অনুব্রত কান্ড পরবর্তী খেলা হবে আতঙ্ক

ভুতের মতন চেহারা যেমন
নির্বোধ অতি ঘোর –
যা কিছু হারায়,CBI বলে
কেষ্টা ব‍্যাটাই চোর।
‘দিদি’র সবচেয়ে অনুপ্রাণিত ‘ভাই’, মাথায় অক্সিজেন (পরুন বুদ্ধি) কম যাওয়া, শ্রীমান কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মন্ডল যখন গ্রেপ্তার হন, তখন আমি ব‍্যস্ত ছিলাম বনগাঁ সীমান্তে ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের দেশের অতন্দ্র প্রহরী বিএসএফের জওয়ানদের রাখি পরানোর অনুষ্ঠানে। সেখানে বহু সাধারন মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন এই অনুষ্ঠান দেখতে। অনুব্রতর গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে মানুষের মধ‍্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ দেখা গেল তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পনের খবরে আনন্দ প্রকাশের সঙ্গে। মানুষের মুড দেখে মনে হচ্ছিল, রাম-রাবনের যুদ্ধে যেন কুম্ভকর্ণের পতন হল। শুধু বীরভূম নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গ যেন এক দুঃশাসনের থেকে মুক্ত হল! ‘দিদি’র অনুগৃহীত সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি পর্যন্ত টিআরপি নষ্ট হওয়ার ভয়ে এই গ্রেপ্তারীর সংবাদ যথেষ্ট উল্লাস, উৎসাহের সঙ্গে পরিবেশন করতে বাধ‍্য হল।
অনুব্রত মন্ডল বীরভূমের অলিখিত মনসবদার ছিলেন বললেও ভুল হবে – তিনি এই জেলার সরকারি প্রশাসন, পুলিশ ও তাঁর দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ ছিলেন! সেখানে দেশের আইনের শাসনের জায়গায় অনুব্রতীয় আইনশাস্ত্র অনুযায়ী শাসন ব‍্যবস্থা মানতে জেলার মানুষকে বাধ‍্য করা হয়েছিল। আইন না মেনে হুঙ্কার, প্রশাসনকে বোম মারা ও মিথ‍্যা মামলা সাজানোর প্রকাশ‍্য হুকুম দেওয়া তাঁর কাজের অঙ্গ হিসেবে পরিচিত। প্রশাসন ও দলীয় কর্মীদের দ্বারা তাঁর আজ্ঞা পালনে বীরভূমে রাষ্ট্রের শাসন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর যিনি বলেন যে এই শিশুসূলভ সরল মানুষটির কি অপরাধ ছিল তা তিনি জানেন না – তখন সেই ব‍্যক্তির অভিনয় দক্ষতার প্রশংসা করেও তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। আমি মনে করি, এই স্থূল বুদ্ধির মানুষটির উচ্চাশা ও লোভের সুযোগ নিয়ে তাকে ব‍্যবহার করা হয়েছে। যে বা যারা তাকে ব‍্যবহার করেছে তারা সকলেই কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থার র‍্যাডারে ধরা পড়বে। এ সবই অভিযোগ – প্রমাণের দায়িত্ব অনুসন্ধানকারীদের। যদিও অদম‍্য “অনুপ্রেরনা” বলতে পারেন যে তিনি অনুব্রতকে আগেই চিনতে পেরেছিলেন – কারন তিনিই প্রথম বি-জ্ঞান ভিত্তিক তত্ত্ব “ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়; কথাটা বুঝতে হবে” – বলেছিলেন। আসলে অক্সিজেন বলতে মহান মানুষজন বুদ্ধি বোঝেন! এই বুদ্ধি নিয়েই তিনি জেলার সব অবৈধ কাজকর্মে মদত দিয়েছেন এবং তোলা তুলেছেন – গরু পাচার, বৈধ-অবৈধ বালি খাদানের তোলা, পাথর খাদানের তোলা, গেস্ট-হাউস ও মেলা-হাটের থেকে তোলা, সবেরই বন্দোবস্ত করেছেন। মাননীয়ার কাছে অনুরোধ, তিনি যেন বিদায় বেলায় তাঁর এই আদরের ভাইটিকে তোলাশ্রী বা তোলাভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন!
এবার আসি এই কান্ডের অন্দরে সত‍্যের সন্ধানে। একটু লক্ষ‍্য করলে এখানে পার্থ-কান্ডের সঙ্গে যে তফাৎ দেখা যায় তা হল, পার্থ অনেকটা ছুপা-রুস্তম কায়দায় অপারেশন চালালেও কোন এক অদৃশ‍্য শক্তির অমোঘ অঙ্গুলিহেলনে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা পার্থর ব‍্যাপারে সমস্ত সূত্র মারফৎ সঠিক খবর পেয়ে অপারেশন-পার্থ সাফল‍্যমন্ডিত করেছে। কিন্তু অনুব্রত-কান্ডে সেই অদৃশ‍্য শক্তি অন‍্যভাবে অপারেশান চালিয়েছে। কারন,অনুব্রতর বুদ্ধির গোড়ায় “অক্সিজেন” কম থাকায় সে নিজেই অফুরন্ত সূত্র রেখে দিয়েছে যা কেন্দ্রীয় সংস্থাকে বিশেষ তদন্তসাপেক্ষে জানতে হয়নি! এখানে দাবার সবচেয়ে বড় বোরে অনুব্রতর দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের গ্রেপ্তারী। অনুব্রতর লম্ফঝম্প, বীরভূমের প্রশাসন ও পুলিশের আচরণ যা জমিদারদের খাস চাকরের মোসাহেবীকেও হার মানায়; ‘দিদি’র আশীবাদের হাত মাথায় থাকা – এসব থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেভাবে কাজ করেছে,তা প্রশাসনের আইএএস ও আইপিএস মহল পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, এই অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয় কেন্দ্রীয় সংস্থা হলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা এই তদন্তে নিয়োজিত হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের রিপোর্টিং অথরিটি হল উচ্চ আদালত। তাই কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির এই অনুসন্ধানে কোন হস্তক্ষেপ করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ‍্যজনক হলেও যেটা সত‍্যি তা হল, দীর্ঘ সময় রাজ‍্যের শাসন ক্ষমতায় থাকা “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” নীতির সফল রূপকার সিপিএম সেটিং তত্ত্ব অবতারণা করে ভবিষ‍্যতে “টালির চালা” বা “শান্তিনিকেতন”কে সমর্থনের সুযোগ বজায় রাখছে। এ রাজ‍্যের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকরা তাদের ঔদ্ধত‍্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রাজ‍্যের জনগণকে গরু-ছাগলের পাল মনে করেন! তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, তারা মিছিল করে ‘অনুসন্ধানে’ কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করছে; একই সঙ্গে তাদের তিন মন্ত্রী উচ্চতর আদালতে আবেদন করেছে – তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীণ সম্পত্তির ব‍্যাপারে যেন ইডি অনুসন্ধান না করতে পারে! ভারি অদ্ভুত আব্দার – চুরি করলে দোষ নেই, কিন্তু দেশের সংবিধান অনুযায়ী তার তদন্ত যে সংস্থার করার কথা, তাকে তদন্ত করতে দেব না! বোধহয়, এমন পরষ্পর বিরোধী কার্যকলাপ এরাই করতে পারে এবং এরা জনগণকে কতটা মূর্খ ভাবে তা এদের হাস‍্যকর আন্দোলনের মধ‍্যেই বোঝা যায়।
যাক এসব কথা। আমার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রতর যে এমন অবস্থা হতে যাচ্ছে তা তার বশংবদ এবং ‘দিদি’র খাস ভৃত‍্য প্রশাসনিক কর্তারা জানতেন না – তা অসম্ভব। তবে, মোদ্দা কথা হল, প্রমাণ সব আগেই ছিল। কিন্তু বারুদের স্তুপে আগুন কে লাগালো? লক্ষ‍্য করলে বোঝা যাবে, CBI এর modus operandiতে কোন নতুনত্ব নেই। শুধু পুরাতনভৃত‍্যর মস্তিষ্কের নিরেট অংশের সুযোগ নিয়ে তার পরামর্শদাতারাই তাকে ডুবিয়েছে। পার্থ-কান্ডের পর SSKMএর ডাক্তাররা আর শাসকদলের অভিযুক্ত VVIP চোর বদমাইশদের বিনোদন এবং বিশ্রামস্থল হতে দিতে পারবেন না – উচ্চ আদালতের তীক্ষ্ণ নজর আছে। কাজেই অনুব্রতর ‘অসুস্থ নাটক’ এর চিত্রনাট‍্য বদলের প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া অনুব্রতকে দশবার সাক্ষ‍্য দিতে ডাকলেও একবারের তরে সে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়নি। একবার হাজিরা দিয়েই অসুস্থতার অজুহাতে বেরিয়ে গিয়েছিল! তারপর শেষবার বোলপুরের সরকারি হাসপাতালের সুপার ও ডাক্তারকে অনুব্রতর বাড়ি গিয়ে মিথ‍্যা অসুস্থতার শংসাপত্র দিতে ‘বাধ‍্য’ করা হল! এমনভাবে কেস সামনে এল যে, CBIকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করার ক্ষমতা যেন অনুব্রতর আছে! এটা পরিষ্কার, অনুব্রত এই নাটকে এক নিরেট বুদ্ধির আকাট চরিত্র। কিন্তু তার পরামর্শদাতারা কারা? সেই প্রশ্নের উত্তর পেলেই অনুব্রতর উইকেটের চিরতরে পতন নিশ্চিত হবে। সারদা-কান্ডে গ্রেপ্তারী, এমনকি উচ্চপদস্থ IPSকে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টার বিরুদ্ধে রাজ‍্যের “অনুপ্ররনা” যেভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, তার ছিঁটেফোটাও এবার দেখা গেল না। তার কারন একটাই – দলের এবং প্রশাসনের রাশ পুরোপুরি “অনুপ্রেরনা”র হাতে নেই, অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি নিজের বিরুদ্ধে ত আর আন্দোলন করতে পারেন না – স্নেহ অতি বিষম বস্তু; বিশেষতঃ রক্তের সম্পর্কের মধ‍্যে। সুতরাং কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে ‘দিদি’র বড় ভরসা কেষ্টর উইকেট পড়ার পেছনে আরেক “শান্তিনিকেতন”এর থেকেই বারুদের স্তুপে দিয়াশলাই কাঠি জ্জ্বালানো হয়েছে বলে অনুমানের যথেষ্ট কারন আছে। মুসল পর্বে এখন “টালির চালা”র সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী হল একই অঞ্চলের “শান্তিনিকেতন”। আমি এইসব ঘটনার শুরু থেকেই বলে আসছি, রাজ‍্যে দল ও প্রশাসনের রাশ কার হাতে থাকবে বা যাবে তার লড়াই চলছে। তবে, দুই গোষ্ঠীর কুশীলবরা তাদের নির্বুদ্ধিতায় “খেলা হবে”র নেপথ‍্য খেলা জনসাধারনের কাছে প্রকাশ করে দিচ্ছে। আস্তাকুঁড়ের পাশে পড়ে থাকা দলের এক ছাঁটমালকে বাজারী মাধ‍্যম “বুদ্ধিজীবী” তকমা দিয়ে দম দেওয়া টাট্টুঘোড়ার মত রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে! তার বুদ্ধির একটি উদাহরণ – দলের এক পথসভায় তিনি সরবে তাঁর নবতম আবিষ্কার ঘোষণা করেছেন! পার্থর “বান্ধবী”র বাড়ি থেকে নাকি ৪০ কোটি নয়, ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে! এবং বাকী ৬০ কোটি টাকা নাকি ইডির অফিসাররা পকেটে পুরেছেন! অঙ্গভঙ্গী সহকারে তিনি উপস্থিত গুটি কয়েক শ্রোতাকে বলছেন! এমন আজগুবি স্ক্রিপ্টে অভিনয় বোধহয় সিনেমার সেরা কমেডিয়ানরাও করতে পারবেন না! এই রকম অজ্ঞ, চতুষ্পদীয় সমতুল বুদ্ধির সেনাপতি থাকলে হাগিস পরিহিত রাজনীতিবিদ যুবরাজের পর্যন্ত যুদ্ধজয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে কি! এই “বুদ্ধিজীবী” নেতার সিজার লিষ্ট তৈরীর পদ্ধতি সম্বন্ধে বিন্দুমাত্রও ধারনা নেই। উনি বোধহয় ওনাদের লুঠের বখরা কাড়াকাড়ির পদ্ধতির অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিষয়টা গুলিয়ে ফেলেছেন! আবার তিনি পার্থর হয়ে সাফাই দেওয়ার বদলে তাকে আরো গাড্ডায় ফেললেন! এদিকে বীরভূমের বেতাজ বাদশার গ্রেপ্তারের পর কিছু সাধারণ নাগরিক তার গাড়ি লক্ষ‍্য করে জুতো দেখাচ্ছিলেন, যা বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদের একটি ভাষা। তার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তৃণমূলের প্রবীন সাংসদ যিনি নাকি তথাকথিত “অধ‍্যাপক”, বললেন, এ লোকগুলোর গায়ের চামড়া দিয়ে নাকি ওনার পায়ের জুতো তৈরী করাবেন! আবার “অনুপ্রেরনা” যেমন ডিজিটাল মাধ‍্যমকে কুকুর বলছেন, তেমনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তুই-তোকারি করছেন! এই দলটির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি দেখে বাঙ্গালী হিসেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। পুলিশ, প্রশাসনের নিস্তব্ধতায় মনে হয় তারাও দিশাহারা!
এভাবে তৃণমূল দলের মূষল যুদ্ধে যে ভাবে “টালির চালা”র নেতৃত্ব এবং তাঁর দলবল প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তাতে মনে হয় যেন – চোরের মায়ের বড় গলা! চুরির অভিযোগ করা যাবে না, তার অনুসন্ধান করা যাবে না, সরকারি টাকা খরচের কোন হিসাব দেবে না – এরা কি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক? অবশ‍্য এসব প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া হতেও পারে! কারন, আমরা জানি, শ্রমিক মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে তা রাণী মৌমাছির কাছে জমা রাখে। রাণী নিজে কোন মধু সংগ্রহ করে না। এভাবে যদি অনুচর নেতৃত্ব বার্তা দিতে থাকে, তাহলে বলতে হবে, “টালির চালা” অপেক্ষা প্রথম দু রাউন্ডে “শান্তিনিকেতন” এগিয়ে গেছে।
সুতরাং, আরো উইকেট পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখানে বলা দরকার, “টালির চালা”র কাছের নেতা-নেত্রীরাও কিন্তু তেমনভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ঝড় তোলেননি। দলের কিছু তৃতীয় সারির খুচরো নেতা-নেত্রী ছাড়া নিয়ম রক্ষার মিছিলে কোন হেবি ওয়েট নেতার দেখা মেলেনি! শুধু “অনুপ্রেরনা” নিজে এবং কিছু লাইট ওয়েট নেতা, নেত্রী, যাদের উইকেট অদূর ভবিষ‍্যতে পরার সম্ভাবনা নেই, সংবাদ-মাধ‍্যমে বিবৃতি দিয়ে হাস‍্যকর রকমে পার্থ ও অনুব্রতকে সমর্থন করছেন। “অনুপ্রেরনা” বলছেন – কেষ্টকে কেন গ্রেপ্তার করা হল – কি তার অপরাধ! এ বিষয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলে তিনি শিশুসুলভ অজ্ঞতার অভিনয় করছেন – পশ্চিমবঙ্গবাসীর দুর্ভাগ‍্য। কিন্তু “শান্তিনিকেতন” গ্রুপের কেউ এখনো পর্যন্ত এই দুই অভিযুক্ত অপরাধীর পক্ষে কিছু বলেননি। তৃণমূল যখন দল হিসেবে “জিরো টলারেন্স”এর কথা বলে; আবার একই সঙ্গে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কেষ্টর গ্রেপ্তারের কারন না জানার ভান করেন, তখন এই ধরনের দ্বিচারিতা দলের চরম অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
জানিনা, এই লেখা ছাপার আগে আরো উইকেটের পতন হবে কিনা। তবে, একটা কথা নির্দিধায় বলা যায়, “টালির চালা” বনাম “শান্তিনিকেতনের এই লড়াইয়ের প্রথম পর্যায়ে “শান্তিনিকেতন” শুধু যে এগিয়ে আছে তাই নয়, দলের প্রায় পূর্ণ কর্তৃত্ব তার নিয়ন্ত্রণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলে এবং প্রশাসনে “টালির চালা”র ক্ষমতা খর্ব হতে বাধ‍্য। এই তৃণমূল দলটি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দল ও সরকারি প্রশাসনের মধ‍্যে বিভেদ রেখা তুলে দিয়ে প্রশাসনকে দলের অধীনে এনে দলকে সরকারি প্রশাসনের উপরে প্রতিষ্ঠা করে! তাই, মুষল যুদ্ধের পর্বে দলের আভ‍্যন্তরীন সংঘর্ষের সঙ্গে প্রশাসনিক অরাজকতাও বাড়বে।

