ভারতে বিদেশী আক্রমণের আশঙ্কা আদৌ আছে কি

ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত,ভারত কোন প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কি হবে – এমন সব প্রশ্নের উত্তর ইদানিং মানুষ চাইছে – এমনকি এই অভাজনের কাছেও। এই বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞ আছেন; তাঁরা অনেককিছু বিশ্লেষণ করে গুরুগম্ভীর উত্তর দেন – যা এটাও হয়, ওটাও হয় গোছের! এ যেন জ‍্যোতিষীর হস্তরেখা বিচার – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মোড়কে!
এখানে পরিস্থিতি ও পারিপার্শিকতা বিচার করে সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমেই যেটা বলা দরকার তা হল, এই উপমহাদেশে satellite রাষ্ট্র নেপাল ও ভুটানের ভৌগলিক অবস্থান এবং সমরশক্তি এমন নয় যে, তারা ভারতের পক্ষে কোন বড় বিপদ হতে পারে। বরঞ্চ দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের মধ‍্যে buffer states হিসাবে যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমনের কাজে লাগতে পারে – যেমন, এক সময় সাবেক USSR ও চীনের মধ‍্যে buffer state হিসাবে মঙ্গোলিয়ার ভূমিকা ছিল। এখনো এই ধরনের রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আছে। বাকী রইল শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাক-ই-স্তান।
এই তিন দেশের দুর্বল অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে চীন তাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ভারত-বিরোধী কাজের প্ররোচনা দিচ্ছে। এইভাবে তিন দেশেই সরকারকে এরা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে অথবা বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভারতের অভ‍্যন্তরে অস্থিরতা তৈরী করতে চাইছে বলে অভিযোগ। অর্থাৎ চীন সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে না – অন‍্য দেশের সাহায‍্যে ভারতের অভ‍্যন্তরে এবং সীমান্তে অস্থিরতা তৈরীতে মদত দিচ্ছে। চীনের আভ‍্যন্তরীন সমস‍্যা এবং অর্থনৈতিক স্থিতি বিচার করলে তাদের দেশের বিস্তারধর্মী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামার কোন কারন নেই। তবু, গালওয়ান পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহ প্রমাণ করে, চীন উপযাচক হয়ে ভারত আক্রমণের ঝুঁকি নেবে না।
এর কারন খুঁজতে গেলে আমাদের বর্তমানে চলা রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে তাকাতে হবে। গত আট মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার বাহিনী দ্রুত ইউক্রেনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারলেও যত সময় গড়িয়েছে, ইউক্রেন ততই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হ‍্যাঁ, একথা ঠিক যে আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলি, বিশেষতঃ ন‍্যাটো-শক্তি ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্রসহ গোলাগুলি ও আনুসঙ্গিক সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে উন্নততর ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়ার বাহিনীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে শুধুমাত্র ইউক্রেনীয়দের। এভাবে সময়ের সাথে সাথে অসম যুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্লা দিয়ে লড়াই দেওয়ার মধ‍্যে যুদ্ধের একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কথা উল্লেখ করা দরকার। সেই রামায়ণ, মহাভারতের সময় থেকে সব যুদ্ধের ফলাফল একই নিয়মে নির্ণীত হয়েছে। তা’হল আদর্শ বা বাঁচার জন‍্য লড়াইয়ের বিরুদ্ধে পেশাগত কারনে আদর্শহীণতার লড়াইয়ে সর্বদা প্রথম পক্ষের জয়। প্রশ্ন থাকতে পারে, ভারতের বুকে ইসলামী শক্তির জয় নিয়ে – এখানে লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, ইসলামী শক্তি তাদের বিস্তারমূলক ধর্মীয় আগ্রাসনের আদর্শকে সামনে রেখে ভারতে তাদের জয় হাসিল করে। পক্ষান্তরে পরাজিত শক্তির ধর্মীয় উগ্রতা না থাকায় তারা লড়াই জেতার জন‍্য অতিরিক্ত শক্তি নিয়োজনের আকাঙ্খা করেনি। আবার মুঘল রাজত্বের শেষদিকে, বিশেষতঃ ঔরঙ্গজেবের সময় ধর্মীয় আগ্রাসনের আড়ালে শুধু অত‍্যাচার নির্ভর প্রশাসনকে শায়েস্তা করার জন‍্য মারাঠা ও রাজপুত বাহিনীর জয় এসেছিল একই কারনে – ধর্মীয় আদর্শ রক্ষার তাগিদে। পরবর্তী সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকার মত সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ শুধু আদর্শহীণতার কারনে দেশপ্রেমিক শক্তির আদর্শের কাছে পরাজিত হয়। এসব ছাড়াও সাম্প্রতিককালে তালিবানদের ইসলামী (তাদের মত করে) আদর্শের কাছে আফগানিস্তানে আগ্রাসী শক্তির পরাজয় ঘটে। সুতরাং, ইউক্রেন যখন তাদের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদে যুদ্ধে নেমেছে, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যত সময় গড়াবে, রাশিয়ার জয় তত শক্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। হ‍্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। এটা ঠিক যে, অন‍্যদেশে যারাই আগ্রাসন চালাতে গেছে, তাদেরই সেখানে সেই যুদ্ধে পরাজয় হয়েছে। অবশ‍্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্ণায়ক হয়েছে জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণ! রাশিয়া যদি এই যুদ্ধ জিততে চায় তবে তাকে প্রতিবেশী ইউক্রেনের উপর পারমাণবিক আঘাত হানতে হবে। এই মূহুর্তে পরমাণু অস্ত্রের ব‍্যবহারের অনুকুল পরিস্থিতি না থাকায় পরমাণু অস্ত্রের ব‍্যবহার সম্ভব নয়।
ফিরে আসি ভারতের উপর চীনের আগ্রাসন প্রসঙ্গে। সেখানে মনে রাখতে হবে, ভারত ও চীন – দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর এবং দুদেশের পারমাণবিক মিসাইল ক্ষেপণ ক্ষমতা এতটাই যে, অতি অল্প সময়ে দুটি দেশই একে অপরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। এইজন‍্যই দুটি দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব‍্যবহার করতে পারবে না। ফলে, চীনের দিক থেকে ছোটখাটো অনুপ্রবেশের চেষ্টা ও সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখলর চেষ্টা ছাড়া সরাসরি বড় ধরনের দখলদারি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা নেই। আবার উপমহাদেশ চীনের একাধিপত‍্য কায়মের প্রধান বাধা ভারত। সেজন‍্য চীন ভারতকে ব‍্যতিব‍্যস্ত রাখার জন‍্য অপ্রত‍্যক্ষ যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর কিছু ভুল নীতি এবং গণতন্ত্রের নামে তার সুযোগের যথেচ্ছাচার দেশের জাতীয়তাবোধের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। দেশের রাজনীতিকদের একাংশ ভারতে রাজনীতি করলেও অন‍্য দেশের সরাসরি লাভ হয় এমন কাজে লিপ্ত থেকে দেশের জাতীয়তাবাদ ও অখন্ডতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। কাশ্মীরের হিন্দু-পন্ডিতদের গণহত‍্যার সময় সেখানে মূখ‍্যমন্ত্রী ছিলেন ফারুখ আবদুল্লা। তিনি সম্প্রতি সেখানে পাক-ই-স্তানের মদতপুষ্ট জেহাদীদের দ্বারা হিন্দু-পন্ডিতদের হত‍্যার বিষয়ে মন্তব‍্য করেছেন, কাশ্মীরিদের পূর্ণ ইন্সাফ না মেলা পর্যন্ত এই হত‍্যালীলা চলবে! কোন সুসভ‍্য দেশ দুরের কথা, তাঁর প্রিয় পাক-ই-স্তানে দাঁড়িয়ে তিনি যদি সেখানকার ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু মানুষদের হত‍্যা প্রসঙ্গে এমন মন্তব‍্য করতেন তবে, হয় তিনি তৎক্ষণাৎ জেলে যেতেন বা তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়া হত। আশ্চর্য হল, এমন মন্তব‍্যের পর্যন্ত এই দেশে কোন বিরোধীতা হয় না। কিছু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি একে সমর্থন করে আর সরকার গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে চুপ করে থাকে। এই ধরনের রাজনীতি ভারতের স্থায়ীত্বের পক্ষে এই মূহুর্তে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। রাজনৈতিক কারনে ধর্মকে সামনে রেখে আসাদউদ্দিন ওয়েসীর মত নেতা দেশের অখন্ডতার বিরুদ্ধাচরন করলে তা নিয়ে বিশেষ প্রতিবাদ হয় না! কম‍্যুনিস্ট রাজনীতিকরা এবং তাদের চিন্তাধারায় লালিত ও পুষ্ট কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম যখন দেশের অখন্ডতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে”র মত নাড়া লাগান, তাদের পযর্ন্ত কোন শাস্তি হয় না। এভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের শিকড়কে স্বাধীনতার পর থেকেই উপড়ে ফেলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বেশীদিন এভাবে চললে এমন সময় একদিন আসবে যখন দেশের এক বড় অংশের মানুষ আর ভারতকে নিজের দেশ বলে মানবে না! চীনের নেতৃত্বে ও উপমহাদেশের অন‍্যান‍্য রাষ্ট্রের কিছু মানুষের মদতে ভারতের অভ‍্যন্তরে এমন বিচ্ছিন্নতার বাতাস লাগানোর কাজ পুরোদমে চলছে। এছাড়া, কিছু রাজনীতিক ভোটের স্বার্থে ভারতের অভ‍্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে পরোক্ষ সমর্থন জোগাচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ ভারতের খন্ডিত স্বাধীনতালাভের সময়েই প্রোথিত হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে ত্রিখন্ডিত হয়ে দুটি খন্ডে ধর্মের ভিত্তিতে শাসনব‍্যবস্থা কায়েম হলেও ভারতে সংখ‍্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগ গুরুত্ব পেল না। বরং যে ধর্মের মানুষদের কারনে দেশ ত্রিখন্ডিত হল, সেই ধর্মের মানুষদের ধর্মাচরণের বিশেষ সুবিধাসহ “ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু”র অধিকার ভারতে স্বীকৃত হল! এখানেই স্বাধীন ভারতে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করা হল। কোন দেশ তার জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ ছাড়া বাঁচতে পারে না। যখন ভারতের জাতীয়তাবোধের উপর আঘাত আসে তখনই কম‍্যুনিস্টসহ বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় ও কিছু রাজনীতিক তাতে বাতাস দেয়! ভারতে যে কোন কাজের জন‍্য যোগ‍্যতার প্রয়োজন হলেও রাজনৈতিক নেতা হতে এবং ভোট রাজনীতিতে টিঁকে থাকতে কোন যোগ‍্যতা লাগে না। এর জন‍্যই দেশের রাজনীতিতে এত অসততার আধিক‍্য।
একটি কথা ভারতের রাজনীতিবিদদের মাথায় আসে না – যদি তাদের মদতে বিদেশী শক্তির হাতে দেশের একটি অংশের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়, তবে সেই বিদেশী শক্তি প্রথম সুযোগেই ভারতীয় রাজনীতিকদের নিকেশ করবে – এটাই স্বাভাবিক। যে কোন রাষ্ট্রের স্থায়ীত্বের ভিত্তি তার জাতীয়তাবাদ এবং জনসাধারণের জাতীয়তাবোধ। এমনকি তথাকথিত কম‍্যুনিস্ট চীনের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ‍্য। ইসলামী মানুষদের সংখ‍্যাধিক‍্যের দেশ ইন্দোনেশিয়া তাদের জাতীয়তাবোধের জন‍্য জাতীয় বীর হিসেবে শ্রীরাম ও অর্জুনকে বেছে নিয়েছে – সে দেশের বিভিন্ন স্ট‍্যাচু ও সংস্কৃতিতে তার ছাপ দেখেছি। দেশের অখন্ডতা ও সুরক্ষার প্রধান হাতিয়ার এই জাতীয়তাবোধকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভারতীয়দের দ্বারাই আঘাত করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে! এটি গভীর দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ। দেশের সরকার যদি এসব দ্রুত বন্ধ না করে তা’হলে অচিরেই তা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।
এবার আসি ভারতের অন‍্য প্রতিবেশীদের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনায়। প্রথমে আসে পাক-ই-স্তানের নাম। খন্ডিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ‍্য ভারতের উপর আগ্রাসন চালানো। তার সেই চেষ্টা পরপর তিনবার ব‍্যর্থ হলেও পাক-ই-স্তানের সেনাবাহিনীর মদতপুষ্ট রাজনৈতিক নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জিহাদকে ধর্মের মোড়কে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন যে এখন সর্বদা ভারতের সক্রিয় বিরোধীতা না করলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। এজন‍্য প্রাক-স্বাধীনতা পর্যায়ে গান্ধী-নেহরু জুটির দায় থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নেহরুর আগবাড়িয়ে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির খেসারত আজও ভারতকে দিতে হচ্ছে। আজ কাশ্মীরকে অশান্ত করার চেষ্টার মূল কান্ডারী পাক-ই-স্তান ও কাশ্মীরের কিছু ইসলামী-ভারতীয় নাগরিক – যারা পাক-ই-স্তানপন্থী ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বিশেষতঃ কাশ্মীরের দু তিনটি ইসলামী রাজনৈতিক পরিবার প্রথম থেকেই ভারতের জাতীয়তা-বিরোধী আন্দোলনে কাশ্মীরি ইসলামীদের শামিল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে – এখনো তা চালানোর সুযোগ খুঁজছে। শক্ত হাতে এই গোষ্ঠীর মোকাবিলা করলে এবং পাক-ই-স্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মুক্তির দাবীর সক্রিয় সমর্থন করলে ভারত অদুর ভবিষ্যতে পাক-ই-স্তানের দিক থেকে ক্ষতির আশঙ্কাকে প্রশমিত করতে পারবে।
বাংলাদেশে কিছু ইসলামী জিহাদী এবং শ্রীলঙ্কার একাংশ মানুষ চীনের প্ররোচনায় পা দিয়ে ভারতের সক্রিয় বিরোধীতার চেষ্টা করলেও এই দুটি দেশের সরকার তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ করার সাহস করবে না। ভূটান বা নেপাল – দুই স্থলবেষ্টিত প্রতিবেশী যতই প্রলোভন থাকুক, ভারতের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের ধৃষ্টতা দেখাতে পারবে না।
সুতরাং, একমাত্র পাক-ই-স্তান, যে একটি পরমাণু অস্ত্র সম্বৃদ্ধ দেশ, ভারতের বিরুদ্ধে তার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আতঙ্কবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে চেষ্টায় ভারতের অভ‍্যন্তর থেকে খোলাখুলি বা গোপনে যেসব মদত দেওয়া হচ্ছে, তার উৎসগুলি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদক্ষপে বন্ধ করলেই পাক-ই-স্তানের ভারত-বিরোধীতার বিষদাঁত ভেঙ্গেদওয়া সম্ভব হবে।
পরিশেষে বলি, পাক-ই-স্তান পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হলেও তার দিক থেকে ভারতের উপর পারমাণবিক আঘাত করার সম্ভাবনা নেই। পাক-ই-স্তান যত সময় নিয়ে ভারতের চার বা পাঁচটি শহরের উপর পারমাণবিক বোমার আঘাত হানতে পারে, তার থেকে কমসময়ে ভারতের পরমাণু বোমার আঘাতে পাক-ই-স্তান দেশটাই একটি তেজস্ক্রিয় জোনে পরিণত হবে – যখন পৃথিবী বলবে “এখানে পাক-ই-স্তান বলে একটি দেশ ছিল” কাজেই পাক-ই-স্তানের দিক থেকে ভারতে পরমাণু আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। তবে পাক-ই-স্তানের পরমাণু অস্ত্র থাকাটা তাদের একটাই স্বস্তি দেবে যে তারা ভারতসহ অন‍্য কোন দেশের পারমাণবিক আক্রমণের শিকার হবে না! ভারতে খুচরো নাশকতামূলক কাজকর্মে মদত দেওয়া বন্ধ করার জন‍্য ভারতের সরকারের তরফে কড়া দাওয়াইয়ের প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক অশান্তি ও অরাজকতা নয়, রাজনীতির অলঙ্ঘনীয় নীতি হোক, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ – যাকে সারা পৃথিবীর অন‍্য সব দেশ মাণ‍্যতা দেয়।

