এ কোন অচেনা পশ্চিমবঙ্গ

বিস্তীর্ণ দু পারের অসংখ‍্য মানুষের
হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে
ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছ কেন।
নৈতিকতার শ্খলন দেখেও
মানবতার পতন দেখেও
নির্লজ্জ অলসভাবে বইছ কেন……
তবু যুক্তি বলে মা গঙ্গা এই পাহাড় প্রমাণ অনাচারের মধ‍্যে স্বাভাবিক গতিতে বয়ে চলেছে – আর তাকেই স্বাভাবিকতার ছবি হিসেবে দেখানো হচ্ছে! হিংসা, অত‍্যাচার, অনাচারের মরুদ‍্যানে আমরা একমাত্র ওয়েসিস হিসেবে জানতাম বিচার ব‍্যবস্থাকে। রাজ‍্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেখিয়েছে, কমিটেড জুডিসিয়ারী কি হতে পারে। সেইসঙ্গে বিচার ব‍্যবস্থার উপর সংঘবদ্ধ বলপ্রয়োগের খন্ডহার দেখা যাচ্ছে। মনুষ‍্যত্ত্বহীণ রাজনীতির উলঙ্গ নেতৃত্বের ছবি চারদিকে দৃশ‍্যমান। আগে অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ‍্যম এসব ‘ছোট ঘটনা’ প্রকাশের মত তুচ্ছ কাজ করত না! এখন এ ঘটনা নিত‍্যনৈমিত্তিক অভিজ্ঞতার অঙ্গ হওয়ায় আর তা গোপন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বগটুইয়ের গণহত‍্যার নৃশংসতা ও তৎপরবর্তী প্রশাসনিক গাফিলতি শুধু শাসকের সংবেদনশীলতার অভাবই প্রমাণ করে না, প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে বিরোধী রাজনীতির উপর মিথ‍্যা দোষ চাপিয়ে সাম্প্রদায়িক তাস খেলতেও দেখা যায়। তারপর একে একে যত ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা খবর হতে থাকে ও সেখানে অভিযুক্ত হিসেবে শাসকদলের বিভিন্ন নেতার নাম প্রকাশ‍্যে আসতে থাকে। সংবাদ-মাধ‍্যম এসব ঘটনা আগে প্রকাশ না করায় শাসকের এই সমস‍্যা মোকাবেলা করার ইচ্ছে ও যোগ‍্যতা কোনটাই ছিল না। সেজন‍্য এখনকার পরিস্থিতিতে শাসকের ধৈর্য‍্যচ‍্যুতি ঘটে। হাঁসখালির ঘটনার পর রাজ‍্যের প্রশাসনের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ব‍্যক্তি বললেন, যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করার পরদিন মৃত‍্যু হয় ও বেয়াইনীভাবে তার দেহ সাধারন মৃত‍্যুর মত পোষ্টমর্টেম না করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সে অন্তঃসত্বা থাকতে পারে, তার ধর্ষকের সঙ্গে ভালোবাসা থাকতে পারে ইত‍্যাদি! “বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ” – এই নীতির প্রয়োগে ডিস্ট্রিক্টের পুলিশ কর্তা ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে বললেন, ঐ মেয়েটি নাকি মদ‍্যপান করেছিল আর সে মদ‍্যপানে অভ‍্যস্ত ছিল! ভিসেরা টেষ্ট না হলে কিভাবে এ তথ‍্য পাওয়া যায়! আচ্ছা, রাজ‍্যের এইসব ‘অনুপ্রাণিত’ কর্তাদের বিদ‍্যাবুদ্ধি কতদূর – সে প্রশ্ন আজ মানুষের মনে আসাই স্বাভাবিক। আরেকটি কথা – হাইকোর্টের আদেশে CBI এই ঘটনার তদন্ত করছে। এক্ষেত্রে রাজ‍্যের কোন পুলিশ আধিকারিক এবং স্বয়ং মন্ত্রী বা মূখ‍্যমন্ত্রীর এ ধরনের প্রমাণবিহীন মন্তব‍্য তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, তদন্তকে প্রভাবিত করার জন‍্য CBI তাঁদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও আশ্চর্য হতে হয়। রাজ‍্যের এতগুলি ঘটনার তদন্ত করছে CBI – এখনো একটি ঘটনার তদন্ত শেষ করে আদালতে ফাইনাল চার্জশিট পেশ করেনি! আমাদের সকলের কাছে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার। রাজ‍্যের পুলিশ যেমন রাজ‍্যের শাসকের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত সংস্থা CBI। রাজ‍্যের বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে কেন্দ্রের অধীন CBI নিঃসন্দেহে তাদের তদন্তের ব‍্যপারে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ‍্য। রাজ‍্যের সাধারন মানুষ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারী করা যেমন দেখছে, তেমনই CBI এর বিভিন্ন তদন্ত এবং সেগুলির মেগাসিরিয়ালের মত গতি প্রকৃতিও লক্ষ‍্য করছে। আমি রাজ‍্য পুলিশ বা CBI এর কর্মদক্ষতার উপর সন্দেহ প্রকাশ করছি না কারন তাদের কর্মদক্ষতার ভূরিভূরি উদাহরণ আছে। তবে দুই সংস্থার রাজনীতিকরন সম্পূর্ণ হয়েছে বলাই যায়। এই CBI মহারাষ্ট্র সরকারের অতি প্রভাবশালী মন্ত্রীকে গেপ্তার করে জেলে রাখতে পারে, সেখানের প্রাক্তণ পুলিশ কমিশনারকে গ্রেপ্তার করতে পারে; আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যখনই রাজ‍্যের শাসকদলের কোন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নোটিশ জারি করে তখনই তাঁরা একটি বিশেষ সরকারী হাসপাতালের বিশেষ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যান। আস্তে আস্তে CBI ঐ কেসে ঝিমিয়ে পড়ে। বছরের পর বছর একই স্ক্রিপ্টের কৌতুকাভিনয় দেখে দেখে জনসাধারণ ক্লান্ত! প্রত‍্যেক নেতার বক্তব‍্য একই – “আইন আইনের পথে চলবে” তারপর ঐ বিশেষ নেতার মামলা CBI দপ্তরে শীতঘুমে চলে যায়। এই রাজ‍্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের অদৃশ‍্য অঙ্গুলীহেলনের ইনভেস্টিগেশনে সাধারন মানুষ বীতশ্রদ্ধ।
মনে প্রশ্ন জাগে, যে ৫৬ ইঞ্চির গর্ব করা হয় কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন‍্য ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলোপ করার কৃতিত্ব দিয়ে, সেই একই ‘৫৬ ইঞ্চি’র নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব কি নেই পশ্চিমবঙ্গকে আফগানিস্তান হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর? অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের বিচার-ব‍্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখে – উচ্চ ন‍্যায়ালয়ের বিচারকদের সততা আজ প্রশ্নের মুখে। আবার উচ্চ ন‍্যায়ালয়ের এক বিচারকের রায় শাসকদলের অপছন্দ হওয়ায় সেই বিচারকের এজলাস বন্ধ করার আন্দোলনের নামে বলপ্রয়োগ – ফ‍্যসিবাদী শক্তিকে মনে পড়ায়। শাসকের অসহিষ্ণুতার বলি হচ্ছে সাধারণ নাগরিক। ডিভিশান বেঞ্চের স্থগিতাদেশের সময়সীমা নিঃসন্দেহে ন‍্যায়ালয়ের সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগায়। ১৩ই মে, ২০২২ অব্দি স্থগিতাদেশ। তারপর উচ্চন‍্যায়ালয়ের বছরের দীর্ঘতম ছুটি – সামার ভ‍্যাকেশান। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে বিচারকদের মামলার শিডিউল পাল্টে যাওয়া। তাহলে রায় বাতিল হওয়া আর স্থগিত হওয়ার মধ‍্যে কার্যকরী তফাৎ হল কি? বরঞ্চ রায় বাতিল হলে যুক্তিগ্রাহ‍্য রায় দিতে হত – এক্ষেত্রে তার দায়িত্ব নিতে হল না!
এখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ব‍্যর্থতা। নির্দিষ্ট বয়সসীমার নাগরিকদের সবাইকে ভোটাধিকার দেওয়ার কুফল এখন বোঝা যাচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী নির্বাচিত শাসককুল তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন থাকলেও দায়িত্ব পালনের দায় তাঁরা নেন না। তাঁরা কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রতিস্থাপিত হওয়ার যোগ‍্য। যে কোন দেশের (কম‍্যুনিস্টসহ) রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু এদেশে দলের রাজনৈতিক স্বার্থ, বিশেষতঃ সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীর ব‍্যাক্তিগত স্বার্থ সর্বদা জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব পায়। সেজন‍্য দেশের নাগরিকরাও জাতীয় স্বার্থে সংঘবদ্ধ হতে পারে না। ফলে, অসৎ রাজনৈতিক নেতারা দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্দেশ‍্য সাধনে সমর্থ হন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটি সমধিক প্রযোজ‍্য।
এখন আবার একটি কৌশল লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে – রাজ‍্যের শাসকদল তিন চার দিনের ব‍্যবধানে ন-দশটি ধর্ষণের ঘটনায় খানিকটা হলেও ব‍্যাকফুটে। কারন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শাসকদলের স্থানীয় নেতা বা তার নিকট আত্মীয় অথবা ঘনিষ্ঠ। সেজন‍্য জনগণের সহানুভূতি আদায়ে দলের কয়েকজন এমপিকে দিয়ে একই রকম কথা বলানো হচ্ছে – দল এসব সমর্থন করে না; দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক….. ইত‍্যাদি। আবার মূখ‍্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পুলিশ সুপার তদন্তের ক্ষেত্রে অন‍্যরকম ‘টোন’ ঠিক করে দিচ্ছেন!
এই অরাজকতা আরো বেড়েছে শাসকদলের নিজেদের মধ‍্যে মারামারিতে। বুঝতে অসুবিধা নেই – অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের ভাগাভাগিই এর মূল কারন। বছরের পর বছর সরকারী চাকরীর নামে প্রতারণা, নেতাদের প্রাসাদোপম বাড়ির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনযাপন, পেশীশক্তির জোরে দুষ্কর্ম – ইত‍্যাদির চাপে রাজ‍্যের অবস্থা নরকের চেয়ে খারাপ। আবার, রাজ‍্য অর্থনৈতিক ঋণজালে জড়িয়ে গেছে। এই মূহুর্তে রাজ‍্য সরকারের ঋণের পরিমাণ সাড়ে পাঁচলক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশী! গত দশ বছরে রাজ‍্য সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছে। এই টাকা রাজ‍্যের মানুষের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। টাকা পরিশোধের জন‍্য বাড়ি-জমির ট‍্যাক্স থেকে ধরে অন‍্যান‍্য ট‍্যাক্স হাজারগণ বা তার বেশী বাড়াতে হবে! এই রাজ‍্য উৎপাদনী রাজ‍্য নয়, বরঞ্চ এটি consuming state। ফলে, এখন রাজ‍্য যে পরিমাণ GST পাচ্ছে, আগামী জুলাই ২০২২ থেকে তা অনেক কমে যাবে। সেক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ আরো দ্রুত বাড়াতে হবে! আবার এখনকার নিয়মে রাজ‍্য GDPর সর্বাধিক ৩% পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। প্রথমে রাজ‍্য সরকার রাজ‍্যের GDP অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেখানোয় তা কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেয়নি। আবার, রাজ‍্য এই ৩%এর ক‍্যাপকে বাড়িয়ে ৫% এনিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে! স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রের এই প্রস্তাব মানার কথা নয়। যদি উচ্চতম নেতৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে কেন্দ্র এই দাবী মেনে নেয়, তবে রাজ‍্যের নাগরিকদের উপর মাত্রাতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপানোর দায় রাজ‍্যের সঙ্গে কেন্দ্রকেও নিতে হবে।
একটা ব‍্যপারে খুব অবাক লাগে। এই যে চারদিকে এত অরাজকতা, দ্রব‍্যমূল‍্য বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে আইন শৃঙ্খলার বিশেষ অবনতি – সামাজিক মূল‍্যবোধের চরম অবক্ষয়, তার সাথে প্রশাসনিক মদতে সাধারণ মানুষের উপর দুর্বৃত্তের অত‍্যাচার – বলা ভালো প্রশাসনের দুর্বৃত্তায়ণ, এর থেকে মুক্তির উপায় রাজনৈতিক স্তরেই হওয়া ভালো না হলে………। ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সিপাহী বিপ্লব ও তার পরবর্তী বঙ্গপ্রদেশের অরাজক অবস্থার দায় যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিল না, তখন বৃটিশ শাসনব্যবস্থার মধ‍্যে ভারতবর্ষকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করে কোম্পানীর আমলের অরাজক শাসন বন্ধ করা হয় – একথা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় পাওয়া যায়।
আইনের শাসন রক্ষায় মহামাণ‍্য আদালতের ভূমিকা সব দেশে, সব সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। আদালত ও বিচারকদের উপর পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ কেউ করে না কারন নিরপেক্ষ বিচারের উপর শাসনব‍্যবস্থার মূল স্তম্ভ দাঁড়িয়ে থাকে। এই রাজ‍্যে তার উপরেও বারবার আঘাত করা হয়। এক বিচারপতিকে ” লালা বাংলা ছেড়ে পালা” শ্লোগান দিয়ে ধাওয়া করা কেউ ভোলেনি। শাসকের পছন্দ নয় এমন রায়দানকারী বিচারককে শারীরিক নিগ্রহ করার ঘটনাও এখানে ঘটে। আমেরিকায় বসবাসকারী আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমায় কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে বলে, “sir, politicization of every facets of administration now leads to total corruption”। ওরা পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ বাঙ্গালী মানুষজনের কি হবে!
চীনের গৃহযুদ্ধের সময় লাল ফৌজ ও সাধারণ নাগরিকরা আদালতের পক্ষপাতদুষ্ট বিচারে বারবার নিগৃহীত হত। কারন, বিচারকেরা নিজেদের চিয়াং কাইশেক এর কুওমিনটাং ও ক্ষমতাশালী, বিত্তশালী জমিদারদের কাছের লোক মনে করতেন – এদের থেকে সর্বদা বিচারকরা উপঢৌকন (উৎকোচ বলা যাবে না) পেতেন। ফলে, দেশের মানুষদের বিচারব‍্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে যখন চিয়াং কাইশেকের ন‍্যাশনালিস্ট চীনা পার্টি মূল ভূখন্ড ছেড়ে তাইওয়ানে আশ্রয় নিল, আর মূল ভূখন্ডে মাও জে দং এর নেতৃত্বে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না গঠিত হল, তার প্রথম দিকেমূল ভূখন্ডের বিভিন্ন স্থানে বাতিস্তম্ভে বিচারকদের দেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি বড় মারাত্মক। কোন নাগরিক, তিনি যত বড়ই হোন না কেন, তাঁর চেয়ারের অপব‍্যবহার করার অধিকার নেই। একটি সঙ্গত প্রশ্ন কেউ কি করেছেন – হাঁসখালির যে মেয়েটি ধর্ষিতা হয়ে পরদিন মারা গেছে, সে নাবালিকা। অর্থাৎ এই মামলায় পকসো আইন লাগু হওয়ার কথা – এক্ষেত্রে বিচারকের অধিকার IPC ও সংবিধান নির্দিষ্ট। সুতরাং এইক্ষেত্রে মামলা CBIএর থেকে নিয়ে নেওয়া বা স্থগিতাদেশ দেওয়া যায় না। অবশ‍্য এই মামলায় কোন স্থগিতাদেশ কেউ দেয়নি। তবে, সরকারী চাকরী সংক্রান্ত বেআইনী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে কার লাভ ও কার ক্ষতি – এই বিশ্লেষণ মানুষ করছে। তার ফল বিচারব‍্যবস্থার জন‍্য সুখকর হবে কি?
এবার আসি শেষ কথায়। এমন আইন শৃঙ্খলার অবণতি, অর্থনৈতিক নৈরাজ‍্য ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষহীণতার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যে তীব্র আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তোলার কথা তা কোন গূঢ় কারনে অনুপস্থিত! শুধু টেলিভিশনের পর্দায় কিছু নেতার চেঁচামেচি ও ঝগড়ায় তা সীমাবদ্ধ। আর পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবি’কুল শীতঘুমে থেকে তাঁদের পেশাদারী রুদালী চরিত্রের পরিচয় দিলেন! আজকের রাজনীতির কুশীলবরা পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে কি লাভ করলেন তা ভবিষ‍্যতের দলিলে লেখা থাকবে।