তৃণমূলের অস্তিত্ব সংকট কোন পথে

পার্থ ও অনুব্রত কান্ড বর্তমান রাজ‍্য সরকারের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করেছে তার থেকে মুক্তির চেষ্টা করতে গিয়ে তৃণমূলের আভ‍্যন্তরীন অনৈক‍্যের যে খবর সংবাদ-মাধ‍্যমে বেরিয়ে আসছে তা এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের শিরঃপীড়ার কারন হচ্ছে। রাজ‍্যের বিভিন্ন জায়গায় যে গোষ্ঠীকোন্দলের খবর দলের অস্বস্তির কারন, তার প্রায় সবগুলির মূলে আছে বখরার ঝগড়া ও কাটমানির দখল নিয়ে দলের আভ‍্যন্তরীন লড়াই। দলের সমর্থক ও সাধারন মানুষদের থেকে ‘ঘুষ’ বাবদ টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগ। সঙ্গে জুড়েছে টাকা দিয়েও চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে পুরোনো কথা মনে পড়ে খেল – তখন ঘোর সিপিএম আমল – আলিমুদ্দিনের অনুমোদন ছাড়া রাজ‍্যে একটি গাছের পাতা অব্দি নড়ে না! সে সময় রাজ‍্যে প্রোমোটারী ব‍্যবসার রমরমা। সব প্রোমোটাররা নিজেরাই ‘লোকাল কমিটি’র নেতা বা আলিমুদ্দিনের নির্দিষ্ট স্থানে ভেট চড়িয়ে ‘বড় ব‍্যবসায়ী’। এক সময় পার্টির ‘চাহিদা’ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রোমোটার একই ফ্ল‍্যাট তিন-চারজনকে বেচে দিত! এমন অনেক কেস ধরা পড়ার পর সরকার নড়েচড়ে বসে এই অস্বাভাবিক তোলাবাজিতে রাশ টানতে বাধ‍্য হয়।
বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে দু রকম পদ্ধতিতে অবৈধ অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ পাওয়া যায় – অবশ‍্য এসব অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব প্রশাসনের। যেভাবে সংবাদ-মাধ‍্যমে নিত‍্য নতুন অবৈধভাবে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে – যার প্রতি ক্ষেত্রেই শাসকদলের যোগসূত্র দেখা যাচ্ছে – তার মূলে আছে বিভিন্ন অযোগ‍্য প্রার্থীদের সরকারি ও সরকারপোষিত সংস্থায় চাকরির বিনিময়ে মোটা টাকা সংগ্রহ! যে কেসগুলি যোগ‍্য প্রার্থীদের উচ্চ আদালতে মামলার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করছে তার সংখ‍্যা নগণ‍্য। পরবর্তীকালে যেখানেই সরকারি চাকরির কথা জানা যাচ্ছে, সবেতেই দূর্ণীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমার এক ভূতপূর্ব সহকর্মী, যিনি রাজ‍্য সরকারের অতি উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন, আমাকে কয়েকদিন আগে ফোন করে বললেন, “মনে হচ্ছে এরা গত এগারো বছরে সব সরকারি চাকরিই বিক্রি করেছে!” এই উক্তিতে সত‍্যতা হয়ত নেই, কিন্তু সারবত্তা আছে। অর্থাৎ, সরকারি চাকরি, তা শিক্ষক নিয়োগ হোক বা অন‍্য জায়গায়, সবেতেই অনিয়ম করে যোগ‍্য প্রার্থীদের বঞ্চনা করে অযোগ‍্যদের ঢোকানো হয়েছে! শুধু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই দূর্ণীতির আর্থিক পরিমাণ আনুমানিক তিন হাজার কোটি হবে বলে তথ‍্যাভিজ্ঞ মহলের অনুমান। এছাড়া, জনশ্রুতি আছে যে, কোন নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে গেলে যথাস্থানে লক্ষ লক্ষ টাকার ভেট চড়াতে হয়! যদি কেউ দেশ সেবার সংকল্প নিয়ে নির্বাচনে লড়তে চান, তবে তিনি নিশ্চয়ই চড়া মূল‍্যে নির্বাচনের ‘সিট’ কিনবেন না! তারাই অর্থ ব‍্যয় করে নির্বাচনে লড়বেন, যাঁরা নির্বাচনে জিতে বিনিয়োগের বহুগুণ অর্থ, অবশ‍্যই অবৈধ উপায়ে, অর্জন করবেন! এ অসৎ ব‍্যবসার র‍্যাকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে – গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশসেবার রাজনীতির চরম অবক্ষয় হিসেবেই একে দেখা হবে।
এরপর আসি অবৈধ উপায়ে উপার্জনের দ্বিতীয় গণ-অভিযোগে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অভিনব পরিকল্পনা – যা রূপায়নের জন‍্য সরকারি প্রশাসনের সহযোগীতা আবশ‍্যক। তার জন‍্য ধীরে ধীরে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে দলদাসে পরিণত করা হল। তারপর এই পদ্ধতিতে যে কাজটির সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, তা হল, সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অনুদান দেওয়া। এর জন‍্য বিভিন্ন অকারন, অযৌক্তিক প্রকল্প ঘোষণা করে তাকে রাজ‍্যের ‘উন্নয়ণ’ বলে চালানো! এটি দু রকমভাবে করা হয় – প্রথমটি সরাসরি জনসাধারণের নির্দিষ্ট অংশকে বিভিন্ন নামের প্রকল্পের মাধ‍্যমে অনুদান হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের ব‍্যবধানে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ প্রদান। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ভুয়ো একাউন্টে টাকা যাওয়ার সুযোগ আছে যা ইউসির অডিট হলে ধরা পড়া উচিৎ। আবার প্রাপকদের থেকে কাটমাণি নেওয়ার অভিযোগও আসছে! দ্বিতীয়টি হল, বিভিন্ন NGO এবং অন‍্যান‍্য সংস্থাকে ‘উন্নয়ণ’ ও ‘গবেষণা’র স্বার্থে প্রকল্পভিত্তিক অনুদান প্রদান! এই দুটি ক্ষেত্রেই টাকা নয়ছয়ের বিরাট সুযোগ রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে যে মানুষদের অনুদান দেওয়া হচ্ছে তা প্রকল্প বিশেষে সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে প্রশাসনিক গাফিলতি আছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত তা একমাত্র সঠিক অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে। এমন মানুষের খোঁজ জানা আছে, যার বাড়ি, গাড়ি থাকা সত্বেও তার স্ত্রী ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রাপক! আবার এমন সংবাদ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে যে, স্বামী বর্তমানে স্ত্রী ‘বিধবা ভাতা’ পাচ্ছে! ১০০ দিনের কাজে MGNREGA প্রকল্পে প্রকৃত প্রাপক ও টাকার খরচের মধ‍্যে কারচুপি না থাকলে রাজ‍্য সরকার কেন বারবার UC দিতে ব‍্যর্থ হচ্ছে! যে কোন সরকারি প্রকল্পের কাজে বরাদ্দ অর্থ খরচের utilization certificate দেওয়া আইন অনুসারে বাধ‍্যতামূলক। না হলে পরবর্তী পর্যায়ে টাকা দেওয়া যায় না। রাজ‍্য সরকার এই UC না দিয়ে অযথা কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপের নাটক করছেন। তাদের এমন ভাব যেন মনে হচ্ছে, ভোটে জিতলে নির্বাচিত সরকারের দেশের আইন না মানার অধিকার জন্মায়! ভোটে জেতার অর্থ কিন্তু আর্থিক নয়ছয় করার অধিকার নয়। এছাড়া, ‘উন্নয়ণ’ করার তাগিধে যে কাজ করা হচ্ছে, সেখানেও রাজ‍্য সরকারের থেকে যথাযথ প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান না থাকার কারনে (দুর্জনে বলে, রাজ‍্যের শাসকদলের চাপে) এসব প্রকল্পের accountability থাকে না। এমন ব‍্যাপারও জানি, যেখানে গবেষণা প্রকল্পে গবেষক তার পাওয়া টাকার UC না দিলেও রাজ‍্য সরকারের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট পরবর্তী বছরের টাকার গ্রান্ট ‘রিলিজ’ করে দিয়েছেন! এইভাবে “এলোমেলো করে দে মা লুঠেপুটে খাই” নীতির ফলেই আদালতের রায়ের কারনে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারি অডিটের প্রেক্ষিতে ভিজিলান্সের সক্রিয়তাও শুরু হয়েছে বলে খবর।
এরপর আসছে রাজ‍্যের সম্পদ – কয়লা, বালি খাদান, পাথর খাদান ইত‍্যাদির অবৈধ উত্তোলন ও পাচার! সঙ্গে বাংলাদেশে অবৈধ উপায়ে গরু পাচার! রাজ‍্য প্রশাসন ও রাজ‍্য পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এসব পাচার কখনোই সম্ভব নয়।
এতদিন অনুগৃহীত সংবাদ-মাধ‍্যমের কর্মদক্ষতায় এবং প্রশাসন-পুলিশ ও দলের “দুষ্টু ছেলে”দের দৌরাত্মে রাজ‍্যের মানুষ বাধ‍্য হয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন দলের মধ‍্যে দুই প্রাসাদের লড়াই ও তার প্রভাবে এই দলের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। আগেও বলেছি, এখনও বলছি, দলের নেতারা যতই আভ‍্যন্তরীন কোন্দল বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেষ্টা করুন না কেন, আসলে এই লড়াই “টালির চালা”র সঙ্গে একই অঞ্চলের “শান্তিনিকেতন”এর লড়াই। রাজ‍্যের যুবরাজ ধীরে ধীরে দলীয় প্রশাসনকে নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছেন! যে সব নেতারা শুধু “টালির চালা”য় ‘অনুপ্রানিত’ থাকবেন তাদের উইকেট পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা! একটি কথা মনে রাখা দরকার – যেটা বারবার স্বার্থান্বেষী মহল থেকে ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে – কেন্দ্রীয় সংস্থারা যে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি দলের কোন সম্পর্ক নেই। কারন এই সংস্থাগুলি উচ্চ আদালতের নির্দেশে ও তাদের তত্ত্বাবধানে এই অনুসন্ধান চালাচ্ছে। একে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” বলা হতাশাজনিত বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা মাত্র।
ঠিক একই রকমভাবে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী থেকে তাদের রাজনৈতিক লাভের জন‍্য সেটিং তত্ত্ব আউরে জনগনের মনে অনুসন্ধানকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদের ও উচ্চ আদালতের সম্মানহানির অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায় যে, রাজ‍্যের যুবরাজের সরাসরি অনুগত ভৃত‍্যের পর্যায়ে না থাকতে চাওয়া হেবিওয়েট পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দলের জেলা সভাপতিদের মধ‍্যে নেত্রীর চরমতম প্রশ্রয়ে থাকা অনুব্রত মন্ডলের উইকেট কেন্দ্রীয় সংস্থাদের হাতে চলে গিয়েছে। এর অবিসম্বাদী ফল হল, দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বের কর্মপদ্ধতি বদল। শুধু ‘অনুপ্রানিত’রা নিশ্চুপ – যা কিছু আবোলতাবোল বকছেন “মাননীয়া” – আর “ব্রাহ্মণ যখন মুসলমান হয়, গোস্ত খাওয়ার যম হয়” প্রবাদকে মাণ‍্যতা দিয়ে যুবরাজ পদতলে “আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান” গোছের বক্তব‍্য রাখছেন – “আইন আইনের পথে চলবে” অথবা “মানুষকে ঠকিয়ে কেউ কিছু করলে দল তাকে সমর্থন করে না” এবং “আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি”! এসব বুলি এতদিন কোথায় ছিল? একজন পদস্থ পুলিশ কর্মচারিকে বাঁচাতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব‍্যক্তি যেদিন উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মচারিদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে বসেছিলেন, সেদিনই রাজ‍্যবাসীর কাছে সিগন‍্যাল গিয়েছিল যে দূর্ণীতি ও প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব‍্যবহার করার প্রশ্নে রাজ‍্যের সর্বোচ্চ ব‍্যক্তির অবস্থান কি! সেদিন থেকে জনমানসে দূর্ণীতির ঝর্ণার উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে প্রশাসনকে বার্তা দেওয়া হল, দূর্ণীতিতে সহযোগিতা করার। তারপর থেকে ঘোমটা খসে গিয়ে দলের মধ‍্যে দূর্ণীতির গণতন্ত্রীকরন খোলাখুলিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এভাবে অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর যুবরাজ আসরে নেমে তাঁর মত করে শুদ্ধিকরন প্রক্রিয়া শুরু করলেন! উদ্দেশ‍্য একটাই – গদির উত্তরাধিকার প্রাপ্তি – যা দ্রুততার সাথে কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হল। হাগিস পরিহিত রাজনীতিবিদের অধৈর্য‍্য ও অনভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক উত্তরণের প্রধান অন্তরায়। কারন, দুটি উইকেট পড়ার পর ‘অনুপ্রেরনা’র অনুচরদের আরো উইকেট পড়া যখন নিশ্চিত, তখনই এই অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা offence is the best defence নীতি সম্বল করে নেমে পড়বেই। অসমর্থিত খবর- একজন সুপার-হেবিওয়েট নেতার অন্ধকার কাজের প্রধান সহযোগী – তাঁর জামাই রাজ‍্য বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। এছাড়া, একজন মন্ত্রী এবং কোলকাতার কাছের একজন পৌরনিগমের মেয়রও নাকি একই পথের পথিক! সুতরাং, মুষল পর্ব শুরু হয়েছে – ধ্বংস শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এখানে সব বিরোধীদল, বিশেষতঃ বিজেপিকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন – যাতে ২০২১ এর পুনরাবৃত্তি না হয়। এটা পরিষ্কার, ছাটমাল ও বড় রকমের অসৎ না হলে কেউ তৃণমূল দল পরিবর্তন করবে না। অনেকে, এমনকি বড় মাপের রাজনীতিবিদ পর্যন্ত বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা একজন একনাথ শিন্ডের অপেক্ষায় আছেন! আমার মনে হয়, এই চিন্তা ভুল। কারন, আদর্শগত দিক দিয়ে বিজেপি ও শিবসেনার মধ‍্যে স্বাভাবিক মিত্রতা থাকার কথা। শুধু ঠাকরে পরিবারের ব‍্যক্তিগত উচ্চাশার জন‍্য মহাগোটবন্ধন তৈরী হয়েছিল – যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়াই স্বাভাবিক। শুধু একনাথ শিন্ডে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের কাজটুকু করেছেন।
পরিশেষে একটি উর্দু শায়ের দিয়ে শেষ করি – ” গুলিস্তাঁ বরবাদ করনে মে একই উল্লু কাফি হ‍্যায়, হর শাখ পর উল্লু বৈঠা হ‍্যায় ত গুলিস্তাঁ কা ক‍্যায়া হোগা”। এই এখনকার তৃণমূলের অবস্থা। এ সব ছাঁটমাল, দূর্ণীতিগ্রস্ত নেতারা (যারা মেনে নিয়েছিলেন, একটাই পোস্ট, বাদবাকী ল‍্যাম্পপোস্ট) বিজেপি বা সিপিএম – যে দলেই যাক না কেন, সেই দলের কর্মী, সমর্থকদের মনোবল নষ্ট করে দলের রাজনৈতিক সমাধি ঘটাবে। এই অনুপ্রানিত দলটির দূর্ণীতি ও বাগাড়ম্বরপ্রিয় অসৎ নেতৃত্বের ভারে চুর্ণ-বিচুর্ণ হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

বঙ্গ রাজনীতিতে সেটিং তত্ত্ব

পার্থ-কান্ড পরবর্তী সময়ে সংবাদ-মাধ‍্যমের – বিশেষতঃ বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে সবচেয়ে আলোচিত তথ‍্য হচ্ছে বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ‘সেটিং’! এটি বুঝতে গেলে সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞবৃন্দ ও রাজনৈতিক দলের থেকে পাঠানো বিশেষজ্ঞরা নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক প্রতিপন্ন করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই সব আলোচনা সভা প্রায় সব সময়ই মাছের বাজারকেও চিৎকার, চেঁচামেচিতে হার মানায়। এসব দেখে মানুষজন আরো বিভ্রান্ত, বীতশ্রদ্ধ হন।
‘সেটিং’ কথাটা রাজনীতিতে এসেছে বহুদলীয় জোটের শাসন এবং বিরোধী পক্ষের জোটবদ্ধ অবস্থান থেকে। বঙ্গ রাজনীতিতে বহুদলীয় জোটের শাসন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ‍্যমে। এই ফ্রন্টের চালিকাশক্তি ছিল সিপিএম। অবশ‍্য স্বাধীনতাপূর্ব প্রাদেশিক অ‍্যাসেম্বলীতে যে স্বল্প সময়ের পরিবর্তনশীল জোটের দেখা মিলেছিল, তা রাজনীতির নিয়মে বিশেষ পরিস্থিতি এবং পরিবর্তনশীল জাতীয় ও প্রাদেশিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে সময়ের দাবী হিসেবেই দেখা হয়। এখানে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ভারতীয় রাজনীতির কথা বলা হচ্ছে। এই ‘সেটিং’ তত্ত্ব বঙ্গ-রাজনীতির আঙ্গিনায় প্রথম আমদানি করে যুক্তফ্রন্টের বকলমে কম‍্যুনিষ্টরা – বিশেষভাবে সিপিএম। পরবর্তী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত রূপ দেখা এবং সমাজজীবনে রাজনৈতিক হিংসা রক্তক্ষয়ী দিকে মোড় নেয় বামপন্থী – নরম, চরম, অতিবাম ইত‍্যাদি বিভিন্ন কম‍্যুনিষ্ট দলের প্রত‍্যক্ষ‍ মদতে। এই সময় থেকেই পুলিশকে শাসকদলের অধীনে “সরকারি গুন্ডা”র মত ব‍্যবহার করা শুরু হয় কম‍্যুনিষ্ট মদতে – স্ট‍্যালিনিস্ট ডিক্টেটরশিপের প্রাদেশিক আদলে! সেই সময় থেকেই সাধারণভাবে সমগ্র দেশে, আর নির্দিষ্টভাবে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাধ‍্যম (social and cultural media) প্রভাবিত হতে লাগল বামপন্থী চিন্তাধারায়। এমনকি, সংবাদ-মাধ‍্যম ও পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমের নীতি ও সাংবাদিক নিয়োগে বামপন্থী চিন্তাধারা সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে লাগল। আশির দশকে উচ্চশিক্ষায় UGC বেতনক্রম চালু হওয়ার পর থেকে অত‍্যন্ত সুনিপুণভাবে বঙ্গীয় শিক্ষা-জগতকে বামমনস্ক শিক্ষকদের দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হল। এই শিক্ষকদের প্রধান কাজ ছিল তাদের দলের চিন্তাধারা এবং বক্তব‍্যকে বামপন্থীয় বৈজ্ঞানিক চিন্তা – বলে প্রচার করা এবং তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ দলের বামপন্থায় দীক্ষার সূতিকাগার হিসেবে ব‍্যবহার করতে লাগলেন। এভাবে বাঙ্গালী মননে তাদের বামপন্থী রাজনীতি যে বিশেষ বিষয়গুলি ঢুকিয়ে দিচ্ছিল তা হল, বিশ্বের বেশিরভাগ ধর্ম – বিশেষত খ্রীষ্ট ও ইসলাম – ধর্মনিরপেক্ষতাকে নীচু চোখে দেখলেও ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থীয় রূপকে আধুনিক জ্ঞানের স্তম্ভ হিসেবে বাঙ্গালীর মনের মধ‍্যে গেঁথে দেওয়া! ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টরা আদর্শগতভাবে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামের প্রতি নরম মনোভাবের কারনে বাঙ্গালীর মধ‍্যে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতা তৈরী হয়েছে। সে কারনে বাঙ্গালীর কম‍্যুনিষ্টসূলভ ধর্মনিরপেক্ষতা “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা”য় পর্যবসিত হয়েছে। কম‍্যুনিষ্টরা সর্বদা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব‍্যঙ্গ-বিদ্রুপ করায় বাঙ্গালী সমাজে জাতীয়তাবোধের অভিব‍্যক্তি অনেক কমে গেছে। সেইসঙ্গে কম‍্যুনিষ্টসূলভ গোয়েবেলসীয় প্রচার (যা পরবর্তী সময়ে স্ট‍্যালিনের বড় ইউএসপি হয়ে দাঁড়ায়) করার ফলে বাঙ্গালী ও বাংলার সংস্কৃতি বলতে আরবীভাষাও সংস্কৃতি সংপৃক্ত বাংলাদেশের ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা সাম্প্রতিককালে বিশেষভাবে লক্ষ‍্য করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের এই বিশেষ অবস্থানের কথা মাথায় রেখে ‘সেটিং’ তত্ত্বের সাম্প্রতিক রূপের ব‍্যাখ‍্যায় আসতে হবে। ২০১১ সালের ঐতিহাসিক পালা বদলের পর পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিষ্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ‍্যায়। তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শে কম‍্যুনিষ্টদের অনুসারী না হলেও চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে কম‍্যুনিষ্টদের ছাপিয়ে
গেলেন। কম‍্যুনিষ্টদের আদর্শের নামে লিখিত বা অলিখিত জোট, “lesser enemy” ইত‍্যাদি তত্ত্ব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পরেই তৃণমূল সুপ্রিমো তাঁর দলের “যখন যেমন, তখন তেমন” নীতির সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে কখনো বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের জোটসঙ্গী, আবার কখনো কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের জোটসঙ্গী হিসেবে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন। আবার নিজের ও দলের স্বার্থে হটাৎ জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেই সরকারের চরম বিরোধীতা করেছেন! সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজ‍্যে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে কম‍্যুনিষ্ট ও তৃণমূল শাসনে রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে বিপরীতধর্মী দলের সাথে সমঝোতার লম্বা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। এই সময়ের সমঝোতার গোপন প্রয়াসকেই শ্লেষাত্মক শব্দে ‘সেটিং’ বলে অভিহিত করা হয়েছে!
কম‍্যুনিষ্ট লবি থেকেই এই ‘সেটিং’ কথাটা বলা হচ্ছে – মমতার তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের চালিকা শক্তি বিজেপি দলের। এ প্রসঙ্গে একটা চালু প্রবাদ মনে এল – “রতনে রতন চেনে” – কারন, রাজনীতির ইতিহাসে এই ধরনের গোপন সমঝোতা বঙ্গীয় কম‍্যুনিষ্ট নেতৃবৃন্দ, বিশেষতঃ জ‍্যোতি বসু ও তাঁর দল সিপিএম কেন্দ্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষতঃ রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস এবং পরবর্তী নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেসের সঙ্গে এই ধরনের গোপন সমঝোতা করেছিলেন। তারও আগে থেকে, ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে কম‍্যুনিষ্টদের সঙ্গে ইন্দিরার দীর্ঘ সময়ের ‘সেটিং’ ছিল। তখন কম‍্যুনিষ্টদের হাতে শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন রাজ‍্যে তাদের বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে ইন্দিরা কম‍্যুনিষ্টদের সাহায‍্যে পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিল পাশ করাই শুধু নয়, তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রকে সম্বল করে ইন্দিরা সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করেছেন – বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময়ে তা যথেষ্ট কাজে লেগেছে।একেই এখন কম‍্যুনিষ্টরা ‘সেটিং’ বলছেন! এমনকি মনমোহন সিংয়ের সরকারের সময়ে যখন কম‍্যুনিষ্টরা তাদের সমর্থন তুলে নিল, তার পরও এই ধরনের ‘সেটিং’ হয়েছিল বলে শোনা যায়। একে ঐ সময়ের বিরোধী দলগুলি “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” বলে অভিহিত করত! মজার বিষয় হল, এখন এ রাজ‍্যে সিপিএম তথা কম‍্যুনিষ্টরা রাজ‍্য বিধানসভায় এবং লোকসভায় আসনসংখ‍্যার নিরিখে শূন্য হলেও, সংবাদ-মাধ‍্যম ও বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে তাদের অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হয়! এতেই বোঝা যায় যে, এখনো সংবাদ-মাধ‍্যমে কম‍্যুনিষ্ট প্রভুত্ব বজায় আছে। রাজীব গান্ধীর সময়ে কম‍্যুনিষ্টদের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। কারন, তাদের ভাষায় – ‘সেটিং’। সিপিএম তাদের দলের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, যিনি বিভিন্ন উচ্চ আদালতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন, তাঁর রাজ‍্যসভায় জেতার সময় তৃণমূল দলের সঙ্গে ‘সেটিং’ কতটা কাজ করেছে তা দলের তরফে বলা হয়েছে কি? অঙ্কের নিয়মে কিন্তু বিকাশবাবুর ‘সেটিং’ ছাড়া জেতার কথা নয়। বিকাশবাবুর আগে কংগ্রেসের এক বরিষ্ট নেতার ক্ষেত্রেও রাজ‍্যসভায় জেতার প্রশ্নে তৃণমূল দলের সঙ্গে ‘সেটিং’ করার কথা আমরা জানি। সুতরাং, ‘সেটিং’ কম‍্যুনিষ্ট ও কংগ্রেস, সর্বদাই স্বার্থের প্রয়োজনে করে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে এই ‘সেটিং’ তত্ত্ব উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে বাজারে ছাড়া হয়েছে – অবশ‍্যই সিপিএম এর প্রবক্তা! অথচ কিছুদিন আগে, গত মার্চ মাসের শেষের দিকে কেরলের সিপিএমের মূখ‍্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রীর চেয়ে আরো বড় ও কালারফুল ফুলের বোকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন – একে ‘সেটিং’ বলার সাহস কোন কম‍্যুনিষ্ট নেতার নেই! সততার পরাকাষ্ঠা দেখানো বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীকুল (১০০% রিডাকসান সেলে বিক্রি হওয়া) ও সিপিএম নেতারা একে ‘সেটিং’ বলুন দেখি! পশ্চিমবঙ্গের ইডি ও সিবিআইয়ের অনুসন্ধানে মূখ‍্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের জরিত থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে যদি এই দাবী করা যায় ত, কেরলের মূখ‍্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও ইডি, সিবিআই, এমনকি সোনা পাচারের মত গুরুতর অভিযোগের অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত‍্যতা মিলেছে। সুতরাং, গোয়েবেলসীয় প্রচারনীতিতে কম‍্যুনিষ্ট প্রচারের ফানুস – মমতা বন্দোপাধ‍্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘সেটিং’ বা তাঁর তুষ্টিকরনের জন‍্য গিয়েছেন আর বিজয়নের ব‍্যাপারে নিশ্চুপ থাকা – এই প্রশ্নে কম‍্যুনিষ্টরাই সন্দেহের র‍্যাডারে পড়েছেন!
বঙ্গীয় তথা ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টদের একটি প্রধান দোষ হল, তারা ভারত ও ভারতীয়ত্ত্ব বিরোধী অবস্থান নিলেও সেটি দেশের জনগণকে মিথ‍্যার বুননে ভালোভাবে ‘গেলানো’র কাজে ধারাবাহিক ব‍্যর্থতা। এই কারনেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় এবং রাজ‍্য বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধি সংখ‍্যা শূণ্য। তবু, এরা এদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন করবে না!
আসলে রাজনীতিতে ‘সেটিং’ বলে কোন তত্ত্ব হয় না। আবার রাজনৈতিক সুবিধার জন‍্য marriage of convenience একটি প্রচলিত প্রথা। যেমন, আদর্শগতভাবে কংগ্রেস ও শিবসেনা বিপরীত মেরুতে থাকলেও তারা একসঙ্গে মহারাষ্ট্রে সরকার চালিয়েছে। এ ধরনের সমঝোতা করলে আখেরে যে তা রাজনৈতিকভাবে ভালো হয় না, তা দেরীতে হলেও উদ্ধব এখন বুঝতে পারছেন। কিন্তু বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে কাশ্মীরে জেহাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে কম‍্যুনিষ্টরা ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হলেও তারা তাদের দেশবিরোধী লাইন পাল্টায়নি! এমনকি ১৯৬২ সালে চীন যখন ভারত আক্রমণ করে তখন অনেক ভারতীয় কম‍্যুনিষ্ট নেতা উল্লাস প্রকাশ করে বলেন যে, এবার চীন ভারতকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বে কম‍্যুনিষ্ট চীনের ঝান্ডা তুলবে! এমন ক‍্যুইসলিং (বাংলায় বললে মীরজাফর) শুধু ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টরাই হতে পারে।
এবার দেখা যাক এই কম‍্যুনিষ্ট প্রচারিত ‘সেটিং’ তত্ত্বে কার লাভ। যদি ‘সেটিং’ তত্ত্ব সঠিক বলে রাজ‍্যের জনগণকে বোঝানো যায়, তবে, তৃণমূল সমর্থকদের কাছে মমতা বন্দোপাধ‍্যায়সহ তৃণমূল নেতাদের উপর অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরী হবে এবং একইভাবে বিজেপি সমর্থকদের কাছে বিজেপির উপরে হতাশা ও অবিশ্বাস জন্মাবে। ফলে দুই দলের ভোটারদের বড় অংশ তাদের দলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা কম‍্যুনিষ্টদের ভোটবাক্স ভর্তি করবে! এই আশায় নিজেদের কমিটেড সংবাদ-মাধ‍্যমদের কাজে নামিয়ে তারা ‘সেটিং’ তত্ত্বের হাইপ তুলে জনমানসকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
আমি মনে করি এমন তত্ত্ব বালখিল‍্য চিন্তার ফসল। কারন marriage of convenience তত্ত্বের নিরিখে তৃণমূল দলকে প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপির কোন প্রয়োজন নেই। রাজ‍্যসভা বা লোকসভায় তৃণমূল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিক – তাতে ফলের কোন হেরফের হবে না। তৃণমূলের আন্তজার্তিক স্তরেও আলাদা কোনো গ্রহণযোগ‍্যতা নেই। বরঞ্চ তৃণমূলের সঙ্গে সাম‍ান‍্যতম সমঝোতায় রাজ‍্যে বিজেপির সমূহ ক্ষতি। প্রথমতঃ এ রাজ‍্যে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্ণীতির দায় বিজেপির ঘাড়ে চাপলে তাদের ভোটব‍্যাঙ্কে বিশাল ধ্বস নামার সম্ভাবনা। এই কথা মাথায় রেখে স্রেফ ভোট ভাঙ্গানোর রাজনীতি করার জন‍্যই সিপিএমের এমন অপপ্রচার।
এই অপপ্রচারকে হাওয়া দিচ্ছে কম‍্যুনিষ্ট তাঁবেদারীতে প্রশিক্ষিত সংবাদ-মাধ‍্যম ও বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যম। অথচ, এরা একবারের জন‍্যেও ইতিহাসের পাতা উল্টে বলছে না যে, ‘সেটিং’ তত্ত্বে কম‍্যুনিষ্টদের একচেটিয়া অধিকার। আবার বলি, এই সেটিং তত্ত্বে বিন্দুমাত্র সত‍্যতা থাকলে ক্ষতি তৃণমূল ও বিজেপির – লাভ সিপিএমের। আর, যে কোন রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বদা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন – তার জন‍্য কম‍্যুনিষ্টদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়না। কোন রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন করলে তা অনুমোদন করাই দস্তুর। সুতরাং মমতা বন্দোপাধ‍্যায় বা বিজয়নের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অন‍্য কোন অর্থ করার উদ্দেশ‍্য নিঃসন্দেহে সততার পরিচয় বহন করে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ‍্য, কয়েকদিন আগে কাশ্মীরের সাংসদ ফারুখ আবদুল্লার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হেসে হেসে কথা বলার ছবি সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কই, কম‍্যুনিষ্টরা এক্ষেত্রে ত ‘সেটিং’য়ের আওয়াজ তুলছে না!
এভাবে ‘সেটিং’ তত্ত্বের ভিত্তিহীন গল্প ফেঁদে কম‍্যুনিষ্ট ও তাদের বশংবদ সংবাদ-মাধ‍্যম জনগণকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করার জন‍্য যে নাটক মঞ্চস্থ করেছে তা ফ্লপ হতে বাধ‍্য। এভাবে পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিষ্টদের অন্তর্জলী যাত্রা ত্বরাণ্বিত হবে মাত্র।

