধানের স্বাক্ষরের কয়েক মিনিট আগে মুশারফ কোন অজুহাত ছাড়াই চুক্তি সই না করেই তড়িঘড়ি দেশে ফিরে যান! মুশারফ শুধু কাশ্মীরে আগ্রাসনই নয়, ভারতের অভ‍্যন্তরে গুপ্তহত‍্যা ও নাশকতা, অন্তর্ঘাত চালিয়ে গেছেন। তাঁর সময়ই Cross-border terrorism এর বাড়বাড়ন্ত হয়। তাঁরই সময়ে ২০০১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনে জঙ্গী হানায় ১৪ জনের মৃত‍্যু হয়। এর দায় নেয় মুশারফের পাক-ই-স্তানে লালিত-পালিত ও প্রশিক্ষিত লস্কর-ই-তৈবা ও জয়শ-ই-মহম্মদ।
ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে জঙ্গী আক্রমণ এবং এই জঙ্গীদের ঘাঁটি তৈরী করে তাদের ট্রেণিং সহ রক্ষণাবেক্ষণের যে নকশা তৈরী করে তার প্রয়োগ গতি পায় মুশারফের আমলেই। মুশারফ অত‍্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে শুধু যে নওয়াজ শরীফকেই বোকা বানিয়েছেন তাই নয়, আফগানিস্তানে আমেরিকার অভি‍যানকে সমর্থন করেও তিনি উপর উপর জঙ্গী দমনের কথা বললেও দেশের অভ‍্যন্তরে ভারতের বিরুদ্ধে সমস্ত রকম ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে মদত দিয়েছেন। তিনি চাপে পড়ে ভোল পাল্টাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ইন্দো-পাক জঙ্গী-বিরোধী প্রক্রিয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে যথারীতি ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ ও জঙ্গী প্রশিক্ষণে গতি আনেন। লক্ষ‍্য করলে দেখা যায়, পারভেজ মুশারফ শুধু কারগিল যুদ্ধের খলনায়ক নন, তিনি ভারত-বিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলির পালক পিতাও বটে!
আবার পাক-ই-স্তানের অভ‍্যন্তরে টিপিক‍্যাল জিহাদী মানসিকতায় তিনি তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কন্ত্র চালিয়ে গেছেন। ২০১৯ সালে তাঁকে অনুপস্থিত অবস্থায় ফাঁসির সাজা শোনানো হয়! পরে লাহোর হাইকোর্ট শুধু ফাঁসি রদ করে। তাঁকে নবাব আকবর বুগতি ও বেনজির ভুট্টোর হত‍্যাকান্ডের অন‍্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি নওয়াজ শরীফ ও তাঁর কাছের মানুষদের কাছে এমন ভাব দেখাতেন যেন তিনি গণতন্ত্রের উপর প্রচন্ড আস্থাশীল। তেমনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক মূল‍্যবোধকে সম্মান জানানোর অভিনয়ে তিনি দেশ-বিদেশের নেতাদের সাময়িকভাবে বোকা বানাতে সক্ষম হন! অথচ, ক্ষমতা পাওয়ার পরপরেই তিনি গণতন্ত্র ত দুরস্ত্, প্রতিবাদের ভাষার কন্ঠরোধ করে দেশে সমস্তধরনের ট্রেড-ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেন! এমনকি ২০০২ সালে উনি যখন নির্বাচনে (যা পাক-ই-স্তানের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী জোচ্চুরীর নির্বাচন বলে চিহ্নিত হয়ে আছে) জিতে দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন, তখনও তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদ ছাড়েননি! আসলে মুশারফ গণতন্ত্রের ভড়ং দেখালেও তিনি ছিলেন আদ‍্যন্ত যুদ্ধবাজ একনায়ক সামরিক প্রধান।
মুশারফের মধ‍্যে জিহাদী প্রবৃত্তি থাকায় তাদের স্বভাব অনুযায়ী তিনি সর্বদা সামরিক অভ‍্যুত্থানের ভয় পেতেন কারন তিনি নিজেই ছিলেন ঐ পথের পথিক! ফলে, তিনি সেনাবাহিনীতে কোন জনপ্রিয় ও উচ্চাভিলাষী অফিসারের খোঁজ পেলেই তাকে বিদায় করে দিতেন! এভাবে সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর প্রভাব পরে এবং বাহিনীতে মোসাহেব অফিসারের সংখ‍্যা বাড়তে থাকে।
মুশারফের একটি বড় সাফল‍্য হল, তার অভিনয় দক্ষতায় তিনি আমেরিকাকে জঙ্গী দমনের মিথ‍্যা প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করাতে বাধ‍্য করানো! তিনি ২০০১-০২ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে আফগানিস্তানের তালিবান জঙ্গীদের বিতাড়নকে সমর্থন করেন এবং সে দেশের সঙ্গে মিলিতভাবে জঙ্গী দমন পদ্ধতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন! একদিকে তিনি জঙ্গী নির্মূল অভিযানে আমেরিকার বিশ্বস্ত জোটসঙ্গী থেকেছেন; অন‍্যদিকে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সাহায‍্য কাজে লাগিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গীগোষ্ঠী, যেমন লস্কর-ই-তৈবা, জয়শ-ই-মহম্মদ ইত‍্যাদিকে পুষেছেন, ট্রেণিং দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে ব‍্যবহার করেছেন। মুশারফের সময়ই পাক-ই-স্তান সেনাবাহিনী ও ISIএর প্রত‍্যক্ষ মদতে ভারত বিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীদের বিপুল সংখ‍্যায় ট্রেণিং সেন্টার খোলা হয়! তখন ভারতে অনুপ্রবেশকারী জঙ্গীদের নাশকতার ব‍্যাপ্তি বাড়তে থাকে। পুরো সিস্টেমটাই মুশারফের আমলে গতি পায়। আরেকটি লক্ষ‍্যণীয় বিষয় হল, মুশারফের আমলেই ভারতে জাল নোট ধরা পরতে থাকে, যা পাক-ই-স্তানের টাঁকশালে ছাপা বলে অভিযোগ ওঠে!