ভারতের সংবিধানের পুনর্মূল‍্যায়ন জরুরী

ভারতমাতার পরনের শাড়িটি যদি দেশের সংবিধান হয়, তাহলে বলতেই হবে, আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুসারে শতদীর্ণ, তালি-তাপ্পার প্রভাবে আসল শাড়ি আর নজরে পড়ছে না! আমাদের ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়ার পর পশ্চিম ও পূর্বদিকের দুই ভূখন্ডের রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম, আর তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বের অদূরদর্শীতায় ভারতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা স্বীকার করে নেওয়া হল।
সংবিধানের ২৫ নং ধারায় আছে – মুক্ত বিবেক, মুক্ত পেশা এবং ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সকল ভারতীয়ের অধিকার। ২৫(২)(বি) অনুচ্ছেদ বলছে, হিন্দুদের সর্বজনীন ধর্মস্থানে হিন্দুদের অবাধ প্রবেশিধার আছে। আবর ২৬ নং ধারা বলছে, ধর্মীয় কাজে ভারতীয়দের অধিকার স্বীকৃত; সেইসঙ্গে বলছে, “This right has to be excercised in a manner that is in conformity with public order, morality and health”! এই conformityর ব‍্যাপারটা খানিক কল্পিত ও ব‍্যক্তিবিশেষের বোধের উপর নির্ভরশীল, আর বাকিটা ধর্মীয়বোধের interpretation এর উপর নির্ভরশীল! ২৭ নং ধারা অনুযায়ী যে কোন ভারতীয়ের ধর্মের জন‍্য অর্থ (tax) দেওয়া স্বীকৃত হলেও বাধ‍্যতামূলক নয় – যেখানে প্রদত্ত অর্থ একটি বিশেষ ধর্মের উন্নতিকল্পে এবং তার খরচখরচা চালানোর জন‍্য ব‍্যবহৃত হয়। ২৮ নং ধারাটি অত‍্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। এখানে বলা আছে যে, সরকারের টাকায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কোন ধর্মীয় নির্দেশ দেওয়া যাবে না।
এই কটি অনুচ্ছেদই ধর্ম সম্পর্কিত। এগুলি ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, সংবিধান প্রণেতারা এগুলি তৈরী করেছিলেন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের কথা বিশেষভাবে মাথায় রেখে। অন‍্য ধর্মগুলি, বিশেষতঃ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত কোন রকম সাংবিধানিক বাধ‍্যবাধকতা রাখা হয়নি; তেমনই সাংবিধানিক অধিকারের কথাও বলা হয়নি! কারন মনে হয়, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের ও অন‍্য দুটি ভূখন্ডের ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে মাণ‍্যতা দেওয়ার কারনে সংবিধান প্রণেতাদের মাথায় ইসলামী ধর্মাবলম্বীদের জন‍্য ভারতীয় সংবিধানে rights and privilege এর ব‍্যাপারে কিছু বলা হয়নি – কারন তাদের জন‍্য ভারতভাগ করে আলাদা দুটি ভূখন্ড দেওয়া হয়েছিল। এগুলি এই মূহুর্তে যথেষ্ট স্ববিরোধী ও পক্ষপাতমূলক মনে হতে পারে।
এখন জনসংখ‍্যার নিরিখে ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ ইসলামী নাগরিকের বাস। পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র নেই যেখানে ৩০ শতাংশ কোন ধর্মের মানুষের বাস থাকলে তাদের ঐ দেশে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বলা হয়। আমাদের নির্বাচনী- গণতন্ত্রে ৪৯ শতাংশ মানুষ যদি কাউকে সমর্থন জানান তা হলেও তিনি পরাজিত হতে পারেন – এমনকি বিরোধী প্রার্থীর তুলনায় এক ভোট বেশী পেলেও একজন বিজয়ী হতে পারেন! এই সংখ‍্যার নিরিখে রাজনীতির গদির ফয়সলা হলেও এভাবে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বা সংখ‍্যাগুরু নির্বাচন করা যায় না। আমাদের সংবিধানে কোথাও ইসলামী মানুষদের ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বলা হয়নি – যা সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা তাদের দলীয় ও ব‍্যক্তিগত স্বার্থে চিহ্নিত করেছেন – এর কোন সাংবিধানিক বৈধতা নেই। হিন্দুরা যদি ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু হন, ইসলামীরা তাহলে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু।
ধারা ১৪ অনুসারে যে কোন নাগরিক ভারতে আইনের চোখে সমান। ধারা ১৫ নং অনুযায়ী নাগরিকদের মধ‍্যে ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত, লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম‍্য করা যাবে না। আবার ১৬ নং ধারা অনুসারে যে কোন নাগরিকের চাকরী ও জীবিকার ক্ষেত্রে সমান অধিকার! আর, সকল ভারতীয়ের ছটি মৌলিক অধিকার, যা অলঙ্খনীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় তা হল – বক্তব‍্য প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েতের অধিকার, সংঘ (association) গঠনের অধিকার, দেশের যে কোন স্থানে গমন ও বসবাসের অধিকার এবং নিজের পছন্দের আইনসিদ্ধ কর্মসংস্থানের অধিকার। এগুলি ১৯ নং ধারায় লিপিবদ্ধ আছে।
এবার যেটা লক্ষ‍্য করার বিষয় তা হল, ভারতের নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট মৌলিক অধিকার ও ধর্মাচরনের অধিকার – যা সংবিধানে স্বীকৃত – তা এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে নাগরিকদের কাছে অনেক সময়ই পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলির মধ‍্যে স্ববিরোধীতা – যার সুযোগে খন্ডিতভাবে একটি বা দুটি অনুচ্ছেদ ধরে তার ব‍্যাখ‍্যা করলে তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী!
যেমন, সকল ভারতীয়ের ধর্মাচরনের সমান অধিকার – সংবিধান স্বীকৃত। অথচ ধর্মাচরন ও তার সীমারেখা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। হিন্দুদের গণেশ চতুর্থী থেকে দূর্গাপুজা, কালীপুজা ইত‍্যাদির অধিকার যেমন স্বীকৃত, তেমনি ইসলামে মূর্তিপুজা নিষিদ্ধ – এমনকি মূর্তিপুজার বিরোধীতা করা জায়েজ! অর্থাৎ ইসলামীরা তাদের ধর্মীয় কারনে যখন হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙ্গে, পুজা পন্ড করে, তা তাদের ধর্মাচরণ! এটি কি করে সংবিধান স্বীকৃত হয়? হয়ত এইসব চিন্তা করেই মহম্মদ আলী জিন্না সকল ভারতীয় ইসলামীদের জন‍্য তাদের পাক-ই-স্তান (আল্লার স্থান) চেয়েছিলেন – যুক্তি ছিল, হিন্দু ও ইসলামী দুই পৃথক জাতিসত্বা হওয়ায় তাদের সহাবস্থান অসম্ভব। বাস্তবতা জিন্নার পক্ষে থাকলেও ভারতীয় হিন্দু নেতৃত্ব, বিশেষতঃ কংগ্রেসের নেহরু-গান্ধী এবং তাদের পরম্পরা ভারতের মধ‍্যে এই দুই ভিন্ন জাতিসত্বার সহাবস্থানের জন‍্য জোরজবরদস্তি করে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও সামাজিক অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে।
১৯৭৬ সালে জরুরী অবস্থার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ইতিহাসে বৃহত্তম, ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে দেশের মূল সাংবিধানিক কাঠামোটাকেই পাল্টে দিলেন। তাঁর অত‍্যধিক উচ্চাকাঙ্খা এবং অসার দম্ভ তাঁকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাঁর নির্বাচন বাতিলের রায়কে হজম করতে বাধা দেয়। তিনি সংবিধান সংশোধন দ্বারা সংবিধানে প্রদত্ত আদালতের অধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এই সময় তিনি তাঁর সোশালিষ্ট মনোভাবাপন্ন কিন্তু প্রকারান্তরে কম‍্যুনিস্ট মানসিকতার কাছের মানুষদের সাহায‍্য নিলেন। এরা সর্বদাই ভারত ও হিন্দুত্ব বিরোধী হওয়ায় এদের পরামর্শে শ্রীমতি গান্ধী ভারতীয় সংবিধানকে দুমড়ে মুচড়ে এক কিম্ভুতকিমাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে শেষ কথা বলার অধিকার শুধুই সংসদের ( সংসদীয় গণতন্ত্র নয়, শুধুই সংসদীয় সংখ‍্যাধিক‍্য নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র) শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হল! তিনি সংবিধানের প্রস্তাবণায় দুটি নতুন কথা সংযোজন করলেন – “সমাজতান্ত্রিক” ও “ধর্মনিরপেক্ষ”। তিনি ভারতকে “সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” ঘোষণা করলেন! একেই বলেছি – কিম্ভুতকিমাকার – কয়েকটি পরস্পরবিরোধী শব্দের সমাহার! প্রজাতন্ত্র যদি সমাজতন্ত্র হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক হয় কি করে? এমনকি চীন পর্যন্ত নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে না। তারা গণপ্রজাতন্ত্রী। দেশের সাধারন মানুষকে বোকা মনে করা একশ্রেণীর রাজনীতিকের লালসা ও নোংরা খেলার শিকার হতে হয়েছে দেশবাসীকে। কিছু রাজনীতিক পরিবারের তাৎক্ষণিক লাভ ও ভারতবিদ্বেষীদের দীর্ঘমেয়াদী লাভ ছাড়া এতে কারোর কোন উপকার হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কখনোই সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতা (socialist secular) থাকে না। আশ্চর্যের কথা, আমাদের দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থা কম‍্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এর অপব‍্যাখ‍্যা ছাড়া আর কিছু বলা হয় না। সুতরাং আমাদের দেশের সংবিধান এখন “সোনার পাথর বাটি”র মত এক অবাস্তবতার মোড়কে আবদ্ধ! এখানে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনে সংসদে সংখ‍্যাগরিষ্টের ভোটে দেশে যা খুশী তাই করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে ভারতীয় সংবিধানের বহু ক্ষেত্রেই স্ববিরোধীতার জায়গা তৈরী হচ্ছে। তার সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহল। যেমন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কাশ্মীরের বিশেষ অবস্থান দেওয়া ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা, যা শেখ আবদুল্লার সঙ্গে জওহরলালের কোন গোপন আঁতাতের ফল বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, তা সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়ায় ভারতের অখন্ডতার বিরোধী দলগুলি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সোচ্চার। আবার কাশ্মীরের সাধারন মানুষদের দারিদ্র‍্যে নিমজ্জিত রেখে তাদের শোষণের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনই তাদের দারিদ্র‍্যের সুযোগ নিয়ে তাদের ভারতবিরোধী শক্তির পুষ্টিকরনের জন‍্য ব‍্যবহার করা শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতে রাজনীতি করা কিছু রাজনৈতিক দলও সমানভাবে চালিয়ে গেছে। এই দলগুলির কারো উদ্দেশ‍্য ভারতের বিরোধীতা করা, আবার কারো উদ্দেশ‍্য – এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই!
ভারতের রাজনীতির স্তর অত‍্যন্ত নিম্নরুচির হওয়ায় রাজনীতিকরা সতত মিথ‍্যাচার করার সাহস দেখায়। সাম্প্রতিক একটি সংবাদে জানা যায় যে, সিপিএমের সাধারন সম্পাদক সীতারাম ইয়েচোরী বলেছেন, হিজাব ইসলামী মহিলার “সাংবিধানিক অধিকার”! এমন ডাহা মিথ‍্যা বলার দুঃসাহস মাত্র দুধরনের মানুষ করতে পারেন – এক, যিনি সবজান্তা ভাব দেখানো এক গন্ডমূর্খ; দুই, যিনি যাদের উদ্দেশ‍্য করে বলছেন, তাদের গন্ডমূর্খ মনে করেন। ইয়েচোরীর হিম্মত থাকলে সততার সঙ্গে এটি সংবিধানের কত ধারায় আছে তা উল্লেখ করতেন! আসলে উনি ভারতীয় সংবিধান না পড়ে এই ধরনের ‘জ্ঞান’ দেন। আবার কংগ্রেসের এক প্রাক্তণ মূখ‍্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া বলেছেন, ইসলামী মহিলাদের “মৌলিক অধিকার” নাকি হিজাব পরিধান করা! ২০১৭ সাল থেকে চীন, উত্তর কোরিয়ায় হিজাব নিষিদ্ধ। ইরানের ইসলামী মহিলারা হিজাবের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। সেখানে তথাকথিত নীতি পুলিশের হাতে ৮০০ র বেশী আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। মনে হচ্ছে সীতারাম আর সিদ্ধারামাইয়ারা ভারতে ইসলামের নীতি পুলিশের ভূমিকা নিচ্ছেন! ইওরোপ ও আমেরিকায় হিজাবের বাধ‍্যবাধকতা নেই – নেই সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতেও। তবু এখানকার অর্ধশিক্ষিত, ধান্দাবাজ, ভারতবিরোধী কিছু রাজনৈতিক নেতারা শুধু জেহাদীদের তুষ্টিকরনের জন‍্য এমন নির্জলা মিথ‍্যা বলে জনমানসে উপহাসের পাত্র হচ্ছেন। এরা কিসের বাধ‍্যতায় এমন মিথ‍্যাচার করছেন তা বোঝা দায়।
যাই হোক, সংবিধানের জায়গা থেকে ভারতের অখন্ডতা রক্ষা, বিভিন্ন ধর্মীয় ও অন‍্যান‍্য সংরক্ষণ নীতির কারনে সমাজে যে বৈসম‍্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তা শুধরে নেওয়ার জন‍্য সংবিধানের সংশোধন ও পরিমার্জন জরুরী।
দেশের সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতা”র কথা বলা হয়েছে। এটা কি? আমরা জানি লিঙ্গ ভিত্তিক সাধারনভাবে দুই প্রজাতি – পুরুষ ও স্ত্রী-জাতি। আর freak of the nature হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব – লিঙ্গনিরপেক্ষ। তেমনি ভারতের মানুষদের ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন। তবে freak of religion হতে পারে – ধর্মনিরপেক্ষ। হিন্দুধর্মে মানুষের ধর্মনিরপেক্ষতার কোন স্বীকৃতি নেই। ইসলামে, কোরানমতে ধর্মনিরপেক্ষতা হালাল অর্থাৎ গর্হিত কাজ। বাইবেলেও ধর্মনিরপেক্ষতার নিন্দা করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মাচরন করা, যা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার, কোন হিন্দু, ইসলামী বা খ্রীষ্টান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। সমাজে প্রচার করা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতা পালনের দায় শুধুই সনাতনী হিন্দুদের! সেজন‍্য একে বহু বছর ধরে “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা” বলে আসছি। কারন, ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট ও অর্ধশিক্ষিত বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীকুল ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ইসলামী এলাকায় দূর্গাপুজা ও মন্দিরের সন্ধ‍্যারতির বিরুদ্ধে ; তারা কিন্তু মসজিদের আজানের বিরুদ্ধে নয় – সেটা নাকি ধর্মীয় অধিকার! তারা দূর্গামন্ডপে কোরান, বাইবেল রাখলেও মসজিদ বা গীর্জায় গীতা বা হনুমান চালিশা রাখার কথা ভুলেও বলেন না! সুতরাং এই “ধর্মনিরপেক্ষ”তার ব‍্যবহার সচেতনভাবে করা হচ্ছে শুধু একটি কথা মাথায় রেখে – ভারতে হিন্দুত্বকে ধ্বংস করা গেলেই তার অখন্ডতাকে বিনষ্ট করা যাবে – আর তাতেই গঙ্গাধর অধিকারীর তত্ত্বকে লাগু করা যাবে। কি সেই তত্ত্ব, যা ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা গ্রহণ করেছে? কম‍্যুনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা ও প্রাক্তণ জেনারেল সেক্রেটারীর এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভারত কোন রাষ্ট্র নয়, কিছু সার্বভৌম রাজ‍্যের সমষ্টি মাত্র! আবার “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” নাড়া লাগানো মানুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহুদিনের জিহাদী- কম‍্যুনিস্টের ঐক‍্যবদ্ধ জোটের প্রজেক্ট সফল করা যাবে!
অতয়েব, সাধু সাবধান। সাংবিধানিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে গুরুত্ব দেওয়া হোক – শুধুমাত্র দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও দায়িত্বে। গণতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পরিপন্থী বলে তার উপর লাগাম দেওয়ার আশু প্রয়োজন আছে।

