অমর্ত‍্য সেন ও কিছু অপ্রিয় সত‍্য

এই লেখাটি লেখার আগে বহুবার ভেবেছি – লিখব কি না! কারন এখানে যে পরিমাণ কাদা ঘাঁটতে হবে তা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবু অনেক পাঠক, শুভানুধ‍্যায়ীর সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রাখলাম – অবশ‍্যই কোন ইজম, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ব‍্যক্তিগত সম্পর্কের আলো ব‍্যতিরেকে এই উপস্থাপনা। হয়ত ডান,বাম সহ সব “বুদ্ধিজীবীর ঘুমন্ত বিবেক জাগবে না, তবে, নিঃশব্দ চিড়বিড়ানি হবেই!
“বিশ্ববিখ‍্যাত” অর্থনীতিবিদ অমর্ত‍্য সেন একজন জ্ঞানী,গুণী ব‍্যক্তি। এই প্রাজ্ঞ মানুষটি এই দেশে ত বটেই, বিদেশেও সুপরিচিত। বহু মানুষ তাঁর যে কোন বক্তব‍্য বা কাজের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েন! সেই সুযোগে এই নবতিপর মানুষটি সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মত সর্ব বিষয়ে তাঁর “বিশেষজ্ঞ” পরামর্শ অর্থাৎ বক্তব‍্য দিয়ে থাকেন! তাঁর এই মন্তব‍্য থেকে, যা অনেক ক্ষেত্রেই আলটপকা মনে হয়, অনেকে তাঁকে দার্শনিক বলে থাকেন! তাঁর দর্শন শাস্ত্রের উপর কোন লেখা আমার জানা নেই। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র বলা হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পরীক্ষাতেই তিনি কিন্তু প্রথম স্থান পাননি! প্রথম হতেন সুখময় চক্রবর্তী। এই সুখময়বাবু পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস‍্য হয়েছিলেন। তিনি অমর্ত‍্যর মত রাজনৈতিক মতামত পোষণ করা এবং অযথা সব জায়গায় মন্তব‍্য করতেন না। অমর্ত‍্য সেনের “নোবেল স্মারক পুরস্কার” পাওয়া যে ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির জন‍্য, তার সঠিক প্রয়োগে পৃথিবীর কোন দেশ সাফল‍্য পেয়েছে বলে জানা যায় না!
এই পুরস্কারকে অনেকে নোবেল পুরস্কার বলে ভুল করেন! আসলে অর্থনীতির উপর এই পুরস্কার এবং তার অর্থমূল‍্য বহন করে Sveriges Riksbank of Sweden যা এখন Bank of Sweden নামে পরিচিত।আলফ্রেড নোবেলের ট্রাস্টের থেকে পাঁচটি মৌলিক বিষয়ে – পদার্থবিদ‍্যা, রসায়ন, শারীরবিদ‍্যা বা চিকিৎসাবিদ‍্যা, সাহিত‍্য এবং শান্তি – এর উপর প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এর প্রাপকরা একটি বিষয়ে সর্বাধিক তিনজন এই পুরস্কার ভাগ করে নিতে পারেন। পুরস্কার প্রাপকরা নামের শেষে NL লেখার অধিকার পান। অর্থনীতির এই পুরস্কার বিজ্ঞানের প্রয়োগের সার্থকতার উপর দেওয়া হয় না। অর্থনীতির পুরস্কার নোবেলেরস্মৃতিতে দেওয়া হয় আর তার প্রাপকরা NL লেখার অধিকারী নন। এটা ঠিক যে অমর্ত‍্য সেন কখনো নিজের নামের পাশে NL লেখেননি। অতি সম্প্রতি তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি নোবেল পাননি। তবে আমাদের দেশের অপরিণত সংবাদ-মাধ‍্যম জোশ দেখিয়ে তাঁকে NL বানিয়েছে! যাক সে কথা। অমর্ত‍্য সেন সম্পর্কে বলতে গেলে একটি কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। তিনি অর্থনীতির যে তত্ত্ব দিয়েছেন তার প্রয়োগে কোথাও সার্থকতা পাওয়া না গেলেও তিনি তাঁর কয়েকটি ধারনার উপর বরাবর আস্থাশীল থেকেছেন! প্রথম, সর্বদা বিতর্কিত মন্তব‍্য করলেও কম‍্যুনিস্টদের সব রকম ভারত বিরোধী ধারনাকে মদত দেওয়া, যার প্রতিদানে কম‍্যুনিস্ট ও তাদের সহযোগী কংগ্রেসের থেকে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা পাওয়া তাঁর প্রাপ্তির রেকর্ড ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। যেখানে যখন যে রাজনৈতিক দল তাঁকে হাইলাইট করেছে, সেখানে তিনি তাদের স্বপক্ষে বক্তব‍্য রেখেছেন! ভদ্রলোক সারা জীবনে যা ডিগ্রি বা উপাধি পেয়েছেন তার শতকরা নব্বইভাগ সাম্মাণিক! ভারত-বিরোধী কম‍্যুনিস্টদের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তাদের সাহায‍্যে ভেসে থাকা কংগ্রেসের আমলে অমর্ত‍্য তাঁর আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান “ভারতরত্ন” পেয়েছিলেন! আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন, দেশের জন‍্য কোন অবদানের স্বীকৃতিতে তিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন? এর ফলে, কেউ সম্মানিত হল না, “ভারতরত্ন” সম্মানের মান খোয়ালো। একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয়, তাঁর অর্থনীতির বই এবং ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির প্রয়োগে সাফল‍্যের কারনে অন্ততঃ তাঁকে “ভারতরত্ন” দেওয়া হয়নি! এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রয়াত ইভা কলরনির নামে যে ট্রাস্ট তৈরী করেছেন, সেখানে বক্তৃতা দেবার জন‍্য আহ্বান করেন ভারতের অরুন্ধতী রায়কে!অরুন্ধতী রায় কত বড় অর্থনীতিবিদ তা মানুষ না জানলেও তাঁর ঘোষিত হিন্দু-বিদ্বেষ এবং জিহাদী ভারত-বিরোধীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তাঁকে অমর্ত‍্যবাবুর কাছে যোগ‍্য বক্তা করে তুলেছে! অমর্ত‍্য সেন ২০১৪ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত বিষোদ্গার করার পর ২০১৫ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টারের “পদ” থেকে ইস্তফা দেন। এই পদে তাঁকে বসায় কংগ্রেস সরকার। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টারের ভূমিকায় অমর্ত‍্য সেনের কাজ যথেষ্ট বিতর্কিত। আসলে তিনি সর্বদা তাঁর কথাবার্তা এবং কাজকর্মে বিতর্ক তৈরী করেছেন, যা সুনিপুণভাবে তাঁর উচ্চাকাঙ্খাকে মদত দিয়েছে। ব‍্যক্তিগত জীবনকেও তিনি একই কায়দায় উন্নতির সোপান হিসেবে ব‍্যবহার করেছেন। তাঁকে সবচেয়ে কম বয়সে (২৩ বছর) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ‍্যাপক করে আনা হয় বিশেষতঃ তদানীন্তন মূখ‍্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ইচ্ছায়। তাঁর গবেষণায় যে দারিদ্র দূরীকরনের দাওয়াই বাতলানো হয়েছে তা তাঁর অন্ধ মার্কসীয় দর্শনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাঁর Poverty and Famines : An Essay on Entitlement and Deprivation (১৯৮১) বইয়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারন হিসেবে বন্টনগত সমস‍্যার কথা তুলে ধরা তাঁর একমাত্র উল্লেখযোগ‍্য কাজ! তিনি তাঁর অর্থনীতির জ্ঞান ও খুরধার দার্শনিক বুদ্ধির প্রয়োগে এই উপমহাদেশে অর্থনৈতিক অসাম‍্য দূরীকরনের দিশা দেখাতে ব‍্যর্থ। একসময় তাঁকে নিয়ে এদেশে শাসক ও বিরোধী বহু রাজনীতিক উদ্বাহু নৃত‍্য করলেও অন‍্য কোন দেশে তাঁর “জ্ঞান” নেবার চাহিদা না থাকায় তিনি এই দেশে এমনভাবে তাঁর “বাণী” দেন যে তাঁর ব‍্যক্তিগত সুবিধা ও বিশেষ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সুবিধা হয়! এভাবেই তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে ভেসে থাকার চেষ্টা করেন। ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের কারন সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক কাজ প্রশংসা পেলেও পরবর্তীতে তিনি ভারতভাগের আগের ১৯৪৬ এর হিন্দু-নিধনের সময়ের সময়ে এক ব‍্যতিক্রমী ঘটনা – কাদের মিয়ার ছুরিকাহত হয়ে মৃত‍্যুর কারন অনুসন্ধানে সর্বৈব অসত‍্য এক propagandist তত্ত্ব আরোপ করেন! তাঁর সব কাজের পিছনে উদ্দেশ‍্য থাকে – ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ গোষ্ঠী এবং বিশেষ রাজনৈতিক মতকে প্রোমোট করা। বিনিময়ে এই গোষ্ঠী তাঁকে মাথায় তুলে নাচতে থাকে। এদের অবদানেই আজ তিনি দার্শনিক হিসেবে সুপারম‍্যান! সেজন‍্য তিনি ১৯৪৬এর দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং এবং নোয়াখালী হিন্দুগণহত‍্যার মত ঐতিহাসিক তথ‍্যকে বিকৃত করার দুঃসাহস দেখাতে পারেন! তাঁর উয়ারির বাড়ির সামনে ছুরিকাহত কাদের মিয়ার মৃত‍্যু তাঁকে এতটাই ভাবায় যে তিনি তার জন‍্য সম্পন্ন হিন্দুদের শোষণ এবং মুসলমানদের দারিদ্রকে দায়ী করেন! হিন্দুদের দ্বারা শোষনের জন‍্যই নাকি ইসলামী প্রতিবাদে সংঘর্ষ! বাঃ…..! কাল্পনিক গল্প হল অর্থনৈতিক তত্ত্ব। ঐ সময়ে ঐ পাড়ায় থাকা এক বৃদ্ধের (এখনো জীবিত) মুখে শুনেছি কাদেরের পিঠে দাঙ্গার সময় আঁচড় লেগেছিল এবং সেই ঘটনার বহু বছর পরেও সে ঐ অঞ্চলে হিন্দুসহ অনেক বাড়িতেই মুনিষ খাটার কাজ করত! এভাবেই অমর্ত‍্য লোক ঠকানো গল্প করে সমাজে বিষ ঢালার চেষ্টা চালিয়েছেন! এমন উগ্র সমর্থনের পরেও পূর্ব-পাক-ই-স্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) উয়ারির মানিকগঞ্জে তাঁর দাদামশাই ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়ি কেন শত্রু সম্পত্তি ঘোষনায় আত্মসাৎ করা হল তা ঐ দেশের সরকার দুরের কথা, অমর্ত‍্য সেন নিজেও কখনো বলেননি!
Keynesian অর্থনীতির বিপরীতে হেঁটে তিনি যত না বিখ‍্যাত, তার চেয়ে অনেক বেশী পরিচিত হয়েছেন জিহাদী ও উগ্র মার্কসীয় দর্শনের সমর্থক হিসেবে অন্ধ ভারত-বিদ্বেষের কারনে। তিনি হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদের বিরোধীতা করতে গিয়ে জিহাদী, দেশ বিরোধী কম‍্যুনিস্টদের হাই-প্রোফাইল দালালের কাজ করেছেন! ২০১৯ সালে যখন অশান্ত কাশ্মীরে কার্ফু জারি করা হয়, তখন তিনি বিবৃতি দেন – “As an Indian, I am not proud of the fact that India, after having done……..we lose that reputation on the grounds of action that have been taken”। তিনি কাশ্মীরিদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলেন, “a classical colonial excuse”! এই ভারত-বিদ্বেষী, পাক-ই-স্তানি জিহাদীপ্রেমী মানুষটি শুধু নিজের লাভের জন‍্য এসব অপকর্ম করে গেছেন এবং যাদের হয়ে কাজ করেছেন, তাদের বাহবা কুড়িয়েছেন। ওঁর ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির প্রয়োগ ভারতসহ কোনো দেশেই সাফল‍্য পায়নি। উনি ভারতের নাগরিক নন – খুব সম্ভবতঃ OCI (বিদেশে বসবাসকারী জন্মসূত্রে ভারতীয়) উনি ভারতের ভোটার নন। যদি ওনার প্রকৃত মালিকদের অঙ্গুলীহেলন ছাড়া উনি এসব মন্তব‍্য করে থাকেন তবে ওনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসার আছে – ১৯৪৬ এর কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গায় উনি হিন্দু বাঙ্গালী নিধন, হিন্দু নারী ধর্ষণের মত ঘটনা দেখেননি কেন? ওনার কোন বক্তব‍্য বা লেখায় তার উল্লেখ নেই কেন? কেন কাদের মিয়ার নামে মিথ‍্যা গল্প ফেঁদেছিলেন? উনি কাশ্মীরী পন্ডিতদের উপর জিহাদী ইসলামি অত‍্যাচারের ব‍্যাপারে নিশ্চুপ কেন, বিশেষতঃ যখন ভারত বিরোধী কাজের জন‍্য গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদীদের প ক্ষে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন? সর্বোপরি বালাকোটের স্ট্রাইকের নিন্দা করলেও উনি কেন পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাদের উপর আক্রমণের বিষয়ে মৌণ থেকেছেন? উনি যখন এতটাই পাক-ই-স্তান প্রেমী অর্থনীতিবিদ, তখন ওনার প্রিয় পাক-ই-স্তানকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচানোর জন‍্য উনি কি করেছেন?
আসলে এই অমর্ত‍্য সেন একটি “মাকাল ফল” যিনি এমন অর্থনীতিবিদ যাঁর নীতি কোন দেশেই সাফল‍্য পায়নি! তিনি বিশেষ মত ও বিশেষ ধর্ম ব‍্যবসায়ীদের এজেন্সী নিয়ে কাজ করেছেন আর তাদের থেকে সমস্ত রকম সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু এখন ভারতে ওনার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবনার “গুরুঠাকুরদের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতার কারনে তারা ওনাকে আর আগের মত সুবিধা দিতে পারছে না!
উনি যখন বিশ্বভারতীর জমি আত্মসাৎ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন, যেখানে ১৩ দশক জমি LR রেকর্ড অনুযায়ী জবর দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠল, তখন তিনি অন‍্য খেলা শুরু করলেন! ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের মনে চরম দাগা দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জীর স্তুতি শুরু করলেন! বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এবং মমতাদেবী রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সর্বদা রণংদেহী মূর্তিতে থাকায় অমর্ত‍্যবাবু মমতাদেবীকে ব‍্যবহার করলেন! আগ বাড়িয়ে, অযাচিতভাবে মমতাদেবীর মনের ঐকান্তিক বাসনাকে উস্কে দিয়ে তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে বললেন, মমতাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ‍্যতম ব‍্যক্তি! মনে রাখা দরকার, অমর্ত‍্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার, ভারতের নয়। আবার লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, বাস্তবের সঙ্গে যতই তফাৎ থাকুক, তিনি সর্বদা তাঁর বক্তব‍্যকে আত্মবিশ্বাসের অভিনয়ের সঙ্গেপেশ করেন! এখানেও তার ব‍্যত‍্যয় হল না। এতে যেমন তিনি মমতা ব‍্যানার্জীকে টোপে গাঁথলেন, তেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে অপাংক্তেয় কম‍্যুনিস্টদের মনে চরম দাগা দিলেন। এতে স্বার্থের জন‍্য যে কোন লাইন নেবার চরম সুবিধাবাদী চরিত্র প্রকট হল। মমতাদেবী বিতর্কিত জমির রাজ‍্যসরকারের ‘পর্চা’ নিয়ে নিজে গিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যমকে সাক্ষী রেখে অমর্ত‍্যবাবুকে পৌঁছে দিলেন! অযৌক্তিকভাবে রাজ‍্যসরকারের খরচে এই বিদেশী নাগরিকের জন‍্য Z ক‍্যাটাগরির নিরাপত্তার ব‍্যবস্থা করলেন – কেন? তাঁকে কেউ কি হুমকি দিয়েছে? জানা নেই! আশ্চর্যের কথা, এই পরচায় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তোলা জমি বিতর্কের মিমাংসা হল না। LR এর রেকর্ড অনুযায়ী অমর্ত‍্যর বাবা আশুতোষ সেনকে বিশ্বভারতী ১২৫ দশক জমি ‘লিজ’ দেয়। আমাদের দেশের আইনে ‘লিজ’ দেওয়া জমির মালিকানা কখনো উপভোক্তার উপর বর্তায় না। ‘লিজ’ বংশ পরম্পরায় স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয় না যদি বিশেষভাবে তা লিজ দলিলে উল্লেখিত না থাকে – মালিকের (এক্ষেত্রে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ) লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, ২৪শে জানুয়ারী,২০২৩ এর চিঠিতে অমর্ত‍্যর পিতা আশুতোষ সেনকে ‘লিজ’ দেওয়া জমির পরিমাণ ১২৫ দশক (প্লট নং ১৯০০, সুরুল মৌজা)। এই ‘লিজ’ দেওয়া হয় ২৭শে অক্টোবর, ১৯৪৩, যা অমর্ত‍্য সেনের নামে ২০০৬ সালে মিউটেশান হয়।
সুতরাং এটা ঠিক যে, অমর্ত‍্য সেনের বাড়িসহ জমির পরিমাণ ১২৫ দশক। কিন্তু বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী অমর্ত‍্য ঐ দাগে যে জমি ভোগ দখল করছেন তার পরিমাণ ১৩৮ দশক! এজন‍্য বিশ্বভারতী যৌথ সার্ভের কথা বলেছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপর অমর্ত‍্য কোন পদক্ষেপ না করে, মমতাদেবী ১৩৮ দশক জমির পর্চা নিয়ে সরাসরি হাজির হলেন অমর্ত‍্যবাবুর কাছে! অমর্ত‍্যবাবুও দেখলেন, রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীকে এই ঘটনায় জড়াতে পারলে তাঁর জমি-বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়া যাবে! এই আশাতেই তিনি প্রথমে মূখ‍্যমন্ত্রীর প্রশংসা করে তাঁকে বিতর্কে জড়ালেন – এতে মমতাদেবী ফেঁসে গেলেন! কিভাবে?