করোনা অতিমারীর শেষ কথা

করোনায়িত বিশ্বে শান্তি আসুক নেমে। ১লা এপ্রিল, ২০২২ থেকে করোনা সংক্রান্ত সমস্ত রকমের বিধিনিষেধ, যেগুলো কেন্দ্র ও রাজ‍্য সরকার থেকে লাগু করা হয়েছিল, তা উঠে গেল – করোনার থাবা মোটামুটিভাবে চলে গেছে বলা যায়। ১৯১৮-২০ সালের প্লেগের পর দেশে এত মানুষের আক্রান্ত ও মৃত‍্যু খবর জানা নেই। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত প্রায় ৪৯ কোটি মানুষ, যার মধ‍্যে মৃত‍্যু হয়েছে ৬১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ আর মৃত‍্যু হয়েছে ৫ লক্ষ ২২ হাজার মানুষের। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ‍্যা দুটি যথাক্রমে ২০ লক্ষ ২০ হাজার ও ২১ হাজার ২০০ জন। অতি স্তিমিত হয়ে পড়ে যেতে যেতে করোনা হয়ত এই সংখ‍্যাটা অল্প বাড়িয়ে যাবে! বিশ্বব‍্যাপী বিপর্যয়ের আঁচ যখন আমাদের দেশে পড়েছে তখন, বিশেষতঃ কিছু বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ‍্যম মানুষের দুঃখ দুর্দশার ছবি দেখানোর সাথে সাথে কল্পিত ভয় – হরর সিনেমা দেখানোর মত – প্রচার করেছে। তাতে মদত দিয়েছেন ঐসব সংবাদ-মাধ‍্যম দ্বারা ঘোষিত বিশেষজ্ঞের দল! তারপর অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিষ্পেষিত মানুষকে আশার বাণী শোনানোর পরিবর্তে এইসব planted ‘বিশেষজ্ঞ’রা লকডাউনের কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধের বেড়ি পরিয়ে যত মানুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, তত অত‍্যাবশ‍্যকীয় পণ‍্যসামগ্রীর দাম সহ সমস্ত পণ‍্য ও সার্ভিসের বাজার দর ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী হয়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন – রোজগার কমেছে অধিকাংশ মানুষের। শুধু রোজগার বেড়েছে মুনাফাখোর আর ঐ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির। তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের রোজগার বেড়েছে বৈ কমেনি! সাধারণ মানুষের অশেষ দূর্ভোগের পরেও এইসব সংবাদ-মাধ‍্যম এমন তথ‍্য পরিবেশন করছে যে, মনে হয়, ওমিক্রনের পর আরো মারাত্মক করোনা ভ‍্যারিয়েন্ট আমাদের কাবু করতে ছুটে আসছে! এর কারন একটাই – ভীতির পরিবেশে অর্থনৈতিক শোষণ সুবিধার – সঙ্গে প্রচারকদের “কাটমানি”। এই কারনেই করোনা ভাইরাসের সঠিক বর্তমান পরিস্থিতি ব‍্যাখ‍্যা করার উদ্দেশ‍্যে এই লেখার অবতারনা।
RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট অনুযায়ী করোনা ভাইরাস যত মিউটেশান করবে তত তার মারণ ক্ষমতা কমবে ও সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে – একথা একাধিকবার আলোচনা করেছি। সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ার অর্থ কিন্তু ক্ষতি করার ক্ষমতা বাড়া নয় – এই বৈজ্ঞানিক সত‍্যকে বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি ভালোভাবে প্রচার করেনি।
আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের টীকাকরণ হয়ে গেছে। তাছাড়া, সজ্ঞানে (পরীক্ষায় প্রমাণিত) বা অজ্ঞানে (পরীক্ষা না করা) সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন – তা যে কোন মিউটেড ভ‍্যারিয়েন্ট হোক না কেন। এর ফলে তাদের দেহে করোনা ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে – যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাভাবিক। আবার করোনা আক্রান্ত হোন বা না হোন, যাদের টীকাকরণ শুরু হয়েছে, তাদের দেহের টি-লিম্ফোসাইট কোষের বৃদ্ধির ফলে কোষের মধ‍্যস্ততায় যোঝার শক্তি (immunity) বেড়ে গিয়ে ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ‍্যান্টিজেনকে নষ্ট করতে অধিকতর সক্ষম হয়। তাছাড়া, বি-লিম্ফোসাইট, যা মূলতঃ বোনম‍্যারোতে পাওয়া যায়, একটি অবিযোজিত (adaptive) যোঝার শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। এই শ্বেত কণিকার মধ‍্যস্ত কোষগুলি ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায‍্য করে। সেইসঙ্গে টি-লিম্ফোসাইট যে বিশেষ কোষ নির্দেশক সাইটোকাইন মোচন করে তা ভাইরাস ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অর্থাৎ একজন টীকা নেওয়া মানুষের করোনা ভাইরাসের সঙ্গে শুধু লড়াইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, ভাইরাসকে ধ্বংস করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, টীকাকরনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে যোঝার শক্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনই ৭০% মানুষের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারনে গোষ্ঠীসংক্রমণে সমাজে herd immunity তৈরী হওয়ায় দ্রুত করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই জয়ী হয়েছে। আবার যেকোন RNA ভাইরাসের এই ভাইরাস যখন মানবদেহে ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা হারাবে, তখন তারা মানবদেহ ছেড়ে আবার পশুদেহে আশ্রয় নেবে এবং ক্রমশঃ সুপ্ত (dorment) অবস্থায় চলে যাবে। আমরা এই মূহুর্তে শেষের অবস্থায় আছি। সুতরাং, বিপর্যয় কেটে গেছে, তা বলাই যায়। অবশ‍্য, ঠিকমত স‍্যানিটাইজ করা এবং স্বাস্থ‍্যবিধি পালন করে যাওয়া আবশ‍্যক – এর বড় কারন হল, এর ফলে বি-লিম্ফোসাইট শক্তিশালী হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, করোনা অতিমারীর প্রভাব এখন বিলীন হওয়ার পথে। কিন্তু, লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে অতিমারীর যে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তার সংক্রমণ ক্ষমতার শক্তি আলোচনা করে জনসাধারনকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের অশুভ প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
আবার অতিমারী ও লকডাউনের অজুহাতে ঊর্ধমূল‍্যের বাজারে দ্রুতগতির মূল‍্যবৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে, বিশেষতঃ বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের কারনে মানুষের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখনএভাফে মানুষকে ভয় দেখানো অত‍্যন্ত ঘৃণ‍্য কাজ।
এখানে একটি কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না – রিজেনারেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিক‍্যাল প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারত তথা আমাদের রাজ‍্যের ক্লিনিশিয়ানদের যথেষ্ট অনীহা আছে। বৈজ্ঞানিক সত‍্য যে, বি-লিম্ফোসাইটের মধ‍্যে হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষ থাকে। এই কোষের বাইরে থেকে সংগ্রহ করার একটি সূত্র হচ্ছে কর্ড ব্লাড। আমাদের রাজ‍্যে সরকারী কর্ড ব্লাড ব‍্যাঙ্ক থাকলেও বহু বছর ধরে তার ব‍্যাবহার করা হয়নি। এর কারন না জানা থাকলেও এটা বলাই যায় যে এভাবে টাকা নষ্ট করার কোন যুক্তি নেই।অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগে কর্ড ব্লাড হয়ত বি-লিম্ফোসাইট বৃদ্ধি করে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। এত জ্ঞান দেওয়া সবজান্তা সাংবাদিককুল কখনো এ ব‍্যাপারে ডাক্তারবাবুদের প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখাতে পারেননি।
এবার শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রেও অর্থনীতির উপর করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আঘাত আসতে শুরু করেছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পেট্রোল, ডিজেলের দাম লিটারে দশ পয়সা বাড়লে নোটে শাকের আঁটির দাম দশ পয়সা বেড়ে যায়! সেই ট্র‍্যাডিশান সমানে চলেছে। আবার সব পণ‍্য ত বটেই, এমনকি সমস্ত রকম পরিষেবা জিএসটির আওতায় আনলেও একমাত্র পেট্রোল-ডিজেলকে অতিমারী পরবর্তী পর্যায়েও জিএসটির বাইরে রাখা হয়েছে। এর দায় কেন্দ্র, রাজ‍্য উভয় সরকারের। সুতরাং পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন‍্য রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদী আন্দোলন জনগণকে ধাপ্পা দেওয়ার মতলব। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভোটের ইস্তাহার প্রকাশের সময় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটায়। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো দলের ঘোষিত ইস্তাহারে পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। জনসাধারণকে শোষণ করার এ এক ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়া। বাজার অর্থনীতিতে এই বিষক্রিয়ার ফল ফলতে শুরু করেছে।পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনঅত‍্যাবশ‍্যকীয় সামগ্রীর চাহিদা সাধারন নিয়মেই এখনকার পরিস্থিতিতে বাড়ার কথা। আবার, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়ায় চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের রাজ‍্যে মূল‍্যস্ফীতি সরাসরি না হয়ে এখন নিশ্চলতা-স্ফীতি (stagflation) চলছে। সরকার যদি সাধারন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়াতে না পারে তবে এই অচল অবস্থা থেকে রাজ‍্যের অর্থনীতি অপ্রতিস্থাপনযোগ‍্য তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে।
এর লক্ষণ এখনই সমাজে পরোক্ষভাবে হলেও, দেখা যাচ্ছে। চারদিকে হিংসা, হানাহানি, অসামাজিক কাজকর্মের অতিবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। এক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি যেন প্লেগ পরবর্তী বৃটিশ সরকারের উদাসীনতাকেই মনে করায়। করোনা অতিমারীর ফিরে আসা ও পুনরায় লকডাউনের অবৈজ্ঞানিক সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, চাহিদা-যোগান-ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখার প্রয়াসকে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

পশ্চিমবঙ্গের জন্ম ও তার পটভূমি

একটি দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন‍্য যে শর্ত প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন তা হল, দেশের জনগণের ত বটেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। আজ যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ‍্যে যুদ্ধ চলছে, তার আত্মিক শক্তি হল জাতীয়তাবোধ। এমনকি, কম‍্যুনিষ্ট চীন থেকে শুরু করে পাশ্চাত‍্যের দেশগুলিরও চালিকা শক্তি এই জাতীয়তাবোধ। মধ‍্যপ্রাচ‍্যের ইসলামী দেশগুলি – সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সৌদি আরব বা কাতার – সকলেই ধর্মকে স্বীকার করেও দেশ পরিচালনায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেয় জাতীয় স্বার্থকে। কটু শোনালেও, একথা বাস্তবিক সত‍্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিকরা তাদের পারিবারিক স্বার্থকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন! তার জন‍্য ভোটে জেতা জরুরী হওয়ায় তাদের ভোটের স্বার্থে দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপোষ রাজনীতি করতেও দেখা যায়! ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময়ের দুই সফলতম ভন্ড সমাজসেবী হচ্ছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু।
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের জনক চৌধুরী রহমত আলী ১৯৩৩ সালে বৃটিশ ভারতবর্ষের মধ‍্যে থেকে ইসলামীদের জন‍্য আলাদা রাষ্ট্র পাক-ই-স্তান (Land of purity) গঠনের কথা বলেন; যেখানে পাঁচটি প্রদেশ – পঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, সিন্ধ ও বালুচিস্তান ছিল। প্রথমে মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব প্রত‍্যাখ‍্যান করে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৪০সালে লাহোর সম্মেলনে জিন্না দ্বিজাতীতত্ত্ব (হিন্দু আর মুসলমান দুই আলাদা ‘জাতি’) সামনে এনে সহাবস্থান অসম্ভব ঘোষনা করে তার ভিত্তিতে পাক-ই-স্তান গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। হিন্দু রমণীর পাণিগ্রহণ ও প্রিয় খাদ‍্য তালিকায় শুয়োরের মাংস এবং হুইষ্কি থাকায় জিন্নাকে ইসলামী আলেমরা ইসলামের প্রতিভূ বা মেসিহা মনে করতেন না। সেজন‍্য জিন্নাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের মধ‍্যে থেকে তাঁর প্রাপ‍্য স্থান ও সম্মান আদায় করে নিতে। কিন্তু কোন স্বাধীনচেতা, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ, সে হিন্দু বা ইসলামী যাই হোন না কেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে টিঁকতে পারতেন না। কংগ্রেসের পালক পিতা হিসেবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রতিষ্ঠার পর, এই দল ধীরে ধীরে গান্ধী ও তাঁর অনুচরদের রাজনৈতিক দলে পরিণত হল। গান্ধীজীর দুই বিশ্বস্ত অনুচর, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প‍্যাটেল ধীরে ধীরে স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত ও প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষজনকে – যেমন বিঠলভাই প‍্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ‍্য করেছেন। গান্ধীজীর গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না। তার সবচেয়ে বড় নমুনা হল ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে চরম গোষ্ঠীবাজি করে গান্ধী-নেহরু জুটি ও তাদের চামচারা সুভাষকে পদত‍্যাগ করতে ও কংগ্রেস ছাড়তে বাধ‍্য করে। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তিনি সর্বদা তাঁর মতই নয়, তাঁর পথকেও চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
এইসব পর্যবেক্ষণ করে শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও চৌধুরী রহমত আলীর যে প্রস্তাবে পাক-ই-স্তান গঠনের কথা প্রথম বলা হয় তাতে বাংলা প্রদেশের কথা ছিল না; পরবর্তীতে গান্ধীর দোদুল‍্যমান নীতিকে চাপে রেখে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সাল থেকে বাংলাকেও পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেবার দাবী জানায়। এই বাংলা ভাগে পক্ষে তদানীন্তন অখন্ড ভারতের সব মুসলিম নেতাই ছিলেন! গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ভাবগতিক ছিল – যাক, বাংলাটা পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে বাঁচা যায়! এর কারন, কংগ্রেসের তিন নেতা – গান্ধী-জওহর-বল্লভভাইদের নেতৃত্বের সংঘাতে বাংলার রাসবিহারী, সুভাষরা বারবার পর্যুদস্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, সাভারকর থেকে বিঠলভাই, এমনকি সুভাষ পর্যন্ত গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ তোষণ রাজনীতি ধরে ফেলেছিলেন! আজকে কংগ্রেস দলের পারিবারিক নেতৃত্ব ও তাঁদের কর্মচারীসম কংগ্রেসী নেতারা গণতন্ত্রের কথা বললেও তাঁরাই গান্ধীর অগণতান্ত্রিক উপায়ে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারণ ও দল পরিচালনায় হস্তক্ষেপের কথা গোপন করেন কেন? ত্রিপুরী কংগ্রেসে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রার্থীকে ভোটে হারানোর ‘অপরাধে’ (!) সুভাষকে অপমান ও অবহেলা করে চক্রান্তের জাল বিস্তারের মাধ‍্যমে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ও জওহরলাল এবং বল্লভভাইয়ের সহযোগীতায় সুভাষকে অল্পদিনের মধ‍্যে পদত‍্যাগ করতে বাধ‍্য করানো – এসব কিন্তু বাঙ্গালী ভোলেনি। স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার ‘দায়িত্ব পাওয়া’ কম‍্যুনিষ্ট ইতিহাসবিদরা এসব কথা লিখতে ভুলে যান! বাঙ্গালী মননে গান্ধী পুজন ও বল্লভভাইয়ের স্ট‍্যাচু কোন আনন্দবার্তা বয়ে আনে না। এমনকি, শুধু পঞ্জাবের বিপ্লবীরাই নয়, বাংলার বিপ্লবীদের কাজকর্মের গান্ধীজী এতটাই বিরোধীতা করেছেন যে, তিনি স্বাধীনতা আদায়ের জন‍্য তাঁর দেখানো অহিংস আন্দোলন ছাড়া অন‍্য কোন পথকেই সমর্থন করা দুরে থাকুক, তার বিরোধীতাই করেছেন। পথ ভিন্ন, উদ্দেশ‍্য এক – এমন মতবাদে গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীনতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করলে বোঝা যায়, গান্ধীজী প্রশ্নহীণ আনুগত্য দেখানো অনুচর ছাড়া কাউকে গুরুত্ব দিতেন না। এমন একজন megalomaniac মানুষের হাতে স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থায় সর্বাধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে যে কটি উল্লেখযোগ‍্য পরিবর্তনের দিকে দেশ এগুলো, তা হল, বাংলার নেতাদের অনেকের নেতৃত্বের ক্ষমতা ও জনভিত্তিকে গান্ধীজী ও জওহরলাল ভয় ও হিংসা করতেন! সে কারনে, বাংলা যদি ভারতের মধ‍্যে না থাকে তাহলে তাদের বিশেষ ক্ষতি হয়না – এজন‍্য ভারতভাগের সময় বাংলা ভাগের কোন অভিপ্রায় কংগ্রেসের ছিল না। যদিও গান্ধীজী বারবার আপামর ভারতীয়কে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ভারতভাগের তিনি বিরুদ্ধে; এমনকি এও বলেছেন, ভারতভাগ তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে! এদিকে তিনি জিন্নার সঙ্গে বৈঠক করেছেন; তাঁর শিষ‍্য জওহরকে স্বাধীন দেশের প্রথম নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এভাবেই তিনি জিন্নাকে কংগ্রেস তথা ভারতের নেতৃত্বে আসার সুযোগ দেননি। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতির মধ‍্যে আন্দোলনের নামে বৃটিশ শক্তিকে বিব্রত না করা; মুসলিম লীগের সব দাবীগুলিতে নীরবতার দ্বারা (মৌণং সম্মতি লক্ষণম্) সমর্থন করা এবং জওহরলালের নেতৃত্বে তাঁর বশংবদদের হাতে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তা দেখা।
এদিকে তখন কম‍্যুনিষ্ট পার্টি পুরোপুরি পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে এবং পুরো বাংলা প্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন‍্য ওকালতি শুরু করে। একাজে তাদের দলের সাধারণ সম্পাদক গঙ্গাধর অধিকারী অগ্রণী ভূমিকা নেন। গঙ্গাধর অধিকারী তাঁর কাজের সমর্থনে ভারতবর্ষের ইতিহাসকেও অস্বীকার করতে পিছপা হননি। তিনি তাঁর লেখায় ভারতবর্ষকে দেশ হিসেবে না দেখে বিভিন্ন প্রদেশের (বা রাজ‍্যের) সমষ্টি হিসেবে দেখেছেন! এমন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে কম‍্যুনিষ্ট পার্টি দলগতভাবে পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে ও বাংলা ভাগে বিরোধীতায় নামে। শুধু তাই নয়, তারা মুসলিম লীগ – বিশেষতঃ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করে। এই দলের অগ্রণী নেতাদের মধ‍্যে মুজফ্ফর আহমেদও ছিলেন! কিছু হিন্দু বাঙ্গালী নেতা, শরৎ চন্দ্র বসু, কিরন শঙ্কর রায় ইত‍্যাদি পাকিস্তান গঠনের দাবীকে সমর্থন করেন এবং বাংলা ভাগের বিরোধীতা করেন। এই নেতারা তাঁদের ব‍্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা করে হিন্দু বাঙ্গালীর ভবিষ‍্যৎ জ্বলাঞ্জলী দেওয়ার রাস্তা দেখাতে চেয়েছেন।
এই সময় শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় বৃটিশ রাজশক্তিকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন – বাংলায় ইসলামী শাসনের আগে এদেশের কৃষ্টি, ঐতিহ‍্য, সভ‍্যতা, খাদ‍্যাভাস, সবই এক থাকলেও ইসলামী শাসনের পরে তা পাল্টে যায় – একথা মসলিম লীগের তত্ত্বেও উঠে এসেছে আর কংগ্রেসও এতে আপত্তি করেনি। তিনি যুক্তি দিলেন যে, জনসংখ্যার ২৪% যদি এই কারনে আলাদা রাষ্ট্র পায় তবে বাংলার হিন্দুদের (অবিভক্ত বাংলায় ৪৫% মানুষ ছিলেন হিন্দু) উপর অবিচার হবে।ধর্মীয় কারনে বিভাজনের ক্ষেত্রে তিনি হিসেব করে হিন্দু অধ‍্যুষিত পরগণাগুলিকে নিয়ে আলাদাভাবে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টির সওয়াল করেন। তখন শরৎ বসুরা আবার বাগড়া দিয়ে বললেন, আমরা তাহলে পশ্চিমবঙ্গকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চাই! আসল উদ্দেশ‍্য পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া। শ‍্যামাপ্রসাদ শুধু হিন্দু মহাসভা দলের থেকেই নয়, সকল বাঙ্গালীর কাছেই পশ্চিমবঙ্গের সমর্থনে এগিয়ে আসার যুক্তি দেখান। হিন্দু মহাসভা ছাড়াও মারোয়ারী সম্প্রদায় এবং কতিপয় পঞ্জাবী ও নেপালীরা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাবে সমর্থন জানান। কম‍্যুনিষ্ট পার্টি হিন্দু মহাসভাকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর জন‍্য দায়ী করে মুসলিমলীগের সমর্থনে ও বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবীতে প্রচার চালায়! গঙ্গাধর অধিকারী ছাড়াও মুজফ্ফর আহমেদের মথ মানুষও এতে শামিল ছিলেন! এইভাবেই জেহাদী ইসলামের সমর্থক ও পাক-ই-স্তানের বন্ধু এই কম‍্যুনিষ্টরা ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে অবলুপ্তির পথে। একমাত্র সংবাদ-মাধ‍্যম ও সামাজিক মাধ‍্যমেই এদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
এদিকে, বৃটিশ শাসকরা বাংলার রাজনীতির নাড়ি বোঝার জন‍্য ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের প্রস্তাবকে বাংলার আইনসভায় প্রস্তাব আকারে পেশ করার কথা বললেন। এই সময় কংগ্রেস দলগতভাবে কোন দিকে না গেলেও মুসলিম লীগ তাদের সদস‍্যদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেবার জন‍্য হুইপ জারি করে। ভোটাভুটিতে অদ্ভুত বিভাজন লক্ষ‍্য করা যায়। ৫৮ জন পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে ভোট দেন এবং ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন! দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ইসলামী সদস‍্য পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করেন। সেদিন কম‍্যুনিষ্ট পার্টির ঘোষিত নীতি পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরুদ্ধে থাকলেও তাদের দুই দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা জ‍্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। আবার কিছু হিন্দু বাঙ্গালী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
এর থেকে একটি ব‍্যপার খুব পরিষ্কার। দলমত নির্বিশেষে সকল ইসলামী পাক-ই-স্তানের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাকে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিল। আর বেশীরভাগ হিন্দুরা (কংগ্রেস দলগতভাবে নয়) চেয়েছিল বাংলার বিভাজন ও ভারতের মধ‍্যে হিন্দু অধ‍্যুসিত পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্তি। তারপর ২০শে জুন,১৯৪৭ সালে সরকারী নোটিশ জারি হয় যাতে করে ভারতের নতুন প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়।

