বাঙ্গালীর জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের মূলে রাজনৈতিক অসততা

         বাঙ্গালী জাতি হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে যে একতা ও দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছিল, তার উপর স্বাধীণতার অব‍্যবহিত পূর্বেই আঘাত হানা শুরু হয়েছিল। এই আঘাতের জন‍্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও তার সহযোগী দলগুলি যেমন দায়ী, তেমনি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দও একই রকম দায়ী। বাঙ্গালী অস্মিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে বৃটিশের ধামাধরা দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ইংরেজরা দেশের শাসনভার ছেড়ে যেত না - এ‍্যাটলের একটি ছোট্ট কথাতেই তা পরিষ্কার। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ভারতের স্বাধীনতায় গান্ধীজীর অবদান কতটা - তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "minimal"। এটা নিয়ে পেইড ইতিহাসবিদরা কিছু বলেন না। গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের নেতারা সুভাষচন্দ্র বসুকে ভয় পেতেন। সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে জার্মানী ও জাপানের সহযোগীতায় সশস্ত্র বিপ্লবের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাতে তাঁর নেতৃত্বে শুধু হিন্দুরাই নয়, বহু দেশপ্রেমিক মুসলমান মানুষও শামিল হয়েছিলেন।নেতাজীর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সততাকে ভয় ও ঈর্ষা করতেন স্বয়ং গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা।  এই ভয় দেশের স্বার্থে নয়, তা ব‍্যক্তিস্বার্থে - নেতৃত্বের মধুভান্ড হারানোর ভয়! এই কংগ্রেসের নেতারাই কিন্তু মহম্মদ আলী জিন্নাকে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারন করার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কখনো শামিল হতে দেয়নি। গান্ধীজী ও তাঁর পেটোয়া হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের মধ‍্যে একটা কোটারি তৈরী করে সর্বদা চালিয়েছে। এরাই জিন্নাকে একঘরে করার নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকায় শেষে জিন্না বাধ‍্য হয়ে রাজনীতিতে ভেসে থাকার জন‍্য মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলিম কার্ড খেললেন। গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামী কংগ্রেসের নেতারা বারবার এই কৌশল নিয়েছে। তারপর মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগের দাবীতে সরব হল। খন্ডিত ভারতের নেতৃত্ব পাওয়ার প্রস্তাবে গান্ধীজী প্রথমে প্রতিবাদ অনশন করলেও সে আন্দোলন তাঁর অন‍্য আন্দোলনগুলির মতই কিছুদিন চলার পর বন্ধ হল! গান্ধীজী একসময় জেহাদী মুসলিম নেতাদের প্রাধান‍্য দিয়ে নিজের নেতৃত্ব টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ দ্বারা প্রত‍্যাখাত হলেন। তাঁর কায়দা চতুর রাজনীতিক জিন্না ধরে ফেলেছিলেন।
         একটি তথ‍্য এখানে অত‍্যন্ত খুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল ভারতের স্বাধীনতা কেন ১৯৪৭ সালে এসেছিল। এর মূল কারন হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ, নির্বাচনে চার্চিলের পরাজয়, সুভাষের INAর চাপ এবং ভারতের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খন্ডিত ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের মাধ‍্যমে বৃটিশদের কাছের দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দুই দেশের শাসনভার অর্পনের মাধ‍্যমে ভারতে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বজায় রাখা। এসব কারনের সম্মিলিত ফল হল ভারতের স্বাধীনতা লাভ। এখানে একটি ব‍্যপার অবশ‍্য লক্ষণীয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে যে দুটি প্রদেশ বৃটিশদের সবচেয়ে বেশী বেগ দিয়েছে সেই দুটি - পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন! যদিও মুসলমান জনসংখ‍্যা অবিভক্ত ভারতের অন‍্যান‍্য প্রদেশেও ভালো সংখ‍্যায় উপস্থিত ছিল। বাংলাকে পুরোটাই পাকিস্থানে দিয়ে দেওয়ার আলোচনায় গান্ধীজী ও তাঁর প্রিয় কংগ্রেস নেতাদের থেকে কোন আপত্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। এই সময় শ‍্যামাপ্রসাদ যুক্তি দিয়ে বোঝান যে হিন্দু সংখ‍্যাগরিষ্ট বাংলাকে পাকিস্তানে দিয়ে দিলে এই বিপুল সংখ‍্যক হিন্দুর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বরং বাংলাকে খন্ডিত করে হিন্দু অধ‍্যুষিত পশ্চিম অংশকে ভারতের প্রদেশ হিসেবে ভাগ করা অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ তার বাঙ্গালী মুসলমান সদস‍্য সমর্থকদের দিয়ে হিন্দু বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। এই সময় মুসলিম লীগের কিছু নেতা, যেমন হুসেইন সুরাবর্দী জিন্নাকে টেক্কা দেওয়ার জন‍্য 'দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং' এর মাধ‍্যমে নিজেদের ব‍্যক্তিগত স্বার্থে সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের প্ররোচিত করে। দুঃখের বিষয় হল, সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বিপুল অংশ সেই প্ররোচনায় পা দেয়। এর সঙ্গে খুণ,লুঠতরাজ ও ধর্ষন ত আছেই। দুঃখের কথা, হিন্দু ধর্মীয় স্থান থেকে প্ররোচনা না দিলেও মসজিদ ও মজলিস থেকে তাদের এই ঘৃণ‍্য কাজের ধর্মীয় সমর্থন দেওয়া হতে লাগল। এখানেই বাঙ্গালী ঐক‍্য - যা বাঙ্গালীর গর্ব এবং বৈশিষ্ট‍্য ছিল - চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। দুই ভিন্ন ধর্মের বাঙ্গালীর মধ‍্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা জন্ম নিল। বাংলায় যে হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে দাঙ্গাগুলি ঘটেছিল তার কারন কিন্তু লোভ ও অন‍্যের সম্পত্তি গ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে অত‍্যাচারের লিপ্সা। এই পাশবিক প্রবৃত্তিকে স্বাভাবিকতার স্বীকৃতি দেওয়ার জন‍্য ধর্মকে আশ্রয় করা হয়েছিল। যার জন‍্য ক্ষতিগ্রস্ত হল ধর্মের গ্রহণযোগ‍্যতা। আর এই কাজের জন‍্য প্রয়োজন ছিল উচ্চ প্রশাসনিক মহলের সমর্থন এবং আত্মিক অনুমোদন। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই দুটোই সহজে পাওয়া গিয়েছিল। এটি ঐতিহাসিক সত‍্য যে হুসেইন সোরাবর্দী ও মুসলিম লীগের অন‍্যান‍্য নেতৃবৃন্দ দুটি কারনে এই গণহত‍্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের ভারতে অন্তর্ভূক্তি - যা তারা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছাড়া ভাবতে পারেনি। দ্বিতীয় কারন হল মহম্মদ আলী জিন্নাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে বার্তা দেওয়া যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ অধিকতর মুসলিম দরদী! সেইসঙ্গে বহু বাঙ্গালী মুসলমান, যারা এত বছর হিন্দু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এসেছে, তাদের মনে হিন্দুবিদ্বেষের বীজ বপন করার জন‍্য ধর্মের নামে - ইসলামের নামে - বিভেদের আগুন জ্বালালেন মসজিদ, মহল্লা থেকে জিহাদে হিন্দু নিধনের ডাক দিয়ে। এইভাবে বাঙ্গালীদের মধ‍্যে একটি স্থায়ী বিবাদের সূচনা হয়। এর ফলে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ‍্যে যেমন মুসলমান বিদ্বেষ চলে এলো তেমনি বাঙ্গালী মুসলমানদের পশ্চিমী মুসলমানরা ছোট জাত বলে তাচ্ছিল‍্য করার সুযোগ পেল। তখন থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী সংস্কৃতির গোলামী করা ছাড়া উপায় থাকল না। সেজন‍্য এখনো বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ‍্যে কোরআন, হাদিশের থেকে ব‍্যাখ‍্যার মাধ‍্যমে হিন্দু বিরোধী জেহাদ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ‍্য, বাংলাদেশের (আগের পূর্ব পাকিস্তান ) বাঙ্গালী মুসলমানদের একাংশ এই ফাঁদে না পড়ে, বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সভ‍্যতার ধারক-বাহক হয়ে সংখ‍্যালঘু হিন্দু বাঙ্গালীদের রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে চেষ্টা চালাচ্ছে - যদিও এই প্রচেষ্টা মহৎ, কিন্তু এর প্রভাব সাম্প্রদায়িক জেহাদের তুলনায় এখনো কম।
              আবার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একটি বড় অংশ কম‍্যুনিস্ট শাসনের প্রভাবে কম‍্যুনিজমকেই বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক জ্ঞানে পুজো(!) করছে। ভারতীয় কম‍্যুনিজমের জন্ম, আদর্শ ও অভিমুখ সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ ধারনা না থাকার কারনে তারা গড্ডালিকা প্রবাহে কম‍্যুনিজমে দীক্ষা নেয়! পারিপার্শিকতার প্রভাবে বিশেষতঃ যুবা বয়সে কম‍্যুনিজম একটি রোমান্টিক মিথ্ তৈরী করে। এইসব "শুনে কম‍্যুনিষ্ট"রা সর্বদা দাদা অথবা দিদি নির্ভর। এখানে প্রবাদপ্রতিম পদার্থবিদ শ্রী সত‍্যেন বসুর জীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সত‍্যেন বসুর পদযুগল স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। যে সময়ের ঘটনা, তখন পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিস্টদের স্বর্ণযুগ চলছে। ঐ সময় শিক্ষা জগতে কোন নিয়োগ, উন্নতি - কিছুই কম‍্যুনিস্টদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ত বটেই, অধ‍্যাপকরা পর্যন্ত নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবীদের জন‍্য কৌটো নেড়ে বা রসিদ দিয়ে চাঁদা তুলতেন। তাঁরা কলকাতায় বিপ্লব করতেন কিউবা ও কোরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! অধ‍্যাপকরা তাঁদের উন্নতির শর্টকাট রাস্তা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এমনই একজন পদার্থবিদ‍্যার অধ‍্যাপক ছিলেন বি ডি নাগচৌধুরী। তাঁর পৌরহিত‍্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল।

বিষয় – পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ পরীক্ষা করে আমেরিকা কিভাবে তেজস্ক্রিয় ছাই ছড়িয়ে পৃথিবীর ক্ষতি করছে। প্রধান বক্তা অরাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ‍্যাপক সত‍্যেন সেন। তিনি শুধু বিজ্ঞান আলোচনা করা হবে – এই প্রতিশ্রুতিতে সভায় আসতে সম্মত হন। বক্তারা, বিশেষতঃ অধ‍্যাপক নাগচৌধুরী, মার্কিন সরকারের সবিশেষ মুন্ডুপাত করার পর শেষে বলতে ওঠেন স‍ত‍্যেন বসু। তিনি তথ‍্য সহযোগে জানান যে, সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত সরকার যে পরিমাণ পারমাণবিক বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছে তা মার্কিন বিস্ফোরণের তুলনায় বহুগুণ বেশী। তাঁর একটিই জিজ্ঞাস‍্য ছিল যে, এর প্রতিবাদে ঐ সভার অধ‍্যাপক ও বিদগ্ধজনেরা কটি প্রতিবাদ সভা করেছেন! সভায় গুঞ্জন ওঠে – শেষে সভা তালকাটা পরিবেশে শেষ হয়। এভাবেও বাঙ্গালীদের মনে ভ্রান্ত ধারনা ঢুকিয়ে বিদ্বেষের বিষ গেঁথে দেওয়া শুরু হয়।
সত‍্যি বলতে কি, শুরু থেকে বাঙ্গালীদের মধ‍্যে জাতিগত ও ধর্মগত বিদ্বেষ ছিল না। এমনকি বাঙ্গালীদের মধ‍্যে বর্ণগত পরিচয় বল্লাল সেনের আগে ছিল না। তখন বর্ণভেদ ছিল কর্মের ভিত্তিতে – জন্মের ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ উচ্চ ও নিম্ন বর্ণে উত্তরণ ও অবনমন ছিল বাস্তব। আবার বাঙ্গালী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা সকলেই হিন্দু ছিলেন – এটি ঐতিহাসিক সত‍্য। বাঙ্গালীদের মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারন রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ। সেজন‍্য বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ‍্যে চেহারায় ও কথাবার্তায় শুধু মিল নয়, তাদের DNAতেও সাদৃশ‍্য আছে। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে বাঙ্গালী হিন্দু, বাঙ্গালী মুসলমান, এমনকি এই হিন্দুদের মধ‍্যে সমস্ত জাতপাতের মানুষজন ভাই-বোন। এটাই ঐতিহাসিক সত‍্য। কিন্তু গত প্রায় একশ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে এবং ধর্মীয় সুবিধাবাদের চাদরে ভাই-বোন ও ভাই-ভাইয়েরসম্পর্কটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন একাংশ বাঙ্গালী আরবী সভ‍্যতার পদলেহনকারী; অপর অংশ আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে দেশবিরোধী শক্তির কমিশন এজেন্ট অথবা দেশভক্তের মুখোশের আড়ালে অবাঙ্গালী বানিয়াদের অনুচর ইত‍্যাদি। এইভাবে বাঙ্গালী পরিচয়টাই আজ অবলুপ্তির পথে।
তারপর গত দশ বারো বছর ধরে বাংলার মাটিতে চলছে অন‍্য খেলা। দুই বাংলাতেই রাজনীতিকদের লক্ষ‍্য সংখ‍্যাগুরু বাঙ্গালীর ইচ্ছাতে সুরসুরি দিয়ে ভোটযুদ্ধে জেতা। তারপর ক্ষমতার মধুভান্ড দখল করা বা দখলে রাখা। এজন‍্য তারা চটজলদি সমাধানের মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। প্রথমে বাংলাদেশের কথা বলা যাক। সেখানে বর্তমান সরকার বাঙ্গালী অস্মিতার কথা ও সংখ‍্যালঘু হিন্দুদের চোখের মণির মত রক্ষা করার কথা বললেও কখনো দেশবিরোধী জেহাদী সংস্কৃতির বাহকদের – যারা ইসলামের নামে আরবী সংস্কৃতি, সে দেশের মানুষের উপর তালিবানী কায়দায় চাপাতে চায় – তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ইতস্ততঃ করে। অবশ‍্যই সংখ‍্যাগুরু ভোটব‍্যঙ্কের কথা মাথায় রাখার জন‍্য এই ঢিলেমী। ফলে, সে দেশে মাঝেমধ‍্যেই সংখ‍্যালঘু হিন্দুরা বক্সিংয়ের পাঞ্চিং ব‍্যাগের মত ব‍্যবহৃত হয়। অনেক বাঙ্গালী মুসলমান এর সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ না করলেও ভয়ের পরিবেশে নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।
আবার পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টা অন‍্য। এখানে মানুষ মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত। সকলেই নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে গর্বিত – যা অবশ‍্যই বাঙ্গালী অস্মিতার অবক্ষয়ের বড় কারন। একভাগ তথাকথিত আন্তর্জাতিক কম‍্যুনিজমের আদর্শে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। এরা কোনো ধর্ম সম্বন্ধেই জ্ঞান না থাকায় সহজেই হিন্দুধর্মের নামে কুৎসা রটনাকে ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাচ্ছিল‍্য এবং অবমাননাকর বহিঃপ্রকাশকে প্রগতিশীলতা মনে করে। আরেকভাগ বাঙ্গালী বাঙ্গালীয়ানাকে বিসর্জন দিয়ে কোরআন, হাদীসের জেহাদী রূপান্তরকে মোক্ষ করে বাঙ্গালীস্থানকে পাক-ই-স্তান বানানোর কারিগর হিসেবে নিজেদের দেখতে চায়। এই দুই ধরনের বাঙ্গালী এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে শাসকানুকুল‍্য পাচ্ছে – কারন এদের মিলিত ভোটেই শাসকের নির্বাচনে জয়লাভ সুগম হচ্ছে। উপরের দুই দলের ক্রিয়াকর্মের প্রভাবে আরেক ধরনের বাঙ্গালীকুল মাথাচাড়া দিয়েছে। তারা নিজেদের একমাত্র দেশভক্ত এবং হিন্দুধর্মের একমাত্র ঠিকাদার হিসেবে বাঙ্গালী ঐতিহ‍্যের পরিপন্থী আচরণ করছে এবং অবাঙ্গালী বানিয়াগোষ্ঠীর তাঁবেদারী করে জেহাদী বাঙ্গালীকুলের মতই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। এখানে একটি ব‍্যাপার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল যেমন শাসকদলের ভোটব‍্যাঙ্ক হিসেবে মদতপ্রাপ্ত, তেমনি তৃতীয়দলও শাসকের প্রচ্ছন্ন মদতে শক্তিশালী থাকছে। কারন তৃতীয়দলের আচরণ ও ক্রিয়াকর্ম প্রথম ও দ্বিতীয়দলকে শাসকের পক্ষে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।
এবার আসি আমাদের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির ভূমিকায়। তারা এই তিন বিভাগের মানুষদের থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকুল হবে এমন মানুষদের বেছে নিয়ে তাদের ‘বুদ্ধিজীবি’ তকমা দিয়ে এমন প্রচার চালাচ্ছে যে, এই ‘সর্বজ্ঞ’ মানুষেরা যা বলছে তা যেন ধ্রুবসত‍্য! এই ‘বুদ্ধিজীবি দলে ভিড় করা মানুষদের মধ‍্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, চিত্রনাট্য লেখক থেকে মায় খেলোয়ার অব্দি আছেন! আচ্ছা, আগে কেউ কখনো কে এল সায়গল, হেমন্ত মূখার্জী, মান্না দে, উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনকে কেউ ‘বুদ্ধিজীবি’ হিসেবে কল্পনা করেছেন! আসলে পুরোটাই একটি প্ররোচনার প‍্যাকেজ। বাঙ্গালীকে শতধা বিভক্ত করে তার জাতিগত সত্তাকে নষ্ট করে দাও। বাঙ্গালী না থাকলে রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, শিক্ষা থেকে বিনোদন – সমস্ত জায়গায় অন‍্য সংস্কৃতি দখলদারি কায়েম করতে পারবে। বাঙ্গালীর মেধা, মনন ও যোগ‍্যতা তার বিপক্ষে গেল। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বহু বাঙ্গালী সেকারনে এই ব‍্যক্তিস্বার্থসঞ্জাত রাজনৈতিক নোংরামো থেকে সরে থাকছে। এদের সংখ‍্যা যখন আরো বাড়বে তখন হয়ত বাঙ্গালীর সুদিন আসতে পারে। অন‍্যথায় তার ধ্বংস অনিবার্য। শেষে বলি, সম্মিলিত বাঙ্গালী বিরোধীতার বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র হাতিয়ার ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী ঐক‍্য ও তার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো অর্থগৃধ্নু সংবাদ-মাধ‍্যম বর্জন করা। তবে,তার জন‍্য উপযুক্ত বাঙ্গালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। গুলিস্তাঁ বরবাদ করনেকো একই উল্লু কাফি হ‍্যায়, হর শাখ পর উল্লু বৈঠা হ‍্যায় ত গুলিস্তাঁকো ক‍্যয়া হোগা।