একটু লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, রাজ‍্য-সরকার জমির যে পর্চা তৈরী করেছে তা ১৩৮ দশকের। অর্থাৎ, রাজ‍্য-সরকার স্বীকার করছে যে অমর্ত‍্য ১৩৮ দশক জমি ভোগদখল করছেন! এই পরিমাণ জমি দলিলে উল্লিখিত ১২৫ দশকের থেকে ১৩ দশক বেশী। এই অতিরিক্ত জমির জন‍্য কোন দলিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ (লিজ দাতা) বা অমর্ত‍্য সেন (লিজ গ্রহীতা) কারো কাছে নেই। মমতাদেবীর দেওয়া কাগজ বকলমে বিশ্বভারতীর দাবীকেই মাণ‍্যতা দিল। আসলে লিজ-হোল্ড জমির পরিমাণ স্থির হয় লিজ-ডিড এর ভিত্তিতে। এই রেকর্ড অনুযায়ী তা ১২৫ দশকের। তা হলে অমর্ত‍্যবাবুর কাছে আরো ১৩ দশকের লিজ-ডিড থাকার কথা। সেটা দেখালেই ত সব বিতর্ক শেষ – অন‍্যথায় ওঁর দখলদারি আইনি স্বীকৃতিহীন বলতে হবে। এদিকে মমতাদেবীর দেওয়া কাগজ প্রমাণ করে দিল যে অমর্ত‍্যবাবু আদতে ১৩৮ দশক জমি দখলে রেখেছেন। এবার, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এবং রাজ‍্য-সরকার কি পদক্ষেপ নেয় তার উপর লিজ-হোল্ড জমির মালিকানা ও ভোগদখল নির্ভর করবে। আশা করব, দেশের আইন অনুযায়ী এ ব‍্যপারে দ্রুত ব‍্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভারতের হিমালয়ান ব্লান্ডার

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে ভারতের তদানীন্তন নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ব‍্যর্থতা দেখা গিয়েছিল – এখনো সারা দেশ তার খেসারত দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে ভুলের কথা বলা হয়েছে। দেশের বর্তমান প্রজন্ম আমাদের এই সীমান্ত সমস‍্যা বিষয়ে সম‍্যক অবহিত নয় – তার সবচেয়ে বড় কারন হল, দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমের সংবাদ পরিবেশনের সময় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অপেক্ষা আভ‍্যন্তরীন বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া!
স্বাধীনতার পর ভারত পঞ্চশীল নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে চীনকে অযাচিতভাবে পরম বন্ধু মনে করে তার সঙ্গে সখ‍্যতা স্থাপনের জন‍্য রাষ্ট্রসংঘে চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস‍্য করার পক্ষে সওয়াল করে! আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে সর্বদা দেওয়া-নেওয়ার ব‍্যাপার থাকে। এক্ষেত্রে চীন কি দিয়েছে তা কেউ জানে না! ১৯৫৯ সালে তিব্বতে পূর্ণ দখলদারি কায়েম করার পর চীন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ১৯৬২ সালে বিনা প্ররোচনায় ভারত আক্রমণ করে। ভারতের কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সেই আক্রমণে তারা ভারতকে পর্যুদস্ত করে আকসাই চীন সহ NEFAর অনেকটা এলাকা দখল করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রথম থেকেই তাদের বিস্তারধর্মী আগ্রাসী নীতিতে নতুন নতুন এলাকা দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ঐ আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল যে আকসাই চীন সহ বর্তমান অরুনাচল প্রদেশ যা তদানীন্তন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত ছিল, পুরোটাই নাকি চীনের অংশ! এর স্বপক্ষে চীনের একমাত্র যুক্তি ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি! এভাবে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ভুলের সুবিধা নিয়ে চীন যা করেছে তাকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। একথা বলা বাহুল‍্য, সে সময়ের ভারতের পররাষ্ট্র নীতি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরনে জওহরলাল নেহরুর অনীহা চীনকে ভারত আক্রমণের সাহস জুগিয়েছিল।
অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে, তিব্বত একটি রুক্ষ, পার্বত‍্য জায়গা যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মেই চীনের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আসে! এ বিষয়ে অপপ্রচার ও ক্ষেত্র বিশেষে মৌনতার কারনে যে ভুল ধারনা জন্মেছে তার নিরসনের জন‍্য বলি, তিব্বত ভূখন্ডের আয়তন ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যা চীনের ভূখন্ডের চার ভাগের এক ভাগ এবং ভারতের আয়তনের এক তৃতীয়াংশ। পৃথিবীর উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ হিমালয় এই তিব্বতেই। রাজধানী লাসা। তিব্বতের মোট জনসংখ‍্যা ৬৭ লক্ষ, যার অধিকাংশ বিশেষ মতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মীয় আচার-বিচার চীনাদের থেকে পৃথক। তিব্বতী ভাষাও চীনা ভাষার থেকে আলাদা। এই তিব্বতী জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের কৃষ্টি-সভ‍্যতা ও ধর্মাচরন প্রক্রিয়া চীনাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর থেকে পৃথক। তিব্বতীদের মূল জীবিকা কৃষি ও পশুপালন। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে মূল চীনা ভূখন্ডের কোন সীমানা নেই! ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ আছে তিব্বতের। আমাদের উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দেশগুলি হল – পাকিস্তান, পূর্ব তুর্কিস্তান, তিব্বত, নেপাল, ভূটান ও মায়ানমার। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জন্মের পর থেকেই লক্ষ‍্য ছলে-বলে-কৌশলে তাদের সীমান্তবর্তী দেশগুলিকে ধীরেধীরে আত্মস‍াৎ করা। তাছাড়া, উপমহাদেশে তাদের একচ্ছত্র আধিপত‍্য বিস্তারে একমাত্র বাধা ভারতকে ব‍্যতিব‍্যস্ত রেখে চাপ সৃষ্টি করে স্ট্র‍্যাটেজিক ভূখন্ডের দখল নেওয়া যাতে ভবিষ‍্যতে তাদের সীমানা বিস্তারে সুবিধা হয়। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতায় থাকা নেতারা তা বুঝতে না চাওয়ার খেসারত যেমন তিব্বতকে দিতে হচ্ছে, তেমনি ভারতকেও দিতে হচ্ছে।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে কামডো (Chamdo) দখলের মাধ‍্যমে চীন তিব্বতে তাদের বিক্ষিপ্ত সামরিক অভিযান শুরু করলেও ১৯৫৯ সালের ২৫শে মার্চ চীনা লালফৌজ লাসা দখল করে। তারা তাদের তাঁবেদার পাঞ্চেন লামাকে চতুর্দশ দালাই লামার স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা করলেও সাধারণ তিব্বতীরা তা মেনে নেয়নি। সে সময় যুদ্ধে ৮৭০০০ তিব্বতীর মৃত‍্যু হয় এবং ১০০০০০ তিব্বতী শরণার্থী বিশেষতঃ ভারত, নেপাল ও ভূটানে পালিয়ে যান। দালাই লামা ভারতে এসে হিমাচলের ধরমশালায় তাঁর Government of Tibet in exile গঠন করেন। রাষ্ট্রসংঘ চীনা আগ্রাসনকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করে এবং ভারতের পুরুষোত্তম ট্রিকমদাসের নেতৃত্বে সাত সদস‍্যের (বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ঘানা, ভারত, মালয়, নরওয়ে ও সিয়াম) কমিটি তৈরী করে তিব্বতের উপর রিপোর্ট দিতে বলে। সেই রিপোর্ট মোতাবেক রাষ্ট্রসংঘের সাধারন সভায় ২১শে অক্টোবর, ১৯৫৯ সালে তিব্বতের উপর একতরফা চীনা আগ্রাসন ও সেখানে চীন দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব নেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ‍্য যে, ১৯৬০-৬২ এই দু বছরে শুধু চীনাদের দ্বারা মনুষ‍্য আরোপিত দুর্ভিক্ষে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ তিব্বতী প্রাণ হারান। এই সময় চাপে পরে চীন সরকার ১৯৬৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর স্বশাসিত তিব্বত অঞ্চল (Tibetan Autonomous Region) গঠন করে। এর সর্বেসর্বা হন একজন চীনা নাগরিক যিনি পার্টির উচ্চ নেতৃত্বে থাকেন! তারপর থেকে ক্রমশঃ তিব্বতের উপর চীনের ফাঁস যত শক্ত হতে থাকে, তত তিব্বতীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা চাপা দেওয়া হতে থাকে। ফলে, উপর উপর কিছু লোক দেখানো পরিবর্তন হলেও তিব্বতের উপর চীনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তেই থাকে। তার ফলশ্রুতিতে যে সব প্রতিবাদ আন্দোলন হয়, সেগুলো মধ‍্যযুগীয় বর্বরতায় দমন করা হয়েছে।
আসলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের লক্ষ‍্য হচ্ছে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়া। যখনই চীনে কোন গোষ্ঠীর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ রাখার কৌশল হিসাবে সব সম্রাটই যুদ্ধ ও সাম্রাজ‍্য বিস্তারের মাধ‍্যমে কৃত্রিম চীনা জাতিসত্তা জাগানোর চেষ্টা করেছে। তা এখনো চলছে। এখানে কোন ‘ইজম’ বা তত্ত্ব বড় কথা নয়, আসল ব‍্যাপার হল, বর্তমান চীনা নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নীতির কোন পরিবর্তন না আসা! সামরিক শক্তিতে দূর্বল ও খনিজ সম্পদে ভরপুর তিব্বতকে স্ট্র‍্যাটেজিক দিক থেকে দখল করে চীন ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তিব্বত দখল করা হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগকে মাথায় রেখে! ইতিমধ্যে জওহরলালের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় আকসাই চীনের ৩৬,৮৪৬ বর্গকিলোমিটার জায়গা চীন দখল করে নিয়েছে এবং অরুনাচল প্রদেশের ৯৩,০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাকে শুধুমাত্র গায়ের জোরে তাদের বলে দাবী করে আসছে। বর্তমান ভারত সরকার কড়া হাতে সীমান্ত সংঘর্ষ মোকাবিলা করায় চীনের হানাদারি একটু থমকালেও তাদের পরিকল্পনার কোন পরিবর্তন লক্ষ‍্য করা যায়নি।
মনে হয়, চীনা কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর সব flat noseএর মানুষের বাসস্থানকেই তাদের দেশ বলে দাবী করা মনস্থ করেছে! সেজন‍্য চীনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করা দেশ নেপাল, ভূটান, ভারত, লাওস, মায়নামার (পূর্বতন বার্মা), মঙ্গোলিয়ার ভূখন্ড চীন নিজেদের বলে দাবী করছে! আবার যাদের সঙ্গে স্থল নয়, জলপথে যোগ আছে, যেমন, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রুনেইয়ের উপর চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি দেওয়া হচ্ছে চীনের তরফে! লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, এসব দেশে flat nose জনগোষ্ঠী আছে। এমন মধ‍্যযুগীয় আগ্রাসন নীতির জন‍্য চরম খেসারত দিতে হচ্ছে তিব্বতীদের। তিব্বতীদের দেশপ্রেমজনিত প্রতিবাদকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন‍্য চীন শুধু সামরিক বাহিনীর উপরেই নির্ভর করছে না; তারা তিব্বতে জাতিগত নির্মূলীকরন (ethnic cleansing)এর দিকে এগোচ্ছে। তিব্বতীদের নিজস্ব ধর্মাচরনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। চীন তিব্বতী মোনাষ্টারি বন্ধ করছে। চীনাদের ধর্মাচরন প্রক্রিয়া অনুসরন করা তিব্বতীদের জন‍্য বাধ‍্যতামূলক। স্কুলে তিব্বতী ভাষা শিক্ষা বন্ধ। শুধুমাত্র চীনা ভাষা শিক্ষা ও চীনা ভাষায় পড়াশুনো করার স্বীকৃতি মিলেছে!
তিব্বতে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি ও উন্নত যোগাযোগ ব‍্যবস্থা করে চীন সরাসরি ভারতকে সামরিক চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সর্দার বল্লভভাই প‍্যাটেল নেহরুকে লেখা ১৯৫০ সালের ৭ই নভেম্বরের চিঠিতে দুঃখ করেছিলেন – তিব্বতী জনগণ তাদের স্বাভাবিক বন্ধু ভারতের থেকে যে সাহায‍্য আশা করেছিলেন, তা পুরন করতে ভারত এগিয়ে আসেনি। পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ‍্যায় তিব্বতের স্বাতন্ত্রতা রক্ষা না হলে ভারতের ঐক‍্য ও স্বাধীনতা বিপন্ন হবে বলে ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল মন্তব‍্য করেন। রাজ‍্যসভায় ১৯৫৪ সালে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকার আসল কথাটি বলেন, “যদি ১৯৪৯ সালে চীনকে স্বীকৃতি না দিয়ে ভারত তিব্বতকে স্বীকৃতি দিত, তাহলে আজকে ইন্দো-চীন কোন সমস‍্যাই তৈরী হত না”। এমনকি লোকসভায় ১৯৬০ সালের ১৭ই মার্চ বিরোধী নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেন যে, তিব্বতের উপর চীনের মারণ আক্রমণ ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং, সে সময়ের বিভিন্ন নেতার সতর্কবার্তা পর্যন্ত নেহরু ও তাঁর সরকারকে আত্মঘাতী ভুল রাস্তা থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। এর দায় তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার ও তার কর্নধার নেহরুর উপরেই বর্তায়।
এখন তিব্বতে সর্বদা নূন‍্যতম পাঁচ লক্ষ চীনা সেনা মজুত থাকছে। তাদের অন্ততঃ ১৫টি সামরিক বিমান বন্দর এবং ১৭টি গোপন রাডার তিব্বতের মধ‍্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এছাড়া ৮টি ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি আছে, যেখানে ৭০টি মধ‍্যপাল্লা এবং ২০টি অন্তর্বর্তী পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র মজুত আছে। ৫০টি ভি-স‍্যাট স্টেশন পুরো TAR জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তিব্বতের খনিজ আকরিক উত্তোলন করে চীনের উন্নয়ণ করা হচ্ছে। কিন্তু এই কাজে নিয়োজিত তিব্বতী শ্রমিকদের নূন‍্যতম মজুরী থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে খনিজ সম্পদ আহরনের কারনে পরিবেশের ভারসাম‍্য দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। হিমবাহ গলে যাচ্ছে কিন্তু তথাকথিত কম‍্যুনিস্ট পরিবেশবিদরা নীরব!
তিব্বতের পরিকাঠামোগত উন্নয়ণের নামে চীন তার সামরিক শক্তিকে দ্রুত ভারতের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করছে। ২০০৬ সালে গোর্মো থেকে লাসা রেল যোগাযোগ ব‍্যবস্থা চালু করে চীন তিব্বতের বুকে তার আধুনিক সমরাস্ত্র এনে জড়ো করেছে। পুরো তিব্বত জুড়ে ৫৮,০০০ কিলোমিটার রাস্তা বানানো হয়েছে সামরিক বাহিনীর দ্রুত চলাচলের জন‍্য। চীন ৩২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে আগামী কয়েক বছরে ১,১৮,০০০ কিলোমিটার হাইওয়ে তৈরীর পরিকল্পনা নিয়েছে। তিব্বতের বিমান বন্দর ও রানওয়েগুলির মূখ‍্য উদ্দেশ‍্য শুধু আকাশ পথে তিব্বত শাসনে নজরদারি চালানোই নয়, ভারতের সঙ্গে সম্ভাব‍্য যুদ্ধে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ শহরকেই তারা আকাশ-নিশানায় এনে ফেলেছে। এরপরও চীন আরো উন্নত বিমানবন্দর বানানোর পরিকল্পনা করছে।
এখন ‘গালওয়ান’ সহ সীমান্তে চীনা কার্যকলাপ এবং ভারত সীমান্ত বরাবর চীনের বিভিন্ন নির্মান তৎপরতা ও সেইসঙ্গে তিব্বতের অভ‍্যন্তরে সামরিক বাহিনী পরিবহন করা ও রসদ সরবরাহের তাগিধে সড়ক ব‍্যবস্থার প্রভূত উন্নতিসাধন শুধুমাত্র ভারতের উপর চীনা আক্রমণের উপক্রমনিকা হিসেবেই দেখার কথা!