এই অমানিশা আর কতদিন

একটি আত্মঘাতী জাতি কতদিন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে? হ‍্যাঁ, বাঙ্গালী জাতির কথাই বলছি। স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের এবং তার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষের উপর বারবার অত‍্যাচার, অবহেলা ও বঞ্চনার অভিশাপ ঝরে পড়েছে। ১৮৮০র সময় থেকেই বাঙ্গালী যুবশক্তির একটি বড় অংশ সশস্ত্র পদ্ধতিতে বৃটিশের অত‍্যাচারের প্রতিদান হিংসার মাধ‍্যমে দেওয়ার শপথ গ্রহণ করে। এই বাঙ্গালী বিপ্লবীরা মোটামুটি দুটি দলে – অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর – বিভক্ত ছিল। যখন বৃটিশ শাসককুল বিপ্লবীদের কাজকর্মে ব‍্যতিব‍্যস্ত বোধ করতে লাগল, ইতিহাস বলে, গান্ধীজি তাঁর অতিরিক্ত হাইপ তোলা গণআন্দোলন – অসহযোগ – শুরু করলেন। গান্ধীজি কখনো বিপ্লবীদের শাসক-বিরোধীতাকে সমর্থন করেননি, বরং সক্রিয় বিরোধীতা করেছেন। তিনি তাঁর কাজের মধ‍্যে দিয়ে বাঙ্গালীদের, তাঁর ধারনাপ্রসুত ‘ভারতীয়ত্ব’-এর বাইরে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলশ্রুতিতে তাঁরই শিষ‍্য জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বারবার বাঙ্গালীদের তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বঞ্চনার চেষ্টা করেছেন। এমনকি “দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং” এবং “নোয়াখালী হিন্দু গণহত‍্যা”র পরে প্রতিনিয়ত যখন পূর্বপাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ‍্যক হিন্দু শরণার্থীর আগমন শুরু হল, তখন জওহরলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার পঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীদের সঙ্গে বিমাতৃসূলভ আচরন করেছেন – এসবের ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ফলে, বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থী পরিবারগুলির মনে কংগ্রেস দলের প্রতি প্রতিকুল মনোভাব জন্ম নেয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস কখনো তা দূর করার চেষ্টা করেনি।
আবার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বাঙ্গালী – হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বিষে আক্রান্ত ছিল না। যেহেতু, সব বাঙ্গালী মুসলমানই হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের কৃষ্টি, সভ‍্যতা, কথাবার্তা সবই একরকম। আরবী কৃষ্টি, আচার-আচরণ তাদের অজানা ছিল। সেকারনে এই বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী মুসলমানরা নীচুজাত (সাচ্চা মুসলমান নয়) মনে করত! পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী মুসলমান শাসকেরা যখন বুঝল যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের বেশীদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, তখন তারা চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কার্ড খেলল। একই দল, মুসলিম লীগের জিন্নার নেতৃত্বকে চ‍্যালেঞ্জ জানানোর জন‍্য অধিকতর মুসলমান দরদী সাজার চেষ্টায় থাকা হোসেন সুরাবর্দীর নেতৃত্বে “দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং” ও “নোয়াখালী গণহত‍্যা”র মধ‍্যে দিয়ে হিন্দু-বিদ্বেষের মাপকাঠিতে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতা হতে চেয়েছিলেন। একাজে ধর্মীয়স্থান মসজিদগুলিকে ব‍্যবহার করে এবং মসজিদের মৌলানা, মৌলভীদেরও এই কাজে যুক্ত করেন; এরা সাধারণ মুসলমানদের মধ‍্যে হিন্দুদের উপর বিদ্বেষ জাগাতে অগ্রণী ভূমিকা নেন। যে সাধারন বাঙ্গালী মুসলমানরা বাংলা ছাড়া অন‍্য ভাষা জানতেন না, তাদেরকে কোর-আন থেকে বেছে বেছে খন্ডিতভাবে বিভিন্ন সুরার অপব‍্যাখ‍্যা করে মৌলভীরা হিন্দু-বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। আর্থিক সাহায‍্য ও ইন্ধন আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। হিন্দু বিতাড়নও গণহত‍্যার পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভূত্ব পূর্ব পাকিস্তানের গলায় ফাঁসের মত চাপ বাড়াতে থাকে। ফলে, ১৯৬৯ সাল থেকেই শুরু হয় আন্দোলন, হিংসা, আবার হত‍্যালীলা, ধর্ষণ। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানে রমনা কালী মন্দির সহ অজস্র মন্দির ধ্বংস করা হয়। সার্বিকভাবে হিন্দুরা বাঙ্গালী মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী নির্যাতিত হন। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় সাহায‍্যে পাকিস্তানী উর্দুভাষী হানাদারদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়। কিন্তু, ঐ যে মসজিদ থেকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর সেট-আপ, সেটা বহল থাকে। তার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার নামে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে অজস্র মাদ্রাসা তৈরী হয় – যাদের হিন্দু-বিদ্বেষের আঁতুরঘর বলা যেতে পারে। এসবের ফলে দুই বাংলাতেই বাঙ্গালীদের নিজেদের মধ‍্যে সুদূরপ্রসারী ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ তৈরী করার চেষ্টা করা চলল – যা এখনো চলছে। এর ফলে কার লাভ আর কার ক্ষতি, তা পর্যালোচনা করলেই আমরা এর কারন জানতে পারব।
প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসে আরেকটি কথা বলা দরকার। যে উদ্বাস্তু পরিবারগুলির সক্রিয় সমর্থনের উপর ভিত্তি করে কম‍্যুনিষ্টরা তীব্র গণআন্দোলনের মাধ‍্যমে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলো, সেই মানুষদের সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়ণের কোন চেষ্টাই তারা করেনি। উপরন্তু, ১৯৭৯ সালে মরিচঝাঁপিতে পুলিশের সহায়তায় কম‍্যুনিষ্টরা হতভাগ‍্য উদ্বাস্তুদের গণহত‍্যা সংঘটিত করে তাঁদের স্থায়ীভাবে কম‍্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের স্থায়ী বিরোধী করে তোলে।আবার, যখন উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ‍্যার চাপে রাজ‍্যের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, সেই ৫০-৬০এর দশকে কংগ্রেস,কম‍্যুনিষ্ট নির্বিশেষে উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দাদের ক্ষেপিয়ে তোলার কাজ করা হয়! শুধু হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নয়, “ঘটি-বাঙ্গাল” ভেদও তৈরী করা হল! এমন একটি ভাব যেন, এই “বাঙ্গাল”গুলো এদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানকার সম্পদে অনধিকার ভাগ বসাচ্ছে! তারপর বাম জমানায় নতুন শিল্প ত দুরস্ত্, চালু শিল্পগুলিও শ্রমিক আন্দোলনের অজুহাতে বন্ধ করে দিতে লাগল! তখন কম‍্যুনিষ্ট দলগুলির যারা সর্বভারতীয় নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের নিজেদের রাজ‍্য – পাঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেরালাতে এভাবে পাইকারী হাযে চালু শিল্প বন্ধ করা হয়নি! অর্থাৎ, বাম শ্রমিক আন্দোলন প্রতিটি রাজ‍্যের ক্ষেত্রে আলাদা! অবাঙ্গালী কর্মচারীরা তাঁদের নিজ নিজ রাজ‍্যে ফিরে গেলেও এই রাজ‍্যের বাঙ্গালী শ্রমিকদের অবস্থা হল শোচনীয়। এদিকে, অপারেশন বর্গার কারনে একলপ্তে এই রাছ‍্যে বড় ছমি না পাওয়ায় উন্নতমানের আধুনিক চাষাবাদ করাও এখানে সম্ভব হল না। কম‍্যুনিষ্টরা পশ্চিমবঙ্গে সমবায় আন্দোলনকেও সমর্থন দেয়নি। ফলে, চাকরীর বাজার রাজ‍্যে খুব সংকুচিত হয়েপড়ল। আবার সরকারী চাকরীতে জাতিগত সংরক্ষণের জন‍্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারনে বাঙ্গালীর মধ‍্যে জাতিগত বিদ্বেষের সূচনা হল। মনে রাখতে হবে, বাঙ্গালীর মধ‍্যে জাতিগত অশ্পৃশ‍্যতা কখনো ছিল না।
আবার, পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ‍্যে আধুনিক শিক্ষার আলো যাতে সহজে প্রবেশ করতে না পারে তার চেষ্টা উর্দুভাষী মুসলমানরা প্রথম থেকেই করে আসছে। এর দুটি উদ্দেশ‍্য : এক, অশিক্ষিত মানুষকে শোষণ করা সহজ; দুই, এদের মাদ্রাসা শিক্ষায় রাখলে জেহাদী বানানো সহজ হয়। পরধর্ম আগ্রাসনের কামনা বাঙ্গালী মুসলমানের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আরবী কৃষ্টি ও সভ‍্যতার অপভ্রংশ – উর্দুভাষী মুসলমান – আর তা পুরোপুরি নিজেদের স্বার্থে। কারন, এর জন‍্য বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের আর্থিক বা আত্মিক – কোন উন্নয়ণ হয়নি। বরং হিন্দু বাঙ্গালীদের শত্রু বানিয়ে তাঁরা নিজেদের সামাজিক ক্ষতি ডেকে এনেছে। অবশ‍্য এটা ঠিক যে, হিন্দু-মুসলমান উভয় বাঙ্গালী সমাজে বহু মানুষ আছেন যাঁরা বাঙ্গালী ঐক‍্যের মধ‍্যে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বাকে জাগাতে আগ্রহী। কিন্তু দূর্ভাগ‍্যজনকভাবে তাঁদের সংখ‍্যা অন‍্যদের তুলনায় নগণ‍্য। বাঙ্গালী মুসলমানের মনে হিন্দু বিরোধী মনোভাব জাগানোর জন‍্য শুধু যে নাটক, সিনেমার আশ্রয় নেওয়া হয় তাই নয়, বাংলা ভাষায় আরবী ও উর্দু শব্দ প্রয়োগ করে তা জোরের সঙ্গেচাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ত বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও জলের বদলে বাঙ্গালী মুসলমানকে পাণি বলতে বাধ‍্য করা হচ্ছে! তাছাড়া ফুফা-ফুফি, চাচা-চাচি, আপা, বুবু ইত‍্যাদি প্রচুর বিজাতীয় শব্দ বাংলায় ঢুকিয়ে বাঙ্গালী মুসলমানদের বাঙ্গালী হিন্দুর থেকে পৃথক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। এতে করে বাঙ্গালী হিন্দুদের জাতিগত নির্মূলকরন (ethnic cleansing) করার পর যে অল্পসংখ‍্যক বাঙ্গালী মুসলমান অবশিষ্ট থাকবে তাদের আরবী-উর্দু কৃষ্টি ও সভ‍্যতা রক্ষার কৃতদাস হিসেবে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
পশ্চিমবঙ্গে যেমন বামফ্রন্টের সময় থেকেই সূক্ষ্মভাবে বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ‍্যে বিভেদ ছড়ানোর জন‍্য মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে জেহাদী শিক্ষা ও জেহাদের ডাক দেওয়া হত, তেমনি প্রশাসন শক্ত হাতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা প্রকাশ‍্যে আসতে দিত না। কিন্তু মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল দল ১১ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর জেহাদী-ইসলামকে শুধু তোল্লা দেওয়াই নয়, জেহাদীদের দলের বিভিন্ন স্থানীয় নেতাদের দলের নেতৃত্বে বসানোর কাজ শুরু হল! বামফ্রন্টের রাজত্বে সিপিএমের নেতৃত্বে যখন গুন্ডাগর্দী শুরু হয়, তখনই বাঙ্গালীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ বর্ধমানের সাঁইবাড়ি হত‍্যাকান্ডে সিপিএমের ক‍্যাডারদের নৃশংস বর্বরতা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে শুধু স্তম্ভিত করেনি – রাজ‍্যের মানুষের প্রতিবাদের ভাষাকে কেড়ে নিয়েছিল। তারপর, সিপিএমের ক‍্যাডার রাজে বিরোধী কন্ঠ স্তব্ধ করার জন‍্য একের পর এক হত‍্যালীলা সংঘটিত হতে থাকে। ১৯৮৫ সালের ২রা জুলাই বর্ধমানের কেশবাড়ি গণহত‍্যা। ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ছোট আঙারিয়া…….কেশপুর……..। গণহত‍্যা, ধর্ষণ, ও জোর করে আদায় করা কাটমাণি বা দালালী ইত‍্যাদি বিভিন্ন রকম অত‍্যাচারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অভ‍্যস্ত হয়ে উঠল। তৃণমূল রাজত্বে এই অত‍্যাচার গণতান্ত্রিক রূপ পেল! বহু মানুষ একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করল। যে সিন্ডিকেট রাজ সিপিএম শুরু করেছিল তা তৃণমূলের রাজত্বে মহীরুহে পরিণত হল। প্রশাসনিক প্রশ্রয়ে বা ঔদাসিন‍্যে, অনৈতিক উপায়ে ও শোষণে সংগৃহীত অর্থের ভাগাভাগির কারনে খুনোখুনির অনেক ঘটনা ঘটতে লাগল! সাম্প্রতিককালে বগটুই গ্রামের নারকীয় ঘটনা এর সাক্ষ‍্য বহণ করে।
যেকোন নির্বাচনে বিরোধীদের গায়ের জোরে হটাতে প্রতিটি সাধারন নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মৃত‍‍্যু মিছিল দেখল। আশ্চর্য লাগে, বগটুই গ্রামের ঘটনায় মূখ‍্যমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন, পুলিশ কিভাবে তদন্ত করবে, তদন্তের অভিমুখ কি হবে! কে দোষী – কাকে গ্রেপ্তার করতে হবে – এসব সংবাদ মাধ‍্যম ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে মৌখিক আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা মূখ‍্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর আছে কিনা – সংবিধান কিভাবে তাঁকে এই ক্ষমতা দেয় এবং প্রশাসনের উপর এভাবে চাপ সৃষ্টি করা যায় কিনা – তা জানার ইচ্ছা রইল। এমনকি প্রশাসনের বাইরে, শাসকদলের একজন নেতা গণমাধ‍্যমের সামনে বলে দিচ্ছেন যে, প্রশাসন কিভাবে কেস সাজাবে! প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার এর থেকে বড় লক্ষণ আর কিইবা হতে পারে!
এই রকম ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিতে, হিংসা-দ্বেষের রাজনীতির শিকার হচ্ছে বাঙ্গালী, মারছে বাঙ্গালী, মরছেও বাঙ্গালী – তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন। বাঙ্গালীকে ধর্ম, জাতপাতে ও আঞ্চলিকতায় (বাঙ্গাল, ঘটি, রাজবংশী, ঝাড়খন্ডী ইত‍্যাদি) বেঁধে রেখে যারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং যে নেতারা তা করতে সাহায‍্য করছেন, তাদের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার একতা দেখাতে না পারলে বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বই লুপ্ত হবে। আত্মপ্রবঞ্চক, ভ্রষ্ট রাজনীতির যুপকাষ্ঠে বাঙ্গালী জাতি বলিপ্রদত্ত – তার দায় যেমন বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী রাজনীতিকের, তেমনি ধর্ম ব‍্যবসায়ী সহ মেরুদন্ড খোয়ানো সমগ্র বাঙ্গালী জাতির।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন পথে