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
সত‍্যি এমন দেশের জুড়ি মেলা ভার! এখানে দেশ বলতে কবির মতই রাজ‍্যকে বলছি। এমন রাজ‍্য এই দেশে কেন, পৃথিবী খুঁজেও দ্বিতীয় একটি পাওয়া যাবে না! শিক্ষকদের কাছে শিক্ষালাভের সময় শুনেছি, কোন দেশকে ধ্বংস করতে হলে যুদ্ধের মত সরাসরি অস্ত্রপ্রয়োগের পথে না গিয়ে অনেক কার্যকরী হচ্ছে, ঐ দেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ‍্য ব‍্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। এই দুটির অবর্তমানে অল্প সময়ের মধ‍্যে দেশ ধ্বংস হবে।
আজকে রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থার উদ্দেশ‍্য ও রাজ‍্যের শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করছি। একসময় দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থার মেরুদন্ড না হলেও মস্তিষ্ক ছিল এই রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা। কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয় ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থার অবমূল‍্যায়ন শুরু হয় সিপিএমের আমলে শিক্ষায় উৎকর্ষতার বিরুদ্ধে সিপিএমের সরকারের জিহাদ ঘোষণার সময় থেকে। স্মরণে আছে, একসময় আমরা কয়েকজন অধ‍্যাপক ডঃ অশোক মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ফ্ল‍্যাটে গিয়েছিলাম। আমাদের দলে স্বর্গীয় শৈবাল মিত্র, স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ ব‍্যানার্জী, পুলকনারায়ণ ধর ও সুব্রত পান্ডা ছিলেন। এই দলের কণিষ্ঠতম সদস‍্য ছিলাম আমি। সেদিনের আগের দিন ডঃ মিত্র জ‍্যোতি বসুর ক‍্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। ঐ দিন ডঃ মিত্র আমাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন – এরা (বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএম) মুড়ি,মিছরির একদর করে দিল! প্রেসিডেন্সী কলেজ আর গোবরডাঙ্গা কলেজ এক হল! দুই কলেজের প্রিন্সিপালের মাইনে সমান হল! এভাবেই বামফ্রন্টের শিক্ষানীতি ও তার প্রয়োগ নিয়ে ডঃ অশোক মিত্র তাঁর অভিমত ব‍্যক্ত করেন। সেই শুরু – শিক্ষায় মেধা, উৎকর্ষতার বদলে জায়গা করে নিল দলের প্রতি আনুগত্য। এই আনুগত‍্যের মাপকাঠিতে শিক্ষকতা চাকরী পাওয়া শুধু নয়, পদোন্নতি পর্যন্ত হতে লাগল! শিক্ষক নিয়োগে যোগ‍্যতা নয়, গুরুত্ব পেল আলিমুদ্দিনের শিক্ষা সেলের recommendation! তারপর, পুরো শিক্ষা ব‍্যবস্থাই সরকারী প্রশাসনের অধীনে থাকলেও রিমোট কন্ট্রোল দলের শিক্ষা সেলের নিয়ন্ত্রনে ছিল। নিয়োগ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চয়ন – পুরো কর্মকান্ডই অলিখিতভাবে দলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। একাধিক উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসির নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও একটা কথা বলা প্রয়োজন। সব কিছুই করা হত অতি সন্তর্পনে ও নীরবে দলের বিশ্বস্ত “কমরেড”দের পরিচালনায়! খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে মেধা দাম পেত – বিশেষতঃ শিক্ষকতা শুরু করার সময়। তবে প্রফেসর ও উপাচার্যদের চেয়ারে বসতে দলের recommendation ছিল আবশ‍্যিক। দলের সবুজ সংকেত ছাড়া কোন কলেজের প্রিন্সিপাল নিয়োগ না করার অলিখিত আদেশ ছিল! এভাবেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অবমূল‍্যায়ন শুরু হয়। আমরা একে “অনিলায়ন” (তখন অনিল বিশ্বাস দলের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী চেয়ার – জেনারেল সেক্রেটারী পদে আসীন) বলতাম। অনিলায়নের ফলে যা হল তার নির্যাস হল রাজ‍্যে শিক্ষার রাজনীতিকরন। এর ফলে রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। তার প্রভাব প্রত‍্যক্ষভাবে রাজ‍্যের ছাত্রসমাজের উপর এসে পড়ল। ছাত্র, শিক্ষক, সকলেই তখন কে কত বড় কম‍্যুনিস্ট, কে ‘আগমার্কা’ সিপিএম – তা প্রমাণ করতেই তাদের সব শক্তি নিয়োগ করত! অনিল বিশ্বাসের মৃত‍্যুর পরেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। তখন এই ব‍্যবস্থাই রাজ‍্যের শিক্ষায় “সিস্টেম” হয়ে গেছে! শিক্ষার অবক্ষয়ের সঙ্গে অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রেও জনসাধারণের অসন্তুষ্টির কারনে ২০১১ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়।
মমতা বন্দোপাধ‍্যায় ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সব দপ্তরের মন্ত্রীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাঁর নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে সচেষ্ট হলেন। যেসব মন্ত্রীরা শতকরা ১০০ ভাগ স্তাবকতা করতে রাজি হলেন না, তাদের ধীরেধীরে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারন করা হল। জনমানসে বার্তা গেল – দল ও সরকারে একটিই পোস্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোস্ট! ধীরে ধীরে নেতৃত্বের megalomaniac চরিত্রের পরিচয় প্রকাশ পেতে লাগল। সব বিভাগীয় মন্ত্রী, আমলারা তাদের সমস্ত নীতিগত এবং রুটিন মন্তব‍্য পর্যন্ত – “মূখ‍্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরনায়” বা “মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের অনুপ্রেরনায়” বলে উল্লেখ করা নিয়মের মধ‍্যে নিয়ে এলেন!
মূখ‍্যমন্ত্রীর বিভিন্ন কাজের মধ‍্যে যেমন দেখনদারি প্রকাশ পেতে লাগল, আসল কাজের ক্ষেত্রে তার সিকিভাগ কাজও অনেকক্ষেত্রেই হল না। যেমন, রাস্তাঘাট সারাই, বিভিন্ন স্তরের কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন‍্য বিভিন্ন নামের স্কীমের থেকে অনুদান দেওয়ার (বিভিন্ন “শ্রী” যুক্ত করা নামে) ঘোষণাকে রাজ‍্য সরকারের তরফে “উন্নয়ণ” বলে চালানো হতে লাগল। শিক্ষা ও চিকিৎসা – উভয় দপ্তরেই এর কোন ব‍্যতিক্রম হল না। অথচ এই দুই দপ্তর সম্পর্কে ধারনা না থাকলে এদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা দুঃসাধ‍্য। শিক্ষায় “উন্নয়ণ”এর সহজ রাস্তা চিনে নেওয়া হল – শুধু বাড়ি,ঘরদোর বানিয়ে বলে দেওয়া হল স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত খুলে দেওয়া হল! মনে হয় না কোন বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তাদের সুপারিশে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। বিশ্বভারতীর মত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক কিলোমিটারের মধ‍্যে “বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয়” খোলা হল! এর জন‍্য মনে হয় না কোন রকম বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তার সুপারিশ নিয়ে এসব হয়েছে।যে জেলায় মহিলা বিশ্ববিদ‍্যালয় খোলা হল, সেখানে তার যত না দরকার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী দরকার ছিল উত্তরবঙ্গে মহিলাদের জন‍্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলার। স্কুল, কলেজও একই পদ্ধতিতে খোলা হয়েছে। কারোর “অনুপ্রেরনা”য় শিক্ষা জগৎ চললে এমন হওয়াই ত স্বাভাবিক। অথচ এইসব শিক্ষাকেন্দ্রের অবকাঠামো (infrastructure) অতি সামান্য বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। শিক্ষা দপ্তরের এমন বাজেট নয় যে আগামী ত্রিশ বছরেও এইসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির যথাযথ অবকাঠামো তৈরী করা যেতে পারে। শুধু বাড়ি তৈরী করলেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী হয় না – অনেকগুণ বেশী অর্থ প্রয়োজন যথার্থ অবকাঠামো নির্মাণে। আবার অনেক জায়গায় রাজনীতির হাততালি কুড়োতে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া হয়েছে! বিশ্ববিদ্যালয় ও তার কাজকর্ম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা থাকলে এভাবে হাস‍্যকর “উন্নয়ণ”এর নামে শিক্ষাদপ্তরকে গৌরবান্বিত করার ধৃষ্টতা দেখানো যায় না। বিশ্ববিদ‍্যালয়ে উপাচার্য, কলেজে প্রিন্সিপাল ও স্কুলে হেডমাস্টারমশাই নিয়োগ করেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ‍্যমে শিক্ষার “উন্নয়ণ” ঘোষণা করা হয়!
যে রাজ‍্যে এত বেকার শিক্ষিত ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ার আছে, সেখানে প্রত‍্যাশিতভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কলেজ গুলিতে ছাত্রভর্তির হার মোটেই আশাব‍্যঞ্জক নয়। এমতাবস্থায় রাজ‍্যে যত্রতত্র ITI খুলে কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের সংখ‍্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিইবা করা যায়! রাজ‍্যে শিল্পস্থাপন হলে এবং ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য বাড়লেই মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে ও সাথেসাথে রোজগার বাড়বে। তখনই শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হবে। এখন যেহেতু রাজ‍্যে সরকারী ও সরকার-পোষিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম, সেইসঙ্গে অনুদান নীতির ফলে রাজ‍্যের কোষাগার প্রায় শূণ‍্য, সরকারের পক্ষে নতুনকরে তার নীতি পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও রাজ‍্যের কর্ণধার তাঁর চারিত্রিক গুণের কারনে তাঁর নিজের নীতির থেকে বিচ‍্যুত হবেন না! তিনি গর্ব করে সংবাদ-মাধ‍্যমের কাছে বলেন, ক্ষমতায় আসার পর তিনি নাকি রাজ‍্যে পাঁচশ IIT তৈরী করেছেন! সারা ভারতে পঞ্চাশ কেন, তার অর্ধেক IIT নেই! হয়ত উনি IIT আর ITI এর তফাৎ করতে পারেননি! এভাবেই অনুপ্রাণিত শিক্ষাদপ্তর চলছিল। এক অভিনব পদ্ধতিতে এই দপ্তরের স্কুলস্তরের বিভিন্ন লেভেলে ‘শিক্ষক’ নিয়োগ চলছিল লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ের মাধ‍্যমে। আসলে সরকারের “সততার প্রতীক” ভাবমূর্তি রাখার উদগ্র কামনায় এই আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল এইসব নিয়োগে চরম দূর্ণীতির হদিশ পেয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদ্বয় অনুসন্ধান করে দেখে যে, দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ তাঁর দ্বারা এবং “অনুপ্রেরনা”র অনুমোদনে নিযুক্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা অর্থের বিনিময়ে যাকে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছে! মন্ত্রীসহ রাঘব-বোয়ালরা জেল হাজতে যেতেই থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল।
এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়া “কেন্দ্রের চক্রান্ত” বলার সুযোগ নেই; কারন এটি চলেছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং আদালতের তত্বাবধানে। আশ্চর্যের বিষয় – এই অনুসন্ধানের বিরুদ্ধে উচ্চতম আদালতে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বন্ধ করার আবেদন জানানো হয়েছিল – আদালত অবশ‍্য তাতে সাড়া দেয়নি। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এভাবে যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ও যারা তাদের সেটা করার সুযোগ করে দেয়, তারা শুধু শিক্ষা দপ্তরকেই কলুষিত করছে না, সেইসঙ্গে রাজ‍্যের ভবিষ‍্যৎ প্রজন্মকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই পাপ এক আধটা খুন করার চেয়ে অনেক ঘৃণ‍্য অপরাধ। সংবাদ-মাধ‍্যমের কল‍্যানে আমরা এই রাজনৈতিক চক্রের কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ‍্য জেনেছি। এখানে তার ব‍্যখ‍্যার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, যারা এভাবে অর্থ উপার্জনের পথ করে নিয়েছে, তাদের পশু বললে পশুদের পর্যন্ত অপমান করা হয়। কারন এরা জনগণের ভবিষ‍্যতকে নষ্ট করে রাজ‍্যকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শাসক কেন রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা ধ্বংস করতে চায় – সেটা সত‍্যজিত রায় তাঁর “হীরক রাজার দেশে” ছবিতে পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছাত্ররা শিক্ষা পেলে “মানে কম”! ফলে,”হীরকের রাজা ভগবান” শ্লোগান প্রশ্নের মুখে পড়বে! খেলা,মেলা, অনুদান থেকে দুয়ারে স্ফুর্তির নানাবিধ উপকরণ প্রশ্নের মুখে পড়বে! কোন একনায়ক, যিনি megalomaniacও বটে, কখনোই তা মানতে চাইবেন না। তাই আশা ছিল যে, উচ্চ আদাদালতের নির্দেশের পর রাজ‍্য সরকার তাদের ভুলত্রুটিগুলি শুধরে নেবেন; নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভন্ডামোতে নিযুক্ত, ঘুষ দেওয়া অযোগ‍্য ‘শিক্ষক’ নিয়োগের পুরো প‍্যানেলটাই বাতিল করে শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করবেন!
কিন্তু বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন‍্যরকম গন্ধ পাওয়া গেল। তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে জানালেন যে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁরা নতুনভাবে “যোগ‍্য” প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দেবেন। সেইসঙ্গে তিনি আরো বললেন, যারা আদালত নির্দেশিত ব‍্যবস্থায় চাকরী হারাবেন (যারা অসৎ উপায়ে ও উৎকোচের বিনিময়ে চাকরী পেয়েছেন) তাদের জন‍্যও সরকার চাকরীর ব‍্যবস্থা করবে! এমনিতেই সরকারের ভান্ডারে টাকা নেই; কর্মচারীদের ডিএ বন্ধ থেকে অনেক উন্নয়ণমূলক কাজ অর্থাভাবে বন্ধ। এমতাবস্থায় এই স্বীকৃত অযোগ‍্য এবং অসৎ মানুষদের চাকরীতে বহাল রাখার দায় কেন সরকারের? তাহলে কি সরকারের কর্তাব‍্যক্তিরাই চাকরী সংক্রান্ত অবৈধ লেনদেনে জড়িত? কিছু এমন বার্তা আসছে! এভাবে ঘরের ময়লা কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা কি শুধু ক্ষমতাশালী দোষীদের বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা? আবার এই অতিরিক্ত আর্থিক চাপ নেওয়া কি সরকারের পক্ষে সম্ভব? কারন, বেআইনী চাকরী পাওয়া শিক্ষকের সংখ‍্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে! এভাবে বাজেট বরাদ্দে প্ল‍্যান ও আনপ্ল‍্যান দুরকম বাজেটই গুবলেট হবে। ফলে, অর্থনৈতিক নৈরাজ‍্য ও সেইসঙ্গে সরকারের স্থায়ীত্ব প্রশ্নচিহ্নের মুখে পরবে।

কোভিড-১৯ ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা

কয়েকদিন আগে আমেরিকার ইমিউনোলজিস্ট ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসি (Anthony Fauci) একটি স্বাস্থ‍্য বিষয়ক আলোচনা সভায় বলেছেন যে, যদিও কোভিডের ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের দাপট অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে, তবু আগামী শীতে নাকি কোভিড-১৯ এর একটি নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট আসতে চলেছে! এটি নাকি সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভ‍্যারিয়েন্ট এবং সেইসঙ্গে এটি নাকি সমস্ত বাজার-চলতি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দেবার ক্ষমতা রাখে! তিনি আরো বলেছেন যে, ওমিক্রনের সাম্প্রতিক সময় জানা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.5, যা এই মূহুর্তে সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইন হিসেবে স্বীকৃত – তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.4.6 অনেক বেশী শক্তিশালী স্ট্রেইন হিসাবে ভ‍্যাকসিনের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে!
WHOর প্রতিবেদন অনুসারে, ওমিক্রনের Pango lineage ও তার পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের (BA.5 বা +R346X/+K444X বা +N450D বা +N460X) বিস্তৃত মনিটারিং চলছে। এর কারন, নতুন যেসব সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা যাচাই করা এবং তারা বাজার চলতি ভ‍্যাকসিনকে কতটা ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে – সেই শক্তি পরখ করা। এটি যে RNA ভাইরাস গত দুবছর ধরে বিশ্বত্রাস হয়ে উঠেছিল তার বিষয়ে রুটিন পরীক্ষা।
এক সময় একাধিক লেখায় জানিয়েছিলাম যে, SARS-Cov2এর মত RNA ভাইরাসের ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের মাধ‍্যমে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করা – যারা আবার নিজেদের সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করে। এগুলো ভাইরাসকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখার জন‍্য একান্ত প্রয়োজনীয়। survival of the fittest তত্ত্ব অনুসারে এভাবে পরবর্তী পর্যায়ে যে ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়, তাদের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধির চেষ্টায় কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস সাফল‍্য পেতেই পারে। কিন্তু প্রাথমিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই স্থায়ীত্ব যে মানবদেহে অধিকতর ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম – সে কথা বলা যায় না। আরেকটি ব‍্যাপার, যা সব ইমিউনোলজিস্টের জানা – যদি কোন RNA ভাইরাস তার প্রাথমিক গঠন-বিন‍্যাস ঠিক রেখে পরিবর্তিত জিন মিউটেশান করে, তাহলে ভ‍্যাকসিন তার মডিফায়েড ফর্মে এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এছাড়া আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্য মাথায় রাখা প্রয়োজন – তা হল, গোষ্ঠী-সংক্রমণ হলে ধীরে ধীরে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (herd immunity) তৈরী হয়ে যায়। সমাজে যদি লক্ষণবিহীন ও লক্ষণযুক্ত মানুষের মোট সংখ‍্যা বৃদ্ধি পায় তবে একসময় মানুষের মধ‍্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আক্রান্তের সংখ‍্যা দ্রুত কমে যায়। আমাদের দেশে ঠিক এটাই হয়েছে। সেইসঙ্গে ভাইরাসের কাবু করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এর দুটি কারন – ভ‍্যাকসিনের প্রভাব এবং গোষ্ঠী-সংক্রমণের কারনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হওয়া।
RNA ভাইরাসের ধর্ম অনুযায়ী SARS-Cov2 এর যত ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, তার মারণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হবেই। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে যে, এখন ভাইরাস নিজে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সে এও জানে, তার মানব-দেহে মারণ-ক্ষমতা বাড়লে তার ধ্বংসও ত্বরান্বিত হবে। সেজন‍্য, এই ধরনের ভাইরাসের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এরা যেমন পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে নির্মূল হবে না, তেমনি নিষ্ক্রিয় (dorment) অবস্থায় কোন প্রাণীদেহে আশ্রয় নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করবে। এই মূহুর্তে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের আক্রমণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী। সুতরাং মূল ভাইরাসের যত ভ‍্যারিয়েন্টই আসুক না কেন, জীবদেহে তার বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়লেও মানবদেহে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা নষ্ট হবেই।
এভাবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট বা তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে “আবার অতিমারীর করালগ্রাস ফিরে আসছে” – বলার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। WHO শুধু বলেছে, ভয়ের কিছু নেই; আমরা সতর্ক থাকব এবং গবেষণা চলতেই থাকবে। মানুষকে অযথা ভয় পাইয়ে দেওয়া অমূলক। এ বিষয়ে পৃথিবীব‍্যপী সংবাদ-মাধ‍্যমের ভূমিকা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন সংখ‍্যাতত্ত্বের মাধ‍্যমে অর্ধসত‍্যকে উপস্থাপিত করা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির কাজ নয়। এটা ঠিক যে, WHO নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যেতে বলেছে এবং সেইসঙ্গে অযথা ভয় ও লকডাউনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় কোন একটি বা দুটি গবেষণার খন্ডিত তথ‍্য প্রকাশ করে মানুষের মনে ভয় ধরানো উচিত নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে দেখেছি যে, SARS-Cov2এর শুরু থেকেই শীত বা গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম‍্যের উপর আক্রান্তের সংখ‍্যা বা আক্রমণের তীব্রতা নির্ভর করেনি। এমন উচ্চ জনঘণত্বের দেশে ভাইরাসের আক্রমণের শুরুর দিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ‍্যা দ্রুত বাড়ার সঙ্গে সমাজে লক্ষণবিহীন আক্রান্তের সংখ‍্যাও বাড়ছিল। তার একটি ভালো ফল হল, ভারতে দ্রুত গোষ্ঠী-সংক্রমণ হওয়ায় দ্রুত গোষ্ঠী-অনাক্রম‍্যতা (herd immunity) তৈরী হয়েছে। তারপর যখন ভ‍্যাকসিন নেওয়া শুরু হল, এই জোড়া ফলার আক্রমণে কোভিড ভাইরাস অতি দ্রুত তার মারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এই কথাই বলছে। ১০ই অক্টোবর, ২০২২এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ১৯৯৭ জন আক্রান্ত আছেন আর এক সপ্তাহে দেশে ৯ জনের কোকোভিডে মৃত‍্যু হয়েছে যার ৩ জনই কেরলে। দেশে দূর্ঘটনায় মৃত‍্যুর সংখ‍্যাও এর থেকে অনেক বেশী। অথচ, ভারতে কোভিড-১৯এ মোট আক্রান্ত ৪,৪৬,১৪,৪৩৭, যার মধ‍্যে মৃত ৫,২৮,৮১৪। অর্থাৎ আক্রান্তদের শতকরা ৯৯% সুস্থ হয়ে গেছেন; শুধু ১% এর মৃত‍্যু হয়েছে। অথচ, দেশে ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির সময় মৃতের সংখ‍্যা মোট আক্রান্তের ২.৫% হয়েছিল; তার বেশী কখনোই হয়নি। এখন যে জন‍্য নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত কোভিড-১৯ অতিমারীর ভীতিপ্রদ সংক্রমণ ও প্রাণঘাতী আক্রমণ থেকে মুক্ত হবার মুখে।
এই সময় সাধারণ মানুষকে যেমন অন‍্যান‍্য বায়ুবাহিত রোগকে ধরে, সাধারণ মানুষকে যেমন স্বাস্থ‍্যবিধি মেনে চলতে হবে তেমনি সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা ও ভিড়ের মধ‍্যে মাস্কের ব‍্যবহার এবং যথার্থ স‍্যানিটাইজেশান নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে। তবে, অর্থনীতি ও সমাজজীবনের সুস্থতা মাথায় রেখে অযথা বাধানিষেধ আরোপের কোন প্রয়োজন নেই। এরপর যে কথাটা বলা জরুরী তা হল, নতুন সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট, যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে তা নাকি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম – সেটি একদম ভুল কথা। কারন RNA ভাইরাস যখনই ভ‍্যাকসিন-নিষ্ক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পরিবর্তিত জিন মিউটেট করবে, তার নতুন স্ট্রেইন শণাক্ত করে ভ‍্যাকসিনের উন্নতিকরণ (up-gradation) করে তাকে ধ্বংস না করার কোন বিজ্ঞানসম্মত কারন নেই। তাই, ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসির বক্তব‍্যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র সদা সতর্ক থেকে ভ‍্যাকসিনের সব রকম উন্নতির মাধ‍্যমে কোভিড-১৯কে আয়ত্বে রাখা সম্ভব। যেহেতু এই RNA ভাইরাস জীবদেহের আশ্রয় ছাড়া বেশীক্ষণ বাঁচে না, এরা ভবিষ‍্যতে মানবদেহে সুবিধা করতে না পেরে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে যেতে অন‍্য কোন জীবদেহে অক্ষতিকর ঘুমন্ত (dorment) অবস্থায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। এই মূহুর্তে এটি অনুমান নির্ভর বৈজ্ঞানিক ব‍্যাখ‍্যা মাত্র। তবে একটি কথা নিরদ্বিধায় বলা যায়, মানব সমাজে ত্রাস সঞ্চার করার ক্ষমতা এই একদা মারণ ভাইরাসের আজ আর নেই। বিশেষভাবে ভারতের মত অতি জন-ঘণত্বের দেশে তার ক্ষমতা নিঃশেষিত। আমরা যদি ভ‍্যাকসিন উন্নয়ণ ও সাধারণ স্বাস্থ‍্যবিধি মানার ব‍্যপারে চরম ঔদাসিন‍্য না দেখাই, তবে আমাদের দেশে কোভিড-১৯এর ফিরে আসার সম্ভাবণা নেই।
এত কথার পরেও বলার আছে যে দেশের কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম এই ধরনের খবর প্রচার করছে! তার কারন হল, এই দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির সামাজিক দায়িত্ব-বোধ সম্পর্কে ধারনা পরিষ্কার নয়। তাদের টিআরপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুনাফা ছাড়া আর কোন চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ফলে শুধু সংবাদ পরিবেশনে মানুষকে আকৃষ্ট করা ছাড়া এরা সংবাদের বিস্তৃত বিশ্লেষণে বিশেষ প্রবেশ করে না। এক্ষেত্রে এমন অর্ধসত‍্য সংবাদ পরিবেশনে মানুষ কৌতুহলী হবে এবং তাদের মনে ভয়ের সঞ্চার হলে তাদের থেকে যে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া হবে – তার থেকে কতিপয় ব‍্যবসায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতারা উপকৃত হবে। মনে পড়ে, লকডাইন পর্যায়েও এমনটা হয়েছিল।
তাছাড়া, এ ধরনের সংবাদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভারতের মত বিপুল জনবহুল দেশে মারাত্মক হতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয়স্তরেই বিরোধী দলগুলি যেমন সরকারের অহেতুক সমালোচনা করার সুযোগ পাবে, তেমনি অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।
দেশের বিভিন্ন কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলিতে কোভিড আক্রান্ত রোগীর ক্রমহ্রসমান সংখ‍্যার কথা মাথায় রাখলে বোঝা যায় যে, এই ভাইরাসের দেশ থেকে বিদায় নেবার সময় চলে এসেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথায় বলা যায়, এখানে আর কোন কোভিড আইসোলেশান সেন্টার নেই। সব হাসপাতালের কোভিড ইউনিট রোগী না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত সাতদিনে রাজ‍্যে নতুন কোভিড রোগীর সংখ‍্যা শূণ‍্য। সুতরাং এখানে কোভিড-১৯ বা তার কোন ভ‍্যারিয়েন্ট বা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট,যারা একই গঠনের মধ‍্যে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানে জন্ম নিয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করার জন‍্য ভ‍্যাকসিন ও হার্ড ইমিউনিটির যুগলবন্দীই সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে। কিন্তু যদি বেসিক গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কোন RNA ভাইরাস আক্রমণ করে তবে তখন ভ‍্যাকসিন কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ না হয়ে নতুন কোন নামের হবে। এখনো অবধি এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সুতরাং ভয় পাইয়ে দিয়ে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা অর্থহীন। সাবধানের মার নেই – প্রবাদকে মনে রেখে মাস্ক ও স‍্যানিটেশানের সঠিক প্রয়োগ যথেষ্ট। সেইসঙ্গে ভ‍্যাকসিনের বুস্টার ডোজ যতবার আসবে তা গ্রহণ করাই ঠিক। এইভাবে গবেষণার খন্ডহার উপস্থাপনা সংবাদ-মাধ‍্যমের টিআরপি বাড়ানোর প্রানপণ চেষ্টা বলেই মনে হয়।