ডঃ আম্বেদকারের বক্তব‍্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যেতে পারে, এটাও সত‍্যি যে, পশ্চিমী শক্তি, বিশেষতঃ আমেরিকা এবং সর্বোপরি ভারত এখনো তিব্বতীদের নির্বাচিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি! ফলে, রাষ্ট্রসংঘের আর বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা থাকছে না! প্রথমে চীনের যে অজুহাত ছিল – দালাই লামার শাসনব‍্যবস্থায় কিছুমাত্র গণতন্ত্র না থাকা – তা কিন্তু ধর্মশালার তিব্বত সরকারের বর্তমান ব‍্যবস্থার পরিচায়ক নয়। বহু চেষ্টার পরেও এখনো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতী জাতিগোষ্ঠীদের ধর্মীয় নেতার জায়গায় চতুর্দশ অর্থাৎ বর্তমান দালাই লামার স্থান অটুট। তাছাড়া, এই সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। তাঁদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী Rimchen Khandu Khrimey। যদি ভারতীয়রা রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউক্রেনকে বাঁচানোর ব‍্যপারে মনোযোগী হন, তবে একই ভাবে চীনের আগ্রাসন থেকে তিব্বতকে বাঁচানোর চেষ্টায় তাঁদের ব্রতী হওয়ার কথা। এর অবিসম্বাদী ফল হচ্ছে চীন ও ভারতের মধ‍্যে কোন সরাসরি সীমান্ত না থাকলে এবং বন্ধু তিব্বত সরকার পাশে থাকলে চীনের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা অনেক সহজ হবে।
একথা মনে রাখা দরকার, ভারতে বহমান বেশকিছু নদীর উৎসমুখ তিব্বতে এবং সেখানে বিভিন্ন জায়গায় নদীবাঁধ তৈরী করে চীন তার নাশকতামূলক কাজের পরিচয় দিচ্ছে। তারা একদিকে তিব্বতীদের কোথাও শুখা রেখে আর কোথাও কৃত্রিম বন‍্যা বইয়ে তাদের কৃষি-ব‍্যবস্থাকে ধ্বংস করছে, অন‍্যদিকে তাদের এই কাজের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলিতে শুখা ও বর্ষার মরসুমে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে ভারতের অসীম ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করতে পারে। এর ফলে তিব্বতের হিমবাহগুলিকে সংকুচিত করে পরিবেশগত ভারসাম‍্য নষ্ট করা হচ্ছে।
ভারতকে রাষ্ট্রসংঘ এবং পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে মিলিতভাবে একটি কার্যকর, স্থায়ী সমাধান সূত্র বের করে তিব্বতীদের নিজেদের হাতে তাদের ভাগ‍্য-নিয়ন্ত্রনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এই উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন‍্য অতীব জরুরী।

লালন শেখের মৃত‍্যু ও কিছু প্রশ্ন

সংবাদের শিরোনামে বগটুই গ্রামের উঠে আসার কারন ছিল ঐ গ্রামের মহিলা ও শিশুসহ গত ২১শে মার্চ ১০ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার খবর। স্থানীয় বাহুবলী টিএমসি নেতা ভাদু শেখের মৃত‍্যুর বদলা নিতে এই হত‍্যাকান্ড বলে অভিযোগ। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর যখন এই হত‍্যাকান্ডের তদন্তভার উচ্চ আদালতের নির্দেশে CBIএর হাতে গেল, তখন থেকেই টিএমসি ও তাদের সরকারের লোকজন খোলাখুলিভাবে CBI তদন্তভার নেওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এখানে একটি কথা বলা দরকার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই রাজ‍্যে শাসকদল টিএমসির অভিযুক্ত লোকজনদ্বারা খুন,জখম, ভীতি প্রদর্শন ও মারধোরের ঘটনার পুলিশী তদন্তের পর ১% অভিযুক্তেরও শাস্তি হয় না! স্বাভাবিকভাবেই টিএমসি বলে থাকে সব “সাজানো ঘটনা”! গত কয়েকটি নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনায় যত মায়ের কোল খালি হয়েছে, তার ১% এর ক্ষেত্রেও অভিযুক্তর কোন শাস্তি হয়নি – তা তদন্ত CBI বা রাজ‍্যের “দলদাস” পুলিশ – যেই করুক না কেন! ফলত, রাজ‍্যে দুষ্কৃতিদের দাপাদাপি বৃদ্ধিতে প্রশাসনিক অপদার্থতা বা নিস্পৃহতা যে অনেকাংশে দায়ী, তা বলাই বাহুল‍্য।
যাক, ফিরে আসি বগটুই প্রসঙ্গে। CBI ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা এই হত‍্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত লালন শেখকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারে ওই ১০ জন মৃতের পরিবার খুশী হয়, তারা অভিযুক্তের শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নে আশাবাদী হতে থাকে। কিন্তু, CBI হেপাজতে থাকাকালীন গত ১২ই ডিসেম্বর লালন শেখের মৃত‍্যু হয়। CBIএর বক্তব‍্য অনুযায়ী, লালন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত‍্যা করেছে। আর, এই খবর প্রকাশের সঙ্গেসঙ্গে নরকের দরজা খুলে গেছে! লালনের পোস্টমর্টেম করা দেহ তার পরিবার গ্রহণ না করে দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের দাবী জানায় যা কোর্ট মেনে নিয়েছে। লালনের পরিবার লালনকে CBI খুন করেছে বলে রাজ‍্য পুলিশের কাছে FIR করে। পুলিশ সক্রিয়তার সঙ্গে এই FIR নিয়ে তদন্ত শুরু করতে চায়! এই রাজ‍্য পুলিশই টিএমসির বিরোধী রাজনীতির তরতাজা যুবক, যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ পর্যন্ত ছিল না, তাদের রহস‍্যজনক মৃত‍্যুর পর ঝুলন্ত দেহের পোস্টমর্টেম করিয়ে সাথেসাথে আত্মহত‍্যা বলে সিলমোহর দিয়েছে! সে সময় বিরোধীদের কোন অভিযোগ পুলিশ ত দূরের কথা, টিএমসির সর্বাধিনায়িকা পুলিশমন্ত্রী এবং মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় পর্যন্ত রাজ‍্য পুলিশের পক্ষে সাফাই ণগেয়েছেন! এ ধরনের মামলায় যেখানে শাসকদল টিএমসির লোকজন অভিযুক্ত, একজনেরও আদালতে শাস্তি হয়নি! মনে রাখতে হবে, আদালতে কেস সাজানো এবং যথাযত তদন্ত রিপোর্ট পেশের দায়িত্ব রাজ‍্য পুলিশের। তারা যদি এমনভাবে কেস সাজায় যে অপরাধ প্রমাণিত হবে না – তখন আদালতের কিছু করার থাকে না। রাজ‍্যে বিভিন্ন রকমের দুর্ণীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি – এসবের অনেক কারন, যুক্তি থাকতে পারে – এখানে সেসব বিবেচ‍্য নয়। উল্লেখিত পরিসংখ্যান বলছে যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ, এমনকি খুন পর্যন্ত করেও অপরাধী বিশেষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পার পেয়ে বহাল তবিয়তে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে পারে! এর ফলে সমাজে যে বার্তা এসেছে, তা হল, বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে থেকে সমাজবিরোধীরা সমস্ত রকম অপরাধমূলক কাজ করতে পারে! এতে রাজ‍্যের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি না হলেও চরম মাৎসন‍্যায় যে চলছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে বড় রকমের লগ্নি দূরের কথা, সামান্য ছোটখাট ব‍্যবসা করতে গেলে পর্যন্ত এত পরিমাণ “কাটমাণি” দিতে হয়, আখেরে ব‍্যবসা অলাভজনক হয়ে পড়ে!
কলকাতায় এই মূহুর্তে ছোট চার চাকা গাড়ির পার্কিং ফি দশ টাকা প্রতি ঘন্টা। অথচ সব জায়গায় নূন‍্যতম কুড়ি টাকা নেওয়া হচ্ছে! এসব ক্ষেত্রে পুলিশে নালিশ জানানোর বা পৌর-নিগমে নালিশ জানানোর সহজ পন্থা জানা নেই। নিউমার্কেটে রাস্তা জুড়ে হকাররা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ব‍্যবসা করছে। পৌরমন্ত্রী দূরের কথা, রাজ‍্য সরকারের এইসব হকার, যারা আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী বটে, তাদের হটানোর ক্ষমতা নেই! এদের দৌরাত্মে নিউমার্কেটের ভিতরের দোকানগুলির বিক্রিবাটায় মন্দা এসেছে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। যেটা বলার তা হল, এই রাজ‍্য সরকার লুম্পেন, অপরাধী ইত‍্যাদিকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, নেতার মর্যাদা দেওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কাজকর্ম অবাধে চালানোর ইজারা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ “দলদাস” হিসেবে কাজ করায় তাদের কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – পুলিশের মধ‍্যে দুর্ণীতি বাড়ছে, বিশেষতঃ এই সরকারের আমলে চাকরী পাওয়াদের মধ‍্যে। পুলিশ কর্মীরা একাধিক ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকায় তা সংবাদ-মাধ‍্যমে খবর হয়!
এইভাবে প্রশাসনের মদতে রাজনীতির অপরাধকরন ধীরে ধীরে সামাজিক অবক্ষয়ের রূপ নেয়। সাধারণ মানুষ এ সময় ভয় ও অসহায়তায় অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও অস্ট্রিচের মত মাটিতে মুখ গুঁজে থাকে। এভাবে মানুষ ঘৃণা মিশ্রিত অভিব‍্যক্তি নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়। এইভাবে regimented অপরাধমূলক রাজনীতি সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লালন শেখের মৃত‍্যু নিয়ে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রথমেই CBIকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন! অথচ রাজ‍্যের অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর ফাঁস ঝোলানো মৃতদেহকে যখন রাজ‍্যের পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়েছে, তখন একটি ক্ষেত্রেও তিনি পুলিশের বক্তব‍্যে অসঙ্গতি খুঁজে পাননি! লালন শেখের মৃত‍্যুতে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। এতে লাভ কার? নিশ্চয়ই CBIএর নয়, বরং তার কর্তব‍্যে অবহেলায় সুনামের ক্ষতি হবে। এই ব‍্যাপারটা বিশ্লেষন করলে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হবে। বগটুইয়ের ১০ জনকে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে মারার পর প্রথমেই বীরভূমের টিএমসির বেতাজ বাদশা অনুব্রত মন্ডল পুরো ঘটনার দায়িত্ব বিরোধীদের উপর চাপিয়ে সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলেন। এমনকি পুলিশকে সেভাবে এগোতে উপদেশ দেন! এই অনুব্রত এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ধরা পরে জেলবন্দী। অনুব্রতর গ্রেপ্তারকে কটাক্ষ করে তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দলনেত্রী মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়। যাক সে কথা। ভাদু শেখের মত দুষ্কৃতির খুনের বদলা নিতে এই দশজনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগের মূল অভিযুক্ত ছিল এই লালন শেখ। ভাদু টিএমসির নেতা এবং তাকে যারা মেরেছে বলে অভিযোগ, তারাও টিএমসির সমর্থক। লালন ভাদুর অনুগামী বলেই সে বদলা নেওয়ার জন‍্য এই কাজ করে বলে অভিযোগ। অনুব্রতর প্রাথমিক চেষ্টায় বগটুই হত‍্যাকান্ডকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টার মধ‍্যেই পরিষ্কার যে টিএমসি তথা অনুব্রত বগটুই কান্ডের আসল অপরাধীদের আড়াল করে পুরো ব‍্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে। কারন এটি একই সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা সকলেই টিএমসিপির লোক, তাদের দুদলের গোষ্ঠীদ্বন্দের ফল। এভাবে দুষ্কৃতিদের প্রশ্রয় দেওয়ার ফলে যে বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল, এখন তার ফল ফলতে শুরু করেছে। মূল অভিযুক্ত লালন যদি CBIএর কাছে স্বীকারোক্তিতে দলের অন‍্য কোন নেতার নাম বলে দেয় বা অর্থনৈতিক গূঢ় কারন নিয়ে মুখ খোলে তবে দলের বড় নেতা বা নেতাদের অনিবার্য বিপদ হতে পারত। আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে এই অনুসন্ধান বন্ধ করা যাবে না – অনুসন্ধান চলছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং CBI ও অন‍্য অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয় সরাসরি উচ্চ আদালতে রিপোর্ট করছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন ভূমিকা নেই।
লালনের মৃত‍্যুর পরে রাজ‍্য পুলিশের কাছে যে FIR দাখিল করা হয়েছে তা যথেষ্ট সন্দেহজনক! এর উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধে অন‍্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! লালনকে CBI খুন করেছে বলে যে অফিসারের নাম দিয়ে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে সেই সুশান্ত ভট্টাচার্য বগটুইয়ের অনুসন্ধানকারী দলের সদস‍্যই নন! তিনি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে গরুপাচার ও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের অনুসন্ধানকারী দলের IO! সুতরাং CBIএর কোন অফিসারকে কেন ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা জলের মত পরিষ্কার। পরন্তু, ঝাড়খন্ড থেকে যখন CBI লালনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তখন তাকে হত‍্যার অনেক সুযোগ ছিল। CBIএর লালনকে হত‍্যার মোটিভ নেই। আবার বলা হচ্ছে, লালনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যার সময় তার পা নাকি মাটিতে ছুঁয়ে ছিল। এ সম্বন্ধে বলি, বিজেপি কর্মীর দেহ একই রকমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়ার সময় যখন দেখা গিয়েছিল যে মৃতের পা মাটি ছুঁয়ে আছে, তখন রাজ‍্য পুলিশ আত্মহত‍্যার তত্ত্বে অনড় থেকে partial hanging তত্ত্বের কথা বলে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পা মাটিতে ঠেকে থাকলেও একজন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যা করতে পারে। তাড়াহুড়োয় কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে এই FIRএর পক্ষে অ‍্যাকশন নিতে গিয়ে কি সেক্ষেত্রে দোষীকে আড়াল করার দায় রাজ‍্য পুলিশ নিজেদের ঘাড়ে নেবে! লালনকে যখন তদন্তের প্রয়োজনে তার আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে নাকি তার নিকটজনদের কাছে বলেছিল যে CBI তাকে প্রচন্ড মারধোর করেছে! CBI অফিসার ও CISF রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত লালনের পক্ষে এমন কথা বলা অসম্ভব। এটা সর্বৈব মিথ‍্যা – এছাড়া post mortemএ লালনের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই লালনের বিরুদ্ধে যে খুনের প্রধান অভিযুক্তের আরোপ ছিল, তাতে তার মত একজন hardened ক্রিমিনালের পরিবার ও তার পারিপার্শিক জগতের কাছে শিশু সুলভ সরলতা আশা করা যায় না।
বরঞ্চ, লালনের মৃত‍্যুকে ব‍্যবহার করে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার গতি বন্ধ করা বা শ্লথ করার অশুভ চেষ্টা করা যায় তবে কার লাভ তা সবাই বুঝতে পারছে। এই অশুভ শক্তির আশু প্রয়োজন সুশান্ত ভট্টাচার্যকে গরুপাচারের তদন্ত থেকে সরে যেতে বাধ‍্য করা! “রাঘব বোয়াল”কে বাঁচাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে তবে, এই মূহুর্তে রাজ‍্যের যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের এই রাজ‍্যে নির্বাচনে ভরাডুবি অবশ‍্যম্ভাবী। মনে হয় না, ঐ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এমন ভুল করবে। সেজন‍্য অবশ‍্য রাজ‍্যে টিএমসি CBI ও ED বিরোধী আন্দোলনে রাজ‍্য সরকারের মদতের জন‍্য যথাসাধ‍্য চেষ্টা চালাবে। যেভাবে সমাজে অপরাধ ও তা আড়াল করার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ছে, তাতে আসলে মদত পাচ্ছে মাৎসন‍্যায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা বন্ধ করা অসম্ভব।

ভারতের রাজনীতিতে বাঙ্গালী ব্রাত‍্য কেন

বাঙ্গালী বলতে কি শুধু বাংলাভাষী, নাকি পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী (বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র) বোঝায় – এই প্রশ্ন এখন উঠেছে। এর পিছনে একাধিক কারন রয়েছে। প্রথমে বলতে হয়, বাঙ্গালী – বিশেষতঃ হিন্দু বাঙ্গালী – তারা ভারতীয়। যেমন দ্রাবিড় সভ‍্যতা ও সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা প্রবহমান, তেমনি বাঙ্গালী সভ‍্যতা, তার কৃষ্টি, সংস্কৃতির স্বকীয়তা বর্তমান। ভারতের বিভিন্ন রাজ‍্য তথা মানুষের কৃষ্টি, সভ‍্যতা, সংস্কৃতির বিচিত্র বিবিধতা লক্ষ‍‍্যণীয়। এই বিবিধতার মাঝে মিলনের যোগসূত্রকে ধরে রাখার জন‍্য নেতৃত্বের তিনটি গুণের প্রয়োজন – শিক্ষা, দীক্ষা ও মানসিক ঔদার্য। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে থেকেই এই তিন গুণের অভাব নেতৃত্বের মধ‍্যে রয়ে গেছে। ফলে, ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীস্তরে দুটি খন্ডের মানুষের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হল ইসলাম – কারন, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল – এই সত‍্য বৃটিশসহ পরাধীন ভারতের প্রায় সব নেতাই মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি পাক-ই-স্তান নামের মধ‍্যেই এই ধর্মীয় কারনে বিভাজনের পরিচয় পাওয়া যায়। পাক-ই-স্তান অর্থ আল্লার স্থান। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ভারত-বিদ্বেষের মধ‍্যে দিয়ে এই দুই খন্ড তার অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেল। অথচ ভারত হল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’! অর্থাৎ অখন্ড ভারত বিভাজিত হয়ে জনসংখ‍্যার ভিত্তিতে ইসলামীরা পেল দুটি খন্ড আর বিপুল সংখ‍্যাধিক‍্যের হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন ধর্মীয় মানুষদের জন‍্য আলাদা রাষ্ট্র জুটল না। তারা এই দেশীয় নেতৃত্বের জন‍্য ইসলামী এমনকি খ্রীষ্টানদের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ভাগ করে নিতে বাধ‍্য হল। ভারতভাগের সময় দেশীয় নেতৃত্বের Super leader মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং তাঁর চয়নকরা কংগ্রেস নেতৃত্ব – জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প‍্যাটেল ইত‍্যাদির ইচ্ছায় ভারতের সংখ‍্যাগরিষ্ট ধর্মের মানষের জন‍্য কোন রাষ্ট্র রইল না। সে সময়, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর কাছে ডঃ শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় তদানীন্তন বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সমর্থ হন। সেকারনেই জন্ম হয় নতুন রাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গের – বাঙ্গালী হিন্দুদের একমাত্র বাসস্থান, যা পূর্ব পাক-ই-স্তান থেকে আগত হতভাগ্য হিন্দু শরণার্থীদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়।
গান্ধী-নেহরু-প‍্যাটেল কোম্পানি বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য কিছু করেনি। শুধু তাই নয়, গান্ধী, বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য যেমন কোন বাক‍্যব‍্যয় করেননি, তেমনি তিনি কোন বাঙ্গালী নেতার প্রশংসা করেননি। সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি যে ব‍্যবহার করেছেন, তা মোটেই বড় মনের নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে না। এই গান্ধীজীই ছিলেন স্বাধীনতা পর্বে ভারতের বেশীরভাগ নেতার গডফাদার। এমনকি, সর্দার বল্লভ ভাই প‍্যাটেলের দাদা বিঠল ভাইজী খোলাখুলিভাবে সুভাষ চন্দ্র বোসকে সমর্থন করতেন বলে গান্ধীজী বিঠল ভাইয়ের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই গান্ধীকে “most over rated politician” বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর অদ্ভুত যুক্তি – আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও হিংসা বর্জনীয় – ভারত মায়ের অনেক সুযোগ‍্য সন্তানকে হারাতে সাহায্য করেছে! বাঙ্গালী হিন্দুদের এক বৃহৎ অংশ তাঁর অবহেলার কারনে ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়েছেন। এমনকি গান্ধীজীর শিষ‍্যরা, যারা দেশের নেতা, কেউ এই হতভাগ‍্য বাঙ্গালীদের সাহায‍্যে এগিয়ে আসেনি। Clement Attlee,যিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি BBC তে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা কারনগুলি হল – INA ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে তার কর্মচাঞ্চল‍্য, নৌবিদ্রোহ, ভারতের বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের ত্রিখন্ডিত করার যুক্তি মেনে নেওয়া। এক সাক্ষাৎকারে ডঃ বি আর আম্বেদকরও মোটামুটি এই যুক্তিই দিয়েছিলেন। এমনকি, পরবর্তী সময় যখন Attleeকে প্রশ্ন করা হয়, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব কতটা – তখন তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল – “minimal”!