আমায় একটি প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়, “আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ‘দিদি’ কি বামফ্রন্টের রেকর্ড ভেঙ্গে দেবেন”? রাজনীতির অতি সরলীকরন করলেও মনে হয় না যে মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্টের চেয়ে বেশী সময় পশ্চিমবঙ্গের গদি দখলে রাখতে পারবে! তার প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে, ১৯৬৪ সাল থেকে লাগাতার বামপন্থী আন্দোলনের মধ‍্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক জমি তৈরী হয়েছে তার ফসল ১৯৭৭ সাল থেকে বামফ্রন্টের মোড়কে সিপিএম ঘরে তুলেছে। পক্ষান্তরে, নকশাল ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের “কংশাল” অত‍্যাচারের মধ‍্যে মমতা ব‍্যানার্জীর রাজনৈতিক জন্ম হওয়ায় তিনি তাঁর রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন দুটি স্তম্ভের উপর – একটি বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিএমের কুশাসনের ফলে তৈরী হওয়া জনরোষ এবং অন‍্যটি কৃষকের জমি হারানোর ভয় ও বেকারসংখ‍্যার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। এতসব সত্ত্বেও বলব, ২০১১ সালে রাজনৈতিক সততার ধ্বজাধারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য না থেকে যদি কোন কট্টর জঙ্গী নেতা বামফ্রন্টের কান্ডারী থাকতেন, তাহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সফল ভূমিকা সত্ত্বেও মমতা ব‍্যানার্জীর মূখ‍্যমন্ত্রীত্ব পাওয়া হয়ত সম্ভব হত না।
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকায় – বিশেষতঃ রাজ‍্যের ক্রমবর্ধমান বিপুল বেকারত্বের চাপের মধ‍্যে তৃণমূল সরকার যেভাবে রাজ‍্যের অর্থনীতিকে চালাতে চেষ্টা করছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত‍্যক্ষ‍ সাহায‍্য ছাড়া রাজ‍্য সরকারের চলার কথা নয়। প্রতি মাসে প্রায় ছ হাজার কোটি টাকা ওভারড্রাফ্ট (সুদ দেওয়ার করারে ধার) না নিলে সরকার তার অনুদানের প্রজেক্টগুলি ত চালাতে পারবেই না, তারা কর্মচারীদের মাইনে এবং পেনশান দিতেও সমর্থ হবে না। এখানে একটা কথা, অনুমোদিত পেনশান দেওয়া এবং প্রদান করা দুটোই সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ‍্যে পরে। অর্থাৎ, এটা DA দেওয়া নয়; যেদিন সরকারী পেনশান বন্ধ হবে, সেদিন থেকে রাজ‍্য সরকারের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সংবিধানের ৩৫৫ ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তাবে। এ বিষয়ে সংবিধান এতটাই পরিষ্কার যে, কোন জজ বা কোন ‘সেট ইন’ ব‍্যবস্থা তা আটকাতে পারবে না। অবশ‍্য কতদিন এই ধার দেওয়া-নেওয়া চলবে তা রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের উপর অর্থাৎ বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থনৈতিক কারনে দায়বদ্ধ থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় আটকে গেছে রাজ‍্যের তৃণমূল সরকার।
আগে একাধিকবার বলেছি, ২০২১এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জেতেনি – বিজেপি হেরেছে! এর ব‍্যাখ‍্যাও দিয়েছি। এখন যত সময় এগোচ্ছে, সেই যুক্তির সত‍্যতা বেশী বেশী করে প্রমাণিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থা গত পঞ্চাশ বছরে যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অযথা রাজনৈতিক বিবাদের ফলশ্রুতিতে রাজ‍্য চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা। এটা বুঝেই দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে সুচতুর রাজনীতিবিদ জ‍্যোতি বসু রাজনীতিতে যে সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন তা অল্প কথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয় – রাজ‍্যে কুস্তি, কেন্দ্রে দোস্তি! এর ফলে, কেন্দ্রের তখনকার শাসকদল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ছন্নছাড়া অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। এটি জ‍্যোতিবাবু খুব চাতুর্যের সঙ্গে করতেন এবং সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংষ্কার আন্দোলনের সার্থক রূপ দেওয়া ও পঞ্চায়েতীরাজ চালু করা – এগুলোই বামফ্রন্টকে চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় রেখেছিল। মমতাদেবীর তৃণমূল দলের এমন কোন কাজ না থাকায় এবং অনুদান রাজনীতির জাতাকলে রাজ‍্যের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় এই সরকারের স্থায়ীত্ব অনেকটাই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল।
দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল গত নির্বাচনে জেতার পরেই হটাৎ করে সর্বভারতীয় দল হওয়ার লক্ষ‍্যে ত্রিপুরার লোকাল বডি নির্বাচনে তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে গেল। নিজেদের বিজেপির বিরুদ্ধে প্রজেক্ট করল! সেখানে বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের মধ‍্যে প্রাক্তণ বিরোধীদল সিপিএম যেটুকু ঘর গুছিয়ে নিতে পেরেছিল, তৃণমূলের এই বহুল প্রচারিত লড়াইয়ে তারা সিপিএমের ভোট অনেকটাই কেটে নিয়ে বিজেপির জয় সুনিশ্চিত করল! আশ্চর্যের ব‍্যাপার – তৃণমূল একটুও দমে না গিয়ে, সাজানো স্ক্রিপ্টের নাটকের মত গোয়ায় গিয়ে এমন প্রচার শুরু করল যে মনে হল তারা এবার সেখানে বিজেপিকে হারিয়ে রাজ‍্য বিধানসভা দখল করবে! যেন তাদের নির্বাচন জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা! সেখানেও তারা বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রজেক্ট করল! এখানে মনে রাখা দরকার, গোয়ায় ২০১৫ সালের নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল ছিল কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীর মূর্খামী ও বিজেপির রাজনৈতিক পরিপক্কতার কারনে সেখানে বিজেপি কংগ্রেসের দল ভাঙ্গিয়ে এবং এমজিপির সঙ্গে সমঝোতা করে সেবার ক্ষমতায় আসে। সুতরাং এবারের লড়াই শুধু শক্তই নয়, বিজেপির কাছে অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। তৃণমূল, প্রধানত মমতা ব‍্যানার্জী ও অভিশেক ব‍্যানার্জী, সেখানে তাদের বিজেপি বিরোধী ইমেজ ভাঙ্গিয়ে যে প্রচার করলেন, তাতে তাদের দল কোন আসন না পেলেও কংগ্রেস ও আপের ভোট কেটে তাদের আসন সংখ‍্যা অনেক কমিয়ে দিল – বিজেপির সরকার গঠন অনেক সহজ হল। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সহযোগী দল এমজিপিও তৃণমূলের বিজেপি বিরোধী ইমেজকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটল; ভোট গণনা শুরু হওয়ার মুখে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙ্গে রাজ‍্যে বিজেপিকে সমর্থন করার ঘোষণা করে দিল!
উত্তর প্রদেশে মমতা ব‍্যানার্জী সমাজবাদী পার্টির সভায় এমন আক্রমণাত্মক বক্তব‍্য রাখলেন যে সেখানকার নির্বাচনে, বিশেষতঃ বাঙ্গালী অধ‍্যুষিত বেনারসে বিজেপি সহজেই জিতে গেল। অর্থাৎ, মমতা ব‍্যানার্জী বিজেপির পক্ষে দূর্বল জায়গাগুলিতে প্রচার চালালেন এবং সব জায়গাতেই বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভ করল! মমতা ব‍্যানার্জীর মত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার ধৃষ্টতা করা ঠিক নয়। তিনি ভুল স্ট্র‍্যাটেজি নিয়ে এসব করেছেন বলে মনে হয় না। আবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রার্থী চয়ন থেকে দলের নির্বাচন পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ এমনভাবে করল যে, এমন পরিপন্থী কাজ করা তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেও মানা যায় না। হয়ত এভাবেই রাজনৈতিক সৌজন‍্যের প্রতিদান দেওয়া হয়!
এদিকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যে দলের প্রধান বিরোধীর ভূমিকা পালন করার কথা, সেই জাতীয় কংগ্রেস দল কালের নিয়মে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে এখন বিলীন হওয়ার পথে। তার প্রথম ও প্রধান কারন, এই দল লালবাহাদুর শাস্ত্রী জমানার অল্প সময় ছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পারিবারিক দল হিসেবে রয়ে গেছে। ভারতের মত কর্তাভজা দেশে অবশ‍্য তাতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কারন প্রায় সব বিরোধী দলই পারিবারিক দল! তবে, এইসব দলের স্থায়ীত্ব ও সাফল‍্য নির্ভর করে তার নেতৃত্বের যোগ‍্যতার উপর। ইন্দিরা গান্ধী যে যোগ‍্যতায় দলকে পরিচালনা করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে তা দেখা না গেলেও সুদৃঢ় ইমারত ভাঙ্গতে আরো ২৫-৩০ বছর লাগছে। কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বে দাম্ভিকতা পুরোপুরি থাকলেও যোগ‍্যতা বিন্দুমাত্র নেই। সোনিয়া গান্ধী বড়জোর kitchen conspiracyতে দক্ষ হতে পারেন – তাঁর কংগ্রেসের মত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর যোগ‍্যতা নেই, উপরন্তু দাম্ভিকতা পুরোদস্তুর – ফলে, অযোগ‍্য চামচা ছাড়া আর কোন সুযোগ‍্য রাজনীতিকের ঐ দলে থাকা সম্ভব নয়।
সোনিয়া গান্ধী বিদেশিনী হওয়ার কারনে তিনি একটি বিশেষ স্তরের উপরে, সর্বভারতীয় পর্যায়ে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সাহস করেননি। যদিও তিনি ভারতের ডোমিসাইল্ড নাগরিক – ইটালীতে জন্ম এবং ইটালিয়ান বাবা মার সন্তান হওয়ার কারনে তিনি OCI (Oversease Citizen of Italy) হতেই পারেন। ভারত ও ইটালী দুই দেশই দ্বিনাগরিকত্বকে মাণ‍্যতা দেয় না। তবে ভারতের ওভারসীজ সিটিজেনরা দেশে জমিজমা ও অন‍্য সম্পত্তি রাখতে পারেন এবং তাঁরা ভারতীয় ইনকাম ট‍্যাক্সের আওতায় পরেন; কিন্তু তাঁরা ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না। ইটালীর OCIরা কিন্তু এখন সে দেশের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন! তাদের এই আইনটা ভিন্ন। সে দেশের পার্লামেন্টো ইটালীয়ানোতে দু ভাগে বিভক্ত সিনেট ও ডেপুটিজ – দুয়ের ক্ষমতা সমান; দু কক্ষই সরাসরি নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত। এক্ষেত্রে সংবিধানের ল নম্বর ৪৫৯ এ ২৯শে ডিসেম্বর, ২০০১ সালে সংশোধন করে (৪৮, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর সংশোধনী) ওভারসীজ কন্সটিটিউয়েন্সী নামে OCIদের জন‍্য ৬টি সিনেট ও ১২টি ডেপুটিজ কন্সটিটিউয়েন্সী করে ভোট দেওয়ার নিয়ম করেছে! কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন পরিবার যে ইটালীর OCI নন, তেমন কোন প্রমান এখনো জানা নেই। ভারতের আইনে কিন্তু কোন নাগরিক বিদেশের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। এধরনের রহস‍্যাবৃত নাগরিকত্ব নিঃসন্দেহে ভোটের ময়দানে অন‍্য রাজনৈতিক দলকে সুবিধা করে দেবে। পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবারতন্ত্রের কংগ্রেসের তৃণমূল বা বিজেপিকে বেগ দেওয়ার ক্ষমতা আগামী নির্বাচনে অন্ততঃ নেই।
এখন কম‍্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের পুনরুত্বানের যে গল্প বিভিন্ন মিডিয়ার দৌলতে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার কোন ভিত্তি আছে বলে ত মনে হয় না। লকডাউনের সময় রেড ভলান্টিয়ার্সদের কাজ যেমন প্রশংসার দাবী রাখে, তেমনি আরো অনেক গোষ্ঠীই সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এসেছিল – শুধু একটি বা দুটি গোষ্ঠীকে সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রচার পাইয়ে দিলে তা যে বিশেষ পার্টির ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে – তার কোন কারন আছে বলে মনে হয় না। এ ব‍্যাপারে কম‍্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের বড় বাধা হল তাদের জাতীয় নীতি! কম‍্যুনিষ্টরা স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যেমন হিন্দু-বিদ্বেষের সঙ্গে ভারত বিদ্বেষ ও পাকিস্তানপ্রীতি চালিয়ে গেছে, আজও সেই একইভাবে তাদের নীতি অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছে। ফলে, দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে তাদের কাজকর্ম দেশ-বিরোধী তকমা পাচ্ছে। এভাবেই তারা সারা দেশেই ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত মৌলিক পরিস্থিতিতে যে মৌলিক নীতির পরিবর্তন করতে হয় তা ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টদের অজানা।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গে ২০২৪ সালের নির্বাচনে মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল দলের কোন বিকল্প নেই – যদি না বিজেপি তাদের ‘সেট-ইন’ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসে। এই ব‍িষয়টা পুরোপুরি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। ইডি,সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের বারবার বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে চলা রাজ‍্যসরকারের পাশে যখন না দাঁড়ানোর সংকেত আসবে এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার মত অভিজ্ঞ টিম যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ‍্য বিজেপিতে তৈরী করে তখন বুঝতে হবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আসন্ন। অন‍্যথায়, পশ্চিমবঙ্গের মসনদ থেকে মমতা ব‍্যানার্জীকে হটানো সম্ভব নয়। তবে, রাজনীতির দাবা খেলায় তৃণমূলের দিল্লী দখল ত দুরস্ত্, পশ্চিমবঙ্গ তাদের থাকবে কিনা তা বিজেপির উপর নির্ভরশীল।

আমআদমি পার্টির কাছে পশ্চিমবঙ্গের মাটি কতটা ঊর্বর

পাঁচ রাজ‍্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কারভাবে রাজনীতির আঙ্গিনায় উঠে এসেছে। চার রাজ‍্যে বিজেপির জয় এবং কেন্দ্রশাসিত দিল্লীর বাইরে প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ‍্য পাঞ্জাবে আপের উত্থান। তারপরই উচ্ছসিত আপ নেতৃত্বের ঘোষণা – পশ্চিমবঙ্গ তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক টার্গেট। তখন থেকেই বাঙ্গালীদের আপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কথা শুরু হয়েছে! আপের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বলার মত সময় এখনো না এলেও এ বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে। প্রথমে বলতে হয়, আপ (আম আদমি পার্টি) গঠনতন্ত্র ও সংগঠনে অন‍্য আঞ্চলিক দলগুলির থেকে আলাদা কিছু নয় – যেমন অন‍্য আঞ্চলিক দলগুলি একজন সুপ্রিমো দ্বারা চালিত হয়, তেমনি আপও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল।
কে এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল? ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের অফিসার কেজরিওয়াল আই আই টি খড়্গপুর থেকে মেকানিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ বি টেক পাশ করার পর ১৯৯৫ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে (ইনকাম ট‍্যাক্স) যোগ দেন। চাকরীতে তিনি বিভিন্ন কারনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন

এবং তিনি ২০০৬ সালে চাকরীতে পদত‍্যাগ করলেও তা মামলা-মকদ্দমার পর ১৯১১ সালে গৃহীত হয়। চাকরী জীবনেও কেজরিওয়ালের চাকরী অপেক্ষা সামাজিক ন‍্যায়ের জন‍্য লড়াই করার প্রবণতা অনেক বেশী লক্ষ‍্য করা যায়। চাকরী করার সময় কেজরিওয়াল কখনোই সরকারী আধিকারিকের চাকরীর প্রতি যে বিশ্বস্ততা দেখানোর কথা তা দেখাননি। তিনি আন্না হাজারের ‘সরকারীস্তরে এবং রাজনীতিতে দূর্ণীতি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হন। সেখানে সহযোগী হিসেবে পান সহকর্মী মণীশ শিশোদিয়াকে। তারপর বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দূর্ণীতির বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লীতে। সরকারের right to information (RTI) বিল পাশ করাতে তাঁর আন্দোলন যথেষ্ট গুরুত্ব দাবী করে। কিন্তু, তারপর দুটি NGO পরিচালনার ব‍্যাপারে (যার একটি নন-রেজিষ্টার্ড) এবং আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের সাদা জামায় কালির ছিটে লাগে। আন্না হাজারের অরাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের মধ‍্যে দিয়ে যার সামাজিক প্রতিষ্ঠা, সেই কেজরিওয়ালের পুরো লড়াই রাজনীতির ময়দানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন‍্য – এই উদ্দেশ‍্য যখন সামনে এলো তখন শুধু যে তিনি আন্নার থেকে সরে গেলেন তাই নয়, তাঁর আন্দোলন রাজনৈতিক সততার পরাকাষ্ঠা আর থাকলো না। যে অচলায়তনের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই, তিনি সেই অচলায়তনেরই অংশ হয়ে গেলেন। কেজরিওয়াল জনলোকপাল বিলের খসড়া তৈরীর কমিটিতে থাকলেও এবং প্রথমদিকে আন্না হাজারে, অরুন্ধতী রায়ের মত সমাজ-জীবনে দূর্ণীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা মানুষরা তাঁর সঙ্গে সাথ দিলেও পরে কেজরিওয়ালের NGOতে ফোর্ড ফাউন্ডেশান সহ বিদেশী এজেন্সির ফান্ডিং করার ব‍্যাপারে কেজরিওয়াল কোন সঠিক ব‍্যখ‍্যা না দিতে পারার কারনে তাঁরা কেজরিওয়ালের বিরোধীতা করেন।
এত কথা বলার উদ্দেশ‍্য একটাই। যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে গেলে মমতা ব‍্যানার্জীর কর্মপদ্ধতি জানতে হবে, তেমনি কেজরিওয়ালের কর্মপদ্ধতি জানলে আপের কর্মপদ্ধতি জানা যাবে। মমতা ব‍্যানার্জী ও কেজরিওয়ালের মধ‍্যে মিলের জায়গাটা হল, দুজনেই জন-আন্দোলনের ভিত্তির উপর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এবং দুজনেই ব্ল‍্যাকমেলিংয়ে সিদ্ধহস্ত। রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রতিশ্রুতির খেলাপ দুজনের রেকর্ডেই আছে! শুধু মমতা ব‍্যানার্জী প্রথম থেকেই রাজনীতির আঙ্গিনায় আছেন আর কেজরিওয়াল অরাজনৈতিক, দূর্ণীতি বিরোধী আন্দোলনে পরিচিতি পেয়ে রাজনীতির আঙ্গিনায় তার ফসল তুলেছেন। যে রাজনৈতিক ভন্ডামী ও অসততার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করে নেতৃত্বের দাবীদার হয়েছেন, পরবর্তী সময়ে সেই ভন্ডামী ও অসততার পরিকাঠামোর মধ‍্যে তিনি মধু আহরনের অন্বেষণে মনোনিবেশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি সুচারুভাবে পরিকল্পিত দ্বিচারিতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পরপর দুবার দিল্লীতে কেজরিওয়ালের আপ কিভাবে অভূতপূর্ব সাফল‍্য পেল। এ ব‍্যাপারে বলতে হয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেজরিওয়ালের অবস্থান বদল য়থেষ্ট কার্যকরী হয়েছে। কেজরিওয়ালের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দী বিজেপি এবং কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল হওয়ায় সব ইস‍্যুতে তারা সহজে নিজেদের অবস্থান বদল করতে পারেনা – এটা সব সর্বভারতীয় দলের ক্ষেত্রেই হয় – তাদের নীতির স্বচ্ছতা বজায় রাখার বাধ‍্যবাধকতা থাকে। বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে জাতীয় কংগ্রেস যত পিছিয়ে পড়েছে ততই তারা জেহাদী ও মৌলবাদী শক্তি এবং দেশবিরোধী কম‍্যুনিষ্টদের হাত ধরেছে। তার ফলে, শিক্ষিত, শান্তিপ্রিয় ভারতীয় মুসলমানদের অসহায়তা বেড়েছে এবং তাতে বিজেপির ও আঞ্চলিক দলগুলির লাভ হয়েছে। কারন, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি দেখলে বোঝা যায় যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিমুখী। এক্ষেত্রে মুসলিম ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলির পক্ষে গিয়েছে। এই আঞ্চলিক দলগুলি প্রায় সকলেই কপট ইসলামপ্রেমী ‘সেকুলার’ ভেকধারী। এভাবেই দিল্লীর বিধানসভা ভোটে আপের সমর্থনে মুসলিম ভোট প্রায় একচেটিয়াভাবে পড়েছে কারন এই ভোটারদের কাছে অন‍্য অপশান ছিলনা! অন‍্যদিকে দিল্লীতে কেজরিওয়ালের দূর্ণীতি বিরোধী ইমেজ আপের পক্ষে হিন্দু মধ‍্যবিত্তদের একাংশের ভোট পেয়েছে যা দিল্লীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ‍্য – ভারতের অন‍্য জায়গায় তার প্রভাব পড়ার কথা নয়। আবার ‘ফ্রি সার্ভিস’ দেওয়ার যে টেকনিক আপ দেখিয়েছে, যেমন বিদ‍্যুত, জল – এসবের জন‍্য নিম্নবিত্তদের অধিকাংশ সমর্থন আপের দিকে গেছে। এখানে মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রশাসিত দিল্লী বিধানসভার ক্ষমতা ও গন্ডি অনেক সীমিত। সে তুলনায় পাঞ্জাব বিধানসভা একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ‍্যের এবং তার ক্ষমতার গন্ডি অনেক বেশী। পাঞ্জাবের পুলিশ প্রশাসন, পঞ্চায়েত ও কৃষি প্রশাসন কেজরিওয়ালের আপের কাছে এক নতুন পরীক্ষা।
আপের পাঞ্জাব বিধানসভার নির্বাচনে অভুতপূর্ব সাফল‍্যলাভের ব‍্যাখ‍্যা যারা করছেন তাঁদের অধিকাংশের ব‍্যাখ‍্যাই পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ায় সঠিক কারন বলা হয়নি। আপের এই জয়ের কারন কিন্তু দিল্লীর নির্বাচন জয়ের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দিল্লীর শাসন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আপ নেতৃত্বের সঙ্গে জেহাদী ও কম‍্যুনিষ্ট ‘টুকরে গ‍্যাং’য়ের যোগাযোগ ছিলই। এদের একটি নীতি খুব পরিষ্কার – ম‍্যাকিয়াভেলীর তত্ত্ব অনুযায়ী এরা শত্রুর শত্রুকে বন্ধু হিসেবে জড়িয়ে ধরে। সেভাবেই এরা দিল্লীতে বিজেপি বিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক দল আপের পক্ষে ভোট করেছে। পাঞ্জাবের খেলা আবার অন‍্যরকম। দিল্লীর প্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে চলা তথাকথিত কৃষক আন্দোলনের সময় প্রকাশ পায় যে এই আন্দোলন শুধু ভারত বিরোধী জেহাদীশক্তি ও কম‍্যুনিষ্টদের মদতেই নয়, এই আন্দোলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল আরেক ভারত বিরোধী শক্তি – খালিস্তানীরা। খালিস্তানীদের কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের উপর রাগের সবচেয়ে বড় কারন হল, বর্তমানে বাতিল হওয়া কৃষি আইন। এই আইনের ফলে সংগঠিত ও ক্ষমতাশালী কৃষক লবির কৃষিপণ‍্যের মূল‍্য ও বন্টন ব‍্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হচ্ছিল। আমরা জানি যে, খালিস্তানী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে পাঞ্জাবের এই কুলাক শ্রেণী। কেজরিওয়াল ও আপ এই কৃষক আন্দোলনকে খুল্লামখুল্লা সমর্থন করায় এই শ্রেণী দেখল বিজেপির সঙ্গে থাকা শিরোমণি অকালি দল অপেক্ষা আপ তাদের অনেক কাছের। তারা বিভিন্ন কারনে কংগ্রেসের উপরেও অসন্তুষ্ট ছিল। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরকারী প্রশাসনকে দূর্ণীতিমুক্ত করার ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলো। যদি কৃষক আইনের জন‍্য জনসাধারনের বিরূপতা বিজেপিকে সইতে হত তা হলে, যেখানে এই আন্দোলন হয়েছে সেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি এত সংখ‍্যাগরিষ্টতা পেত না। পাঞ্জাবের ভোট নিয়ন্ত্রণ করেছে খালিস্তানী শক্তি। আমার অভিমত হল, এখান থেকেই আপের আসল পরীক্ষা শুরু হল। কারন, রাজ‍্যে ক্ষমতা দখল করেই দূর্ণীতি উপড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে – সেই দূর্ণীতিগ্রস্ত ব‍্যবস্থার অংশীদার হয়ে – ক্ষমতার অলিন্দে বসে ভারতে কোন রাজনৈতিক দল সফল হয়নি। তাছাড়া, পাঞ্জাবে আপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক খালিস্তানী শক্তিও দূর্ণীতি দুর করার ব‍্যাপারে আগ্রহী নয়। এই খালিস্তানীদের চাপ আপ সরকারের উপর ক্রমশঃ বাড়তে থাকলে কত দূর পর্যন্ত তা সামাল দেওয়ার দক্ষতা আপ দেখায় সেটাও পর্যবেক্ষণ করার ব‍্যাপার। এর অবিসম্বাদী ফল হল, দু বছর বাদে আপের জনপ্রিয়তায় ভাঁটার টান আসতে বাধ‍্য।
এবার আসি কেজরিওয়াল তথা আপের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঘোষিত প্রবেশের সম্বন্ধে কিছু কথায়। পশ্চিমবঙ্গে গত সাতান্ন-আটান্ন বছর ধরে পাঁচ-ছয় রকম স্তরে নির্বাচনে রিগিং হয়ে আসছে। এখন ত পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনও সন্দেহের ঊর্ধে থাকেন না! একমাত্র ২০১১ সালে এখানে রিগিং করেও শেষরক্ষা করা যায়নি। অন‍্য রাজ‍্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন একদম আলাদা। এই দীর্ঘ সময়ে সব সময়, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে সর্বদা শাসকদলের (যখন যে দল ছিল) প্রার্থী জিতেএসেছে। সুতরাং, এখানে শাসক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন জেতা অসম্ভব। বিশেষত পঞ্চায়েত ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন, যার দায়িত্ব রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনের – সেই নির্বাচনগুলি কতটা নির্বাচন ও কতটা অন‍্য কিছু – তা সময়ের দলিলে লিপিবদ্ধ থাকছে। এমতাবস্থায়, আপের দুই প্রধান অস্ত্র, অনুদান ও দূর্ণীতি দূরীকরণ, পশ্চিমবঙ্গে কাজ করবে না। কারন, তৃণমূল কংগ্রেসের কর্ণধার মমতা ব‍্যানার্জীর অনুদান নীতি, তার নাটকীয় ঘোষণা ও তাঁবেদার বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির প্রচার – এতকিছুর সঙ্গে আপ পাল্লা দিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ও দূর্ণীতিগ্রস্ত প্রশাসনের সঙ্গে এ রাজ‍্যের মানুষ এতটাই পরিচিত যে, আপের প্রচার নতুন করে তাঁদের মনে দাগ কাটতে পারবে না। বিশেষতঃ অরুন্ধতী রায়রা আগেই কেজরিওয়ালের NGOতে বিদেশী অনুদানকে কাটমানির পর্যায়ে ফেলে দেওয়ায় আপ মমতা ব‍্যানার্জীর নিজের মাঠে তাঁর স্টাইলে খেলতে এলে তাদের পরাজয় অবশ‍্যম্ভাবী। হয়ত প্রথমবার বলে NOTAর সমসংখ‍্যক ভোট আপ পেতে পারে! সব রাজ‍্যের সব মানুষই যে অনুদানজীবি – তা ভাবার কারন নেই। সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গে ৫০০ টাকা লক্ষ্মীর ভান্ডারের অনুদানের জন‍্য তৃণমূল জিতেছে ধরে নিলে বলতে হয়, গোয়ায় ৫০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও সেখানে তৃণমূলের খাতা না খুলতে পারার কারন কি? আসলে প্রতিটি রাজ‍্যের পরিস্থিতি, চাহিদা ভিন্ন। পাঞ্জাবে খালিস্তানি ফ‍্যাক্টর কাজ করেছে। সেই ফ‍্যাক্টর ইউপিতে না থাকায় সেখানে কাজ করেনি। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষতঃ মহম্মদ সেলিম সিপিএমের রাজ‍্য সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় এবং মমতা ব‍্যনার্জীর ” দুধেল খাই” নীতির প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের জেহাদী মুসলিম ভোট আপের দিকে যাওয়ার কোন কারন নেই।
সুতরাং, আপের সর্বাধিক বৃদ্ধি হয়ে গেছে। অন্ততপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অদূর ভবিষ‍্যতে তার রাজনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবণা নেই।