আসলে মুশারফ নিজের স্বার্থের জন‍্য পাক-ই-স্তানের মধ‍্যে যেমন বহু অসৎ কর্ম করেছেন, তেমনি তিনি ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান থেকে কখনো বিচ‍্যুত হননি। ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রথমেই তিনি ভারত আক্রমণ করে কাশ্মীর দখলের যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই যুদ্ধবাজ হটকারী সিদ্ধান্তের জন‍্য সাহস পেয়েছিলেন তাঁর কাশ্মীর ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা থেকে। চাপের মুখে মিষ্টি কথা বলতে অভ‍্যস্ত মুশারফ কখনো ভারতকে টুকরো করার এবং কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি। একসময়, ১৯৭১ এর যুদ্ধে তাঁকে পূর্ব-পাক-ই-স্তানে বদলি করা হলেও পশ্চিম-পাক-ই-স্তানে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় তা শেষ মূহুর্তে বাতিল হয়। মনে হয়, পূর্ব-পাক-ই-স্তানে তাঁর দেশের লজ্জাজনক পরাজয় ও নিয়াজীর অসহায় আত্মসমর্পণ তাঁকে বিচক্ষণ বাস্তববাদী করে তোলার বদলে প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষিপ্ত এক সেনানায়কে পরিণত করে! পাক-ই-স্তানের আভ‍্যন্তরীন রাজনীতিতেও তাঁর এই প্রতিশোধস্পৃহার বহু উদাহরণ আমরা পাই। যাই হোক, এই যুদ্ধবাজ ভারতবিদ্বেষী মানুষটির মত ও পথ আমাদের দেশের তথা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে বিপজ্জনক হলেও তাঁর নিখাত পাক-ই-স্তান প্রেমের জন‍্য অন্ততঃ সাধারণ পাক-ই-স্তানী মানুষজন তাঁকে মনে রাখবে।

ভাবের ঘরে চুরি : রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গ

সারা দেশের মধ‍্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এর জন‍্য কোন “ইজম”এর দলদাস অর্থনীতিবিদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। যাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উন্নয়নের মাপকাঠি করেছে সেই বিভিন্ন “প্রকল্পে” “অনুদান” পাওয়া মানুষের সংখ‍্যা এই রাজ‍্যেই সর্বাধিক! এমনকি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রজাপতি’ সিনেমায় এইসব “সাথী” প্রকল্প প্রাপকদের নিয়ে তির্যক মন্তব‍্য করা হয়েছে! এছাড়া আরেক মাপকাঠি – রাজ‍্যে উৎপাদনকারী সংস্থার জিএসটি প্রদানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান অন‍্য রাজ‍্যগুলির তুলনায় নীচের সারিতে।
এই দুই মাত্রার মাপকাঠিতে বলা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দৈন‍্যতা অত‍্যন্ত ভয়াবহ। এ ব‍্যাপারে সমালোচনার রাজনীতিতে কারুর কোন লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের উত্থানের নেপথ‍্যে কেন্দ্রের বঞ্চনা অর্থাৎ তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের বিমাতৃসূলভ আচরণের প্রচার অনেকটাই দায়ী। কিন্তু, আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এই বামপন্থীরাই সেই কংগ্রেস (তাদের নীতিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন না হলেও) দলের সঙ্গে মিলিতভাবে রাজ‍্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের মিলিজুলি রাজনীতি করেছে! আবার বর্তমানে দেশের ক্ষমতায় থাকা জাতীয়তাবাদী দল একই সঙ্গে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসুকে আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রনেতা হিসাবে মানে! এ ত সুবিধাবাদী রাজনীতি! যাদের মত ও পথ বিপরীতমুখী, তাদের মধ‍্যে মেলবন্ধনের চেষ্টা সুবিধাবাদের রকমফের মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থার চিত্র শুধু রাজ‍্যের মানুষের নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের পক্ষে ভয়াবহ। শিক্ষা-দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ আধিকারিক, যারা শিক্ষা-দপ্তরে শিক্ষকসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সকলেই জেলে! রাজ‍্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জেলে! এদের অপরাধের তদন্ত চলছে উচ্চ- আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের দ্বারা। সারা দেশ জানে, এরা সবাই শিক্ষক নিয়োগ সহ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে মেধা ও পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের প্রায় সকলের হেফাজত থেকে হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশ। একটি ব‍্যাপারের উল্লেখ করতে হয় যেটাকে সংবাদ-মাধ‍্যম ও সামাজিক-মাধ‍্যম গুরুত্ব দিচ্ছে না! তা হল, অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেসঙ্গে এ ধরনের অপরাধ সমাজের জন‍্য অত‍্যন্ত ঘৃণ‍্য এবং উদ্বেগজনক অপরাধ! সমাজে দুটি সুদৃঢ় স্তম্ভের উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি – শিক্ষক, যার কাজ চরিত্র গঠন সহ শিক্ষার আলোকে সমাজকে শিক্ষিত করা এবং চিকিৎসক, যাদের হাতে সমাজের স্বাস্থ‍্য নির্ভর করে। যদি শিক্ষক নিয়োগে টাকার বিনিময়ে জাল শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তবে পুরো শিক্ষা ব‍্যবস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। তার অবিসম্বাদী ফল হল পুরো জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া। কারন, শিক্ষাই পশুর সঙ্গে মানুষের তফাৎ গড়ে দেয়। এই দুর্ণীতিতে সমাজে শিক্ষকদের এবং সেইসঙ্গে রাজ‍্যের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার গ্রহণযোগ‍্যতাই কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা রাজ‍্যের শাসন-ব‍্যবস্থার চরম অবক্ষয়ের লক্ষণ। রাজ‍্যের প্রাচীনতম এবং সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে আইন না মানার কারনে ঐ উপাচার্যকে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে বরখাস্ত হতে হয়। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ব‍্যাপারও আদালতে বিচারের অপেক্ষায়। শিক্ষা-বিভাগে এই মূহুর্তে একজন শিক্ষা-মন্ত্রী থাকলেও জনমানসে রাজ‍্যের শিক্ষা-দপ্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান শিক্ষা-মন্ত্রীর আমলে সাম্প্রতিকতম শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার দুর্ণীতি ও অনিয়মের প্রমাণ সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশিত হওয়ায় দপ্তরের নতুন ‘মাথা’দের বিশ্বাসযোগ‍্যতাও তলানিতে। এ ব‍্যাপারেও ধরা পড়েছে রাজ‍্যের শাসকদলের এক “নেতা”! এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের কাজকর্মে ঢিলেমির জন‍্য উচ্চ-আদালতের একাধিক ন‍্যায়াধীশ বারংবার তাদের তিরষ্কার করেছেন! তবু তারা নির্বিকার! এটা তখনই সম্ভব যখন এই তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদ্বয় বিশেষ কোন কারনে তদন্তে ঢিলে দিতে বাধ‍্য হয়! মনে রাখতে হবে, যদিও তদন্ত চলছে আদালতের নির্দেশে, এই সংস্থাদের প্রশাসনিক কন্ট্রোল কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। আবার শিক্ষা – সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র-রাজ‍্য যৌথ দায়িত্বে থাকায় রাজ‍্যের শিক্ষা-দপ্তরের এমন হালের পরেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের এমন ঢিলেমি নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এখনো পযর্ন্ত যে অভিযুক্তদের হেপাজতে নেওয়া হয়েছে তারা সকলেই রাজ‍্যের শাসকদলের নেতা বা নেতা-নেত্রী ঘনিষ্ঠ। সুতরাং এই দুর্ণীতিতে শাসদলের নেতা-নেত্রীর যোগ যেমন প্রমাণিত, তেমনি রাজ‍্যের বিরোধী দল, যারা কেন্দ্রের শাসক দল, তাদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাদের এমন ঢিলেমির দায় কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়ার রহস‍্যময় ইঙ্গিত দেয়!
শুধু শিক্ষা-দপ্তরের ক্ষেত্রেই নয়, অন‍্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও – যেমন কয়লা পাচার কেলেঙ্কারী, অবৈধ বালি পাচার, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গরু পাচারের মত তদন্তেও ঢিলেমির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে! রাজ‍্যের দুর্ণীতির বিরুদ্ধে পুরো অনুসন্ধান প্রক্রিয়াই যেন দুধ-ভাত খেলা হয়ে যাচ্ছে! এতে শুধু এই সংস্থারাই নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। হয়ত, কেন্দ্রে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতাদের হিসাব-নিকাশ বলছে – আগামী ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে কয়েকটি রাজ‍্যে কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে অনুমান করে কেন্দ্রের শাসক দল পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী! মনে হয়, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিরোধী দলের রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী!
সারা দেশে অনুদান রাজনীতির প্রভাব কম-বেশী থাকলেও তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক। “শ্রী” যুক্ত এবং “শ্রী” হীন অনুদান রাজনীতির কারনেই রাজ‍্যের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু এ রাজ‍্যে বাণিজ্যিক লগ্নীর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম, সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গে অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণের চাহিদা প্রায় নেই! তা সত্ত্বেও এখানে অবকাঠামো উন্নয়ণ দুরের কথা, রক্ষণাবেক্ষণ পযর্ন্ত ঠিকমত হচ্ছে না। আসলে এই রাজ‍্যে এত বেশী দুর্ণীতির অভিযোগ, তার কারনে এখানে লগ্নিকারীরা আসতে সাহস পাচ্ছেন না। সকলের বক্তব‍্য, রাজ‍্যে লগ্নি করার পর রাজনীতির গ‍্যাঁড়াকলে ফেঁসে যেতে হবে না ত! প্রকৃষ্ট উদাহরণ – সিঙ্গুরে টাটাদের পশ্চাদপসরন।
এমন পরিস্থিতিতে চাকরি-বাকরি থেকে ধরে ব‍্যবসা-বাণিজ‍্যে রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরি বিক্রি ও যে কোন প্রাপ‍্য সার্ভিসের বিনিময়ে ‘কাটমাণি’ নেওয়ার অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যেটা স্বাভাবিক পরিণতি, সেদিকে যদি রাজ‍্যটা চলে যায় তবে তার দায় কার? অর্থনৈতিক বিকাশে বারবার বাধা ধীরেধীরে পুরো সমাজকে অসহিষ্ণু অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয় – যার খন্ডহার এখন বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। একে “গোষ্ঠী সংঘর্ষ” বা “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বলে কতদিন ধামাচাপা দেওয়া যাবে! এইসঙ্গে একটি ব‍্যাপার খেয়াল রাখা দরকার – পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়েছে এক বিশেষ ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে এবং জন্মের পর থেকেই এই রাজ‍্যের মানুষকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত রেখে, ধর্মীয় “ইজম” এর ধোঁয়া তুলে কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয়ই রাজনৈতিক ফয়দা তুলেছে। একটি ব‍্যাপার লক্ষণীয় – এই রাজ‍্যে সর্বদা সংসদীয় রাজনীতিতে শাসক ও বিরোধী – দুই ভাগে মানুষের সমর্থন বিভক্ত থেকেছে। অথচ, প্রথমে কংগ্রেস ও তারপর যুক্তফ্রন্টের শাসনকালের পর রাজ‍্যের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। কারন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই রাজ‍্যে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন কায়েম হওয়ার পর তাদের দুটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের থেকে পৃথক অবস্থানে নিয়ে গেল। তারা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে শস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতির দিকে paradigm shift করল। প্রথমে কৃষি-জমি বিল এনে রাজ‍্যের সব চাষ-আবাদের জমিকে ভেঙ্গে দিল এবং রায়তদের জমির মালিকানা পাওয়ার আইনের ফলে বড় ও একলপ্তে থাকা কৃষিজমি আর রাজ‍্যে রইল না। জমির ঊর্ধসীমা সিলিংএর আইনে হয়ত রাজনীতিতে সিপিএমের সমর্থন বাড়ল; কিন্তু সেইসঙ্গে চাষের কাজে আধুনিকীকরনের সুযোগ বন্ধ হল। আধুনিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চাষের জন‍্য একলপ্তে যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন, রাজ‍্যে আর তা রইল না। এখানে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তা “শ্রেণী-সংগ্রাম” বলে প্রচারের সুযোগে রাজ‍্যে সমবায় আন্দোলন দানা বাঁধল না। নিট ফল হল, প্রতি হেক্টর জমিতে একই জাতের ফসল ফলনের নিরিখে পঞ্জাব, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র ইত‍্যাদি রাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক এগিয়ে গেল। দ্বিতীয় হল শিল্পক্ষেত্র – যেখানে অযৌক্তিক দাবী তুলে শ্রমিকদের সংগঠিতভাবে দলীয় সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় তাদের মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে একেএকে শিল্প, কারখানা বন্ধের রাজনীতি শুরু হল। বেকার শ্রমিক ও অভুক্ত কৃষকদের নিয়ে দলীয় সংগঠন স্ফীত করতে সক্ষম হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আর্থ-সামাজিক অধোগতি শুরু হল। তখন, এইসব বিপুল সংখ‍্যক দলীয় সমর্থকদের (ক‍্যাডার) পুষ্টিকরনের উদ্দেশ‍্যে পঞ্চায়েত রাজ চালু হল। উন্নয়ণের নামে এই পঞ্চায়েতের মাধ‍্যমে সরকারী অর্থ খরচের বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হল। সুতরাং দল তথা সরকারে বাফ্রন্টের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়োজনে যেন-তেন-প্রকারেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন‍্য রিগিংয়ের সাথে বলপ্রয়োগ শুরু হল – এর জেরে নির্বাচনে হিংসার আমদানি হল। তার রূপায়নের তাগিধে রাজ‍্যের প্রশাসন ও পুলিশকে ব‍্যবহার করা শুরু হল।
রাজ‍্যের মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমিত করার সঠিক দিশা না পেয়ে রাজ‍্য নেতৃত্ব তখন “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” নীতির সফল রূপায়ন করল! এই নীতির সফল রূপকার নিঃসন্দেহে জ‍্যোতি বসু। যেহেতু সংসদীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সর্বদা দ্বিমেরুভিত্তিক রাজনীতি সমর্থন করে এসেছে, সেজন‍্য মানুষের কাছে ভোটের সময় বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের বিকল্প তৈরী হল না! এই রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ যেমন হল, তেমনই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংসের পথ সুগম হল। রাজনৈতিক চালাকি এই রাজ‍্যের মানুষের না-পসন্দ। এই অবস্থায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে লড়াকু নেত্রী মমতা ব‍্যানার্জী ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ দল গঠন করে নির্বাচনী ময়দানে সিপিএম ও কংগ্রেসের বিকল্পর সন্ধান দিলেন। এই দলের জন্মের পর থেকে সিপিএমের উপর মানুষের অনাস্থার কারনে তৃণমূল দল নির্বাচনে ছাপ রাখতে শুরু করল। নির্বাচনে জেতার জন‍্য ছাপ্পার সঙ্গেসঙ্গে নির্বাচনী ও নির্বাচনোত্তর হিংসা ক্রমশই বাড়তে লাগল। পশ্চিমবঙ্গের সব নির্বাচনে হিংসা অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হিসেবে ভোট ময়দানে স্বীকৃত টেকনিক হিসেবে দেখা দিল! এসবের সবচেয়ে বড় কারন হল, সিপিএম রাজত্বে এই রাজ‍্যের বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগার ছিল রাজনীতির ছত্রছায়ায় তোলাবাজি ও বিভিন্ন অবৈধ পাচারের পথে উপার্জন! ফলে, রোজগার হারানোর ভয়ে এরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে হলেও দলকে নির্বাচনে জয়লাভের রাস্তায় নিয়ে যেত। তৃণমূল দলের শুধুমাত্র বামফ্রন্টের বিরোধীতার জন‍্য জন্ম হলেও, বামফ্রন্টের শেষ মূখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের ভুল নীতির পরিবর্তনের চেষ্টায় দলেরই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন, বিশেষতঃ যারা অসৎ উপায়ে রোজগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব “কুস্তি-দোস্তি”র রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেই নীতির প্রয়োগে মমতা দেবী তাঁর তৃণমূল দলকে ২০১১র সাধারন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা কংগ্রেসের প্রত‍্যক্ষ‍ সাহায‍্যে রাজ‍্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলেন।
ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গে তৃণমূলের সিপিএম বিরোধীতার লড়াই শেষ হল! তখন প্রশাসন চালানোর জন‍্য মমতা দেবী সিপিএমের রাস্তায় আরো উগ্রতা ও ব‍্যাপ্তির সঙ্গে রাজ‍্যকে নিয়ে এলেন। তিনি যথার্থ সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তাঁর শাসন এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তৃণমূল দলটি ব‍্যাক্তি মমতা নির্ভর দল হওয়ায় এরা দ্রুত ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সিপিএম জমানার হিংসা, তোলাবাজি ও অবৈধ পাচারের অর্থসংগ্রহকে বিপুল মাণ‍্যতা দিয়ে অল্প সময়েই রাজ‍্যের হাল শোচনীয় করে তুলল। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” নীতিতে অভ‍্যস্ত‍, মমতা ব‍্যানার্জীও সেই কায়দায় রাজ‍্য চালানোর চেষ্টা করতে লাগলেন!