আত্মহণনকারী বাঙ্গালী

একটা খুব সাধারণ প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বিদেশী বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল – “তোমাদের দেশে বাঙ্গালী কারা?” উত্তর দিয়েছিলাম,”যারা বাংলায় বাস করে”। বন্ধু আবার প্রশ্ন করল,”কোন বাংলা – বাংলাদেশ নাকি ভারতের একটি অঙ্গরাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গ?” আমার তাৎক্ষণিক উত্তর – দুটোই। বন্ধু বলল, “তোমাদের বাঙ্গালীদের দুটি আলাদা দেশ; আলাদা কালচার; আবার তোমরা ভারতীয়রা সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আর বাংলাদেশ ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্র। তোমাদের মধ‍্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশী। এমনকি খাদ‍্যাভ‍্যাসেও প্রচুর তফাৎ”। বুঝলাম, আমার বন্ধুটি বাঙ্গালী জাতির ব‍্যপারে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। সেই থেকে তার বক্তব‍্য বাঙ্গালী হিসেবে আমায় নাড়া দিয়েছে।
জাতি হিসাবে গুজরাতিদের ভাষা, কালচার ইত‍্যাদি এক। মারাঠি থেকে কানাড়ি, তামিলি, ওড়িয়া – সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ‍্য। একটি জাতি তখনই জাতি হিসেবে বিকশিত হয়, যখন তার জাতিসত্ত্বা ও জাতির অস্মিতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুই দেশের তথাকথিত বাংলায় কথা বলা মানুষদের জাতিসত্ত্বায় প্রচুর তফাৎ আর বাঙ্গালী অস্মিতার প্রকাশ দেখি শুধু রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। এর কারন, গত একশ বছরের বাঙ্গালীর ইতিহাস ও তার সামাজিক অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা জল খাওয়ার কথা বলে, উত্তর ভারতীয়রা পানি পিতে হ‍্যায় আর বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা পানি খায়! আচ্ছা, বলুন ত বাঙ্গালী ঐতিহ্য কি? দুজন পরিচিতের দেখা হলে হাত জোড় করে নমষ্কার ও প্রতি নমষ্কার জানানো পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী শিষ্টাচার। আবার বাংলাদেশের দুই বাঙ্গালী তখন এক হাত বুকে ঠেকিয়ে আসলাম ওয়ালেকুম ও আলেকুম সালাম বলে। কোনটা বাঙ্গালীর সঠিক শিষ্টাচার! দুই বাংলার বাঙ্গালীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলনকারী শহীদদের স্মরণে ভাষা দিবস পালন করে আর একই রকম বাংলা ভাষার জন‍্য আসামে আন্দোলনকারী শহীদদের কথা তারা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না! বাঙ্গালী জাতির কর্মকান্ড এমনই অদ্ভুত যুক্তিহীন দ্বিচারিতায় ভরা।
নিরপেক্ষভাবে এর কারন বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও জানি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারনে সমালোচিত হতে হবে! প্রথমে বলি, উইন্সটন চার্চিলের নির্বাচনে পরাজয়ের পর এ‍্যাটলী বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী না হলে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা আসত না। এমনকি, স্বয়ং এ‍্যাটলী ভারতের স্বাধীনতার কারন হিসেবে গান্ধীজীর অবদানকে “নূন‍্যতম” বলে অভিহিত করেন। ভারতের স্বাধীনতার পিছনে প্রধান কারনগুলি হল – বৃটেনের উপর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, ভারতের দিকে দিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, INAর কর্মকান্ড, এবং মিত্রশক্তির অন‍্যান‍্য সহযোগী যেমন আমেরিকা ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক চাপ। তখন ইংরেজ সরকার চাইল বশংবদ নেটিভ নেতৃত্বের হাতে ভারতের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দায় থেকে মুক্তি পেতে। এর মধ‍্যে নূন‍্যতম অবদান গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন – যা চার্লস্ এ‍্যাটেনবরোর “গান্ধী” ছবিতেও দেখানো হয়েছে। এভাবে ভারত খন্ডিত করে স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গান্ধীজী প্রতিবাদ-অনশন করলেও পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোন অদৃশ‍্য অঙ্গুলীহেলনে ভারতভাগের পক্ষে রাজি হয়ে গেলেন, সেই ইতিহাস আজও অজানা। বাঙ্গালী সুভাষ ও বাঙ্গালী শ‍্যামাপ্রসাদের মৃত‍্যুর ইতিহাস আজও রহস‍্যময়। এতে কার লাভ হয়েছে তা সবাই জানলেও কার ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে চর্চা হয়েছে কি? বিধানচন্দ্র রায়কে বাঙ্গলার উন্নয়ণের প্রশ্নে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার যদি পর্যাপ্ত সাহায‍্য করত তাহলে তাঁকে উন্নয়ণের জন‍্য জন এফ কেনেডির সফল চিকিৎসার বিনিময়ে সাহায‍্য চাইতে হত না! ভারত খন্ডিত হওয়ায় যে দুটি রাজ‍্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা হচ্ছে বাংলা ও পাঞ্জাব। এই দুটি রাজ‍্যে ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় যে ক্ষতি হয়েছিল, মানুষের প্রাণহানি ও সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল, শুধু ধর্মীয় কারনে সেখানে যে গণহত‍্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর শ্লীলতাহানির মত হাজার হাজার পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক সাহায‍্য ও পুনর্বাসন নীতির দরকার ছিল তার থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রশ্নাতীতভাবে বঞ্চিত হয়েছিল। বাংলা ভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের (সুরাবর্দী ছিলেন তাদের নেতা) মুসলমান নেতৃত্বের অনুগামীদের অত‍্যাচারে সম্পত্তি হারানো (এনিমি প্রপার্টি আইনে!), ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তরকরন ও খুনের রক্তস্রোত বইয়ে বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে এবং আসাম ও ত্রিপুরায় যে হিন্দু বাঙ্গালী শরণার্থীরা আশ্রয় নিতে আসে – পৃথিবীর যে কোন আইনে তারা ধর্মীয় শরণার্থী। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে এবং তাদের ‘ধর্মীয় শরণার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করতে জওহরলাল নেহরু সরকার অস্বীকার করে। আর এই ব‍্যপারটা তারপরেও ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের কাছে হারার পরে পুনরাবৃত্তি হয়। হিন্দু বাঙ্গালীদের সেখানে বক্সিংয়ের ‘পাঞ্চিং ব‍্যাগ’ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয়েছে। ভারতের অন‍্য কোন রাজ‍্যের এই অভিজ্ঞতা হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ঘৃণিত ঔদাসীন‍্যের সুযোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গের কম‍্যুনিস্টরা। তারা এই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে শরণার্থীদের মধ‍্যে কম‍্যুনিজমের তত্ত্ব প্রচারের মাধ‍্যমে বাঙ্গালীর এই অংশকে তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করার চেষ্টা করতে লাগল। এই হতভাগ্য ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার নূন‍্যতম রসদ জোগাড়ে সাহায‍্য করার বিনিময়ে এদেরকে কম‍্যুনিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেওয়ার নামে ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মকে বিদ্রুপ ও অমান‍্য করার পাঠ দিতে শুরু করল। এইভাবে নরম ব্ল‍্যাকমেলিংয়ের প্রভাব এপারের হিন্দু বাঙ্গালীর মননে পড়তে শুরু করল। ইতিমধ্যে ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের দখলদারি কম‍্যুনিস্টদের হাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙ্গালী হিন্দুদের গৌরবের ইতিহাস, বাঙ্গালীর নিজস্ব, ঐতিহ্যবাহী উৎসব ইত‍্যাদিকে সমাজজীবন থেকে মুছে দিতে তৎপর হল। এই ভাবে বাঙ্গালী হিন্দুদের শ্লো পয়জনিং পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। পেটের জ্বালায়, বাঁচার তাগিদে এরাও নিজেদের জাতিসত্ত্বা ভুলে কম‍্যুনিস্টদের ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ‍্য হল। বাঙ্গালী হিন্দুদের নব‍্য প্রজন্ম পুজোআর্চায় অবিশ্বাসী কম‍্যুনিস্ট, কিন্তু মুসলিম বন্ধুর ডাকে রমজানের ইফতারে মাথায় টুপি পরে হাজির হতে লাগল। এরা জানে না যে ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এই বাঙ্গালী আপরুচি খানার নামে গরুর মাংসের স্বাদ ও উপকারিতা নিয়ে লেকচার দিয়ে তার প্রগতিশীল মনের পরিচয় দিল। আবার তাদের কাউকে মুসলমান বন্ধুকে শুয়োরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা বোঝাতে দেখা গেল না! ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দু বাঙ্গালীর আত্মবিস্মরণ তখন থেকে দ্রুততর হল। আবার অন‍্যদিকে মুসলমান বাঙ্গালীদের গরিষ্ঠ অংশ পূর্বপাকিস্তান,অধুনা বাংলাদেশে রয়ে গেল। আর একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে থেকে গেল – ফলে তারা ভারতের বাসিন্দা হয়ে ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পরল। এদিকে পূর্বপাকিস্থানের হিন্দু বাঙ্গালীদের স্বার্থের জন‍্য ধর্মের নামে ক্রমবর্ধমান অত‍্যাচার সইতে হল। দুটো বিকল্প তাদের সামনে ছিল – ধর্মান্তর বা ধন সম্পত্তি ফেলে রেখে একবস্ত্রে ভারতে শরণার্থী হওয়া। এর মূল দায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রতি তাদের বিমাতৃসূলভ আচরণ এই হতভাগ‍্য মানুষগুলোকে বাধ‍্য করেছিল কম‍্যুনিস্টদের ঝান্ডার পিছনে দাঁড়াতে। বিনিময়ে তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল হিন্দুত্বের অস্মিতা। সেইসঙ্গে কম‍্যুনিস্টরা এদের ইসলামী সেকুলারিজমের ধারাপাত মুখস্ত করিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের নামে মহান চিন ও রাশিয়ার বিপ্লবের পাঠ নিতে বাধ‍্য করল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ‍্যক্রম থেকে জাপান ও সুইজারল্যান্ডের বদলে চিন ও রাশিয়ার অন্তর্ভূক্তির মাধ‍্যমে এদের সেকুলারিজমে ব‍্যপটাইজেশান হল। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর বই থেকে হিন্দুধর্ম ও পুরোহিতদের অসম্মান ও বিদ্রুপ করা শেখানো হতে লাগল। আশ্চর্যজনকভাবে মুসলিম ও খ্রীষ্টান ধর্ম নিয়ে কিছু বলা হল না। পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রীকে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন‍্য দল থেকে ভর্তসনা করা হল, কিন্তু অন‍্য এক মুসলিম মন্ত্রীকে হজ যাত্রার জন‍্য ছুটি দেওয়া হল! পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা এভাবেই ইসলামী সেকুলারিজমকে গ্রহণ করল। বাঙ্গালী বিপ্লবীদের শৌর্য, নেতাজী সুভাষ, রাসবিহারী বসু ও শ‍্যামাপ্রসাদ মূখার্জীদের মেধা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় গদি হারানোর ভয়ে ভীত ভারতের শাসককুল জওহরলাল ও প‍্যাটেলভাইদের নেতৃত্বে (অবশ‍্যই গান্ধীজীর সমর্থনে) প্রথম থেকেই বাঙ্গালী তথা স্পষ্ট বক্তা উত্তর-পূর্বের মানুষদের সঙ্গে বৈষম‍্যমূলক আচরন করেন। এর অবিসংবাদী ফল স্বরূপ বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ‍্যে কেন্দ্রবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। ভিন্ন কারনে দুই বাংলার বাঙ্গালীদের মধ‍্যে অনুন্নয়ণ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও পূর্ববাংলায় ধর্মের নামে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজকে ঐক‍্যবদ্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে মৌলভী-মুয়াজ্জিমদের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেখানে সংখ‍্যালঘু বাঙ্গালীদের উপর ধর্মের দোহাই দিয়ে অত‍্যাচার করা হয়েছে, তার আসল উদ্দেশ‍্য ছিল ধন-সম্পত্তি ও জমি-বাড়ি লুঠ করা – দস‍্যুবৃত্তির রকমফের। এর প্রতিবাদে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রতিবাদ করলে মৌলবাদী শক্তি মৌলানা-মৌলভীদের একাংশকে এদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার কাজে নামায়। তারপর ধীরে ধীরে ‘ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা তৈরী করে ইসলাম প্রসারের নামে শিশু বয়স থেকেই মগজ ধোলাই করে হিন্দু (কাফের)দের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে ঘৃণার বীজ বপন শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে সেখানকার জনগোষ্ঠী তাদের বাঙ্গালী সত্ত্বা হারিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের নামে আরবী কালচারের গোলামে পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মধ‍্যে হিন্দু উদ্বাস্তু অংশকে যেমন কম‍্যুনিষ্টরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় দীক্ষিত করেছিল, তারাই আবার ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি মরিচঝাঁপিতে হতভাগ্য মানুষগুলোর গণহত‍্যার মধ‍্যে দিয়ে উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল হিন্দু বাঙ্গালীদের একটি বড় অংশের কাছে কম‍্যুনিষ্টরা খলনায়কে রূপান্তরিত হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক সত‍্য হল, এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে কম‍্যুনিস্টরাই এখানে এনে বসিয়েছিল! তারপর থেকে উদ্বাস্তু পরিবারের একটি বড় অংশ কম‍্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় কম‍্যুনিস্টরাও উদ্বাস্তুদের প্রাপ‍্য অনেক সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিল। ভোটব‍্যাঙ্কের রাজনীতিতে এই লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার জন‍্য কম‍্যুনিস্টরা বাংলাদেশের মুসলমান নাগরিকদের এদেশে যাতায়াতের সুযোগ করে দেওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসন হাতে থাকার সুবাদে তাদের ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ড করিয়ে দিতে মনোযোগী হল। সেইসঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের অপ্রত‍্যক্ষ সহায়তায় এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের সহযোগীতা করার ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে কম‍্যুনিস্টরা তাদের ভোটব‍্যাঙ্কের প্রাধান‍্য অক্ষুন্ন রাখল। এতে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে টেনশান শুরু হল। তারপর সময় যত গড়ালো, কম‍্যুনিস্টদের রাজ‍্য থেকে হটানোর জন‍্য আঞ্চলিক দল তৃণমূল সৃষ্টির শুরু থেকেই তারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোটব‍্যাঙ্ক টার্গেট করে রাজনীতি শুরু করল। বাঙ্গালী জাতিটাকেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও আঞ্চলিক ভাগে ভেঙ্গে দেওয়ার কম‍্যুনিস্ট তত্ত্বকে তৃণমূল অত‍্যন্ত সুচারুভাবে প্রয়োগ করল। কম‍্যুনিস্টদের উপর প্রত‍্যাশার চাপবৃদ্ধি, অনুন্নয়ণের ফলে উদ্ভুত বিপুল বেকারত্ব ও সর্বোপরি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন কম‍্যুনিস্টদের হিন্দু, মুসলমান উভয় বাঙ্গালী ভোটব‍্যাঙ্কেই ধ্বস নামালো। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের কম‍্যুনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর একটু একটু করে বোঝা গেল যে, সম্মিলিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসনের প্রভাবে বাঙ্গালীর জাত‍্যাভিমান ও বাঙ্গালী অস্মিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর থেকে তৃণমূল আঞ্চলিক দল হওয়ার সুবাদে তার কোন সর্বভারতীয় নীতির বাধ‍্যবাধকতা না থাকায় এবং ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মত একজন সুপ্রিমো দ্বারা দল পরিচালিত হওয়ার কারনে তারা “যখন যেমন তখন তেমন” নীতিতে ভোটব‍্যাঙ্ক রাজনীতি নিয়ে চলতে লাগল। প্রথম নির্বাচন তৃণমূল জেতে কম‍্যুনিস্টদের অপছন্দ করার জন‍্য ভোট পাওয়ায় এবং তৃণমূলের কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে জোটের কারনে। এরপর কংগ্রেসের এম এল এ ভাঙ্গানো, সিপিএমে ভাঙ্গন ধরানো – এসবে পরিষ্কার হল, রাজ‍্যে ক্ষমতায় আসতে এবং ক্ষমতায় থাকতে গেলে জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় নিদান বড় কথা নয়, আসল হল “আপনা ধান্দা জিন্দাবাদ” নীতি। আর কিছু দিলে কিছু পাওয়া যাওয়ার ‘ব‍্যবসা’ – এই নীতিতে একে একে রাজ‍্যের সবকটি বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমকে রাজ‍্যসরকার তথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হল। নতুন করে সমাজে সংস্কার (!) শুরু হল। হিন্দু বাঙ্গালীদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দেগে দেওয়া হল। এই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ হল, হিন্দুদের সার্বজনীন পুজোগুলিকে পুজো না বলে ‘উৎসব’ বলা হতে লাগল – যেমন দূর্গাপুজো হল শারদোৎসব, কালীপূজো হল দেওয়ালী আর সরস্বতী পূজো বসন্ত পঞ্চমী উৎসব! আর এই উৎসব উদযাপনের মধ‍্যে দিয়ে বিকৃত মূর্তির প্রতিমাকে আর্টের উদাহরণ হিসেবে দেখা হতে লাগল। আসলে পূজোর পরিবেশকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন আমোদ-প্রমোদ ও উপভোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সংবাদ-মাধ‍্যমের ঢক্কানিনাদে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পূজোর সময় উৎকট উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। এইভাবে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লঘুকরনের সাথে সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে যাতে কোনভাবে লঘুকরন করা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হল।
এইভাবে বাঙ্গালী হিন্দু তার বাঙ্গালী সত্ত্বার অনেকটাই হারিয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে আত্মহণনের পরাকাষ্ঠা দেখাল – সেইসঙ্গে তার বাঙ্গালী জাত্মাভিমানকে জলাঞ্জলি দিল। আবার বাংলাদেশের সংখ‍্যাগরিষ্ট মুসলমান বাঙ্গালী তাদের যে জাত‍্যাভিমান দেখাল তা আরবী সংস্কৃতির মিশেলে বাঙ্গালী অস্মিতার সৌরভ বিবর্জিত এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিল। এর প্রভাবে এবং সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দখলদারির মহিমায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিরাপত্তাহীণতায় এবং অপর অংশ সুবিধাবাদী নীতির প্রভাবে বাঙ্গালীর মধ‍্যে বিভেদের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরল। এভাবে জেহাদী ও বিপরীত-জেহাদী রাজনীতির জাঁতাকলে নিজেদের ধরা দেওয়ার ফলে আজ বাঙ্গালী অস্মিতা মূমুর্ষ অবস্থায় দেহ রাখার অপেক্ষায় আছে।