কলকাতা বইমেলা ও কিছু প্রশ্ন

৪৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা সবে শেষ হল। ১৯৭৬ সালে ময়দানে এখনকার মোহরকুঞ্জে প্রথম বইমেলা শুরু হয়। এটি প্রথমে ছিল কলকাতাস্থিত পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স গিল্ডের একটি প্রশংসনীয় উদ‍্যোগ। এই মূহুর্তে বইয়ের সম্ভারে এই আন্তর্জাতিক বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডনের বইমেলার পরেই। অবশ‍্য জনসমাগমের হিসেবে কুড়িলক্ষের বেশী হওয়ায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক বইমেলা।
আমি ১৯৭৬ সাল থেকে টানা প্রায় ত্রিশ বছর প্রতিটি বইমেলায় উপস্থিত থেকেছি। মেলার মূল উদ্দেশ‍্যের সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ করে বই পড়া ও কেনার আনন্দ উপভোগ করেছি। মনে আছে, ১৯৭৮ সালে, ভারতীয় আর্কিটেকচারের উপর একটি মূল‍্যবান প্রামাণ‍্য বই এক স্টলে রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কেউ আমায় বাধা দেয়নি – কেউ এগিয়ে এসে বলেনি বইটা দেব; অর্থাৎ, “না কিনলে সরে পরুন” গোছের ভাব – যা পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে। মেলার শেষ দিনে বইটা পড়ে যখন যথাস্থানে রাখছি, একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আপনার পড়া শেষ হল?” আমি তৃপ্তির হাসি নিয়ে বললাম,”হ‍্যাঁ”। উনি হেসে বললেন,” আমরা লক্ষ‍্য করেছি, আপনি রোজ এসে বইটা পড়েন। আপনার সুবিধার জন‍্য আমরা এই বইটা একই জায়গায় রেখেছি”। আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে বললাম,”ধন‍্যবাদ। আসলে এত দামী বই কেনার ক্ষমতা আমার নেই। তাই রোজ এসে আমি বইটা পড়ে নিলাম” – এই ছিল বইমেলার মর্মার্থ (spirit)। তখন বইমেলায় প্রবেশমূল‍্য লাগত পঞ্চাশ পয়সা! পরবর্তী সময়ে প্রবেশমূল‍্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সিজন টিকিটের বন্দোবস্ত হয়। ধীরে ধীরে বইমেলার কলেবর স্ফীত হতে থাকে। মানবিক মূল‍্যবোধের সামাজিক অবক্ষয়, যা রাজনীতির প্রত‍্যক্ষ‍ হস্তক্ষেপের আবহে এ রাজ‍্যে প্রসার লাভ করে, তা বইমেলাতেও ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হতে থাকে। ক্রমশঃ শুধু পাঠক নয়, উদ‍্যোক্তাদের চিন্তাধারায়ও অনেক পরিবর্তন আসে। ময়দানের পর, মিলনমেলা ঘুরে, এখন কলকাতা বইমেলার স্থায়ী জায়গা হয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক, বিধাননগর। বেশ কয়েকবছর মেলায় ঢুকতে কোন প্রবেশমূল‍্য লাগে না। আগে মেলার পাশে নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রাখার ব‍্যবস্থা ছিল – ঘন্টাপ্রতি কুড়িটাকা হিসেবে। এবারের অভিজ্ঞতা, মেলার উল্টোদিকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পার্কিং – সত্তর টাকা ঘন্টা, কোন রসিদ দেওয়া হয় না! এটা সরকার, পুলিশ ও গিল্ডের অগোচরে হয়েছে বলে কি মনে হয়? আসলে মেলা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র বদল হয়েছে। প্রথমে এই মেলায় স্টল দেওয়া যেত একমাত্র পাবলিশার হলেই – সাধারন বই বিক্রেতাদের স্টল দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ২০০০ সাল থেকে শুধু পাবলিশার্সরাই নয়, বই বিক্রেতারাও স্টল দিতে পারেন। এতে মেলায় অংশগ্রহণের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব অপেক্ষা অর্থনৈতিক লাভের আকাঙ্খা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা অন‍্যরকম প্রভাব মেলায় পড়েছে। মেলার দর্শক চরিত্র বদলে গিয়ে মেলার বই বিক্রির সংখ‍্যার কি বৃদ্ধি হয়েছে – এটাই মূল প্রশ্ন। কারন, বইমেলার উদ্দেশ‍্য দুটি – বইয়ের প্রকাশক ও ক্রেতা-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগের মাধ‍্যমে মতবিনিময় এবং বই পড়ার উৎসাহ প্রদান করা।
মেলার চাকচিক‍্য, ব‍্যাপ্তি ও প্রচারের ক্রমবৃদ্ধিতে গিল্ডের প্রয়াস যেমন মাণ‍্যতা পায়, তেমনি সরকারী দাক্ষিণ‍্য ও আনুকুল‍্য এর একটা বড় কারন। এখানেই বইমেলার সবচেয়ে বড় চরিত্রগত পরিবর্তন লক্ষ‍্য করা গেল। গত ৫০-৬০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমাজ জীবনে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কাজের ব‍্যাপারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবান্ছিত হস্তক্ষেপ সুবিদিত। সেজন‍্য আমাদের কলকাতা বইমেলা যত সরকারী দাক্ষিণ‍্যের বেড়াজালে নিজেকে সঁপে দিয়েছে ততই সে তার লক্ষ‍্য থেকে একটু একটু করে সরে গিয়েছে। রাজনীতির মোড়কে বইমেলাকে মুড়ে ফেলার উদ‍্যোগ রাজ‍্যসরকারের উচ্চতম স্তর থেকে শুরু হওয়ায় তা রোধ করার ক্ষমতা গিল্ডের ছিল না। গিল্ড সে চেষ্টাও করেনি। আবার বইমেলার ব‍্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম বৃদ্ধির ফলে এই মেলা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল মেলায় পরিণত হল! এর থেকে লাভের কড়ি সংগ্রহের বিভিন্ন রকম বন্দোবস্ত শুরু হল – আর তার ফলে বইমেলা তার চরিত্র খুঁইয়ে এক অদ্ভুত জনসমাগমের মেলায় পরিণত হল!
এবারের, অর্থাৎ ৪৫তম কলকাতা বইমেলায় দু বছর বাদে পা রেখে যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ‍্য করেছি, তা প্রথমেই বলি, বই ছাড়া অন‍্য জিনিষের প্রাচুর্য! যেমন, ভোজনরসিক বাঙ্গালীর জন‍্য ভারতীয়, চাইনিজ, ও আরো অনেক ফিউশানধর্মী খাবারের দোকান। পুরো মেলার মধ‍্যে এই দোকানগুলিতেই ক্রেতা ও ভোক্তার ভিড়। এছাড়া বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রয়াত মানুষজনের নামে মুক্ত ও বদ্ধ মঞ্চ! এগুলির কয়েকটি জায়গায় গিয়ে আমার উপলব্ধি – এগুলিতে ব‍্যক্তি বিশেষের আত্মপ্রচার ও বিশেষ ‘ইজম’ ভিত্তিক প্রচার হচ্ছে যা, বইমেলায় বই দেখতে ও পড়তে আসা মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন। এছাড়া, বইমেলায় পটশিল্পী তাঁর পট ও ছবির পসরা সাজিয়ে বিক্রির উদ্দেশ‍্যে বসেছেন! এমনকি জাঙ্ক জুয়েলারী বিক্রির দোকানও দেখেছি! যত মানুষ বই দেখছেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী মানুষ, বিশেষতঃ যুবক-যুবতীর দল মোবাইলে সেল্ফি তুলতে ব‍্যস্ত। বাবা-মার হাত ধরে খুঁদে পড়ুয়ার দল, যারা বই দেখে, গন্ধ আস্বাদন করে বই কিনত, তাদের সংখ‍্যা অতি নগণ্য। বইমেলায় নয়টি প্রবেশদ্বার থাকায়, প্রবেশমূল‍্য ব‍্যতীত এই মেলায় দর্শক সমাগমের সঠিক হিসেব পাওয়া সম্ভব নয়। তবে, একটি ব‍্যাপার পরিষ্কার – বইমেলা তার দর্শক চিত্রে বদল ঘটিয়েছে। এখন বই বিক্রেতা ত বটেই, প্রকাশকরা পর্যন্ত বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচিত হওয়ার সময় দিতে নারাজ – অনেকটা ভোগ‍্যপণ‍্যের বাজারের মত – ফেল কড়ি, মাখো তেল – গোছের! তাঁদের বই বিক্রি একমাত্র উদ্দেশ‍্য বলে মনে হয়। আবার বইমেলার ক্রেতা চরিত্রের আমূল পরিবর্তন নজরে আসে। বইমেলায় ঘুরতে আসা, সেল্ফি তোলা, ও বিভিন্ন খাবারের দোকানে ভিড় করা মানুষের সংখ‍্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পকেটমারও হাজির! এক অভিনেত্রী-কাম পকেটমার ধরাও পরেছে। আগে বইচোর (এদের চোর বলতে আমার দ্বিধা আছে) ধরা পরত – এখন ভোগের সামগ্রীর মেলার চরিত্র অনুযায়ী পকেটমার ধরা পরছে! এইসঙ্গে ভালো বই দেখা, কেনা ও পড়ার মানুষের সংখ‍্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিভিন্ন দেশের প‍্যাভেলিয়ানগুলির মধ‍্যে নজর কাড়ার কথা থিম কান্ট্রি বাংলাদেশের প‍্যাভেলিয়ানের। সেখানে ভিড় আছে। হয়ত তাদের বই বিক্রিও হচ্ছে। এখানে একটা কথা অবশ‍্যই বলা উচিৎ – বইমেলা আসলে বইয়ের সাথে পাঠকের পরিচিত হওয়ার মেলা। কারন, কলেজস্ট্রীটে বই কিনলে বইমেলায় দেয় ১০% এর বেশী ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু কলেজস্ট্রীটে বই বাছার ও বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সুতরাং, বই চয়ন করার জায়গা হল বইমেলা। বইমেলার এই রূপটাই এবারের বইমেলায় খুঁজে পাওয়া গেল না। উচ্চমধ‍্যবিত্তের ড্রইংরুমে সাজানোর জন‍্য বই কেনা ও সরকারী দাক্ষিণ‍্যে ‘অনুপ্রাণিত’ ছোট, বড়, মেজ, সেজ কিছু আধিকারিকের দাপাদাপি দৃশ‍্যমান! এর মধ‍্যে পুলিশের দায়িত্ব পালন যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের বইয়ের দাম টাকায় লেখা এবং বাংলাদেশের টাকার আন্তর্জাতিক মূল‍্যমান ভারতীয় টাকার তুলনায় কম। তবু তারা তাদের দেশের টাকার হিসেবে ভারতীয় টাকায় ১০% ছাড় দিয়ে তাদের বই বিক্রি করছে – অতিরিক্ত মুনাফা লাভের অনৈতিক প্রয়াস। এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। এই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সময় বাংলাদেশের ঢাকার দুটি জায়গায় তাদের সর্ববৃহৎ বইমেলা – ‘একুশে বইমেলা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কোন ভারতীয় প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই! এর কারন বোঝা যায়না – অংশগ্রহণে অসুবিধা কোথায়?
শুধু বাংলাদেশই নয়, আরো কয়েকটি দেশের প‍্যাভেলিয়ানে ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও বইয়ের সম্ভার দেখা যায়নি! আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুবিশাল প‍্যভেলিয়ান জুড়ে কোন বইয়ের দেখা পেলাম না। হতে পারে এদের উদ্দেশ‍্য অন‍্য! তবে, বইমেলার মূল উদ্দেশ‍্য, বইপড়ার চেতনাবৃদ্ধির কোন প্রচেষ্টা এসব জায়গায় দেখা যায়নি। এছাড়া, লিটল্ ম‍্যগাজিন ও ছোট ছোট পাবলিশার্সদের যে উৎসাহ, উদ্দীপনার মধ‍্যে স্টল দেওয়া এবং সেখানে উৎসাহী পাঠকদের আনাগোনা কয়েক বছর আগেও দেখা যেত, তা এখন সম্পূর্ণভাবে অদৃশ‍্য।
এবারের বইমেলায় ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ‘বইমেলা’ নামের একটি হুজুগে বিনোদনকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। অবশ‍্য নবীন ও প্রবীন লেখকদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান মেলা প্রাঙ্গনে হয়ে চলেছে অনেকটা বাহ‍্যিক আচার অনুষ্ঠানের মত – মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অভাব প্রায় সব ক্ষেত্রেই। এর থেকে কয়েকটি ব‍্যাপার সহজেই প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ, এই সময়ে লেখার ও বিষয়ের গুনাগুণের উপর জনপ্রিয়তা নির্ভর করেনা – করে, কোন সংবাদ-মাধ‍্যম প্রমোট করছে তার উপর! শুধু প্রবন্ধের ক্ষেত্রেই নয়, গল্প, উপন‍্যাস, কবিতা – সবক্ষেত্রেই তা প্রযোজ‍্য। ফলে গুণমানের অবমূল‍্যায়নের সাথে বই পড়ার অভ‍্যাস – বিশেষতঃ বাঙ্গালীর – নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন যেকোন মুদ্রিত বাংলা সংস্করণের বিক্রির সংখ‍্যা দেখলেই বোঝা যায়। গল্প-উপন‍্যাস এমনকি গান,কবিতায়ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির বদলে ‘ইজম’ এর বহিঃপ্রকাশ – যা মানুষের সৃজনশীলতাকে গোলাম বানানোর চেষ্টায় পরিণত হচ্ছে। এগুলো পাঠককে গেলানোর চেষ্টার অবিসম্বাদী ফল হল – বাঙ্গালী পাঠক ধীরে ধীরে বই পড়ার অভ‍্যাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
আবার বিভিন্ন রকম কারনে বইয়ের অস্বাভাবিক মূল‍্যবৃদ্ধি এই নেগেটিভ চিন্তাধারায় খানিকটা ইন্ধন জুগিয়েছে। পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মনন, চিন্তনের সুস্থ বহিঃপ্রকাশের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ‍্যম হল সৃজনশীল, রাজনীতিমুক্ত চিন্তা, যা লেখার মাধ‍্যমে আমজনতার কাছে পৌঁছায়। এক সময় এই কৃষ্টি-ঐতিহ‍্য বাঙ্গালীর ছিল। কিন্তু, বাংলার রাজনীতিমুক্ত চিন্তা-ভাবনা ও সৃজনশীলতার ঐতিহ্য যদি আবার কখনো ফিরে আসে, তাহলে বাঙ্গালী আবার তার বইপ্রীতির জগতে ফিরে আসবে। কারন, সামাজিক-মাধ‍্যম ও বৈদ‍্যুতিন-মাধ‍্যম কখনোই বইয়ের প্রতিস্থাপক নয়। তবে, সবচেয়ে প্রথমে ব‍্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দাক্ষিণ‍্যের মোহ ত‍্যাগ করে এই সৃষ্টির জগতকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। আমাদের সবার এই দায়িত্ব থাকলেও প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ডের।