পশ্চিমবঙ্গ একটি আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী রাজ‍্য হওয়ায় এবং এখানে ভারত-বিরোধী জিহাদী অনুপ্রবেশের প্রচুর ইতিহাস আছে। ভোটের তাড়নায় মমতাদেবী সিপিএমের থেকেও অনেক বেশী জিহাদী তোষণ করতে লাগলেন ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে। এখন কিন্তু রাজ‍্যের সাধারণ ইসলামী নাগরিকরা তাঁর এই অভিসন্ধি ধরে ফেলেছেন। ফলে, তাঁরা যত তৃণমূল দলের থেকে সরে যাবেন, ততই রাজ‍্যে মাথাচাড়া দেবে সিপিএম ও কংগ্রেস জোট। কারন তাদের সঙ্গে আতাঁত রয়েছে ISF এর। হয়ত, রাজ‍্যের বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মমতা ব‍্যানার্জীর দল lesser enemy তত্ত্বের নিরিখে কম ক্ষতিকারক মনে হতে পারে, কিন্তু রাজ‍্যের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস দল এই খেলা খেলতে গিয়ে রাজ‍্যে রাজনৈতিক হারিকিরি করেছিল। তাছাড়া, এখনকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং সীমান্তবর্তী রাজ‍্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অচিরেই পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিতীয় কাশ্মীর বানাতে পারে। ইলাস্টিককে বারবার টানাটানি করলে তা একবার যখন বড় হয়ে যায় তখন আর ব‍্যবহারযোগ‍্য থাকে না। অতয়েব সাধু সাবধান।

অমর্ত‍্য সেন ও কিছু অপ্রিয় সত‍্য

এই লেখাটি লেখার আগে বহুবার ভেবেছি – লিখব কি না! কারন এখানে যে পরিমাণ কাদা ঘাঁটতে হবে তা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবু অনেক পাঠক, শুভানুধ‍্যায়ীর সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রাখলাম – অবশ‍্যই কোন ইজম, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ব‍্যক্তিগত সম্পর্কের আলো ব‍্যতিরেকে এই উপস্থাপনা। হয়ত ডান,বাম সহ সব “বুদ্ধিজীবীর ঘুমন্ত বিবেক জাগবে না, তবে, নিঃশব্দ চিড়বিড়ানি হবেই!
“বিশ্ববিখ‍্যাত” অর্থনীতিবিদ অমর্ত‍্য সেন একজন জ্ঞানী,গুণী ব‍্যক্তি। এই প্রাজ্ঞ মানুষটি এই দেশে ত বটেই, বিদেশেও সুপরিচিত। বহু মানুষ তাঁর যে কোন বক্তব‍্য বা কাজের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েন! সেই সুযোগে এই নবতিপর মানুষটি সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মত সর্ব বিষয়ে তাঁর “বিশেষজ্ঞ” পরামর্শ অর্থাৎ বক্তব‍্য দিয়ে থাকেন! তাঁর এই মন্তব‍্য থেকে, যা অনেক ক্ষেত্রেই আলটপকা মনে হয়, অনেকে তাঁকে দার্শনিক বলে থাকেন! তাঁর দর্শন শাস্ত্রের উপর কোন লেখা আমার জানা নেই। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র বলা হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পরীক্ষাতেই তিনি কিন্তু প্রথম স্থান পাননি! প্রথম হতেন সুখময় চক্রবর্তী। এই সুখময়বাবু পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস‍্য হয়েছিলেন। তিনি অমর্ত‍্যর মত রাজনৈতিক মতামত পোষণ করা এবং অযথা সব জায়গায় মন্তব‍্য করতেন না। অমর্ত‍্য সেনের “নোবেল স্মারক পুরস্কার” পাওয়া যে ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির জন‍্য, তার সঠিক প্রয়োগে পৃথিবীর কোন দেশ সাফল‍্য পেয়েছে বলে জানা যায় না!