পার্থ-কান্ডের নেপথ‍্যে কে

পার্থ-কান্ডে রাজ‍্য রাজনীতি সরগরম। সংবাদ-মাধ‍্যম তাদের তৈল-মর্দন-নীতি বজায় রেখে টিআরপি বাড়াতে যার পর নাই সচেষ্ট। এমন হাইপ তোলা হচ্ছে যেন, সর্বকালের সেরা চোর ও লাম্পট‍্যে বিশ্ব-চাম্পিয়ন প্রাক্তণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়! মানুষ সর্বদা কলঙ্কের রসালো গল্প নিয়ে মশগুল থাকতে ভালোবাসে – এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। মদের সঙ্গে যত মুখরোচক ‘চাট’ থাকে, আসর ততই জমে ওঠে। এখানে ‘চাট’ খুব মুখরোচক। তাই, ভালো মানুষের ছেলেপুলেরা যখন মদের আসরে মাতলামি শুরু করল, তখন জনসাধারণরূপী ‘চাট’খোরেরা ঐ চাটের স্বাদেই বিভোর! লক্ষ‍্যণীয় হল, দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিকরা পার্থর নিন্দায় মুখর। এভাবে “মিডিয়া ট্রায়াল”এর বিরুদ্ধে একমাত্র তৃণমূলের দলনেত্রী তথা মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় সরব হয়েছেন। এমনকি, অত‍্যন্ত ক্ষমতাশালী “যুবরাজ” পর্যন্ত পার্থর নিন্দায় খুবই সক্রিয়। অবশ‍্য, যে চিত্রনাট‍্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হচ্ছে তার ফলে জনসাধারণের কি লাভ এবং তার আসল উদ্দেশ‍্য কি তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।
গত ৩৪+১১ বছরের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি রাজ‍্যের জনসাধারণকে দিয়েছে এমন রাজনীতি যা মানুষে মানুষে কুৎসা, হিংসা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দলের মধ‍্যে অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে। সেইসঙ্গে এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের চুরি, জোচ্চুরি, ধাপ্পাবাজি, লাম্পট‍্য যেমন বেড়েছে, নেতৃত্বের সর্বচ্চোস্তরের অভিনয় দক্ষতা সময়ের সঙ্গেসঙ্গে আরো নিপুনতা পেয়েছে! এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় – সমাজের যত ক্রিমিনাল, তারা সব সমাজসেবী হয়ে গেছে! সে কারনে রাজনীতির অন্ধকার, পঙ্কিল সরণীতে চোরাগোপ্তা মার ও “কিচেন কন্সপিরেসি” বেড়েছে – যা মুঘল শাসনের শেষদিকে দিল্লী দরবারে দেখা যেত, তা এখানেও দেখা যাচ্ছে।
কোন এক মণীষী বলেছিলেন, “যা সাদা চোখে দেখছ তা ঘটেনি, যা তুমি চোখে দেখনি সেটাই ঘটেছে” – এই কথার সারবত্তা এখন অনুভব করা যাচ্ছে। বিশেষতঃ পার্থ-কান্ড বিশ্লেষণ ও তার পরবর্তী রাজনীতির ময়দানের প্রতিক্রিয়ায় আমার তাই মনে হয়েছে। মাথায় যদি ঘিলু বলে কোন পদার্থ থাকে, তাহলে কিভাবে মানুষ বিশ্বাস করে যে, পার্থর বিশেষ ‘ঘণিষ্ট’ অর্পিতা এত টাকা, অলঙ্কার, বিভিন্ন ভূয়ো ও কাগুজে কোম্পানীর মালিকানা এফং জমি-বাড়ির দলিল – সব ফটাফট স্পুটনিকের গতির দ্রুততায় তদন্তকারী সংস্থা ইডি বের করে ফেলল! ইডির কর্মদক্ষতার ইতিহাস কিন্তু অন‍্য কথা বলে। দ্বিতীয় একটি ব‍্যপার খুবই রহস‍্যজনক – ইডি যে কটি জায়গায় হিট করেছে, প্রতিটি নির্দিষ্ট লক্ষ‍্যে এবং পার্থ-অর্পিতা ছাড়া এখনো অব্দি তাদের হিট লিষ্টে অন‍্য কেউ আসেনি! এমন নির্দিষ্ট ও সুচারু অপারেশান বোধহয় দেশের প্রথিতযশা সার্জেনরাও করতে পারতেন না! অথচ অর্পিতার তিনটি মূল‍্যবান গাড়ি নিখোঁজ! পার্থ-অর্পিতার একটি বাড়ি থেকে নাকি বস্তাবন্দি মালপত্র (!) চুরি হয়ে গেছে – এসবের কোন কিনারা হয়নি! আশ্চর্য লাগে, ইডি পার্থ ঘণিষ্ট বিভিন্নজনের স্থাবর-অস্থাবর কোন সম্পত্তি এখনো বাজেয়াপ্ত করল না, শুধু যে দুটি ফ্ল‍্যাটে গেল সেখান থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপর সম্পত্তি পেল! এসব দেখে মানুষের মনে হতেই পারে, পার্থর কাছের এবং দলের কোন শক্তিশালী মহল থেকে ইডিকে যেটুকু ‘খবর’ দেওয়া হয়েছে, ইডি সেটুকুই এগিয়েছে! একটা কথা ভুললে চলবেনা যে, এই অনুসন্ধানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির কোন সম্বন্ধ নেই – এটি হাইকোর্ট নির্দেশিত তদন্ত এবং ইডিকে হাইকোর্টের কাছে রিপোর্ট পেশ করতে হচ্ছে। আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার যার একটিই মুখ, মমতা বন্দোপাধ‍্যায়, তারা প্রতিটি মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেছে, এই কেসে কিন্তু সেভাবে তারা আপীলে যায়নি। যদিও, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কেস ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট যেসব মামলায় হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে তার মধ‍্যে অন‍্যতম হল, শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগ দুর্ণীতি। যত সময় এগিয়েছে, তত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়েছে, গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে যত নিয়োগ হয়েছে তার সমস্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে যেখানেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান করেছে, সেখানেই দুর্ণীতির গন্ধ পেয়েছে। ফলে মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকারের নৈতিকতার ধ্বজা প্রায় ধুলায় মিশে গেছে। অথচ, ইডির modus operandi দেখলে বোঝা যায় যে, ইডি নির্দিষ্ট খবরের উপর ভিত্তি করে, নির্দিষ্ট মানুষদের টার্গেট করে তাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় তৃণমূল দলের মধ‍্যে নেতৃত্বের অবস্থান বৈপরীত্য লক্ষ‍্যণীয়। একদিকে কেন্দ্র তথা বিজেপির বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্র” তত্ত্বের কথা আউরে বিষোদগার ও পার্থর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে মমতা ঘণিষ্ট নেতা নেত্রীদের বক্তব‍্য প্রথমদিকে ফলাও করে সংবাদ-মাধ‍্যমে বেরোল; আবার সময়ের সাথে সাথে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়া পার্থকে “যুবরাজ” ঘণিষ্ট নেতারা মন্ত্রীত্ব ও দল থেকে সরাসরি বহিষ্কারের দাবী তোলে। শেষ পর্যন্ত যুবরাজ ঘণিষ্ট নেতাদের চাপে বরিষ্ট নেতা ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মত নেতা, যিনি প্রথমে পার্থর দপ্তরের দুর্ণীতিকে মন্ত্রীসভার “যৌথ দায়িত্ব” বলেছিলেন, তিনিও পরবর্তী সময়ে পার্থর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন! বোঝা যাচ্ছে যে, ফিরহাদ হাকিম যুবরাজের ঘণিষ্ট বৃত্তের সঙ্গে একাত্মতার বার্তা দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করলেন! তৃণমূল নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন বক্তব‍্য অনুধাবন করলে তাদের দলের আভ‍্যন্তরীন লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ফলে, শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত হাস‍্যকর প্রয়াস চালাচ্ছেন। ফিরহাদ হাকিম বললেন, ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি ১১ নম্বর প্লটের উপর বসতবাড়ি হিসেবে দেখানো হলেও আদতে এটি একই মালিকের ১০, ১১ ও ১২ নম্বর এই তিনটি প্লটের উপর বানানো হয়েছে এবং এটি কমার্শিয়াল ভাবে ব‍্যবহার করা হচ্ছে। গত আট বছর ধরে এই বাড়ি ব‍্যবহার করা হলেও পার্থ-কান্ডের পর ফিরহাদবাবুর ঘুম ভেঙ্গেছে এবং তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছেন, বকেয়া কর জরিমানা সহ আদায় করা হবে; প্রয়োজনে নাকি বেআইনি নির্মাণ ভেঙ্গে দেওয়া হবে! এতদিন বাদে কুম্ভকর্ণের মত জেগে ওঠার পিছনে কি উদ্দেশ‍্য? হটাৎ ফিরহাদের এমন পার্থ-অর্পিতা বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারন কি যুবরাজকে আনুগত‍্যের বার্তা দেওয়া – ভবিষ‍্যত এর উত্তর দেবে।
আবার মমতা বন্দোপাধ‍্যায় থেকে অভিষেক বন্দোপাধ‍্যায় একসুরে বলেছেন, ১৮ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ করা হবে – এটি মমতা সরকারের সাফল‍্য! অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ‍্যম এদের জয়ধ্বনির কোরাস শুরু করল! কিন্তু আসল ঘটনা হল, এই নিয়োগ হাইকোর্টের আদেশে করতে হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে পরীক্ষা বা বিনা পরীক্ষা – যেখানেই শিক্ষক নিয়োগের ব‍্যপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, সেখানেই আর্থিক দুর্ণীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! এসবই এখন হাইকোর্ট নিয়োজিত তদন্তের ফলে প্রকাশ পাচ্ছে; আর মমতা সরকার সব আদেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চ ও তারপর সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে! দুর্ণীতি ঢাকার এমন মরিয়া চেষ্টা সরকারের তরফে ভারতে আগে কখনো হয়েছে বলে জানা যায়নি। এমনকি, মমতাদেবী সর্বসমক্ষে বললেন, “একশটা চাকরী দিলে একটা কি নিজের লোককে দেবে না”! ভারতের অন‍্য কোন জননেতা প্রশাসনিক পদে থেকে এমন কথা বলেছেন কিনা তা জানা নেই। সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এই কথা সম্পর্কে বলতে হয়, উনি যখন মূখ‍্যমন্ত্রীত্বে শপথ নিয়েছেন, তখন সংবিধান মোতাবেক “without fear and without favour” কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন! ওনার মতে হয়ত অল্প-চুরি, চুরি নয়! সুতরাং এখন যদি প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্ণীতির গণতন্ত্রীকরন হয়, তাহলে তার দায় কি মমতাদেবী এড়াতে পারেন?
ভারতীয় সংবিধানের ১১ নম্বর পার্টে খুব বিস্তৃত ও নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্র ও রাজ‍্যগুলির ক্ষমতার বিভাজন লিপিবদ্ধ আছে। মমতা বন্দোপাধ‍্যায় মূখ‍্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন কারনে কেন্দ্রের জন‍্য নির্দিষ্ট ক্ষমতাকে রাজ‍্যের এক্তিয়ারে বলে জাহির করেন। সে বিষয়ে তিনি শোরগোল তুলে রাজনীতির বাজার গরম করার চেষ্টা করেন। তিনি যুক্তি ও আইনের চেয়ে তাঁর নিজের সুবিধাকে সর্বদা প্রাধান্য দেন! তাঁর অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সংবাদ-মাধ‍্যমকে ব‍্যবহার করার দক্ষতা, বিরোধী অনৈক‍্য এবং অলস বাঙ্গালীর অনুদানজীবি মানসিকতাকে সম্বল করে তিনি এতদিন রাজনীতির মঞ্চে সাফল‍্য পেয়েছেন। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর দলের মধ‍্যে মমতাদেবীর ‘ইচ্ছে’র থেকে অন‍্য কিছু বেশী গুরুত্ব পেতে চলেছে।
সেই ‘অন‍্য কিছু’ কি? আমরা দেখেছি যে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ‘যুবরাজ’ এক সময় প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদার থাকলেও তার মা তাকে “পিএম অন ওয়েটিং” করে রাখলেন! তারপর যুবরাজের সঙ্গেসঙ্গে তার দল কংগ্রেসও শুকিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কিন্তু এখানকার “যুবরাজ” রাজ‍্যের সিংহাসনে এখনই বসতে উদগ্রীব! আমাদের দেশের রাজনীতিকদের বংশানুক্রমিক দেশসেবার ঠিকাদারী নেওয়াই দস্তুর। তাই পশ্চিমবঙ্গের “যুবরাজ”-এর ইচ্ছা খুব স্বাভাবিক। সে কারনে তিনি অনেকদিন ধরে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। প্রথমে দলের মধ‍্যে তাঁর বশংবদ একটি গোষ্ঠী তৈরী করেছেন। তারপর দলের বরিষ্ট নেতা, যারা তাঁর বশংবদ হতে রাজী হবেন না এবং যাদের রাজ‍্য রাজনীতিতে কিছুমাত্র প্রতিষ্ঠা আছে, তাদের একএক করে দলে না থাকার মত পরিস্থিতি তৈরী করেছেন। দুই বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী দুরকম ভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব‍্যাক্ত করেছেন। তারপর এক এক করে যেসব নেতারা একমাত্র “অনুপ্রেঢ়ণা” ছাড়া আর কারোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন না, তাদের বিদায়ের ঘন্টা বাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হল। সুব্রত মূখোপাধ‍্যায় মরে গিয়ে হয়ত জেল হাজত ও অন‍্যান‍্য অপমানকর পরিস্থিতির থেকে রক্ষা পেয়েছেন। ফিরহাদ হাকিম টার্গেটে থাকলেও অনুপ্রেঢ়ণার “দুধেল গাই” তত্ত্ব এবং বগটুই কান্ডের পর এই মূহুর্তে হাকিমের চেয়ার ধরে টান না পড়লেও তিনি নিঃসন্দেহে অপেক্ষমান লিস্টে আছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত নেতা খুব স্বাভাবিকভাবেই টার্গেট হবেন। কারন সুব্রত মূখোপাধ‍্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর অনুপস্থিতিতে তিনিই দলীয় ক্ষমতায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন – এটাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাল হল। যেমন, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত‍্যুর পর রাজীব গান্ধী প্রথম যে উইকেটের পতন ঘটান তা প্রণব মূখোপাধ‍্যায়ের। এই মূহুর্তে তৃণমূল দলের জেলা সভাপতিদের মধ‍্যে সবচেয়ে মমতা-ঘণিষ্ট হলেন বীরভূমের অনুব্রত মন্ডল। দেখা যাচ্ছে,তাঁর পিছনে নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা লেগে আছে। ইতিমধ‍্যে তাঁর দেহরক্ষীর থেকে প্রচুর বেআইনি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অনুব্রতবাবুর গাড়ির বেআইনি লালবাতির জন‍্য রাজ‍্য পুলিশ তাঁর ফাইন করেছে – এই পুলিশের বিরুদ্ধে তৃণমূল দলের পাইক বরকন্দাজ হিসেবে ব‍্যবহারের বহু অভিযোগ। পুলিশ অনুব্রতবাবুকে ঘাঁটানোর সাহস (হাইকোর্ট বললেও) কোথা থেকে পায়! তৃণমূলের উচ্চ পর্যায়ের সাহায্য ছাড়া এইসব হাইপ্রোফাইল নেতাদের আর্থিক ও অন‍্যান‍্য কেলেঙ্কারীর খবর তদন্তকারী সংস্থাদের জানা সহজ নয়। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে, এই মূহুর্তে তৃণমূল দলের নেতৃত্ব স্পষ্টতই দুভাগে বিভক্ত – বর্তমান ও আগামী। বর্তমানকে আপাত অসম্ভব পুরষ্কারের লোভ দেখানো হচ্ছে – ২০২৪শে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী চেয়ার – প্রধানমন্ত্রীত্ব! তবে তার আগে যুবরাজের রাজ‍্যাভিষেক পাকা করতে হবে।
এখন, রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের চাকরী, রোজগার কিছুই নেই। শুধু নেই রাজ‍্য থেকে রাজনীতিকদের কোটি কোটি অসৎ উপায়ে লোক ঠকিয়ে উপার্জন করা অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে! “যুবরাজ” কালো টাকার জন‍্য মোদীর জবাব চাইছেন! এতেই বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের যুবরাজের সঙ্গে এই রাজ‍্যের যুবরাজের বুদ্ধির স্তরে কোন তফাৎ নেই। এ অনেকটা বামপন্থীদের শ্লোগান সর্বস্ব আন্দোলনের মত – “নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবীদের উপর মার্কিন আগ্রাসন হল কেন, কেন্দ্র তুমি জবাব দাও”! এদেরকে ব‍্যঙ্গ করে কোলকাতায় একটি চালু ছড়া ছিল, “ভুলতে পারি বাপের নাম, ভুলবো নাকো ভিয়েতনাম”!
দুর্বল চিত্রনাট‍্যের আরেক দিক হল, “যুবরাজ” তাঁর পয়লা নম্বরের মোসাহেব, যিনি নিজে সারদা কেলেঙ্কারীতে দীর্ঘদিন হাজতবাসের পর বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন, তাকে সঙ্গে নিয়ে ৫০০ দিন আন্দোলনরত পরীক্ষা উত্তীর্ণ চাকরীপ্রার্থীদের সঙ্গে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন! দেখা গেল, মোসাহেবি করা কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম যুবরাজের উদারতার প্রশংশায় পঞ্চমুখ! আজ, আন্দোলনের ৫০০ দিন বাদে যুবরাজের আন্দোলনরতদের কথা মনে পড়ল! উনি কয়েকজন নির্দিষ্ট আন্দোলনকারীর সঙ্গে আলাদা দেখা করলেন। আমার প্রশ্ন, “যুবরাজ” কোন ক‍্যাপাসিটিতে তাদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং কোন ক্ষমতাবলে তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন! তার চেয়ে অনেক কার্যকরী হত যদি উনি “অনুপ্রেঢ়ণা”কে দিয়ে এই ছেলেমেয়েগুলির ন‍্যায‍্য চাকরীর বন্তোবস্ত করে দিতেন। আসলে উনি কিছুই করতে চান না এবং বর্তমান অবস্থায় কিছু করতেও পারবেন না। উনি শহীদুল্লার মত কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বে এমন ধারনা তৈরীর চেষ্টা করলেন যে,তিনি আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রতি সহানুভূতিশীল! এই নাটকের দুটি উদ্দেশ‍্য – এক, আন্দোলনকারীদের মধ‍্যে ধন্দ্ব সৃষ্টি করা; দুই, নিজের নেতৃত্ব জাহির করা।
এভাবে “অনুপ্রেঢ়ণা”কে সরিয়ে “যুবরাজ”-এর অভিষেক প্রক্রিয়ার চিত্রনাট‍্য অনুযায়ী নাটক শুরু হয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তদন্ত প্রক্রিয়া আরো জোরদার করবে। বিরোধী দলগুলি আরো চেঁচামেচি করবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে “অনুপ্রেঢ়ণা”কে “যুবরাজ” প্রতিস্থাপন করলে জনগণের কি লাভ? এ হল, “head I win, tail you loose” গোছের ব‍্যাপার।