বঙ্গ রাজনীতিতে জাতীয়দল ব্রাত‍্য

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ভারতের অন‍্য রাজ‍্যগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যে কারনে স্বাধীনতা উত্তর যুগে বিধান রায় ও প্রফুল্ল সেনের পর সর্বভারতীয় কোন দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সিংহাসনে বসতে পারেনি (সিদ্ধার্থ রায়ের ১৯৭২ সালের নির্বাচনে বিতর্কিত জয় বাদ দিলে)। এইজন‍্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চরিত্র ও চাহিদা বুঝে রাজনীতি না করলে এই রাজ‍্যে রাজনৈতিক সাফল‍্য পাওয়া দুষ্কর। যদি পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য গঠনের পর থেকে রাজনৈতিক পটভূমি ও ইতিহাসের দিকে তাকানো যায়, তাহলে শুরু থেকেই এ রাজ‍্যের বঞ্চনার ইতিহাসের কাহিনী পাওয়া যাবে। প্রথমে এ রাজ‍্যের সফলতম মূখ‍্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে নেহরু গোড়াতে ডঃ রায়কে এই চেয়ারে বসাতে চাননি – পরে অবশ‍্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বসাতে বাধ‍্য হয়েছিলেন। তারপর বহুবার রাজ‍্যের উন্নয়ণের প্রস্তাবে নেহরু সরকারের অসহযোগীতায় ডঃ রায় বিরক্তি প্রকাশ করেন। একবার তিনি তাঁর চিকিৎসার দ্বারা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে সুস্থ করার বিনিময়ে সে দেশের সরকারের থেকে রাজ‍্যের উন্নয়ণের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায‍্য গ্রহণ করেন! তখন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর অবিরাম বহমান স্রোতে পশ্চিমবঙ্গ দিশেহারা। যদিও পাঞ্জাবে একই রকম উদ্বাস্তু সমস‍্যা হয়েছিল, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায‍্যের পরিমাণ অনেক বেশী সদর্থক ও কার্যকরী হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক সেবা কাজে নিযুক্ত সেবামূলক সংস্থা সেখানে অনেক বেশী সক্রিয় ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘ ছাড়া আর কোন সংস্থা কার্যকরী সাহায‍্যের হাত বাড়ায়নি। তাছাড়া, ভারতের অন‍্য কোন রাজ‍্যকে এই রাজ‍্যের মত ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত সামলাতে হয়নি। এই দুবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের বদলা নিতে পাকিস্তান তাদের হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর চরম অত‍্যাচার করে দেশ ছাড়তে বাধ‍্য করে। পূর্বপাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার তাদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে উদ্বাস্তু হিসেবে হিন্দুরা ভারতে পালিয়ে আসতে থাকে। যদিও কিছু শরণার্থী আসাম ও ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন, তবু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের শতকরা নব্বইভাগের বেশী উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সত‍্য বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, নেহরু ও তাঁর পরবর্তী কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রীয়স্তরে যেমন এই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কোন সঠিক পরিকল্পনা করেননি, তেমনই তাঁদের জন‍্য কোন আর্থিক সাহায‍্য মেলেনি। রাজ‍্যের সরকারও সেভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ কিছু শরণার্থীকে পান্ডব বিবর্জিত, জনমানবশূণ‍্য, চাষের অযোগ‍্য শুখা জায়গা দন্ডকারণ‍্যে পাঠিয়ে এই সমস‍্যা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পশ্বিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলিও এদের হিন্দু-বাঙ্গালী পরিচয় এবং সেকারনেই উদ্বাস্তু হয়ে আসা হতভাগ্য মানুষদেরকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-বাঙ্গালী সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু সমাজে এদের বাংলা ভাষাগত উচ্চারণের পার্থক‍্যের কারনে এই হতভাগ‍্য মানুষদের বিদ্রুপ ও অবহেলার শিকার হতে হয়েছে! সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এদের সঙ্গে এপার বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীদের(এদেশী) আলাদা করার প্রয়াস করা হয় – পাঞ্জাবীদের সঙ্গে এখানেই বাঙ্গালীদের তফাৎ। এই অভাগা মানুষরা যখন ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হয়ে অর্থ, সম্পদ, মান-সম্মান, সমস্ত কিছু খুঁইয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তখন তাদের প্রতি সহমর্মীতা দূরের কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসহযোগীতা করা হয়েছে। এই বাস্তবতার এক অপ্রত‍্যক্ষ প্রমাণ হল পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় অস্বাস্থ‍্যকর পরিবেশে উদ্বাস্তু কলোনী গড়ে ওঠা – এই উদ্বাস্তু পরিবারদের বাঁচার সামাজিক মূলধন বলতে সংঘবদ্ধতাই একমাত্র অবশিষ্ট ছিল।
এই সময় পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিস্টরা রাজনৈতিক জমি শক্ত করার কাজে মনোনিবেশ করে। তারা এইসব উদ্বাস্তু পরিবারের থেকে কর্মী সংগ্রহ করার উদ্দেশ‍্যে এদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহার করতে শুরু করে এবং এদের উন্নয়ণের ও বাসস্থান এবং খাবার সংস্থানের জন‍্য সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। তখন উদ্বাস্তুরাও সরকারী এবং সামাজিক অবহেলায় সব আশা ভরসা হারিয়ে এদেরকেই খরকুটোর মত আঁকড়ে ধরে। তারপর কম‍্যুনিস্টরা যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলো তখন তাদের আদর্শগত দ্বন্দ সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ তৈরী হলো! সবচেয়ে বড় দ্বন্দের কারন, এই উদ্বাস্তু পরিবারের প্রায় সবাই কম‍্যুনিস্টদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভোটার আর এদের মধ‍্যে প্রচুর অল্পবয়সী সক্রিয় কম‍্যুনিস্ট কর্মী থাকলেও তাদের সকলের মুসলমান বিদ্বেষ ছিল – যা পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। এদিকে ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা শুরু থেকেই জেহাদী ইসলামের সমর্থন ও পাকিস্তানের পক্ষে সওয়াল করে আসছে; শুধু তাই নয়, আদর্শগতভাবে তারা হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের এই অবস্থান যে সমর্থন পাবে না – সেটা বুঝেই তারা এক অদ্ভুত শব্দ – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ – আমদানী করল। যদিও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইসলাম এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম স্বীকৃত নয়, তবু তারা এটি হিন্দুদের অবশ‍্য পালনীয় একটি কর্তব‍্য – যা তাদের কৃষ্টি ও সভ‍্যতার মেরুদণ্ড – এমন প্রচার শুরু করল! বেঁচে থাকার তাগিধে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি কোন আপত্তি করার সাহস পেল না।তারপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের (committed intellectuals) দিয়ে গল্প-উপন‍্যাস লেখানো, সিনেমা, থিয়েটার দেখানো ইত‍্যাদি শুরু হল যেখানে ইসলামী ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের প্রেম ও পরিণতিতে ইসলামী পরিবারের উদারতার কথা প্রচার করা হতে লাগল। যদি ভিন্ন ধর্মীয় ছেলে মেয়ের প্রেমের গল্প দেখানো হয়, সেখানে সমকালীন সাহিত‍্যে কোন হিন্দু ছেলের সঙ্গে ইসলামী মেয়ের প্রেম এবং সেখানে মেয়ের পরিবার ধর্মীয় উদারতা দেখিয়েছে – এমন একটি গল্প-উপন‍্যাস বা সিনেমা আমার চোখে পড়েনি। কম‍্যুনিস্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গে যে সব পরিবর্তন হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল দলদাস ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করা। এই বুদ্ধিজীবীরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হবেন এমন কোন কথা নেই – তবে তাদের দলদাস সংবাদ-মাধ‍্যম বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রচার করেছে আর এরাই দলের নীতি জনগনকে ‘গেলানো’র দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মাধ‍্যমেই বাঙ্গালী হিন্দুদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মাহাত‍্য বোঝানো শুরু হল। বঙ্গীয় হিন্দু বাঙ্গালীদের উদ্বাস্তু ও এদেশীরা উভয়েই ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্টদের এই চালে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ‍্য হল। সমাজজীবনে এবং অর্থনৈতিকভাবে কোন সাহায‍্য না পাওয়ায় যেমন সর্বভারতীয় দলগুলির থেকে বাঙ্গালীরা মুখ ফিরিয়ে নিল তেমনি কম‍্যুনিস্ট নিষ্পেষণ ও ভোটের হিংসা বাঙ্গালীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল। বাঙ্গালীর আল্ট্রা কম‍্যুনিস্টদের হিংসায় প্রতিবাদী চরিত্র অবধি নষ্ট হল। “কম‍্যুনিস্ট প্রচার নাৎসী প্রচারকেও হার মানায়” বলে প্রবাদ আছে। কয়েকবছর আগে চীনে গিয়ে আমি সাংহাইয়ের চাকচিক‍্যের আড়ালে জিয়ান থেকে বেজিংয়ের বিভিন্ন অনুন্নয়ণের ছবি দেখেছি। এনিয়ে ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের কথা বলতে দেখিনি। যেমন রাশিয়ার ইউক্রেনের উপর দখলদারীর আক্রমণ বিষয়ে কম‍্যুনিস্টরা আর তাদের প্ল‍্যান্টেড বুদ্ধিজীবীদের ভাষা বন্ধ হয়ে আছে!
আবার ২১শে ফেব্রুয়ারীকে বাংলা ভাষা দিবস বলে দলদাস বুদ্ধিজীবী – সংবাদ-মাধ‍্যমের পশ্চিমবঙ্গ আর সোশ্যাল মাধ‍্যম জুড়ে সেকি লাফালাফি! বাংলা ভাষা নিয়ে আমার জানা আন্দোলনগুলির কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল বাঙ্গালী জাতি হিসেবে শতধাবিভক্ত – ভাষা হিসেবেও তাই! বিশুদ্ধ বাঙ্গালী আর বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা – দুইই অস্তিত্বহীন! পশ্চিমবঙ্গে ভাষা দিবসের নামে যা হয়, তা অন‍্য একটি রাষ্ট্রের প্রচার মাত্র। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতীতত্ত্বের (হিন্দু ও মুসলমান) ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান, দুটি খন্ডিত অংশ নিয়ে পাকিস্তান তৈরীর পর থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানে এবং দুই অংশেরই রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম। এই ধর্মের সুযোগ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের লাঞ্ছনা ও ইজ্জত হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সর্বস্ব খুঁইয়ে ভারত ভূখন্ডে (প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গে) উদ্বাস্তু হয়ে আসার ঢল নামে। তাঁদের সম্পত্তি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা দখল করলেও আইন হিন্দুদের কোন সুরাহা দিল না (কুখ‍্যাত এনিমি প্রপার্টি আইন)। প্রথম ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে সংশোধনী এনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদায় সরকারী ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব পেশ করেন সংসদ সদস‍্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁকে সমর্থন জানান পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হিন্দু সদস‍্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টপাধ‍্যায়। যে কথা বলা হয় না তাহল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন‍্যান‍্য ইসলামী বাঙ্গালী সদষ‍্যরা, যারা মুসলিম লীগের সদস‍্য, তারা মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের নেতৃত্ত্বে বাংলা ভাষার জন‍্য আনা এই সংশোধনীকে বিরোধীতা করে খারিজ করেন। সুতরাং বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলন সে দেশের মুসলমান বাঙ্গালীর আন্দোলন নয়! গোল বাঁধল ১৯৫০ সালের পর – যখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে চাকরী ও অন‍্যান‍্য সরকারী সুবিধার জন‍্য একমাত্র উর্দু ভাষাকে স্বীকৃতি দিল। বাংলা ভাষা সরকারের কাছে শুধু গুরুত্বহীণ হয়ে গেল তা নয়, বাংলায় শিক্ষাপ্রাপ্ত উর্দু না জানা সিংহভাগ পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকের (ধর্ম নির্বিশেষে) ভাষার কারনে অর্থনৈতিক বৈষম‍্যের শিকার হওয়ার উপক্রম হল। তখন মুজিবুর রহমানসহ মুসলীম লীগ নেতারা প্রমাদ গুনলেন। এই কারনেই, মূলতঃ অর্থনৈতিক বঞ্চনার ভয়ে তাঁরা বাংলাকে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন শুরু করলেন। এটা ভাষা আন্দোলন নয় – উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানকে ভাতে মারার চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন। বহু বছর আগে ‘দি স্টেটসম‍্যান’ কাগজে প্রখ‍্যাত লেখক আব্দুল গফ্ফর খান এই লাইনেই একটি লেখা লিখেছিলেন। যে কারনে বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলনের পুরোধা গণপরিষদের হিন্দু সদস‍্যদের ২১শে ফেব্রুয়ারীর সম্মাননা অনুষ্ঠানে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় না। এটি উর্দুভাষী ইসলামীদের বিরুদ্ধে বাংলাভাষী ইসলামীদের ক্ষমতা দেখানোর লড়াইয়ের একটি অধ‍্যায়।
আবার দেখা যাচ্ছে, বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের অন‍্য যে রাজ‍্যে থিতু হয়েছে, সেখানেই তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন‍্য লড়াই করেছে। আসামে ১৯৬০-৬১ সালে যখন মূখ‍্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা রাজ‍্যে অহমীয়া ভাষাকেই একমাত্র সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, হিন্দু উদ্বাস্তু অধ‍্যুষিত বরাক উপত‍্যকার মানুষ তীব্র ক্ষোভে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে এই হিন্দু বাঙ্গালীদের ১১ জনকে অসম পুলিশের বাহিনী গুলি করে হত‍্যা করে। তারপর প্রতিবাদের আগুন তীব্রতর হওয়ায় চালিহা বরাক উপত‍্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে বাধ‍্য হন। এ সময় আন্দোলনে কোন বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহনের প্রমাণ মেলে না! পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলি ও ভাড়াটে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন অন‍্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলন বলে চালান; আর ১৯৬১র ১৯শে মে’র বাংলা ভাষার জন‍্য বাঙ্গালীর আত্মবলিদানকে ভুলে যান, তখন তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত ইসলামী সেকুলারিজমকে আপামর বাঙ্গালীর হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার গূঢ় অভিপ্রায় প্রতীয়মান হয়। এভাবে ছত্রিসগড়ের দন্ডকারণ‍্য, কর্ণাটকের রায়চুড় জেলা, বিহারের মানভূম ও ঝাড়খন্ডের শিকার জেলায় উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা পড়াশোনার মাধ‍্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনে ভাড়াটে সংবাদ-মাধ‍্যম ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনগুলিকে ভাষা আন্দোলন বলে না, কারন এগুলি তাদের এ‍্যাজেন্ডায় নেই!
ভারতে বাংলা ভাষার জন‍্য যে কটি আন্দোলন হয়েছে, তার সবকটিই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীর নেতৃত্বে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কুটচালে এই বাংলার ‘এদেশী’ বাঙ্গালী এই আন্দোলনে কখনো সামিল হননি। এর কারন একটাই, কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল দল ত বটেই, পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত বামপন্থীরাও তাদের রাজনৈতিক সুবিধার জন‍্য সামাজিক পরিবেশে হিন্দু বাঙ্গালীদের বিভক্ত করে রেখেছে। অথচ, এরাই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও কার্যকরী শিক্ষার উন্নতি না করে শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে মুসলমান সমাজকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে।
এইভাবে ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্ট প্রভাবে রাজনীতি বাঙ্গালীর সমাজনীতিতেও ঢুকে গেল। রাজ‍্যের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনে কেন্দ্রের ঔদাসীন‍্য এবং কম‍্যুনিস্ট দলতন্ত্র কায়েমের ঘটনা রাজ‍্যের সাধারন মানুষকে সরকারী তথা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ‍্য নির্ভর করে তুলতে বাধ‍্য করল। প্রথমে উদ্বাস্তু পরিবারের জন‍্য হলেও পরে রাজ‍্যের অর্থনীতির বন্ধ‍্যাত্বের কারনে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীই সরকারী দাক্ষিণ‍্য ও ভাতাজীবী হওয়ার দিকে ঝুঁকে গেল। কম‍্যুনিস্টদের নেতৃত্বে যখন প্রকৃত ভদ্রলোক বাঙ্গালী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এলেন এবং তিনি ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার আফিমের বদলে বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করলেন। তখন বাঙ্গালীর মানসিক গঠনের পরিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ায় বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোটে বামপন্থী দলকে হটিয়ে মমতা ব‍্যানার্জীর আঞ্চলিক দলকে রাজ‍্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলো। ইতিমধ্যে ভোটে হিংসা ও সরকারী প্রশাসনকে ব‍্যবহার করে বারবার নির্বাচন জেতা কম‍্যুনিস্টদের অত‍্যাচারে হিন্দু-মুসলমান সবারই মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। শুধু বুদ্ধদেববাবুর সততা ও সমাজের উন্নয়নের প্রকল্প ব‍্যর্থ হল! মমতা ব‍্যানার্জী ক্ষমতা দখলের পর কম‍্যুনিস্ট কায়দায় প্রশাসন ও সংবাদ-মাধ‍্যমকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে দলদাসে পরিণত করে একই কায়দায় নির্বাচনে বিভিন্ন পর্যায়ের অসততা ও ভীতির আশ্রয় নিয়ে তাঁর দলের জয়লাভ সুনির্দিষ্ট করলেন! কখনো কেন্দ্রীয় সরকারের কোন সদর্থক পদক্ষেপ না থাকায় এবং জাতীয় দলগুলির নেতৃত্বকে এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোন কার্যকরী সাহায‍্য না করায় তাদের রাজ‍্য নেতৃত্ব রাজনৈতিক জোকারে পর্যবসিত হলেন! এতে অবশ‍্যই তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজ‍্য নেতৃত্ব ও রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কুটনীতির সাফল‍্য দায়ী – ক্ষতি অবশ‍্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীর। মমতাদেবী পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে সরকারী দাক্ষিণ‍্য নির্ভর হিন্দু বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার অক্সিজেন হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করলেন – সঙ্গে অবশ‍্যই ইসলামী ধর্ম নিরপেক্ষতার তাস খেলতে লাগলেন। তার বড় কারন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারনে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামী ভোটারের সংখ‍্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কম‍্যুনিস্টদের কায়দায় তিনিও তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চরিত্রের মধ‍্যে তফাৎ ঘুচিঁয়ে দিয়ে দল ও প্রশাসনকে সমার্থক করার প্রয়াস করলেন।
আমরা বাঙ্গালী হিন্দুরা এখনো ঘটি, বাঙ্গাল, অসমীয়া বাঙ্গালী, বিহারী বাঙ্গালী, প্রবাসী বাঙ্গালী ও সেকুলার বাঙ্গালী ইত‍্যাদি মেরুদন্ডহীণ কয়েকটি ক্লীবশ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ‍্যে তুচ্ছ দলাদলিতে মগ্ন – সমষ্ঠীস্বার্থ সম্পর্কে জ্ঞানহীন জীব হয়েই রইলাম। কিন্তু ইসলামীরা, বাঙ্গালী হোক বা না হোক – প্রথমে তারা ইসলামী, শেষেও তারা ইসলামী। তাদের কাছে হিন্দুরা “মালাউন”। সুতরাং হিন্দু-মুসলিম সামাজিক ঐক‍্য সোনার পাথরবাটি মাত্র – ধর্মকে কার্যকরীভাবে ভুলতে পারলেই শুধু বাঙ্গালী ঐক‍্য সম্ভব। এখন তার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মধ‍্যে কোন জাতিগত একতা না থাকায় বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদের বোধও তৈরী হয়নি। সেজন‍্য জাতীয় স্বার্থ, বিদেশনীতি, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বাঙ্গালীর বর্তমান প্রজন্মের মধ‍্যে অনুপস্থিত। ভাতাজীবী বাঙ্গালী, ও ইসলামী ঐক‍্যের সমন্ধয়ে বাঙ্গালীর থেকে কোন জাতীয়তাবাদী বা সর্বভারতীয় দলের সমর্থন পাওয়ার কথা নয়, কারন, বাঙ্গালী নিজের মূল থেকে উৎপাটিত হওয়ায় তার মধ‍্যে ভারতীয়ত্ব খোঁজা বাতুলতা মাত্র। সেজন‍্য সুবিধাবাদী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাফল‍্য পাওয়া অদূর ভবিষ‍্যতে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। বাঙ্গালীর ভবিতব‍্য গর্বিত ক্রীতদাসের ভাতাজীবী জীবন!