প্রশাসক তুমি কার জন‍্য

ইংরেজ প্রদত্ত ভারতের ডোমিনিয়ান স্ট‍্যাটাসের সময় থেকে আভরা দেশের প্রশাসনিক দায়িত্বের জন‍্য ICS ও IPSদের সার্ভিস রুল পুরোটাই ব্রিটিশদের থেকে ধার করে চালিয়েছি। তারপর প্রজাতন্ত্র লাভের পর সর্বভারতীয় সার্ভিস এ‍্যক্ট ১৯৫১ তৈরী হয়। আর তারপর প্রশাসনিক অফিসার ICSদের যেমন IAS অর্থাৎ সিভিল সার্ভিস থেকে তা প্রশাসনিক সার্ভিস হল, তেমনি IPSও IASদের সার্ভিস রুল (এ‍্যক্ট নয়) পরিবর্তন করা হল। এটি১৯৫৪ সালে সার্ভিস এ‍্যক্টের অংশ হিসেবে চালু করা হল। তখন বিভিন্ন রাজ‍্যে কর্মরত ও নির্দিষ্ট IASদের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করলে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা দ্বারা গৃহীত হলে, অন‍্য রাজ‍্যে স্থায়ীভাবে বদলি করে দেওয়া যেত। এভাবেই ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন উজ্জ্বলকান্তি রায়কে স্থায়ীভাবে অন্ধ্র ক‍্যাডার থেকে পশ্চিমবঙ্গ ক‍্যাডারে বদলী করেন। তারপর ১৯৬৮তে আবার যখন ক‍্যাডার রুল পরিবর্তন করা হয় তখন এই ব‍্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। যেহেতু এই ক‍্যাডারে চাকুরীরতদের কেন্দ্রীয় সরকারের সার্ভিস রুল দ্বারা govern করা হয় সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার যখন সার্ভিসে যা পরিবর্তন করেন সেটা এই ক‍্যাডারে চাকরীরতদের উপর প্রযোজ‍্য হয়।
এই ঘটনার উল্লেখ করে শুধু এটুকু বলা যায় যে, এই ক‍্যাডার পোষ্টগুলি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সৃষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের চয়ন, তাদের ট্রেণিং ও প্লেসমেন্ট করে। প্রতি রাজ‍্য শুধু তাদের নিদিষ্ট ক‍্যাডারের প্রয়োজন অনুযায়ী অফিসারের সংখ‍্যা জানাতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার তার মধ‍্যে যতটা সম্ভব পুরণ করার চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যসরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এই অফিসারদের প্লেসমেন্ট দেয়। এক্ষেত্রে রাজ‍্যসরকারের ভূমিকা সীমিত। এছাড়া শেষ সংশোধনী অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট শতকরা হিসেবে রাজ‍্যের প্রশাসনিক অফিসারদের, যেমন WBCS, মধ‍্যে থেকে পদোন্নতির মাধ‍্যমেও IAS ও IPS হওয়া এখন একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। যদিও রাজ‍্যের অফিসারদের এই ধরনের পদোন্নতি সংক্রান্ত রাজ‍্যের সুপারিশের পরে শেষে তাদের নিয়োগপত্র আসে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে। এই ক‍্যাডারদের নিয়োগপত্রের শুরুতে থাকে – “The President of India is pleased to appoint…….”। আবার রাজ‍্য সরকারের অফিসার, যেমন WBCS, নিয়োগের সময় নিয়োগপত্র শুরু সময় লেখা থাকে – “The Governor is pleased to appoint……….”। এর থেকে এটা পরিষ্কার হল যে এই ক‍্যাডার পোষ্টগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। এজন‍্য এই অফিসাররা যে যে রাজ‍্যে কর্মরত, সেসব রাজ‍্য কর্মচারীদের মত না হয়ে এদের মহার্ঘভাতা, বাড়িভাড়াভাতা ইত‍্যাদি কেন্দ্রীয় হারে পেয়ে থাকেন।
আরো একটি প্রশ্ন উঠছে – রাজ‍্যসরকার নাকি এইসব রাজ‍্যে কর্মরত ক‍্যাডার অফিসারদের বেতন দেন! এমন প্রচার করে আমাদের রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি নিজেদের শুধু খেলো নয়, হাস‍্যাষ্পদ করেছে। আসলে এই অফিসারদের বেতন ইত‍্যাদি রাজ‍্যের প্ল‍্যান-এক্সপেন্ডিচার বাজেটের অন্তর্গত। আর প্ল‍্যান-এক্সপেন্ডিচারের বেতন ইত‍্যাদিসহ একটি বড় অংশ মিটিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। একমাত্র নন্-প্ল‍্যান এক্সপেন্ডিচার অংশ রাজ‍্যের এক্তিয়ার। সেখানেও আমাদের রাজ‍্যসরকার একটি সূক্ষ্ম চাল চেলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার দু এক বছরের মধ‍্যে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি কেন্দ্রীয় অর্থ বন্টন ব‍্যবস্থাকে সরলীকরনের নামে বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক অর্থাৎ, হেড অনুযায়ী রাজ‍্যগুলিকে অর্থমঞ্জুর না করে এ‍্যাডহক ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ ও অর্থ রিলিজ করেন। ফলে, কেন্দ্র হয়ত এক কাজের জন‍্য অর্থ দিচ্ছে, কিন্তু রাজ‍্যসরকার সেই অর্থ অন‍্য খাতে ব‍্যবহার করলে তাতে আইনী বাধা থাকে না। আর এইভাবেই কেন্দ্রের দেওয়া টাকায় রাজ‍্যের প্রকল্পগুলি রাজ‍্যের নামে চলতেই পারে – সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থকরা সোশাল মিডিয়ায় যতই বিপ্লব করুন, রাজ‍্যসরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার আইনতঃ কোন দোষ দিতে পারবে না। কিন্তু এখানে একটা ব‍্যপার পরিষ্কার। কেন্দ্রীয় IAS ও IPS অফিসার যারা এই রাজ‍্যে কর্মরত, তাদের বেতন, ভাতা সবই কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আসে। এই অফিসারদের কর্মরত অবস্থায় রাজ‍্যসরকারের অধীনে থাকলেও এদের চাকরী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। এই কারনে প্রাইজ পোস্টিং সহ পদোন্নতির সুপারিশ ও অন‍্যান‍্য স্বার্থের প্রয়োজনে এরা অনেক সময় রাজ‍্যসরকারের রাজনৈতিক তাঁবেদারী করে থাকেন। এদের যদি কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজন ও ক্ষেত্র বিশেষে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ডেকে নেয় তাহলে তাতে রাজ‍্যসরকারের যুদ্ধংদেহী ধরনের প্রতিবাদের কারন কি?
এই ব‍্যপার বুঝতে গেলে আমাদের বর্তমান রাজ‍্যসরকারের মোডাস অপারেন্ডি বোঝা প‍্রয়োজন। রাজ‍্যের বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রীদের ক্ষমতা অসীম মনে হলেও সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা, এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রী পর্যন্ত শুধু পরামর্শ দিতে পারেন; সরকারের নীতি নির্ধারণ করতে পারেন – আইনগত যথার্থতা ও তার রূপায়নের ভার থাকে বিভাগীয় সচিব অর্থাৎ IASদের হাতে। এমনকি বিভাগের অর্থনৈতিক দায়িত্ব সচিবের হাতে – মন্ত্রীর নয়। সংবিধান অনুযায়ী চললে তাই। কিন্তু রহস‍্য লুকিয়ে এদের কর্মপদ্ধতিতে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই IAS সচিবকুল নিজেদের জাত্মাভিমান নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন! সরকারী নীতি অনুযায়ী বিভিন্নস্তরের অফিসারদের জন‍্য গাড়ি ও তার খরচ নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট তেল খরচ ও ভাড়াগাড়ী হলে তার খরচও নির্দিষ্ট। এটি অর্থ দপ্তরের থেকে সার্কুলার দিয়ে জানানো থাকে। অথচ প্রতি বিভাগের সচিবের জন‍্য বিভাগের গাড়ি ছাড়াও বিভাগীয় কর্পোরেশান থেকে গাড়ি বরাদ্দ হয়। জানিনা এমন ক’জন বিভাগীয় সচিব আছেন যার জন‍্য বিভাগের থেকে একটিমাত্র গাড়ি নির্দিষ্ট আছে। বরঞ্চ একসঙ্গে একাধিক গাড়ি চড়ার ক্ষমতা এইসব সচিবরা আয়ত্ব করেছেন। কোন বিভাগীয় মন্ত্রী এতে আপত্তি করেছেন বলে জানিনা। কারন একটাই – প্রশ্নাতীত আনুগত‍্য। তাহলেই সব ঠিক রহেগা!
IASদের কাজ হল সরকারী প্রশাসন সাধারন মানুষের স্বার্থ বজায় রেখে আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে চালানো। তাঁরা people’s servant। কিন্তু কার্যক্ষেত্র এদের ঠাটবাট, চলনে বলনে দেখি এরা বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে চাকরী করতে আসে যে people are their servants। এটি কিন্তু পরাধীন দেশের বৃটিশ সিস্টেমের উত্তরাধিকার। এরা নিজেদের ইগো আর ভ‍্যানিটি নিয়েই থাকে – এমনকি অধীনস্ত কর্মচারীদেরও প্রাপ‍্য সম্মানটুকু দেয় না। তবে, একটি ব‍্যপারে তারা অতিমাত্রায় সচেতন। সেটা হল যথা সময় যথা স্থানে তৈলমর্দন। রাজ‍্যের তথাকথিত শাসনকর্তারা, যারা সর্বদা “অনুপ্রেঢ়না” চালিত, জানেন যে, তাঁদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। যদি বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা যায় তাহলে শুধু পকেটনয়, আরো অনেক কিছু ভর্তি করা যেতে পারে। তবে, একাজের জন‍্য তারা পুরস্কার ও তিরস্কার নীতির টোপ ঝুলিয়ে এইসব প্রশাসকদের, জেলাস্তর থেকে বিভাগীয়স্তর পযর্ন্ত কন্ট্রোল করে। এই অফিসাররাও পোস্টিংয়ের সুবিধা সহ অন‍্যান‍্য সুবিধার জন‍্য রাজনীতিবিদদের তাঁবেদারী করতে আগ্রহী হয়। কোন অফিসারের ‘সততার চুলকানি’ উঠলে তা দমন করার রাস্তাও রাজ‍্যসরকারের হাতে আছে। তাহল তথাকথিত রসকষহীণ স্থানে বদলি – এমনকি অফিসার-অন-স্পেশাল ডিউটি করে বসিয়ে রাখা। এভাবেই এই কেন্দ্রীয় অফিসারদের রাজ‍্যসরকার তার তাঁবে করে রেখে দেয়।আবার যখন সেট-ইনএ থাকা কোন অফিসারকে কেন্দ্রীয় সরকার বদলি (বলা হয় ডেপুটেশান; কারন এরা এখন স্থায়ীভাবে রাজ‍্যে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী) করে, তখন স্বাভাবিক কারনেই সেট-ইন বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কায় রাজ‍্যসরকার তাদের ছাড়তে চায় না। এখানে রাজ‍্যসরকারের ডাবল স্ট‍্যান্ডার্ড প্রকাশ পাচ্ছে। রাজ‍্যের ধামাধরা বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে, রাজ‍্যসরকার এই IAS, IPSদের ছেড়ে দিলে সরকারের প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে! এটি অত‍্যন্ত হাস‍্যকর যুক্তি। কারন রাজ‍্যসরকারের ‘সুপ্রিমো’ থেকে পায়াভারী মন্ত্রী, সকলেই বলেছেন যে, মাস্টাররা শিক্ষাঙ্গনে রাজ‍্যসরকারের হুকুম তামিল করতে বাধ‍্য – কারন রাজ‍্যসরকার তাদের বেতন দেয়! এইভাবে বেতন দেয় বলে আজকে রাজ‍্যসরকারের অধীনস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অবস্থা নবান্নের করণিকদের চেয়েও অধম! তাহলে সেই একই যুক্তিতে IAS, IPSদের নিয়োগ থেকে বেতন সবই কেন্দ্রীয় সরকার দেয় বলে তারা কেন কেন্দ্রের হুকুম মানবেন না – আর কোন যুক্তিতে রাজ‍্যসরকার ও তার ধামাধরা সংবাদ-মাধ‍্যম এজন‍্য কেন্দ্রের বিরোধীতা করে। কোন যুক্তিতে এই অফিসারদের কেন্দ্রে ডেপুটেশানে যেতে হলে ‘মাননীয়া’র অনুমতি নিতে হবে তা কিন্তু কেউ স্পষ্ট করে বলছেন না। যে সং সাজা মাধ‍্যমগুলি এত লাফালাফি করছে তাদের উদ্দেশ‍্যে বলি – চরিত্র আগেই বিকিয়ে দিয়েছেন, এখন মেরুদন্ড হারিয়ে কি পেলেন!
IAS, IPSদের সার্ভিস রুল কেন্দ্রীয় সরকারের বিচার্য বিষয়। রাজ‍্যসরকারী কর্মচারীদের চাকরী ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি থাকলে তাঁরা স্টেট অ‍্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব‍্যুনালে (SAT) আপীল করতে পারেন। কিন্তু IAS, IPSদের ক্ষেত্রে অন‍্য কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীর মত একই কারনে সেন্ট্রাল অ‍্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব‍্যুনালে (CAT) যেতে হয়। তাহলে রাজ‍্যে থাকতে অধিকাংশ IAS, IPS এত আগ্রহী কেন? কারন পরিষ্কার – প্রাইজ পোষ্টিং – রাজ‍্যের মধ‍্যে যা সম্পূর্ণভাবে রাজ‍্যসরকারের এক্তিয়ারভূক্ত। আর এই পোষ্টিংএই ত যত গুড়,মধু! কারন এই অফিসারদের সঙ্গে রাজ‍্যসরকার চালানো রাজনৈতিক দলের ‘সেটিং’ একবার হয়ে গেছে। তা নষ্ট হলে নতুন অফিসারের সঙ্গে সেটিং করা শুধু সময়সাপেক্ষ নয়, অনিশ্চয়তাও আছে। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারের জায়গায় রাজ‍্যের এই প্রতিবাদী হস্তক্ষেপ। যদি কেন্দ্রীয় সরকার এ ব‍্যপারে পিছিয়ে যায়, তাহলে পর্দার পিছনে অন‍্য রাজনৈতিক খেলা সম্পর্কে জনমানসের ধারণা আরো বদ্ধমূল হবে।
এবার এই প্রশাসনিক পদগুলি – বিশেষতঃ IASদের কাজকর্ম এবং এদের রাখার যৌক্তিকতা বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। ICS কুল ছিল বৃটিশদের দ্বারা সৃষ্ট এবং শুধু তাদের স্বার্থ দেখা ও ভারতীয় “নেটিভ”দের দমিয়ে রাখার কাজের জন‍্য তারা নিয়োজিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর নাম পাল্টে এই সার্ভিস হল IAS। এক্ষেত্রে কাজের ধারা ও তার অভিমুখ সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা করতে গেলে যে সুদূরপ্রসারী দুরদৃষ্টি থাকা দরকার তা তদানীন্তন শাসকদের মধ‍্যে দেখা যায়নি। বৃটিশ সিস্টেমের উপর কিছু কসমেটিক ও সিম্বলিক পরিবর্তন করা হল মাত্র। ব‍্যপারটা কেমন দাঁড়ালো? গাউন পরিহিত বৃটিশ ভদ্রমহিলা যদি গাউনের উপর ভারতীয় মহিলাদের ব্লাউজ পরেন তবে যেমন দেখায় তেমন দাঁড়ালো – না ঘরকা না ঘাটকা। এই নতুন শ্রেণী যারা আমলা নামে অভিহিত হল তারা রাজনৈতিক নেতাদের ‘হাত’ হিসেবে নেতাদের হুকুম তামিল করতে লাগল – বিনিময়ে নিজেদের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিতে লাগল। এই সার্ভিসের মত পৃথিবীর কোথাও এমন টাইম বাউন্ড প্রমোশান সহ স্থায়ী চাকরীর দেখা মেলে না। এদের কার্যকারিতা বিচারের গন্ডি না থাকায় যদি সমাজের উন্নয়ণ এদের কার্যকারিতার পরিমাপ হয়, তাহলে এরা কেউ পাশ করার যোগ‍্যতা অর্জন করবে না। এই প্রশাসককুল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের সেবার বদলে রাজনৈতিক বসদের সেবাকেই ‘সার্ভিস রুল’ মনে করল। ঔদ্ধত‍্য, আত্মম্ভরীতা ও দূর্ণীতি ধীরে ধীরে পুরো সার্ভিসটাকেই নষ্ট করে দিল। যে কোন চাকরীতে মূল‍্যায়ন হয়। শুধু এদের হয়না। এদের প্রভূত্ব সমাজের সব স্তরে লক্ষ‍্য করা যায়। এরা বিনা ট্রেণিংয়ে সব বিষয়ের ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসাবে সরকারী নোট দেন! এর ফলে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সামাজিক অনুন্নয়ন ও বৈষম‍্যের চিত্র সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে।
এখন এ ধরনের সার্ভিস সারা বিশ্বেই অচল। পরিবর্তে বিশেষজ্ঞের যুগ। এখন দায়িত্ব দিয়ে বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের মাধ‍্যমে এই IASদের প্রতিস্থাপন করার সময় এসেছে। এমন অচল, স্থবির ব্রিটিশ উত্তরাধিকার দেশবাসীকে কতদিন বইতে হবে কে জানে।