পার্থ-কান্ড তৃণমূলের ধ্বংসের অনুঘটক

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে ক্রমশঃ পঙ্কিল আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে, সেকথা অনেকবার লিখেছি। রাজনৈতিক অসততা ও ভোগলিপ্সার সঙ্গে যখন অযোগ‍্য, অসৎ হাতে প্রশাসনের দায়িত্বভার বর্তায়, তখন এভাবেই নোংরা পঙ্কিল স্রোতে সততা, মনুষ‍্যত্ব ও সমাজ সেবার ভড়ং ভেসে যায়।
আমি ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দেখে আসছি। ১৯৬৭র ভোটে বামপন্থীদের উত্থান ও তৎপ্রসুত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় থেকে রাজ‍্যের রাজনীতিতে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন দেখা যায়। সমকালীন গল্প, উপন‍্যাস, যেমন সমরেশ বসুর বিবর,পাতক ইত‍্যাদিতে তার ছাপ পাওয়া যায়। তারপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ ধরে নিয়েছে যে, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সরকারি টাকা নয়ছয় করা – রাজনীতিকদের একটি আবশ‍্যিক বাধ‍্যবাধকতার মত! এর বড় উদাহরণ হল, সারদা-নারদার মত টাকা আত্মসাৎ করা রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী পর্যায়ে ভোটে জিততে কোন অসুবিধা হয়নি। আর একথা সত‍্যি যে, রাজনীতিতে নির্বাচন লড়তে, দল চালাতে, তার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড রূপায়ণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সে অর্থ যে প্রথাগত বামপন্থী ভড়ংয়ের কৌটো ঝাঁকিয়ে খুচরো ‘তোলা’ তুলে সম্ভব নয়, তা এখন বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও বোঝে। সুতরাং কার “ঘনিষ্ঠ”র বাড়ি থেকে একুশ কোটি টাকা বেরোলো, তা নিয়ে মিডিয়া তার টিআরপি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে; তবে তাতে আপাতদৃষ্টিতে দলের কোন রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
তবে, এখনকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিষয়টির গুরুত্ব অন‍্য রকম। তৃণমূলের সুপার-হেবিওয়েট মন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় সেক্রেটারি জেনারেল, যদিও তৃণমূল দলে সেকেন্ড-ইন-কম‍্যান্ড বলে কিছু হয় না, অভিজ্ঞতার নিরিখে মন্ত্রীসভায় মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের পরেই যার স্থান, সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি (যারা ‘পাবলিক মানি’ নয়ছয় ও আর্থিক অপরাধের তদন্ত করে) গত ২৩শে জুলাই, গ্রেপ্তার করেছে। রাজনীতিক ও নেতা-মন্ত্রীরা আগেও আর্থিক অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমনকি বিহারের প্রাক্তণ মূখ‍্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এই কারনে দীর্ঘদিন অপরাধী সাব‍্যস্ত হয়ে জেল খাটছেন। এতে কোন নতুনত্ব নেই। এতে রাজনৈতিক দলের ইমেজ নষ্ট হয় না। কারন, এত কিছুর পরেও লালু প্রসাদ যাদবের প্রতিষ্ঠিত এবং এখন তার পুত্র তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে পরিচালিত আরজেডি গত বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের ভোটে শুধু বৃহত্তম দল হিসেবেই উঠে আসেনি, ক্ষমতাসীন নীতিশ কুমার-বিজেপির জোট সরকারের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে! কাজেই শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগ থাকলে তৃণমূল দলের চিন্তার বিশেষ কারন ছিল না। এক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারি বা বেনিয়ম নয় – এটি তদন্তাধীন অবস্থায় সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বলা যায় – চুড়ান্ত সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক অবক্ষয়ের নিদর্শন – অবশ‍্য সব অভিযোগ যদি সত‍্যি বলে প্রমাণিত হয়।
এই ঘটনায় তৃণমূল দলের প‍্যানিক বাটন টেপার জন‍্যই একথার সত‍্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। প্রথমে দলের হয়ে মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সংবাদ-মাধ‍্যমের কাছে প্রেস কন্ফারেন্স করে জানালেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার (বোধহয় বলতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপি) যে প্রতিহিংসার বশে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তাদের দলের নেতাদের (বহুবচন) বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন, তার কারনে যদি কেউ, অর্থাৎ, অভিযুক্ত, অসুস্থ হন বা তাদের কোন ক্ষতি (!) হয়, তবে ‘দল’ ছেড়ে কথা বলবে না। এই বক্তব‍্যের পর্যালোচনা করলেই ‘প‍্যানিক বাটন’ তত্ত্ব প্রমাণিত হয়!
কেন্দ্রের সরকার বা বিজেপি দলের সঙ্গে কিন্তু এই ইডি অনুসন্ধানের কোন সম্পর্ক নেই। অনুসন্ধান চলছে মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে। কোন ভারতীয় নাগরিক – মন্ত্রী, সান্ত্রীসহ সকলেই – ভারতীয় আইন মোতাবেক, আদালত নির্দেশিত অনুসন্ধানকারী সংস্থাকে এভাবে ভয় দেখিয়ে, শর্ত আরোপ করে অনুসন্ধানকারী সংস্থার কাজে বাধা দিতে পারেন কি! এ ত আদালতের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ! তৃণমূল দলের যে কোনো আইনজ্ঞ কোন আইনে এই সমালোচনা ও শর্ত আরোপ করা যায়, তা জানালে তাকে সেলাম জানাবো। অবশ‍্য এসব কথা কতটা ভয় থেকে আর কতটা হতাশা থেকে বলা হচ্ছে তা অনুমানের বিষয়। কারন, বক্তব‍্য রাখা মন্ত্রী নিজেও বোধহয় “প্রতিহিংসা” তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তার প্রমাণ হল, তৃণমূলের স্বীকৃত মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেছেন যে, আইনি পদক্ষেপে ‘দল’ কোন বাধা দেবে না; এবং দোষী প্রমাণিত হলে ‘দল’ তাকে কঠোর শাস্তি দেবে! লক্ষ‍্য করার বিষয়, দলের সুপ্রিমো মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় এই প্রসঙ্গে কোন মন্তব‍্য করেননি; উপরন্তু তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এখনো মন্ত্রীত্ব এবং দলের সর্বভারতীয় মহাসচিবের পদে বহাল রেখেছেন! যদিও উচ্চ আদালতের বিচারপতি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে দুর্ণীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রীদ্বয় পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পরেশচন্দ্র অধিকারীকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানো হবে, সে আশায় আগেই “সততার প্রতীক” পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় জল ঢেলে দিয়েছেন।
এখনো পর্যন্ত ইডির এই অনুসন্ধানে যা প্রকাশ পেয়েছে তার ফল তৃণমূল দলের পক্ষে মারাত্মক। কিভাবে এবং কেন? তা জানতে গেলে বাঙ্গালীর মানসিকতা ও সামাজিক এবং সাংসারিক বোধ সম্পর্কে ধারনা থাকা দরকার। রাজনীতিকদের সাধারণ আর্থিক দুর্ণীতি নিয়ে বাঙ্গালী যে মাথা বিশেষ ঘামায় না – যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ – গোছের চিন্তাধারা, তা প্রমাণ হয়, নির্বাচনের সময় সারদা-নারদার প্রভাব না পড়ায়। কিন্তু বাঙ্গালী নৈতিক শ্খলনজনিত (moral turpitude) অপরাধকে সর্বদা নিন্দা করে।এই নিন্দার ক্ষেত্রবিশেষে কারন ভিন্ন হলেও অভিমুখ একই থাকে। পার্থর ক্ষেত্রে এই নৈতিক শ্খলনজনিত খবরে জড়িয়েছে অর্পিতা মূখোপাধ‍্যায় ছাড়াও আরো কয়েকজন ‘ঘনিষ্ঠ’ মহিলার নাম। এদের প্রত‍্যেকের কাছেই হিসাব বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে অর্পিতা মূখোপাধ‍্যায়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্কের অকাট‍্য প্রমাণ হিসেবে পার্থর বাড়ি থেকে অর্পিতার নামে স্থাবর সম্পত্তির দলিল পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের দুজনের মধ‍্যে কথোপকথনের জন‍্য বিশেষ মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়া, অর্পিতার বাড়িতে পাওয়া সম্পত্তির মধ‍্যে বিপুল পরিমাণ টাকা ও অলংকার ছাড়াও প্রচুর বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গেছে। অর্পিতা কিসের জন‍্য ঘনঘন বিদেশযাত্রা করতেন, কার সঙ্গে, কি কারনে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অর্পিতা ইতিমধ‍্যেই পার্থর নাম এবং সম্পর্ক নিয়ে ইডির কাছে মুখ খুলেছে। সুতরাং, বিদেশ সফর জনিত আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা তাও বিচার্য বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ যে, অর্পিতা ও পার্থর নাম মিলিয়ে পার্থ বোলপুরে তার একটি বাংলোর নাম রেখেছে “অপা”। এসব নোংরামো বাঙ্গালী কতটা সইবে তা ভবিষ‍্যৎ বলবে। এদিকে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের খামে অর্পিতার বাড়িতে প্রচুর টাকা মিলেছে। তৃণমূলের পক্ষে মারাত্মক খবর হল, অর্পিতার কাছে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের একটি গোপন কালো ডায়েরির খোঁজ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ইডির সিজার লিস্টে ছত্রে ছত্রে দুর্ণীতি, শিক্ষিত বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের হৃদয় বিদারক চাকরি চুরি, এসবের প্রমাণ। একটি অন‍্য দপ্তরে উচ্চপদে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি এটুকুই বলতে পারি যে, এত বড় দুর্ণীতি এবং সামাজিক দুষ্কর্মের খবর মূখ‍্যমন্ত্রী জানতেন না, তা অবিশ্বাস‍্য! পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের modus operandi সম্বন্ধে যে ধারনা আছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের সরকারে মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোনো দপ্তরের কোনো কাজ হয় না – সমস্ত বিভাগীয় মন্ত্রীরা জনসমক্ষে একে মূখ‍্যমন্ত্রীর “অনুপ্রেঢ়না” বলে অভিহিত করেন! সুতরাং, শিক্ষা দপ্তরের এই পাহাড়প্রমাণ দুর্ণীতির “অনুপ্রেঢ়না” কে? কেউ কি জবাব দেবেন? এভাবে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পরল! এইসব কর্মকান্ডে যে টাকা পাওয়া গেছে তা বাঙ্গালীর শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে ধ্বংস করে শিক্ষিত যুবশক্তিকে ধ্বংস করে ভাতাজীবি হতে বাধ‍্য করার চক্রান্তের ফসল। জাতি ধ্বংসের জন‍্য দায়ী এই নেতৃত্ব। তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে পার্থর সঙ্গে দল ও দলনেত্রীর পৃথকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে তা যেমন দল ও দলনেত্রীকে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা, তেমনই মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের কাছে অর্পিতা মুখোপাধ‍্যায় অপরিচিত নন – তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি এবং মমতার নিজের মুখ থেকে অর্পিতার প্রশংসার ক্লিপিংস সংবাদ-মাধ‍্যমে ঘুরছে। এখানেই শেষ নয়, তৃণমূল দলের সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানে এই অর্পিতা মুখোপাধ‍্যায়কে দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মঞ্চ আলো করে বসে থাকার ছবি প্রমাণ করে যে, দলের কাছে এবং দলনেত্রীর কাছে অর্পিতা অপরিচিত – এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ মিথ‍্যা। অর্পিতার উপার্জনের কোন নির্দিষ্ট সূত্র জানা না গেলেও তার মডেলিং ও অভিনয়ের প্রশংসা মমতার মুখ থেকে শোনার পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওড়িয়া সহ গোটা চারেক ছবিতে ছোট পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে! এর জন‍্য মূখ‍্যমন্ত্রীর প্রশংসা দৃষ্টিকটু লেগেছে।
ইডি অনুসন্ধানের অন‍্য একটি অভিমুখ অবশ‍্যই নোটবন্দী পরবর্তী পুরোনো নোট জমা করার মধ‍্যে নিহিত আছে। সমাজে ব‍্যপকভাবে বিস্তৃত এক কলুষিত নেটওয়ার্কের অভিযোগের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ২০১৪-১৬ সালের মধ‍্যে শিক্ষাদপ্তরের নিয়োগে এই সব ঘুষের বিপুল টাকা এসে থাকলে নোটবন্দীর পরের ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোটে এই টাকা পাওয়া গেল কিভাবে? এটা তখনই সম্ভব, যদি ভালো এবং ব‍্যপক নেটওয়ার্কের মাধ‍্যমে ব‍্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, পেট্রোল পাম্প, সর্বপরি সাধারণ মানুষের মাধ‍্যমে পুরোনো বাতিল নোট জমা দিয়ে তা নতুন নোটে পরিবর্তন করা হয়! এই রহস‍্যের উদঘাটন জরুরী। এভাবেই সব চোর, জোচ্চোর,বাটপার, অপরাধীরা সব কালো টাকার পুরোনো নোটকে নতুন নোটে বদলে নেওয়ায় সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে, প্রায় সব পুরোনো নোট বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এভাবে কালো টাকার ভান্ডার নষ্ট করা যায়নি। রাজনীতি প্রযোজিত এই সামাজিক ব‍্যাধি দুর করার দায়ীত্ব ইডির উপর। এই সরকারের আমলের অপরাধের গণতন্ত্রীকরণের কুশীলবদের শণাক্ত করা জরুরী।
আবার অর্পিতার মায়ের কথায় আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট। তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর মেয়ের মডেলিং ও অভিনয় ছাড়া আর কোন ‘কাজ’-এর কথা জানেননা। সেইসঙ্গে এও স্বীকার করেছেন যে, মেয়ের মুখে তিনি মেয়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কথা মেয়ের কাছেই শুনেছেন! এখানেই অনেক না বলা কথা বলা হল! আবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় অনুসন্ধান ও তার পরবর্তী পর্যায়ে যখন অনুসন্ধানকারী দলের কাছ থেকে মোবাইলে কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন, পরপর চারবার তিনি মমতা বন্দোপাধ‍্যায়কে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন! মমতা ফোন ধরেননি। এর দুটো কারন হতে পারে। দলের এবং মন্ত্রীসভার গায়ে এভাবে কালি লাগায় তিনি অসন্তুষ্ট, বিরক্ত; অথবা তিনি ভয় পেয়েছেন। প্রথমটি হলে, চার্জসিটে এভাবে পার্থর বিরুদ্ধে বহু গুরুতর অভিযোগ ও প্রমাণ থাকায় এবং পরিষদীয় ও শিল্প এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রীর পদে আসীন পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার দলের সর্বভারতীয় মহাসচিব! এহেন গুরু দায়িত্বে থাকা মানুষের জন‍্য যদি দলের গায়ে কালি লাগে, খুব স্বাভাবিকভাবেই মমতা তাকে মন্ত্রীসভা থেকে এবং দলের পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। যদি আদালতে পার্থ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারে তবে তাকে পুনরায় সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মমতা তা না করায় বোঝা যাচ্ছে যে,মমতা পার্থকে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কেন? কারন অবশ‍্যই আদালতে পার্থ যদি রাজসাক্ষী হয় এবং……। এই ভয় থেকেই মমতার অবস্থা ছুঁচো গেলার মত – না পারছেন পার্থকে ফেলতে, না পারছেন গিলতে!
পার্থ উপাখ‍্যানের আরেকদিক হল, এই দুর্ণীতি শুধু আর্থিক নয়, এর সামাজিক ও মানবিক দিক হল – অভিযোগ আছে, এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে যোগ‍্য ও সফল প্রার্থীদের শিক্ষকতার চাকরীতে নিয়োগ না করে অযোগ‍্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছে। এই সরকারের প্রশাসনিক বদলী থেকে ধরে চুক্তিভিত্তিক চাকরীর ক্ষেত্রেও প্রচুর ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই কদিনের অনুসন্ধানে ঘুষের সম্পত্তির পরিমাণ ১২০ কোটির বেশী বলে প্রাথমিক অনুমান করা হচ্ছে। এই টাকা শুধু অর্পিতা নয়, জেলায় জেলায় এমন বহু ‘অর্পিতা’র সন্ধান পাওয়া যাবে। বিদেশী যোগাযোগ ও হাওলা সম্পর্কও বেরিয়েছে! কে জানে, বিদেশীদের সঙ্গে মিলে এই দেশে ধ্বংসাত্মক কাজে, যেমন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ইত‍্যাদির মত কাজে এই অর্থের অংশ ব‍্যবহার হত কিনা। একজন বরিষ্ট মন্ত্রীর এমন “ঘনিষ্ঠ” বান্ধবীদের সংখ‍্যা অনুসন্ধানের সঙ্গেসঙ্গে যত বাড়বে, তত কাদাঘাটা, নোংরা তথ‍্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মমতাদেবী তবু পার্থকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানোর দুঃসাহস দেখাতে না পারায় তাঁর দুর্বলতা ছাড়া আর কোন কারন নেই।
পার্থ গ্রেপ্তার হওয়ার পর IPGMRএ ভিআই পি ‘রোগী’ হিসেবে ভর্তি হয়ে গেল! এই ভর্তি হওয়ার নাটক আর তার নেপথ‍্য কাহিনীর পরতে পরতে ছলচাতুরী ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর প্রচেষ্টা প্রবল। পার্থর গ্রেপ্তারের পর চিফ মেট্রোপলিটন ম‍্যাজিস্ট্রেটের আদালত পুলিশ রিমান্ডের আদেশ দিলেও পরে কোন অদৃশ‍্য কারনে সেই আদালত দুটি আদেশ দেয়। ২৩শে জুলাইয়ের সেই আদেশে পার্থকে IPGMRএ ভর্তি করার কথা বলা হয় এবং অন‍্যটিতে ইডির উপর আদেশ হয় যে পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার আইনজ্ঞ সেখানে পার্থর সঙ্গে উপস্থিত থাকবে! এমন অদ্ভুত আদেশকে ইডি তৎক্ষণাৎ হাইকোর্টে চ‍্যালেঞ্জ জানালে গুরুত্ব অনুধাবন করে মহামাণ‍্য জজ বিবেক চৌধুরী ২৪ তারিখ দু পক্ষের সওয়াল জবাবের পর এই দুই আদেশ দেশের আইনের পরিপন্থী বলে বাতিল করে দেন। আর ইডির উপর আদেশ হয় যে, ২৫ তারিখ সকালেই পার্থকে দরকার হলে এয়ার অ‍্যাম্বুলেন্সে AIIMS, ভুবনেশ্বরে নিয়ে গিয়ে সব শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে তার রিপোর্ট ঐ দিনই দাখিল করতে হবে। তিনি এর সঙ্গে IPGMRএর ক্ষমতাশালী অভিযুক্ত ভিআইপিদের মেডিক্যালি সুরক্ষা দেওয়ার জায়গা বলে কটাক্ষ করেন। যথারীতি AIIMS, ভুবনেশ্বরের রিপোর্টে পার্থর কিছু বয়েসজনিত ক্রনিক অসুবিধে ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না! তারা জানিয়ে দিল, পার্থকে হাসপাতালে ভর্তি রাখার কোনো প্রয়োজন নেই – অথচ, IPGMR পার্থকে ICUতে রেখেছিল। এতেই বোঝা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালকে কিভাবে মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ করে অভিযুক্ত ভিআইপিদের রক্ষা করার কাজে লাগানো হচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার – স্বাস্থ‍্য বিভাগ, যার অধীনে IPGMR, তার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়! এরপরও পার্থ কান্ডের দায় মমতা সরকারের উপর না পড়ার কারন আছে কি? এখন এটাই দেখার যে, যেসব ডাক্তাররা পার্থর চিকিৎসা করে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করিয়েছিলেন, তারা সমাজের কাছে কতটা অপরাধী হলেন এবং ইডির জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় তাদের ফেলা হয় কিনা। কারন কার আদেশে তারা এসব করছিলেন, সেটিও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের চালাকি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব‍্যবহারের চেষ্টার অভিযোগ নতুন করে গতি পেল। যেহেতু পার্থ শারীরিক দিক থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মত সুস্থ আছে, তৃণমূল দলের রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দু সপ্তাহ কাটিয়ে দিলে জুডিশিয়াল কাস্টডি হয়ে যায় বলে তখন অভিযুক্তর কিছুটা সুরাহা মেলে। এই ব‍্যাপারটা মাথায় রেখে IPGMRএর নাটক শুরু হয়েছিল। কিন্তু বহু অভিনয়ে দীর্ণ একই স্ক্রিপ্ট এবার মঞ্চস্থ করা গেলনা। অবশ‍্যই দেশের আইনি ব‍্যবস্থাকে এর জন‍্য বাহবা দিতে হবে।
যেভাবে শিক্ষায় চাকরী দেওয়ার ব‍্যপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তেমন সব চাকরীর ক্ষেত্রেই, এমনকি সিভিক পুলিশের বিনা ট্রেণিংয়ের অস্থায়ী চাকরীতে পর্যন্ত অনুসন্ধান শুরু হলে থলে থেকে আরো অনেক বিড়াল বেরোবে। কয়লা, গরুপাচার, বালি খাদানের অবৈধ বালি পাচার, চাকরি চুরি – ইত‍্যাদি বিভিন্ন কেলেঙ্কারীর সঙ্গে রাজ‍্য সরকারের মন্ত্রীর গায়ে অবৈধ সম্পর্কের তকমাও লাগতে চলেছে। সম্প্রতি মমতা বন্দোপাধ‍্যায় মন্তব‍্য করেছেন, একশোটা চাকরীর মধ‍্যে একটাও কি নিজের লোককে দেওয়া যায় না! জানিনা, দেশের অন‍্য কোন রাজনীতিক এমন অসাংবিধানিক কথা বলতে পারেন কিনা। সংবিধান মোতাবেক শপথ নিয়ে এভাবে সংবিধান বিরোধী কাজের সাফাই কিন্তু চাপের মধ‍্যে ধৈর্য‍্য হারানোর লক্ষণ। এই চাপ দল ও দলনেত্রী কতদিন সামলাতে পারেন সেটাই দেখার।

মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের রাজনীতির ভবিষ‍্যত

আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আঙ্গিনায় দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে – লক্ষ‍্য ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট। ভারতের যে কোন সুস্থ মনের ভোটার, তিনি যে দলের সমর্থক হোন না কেন, বলবেন যে পরবর্তী লোকসভা ভোটে জিততে চলেছে বিজেপি। তাহলে, দেশের প্রথম রাজ‍্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে ভোটের হাওয়া তুলে দেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্দেশ‍্য কি? উত্তর খুব সহজ। তবে, শুধু উত্তর নয়,তার কারন ব‍্যখ‍্যা করার প্রয়োজন আছে।
মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের যারা খোঁজ রাখেন, তাঁরা সকলেই জানেন, এই অসম সাহসী নেত্রী যেমন ঝুঁকি নিতে অভ‍্যস্ত, তেমনই তিনি সর্বদা ক্ষমতা তথা রাজনীতির শীর্ষে থাকা পছন্দ করেন। আরেকটি কথা – তিনি কখনো তাঁর হাতের আসল তাস আগে সামনে দেখান না – এই ব‍্যপারটি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই লক্ষ‍্য করছি। এবারেও তিনি তাঁর অনুচরদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। একজন ত চাটুকারিতার আতিশয‍্যে বলেই ফেললেন, ২০২৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে নাকি লালকেল্লা থেকে মমতা বন্দোপাধ‍্যায় ভাষণ দেবেন! এই উক্তি অবশ‍্য যিনি করেছেন, তিনি “সারদা কেলেঙ্কারী”র সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে জেলে ছিলেন। এখন জামিনে মুক্ত এই লোকটির কথা সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে তা বোঝাই যায়!
মমতাদেবীর রাজনীতি লক্ষ‍্য করলে একথা হলপ করে বলা যায় যে, তিনি অন‍্য বিরোধী নেতৃবৃন্দ এক জায়গায় আসার আগেই বিরোধী ঐক‍্যের নামে একটি বিজেপি বিরোধী জোটের নেত্রী হবার চেষ্টা করবেন। একথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রথমে সেই জোটে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমও থাকবে! কিন্তু মমতাদেবী এদের কাউকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি সিটও ছাড়বেন না, এমনকি তেজস্বী যাদবের আরজেডিকেও নয়! আবার তিনি তামিলনাড়ুতে ডিএমকের সঙ্গে আঁতাতের চেষ্টা করবেন! মেঘালয় ও ত্রিপুরায় টিকিট না পাওয়া বিজেপি এবং কংগ্রেসীদের তাঁর দলের টিকিটে দাঁড় করাবেন – হয়ত গোয়াতেও সে চেষ্টা করতে পারেন! মমতাদেবীর মূল লক্ষ‍্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে ৪০-৪২টি লোকসভা আসন জেতা এবং সেইসঙ্গে অন‍্য রাজ‍্যগুলি থেকে আরো ২-৩টি সিট পাওয়া। রাজনৈতিক চাতুর্যে তিনি বুঝে গেছেন যে, কংগ্রেসের রক্তক্ষরণ অব‍্যহত থাকবে এবং তারা হয়ত ৪০টি বা তার কম আসন পাবে – বিশেষতঃ হিন্দি বলয়ে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। লক্ষ‍্য করলে দেখা যায়, তৃণমূল নেতৃত্ব হিন্দি বলয়ে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়ার জন‍্য কোমর বেঁধে নেমেছে – অবশ‍্য পশ্চিমবঙ্গের তাঁবেদার সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি এই কাজে প্রধান প্রচারকের ভূমিকা পালন করছে! এ থেকে বোঝা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি নয় – কংগ্রেস! আবার মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পট পরিবর্তনের ফলে শরদ পাওয়ারের এনসিপি বা শিবসেনা কেউই ৪০টি লোকসভা আসন পাওয়ার জায়গায় নেই। তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনে লড়াই ডিএমকের সঙ্গে এআইডিএমকের। অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় দুটি পৃথক দল ক্ষমতায় থাকায় তাদের কারোর পক্ষেই ৪০টির মত আসন জেতা সম্ভব নয়। সেজন‍্য মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের কাছে লোকসভার বিরোধী নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।
কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের মসনদ ছেড়ে তিনি কেন লোকসভার বিরোধী নেত্রী হতে যাবেন? খুব পরিষ্কার – যেভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে দমিয়ে রেখেছেন, সেই বিষবৃক্ষের ফল এখন ফলতে শুরু করেছে। যে মামলা টেট কেলেঙ্কারী দিয়ে শুরু হয়েছিল তা এখন সকল স্তরের শিক্ষক নিয়োগে দুর্ণীতির ক্ষেত্রে প‍্যন্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে! এতেই শেষ নয়, একের পর এক কয়লা কেলেঙ্কারী, গরুপাচার, অবৈধভাবে বালি খাদানের বালি পাচার এবং সর্বোপরি ২০২১ এর নির্বাচনোত্তর হিংসা,লুঠ ও খুন। প্রথমদিকে এসব কেলেঙ্কারী কার্পেটের নীচে লুকানোর চেষ্টা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো একের পর এক বেরিয়ে আসছে।
মমতাদেবী শাসক হিসেবে যতটা সমালোচনার যোগ‍্য, তিনি বিরোধী নেত্রী হিসেবে ততটাই প্রশংসার দাবী রাখেন! কিন্তু এক কার্ড বারবার খেললে প্রতিপক্ষ তা ধরে ফেলে – এটাই মুস্কিল। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের যে কোন সিদ্ধান্তের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই মমতা বন্দোপাধ‍্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সমালোচনা শুরু করে দেন! CAA ও NRCর বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ তাঁকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু, ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরোধীতা করে তিনি সুবিধা ত পেলেনই না – বরঞ্চ নিজেকেই হাসির খোরাক করলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি চাকরীর সংকোচন করেছেন – অত‍্যন্ত স্বল্প মাইনের বিনা ট্রেণিংয়ের “সিভিক পুলিশ” মার্কা অস্থায়ী নিয়োগ করে চলেছেন। এদের চাকরীর যেমন স্থিরতা নেই, তেমনি ইনক্রিমেন্ট, মেডিকেল, PF কিছুই নেই – পেনশন ত দুরস্ত! সেই মমতাদেবী ও তাঁর দলের নেতারা যখন অগ্নিবীরদের পেনশন না দেওয়ার জন‍্য প্রতিবাদ করেন, তা মানুষ কিভাবে নিচ্ছেন সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। অগ্নিপথ প্রকল্পে দেশে রেকর্ড সংখ‍্যক আবেদন জমা পড়ার পর দেশের কিছু বিরোধী দল এর বিরোধীতা থেকে সড়ে এলেও মমতাদেবী বিরোধী দলনেত্রী হওয়ার বাসনায় এখনো তার বিরোধীতা চালিয়ে যাচ্ছেন! আবার মমতাদেবীর অনুপ্রেরণায় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দপ্তর কেমন চলছে এবং তার শিক্ষক নিয়োগ দূর্ণীতির তদন্ত কতদূর যাবে তা সময়ই বলবে। তবে, একথা বললে বোধহয় অত‍্যুক্তি হবে না যে, কেন্দ্রের শিক্ষানীতির বিরোধীতা করে রাজ‍্যের জন‍্য আলাদা শিক্ষানীতি (!) করার ঘোষণা করে উনি নিজেকে আরো খেলো করেছেন! শিক্ষা যৌথ দায়িত্ব হলেও, নীতি নির্ধারণ ও তার নিরূপণ করার দায়িত্ব শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের। অর্থের মূল যোগানের দায়িত্বও কেন্দ্রের হাতে। মমতাদেবীর বিশেষত্ব হল, তিনি তাঁর ক্ষমতা সম্বন্ধে অতিরিক্ত সচেতন থাকলেও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন নন।
মমতা বন্দোপাধ‍্যায় রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী – তিনি মন্ত্রীসভার বৈঠকে পৌরহিত‍্য করবেন; তাঁর নিজের হাতে থাকা দপ্তরগুলির এবং সাধারনভাবে রাজ‍্য সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করবেন – এটাই তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু তিনি ত এক এবং অদ্বিতীয় মমতা বন্দোপাধ‍্যায়! তিনি তাঁর এমন এক ইমেজ তৈরী করেছেন যে, তাঁর দলের বড়, ছোট, মেজ,সেজ, সব নেতাই তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, এমনকি কোন প্রকল্প শুরুর ঘোষণা করলেও তাঁর “অনুপ্রেরণায়” কথাটি লিখতে বা বলতে ভূল করেন না! এ যেন দলের এক অলিখিত কম‍্যান্ড! এধরনের কাজকর্মের সবচেয়ে বড় বিপদ হল, যদি কোন প্রকল্প ব‍্যর্থ হয় বা কাজে গাফিলতি হয়, তার দায়ও মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের উপরেই বর্তায়! যেমন, পশ্চিমবঙ্গের কোষাগারকে প্রায় শূণ‍্য করে দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ণের নামে জনসাধারণের কয়েকটি গোষ্ঠীকে আর্থিক ‘অনুদান’ দেওয়া। এধরনে ‘অনুদান’ তখনই দেওয়া যায়, যখন কোষাগারে এর জন‍্য উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে। পশ্চিমবঙ্গের কোষাগারে ভাঁড়ে মা ভবানী। সুতরাং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় উন্নয়ণ প্রকল্পের উপর কোপ! তার উপর আরেকটি ব‍্যাপার আছে – মমতাদেবীর ‘আমিত্ব’ – আমি করে দিলাম, আমি সব করে দিলাম, ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, অটল পেনশন যোজনা, প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ‍্য যোজনা, অন্ত‍্যোদয় প্রকল্প, MGNREGA ইত‍্যাদি যোজনা বা প্রকল্পের নাম পাল্টে বা শর্ত পাল্টে এই ‘আমিত্ব’ প্রয়োগে সব ক্রেডিট আর আলো নিজের দিকে টানতে গিয়ে রাজ‍্যের কোষাগার এতটাই বেসামাল যে, ঋণ নিয়েও আর ঋণ-ফাঁদ (debt trap) আটকানো যাচ্ছেনা। তারউপর রাজ‍্য সরকারি কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে সমান মহার্ঘ ভাতা দেবার যে নির্দেশ মহামাণ‍্য উচ্চ আদালত বহাল রেখেছে, সেই টাকা মেটানোর সময়সীমা আগামী আগস্ট মাসে শেষ হবে। তা না দিতে পারলে রাজ‍্য সরকার অবশ‍্যই আদালত অবমাননার দায়ে পড়বে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সংবিধান মোতাবেক অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা জারি করার যে দাবী উঠেছে, কিছুদিনের মধ‍্যেই তা তীব্র হবে। শুধু কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেবার আদেশ কার্যকর করতেই রাজ‍্য সরকারের অতিরিক্ত ২২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম বহির্ভূতভাবে রাজ‍্যের ঋণ নেবার ঊর্ধসীমা বৃদ্ধি না করলে রাজ‍্যের পক্ষে তা মেটানো সম্ভব নয়। এদিকে রাজ‍্য সরকারের অনুদান নীতির ফলে উদ্ভুত কণ‍্যাশ্রী, যুবশ্রী, বিধবা ভাতা, সাইকেল দান থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার – সব প্রকল্পের অনিশ্চিত ভবিষ‍্যতের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ‍্যসাথী প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়ার মুখে। এমতাবস্থায় এই বেহিসেবী, হুজুগে ডোল দেওয়ার রাজনীতি আর বেশীদিন চালানো সম্ভব নয়। আবার এগুলো বন্ধ করে দিলে জনরোষের আশঙ্কাও অমূলক নয়। সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য সরকারের দায়িত্ব তাঁর উত্তরসূরীর হাতে দিয়ে তিনি বিরোধী দলের সর্বভারতীয় নেত্রী হিসেবে পরবর্তী ইনিংস শুরু করার পরিকল্পনা করতেই পারেন। তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বৈমাত্রেয় আচরনের অভিযোগ তুলে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারবেন। অবশ‍্য এ সবই অনুমান সাপেক্ষ – আর এখানে পরিবর্তনশীল রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যায়, তার উপরেই এই পরিকল্পনার সাফল‍্য নির্ভর করবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী NDAর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মু ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী শ্রী জগদীপ ধনখরের জয়লাভ সুনিশ্চিত। বিশেষ করে ধনখরজীর মনোনয়নের দুরকম রাজনৈতিক ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়। একটি বামপন্থীদের থেকে প্রচার করা হচ্ছে – এর দ্বারা মমতা বন্দ‍োপাধ‍্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের “সেটিং” তত্ত্ব প্রমাণিত হল! কারন, সাম্প্রতিক অতীতে যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোন একজন ব‍্যক্তি সবচেয়ে ব‍্যতিব‍্যস্ত করে থাকেন তবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সদ‍্য প্রাক্তণ রাজ‍্যপাল ধনখরজী। এই আইন বিশেষজ্ঞ রাজ‍্যপাল বারবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আইন মেনে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে কারনে তৃণমূলের ছোট, বড়, মেজ, সেজ সব নেতাই, এমনকি বিধানসভার স্পিকার পর্যন্ত তীব্র ভাষায় রাজ‍্যপালের নিন্দা করেছেন। আবার অন‍্য অভিমত হল, কৃষকঘরের আইনজ্ঞ সন্তান ধনখরজী উপ-রাষ্ট্রপতি হলে, রাজ‍্যসভার চেয়ারম‍্যান হিসেবে রাজ‍্যসভা পরিচালনার জন‍্য যোগ‍্যতম ব‍্যক্তি। আমার নিজের মত হল, বিজেপির এটি একটি মাস্টার স্ট্রোক। এভাবে তারা মমতা বন্দোপাধ‍্যায় ও তাঁর দলকে বাধ‍্য করল যাতে তাঁরা ধনখরজীর জয়লাভ সুনিশ্চিত করে – তাতে আর যাই হোক, একজন সক্রিয় আইনজ্ঞের খবরদারি থেকে তারা বাঁচবে। অবশ‍্য এর ফলে বিজেপির উপরেও এক ধরনের রাজনৈতিক আবশ‍্যকতা তৈরী হবে যে, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী রাজ‍্যপালও সংবিধানের সক্রিয় প্রহরী হিসেবে তাঁর ভূমিকা পালন করেন। তা না হলে কিন্তু “সেটিং” তত্ত্বই গতি পাবে।
পরিশেষে বলি, মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের এই রকম রাজনৈতিক পরিকল্পনায় বিজেপির সবচেয়ে বড় অবদান প্রয়োজন। এখন, এটাই দেখার যে, কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার লক্ষ‍্যে বিজেপি কি তৃণমৌলের মত একটি আঞ্চলিক দলকে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায‍্য করবে? তবে যদি কোনভাবে তৃণমলের এই প্রচেষ্টা সফল হয়, তাহলে, কাশ্মীর নয়, ভারতের জিহাদী সমস‍্যাও সীমান্ত-সন্ত্রাসের (cross border terrorism) দীর্ঘমেয়াদী সমস‍্যার কেন্দ্রবিন্দু হবে পশ্চিমবঙ্গ এবং তা ক্রমশঃ উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরবে।অতয়েব সাধু সাবধান।