এভাবে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতার বাংলা ও হিন্দু বাঙ্গালীদের প্রতি অবহেলার আবহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বের বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর অবহেলা থেকে উভয় তরফেই এক অবিশ্বাসের বাতাবরন তৈরী হয়। শুধু সুভাষ চন্দ্র নয়, ভারতীয় বিপ্লবের জনক রাসবিহারী বোসেরও সঠিক মূল‍্যায়নে গোবলয়ের নেতৃত্বে থাকা কংগ্রেসীদের অনীহা লক্ষ‍্যণীয়!
এখন হয়ত সময় ও চিন্তা দুইই বদলেছে। পূর্ব তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে বঞ্চনা করা হয়েছে, তা অনেকাংশে শুধরানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু দুটি কারনে এই চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রথমতঃ, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল কেন্দ্রের শাসকদলের বিরোধী; দ্বিতীয়ত, গান্ধীজী ও তাঁর চ‍্যালাদের সহিংস-বিপ্লব এবং সুভাষ বিরোধী মনোভাব সার্বিকভাবে “বাঙ্গালী” বিরোধীতায় রূপ নিয়েছে! একটি ব‍্যাপার খুব অবাক করার মত ; তা হল, বাঙ্গালী দেশপ্রেমিক নেতা সুভাষ চন্দ্রকে সারা ভারতের মানুষ বীরের সম্মানে ভূষিত করলেও কিছু বাঙ্গালী রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করেছে, এমনকি তাঁকে “তোজোর কুকুর” বলা হয়েছে! অথচ যতই গান্ধীজী তাদের চিন্তাধারার পূর্বসূরী না হোন, কোন গুজরাতি মানুষ নেই যিনি গান্ধীজীকে জাতির জনক “বাপুজী” মনে করেন না। এখানে দুঃখজনক সত‍্যিটা হল, ভারতের সব রাজ‍্যের মানুষ নিজেদের “ভারতীয়” বললেও জাতীয় ঐক‍্যের প্রশ্নে নিজের ভাষা, ঐতিহ‍্য, সংস্কৃতির জাতিভিত্তিক চেতনাকে সবার উপরে স্থান দেন! একজন গুজরাতি যদি গুজরাতি, তামিলি যদি তামিলি, ওড়িয়া যদি ওড়িয়া থেকে যান, তাহলে ভারতীয়ত্ত্ববোধ ধাক্কা খেতে বাধ‍্য। বিশেষতঃ রাজনৈতিক নেতারা এমন বোধের শিকার হন, তা কখনোই কাম‍্য নয়।
হয়ত বাঙ্গালী-বিরোধী চিন্তা থেকেই প্রাদেশিকতার জন্ম হলেও দেশের গত একশ বছরের ইতিহাসে বাঙ্গালী হিন্দুদের ভারত বিরোধীতার পরিচয় নেই। যদিও গান্ধীজীর নেতৃত্বে জওহরলাল অ‍্যান্ড কোং বারবার পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবু স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় (২০ বছর) ধরে পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার কংগ্রেসের হাতে ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশী শহিদ হয়েছেন বাঙ্গালী হিন্দু, তারপরের স্থানে পঞ্জাব। অথচ স্বাধীনতার সময়ে ভারতের নেতাদের, বিশেষভাবে কংগ্রেসের, অনুমতিক্রমে এই দুটি রাজ‍্যকে ভেঙ্গে টুকরো করে পাক-ই-স্তানে জুড়ে দেওয়া হল। তারপরেও পঞ্জাবে হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা ভারত সরকার তথা কংগ্রেসের কাছ থেকে যে সাহায‍্য পেয়েছেন, তার ছিটেফোঁটাও বাঙ্গালী হিন্দু শরণার্থীদের কপালে জোটেনি। এমনকি, গান্ধী ও তাঁর কংগ্রেসী নেতৃত্ব বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তভূর্ক্তিতে কোন আপত্তি করেনি। সে সময় শ‍্যামাপ্রসাদ তাঁর পশ্চিমবঙ্গ গঠনের আন্দোলনে গান্ধীজী ও তাঁর কংগ্রেসী অনুচরদের থেকে খোলাখুলি কোন সাহায‍্য, এমনকি সহানুভূতি পাননি। এসবের জন‍্যই এই দুই রাজ‍্য, পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আগুন জ্বললে তার ফয়দা তুলল আঞ্চলিক দলগুলি। কেন্দ্রে পালা বদল হলেও এখনো পশ্চিমবঙ্গের উপর বিমাতৃসূলভ আচরণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে – বলা যাবে না।
যুক্তি, বিপরীত যুক্তি অনেক দেওয়া যায় – তবে আসল সত‍্যিটা হল, গোবলয়ের রাজনীতিকরা এখনো বাঙ্গালী রাজনীতিকদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। এইখানেই গান্ধীজীর ভাবধারার ক্রমধারাবাহিকতা লক্ষ‍্য করা যায়। কংগ্রেসের নেতা গান্ধীজী কিন্তু এখনকার কংগ্রেস বিরোধী ক্ষমতাসীন দলের কাছেও পুজনীয় ব‍্যাক্তি! এইসব কারনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুদের মনে যদি প্রাদেশিকতার ভাব জন্মায়, তবে তা কতটা দোষের! যেভাবে বাঙ্গালী তার দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছে তার দাম গোবলয়ের রাজনীতিকরা দিয়েছেন কি? এমনকি, বাঙ্গালীর দূর্গাপুজাকে গোবলয়ের মানুষ বাঙ্গালীর পুজা-অনুষ্ঠান বলে; আর রামনবমী থেকে শিবাজী উৎসব, করবা চৌথ হয়ে যায় ভারতীয় উৎসব! এ ধরনের বিভেদকামী প্রভূত্ববাদী প্রচার কখনোই সার্থকভাবে দেশাত্মবোধ জাগাতে পারে না। প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট গোবলয়ের পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই বাঙ্গালী হিন্দুদের নিজের সমগোত্রীয় মনে করেনি। ছোটবেলায় কলকাতায় অবাঙ্গালী গোবলয়ের মানুষদের প্রতিবেশী হওয়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, শুধু “মছলিখোর” বলে তারা আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত। শুধু তাই নয়, সামাজিক মেলামেশায় “মছলিখোর” হওয়ার কারনে আমরা তাদের সমাজে ব্রাত‍্য ছিলাম।
ভারতীয়ত্বের যে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক মেলবন্ধনের কথা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী নেতারা বলে থাকেন, তার সারমর্ম হচ্ছে – গোবলয়ের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ – যা আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। “আমার নেতৃত্বে, আমার ধারনার সঙ্গে মিলে তুমি আমার সংস্কৃতি, পোষাক, খাদ‍্যরুচির অনুসরন করলে জাতীয়তাবাদী” – এমন অদ্ভুত ভাবনা কখনোই ধান্দাবাজ চামচা ছাড়া প্রকৃত দেশভক্ত তৈরী করে না। তামিল, বাঙ্গালী, গুজরাতী, মারাঠি, রাজস্থানী ইত‍্যাদির সমন্বয়ে গত ৭৫ বছরেও ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। যদি তা হত, তবে গোবলয়ের বাঙ্গালী বিরোধী, সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরোধী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এখনো গোবলয়ের, বিশেষ ভাবে গুজরাতীদের হিরো হত না। একই সঙ্গে গান্ধী এবং সুভাষকে সম্মান দেখানো রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ওড়িশা, তেলেগু, দ্রাবিড় অঞ্চলে আঞ্চলিক দলগুলির দীর্ঘ দিনের প্রাধান‍্য এই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার ফল!
জাতীয়স্তরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে তিনটি আবশ‍্যিক গুণের কথা বলা হয়েছে, তার অভাব এখনো অনেকাংশে অনুভূত হচ্ছে। এই “মছলিখোর” বিরোধী মানসিকতার প্রতিফলন দেখা গেছে “বাঙ্গালী”র মছলি খাওয়াকে অবজ্ঞাসূচক বিদ্রুপের মধ‍্যে দিয়ে। যদিও পরবর্তী সময়ে ঐ অভিনেতা-কাম-রাজনীতিক বিশ্লেষণাত্মক ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন, তিনি বাঙ্গালী বলতে রোহিঙ্গা (!) ও বাংলাদেশী বলতে চেয়েছেন! এইসব অর্ধ শিক্ষিত প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট নেতারা জানেন না যে স্বর্গীয় অটল বিহারী বাজপেয়ীজীর প্রিয় খাবারের মধ‍্যে “মছলি” ছিল! উচ্চতম নেতৃত্ব সঠিক নেতা চয়ন না করলে দল তথা দেশকে ভুগতে হবে।
এখন রাজনীতিতে নিম্নবর্গীয় নেতৃত্বের কারনে দলীয় নেতৃত্বের কাছে প্রশ্নাতীত আনুগত্য একমাত্র যোগ‍্যতার মাপকাঠি। হয়ত সে কারনেই পশ্চিমবঙ্গের ঐ দলের পক্ষ থেকে এমন বাঙ্গালী বিদ্বেষী উক্তি নিয়ে কোন প্রতিবাদ হয়নি! আরেকটা কারন হতে পারে, বাঙ্গালীদের প্রতি গোবলয়ের অবিশ্বাস তত্ত্বে দলের বঙ্গ নেতাদের বিশ্বাস আছে বলেই তাঁরা এর সমালোচনা করে উচ্চ-নেতৃত্বের বিরাগভাজন হতে চাননি! আবার এর সমালোচনা করতে গিয়ে থেবলা, গাঠিয়া খাওয়া মানুষদের বিদ্রুপ করার ঘটনাও একই রকম নিন্দনীয়। এভাবে প্রাদেশিকতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা করা – এ ব‍্যাপারটা জাতীয়স্তরের শীর্ষনেতৃত্ব খেয়াল রাখলেই মঙ্গল। শুধু বাঙ্গালী নয়, ভারতের রাজনীতির চিরকালীন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভোগলিপ্সা জাতীয় ঐক‍্য ও মূল‍্যবোধের পরিপন্থী কার্যকলাপের জ‍ন‍্য বহুলাংশে দায়ী। যেমন, দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্বে চাপিয়ে দেওয়া প্রবাসী, ভূঁইফোড় বাঙ্গালী নেতাদের যে রাজ‍্যের মানুষ প্রত‍্যাখ‍্যান করেছে তা তাদের নির্বাচনের ফলেই প্রতিভাত। অসমে যোগ‍্য, নতুন দলে আসা অহমীয়া এবং রাজ‍্যে রাজনীতি করা মানুষকে নেতৃত্বে বসিয়ে সাফল‍্য পেলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী নেতৃত্বকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর দল তাদের অপশাসনের কোন কুফল ত ভোগ করছেই না, পরন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধ‍্য হচ্ছে এই রাজ‍্য-সরকারকে সাথে নিয়ে চলতে!
পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সবজান্তা মূর্খ, ধান্দাবাজ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দলের জন-বিচ্ছিন্নতার বড় কারন। ফলে, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ব্রাত‍্য বাঙ্গালীর উত্থান সুদূরপরাহত বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।

রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন নয়

১৯৮৩ সালে ভারত সরকার যে কেন্দ্র-রাজ‍্য সম্পর্কের প্রশ্নে রঞ্জিত সিং সারকারিয়া কমিশন গঠন করে, তারা তাদের পর্যবেক্ষণ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পর তা তৎকালীন এবং পরবর্তী কোন সরকারই গ্রহণ করেনি। কিন্তু এই কমিশনের পর্যবেক্ষণগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ‍্য-সরকার তাদের স্বার্থে ব‍্যবহার করার কথা বলেছে! সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্ট মানতে হলে আমাদের দেশের সংবিধানকে জ্বলাঞ্জলী দিতে হবে! বিশেষতঃ, রাজ‍্যপাল নিয়োগের প্রশ্নে তাঁকে কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করার যে সংবিধান স্বীকৃত পন্থা আছে, তা বদলে রাজ‍্য বিধানসভা তথা রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে রাজ‍্যপাল নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে! কোন রাজ‍্য-সরকার যদি দেশের সংহতির পরিপন্থী এবং সংবিধান বিরোধী কাজ করে, তা হলেও কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান মোতাবেক সেই রাজ‍্য-সরকারকে সরাতে পারবে না! মনে পড়ল, কম‍্যুনিস্ট পার্টির প্রাক্তণ সাধারণ সম্পাদক ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীর তত্ত্ব – যেখানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ বলে দেখানো হয়েছে! এদিকে রাজ‍্য-সরকারগুলি তাদের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে ও উন্নয়ণের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সাহায‍্যের উপর নির্ভরশীল। কিছু রাজ‍্য-সরকারের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বভাব হচ্ছে, একের পর এক প্রকল্পের জন‍্য কেন্দ্র থেকে টাকা নিয়ে তার হিসাব না দেওয়া – এমনকি টাকার Utilization certificate পযর্ন্ত দেওয়া হয় না। এর কারন বহুবিধ। অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম পাল্টে দেওয়া, প্রকল্পের টাকার হিসাব না দেওয়ার বড় কারন হচ্ছে এক খাতের টাকা সম্পূর্ণ অন‍্য খাতে ব‍্যয় করা, প্ল‍্যানড্ ও আন-প্ল‍্যানড্ বাজেটের হিসেব গুলিয়ে ফেলা – সর্বোপরি দুর্ণীতির সুযোগ তৈরী করা!
