পারভেজ মুশারফ : স্বৈরতন্ত্রী যুদ্ধবাজ দেশপ্রেমিক

গত ৫ই ফেব্রুয়ারী,২০২৩ এ দুবাইয়ের হাসপাতালে পাকিস্তানের স্বঘোষিত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান পারভেজ মুশারফের ৭৯ বছর বয়সে মৃত‍্যু কোন ব‍্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে তাঁর মৃত‍্যুর সঙ্গেসঙ্গে এই উপমহাদেশের মানুষের চরম ক্ষতিকারী একজন স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবাজ সমরনায়কের সব কার্যকলাপ ধুয়ে মুছে যায় না – বিশেষতঃ পাক-ই-স্তানের বর্তমান চরম দুরবস্থার সূত্রপাত তাঁর অদূরদর্শী যুদ্ধবাজ কাজকর্মের জন‍্যই।
মুশারফের পাক-ই-স্তান সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘ সার্ভিসের শুরু হয় তাঁর দুই বন্ধু আলী কুলী খান ও আব্দুল আজিজ মির্জার সঙ্গে ১৯৬৪ সালে। তাঁরা তিনজনই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নেন। মুশারফ প্রথমে আর্টিলারী বাহিনীতে গেলেও ১৯৬৫ ও ১৯৭১এর যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখানোয় তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হকের নেকনজরে পড়েন এবং তাঁর দ্রুত পদোন্নতি হতে থাকে। তাঁকে কাশ্মীর সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়। তিনি পাক-ই-স্তানের মর্যাদাপূর্ণ মেডেল ইমতিয়াজ সনদ পান। পাক-ই-স্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মুশারফের অভিজ্ঞতা পাক-ই-স্তানের পক্ষে অত‍্যন্ত লাভজনক হয়।
মুশারফের জীবন ও কর্মপদ্ধতি অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, অন‍্যান‍্য পাক-ই-স্তানী সমরনায়ক ও রাজনীতিবিদদের মতই তিনি পাক-ই-স্তানের জন্মের পর থেকেই সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে দখল করা এবং ভারতকে সামরিকভাবে ব‍্যতিব‍্যস্ত রেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন! পাক-ই-স্তানকে বিপর্যয় ও ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন‍্য ভারত বিরোধীতা ও কাশ্মীর দখলের জিগির তোলা হত। মুশারফের সময় বারবার কাশ্মীর সমস‍্যাকে রাষ্ট্রসংঘে নিয়ে যাওয়া ও পাশ্চাত‍্য দেশের মিমাংসা করার জন‍্য ভারতীয় ভুখন্ড কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকার তকমা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এটা করতে গিয়ে পাক-ই-স্তানকে জঙ্গী তৈরী থেকে যে বিভিন্ন বিধ্বংসী কাজে মদত দিতে হত তার খরচ জোগাতে পাক-ই-স্তানের অর্থনীতির উপর চাপ পড়া শুরু হয় এই মুশারফের শাসনকালেই।
সামরিক বাহিনীর শিক্ষা মুশারফকে নির্মম ও হৃদয়হীন যোদ্ধা হিসাবে তৈরী করলেও তাঁর এই দুই স্বভাবের প্রতিফলন অসামরিক ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে! তিনি যাকে শত্রু মনে করতেন তার সঙ্গে কুটনৈতিক সৌজন‍্য ততদিন বজায় রাখতেন, যতদিন না সুযোগ আসে সেই শত্রু নিকেশ করার! এখানে উল্লেখ‍্য, আমরা ইতিহাসে যেভাবে মুঘল দরবারের বিশ্বাসঘাতকতা ও পিছন থেকে ছুরি মারার ঘনঘটা দেখি, পাক-ই-স্তানের জন্মের পর থেকে সেখানেও লিয়াকত আলীর থেকে একই নোংরামোর পরম্পরা দেখা যায়! এই