এই পুরস্কারকে অনেকে নোবেল পুরস্কার বলে ভুল করেন! আসলে অর্থনীতির উপর এই পুরস্কার এবং তার অর্থমূল‍্য বহন করে Sveriges Riksbank of Sweden যা এখন Bank of Sweden নামে পরিচিত।আলফ্রেড নোবেলের ট্রাস্টের থেকে পাঁচটি মৌলিক বিষয়ে – পদার্থবিদ‍্যা, রসায়ন, শারীরবিদ‍্যা বা চিকিৎসাবিদ‍্যা, সাহিত‍্য এবং শান্তি – এর উপর প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এর প্রাপকরা একটি বিষয়ে সর্বাধিক তিনজন এই পুরস্কার ভাগ করে নিতে পারেন। পুরস্কার প্রাপকরা নামের শেষে NL লেখার অধিকার পান। অর্থনীতির এই পুরস্কার বিজ্ঞানের প্রয়োগের সার্থকতার উপর দেওয়া হয় না। অর্থনীতির পুরস্কার নোবেলেরস্মৃতিতে দেওয়া হয় আর তার প্রাপকরা NL লেখার অধিকারী নন। এটা ঠিক যে অমর্ত‍্য সেন কখনো নিজের নামের পাশে NL লেখেননি। অতি সম্প্রতি তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি নোবেল পাননি। তবে আমাদের দেশের অপরিণত সংবাদ-মাধ‍্যম জোশ দেখিয়ে তাঁকে NL বানিয়েছে! যাক সে কথা। অমর্ত‍্য সেন সম্পর্কে বলতে গেলে একটি কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। তিনি অর্থনীতির যে তত্ত্ব দিয়েছেন তার প্রয়োগে কোথাও সার্থকতা পাওয়া না গেলেও তিনি তাঁর কয়েকটি ধারনার উপর বরাবর আস্থাশীল থেকেছেন! প্রথম, সর্বদা বিতর্কিত মন্তব‍্য করলেও কম‍্যুনিস্টদের সব রকম ভারত বিরোধী ধারনাকে মদত দেওয়া, যার প্রতিদানে কম‍্যুনিস্ট ও তাদের সহযোগী কংগ্রেসের থেকে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা পাওয়া তাঁর প্রাপ্তির রেকর্ড ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। যেখানে যখন যে রাজনৈতিক দল তাঁকে হাইলাইট করেছে, সেখানে তিনি তাদের স্বপক্ষে বক্তব‍্য রেখেছেন! ভদ্রলোক সারা জীবনে যা ডিগ্রি বা উপাধি পেয়েছেন তার শতকরা নব্বইভাগ সাম্মাণিক! ভারত-বিরোধী কম‍্যুনিস্টদের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তাদের সাহায‍্যে ভেসে থাকা কংগ্রেসের আমলে অমর্ত‍্য তাঁর আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান “ভারতরত্ন” পেয়েছিলেন! আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন, দেশের জন‍্য কোন অবদানের স্বীকৃতিতে তিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন? এর ফলে, কেউ সম্মানিত হল না, “ভারতরত্ন” সম্মানের মান খোয়ালো। একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয়, তাঁর অর্থনীতির বই এবং ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির প্রয়োগে সাফল‍্যের কারনে অন্ততঃ তাঁকে “ভারতরত্ন” দেওয়া হয়নি! এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রয়াত ইভা কলরনির নামে যে ট্রাস্ট তৈরী করেছেন, সেখানে বক্তৃতা দেবার জন‍্য আহ্বান করেন ভারতের অরুন্ধতী রায়কে!অরুন্ধতী রায় কত বড় অর্থনীতিবিদ তা মানুষ না জানলেও তাঁর ঘোষিত হিন্দু-বিদ্বেষ এবং জিহাদী ভারত-বিরোধীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তাঁকে অমর্ত‍্যবাবুর কাছে যোগ‍্য বক্তা করে তুলেছে! অমর্ত‍্য সেন ২০১৪ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত বিষোদ্গার করার পর ২০১৫ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টারের “পদ” থেকে ইস্তফা দেন। এই পদে তাঁকে বসায় কংগ্রেস সরকার। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টারের ভূমিকায় অমর্ত‍্য সেনের কাজ যথেষ্ট বিতর্কিত। আসলে তিনি সর্বদা তাঁর কথাবার্তা এবং কাজকর্মে বিতর্ক তৈরী করেছেন, যা সুনিপুণভাবে তাঁর উচ্চাকাঙ্খাকে মদত দিয়েছে। ব‍্যক্তিগত জীবনকেও তিনি একই কায়দায় উন্নতির সোপান হিসেবে ব‍্যবহার করেছেন। তাঁকে সবচেয়ে কম বয়সে (২৩ বছর) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ‍্যাপক করে আনা হয় বিশেষতঃ তদানীন্তন মূখ‍্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ইচ্ছায়। তাঁর গবেষণায় যে দারিদ্র দূরীকরনের দাওয়াই বাতলানো হয়েছে তা তাঁর অন্ধ মার্কসীয় দর্শনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাঁর Poverty and Famines : An Essay on Entitlement and Deprivation (১৯৮১) বইয়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারন হিসেবে বন্টনগত সমস‍্যার কথা তুলে ধরা তাঁর একমাত্র উল্লেখযোগ‍্য কাজ! তিনি তাঁর অর্থনীতির জ্ঞান ও খুরধার দার্শনিক বুদ্ধির প্রয়োগে এই উপমহাদেশে অর্থনৈতিক অসাম‍্য দূরীকরনের দিশা দেখাতে ব‍্যর্থ। একসময় তাঁকে নিয়ে এদেশে শাসক ও বিরোধী বহু রাজনীতিক উদ্বাহু নৃত‍্য করলেও অন‍্য কোন দেশে তাঁর “জ্ঞান” নেবার চাহিদা না থাকায় তিনি এই দেশে এমনভাবে তাঁর “বাণী” দেন যে তাঁর ব‍্যক্তিগত সুবিধা ও বিশেষ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সুবিধা হয়! এভাবেই তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে ভেসে থাকার চেষ্টা করেন। ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের কারন সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক কাজ প্রশংসা পেলেও পরবর্তীতে তিনি ভারতভাগের আগের ১৯৪৬ এর হিন্দু-নিধনের সময়ের সময়ে এক ব‍্যতিক্রমী ঘটনা – কাদের মিয়ার ছুরিকাহত হয়ে মৃত‍্যুর কারন অনুসন্ধানে সর্বৈব অসত‍্য এক propagandist তত্ত্ব আরোপ করেন! তাঁর সব কাজের পিছনে উদ্দেশ‍্য থাকে – ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ গোষ্ঠী এবং বিশেষ রাজনৈতিক মতকে প্রোমোট করা। বিনিময়ে এই গোষ্ঠী তাঁকে মাথায় তুলে নাচতে থাকে। এদের অবদানেই আজ তিনি দার্শনিক হিসেবে সুপারম‍্যান! সেজন‍্য তিনি ১৯৪৬এর দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং এবং নোয়াখালী হিন্দুগণহত‍্যার মত ঐতিহাসিক তথ‍্যকে বিকৃত করার দুঃসাহস দেখাতে পারেন! তাঁর উয়ারির বাড়ির সামনে ছুরিকাহত কাদের মিয়ার মৃত‍্যু তাঁকে এতটাই ভাবায় যে তিনি তার জন‍্য সম্পন্ন হিন্দুদের শোষণ এবং মুসলমানদের দারিদ্রকে দায়ী করেন! হিন্দুদের দ্বারা শোষনের জন‍্যই নাকি ইসলামী প্রতিবাদে সংঘর্ষ! বাঃ…..! কাল্পনিক গল্প হল অর্থনৈতিক তত্ত্ব। ঐ সময়ে ঐ পাড়ায় থাকা এক বৃদ্ধের (এখনো জীবিত) মুখে শুনেছি কাদেরের পিঠে দাঙ্গার সময় আঁচড় লেগেছিল এবং সেই ঘটনার বহু বছর পরেও সে ঐ অঞ্চলে হিন্দুসহ অনেক বাড়িতেই মুনিষ খাটার কাজ করত! এভাবেই অমর্ত‍্য লোক ঠকানো গল্প করে সমাজে বিষ ঢালার চেষ্টা চালিয়েছেন! এমন উগ্র সমর্থনের পরেও পূর্ব-পাক-ই-স্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) উয়ারির মানিকগঞ্জে তাঁর দাদামশাই ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়ি কেন শত্রু সম্পত্তি ঘোষনায় আত্মসাৎ করা হল তা ঐ দেশের সরকার দুরের কথা, অমর্ত‍্য সেন নিজেও কখনো বলেননি!
Keynesian অর্থনীতির বিপরীতে হেঁটে তিনি যত না বিখ‍্যাত, তার চেয়ে অনেক বেশী পরিচিত হয়েছেন জিহাদী ও উগ্র মার্কসীয় দর্শনের সমর্থক হিসেবে অন্ধ ভারত-বিদ্বেষের কারনে। তিনি হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদের বিরোধীতা করতে গিয়ে জিহাদী, দেশ বিরোধী কম‍্যুনিস্টদের হাই-প্রোফাইল দালালের কাজ করেছেন! ২০১৯ সালে যখন অশান্ত কাশ্মীরে কার্ফু জারি করা হয়, তখন তিনি বিবৃতি দেন – “As an Indian, I am not proud of the fact that India, after having done……..we lose that reputation on the grounds of action that have been taken”। তিনি কাশ্মীরিদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলেন, “a classical colonial excuse”! এই ভারত-বিদ্বেষী, পাক-ই-স্তানি জিহাদীপ্রেমী মানুষটি শুধু নিজের লাভের জন‍্য এসব অপকর্ম করে গেছেন এবং যাদের হয়ে কাজ করেছেন, তাদের বাহবা কুড়িয়েছেন। ওঁর ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির প্রয়োগ ভারতসহ কোনো দেশেই সাফল‍্য পায়নি। উনি ভারতের নাগরিক নন – খুব সম্ভবতঃ OCI (বিদেশে বসবাসকারী জন্মসূত্রে ভারতীয়) উনি ভারতের ভোটার নন। যদি ওনার প্রকৃত মালিকদের অঙ্গুলীহেলন ছাড়া উনি এসব মন্তব‍্য করে থাকেন তবে ওনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসার আছে – ১৯৪৬ এর কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গায় উনি হিন্দু বাঙ্গালী নিধন, হিন্দু নারী ধর্ষণের মত ঘটনা দেখেননি কেন? ওনার কোন বক্তব‍্য বা লেখায় তার উল্লেখ নেই কেন? কেন কাদের মিয়ার নামে মিথ‍্যা গল্প ফেঁদেছিলেন? উনি কাশ্মীরী পন্ডিতদের উপর জিহাদী ইসলামি অত‍্যাচারের ব‍্যাপারে নিশ্চুপ কেন, বিশেষতঃ যখন ভারত বিরোধী কাজের জন‍্য গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদীদের প ক্ষে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন? সর্বোপরি বালাকোটের স্ট্রাইকের নিন্দা করলেও উনি কেন পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাদের উপর আক্রমণের বিষয়ে মৌণ থেকেছেন? উনি যখন এতটাই পাক-ই-স্তান প্রেমী অর্থনীতিবিদ, তখন ওনার প্রিয় পাক-ই-স্তানকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচানোর জন‍্য উনি কি করেছেন?
আসলে এই অমর্ত‍্য সেন একটি “মাকাল ফল” যিনি এমন অর্থনীতিবিদ যাঁর নীতি কোন দেশেই সাফল‍্য পায়নি! তিনি বিশেষ মত ও বিশেষ ধর্ম ব‍্যবসায়ীদের এজেন্সী নিয়ে কাজ করেছেন আর তাদের থেকে সমস্ত রকম সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু এখন ভারতে ওনার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবনার “গুরুঠাকুরদের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতার কারনে তারা ওনাকে আর আগের মত সুবিধা দিতে পারছে না!