সারকারিয়া কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করতে হলে বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে রাজ‍্যগুলিকে রক্ষা করা এবং রাজ‍্যগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুসারে তাদের অর্থ প্রদান করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের আর কোন ভূমিকা থাকবে না! রাজ‍্যগুলির কাজকর্মের সঠিক গতি ও পথ নির্ণয়ে রাজ‍্যপালের ভূমিকা বদলে গিয়ে তা রাজ‍্য-সরকার তথা মূখ‍্যমন্ত্রীদ্বারা চয়ন করা একজন “রাবার স্ট‍্যাম্প” হবে মাত্র! এমন অবাস্তব ও সংবিধান-বিরোধী পর্যবেক্ষণের কারনেই স্বাভাবিকভাবে এত বছরে যত সরকার কেন্দ্রে এসেছে, তারা কেউই এই কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি, ব‍্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের কারনে এখনো এই কমিশনের পরামর্শ না মানার জন‍্য কেন্দ্রকে দোষারোপ করে থাকেন। আবার এই নেতারাই যখন কেন্দ্রীয় সরকারে থাকেন, তখন কেউ সারকারিয়া কমিশনের কোন অংশকেই গ্রহণ করার আগ্রহ দেখান না।
সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ কার্যকর না হওয়ার জন‍্যই কেরলের রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খান কেরল সরকারের আইন বিরোধীভাবে সরকারি অর্থ অপচয় করে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ‘পেনশন’ দেওয়ার প্রকল্প নিয়ে আপত্তি করতে পারেন। কেরলে রাজ‍্যের মন্ত্রীরা তাদের ব‍্যক্তিগত কাজের জন‍্য চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে পারেন। এই কর্মীরা যত কম দিন কাজ করুন না কেন, তাঁরা সরকারি স্থায়ী কর্মীদের মত পেনশন পাওয়ার অধিকারী! বামফ্রন্টের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ম চালু আছে! এদের নিয়োগের কোন নির্দিষ্ট যোগ‍্যতা নেই। এরা কোন নির্বাচন পদ্ধতির মধ‍্যে দিয়ে নির্বাচিত নয়! এদের একটাই যোগ‍্যতা – পার্টির লোক এবং মন্ত্রীর ইচ্ছেয় চাকরী করছেন! এদের কাজও রাজনৈতিক স্বার্থ ও রাজনীতিকের স্বার্থ দেখা! এখানে কেরলের মাননীয় রাজ‍্যপাল প্রশ্ন তুলেছেন – সরকারি অর্থ ব‍্যয় করে এইসব রাজনৈতিক কর্মীদের আজীবন পেনশন দেওয়া হচ্ছে কেন? আশ্চর্যের ব‍্যাপার হল, রাজ‍্য-সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে পেনশন পাওয়ার জন‍্য যে নূন‍্যতম বছর চাকরি করার প্রয়োজন, তা এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ‍্য নয়! এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পেনশন দিতে খরচের ব‍্যাপারে কেরলের রাজ‍্যপাল সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ‍্যণীয়, পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন থেকে ধরে বর্তমান রাজ‍্যপাল – কেউ এ ব‍্যাপারে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক কর্মীদের মধ‍্যে বিলি করার নৈতিক অনুমোদন পাওয়া যায় কি? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মীরা, পেনশনভোগী বৃদ্ধ প্রাক্তণ সরকারি কর্মীরা ডিএ না পাওয়ায় যে অর্থকষ্টে ভুগছে, তাদের রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচাল করার জন‍্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে এদের ঘুঁষি মারা হচ্ছে, লাঠিপেটা করা হচ্ছে! অথচ, এমন নীতিবিরুদ্ধ কাজের জন‍্য কোন প্রতিবাদ নেই! তাই, ধন‍্যবাদ মাননীয় রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খানকে। তিনি এব‍্যপারে মুখ খুলেছেন। অথচ, কোন রাজনীতিক এই অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে দলের লোককে সরকারি অর্থ পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রথম শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের হাত ধরে। তারপর তা অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এবার কথা হল, সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক রাজ‍্যপাল নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলে কেরল সরকারের মনোনীত রাজ‍্যপালকখনোই সরকারের এই নীতি বিরুদ্ধ কাজ নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতেন না। আবার পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী দাবী করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের নব-নিযুক্ত রাজ‍্যপাল ডঃ সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়োগের সময় তাঁর পরামর্শ চাওয়া হয়নি! আইন ও সংবিধান মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার কোন রাজ‍্য-সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করে ঐ রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল নিয়োগ করে না।একটি রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ‍্য-সরকারের কাজকর্মের ব‍্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন রাজ‍্যের মানুষের স্বার্থে। তিনি নির্বাচনে জেতা দলীয় প্রতিনিধি নন। রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, রাজ‍্যপালের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব রাজ‍্য-সরকারের উপর। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে রাজ‍্যপালের সক্রিয়তা জরুরী।
অথচ, রাজ‍্য-সরকারের কোন কাজকে সঠিক দিশা দেখানোর জন‍্য যদি রাজ‍্যপাল তাঁর সরকারকে পরামর্শ দেন, তখন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আবার শিক্ষার মানদন্ড না থাকায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন রাজ‍্যের ক্ষমতায় বসেন, তখন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতার সীমা ও এক্তিয়ার সম্পর্কে তাঁরা নিজেরাই বিশেষ অবগত থাকেন না। বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে বলা যায়, সরকারের জন-বিরোধী বা বেআইনি কাজকে যখন কোন রাজ‍্যপাল সামনে এনেছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তখনই সেই রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে সরকার তথা শাসক দলের পক্ষে প্রতিবাদের ঝড় তোলা হয়েছে – অনেক সময় এই প্রতিবাদ শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। এতে হয়ত রাজনৈতিক ফয়দা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
এইভাবে এই রাজ‍্যে হয় রাজ‍্য-সরকারের রাবার-স্ট‍্যাম্প রাজ‍্যপাল অথবা দায়িত্বশীল রাজ‍্যপালের জন‍্য বরাদ্দ হয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির তকমা! লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের; ক্ষতি সাধারণ মানুষের। এখানেও বলতে হয়, সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্টের রাজত্বকালেই রাজ‍্যপালের সঙ্গে অসভ‍্যতা করা শুরু হয়। রাজ‍্যপাল ধর্মবীরার সময় কিভাবে তাঁকে অপমান করা হয়, মিছিল সংঘবদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করা হয় – তা এখনো পশ্চিমবঙ্গের জনগণ মনে রেখেছে। এখন “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী”র রাজত্বে এই নোংরামো বহুগুণ বেড়েছে।
যে রাজ‍্যে বড় কল-কারখানা থেকে ছোট শিল্প, SEZ ইত‍্যাদি ধ্বংস করে রাজ‍্যের মানুষকে ভাতা কেন্দ্রীক জীবন ধারনে বাধ‍্য করা হয়েছে, তার দায় এই রাজ‍্যে বিভিন্ন সময়ে (গত ষাট বছর) শাসন করা রাজনৈতিক দলগুলির। এখন রাজ‍্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই শাসকদলের মদতে একমাত্র ব‍্যবসা হল ‘কাটমানি’ ব‍্যবসা। এইসবের বিরুদ্ধে যে রাজ‍্যপাল সরব হবেন, তাঁকেই শাসক বাহিনীর বিদ্রুপ ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে অপমান সহ‍্য করতে হবে। এর শুরু সেই ধর্মবীরের সময় থেকে। সে সময়ের শাসকদল এখন বিধানসভায় একজনকেও জিতিয়ে আনতে পারে না! কারন, এ রাজ‍্যে শাসকদল শোষকদলে পরিণত হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্ণীতির নাগপাশে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের জন‍্য কেন্দ্রের প্রতিভূ রাজ‍্যপাল যখনই কোন পদক্ষেপ করতে গেছেন, তখনই তাঁকে শাসকদলের সমবেত আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। সেটাই এখন এ রাজ‍্যের রাজনৈতিক ঐতিহ‍্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে রাজ‍্যপালকে কাজ করতে না দেওয়ার কারন একটাই – রাজ‍্যের শাসকদলের দুর্ণীতি কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখার অসৎ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।
আরেকটি রাজনৈতিক কারন এখানে উল্লেখ করা যায় – বিশেষতঃ দেশের গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে। এই রাজ‍্যে ভোটের সময় যত সন্ত্রাস, হিংসাত্মক ঘটনা, খুণ-জখম এবং রক্ত ঝরানোর ঘটনা ঘটে, সারা দেশে তার অর্ধেক হিংসা ঘটে না। ভোট-পরবর্তী হিংসাও এই রাজ‍্যের বিশেষত্ব। এর বেশ কয়েকটি কারন আছে – প্রথমতঃ রাজ‍্যে কর্মসংস্থান ও অর্থ উপার্জনের সুযোগ অত‍্যন্ত সীমিত হওয়ায় রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে অনৈতিক উপায়ে দালালী, কাটমানি ইত‍্যাদি রাজ‍্যের এক বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগারে পরিণত হয়েছে। এখানেও সেই বামপন্থী রাজত্বের থেকে শাসকদলের হয়ে বিভিন্ন রকম প্রচার, তাদের দলের স্বার্থে হিংসাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে বহু মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এ ধরনের কাজে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ‍্য আসায় এবং রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপে পুলিশের ছত্রছায়ায় এই কাজে রিস্ক কম থাকায় বহু অল্প বয়সী ছেলেপিলে একে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে – বিশেষতঃ অন‍্য কাজের সুযোগ না থাকায়।
এভাবে ধীরে ধীরে রাজ‍্য-রাজনীতিতে যেমন দুর্ণীতি ও হিংসা বাড়তে থাকে, তেমনি ক্ষমতা দখলে রাখার মরিয়া চেষ্টায় রাজনৈতিক হিংসাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ভোটের সময় স্বাভাবিক কারনেই স্বার্থ ও জীবিকা বাঁচানোর তাগিধেই এ ধরনের লুম্পেন কর্মীদের দ্বারা রাজনৈতিক স্বার্থে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হয়। এ রাজ‍্যে নির্বাচন পরিণত হয়েছে লুম্পেন কর্মীদের রুজি-রোজগার বজায় রাখা অথবা তা ছিনিয়ে নেবার সংগ্রাম হিসাবে! এইভাবে রাজ‍্যে হিংসাত্মক রাজনীতির জন্মও হয় বামপন্থী ও অতি-বামপন্থী রাজনীতির অনুসঙ্গ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে বামপন্থীসহ কিছু রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এই হিংসাত্মক রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। রাজ‍্যে শিল্প ও ব‍্যবসা-বাণিজ‍্যের প্রতিকুল পরিবেশে এই লুম্পেন রাজনীতির হাত ধরে বামপন্থী রাজত্বেই আসে কাটমানি বাণিজ্য – যা ২০১১ সালে পালা বদলের পর রাজ‍্যের বর্তমান শাসককুল প্রায় সব ধরনের বাণিজ‍্যিক আদান প্রদানে বাধ‍্যতামূলক করে দিয়েছেন! এ কাজের গণতন্ত্রীকরনের জন‍্য রাজ‍্যের আইনের রক্ষকদের এমনভাবে কাজে লাগানো হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে শাসকদলের লিগ‍্যালাইজড্ গুন্ডাবাহিনীর মত আচরণের অবিযোগ বিস্তর।
এমতাবস্থায় রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব রাজ‍্যপালের। তিনি যদি সেটিং তত্ত্বের ক্রীড়নক হয়ে পড়েন, তাহলে বলতে হয়, দেশে আইনের শাসন ও সংবিধানের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গেছে। তার দায় তখন রাজ‍্যপাল ও তিনি যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ‍্যে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন – সেই সরকারের কুশীলবদের উপরেই বর্তায়। এখানে গত শতাব্দীর শেষপাদ থেকে কাশ্মীর রাজ‍্যের কথা মনে করিয়ে তার ফলাফল বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার কথা মনে হল। অতয়েব, সাধু সাবধান।

বঙ্গ রাজনীতিতে এত কটুক্তির বন‍্যা কেন

ভোলা ময়রার বহুল প্রচলিত কবিগানের উক্তি : “জন্ম যেমন যার, কর্ম তেমন তার; এ ব‍্যাটা ভেড়ের ভেড়ে, নিমক ছেড়ে কবির ব‍্যবসা ধরেছে” – এই কথাগুলি যেন মনে হয় বর্তমান সময়ে রাজ‍্যের রাজনীতিকদের নিয়ে বলা হয়েছে!
বাঙ্গালীরা বরাবর আবেগপ্রবণ জাত। এই আবেগের বশেই একসময় শিক্ষিত বাঙ্গালীকুলের বড় অংশ দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের বলিদান দিয়েছিল। সেই সময় যারা রাজনীতির আঙ্গিনায় এগিয়ে এসেছিল, সেই বাঙ্গালীদের অধিকাংশই স্বচ্ছল পরিবারের যুবক। তাদের উদ্দেশ‍্য ছিল দেশের জন‍্য, সমাজের জন‍্য ভালো কিছু করা – রাজনীতি তাদের কারোর জীবিকা ছিল না। সে কারনে রাজনীতির মাধ‍্যমে রোজগার করার ধারনাটাই তখন ছিল না।
দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই একদল রাজনীতিকের আবির্ভাব হয়, যারা ” ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” বলে এই সমাজসেবা করাকে তাচ্ছিল্য করে এবং নির্বাচনে জেতাকে রাজনীতির মঞ্চে পরম সাফল্য বলে মনে করে। এভাবে অহঙ্কারী ও লোভী মানুষের মধ‍্যে রাজনীতির মঞ্চে ভীড় করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয় – ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় যে মানুষদের হাতে ক্ষমতার ‘মধুভান্ড’ আসে, তারা সততা ও দেশপ্রেম থেকে বহু যোজন দূরে থাকা মানুষজন! সম্ভ্রান্তের তকমা পাওয়া কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে এসে যে মধুভান্ডের স্বাদ পান, তারজন‍্য তাদের অনেকেই নিজের অপদার্থ, অযোগ্য, অসৎ বংশধরদের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। এরাই ভারতে বংশপরম্পরায় রাজনীতির ব‍্যবসা শুরু করেন। প্রথম উদাহরণ অবশ‍্যই নেহরুর পরিবার। প্রশাসনিক দুর্ণীতির অংশ হয়ে এই রাজনীতিকরা এমন ধনবান হয়ে পড়ে যে তারা অন‍্য ব‍্যবসায় কিছুতেই এত অর্থের মালিক হতে পারতেন না।
ভারতীয় রাজনীতির এই অসততার শিকড় আমাদের রাজ‍্যেও সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। এমনকি, এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত মানুষজন – জজ, আইএএস, শিক্ষাবিদ – অনেকেই অবসরগ্রহণের পরেপরেই কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করতে নেমে পড়েন। জীবনের শেষপাদে এসে তাঁদের দেশসেবার ইচ্ছা চাগিয়ে ওঠে! এদের কার্যকলাপে সন্দেহ জাগে তাদের কর্মজীবনের কাজে নিরপেক্ষতা উপর।
আমাদের সাধারন মানুষকে বুঝতে হবে, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অপগন্ড থেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব‍্যাক্তি, প্রতিষ্ঠিত খেলোয়ার, গায়ক, অভিনেতা – সকলের এত দেশসেবার হিড়িক জাগল কেন! আসলে, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বিনা বিনিয়োগে সবচেয়ে লাভজনক ব‍্যবসার নাম – রাজনীতি! এ আর “দেশসেবা” নয় – profession। সেজন‍্য অনেক রাজনীতিক তাঁদের ফর্ম পুরনের সময় professionএর জায়গায় লেখেন – রাজনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় কয়েকটি পরিবার রাজনীতির ‘মধুভান্ড’ কুক্ষিগত করে রাখেন। ভারতের মসনদে যেমন নেহরু-গান্ধী পরিবার, কাশ্মীরে আবদুল্লা পরিবার ইত‍্যাদির ধনবৃদ্ধিতে প্রলুব্ধ হয়ে, বহু মানুষ রাজনীতিকে profession হিসেবে গ্রহণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে! রাজনীতি করতে যেহেতু কোন যোগতা লাগে না, সে কারনে বহু লোভী ও অসৎ মানুষ রাজনীতির আঙ্গিনায় ভিড় করে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলতে হয়, স্বাধীনতার অব‍্যবহিত আগে সুরাবর্দী তাঁর অসৎ উদ্দেশ‍্যে রাজ‍্যের পুলিশকে ব‍্যবহার করে এবং সেইসঙ্গে রাজনীতির আঙ্গিনায় দলীয় গুন্ডাগর্দীর প্রচলন করেন। আবার সময়ের সঙ্গেসঙ্গে বঙ্গ রাজনীতিতে দলীয় মাসলম‍্যানদের গুরুত্বের পরিবর্তন হয়। প্রথমদিকে, বিশেষতঃ কংগ্রেসের প্রথম ১৫-১৬ বছরের শাসনকালে এই গুন্ডাবাহিসীর কিছুটা ভূমিকা দেখা গেলেও তারা কখনোই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্ব পেত না।একটা ব‍্যাপার লক্ষ‍্য রাখা হত, এরা যেন সমাজে সাধারন মানুষের অসুবিধে না করে।
তারপর রাজ‍্য-রাজনীতির আঙ্গিনায় উত্থান হল বামপন্থীদের। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন‍্য যতটা আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেল, তার চেয়ে তারা অনেক বেশী আগ্রাসী ভঙ্গিতে প্রধান বিরোধী দলকে ছলে-বলে-কৌশলে হেয় করার প্রয়োগ-কৌশল দেখালো – এখানে কোন নিয়ম, নীতির তোয়াক্কা করল না! নির্বাচনের সময় বামপন্থার বকলমে সিপিএমের দেওয়াল লিখনে ও চিত্রাঙ্কনে শুধু ইন্দিরা-কংগ্রেসকে গালি দেওয়া নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক রক্ত-পিপাসু ডাইনীর রূপে চিত্রিত করে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দেওয়াল লিখন করা হল!