তৃতীয় লিঙ্গের তোলাবাজি কি প্রশাসনের মদতে

গত দশ বারো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এক উপদ্রব নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এই উৎপাত যেহেতু একবার একটি পরিবারের উপর সীমাবদ্ধ থাকে, সেজন‍্য এর সামাজিক প্রভাব সীমিত – তাই এ নিয়ে সংবাদ করলে সংবাদ-মাধ‍্যমের টিআরপি বাড়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই! তবে দিন দিন যেভাবে তৃতীয় লিঙ্গের (যাদের সাধারনভাবে হিঁজরে বলা হয়) সংগঠিত তোলাবাজি বেড়ে চলেছে,বিশেষতঃ প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং অবশ‍্যই পুলিশী উদাসীনতায় – তার দায় সরকারের অস্বীকার করার উপায় নেই।
ঝাড়গ্রামের রাধানগর অঞ্চলের একজন ড্রাইভার চন্দন খিলারের স্ত্রী তনিমার জমজ পুত্রের জন্মের পরে শিলদা হাসপাতালের নিও-নাটাল কেয়ারে শিশুদুটিকে একমাস রাখার পর তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তার দিন কুড়ি বাদে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দল বেঁধে এসে ঐ পরিবারের কাছে ১২ হাজার টাকা দাবী করে। চন্দনের পরিবার তাদের অপারগতার কথা জানালে তারা গালাগালের সঙ্গে বিস্তর দরাদরি করে। অবশেষে তারা ২ হাজার টাকায় রফা করে। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও শিশুদুটিকে নিয়ে উদ্দাম নাচানাচি করতে থাকে। তার ফলে দুটি শিশুর মধ‍্যে সুমন নামের একটি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ঐ দলটি শিশুদের ফেরৎ দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করে। শিশুটিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিলদা হাসপাতালে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় পাড়ার লোকজন ঐ দলের তিনজন হিঁজরেকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। চন্দনের FIRএর ভিত্তিতে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। তদানীন্তন এসপি ভরতকুমার রাঠোর পদক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের কোন শাস্তির কথা জানা নেই।
আবার বেহালায় এক পরিবার পুলিশে নালিশ জানায় যে, ঐ বাড়িতে নবজাতক শিশুর জন‍্য তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ দল বেঁধে এসে চারমাসের মধ‍্যে দ্বিতীয়বার ২১ হাজার টাকা দাবী করে! যদিও বাড়ির মানুষরা জানান, তাঁরা আগে একবার টাকা দিয়েছেন, তবু তারা হিঁজরেদের দেওয়া ‘কার্ড’ দেখতে চায়! ঐ কার্ড ঐ মুহূর্তে বাড়ির লোকে কাছে ছিল না। হিঁজরেরা ঐ মুহূর্তে বাড়ির সামনে অসহনীয় চেঁচামেচি ও গালাগাল করতে থাকায় ঐ পরিবার ঠাকুরপুকুর থানায় অভিযোগ জানিয়ে বলে, ঐ গোলযোগের সময় তারা ১০০ ডায়াল করেও কোন রকম রেসপন্স পাননি! তারপর ঐ পরিবার কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে অভিযোগ জানালে তারা জানায় যে, অভিযোগটি ঠাকুরপুকুর থানায় পাঠানো হয়েছে, কারন ঘটনাটি ঘটে ঐ থানার ‘এলাকায়’! ব‍্যাস, ঐ পর্যন্তই। তারপর এই কেস নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ‍্য শোনা যায়নি!
এরপর আসি অতি সাম্প্রতিককালের বিধাননগর থানা এলাকার ঘটনায়। সেখানে বিবাহিত কন‍্যা তার মেয়ের জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে পিত্রালয়ে আসে। শিশুটির জন্মের একমাসের মধ‍্যে একদল হিঁজড়ে এসে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে! তারপর যখন তারা বাড়িটি শিশুর মামাবাড়ি বলে জানে, তখন বিস্তর দর কষাকষির পর ১৬ হাজার টাকা, সঙ্গে নতুন কাপড় নিয়ে একটি কার্ড দিয়ে চলে যায়। ঐ ছাপানো কার্ডে লেখা ছিল, ঐ অঞ্চলের টাকা নেওয়ার দায়িত্ব ঐ ইউনিয়নের! তাদের এলাকাও চিহ্নিত ছিল! এই ঘটনার মাসখানেক বাদে আবার পরপর দু সপ্তাহ হিঁজরেরা ঐ বাড়িতে আসে এবং আবার টাকা দাবী করে! তাদের যখন বলা হয় যে, তাদের দেওয়া কার্ড আছে – তখন প্রথমে তারা চলে গেলেও পরের সপ্তাহে আরো বড় দলে হাজির হয়ে ঐ কার্ড দেখতে চায়! কার্ড জানালার ভিতর থেকে দেখানো হলে তারা বারবার কার্ডটা তাদের হাতে দিতে বলে! যখন তাদের বলা হয়, কোন পরিস্থিতিতেই তাদের হাতে কার্ড দেওয়া হবে না, কারন তাদের টাকা দেওয়ার একমাত্র প্রমাণ ঐ কার্ড, তখন হটাৎ তারা সুর বদল করে ধমকের সুরে বলতে লাগল, ঐ কার্ড জাল! সেজন‍্য তাদের আবার টাকা দিতে হবে। তারা বাড়ির গেট আটকে অকথ‍্য চেঁচামেচি শুরু করলে যখন তাদের পুলিশের কথা বলা হল, তারা বলল, পুলিশ নাকি তাদের কথায় চলে! তারপর টাকা না পাওয়ায় তারা তোলাবাজির পরিমাণ আরো বাড়ানোর দাবী করে!
এমন ধমক-ধামক ঘন্টাখানেক চলার পর তারা লক্ষ‍্য করে যে বাড়িটি cctv কভারেজে মোড়া। তারা বুঝতে পারে যে তাদের বক্তব‍্য ছবিসহ রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তখন তারা পায়ে পায়ে নিজেদের পথ দেখে।
মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হল। এমন অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে। কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের থেকে সদর্থক পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানা নেই। এমনকি, কলকাতায় ট্রাফিক সিগন‍্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে পরলে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন গাড়ির কাঁচে বা গাড়ির গায়ে ধাক্কা মেরে টাকা চায়। না পেলে অনেক সময় গালাগাল পর্যন্ত করে। এইসব ঘটছে ২০১১ সাল থেকে।
এই অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে পুলিশী পদক্ষেপ না করার কারন অবশ‍্যই ভীতি। অনেক সময় এরা দলবদ্ধভাবে থানা ঘেরাও করে – মারমুখী হিঁজরেদের উপর বড়সড় পদক্ষেপ করতে মনে হয় পুলিশের উপর কোন অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
এইসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ইউনিয়ন আছে। তাদের নেতা/নেত্রীর বক্তব‍্য হল, তারা বেঁচে থাকার জন‍্য এই টাকা নাকি বাধ‍্য হয়ে তোলে! আমাদের রাজ‍্যে এদের উপার্জনের কোন ব‍্যবস্থা রাজ‍্যের সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এখানেই রহস‍্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কারন, অন‍্য অনেক রাজ‍্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উপার্জনের জন‍্য একাধিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে।কিন্তু এখানে এধরনের কোন পরিকল্পনার কথা জানা নেই। সাধারণ মানুষের একটি অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – এদের বিকল্প উপার্জন নেই বলেই তারা তোলাবাজি করবে, জোর করে টাকা নিয়ে যাবে, গায়ের জোর দেখিয়ে অসভ‍্যতা করবে – আর রাজ‍্যের পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে! এটা আর যাই হোক, সুশাসনের পরিচয় নয়।
একটি অসমর্থিত খবর হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ‍্যা গত ২০১১ সালের পর অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের সকলের ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড আছে কি? কারন, শোনা যায় যে এদের একটি বড় অংশ নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে! এরা সাধারনত দুটি পদবী ব‍্যবহার করে – ‘মন্ডল’ ও ‘হালদার’। নাম দিয়ে এদের ধর্ম বোঝা যায় না। এরা যদি চোরাই পথে ভারতে আসা বাংলাদেশী হয় এবং এদের এই রাজ‍্যে ভোটার বানিয়ে এমন তোলাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তার দায় অবশ‍্যই বর্তমান প্রশাসন ও শাসকদলের উপর বর্তায়। যে ভাবে বিভিন্ন ‘তোলাবাজি’র ব‍্যবসায় শাসকদলের নেতৃবৃন্দ ধরা পরছেন, এই তোলাবাজিও শাসকের প্রশ্রয়ে হচ্ছে কিনা – সে বিষয়ে জনমানসে সন্দেহ জাগতেই পারে। এখানে একটি পরিসংখ্যান বোধহয় প্রাসঙ্গিক – ভারতের বিভিন্ন কারাগারে যত বিদেশীরা বন্দী আছে তার মধ‍্যে এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী। এর মধ‍্যে সর্বাধিক বন্দী পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলিতে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশী, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সন্দেহ হওয়ার আরো একটি বড় কারন হল, এই জনগোষ্ঠীর উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা রাজ‍্য প্রশাসনের দায়িত্ত্ব হলেও তারা এ ব‍্যাপারে চরম উদাসীন।ফলে এদের বিভিন্ন রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজের নৈতিক দায় যেমন রাজ‍্য প্রশাসনের উপর বর্তায়, তেমনি এদের তোলাবাজির থেকে কাটমানির আমদানির ব‍্যাপারটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার “দুধেল গাই” বাহিনীর সম্প্রসারিত রূপে এই বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলেও মনে হতে পারে। যাই হোক, সরকারি মদতে বা নিষ্ক্রিয়তায় সাধারন মানুষের উপর এভাবে অত‍্যাচারের অধিকার এই গোষ্ঠীকে দেওয়া যায় না। যদি এদের উন্নয়ণের জন‍্য সরকারের সদিচ্ছা থাকে, বেশ কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন‍্য বিভিন্নভাবে যে সব NGO সাহায্য করছে, সেইসব NGOর মাধ‍্যমে রাজ‍্য সরকার এদের উপার্জনক্ষম করার পরিকল্পনা নিতে পারে। আসলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, নইলে নয়। এদের এভাবে একটি ক্রিমিনাল গোষ্ঠী হিসেবে রেখে দিলে হয়ত শাসকের অনেক গোপন বেআইনী কাজের সুবিধা হতে পারে – কে জানে, এখানে অনুসন্ধান করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে কিনা!
একটি comprehensive স্কীম করে এগোতে গেলে প্রথমেই যা দরকার, তা হল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন‍্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ – অবশ‍্যই বিশেষ ক্ষেত্রে তা প্রযোজ‍্য। এছাড়া, জনগণনার সময় সংখ‍্যার বিচারে এদের স্থানভিত্তিক উপস্থিতির রেকর্ড প্রশাসনের কাছে থাকা আবশ‍্যিক। আধার কার্ডে লিঙ্গ উল্লেখিত থাকলে তার রেকর্ড সরকারের কাছে না থাকার কোন কারন নেই। কাজেই এদের পরিচয়ের রেকর্ড থাকার ব‍্যাপারে ধোঁয়াশা নেই। এখন, সবকিছু নির্ভর করছে প্রশাসনের সদিচ্ছার উপর। গত এগারো বারো বছর ধরে যা চলছে তাতে এমন ধারনার যথেষ্ট কারন আছে যে, এদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কোন সদিচ্ছা রাজ‍্য সরকারের নেই। প্রথমতঃ এদের মধ‍্যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী থাকলে তার প্রাথমিক সনাক্তকরণের দায় সরকারের। দ্বিতীয়ত এদের থেকে তোলাবাজির কাটমাণি পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চাওয়া – হতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ‍্য – কাটমানি শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের ধারেকাছে অন‍্য কোন রাজ‍্য আসতে পারবে না। আরেকটি কথা, এই হতভাগ‍্য মানুষগুলিকে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যেমন বদ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, তেমনি এদের ভোটপ্রক্রিয়ায় সুবিধাজনকভাবে ব‍্যবহার করা যায়। সেকথা মাথায় রেখেই ২০১১ সালের পর থেকে এদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি করতে দেওয়া হয়েছে। State sponsored hooliganism এর যে কটি মুখ আছে, তার একটি অন‍্যতম মুখ এদের দৌরাত্ম্য এবং তা দমন করা দুরে থাক, পুলিশী নিষ্ক্রিয়তা এবং তার সমর্থনে হাস‍্যকর যুক্তির অবতারণা করা এই অভিযোগকেই মাণ‍্যতা দেয়।
সারা পশ্চিমবঙ্গে যত শিশু জন্মাচ্ছে, তাদের প্রত‍্যেকের জন‍্য মায়ের পিত্রালয় ও শ্বশুরালয় থেকে তোলার পরিমাণ হিসাব করলে বছরে বহু কোটি টাকার এই ব‍্যবসায় যে কাটমানিচক্র থাবা বাড়াবে – তা অনুমান করা শক্ত নয়। এই অত‍্যাচার বন্ধ করে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের সুস্থ জীবন ও জীবিকার সুলুক-সন্ধান দেওয়া রাজ‍্য সরকারের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তা না করে এদের ব‍্যবহার করে কাটমানির লোভে সমাজ জীবন বিপর্যস্ত করা সুপ্রশাসন ও সুস্থ মনের পরিচয় নয়। ভারতের অন‍্য অনেক রাজ‍্যে এদের জন‍্য ভালো ভালো পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাতে কোন হেলদোল নেই! এমনটি কার স্বার্থে করা হচ্ছে তার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব রাজ‍্য সরকারের।

