কেনিয়ার জঙ্গলে

চরৈবেতি। আবার সুটকেস গুছিয়ে, আধুনিক নাম লাগেজ গুছিয়, বেড়িয়ে পড়লাম আফ্রিকার জঙ্গল দেখতে। কলকাতা থেকে দিল্লীতে প্লেন পাল্টে সোজা নাইরোবি। এয়ার ইন্ডিয়ার ভালো সার্ভিস। সেখানে ইমিগ্রেশান সেরে বাইরে আসার মুখে দেখলাম Karibu Kenya (কেনিয়ায় স্বাগত)। বাইরে আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সোজা হোটেলে পৌঁছলাম রাত আটটা নাগাদ। উল্লেখ‍্য, কেনিয়ার সময় আমাদের থেকে আড়াই ঘন্টা পেছনে। হোটেলে ঘর মিলল সাততলায় – Sarova Panafric। এখানে ডিনারের পর সারা দিনের ধকলের পর দুগ্ধফেননিভ শয‍্যায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা বুঝিনি! পরদিন সকালে wake-up call এ ঘুম ভাঙ্গল। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ব্রেকফাস্টে ডিইনিং হলে পৌঁছলাম। প্রায় পঞ্চাশ রকম আইটেম। টোস্ট, বাটার আর ডিম দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে দু কাপ বিখ‍্যাত কেনিয়ান কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের জন‍্য বরাদ্দ গাড়ি ৪×৪ টয়োটা ল‍্যান্ড ক্রুজার। এই গাড়ির দু দিকে তিনজন করে ছজন বসতে পারে। প্রত‍্যেকের পাশে জানালা আছে। এছাড়া যখন জঙ্গল সফারিতে (এরা বলে গেম ড্রাইভ) যাওয়া হয়, তখন গাড়ির উপরের হুডটা যান্ত্রিকভাবে খানিক উঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, গাড়ির সব সওয়ারি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে চারপাশ দেখতে পারে। এখানে উল্লেখ‍্য যে, গেম ড্রাইভের জন‍্য কয়েকটি নির্দিষ্ট সংস্থা আছে। এরা প্রত‍্যেকেই রেজিস্টার্ড। এদের থেকেই সবাইকে গাড়ি নিতে হবে। এরা জঙ্গলে গেলে প্রত‍্যেক ড্রাইভার কাম গাইডের মধ‍্যে জন্তু-জানোয়ারের অবস্থান নিয়ে ওয়াকিটকিতে খবর আদান-প্রদান হতে থাকে। যার জন‍্য গেম ড্রাইভে এক যায়গায় দ্রষ্টব‍্য কিছু দেখলে সব গাড়ি সেখানে চলে যায়। এদের শৃঙ্খলাপরায়ণতা প্রশংসনীয়। একজনের দেখা হলে সে সরে গিয়ে পেছনের গাড়িকে জায়গা করে দেয়। আমাদের দেশের ড্রাইভারদের এটা শিক্ষনীয়।
           সকালে নাইরোবি থেকে রওনা দিয়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা বাদে Amboseli পৌঁছে AA Amoseli লজে পৌঁছলাম। মালপত্র রেখে লাঞ্চে গেলাম। গরু আর শুয়োরের মাংস ছাড়া কিছু শাক পাতা আর মোটা চালের ভাত। কোনরকমে খিদে মেটানোর জন‍্য ঐ শাকপাতা আর ভাত খেলাম! তারপর Amboseli ন‍্যাশনাল পার্কে তিন ঘন্টার জন‍্য গেম ড্রাইভে বেরোলাম। আগে থেকে বুকিং না থাকায় আমাদের গেটের সামনে প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। তার পর পার্কে ঢুকতে পারলাম। জঙ্গলের মধ‍্যে সব কাঁচা রাস্তা, গাড়িতে ঝাকুনি খেতে খেতে এগোলাম। মাঝে মধ‍্যে আমাদের ড্রাইভার-কাম-গাইড মরিস বলতে