শিক্ষায় মাৎস‍্যন‍্যায় চলছে চলবে

মেকলে প্রবর্তিত ভারতে শিক্ষানীতির অভিমুখ ছিল ভারতীয়দের ইংরেজী ভাষাজ্ঞান দিয়ে তাদের করনিকবৃত্তির জন‍্য তৈরী করা। কারন ইংরেজ শাসকের বুদ্ধির সঙ্গে নেটিভ হাতের মেলবন্ধন এই বিশাল দেশকে শাসনের জন‍্য দরকার ছিল। স্বাধীনতার পরে নেহরুভিয়ান নীতির প্রভাবে গঠিত শিক্ষানীতির অভিমুখ বদলে হয়ে গেল “সমাজবাদী শিক্ষা” তার সঙ্গে শিক্ষার গণতন্ত্রীকরনের নামে শিক্ষার রাজনীতিকরন!
ব‍্যাপারটা খোলসা করে বলতে গেলে বলতে হয়, শুরু থেকেই ভারতে শিক্ষার অভিমুখ ভুল দিকে গিয়েছে। নেহরুর একটা রোমান্টিক বন্ধন ছিল ‘সমাজবাদী’ কথাটার উপর! তাঁর কন‍্যা এবং পৌত্রের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে “সাম‍্যবাদী” “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে জেহাদী মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছিল। শিক্ষার অঙ্গনে এই নীতির প্রবেশের ছাড়পত্র সরকারী আনুকুল‍্যেই শুরু হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতার অব‍্যবহিত পরবর্তী পর্যায়ে বুনিয়াদী ও প্রাথমিক শিক্ষায় জোর দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা অবহেলা করে শিক্ষাখাতে খরচের সিংহভাগ নিয়োজিত হল IIT, IIM স্থাপনে! একটি বাড়ি তৈরী করার সময় ভিতের দিকে নজর না দিয়ে প্রথমেই উচ্চতম তলের নির্মানের চেষ্টা হলে বাড়ির যে অবস্থা হয়, আমাদের শিক্ষা ব‍্যাবস্থারও সেই হাল হল। একটি জাতির ভিত সুদৃঢ় করতে প্রয়োজন তার উৎকৃষ্ট ও সর্বব‍্যপী প্রাথমিক শিক্ষা ব‍্যবস্থা। ইউরোপ, বিশেষতঃ ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, এমনকি এশিয়ার জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর তার উদাহরণ। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পরে প্রাথমিক স্তর থেকে সার্বজনীন শিক্ষার জন‍্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। Top heavy শিক্ষাব‍্যবস্থায় অর্থব‍্যয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা সমাজের সার্বজনীন উপকারে আসেনি। তাছাড়া, দেশের সুদীর্ঘ সময়কালের শাসক পরিবারের ধারনা ছিল, শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের শিক্ষার উপরে জোর দিলেই স্বাক্ষরতার হার বাড়বে! এই ধারনা রাজনৈতিক ফয়দা নেবার চেষ্টায়। তাদের ধারনা ছিল আমজনতার স্বাক্ষরতা পাওয়া শিক্ষায় মোক্ষলাভ। উচ্চশিক্ষা elitist মাত্র! এই ধারনার বশবর্তী হয়ে ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষার মাদ্রাসা খুলতে সরকারী দাক্ষিণ‍্য মঞ্জুর করা হল। আবার শিক্ষা ধীরে ধীরে কম‍্যুনিস্টদের নিয়ন্ত্রনাধীন হওয়ায় তারা তাদের রাজনৈতিক এ‍্যজেন্ডাগুলি রূপায়নের জন‍্য শিক্ষা বিভাগকে আঁকড়ে ধরল।
শুরু হল শিক্ষার জেহাদীকরন! মাদ্রাসা শিক্ষার রাশ ইসলামী শিক্ষাবিদদের হাতে না গিয়ে তা গেল মোল্লা, মৌলভী যারা ভারতবিদ্বেষী ত বটেই, হিন্দুবিদ্বেষীও বটে, তাদের হাতে। সেখানে প্রকৃত সহিষ্ণুতার শিক্ষা, যা ইসলামের একটি মূল কথা, না শিখিয়ে ছাত্রদের মধ‍্যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদের বীজ রোপনের প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে সাফল‍্য পেতে শুরু করল। কাশ্মীর ও বালুচিস্তান সম্পর্কে নেহরুর অহংকারীভাবে নেওয়া নির্বোধ নীতির ফলে ভারতে জেহাদীর সংখ‍্যা বাড়তে লাগল। সঙ্গে চলল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন। ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা শুরু থেকেই জেহাদী ইসলামের সমর্থক ও হিন্দুধর্মের বিরোধী হওয়ায় দেশে শিক্ষা ব‍্যবস্থায় ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার আমদানী করা হল। দেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের শুরু থেকেই হিন্দুদের ধর্মীয় ঐতিহ‍্য পালনের সুযোগ সাধারন স্কুলগুলিতে কমিয়ে বা বন্ধ করে দেওয়া হল। কিন্তু মুসলমানদের স্কুলে ধর্মপালনের ব‍্যাপারে বাধা ত নয়ই, বরং উৎসাহ দেওয়া হতে লাগল। একথা মনে রাখা দরকার যে এ কাজ ভারতের হিন্দু-মুসলমান সাধারন মানুষরা করেনি। সরকারে অধিষ্ঠিত কংগ্রেস দল তাদের সহযোগী কম‍্যুনিস্টদের সঙ্গে মিলে এভাবে শিক্ষায় ধর্মীয় মেরুকরন শুরু করল।
কিন্তু দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থায় বুনিয়াদী থেকে উচ্চতম স্তর অব্দি নির্দিষ্ট সিলেবাস গলাধঃকরন করে পরীক্ষার সময় যে ছাত্র সেটা যত বেশী উগরে দিতে পারবে তার নম্বর তত বেশী! এই শিক্ষায় আর যাই হোক, বোধবুদ্ধির বিকাশ হয় না – স্বাধীন চিন্তার বিকাশও হয় না। এর ফলে দেশের শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশকে আজগুবি ধর্মনিরপেক্ষতার এবং সাম‍্যবাদের ছাঁচে ঢালাই করে নিতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের পক্ষে সহজ হল। আর সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ভারতীয়ত্বের শিক্ষা না পাওয়ায় দেশের মানুষের মধ‍্যে জাতীয়তাবাদের (nationalism) বোধ কম বা অবলুপ্ত হল। ফলে চরিত্র গঠনের শিক্ষার অভাবে দেশে সমস্ত স্তরে দূর্ণীতি মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেল।
বিশেষতঃ সমাজসেবার নামে নির্বাচনে জিতে কে কত সরকারী অর্থ আত্মস্মাৎ করতে পারে তার জন‍্য হিংস্র প্রতিযোগীতা শুরু হল। ইসলামী ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় ধীরে ধীরে দেশে জেহাদী হিংসা ও তার বিপরীতে হিন্দু প্রতিরোধ বৃদ্ধি পেল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও এই হিন্দুস্তান অর্থাৎ ভারতে ইসলামকে অতিরিক্ত সুবিধা ( এটা মনে রাখা দরকার, শুরুতে ভারতীয় মুসলমানরা অতিরিক্ত কোন সুবিধা দাবী করেনি) দিয়ে জেহাদের রাজনীতি শুরু করার দায়িত্ব পুরোপুরি নেহরু ও পরবর্তী সব কংগ্রেস সরকারের। এর ফলে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মুসলমান নাগরিকরা। একদিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে জেহাদী ও তাদের সহযোগীরা ভারতের অস্তিত্বের মূলে আঘাত করছে, প্রতিবেশী রাস্ট্রের পক্ষে নাড়া লাগাচ্ছে; অন‍্যদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যা এই সব ভারতীয় মুসলমানদের রক্তে। কিভাবে ধান্দাবাজীর রাজনীতি দেশকে বিষিয়ে দিয়েছে তার একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ফারুখ আবদুল্লার মেয়ে একজন হিন্দুকে বিয়ে করার পর ফারুখ তাঁর জামাইয়ের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের নির্দেশ পাঠালে জামাই তাতে অসম্মত হন। তখন রুষ্ট ফারুখ আবদুল্লা তাঁর মেয়েকে ত‍্যাজ‍্যকন‍্যা ঘোষণা করেন। এই ফারুখ আবদুল্লা আবার কোলকাতায় এসে মঞ্চ আলো করে হাতে হাত মিলিয়ে বিরোধী ঐক‍্যের জন‍্য ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দেন! এইসব তথাকথিত বিরোধী নেতা নেত্রীদের সঠিক শিক্ষার অভাবে এরা সচেতনভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে নিজেদের ক্ষুদ্রব‍্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উপায় খোঁজেন। সরকার বিরোধী আন্দোলন কখন যে দেশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, তা বোঝার ক্ষমতা এদের অশিক্ষা-কুশিক্ষার কারনে সম্ভব হয় না।
এখন কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক দলের সরকার আছে তারা নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করলেও এখনো তার বাস্তবায়ন হয়নি।এই শিক্ষানীতিতে পূর্বের দূর্বলতাগুলি দূর করে প্রাথমিক স্তর থেকে মেধার বিকাশ ও সেইসঙ্গে জাতীয় ঐতিহ‍্যের উত্তরাধিকার বহন করার শিক্ষা দেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। শুভ প্রস্তাব – বাস্তবায়নের আশায় রইলাম। এখানে প্রাথমিক স্কুলশিক্ষা অবৈতনিক করার প্রস্তাব রাখা হলেও তা বাস্তবায়নের পরিকাঠামো নির্মাণ এই মূহুর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের জন‍্য সরকারের যে ভূমিকা দরকার তা কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্য সরকারের মধ‍্যে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষা নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ব‍্যবসা। এর থেকে দুধ দোয়ানোর জন‍্য সব পক্ষই উদগ্রীব। গত ৩৫-৪০ বছরে শিক্ষকদের, বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষায়, বেতন যেমন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, সে অনুযায়ী শিক্ষকদের শিক্ষাদান অপেক্ষা দলীয় কাজে সময় দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। বিশেষতঃ কম‍্যুনিস্ট শাসিত রাজ‍্যগুলিতে এই প্রবণতা বেশী থাকলেও অন‍্যান‍্য দল শাসিত রাজ‍্যগুলি তার ব‍্যতিক্রম নয়। এর সবচেয়ে বড় কারন শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতি। কোথাও দলদাস নিয়োগ হয় ত কোথাও অর্থ বা অন‍্য কিছুর বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে! এক্ষেত্রে যোগ‍্যতা ধর্তব‍্যের মধ‍্যে আনা হচ্ছে না। এদিকে বিভিন্ন রাজ‍্য সরকারের বিভিন্ন স্তরের নিয়োগের জন‍্য বিভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ কমিশন আছে। তার ফলে, অল্প হলেও যেমন খুশী তেমন নিয়োগে অসুবিধা হচ্ছে – বারবার আদালতের আদেশে সরকারের মুখ পুড়ছে। এই অসুবিধা সব রাজনৈতিক দলের। সেজন‍্য বিভিন্ন রকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে! নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের ট্রেণিংয়ের কথা বলা হলেও তাদের নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ কিছু বলা নেই। অবশ‍্য এ বিষয়ে বলার কথা UGCর। কিন্তু UGCর সাম্প্রতিক একটি বিজ্ঞপ্তি – ন‍্যাশনাল হায়ার এডুকেশান কোয়ালিফিকেশান ফ্রেমওয়ার্কের খসড়া তারা সব রাজ‍্যকে পাঠিয়ে গত ১৩ই ফেব্রুয়ারির মধ‍্যে মতামত জানাতে বলে! সঙ্গে হায়ার এডুকেশানের ইন্সটিটিউশানাল ডেভেলপমেন্ট প্ল‍্যানেরও খসড়া পাঠানো হয়। শিক্ষায় রাজনীতিকরনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই খসড়া ও তাতে রাজ‍্যের প্রতিক্রিয়া।
এখানে একটি ব‍্যাপার লক্ষ‍্যণীয় – তা হল, কংগ্রেসী রাজত্বে শিক্ষা যে মানুষের মস্তিষ্ক ও চরিত্র গঠনের ট্রেণিং নয়, শুধুমাত্র কম‍্যুনিস্ট ধারনা মোতাবেক মানব সম্পদ উন্নয়নের জন‍্য, তা বোঝাতেই দপ্তরের নাম পাল্টে মানব সম্পদ উন্নয়ণ দপ্তর করা হয়! আমার আগের ধারনার সঠিক প্রতিফলন এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া, বৈচিত্র্যের মাঝে সমন্বয়ের জন‍্য যে দপ্তর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, তা নির্বোধের মত কেন্দ্র-রাজ‍্য উভয়ের যৌথ নিয়ন্ত্রণে এল। কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না – এর ফলে প্রতিটি রাজ‍্য এবং কেন্দ্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই দপ্তরকে ব‍্যবহার করার সুযোগ পেল।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষাকে তার পরিচিত সেট-আপের থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। তাদের পূর্ববর্তী সরকারের অনুগত শিক্ষক বাহিনী শিক্ষার জগতে তাদের রাজনৈতিক চেতনার উত্তরসূরী হিসেবে ছাত্রকুলকে দীক্ষিত করার কাজকে শিক্ষক হিসেবে প্রধান কর্তব‍্য বলে মনে করতেন। এছাড়া এই শিক্ষককুল তাদের পক্ষে সমাজে যতটা রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতেন, তার থেকে প্রকৃত শিক্ষাদানে ব‍্যপৃত থাকতেন অনেক কম সময়! সেজন‍্য এই সরকার তাদের প্রভাব খর্ব করার জন‍্য কয়েকটি পদক্ষেপ করে। প্রথমে তারা নিজেদের প্রতি অনুগত শিক্ষকদের বিশেষ বিশেষ চেয়ারে, যেমন, উপাচার্য, প্রিন্সিপাল বা প্রধান শিক্ষক পদে বসাতে শুরু করেন। অবশ‍্য এ কাজ এখন সারা দেশ জুড়েই চলছে। এটা পরিষ্কার বোঝা যায় এই খসড়া পাঠানোর মধ‍্যে দিয়ে। এখন আমাদের রাজ‍্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায় শিক্ষক সংখ‍্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। সেজন‍্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মেয়াদবৃদ্ধি থেকে ধরে বিভিন্ন নাম দিয়ে শিক্ষিত যুবকদের অত‍্যন্ত কম বেতনে নিয়োগ করা হচ্ছে। এতে সরকারের অর্থ শিক্ষায় ব‍্যয় না করে অন‍্য খাতে ব‍্যয় করা, বেকারদের সরকারী নীতির দ্বারা শোষণ করা এবং চাকরীর স্থিরতায় প্রশ্ন চিহ্ন রেখে তাদের দলদাস হিসেবে ব‍্যবহার করা, বিভিন্ন নিয়োগ আয়োগকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করা – এতগুলি উদ্দেশ‍্য সাধিত হল! বিনিময়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মান নষ্ট হল। নিকৃষ্টমানের শিক্ষক নিয়োগে নিকৃষ্টমানের শিক্ষাদান হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কিছু এসে যায় না। শিক্ষা যে ব‍্যবসা নয়, তা দেশের নেতারা আজও বোঝেননি। ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকারের আমলে ঘোষিত শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ছিল ১:১৮। এখনো কাগজে কলমে তাই। কিন্তু এই খসড়ায় বিজ্ঞান ছাড়া অন‍্য বিভাগে১:৩০ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগে ১:২৫ মাত্র। তা হলে যেসব রাজ‍্যে এবং কেন্দ্রীয় সংস্থায় শিক্ষক সংখ‍্যা ভালো তাদের ব‍্যাপক ছাঁটাইয়ের পথে যেতে হবে! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারে এই অনুপাতের চেয়েও শিক্ষকসংখ‍্যা কম এবং যারা প্রতিনিয়ত শিক্ষায় সংকোচন করে চলেছে তারা একই পথের পথিক হয়ে এই খসড়া প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছে – যা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক বাধ‍্যবাধকতায়। অর্থাৎ প্রতিবাদ করার জন‍্য প্রতিবাদ। এটা শিক্ষা নিয়ে চরম রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রতিফলন। আশ্চর্যের বিষয়, সব সরকার বিশাল বিশাল অট্টালিকা বানাচ্ছে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর জন‍্য! কিন্তু অধিকাংশ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ণের সঠিক পরিকল্পনা বা তার রূপায়ন হচ্ছে না।
এভাবে শিক্ষায় রাজনীতিকরন ও সরকারী উদাসীনতার ফলে এখন শিক্ষা বিভাগের পরিচালনা করা যে অসম্ভব হয়ে পড়েছে তা সব সরকারই বুঝতে পারছে। সেজন‍্য নিজেদের তৈরী করা সংকট থেকে মুক্তিলাভের জন‍্য তারা শিক্ষা সংকোচন ও তার বেসরকারীকরনের রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করবে। যদিও নতুন শিক্ষানীতিতে স্কুলশিক্ষার বেসরকারীকরন করার কথা বলা নেই, উচ্চশিক্ষায় কিন্তু সরকারের তরফে বেসরকারী বিনিয়োগ করতে আপত্তি থাকছে না। আমি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকায় দেখেছি, অধিকাংশ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান সরকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক নিচে। তাছাড়া এইসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও শিক্ষার খরচ অত‍্যন্ত বেশী, এদের অবকাঠামোর মানও অত‍্যন্ত খারাপ। শিক্ষার খরচ প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধারণ মধ‍্যবিত্ত মানুষের আয়ত্তের বাইরে! আমাদের দেশে এখনো পযর্ন্ত যে সব বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ‍্য। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বিপদ আরো বড়। এখানে এখনো পযর্ন্ত সরকারের চিন্তাভাবনার স্তরে আছে স্কুল শিক্ষার বেসরকারীকরন। এতে দুন স্কুলের মত প্রথম সারির বিদ‍্যালয় হয়ত ভবিষ‍্যতে হবে শুধুই উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাশালীদের জন‍্য। সাধারন মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু স্কুল শিক্ষার সংকোচন অবশ‍্যম্ভাবী। পরিশেষে বলি, একটি জাতিকে শেষ করার জন‍্য বিনা অস্ত্রে – শুধুমাত্র তাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে ধ্বংস করাই যথেষ্ট। আর কম‍্যুনিষ্টদের জানাই, মাও-জে-দং চীনের ক্ষমতা দখলের পর যে দুটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা হল খাদ‍্য এবং শিক্ষা।