হিজাব রক্ষার আড়ালে লড়াই কিসের

ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় ছ’টি মৌলিক অধিকারের কথা স্থীকৃত – বক্তব‍্য বা মতামত বলা ও লেখার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও সংঘ গঠনের স্বাধীনতা, দেশের যে কোন স্থানে ভ্রমণ ও বসবাস করার স্বাধীনতা এবং পেশার স্বাধীনতা। এগুলোই মৌলিক অধিকার হিসাবে সকল নাগরিকের প্রাপ‍্য। এখানে কোথাও ইসলামী বা অন‍্য মহিলাদের হিজাব বা বোরখা পড়ার অধিকারের কথা বলা নেই। অথচ, প্রবীণ কংগ্রেসী ও প্রাক্তণ মন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া ‘হিজাব’কে ইসলামী মহিলাদের “মৌলিক অধিকার” বলেছেন! সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচোরই বলেছেন, হিজাব নাকি সাংবিধানিক অধিকার! তা সীতারামজী এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানের কিনা সেটা বলেননি! তাঁর জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০১৭ সালে তাঁর রাজনৈতিক পিতৃদেবের দেশ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাদের দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি হিজাব উত্তর কোরিয়া ও বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে নিষিদ্ধ। ইসলামী দেশগুলির মধ‍্যে সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে হিজাবের বাধ‍্যবাধকতা নেই। আমেরিকাতে সুরক্ষার প্রশ্নে হিজাব খোলা বাধ‍্যতামূলক। সাম্প্রতিক কালে বোরখা ও হিজাবের প্রতিবাদে ইরানের মহিলাদের বলিষ্ট প্রতিবাদ সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এই আন্দোলনে ইরান উত্তাল। অথচ, ভারতের মত দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান স্বীকৃত, সেখানে এই দেশের কতিপয় রাজনীতিক সংবিধানের নামে মিথ‍্যা দোহাই দিয়ে আসলে জিহাদী ইসলামী নেতৃত্বকে তুষ্টিকরনের বার্তা দিচ্ছেন।
কিন্তু কেন? এরা ভালো করেই জানেন যে, পৃথিবীতে যে কটি ইসলামী রাষ্ট্র আছে, তাদের কোনটিতেই স্বীকৃত কোন কম‍্যুনিষ্ট দল নেই! সুতরাং, এই কম‍্যুনিষ্টদের উদ্দেশ‍্য ভারতে ইসলামী শাসন কায়েম করা নয়, তাদের উদ্দেশ‍্য ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তির তুষ্টিসাধন। এইভাবে তারা ভোট রাজনীতির ময়দানে তাদের ভোট-ব‍্যাঙ্ক স্ফীত করতে আগ্রহী। আবার হিন্দু ভোটারদের জন‍্য তাদের টোপ হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “সমাজতান্ত্রিক” কথাদুটি আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭৬ সালে ‘জরুরী অবস্থা’র সুযোগে সংসদে সংখ‍্যাগরিষ্টতার জোরে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের বৃহত্তম সংশোধন করে ঢোকান। রাষ্ট্রের নাম – সমাজবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ভারত – ঘোষিত হল। ইন্দিরা গান্ধীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তাঁর অনুচরবর্গের শিক্ষার দৈন‍্যতা এতটাই য তাঁরা দেশের সব নাগরিককেই মূর্খ ভাবার ধৃষ্টতা দেখালেন। “সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র” বা “গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” থাকলেও (ইংল‍্যান্ড একমাত্র দেশ যেখানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আছে) সমাজবাদী গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কি করে সম্ভব তা একমাত্র সোনার পাথরবাটির মত লাগছে! ভারতের কম‍্যুনিষ্ট নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের “ধর্মনিরপেক্ষতা”র বড়ি খাওয়াতে নানাভাবে চেষ্টা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোরান ও বাইবেল সরাসরি নিন্দা করায় কোন ইসলামী বা খ্রীষ্টান ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না! শুধুমাত্র হিন্দুদের ধর্মহীণতায় উদ্বুদ্ধ করার জন‍্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অবতারণা করা! কম‍্যুনিষ্টদের কাছে হজ করা, ঈদের রমজানের উপবাস ও নমাজ পড়া ইসলামীদের মতই জায়েজ। শুধু দূর্গাপুজার মন্ডপ জুতো দিয়ে সাজানো, পুজো মন্ডপে আজান দেওয়া ও কোরান রাখা “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নিদর্শন! এরা কখনো মসজিদে হনুমান চালিশা বা গীতা পাঠ করতে বলে না। এদের কাছে মক্কায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ জায়েজ। এদের কানে সন্ধ‍্যারতির আওয়াজ অসহ‍্য লাগলেও এরা কখনো লাউড স্পিকারে নমাজের আওয়াজে বিরক্তি বোধ করে না। এভাবেই এরা ভারতে “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার চালান শুধুমাত্র হিন্দু মননে নিজ ধর্মের প্রতি বিরূপতা জাগানোর চেষ্টায়।
এভাবে ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টরা জিহাদী ইসলামের স্বার্থরক্ষা করতে করতে কখন যেন হিন্দু-বিদ্বেষী থেকে ভারত-বিদ্বেষী হয়ে গেল! আর কংগ্রেস সম্পর্কে বলতে হয়, একটি গোঁড়া ক‍্যাথলিক খ্রীষ্টান পরিবারের অধীনে এই শতাব্দী প্রাচীন দলটি এখন রাজনীতির আই সি ইউতে অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায়। এর নেতারা সকলেই ঐ পরিবারকে খুশী করার সাথে সাথে হিন্দু-বিদ্বেষের মাপকাঠিতে নিজেদের যোগ‍্যতাকে বিচার করার মাধ‍্যমে ঐ পরিবারের সন্তুষ্টি বিধানে ব‍্যস্ত।
এই মূহুর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ‍্যে ক্ষমতায় থাকা বিরোধী দলগুলির নীতি নির্ধারণে এই কম‍্যুনিষ্টদের হিন্দু-বিরোধী নীতিকে প্রাধান্য দেওয়ায় তারা প্রায়শঃই ভারত-বিরোধী লাইন নিয়ে ফেলছে। এর ফলেই দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরী হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মত রাজনীতি সচেতন, শিক্ষিত ভোটারদের রাজ‍্যেও এই মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।
এইসব বিরোধী নেতারা ভারতীয় হিন্দু রমনীদের চিরাচরিত বেশভূষায় নাকি গেরুয়াকরণের ছাপ দেখছেন! তারা গেরুয়া রংয়ের ওড়না ও দোপাট্টার বিরোধী! তারা কি একবারও মনে করেছে যে, দেশের জাতীয় পতাকার সবচেয়ে উপরের রং গেরুয়া! তারা কি গৈরিকীকরণের প্রতিবাদ করে দেশের পতাকার রংটাই পাল্টে দেবে!
আসলে এসব করার সুযোগ হয়েছে ঐ ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের জন‍্য। এখানেই ভোট সর্বস্ব রাজনীতির সংসদকে সর্বশক্তিমান বানানোর প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। সংবিধানের ৪৪তম ধারার (৪২তম সংশোধন) বিপুল সংশোধন করে পরবর্তী সময়ে কম‍্যুনিষ্টদের দাপটে দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থায় ব‍্যাপকভাবে জিহাদী অনুপ্রবেশ শুরু হয়। আরবী সংস্কৃতির আদলে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধীরগতিতে পরিবর্তন আনা হয়। রামধনু হয় রংধনু, জল পান করা হয়ে যায় পাণি খাওয়া, জলখাবার পাল্টে হয় নাস্তা করা! শ‍্যালিকা হয় বেয়াইন, “তোমায় দেখে নেব” কথা হয়, “তোমার খবর আছে” ইত‍্যাদি। হারিয়ে যায় ইসলামী বাঙ্গালীর মধ‍্যে বাউল গান, ঝুমুর গান – জায়গা নেয় মেহফিল আর মুজরো মার্কা জলসা। তারপর বিশেষ উদ্দেশ‍্য নিয়ে শুরু হয় ‘লাভ জিহাদ’। হিন্দুদের মধ‍্যে, বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের সঙ্গে বহিরাগত ইসলামীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস না থাকায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে বিশেষভাবে গান্ধী-নেহরুর বাংলা বিদ্বেষের ভুরিভুরি উদাহরণে বাঙ্গালী হিন্দুর সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মিলনের পথে কিছুটা বাধা উপস্থিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের মধ‍্যে কম‍্যুনিষ্ট ও তার উত্তরসূরী এই জায়গাটাই exploit করতে শুরু করে। তারা হিন্দু ঐতিহ্য ও লোকাচারকে ভুলিয়ে দিতে বাঙ্গালী হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে “উৎসব” মুখী করে নতুন সংস্কৃতি আমদানি করে – হিন্দুত্বের শিকড় উপড়ে ফেলার কৌশল। সেখানে “অকাল বোধন” এর দূর্গাপুজা হয়ে যায় দূর্গোৎসব যা শুরু হয় পিতৃপক্ষে! আবার সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর ভ‍্যালেন্টাইনস্ ডে হিসাবে দেখিয়ে পুজার মাহাত্ম্য অস্বীকার করা হতে থাকে। উদ্দেশ‍্য একটাই – হিন্দুদের ধর্মীয় ব‍্যাপারটা নষ্ট করে দাও; হিন্দু ধর্ম ঘেঁটে ঘ হয়ে যাক! হিন্দুদের দেবদেবীর অপমান ও পুজাকে তাচ্ছিল্য করার অছিলা একটাই – ধর্মনিরপেক্ষতা! আবার, ইসলামী বা খ্রীষ্টীয় ধর্মের কোন রকম লঘুকরনের এরা বিরোধী – অজুহাত – সংখ‍্যালঘুর ধর্ম রক্ষা! এভাবে একটি ধর্মের অবমাননা ও অন‍্য ধর্মের রক্ষা করা – এর নামই কম‍্যুনিষ্ট চর্চিত ও কংগ্রেস প্রযোজিত “ধর্মনিরপেক্ষতা”।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে এরা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রিয় চর্চার বিষয় করে তোলে হিন্দু দেবদেবী ও অবতারদের ব‍্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে আক্রমণ করা। কোন প্ররোচনা ছাড়া এমন অযৌক্তিক আক্রমণের কারন হচ্ছে হিন্দুধর্ম এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকে আক্রমণ করা। আশ্চর্য বিষয় হল, এরা ভুলেও কখনো ইসলামীদের উপাসক বা তাদের অবতারদের নিন্দা করা দুরের কথা, এ বিষয়ে আলোচনাকে অব্দি ‘গুণাহ্” মনে করে। কাজেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে একদল মানুষ সমাজের বৃহত্তর অংশের হিন্দুদের ধর্মকে নষ্ট করে দেশের সংহতিকে আঘাত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে, যেখানে এদের সহযোগী রয়েছে ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তি – যারা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে মদত পাচ্ছে।
একটা ব‍্যাপার কখনো মাথায় ঢোকে না – যারা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে, তাদের জিজ্ঞাসা করি, দূর্গাপুজায় মাতৃ আরাধনাতে কি কোন ইসলামী মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন? কারন, ইসলামে কোন দেবীরূপ স্বীকৃত নয় – মহিলারা “শষ‍্যক্ষেত” মাত্র – একথা একাধিক ইসলামী পন্ডিতের কাছে জেনেছি। কাজেই দূর্গাপুজায় ইসলামীদের অংশগ্রহনের অভিনয় হয়ত থাকবে, কিন্তু যথার্থ অংশগ্রহন থাকবে না। আবার ঈদের রমজানের উপবাসের পর রোজা ভাঙ্গার ইফতারে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ অভিনয় হতে পারে, তা কখনোই ধর্মীয় অনমোদনের ইফতার নয়। ইফতারে তারাই থাকতে পারে, যারা সবশক্তিমান আল্লার সেবক এবং রমজানের উপবাস রেখেছে। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির নামে দেশের স্থায়ীত্বের উপর আঘাত করার আরো একটি পরিকল্পনা হল – দেশের কোন রাষ্ট্রধর্ম না থাকা! ধর্ম মানুষের সঙ্গে পশুর তফাৎ গড়ে দেয়। এদেশে এমনকি জাতীয় গান “বন্দেমাতরম্” নিয়ে পর্যন্ত আপত্তি করা হয়! এমন অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়া নির্বুদ্ধিতা বা চরম অসততা। এই আবহাওয়ায় হিজাব নিয়ে যে আন্দোলন, তা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত! হিজাব যদি ধর্মীয় বাধ‍্য-বাধকতার জন‍্য হয়, তার নিদান কোরান বা হাদিস – কোথাও নেই কেন? হিন্দুধর্মের মধ‍্যে যেমন লোকাচারের অনুমোদন খোঁজা বৃথা, তেমনি ইসলামের ধর্মীয় বিধি পালনে হিজাব অপরিহার্য নয়। অবশ‍্য, যে অশুভ আঁতাত হিজাব নিয়ে শোরগোল করছে, তাদের আসল উদ্দেশ‍্য ইসলামী মৌলবাদের আড়ালে দেশের মানুষের মধ‍্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব বিঘ্নিত করা।
পরিশেষে বলি, কে কি পরবে বা খাবে তা যেমন তার নিজস্ব, তেমনি, কোন প্রতিষ্ঠান তার কর্মচারী বা ছাত্রছাত্রীদের কি ধরনের পোষাক পরে ঐ প্রতিষ্ঠানে আসবে, তার অধিকার একমাত্র ঐ প্রতিষ্ঠানের। অবশ‍্য, অশ্লীলতা ও অন‍্যের অসুবিধা না করে পোষাক পরার অধিকার শুধু সমাজে নয়, সংবিধানে অবধি স্বীকৃত। এইসঙ্গে সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সমঝোতা বা ধর্মের দোহাই দিয়ে তার লঘুকরণ করা যায় না। এমনকি, ইউরোপ, আমেরিকায় একাধিকবার দেখেছি, পর্দানশীন মহিলাদের বোরখা খুলে পরীক্ষা পদ্ধতির মধ‍্যে দিয়ে যেতে হয়। তারা কিন্তু সেখানে কোন প্রতিবাদ করে না! ধর্মের নামে যত প্রতিবাদ সব ভারতে! এ ধরনের ধর্মীয় জিহাদের বিস্তারকরণ নিঃসন্দেহে দেশের সুরক্ষার পরিপন্থী। সেজন‍্য এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা আবশ‍্যক। ইসলামী সংস্কৃতির নামে আরবী সভ‍্যতার বিস্তারধর্মী আগ্রাসন বন্ধ করতেই হবে।

পিসী-ভাইপো সাম্রাজ‍্যের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিশ্চিতভাবে নতুন অধ‍্যায়ের সূচনা করেছে। এই রাজ‍্যে বিধান চন্দ্র রায়ের পরবর্তী সময় রাজনীতি শাসক দল ও একটি বিরোধী দলের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখানে কখনো জোট রাজনীতি সফল হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকারের হামাগুড়ির পর্যায়েই মৃত‍্যু হয়েছিল। অবশ‍্য তারপর বামফ্রন্ট সরকার চালালেও সেখানে প্রকৃত অর্থে শাসক দল ছিল সিপিএম। তাদের সঙ্গে কিছু সহযোগী দলের বিক্রিত নেতা লালবাতি গাড়ি ও মন্ত্রীত্বের লোভে বামপন্থী সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে তাদের যেটুকু অল্পস্বল্প ভোট ব‍্যাঙ্ক ছিল, তার অন্তর্জলী যাত্রার বন্দোবস্ত করে। এর ফলে, ক্ষমতা ধরে রাখার কারনে এবং প্রতিবাদী বিরোধী শক্তির কন্ঠরোধ করার জন‍্য বিভিন্নভাবে দলদাস পুলিশবাহিনী তৈরীর সাথে সাথে ক‍্যাডার বা দলীয় গুন্ডাদের ব‍্যবহার করা শুরু হল। এ দুটি শ্রেণীর প্রথমটি লাইসেন্সড ও দ্বিতীয়টি আনলাইসেন্সড গুন্ডা বাহিনী যারা শাসকের অঙ্গুলি হেলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এরা শাসকের হয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করার পাশাপাশি অন‍্য সময় নিজেদের আখের গুছানোর জন‍্য তোলাবাজি ও অন‍্যান‍্য অপরাধমূলক কাজে ব‍্যস্ত থাকত। ফলতঃ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নের মুখে পড়ায় যত শাসকের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়তে লাগল, ততই শাসক নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন পর্যায়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে শুরু করল। এ কাজে তাদের প্রধান সাহায‍্যকারী ছিল এই দু ধরনের গুন্ডা বাহিনী। একটা সময় এলো, যখন নির্বাচনে জালিয়াতি ও ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও সিপিএম পরাস্ত হল। ২০১১র বিধানসভা নির্বাচনে জিতে পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন মমতা ব‍্যানার্জী। তাঁর তৃণমূল দলটি প্রথম থেকেই কোন ইজম-ভিত্তিক দল নয়। এদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিও পরীক্ষিত নয়। এই দলের সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জীর কথাই দলে প্রথম ও শেষ কথা – তিনিই দলের কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক মায় গীতা – তাঁর কথা অলঙ্ঘনীয়! এ ধরনের দলের সহজেই স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠার প্রবণতা থাকে।
মমতাদেবীর মস্তিষ্কপ্রসূত বিভিন্ন “উন্নয়ণ” প্রকল্প রূপায়নের নামে যেমন অনুদান রাজনীতির অর্থনৈতিক প্রভাব রাজ‍্যের কোষাগারে পড়ল, তেমনি রাজ‍্যের শিল্প-বাণিজ‍্যের শোচনীয় অবস্থায় অর্থভান্ডারের অবস্থা অবর্ণনীয়ভাবে খারাম হয়ে পড়ল।মমতাদেবীর দল ও প্রশাসন সমার্থক হয়ে গিয়ে তিনি শুধু স্তাবকবেষ্টিত প্রশাসন চালাতে লাগলেন। বিশেষতঃ ভিনদেশীয় IAS ও IPSরা তাঁর আত্মম্ভরী অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে রাজ‍্যের ভরাডুবির বন্দোবস্ত করতে উদ‍্যত হল। এদের চাকরী জীবনে ‘নিজের আখের গুছোনো’ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ‍্য নেই। এ ধরনের প্রশাসনে দুর্ণীতির ফোয়ারা ছোটে – এখানেও তার ব‍্যতিক্রম হল না। এর সাথে সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর প্রশাসনকে এমনভাবে কাজ করার কথা বললেন যে তাঁর একাধিক মন্ত্রী, দলের জেলা সভাপতিসহ অনেক নেতাই দুর্ণীতির অভিযোগে জেলবন্দী। তৃণমূল দলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী ত বটেই, তাঁর নিজের পরিবারের ধন-সম্পত্তি গত দশ বারো বছরে যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জেনে সাধারণের চোখ কপালে উঠেছে! শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিভাগে টাকার বিনিময়ে চাকরী দেওয়া এবং চাকরি চুরির দায়ে প্রাক্তণ শিক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন রকমে বিশেষভাবে নির্বাচিত আমলারা গারদে ঢুকে গেছে! বিরোধীরা সম্পূর্ণ দুর্ণীতিগ্রস্ত সরকারের আশু পতন দাবী করছে।
এমতাবস্থায় মমতাদেবী কংগ্রেসী ঐতিহ‍্যে নিজের পরিবারের মধ‍্যে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরো বেকায়দায় পড়েছেন।তাঁর পরিবারের মানুষজনকে কর্পোরেশনের কাউন্সিলার করা থেকে বিভিন্নভাবে উপার্জনের সুযোগ করে দিলেও তিনি তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ‍্যায়কে বহু আগে থেকেই মনোনীত করেছেন। গুণধর ভাইপোও নিজেকে পিসীর যোগ‍্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরী করেছেন। পিসী যেমন ফেক বিশ্ববিদ্যালয় – ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন বলে দাবী করেছিলেন, ভাইপো তেমনি এমন প্রতিষ্ঠান থেকে এমবিএ করেছেন বলে দাবী করেছেন যার কোন স্বীকৃতি নেই! তিনি যতদিন উত্তরাধিকার সূত্রে তৃণমূল দলের দু নম্বর চেয়ার দখল করে নিজেকে শুধু দলের এমপি হিসেবে রেখেছিলেন, ততদিন কোন গুরুতর সমস‍্যা হয়নি। কিন্তু যখন তিনি পিসীর থেকে প্রশাসনিক উত্তরাধিকার নেওয়ার জন‍্য এগোতে শুরু করলেন, তখন গুরুতর সমস‍্যা তৈরী হল।
যেহেতু তৃণমূল দলের একমাত্র মন্ত্র “নেত্রী ধর্ম, নেত্রী স্বর্গ, নেত্রী হি পরমন্ততপঃ”, দলের বিভিন্ন পোস্টার ও কাটআউটে পিসী-ভাইপো যুগলের ছবির মাধ‍্যমে দল তথা প্রশাসনে উত্তরাধিকারের ছকটা বুঝিয়ে দেওয়া হল। এ ধরনের একনায়কতন্ত্রী দলের সুবিধা হল, দলীয় কর্মীরা শ্রমিক পিঁপড়ের মত – নেত্রীকে কোন প্রশ্ন করে না, শুধু জয়ধ্বনির শ্লোগান দেয় আর হুকুম তামিল করে। তবে হুকুম দেওয়া ত ফেক ডিগ্রির অনভিজ্ঞ যুবকের দ্বারা সম্ভব নয় – সম্ভব শুধু হাকিমের দ্বারা! ফলে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত নেতার দলবলের (পড়ুন বিশ্বস্ত চামচা) সঙ্গে পিসীর দলবলের সংঘর্ষ শুরু হল। পিসী-ভাইপো তা বন্ধ করতে ব‍্যর্থ। কারন, ভাইপো তার উত্তরাধিকারের দাম্ভিকতায় ও অনভিজ্ঞতার কারনে সাফল‍্যের সঙ্গে পশ্চাদাপসারণ (successful retreat) অপমানজনক মনে করে প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও সর্বাত্মক আক্রমণের রাস্তা বেছে নিলেন!
গত ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২২এ বিজেপির নবান্ন অভিযানে যেভাবে রাজ‍্যের পুলিশকে ব‍্যবহার করা হয়েছে তার ফলে – বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ‍্যে সাধারণ মানুষের বিরক্তি গিয়ে পড়েছে প্রশাসন ও পুলিশের উপর। আমি মনে করি, মনের অন্দরেঙ কোন গোপন ভীতির কারনে প্রশাসন ও পুলিশ এভাবে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এতে পরিষ্কার যে তৃণমূল দল (এখন শাসক দলের সঙ্গে প্রশাসন-পুলিশ সব মিলেমিশে একাকার!) অত‍্যন্ত ভীত হয়ে এধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সিপিএম যদিও রিগিং নির্ভর নির্বাচন করত, তৃণমূল এখন নির্বাচনে জয়লাভের জন‍্য সম্পূর্ণ রিগিং এবং নেতাদের দৈনিক সুরক্ষার জন‍্য এই পুলিশ ও দলীয় পেশীশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সুতরাং এদের জনমুখী করার কোন কৌশল এই দলের কাছ থেকে আসা সম্ভব নয়। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দেহ-ভঙ্গিমা ও বক্তব‍্য ভালো করে অনুধাবনে বোঝা যায়, এই মূহুর্তে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে পিসী-ভাইপো যুগলবন্দী। বাদবাকী কেউ স্থির নয়। দলের সব স্তরে অবিশ্বাসের বাতাবরন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অন‍্য কাউকে এই পারিবারিক নেতৃত্ব বিশ্বাস করছে না। আবার পিসীকে ল‍্যাং মেরে প্রথম সুযোগেই পিসীর চেয়ার দখল করতে মরিয়া ভাইপো! কেমন যেন ইতিহাসের পাতা থেকে later Mughalsদের পুনরাবৃত্তি!
এমনটি হওয়ার কারন নিঃসন্দেহে ইডি-সিবিআইয়ের সাম্প্রতিক তৎপরতা। আগে যেভাবে রাজনৈতিক ব্ল‍্যাকমেলিংয়ের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থাদ্বয়ের তৎপরতাকে বন্ধ করা গিয়েছিল, সেই এক কায়দায় এবার চরমভাবে নিরাশ হতে হচ্ছে – কারন এবারের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চলছে পুরোপুরি উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং তারই তত্বাবধানে। যদিও রাজনীতি করার জন‍্য সেটিং-সেটিং রব তোলা হচ্ছে, সে সন্দেহ অমূলক। এখানে রাজনীতির প‍্যাঁচ পয়জারের কোন সুযোগ নেই। সে কারনেই অত‍্যন্ত চাপের মধ‍্যে পড়ে তৃণমূলের “পাপ্পু” যুবরাজ, যিনি “ভাইপোদা” on standing, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দাম্ভিকতায় রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন।
“ভাইপোদা” তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরুই করেছেন পিসীর ভাইপো হিসেবে সর্বোচ্চ স্তর থেকে! ফলে, রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের মধ‍্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ তাঁর ছিল না। চামচা পরিবেষ্টিত থাকায় তৃণমূলের মত গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতন্ত্রী দলে তাঁর মধ‍্যে মিথ‍্যা অসারতা (false vanity) এবং অতিরিক্ত দম্ভ পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পায়। এসব তাঁর প্রশাসন চালানোয় সহযোগিতা ত নয়ই, বরং অন্তরায় হচ্ছে। আমার জিজ্ঞাস‍্য – “ভাইপোদা” পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কে? কোন অধিকারে তিনি সরকারী প্রশাসন ও পুলিশের কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ তা জনসমক্ষে বলেন? আসলে রাজ‍্যের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় স্বৈরতন্ত্রী পারিবারিক শাসনের এ এক নমুনা!
এই “ভাইপোদা”র সঙ্গে একটি রাজনৈতিক চরিত্রের কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের অনেক মিল পাওয়া যায়। তিনি হলেন অক্টোবর ১৯৭৬ থেকে জানুয়ারী ১৯৭৯ (দু বছর তিন মাস) কাম্বোডিয়ার স্বৈরাচারী কম‍্যুনিষ্ট প্রধানমন্ত্রী পল পট। তিনি তাঁর শাসনকালে কাম্বোডিয়ায় একদলীয় শাসন ও তাঁর ডিক্টেটরশিপ বজায় রাখার জন‍্য সব বিরোধীসহ দেশের ২৫ শতাংশ (১৫ থেকে ২০লক্ষ) মানুষকে হত‍্যা করেন। কাম্বোডিয়ার ইতিহাসে তিনিই সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত শাসক হিসেবে চিহ্নিত। “ভাইপোদা” যেভাবে বিরোধী বিজেপির আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ‍্যে বললেন যে, ক্ষমতায় থাকলে তিনি পুলিশকে কপালের মাঝখানে গুলি করতে বলতেন – তা পল পটের কর্মকান্ডের অনুসরণ! গণতান্ত্রিক শাসন-ব‍্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক নেতা এভাবে হুমকি দিলে তাঁর মানসিকতার পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠতে হয়। যতই অনুসন্ধানকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদুটির চাপ এই পরিবারের উপর বাড়ছে, ততই বেশী করে আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে তিনি নিজের উদ্ধত, স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রমাণ রাখছেন। “ঠাকুর ঘরে কে” জাতীয় প্রশ্নের উত্তরে তাঁর ব‍্যবহার “আমি কলা খাইনি” গোছের!
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে মহিলা পুলিশ দিয়ে ঘিরতে যাওয়া যে একটা ফাঁদ ছিল; তা পরবর্তী পর্যয়ে দলের এমএলএ ও নেতাদের আচরণে এবং বালখিল‍্য প্রতিবাদে(!) প্রমাণ হয়েছে। তাদের টিটকারী অক্ষমের নিষ্ফল প্রয়াসের মত লাগল। মনে হয় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার হতাশা থেকে উদ্ভুত এমন আচরণ। যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রুখে দেওয়ার কাজে মহিলা পুলিশকে ব‍্যবহার করা হয় মহিলা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আর পুরুষ বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুরুষ পুলিশ দেওয়া হয়। এটাই সারা পৃথিবীর নিয়ম – এতদিন এ রাজ‍্যেও তাই হয়েছে। জানি না পিসী-ভাইপোর অনুপ্রেরণায় কিনা, মনে হয় “ভাইপোদা”র অনুপ্রেরণায় রাজ‍্যের পুলিশ গত ১৩ই সেপ্টেম্বর ঠিক উল্টোটাই করেছে! মীনাদেবী পুরোহিতের মত একজন বরিষ্ট নাগরিক, ছ বারের কাউন্সিলার, প্রাক্তণ ডেপুটি মেয়রকে পুরুষ পুলিশ যেভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে তা এদের আরো কালিমালিপ্ত করেছে।আবার শুভেন্দুবাবুর অভিজ্ঞতা ও প্রত‍্যুৎপন্নমতিত্বের কাছে “ভাইপোদা”র পুলিশের ছক বানচাল হয়ে গেছে। হয়ত সেকারনে “ভাইপোদা”র রাগ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ এমন পল পটিয় ভাষায় বেরিয়ে এসেছে!
আগের লেখায় পিসীর অপ্রকৃতিস্থ আচরণের কারন দেখিয়েছি। এখানে ভাইপোর এমন আক্রমণাত্মক হওয়ার কারন ব‍্যখ‍্যার চেষ্টা করা হল। যত সময় যাবে, একে একে নিভিছে দেউটির মত যত দলীয় নেতা জেলের ভাত খেতে ঢুকবে, তত পিসী-ভাইপো জুটি রাগ,ভয় ও হতাশায় বেশী করে অরাজনৈতিক উপায়ে আক্রমণ শানাবে। এভাবে তারা অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকবে। যেহেতু প্রশাসন ও শাসক রাজনৈতিক দল এরাজ‍্যে সমার্থক ও একে অন‍্যের পরিপুরক, সেহেতু প্রশাসনও অপ্রকৃতিস্ত আচরণ করবে – ফলে, রাজ‍্যের আইন-শৃঙ্খলা ও শাসন-ব‍্যবস্থার দ্রুত অবণতি ঘটবে। সেই শেষ অবস্থায় রাজ‍্যে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব সংবিধানের রক্ষকদের উপর। অপেক্ষা যত দীর্ঘায়িত হবে, জনসাধারণের দুর্দশা তত বাড়বে।