করোনায়িত পশ্চিমবঙ্গে সবাই লাভের কড়ি গোছাতে ব‍্যস্ত

করোনায়িত পশ্চিমবঙ্গ। কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউ সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ‍্যেও অপ্রতিরোধ‍্য। অপ্রতিরোধ‍্য বললাম বটে, তবে সত‍্যিই কি প্রতিরোধের চেষ্টা সরকার বা আমজনতা – কারোর মধ‍্যে আছে কি? অনেক সংবাদ-মাধ‍্যম ঘোষিত বোদ্ধা – বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন রকমের জ্ঞান দিয়ে আসছেন। এরমধ‍্যে আমজনতা সরকারী বিধিনিষেধের ছাড়ের মধ‍্যে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমিক সিরিজের সাময়িক বিনোদনের খোরাক পেয়ে যাচ্ছেন!
যেমন ধরুন সরকারী ছাপ মারা বিশেষজ্ঞ কমিটির মতে খোলা জায়গায় জলশা বা যাত্রা দেখতে গেলে করোনা সেখানে কবাডি খেলতে গেলেও কাউকে ছুঁতে পারবে না। আবার সিনেমা, থিয়েটার অর্ধেক দর্শক নিয়ে চললে কোন ভয় নেই, কিন্তু তার বেশী দর্শক এলেই করোনা সুনামির গতিতে আছড়ে পরবে! আবার বিয়ে সহ অন‍্য অনুষ্ঠান বাড়িতে ২০০ জন নিমন্ত্রিত অভ‍্যাগত এলে করোনা বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি পর্যন্ত করবে না! যদি নিমন্ত্রিত ২০১ জন হয়ে যায় তাহলে করোনার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পরবে! প্রথমে সেলুন, বিউটি পার্লার ও রেষ্টুরেন্ট বন্ধ করার আদেশ দিলেও তাঁরা, অর্থাৎ রাজ‍্যের করোনা বিশেষজ্ঞরা, দিব‍্যচক্ষে জানলেন এদের বাণিজ্য করার সময় কমিয়ে দিলে করোনা কোন ক্ষতি করতে পারবে না! দোকানপাট, আধুনিক শপিংমল ৫০% ক্রেতা নিয়ে অনুমতি আছে। তবে, ১০০% কতজনে হবে তার কোন মাপ নেই! অর্থাৎ কত সংখ‍্যার ৫০% তা কেউ জানে না! পরিবহন ও লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিবহন ক্ষেত্রে বাস, ট্রেনের সংখ‍্যা কমিয়ে যাত্রীসংখ‍্যা কমানো যায় – এই তত্ব প্রথম জানা গেল! আবার দেখুন, ফুটবল, ক্রিকেট সহ বিভিন্ন খেলাধূলা চললে নাকি করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারন নেই! বোধহয় এরা ধরে নিয়েছেন যে, করোনা খেলোয়ারদের সমীহ করে ছেড়ে দেবে!
কিন্তু হ‍্যাঁ। রাজ‍্যে পড়াশুনা একদম বন্ধ থাকবে – স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ‍্যালয়, গবেষণা – সব। শিক্ষা মনেহয় এরাজ‍্যে বাহুল‍্যমাত্র। ডিগ্রি পাওয়ার সুবন্দোবস্ত কিন্তু করা আছে। দু বছর অ-শিক্ষায় রাজ‍্য চলছে। এবার তৃতীয় বছরটাও এভাবে চালাতে পারলে মোটামুটিভাবে একটি প্রজন্মের শিক্ষার ভিত্তিই নষ্ট করে দেওয়া যাবে। বিশ্বব‍্যাঙ্কেরগ্লোবাল ডিরেক্টার জেমি সাবেত্রাও অবিলম্বে স্কুল, কলেজ খোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন। এই বন্ধে ক্ষতি সাধারন মানুষের – ক্ষতি মনুষ‍্যত্বের। লাভ কার? সেই লাভের কান্ডারীর খোঁজ করতে গিয়ে কয়েকটি অদ্ভুত তথ‍্য এবং তার বিশ্লেষণে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিল। প্রথম প্রশ্ন, অনলাইন স্টাডির ধারনা – এর প্রচারে জানলাম যে দেশে, বিদেশে শিক্ষাদান ও শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিচিতি থাকার সুবাদে আমার জানার যেটুকু ভাঁড়ার তা নিতান্তই সেকলে,অচল! এখন শিক্ষাদান বিষয়ে বিজ্ঞ হলেন বলিউড তারকা থেকে প্রাক্তণ ক্রিকেট খেলোয়াড়! অভিনেতার থেকে জানতে পারলাম যে আধুনিক শিক্ষাদানের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি এক ক্লাশে দু জন শিক্ষকদ্বারা শিক্ষাদান! “বিজ্ঞাপনের গরু গাছে চড়ে” প্রবাদটি জানা থাকলেও জানা ছিলনা যে, এইসব অনলাইন টিউশান ক্লাশ করানো কোম্পানীগুলি ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকদের কতটা মূর্খ মনে করে। এদের বিজ্ঞাপনের কালোয়াতি প্রচারে মনে হয় সর্বজ্ঞ শিক্ষক ও সর্বজ্ঞ ছাত্র-ছাত্রী তৈরী করার জন‍্যই অনলাইন ক্লাসের কোম্পানীগুলির জন্ম হয়েছে – যেখানে শিক্ষক (কোন একটি বিষয়ের) বলছেন, ছাত্র যদি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরী ক্ষায় পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে ঐ শিক্ষকও ইঞ্জিনিয়ার হলেন! পরশুরামের ছাগলাদ‍্য ঘৃত দাওয়াইয়ের কথা মনে পড়ল! তবে, এরা যখন বহু কোটি টাকা খরচ করে এত বিজ্ঞাপন করছে, তখন এদের বিনিয়োগের পরিমাণ কল্পনা করলে অন্ততঃ এটা বোঝা যাবে যে এরা লাভের ব‍্যবসা করতে এসেছে – টাকা ওড়াতে নয়। আবার এদের খদ্দের বা ‘মুরগী’ যাই বলা যাক, সেই টার্গেট সংখ‍্যা অনেক কমে যাবে যদি স্কুল, কলেজ খুলে গিয়ে শিক্ষাদান আবার করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যায়। সুতরাং এইসব কোম্পানী চাইবে, যেকোন মূল‍্যে ক্লাশরুম শিক্ষা – বিশেষতঃ স্কুলশিক্ষা বন্ধ থাকুক। কারন, এদের ‘খদ্দের’ স্কুল লেভেলেই বেশী। তারা কি ধরনের ‘তালা’ ব‍্যবহার করে এই রাজ‍্যে ক্লাশরুম শিক্ষা বন্ধ রেখেছে তা অনুমানসাপেক্ষ হলেও সাধারণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেজন‍্য এমন ধারনা করা অমূলক নয় যে, করোনার দোহাই অন‍্য সব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন‍্য ব‍্যবহার না করে শুধু শিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রেই ব‍্যবহার করা হচ্ছে – বিশেষতঃস্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে। অথচ, যত হাস‍্যকর পদ্ধতিতেই হোক না কেন, পরীক্ষা হয়েচলেছে যথারীতি!
দেখা যাচ্ছে, মদের দোকান ও বার খোলা রাখতে সরকারী বিশেষজ্ঞরা খুবই দরাজ। এই রাজ‍্যে করোনা ভাইরাস বোধহয় মদের নাম শুনলেই উল্টো রাস্তায় দৌড়ে পালায়। করোনা জুজুর ভয়ে মানুষের বাইরের কাজকর্ম যত কমবে, মদ বিক্রি তত বাড়বে – এই সাধারণ সূত্রে সরকারী কোষাগার যে মদ বিক্রির থেকে পাওয়া আবগারী শুল্কের প্রভাবে স্ফীত হচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। আবার, যেখানে যতই স্ফূর্তি করুন, নিমন্ত্রণ খান, রাত দশটার মধ‍্যে আপনাকে আপনার রেজিষ্টার্ড খোঁয়ারে – মানে, আপনার বাড়িতে ফিরতে হবে। রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা অব্দি রাজ‍্যের বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাস রাস্তাঘাট, বায়ুমন্ডল – মানে খোলা আকাশের নীচে – সমস্ত কিছুর দখল নেয়! আর সকাল পাঁচটা বাজার একমিনিটেরও কম সময়ে ভাইরাসগুলি কোথায় লুকিয়ে পড়ে তা বোধহয় ঐ বিশেষজ্ঞরাই জানেন! এতে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেলেও সেখানে কারোর যেমন পৌষমাস, তেমনি যাদের গাড়ি ছাত্রছাত্রী, আইটি ও কলসেন্টারের কর্মীদের পরিবহন দেয় তাদের সর্বনাশ।
একটি বেসরকারী ব‍্যাঙ্কের শাখায় পাশবই আপডেট করতে গিয়ে জানলাম যে করোনার কারনে গত ছ মাস ধরে পাশবই আপডেট করা যায়না! পোষ্টঅফিসে রেজিষ্টার্ড পোষ্ট, স্পীডপোস্ট সহ প্রায় সব পোস্টাল সার্ভিস বন্ধ – অজুহাত করোনা! কদিন আগে দেখলাম, একটি শিশুকে তার মা খাওয়ানোর সময় ভয় দেখাচ্ছিল যে, তাড়াতাড়ি না খেলে করোনা এসে শিশুটিকে ধরবে! শুনলাম এভাবে ভয় দেখানোর জন‍্য শিশুটি নাকি তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। সাম্প্রতিকতম যে আন্দোলন বাসমালিকরা করছেন তা হল করোনার জন‍্য বাসভাড়া বৃদ্ধি! আবার কেন্দ্রীয় সরকারও পিছিয়ে নেই। তাদের সংখ‍্যাতত্ত্বের মাহাত‍্যে দেশের অর্থনীতি নাকি এখন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাওয়া দৌড়ের থেকেও দ্রুত ছুটছে! তবুও কেন ব‍্যাঙ্কের আমানতে সুদের হার ক্রমশঃ কমছে তা বোধগম‍্য নয়। এখানে একটা কথা পরিষ্কার – মন্ত্রী-সান্ত্রী সবাই ধরে নিয়েছেন যে জনগণ হচ্ছে গোবর-গনেশ, তাকে যা বোঝানো যায় তাই বুঝবে!
এ রাজ‍্যের ভূক্তভোগী মাত্রই জানেন, নিজের বসতবাড়ি বানানো বা সম্প্রসারণের জন‍্য কাজ শুরু করতে গেলে স্থানীয় “সিন্ডিকেট” নামক এক সংঘবদ্ধ তোলাবাজির শিকার হতে হয়। এদের এলাকাভিত্তিক ‘রেট’ হয়। আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলছে, এই রেট করোনা উপলক্ষ‍্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তোলাবাজরাও মানুষ – করোনার সঙ্গে যোঝার রসদ তাদেরও চাই! পোষ্ট অফিসের অনেকটা কাজকর্ম বন্ধ – কোন আদেশবলে তা জানা নেই। বলা হচ্ছে করোনায়িত সমাজে এখন স্পীডপোষ্ট, রেজিষ্ট্রীপোষ্ট ইত‍্যাদি প্রকারের কাজকর্ম বন্ধ। অবশ‍্য বেসরকারী ক্ষেত্রে এগুলো সবই চালু আছে – অবশ‍্যই উচ্চতর মূল‍্যে। সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছে মোদ্দা ব‍্যপার দাঁড়ালো, সরকারী পোষ্টাল বিভাগের গঙ্গাযাত্রা আর সেইসঙ্গে চড়া দামে বেসরকারী পোষ্টাল সার্ভিসের পুষ্টিকরন! অবশ‍্য এর জন‍্য করোনা দায়ী – দুর্জনে বলে করোনা অজুহাত মাত্র।
তবে হ‍্যাঁ, যতই করোনার আস্ফালন চলতে থাকুক – যতই ডাক্তার, সিস্টার, স্বাস্থ‍্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ুন, নির্বাচন – সে উচ্চতম থেকে নিম্মতম স্তর – সব জায়গায় চালু থাকছে। ভোটপ্রচারে প্রার্থী দলবলসহ প্রচারে বেরোলে তাদের দেখেই বোধহয় করোনা লজ্জাবতীলতার মত একদিকে নুয়ে পড়ে থাকবে! করোনার ঘোষিত তৃতীয় ঢেউয়ের মধ‍্যেই কলকাতা পুরসভার নির্বাচন ‘সম্পন্ন’ হল। আর তারপর কয়েকদিনেই দেশের সব বড় শহরের মধ‍্যে সংক্রমণের সংখ‍্যায় কলকাতা প্রথম স্থানে পৌঁছে গেল। তারপর হাইকোর্টের গুঁতোয় বিধাননগর, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও চন্দননগর পৌরনিগমগুলির নির্বাচন তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে বাধ‍্য হল! বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় প্রার্থীদের প্রচারে কিন্তু কোন কার্যকরী বাধানিষেধ আরোপ হল না! অর্থাৎ আরো তিন সপ্তাহ প্রচার চলতে পারে! বাড়ি বাড়ি প্রচার চলবে – শুধু এইসব প্রার্থী, তাদের কর্মী ও ভোটারদের করোনা ধরবে না!
এবার করোনাকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণে আসা যাক – সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব ও তার দোহাই। এটা ঠিক যে, সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব সাধারণভাবে যতটা না কর্মচারীদের উপর পড়েছে, তার চেয়ে অনেক মারাত্মক প্রভাব পড়েছে বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে। সেখানে কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করা থেকে ধরে চাকরী হারানোর প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে করোনা এবং তৎসংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারী বাধানিষেধের কারনে, মানুষের দুর্গতি অপরিসীম। সরকার নাকি এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্মী প্রকল্প – ভান্ডার ইত‍্যাদি অনেক প্রকল্প দিয়েছে – একটা এমন প্রকল্প মনে পড়েনা, যেখানে এই কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের জন‍্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিজায়ী শ্রমিকের (কারা পরিজায়ী তার সংজ্ঞা রাজ‍্য সরকারের নথিতে আছে কি?) জন‍্য অনেক কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিয়েছে – সরকারের পোঁ ধরা সংবাদ-মাধ‍্যম; কিন্তু এই পরিজায়ীদের মধ‍্যে কতজন আবার তাঁদের পুরোনো কর্মসংস্থান দেওয়া রাজ‍্যে ফিরে গেছেন, কেন গেছেন – এসব তথ‍্য রাজ‍্য সরকারের কাছে নেই।
রাজনীতি সর্বস্ব – এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই – নীতিতে বিশ্বাসী শাসক, যে সর্বদা ধামাধরা মোসাহেববেষ্টিত, তার বধির কর্ণকুহরে অনাহার, অর্ধাহারে থাকা, বিনা চিকিৎসায় ভুগতে থাকা মানুষের হাহাকার পৌঁছায় না।
এবার ডাবল স্ট‍্যান্ডার্ড দেখানো বাংলা সংবাদ-মাধ‍্যম আর রাজনীতিকদের করোনা হাতিয়ার করে মিথ‍্যে ইমেজ তৈরীর প্রচেষ্টার কথা বলে এবারের মত শেষ করব।
রাজ‍্যের সুপ্রিমোর নাম ও ছবিসহ ফলের ঝুড়ি (!) এবং আরো কিছু জিনিষ নাকি সব করোনা পজিটিভ রোগীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে – মহান সরকারের মানবিকতা মহতী উদ‍্যোগ! কার্যক্ষেত্রে সংবাদ-মাধ‍্যম মারফৎ জানা গেল, সৌরভ গঙ্গোপাধ‍্যায় ও সুকান্ত মজুমদারের কাছে এসব পাঠানো হয়েছে। এই প্রচারকে ১০০% রিডাকসান সেলে বিক্রি হওয়া বাংলার বুদ্ধিজীবি(!) রা অনুপ্রাণিত বাহবায় ভরিয়ে দিল। এখানে আমার জানা দুটো ঘটনার উল্লেখ করছি। আমার এক পূর্ব কলকাতার বন্ধুর এই সময়ে করোনা পজিটিভ হওয়ার পর সে গৃহ-অন্তরীন হয়। এছাড়া আমার পরিবারের এক যুব সদস‍্য করোনা পজিটিভ হয়ে প্রায় একই সময় গৃহ-অন্তরীন হলেও তাদের কারো কাছেই কোন ফলের ঝুড়ি ত দূরস্ত্, কোন সৌজন‍্যবার্তা অব্দি আসেনি। অবশ‍্য তারা ‘সেলিব্রিটি’ বা রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব নয়। সুতরাং তথাকথিত সেলিব্রিটিকে যুক্ত করে প্রচার পাওয়ার মাধ‍্যম অবশ‍্যই করোনা – যা নবতম রূপ ওমিক্রন।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের বক্তব‍্য অনুযায়ী ওমিক্রন আরটিপিসিআর-এ ধরা পরে না। এর জন‍্য যে জিনণ সিকোয়েন্সিং দরকার তার টেষ্টের সুযোগ এখানে সীমিত। অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ‍্যমে রোজ যে বহু হাজার পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে তা নিশ্চয় ওমিক্রন নয় – ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট! তাহলে এখানে ওমিক্রন ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? পুরো ব‍্যপারটাতেই কেমন এলোমেলো যুক্তির গন্ধ। সুতরাং সাধু সাবধান। নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ‍্য নিজে বাঁচান। “ধান্দাবাজী জিন্দাবাদ”এর দর্শন থেকে শতহস্ত দূরে থাকুন।

ভারতীয় উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের ফল

ভারত আর পাকিস্তান দুটি দেশ একসঙ্গে ৭৫ বছর আগে স্বাধীনতা পেয়েছে। তারপর পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সংবিধান এতবার সংশোধন করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের সামরিক সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর সবকিছুই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আজ, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর, এর কারন খুঁজতে বসে প্রথমেই যে কথাটা মনে হচ্ছে তাহল, “আমরা যা নই তাই সেজে সবার চোখে যে দিই ধুলো”। আমাদের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই আমাদের নেতারা তাদের মুখগুলিকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে দেশপ্রেমের অভিনয় করে গেছেন।
জাত-পাতের রাজনীতি ভারতের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই দেশের রাজনীতিতে অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মত প্রবহমান। গান্ধীজির অসহযোগীতায় ভীমরাও রামজী আম্বেদকারের মত একজন যথার্থ গুণী, বিদ্বান মানুষকে দেশের স্বার্থে সঠিকভাবে ব‍্যবহার করা হয়নি। গান্ধীজি মুখে অন্তজ ও অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের জন‍্য সহানুভূতি দেখালেও তাদের যথার্থ সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়নের জন‍্য কোন সার্থক প্রয়াস করেন নি। গান্ধীজি তাঁর অহঙ্কার ও প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট থাকার কারনে (যা ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রায় অধিকাংশের মধ‍্যেই দেখা যায়) তিনি শুধু সুভাষচন্দ্র নয়, শ‍্যামাপ্রসাদকেও তাঁর যোগ‍্য স্থানপ্রাপ্তিতে প্রত‍্যক্ষ‍্যে বা পরোক্ষে বাধা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ‍্যের – বিশেষতঃ বাংলার মানুষদের অগ্নিগর্ভ স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মবলিদান তাঁকে বিচলিত করেনি। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি তাঁর অহংকার প্রসূত ঘৃণা তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধেই প্রশ্ন তোলে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির থেকে অধিক গুরুত্ব দিতেন তাঁর অহিংস আন্দোলনের পথকে! পৃথিবীর অন‍্য কোন দেশে অহিংসার মাধ‍্যমে স্বাধীনতা আসেনি। আমাদের দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর ব্রিটেনের অর্থনীতি ও ঐ সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি – সর্বোপরি উইনস্টন চার্চিলের সাধারণ নির্বাচনে পরাজয় আর তার সঙ্গে জাপানের আত্মসমর্পণ – এসবের যথেষ্ট সম্পর্ক আছে। গান্ধীজি সারা দেশের নেতা ছিলেন ; কিন্তু তাঁর কাছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে এই অঞ্চলগুলি থেকেই সিংহভাগ নেতৃত্ব ক্ষমতার শীর্ষে আসেন। গান্ধীজি তাঁর অহিংস আন্দোলনকে একমাত্র গুরুত্ব দিলেও কখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন সহিংস আন্দোলনের প্রতিবাদ করেননি। কেন? এর একটি ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়। তাহল, গান্ধীজির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব মানুষের নেতা হওয়ার ইচ্ছের জন‍্য তিনি মুসলমান নেতাদের সাম্প্রদায়িক কাজকর্মের ব‍্যপারে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তিনি এই নেতাদের প্রতি সফট ফিলার যা সাদা বাংলায় নৈতিক ঘুষ বলা যায় তা দিয়ে গেছেন। এরজন‍্য একাধিকবার কংগ্রেসকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। তবে, গান্ধীজি একাই এভাবে মুখোশের আড়ালে রাজনীতি করেছেন তা নয়, আরেকজনের নাম অবশ‍্যই বলতে হয় – যিনি গান্ধীজির সবচেয়ে স্নেহধন‍্য শিষ‍্য জওহরলাল নেহরু। বিলেতের ব‍্যরিস্টার নেহরু কোনদিনই সাধারন জননেতা ছিলেন না। তাঁকে জননেতা বানানো হয়েছিল। তাঁর বিলেতি আচার আচরণ, দেশের কৃষিজীবি ও শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে যোজন দূরত্বে থাকা নেহরু, গান্ধীজির প্রত‍্যক্ষ পক্ষপাতিত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। যেহেতু কোন সংগ্রামী আন্দোলনের মধ‍্যে দিয়ে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নেহরু প্রধানমন্ত্রীর গদীতে আসীন হননি, সেসময়কার সম্ভ্রান্ত ও ধনী মানুষদের মত তাঁর উন্নাসিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং সমাজের সব শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে চলার মানসিকতা ছিলনা। ফলে, তিনি কংগ্রেসের coterieর নেতা হিসেবে দেশের ক্ষমতায় নিজের coterieকেই প্রমোট করেন। আর তার জন‍্যই স্বাধীনতার সময় থেকেই দেশে যোগ‍্য ক‍্যাবিনেটের অভাব ছিল। পরবর্তীতে অবশ‍্য ধীরে ধীরে কিছু যোগ‍্য মানুষ দেশের শাসনক্ষমতার অলিন্দে এলেও গোষ্ঠীতন্ত্র এখনো আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল কথা।
আবার অযোগ‍্য মানুষের হাতে ক্ষমতা গেলে যা হয় তা শুরু থেকেই আমাদের দেশেও চালু ছিল। তাহল, ক‍্যালিবারের বদলে চাটুকারিতা ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গুণ হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। সুখ-স্বাচ্ছন্দভোগের এমন উপায় চিরস্থায়ী করার জন‍্য বংশগতভাবে গদী ধরে রাখার পরিকল্পনা শুরু হল। এই কাজে সুবিধে পাওয়ার জন‍্য সংবিধানকে হাতিয়ার করে তার বিকৃত ব‍্যখ‍্যা করা শুরু হল। প্রথমে ১৯৪৭ সালে কিন্তু আমরা ইংরেজ সাম্রাজ‍্যের ডোমিনিয়ন স্ট‍্যটাস পাই। পরে ১৯৫০ সালে আমরা ভারতকে প্রজাতন্ত্র (republic) হিসেবে ঘোষণা করি। আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান নাম Sovereign Socialust Secular Democratic Republic of India (Union of States)। এই নাম মেনে আমাদের রাষ্ট্রের স্বরূপ বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব! কারন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক সংজ্ঞা অনুসারে কয়েকটি বিপরীতধর্মী শব্দের সমাহার ও তৎসহ বাস্তব বিশেষণে ভূষিত হয়ে আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা ব‍্যখ‍্যা করতে গেলে বলতে হয়, এটি এমন একটি রাষ্ট্র যে, তার স্বরূপ সর্বদা ব‍্যখ‍্যা নির্ভর যা কিনা ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত যেকোন পরিবর্তন হতে পারে!
প্রথমে আসি Democratic Republic অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (!) এর ব‍্যখ‍্যায়। গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত সরকার দেশ চালালেও দেশের শাসনপ্রক্রিয়ায় জনগণের সকল প্রকার অংশগ্রহণ স্বীকৃত। সরকার তার কাজের সবরকম স্বচ্ছতা জনগণের কাছে জানাতে বাধ‍্য। প্রজাতন্ত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পদের নির্বাচন প্রত‍্যক্ষ না হয়ে অপ্রত‍্যক্ষ হতে পারে। যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অপ্রত‍্যক্ষভাবে হয়। আবার রাজতন্ত্র বা বংশগত শাসন গনতন্ত্রে থাকলেও তা প্রজাতন্ত্রে সম্ভব নয়। যদিও গণতন্ত্রে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র (যেমন গ্রেট ব্রিটেন) সম্বন্ধে কিছু বলা নেই, তবু গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় বংশগতভাবে শাসনভার পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেজন‍্য এই দুটি আপাত নিরীহ বাক‍্য ব‍্যবহার করে প্রথমেই জনগণের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার প্রশ্নে জল ঢালা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার সময় থেকেই স্বার্থান্বেষী অযোগ‍্য মানুষজন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ভিড় করার পর তাদের মনে সাধ জাগলো, যদি এই ক্ষমতার মধুভান্ড বংশপরম্পরায় কুক্ষিগত করা যায়! এজন‍্য যতক্ষণ গণতন্ত্র তাদের কাজের পরিপন্থী না হচ্ছে ততক্ষণ গণতন্ত্রের ধারক আর যখন তাদের কাজের স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে তখন প্রজাতন্ত্রের দোহাই – অর্থাৎ, যখন যেমন তখন তেমন, করার সুযোগ নেওয়া শুরু হল। গণতন্ত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার – এই চিন্তাধারার পরিপন্থী ‘আরক্ষণ নীতি’কে সমাজের সকল ক্ষেত্রে স্থায়ীত্ব দেওয়া হল। এই সময় আমরা গণতান্ত্রিক থাকলাম না! শাসকের ভোটবাক্সের স্বার্থে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সংজ্ঞা এবং বয়স – দুইই পরিবর্তিত হল। পরবর্তীকালে স্বতঃস্ফূর্ত মতদান প্রক্রিয়ায় বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন স্তরে ‘হস্তক্ষেপ’ শুরু হল। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, যতদিন পর্যন্ত জওহরলালের কোন বংশধর স্থায়ীভাবে প্রধানমন্ত্রীত্বের গদীতে না বসেছেন ততদিন পর্যন্ত কংগ্রেস পার্টি দেশের সুস্থিরতা ব‍্যহত করতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এর থেকে একটি জিনিষ খুব পরিষ্কার যে, ভারতের স্বাধীনতা আর যাই হোক, গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
জরুরী অবস্থার সময় দেশের মধ‍্যে বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের বন্ধুদল কম‍্যুনিষ্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পারিবারিক শাসন কায়েম করার সুবিধের জন‍্য ভারত রাষ্ট্রকে Socialist ও Secular রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধানে সংশোধনের মারফৎ অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে করে দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে তাদের রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মতার মূল ভিত্তিটাই পাল্টে দেওয়া হল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে plebiscite ছাড়া তা করা যায় না। আশ্চর্য লাগে, এখনো অব্দি পরবর্তী কোন সরকার এ ব‍্যপারে পদক্ষেপ করেনি। এতে কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলির গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানোকে সাধারণ মানুষ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
যে পটভূমিতে ভারত ত্রিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল, ধর্মের (religion) ভিত্তিতে সেই বিভাজন মেনে নেওয়ায় যেমন পাকিস্তান (পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশও একই পথের পথিক) যথার্থভাবে মুসলিম রাষ্ট্র, তেমনি ভারতও যুক্তিগ্রাহ‍্যভাবে হিন্দুরাষ্ট্র হওয়ার কথা; অন্ততঃ ডোমিনিয়ন স্ট‍্যটাস দেওয়ার তথ‍্য অনুযায়ী। কিন্তু ভারতীয় শাসক তার কন্ট্রোল্ড গণতন্ত্রে মুসলমান নাগরিকদের তোষন করার প্ল‍্যান অনুসারে ভারতে সর্বধর্ম-সমন্বয়ের সোনার পাথরবাটি তুলে ধরলেন! আইন মোতাবেক তা করা যায় না। এমন নয় যে সেই রাষ্ট্রে অন‍্য ধর্মালম্বীরা থাকতে পারবে না বা তাদের কোন বৈষম‍্যের শিকার হতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গান্ধীজির মদতে জওহরলাল নেহরু ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে মানতে চাননা। তাঁর এই অযৌক্তিক কাজের খেসারত আজ দেশের সব ধর্মের নাগরিকদের দিতে হচ্ছে। এর কারন একটাই। গান্ধীজি এবং তাঁর মানস-পুত্র জওহরলাল এই দেশটাকে তাদের দখলদার মৌরুসীপাট্টা হিসেবে দেখেছিলেন। শুধু সাধারণ নির্বাচনে জিতে কোন সরকার এভাবে রাষ্ট্রের গঠন পাল্টে দিতে পারেনা। এর জন‍্য কোন বিশেষ plebisciteও করা হয়নি। তাহলে ত উত্তর কোরিয়ার বংশানুক্রমে শাসন করা শাসককেও সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ধারক ও বাহকের তকমা দিতে হয়!
আমাদের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া যাবে না। তাহলে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলি থাকা সত্বেও ধর্মের ভিত্তিতে কি করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে? সরকার কিভাবে এটা চালিয়ে যাচ্ছে আর আইনের চোখে তা গ্রাহ‍্য হচ্ছে!
এই ধরনের ধর্মীয় ও জাতিগত সংরক্ষণ ও আর্থিক উপঢৌকনে এই গোষ্ঠীগুলির সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের কোন ছবি ধরা পড়ে না। উপরন্তু এই ধরনের প্রকল্প সমাজের ও দেশের স্থায়ীত্বের ভিত্তিমূলেই আঘাত করছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা তার সাক্ষ‍্য বহন করে। এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য। যখন ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে বা ভারতের পক্ষে বসবাসের জন‍্য মতদান করে ছিলেন, তখন তাঁরা কি ভারতে ‘সংখ‍্যালঘু’ তকমা পাওয়ার দাবীদার ছিলেন? যেমন পাকিস্তানে বা অধুনা বাংলাদেশে সে দেশের ধর্মীয় ‘সংখ‍্যালঘু’দের অধিকার, এই ভারতেও সেই একই অধিকার থাকা উচিৎ। অত‍্যন্ত দুঃখজনক হলেও এর দায় কিন্তু কংগ্রেসের – বিশেষতঃ একটি বংশের। আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” নাড়া লাগানো মানুষদের প্রভাবিত করেছে এই নেহরু-গান্ধী পরিবারের ভারতে রাজত্ব করার লিপ্সা।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জাতি,ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের সব নাগরিককে যথার্থ দেশাত্মবোধের পরিচয় দিতে হবে। দেশের সব নির্বাচিত পদের মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে হবে (একবার বা দুবারের বেশী একজন ব‍্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে)। যেকোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ও তার পরিবারের সকল উপার্জন subject to public scruitiny করতে হবে। অবশ‍্য এসব হলে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের জনসেবার উৎকট, উদগ্র কামনা কতটা অবশিষ্ট থাকে তা দেখার বিষয়। তবে, একটা কথা, বিড়ালের গলায় কে ঘন্টা বাঁধবে!