পরম্পরার আদর্শ চরিত্র পারভেজ মুশারফ। নওয়াজ শরীফের প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় পাক-ই-স্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর অযৌক্তিকভাবে অসামরিক ব‍্যাপারে হস্তক্ষেপের চেষ্টার জন‍্য শরীফ তাকে বরখাস্ত করেন। সে সময় নওয়াজ শরীফ তাঁর ভাই এবং মন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সুপারিশক্রমে দুজন সিনিয়ার সেনানায়ককে টপকে মুশরফকে চার তারা অফিসারে উন্নীত করে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন! এই সময় মুশারফ আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে গণতান্ত্রিক মূল‍্যবোধের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাহির করেন! পাক-ই-স্তানের জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের চেয়ারম‍্যান হিসেবে শরীফ মুশারফকেই নিয়োগ করেন এবং মুশারফের সিনিয়র এবং নৌবাহিনীর অধ‍্যক্ষ বুখারীকে বরখাস্ত করেন।
ইতিমধ‍্যে মুশারফ সেনাপ্রধান হওয়ার পরেই তাঁর কাশ্মীর ফ্রন্টের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করে শরীফকে কাশ্মীর আক্রমণের ব‍্যাপারে রাজী করান এবং বিনা প্ররোচনায় ভারতের কাশ্মীর আক্রমণ করেন! কারগিল ফ্রন্টে এই হটাৎ আক্রমণের কারনে ৫০০ মত ভারতীয় সেনা শহীদ হন। তারপর পাল্টা আঘাতে পাক-ই-স্তান সেনাবাহিনী দ্রুত পিছু হটে। কারগিল যুদ্ধ স্মৃতি মিউজিয়ামে গেলে দেখা যাবে, সিভিলিয়ানের ছদ্মবেশে পাক-ই-স্তানী সেনারা কার্গিলে ঢুকে যুদ্ধ করেছে – মৃতদের কাছে সেনাবাহিনীর পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে! এমন নোংরামো আগে কখনো হয়নি। সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে মুশারফের মস্তিষ্ক-প্রসুত! মুশারফের পরিকল্পনায় এই যুদ্ধ হলেও তার হারের দায় মুশারফ নওয়াজ শরীফের উপর চাপায়! অথচ, তার উপর বিশ্বস্ততার সুযোগ নিয়ে নওয়াজ শরীফ মুশারফকে কারগিল যুদ্ধের সম্মতি দিলেও যুদ্ধের কয়েকমাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং নওয়াজ শরীফের যৌথ প্রচেষ্টায় লাহোর-পাঞ্জাব বাসযাত্রা শুরু হয়!
যাই হোক, মুশারফের এই অপকর্মের দায় শরীফের উপর চাপিয়ে মুশারফ সেনাবাহিনীর সাহায‍্যে শরীফকে গদিচ‍্যুত করে নিজেকে পাক-ই-স্তানের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ঘোষণা করেন! কালক্রমে মুশারফ বলপূর্বক ভোট-জালিয়াতি করে নির্বাচনে জিতে নিজেকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন! ইতিমধ‍্যে ভারতের হাতে তার অ‍্যাডভেঞ্চারের শখ মিটে যাওয়ার পর ২০০১ সালের জুলাই মাসে আগ্রায় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ও মুশারফের মধ‍্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া স্থির হয়। এই চুক্তিতে দু দেশের সেনা নিয়ন্ত্রণ, পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার-রোধ ও অনাগ্রাসন ইত‍্যাদির বিশদ ব‍্যাখ‍্যা থাকে। সেখানে রাজি হওয়ার পরেও দুই দেশের প্রধানের স্বাক্ষরের কয়েক মিনিট আগে মুশারফ কোন অজুহাত ছাড়াই চুক্তি সই না করেই তড়িঘড়ি দেশে ফিরে যান! মুশারফ শুধু কাশ্মীরে আগ্রাসনই নয়, ভারতের অভ‍্যন্তরে গুপ্তহত‍্যা ও নাশকতা, অন্তর্ঘাত চালিয়ে গেছেন। তাঁর সময়ই Cross-border terrorism এর বাড়বাড়ন্ত হয়। তাঁরই সময়ে ২০০১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনে জঙ্গী হানায় ১৪ জনের মৃত‍্যু হয়। এর দায় নেয় মুশারফের পাক-ই-স্তানে লালিত-পালিত ও প্রশিক্ষিত লস্কর-ই-তৈবা ও জয়শ-ই-মহম্মদ।
ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে জঙ্গী আক্রমণ এবং এই জঙ্গীদের ঘাঁটি তৈরী করে তাদের ট্রেণিং সহ রক্ষণাবেক্ষণের যে নকশা তৈরী করে তার প্রয়োগ গতি পায় মুশারফের আমলেই। মুশারফ অত‍্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে শুধু যে নওয়াজ শরীফকেই বোকা বানিয়েছেন তাই নয়, আফগানিস্তানে আমেরিকার অভি‍যানকে সমর্থন করেও তিনি উপর উপর জঙ্গী দমনের কথা বললেও দেশের অভ‍্যন্তরে ভারতের বিরুদ্ধে সমস্ত রকম ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে মদত দিয়েছেন। তিনি চাপে পড়ে ভোল পাল্টাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ইন্দো-পাক জঙ্গী-বিরোধী প্রক্রিয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে যথারীতি ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ ও জঙ্গী প্রশিক্ষণে গতি আনেন। লক্ষ‍্য করলে দেখা যায়, পারভেজ মুশারফ শুধু কারগিল যুদ্ধের খলনায়ক নন, তিনি ভারত-বিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলির পালক পিতাও বটে!
আবার পাক-ই-স্তানের অভ‍্যন্তরে টিপিক‍্যাল জিহাদী মানসিকতায় তিনি তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কন্ত্র চালিয়ে গেছেন। ২০১৯ সালে তাঁকে অনুপস্থিত অবস্থায় ফাঁসির সাজা শোনানো হয়! পরে লাহোর হাইকোর্ট শুধু ফাঁসি রদ করে। তাঁকে নবাব আকবর বুগতি ও বেনজির ভুট্টোর হত‍্যাকান্ডের অন‍্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি নওয়াজ শরীফ ও তাঁর কাছের মানুষদের কাছে এমন ভাব দেখাতেন যেন তিনি গণতন্ত্রের উপর প্রচন্ড আস্থাশীল। তেমনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক মূল‍্যবোধকে সম্মান জানানোর অভিনয়ে তিনি দেশ-বিদেশের নেতাদের সাময়িকভাবে বোকা বানাতে সক্ষম হন! অথচ, ক্ষমতা পাওয়ার পরপরেই তিনি গণতন্ত্র ত দুরস্ত্, প্রতিবাদের ভাষার কন্ঠরোধ করে দেশে সমস্তধরনের ট্রেড-ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেন! এমনকি ২০০২ সালে উনি যখন নির্বাচনে (যা পাক-ই-স্তানের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী জোচ্চুরীর নির্বাচন বলে চিহ্নিত হয়ে আছে) জিতে দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন, তখনও তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদ ছাড়েননি! আসলে মুশারফ গণতন্ত্রের ভড়ং দেখালেও তিনি ছিলেন আদ‍্যন্ত যুদ্ধবাজ একনায়ক সামরিক প্রধান।