হীরক রাণীর দেশে

বেশ কয়েক বছর আগে নিউ জার্সিতে এক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে যোগদান করতে গিয়ে এক ডাক্তার-বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের সাথে কথোপকথনের সময় উনি একটি কথা বলেছিলেন – ভগবান যাকে ধ্বংস করা মনস্থ করেন, তাকে প্রথমে পাগল করে দেন! সেই কথা আমার এখন মনে পড়ল – সৌজন‍্যে পশ্চিমবঙ্গের স্বঘোষিত অধিশ্বরীর কার্যকলাপ!
আমরা জানি, ভিতরে ভিতরে মন দেওয়া নেওয়া হয়। এখন জেনেছি ভিতরে ভিতরে খাটের তলায়, ফ্ল‍্যাটের মধ‍্যে টাকার পাহাড় থাকে! এর কারন বোধহয় গোপন ব‍্যবসা! কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিভাবে শিল্প হয়- তা ভেবে ভেবে মাথার একশ গাছি চুল ছিঁড়ে ফেলেও কোন উত্তর পেলাম না!
উনি নাকি ত্রিশ হাজার ছেলেমেয়েকে চাকরি দেবেন! নিয়োগ পত্র দেওয়া হল, বেসরকারী শিল্পের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষানবিশের! তাও যে কোম্পানির অধীনে, তারা জানালো তাদের লেটার হেড ব‍্যবহার করে এই কাজ করা হয়েছে। তারা এ ব‍্যপারে বিন্দু বিসর্গ জানে না। তারপর তিনি চুপ! বেকারদের তিনি অনেক পরামর্শ দেন – অনেকটা শিবরাম চক্রবর্তীর কৃষি পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার মত! তাঁর শেষ নিদান, পুজোর সময় চা,ঝালমুড়ি, ঘুগনি বিক্রির!
আসলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতির দায় অপ্রত‍্যক্ষভাবে রাজ‍্যের অধিবাসীদের (পড়ুন ভোটার)। জনসাধারণ ভোট দেওয়ার আগে প্রার্থীদের রাজ‍্য ও প্রশাসন পরিচালনায় যোগ‍্যতা এবং ক্ষমতা বিচার না করে – অর্থাৎ মস্তিষ্ক প্রয়োগ না করে, শুধু হৃদয়ের তাড়নায় ভোট দিয়েছেন। সেজন‍্য তাঁরা এমন শাসক পেয়েছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক যোগ‍্যতার অভাবে তারা ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার উৎকট বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভোটে জিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মত যা খুশী তা বলার এবং করার অধিকার জন্মায় না। সংবিধান মেনে আইন ও ঐতিহ্যকে সম্মান করে শাসন ব‍্যবস্থা চালাতে হবে – এই সাধারন সীমাবদ্ধতার কথা মনে হয় এই রাজ‍্যের শাসকদের অজানা!
প্রথমে বলি, গত কয়েকটি সাধারন নির্বাচনের সময় তৃণমূল দলের সুপ্রিমো বলতেন যে, জনগণ যেন মনে করেন, রাজ‍্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের সবকটিতেই তিনিই প্রার্থী – এই বিবেচনায় যেন মানুষ তাঁকে ভোট দেন! অর্থাৎ রাজ‍্যে তিনি একটিই পোষ্ট, বাকী সব ল‍্যাম্পপোষ্ট! তাই, এখন যখন রাজ‍্যের মন্ত্রী, পার্টির জেলা সভাপতি, অন‍্য নির্বিচিত নেতারা দুর্ণীতি ও নানাবিধ অসততার দায়ে ধরা পড়ে হাজতে যাচ্ছেন – তার দায়ও নিঃসন্দেহে দলের সুপ্রিমোকেই নিতে হবে – অন্ততঃ সহজ যুক্তি তাই বলে। নৈতিকভাবে তিনি সে দায় অস্বীকার করেন কিভাবে? তাঁর আরেকটি বড় সমস‍্যা হল, তাঁর কথাবার্তায় একজন megalomaniac রোগীর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। এই রোগের লক্ষণ, বেশী কথা বলা এবং সেই কথায় তাঁর অহংভাব ফুটে ওঠা। আমি ব‍্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাঁর অনেকগুণ থাকলেও তিনি সেসব নিয়ে কিছু না বলে, যে সব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান নেই বা সীমিত – সেসব সম্পর্কে জনসমক্ষে জ্ঞান জাহির করতে গিয়ে বাহবা নেওয়ার বদলে হাস‍্যাষ্পদ হন। বহু উদাহরণ দেওয়া যায় – সরস্বতী-বন্দনার মন্ত্র সর্বসমক্ষে বলতে গিয়ে বললেন “কুচোসিত ভুইতো মুক্তা হারে, বিনা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে”! অথচ আসল মন্ত্র হল, “কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে, বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে”। আবার, ওনার অন‍্যতম প্রিয়পাত্র বীরভূমের তৃণমূলের সভাপতি – যিনি কথায় কথায় পুলিশকে বোম মারতে বলতেন; বিরোধীদলের মহিলাদের অব্দি গাঁজা কেসে ফাঁসানোর নিদান দিতেন ( নিজেই এখন নানাবিধ দুর্ণীতির দায়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও তত্বাবধানে চলা মামলায় ধরা পড়ে জেলে) – সম্পর্কে স্নেহের সুরে বললেন, ” ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়”! উনি ডাক্তারীর কিছু না জানলেও ওঁর কাছের ডাক্তাররা কেউ কি ওঁকে বলতে পারেননি যে, অক্সিজেন মাথায় নয়, লাংয়ে যায়, যার একাংশ রক্তদ্বারা বাহিত হয়ে ব্রেনে অর্থাৎ মাথায় পৌঁছায়। এর সাপ্লাই কমে গেলে ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যাবে। তাছাড়া, ওনার বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা নিয়ে এমনকি ওঁর নিজের দলের লোকজন পর্যন্ত হাসাহাসি করেন। ভদ্রমহিলার megalomaniac চরিত্রের পরিচয় আমরা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই পেয়েছি। ১৯৮৪ সালে উনি যখন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম সংসদীয় ভোটে দাড়ালেন, তখন হটাৎ নামের আগে ডঃ (পিএইচ ডি ডিগ্রীধারী) লেখাশুরু করলেন। দেখা গেল, উনি নাকি আমেরিকার অস্তিত্বহীণ বিশ্ববিদ্যালয় (!) ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এই ডিগ্রি পেয়েছেন! কিছুদিন আগে উনি বলেন যে, তিনি একসঙ্গে আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট, পোষ্টগ্র‍্যাজুয়েট ও ল ডিগ্রি করেছেন! অন‍্য রাজনীতিকদের সম্পর্কে ওনার বাক‍্য চয়নেও ওনার পরিচয় মেলে। একবার লোকসভা নির্বাচনের আগে উনি বললেন, নির্বাচনের পর উনি নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে শৃঙ্খলিত করে টেনে আনবেন! উনি প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে তুই-তোকারি পর্যন্ত করেছেন! এগুলো সবই megalomaniac চরিত্রের প্রমাণ। আবার, অন‍্যান‍্য বহু আচরণে তাঁর মধ‍্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না।
এবার সংবিধান স্বীকৃত ক্ষমতার বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। সরকারী প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, কোন মন্ত্রী, এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীর পর্যন্ত সরকারী কোষাগার থেকে অর্থ বিতরণের ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানের – সচিব, প্রধান সচিব, অতিরিক্ত মূখ‍্য সচিব ইত‍্যাদির উপর ন‍্যস্ত। বিভাগের নীতি নির্ধারণ ক্ষমতা বিভাগীয় মন্ত্রীদের। তবে তাদের সিদ্ধান্ত মন্ত্রীমন্ডলীর বৈঠকে গৃহীত হবার পরই তা কার্যকর হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মূখ‍্যমন্ত্রী। আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এখন যাঁরা মূখ‍্য সচিব ও অর্থ সচিব, তাঁরা মৃদুভাষী, সুভদ্র অফিসার। কিন্তু তাঁরা DA মামলায় যদি আদালত অবমাননার দায়ে পড়েন, তাঁদের হাজতবাসের মত কড়া শাস্তি পর্যন্ত হতে পারে। তখন আইনী প্রক্রিয়ার মধ‍্যে মূখ‍্যমন্ত্রী কোন ভাবেই পড়বেন না। অথচ এই রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রশাসনিক ঘোষণা এমনভাবে করেন – এটা করলাম, ওটা দিলাম গোছের – সবেতেই ‘আমিত্ব’ ফুটে ওঠে! এগুলো যতদূর জানি, মন্ত্রীসভার যৌথ সিদ্ধান্ত, যা কার্যকর করার দায়িত্ব মূখ‍্য সচিবের তত্বাবধানে বিভাগীয় সচিবদের। সেজন‍্য প্রশাসনিক গাফিলতির দায় সচিবদের উপর বর্তালেও তা কখনো মন্ত্রী বা মূখ‍্যমন্ত্রীর উপর আসে না। রাজনৈতিক নেতারা যখন গ্রেপ্তার হন, এসব কারনে নয়, একমাত্র দূর্ণীতি করে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীণ সম্পত্তি করার জন‍্য – আর এভাবেই থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। সাধারন মানুষের কাছে বাহবা নেওয়ার জন‍্য আত্মম্ভরী ঘোষণায় অসুবিধার জায়গাগুলো এবার আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছে। রাজ‍্য সরকারের বকেয়া DA না দেওয়া, যা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে – সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত – তার দায় সম্পূর্ণভাবে মূখ‍্য সচিব ও অর্থ সচিবের। মূখ‍্যমন্ত্রীর এখানে কোন দায় নেই। কিন্তু অনাবশ‍্যক আত্মম্ভরীতার কারনে রাজ‍্য সরকারের সমস্ত ব‍্যর্থতার দায় তাঁর ঘাড়েই চাপছে।
এখানে ১৯৮৯ সালে রুমানিয়ার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। সে দেশের নির্বাচনে রুমানিয়ার কম‍্যুনিস্ট ডিক্টেটর Nicolae Ceausescu ৯৯.৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তখন অস্বাভাবিক মূল‍্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের কারনে যে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হল, তা ভাঙ্গতে সরকার দমন-পীড়ন ও হত‍্যার যে চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করল, তাতে বিক্ষোভের আগুন প্রবলতর রূপ নিল। Ceausescuর ২৪ বছরের অপশাসনের পরিসমাপ্তি হল ঐ বছরের ২২শে ডিসেম্বর আর সস্ত্রীক Ceausescu ২৫শে ডিসেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিলেন। তিন মাস আগে তিনি দেশের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন! এই Ceausescu এবং তাঁর স্ত্রী Elena Ceausescu তাঁদের আত্মম্ভরী ও উদ্ধত স্বভাবের জন‍্য পরিচিত ছিলেন। তাঁদের প্রচার, বিশেষতঃ বাইরের দেশে এমন ছিল যেন Ceausescu আধুনিক রুমানিয়ার রূপকার – উন্নয়ণের জোয়ারে তিনি রুমানিয়াকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন! তাঁর পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই মিথ‍্যার ফানুষ ফেটে গিয়েছিল।সুতরাং, নির্বাচনে জিতে যেমন যা খুশী তা করা যায় না; তেমনি নির্বাচনে বেশী ভোটে জেতা কোন শাশ্বত জনপ্রিয়তার নির্ণায়ক নয়। এই সহজ কথাটা স্মরণ রাখলে রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল। রাজনীতির মঞ্চে আজকের নবাব আগামীকালের ফকির।
আমরা যারা তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনীতি শুরু থেকে দেখে আসছি, তারা তাঁর অতিনাটুকেপনা দেখতে অভ‍্যস্ত। যেমন, তিনি যখন কংগ্রেসে সোমেন মিত্রদের দ্বারা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কোণঠাসা অবস্থায়, তখন একদিন প্রকাশ‍্যে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁসের অভিনয় করেছিলেন। আরেকবার ব্রিগেডের জনসভায় বিরাট এক রেডিমেড ঘন্টা বাজিয়ে বামফ্রন্টের বিদায় ঘন্টা বাজিয়েছিলেন! তিনি সর্বদা একদল চাটুকার সাংবাদিক ‘সেট’ করে রাখেন যারা সবেতেই “কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ” বলে বাহবা দেন। এই মেলোড্রামা বহু বছরের পুনঃ পুনঃ ব‍্যবহারে দীর্ণ। ফলে, গত বিধানসভা ভোটের সময় যখন তিনি নন্দীগ্রামে অজ্ঞাত (!) শত্রুর আক্রমণে (!) পা ভাঙ্গার কথা বলে পুরো নির্বাচন পর্বে হুইল চেয়ার অভিযান করলেন, তখনও তিনি নন্দীগ্রামে নির্বাচনী পরাজয় এড়াতে পারলেন না।
তবে আমি বরাবর তাঁর রাজনৈতিক বোধকে শ্রদ্ধা করি। উনি যথার্থই বুঝতে পারছেন, “একেএকে নিভিছে দেউটি”র মত তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর, মন্ত্রী-সান্ত্রীরা, যারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঔদ্ধত্বে দলের সুপ্রিমোকেও টেক্কা দিত – তারা এখন জেলের ভাত খেতে অভ‍্যস্ত হচ্ছে। অনেক আগে একটি বৈদ‍্যুতিন চ‍্যানেলে আমি বলেছিলাম, পার্থ চট্টোপাধ‍্যায়ের মনোভাবের প্রতিফলন হয়েছে রাজ‍্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের কর্মদক্ষতায়! তখন পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী – তিনি বলেছিলেন, শিক্ষকদের তিনি মাইনে দেন, তাই শিক্ষকরা তাঁর চাকর! এই লোকটির আমলে বিধানসভায় বেআইনীভাবে বিল পাশ করিয়ে আচার্য তথা রাজ‍্যপালকে বাদ দিয়ে দলদাস উপাচার্য নিয়োগ প্রথা চালু হয়! উচ্চ আদালতের নির্দেশে এইভাবে নিযুক্ত দলদাস এক বিশ্ববিদ‍্যালয়ের উপাচার্যর নিয়োগ বাতিল হয়। এই উপাচার্য, যার অধ‍্যাপক হওয়ার নূন‍্যতম যোগ‍্যতা ছিল না, তিনি তার নিয়োগ কর্তাকে তৈল মর্দনের নতুন রেকর্ড করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান কর্ণধারকে সাম্মাণিক ডি লিট দিয়েছেন! এই কর্ণধার এমনই বিদ্বান যে মুক্ত সভায় দাবী করেন, পশ্চিমবঙ্গে তিনি নাকি পাঁচশটি IIT তৈরী করে দিয়েছেন! অবশ‍্য রেকর্ড অনুযায়ী সারা দেশে তার পাঁচ শতাংশ IIT নেই! আমার অনুমান, উনি ITI এর সঙ্গে IITকে গুলিয়ে ফেলেছেন। কোন কিছু যদি না জানা থাকে তাতে সমস‍্যা হয় না; কিন্তু কেউ যদি না জানেন যে তিনি জানেন না, তবে তা বিপদের!
পরিশেষে বলি, তিনি এখনো “দুধেল গাই” তত্ত্ব প্রয়োগে মগ্ন। দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় তিনি ও তাঁর দল বলিষ্ট প্রতিবাদ করেন। হাতরাসের ঘটনায় চারজন হিন্দুকে গ্রেপ্তার করা হল যেখানে নির্যাতিতা একজন ইসলামী মহিলা – তিনি ডেরেকের নেতৃত্বে দলের পুরো টিমকে পাঠালেন। নিজে বারবার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নিশানা করলেন! তাঁর বশংবদ অর্ধশিক্ষিত “বুদ্ধিজীবী” সম্প্রদায় দম দেওয়া পুতুলের মত খুব লাফালাফি করল! তারপর যখন লখিমপুর খেরীর ঘটনা ঘটল, যেখানে একজন হিন্দু মহিলার উপর চরম পাশবিক অত‍্যাচারের কারনে ছ জন ইসলামী দুষ্কৃতি গ্রেপ্তার হল, তখন তিনি লোক পাঠানো দূরের কথা, এই ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত করলেন না। তাঁর পোষা “বুদ্ধিজীবী”রা শীত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন! এভাবে তিনি কিছু জেহাদীর সমর্থন পেলেও সাধারন ইসলামীদের সমর্থন হারাবেন। দুষ্কৃতি সর্বদা দুষ্কৃতি। নির্যাতিতাও সর্বদা নির্যাতিতা। এভাবে ধর্মের সুড়সুড়ি দেওয়া রাজনীতি বাঙ্গালী পরিত‍্যাগ করবেই। অনেক রাজনৈতিক গুণের অধিকারী হয়েও ধান্দার রাজনীতি, দুর্ণীতিকে প্রশ্রয়, ও জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে নিতে এক সময় তিনি রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যাবেন।