তুঘলকী প্রশাসন ও ওমিক্রন ভূত

আবার করোনার ভ্রুকুটি – আবার গরীবের পেটে লাথি। এবারের করোনা ভূত – তার নাকি ওমিক্রন রূপ! অতয়েব আবার বিধিনিষেধ – আবার ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের দীর্ঘনিশ্বাস – চোখের জলে মাটি ভিজবে – বেসরকারী হাসপাতালগুলির লাভের ঘর স্ফীত হবে – ‘অনুপ্রাণিত’ মানুষদের ঘরে অতিরিক্ত সম্পদের সংস্থান হবে। এমন অবস্থা কেন, কিভাবে হল – এর পেছনে কুশীলব কারা – সেই তথ‍্য বিশ্লেষণ করা অতি প্রয়োজন।
বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট, যাতে ৩৭ জায়গায় প্রোটিনের কার্বোহাইড্রেট ও অ‍্যামিনো অ‍্যাসিডের ট‍্যগিং পয়েন্ট পরিবর্তিত হয়েছে, সেটি অত‍্যন্ত বেশী মাত্রায় সংক্রামক ও তার ফলেই নাকি করোনা আক্রান্তের সংখ‍্যার এই বাড়বাড়ন্ত! এমন ভাবের ঘরে চুরি বোধহয় এখনকার প্রশাসনের পক্ষেই সম্ভব। পরিসংখ্যান কিন্তু সম্পূর্ণ অন‍্য কথা বলছে। গত ১লা জানুয়ারি, ২০২২এর সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের একদিনে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ‍্যা সাড়ে ঢার হাজার, যার মধ‍্যে ওমিক্রন আক্রান্ত মাত্র ১৯। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, আমাদের রাজ‍্যের ক্ষেত্রে ওমিক্রন নয়, সবচেয়ে ভয়াবহ ভ‍্যরিয়েন্ট ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাসে আক্রান্তের সংখ‍্যায় অতিবৃদ্ধি হয়েছে। আবার এই সময়ে লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে যে, উত্তর-পূর্বের রাজ‍্যগুলিতে – বিশেষতঃ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ‍্যুষিত নাগাল‍্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত কয়েকদিনে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া দেশের বড় শহরগুলির মধ‍্যে মুম্বাই, পুণে, দিল্লী, কোলকাতা ও ব‍্যাঙ্গালোরে করোনা রোগীর সংখ‍্যা ১০% এর মত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোলকাতায় এই বৃদ্ধি সর্বোচ্চ – ২৩% এর উপর!
এই পরিসংখ্যান আমাদের যে তথ‍্য দিচ্ছে তার থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বর্ষপূর্তি ও খ্রীষ্টমাসের আনন্দে বাঁধনহারা মানুষের কোভিড প্রোটোকল বিরোধী জমায়েত, মাস্ক না পড়ে, সামাজিক দূরত্ববিধি না মানা – এসব যেখানেই বেশী হয়েছে সেখানেই করোনার আক্রমণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর দ্বারা উন্মোচিত,সরকারী খরচে আলোর মেলা – যা দেখতে লক্ষ মানুষের ভিড় জমেছে – তা যেকোন পুজোর ভিড়কে ছাপিয়ে যায়। কোর্টের আদেশে প্রশাসন ও পুজো কমিটিরা এই ব‍্যপারে সতর্ক থাকায় পুজোর সময় রাজ‍্যে তৃতীয় ঢেউ আটকানো গেছে। তবে এবারের এই বিপর্যয়ের দায় বহুলাংশে রাজ‍্যের বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগোষ্ঠীগুলিকে নিতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্মের জন‍্য এরা আগেই যথেষ্ট পরিচিত। পুরোনো নানা ঘটনার উল্লেখে বিড়ম্বনা বাড়ানো এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য নয়। তবু একথা মানতে হবে, আমদের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি আগে থেকে কোন অনুষ্ঠানের বা উৎসবের ‘হাইপ’ তুলতে থাকে। এর কারন এখন সবাই বোঝেন। নিজেদের লাভের কড়ি বাড়াতে গিয়ে এরা এই খ্রীষ্টমাস ও ইংরেজী বর্ষবরণের ‘হাইপ’ তুলতে একে অন‍্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামল। ওদিকে ‘কম জানা, বেশী বোঝা’ ধর্মনিরপেক্ষ (!) বাঙ্গালী মধ‍্যবিত্ত তাদের স্ট‍্যাটাস দেখানোর জায়গা হিসেবে করোনা রোগীর সংখ‍্যাবৃদ্ধিতে সরাসরি ইন্ধন জুগিয়েছে। প্রাথমিক তথ‍্য বলছে, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা এবং বয়স্ব নাগরিকরা এই হুজুগ থেকে দূরে থাকায় তাঁদের মধ‍্যে করোনা আক্রান্তের সংখ‍্যা তুলনামূলকভাবে কম। যখন উৎসব শেষ, বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি বাঙ্গালীর কফিনে পেরেক পোঁতার কাজে নেমে পড়ল। এবারের উদ্দেশ‍্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ঘরে আটকে রেখে অর্থনীতির চরম ক্ষতি করা। নেপথ‍্য কারন মনে হয়, ‘অনুপ্রেঢ়ণা’ ও ‘অনুপ্রাণিত’ প্রশাসনকে জনসাধারনের রোষ থেকে বাঁচানো।
তারজন‍্য প্রথমেই ওমিক্রন ও তার সংক্রমনের ভয়াবহতা নিয়ে নিয়ে ভূতের গল্প শোনানোর মিথে জনমনে ভীতি ছড়ানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সাংবাদিকের জ্ঞানগর্ভ লেখায় সেকি জোশ!…… আমার মনে পড়ল, প্রমথনাথ বিশীর এক অসাধারণ উক্তি। এই প্রথিতযশা সাহিত‍্যিক বহু বছর এক বৃহৎ সংবাদপত্রে সাংবাদিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যাপনার কাজে যোগদান করেন এবং সেখান থেকেই কর্মজীবনে অবসর নেন। তারপর তিনি কোন এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলকাতা সেনেট হলে একটি আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিতে আসেন। বক্তৃতার শেষে তিনি যখন চলে যাচ্ছেন, তখন কিছু সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে জানতে চান যে তিনি তাঁর কর্মজীবনে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে কাজ করেছেন। তারা খুব অল্প কথায় তাঁর কাছে জানতে চান দুই জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। প্র.না.বি.(এই নামে তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন) অল্প কথায় বললেন, “প্রথম জীবনে আমি দেখেছি মূর্খের পান্ডিত্ব আর পরের জীবনে দেখছি পন্ডিতের মূর্খামি”। এর থেকেই বোধহয় বোঝা গেল, ওমিক্রন সংক্রান্ত আমাদের জ্ঞান বিভিন্ন প্রকাশিত গবেষনাপত্র থেকে নয়, মধ‍্যবিত্ত বাঙ্গালী এই জ্ঞান নিয়েছে সাংবাদিকদের থেকে! তবে, আজকের দিনে মানুষ উদ্দেশ‍্যবিহীন কোন কাজ করেনা। সংবাদ-মাধ‍্যমও তার ব‍্যতিক্রম নয়।
এবার দেখা যাক, আমাদের রাজ‍্যে, বিশেষতঃ কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে করোনা রোগীর এমন অকস্বাৎ বৃদ্ধির কারন কি। ‘অনুপ্রাণিত’ সংবাদ-মাধ‍্যম কখনোই এই বিশ্লেষণ করবে না। এর সবচেয়ে বড় কারনগুলির একটি হল উৎকট উল্লাসে সমস্ত কোভিড বাধানিষেধকে ছুঁড়ে ফেলে ‘উৎসব’ উদযাপন। দ্বিতীয় কারন অবশ‍্যই কোলকাতা পুরসভার সাম্প্রতিক নির্বাচন। পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে রাজ‍্যে সাম্প্রতিক মোট আক্রান্তের মধ‍্যে শতকরা ষাট-সত্তর ভাগ হচ্ছে কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এই কঠিন সময় পুর নির্বাচনের কি বিশেষ প্রয়োজন ছিল? আবার বিধাননগর, শিলিগুড়ি, আসানসোল সহ কয়েকটি পুরসভার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই নির্বাচন আর কয়েকদিন বাদে নির্ধারিত। প্রার্থীরা উৎকট দেশসেবার উদগ্র কামনায় যে কোভিড আচরণবিধি জলাঞ্জলি দেবেন তা আমাদের পূর্ব নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় সবাই দেখেছি। নির্বাচন হবে – তবে কতো করোনার বলি চড়ানো হবে সেই আশঙ্কায় শঙ্কিত হচ্ছি।
আবার, গঙ্গাসাগরের মেলা ও পূণ‍্য সঙ্গমস্নান চলবে বলে সুপ্রিম ‘অনুপ্রেঢ়ণার’ আদেশে অনুপ্রাণিত প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোন সুস্থ বোধবুদ্ধিতে এ রাজ‍্যে সমস্ত মেলা,খেলা,উৎসব, অনুষ্ঠানের ভিড় চলছে কে জানে! মনে হচ্ছে, প্রশাসন মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, চলছে হৃদয়ের অনুপ্রেঢ়ণায়। এদিকে, কোভিডপ্রোটোকল মেনে এই সব করার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের রাজ‍্যের মানুষজনের আচরণ দেখে মনে হয়, এ যেন যৌনকর্মীর কাছে কুমারীত্ব দাবী করা! পার্কস্ট্রীটের যে জনসমুদ্রের ছবি বিভিন্ন সংবাদ-মাধ‍্যমে দেখা গেছে তা কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানের দিনগুলি জুড়েই চলেছে। প্রশাসন এই সবের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিয়েছে সে সম্বন্ধে সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির নিরবতা লক্ষ‍্যণীয়। অতএব, গঙ্গাসাগররের উৎসব-পার্বণের আনন্দ ও ভোট “খেলা” আরো দুটি বড় সংক্রমণের কারন হতে চলেছে।
একটা ব‍্যপার খুব অদ্ভুত লাগছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকান্ড বেগবতী পাহারী নদীর মত সতত প্রবহমান – এখানে কখনো লকডাউন করা যাবে না – যানবাহন ও রেল সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না – এসব করলে রাজ‍্যের ভঙ্গুর স্বাস্থ‍্যের অর্থনীতি যে ভেঙ্গে পড়বে সে বিষয় সবাই একমত। তাহলে উপায় কি? প্রচারবিহীন ‘অনুপ্রেঢ়ণা’ ও জলছাড়া মাছ একই রকম। সুতরাং রাজ‍্য প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ শুরু করল। কি? ইংল‍্যান্ড থেকে আসা বিমানের অবতরন এই রাজ‍্যে বন্ধ করা হল। কেমন অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা – কোন যাত্রী যদি ইংল‍্যান্ড থেকে দুবাই হয়ে কোলকাতায় আসে? যদি দুবাই না হয়ে ভারতের অন‍্য কোন এয়ারপোর্টে নেমে তার পর চেক-আউটের পরে দেশীয় উড়ানে কোলকাতায় আসে – তাদের ক্ষেত্রে কি ব‍্যবস্থা; এভাবে সংক্রমণ আটকানো যাবে কি? “pennywise pound foolish” – এই প্রবাদটা মনে পড়ল। যেসব দেশে খ্রীষ্টমাস ও নিউ ইয়ার উদযাপন সবচেয়ে বড় উৎসব সেখানে ওমিক্রন সংক্রমণ বিপুল হারে বাড়ছে। আমাদের রাজ‍্যে কিন্তু ওমিক্রনের থেকে ডেল্টা প্রজাতির সংক্রমণের সমস‍্যা অনেক বেশী। আর এই সমস‍্যার উদ্ভব যেমন উৎসব ও উদ্দাম আনন্দের মুক্ত-মিলনের কারনে গতি পেয়েছে, তেমনি নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডও এই বৃদ্ধির জন‍্য দায়ী। প্রশাসন রাজনৈতিক কর্মকান্ড পুরোপুরি বজায় রাখছে! রাস্থায় বেরিয়ে মানুষের কোভিডবিধি না মানার জন‍্য শাস্তির বিধানের প্রয়োগ ত বিশেষ করছেই না; পরন্তু প্রশাসনের মানষজনের মধ‍্যেও সামাজিক দূরত্ব না-মানা, থুতনি-মাস্ক পড়ে অফিসে কাজ করা – এইসব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা কথা সবাইকে জানানো হচ্ছেনা যে WHO জানিয়েছে, ওমিক্রণ একটি অতি সাধারন সংক্রমণ। এতে সরাসরি মৃত‍্যু হয় না (আগের একটি লেখায় তা বিশদে আলোচিত করা হয়েছে)। কিন্তু আমাদের রাজ‍্যে ত বাড়ছে করোনার সবচেয়ে ভয়াবহ ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ।
প্রশাসনের আরেকটি ব‍্যর্থতার জায়গা অবশ‍্যই সব পানশালাসহ হোটেল, রেস্টুরেন্ট খুলে রাখা। ৫০% বুকিং-এর কথা বলা হলেও তার সঠিক পর্যবেক্ষণ ও স্টেপ নেওয়ার পরিকাঠামো রাজ‍্যসরকারের আছে কি? রাত বারোটায় উত্তর কোলকাতার যে রেস্তোরাঁ খুলে রাখা হয়েছিল এবং খাবার নিয়ে বচসার জেরে রেস্তোরাঁর লোকজনের হাতে খদ্দেরদের শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার পর সেই রেস্তেরাঁর ঘটনায় কজন কি শাস্তি পেল তা কেউ জানে না। এ সব ঘটনা প্রশাসনের নিয়ম পালন করার নির্দেশকে বিদ্রুপ করে। আবার এই উৎসবের হাইপ তুলে বছরের শেষে মদের দোকান থেকে রেকর্ড পরিমাণ শুল্ক আদায় হলেও তার পরোক্ষ প্রভাব করোনা সংক্রমণের সংখ‍্যাবৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সুতরাং শুধু ইংল‍্যান্ড থেকে আসা উড়ানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা মনেহয় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হয়ে গেল। এভাবে করোনার সঙ্গেলড়াইয়ে এঁটে ওঠা যাবেনা। যদি সাধারণ মানুষকে কোভিডবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করাতে বাধ‍্য করা না যায়, প্রশাসনের সেই ব‍্যর্থতার দায় কিন্তু ভুগতে হবে আমাদের সবাইকে – মূর্খস‍্য লাঠৌষধি।
আরেকটি কথা। রাজনৈতিক কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন উৎসব চলতেই পারে। কিন্তু এই নিউ নর্মাল সময়ে তা নর্মালভাবে করা যাবে না। এই সহজ সরল কথাটা রাজনৈতিক নেতাদের বোঝা উচিৎ। রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনারের উচিৎ এখুনি পুরনির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। একটা কথা মনে পড়ল। সৌরভ গাঙ্গুলীর করোনা হয়েছে বলে সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি প্রধান খবর হিসেবে রিপোর্ট করেছে। অথচ, তাঁর ভাইরাল লোড মাত্র সাড়ে উনিশ! করোন হলেও তা মার্জিনাল। শুধু এর জন‍্য সাধারণ মানুষজন কেউই হাসপাতালে ভর্তি হবেন না। অথচ জনসাধারনের মধ‍্যে করোনার বিপুল সংক্রমণ নিয়ে বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির কোন সদর্থক সংবাদ চোখে পড়ে না। অর্থাৎ, আমাদের দেশের গণতন্ত্রে সব মানুষ সমান হলেও কিছু মানুষের অবস্থান বিশেষে তারা উপরে! একই রকমভাবে প্রশাসন, বিচার-ব‍্যবস্থা ও সংবাদ-মাধ‍্যম যদি দেশের সব মানুষের ভালোর জন‍্য ভাবত, তবে হয়ত আজ এমন অবস্থা হত না। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। কোন অনুপ্রেঢ়ণায় প্রশাসন চলে না। প্রশাসনকে যুক্তি সহকারে আইনের পথে চলতে হয়। বিশেষ কারো ego satisfy করা প্রশাসনের সাজে না। কারন তাদের কাজের দায় পুরোটাই প্রশাসনের – কোন রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর নয়। আমাদের সংবিধানের এই জায়গাটা বোধহয় শাসক ও শাসনকর্তারা জানেন না। তেমনি সাধারণ মানুষের, বিশেষতঃ বিভিন্ন ছোট ব‍্যবসায়ী ও অন‍্যান‍্য ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের রুজিরোজগার যাতে সচল থাকে তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু প্রশাসনের। সুতরাং ওমিক্রনের কল্পিত ভূতের ভয় না দেখিয়ে করোনার সংক্রমণ বন্ধ করার জন‍্য জনসাধারণকে কোভিড প্রোটোকল সঠিকভাবে মানতে বাধ‍্য করাতে হবে। এটা প্রশাসনের দায়িত্ব। সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে,রাজ‍্যের অর্থনীতি ও প্রান্তিক মানুষজনের রুজিরোজগার যাতে বন্ধ না হয়। সেকাজে ব‍্যর্থ হলে তা প্রশাসনেরই ব‍্যর্থতা। সেক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত প্রশাসন কিনা তা বিচার্য নয়।