লাগল কোথায় কি দেখা যাচ্ছে! তারা সর্বদা গেম ড্রাইভে আসা অন‍্য ড্রাইভারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে। প্রথমে ঘাড়ে এবং পিঠে কালো চুল ওয়ালা গরুর মত দেখতে একদল প্রাণীকে দেখলাম। মরিস জানালো এরা ওয়াইল্ডি বিস্ট! এরা অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। সিংহ, চিতা বিশেষ ভাবে এদেরকেই শিকার করে। এরা তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে না। জিরাফ আর জেব্রা এদের থেকে যেমন দ্রুত দৌড়াতে পারে, তেমনি তারা অনেক বেশি সতর্ক। এছাড়া একপাল হাতি দেখলাম – আফ্রিকার বিশাল চেহারার লম্বা দাঁতওয়ালা হাতি। এরা যুথবদ্ধভাবে ছিল। আমাদের গাড়িকে দাঁড় করিয়ে এরা রাস্তা পার হল (ছবি নম্বর ১)। খানিক এগিয়ে একদল জিরাফের দেখা পেলাম। তারা শুকনো ঘাস খাচ্ছিল। মরিসের কাছ থেকে শুনলাম, ওদের জীভ খুব শক্ত হওয়ায় ওরা শুকনো ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে। ওরা প্রচন্ড গরমে রোদে থেকেও খুব সতেজ। তার কারন ওদের গায়ের সাদা কালো ডোরা! কালো যেমন সূর্যের আলো শোষণ করে তেমনি সাদা রং আলো প্রতিফলিত করে। তারপর দেখলাম তিনটি জেব্রা। দুটি পূর্ণ বয়স্ক আর একটি ছোট। মনে হল একটি পরিবার। সবচেয়ে কাছের বড় জেব্রাটি আমাদের গাড়িকে খানিকক্ষণ দেখে তারপর মনে হল আমাদের দেখানোর জন‍্য সে ক‍্যাট ওয়াক করতে করতে দুরে চলে গেল। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। সাধারণ মানের ডিনারের পর বিশ্রাম ও ঘুম। পরদিন সকাল ছটায় রেডি হয়ে টোস্ট, ওমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্টের পর লাগেজ গুছিয়ে সোজা গাড়িতে। ঠিক আটটায় গাড়ি ছাড়ল। আমরা ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে Ambosoliর Sentrim Camp এ পৌঁছলাম। এদের ব‍্যবস্থা অনেক উন্নত। ক্লোক রুমে মালপত্তর রেখে গাড়িতে উঠে চললাম সারা দিনের Amboseli গেম রাইডে। এবার মরিস আগে থেকে আমাদের সকাল দশটার মধ‍্যে এন্ট্রি পারমিট করিয়ে রাখায় আমরা সময়ের পনেরো মিনিট আগেই জঙ্গলে ঢুকলাম।
               প্রথমে চোখে পড়ল বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ।গাঢ় বাদামী চামড়ার হরিণকে বলে এ‍্যান্টিলোপ টোপী। এরপর এগিয়ে গিয়ে আগের দিনের থেকে বেশি সংখ‍্যায় হাতির পাল, জিরাফ, জেব্রা দেখলাম। আর ছিল অজস্র ওয়াল্ডি বিস্ট। হটাৎ একসময় মরিস ফোনে কথা বলার পর গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত অন‍্য রাস্তায় নিয়ে এল! তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দূরে দেখালো একটি পূর্ণ বয়ষ্ক সিংহি। প্রথমে সে শুয়ে ছিল। গাছের ছায়া পেয়ে গরমে ক্লান্ত সিংহি বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারপর বসল, শেষে এত গাড়ি দেখে বোধহয় বিরক্ত