বাঙ্গালীর দূর্গাপুজা – সেকাল ও একাল

বাঙ্গালীর সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক খুঁজতে বাজারী বুদ্ধিজীবীরা ব‍্যর্থ! তাদের বক্তব‍্য হল, রামচন্দ্র উত্তর ভারতের, আর দেবী দূর্গা অর্থাৎ শিব ঠাকুরের গৃহিনী পার্বতী উমা হলেন বাঙ্গালীর নিজের কন‍্যা – কারন, দূর্গার বাপের বাড়ি বাংলায়! আসলে এইসব বুদ্ধিজীবীদের কেউ অভিনয় জগতে সাফল‍্য পাওয়া, কেউ বা সাফল‍্যের খোঁজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষজন – যারা নির্দিষ্ট চিত্রনাট‍্যের ভিত্তিতে অভিনয় করেন! এরা সমাজ, সংস্কৃতি বিহীন এমন জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছেন যে, এখন আমজনতা এই বুদ্ধিজীবীকুলকে বিদ্রুপের পাত্র মনে করেন – এদের বিবেক বিশেষ আলমারিতে বন্ধ থাকে। অর্ডারী সময় শুধু তা বেরিয়ে আসে। এদের বিদ‍্যাবুদ্ধির দৌড় এমন যে, আশ্বিনের শারদ প্রাতে দেবীপক্ষের সপ্তমীতে যে দূর্গাপুজাকে বাঙ্গালীর নিজস্ব বলে চালানো হয়, তা যে শ্রীরামচন্দ্রের হাত দিয়েই শুরু হয় – তার কথা এদের স্মরণে থাকে না! মহিষাসুর বধের যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত, তা বসন্তকালের পুজা। রাবণ বধের প্রাক্কালে শ্রীরামচন্দ্র যে দূর্গা মায়ের আরাধনা করেন, তাকে “অকাল বোধন” নামে অভিহিত করা হয়। এই অকাল বোধনই আমাদের বাঙ্গালী হিন্দুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুজা – দূর্গাপুজা। অথচ শ্রীরামচন্দ্রকেই এরা উত্তর ভারতীয় বলে বাংলায় ব্রাত‍্য ঘোষণা করেছে! রাজনৈতিক স্বার্থে এমন আজগুবি চিন্তাধারা একমাত্র বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নামের অর্ধশিক্ষিত ধান্দাবাজদের দ্বারাই প্রচার করা সম্ভব।
বাঙ্গালীর দূর্গাপুজার ইতিহাস যদিও কয়েকশ বছরের পুরোনো, এই পুজায় আমজনতার অংশগ্রহণ শুরু হয় ১৭৯০ সালে। তার আগে বনেদি পরিবারের দূর্গাপুজা অনেক ক্ষেত্রেই খুব ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলেও সেসব পুজায় সাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকত না। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পরবর্তী পর্যায়ে কোম্পানির সাহেবদের খুশী করার জন‍্য – ব‍্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ‍্যে কোলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দূর্গাপুজায় সাহেবদের বিশেষ নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নিয়ে আসা হয়। সেইসঙ্গে বাইজী নাচ ও সুরার বিশেষ বন্দোবস্তও করা হল। এই ব‍্যাপারে বিভিন্ন বনেদি বাড়ির পুজার উদ‍্যোক্তা পরিবারগুলির মধ‍্যে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরী হত! নথি অনুযায়ী কোলকাতার প্রথম দূর্গাপুজার কৃতিত্ব দেওয়া হয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারকে। এদের দূর্গাপুজা শুরু হয় মোঘল আমলে – ১৬১০ সালে। প্রথম দিকে এই পুজাতেও সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারনে সর্বজনীন দূর্গাপুজার উদ্ভব হয়েছে। শুরুটা করেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে। এর থেকেই আসে বারো ইয়ারী – অর্থাৎ বারোয়ারী দূর্গাপুজা। বর্তমানে এই পুজা সর্বজনীন রূপ নেওয়ায় তা সর্বজনীন দূর্গাপুজায় দাঁড়িয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন স্বাধীনতা আন্দোলন বিক্ষিপ্তভাবে দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে, তখন কোলকাতার প্রথম বারোয়ারী পুজার সন্ধান মেলে ১৯০৯ সালে বলরাম বোসঘাট রোডে, যার উদ‍্যোক্তা ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা। এই পুজার প্রাণপুরুষ ছিলেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী। এই সময় থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ‍্যা বাড়তে থাকে। তার প্রধান কারন হল, দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির জন‍্য যেসব বিপ্লবী তরুণরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে মহিষাসুরমর্দিনী মা দূর্গারূপে বিদেশী অসুর ও তাদের দালালদের বিনাশ করার জন‍্য মানসিক শক্তি আহরনের উদ্দেশ‍্যে তাঁরা অসুরদলনী দূর্গার আরাধনা শুরু করেন। সঙ্গে গূঢ় উদ্দেশ‍্য ছিল – সামাজিক মিলন।
বাংলার যে দুটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল – যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতি – তার নেতৃত্বে থাকা যুবকরাই এইসব পুজার প্রধান উদ‍্যোক্তা ছিলেন। এই প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঐ সময় বাঙ্গালী হিন্দুর মনে সৌভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ তৈরী করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ব্রাহ্ম ছিলেন, তবুও রবীন্দ্রনাথের দূর্গাপুজায় অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায় এই উপলক্ষ‍্যে তাঁর লেখা বেশকিছু কবিতায় ও গানে। যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বারোয়ারী দূর্গাপুজার গ্রহণযোগ‍্যতা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই পুজার বহিরঙ্গের পরিবর্তন হতে থাকে। প্রথমে ছিল, এক চালের প্রতিমায় মা দূর্গা, মহিষাসুর, সিংহ সহ দুই পুত্র ও দুই কন‍্যা – সপরিবারে বিরাজমান। বৈশিষ্ট‍্য ছিল, প্রত‍্যেকে নিজ নিজ বাহনারূঢ়া। তারপর ক্রমে মায়ের সঙ্গে পুত্র-কন‍্যারা আলাদা হতে লাগলেন। চালচিত্রেও বৈশিষ্ট্য এলো। শুধু মূর্তিময়ী মা – যেন চিন্ময়ী কন‍্যা উমা সপরিবারে মৃন্ময়ীরূপে আবির্ভূতা।
এগুলি সমাজে বাঙ্গালী হিন্দুর মননের পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ‍্যপূর্ণ। বারোয়ারী পুজার বর্তমান সংস্করণে আসার আগে বাঙ্গালী মননে দূর্গাপুজা ও তার ইতিহাস না জানলে পুজার বিবর্তনকে শুধু রাজনীতির চোখেই দেখতে হবে – সামাজিক নয়। প্রথমে বাঙ্গালীর সর্বজনীন বারোয়ারী পুজা শুরুর উদ্দেশ‍্য দেখা যাক। সাধারণ মানুষের কাছে বনেদী বাড়ির দূর্গা পুজায় অংশগ্রহণ অত‍্যন্ত সীমিত থাকলেও তাদের মনে পুজায় যোগদান ও সার্বিক অংশগ্রহনের আকাঙ্খা জাগানোর পিছনে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী যুব সমাজ – বিশেষতঃ ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একদল যুবকের মনে যে অসুরদলনী মাতৃরূপের মৃন্ময়ীর আরাধনাকেই আপামর বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ তাঁদের দেবী দূর্গা রূপে পুজা শুরু করে। এর ফলে যেমন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বার্তা দেওয়া হয়, তেমনই চারদিনের পুজার মাধ‍্যমে সামাজিক বন্ধনের প্রক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। এই দুটিই প্রাক-স্বাধীনতা বারোয়ারী দূর্গাপুজার অবদান হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী সমাজের ও বাঙ্গালী মননে মা দূর্গাকে বাঙ্গালী তার নিজের ঘরের বিবাহিত কন‍্যার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। কৈলাশ থেকে উমা – পুত্র-কন‍্যাসহ বাপের বাড়ি, অর্থাৎ বাংলায় আসেন। বাপের বাড়িতে বহুদিন পর বিবাহিত কন‍্যা এলে যেমন আনন্দ-উৎসবে বাড়ি মুখরিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হতে শুরু করে। বিশেষতঃ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অসুরদলনী মহিষাসুরমর্দিনীরূপের প্রয়োজনীয়তা ফুরানোর পর ধীরে ধীরে তা প্রতীকী রূপ নেয় – আত্মিক প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
এইসময় মুসলিম লীগের বাড়বাড়ন্ত ও রাজনৈতিক দলগুলির ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় ইন্ধন দেওয়ার কারনে প্রাক-স্বাধীনতাপর্বের শেষের দিকে, ১৯৪৬ সালে বাঙ্গালীর দূর্গাপুজাকে ঘিরে নতুন ঝামেলার উদ্ভব হয়। বাংলার বশ কয়েকটি জেলায় ইসলামী মানুষের সংখ‍্যাধিক‍্য থাকায় এবং তাদের মসজিদ, মাদ্রাসার মৌলভী, ইমাম, মৌলানারা ইসলামী নেতৃবৃন্দের অঙ্গুলীহেলনে ইসলামীদের মূর্তিপুজার সক্রিয় বিরোধীতা করতে প্ররোচিত করে। তার পর থেকে বাঙ্গালী ইসলামীদের একাংশ দূর্গাপুজাকে হাতিয়ার করে ইসলামের পরিপন্থী কাজের অছিলায় দূর্গামুর্তি ভাঙ্গাসহ দূর্গাপুজা বন্ধের অভিযানে নামে। স্বাধীনতা উত্তর পূর্ব পাকিস্তান -অধুনা বাংলাদেশে – একইভাবে দূর্গামুর্তি ভাঙ্গা এবং পুজা পন্ড করার প্রক্রিয়া চালু আছে; যদিও সে দেশের বর্তমান সরকার প্রকাশ‍্যে এ ধরনের কাজের নিন্দা করছে, তবু তাদের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বর্বরতা বন্ধের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আসলে পুরো ব‍্যাপারে কিছু অপ্রকাশিতব‍্য মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায় মাত্র। প্রথম যখন বারোয়ারী দূর্গাপুজার প্রচলন হল, তখন হিন্দু মননে যে মাতৃপুজার রূপ চিহ্নিত হয়ে আছে, সেখানে বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শুধু নয়, তাদের সহযোগী হয়ে যেসব দেশীয় মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগীতা করত, তারাও অসুরশ্রেণীর মধ‍্যে পরত! যে যতীন্দ্রমোহন মুখার্জী ভবানীপুরে বারোয়ারী পুজার প্রচলন করেন, তিনিই বৃটিশ শক্তির হয়ে কাজ করা খান বাহাদুর শামসুল আলমের খুনের (ফেব্রুয়ারী, ১৯১০) নেপথ‍্যে ছিলেন। একদিকে যেমন মাতৃশক্তির আরাধনায় বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলেন, তেমনি বাঙ্গলার ইসলামী সমাজ এই পুজার মধ‍্যে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধালাভের সুযোগ না থাকায় ধর্মীয় মোড়কের আড়ালে এর বিরোধীতা করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষতঃ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ‍্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুজা আচারের কিছু পরিবর্তন লক্ষ‍্য করা যায়। বাঙ্গালী ঘরের মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে চোখের জলে বিদায়ের সময় যে লোকাচার করা হয়, বিজয়া দশমীতে মাতৃবরণের সময় তার প্রতিফলন দেখা যায়। আবার বাঙ্গালী হিন্দু মেয়েদের আরেকটি লোকাচার – সিঁদুর খেলার মাধ‍্যমে দূর্গাপুজার সমাপ্তিতে বিভিন্ন পরিবারের মেয়েদের মধ‍্যে মেলবন্ধন দেখা যায়। বিজয়া দশমী অন্তে গুরুজনদের সম্মান জানানো ও অন‍্যদের স্নেহাশীষ এবং ভ্রাতৃত্ববোধের কোলাকুলি – সবই সামাজিক মেলবন্ধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
এভাবে দূর্গাপুজা কবে যে বাঙ্গালীর নিজস্ব সংস্কৃতিতে জারিত হয়ে নির্ভেজাল বাঙ্গালী হিন্দুর পুজার সঙ্গে উৎসবের মেজাজের মেলবন্ধন হয়ে গিয়েছে তার নির্দিষ্ট সন-তারিখ বলা সম্ভব নয়। তারপর, বাঙ্গালী হিন্দুর – বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুদের দূর্গাপুজায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন – যেটা বাঙ্গালীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ‍্য রেখেই এলো। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দলে দলে পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে বিপুল সংখ‍্যক বাঙ্গালী হিন্দু সর্বস্ব খুঁইয়ে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আসেন। কিছু মানুষ আসাম এবং ত্রিপুরায় যান। এদের জওহরলালের নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হয়। পঞ্জাবে যেমন জন-বিনিময় হয়, তেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও করার প্রস্তাব শ‍্যামাপ্রসাদ ও বল্লবভাই প‍্যাটেল সমর্থন করলেও জওহরলালের তীব্র আপত্তিতে তা ঞবাতিল হয়। জওহরের এই বাঙ্গালী বিদ্বেষের পর উদ্বাস্তু বাঙ্গালীদের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কারনে এদের বামপন্থীরা যে রাজনীতির গোলকধাঁধায় ফেলেছিল, তার মূল শিক্ষা ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা” নামের সোনার পাথর বাটি মার্কা তত্ত্ব যার নির্গলিতার্থ উদ্দেশ‍্য ছিল হিন্দুধর্মের সব পুজা, আচার-অনুষ্ঠানকে বিদ্রুপাত্মকভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল‍্য করা। এই “ধর্মনিরপেক্ষতার”র প্রভাব এসে পড়ল বাঙ্গালীর পুজা-আর্চা এবং অন‍্যান‍্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর! প্রথমে শুরু হল মায়ের মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্তরালে পুজার ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব‍্যক্তিকে বিদ্রুপের সঙ্গে লঘু করা। পর্বত কন‍্যা উমাকে শুধু কাঁচুলি পড়িয়ে মূর্তি তৈরী হল! তারপর বিভিন্ন পরিত‍্যজ‍্য জিনিষ – আবর্জনা দিয়ে মূর্তি গড়া শুরু হল! এই পর্যায়ে আখের ছিবড়ে, বাঁশ, এমনকি মাছের আঁশ, আবর্জনা দিয়ে মূর্তি তৈরী হয়েছে। এক সময় শুরু হল মাটির ভাঁড় নিয়ে ভাঁড়ামো! এদিকে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এবং বাজারী সংবাদ-মাধ‍্যমের ঢক্কানিনাদে বাঙ্গালী হিন্দুর দূর্গাপুজা কিভাবে যেন “দূর্গোৎসব” হয়ে গেল! রাজনৈতিক অশুভ শক্তির সঙ্গে জিহাদী শক্তির যোগসাজসে হিন্দুত্বকে ব‍্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা ‘আধুনিকতা’ ও ‘শিক্ষিত মনন’-এর পরিচয় হিসেবে ধরা হল! শুধু দূর্গাপুজা নয়, সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর “ভ‍্যালেনটাইনস্ ডে” হিসেবে অর্ধ-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মার্কা ধান্দাবাজ মানুষজন প্রচার করতে শুরু করল। এটা ঠিক যে, সকল ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন ঐ ধর্মের মানুষদের কাছে বিশেষভাবে পালন করার দিন হিসেবে দেখা হয়। ২৫শে ডিসেম্বর যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনের আনন্দ অনুষ্ঠানের গতি প্রকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হলেও, ঐ দিনের চার্চের প্রাতঃ প্রার্থনার কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার, ইসলামীদের ঈদের অনুষ্ঠান ও প্রার্থনার একচুল পরিবর্তনের কথা বলার সাহস কোন ভাড়াটে ধান্দাবাজ – যাদের পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী বলে, বা কোন ভুঁইফোর সাংবাদিক বা কোন “ধর্মনিরপেক্ষ” রাজনীতিককে বলতে শুনিনি! শুধু হিন্দুদের ‘পুজা’কে ‘পুজা’ না বলে ‘উৎসব’ বলে চালানোর প্রচেষ্টার পিছনে এক গুঢ় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসততা প্রতীয়মান হয়।
এবার আসা যাক কম‍্যুনিষ্ট-উত্তর সিপিএমের মেধাবী ছাত্রীর জমানায়। এই সময় “দুধেল গাই” তত্ত্ব ও বাঙ্গালী হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে state sponsored পরিবর্তন – বিশেষতঃ দূর্গাপুজায় – লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে।
এখন বারোয়ারী দূর্গাপুজা করা “ক্লাব”গুলি সরকারী অর্থের অনুদানে বলীয়ান। এর সঙ্গে ধর্ম বা পুজার কোন সম্পর্ক নেই। কারন, নির্দিষ্টভাবে পুজা-উপকরন বা মূর্তির জন‍্য এই অনুদান দেওয়া হয় না! বলা ভালো, এই টাকা ক্লাবগুলিকে কোন শর্ত ছাড়াই ‘দান’ দেওয়া হয়! একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা মনে পড়ে গেল – “there is no free lunch”। তাহলে ক্লাবগুলিকে এই অনুদান দেওয়ার কারন কি? সরকারী বিজ্ঞাপনে বলা হয় – “পুজা যার যার, উৎসব সবার”। অর্থাৎ, দূর্গাপুজা – যা এখন পুজা নয়, উৎসব – সবার! একেবারে সর্বধর্ম সমন্বয়! এর বহিঃপ্রকাশ শুরু হয়েছে দূর্গা মন্ডপে কোরান রাখা, গির্জা, মসজিদের আদলে দূর্গা মন্ডপ নির্মান – এসব দিয়ে! এমনকি জুতোর মন্ডপ পর্যন্ত এসে গেছে! অথচ অন‍্য ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এমন “সর্বধর্ম সমন্বয়” মার্কা বদ ঐতিহ‍্য দেখা যায় না। কোন ইসলামী মানুষ ঈদের নমাজে বা মসজিদের প্রার্থনায় হনুমান চালিশা বা গীতা বা বাইবেলের উপস্থিতি মেনে নেবেন কি? এভাবে সরকারী মদতে ইচ্ছাকৃতভাবে দূর্গাপুজার ইসলামীকরণ কাম‍্য নয়। তাছাড়া দেশের সংবিধান অনুযায়ী শুধু কোন পূজার জন‍্য সরকারী অর্থ সাহায‍্য করা যায় না। এর ফলে হয়ত কিছু রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে; বিনিময়ে দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুসলমান বিবাদের খেসারত আপামর বাঙ্গালীকেই দিতে হবে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আচার-আচরণের লঘুকরনের মাধ‍্যমে তাদের ধর্মবোধকে নষ্ট করে অন‍্য ধর্মকে অটুট রাখার প্রক্রিয়া হিন্দুত্বকে খতম করার রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ডকে যদি এখুনি প্রতিরোধ করা না যায়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভন্ডামীকে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতায় পরিণত করা হবে! বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বারোয়ারী দূর্গাপুজার যে রূপ আমরা দেখি, তা ভাতাজীবী বাঙ্গালী হিন্দুদের “দুর্গোৎসব” – দূর্গাপুজা নয়। সেখানে স্ফুর্তির বহুবিধ উপকরণ মজুত থাকলেও ভক্তির লেশমাত্র নেই।
আবার দূর্গাপুজাকে UNESCOর হেরিটেজ তকমা পাওয়া নিয়ে ধান্দাবাজ রাজনীতিক ও অর্ধশিক্ষিত সংবাদ-মাধ‍্যমের লম্ফঝম্ফ দেখে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগে – ঈদ বা খ্রীষ্টমাসের ধর্মীয় উদযাপন করাকে কেউ হেরিটেজ তকমা দিয়েছে কি? আর সেখানে দূর্গার বদলে ‘কোরান’ বা ‘বাইবেল’ পুজা করলেও তা হেরিটেজ হবে ত? এই ‘হেরিটেজ’ খায় না মাথায় মাখে – তাও বোঝা গেল না। আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী হিন্দুদের বলি, আর কতদিন ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত লাফাবেন? যে জাতির ধর্ম নেই – ধর্মবোধ নেই – তার আত্মহনন নিকটপ্রায়।