Dakshineswar Temple – Saga of
Hindu Religious Renaissance

Dakshineswar temple is the most revered Kali temple of Bengal. Ma Kali, in her different image and attitude, is the most revered goddess of the country – particularly in eastern part of India, three states namely Bengal, Assam and Tripura. Actualy, Dakshineswar Kali temple is only second to Kamakhya Kali temple in reverence. Kamakhya Kali temple goddess is Tantrik Kali where sacrifice of animal blood is must. Whereas Dakshineswar Kali is known as Ma Bhabatarini – a form of Adyashakti Kali Mata – Ma is standing over Shiva, her consort. Therefore, following our hindu custom, Ma is ashamed of standing on her husband and consequently she being ashamed, opens her mouth and holds her tongue with her teeth. Adyashakti is the primordial energy-consciousness-bliss, she is the creator of the universe and liberates jivia from the clutches of Maya. The amazing fact of the idol is that, the face of Ma Kali is so calm and soothing that it seems to be our mother – own family. There is also a striking difference between Dakshineswar Bhabatarini with Kamakhya and Tripureswari temples – that is, the puja at Dakshineswar is performed with complete vegetarian voga consisting of sweets, fruits and vegetables. But in other two Shaktipeeths the voga must contain animal bloods! Only from 2019, the sacrifice of animals become prohibited at Tripureswari – Ma Kali is a form of Ma Chandi here. There is another peculiarity in Tripureswari temple. There are two idols in the garbha griha – one is of 5 feet height and the other one is of 2 feet only – known as Chhotoma. So, among the three most famous Shakti peeths of three states, Dakshineswar temple stands alone with its idol and style of puja rituals. Ma Bhabatarini is like a lady of our home – so, the Sahajia way of Kali puja, adopted by its legendary chief priest Sri Ramkrishnadev, is different from the style of rituals at the other two Shakti peeths.
Dakshineswar temple was built like navaratna, a typical Bengal style of temple architecture. There is a large roof over the temple with four spires at the four corners of the roof. It is followed by a smaller roof over it where four corners of this roof also have four spires. At the middle of this roof is the biggest spire. The two roofs are in such angles that all nine spires can be seen from any place. Altogether, there are nine spires.
Dakshineswar temple has an interesting history. Rani Rashmoni, an intelligent, philanthropist bengali widow, who was in-charge of his husband’s zamindary, was set to sail to Kashi for Ma Kali’s ‘darshan’ in 1847. But in the night before her scheduled pilgrimage, Rani dreamt of Divine Mother goddess Kali who adviced her not to go to Kashi, instead, Rani should make a temple of Ma Kali at the bank of river ganges and should arrange her worship there. Divine mother also told her in the dream that she will manifest her image in the idol of the temple.
Profoundly influenced by the dream, the spirited lady Rani Rashmoni, who was not only a devoted benevolent zaminder and pious widow, but also a shrewd administrator, immediately started searching the suitable land for the construction of the temple. She bought 20 acres of land at the bank of river ganges from James Hasty, an Englishman. The land resembled the hump of a tortoise. The total temple area is of 60 bighas though,in the record book of the Trustee Board of the temple, it is 54.5 bighas. A portion of the purchased land was an abundoned muslim burial ground. As per records, the total cost of the land was 42 thousand and 500 rupees. According to the record book, some portion of the temple land was donated for the construction of Vivekananda bridge over the river ganges. Accordingly, present temple land is of 58 bighas. The construction of the temple building started in1847 and was completed in 1855. The idol was installed on Snan Yatra day, 31st May, 1855. The main navaratna temple was of 14 square meter area and 30 meter high. The idol was placed in the Garbha Griha (sanctum sanctorium) on a thousand petaled lotus throne made of silver. The idol is south facing. Apart from this main temple, within the temple premises, there are a series of 12 identical Shiva temple in a single line at the river side. Each of these temples are painted white and the black Shiva lingas made of stone are placed inside. All the Shiva temples are east facing and are in ‘aat chala’ architecture – a typical bengal way. The Shiva temples are equally divided by a river bank. At the north-east of the temple premises, there was a Vishnu temple (popularly known as Radha-Krishna temple). 550 mm idol of Krishna and 410 mm idol of Radha were placed on a silver throne in the sanctum sanctorium. It was repaired later and ultimately replaced by the present Devottar estate in 1930.
Dakshineswar temple was opened on the Snan Yatra day of Sri Jagannathji in 1955. The first chief priest of the temple was Ramkumar Chattopadyay and his younger brother Gadadhar as his assistant.
Rani Rashmoni was a spirited patriotic lady. Because of her impartial governance, she annoyed many including the high-ups of East India Company officials. When the inauguration day was approaching, the Brahmin Samaj objected to Rani’s ownership of the temple of goddess Kali! They cited two reasons for objection. First, Rani being widow of low caste Mahishya and married to a further lower caste – dhobi community -, cannot own the temple ; secondly, Rani’s order of opening the temple to people of all castes with equal rights, that is, any hindu can offer puja to the goddess Kali in the temple. Rani with her indomitable energy and indefatigable industry, managed to retrieve the situation to a large extent. The Brahmins relented when Rani made the chief priest from a high caste Brahmin and she declared that she should not have any role in the affairs of the temple. A Trustee Board was made to run the temple administration choosing its members from Brahmin caste. For the maintenance of the temple, Rani donated the earnings from her newly acquired zamindary of Dinajpur (now in Bangladesh) to the temple Trust. Rani completed the registration of the Board of Temple Trust on 18th February,1861 and conspicuously she died on the next day. The head priest Ramkumar Chattopadhyay died about one year after assuming the charge of head priest of the temple. After the death of Ramkumar, Rani Rashmoni had chosen the young Gadadhar – famous in the name Ramkrishna – as head priest. The Brahmins again opposed it strongly. Their main opposition was the way Ramkrishna mingled with and allowed the lower caste people of the society and his way of simplicity in performing the puja. This time, they also tried to destroy the temple property and even attempted do harm, to the extent of physical assault to Ramkrishna. Opposition to the appointment of Ramkrishna was not only from Brahmin Samaj, but also from the family of Rani. At this point of time, with her administrative acumen and outrageous courage, Rani overcame these obstacles and went ahead with the appointment of Ramkrishna Chattopadyay alias Gadadhar as Chief priest of Dakshineswar Bhabatarini temple. In this venture, Rani was ably assisted by one of her sons-in-law Mathurbabu. Afterwards, with his immense help, Rani was able to make the Board of Trustee of the temple registered just before her death.
After the death of Rani Rashmoni, the name of the Bhabatarini temple of Dakshineswar became immensely popular with the people including so called high society of Bengal. The fame and carishma of Bhabatarini and her priest son Ramkrishna became known to not only the people of bengal, but also of whole India. The credit was completely of Gadadhar, now famous in the name Ramkrishna. After some years, Ramkrishna became Kalpataru to his desciples on1st January. From then, he became Sri Ramkrishna Parmhansha (supreme knowledgeable) to his followers. Ramkrishna may not have much formal education, but his way of puja to Bhabatarini and his embracing everyone, without considering caste and social status, made everyone feel oneness with him and at the same time, Ma Kali, in the form of Ma Bhabatarini became mother of everyone’s house. Hindus began to feel that Ma is the protector of everyone. Devoid of hard rituals and tantrik way of puja offerings with fresh blood, Ramkrishnadev made the Sahajia way of puja. He was a philosopher of highest order and he preached the philosophy of equality and offering love and respect to the god from the core of the heart. All his basic principles were preached by his most illustrious desciple Swami Vivekananda. Ramkrishnadev stayed in a small room at a corner of the temple premises with his wife Saradamoni Devi. Saradamoni propagated her husband’s philosophy of love and respect to everyone including animals and trees. It made her known as Ma (mother of all lives). After the death of Saradamoni, their room inside the temple became a place of pilgrimage.
The philosophy of Sri Ramkrishna was propagated by his desciples, the most prominent among them is Narendranath Datta, known as Swami Vivekananda – his post sanyash name. Vivekananda and other desciples of Sri Ramkrishna reffered him as Thakur (god) and Saradamoni as Ma. Actually, the philosophy of love for all, along with treating Ma Bhabatarini as the lady if our own fanily – attracted people’s mind most. This made the Dakshineswar Kali temple most famous shaktipeeth of bengal.
The temple of Ma Bhabatarini of Dakshineswar is still run by the Trustee Board. It has no legal attachment with Ramkrishna Mission of Belur. At present, managing trustee is Sri Kushal Chakraborty. Special puja are offered every year on three special days; the inception day of the temple, that is Snan Yatra day, in the night of amabashya day after Durga puja, and Kalpataru day.

(Author is a retired Professor and former Director & Consultant of West Bengal Biotech Development Corporation)

ভারতীয় চিকিৎসার গৌরব ফিরিয়ে আনা জরুরী

আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হতে আর কয়েকমাস বাকি। এই সুদীর্ঘ সময়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ অনেক বিষয়ে দেশ যেমন উন্নতি করেছে, তেমনই অনেক বিষয়ে অবহেলাজনিত কারনে এবং আরো কয়েকটি অনুঘটকের নিমিত্ত পিছিয়ে পড়েছে। এমনি একটি পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা হল চিকিৎসা ও স্বাস্থ‍্য। একবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের চিকিৎসা মৌলিক অধিকার হওয়া উচিৎ। বিভিন্ন সরকার এবং রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে সেকথা বারংবার উল্লেখ করলেও তা অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হিসেবেই রয়ে গেছে। আমাদের রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্যসাথী প্রকল্পের প্রচার যত, কার্যকারিতা তার শতাংশের একাংশও নয়।
এর কারন হিসেবে কয়েকটি প্রায় অনালোচিত বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমতঃ আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসা ব‍্যবস্থা পাশ্চাত‍্যের থেকে নেওয়া। আর বিভিন্ন ওষুধ হয় বিদেশী লাইসেন্সে এদেশে তৈরী করি অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশীয় সংস্থা তার বিপণন করে। সাম্প্রতিক করোনা ভ‍্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ‍্য। এইসব বিদেশী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার লাভের পরিমাণ সম্পর্কে আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে। যে ওষুধটি বানাতে ১ টাকা খরচ হয়, সেই ওষুধের এমআরপি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। এই ওষুধ কোম্পানীগুলি অসীম শক্তিধর। এদের নেটওয়ার্ক সারা পৃথিবীতে, এমনকি আমাদের দেশেও ছড়িয়ে আছে। এদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত আছে আমেরিকার FDAর। FDAএর ছাড়পত্র না পেলে বিশ্বজুড়ে কোন ওষুধ বিক্রির ক্ষমতা কারো নেই। এমনকি WHO অব্দি FDAকে সমীহ করে চলে। করোনার ভ‍্যাকসিনের ক্ষেত্রেও সব ভ‍্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থাকে FDAর ছাড়পত্র নিতে হয়েছে। এই FDA বিভিন্ন অজুহাতে, কখনো কখনো অযৌক্তিকভাবে তাদের দেশীয় কোম্পানীর অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত পড়তে পারে এমন ওষুধের অনুমোদন দেয় না। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি চিকিৎসার নামে উন্নত দেশগুলির ওষুধ কোম্পানীগুলির শোষণের শিকার। চীন সরকার তাদের দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ও দেশীয় ওষুধগুলিকে মাণ‍্যতা দিয়ে FDAর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছুঁড়ে দিয়েছে। আমাদের বিপুল জনসংখ‍্যার দেশ ভারত যদি সেই পথে শক্ত হাতে রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে এগোয় তাহলে আমাদের দেশেও চিকিৎসা অনেক সুলভ হতে বাধ‍্য।
আমাদের দেশের অনেক মানুষই জানেন না যে, প্রাচীন কাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পযর্ন্ত আমাদের দেশের চিকিৎসা ব‍্যবস্থা পৃথিবীতে সেরা ছিল। সুশ্রুত-সংহিতার রচয়িতা সুশ্রুতকে সারা পৃথিবী সার্জারী – বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারীর জনক হিসেবে মাণ‍্যতা দেয়। মনে রাখতে হবে, সুশ্রুত ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মারা যান। তাঁর লেখা সুশ্রুত-সংহিতার সংকলন নেপালের কাইজার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এটি ১২-১৩ শতাব্দীতে তালপাতার পুঁথিতে সংকলিত। সুশ্রুত-সংহিতায় সার্জারীর যে বিভাগগুলির কথা বলা হয়েছে তা আজও সার্জারীর মূল কথা। তিনি reconstruction ও প্লাস্টিক সার্জারীর কথা লিখতে গিয়ে ৩০০ রকম বিভিন্ন প্রকারের সার্জারীর বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর ১২০ রকম সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের ছবি দেখলে এখনকার ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে অনেক সাযুজ‍্য লক্ষ‍্য করা যায়। তিনি সে যুগে সার্জারী করার সময় অ‍্যানাস্থেশিয়া ব‍্যবহার করতেন – মদ ও ভেষজ henbane ব‍্যবহারের উল্লেখ আছে। তিনি rhinoplasty (কাটা নাক জোড়া দেওয়া), autoplasty (ছেঁড়া কান জোড়া দেওয়া), ছানি অপারেশান ইত‍্যাদি করতেন। কিডনীর পাথর বের করবার শল‍্য চিকিৎসার উল্লেখও তাঁর সুশ্রুত-সংহিতায় পাওয়া যায়। এখনকার আধুনিক শল‍্য চিকিৎসার অনেক কিছুই সুশ্রুত-সংহিতায় পাওয়া যায় – যেমন, রক্তধাতু সঞ্চালন, হৃৎসুলা (heart pain), মধুমেহ ও স্থুলতা, কুষ্ঠ এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত চিকিৎসা।
এরপর আসি পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া চরকের কথায়। চরক কাশ্মীর উপত‍্যকার মানুষ ছিলেন। চরক-সংহিতার রচনাকাল হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর সময়কালকে মাণ‍্যতা দেওয়া হয়েছে। অথচ, খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চরকের চিকিৎসার উল্ল্কেখ পাওয়া যায়। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোন কারন নেই। স্থানীয় ভাষায় ‘চরক’ শব্দের অর্থ হল ‘ভ্রাম‍্যমান চিকিৎসক’। এখানে আরেকটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন – চরক-সংহিতা, যা চরকের রচনা বলে মনে করা হচ্ছে, তার রচনাকাল দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ‍্যে হলেও সেটি একাধিক মানুষের দ্বারা – বিস্তৃত সময়কাল ধরে অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের রচনা হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গ। অভিজ্ঞতার নিরিখে কোন বিষয়কে লিপিবদ্ধ করে বিভিন্ন প্রবুদ্ধজনের জ্ঞানে সম্বৃদ্ধ প্রায় সবকটি প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ। চরক-সংহিতা এর ব‍্যতিক্রম নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় চিকিৎসার গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফসল হল সুশ্রুত-সংহিতা এবং চরক-সংহিতা। যে কারনে বেদের যুগেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ভারতীয় চিকিৎসার পরম্পরাই হল আয়ুর্বেদ।
চরক-সংহিতার মোট ৮টি বইয়ের মধ‍্যে ১২০টি অধ‍্যায় আছে – যার মধ‍্যে শেষ দুটি বই দৃধবলা সংযোজিত। এগুলিতে চিকিৎসা-দর্শন, স্বাস্থ‍্যকর অভ‍্যাসে রোগ প্রতিরোধ থেকে নিয়ে প‍্যাথলজি, অ‍্যানাটমী, এমব্রায়োলজি, থেরাপিউটিক্স, ফার্মাসিউটিক্স ও টক্সিকোলজি যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি চিকিৎসকদের ট্রেণিং, চিকিৎসার এথিক্স ইত‍্যাদি বিষয়ে বিশদে আলোচিত হয়েছে। এই বইগুলি এবং তাদের অধ‍্যায় বিভাজন ও বিন‍্যাস দেখলে বোঝা যায় যে, ভারতীয় আয়ুর্বেদের আধুনিক রূপ হল অ‍্যালোপ‍্যাথি।
তাহলে আজকে আধুনিক চিকিৎসায় অ‍্যালোপ‍্যাথি আদৃত হলেও আয়ুর্বেদ অবহেলিত কেন? এর কারন জানতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে অ‍্যালোপ‍্যাথািক ওষুধের পার্থক‍্য কেন এবং কোথায়। একটি কথা সকলের মনে রাখা দরকার যে, শরীরবিদ‍্যা – physiology ও anatomy আয়ুর্বেদ ও অ‍্যালোপ‍্যাথি দুইয়েই এক ; যেজন‍্য সার্জারীতে সুশ্রুতের ব‍্যবহৃত সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে বর্তমান সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের অনেক মিল পাওয়া যায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে চিকিৎসা বিজ্ঞান একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে নতুন ও উন্নততর উদ্ভাবনী এখানে সতত বহমান। পাথমিকভাবে প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতিতে ওষুধ হিসেবে সবচেয়ে বেশী ব‍্যবহার করা হত বিভিন্ন গাছগাছড়ার মূল ও অন‍্যান‍্য অংশ। এটি শুধু আয়ুর্বেদ নয়, অ‍্যালোপ‍্যাথির ক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য। যেমন, নয়নতারা গাছের মূলকে আয়ুর্বেদে প্রাচীন সময় থেকেই কয়েক প্রকারের ক‍্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হত। এই গাছের মূলে ভিনব্লাস্টিন ও ভিনক্রিস্টিন নামের দই প্রকারের অ‍্যালকালয়েড থাকে যারা এখন অ‍্যালোপ‍্যাথিতে ক‍্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয়। আধুনিক অ‍্যালোপ‍্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিশেষ যৌগগুলিকে পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ করা হয়েছে। এমনকি এই যৌগগুলি কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ একটি অবশ‍্য পালনীয় কর্তব‍্য। কারন, এই গাছের মূলে উল্লেখিত যৌগগুলি ছাড়াও এমন অনেক যৌগ থাকে যেগুলি ক‍্যান্সার সারানোর পরিবর্তে তার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় – যেমন ভিন্ডোলিন জাতীয় যৌগ। এই যৌগটিও নয়নতারা গাছের মূলে থাকায় পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ ওষুধ প্রস্তুত করার একটি অতি প্রয়োজনীয় পর্যায়। উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে আয়ুর্বেদকে হেয় করার জন‍্য আয়ুর্বেদীয় ওষুধের ক্ষেত্রে আধুনিক পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ পদ্ধতির অভাবের জন‍্য এই চিকিৎসা পদ্ধতিকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। আয়ুর্বেদ একটি উদ্দেশ‍্যমূলক অপপ্রচারের শিকার। আয়ুর্বেদ এই পদ্ধতি স্বীকার করে – কারন আয়ুর্বেদেও টক্সিকোলজির বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এই নয়নতারা গাছই যেমন বিষাক্ত। সেজন‍্য সমস্ত আয়ুর্বেদ ওষুধই যথার্থ শোধন করা হয় – প্রাচীন শোধন প্রক্রিয়াই আধুনিক পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ। কারন, প্রাচীন আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুতিতে বর্তমান অ‍্যালোপ‍্যাথির ফাইটোমেডিসিন তৈরীর জন‍্য ব‍্যবহৃত সক্সলেট, রিটর্ট ও ক্রোমাটোগ্রাফীর বিভিন্ন ছবি প্রাচীন আয়ুর্বেদের বইগুলিতে পাওয়া যায়। সুতরাং, প্রাচীনকালের ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার স্বাভাবিক ও সময়োপযোগী রূপান্তরই হল বর্তমানের অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসা।
আয়ুর্বেদের বর্তমান অবহেলার কারন খুঁজতে গেলে দেখা যায় তা চিকিৎসাবিজ্ঞানজনিত নয় – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারনে। ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার সুনাম দ্বাদশ শতাব্দী অবধি অক্ষুন্ন ছিল। বহির্বিশ্বের যবন আক্রমণের সময় থেকেই ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পের যে দ্রুত অবক্ষয় শুরু হল, তার ঢেউ এসে লাগল চিকিৎসায়। নতুন যবন শাসকদল দেশের মানুষের চিকিৎসার ব‍্যপারে উদাসীন ত ছিলই, পরন্তু তারা আয়ুর্বেদ নয়, ইউনানী চিকিৎসার উপর নির্ভর করত। এই সময় চিকিৎসা সম্পর্কিত বহু পুঁথি ও নথিপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা ভারতের শাসনভার নেওয়ার পরে ভারতীয় এই চিকিৎসাবিদ‍্যাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেনি। কিছু ক্ষেত্রে এর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিজেদের চিকিৎসাশাস্ত্রে (যা এখন অ‍্যালোপ‍্যাথি নামে পরিচিত) ব‍্যবহার করেছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার একটি অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ‍্যায় ‘শোধন’ এইভাবে রাজনৈতিক কারনে হারিয়ে যায়। তারপর, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিদেশে – বিশেষতঃ জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপে (সুশ্রুত-সংহিতা আরবী ও ল‍্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল) এই দুটি সংহিতা নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং তার বিস্ময়কর ফল জানার পর ভারত সরকার নড়েচড়ে বসে। কিন্তু এনিয়ে বেশীদূর এগোনো যায়নি। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, বিশ্বের সবচেয়ে বেশী টাকার বাণিজ‍্য করে ওষুধ শিল্প – যার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি উন্নত দেশ। এখানে যদি আয়ুর্বেদশাস্ত্র সম্মত ওষুধ তৈরী ও আধুনিক উপায়ে তার শোধন প্রক্রিয়ার পর আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে এই ওষুধের এফিকেসি পরীক্ষার পর তাকে বাজারে বিক্রির ছাড়পত্র দেওয়া হয় তবে তুলনামূলকভাবে বহুগুণ বেশী দামে বিক্রিত এই আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানীগুলির ওষুধ আর বিক্রিহবেনা – ভারতসহ সারা পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হলেও ঐ ওষুধ কোম্পানীগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সেজন‍্য আমেরিকার FDA আর সেইসঙ্গে WHO ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধকে মাণ‍্যতা দেয়না। অথচ ঐ একই পদার্থ যখন ল‍্যাবোরেটরীতে কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত করে এই ওষুধ কোম্পানীগুলি বাজারে বিক্রি করছে,তার ক্ষেত্রে দ্রুত ছাড়পত্র মিলছে!
এখানে ভারত সরকারের ভূমিকা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও জাপান সরকার তাদের দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরী ওষুধের স্বীকৃতির জন‍্য অনেক লড়াই করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু ভারতের উচ্চমানের স্বীকৃত চিকিৎসাশাস্ত্রের ওষুধ যাতে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায় তার জন‍্য গবেষণার infrastructure গঠন ও তার আধুনিক রূপ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। FDA যাতে ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় ওষুধ, যা অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের চেয়ে উৎকৃষ্ট বা সমমানের – সেইসব কমমূল‍্যের ওষুধকে স্বীকৃতি দেয়, তার জন‍্য সব রকম কুটনৈতিক চাপ দেওয়া প্রয়োজন। দেশ এই কাজে সফল হলে চিকিৎসার খরচ কমবে তাই নয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসায় ভারত আবার বিশ্ব-শ্রেষ্ঠত্বের আসনের দাবীদার হবে।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ জৈবপ্রযুক্তি নিগমের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)।