বাংলা ও বাঙ্গালীর ভাগ‍্য

আমরা,যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, তাদের মধ‍্যে সর্বদা এক দ্বিধা-বিভক্তিজনিত জড়তা কাজ করে। বাঙ্গালী হিন্দুদের মনে যে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে তা হল – আমরা প্রথমে বাঙ্গালী না প্রথমে ভারতীয়! তেমনই বাঙ্গালী ইসলামিদের মনের দ্বন্দ্ব হল – আমরা প্রথমে বাঙ্গালী না প্রথমে ইসলামি! এই দ্বন্দ্বমূলক বিচারধারার পরিণতি না আসায় বাঙ্গালী তার নিজস্ব বোধবুদ্ধির উপর ভরসা না রেখে এক অদ্ভুত কাল্পনিক তত্ত্ব – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আঁকড়ে ধরে বাঙ্গালী হিসেবে ঐক‍্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করছে! তার অবিসংবাদী ফল হচ্ছে, বাঙ্গালী “না ঘরকা, না ঘাটকা” হয়ে সকলের থেকেই তাচ্ছিল‍্য আর অবহেলা পাচ্ছে।
আমরা যদি বাংলার ইতিহাস দেখি, অবশ‍্য কাল্পনিক ‘ইজম’ ভিত্তিক নয়, প্রকৃত ইতিহাস – সেখানে আমরা দেখি, বিদেশী হানাদারদের জন‍্য “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি” শুধু নয়, বিশেষতঃ বর্ষাকালে নদীমাতৃক বাংলায় যুদ্ধ জেতা অত‍্যন্ত কঠিন কাজ। সে কারনে মুঘল আমলেও অমিত শক্তিধর দিল্লীর বাদশারা বাংলা দখলের প্রশ্নে সম্পূর্ণ সার্থকতা পাননি। এমনকি সুলতান আমলের শেষপর্বে, ১৩শ শতাব্দীতে, সুবে বাংলার সুবাদার হিসেবে ইসলামি শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন্ বক্তিয়ার খিলজি যে বাংলা জয় করেন বলে লেখা হয়, তা শুধুমাত্র সুবে বাংলার উত্তর ও পশ্চিমের কিয়দংশ। নদীমাত্রিক বাংলার বেশীরভাগ স্থান বাঙ্গালী রাজাদের অধীনেই থাকে।
বাঙ্গালী অত‍্যন্ত স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমান ও উদারমনা জাতি হিসেবেই বাইরের জগতে পরিচিত। এই কারনেই উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রেনেসাঁর পুরোভাগে নেতৃত্ব দেন বাঙ্গালীরা – রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন থেকে রাসবিহারী বসু ইত‍্যাদি। সাহিত‍্য জগতে – বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং অবশ‍্যই বাংলা সনেটের প্রথম রচয়িতা মধুসূদন দত্ত। এমনকি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি ভিন্ন ধারা – সহিংস ও অহিংস – দুই ধারাতেই বাঙ্গালীর অবদান সর্বাধিক – একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিস্মরনীয় চরিত্র – নেতাজী সুভাষচন্দ্র, রাসবিহারী বসু, ফাঁসির মঞ্চে দেশের প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরা, মাষ্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,…… অজস্র নাম। বাঙ্গালীদের বৈশিষ্ট‍্য হচ্ছে, তারা কখনো পিছন থেকে ছুরি মারে না – অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ইতিহাস নামের মার্কসীয় প্রচার পুস্তিকায় লেখা হয় – ভারতের স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিল পলাশীর প্রান্তরে এবং বাঙ্গালীদের, অর্থাৎ মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ ও ঘসেটি বেগমদের বিশ্বাসঘাতকতায়! কথায় বলে, “গল্পের গরু গাছে চড়ে” – এক্ষেত্রে দেখা যায় ‘ইতিহাস’ নামের প্রচারধর্মী পুস্তিকার কল‍্যানে সর্বৈব মিথ‍্যাকে সত‍্যি বলে চালানো হয়েছে। যাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা কেউ বাঙ্গালী নয়; রাজস্থান, বিহার এমনকি তুরস্ক থেকে আসা মানুষ। এরা কেউ বাংলায় কথাও বলতেন না। আবার ঘসেটি বেগম সিরাজের আত্মীয়। সিরাজউদ্দৌল্লা এবং তার দাদু আলীবর্দী বাংলা না-জানা তুরস্কের মানুষ – এরা আশরাফি মুসলমান হওয়ার সুবাদে বাঙ্গালী হিন্দু ত বটেই, বাঙ্গালী ধর্মান্তরিত ইসলামিদেরও মানুষ মনে করত না। বাঙ্গালী মুসলমানরা সকলেই ধর্মান্তরিত মুসলমান (আতরাফি) হওয়ায় এদের এই উর্দু বা ফার্সীভাষী মুসলমানরা কখনো তাদের স্বগোত্রীয় মনে করত না। অবশ‍্য এই তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকরা সকলেই কোন না কোনভাবে সিরাজের অত‍্যাচার, অবিচারের শিকার। ১৯৩৮ সালে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা নাটক ও প্রামাণ‍্য ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে জানা যায় যে, সিরাজ তুর্কিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ত বটেই, এমনকি বাংলা ভাষার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি দিল্লীর বাদশাহের অধীনে একজন করদ ‘নবাব’ ছিলেন মাত্র। যে জন‍্য অত‍্যাচারী, উশৃঙ্খল সিরাজের পরাজয়ে সাধারণ মানুষের থেকে কোন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ হয়নি। মানুষের ভাবখানা এমন, যেন – দিল্লীর পাঠানো নবাবের বদলে কোম্পানীর নবাব এলো! পরবর্তীতে, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক সুন্নি ইসলামি নাট‍্যকার সিরাজকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে প্রচার করতে সচেষ্ট হন। তার প্রধান কারন ধর্মীয় – প‍্যান-ইসলামিজম এর সাথে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় জিগির তুলে একাত্মতা!
ভারতের স্বাধীনতালাভের আগে মুসলিম লীগের জন্মের পর তার গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়ানোর কাজে আরবী সংস্কৃতির প‍্যান-ইসলামিজমের প্রচার শুরু হয়। ফার্সি ও উর্দুতে কথা বলা ইসলামিদের সঙ্গে চারিত্রিক, ভাষাগত ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য হেতু বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ‍্যে এই আরবী সংস্কৃতির ভ্রাতৃত্বের ডাক প্রথম দিকে বিশেষ দাগ কাটেনি। কিন্তু স্বাধীনতালাভ ও বাংলা ভাগের অব‍্যবহিত আগে মুসলিম লীগের বাঙ্গালী নেতৃত্ব, বিশেষতঃ হুসেন সুরাবর্দী এবং তাদের কম‍্যুনিস্ট বন্ধুরা, সঙ্গে কংগ্রেসের একাংশ – সরাসরি হিন্দু, মুসলমানের মধ‍্যে বিভেদের প্রচার করতে শুরু করে। হিন্দুদের তরফে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলেও বাংলাভাগের দায় বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী মুসলমান রাজনীতিকরা সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর চাপায়! একাজে ধর্মীয় স্থান থেকে ঐ রাজনীতিকদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন মেলে।
ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাগের আকস্মিকতায় হতচকিত বাঙ্গালীদের মধ‍্যে দু রকমের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ সুন্নি ইসলামি সম্প্রদায় তাদের ছোট চোখে দেখা আশরাফি ইসলামিদের প্রচারে ভুলে এবং লোভের বশবর্তী হয়ে সরাসরি হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার, খুন,ধর্ষণ ও লুঠপাট এবং সম্পত্তি দখল করা শুরু করে। পাকিস্তানের তদানীন্তন মুসলিম লীগের সরকার একাজে সরাসরি মদত দেয়। তারা ভারতের মত সংখ‍্যালঘু (ভারতের ক্ষেত্রে ইসলামি ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হিন্দু) সম্প্রদায়ের ধন, প্রাণ, সম্পত্তি রক্ষার অঙ্গীকার করেনি! বরঞ্চ, তারা ‘enemy property’ নাম দিয়ে বকলমে হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করাকে প্রশাসনিক বৈধতা দেয়। এই সময় থেকেই বাঙ্গালী ইসলামিদের একাংশ ক্ষমতা ও অর্থের লোভে পাকিস্তানের আশরাফি ইসলামিদের দালালি শুরু করে। যদিও পাকিস্তানের উর্দুভাষী ইসলামিরা বাঙ্গালী ইসলামিদের অত‍্যন্ত নিম্নবর্গীয় (‘আতরাফি’, অর্থাৎ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত এবং বাংলাভাষায় কথা বলে) বলে তাচ্ছিল্য করে! ১৮৮২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি লর্ড রিপন কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশনে ইসলামিদের তরফে নবাব আব্দুল লতিফের প্রস্তাব ছিল – উচ্চ শ্রেণীর (আশরাফ, অর্থাৎ সৈয়দ,মোঘল,পাঠান) ছাত্ররা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখাপড়া শিখবে। আর নিম্নবর্গীয় (আতরাফ, অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী ইসলামি) ছাত্ররা বাংলায় লেখাপড়া শুরু করবে। এর থেকে পরিষ্কার যে উর্দুভাষী ইসলামিরা প্রথম থেকেই বাংলাভাষী ইসলামিদের ছোট চোখে দেখে। এর একটা বড় কারন হল, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও খাদ‍্যাভাস (বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ‍্যে গরু খাওয়ার প্রবণতা পরে আসে) সব দিক থেকে বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ‍্যে সাযুজ‍্য লক্ষণীয়। এমনকি গ্রাম বাংলার পালাগান, বাউল সঙ্গীতের জগতে হিন্দুদের সঙ্গে ইসলামিদেরও দেখা মেলে। বাঙ্গালীর মধ‍্যে, কি হিন্দু কি ইসলামি, ধর্মীয় ঋজুতা কখনো ছিল না। মসজিদ থেকে বাঙ্গালী ইসলামিদের ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় স্বাধীনতার অব‍্যবহিত পূর্বে।
তিনজন ইসলামি বুদ্ধিজীবী, খোন্দকার ফজলে রাব্বি (বই – বাংলার মুসলমান; বাংলা একাডেমি; ঢাকা;১৯৮৬); মহম্মদ আব্দুল রহিম (বই – Social and Cultural History of Bengal,vol.I; Historical Society; Karachi; ১৯৬৩ ও vol.II, ১৯৭৭; এবং মহম্মদ মোহর আলী (বই – History of The Muslims of Bengal; Riyadh, Ibn Soud Islamic University, ১৯৮৫) প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বাঙ্গালী (অধুনা বাংলাদেশী) ইসলামিদের মধ‍্যে সকলেই আতরাফি নয়, অনেক আশরাফিও আছেন! যদিও সত‍্যনিষ্ঠ কোন প্রমাণ তাঁদের লেখায় পাওয়া যায় না, এবং এদের দুজনের বই যেহেতু পাকিস্তানের ইসলামি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত, এটি মনে করার যথেষ্ট কারন আছে যে, পাকিস্তানের উর্দুভাষী ইসলামিরা এভাবে বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ‍্যে বিভেদের সৃষ্টি করে ruler and to be ruled শ্রেণী তৈরীর চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা এই তথাকথিত বাঙ্গালী আশরাফিদের ব‍্যবহার করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের (এবং প্রতিবেশী ভারতের) অভ‍্যন্তরে ধর্মীয় হিংসার বাতাবরন তৈরীর চেষ্টায় আছে। যদিও বাঙ্গালী ইসলামিদের বড় অংশ অবাঙ্গালী ইসলামিদের দ্বারা এভাবে ব‍্যবহৃত হতে রাজি নয়, এই অশুভ প্রচেষ্টা নিরন্তর চলছে।
এইখানেই পোঁতা হয়েছে হিন্দু বাঙ্গালী ও ইসলামি বাঙ্গালীর মধ‍্যে বিদ্বেষের বীজ। যে বাঙ্গালী ধর্মের গোঁড়ামির মধ‍্যে না থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে নিজেকে ব‍্যাপৃত রাখত, তাকে যখন ধর্ম ও অসহিষ্ণুতার বাঁধনে বেঁধে ফেলা হল, তখন থেকেই সমাজের সব স্তরে বাঙ্গালীর পিছুহটা শুরু হল – বিশেষতঃ বাংলাদেশের মধ‍্যে অসহিষ্ণুতার ঘাত-প্রতিঘাতে পশ্চিমবঙ্গের দুইধর্মের বাঙ্গালীদের মধ‍্যে তার প্রতিফলন দেখা দিল। পশ্চিমবঙ্গের সংখ‍্যাগুরু হিন্দুরা কিন্তু কখনোই ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়নি। যদিও বাংলা ভাগ ও ভারতের স্বাধীনতার সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি ভোলার জন‍্য রাজনৈতিক স্তরে চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। বরঞ্চ সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ভারতের ইসলামিদের মধ‍্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার জন‍্যই কিছুকিছু ধর্ম ব‍্যবসায়ী ও রাজনীতিক ছাড়া অন‍্য ইসলামিদের (বিশেষতঃ আতরাফিদের) সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ইসলামি বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রেও একথা বিশেষভাবে প্রযোজ‍্য।
এই রাজ‍্যের হিন্দু বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক উদাসীনতা ও তাদের দাবার ঘুঁটির মত ব‍্যবহার করার প্রবণতায় ঘটি-বাঙ্গাল সামাজিক লড়াই লাগিয়ে বিভাজন সৃষ্টি করা হল। বাঙ্গালীর চিন্তার মৌলিকতাকে ধীরেধীরে রাজনীতির ‘ইজম’-এ আবদ্ধ করা হল। এদিকে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ‍্যে বিভাজন, ইসলামি বাঙ্গালীদের অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে রাজনীতিবিদ ও আশরাফি মৌলবাদীদের হাতের পুতুল বানানো হল। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত‍্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্তিরতা ও আল্ট্রা-লেফ্ট নকশালদের খুনের রাজনীতি বাঙ্গালীর প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের স্পৃহাকে নষ্ট করে দিল। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীর লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের আশরাফি খানসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও এবং বাংলাদেশের জন্মের জন‍্য ভারতের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের, প্রভূত অবদান থাকলেও, সে দেশের একদল ইসলামি দালালদের সক্রিয় সাহায্যে খানসেনারা বাঙ্গালী, বিশেষভাবে বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর চরম অত‍্যাচার করলেও রাজনীতির প্রয়োজনে তখন ভারতের বাঙ্গালীরা কোন কার্যকরী প্রতিবাদ করেনি। এভাবেই দুই বাংলায় হিন্দু মুসলমানের বিভেদ বাড়তে থাকে। তারপর কম‍্যুনিস্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মেরুদন্ড শুধু যে ভেঙ্গে দেওয়া হল, তা ই নয়, রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলী গায়ে চড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী নেতারা “ইসলামি ধর্মনিরপেক্ষতা”র প্রবক্তা হয়ে উঠলেন। আর, বাংলাদেশের থেকে বেআইনি ইসলামি অনুপ্রবেশকে চোখ বন্ধ রেখে রাজ‍্যের শাসককুল পরোক্ষে সমর্থন দিতে লাগল! তখন থেকেই রাজ‍্যের উন্নয়ন স্তব্ধ থাকায় এবং এভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির চাপে রাজ‍্যের অর্থনীতি যত দূর্বল হতে লাগল, ততই বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক দৈন‍্যতার সুযোগ নিয়ে কম‍্যুনিস্টরা ভোটের সময় বিভিন্ন রকমের কারচুপির মাধ‍্যমে রাজ‍্যে তাদের আধিপত‍্য কায়েম রাখল। তারপর ধীরেধীরে তারা তাদের রেজিমেন্টেড শাসনের মাধ‍্যমে রাজ‍্যের মানুষকে তাদের অঙ্গুলীহেলনে চলতে বাধ‍্য করল।
আবার বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর মৃত‍্যুর পর সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে গেল! তারা নিজেদের দেশকে ইসলামি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ হিসেবে ‘ইসলামি’ তত্ত্বে বিভিন্ন ছুঁতোনাতায় বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার শুরু করল। তখন আবার দফায় দফায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু উদ্বাস্তুর ঢল নামল।
একে শাসকের ভুল সমাজনীতি ও অর্থনীতি, তায় এভাবে জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি, সঙ্গে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগীতার অভাব – সব মিলে শতধা বিভক্ত বাঙ্গালীর অবস্থা এমন হল যে তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেল। এমতাবস্থায় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলেন কম‍্যুনিস্টদের “মেধাবী ছাত্রী” মমতা বন্দোপাধ‍্যায়। তিনি ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে কম‍্যুনিস্ট শাসনের রেজিমেন্টেশানকে আরো তীব্র, সর্বব‍্যাপী ও বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে দিলেন। যে কোন কম‍্যুনিস্ট শাসনে যেমন শাসক পালিত ছাড়া কোন বিরোধী দল থাকে না – তেমনি পশ্চিমবঙ্গবাসী বিরোধীতার ভাষা হারিয়ে ক্রমশঃ শাসকের ক্রীড়নকে পরিণত হল। এই অবস্থায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আপামর বাঙ্গালীর ভাতা নির্ভরতা খাঁচায় আবদ্ধ সিংহের খাবারের জন‍্য লোলুপতাকে স্মরণ করায়।
হায় বাঙ্গালী – হিন্দু, মুসলমানের বেড়াজাল ভেঙ্গে কবে তুমি তোমার স্বাভিমানী চরিত্র ফিরে পাবার লড়াইয়ে সামিল হবে? এপার-ওপার, দু পারের বাঙ্গালীর সুদিন কি আর ফিরবে? আশায় থাকতে দোষ নেই।