স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি কার স্বার্থে

আমাদের দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থা ও শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বেড়ে চলেছে – কেন্দ্র, রাজ‍্য উভয়ক্ষেত্রেই। তবু অন‍্যান‍্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার অন‍্যান‍্য পীঠস্থানগুলি উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; সেখানে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান এবং তাদের বিশ্বের অন‍্যান‍্য দেশের নিরিখে র‍্যাঙ্কিংয়ের অধোগমন অব‍্যাহত। এর কারন অনুসন্ধানের জন‍্য প্রথমেই যা লক্ষ‍্য করা গেল তা হল, শিক্ষাঙ্গনকে উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতির আঁতুরঘর বানানো। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ – ইউরোপ, আমেরিকায় – উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গনে বিচরণ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই দেশের মত শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির জন‍্য ব‍্যবহার করার বিষয় কোথাও দেখতে পাইনি।
প্রথম থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর নাম মৌলানা আবুল কালাম আজাদ – যিনি ভারতে নয়, মধ‍্যপ্রাচ‍্যে শিক্ষালাভ করেন। এই নিয়োগের মধ‍্যে দিয়েই শিক্ষাকে অবহেলা করার সূত্রপাত হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী – কারোর বলার মত শিক্ষাগত যোগ‍্যতা না থাকায় তাঁরা শিক্ষামন্ত্রকের বিষয়ে উন্নতির জন‍্য নীতিগত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারন মোতাবেক নিতেন। এই সময়, অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের পরের দিকে এবং রাজীব গান্ধীর পুরো সময়ে ও তারপরেও দলের হাল রাজীবের পত্নী সোনিয়া গান্ধীর হাতে থাকার সময়ে ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ন্ত্রণ করার মত জনসমর্থন না থাকলেও ভারতের বামপন্থীরা, বলা ভালো, কম‍্যুনিস্টরা বিভিন্ন বিভাগে কংগ্রেসের দালালী করার মধ‍্যে দিয়ে ক্ষমতার মধুভান্ডের ভাগ এবং বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের বিষয়ে তাদের জায়গা দেওয়ার ব‍্যাপারে সফলভাবে লবিং করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে হয়ত গান্ধী পরিবারের ধারনা ছিল – এই দপ্তরে কোন উল্লেখযোগ্য মধুভান্ড নেই! সেজন‍্য সমাজবাদীর ভেকধারী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী শিক্ষার নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ণে তাঁদের কাছের কম‍্যুনিস্টদের উপরেই নির্ভর করেছিলেন। এর আগে একাধিক লেখায় দেখানো হয়েছে যে, তাসখন্দে ১৯২০ সালে ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম দিন থেকেই এরা জেহাদী ইসলামকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। ক্রমে ভারতের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে এবং পরে স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে হিন্দু গণহত‍্যার নিন্দা না করে ও পাকিস্তান গঠনের জন‍্য ভারতের মধ‍্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এরা নিজেদের ভারত বিরোধী চরিত্রের প্রমাণ দেয়। ২২শে আগস্ট, ১৯৪৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় তদানীন্তন কম‍্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীর বক্তব‍্য প্রচারিত হয়, যেখানে তিনি জেহাদী মুসলিম তোষনের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি এ‍্যটলী অব্দি পি সি যোশী ও তাঁর কম‍্যুনিস্ট পার্টিকে বৃটিশদের সহযোগী বলেছেন। কম‍্যুনিস্টদের INA ও সুভাষচন্দ্র বসুর বিরোধীতা, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের বিরোধীতা, হিন্দু ও তাদের জন‍্য লড়াই করা হিন্দু মহাসভার নেতা শ‍্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিরোধীতা এবং সেইসঙ্গে জিন্নার মুসলিম লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসার বহু নিদর্শন আছে। একটি ব‍্যাপারে কম‍্যুনিস্টদের প্রশংসা করতে হয় – যতই ভারত ও হিন্দুবিরোধী এবং জেহাদী মুসলিমদের, বিশেষতঃ ভারতের বিরুদ্ধে লিপ্ত জেহাদীদের সমর্থন করার ফলে তাদের ভারতীয় রাজনীতিতে জনভিত্তি ক্ষীয়মাণ হতে থাকুক, তারা তাদের এই ভারতবিরোধী নীতি থেকে বিচ‍্যুত হয়নি।
এবার শিক্ষার ব‍্যাপারে কংগ্রেসী পরিবারতন্ত্রের কৃপায় তাদের প্রবেশকে তারা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের এজেন্ডা ও নীতির প্রসারে ব‍্যবহার করতে লাগল। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত‍্যেকটিতে শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র মানদন্ড ছিল কোন কম‍্যুনিস্ট দলের প্রতি বিশ্বস্ততা! এমনকি উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ পদগুলিও এভাবে পূর্ণ করা হতে লাগল। ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করার সময় এক কম‍্যুনিস্ট দলের অন‍্যতম শীর্ষ নেতার জামাইকে আই আই এম আহমেদাবাদের ডিরেক্টর পদে বসানো হল। এটা একই সঙ্গে কম‍্যুনিস্টদের গুণ এবং বিরোধীদের অপদার্থতা যে, ধীরে ধীরে শুধু কম‍্যুনিস্ট শিক্ষক নিয়োগই নয়, বিভিন্ন বিষয়, বিশেষতঃ ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত বিষয়গুলির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস নিজেদের মত করে বদলে ফেলতে লাগল। যেমন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ঢোকানো হল চীন ও রাশিয়া। ইতিহাসের স্কুল লেভেল থেকেই সিলেবাসের অভিমুখ বদলে দেওয়া হল। ১২শ শতাব্দীর আগের, অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের গুরুত্ব সিলেবাসের ভার কমানোর নামে কমিয়ে দেওয়া হল। বাড়ানো হল ইসলামী যুগের ইতিহাস। এটার উদ্দেশ‍্য, দেশের হবু নাগরিকদের মধ‍্যে যাতে জাতীয় অস্মিতার বোধ তৈরী না হয় – তাহলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রভাব তাদের মধ‍্যে পড়বে না। তাছাড়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগ্রামকে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকরভাবে দেখানো হল। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন ছিল বিনা প্ররোচনায় আক্রমণকারী – একথা অনুচ্চারিত থেকে গেল। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে ভারতের কৃষ্টি ও সভ‍্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হল বিদেশী সভ‍্যতাকে – আধুনিকতার নামে এইভাবে দেশের নতুন প্রজন্মের ব্রেনওয়াস করা শুরু হল। অদ্ভুত একটি দলিত-মুসলিম ঐক‍্যের তত্ত্ব প্রচার করা শুরু হল। এই চেষ্টা প্রথমে দলিত সম্প্রদায়কে ভারত বিদ্বেষী করার জন‍্য মুসলিম লীগের প্রচেষ্টা ছিল। এভাবে মিথ‍্যা প্রচার সম্বৃদ্ধ কিম্ভুত কিমাকার সিলেবাসে শিক্ষা পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের মধ‍্যে দেশাত্মবোধক চেতনার বিকাশ পরিকল্পিতভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল। এইসঙ্গে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পাঠ নেওয়া হিন্দু ছাত্ররা নিজেদের ধর্মকে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি অন‍্য ধর্ম অর্থাৎ ‘ইসলাম’কে সম্মান জানানো তাদের আধুনিক শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে দেখতে লাগল। বিশেষভাবে কম‍্যুনিস্ট শাসিত কেরল, বাংলা ও ত্রিপুরায় এবং তার সাথে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলিতে এদের দাপাদাপি বেড়ে গেল। একটু লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায় যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বামপন্থী রাজনীতির আঁতুরঘর বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন JNU, হায়দ্রাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। গত দু এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংবাদের শিরোনামে এসেছে শুধুমাত্র অ-শিক্ষাজনিত দেশবিরোধী রাজনীতি ও বামপন্থী এ‍্যজেন্ডার সমর্থনে আন্দোলনকারী হিসেবে।
এখানে অল্প কথায় বলে নিই – এই একই সময়ে একটি নতুন বিষয় দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলিতে চালু হয় – জার্নালিজম ও মাস কম‍্যুনিকেশান। সংগঠনবৃদ্ধির পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে এই বিষয়ের পাঠদানকারী শিক্ষক থেকে ছাত্র, সবেতেই বামপন্থীদের বিপুল সংখ‍্যাধিক‍্য হওয়ায় কয়েক বছরের মধ‍্যে সংবাদ মাধ‍্যমগুলি (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক দুইই) বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কর্মীতে ভরে গেল। এই সময় বামপন্থীরা বাংলা ও ত্রিপুরায় ক্ষমতায় থাকার ফলে এই দুই রাজ‍্যের সংবাদ মাধ‍্যম ত বটেই, কেন্দ্রের কংগ্রেসের কাছাকাছি থাকা জাতীয় সংবাদ মাধ‍্যমগুলির মালিকপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক কারনে কংগ্রেস অনুমোদিত শিক্ষার বামপন্থায়ণ সমর্থন করার নীতি নিল। সংবাদপত্র ও বৈদ‍্যুতিন গণমাধ‍্যমগুলিতে বামপন্থীমুখের সংখ‍্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করল – তথাকথিত বিশিষ্ট ব‍্যক্তিত্ব চয়ন ও বিশেষজ্ঞ চয়নেও বামপন্থী সংখ‍্যাধিক‍্য দেখা গেল। অবশ‍্য সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এদের মধ‍্যে অনেকে ব‍্যক্তিগত সমীকরনের কারনে বামপন্থার বিরোধীতা করতে লাগল। এই পুরো সময় ধরে অন‍্য রাজনৈতিক দলগুলি আশ্চর্যজনকভাবে শিক্ষার এই বামপন্থায়ণ ও তার গূঢ় উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। এখনো তাদের তরফে কোন সদর্থক পদক্ষেপ নজরে আসেনি।
এইভাবে কম‍্যুনিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাধ‍্যম হল শিক্ষা বিভাগ। এখানে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর সময়ে শিক্ষানীতিতে একটি বিষয়ে অভিমুখের কোন বদল হল না। আমাদের দেশে বৃটিশ আমলে আধুনিক শিক্ষানীতি প্রথম শুরু করেন মেকলে সাহেব। তাঁর শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল – ইংরেজী শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করা, এছাড়া শিক্ষার মধ‍্যে কঠোরভাবে সিলেবাসভিত্তিক নোটসর্বস্ব শিক্ষা – যা ছাত্ররা মুখস্ত করে পরীক্ষায় উগরে দেবে! এর ভিত্তিতেই ছাত্রদের মূল‍্যায়ণ। সতর্ক দৃষ্টি ছিল যাতে দেশাত্মবোধক চেতনা এবং দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে ছাত্ররা বিশেষ শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ না পায়। এর কারন হল দেশীয় নেটিভদের ততটুকু শিক্ষাদান যাতে তারা দেশ শাসনে সাহেবদের হাত হিসেবে হুকুম তামিল করতে পারে। এই শিক্ষায় বুদ্ধির বিকাশ ও সঠিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা বিকাশের কোন চেষ্টা ছিল না। পরবর্তীতে কম‍্যুনিস্টরা যখন কংগ্রেসের সহযোগীতায় দেশের শিক্ষানীতির দায়িত্ব নিল তখন তাদের উদ্দেশ‍্য ছিল নেতা তৈরী করা নয়, ক‍্যাডার তৈরী করা। এই উদ্দেশ‍্য নিয়ে তারা মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষানীতির কোন মৌলিক পরিবর্তন করল না। শাসক সর্বদা হুকুম তামিলদার প্রজা চায় – প্রজার প্রশ্ন করা শাসকের নাপসন্দ। এ কারনে সত‍্যিকারের শিক্ষার বদলে সেই নির্দিষ্ট সিলেবাস মুখস্তের শিক্ষা চলতে লাগল! সঙ্গে জুড়ল বিদেশী কম‍্যুনিস্টদের গুণগান, অবশ‍্য বিশেষ কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা ও কংগ্রেসের সর্বশক্তিমান পরিবারের সদস‍্যদের আত্মত‍্যাগের কাহিনীও সিলেবাসে ঢুকল! বলা হল, এটাই আসল স্বাধীনতা সংগ্রাম! অর্থাৎ বৃটিশদের থেকে এই ভারতীয় শিক্ষায় উত্তরণ হল অশিক্ষা থেকে কুশিক্ষায় সন্তরন।
এই বিষবৃক্ষের ফল যথা সময়ে ফলতে শুরু করল। প্রথাগত শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভের সঙ্গে শিক্ষিতদের শিক্ষাগত যোগ‍্যতার কারনে রোজগার করতে পারার কোন সম্পর্ক রইল না। ফলত শিক্ষার গুরুত্ব কমতে লাগল – শিক্ষা আলঙ্কারিক শোভার মত ডিগ্রি পাওয়ায় পর্যবসিত হল। এদিকে যথার্থ যোগ‍্যতা না থাকায় ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিশ্বের শিক্ষার দরবারে সকল প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পরতে লাগল। এই ব‍্যধি দূর করার চেষ্টা না করে দেশের নেতা, নেত্রী থেকে আমলারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিদের ছোট বয়স থেকে আমেরিকা, ইউরোপ বা নিদেনপক্ষে এশিয়ার সেরা শিক্ষার জায়গা জাপান, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ায় নামী, দামী শিক্ষায়তনে ভর্তি করিয়ে দিলেন! আমি কম‍্যুনিস্ট সহ বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রীদের মধ‍্যে এই ধারা লক্ষ‍্য করেছি। এরা আবার বিদেশী ডিগ্রিধারীদের (তা সে মামুলি শিক্ষায়তন থেকে হলেও) দেশের ডিগ্রিধারীদের তুলনায় বড় মনে করেন! ইংরেজের দাসত্বের মানসিক বন্ধন এদের ঘোঁচেনি। আমাদের দেশের এই শিক্ষা ব‍্যবস্থা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা নয় – হলও না। এদিকে, শিক্ষিত বেকারের সংখ‍্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষকদের উন্নত বেতন বরাদ্দের কোন খামতি হল না! যেমন প্রশাসনিক পদের অফিসারদের যোগ‍্যতা বিচার না করে সময়ের সাথে সাথে উচ্চতর পদে নিয়োগ হয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেই একই ব‍্যাপার দেখা গেল। আবার, ছাত্রদের মূল‍্যায়ণে তাদের মুখস্ত বিদ‍্যার প্রতিফলন হলেও এধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার মূল‍্যায়ণ করা যায় না।
এইভাবে স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি যখন মানুষের বিশ্বাস হারাতে চলেছে তখনই এল অতিমারীজনিত লকডাউন। তার ফলে সমস্ত শিক্ষায়তনে প্রায় দু বছর শিক্ষাদান বন্ধ থাকল, শুধু ‘অনলাইন শিক্ষা’র মত ছেলেভোলানো শিক্ষাদান খেলা চলল। কিন্তু যথাসময়ে পরীক্ষা সমাধা হল! আচ্ছা, ল‍্যবোরেটরী নির্ভর বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলির হাতে-কলমে কোন ক্লাশ হল না, কিন্তু পরীক্ষা হল! এই ভোজবাজীর শিক্ষা ব‍্যবস্থা পি সি সরকারের ম‍্যাজিককেও হার মানায়।
আবার ডাক্তারী শিক্ষার ক্লাশও একই কারনে বন্ধ। ছাত্ররা কিভাবে অনলাইনে ক্লিনিক‍্যাল ও সার্জারীর মত বিষয় আয়ত্ত করল তাও এক ধাঁধা! এভাবে মৃতপ্রায় শিক্ষা ব‍্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করা হল। ফলে, এই মূহুর্তে দেশে সমস্ত স্তরে ছাত্রসংখ‍্যা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে এই শিক্ষানীতির প্রবক্তাদের উদ্দেশ‍্য সফল হয়েছে।
কংগ্রেস দল চেয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু গান্ধীজী ও তাদের দলের শীর্ষ পরিবারকে ঘিরে লেখা হোক – ছাত্ররা তেমন ইতিহাসই জানুক। আর কম‍্যুনিস্টদের সুচতুর নীতিতে ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ‍্য সম্পর্কে যেমন শিক্ষিত যুব সমাজের সঠিক ধারনা তৈরী হল না, তেমনি ইসলামী দখলদারীকে নরমভাবে দেখিয়ে মুঘলদের ভারতীয় বানানোর অপচেষ্টা করা হল। বিদেশী স্থপত‍্যবিদদের বিধানেও তাজমহলের নির্মানে কোন মৌলিক চিন্তার পরিচয় না থাকলেও তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দেওয়া হল! এভাবে কম‍্যুনিস্টদের শতাব্দী প্রাচীন নীতি – ভারতবিদ্বেষ ও হিন্দুবিদ্বেষের আগুন জ্বালানোর আবহ তৈরীর চেষ্টা হতে লাগল। এর ফলে তথাকথিত শিক্ষিত যুবসমাজকে উত্তেজিত করে দেশবিরোধী শক্তির হাত শক্ত করার চেষ্টা হল। ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থী ব‍্যখ‍্যা অনুযায়ী হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষার স্কুল, কলেজ খোলার ব‍্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। একইসঙ্গে মুড়ি মুড়কির মত বিভিন্ন জায়গায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, মাদ্রাসা খুলে ইসলামী শিক্ষায় সরকারী সহযোগীতা শুরু হল। মাদ্রাসা শিক্ষা বুনিয়াদী স্তর থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হল। ফলে, দেশে হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদনা হ্রাস পেলেও ইসলামী ধর্মীয় উন্মাদনা বৃদ্ধি পেল। যেমন ভগবানের ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষ ঋদ্ধ হয়, তেমনি যথার্থ আল্লার ধর্মীয় শিক্ষায়ও মানুষ ঋদ্ধ হয়। কিন্তু এইসব মাদ্রাসার মাধ‍্যমে আল্লার শিক্ষা নয়, মৌলভীদের শিক্ষা যা বিধর্মীদের ঘৃণা করতে শেখায় – ভারতকে শত্রুদেশ ভাবতে প্ররোচিত করল। এর ফলে হিন্দু বিরোধীতার আগুনের স্পর্শে মুসলিম বিরোধীতার আগুন জ্বলল। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা হল। এটাই এই শিক্ষানীতির প্রণেতারা চেয়েছিলেন! অথচ ভারতীয় মুসলমানদের জন্ম, ধর্মকর্ম সবই ভারতে। তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মতই ভারতীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের দেশের স্থায়ীত্ব বিরোধী কাজকর্ম হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারন মানুষ প্রত‍্যাখ‍্যান করায় শিক্ষার দ্বারা ব্রেনওয়াশের কংগ্রেস-কম‍্যুনিস্ট যৌথ কৌশল তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বে ধ্বস নামালো।
সে কারনে একটি নতুন শিক্ষানীতি ও সেইসঙ্গে শিক্ষার অভিমুখ বদল করার আশু প্রয়োজন হল। মেকলের শিক্ষানীতি থেকে বর্তমান শিক্ষানীতি অব্দি যে জিনিষটার অভাব ছিল, মেধার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা শুরু হল। এই শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা গৃহীত হওয়ার পর এখনো চালু হয়নি বলে এর ভালোমন্দ বিচারের সময় এখনো আসেনি। অবশ‍্য কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের ও UGCর বিভিন্ন সার্কুলারে এ সম্বন্ধে এখনো অনেক ধোঁয়াশা বিদ‍্যমান। সময় এর উত্তর দেবে। তবে, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করা আশু প্রয়োজন – না হলে কোন শিক্ষা ব‍্যবস্থাই সার্থক হবে না।