আয়ুর্বেদশাস্ত্রের উত্তরসূরি অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসা

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা যেমন পৃথিবীর কাছে আমাদের দেশকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে মেলে ধরেছি, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পকলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছি। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষতা প্রাচীন যুগে এতটাই লক্ষণীয় ছিল যে, প্লিনী অনুযোগ করেন – আর্যাবর্ত দেশ তাদের কাছে বড়লোক, রাজারাজরাদের ব‍্যবহারের জন‍্য মূল‍্যবান ও বহু দুর্মূল‍্য সামগ্রী রপ্তানীর মাধ‍্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করছে! আমরা গুপ্তযুগে নির্মিত যে বিশাল লৌহ মিনারটিকে বানিয়েছিলাম – যেটি কুতুব মিনারের বাগানে ফেলে রাখা আছে – প্রায় দেড়হাজার বছর আগের তৈরী হলেও তাতে একটুও মরচে ধরেনি! ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ঢালাই কারখানাগুলি একশ বছর আগেও এমন মিনার বানানোর কথা কল্পনা করতে পারত না। আমাদের দেশের মসলিন কাপড় বানানোর শিল্পকে ইংরেজ বণিকের দল পশুসুলভ হিংস্রতায় ধ্বংস করেছে। আবার আমাদের নতুনভাবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
আমরা অনেকেই বলে থাকি, ইউরোপ, আমেরিকা চিকিৎসাবিদ‍্যায়, বিশেষতঃ অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসায় অনেক উন্নত – আমাদের আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র তাদের থেকেই শেখা! এমন একটি myth ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। কিছু ডিগ্রিধারী মূর্খ আমাদের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি – আয়ুর্বেদ সম্পর্কে না জেনে উন্নাসিকতা দেখাতে গিয়ে এমন ধারনা ব‍্যক্ত করেন। আমরা যখন কোলকাতার ট্রপিক‍্যাল মেডিসিনে ক্লাস করতাম, তখন রিজেনারেটিভ মেডিসিনের একজন প্রফেসার ক্লাসে প্রায়শঃ বলতেন, আধুনিক অ‍্যালোপ‍্যাথি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মধ‍্যে প্রভূত মিল আছে। তিনি আরো বলতেন, সার্জারী এবং অ‍্যনাটমীর ক্ষেত্রে দুটোই এক। তিনি অবশ‍্য ইউনানী ও হোমিওপ্যাথিকে বিদ্রুপ করতেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিভাবে আমাদের দেশে উৎকর্ষতা লাভ করে এবং আয়ুর্বেদ থেকেই অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসার উৎপত্তি হল বলছি কেন তার বিস্তারিত আলোচনায়। ভারতীয় সভ‍্যতার আদি জ্ঞানভান্ডার হল বেদ। ঋগ্বেদ থেকে আমরা প্রথম জানতে পারি চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা ধন‍্যন্তরীর কথা। অথর্ববেদে সার্জারীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। Xenotransplantation (পশুর অঙ্গ মানুষের দেহে সংস্থাপন) এর প্রয়োগ করেছিলেন স্বয়ং ধন‍্যন্তরী অর্থাৎ বিষ্ণু (ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী)। ভগবান গণপতি এই প্রতিস্থাপনের প্রথম সফল প্রয়োগ।
অর্ধশিক্ষিত মূর্খরা যুক্তিজাল বিস্তার করে বলতেই পারেন – এসব ইতিহাসের প্রামাণ‍্য তথ‍্য নয়। তাদের বলি, পৃথিবীর ইতিহাস শুরু হয়েছে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম বা মহম্মদের মদিনা যাত্রার সময় থেকে কি! ইতিহাস পৃথিবীর জন্মের পর মূহুর্ত থেকে শুরু। কোন উদ্দেশ‍্য প্রণোদিত ইতিহাস কিন্তু ইতিহাস নয়, প্রচারের হ‍্যান্ডবিল। যাদের এসব স্বীকার করতে বাধা আছে তাদের বলি, আধুনিক বিশ্ব পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাকে তিনি হলেন চরক – তাঁকেই আয়ুর্বেদের জনক বলা হয়েছে। তিনি কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘চরক সংহিতা’ চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। চরক সংহিতা প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ‍্যে রচিত। এতে মোট আটটি বই মিলিয়ে ১২০টি অধ‍্যায় আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে চরক সংহিতা কোন একজন মানুষের রচনা নয় – শতাব্দীর পর শতাব্দীব‍্যাপী চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির ফসল। বইগুলির বিষয়ে আরো বিশদে আলোচনা করলে বোঝা যাবে, প্রাচীন আয়ুর্বেদের সঙ্গে বর্তমান অ‍্যালোপ‍্যাথির তত্ত্বের তফাৎ বিশেষ নেই।
এবার বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রাথমিকভাবে দুটি বিভাগ – মেডিসিন ও সার্জারী বা শল‍্য চিকিৎসা। আমরা একাধিক বেদে সার্জারীর উল্লেখ পাই। এই সার্জারীর, বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারীর জনক হিসেবে বিশ্বে যিনি পরিচিত, তিনিও একজন ভারতীয় – সুশ্রুত। প্রামান‍্য নথি থেকে ধারনা করা যায় যে, সুশ্রুতের মৃত‍্যু হয় ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। সুশ্রুতের সুশ্রুত সংহিতায় মোট ১৮৬টি অধ‍্যায় আছে। যেখানে ১১২০ রকমের অসুখ এবং ৭০০ রকমের মেডিক্যাল প্ল‍্যান্ট, ৬৪ রকমের আকরিক উৎসের ও ৫৭ রকমের প্রাণী উৎসজাত ওসুধ তৈরীর বিবরণ বর্নণা করা হয়েছে। তাঁর বইটি মেডিসিন ও সার্জারীর শিক্ষার জন‍্য অত‍্যন্ত মূল‍্যবান। সুশ্রুত সংহিতায় সার্জারীকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হল – ছেদ‍্য (excision), লেখ‍্য (sacrification), ভেদ‍্য (puncture), এস‍্য (exploration), আহর্য (extraction), স্বরায‍্য (evacuation), এবং সিব‍্য (suturing)। শুধু ৬০ রকমের ঘা সারানোর উপকর্মের কথা লিখেছেন। এমনকি তিনি reconstruction ও প্লাস্টিক সার্জারীর কথাও বিশদে লিখেছেন। ৩০০ রকমের বিভিন্ন সার্জারীর কথা তিনি লিখেছেন। ১২০ রকমের সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের কথাও তাঁর বইতে পাওয়া যায়। সুশ্রুত সুষ্ঠুভাবে সার্জারীর জন‍্য অ‍্যনাস্থেসিয়া – মদ, henbane (cannabis indica) প্রয়োগের উল্লেখ করেছেন। তিনি কর্তিত নাকের রোগীয নাকের সার্জারী (rhinoplasty) করতেন। এছাড়া ছেঁড়া কান জোড়া দেওয়া (autoplasty) ও ছানি অপারেশান করতেন। এজন‍্যই তাঁকে প্লাস্টিক সার্জারীর জনক আখ‍্যা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়, সুশ্রুত সংহিতার সংকলন নেপালের কাইজার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এটি ১২-১৩ শতাব্দীতে তালপাতার পুঁথিতে লেখা। এখনকার যে চিকিৎসাগুলি আমরা বিদেশ থেকে ধার করি, সেগুলি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ও শল‍্যচিকিৎসার কথা সুশ্রুত লিখে গেছেন। এর মধ‍্যে আছে রক্তধাতু সঞ্চালন, রসধাতু (lymph), হৃৎসুলা (heart pain), মধুমেহ, স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগের চিকিৎসা। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার কথাও সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত আছে। কিডনীর পাথর বের করার শল‍্য চিকিৎসার কথাও এখানে বলা আছে।
যদিও খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চরকের চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা নিয়ে বিভ্রান্তির কোন কারন নেই। প্রথমতঃ, চরক শব্দের অর্থ ‘ভ্রাম‍্যমান চিকিৎসক’। এখানে আরেকটি কথাও অত‍্যন্ত যুক্তিযুক্ত – চরক সংহিতার প্রকাশকাল দ্বিতীয় শতাব্দীতে হলেও তা একাধিক মানুষদ্বারা গ্রন্থিত। এই ধারা হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন হিন্দু-চিকিৎসাবিদ‍্যা, যা আয়ুর্বেদ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত, তা কোন একজন মানুষের রচনা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গবেষণা ও চিকিৎসাবিদ‍্যার গ্রন্থিত সংকলন। নিঃসন্দেহে এবিষয়ে প্রথম প্রামাণ‍্য রচনা চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। সে কারনেই বেদেও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সুশ্রুতের মৃত‍্যু হয়, পরবর্তীকালে আরো অনেকে সুশ্রুত সংহিতায় অধ‍্যায় সংযোজন করেন। তেমনি আত্রেয় ঋষির তত্ত্বাবধানে অগ্নিবেশ অষ্টম খৃষ্টপূর্বাব্দে অগ্নিবেশ সংহিতা রচনা করেন – যার পূর্ণাঙ্গরূপ দেন চরক। জন্ম হয় চরক সংহিতার। চরক সংহিতায় মোট আটটি বই – ১২০টি অধ‍্যায়। এরমধ‍্যে শেষ দুটি বই – কল্পস্থান ও সিদ্ধিস্থান এবং সর্বমোট ১৭টি অধ‍্যায় দৃধবলা সংযোজন করেন।
চরক সংহিতার বইগুলি ও তার অধ‍্যায়ের কথা জানলে সবাই বুঝতে পারবেন, আমাদের আয়ুর্বেদ আধুনিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছে অ‍্যালোপ‍্যাথিতে। চরক সংহিতার বইগুলি হল –
১) সূত্রস্থান (৩০টি অধ‍্যায়) – আলোচ‍্য বিষয় সাধারণ নীতি, চিকিৎসা দর্শন, স্বাস্থ‍্যকর জীবনযাত্রায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
২) নিদানস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – প‍্যাথোলজি, রোগের কারণ।
৩) বিমনাস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – রোগ নির্দিষ্টকরণ, চিকিৎসকদের ট্রেণিং, নীতিশাস্ত্র (ethics), পথ‍্য ও ওষুধের স্বাদ।
৪) শরীরস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – শরীরবিদ‍্যা (anatomy), এমব্রায়োলজি।
৫) ইন্দ্রিয়স্থান (১২টি অধ‍্যায়) – সংবেদনশীল অঙ্গজনিত পূর্বাভাস – বিশেষতঃ রোগীর সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার মাধ‍্যমে সণাক্তকরণ।
৬) চিকিৎসাস্থান (৩০টি অধ‍্যায়) – থেরাপিউটিকস্, রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ।
৭) কল্পস্থান (১২টি অধ‍্যায়) – ওষুধ প্রকরণ বিষয় (pharmaceutics) ও বিষবিদ‍্যা (toxicology)।
৮) সিদ্ধিস্থান (১২টি অধ‍্যায়) – চিকিৎসার উৎকর্ষতা,আরোগ‍্যের লক্ষণ, স্বাস্থ‍্যবিধি সম্মত সুস্থ‍্য জীবনযাত্রা।
এই দুটি সংহিতা বিশদে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা, যাদের অধিকাংশ ইউরোপ, আমেরিকার, অবাক বিস্ময়ে আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিকধারার প্রাচীন ভারতের এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে বর্তমানের অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের মিল-অমিল বিষয়ে। এ ব‍্যপারে প্রথমেই বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে আয়ুর্বেদিক ওষুধের উপকারীতা আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান অস্বীকার করে না। অল্প কিছু উদাহরণে ব‍্যপারটা পরিষ্কার হবে। অশ্বগন্ধার (withania somnifera) মূল-এ ক্লান্তি, বেশ কিছু চর্মরোগ, মধুমেহ, গেঁটে বাত (rheumatic arthritis) এবং বেশ কিছু পেটের রোগসহ কয়েকপ্রকারের ক‍্যান্সারের উপশম হয়। সর্পগন্ধা (raulfia serpentina) উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্তে রাখে। নয়নতারা (canthranthus roseus) এখনো ক‍্যান্সারের চিকিৎসায় সারা বিশ্বে ব‍্যবহার করা হয়। এতে ভিনব্লাস্টিন ও ভিনক্রিস্টিন অ‍্যালকালয়েড পাওয়া যায় – এই দুটি অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহৃত হচ্ছে। আবার নয়নতারা গাছের মূলসহ সমস্ত গাছেরই বিষক্রিয়া আছে। অশোধিত মূলে এমন অ‍্যালকালয়েড পাওয়া যায়, যেমন ভিনডোলিন, যা ক‍্যান্সার কোষের বৃদ্ধির সহায়ক। প্রায় সব আয়ুর্বেদিক ওষুধের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ‍্য। সে কারনে গাছের কোন অংশকে সরাসরি ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয় না। আয়ুর্বেদে তার জন‍্য উপযুক্ত ‘শোধন’ এর নিদান দেওয়া আছে। তাকে আধুনিক চিকিৎসার পরিভাষায় isolation and purification বলে। এখানেই যত গোলমালের সুযোগ। এই শোধনক্রিয়ার কথা কিন্তু কোথাও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা নেই। এর একমাত্র কারণ, ইচ্ছাকৃতভাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ওষুধের বিলুপ্তি ঘটানোর চেষ্টা। আমরা যেসব ওষুধ প্রস্তুতির প্রাচীন ছবি দেখি সেখানে রিটর্ট ও সক্সলেট জাতীয় যন্ত্রপাতি, যা আধুনিক সময়ে ওষুধের isolation and purification এ ব‍্যবহার করা হয়, সেসবের উপস্থিতির প্রমাণ পাই। সুতরাং এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে এসবের সাহায‍্যে এবং ক্রোমাটোগ্রাফির বিভিন্ন পদ্ধতি ব‍্যবহার করে ওষুধের শোধন করা হত। এতে প্রমাণ হয় যে, প্রাচীনকালে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি আজকের তথাকথিত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের উৎকর্ষতায় মোটেও পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু এত উন্নত ও সফল চিকিৎসা পদ্ধতি তার শ্রেষ্ঠত্ব হারালো কেন!
এর যথাযথ উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে। ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা, যা তখন একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ছিল, তার সুনাম দ্বাদশ শতাব্দী পযর্ন্ত অমলিন ছিল। কিন্তু তারপর, যবন আক্রমণের সময় থেকে এদেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প সম্বৃদ্ধির অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। যবন আগ্রাসনের সময় থেকে তাদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক প্রভাব চিকিৎসাবিদ‍্যার উপরেও আঘাত হানল। নতুন যবন শাসককুল আয়ুর্বেদের পৃষ্ঠপোষকতা দুরস্ত, তার ধ্বংসসাধনে ব্রতী হল। তারা আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বদলে ইউনানি চিকিৎসায় বিশ্বাস করত। তারা নিজেদের কথাই ভাবত। দেশের মানুষের স্বাস্থ‍্য সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনার কথা জানা যায়না। এই সময় বিস্তর দুর্মূল‍্য পুঁথি ও নথি নষ্ট করে ফেলা হয়। আমার মনে হয়, ঐ সময়ই আয়ুর্বেদ চিকিৎসার নথি – বিশেষতঃ শোধনক্রিয়ার বিভিন্ন কলাকৌশল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর ইরেজ বণিকের দল দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদেরও দেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার কোন চেষ্টা ছিলনা। তার কারণ তাদের উন্নাসিকতা। তারা তাদের শিক্ষা থেকে চিকিৎসা – সব ক্ষেত্রেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকত।
দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং তারপরে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আয়ুর্বেদশাস্ত্র নিয়ে বিদেশে চর্চা শুরু হলে তখন আমাদের দেশের সরকারের টনক নড়ে। আবার সেখানেও গন্ডগোল। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টাকার বাণিজ্য করে ওষুধ-শিল্প। সুতরাং নথির ভিত্তিতে আয়ুর্বেদকে মান‍্যতা দিতে বাধ‍্য হলেও পাশ্চাত‍্য-দুনিয়া তার ওষুধ শিল্পকে মান‍্যতা দেয়না। তাদের অস্ত্র হল ঐ isolation and purification অর্থাৎ শোধন। আয়ুর্বেদ ওষুধের এই অপূর্ণতাকে আশ্রয় করেই পাশ্চাত‍্যের ওষুধশিল্প তাদের লাভের ব‍্যবসায় আয়ুর্বেদকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছেনা। এ ব‍্যপারে অগ্রণী হল ওষুধ শিল্পের আন্তর্জাতিক কন্ট্রোলার আমেরিকার FDA. এই FDAর বিরুদ্ধে একাধিকবার সফল লড়াইয়ের ইতিহাস আছে একমাত্র জাপানের। সেজন‍্য FDA শুধু তাদেরকেই সমীহ করে।
এখন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে যথাযথ নজর দেওয়া আয়ুর্বেদ রিসার্চ ও শোধনে সাম্প্রতিকতম পদ্ধতি অবলম্বন করা, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে drug efficacy পরীক্ষা করা এবং তার অনুমোদন ও বাজারে আনা – এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক ডাক্তারীশাস্ত্রে এই আয়ুর্বেদীয় ওষুধের সংযোজন এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর গুণাগুণ পরীক্ষা করে তা যে অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের সমতুল বা উৎকৃষ্টতর তার প্রমাণ রাখার জন‍্য যথার্থ পরীক্ষা নিরীক্ষার ব‍্যবস্থা করার প্রয়োজন। তারপর কুটনৈতিকভাবে সরকারকে FDAর উপর চাপ তৈরী করতে হবে এই ভারতীয় পেটেন্টের আয়ুর্বেদীয় ওষুধকে স্বীকৃতি প্রদানের জন‍্য। আর হ‍্যাঁ, সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিদেশের দালাল ও অর্ধশিক্ষিত ‘বিশেষজ্ঞ’দের থেকে দূরে থেকে এই মিশনকে সাফল‍্যমন্ডিত করতে হবে। দেশ এ কাজে সফল হলে বিশ্বের দরবারে ভারত আবার চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে “শ্রেষ্ঠ আসন লবে”।