এভাবে নির্বাচনে বিরোধীতার আগ্রাসী চরিত্র সামাজিক ক্ষেত্রেও গতি পেল যখন রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু বানতলার নৃশংস ধর্ষণও হত‍্যার ঘটনা প্রসঙ্গে বললেন, “এমন ত কতই হয়”! এভাবে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার পর, গুন্ডাগর্দীর মাধ‍্যমে দলে উঠে আসা মানুষদের নেতৃত্বে বসানো শুরু হল। যার বিরুদ্ধে স্বহস্তে গুলি করে এক থানার ওসিকে নিধনের অভিযোগ, তাকে শুধু এমএলএ নয়, মন্ত্রী করা হল! এইভাবে এই রাজ‍্যে গুন্ডাগিরি রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাওয়ার সোপান হিসেবে দেখা শুরু হল! ইতিমধ‍্যে অতিবামদের খুন খারাবির রাজনীতি শুরু হল। তাদের শ্লোগান – “চীনের চেয়ারম‍্যান আমাদের চেয়ারম‍্যান” আর “ধনীর গায়ের চামড়া দিয়ে গরীবের পায়ের জুতো তৈরী হবে” – এমন অবাস্তব, অসাড় শ্লোগানসহ তারা এক প্রৌঢ় বা বৃদ্ধকে আট-দশজন যুবকদ্বারা নৃশংসভাবে হত‍্যা করার মধ‍্যে বিপ্লব সাফল‍্যমন্ডিত হল – বলে প্রচার করল! এমন চরম সামাজিক ও আইন-শৃঙ্খলার চরম অবক্ষয়ের পর্যায়ে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তিনি পুলিশ দিয়ে তথাকথিত বিপথগামী যুবকদের ‘খুন’ করালেন। সুরাবর্দীর পর, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এভাবে পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে রাজনৈতিক কারনে হত‍্যার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রথম কারিগর এই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। এর সুদূরপ্রসারী ফল হল, যখন পশ্চিমবঙ্গে জ‍্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন প্রতিষ্ঠা হল, তখন প্রথম থেকেই পুলিশকে রাজ‍্যের শাসকদলের স্বার্থে ব‍্যবহার করা হতে লাগল। আবার সিদ্ধার্থ জমানায় যে হাতকাটা জিতু বা কানকাটা ছেনোর দল রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহৃত হত, রাজ‍্যের পুলিশবাহিনী তাদের সঙ্গে আপোষ করার রাস্তা নিল।
সিপিএম জমানায় সাধারন নির্বাচন থেকে লোকাল বডি, এমনকি স্কুল, কলেজের গভর্নিং বডি নির্বাচনে পর্যন্ত গুন্ডা-বাহিনী শাসকদলের সমর্থনে রাস্তায় নামত। এদের রক্ষা করত রাজ‍্যের পুলিশ বাহিনী। তৈরী হল শাসক-গুন্ডা-পুলিশ জোট। সাধারন মানুষ এই জোটের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করত না – শুধু ভয় দেখিয়েই কাজ হাসিল করা হত। বিরোধী বা সংঘবদ্ধ জোট হলে তার বিরুদ্ধে একযোগে এই গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হত। যত সময় গড়ালো, তত নির্বাচনে গুন্ডাগর্দী দেখানো কর্মীরা পার্টির নেতৃত্বে যেতে লাগল। এদের চারিত্রিক ও বাণিজ্যিক গুণগুলি (!) রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করল – এভাবে রাজনীতি একটি সর্বাপেক্ষা লাভজনক ব‍্যবসায় পরিণত হল। যার মধ‍্যে গুন্ডাগর্দী, অসততা, মিথ‍্যাচারসহ সকল চারিত্রিক অনাচার দেখা গেল – তিনি ততই সার্থক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন।শুধু শাসক দল নয়, রাজনীতির এই অবক্ষয় দলমত নির্বিশেষে সব দলের রাজনীতির মধ‍্যেই দেখা গেল। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন নির্বাচনে রক্ত ঝরা একটি স্বাভাবিক ব‍্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
শিল্পায়ণের চেষ্টা, অর্থনীতির উন্নতির চেষ্টা এফং দলীয় নেতাদের তোলাবাজির প্রশ্রয় না দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কুকথার ফুলঝুড়ি ছড়ানো দলীয় নেতাদের প্রশ্রয় না দিয়ে মূখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের এক বড় অংশের কাছে অপ্রিয় হলেন। তাছাড়া, তুচ্ছ কারনে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারনে কংগ্রেস তার নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতার এমন মিশেল ঘটালো যে তারা রাজ‍্যে সহযোগী দল তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় নিয়ে এলো! তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জী ২০১১ সালে রাজ‍্যের নতুন মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন। এই মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর দল তৈরী করেন কংগ্রেস ভেঙ্গে। তিনি সর্বসমক্ষে একাধিকবার সিদ্ধার্থ শঙ্গর রায়কে তাঁর গুরু মেনেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়নের জনক জ‍্যোতি বসুর পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ নিয়েছেন। সিপিএমের এই মেধাবী ছাত্রীর দলে তিনিই প্রথম ও শেষ কথা! দলে একটাই পোষ্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোষ্ট! প্রশাসন চলে তাঁর অনুপ্রেরনায়!
গত এগারো বছরে মমতা ব‍্যানার্জীর শাসনকালে এই গুন্ডাগর্দী ও তোলাবাজীর রাজনীতিকরন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমোকে বারবার তাঁর দলের নেতাদের তোলাবাজি ও গুন্ডামীর জন‍্য সতর্ক করতে হয়েছে! এভাবে এখন পশ্চিমবঙ্গে দলীয় রাজনীতিতে হিংসা ও তোলাবাজির গণতন্ত্রীকরন সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। রাজনীতি যেহেতু আর সমাজসেবা নয় – শুধুই ক্ষমতা ভোগ ও টাকা কামানোর জায়গা – সেহেতু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার স্বার্থজনিত কারনে এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির অভাবে নেতা-নেত্রীরা কুকথার ফুলঝুড়ি ছোটান – তাঁরা মনে করেন, এভাবেই তাঁরা দলীয় নেতৃত্বের কাছে অধিক গুরুত্ব পাবেন! আসলে এইসব নেতা-নেত্রীদের সভ‍্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই ব‍্যবহার তাদের কটুক্তির মাধ‍্যমে বেরিয়ে আসছে। এই রাজ‍্যের নেতা-নেত্রীরা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ধরে আনবেন!তারা অসম্মান করে কটু কথা বলতে পারেন রাজ‍্যপাল ও দেশের প্রেসিডেন্টকে! আবার বিরোধী দলের দায়িত্বশীল নেতা রাজ‍্যের মহিলা মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব‍্য করতে পিছপা হন না! তাদের রাজনীতি ব‍্যবসার স্বার্থে ঘা লাগায় তারা এসব কটুক্তি করেন। এর সবচেয়ে বড় কারন, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার জন‍্য কোন শিক্ষা,দীক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির দরকার হয় না!
এ বিষয়ে রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যমের দায়িত্ব অপরিসীম।তারা এইসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নেতা-নেত্রীর বক্তব‍্য গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করে। ফলে, নিম্ন-সংস্কৃতির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আরো বেশী করে প্রতিপক্ষকে কটুক্তি করার জন‍্য প্ররোচিত হন! সেজন‍্য এখন রাজ‍্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন রাজনীতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছেন! এটি রাজ‍্যের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় অশনি সংকেত। এখন রাজনীতিক এমনকি পায়াভারি মন্ত্রীরাও দুর্ণীতির দায়ে জেল খাটছেন। এমনকি, ব‍্যভিচারের মত কাজ পর্যন্ত রাজনীতিকদের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না! এর ফলে, অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের মানুষের কাছে ত বটেই, অন‍্যান‍্য দেশের মানুষের কাছেও রাজ‍্যের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতির প‍্যাটার্ন আমুল পরিবর্তন না করলে এই অবক্ষয় আটকানো দুরের কথা, ক্রমশঃ তা বেড়ে যাবে। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের আমূল পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন রাজ‍্যের অধিকাংশ সাধারন মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসবে। এই অশুভ রাজনীতির ধারক-বাহকরাও সেটা জানে আর সেকারনেই তারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ও লড়াই লাগিয়ে রাখে! গুন্ডাবাহিনী ও শাসকের অপকর্মের দোসর পুলিশ বাহিনী সদা তৎপর আছে – যে কোন প্রতিবাদের সুর স্তব্ধ করে দেওয়ার জন‍্য। এমন কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল পর্যন্ত নেই যারা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক‍্যবদ্ধ করবে। রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যম পর্যন্ত এই অসৎ রাজনীতির থেকে ফয়দা তুলছে। সুতরাং, কণ‍্যাশ্রী, যুবশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের ভিক্ষে পাওয়া জনগণকে রাজ‍্যের নেতারা কুত্তা (Kutta) পদবী দিলেও কারোর কোন হেলদোল নেই।
এই অনাচারের থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা অত‍্যাচারের এই রাজনীতির আড়ালে মুখঢাকা সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলা। জাতীয়স্তরের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ‍্যপাল প্রসঙ্গে

রাজ‍্যের নতুন রাজ‍্যপাল হয়ে এসেছেন ৭১ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত আমলা ডঃ সি ভি আনন্দ বোস। শুধু এটুকু বললে পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। সুলেখক, পন্ডিত আনন্দ বোসের ইংরেজী, মালয়ালী ও হিন্দি ভাষায় প্রায় চল্লিশটি বই আছে। তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রসংঘের একটি পরামর্শদাতা কমিটির প্রধান।
কেরলের কোট্টায়াম জেলায় জন্ম এই প্রাক্তণ আইএএস BITS পিলানি থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে মুসৌরীর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একাডেমির ফেলো হন। আনন্দ বোসজী জওহরলাল নেহরু স্কলারশিপ প্রাপকও বটে। চাকরী জীবনের বিভিন্ন অধ‍্যায় পর্যালোচনা করলে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। প্রাকৃতিক ভারসাম‍্য রক্ষা থেকে সকলের জন‍্য বাসস্থান – বহু প্রকল্পে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। এই শেষোক্ত কারনে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আসেন। তাঁর শিক্ষা জগতে অবাধ বিচরণ মাণ‍্যতা পায় উপাচার্য পদে নিযুক্তির মাধ‍্যমে।
ডঃ আনন্দ বোসের সম্বন্ধে এ কথাগুলি বলার উদ্দেশ‍্য হল, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া। ফলে, ব‍্যক্তি রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনার সুযোগ পাওয়া যাবে। এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়নি। যদিও তিনি কেরলের এক মালয়ালী পরিবারের সন্তান, তাঁর পদবী কিভাবে “বোস” হল! ডঃ সি ভি আনন্দ বোসের বাবা বাসুদেব পিল্লাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের অত‍্যন্ত অনুরাগী এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের সাত সন্তানের সকলের নামের শেষে “বোস” যুক্ত করেন! ডঃ আনন্দ বোসের কাজের প্রশংসা করেছেন কেরলের মূখ‍্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তিনি অত‍্যন্ত পছন্দের আমলা। এরা সকলেই তাঁর সম্পর্কে একটি কথা বলেন – man of ideas।
এমন একজন রাজ‍্যপাল হয়ত পশ্চিমবঙ্গের সময়ের দাবী ছিল। লা গণেশন যেভাবে তাঁর স্বল্প দিনের দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর পরিবারের একজনের জন্মদিনে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেন এবং মূখ‍্যমন্ত্রী সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে অনুষ্ঠানের একদিন আগে চেন্নাই পৌঁছে যান, তাতে যেমন রাজ‍্যপালের পদের গৌরবের প্রশ্নে প্রশ্নচিহ্ন পড়েছে, তেমনি আগের রাজ‍্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সময় সর্বদা মূখ‍্যমন্ত্রী তথা রাজ‍্যের প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে রাজ‍্যপালের রণংদেহী সম্পর্ক তৈরী হয় – তা রাজ‍্যবাসীর কোন মঙ্গল করেনি।
প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সম্বৃদ্ধ এই বিদ্বান রাজ‍্যপাল দায়িত্ব নেওয়ার সময় একটি কথা বলেছেন, যা অত‍্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাজ‍্যপালের পদকে তিনি কোন বিরাট সন্মানের আলঙ্কারিক পদ হিসেবে দেখেন না। তিনি রাজ‍্যের জনসাধারনের মঙ্গলের জন‍্য সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতার মধ‍্যে থেকে কাজ করবেন এবং রাজ‍্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ‍্যে সমন্বয় (bridge) সাধনের কাজ করবেন। এই উক্তিতেই পরিষ্কার যে তিনি তাঁর সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালন করবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ‘রাবার স্ট‍্যাম্প’ রাজ‍্যপাল না হলে রাজ‍্য সরকারের সমূহ বিপদ। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ‍্যের শাসকদল যেমন তার সুপ্রিমোর অঙ্গুলীহেলনে চলে, তেমনি রাজ‍্যের প্রশাসনও তাঁরই অঙ্গুলীহেলনে চলছে! এখানে প্রশাসন চলে ব‍্যক্তিবিশেষের “অনুপ্রেরনা”য়! সেখানে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কোন জায়গা নেই। প্রাক্তণ রাজ‍্যপাল ধনখড়জীর সঙ্গে মমতাদেবী তথা রাজ‍্য সরকারের গন্ডগোল শুরুর কারনও তাই। রাজ‍্যবাসীর দুর্ভাগ্য যে তারা একজন megalomaniac নেত্রীকে দায়ীত্ব দিয়েছেন আর তিনি সর্বদা পরামর্শ নেওয়াকে ঘৃণা করেন (contemptuous to advice)। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা রাজ‍্যের নির্বাচিত সরকারের কাজকর্মের উপর নজর রাখার জন‍্য এবং পরামর্শ দেওয়া, প্রয়োজনে পদক্ষেপ করার জন‍্য রাজ‍্যপালের পদকে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। রাজ‍্যপাল তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেই ধরা হয়। রাজ‍্যপাল কখনোই “রাবার স্ট‍্যাম্প” নন। কোন রাজ‍্যপাল “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপালের মত আচরণ করলে তিনি জনসাধারণের কাছে তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করবেন।
ধনখড়জী তাঁর পদাধিকারবলে সরকারের যে কোন আধিকারিক বা মন্ত্রী – এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত তাঁর কাছে ডাকতে পারেন। পর্যায়ে রাজ‍্যপাল রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, মূখ‍্যমন্ত্রী নন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে ধনখড়জী রাজ‍্য প্রশাসনের কাছে যার-পর-নাই অপদস্ত হন। এমনকি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে উপাচার্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা না করার ঔদ্ধত্ব দেখান! এ ধরনের নোংরামো করতে গিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছেন – রাজ‍্যপালের নয়। উপাচার্যদের এখন রাজ‍্যের মানুষ অল্পশিক্ষিত, ডিগ্রিধারী শাসকদলের কর্মী ছাড়া অন‍্য কিছু মনে করে না। রাজ‍্যের এক ঐতিহ‍্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়! আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যপদে রাজ‍্যপালের নিযুক্ত প্রার্থীকে তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (যিনি বর্তমানে চৌর্যবৃত্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দী) কটুকথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাতিল করেন!