উনি যখন বিশ্বভারতীর জমি আত্মসাৎ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন, যেখানে ১৩ দশক জমি LR রেকর্ড অনুযায়ী জবর দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠল, তখন তিনি অন‍্য খেলা শুরু করলেন! ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের মনে চরম দাগা দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর স্তুতি শুরু করলেন! বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এবং মমতাদেবী রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সর্বদা রণংদেহী মূর্তিতে থাকায় অমর্ত‍্যবাবু মমতাদেবীকে ব‍্যবহার করলেন! আগ বাড়িয়ে, অযাচিতভাবে মমতাদেবীর মনের ঐকান্তিক বাসনাকে উস্কে দিয়ে তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে বললেন, মমতাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ‍্যতম ব‍্যক্তি! মনে রাখা দরকার, অমর্ত‍্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার, ভারতের নয়। আবার লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, বাস্তবের সঙ্গে যতই তফাৎ থাকুক, তিনি সর্বদা তাঁর বক্তব‍্যকে আত্মবিশ্বাসের অভিনয়ের সঙ্গেপেশ করেন! এখানেও তার ব‍্যত‍্যয় হল না। এতে যেমন তিনি মমতা ব‍্যানার্জীকে টোপে গাঁথলেন, তেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে অপাংক্তেয় কম‍্যুনিস্টদের মনে চরম দাগা দিলেন। এতে স্বার্থের জন‍্য যে কোন লাইন নেবার চরম সুবিধাবাদী চরিত্র প্রকট হল। মমতাদেবী বিতর্কিত জমির রাজ‍্যসরকারের ‘পর্চা’ নিয়ে নিজে গিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যমকে সাক্ষী রেখে অমর্ত‍্যবাবুকে পৌঁছে দিলেন! অযৌক্তিকভাবে রাজ‍্যসরকারের খরচে এই বিদেশী নাগরিকের জন‍্য Z ক‍্যাটাগরির নিরাপত্তার ব‍্যবস্থা করলেন – কেন? তাঁকে কেউ কি হুমকি দিয়েছে? জানা নেই! আশ্চর্যের কথা, এই পরচায় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তোলা জমি বিতর্কের মিমাংসা হল না। LR এর রেকর্ড অনুযায়ী অমর্ত‍্যর বাবা আশুতোষ সেনকে বিশ্বভারতী ১২৫ দশক জমি ‘লিজ’ দেয়। আমাদের দেশের আইনে ‘লিজ’ দেওয়া জমির মালিকানা কখনো উপভোক্তার উপর বর্তায় না। ‘লিজ’ বংশ পরম্পরায় স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয় না যদি বিশেষভাবে তা লিজ দলিলে উল্লেখিত না থাকে – মালিকের (এক্ষেত্রে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ) লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, ২৪শে জানুয়ারী,২০২৩ এর চিঠিতে অমর্ত‍্যর পিতা আশুতোষ সেনকে ‘লিজ’ দেওয়া জমির পরিমাণ ১২৫ দশক (প্লট নং ১৯০০, সুরুল মৌজা)। এই ‘লিজ’ দেওয়া হয় ২৭শে অক্টোবর, ১৯৪৩, যা অমর্ত‍্য সেনের নামে ২০০৬ সালে মিউটেশান হয়।
সুতরাং এটা ঠিক যে, অমর্ত‍্য সেনের বাড়িসহ জমির পরিমাণ ১২৫ দশক। কিন্তু বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী অমর্ত‍্য ঐ দাগে যে জমি ভোগ দখল করছেন তার পরিমাণ ১৩৮ দশক! এজন‍্য বিশ্বভারতী যৌথ সার্ভের কথা বলেছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপর অমর্ত‍্য কোন পদক্ষেপ না করে, মমতাদেবী ১৩৮ দশক জমির পর্চা নিয়ে সরাসরি হাজির হলেন অমর্ত‍্যবাবুর কাছে! অমর্ত‍্যবাবুও দেখলেন, রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীকে এই ঘটনায় জড়াতে পারলে তাঁর জমি-বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়া যাবে! এই আশাতেই তিনি প্রথমে মূখ‍্যমন্ত্রীর প্রশংসা করে তাঁকে বিতর্কে জড়ালেন – এতে মমতাদেবী ফেঁসে গেলেন! কিভাবে?
একটু লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, রাজ‍্য-সরকার জমির যে পর্চা তৈরী করেছে তা ১৩৮ দশকের। অর্থাৎ, রাজ‍্য-সরকার স্বীকার করছে যে অমর্ত‍্য ১৩৮ দশক জমি ভোগদখল করছেন! এই পরিমাণ জমি দলিলে উল্লিখিত ১২৫ দশকের থেকে ১৩ দশক বেশী। এই অতিরিক্ত জমির জন‍্য কোন দলিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ (লিজ দাতা) বা অমর্ত‍্য সেন (লিজ গ্রহীতা) কারো কাছে নেই। মমতাদেবীর দেওয়া কাগজ বকলমে বিশ্বভারতীর দাবীকেই মাণ‍্যতা দিল। আসলে লিজ-হোল্ড জমির পরিমাণ স্থির হয় লিজ-ডিড এর ভিত্তিতে। এই রেকর্ড অনুযায়ী তা ১২৫ দশকের। তা হলে অমর্ত‍্যবাবুর কাছে আরো ১৩ দশকের লিজ-ডিড থাকার কথা। সেটা দেখালেই ত সব বিতর্ক শেষ – অন‍্যথায় ওঁর দখলদারি আইনি স্বীকৃতিহীন বলতে হবে। এদিকে মমতাদেবীর দেওয়া কাগজ প্রমাণ করে দিল যে অমর্ত‍্যবাবু আদতে ১৩৮ দশক জমি দখলে রেখেছেন। এবার, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এবং রাজ‍্য-সরকার কি পদক্ষেপ নেয় তার উপর লিজ-হোল্ড জমির মালিকানা ও ভোগদখল নির্ভর করবে। আশা করব, দেশের আইন অনুযায়ী এ ব‍্যপারে দ্রুত ব‍্যবস্থা নেওয়া হবে।