                                     ( লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ‍্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গ জৈবপ্রযুক্তি উন্নয়ণ নিগমের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)

ভারতীয় গণতন্ত্র সোনার পাথরবাটি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ এমন একটি কথা যার অসংখ‍্য সংজ্ঞার মধ‍্যে কোন বিশেষ একটি সর্বজনগ্রাহ‍্য সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। এ যুগের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী শোনা যায় ‘গণতন্ত্র’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এই দুটি কথা। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে আগে একাধিক লেখায় আলোচনা করেছি যে, কোরান ও বাইবেল মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতা মোটেই ভালোকথা নয়। কোন ধর্মপ্রান মুসলমান বা খ্রীষ্টান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে প্রায় সমস্ত ইসলামী ও খ্রীষ্টান রাজনীতিক নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেন এবং তা প্রমাণ করার জন‍্য প্রণান্তকর প্রচেষ্টা চালান। এখানেই আমাদের রাজ‍্যের তথা দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট‍্য! ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের ট্রেণিংয়ের গোড়ার কথা – “যা ভাববে তা বলবেনা, যা বলবে তা করবেনা, যা করবে তা বলবেনা আর কাউকে কোন অবস্থায় না বলবেনা” – এটি জানিনা ফরেন সার্ভিসে কতটা প্রযোজ‍্য, তবে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে শতকরা একশ ভাগ প্রযোজ‍্য।
ভারতীয় গণতন্ত্র তার সংবিধান অনুসারে চলার কথা। আবার আমাদের সংবিধানের অবস্থা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাউলদের পোষাকের মত – তালিতাপ্পার মহিমায় আহল পোষাকের রূপ ও গুণের কিছুই আর বোঝা যায় না। তেমনি সংশোধনের পর সংশোধনে আমাদের সংবিধানের আসল চেহারাটাই হারিয়ে গেছে। তবু সব রাজনৈতিক নেতাই এদেশের গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করে। এমনকি সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশীয় কম‍্যুনিষ্টরা পর্যন্ত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছে! অবশ‍্য এ বিষয়ে তাদের অনেকের ‘আদর্শগত পিতা’ চীনের একনায়ক জি জিনপিংও সম্প্রতি চীনকে জনগণের গণতন্ত্রের (people’s democracy) দেশ বলেছেন। এখন এই গণতন্ত্রের রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজতন্ত্র থেকে পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র থেকে পলিটব‍্যুরোর কন্ট্রোলে থাকা রাষ্ট্র – এমনকি জেহাদী তালিবানরাও তাদের নিজেদেরকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবী করছে!
এবার এসবের কারন বিশ্লেষণ করা যাক। গণতন্ত্রের বিদ্রুপাত্মক সংজ্ঞা ছাড়া আর যত রকম সংজ্ঞা আছে, তার সবকটিতেই শাসন ক্ষমতায় মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলা আছে। যেহেতু একটি দেশের সকল মানুষের পক্ষে দেশের শাসনব‍্যবস্থায় সরাসরি অংশ নেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তারা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন এবং সেই প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে সরাসরি দেশের শাসনব‍্যবস্থায় অংশ নেবেন। এখানেই লুকিয়ে আছে অশান্তি, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী স্বার্থে ‘ভোটদান’ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করার বীজ। এভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন চালানোই এখন আধুনিক গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রে পরিষ্কারভাবে minority representation এর কথা বলা থাকলেও আমাদের দেশে তার কোন প্রয়োগ নেই – সব মানুষের
পছন্দকে মাণ‍্যতা দেওয়ার পদ্ধতি গণতন্ত্রের অঙ্গ। কিন্তু আমাদের দেশে ভোটের ময়দানে কেউ ৫০.১% ভোট পেলেই বিজয়ী হয়; অন‍্য কেউ ৪৯.৯% ভোট পেলেও পরাজিত। আবার ভোটে অনেক প্রার্থী থাকলে কেউ ২০ – ৩০% মাত্র ভোট পেলেও বিজয়ী হতে পারে। ফলে, দেশের মানুষের ভোটের সঠিক ও গণতান্ত্রিক মূল‍্যায়ণ হয় না। এর ফলশ্রুতিতে আমরা ভোট জালিয়াতির বিভিন্ন পদ্ধতি দেখি এবং জনগণের ইচ্ছার সঠিক মূল‍্যায়নকে কায়েমী স্বার্থে পরিবর্তিত হতে দেখি। একাজের জন‍্য রাজনৈতিক দলগুলিতে আলাদা মেশিনারী তৈরী হয়েছে। corruption begets corruption। আর কম‍্যুনিষ্টরা ‘ভোটযুদ্ধ’ জেতার জন‍্য তাদের মেশিনারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ময়দানে নামিয়ে দেয়!
প্রথম দফার ভোট জালিয়াতি শুরু – ভোটার লিস্টে নাম বাদ দেওয়া ও নাম তোলায়। আমাদের দেশে মানুষের পরিচয়পত্র, এমনকি ব‍্যঙ্ক ও অন‍্যান‍্য অনেক ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিযুক্ত আধার কার্ড একমাত্র প্রামাণ‍্য পরিচয়পত্র হলেও ভোটদানের ক্ষেত্রে ভোটার কার্ড হলেই চলবে! এই কার্ডের সঙ্গে বায়োমেট্রি না থাকায় যে কেউ এই কার্ড বানিয়ে ( নকল মানুষের আসল ভোটার কার্ড হতেই পারে) ভোট দিতে পারে। বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রেও এভাবে ভোটার হওয়ার সুযোগ থাকে। এমনকি আমাদের দেশের মানুষেরও একাধিক ঠিকানায় একাধিক ভোটার কার্ড থাকতে পারে। এছাড়া অনেক আসল ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয় মৃত বা লেফ্ট দেখিয়ে। এক্ষেত্রে ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারী প্রশাসনকে শাসকদল কাজে লাগায়। এর পরের পর্যায়ে ভোটের দিনের প্রাক্কালে সন্দেহজনক ভোটার যে শাসকের পক্ষে ভোট দেবেনা এমন মানুষদের উপর বিভিন্ন উপায়ে চাপ সৃষ্টি ও ভয় দেখানো শুরু হয়। একাজে শুধু রাজনৈতিক দলের ভোট মেশিনারীই নয়, বড় ভূমিকাসহ সহযোগীতা থাকে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারী প্রশাসন এভাবে কেন দলীয় স্বার্থে নিজেদের ব‍্যবহৃত হতে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনকার রাজনৈতিক সিস্টেমের দিকে তাকাতে হবে।
সেই সিস্টেম সম্পর্কে অল্প কথায় বলা যাক। এটি হল এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীতে এবং ভারতের বি‍ভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আদৃত ‘পপুলিজম থিওরী’। এই তত্ত্ব অনুসরণ করে একাধিক রাজনৈতিক দল ভারতের রাজ‍্যে রাজ‍্যে ক্ষমতা দখল করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লী। মানুষ যা চায় তার সব, এমনকি তার চেয়ে আরো বেশী পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথমে ক্ষমতায় এসো। তারপর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে একেএকে ধ্বংস কর। এর জন‍্য যাদের সাহায‍্য প্রয়োজন যেমন, সংবাদমাধ্যম ও প্রশাসন, বিশেষতঃ পুলিশ প্রশাসন – তাদের ‘পুরষ্কার ও তিরস্কার’ নীতির প্রয়োগে উপঢৌকন ও পদাঘাত করে নিজের দলের তাঁবে করে ফেল। ভারতকে যদিও গণতান্ত্রিক দেশ হলা হয়, এখানে মানুষ রাজারাজড়া ও অভিজাতশ্রেণীর প্রজা হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। তাদের পছন্দ benevolent dictatorship। দেশের রাজন‍্যবর্গের থেকে দেশটাকে ধীরে ধীরে ইংরেজরা ছিনিয়ে নিলেও তারা এদেশের মানুষদের ভালোই চিনেছিল। সে কারনে দেশের বহু জায়গায় তারা রাজন‍্যবর্গের প্রতীকী শাসন বজায় রেখেছিল। ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেঁধেছিল এক অনন‍্যসাধারণ ব‍্যক্তিত্বকে অতিমানবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দেশের সুপ্রিম নেতৃত্বে বসিয়ে। হ‍্যাঁ, গান্ধীজীর কথাই বলছি। তিনি কংগ্রেস দলের কোন পদাধিকারী না হয়েও এবং আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেও ছিলেন সর্বোচ্চ নেতা! একেই সুচতুরভাবে ব‍্যবহার করে জওহরলাল নেহরু দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তাঁর পারিবারিক শাসনব‍্যবস্থার বীজ রোপন করেন – যা পরবর্তীকালে মহীরুহ হয়ে কংগ্রেস নামক দলটাই তাঁর উত্তরপুরুষদের ব‍্যক্তিগত মালিকানায় চলে গেল। এর জন‍্য সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে (জওহরলাল কন‍্যা ইন্দিরা গান্ধী) অতিমানবের স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রশাসনিক ও সংবাদমাধ্যমগুলির সহযোগীতায় আলাদা মাত্রা পেল। এর সঙ্গে প্রয়োগ শুরু হল পপুলিজম তত্ত্বের। জনগণের গণতন্ত্র সম্বন্ধে নূন‍্যতম জ্ঞান নেইধরে নিয়ে তাদের গণতন্ত্রের নামে খুশী রাখার জন‍্য অর্থ, খাদ‍্য ইত‍্যাদির সঙ্গে আমোদপ্রমোদের জোগান দেওয়া শুরু হল। জনপ্রিয় শ্লোগান ‘গরীবি হটাও’ দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কাজ এগিয়ে গেল।
এই নীতি যেসব দেশ গ্রহন করেছে তারা ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে। স্বল্প পরিসরে ভেনেজুয়েলার উদাহরণ আদর্শ হতে পারে। এক সময় প্রাকৃতিক সম্পদে সম্বৃদ্ধ এই দেশ দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালে কম‍্যুনিষ্ট নেতা হুগো স‍্যাভেজ ভেনেজুয়েলার শাসনভার দখল করে দেশের মানুষকে ভর্তুকিযুক্ত খাবার ও অন‍্যান‍্য নিত‍্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিষ দিয়ে জনগণের মনে পপুলিজম তত্ত্বের উপর বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করলেন। এরজন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারী অর্থভান্ডার থেকে দেওয়ায় আর্থিক ঘাটতি বেড়ে গল। যার ফলে দেশের উন্নয়ণ ও বিকাশের কাজ ব‍্যহত হতে শুরু করল। ষ‍্যাভেজের মৃত‍্যুর পর ২০১৩ সালে তাঁর শিষ‍্য নিকোলাস মাদুরো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ফ্রি করে দিলেন। ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ত বটেই, এমনকি সব রকম উন্নয়ণ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, উৎপাদন শিল্প – সব বন্ধ হয়ে গেল। দেশের আমদানীর পরিমাণ রেকর্ড বৃদ্ধি পেল।ফলে সরকারের রোজগার দ্রুত কমতে লাখল। এক সময় এমন অবস্থা হল যে ভর্তুকিতেও মানুষের নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার ক্ষমতা রইল না। দেশের আশি শতাংশ মানুষ দরিদ্রতম বলে চিহ্নিত হল। কর্মসংস্থান বন্ধ হল। দেশে অতি উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটল। জনগণের বিক্ষোভ শুরু হল। সেই বিক্ষোভ দমনে গুলি চালানো, মৃত‍্যু – সব ঘটল। এমতাবস্থায় ২০১৯ সালে জুয়ান গুয়ায়িদো সংযুক্ত বিরোধীদের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করলেন! এখানে উল্লেখ‍্য যে ২০¹৮ সালে সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন‍্য মাদুরো সব রকমের পকৌশল ও দূর্ণীতির আশ্রয় নেওয়ায় বিরোধীরা সেই নির্বাচন অবৈধ বলে। পাশ্চাত‍্য দুনিয়া এবং পৃথিবীর বহু গণতান্ত্রিক দেশ তাদের সমর্থন করে। এবং পরবর্তীতে তারা গুয়ায়িদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাণ‍্যতা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর সাহায‍্য নিয়ে মাদুরো দেশের মধ‍্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। এভাবে এক দেশে দুই প্রেসিডেন্ট! মাদুরো এই বিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ‍্যে যুক্তিহীন ও অনৈতিকভাবে দেশের সেনাবাহিনীর বেতন ও সুখসুবিধা বাড়িয়ে চলেছেন।
এই উদাহরণ দেওয়া উদ্দেশ‍্য হল, আমাদের দেশে বেশকিছু রাজ‍্যের মানুষকে এই রকম পপুলিজম তত্ত্ব মোতাবেক অনুদান দেওয়ার প্রভূত প্রকল্প দেখতে পাই। দুয়ের সমন্নয় লক্ষ‍্যণীয়। পশ্চিমবঙ্গে মাদুরো নীতির প্রয়োগ চলছে বললে অত‍্যুক্তি করা হয়না।
আমাদের দেশে এর জন‍্য সমস‍্যা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের কথায় এলে বলতে হয়যে, ষাটের দশকের পর থেকে এই রাজ‍্যে যেমন শিল্পের বিকাশ হয়নি তেমনই জঙ্গী কম‍্যুনিষ্ট আন্দোলন ও তার উত্বরকালে কম‍্যুনিষ্ট শাসনে এই রাজ‍্যে কলকারখানা স্থাপন ত দূরঅস্ত, একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরাজ‍্যের শিল্পে ‘ঘেরাও’ কথাটি এত চালু হয়েছিল যে তা অক্সফোর্ড ডিক্সনারিতেও স্থান পেয়েছে! সরকারী বেতন কাঠামোয় প্রচুর স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার পোষিত সংস্থায় অত‍্যধিক বেতনবৃদ্ধি, সঙ্গে নিয়মিত ডিএ বাড়ানো ইত‍্যাদি কারনে সরকারের কোষাগারে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেতনের টাকা মেটাতে ওভার-ড্রাফ্ট নেওয়া শুরু হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ণ না করে এই অনুদান নীতি যখন আর চলছিলনা তখন বড় শিল্প স্থাপনের চেষ্টা করতে গিয়ে সেই সরকারের পতন হল। আরো বেশী অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান শাসকদল রাজ‍্যসরকারে ক্ষমতায় এলো। হুগো স‍্যাভেজের কায়দায় বিরোধী উৎখাত, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশ প্রশাসন – সব কিছুই পার্টি তথা ব‍্যক্তি নিয়ন্ত্রনে এসে যাওয়ায় এবার সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চালানোর প্রশ্ন এলো। “অনুপ্রাণিত” প্রশাসন তার স্বচ্ছতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হিরিয়েছে তার দক্ষতাও। তখন ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী larger than life নেতা (নেত্রী) বানানো হল! সব সমষ‍্যার সমাধান করে বিভিন্ন নামে ভোটারদের অনুদান দেওয়া শুরু হল। এছাড়া অবশ‍্য শাসকের আর কিছু করার ছিল না। তাই ভেনেজুয়েলার নির্বাচনের মত এখানেও এখানেও নির্বাচনী গণতন্ত্রের মূল কথা – সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত – এই তিনটিই নির্বাচনের সময় অবলুপ্ত হয়ে গেল।
আমরাশুধু এ রাজ‍্যে নয়, অন‍্যান‍্য রাজ‍্য, এমনকি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও এই রাজ‍্যের প্রভাব অনুভব করছি। জওহরলালের পর যখন ইন্দিরা দেশের শাসনভার ‘দখল’ করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে গণতন্ত্রের মোড়কে পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে সচেষ্ট হন, তখন থেকেই আবার দেশের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে larger than life বানানোর চেষ্টা শুরু হয় – যা এখনো চলছে। কুশীলব বদলাচ্ছে – নীতি নয়! এই সময়ে এসে দেশের মানুষের স্বভাব পরিবর্তনের একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করে এই লেখা শেষ করব। বর্তমানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নবম মূখ‍্যমন্ত্রী হচ্ছেন শ্রীমতি মমতা মূখোপাধ‍্যায়। এর আগের কোন মূখ‍্যমন্ত্রী সম্পর্কে রাজ‍্যের মানুষ তথা মন্ত্রী সান্ত্রীদের ‘মাননীয়’ সম্বোধন করতে শুনিনি। কিন্তু এখন মনে হয়, কোন অলিখিত নীতির প্রয়োগে এটা বলা বাধ‍্যতামূলক! আবার জনসাধারনের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন জনগণের টাকায় কোন প্রকল্প উদ্বোধন বা শুরু করেন, তখন “মাননীয়া” ও “অনুপ্রেঢ়নায়” – কথাদুটি অত‍্যন্ত শ্রুতিকটুভাবে কানে বাজে। এতে কি মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মান বাড়ে? মনেহয়, অশিক্ষাজনিত চাটুকারীতার উজ্জ্বল নিদর্শন এই ধরনের চামচাবাজি। সত‍্যি কথা বলতে কি, কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক লঘুভার মন্ত্রী ও আধামন্ত্রী (MOS) কেও আমরা বারবার “মান‍্য নরেন্দ্রমোদীজী” বলতে শুনি আর কেন্দ্রীয় সব প্রকল্পই যেন তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সাধিত হয়! এভাবেই ইমেজ বিল্ডিং হয় ও গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রার দিকে দেশ এগিয়ে চলে।
গণতন্ত্রকে রক্ষা কযার জন‍্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন ভোটারদের যথার্থ শিক্ষিত করা। একাজ করতে কায়েমী স্বার্থের কারনে রাজনীতিকরা সর্বতোভাবে বাধা দেবে। ভোটারদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মাধ‍্যমে বুঝতে হবে, অর্থ ও খাদ‍্যের বিনিময়ে যারা আমাদের ভোট কিনছে তারা আজকের জন‍্য সাময়িক সংস্থান করলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আগামী সংস্থানকে ধ্বংস করছে। এই শিক্ষা না থাকলে তার গণতন্ত্রে ভোটাধিকার থাকা উচিৎ নয়। এছাড়া, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের জন‍্য সমাজ যদি তৈরী না হয়, তাহলে আমাদের দেশে কোথাও মুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সফল হবেনা। পক্ষান্তরে, উপমহাদেশের পরিস্থিতি মাথায় রেখে বলা যেতে পারে, ভবিষ‍্যতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দুষ্কর হতে পারে।