রাজ‍্যপাল ডাকলে বিভিন্ন অযৌক্তিক অজুহাতে রাজ‍্য সরকারের আধিকারিকরা হাজির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখাতেন না! বিভিন্ন সংবাদ-মাধ‍্যমে রাজ‍্যের মন্ত্রীসহ তৃণমূল দলের নেতারা রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে কুকথার বন‍্যা বইয়ে দিতেন। এভাবে শুধু যে প্রশাসনিক দক্ষতাকে পঙ্গু করে প্রশাসনে দলীয় শাসন কায়েম করা হল তাই নয়, সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতায় রাজ‍্য সরকারের প্রশাসনিক ব‍্যর্থতার পরিচয় পাওয়া যায়।
আসলে নেহরু-গান্ধী জমানায় যেভাবে “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল থাকতেন, যারা কেন্দ্রের অঙ্গুলীহেলনে ‘কাজ’ করতেন, সেই যুগ আর নেই। এদিকে মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার চায় এমন রাজ‍্যপাল যিনি বাপুরাম সাপুড়ের কাছে বায়না করা সাপের মত – যিনি একমাত্র megalomaniac নেত্রীর কথা মত “পুতুল নাচের ইতিকথা”র চরিত্র হবেন! সময়ের নিয়মে সেটিও সম্ভব নয়। সংবিধান মোতাবেক রাজ‍্যপালের ভূমিকা রাজ‍্য-প্রশাসনের অভিভাবকের মত। তাঁর নামে প্রশাসন চলে। তাঁর নামে নিয়োগ থেকে কর্মচ‍্যুতি – সব সরকারী কাজ হয় – প্রশাসনিক বদলীও তাঁর নামেই হয়। রাজ‍্যের প্রশাসনের মাথা রাজ‍্যপাল – এই স্বাভাবিক সত‍্য কথাটা মেনে নিতে নির্বাচনে জেতা নেত্রী, যাঁর অনুপ্রেরনায় প্রশাসন চলে – তাঁর মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়! আসলে এই নেত্রী সর্বদা সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা ভোগ করতে আগ্রহী। তা’ছাড়া তিনি ইগো সমস‍্যায় ভোগেন।তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি সর্বদা ‘সংগ্রাম’ করতে আগ্রহী! অথচ, প্রশাসনের কাজে স্বচ্ছতা আনতে এবং প্রশাসনিক ব‍্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন‍্য রাজ‍্যপাল তাঁর রাজ‍্যের মূখ‍্যসচিবসহ যে কোন আধিকারিককে ডাকলে তাদের হাজির হওয়া বাধ‍্যতামূলক। অথচ, নেত্রীর ভয়ে এবং রোষের মুখে পড়ার ভয়ে রাজ‍্যপালকে বারবার অবজ্ঞা করার স্পর্ধা দেখানো হয়েছে। মনে হয়, এসবের পিছনে অন‍্য কোন কারন আছে। রাজ‍্যপাল ধনখড়জী যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব‍্যাপারে উৎসাহ দেখাতে শুরু করলেন, তখন প্রশাসন প্রমাদ গুনলো। তারা ভয় পেল, এবার থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে! নেত্রীর “অনুপ্রেরনায়” তারা রাজ‍্যের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ থেকে রাজ‍্যপালকে অপসারিত করল! নেত্রীর অনুপ্রেরনায় মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ শুরু হল। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলির স্ট‍্যাচুট চুলোয় গেল। তারপর দেখা গেল, উচ্চ আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয়ের অনুসন্ধানের পর বিভাগীয় মন্ত্রী তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। তাঁরা এখন জেল হাজতে আছেন। সুতরাং, প্রশাসনের কাজের ধারা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে রাজ‍্যপালের আইনসম্মত জিজ্ঞাস‍্য থাকলে এই প্রশাসন বিপদের গন্ধ পায়! তখনই তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে “রাজ‍্যপাল হটাও” অভিযান শুরু হয়।
এর প্রেক্ষিতেই মনে হয়, নয়া রাজ‍্যপাল আনন্দ বোসজী তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে অনমনীয় থাকার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। তবে, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই “এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই” ধরনের attitude কে কতটা বাগে আনতে পারবেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
মমতাদেবীর রাজনীতির ধরনে এটা মনে করার কারন নেই যে, তিনি রাজ‍্যপালের সাংবিধানিক পদ্ধতি পালনের এবং রাজ‍্য-কেন্দ্র সম্পর্কে সেতু রক্ষার কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁর সঙ্গে সহযোগীতা করবেন। যতক্ষণ মমতাদেবীর প্রশাসনের কাজে রাজ‍্যপাল ‘পরামর্শ’ ও ‘উপদেশ’ না দিচ্ছেন, ততক্ষণ সব ঠিক থাকবে। কিন্তু রাজ‍্যপাল তাঁর কথা অনুযায়ী কাজ শুরু করলেই ঝামেলা বাঁধবে। মমতাদেবী চান “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল – যিনি তাঁর সব কাজে বিনা জিজ্ঞাসায় সায় দেবেন! আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। সংবিধানও এই রাবার স্ট‍্যাম্পকে মাণ‍্যতা দেয় না। আর, মমতাদেবীর রাজনীতিতে তাঁর অনমনীয় মনোভাবের ফলে, জোট রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট সাড়া জাগিয়ে শুরু করলেও আজ তিনি ও তাঁর দল রাজ‍্য তথা দেশের রাজনীতিতে একা। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি দুটি সর্বভারতীয় দল – বিজেপি ও কংগ্রেস – উভয়ের সঙ্গেই কখনো না কখনো জোট করে সুবিধা নিয়েছেন। আবার একসময় জোটসঙ্গীকে ত‍্যাগ করে বিরোধীতাও করেছেন। সেজন‍্য জোট রাজনীতিতে মমতাদেবী এবং তাঁর দলের কোন বিশ্বাসযোগ‍্যতা নেই। তবে তিনি চিরকাল kitchen politics বা পিছনের দরজা দিয়ে গোপন রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পারদর্শী। এধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ‍্যতা প্রয়োজন – সেটা তিনি কতটা দেখাতে পারেন তা ভবিষ‍্যৎ বলবে। মমতাদেবীর বড় সমস‍্যা হল, তিনি দল ও প্রশাসনকে মিশিয়ে দিয়েছেন। দলীয় নেতৃত্ব থেকে প্রশাসনকে আদেশ করা এবং প্রশাসনের সেই আদেশ পালন করার মধ‍্যেই তা পরিষ্কার। ফলে, দলীয় অসততার আঁচ অবধারিতভাবে সরকারী প্রশাসনে পড়েছে। প্রশাসনিক কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে তাঁর অঘোষিত উত্তরাধিকারীর বিভিন্ন অতিরিক্ত-সাংবিধানিক (extra-constitutional) ক্ষমতা ও কাজকর্ম নিয়েও মানুষের মনে বিস্তর প্রশ্ন।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপাল মহোদয় যদি এইসব অসাংবিধানিক কাজকর্মের ব‍্যাপারে চোখ বুজে থাকেন তবে রাজ‍্য সরকার ও মমতাদেবীর কাছে তিনি খুব ভালো রাজ‍্যপাল! কিন্তু যদি রাজ‍্যের কাজকর্মের ব‍্যাপারে তিনি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, তা’হলে গোলমাল শুরু হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দলের shouting brigadeকে ময়দানে নামিয়ে অসংসদীয় ভাষায় কুকথার প্লাবন বইয়ে রাজ‍্যপালের চেয়ারকে আক্রমণ করার পন্থা নেওয়া হবে। এই দলের নেতৃত্বের মনে রাখা উচিৎ যে তাদের দলের নেতৃত্বের সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ‍্যেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে – ভোটে জিতলেই যা খুশী তাই বলা বা করার অধিকার জন্মায় না! এই দল ও তার নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি কথাটা বুঝবে তত রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপালের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও তাঁর শিক্ষা-সংস্কৃতির পটভূমি বিচার করে মনে হয়, তিনি যা বলেছেন, তাতে রাজ‍্যের সাধারন মানুষের পক্ষে তিনি দাঁড়াবেন এবং সংবিধান সম্মত পদ্ধতিতে রাজ‍্য প্রশাসনকে চালানোর মত অবশ‍্য পালনীয় পরামর্শ দেবেন বলেই মনে হয়। তখন রাজ‍্য প্রশাসন ও মমতাদেবীর দল কি প্রতিক্রিয়া দেয় তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বেহাল দশা

এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষের মাথায় প্রায় ষাট হাজার টাকা ঋণের বোঝা – সৌজন‍্যে গত পঞ্চাশ বছরের রাজ‍্য সরকারের শাসন! এর দায় কার? কে নেবে দায়িত্ব? সঠিক উত্তর দেওয়া ত দূরের কথা, কোন রকম উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত এই রাজ‍্য সরকারের নেই। রাজনীতির আঁচকা আঁচকি থেকে আতাঁত – এসব প্রশ্নে যাওয়া এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য নয় – কোন ব‍্যক্তিবিশেষের দোষ-গুণ বিবেচ‍্য নয়। এখানে প্রশ্ন উঠছে – এভাবে কতদিন? সম্প্রতি রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা এতটাই যে, সুদ দেওয়াসহ তার খরচের পরিমাণের তুলনায় সরকারের রোজগারের পরিমাণ অত‍্যন্ত কম! অর্থাৎ, রাজ‍্য সরকার ঋণজালের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে। এর দায় নিশ্চয়ই রাজ‍্য সরকারের।এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার – আমাদের সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতায় মন্ত্রী, এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীর পর্যন্ত আর্থিক ক্ষমতা নেই! IAS বিভাগীয় প্রধানরা এই ক্ষমতা ভোগ করেন – অবশ‍্যই মূখ‍্যসচিবের অনুমত‍্যানুসারে। তা’হলে এমন আর্থিক হালের জন‍্য দায়ী কে? অবশ‍্যই এই IAS অফিসারেরা নন; কারন প্রশাসন চলে সরকারী নীতি অনুসারে। আর এই নীতি নির্ধারণ করেন বিভাগীয় মন্ত্রীরা – অবশ‍্যই মূখ‍্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার অনুমোদন সাপেক্ষে। শুধু নীতি নির্ধারণের পর তা রূপায়ণের দায় থাকে প্রশাসনিক কর্তাদের উপর। তা’হলে আর্থিক বিশৃঙ্খলার দায় এসে পরে মন্ত্রীসভা ও মূখ‍্যমন্ত্রীর উপর। আর্থিক আয়-ব‍্যয়ের নীতি যারা নির্ধারন করেন, দায় তাদেরই নেওয়ার কথা। সে ভাবে দেখলে এই দায় যৌথভাবে বর্তমান মন্ত্রীসভার। শুধু তাই নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলির আর্থিক বিশৃঙ্খলার দায়ও এই মন্ত্রীসভার! কারন, মন্ত্রীসভা দায়িত্ব নেওয়ার সময় পূর্ববর্তী সরকারের দায় ও সম্পদ (liability and assets) স্বীকার করেই দায়িত্ব নেন। সুতরাং “ঋণং কৃত্ত্বা ঘৃতং পিবেৎ” তত্ত্বের সদব‍্যবহার করতে করতে বর্তমান রাজ‍্য সরকার এই ঋণফাঁদে পড়েছে।
এই রাজ‍্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তার আর্থিক নীতির কারনে রাজ‍্যের আর্থিক হাল ক্রমশঃ খারাপ হয়েছে। বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসনে রাজ‍্যের চালু কলকারখানাগুলি একের পর এক পার্টির নেতাদের মদতে বন্ধ হয়েছে। এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অর্ধশিক্ষিত কম‍্যুনিস্ট নেতারা বুঝিয়েছে, মালিক বড়লোক আর শ্রমিক গরীব; তাই মালিক শ্রমিকের শত্রু! সুতরাং মালিকের লাভ হয় – এমন কাজ কোন শ্রমিকের করা উচিৎ নয়। এভাবে বছরের পর বছর বাঙ্গালী শ্রমজীবী মানুষদের মগজ ধোলাই করে রাজ‍্যের work culture একেবারে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তারপর যখন তাদের বিলম্বিত বোধদয় হল, তখন তাদের জমি দখলের ঔদ্ধত‍্যের খেসারত দিয়ে সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়কে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী পদে বসাতে সাহায‍্য করল!
সিপিএমের নীতি, তা ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন – বাস্তবায়নের একটা দলীয় তাগিদ ছিল। কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিক মমতা বন্দোপাধ‍্যায় তাঁর তৃণমূল দলের শুরু থেকেই কংগ্রেসী কালচারে “এক নেত্রী”র শাসন কায়েম করলেন – দলে একটিই পোস্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোস্ট; একটিই পরিবার, বাকীসব ঢেউয়ে ভাসা হরির দ্বার! এ ধরনের দলে নেত্রীর কর্মদক্ষতার উপর দলের সাফল‍্য নির্ভর করে। মমতা দেবী যেখানেই সিপিএমের নির্যাতন, অপশাসনের খবর পেয়েছেন, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন – প্রতিবাদ করেছেন। এভাবেই তিনি জনপ্রিয়তম নেত্রী হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি ১০০% সফল। কিন্তু বিরোধী নেতৃত্ব দেওয়া আর স্বচ্ছ, সফলভাবে প্রশাসন চালানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব‍্যাপার।
আরেকটি ব‍্যাপার যা আগেও বলেছি, মমতা দেবীর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তাঁর megalomaniac (নিজেকে সব বিষয়ে বিজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ ভাবা) চরিত্র। megalomania ডাক্তারি পরিভাষায় একটি মনোরোগ। ফলে, তিনি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমতী হিসেবে কল্পনা করে নেন। এই কারনেই তিনি তাঁর সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সময় অস্তিত্বহীন – ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির (fake university) ডক্টরেট বলে দাবী করেন! ১৯৮৪ সালে ঐ সময়ের কাগজে সে সংবাদ প্রকাশিতও হয়। এই জাল ডিগ্রির উল্লেখ না করলেও তখন তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কোন অসুবিধা হত না। তথাপি তিনি এ কাজ করলেন।
পরবর্তী সময় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তিনি সব দপ্তরের সমস্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন! এমনকি তাঁর ইগো এতটাই তীব্র যে, কোন টেকনিক‍্যাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করাকে পর্যন্ত অপছন্দ করেন! ফলে, তাঁর আশেপাশের রাজনীতিকদের মত, আমলা ও বিশেষজ্ঞরা তাঁকে যথার্থ পরামর্শ দেওয়ার বদলে স্তাবকতা করে নিজেদের আখের গুছানোকেই পরমার্থ মনে করছেন। এভাবে বেশীদিন সাফল‍্য পাওয়া যায় না। মমতাদেবীর সরকারও তা পাচ্ছেনা। তিনি সর্বদা জনসাধারনকে তুষ্ট রাখার রাজনীতি করেন! এটিই তাঁর USP। ফলে, তিনি যখন সিঙ্গুরের টাটা মোটরসের কারখানা বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্প বিতাড়নের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন, তখন থেকেই তাঁর কাছে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর কোন alternative পরিকল্পনা ছিল না। এদিকে কলকারখানা ও ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য না বাড়ায় রাজ‍্যে কর্মসংস্থানের হাল দিনদিন যত খারাপ হয়েছে, ততই এই megalomaniac নেত্রী তাঁর ইগোর কারনে কর্মসংস্থান বাড়ানোর চেষ্টা না করে বিভিন্ন “শ্রী” যুক্ত প্রকল্পের নামে সরকারী কোষাগার থেকে অনুদান দিয়ে সরকারের অর্থ শুধু ধ্বংসই করেননি, সেইসঙ্গে বিনিময়মূল‍্যহীণ এইসব অনুদানকে “উন্নয়ণ” বলে চালাতে চেয়েছেন।
এভাবে বেশীদিন চললে যা ভবিতব‍্য তাই হচ্ছে! প্রশাসন চালানোর জন‍্য অর্থ-দপ্তরের হাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না আসায় রাজ‍্য সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে।যদিও সরকার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মী সংকোচন করে, অস্থায়ী, অ‍্যাডহক চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে এবং তার কর্মচারী ও পেনশনারদের ন‍্যায‍্য মহার্ঘভাতা না মিটিয়ে – প্রশাসনিক দক্ষতাকে চুলোয় পাঠিয়ে অবস্থা সামাল দিতে চাইছে, তবু ধীরেধীরে রাজ‍্য সরকার ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে বাঁচার সমস্ত রাস্তা পরখ করা হয়েছে! যেমন স্ট‍্যাম্প ডিউটি বৃদ্ধি থেকে ধরে বিভিন্ন সরকারী ও সরকার-পোষিত পৌরনিগমের পরিষেবার মূল‍্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে, সারা রাজ‍্য জুড়ে মদের দোকানের অনুমোদন বৃদ্ধি করে – রাজস্ব আদায়ের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তবু, মূখ‍্যমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাবের জন‍্য পশ্চিমবঙ্গে SEZ সহ শিল্পস্থাপনের যে স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো আছে তা রূপায়ণে রাজ‍্যের অনীহা রাজ‍্যবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ‍্যে ফেলে দিয়েছে।
সরকারী প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতায় জানি যে, সরকারী অর্থ বরাদ্দের হিসেব দেওয়া (UC) বাধ‍্যতামূলক। অডিটেড utilization certificate না দিলে পরবর্তী বছরের অর্থ বরাদ্দ করা যায় না। রাজ‍্য সরকারের অর্থ দপ্তরও এই নিয়মে চলে। কিন্তু যখন কেন্দ্রীয় সরকার বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন প্রকল্পখাতে তাদের দেওয়া অর্থ রাজ‍্য সরকার নেওয়ার পরেও কোন UC দেয়না, তখন আইনত কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যকে ঐ খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। এই রাজ‍্যেও যখন তা হল, রাজ‍্য সরকার এবং তাদের বশংবদ সংবাদ-মাধ‍্যম সরবে কেন্দ্রের বিমাতৃসূলভ আচরণের (!) জন‍্য তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করল! আসলে, ঐ – আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত, তাই কোন হিসেব না দেওয়া আমাদের অধিকার! নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে বোধশূণ‍্য ব‍্যক্তিরা ক্ষমতায় বসলে এমন হতেই পারে!
এর মধ‍্যে সরকারী ও সরকারপোষিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, মূলতঃ শিক্ষকতায়, অযোগ‍্য প্রার্থীদের অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া, স্বজন-পোষণ এবং দলের ক্ষমতাশালী নেতৃত্বের একাংশের জেলযাত্রা – দলীয় নেতাদের টাকার পাহাড় বানানো, বিভিন্ন নেতার বাড়ি অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম হওয়ার খবর মাননীয় উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সৌজন‍্যে রাজ‍্যবাসী দেখছে। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মত তাঁর মত প্রকাশ করা মূখ‍্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের পারিবারিক উত্তরাধিকারী মৌণব্রত অবলম্বন করেছেন!