হয়ে আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভিতরে অনেকটা দূরে চলে গেল! তারপর নির্দিষ্ট এক জায়গায় এসে আমরা অর্থাৎ সব গাড়ির আরোহীরা আমাদের সঙ্গে আনা লাঞ্চ প‍্যাকেট খুলে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর ফেরার পালা। বিকেলে হোটেলে ফিরে নিজেদের নির্দিষ্ট তাঁবুতে গেলাম। খানিকক্ষণ বাদে আমাদের মালপত্র ক্লোক রুম থেকে এসে পৌঁছলো। আমাদের দলের মধ‍্যে আমাদের তাঁবুটাই সবচেয়ে দূরে। একদম জঙ্গলের পাশে। তাঁবু পেছনের দরজা খুলে দেখলাম দুটো চেয়ার আর ছোট একটা টেবিল আছে। তাঁবু শুধু নামেই। সুন্দর পরিপাটি খাট-বিছানা, সব আধুনিক ব‍্যবস্থা সহ টয়লেট, লাগেজ রাখার জায়গা, গরম জলের ইলেক্ট্রিক কেটলি ও চা, কফি, চিনি এবং সুগার ফ্রি সব সাজানো। চেন টেনে নেট দেওয়া জানালা খোলা-বন্ধ করা যায়! আমি দু কাপ কফি (কেনিয়ার বিখ‍্যাত কিলিমাঞ্জারো রোষ্টেড কফি) নিয়ে পেছনের বারান্দায় বসলাম। কিছু দূরে দুটি হরিণ আপন মনে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিল। সন্ধে হতে ভিতরে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দিলাম। এই অঞ্চলে ডিনার টাইম সন্ধে সাতটা থেকে রাত নটা। আমরা বাড়িতে রাত দশটায় খাই। যেহেতু কেনিয়া আমাদের থেকে আড়াই ঘন্টা পেছনে, এই ডিনারের সময়টা আমাদের খুব স‍্যুট করেছিল। রাতে ডিনারে মাছের ফ্রাই আর ডিম ছাড়া আমাদের খাবার বলতে সাদা ভাত ও রুটি। অনেক আইটেম ছিল বিফ, পর্কের। তবে, কেনিয়ার কোথাও খাবারের সঙ্গে জল দেয় না! আলাদা করে দু-তিন ডলার দিলে ৫০০ ml এর ছোট বোতল দেয়।সব হোটেলে প্রতিদিন এক লিটার করে জল দিত আর গেম ড্রাইভে জল ত ফ্রি। এছাড়া আমি কেনিয়া সফরের জন‍্য আলাদা করে এক বাক্স (৫০০ml এর ২৪ বোতল জল একটি মল থেকে দরদাম করে ৬ ডলারে কিনেছিলাম। তাতেই আমাদের খাবার জল নিয়ে কোন অসুবিধা হয়নি। কেনিয়া ভ্রমণে এ ব‍্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
            পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম লেক এলিমেন্টাইটার কোলে Sentrim Elementaita Camp এর উদ্দেশ‍্যে।লেকের কোল ঘেঁসে আমাদের ছোট ছোট বাংলোর আদলে লাক্সারি  তাঁবু। আমরা লাঞ্চ সেরে লেকের কোল ঘেঁষে আমাদের ডবল বেড বাংলোর উঠোনে চেয়ারে বসে লেকের উপর প্রচুর পাখির সমাবেশ দেখলাম! বেশিরভাগ পাখিই সাদা রংয়ের। এরা আবার উড়তে উড়তে ছোঁ মেরে অত‍্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে লেকের জলের উপরিভাগে থাকা মাছ শিকার করছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের বনফায়ারের আয়োজন ছিল। তিন-চার রকমের হুইস্বি, ভদকা ছাড়াও রাম ছিল। ও রসে বঞ্চিত আমি গ্লাস তিনেক ভার্জিন মোজিটো ও এক গ্লাস ব্লু লেগুনের সঙ্গে যথেষ্ট কাজু, পেস্তার সদ্ব‍্যবহার করলাম!
            পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর মাসাইমারার দিকে রওনা দিলাম। পথে এ অঞ্চলের একমাত্র মিষ্টি জলের লেক Naivasaয় এক ঘন্টার বোট রাইডের সময় বহু রকমের পাখি দেখলাম। আর দেখলাম জলের মধ‍্যে দেহ ডুবিয়ে শুধু মাথা আর পিঠের উপরিভাগটুকু দেখা যাচ্ছে এমন অনেক জলহস্তি! আমাদের স্থানীয় গাইড বলল, এরা নাকি দিনের বেলা এভাবে ডুবে থেকে খাবার হজম করে! পরে মাসাই নদীতে এমন অনেক দৃশ‍্য দেখেছি।
             আমরা মাসাইমারার Mara Sentrim Camp এর নির্দিষ্ট কটেজে উঠলাম। এদের নাম ও দাম অনুযায়ী ব‍্যবস্থাপনা কিন্তু মোটেই আশানুরূপ নয়। এদের বাথরুমের গরম-ঠান্ডা জলের মিশ্রণ ঠিকমত কাজ করে না। বিছানা দুজনের পক্ষে শুধু ছোটই নয়, বিছানার ম‍্যাট্রেস মোটেই আরামদায়ক নয়। এখানে পোকার উপদ্রব যথেষ্ট। যাক সে কথা। আমরা পৌঁছে জিনিষপত্র রেখে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করেই মাসাইয়ের জঙ্গলে ঢুকলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড মরিস জানালো আজ যেদিকে যাচ্ছি, কাল সে দিকে যাব না! তবে, জানা গেল দি গ্রেট মাইগ্রেশান নাকি আগের সপ্তাহে হয়ে গেছে! এই সময় তাঞ্জানিয়ার জঙ্গল থেকে জন্তু জানোয়াররা দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে কেনিয়ার জঙ্গলে আসে। একই জঙ্গল – কেনিয়ায় নাম মাসাইমারা আর তাঞ্জানিয়ায় নাম সেরেঙ্গেটি। অবশ‍্য সেরেঙ্গেটির জঙ্গল মাসাইমারার থেকে কয়েকগুণ বড়। জঙ্গলের মাঝে বয়ে চলেছে মাসাই নদী।
            ঘন্টা দুয়েকের জঙ্গল সফারিতে দেখলাম অসংখ‍্য জেব্রা, দশ বারো প্রজাতির হরিণ, ওয়াল্ডি বিস্ট এবং হাতির পাল (ছবি নং ১)। আর দেখলাম জিরাফের পরিবার! জিরাফের cat walk দেখার মত। আমরা ভিডিও তুলে রাখলাম।
                পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমরা প‍্যাকড লাঞ্চ নিয়ে সকাল সকাল মাসাই ড্রাইভে জঙ্গলে ঢুকলাম। এদিনও প্রচুর জেব্রা, আর হরিণ, ওয়াইল্ডি বিস্ট দেখলাম। একটি সিংহ বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ায়ে ছিল। তারপর আস্তে আস্তে খানিকটা কাছে, ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু দূরে  সাত-আটটা জেব্রা একদম চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে পড়তে সিংহটা সরাসরি তাদের দিকে তাকালো। আবার কয়েকটি জিরাফ খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে লক্ষ‍্য করতে লাগল! আমরা রুদ্ধশ্বাসে ক‍্যামেরা রেডি রাখলাম ‘কিল’ দেখার উত্তেজনা নিয়ে। কিন্তু প্রায় মিনিট দশেক এভাবে কাটার পর সিংহটা ওখানে প্রথমে বসল, তারপর শুয়ে পড়ল। বোঝা গেল পশুরাজের পেট ভর্তি। তখন জেব্রা আর জিরাফরা নাজেদের গন্তব‍্যে এগোল। বিকেল নাগাদ আমরা জঙ্গলের একদিকে মাসাইদের গ্রামে গেলাম তাদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে। সে এক ভিন্ন গল্প। আমরা মাসাইমারার জঙ্গলের একদম শেষ প্রান্তে তাঞ্জানিয়ার সঙ্গে জঙ্গলের শেষ সীমায় পৌঁছে ছবি তুললাম (ছবি নং ২)। তারপর ক‍্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম।

ডঃ নারায়ণ চক্রবর্তী