মুশারফের মধ‍্যে জিহাদী প্রবৃত্তি থাকায় তাদের স্বভাব অনুযায়ী তিনি সর্বদা সামরিক অভ‍্যুত্থানের ভয় পেতেন কারন তিনি নিজেই ছিলেন ঐ পথের পথিক! ফলে, তিনি সেনাবাহিনীতে কোন জনপ্রিয় ও উচ্চাভিলাষী অফিসারের খোঁজ পেলেই তাকে বিদায় করে দিতেন! এভাবে সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর প্রভাব পরে এবং বাহিনীতে মোসাহেব অফিসারের সংখ‍্যা বাড়তে থাকে।
মুশারফের একটি বড় সাফল‍্য হল, তার অভিনয় দক্ষতায় তিনি আমেরিকাকে জঙ্গী দমনের মিথ‍্যা প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করাতে বাধ‍্য করানো! তিনি ২০০১-০২ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে আফগানিস্তানের তালিবান জঙ্গীদের বিতাড়নকে সমর্থন করেন এবং সে দেশের সঙ্গে মিলিতভাবে জঙ্গী দমন পদ্ধতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন! একদিকে তিনি জঙ্গী নির্মূল অভিযানে আমেরিকার বিশ্বস্ত জোটসঙ্গী থেকেছেন; অন‍্যদিকে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সাহায‍্য কাজে লাগিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গীগোষ্ঠী, যেমন লস্কর-ই-তৈবা, জয়শ-ই-মহম্মদ ইত‍্যাদিকে পুষেছেন, ট্রেণিং দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে ব‍্যবহার করেছেন। মুশারফের সময়ই পাক-ই-স্তান সেনাবাহিনী ও ISIএর প্রত‍্যক্ষ মদতে ভারত বিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীদের বিপুল সংখ‍্যায় ট্রেণিং সেন্টার খোলা হয়! তখন ভারতে অনুপ্রবেশকারী জঙ্গীদের নাশকতার ব‍্যাপ্তি বাড়তে থাকে। পুরো সিস্টেমটাই মুশারফের আমলে গতি পায়। আরেকটি লক্ষ‍্যণীয় বিষয় হল, মুশারফের আমলেই ভারতে জাল নোট ধরা পরতে থাকে, যা পাক-ই-স্তানের টাঁকশালে ছাপা বলে অভিযোগ ওঠে!
আসলে মুশারফ নিজের স্বার্থের জন‍্য পাক-ই-স্তানের মধ‍্যে যেমন বহু অসৎ কর্ম করেছেন, তেমনি তিনি ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান থেকে কখনো বিচ‍্যুত হননি। ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রথমেই তিনি ভারত আক্রমণ করে কাশ্মীর দখলের যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই যুদ্ধবাজ হটকারী সিদ্ধান্তের জন‍্য সাহস পেয়েছিলেন তাঁর কাশ্মীর ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা থেকে। চাপের মুখে মিষ্টি কথা বলতে অভ‍্যস্ত মুশারফ কখনো ভারতকে টুকরো করার এবং কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি। একসময়, ১৯৭১ এর যুদ্ধে তাঁকে পূর্ব-পাক-ই-স্তানে বদলি করা হলেও পশ্চিম-পাক-ই-স্তানে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় তা শেষ মূহুর্তে বাতিল হয়। মনে হয়, পূর্ব-পাক-ই-স্তানে তাঁর দেশের লজ্জাজনক পরাজয় ও নিয়াজীর অসহায় আত্মসমর্পণ তাঁকে বিচক্ষণ বাস্তববাদী করে তোলার বদলে প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষিপ্ত এক সেনানায়কে পরিণত করে! পাক-ই-স্তানের আভ‍্যন্তরীন রাজনীতিতেও তাঁর এই প্রতিশোধস্পৃহার বহু উদাহরণ আমরা পাই। যাই হোক, এই যুদ্ধবাজ ভারতবিদ্বেষী মানুষটির মত ও পথ আমাদের দেশের তথা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে বিপজ্জনক হলেও তাঁর নিখাত পাক-ই-স্তান প্রেমের জন‍্য অন্ততঃ সাধারণ পাক-ই-স্তানী মানুষজন তাঁকে মনে রাখবে।