সামনে পঞ্চায়েত ভোট। রাজ‍্যের বাজেটের আয়-ব‍্যয়ের স্বচ্ছতা না থাকায় এবং রাজ‍্য ঋণফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের হুঁশিয়ারীর পরেও রাজ‍্যের কর্ণধার তাঁর ইগো নিয়ে পড়ে থাকলে এই ভোটের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করা রাজ‍্যের অর্থ দপ্তরের পক্ষে কতটা সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকছে।
তাছাড়া, রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী এই সরকারের আয় অপেক্ষা ব‍্যয় অনেক বেশী। সুতরাং তার পক্ষে ক্রমান্বয়ে ধার নেওয়া আর ক্রমবর্ধমান সুদের ফলে রাজ‍্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেভাবে রাজ‍্যের জনগণের মধ‍্যে বিভিন্ন অনুদান প্রকল্পের নামে সরকারী টাকা বিলানো হচ্ছে, তার ফলশ্রুতি হিসেবে অতি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন দপ্তরের অত‍্যাবশ‍্যকীয় খরচের অর্থেও টান পড়েছে! এভাবে শুধুমাত্র পুলিশ ও কিছু সংবাদ-মাধ‍্যমকে তাঁবে রেখে প্রশাসন চালানো সম্ভব নয় – যদি না কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ‍্য সরকারকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাহায‍্যের হাত বাড়িয়ে দেয়! সুতরাং এই রাজ‍্য সরকারের স্থায়ীত্ব এখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে!
এ ধরনের সব সরকারের যা বৈশিষ্ট্য, তেমনি এই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দূর্ণীতি ও স্বজন-পোষণের ভুত বাসা বেঁধেছে। এখানে সরকার ও ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দল সমার্থক! সংবাদ-মাধ‍্যম এখনো এ কথাটুকু বলতে পারল না যে, বিভিন্ন উন্নয়ণ(!) যা কিছু ভোটারকে সরকারী কোষাগারের অর্থ বিলানোর মধ‍্যে সীমাবদ্ধ, তা দিচ্ছেন বিভাগীয় প্রধানরা – কোন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীও নন। ব‍্যক্তিগতভাবে অর্থের বিনিময়ে চাকরী দেওয়ার জন‍্য দায়ী আমলারা – কোন মন্ত্রী নন। তবে, রাজ‍্য তথা দেশের মানুষ বোঝেন যে ‘যন্ত্র’ চালান ‘যন্ত্রী’! মন্ত্রীসহ যেসব রাজনৈতিক নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু হিসাব বহির্ভূত ‘সম্পত্তি’ করার কারন এবং সে সম্পত্তির উৎস না বলার কারনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এভাবে রাজ‍্য প্রশাসনটাই কাঠগড়ায় উঠেছ। দল তথা প্রশাসনে দূর্ণীতির ক্রমবর্ধমান ‘বিকাশ’-এর খবর যত বেরোবে, দল ততই পুলিশ-গুন্ডারাজের আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে নেবে! প্রশাসনে ধীরে ধীরে দলের কন্ট্রোল হ্রাস পাবে আর লুম্পেনরাজ প্রতিষ্ঠা পাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে প্রকৃত আয়-ব‍্যয়ের হিসেবের কোন মিল না থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া টাকার কোন UC দেওয়া যাবে না। তাই কেন্দ্র থেকে রাজ‍্যের অনুদান খাতে টাকা পাওয়াও সম্ভব হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এমন অর্থনৈতিক নয়-ছয়ের জন‍্য প্রয়োজনীয় আইনী পদক্ষেপ নেয় তা’হলেই রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল।দেখা যাক, অসৎ রাজনীতির কবলে পড়া পশ্চিমবঙ্গবাসীর মুক্তি কবে মেলে।

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশীয় ক‍্যাম্পাসের বিরোধীতা কেন

আমাদের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি একটি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। আসলে, জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যমে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা ও কিছু ঘোষিত রাজনীতির ঘোষিত সমর্থক তথাকথিত বুদ্ধিজীবির বক্তব‍্য প্রচার করা হয় – তাতে অন্ততঃ এই রাজ‍্যে শিক্ষানীতি নিয়ে সাধারন মানুষের সঠিক ধারনা করা প্রায় অসম্ভব। সংবাদ-মাধ‍্যম নিয়ন্ত্রিত ধারনা অনেকটাই অপরের মুখে ঝাল খাওয়ার মত! শিক্ষানীতি নিয়ে আগে এই জায়গায় বিস্তৃত আলোচনা করায় তা আবার বিবৃত করার কোন অভিপ্রায় নেই। শুধু, সে সময় এই নীতি প্রয়োগে কিছু সতর্কতা ও সন্দেহের কথা বলেছিলাম। এখন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষায় বিদেশী বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্রে fall-outএর ব‍্যপারে আলোচনা করছি।
নতুন শিক্ষানীতির দিশা অবশ‍্যই প্রশংসনীয়। যদিও বিরোধী রাজনীতিকদের অন্ধ বিরোধীতা এবং সরকার পক্ষের রাজনীতিকদের অন্ধ সমর্থনের মধ‍্যে অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিকদের শিক্ষার দৈণ‍্যতাই প্রকাশ পায়। মেকলে নির্দেশিত শিক্ষা-ব‍্যবস্থায়, কম‍্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত শিক্ষানীতির পরিবর্তন দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে অতীব জরুরী ছিল। এই নতুন শিক্ষানীতির অভিমুখ যেহেতু দেশের ঐতিহ‍্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ব‍্যবস্থার মেলবন্ধন করা – সেটি পূর্ববর্তী শিক্ষা-ব‍্যবস্থার ধারক ও বাহকদের না-পসন্দ্ হওয়াই স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন‍্য যা সবচেয়ে জরুরী তা হল শিক্ষকদের যোগ‍্যতা ও তাদের শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগের সদিচ্ছা! চল্লিশ বছরের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাদান ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা জগতে শিক্ষক-চয়ন থেকে শুরু করে তাদের নিয়োগ ব‍্যবস্থা কখনো স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল না! সেখানে প্রার্থীর শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ‍্যতা অপেক্ষা অন‍্য যোগাযোগ প্রাধান‍্য পেয়ে এসেছে! ইউজিসি বেতন কাঠামো পূর্ববর্তী যুগে সাধারণতঃ শিক্ষকরা তাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীকে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকাতে যার-পর-নাই চেষ্টা করতেন। এভাবেই তখন বেশীরভাগ শিক্ষক-চয়ন করা হত। ইউজিসি বেতন কাঠামো পরবর্তী সময়ে কলেজ,বিশ্ববিদ‍্যালয়ের বেতন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলে তার চাপে স্কুল শিক্ষকদেরও বেতনে অনেকটাই বৃদ্ধি হয়। স্কুল, কলেজ উভয় ক্ষেত্রেই সার্ভিস-কমিশনের মাধ‍্যমে শিক্ষক-নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলেও রাজনীতির কোলে চড়ে থাকা এইসব ‘কমিশন’গুলি তাদের ‘বিশেষজ্ঞ’ চয়ন থেকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পন্ন করতে লাগল যে, প্রায় সমস্ত শিক্ষক নির্বাচনই রাজনীতির ক্ষমতায় থাকা দল ও তাদের নেতাদের অঙ্গুীহেলনে করা হত! যেজন‍্য এক সময় কলেজ সার্ভিস কমিশনের নাম লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল “কমরেড সার্ভিস কমিশন”! আর বিশ্ববিদ্যালয়! যত কম বলা যায় ততই ভালো! এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-চয়নে কোন স্বচ্ছতা নেই। কোথাও শিক্ষক চয়নের জন‍্য বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলির ক্ষেত্রে সার্ভিস কমিশন নেই। প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগের কথা – ঐ সময় আমি কলকাতা থেকে বহুদূরের এক সরকারী কলেজে সহকারী অধ‍্যাপক। সে সময়ে প্রায় এক বছরের মধ‍্যে আমার কলেজের ৩-৪ জন সহকর্মী কলকাতার ২-৩টি বিশ্ববিদ‍্যালয়ে ‘নির্বাচিত’ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীতে যোগ দিলেন। এরা সকলেই ছাত্রাবস্থা থেকে তখনকার রাজ‍্যের শাসকদলের সক্রিয় কর্মী! শুধু একজন ছিলেন, যিনি বৈবাহিক সূত্রে শাসকদলের শিক্ষকনেতার সহধর্মীনী! এই অসততা সমর্থকদের একটাই বক্তব‍্য – বাশ্ববিদ‍্যালয়ের অটোনমি! অর্থাৎ, শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতির দোহাই বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অটোনমি!
আরো বড় কথা – বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ‍্যাপক পদে উত্তরণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কলেজগুলোতে সে সুযোগ নেই – সহযোগী অধ‍্যাপক পদেই তা সীমাবদ্ধ! এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কলেজগুলিতেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে শিক্ষাদান এবং গবেষণার সুযোগ থাকলেও অধ‍্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই! সংযোগ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ এই শিক্ষকদের নিযুক্তি এবং পদোন্নতির কারন হওয়ায় তাদের যোগ‍্যতার যথার্থতা কখনোই প্রমাণিত হয়নি। পৃথিবীর কথা বাদ দিলেও, শুধু সারা ভারতের নিরিখে এই রাজ‍্যের শিক্ষার মান যে ক্রমশই নিম্নগামী, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণ চুলোয় গেছে – এমনকি সরকারি কলেজে জীব-বিজ্ঞান বিভাগে specimen কেনার অর্থ না থাকায় জীবদেহ ব‍্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়া শিক্ষা বন্ধ!
যেহেতু এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদের ভিত্তিতে বেতনক্রম নির্ধারিত হয়, এখানে যোগ‍্যতা গৌণ – মূখ‍্য হচ্ছে রাজনৈতিক খুঁটির জোরে পদোন্নতি প্রাপ্তি! সুতরাং এ নিয়ে স্তাবক শিক্ষককুলের মধ‍্যে কোন হেলদোল ছিল না। এবার মুস্কিল হল নয়া শিক্ষানীতির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। কারন, বিশ্বজনীন শিক্ষা-ব‍্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও একটি বুনিয়াদী স্তরের উপরে – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষাকে – পণ‍্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে পণ‍্যের ক্রেতার পণ‍্য, তার মান ও বিক্রয়কেন্দ্র চয়নের স্বাধীনতা থাকছে! শুধু তাই নয়, পণ‍্য বিক্রেতার দায়বদ্ধতা এবং পণ‍্য বিক্রেতাদের মধ‍্যে প্রতিযোগীতাও থাকবে – তা’হলে একমাত্র উন্নতমানের পণ‍্যই বাজারে চলবে! আমাদের এতদিনের চালু শিক্ষা ব‍্যবস্থায় এমন দায়বদ্ধতার কোন ব‍্যাপার ছিলনা। শিক্ষা রাজনীতির নিয়ন্ত্রনাধীন থাকায় ছাত্রদের শিক্ষকের ও শিক্ষার গুণগত মানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। “সকলের জন‍্য সর্বস্তরের শিক্ষা” এবং “শিক্ষা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের দায়িত্ব” বলা কম‍্যুনিস্টদের উদ্দেশ‍্য ছিল অর্ধশিক্ষা ও কুশিক্ষার আলোতে ভারতীয় শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখা। কারন, চীন, রাশিয়ার মত কম‍্যুনিস্ট দেশগুলিও উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় অর্থবিনিয়োগ কমিয়ে তার গুণগত মান বৃদ্ধির জন‍্য শিক্ষার বেসরকারীকরনের মত নীতি নিয়ে চলছে। এ বিষয়ে ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট ও তাদের সমর্থনকারী সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি নিশ্চুপ! এছাড়া এখানে অন‍্যরকম বাদ-বিসম্বাদ আসতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের যোগ‍্য ছাত্রদের জন‍্য বিদেশী বিশ্ববিদ‍্যালয় ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির ভারতে তাদের ক‍্যাম্পাস খোলার পথ সুগম করা হচ্ছে। গুজরাট আন্তর্জাতিক অর্থ প্রযুক্তি শহর (Gujarat International Finance Tec-City) বা সংক্ষেপে GIFT গান্ধীনগরে বিদেশী উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভারতে তাদের ক‍্যাম্পাস খোলার জন‍্য ২০২২এর বাজেটে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন ‘পক্ষ’ মাছের বাজারের চিৎকার শুরু করেছে – অবশ‍্যই স্বার্থহানির আশঙ্কায়!
যা বলা হচ্ছেনা তা’হল, ২০০৫ সালে ইউপিএ জমানায় UGC এইভাবে আগ্রহী বিদেশী উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে ভারতে তাদের অতিরিক্ত ক‍্যাম্পাস খোলার জন‍্য স্পেশাল ইকনমিক জোন খোলার পরিকল্পনা করে – উদ্দেশ‍্য, কম খরচে ভারতের যোগ‍্য ছাত্রছাত্রীদের আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া। সুতরাং এটি নতুন কোন চিন্তা নয়। তবে, এতে অসুবিধা কেন এবং কোথায়?
প্রথম কথা হল, রাজনৈতিক বিরোধীতা নির্বোধের প্রতিক্রিয়া বলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন (যার মধ‍্যে বিজেপিপন্থী সংগঠনও আছে) এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে! তার কারন, আমাদের দেশে শিক্ষা – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষা হচ্ছে শিক্ষকদের করেকম্মে খাওয়ার জায়গা – যেখানে বেতনভূক কর্মচারীর (পড়ুন শিক্ষক) কোন দায়বদ্ধতা নেই। এখানে দায়বদ্ধতা বলতে শিক্ষাদানের গুণগত মানের কথা বোঝানো হচ্ছে। এবার যদি এইসব আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে গুণমানের প্রতিযোগীতায় নামতে হয়, তা’হলে এই শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিমাপ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। বার্সিলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ফুটবল খেলতে নামলে যেভাবে এই দেশের টিমের খেলোয়ারদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার ধুলিস‍্যাৎ হবে – সে ভয়টাই এই শিক্ষকদের মনে কাজ করছে। এতে একটি মূল‍্যবান তথ‍্য বেরিয়ে এসেছে – এতদিন আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের চাহিদা ও মতামতকে গুরুত্ব দিইনি। আমরা শিক্ষার উৎকর্ষের বদলে শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতিকে শিক্ষার বিকাশ মনে করে তৃপ্তি অনুভব করেছি।
এখন সময় এসেছে – নতুন শিক্ষানীতির হাত ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামতে বাধ‍্য করা। উচ্চশিক্ষার নামে বহুবিধ ধ‍্যাষ্টামো বন্ধ হলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়তে বাধ‍্য। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই GIFTর অধীনে বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ক‍্যাম্পাস তৈরী হলে তারা UGCর অধীনে আসবে না – তা বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন‍্য UGCর পরামর্শ মেনে সরকার বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন‍্য কয়েকটি অলঙ্ঘণীয় শর্ত পালনের নিয়ম জারি করেছে। যেমন তাদের এদেশের ক‍্যাম্পাসে যে ডিগ্রি দেওয়া হবে তার মান ও ডিগ্রির মূল‍্য তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের ক‍্যাম্পাসের সঙ্গে যেন অভিন্ন হয়। অর্থাৎ, ক‍্যাম্পাস ভেদে ডিগ্রির ভেদ করা যাবে না। এছাড়া, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো তৈরী করার জন‍্য দেশীয় সহযোগী নেওয়া যাবে। এটা বাস্তব ও যুক্তিসম্মত। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের শিক্ষাদানের মান, ডিগ্রির মূল‍্য ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেবে।
আমার মনে হয়, protective শিক্ষা ব‍্যবস্থায় যে শিক্ষককুল শিক্ষকতার পেশায় শিক্ষকতা ছাড়া অন‍্য কাজে (!) বেশী আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের পক্ষে এই প্রতিযোগীতা অস্বস্তিকর। সেজন‍্য তারা বেশী চেঁচামেচি করছে! অনেকে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচের কথা তুলেছেন! তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, অক্সফোর্ড, কেম্বিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ তাঁরা জানেন? এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি অর্জনের জন‍্য খরচ দেশের ছাত্রদের নাগালের বাইরে যাবে না। জেএনইউ মার্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর জন‍্য কেন দেশের সাধারন মানুষের করের টাকা লাগামছাড়াভাবে ব‍্যয় করা হবে? elitist তকমা পাওয়া এইসব জায়গার ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রদের থেকে জনসাধারন কি প্রতিদান পায়? যে উচ্চ বেতন পাওয়া শিক্ষককুল এই বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির দেশীয় ক‍্যাম্পাস স্থাপনের বিরোধীতা করছেন, তাঁরা শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁদের বেতনের কত শতাংশ অর্থ ব‍্যয় করেছেন তা জানা নেই! আসলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো মোটা মাইনের শিক্ষককুল এখন ধরা পড়ার ভয়ে শোরগোল করছেন! দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ণ প্রক্রিয়া এভাবে আটকানো যাবে না।