মমতা ব‍্যানার্জীর জিহাদ কার বিরুদ্ধে

কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের ‘সুপ্রিমো’, মাননীয়া মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর পশ্চিম বর্ধমানের সভা থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছেন! এই জিহাদ তিনি শুরু করবেন তাঁর দলের ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশের সময় থেকে! বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি এই খবর সবিস্তারে, কেউ কেউ আবার উল্লাসপূর্বক, প্রচার করেছে। “জিহাদ” কথার উৎপত্তি এবং তার অর্থ জানা প্রয়োজন। “জিহাদ”(jihad) একটি আরবিক শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ হল – সংগ্রাম – অবশ‍্যই শব্দটি প্রশংসাসূচক! এটির ব‍্যবহার বিশেষতঃ আরবী দুনিয়া ও সেই সংস্কৃতির অনুসারী জায়গায় এবং এর প্রচলন ইসলামী সমাজে সীমাবদ্ধ। ক্ল‍াসিক‍্যাল ইসলামী আইন (ummah) মোতাবেক এটি কোন ধর্মান্তরকরন (ইসলাম ধর্মে) বা ইসলামী সমাজে আদর্শগত উন্নতির কারনে অ-ইসলামীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সুফী তত্ত্ব অনুসারে “জিহাদ” কথাটা আধ‍্যাত্মিক ও আদর্শগতভাবে ইসলামীদের উন্নতির সোপান। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ইসলামী উগ্রপন্থী এবং ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের মানবতা বিরোধী কার্যকলাপকে তারা এবং তাদের সমর্থকরা “জিহাদ” বলে অভিহিত করছে। প্রাথমিকভাবে এদের নাশকতামূলক কাজকর্ম এবং পুরুষতান্ত্রিক এক মধ‍্যযুগীয় বর্বর শাসনব‍্যবস্থা কায়েম করার সাম্রাজ‍্যবাদী নির্মমতাকে ইসলাম ধর্মের মোড়কে মাণ‍্যতা দেওয়ার (জায়েজ) পদ্ধতিকেই এরা “জিহাদ” বলছে – অর্থাৎ, মধ‍্যযুগীয় বর্বর পুরুষতান্ত্রিক শোষণ ব‍্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করাকেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে “জিহাদ” বলা হয়! যদিও কোরানে “জিহাদ” সামরিক অর্থ ছাড়াই একাধিকবার ব‍্যবহৃত হয়েছে; কোরানে – আল জিহাদ ফি সাবিল আল্লা, অর্থাৎ, আল্লার নির্দেশিত পথে থাকবার প্রচেষ্টা – একটি আত্মপরিশ্রমের পথ। তার জন‍্য ইসলামী ধর্মগুরুগণ কয়েকটি বিশেষ খুঁটিনাটিসহ নিয়ম জারি করেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে “জিহাদ” তার jurisprudence এর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিছু ইসলামী ধর্মগুরু জিহাদের হিংসাত্মক আগ্রাসী অর্থ বানিয়ে তার ক্লাসিক‍্যাল ব‍্যাখ‍্যাকে অর্থহীণ করে তুলেছে। সঙ্গে অবশ‍্যই অ-ইসলামীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী ও উগ্রপন্থীদের বিভিন্ন নাশকতা, হত‍্যা ইত‍্যাদি ঘৃণ‍্য কাজকে ধর্মীয় অনুমোদনের চেষ্টা করা হচ্ছে!
ভারতের ইসলামী সমাজের মধ‍্যে এই আধুনিক “জিহাদ”এর ব‍্যাপারে সাধারণভাবে দুই ধরনের বিভাজন লক্ষ‍্য করা যায়। একদল সংখ‍্যাগুরু মানুষদের “কাফের” মনে করে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জিহাদে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বা আড়ালে থেকে এই কাজে অংশগ্রহণকারীদের সাহায্য করে। আবার আরেকদল ইসলামী একাজে অংশগ্রহণ না করলেও তার বিরোধীতা না করে নিষ্ক্রিয় থাকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ‍্যাগুরু হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার, ধর্ষণ ইত‍্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন নাশকতায় লিপ্ত থাকা উগ্র ধর্মীয় সমাজবিরোধীরা যেমন শুধু ধর্মীয় কারনে হিন্দুদের সঙ্গে শত্রুতা করে, তেমনই ভারতের অখন্ডতার বিরোধীতা করে পাকিস্তানের প্রশংসা করে এবং অনেকে নাশকতার কাজে পাকিস্তানে তালিম নিয়ে আসে। অর্থাৎ এই সামরিক “জিহাদ” প্রকৃতপক্ষে ভারতবিরোধী এবং পাকিস্তান sponsored সন্ত্রাস।
ভারতের অভ‍্যন্তরে এই সন্ত্রাসের রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থনের অভাব কখনো হয়নি। প্রথমেই হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে, ভারতের কম‍্যুনিস্টদের কথাই ধরা যাক। এরা “ধর্মনিরপেক্ষতা” নামের একপ্রকার সোনার পাথরবাটির মত হিন্দুধর্মের যে কোন ধর্মীয় ক্রিয়াকান্ডের বিরোধীতা করে এবং একই সঙ্গে জিহাদী ও কট্টরপন্থী ইসলামীদের স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে কাজ করে। তারা অদ্ভুত কুযুক্তি দেখিয়ে সশস্ত্র হিন্দু-বিরোধীতার জিহাদকে সমর্থন করে! যে কোন লেখা, বক্তব‍্য বা চলচ্চিত্রে হিন্দুদের উপর অত‍্যাচারের কথা থাকলেই তারা তার বিরোধীতা করে। এমনকি তিস্তা জাভেদ শীতলবাদের মত কোন ইসলামীর ধর্মীয় পরিচয় গোপন রেখে তাকে হিন্দু সাজিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনী ব‍্যবস্থা গ্রহণের বিরোধীতা করে! এরা ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার বিরোধীতা করলেও পাকিস্তান গঠনকে সক্রিয় সমর্থন জানায়। একই সঙ্গে তারা বাংলা বিভাজনের বিরোধীতা করে সম্পূর্ণ বাংলা ও বতর্মান অসম, বর্তমান ত্রিপুরার কিয়দংশকে পূর্বপাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবী জানায়। এভাবেই কম‍্যুনিস্টদের জিহাদী রূপ দেখতে জনসাধারন অভ‍্যস্ত। কিন্তু এই মূহুর্তে দেশের কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল ক্ষয়িষ্ণু শক্তি কম‍্যুনিস্টদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জঙ্গী, জিহাদী কার্যকলাপে মদত দিচ্ছে কেন তা বিশ্লেষণ করার পর বিভিন্ন দল, বিশেষতঃ দলনেতা বা নেত্রীর ব‍্যক্তিস্বার্থ প্রধান কারন বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমেই দেশের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে এই দলের শোচনীয় রাজনৈতিক অবস্থার জন‍্য দায়ী এর অযোগ‍্য পারিবারিক নেতৃত্ব – যা আবার পার্টটাইম রাজনীতিতে অভ‍্যস্ত। সোনিয়া গান্ধী একে বিদেশীনী তায় ক‍্যাথলিক খ্রিষ্টান হওয়ার সুবাদে তাঁর পক্ষে হিন্দুত্বের অবক্ষয় কামনা করা স্বাভাবিক। সেকারনে, দেশের সংখ‍্যালঘু নামধারী ২৮% ইসলামীদের তোষণ করার নীতি নিয়ে তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মোকাবিলায় নেমেছেন। আবার নিজের ও ছেলের অত‍্যধিক ক্ষমতার লোভে হিন্দুবিরোধী জোটের ঘোঁট করে উদ্ধব ঠাকরে হিন্দুত্ব-বিরোধী রাজনীতির খপ্পরে পড়ে রাজনৈতিক আত্মহত‍্যা করতে বাধ‍্য হলেন। এসবই মাত্রাতিরিক্ত লালসার কারনে ঘটেছে। আরেকটি কথা, পশ্চিমবঙ্গের তথা সমগ্র ভারতের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি সেই জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই কম‍্যুনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। পরবর্তীকালে এই নিয়ন্ত্রণ আরো বিস্তৃত হয়েছে। এখন ত এমন অবস্থা যে, কম‍্যুনিস্ট এ‍্যাজেন্ডা মোতাবেক দেশবিরোধী এবং দেশের সরকার ও বিজেপি বিরোধী কথা বললেই media exposure পাওয়া যায়; অন‍্যথায় সংবাদ-মাধ‍্যমের গুরুত্ব পাওয়া যায় না! সব রাজনীতিকরাই সংবাদ-মাধ‍্যমে ভেসে থাকাকে অত‍্যন্ত গুরুত্ব দেন। সুতরাং….।
এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলের সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জীর জিহাদ ঘোষণার কারন বিশ্লেষণ করতে হবে। মমতাদেবীর modus operandi দেখলে তাঁর দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট‍্য ধরা পড়ে। প্রথমটি হল, মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী। অবশ‍্য রাজনীতিতে উচ্চাভিলাষ না থাকলে টিঁকে থাকা যায় না। দ্বিতীয়টি হল, অস্থিরমতি। তিনি কোন কাজ বেশীদিন ধরে একই গতিতে এবং একই পন্থায় করেছেন বলে জানা নেই। তাঁর কাজের একটি বড় বৈশিষ্ট‍্য হল, অত‍্যন্ত ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োগে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরী করে নিজের কাজ হাসিল করা! এ ব‍্যাপারে আমার ধারনা যে, এই মূহুর্তে মমতাদেবীই রাজনীতিকদের মধ‍্যে সবচেয়ে এগিয়ে। তাঁর মত একজন বরিষ্ট রাজনীতিক যে, “জিহাদী” connotation না জেনে বা আবেগের বশে বলে ফেলেছেন, তা মনে করার কোন কারন নেই। বরঞ্চ, এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনি জেনে,বুঝেই এ কাজটি করেছেন।
বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা দরকার। সাম্প্রতিককালে দেশবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এবং তাদের সমর্থকরাই কোন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের (এই মূহুর্তে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল) বিরুদ্ধে “জিহাদ” ঘোষণা করতে পারে। এমনকি মমতাদেবী জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর দল শহীদ দিবস পালনের দিন, সামনের ২১শে জুলাই থেকেই এই “জিহাদ” শুরু হবে! অতীতে আমরা দেখেছি যে, কোন সংগঠন যখন “জিহাদ” ঘোষণা করে তখন বিধর্মী মানুষদের, যাদের বিরুদ্ধে “জিহাদ” ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের হিংসাত্মক পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় – এমনকি খুণ,লুঠপাট, ধর্ষণ ইত‍্যাদিকে ইসলামী মৌলবাদের মোড়কে ধর্মীয় স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জনাব এম এ খানের লেখা “জিহাদ – জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ‍্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার” (Islamic Jihad A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery – by M. A. Khan) বইটি পড়ে বর্তমান সময়ে “জিহাদ” কথার আসল অর্থ বোঝা যায়।
এমতাবস্থায় শ্রীমতি ব‍্যানার্জীর ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল ও কম‍্যুনিস্ট দলের ইসলামী তোষণের নামে “জিহাদী” তোষণ হয়ে গেলে তা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের স্থায়ীত্বে রীতিমত প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেবে। আগ্রাসী ধর্মান্তরকরণ ও মধ‍্যযুগীয় সাম্রাজ‍্যবাদ বিস্তারের জন‍্য ইসলামকে কাজে লাগালে অন‍্য ধর্মের মানুষদের ত বটেই, ইসলামী মানুষদেরও বিপদ ডেকে আনবে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল আফগানিস্তান। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তিরা এই জিহাদের আহ্বানকে তাদের জবরদস্তি বিস্তারবাদী ধর্মান্তরকরণ ও সাম্রাজ‍্যবাদী মানসিকতার সফল প্রয়োগের সুযোগ করে দেবে। কাশ্মীরে আগে কিছু ইসলামী রাজনীতিক জিহাদের ডাক দিয়ে ভারত তথা কাশ্মীরী হিন্দুদের ক্ষতি ত করেইছেন, অধিকন্তু কাশ্মীরী মুসলমানদের একাংশকে বিপথগামী করেছেন এবং সেইসঙ্গে সমগ্র কাশ্মীরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি রুদ্ধ করেছেন। সেখানে কয়েকটি রাজনৈতিক পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের বিপুল সম্পত্তিবৃদ্ধি ছাড়া সাধারণ মানুষের অবস্থা দিন কে দিন ক্রমশঃ খারাপ হয়েছে। ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে ভারতীয়দের মধ‍্যে ঘৃণার পরিবেশ তৈরী করে এই রাজনীতিকরা দেশের চরম ক্ষতি করার সাথে সাথে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন।
আশার কথা এটুকুই যে, ইসলামী মানুষজনের একাংশ এদেশে এবং বাংলাদেশে এই ধর্মীয় জিহাদের স্বরূপ প্রকাশ করে তার যথার্থ বিরোধীতায় নেমেছে। কিন্তু ভারতের কম‍্যুনিস্ট সহ বেশ কিছু রাজনীতিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে হিন্দুত্ব ও ভারতবিরোধী শক্তিকে শুধু তোল্লা দিচ্ছে তা ই নয়, তারা একাজ করতে গিয়ে কখন যে ভারতের অখন্ডতার বিরোধীতা করছে – ভারতের জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা করছে, তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। শ্রীমতি ব‍্যানার্জী যেমন অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরোধীতা করছেন অস্থায়ী ট্রেণিং কাম চাকরীর কারনে, তেমন তিনি পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে বিনা ট্রেণিংয়ে মাসিক ছ হাজার টাকা মাইনের “সিভিক পুলিশ” নিয়োগের কৃতিত্ব নিচ্ছেন! সবকিছুতেই বিজেপি বিরোধীতা করতে গিয়ে কখন যে জিহাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে তামাক খেয়ে তা দেশবিরোধীতায় পরিণত হবে সেটা বোঝা যাবে না। আরেকটি কথা – পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের স্থায়ীত্বের প্রথম ও প্রধান শর্ত হল জাতীয়তাবাদ। আশ্চর্যজনকভাবে ভারতের যে রাজনীতিকরা ভারতের জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা করছে, তারা কিন্তু চীন বা রাশিয়ার জাতীয়তাবাদের নিন্দা করছে না। এমনকি ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার এইসব সমর্থকেরা চীন যখন নিজের দেশে ইসলামী ধর্মীয় অনুশাসন বন্ধ করার জন‍্য “চাইনিজ বাম” প্রয়োগ করে, তখন তার নিন্দা করে না। অর্থাৎ এদের নীতি দেশ ভিত্তিক! ভারতের জাতীয়তাবাদের ও জাতীয়তাবোধের বিরোধীতা এবং পাকিস্তানের স্বার্থ সহায়ক কাজে এদের আগ্রহ। কম‍্যুনিস্টদের মেধাবী ছাত্রী, মমতা ব‍্যানার্জী যে রাজনীতিতে তাদের পথই অবলম্বন করবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ভিন্ন, কাশ্মীর অপেক্ষা কিছুটা জটিলও বটে। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত এবং ‘অনুপ্রবেশ’ সমস‍্যা আছেই। তাছাড়া, পশ্চিমবঙ্গে ৩০% ইসলামী ও প্রায় ১৫% হিন্দু, ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার নামে “জিহাদ”পন্থী হওয়ায় মমতা ব‍্যানার্জীর এই ৪৫% টার্গেট ভোটার। তিনি ভোট প্রক্রিয়ার সময় প্রশাসনে থাকলে এই ৪৫% ভোট যদি তাঁর দিকে যায় তবে তাকে ভোটে হারানো অসম্ভব। কিন্তু তাঁর টার্গেট ভোটারদের মধ‍্যে অভিজ্ঞতার নিরিখে বিভাজন হলে তখন পরিস্থিতি অন‍্য রকম হতে পারে। সুতরাং অভিজ্ঞ রাজনীতিক শ্রীমতী ব‍্যানার্জী সচেতনভাবেই ইসলামী আবেগকে ব‍্যবহার করার প্রয়াসে “জিহাদ”কে তোল্লা দেওয়া হচ্ছে। এতে যেমন হিন্দুদের ক্ষতি হচ্ছে, তেমন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইসলামীদেরও ক্ষতি হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে শুধু জিহাদী উগ্রপন্থা ও কিছু রাজনীতিক। একজন বরিষ্ট রাজনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব‍্যানার্জীর এমন “জিহাদ” শুরু করার আহ্বানে রাজ‍্যে ইসলামী উগ্রপন্থীরা যে মদত পাবে তা বলাই বাহুল‍্য। এই ধর্মীয় জিহাদ যত তীব্র হবে ততই বিজেপি বা কোন রাজনৈতিক দল নয়, ভারত এবং বিশেষতঃ হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। ভারতের শত্রু রাষ্ট্ররা স্বাভাবিকভাবেই সে পরিস্থিতির সুযোগ নেবে। কাজেই এভাবে প‍্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেলে তা কোন গোষ্ঠীসংঘর্ষ বা এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন‍্য রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ নয়, তা ভারত ও ভারতীয়ত্বের সঙ্গে আরবী ধর্মীয় আগ্রাসনের সংগ্রাম শুরু করবে। তখন কিন্তু মমতা ব‍্যানার্জী বা তাঁর তৃণমূল দলের নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে না।

পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ‍্যসাথী প্রকল্প শুধুই ঢক্কানিনাদ