দেশভাগের যন্ত্রণার নেপথ‍্যে

সারা দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির আনন্দে গত আগষ্ট মাস জুড়ে উৎসবে মেতেছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতা “Tryst with destiny” সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ উদ্দীপনা সৃষ্টি না করলেও সম্ভ্রান্ত সমাজ এবং ইউরোপীয় সমাজের কাছে আদৃত হয়েছিল। আজ ভারতের স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসের তথ‍্য ঘাঁটলে জানা যায়, এটি একটি অলীক কল্পনা মাত্র। ইতিহাসে উপেক্ষিত অসংখ‍্য মানুষের রক্ত, প্রাণের বিনিময়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর ব্রিটেনের বেহাল আর্থিক হাল ফেরানোর তাগিদে বৃটিশরা ভারত সহ তাদের অধিকাংশ উপনিবেশকে স্বরাজ দিতে বাধ‍্য হয়। চরকা কেটে আর অহিংসা প্রচার করে যে পৃথিবীর কোথাও স্বাধীনতা অর্জন করা যায়নি তা ইতিহাসই বলছে! বরঞ্চ বলা ভাল, এই খন্ডিত স্বাধীনতা ভারতীয় হিন্দু, বিশেষতঃ বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে যুগের যন্ত্রনা (pangs of era)। ভারতের ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতার আগে ও পরে হিন্দু বাঙ্গালীর উপর যে চরম অত‍্যাচার – অবিচার নেমে আসে তা, “সমাজতান্ত্রিক” কংগ্রেসী এবং “ধর্মনিরপেক্ষ” কম‍্যুনিস্ট ঐতিহাসিকদের অবহেলা, অবজ্ঞা ও মিথ‍্যাচারে দেশের মানুষের কাছে কখনো সঠিকভাবে প্রচার করা হয়নি। বর্ধিষ্ণু বাংলা প্রদেশ ধর্মীয় জিহাদ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের শিকার হয়ে যাওয়ায় এবং তার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের অঙ্গরাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পঙ্গুত্বের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রইল।
যে খন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়া গেল, তার হীণবল ও শক্তি হ্রাসের জন‍্য দায়ী একদিকে ইসলামী মৌলবাদ, অন‍্যদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অপদার্থ নেতৃত্ব ও গান্ধীজীর অহংকারী, একগুঁয়ে, পক্ষপাতদুষ্ট পরিচালনা এবং সেইসঙ্গে শাসক বৃটিশের নোংরা রাজনীতি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর পূর্ববর্তী সময়ে (১৮৫৭র সিপাহী বিপ্লবের পরবর্তী সময়কালে) দেশে হিন্দু ও ইসলামীদের মধ‍্যে সর্বব‍্যাপী ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। এই হিংসার কারন হিসেবে প্রথমতঃ, গান্ধীজীর নির্বোধের মত খিলাফত আন্দোলনকে সার্বিক সমর্থন দেওয়া; দ্বিতীয়ত, প্রাক্তণ খিলাফতী সৌকত আলীকে জেনারেল সেক্রেটারী করে ভারতের কম‍্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও তাদের পরবর্তী কার্যপ্রণালী।
খিলাফত আন্দোলন একটি পুরোপুরি ধর্মীয় আন্দোলন – তুরষ্কে খলিফার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার ইসলামী সংগ্রাম। এই আন্দোলনকে কংগ্রেসের সমর্থনের মধ‍্যে গান্ধীজীর রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় না। হয়ত তাঁর ধারনা ছিল, এই আন্দোলনকে সমর্থন করার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দেশের ইসলামীরাও কংগ্রেসের সত‍্যাগ্রহ ও স্বরাজের অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করবে! গান্ধীজীর এই সিদ্ধান্ত ইসলামী ধর্মবিশ্বাস, ঐতিহ‍্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর অজ্ঞতার প্রমাণ। গান্ধীজীর এই জিহাদী ইসলামী প্রীতির খেসারত ভারতকে বিশেষতঃ বাংলাকে চরম মূল‍্য দিতে বাধ‍্য করেছে এবং এই লোকটি তার জন‍্য কখনো দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি! মুস্তাফা কামাল পাশা তুরষ্ক দখলের পর খলিফার অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করেন। ফলে, খিলাফত আন্দোলনের কারন না থাকলেও ঐ সময় এই পরিস্থিতিতে ইসলামী মানুষদের মধ‍্যে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের সঞ্চার হয়। আবার, ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণের পর তাদের কাজকর্মের সুবিধার্থে ভারতীয়দের মধ‍্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ও তৎকালীন আধুনিক পড়াশুনার সুযোগ করে দেয়। তখন হিন্দুরা অধিক সংখ‍্যায় শিক্ষিত হলেও ইসলামীরা সাধারনভাবে ইংরেজী শিক্ষায় বিমুখ ছিল। আবার নবাব আবদুর রহিমের বৃটিশদের কাছে দরবার – যেখানে তিনি উর্দুভাষী আশরাফি ইসলামীদের ইংরেজী ভাষায় শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেও আতরাফি ইসলামীদের (মুলতঃ বাঙ্গালী ইসলামী, যারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত) জন‍্য শুধু বাংলা ভাষায় শিক্ষার দাবী করেন – যার অবিসংবাদী ফল হল, বাঙ্গালী ইসলামীরা অশিক্ষায় নিমজ্জিত থেকে মূলতঃ শ্রমিক ও মুনিষ খাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত।
এমতাবস্থায়, ভারতের ইসলামীরা, বিশেষতঃ আশরাফি ইসলামীরা আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সারা ভারতে ইসলামীদের মধ‍্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে ইসলামীদের জন‍্য আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের চেষ্টায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন – মহম্মদ হাসান দেওবান্দী, মহম্মদ আলী জউহর, হাকিম আজমল খান, মুখতার আহমেদ আনসারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ‍্য। তখন থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষতঃ ইসলামী মহল্লায়, মাদ্রাসা তৈরী ও মাদ্রাসা-শিক্ষার ব‍্যাপ্তি শুরু হয়। মহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী খান, ইস্কান্দার মির্জা, হুসেইন সাহিদ সুরাবর্দী এই প্রয়াসের ফসল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই ইসলামী নেতৃবৃন্দ পরবর্তীকালে ব‍্যাক্তিগত ক্ষমতা করায়ত্ব করার জন‍্য তাদের ধর্মকে ব‍্যবহার করে মসজিদের ইমাম, মৌলভীদের সঙ্গে জোট বেঁধে অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত আরজালি ও আতরাফি ইসলামীদের (এদের ৯৮ শতাংশই অতি দরিদ্র) ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে এবং লোভ-ভোগের অনুভূতিকে জাগ্রত করে ভারতের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইসলামী ঐক‍্যের আওয়াজ তুলতে শুরু করেন। এভাবে আধুনিক ভারতে যে ইসলামী মৌলবাদ জাগ্রত হল তার দায় গান্ধীজী ও তাঁর অঙ্গুলী হেলনে চলা কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর বর্তায়। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হল ‘মুসলিম লীগ’ নামের ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন। লক্ষ‍্য করলে দেখা যায় যে, এই দলের নেতৃত্বের উচ্চকোটিতে একমাত্র আশরাফি ইসলামীরাই ছিলেন!
মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব শুরুতে সারা ভারতে গ্রহণযোগ‍্যতা আদায়ের জন‍্য কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন ও যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গান্ধীজী আন্দোলন পরিচালনায় তাঁর বশংবদ নেতা ছাড়া আর কাউকে নেতৃত্বের ছিঁটেফোঁটা ভাগ দুরের কথা, স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতেন না! তাঁর দেখানো পথ ও মত, তা যতই অবাস্তব হোক, যিনি অনুসরণ করবেন, তাঁকেই শুধু গান্ধীজী কংগ্রেসে শামিল হওয়ার যোগ‍্য মনে করতেন। এমনকি তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধসহ সহিংস আন্দোলনের বিরোধীতা করে বৃটিশ সরকারের হাতকেই শক্ত করেছেন। ত্রিপুরী কংগ্রেসের পর গণতান্ত্রিক উপায়ে কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধী-জওহর জুটির আচরণ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ‍্যায়! ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির যৌক্তিকতা আবিষ্কার করেছিলেন গান্ধীজী! এমনকি তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’ ও ‘যুগান্তর’ এর বিপ্লবীদের কার্যকলাপের যে ভাবে নিন্দা করেছেন তা একজন বৃটিশ ভক্তর মুখে মানালেও, দেশভক্তর মুখে মানায় না। যেজন‍্য একাধিক বিদেশী ইতিহাসবিদ গান্ধীজীর অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা over-hyped আন্দোলন বলেছেন। এর ফলে, কংগ্রেস দলে যেমন সুযোগ‍্য নেতা ও দেশনায়কের অভাব ছিল, তেমনি গান্ধীজীর অদূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপ বারবার জিন্না ও তাঁর মুসলিম লীগকে জিহাদী মতবাদের দিকে ঠেলে দিতে সাহায‍্য করেছে। গান্ধীজী যত বেশী বেশী লীগ নেতাদের দাবী মেনে নিয়েছেন, লীগ তাদের দাবী আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে! এই পর্বে গান্ধীজী ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব‍্যার্থতা মুসলিম লীগের মূল শক্তি। অনেক ক্ষেত্রেই গান্ধীজী লীগ নেতাদের কংগ্রেসের নেতা, যেমন বিঠলভাই প‍্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুর চেয়ে বেশী বিশ্বাস করেছেন। গান্ধীজী শিক্ষিত হিন্দু নেতাদের মধ‍্যে জওহরলাল ও বল্লবভাই প‍্যাটেলকেই পছন্দ করতেন। তিনি সুভাষচন্দ্র, বাবাসাহেব আম্বেদকর ও শ‍্যামাপ্রসাদকে খুবই অপছন্দ করতেন। তাঁর ব‍্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করত। একই ভাবে তিনি জিন্না, লিয়াকত আলী, ইস্কান্দার মির্জা ও সুরাবর্দীকেও অপছন্দ করতেন। আবার এই নেতাদের সঠিক রাজনৈতিক উপায়ে মোকাবিলা করার ক্ষমতা জওহরলালদের ছিল না। ফলে, প্রতিপদে তাঁদের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দেশবাসীকে দিতে হয়েছে।
বারবার কংগ্রেসের থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে মুসলিম লীগ নেতাদের কংগ্রেস, বিশেষতঃ গান্ধীজী সম্পর্কে ধারনা হল, তারা যত চাপের রাজনীতি করবে, ততই কংগ্রেস দল মুসলিম লীগকে জমি ছাড়বে! এই ধারনার বশবর্তী হয়ে জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র ইসলামীদের জন‍্য ভারত ভেঙ্গে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পুরো পঞ্জাব এবং পুরো বাংলার সঙ্গে অসম ও বিহারের একাংশ দাবী করল। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। এই সময়ে সমাজে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসার প্রকোপ ছিল না। তবু মুসলিম লীগ দাবী করল, হিন্দু ও মুসলিম দুই আলাদা জাতি এবং মুসলিমরা হিন্দুদের সাথে সহাবস্থান করতে পারবে না! শুধুমাত্র মুসলিম লীগ নেতারা ধর্মীয় জিগির তুলে হিন্দুদের সাথে সহাবস্থানে তাঁদের অসহিষ্ণুতার কারনে ভারতভাগ দাবী করে। একাজে তারা দেশের মৌলানা, ইমাম ও মৌলভীদের দেশের সাধারন ইসলামীদের মগজ ধোলাইয়ের কাজে নামিয়ে দেয়।
যথারীতি গান্ধীজী ও কংগ্রেস এর মৌখিক বিরোধীতা করলেও একে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেনি। ফলে, কংগ্রেসের অযোগ‍্যতা এবং অকর্মণ‍্যতার কারনে মুসলিম লীগ স্বাধীনতার পূর্বে ধর্মীয় উন্মাদনা ও ইসলামী ঐক‍্যের মেকী বাতাবরন তৈরীতে সমর্থ হয়। অবশ‍্য এ কাজে ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তারা গোড়া থেকেই ইসলামী ও হিন্দু-বিরোধী জিহাদী শক্তিকে সমর্থন করে এসেছে – অবশ‍্যই হাস‍্যকর অজুহাত তৈরী করে। তাদের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক নেতা ও প্রাক্তণ জেনারেল সেক্রেটারী ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী বারবার তাঁর লেখনীতে ভারতের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করেছেন; ভারতকে বিভিন্ন স্বশাসিত প্রদেশের সমষ্টি বলেছেন! শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামী সমাজকে শোষিত, নিপীড়িত সমাজ বলে পাক-ই-স্তান গঠনকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন! এই কারনে (!) পুরো বাংলা সহ অসম, বিহারের কিয়দংশ নিয়ে পূর্ব পাক-ই-স্তান গঠনের প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছিলেন! ‘peoples war’ এবং ‘peoples age’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর তত্ত্ব ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে। সম্পূর্ণ বাংলাকে পাকিস্তানে দেওয়ার পক্ষে বঙ্গীয় কম‍্যুনিস্টদের মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন মুজফফর আহমেদ ও জ‍্যোতি বসু। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এ‍্যাটলী ১৯৪৬ সালে ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন‍্য যে ক‍্যাবিনেট মিশন পাঠালেন তারা ত্রিস্তরীয় শাসন ব‍্যবস্থা কায়েম করার কথা জানিয়েছিলেন। সে সময় সেই ব‍্যবস্থা মেনে নিলে ভারতভাগ আটকানো যেত। কিন্তু জওহরলাল তাঁর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে লর্ড ওয়াভেলকে জানালেন যে এই ব‍্যবস্থা অমোঘ নয় এবং ভবিষ‍্যতে কংগ্রেস এর পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারবে! আর এতেই হিন্দু সংখ‍্যাধিক‍্যের জোরে মুসলিম লীগের ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব প্রত‍্যাখ‍্যান করে। তারা সরাসরি “লড়কে লেঙ্গে পাক-ই-স্তান” এর ডাক দেয় এবং জিন্না জঙ্গী আন্দোলনের স্তরে পাক-ই-স্তান প্রাপ্তির জন‍্য “devide India else destroy India” শ্লোগান তুললেন!
এদিকে বাংলার শতকরা ৫৫ ভাগ মানুষ ইসলামী হলেও এই প্রদেশের পশ্চিমদিকের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের প্রাধান‍্য থাকায় বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ভারতের সম্মিলিত বিরোধীদের নেতা ডঃ শ‍্যামাপ্রসাদ মূখার্জী। রমেশ মজুমদার সহ বাংলার বহু বিদ্বজ্জন এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেন। আবার কৃষকপ্রজা পার্টির সৈয়দ হাবিবউল রহমান হিন্দু-মুসলমানের ঐক‍্যবদ্ধ ভারতের জন‍্য আওয়াজ তুললেও দুই যুযুধান দল – কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতভাগের প্রস্তাব মেনে নিতেই জিন্না মুসলিম লীগের পতাকায় তাঁর পাক-ই-স্তান (আল্লার পবিত্র ভূমি) এর জন‍্য যত বেশী সম্ভব জায়গার দাবী তুললেন। এদিকে তখন মুসলিম লীগ সমগ্র বাংলাকে পূর্ব পাক-ই-স্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবীতে অনড়। তখন কলকাতাকে পাক-ই-স্তানে অন্তর্ভূক্তির জন‍্য বাংলার তৎকালীন মূখ‍্যমন্ত্রী সুরাবর্দী যে ঘৃণ‍্য নীল নক্সা তৈরী করেছিলেন তা তার বিগত মাসগুলির কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যেত! মূখ‍্যমন্ত্রী হয়ে সুরাবর্দী বাংলার পুলিশ বাহিনীতে ব‍্যাপকহারে বিহার ও ইউনাইটেড প্রদেশ থেকে উর্দুভাষী ইসলামীদের নিয়োগ করতে লাগলেন। ফলে, তাঁর পক্ষে ডাইরেক্ট অ‍্যাকশানের সময় পুলিশের সহায়তা লাভ সম্ভব হয়।
বাংলাভাগ বন্ধ করার জন‍্য হিন্দু হত‍্যালীলার মাধ‍্যমে বাংলায় হিন্দু নিধনের প্ল‍্যান কার্যকরী করার প্রশ্নে হুসেইন সাহিদ সুরাবর্দী জিন্নাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। তাঁর গোপন উদ্দেশ‍্য ছিল ইসলামীদের কাছে জিন্নার চেয়ে নিজেকে বড় নেতা হিসেবে মেলে ধরা! সফল হলে তিনি পাক-ই-স্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকতেন!
এ উদ্দেশ‍্যেই তিনি জিন্নাকে ইসলামের পবিত্র দিনে (হজরত মহম্মদ এই দিনে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ‍্যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন, তার সমাপ্তিতে জয়ের মধ‍্যে দিয়ে তিনি মক্কার উপর অধিকার কায়েম করেন) অর্থাৎ ১৬ই আগষ্ট, ১৯৪৬এ ডাইরেক্ট অ‍্যাকশান ডে পালনে প্ররোচিত করেন। ঐ দিন জুম্মার নামাজের পর দুপুর থেকে যে হিন্দু-হত‍্যালীলা শুরু হয়, তা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণিততম ধর্মীয় হত‍্যার ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।