ভারত সরকার দেশবাসীর জন‍্য “আয়ুস্মান ভারত স্বাস্থ‍্য প্রকল্প” করেছে – যার ৬০% টাকা ভারত সরকারের আর ৪০% টাকা রাজ‍্য সরকারের থেকে আসে। যেহেতু স্বাস্থ‍্য পরিষেবা কেন্দ্র-রাজ‍্য সরকারের যৌথ দায়িত্বে পড়ে, এই প্রকল্পে উভয়ের অংশগ্রহণে প্রকল্পটি রাজ‍্যের গরীব ও প্রান্তিক মানুষজনের উপকারে আসতে পারত। কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গে “ভারত” নাম থাকলে সেই প্রকল্প চালাতে দেওয়া হয়না! সে কারনে ২০১৬ সালে প্রান্তিক মানুষের জন‍্য রাজ‍্য সরকারের নিজস্ব প্রকল্প “স্বাস্থ‍্য-সাথী” চালু করা হল। অত‍্যন্ত দুঃখের হলেও একথা সত‍্যি যে, এই রাজ‍্যে সরকারের সব কাজকর্ম চলে শুধুমাত্র রাজনীতির স্বার্থে।
দেশের গরীব ও প্রান্তিক মানুষের জন‍্য ২০০৮ সালে অনেক ঢক্কানিনাদের সাথে চালু হয় “জাতীয় স্বাস্থ‍্য সুরক্ষা প্রকল্প”। ২০১৮ সালে এই প্রকল্পের বদলে আধুনিক, যুগোপযোগী প্রকল্প এল “আয়ুস্মান ভারত” – এটি অনেক broad based প্রকল্প। এই প্রকল্পে দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষকে কভার করা হয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ‍্য ছিল, স্বাস্থ‍্যখাতে অত‍্যধিক খরচের কারনে দেশের যে ৬ কোটি প্রান্তিক মানুষকে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যেতে হয়েছে, তাদের সেকেন্ডারী ও টারসিয়ারী স্বাস্থ‍্য পরিষেবায় হাসপাতাল খরচের বোঝা লাঘব করা। যেজন‍্য এই প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপক চয়নের প্রক্রিয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ‍্যে তাদের চাহিদা ও socio-economic caste অনুযায়ী ২০১১ সালের জনগণনাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে এই প্রকল্প তৈরী হয়েছে। এতে বহির্বিভাগর চিকিৎসাকে যেমন রাখা হয়নি, তেমনি প্রতি পরিবারের (একজনের নামে কার্ড থাকলেই পুরো পরিবার কভার হবে) জন‍্য প্রতি বছর ৫ লাখ টাকার ক‍্যাপ করা হয়েছে। এই খরচের হিসেব কেন্দ্রীয় বাজেটে আলাদাভাবে ধরা আছে।
রাজ‍্যের “অনুপ্রাণিত” সরকারের “ভারত” বা “আয়ুস্মান” – কোন নামে এলার্জি আছে জানিনা – পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ২০১৬ সালে “স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্প” ঘোষণা করা হল! প্রকল্পটি চালু হলেও বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল, যারা এই প্রকল্পে যোগদান করেছে, স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডের রোগীদের ভর্তি নিতে অস্বীকার করে! কারন হিসেবে রাজ‍্যসরকারের তরফে চিকিৎসা খরচের প্রাপ‍্য টাকা না মেটানোর কথা বলা হয়। যার ফলে, রোগীর হেনস্তা ও হাসপাতাল ভাঙ্গচুরের মত ঘটনা ঘটে। যে বীমার মাত্র ৪০% টাকা রাজ‍্য সরকারের দায়, তা না নিয়ে ১০০% দায় নেওয়া প্রকল্প চালু করা কতখানি প্রশাসনিক বিচক্ষণতার পরিচয়, সেটা বোঝার জন‍্য বিশেষ বুদ্ধির দরকার হয়না। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে রাজ‍্য সরকারের এই প্রকল্পের অপমৃত‍্যু প্রত‍্যাশিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল ভাবতে লাগল – কিভাবে ২০২১এর রাজ‍্য বিধানসভা নির্বাচন জেতা যাবে। এই দলের modus operandi দেখলে এদের কার্যপদ্ধতির একটি নির্দিষ্ট ছক লক্ষ‍্য করা যায় – এরা এমন কোন আর্থিক দিক থেকে সুবিধাজনক প্রকল্প নিয়ে আসে যাতে রাজ‍্যের অধিক সংখ‍্যক মানুষ উৎফুল্ল হয় এবং তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা পায়। পুরো প্রকল্পের বাস্তবতা এবং তার স্থায়ীত্বের বিষয়ে এরা মোটেই চিন্তাভাবনা করে না! সবকিছুই একজনের অনুপ্রেঢ়না উদ্ভুত আইডিয়া – তার সম্ভাব‍্যতা বিষয়ে এই রাজ‍্য প্রশাসনের কোন সুস্থ‍ চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। আর সে কারনেই এইসব প্রকল্পের অপমৃত‍্যু ঘটে।
স্বাস্থ‍্য-সাথীর ক্ষেত্রেও তার কোন ব‍্যত‍্যয় হল না। ২০২১এর নির্বাচনের আগে “অনুপ্রাণিত” পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২৬শে নভেম্বর, ২০২০র বিধানসভার নির্বাচনের আগে ঘোষণা করে দিল যে, পশ্চিমবঙ্গের সকল বাসিন্দা (যারা ইতিমধ্যেই সরকারী কোন স্বাস্থ‍্য প্রকল্পের অধীনে আছেন তারা বাদে) স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্পের আওতায় আসবে। পরিবারের একজনের নামে স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ড থাকলেও কার্ডের চিপ-এ পরিবারের সকল ব‍্যক্তির নাম ও পরিচয় পাওয়া যাবে। খরচের ক‍্যাপ অবশ‍্য সেই পরিবার পিছু বাৎসরিক ৫ লক্ষ টাকাই থাকল। এই কার্ডটিও কিন্তু সেকেন্ডারী ও টারসিয়ারী স্বাস্থ‍্য পরিষেবার ক্ষেত্রে (hospitalization) শুধু প্রযোজ‍্য। কিন্তু গ্রাম বাংলার বেশীরভাগ মানুষ আউটডোরে যে প্রাইমারী স্বাস্থ‍্য পরিষেবা নেয়, সেখানে কোন রকম সাহায‍্য এই কার্ডে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়! অনেকটা আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের নাম বদলে কপি-কাট-পেস্ট! ঐ ঘোষণার দিনের আগে পর্যন্ত রাজ‍্যে প্রায় ৫০০টির মত হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের সঙ্গে রাজ‍্যসরকারের টাই-আপ থাকলেও পরবর্তীকালে ২০২১ সালে সেটি বেড়ে গিয়ে ১৫৯০টি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের লিস্ট পাওআ গেল। রাজ‍্য সরকারের বক্তব‍্য অনুযায়ী এতে দেড়কোটি পরিবারের মোট ৭.৫ কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছেন!
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “বিজ্ঞাপনের গরু গাছে চড়ে”। স্বাস্থ‍্য- সাথী প্রকল্পের “অনুপ্রাণিত” ঢক্কানিনাদ ও পদলেহনকারী কিছু সংবাদ-মাধ‍্যমের “হুক্কা হুয়া” রবে রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ ভাবতে লাগলেন, রাজ‍্য সরকার এই সুযোগ করে দিয়ে স্বাস্থ‍্য ফ্রন্টে বিশাল বিপ্লব ঘটিয়ে দিল!
আসলে সব ফক্কা। রাজ‍্য সরকারের স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্প প্রথম থেকেই একটি অসুস্থ চিন্তাধারার (ill-conceived) প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পে যে সুবিধা দেশের প্রান্তিক মানুষের জন‍্য আনা হয়েছে সেখানে মোট খরচের মাত্র ৪০% রাজ‍্য সরকারের বহন করার কথা। কারন, খরচের ৬০% কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়ার কথা। সব রাজ‍্যে এই ব‍্যবস্থা চলছে। এই প্রকল্প গ্রহণ করে রাজ‍্য সরকার রাজ‍্যের প্রান্তিক মানুষদের স্বল্পব‍্যায়ে এই প্রকল্পের সুফল দিতে পারত। কিন্তু, এই রাজ‍্য সরকার বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতায় কাজ করে না – রাজ‍্য চলে “অনুপ্রেঢ়ণা”য়। হয়ত কারো মনে হল, কেন্দ্র এই প্রকল্প চালু করলে বিজেপির রাজনৈতিক লাভ হবে – এমন ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে একরোখাভাবে “স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্প” প্রান্তিক মানুষের পরিবর্তে রাজ‍্যের প্রায় সকল মানুষের জন‍্য চালু করার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল! অথচ এই খরচের জন‍্য বীমা সংস্থাগুলি যে টাকা নেবে তা দেওয়ার কোন সংস্থান বাজেট বরাদ্দে রাখা হল না! সুতরাং “সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙ্গে” – গোছের ছেলে ভুলানো বিজ্ঞপ্তি ও বশংবদ সংবাদ-মাধ‍্যম মারফৎ তার প্রচার, যেখানে স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্পের কথা বারবার এমনভাবে প্রচার করা হতে লাগল, যেন পৃথিবী ত দূর, বিশ্বব্রহ্মান্ডের আর কোথাও মানুষ এমন স্বাস্থ‍্য পরিষেবা পায় না, যা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পেতে চলেছেন!
সময় এগিয়ে চলল। ভোটশেষ। আবার অনুপ্রেঢ়ণায় সরকার প্রতিষ্ঠিত হল। তারপর স্বাস্থ‍্য-সাথীর হাল কি হল? কিছু বশংবদ সংবাদ-মাধ‍্যম অব্দি জানালো যে, স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও নার্সিংহোম মানছে না! এর কারন খুব পরিষ্কার। এই কার্ডে চিকিৎসার খরচ রাজ‍্য সরকারের মেটানোর কথা। কোন বীমা সংস্থা খুব কম টাকায় অর্থ বীমা করলে তারা নিশ্চয়ই চিকিৎসার অধিকাংশ অর্থ বহন করবে না। এটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাজ‍্য সরকারের এই টাকা দেওয়ার পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নেই। সেজন‍্য এক অন‍্য খেলা শুরু করা হল। সরকার এমন পদক্ষেপ করল যাতে সরকারের উপর আর্থিক চাপ না পড়ে আর এই কার্ডও ধীরে ধীরে রাজ‍্য সরকারের সবার জন‍্য রেশন কার্ডের মত হয়ে যায়!
যখন সরকার “দুয়ারে সরকার” প্রকল্প চালু করল, তখন এই স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডের জন‍্য খুব কম সময় ধার্য করে রাখল। আবেদনের মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হলেও কোন খবর নেই যে কবে বায়োমেট্রি করে কার্ড দেওয়া হবে! বিশেষতঃ যেখানে একজন মানুষের পরিবার, সেখানে কোন স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ড ইস‍্যু করা হচ্ছে না! আবার এমন কোন সরকারী বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি যে, এদের স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ড দেওয়া হবে না – কারন তাদের স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার প্রথমে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন বেসরকারী বীমা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই খাতে সরকারের খরচ হবে ২০০০ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছরের হিসেব বলছে যে এখনো পর্যন্ত এই খাতে খরচ হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা মাত্র! এখন বীমা সংস্থাগুলির চিকিৎসা বীমার খরচ মেটানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম রাইডার থাকার কারনে রাজ‍্য সরকার সরাসরি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিকে স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডের চিকিৎসা খরচ মেটায়। এই নিয়ে সরকারের পেমেন্ট মেটানোর ব‍্যপারে বিস্তর অভিযোগ থাকায় বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলির সিংহভাগই স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডে সুবিধা দিতে নারাজ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং “অনুপ্রেঢ়ণা” অনেক হম্বিতম্বি করলেও এখনো অব্দি সরকারী বিজ্ঞপ্তি জারি করে কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকার শুধু মাঝেমধ‍্যে এ‍্যাডভাইসারি জারি করেছে, যা মানার কোন আইনী বাধ‍্যবাধকতা নেই। এইভাবেই স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ‍্যতা নষ্ট না করলে এই প্রকল্পের বিপুল খরচের বোঝা টানার ক্ষমতা কোন রাজ‍্য সরকারের নেই – এই সরল সত‍্যিটা উপলব্ধি করেই প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ! অবশ‍্যই অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ‍্যম এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে।
এখানে একটি বিষয়ের অবতারনা করার প্রয়োজন। দিল্লীর আম আদমী সরকার এমন প্রকল্প করে টাকা নষ্ট (দুর্জনে বলে টাকা নয়ছয়) করেনি। তারা স্বাস্থ‍্যখাতে বাজেট বরাদ্দের একটা বড় অংশ রাজ‍্যের হাসপাতালগুলির মানোন্নয়নে কাজে লাগিয়ে দিল্লীবাসীকে হাসপাতালের সহজলভ‍্য – অনেকক্ষেত্রে ফ্রি – চিকিৎসার সুযোগ করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডের রাজনৈতিক ফয়দা তুললেও রাজ‍্যের সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রগুলির স্বাস্থ‍্যকেই সময়ের সাথে সাথে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর করেছে। সরকারী হাসপাতালগুলির তথাকথিত “রোগী কল‍্যাণ সমিতি” তৈরী করে এবং দলীয় নেতৃত্বের হাতে তার দায়িত্ব তুলে দিয়ে হাসপাতালগুলিতে সমান্তরাল প্রশাসন তৈরী করা হয়েছে। হাসপাতালের অবকাঠামোর উন্নতি দূরের কথা, অবনতি লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে। ডাক্তার, নার্স ও অন‍্যান‍্য সাপোর্টকর্মীর অপ্রতুলতা প্রতিটি হাসপাতালের সুষ্ঠু সেবা চালানোর অন্তরায় হচ্ছে। দিনকে দিন অবস্থা ঘোরালো হচ্ছে।
পরিশেষে স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্পের বিষয়ে গত ৯ই জুন, ২০২২ তারিখের একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তির উল্লেখ করছি যেখানে ভেলোরের খ্রীষ্টান মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ডে চিকিৎসার ব‍্যাপারে আগে অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে! দুটি বিন্দু উল্লেখ করা হয়েছে – প্রথমটিতে বলা হয়েছে, গুরুতর অসুস্থ (critical cases) রোগীদের ওখানে চিকিৎসা করা যাবে যদি তাদের স্বাস্থ‍্যভবনের থেকে ঐ প্রকল্পের জন‍্য “prior approval” থাকে। দ্বিতীয় বিন্দুতে বলা হয়েছে, কোন চিকিৎসকের সুপারিশ থাকা এবং তা রাজ‍্যের নোডাল এজেন্সির দ্বারা গৃহীত হলে তবেই এই চিকিৎসা করানো যাবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, এই রাজ‍্যের কোন চিকিৎসা কেন্দ্রেই ঐ চিকিৎসা সম্ভব নয়! এমন সার্টিফিকেট এই “অনুপ্রানিত” রাজ‍্যের কোন চিকিৎসক দেওয়ার হিম্মত রাখেন কি? অতয়েব, স্বাস্থ‍্য-সাথী কার্ড নাও, কিন্তু ফ্রি চিকিৎসা চেয়োনা! স্বাস্থ‍্য-সাথী প্রকল্পের গঙ্গাজলী যাত্রা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

অগ্নিপথ একটি যুগান্তকারী প্রকল্প

ভারত সরকারের অগ্নিপথ প্রকল্প আমাদের সেনাবাহিনীকে শুধু সম্বৃদ্ধ করবে তা ই নয়, দেশের যুবশক্তির মধ‍্যে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করবে। অল্পকথায় বলতে গেলে, এটি ১৭ থেকে ২৩ বছর (শুধু বর্তমান বছরের জন‍্য, অন‍্যথায় ২১ বছর) বয়সের যুবকদের জন‍্য (যুবতীরা নেভির জন‍্য বিবেচিত হবেন) একটি ঐচ্ছিক ট্রেণিং প্রকল্প। এই প্রকল্পে ছমাসের ট্রেণিংসহ মোট কাজ করার সময় চার বছর। শিক্ষান্তে ট্রেণিদের, যাদের “অগ্নিবীর” বলা হবে, থেকে বাছাই করে ২৫% অগ্নিবীরকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে স্থায়ী কমিশন্ড হিসেবে নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। বাকীরা চার বছরের শেষে সার্টিফিকেট পাবে এবং এই ট্রেণিংয়ের পরে তাদের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থায় কর্মসংস্থানের সুবিধে হবে। এছাড়া সরকারের কিছু কিছু দপ্তরে, যেমন সিভিল ডিফেন্স, চাকরীর ক্ষেত্রে এই অগ্নিবীরদের ১০% সংরক্ষণ কোটা করা হবে। তাদের বছরে প্রায় ৫ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ টাকা ভাতা দেওয়া হবে। ভাতার উপর নির্ভর করে মাসে ৯ থেকে ১১ হাজার টাকা কেটে রেখে চার বছরের শেষে সর্বোচ্চ সুদসহ করমুক্ত ১২ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। প্রত‍্যেক অগ্নিবীরের জন‍্য সরকার ৪৮ লক্ষ টাকার বীমার সংস্থান রাখছে। এছাড়া, সামরিক বাহিনীর সদস‍্যদের মত এদেরও ফ্রি রেশন, মেডিক্যাল ও অন‍্যান‍্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।
পৃথিবীর বহু দেশ, যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইরান, ইজরায়েল, বারমুডা, সাইপ্রাস, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সিঙ্গাপুর, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়া – এইসব দেশে এমন প্রকল্প আছে। সেগুলো কিন্তু আমাদের মত ঐচ্ছিক নয় – আবশ‍্যিক, অর্থাৎ conscription করা হয়। এদের প্রত‍্যেকের প্রকল্পগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সবার মধ‍্যে আমাদের দেশের প্রকল্পই ট্রেণিদের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক। তাছাড়া, ট্রেণিংয়ের শেষে ২৫% শিক্ষার্থীর স্থায়ী ক‍্যাডারে যোগদানের সুযোগ এইসব দেশের প্রায় কারোরই নেই। উত্তর কোরিয়াতে ত ১৪ বছরেই conscriptuon করা হয় – চলে ৩০ বছর বয়েস অব্দি! তাদের ভাতাও অতি নগণ‍্য। আমাদের ভাতা রাশিয়ার থেকে বেশী! আমাদের অগ্নিপথ প্রকল্প রাশিয়া, ইজরায়েল, ইরান ও তুরস্কের থেকে অনেকটাই ভালো।
তবু কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে – হিংসাত্মক বিক্ষোভের মূল লক্ষ‍্য সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করা! কংগ্রেস দলের পারিবারিক সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দলকে অগ্নিপথের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। উদ্দেশ‍্য একটাই – ভারতের প্রতিরক্ষা ব‍্যাবস্থা দুর্বল হোক। সোনিয়া গান্ধীর বাবা, স্টেফানো মাইনো ছিলেন রাশিয়ার কম‍্যুনিস্ট দলের অনুগামী (তখনকার ইটালীর বেশ কিছু মানুষ রাশিয়ার অনুপ্রেরণায় ইটালীয়ান কম‍্যুনিস্টদল গঠন করে)। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইটালীর সৈন‍্যদলে যোগ না দিয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। আবার সেই রাশিয়াতে কিন্তু আইনমাফিক সামরিক ট্রেণিং বাধ‍্যতামূলক! বিহারের এক কম‍্যুনিস্ট নেতা (যিনি আবার জেহাদী ইসলামের সমর্থক) বলেছেন, অগ্নিপথ প্রকল্প বাতিল করতে হবে! আমি সরাসরি তাঁকে চ‍্যালেঞ্জ করছি, ক্ষমতা থাকলে একই রকম প্রকল্প চালু রাখার জন‍্য রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া আর তাদের বিশেষ বন্ধু রাষ্ট্র তুরস্ক ও ইরানকে এমন প্রকল্প চালু রাখার জন‍্য নিন্দা করে বিবৃতি দিক – সে ক্ষমতা এসব বিদেশী রাষ্ট্রশক্তির দালালী করা কাগুজে নেতাদের নেই। ভারতের প্রতিরক্ষা দূর্বল করার চেষ্টা একটি কারনেই করা – পাকিস্তান ও চীনের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন‍্য কাজ করা। একই কথা সোনিয়া গান্ধীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য।
এখানে একটি তথ‍্যের অবতারনা করা বোধহয় প্রাসঙ্গিক হবে। তাহল, গত কয়েক বছরে দেশে অনলাইন কোচিং সেন্টার বা কোচিং কোম্পানীগুলির বাড়বাড়ন্ত। এদের এক একটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণ বিশাল! এতে বিদেশ থেকেও মোটা অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি কেন্দ্রীয়ভাবে এবং রাজ‍্য বিশেষে হাজার হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয়! এদের সম্পর্কে সাধারন মানুষের আলাদা করে কোন কৌতুহল ছিল না। কিন্তু হায়দ্রাবাদ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও বিহারে অগ্নিপথ প্রকল্প বিরোধী মূখ‍্য চরিত্র হিসেবে এমন ই-কোচিংয়ের মালিকদের নাম উঠে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ এইসব কোম্পানীর modus operandi এবং এদের অর্থ বিনিয়োগের ব‍্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা। এরা বিভিন্ন ট্রেণিং ও পেশার ডিগ্রি কোর্সে ভর্তির পরীক্ষারও তালিম দেয় – অবশ‍্যই উচ্চহারে ফি নিয়ে। পরীক্ষার কৃতকার্যতার কোন নিশ্চয়তা নেই! আবার, বিভিন্ন গবেষণার কাজে, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রির জন‍্য গবেষণার কাজে যোগ‍্যতায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্নাতকোত্তর প্রার্থীদের জন‍্য বরাদ্দ ভাতার চেয়ে উচ্চমাধ‍্যমিক পাশ অগ্নিবীরদের ভাতার পরিমাণ অনেক বেশী। এছাড়া, অগ্নিবীরদের খাওয়া থাকা সহ বিভিন্ন পরিসেবা একদম ফ্রী। মেয়াদ অন্তে ২৫% অগ্নিবীরের স্থায়ী ক‍্যাডারে চাকরীর সুযোগ থাকায় এদের মধ‍্যে একে অন‍্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার স্বাস্থ‍্যকর প্রতিযোগীতা থাকবে। যেসব অগ্নিবীর সেনাবাহিনীতে স্থায়ী চাকরী পাবে না, তারা বিভিন্ন সরকারপোষিত ও সরকারী সংস্থায় চাকরীতে ১০% সংরক্ষণ পাবে। এছাড়া তাদের ট্রেণিংয়ের কারনে তারা বেসরকারী সংস্থায় চাকরী পাবে। যারা ব‍্যবসা করতে চায়, সেসব অগ্নিবীরদের মূলধনের জন‍্য ব‍্যাঙ্কগুলি সহজ প্রকল্পে তাদের মূলধন যোগাবে। অন‍্য কোন দেশ কিন্তু এই সুবিধা দেয় না।
এক অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করে এই প্রকল্পের বিরোধীতা করা হচ্ছে – চার বছর ট্রেণিংয়ের পর সবাইকে নাকি স্থায়ী চাকরী দিতে হবে! কম‍্যুনিস্টসহ যে সব বিরোধী রাজনীতিবিদ একথা বলছেন, তারা তাদের শাসনে থাকা রাজ‍্যে কিন্তু কোন ট্রেণিং বা কোর্স করার পর স্থায়ী চাকরী দেননি বা দেওয়ার কোন প্রকল্প করেননি! সদ‍্য পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীসভায় পাশ করা হয়েছে একটি ট্রেণিং প্রকল্প, যেখানে ট্রেণিং শেষে চাকরীর কোন প্রতিশ্রুতি নেই – শুধুমাত্র ট্রেণিংকালে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে – অবশ‍্যই অন‍্য কোন সুবিধাছাড়া! পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী চাকরীগুলো তুলে দিয়ে শুধু চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। বিনা ট্রেণিংয়ে নিযুক্ত “সিভিক” পুলিশের চুক্তিভিত্তিক বেতন মাসিক পাঁচ হাজার টাকা, আবার স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানোর “সিভিক” শিক্ষকেরও মাসিক বেতন পাঁচ হাজার টাকা। এখানে “অনুপ্রেঢ়না”য় চাকরী হয় বা যায়! এখান থেকে যখন অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে অনুপ্রেঢ়না-বাণী শুনতে হয়, তখন একটিই পুরানো প্রবাদ মনে পড়ে – “চোরের মায়ের বড় গলা”! এইসব যারা করে, তারা যখন “অগ্নিপথ প্রকল্প”কে আটকাতে হিংসাত্মক ও ধ্বংসকারী আন্দোলনকে উস্কানি দিয়ে বক্তব‍্য রাখেন, তখন দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করছেন শুধু ভারতের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানার জন‍্য – শত্রুরাষ্ট্রের “হাতে তামাক খাওয়া”। এরা কেউই কম‍্যুনিস্ট দেশগুলি ও ইসলামী দেশগুলির বাধ‍্যতামূলক (conscripted) সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলে না বলেই এদের ভারতের জাতীয়তাবাদ বিরোধী অভিপ্রায় বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এই বিরোধীরা আমাদের সেনাবাহিনীর দীর্ঘ সময় ধরে চালু ব‍্যাবস্থার কথা কিছু বলছে না। আমাদের সেনাবাহিনীতে দু ধরনের কমিশন্ড হয়। একটি পার্মানেন্ট বা স্থায়ী – এখানে অফিসাররা তাদের র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী ও চাকরীর সময় অনুসারে তাদের চাকরীর মেয়াদ পূর্ণ করেন এবং অবসরগ্রহণের পর পেনশন পান। আবার বড় সংখ‍্যায় মানুষ সেনাবাহিনীর সব বিভাগেই শর্ট কমিশন্ড হিসাবেই সার্ভিস দেন। এদের বাহিনীতে বিশেষ কয়েকবছরের সার্ভিস দেওয়ার কথা। তারপর এঁরা যখন সেনাবাহিনী থেকে সরে যান, এককালীন exgratia সহ এঁরাও অবসরকালীন টাকা পান। সেইসঙ্গে এরা যোগ‍্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারী চাকরীতে – এমনকি ক‍্যাডার ভিত্তিক IAS ও IPsএও এরা যোগ দিতে পারেন। এঁদের জন‍্য সংরক্ষিত কোটার প্রবন্ধন করা আছে। সোনিয়া গান্ধীর কাছে আমার জিজ্ঞাস‍্য – আপনার স্বামী, শাশুড়ি এবং দাদাশ্বশুর প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় যে সিস্টেম চালু ছিল, আপনি কি তার বিরোধীতা করছেন? এই অগ্নিপথ প্রকল্প ত শর্ট কমিশন্ড সার্ভিসেরই আধুনিক ও উন্নততর সংস্করণ। এর বিরোধীতা করা মানুষজনের মোটিভ ও তাঁদের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, তাঁরা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা করার অছিলায় ভারতের সার্বভৌমত্বের বিরোধীতা করছেন, যা দেশের অখন্ডতা রক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক।
অগ্নিবীরদের তৈরী করার মাধ‍্যমে ভারতের যুবশক্তির মধ‍্যে জাতীয়তাবোধের চারাগাছ রোপধ করার প্রচেষ্টা লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে। অবশ‍্যই একাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে – গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে ভারতবিরোধী শক্তির হাতে তামাক খাওয়া রাজনীতিবিদদের শতবাধা সত্বেও। আরেকটি ব‍্যপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে – জেহাদীশক্তি যেন কোনভাবে এর সুযোগ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে না পারে।