রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন নয়

১৯৮৩ সালে ভারত সরকার যে কেন্দ্র-রাজ‍্য সম্পর্কের প্রশ্নে রঞ্জিত সিং সারকারিয়া কমিশন গঠন করে, তারা তাদের পর্যবেক্ষণ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পর তা তৎকালীন এবং পরবর্তী কোন সরকারই গ্রহণ করেনি। কিন্তু এই কমিশনের পর্যবেক্ষণগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ‍্য-সরকার তাদের স্বার্থে ব‍্যবহার করার কথা বলেছে! সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্ট মানতে হলে আমাদের দেশের সংবিধানকে জ্বলাঞ্জলী দিতে হবে! বিশেষতঃ, রাজ‍্যপাল নিয়োগের প্রশ্নে তাঁকে কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করার যে সংবিধান স্বীকৃত পন্থা আছে, তা বদলে রাজ‍্য বিধানসভা তথা রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে রাজ‍্যপাল নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে! কোন রাজ‍্য-সরকার যদি দেশের সংহতির পরিপন্থী এবং সংবিধান বিরোধী কাজ করে, তা হলেও কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান মোতাবেক সেই রাজ‍্য-সরকারকে সরাতে পারবে না! মনে পড়ল, কম‍্যুনিস্ট পার্টির প্রাক্তণ সাধারণ সম্পাদক ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীর তত্ত্ব – যেখানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ বলে দেখানো হয়েছে! এদিকে রাজ‍্য-সরকারগুলি তাদের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে ও উন্নয়ণের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সাহায‍্যের উপর নির্ভরশীল। কিছু রাজ‍্য-সরকারের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বভাব হচ্ছে, একের পর এক প্রকল্পের জন‍্য কেন্দ্র থেকে টাকা নিয়ে তার হিসাব না দেওয়া – এমনকি টাকার Utilization certificate পযর্ন্ত দেওয়া হয় না। এর কারন বহুবিধ। অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম পাল্টে দেওয়া, প্রকল্পের টাকার হিসাব না দেওয়ার বড় কারন হচ্ছে এক খাতের টাকা সম্পূর্ণ অন‍্য খাতে ব‍্যয় করা, প্ল‍্যানড্ ও আন-প্ল‍্যানড্ বাজেটের হিসেব গুলিয়ে ফেলা – সর্বোপরি দুর্ণীতির সুযোগ তৈরী করা!
সারকারিয়া কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করতে হলে বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে রাজ‍্যগুলিকে রক্ষা করা এবং রাজ‍্যগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুসারে তাদের অর্থ প্রদান করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের আর কোন ভূমিকা থাকবে না! রাজ‍্যগুলির কাজকর্মের সঠিক গতি ও পথ নির্ণয়ে রাজ‍্যপালের ভূমিকা বদলে গিয়ে তা রাজ‍্য-সরকার তথা মূখ‍্যমন্ত্রীদ্বারা চয়ন করা একজন “রাবার স্ট‍্যাম্প” হবে মাত্র! এমন অবাস্তব ও সংবিধান-বিরোধী পর্যবেক্ষণের কারনেই স্বাভাবিকভাবে এত বছরে যত সরকার কেন্দ্রে এসেছে, তারা কেউই এই কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি, ব‍্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের কারনে এখনো এই কমিশনের পরামর্শ না মানার জন‍্য কেন্দ্রকে দোষারোপ করে থাকেন। আবার এই নেতারাই যখন কেন্দ্রীয় সরকারে থাকেন, তখন কেউ সারকারিয়া কমিশনের কোন অংশকেই গ্রহণ করার আগ্রহ দেখান না।
সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ কার্যকর না হওয়ার জন‍্যই কেরলের রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খান কেরল সরকারের আইন বিরোধীভাবে সরকারি অর্থ অপচয় করে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ‘পেনশন’ দেওয়ার প্রকল্প নিয়ে আপত্তি করতে পারেন। কেরলে রাজ‍্যের মন্ত্রীরা তাদের ব‍্যক্তিগত কাজের জন‍্য চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে পারেন। এই কর্মীরা যত কম দিন কাজ করুন না কেন, তাঁরা সরকারি স্থায়ী কর্মীদের মত পেনশন পাওয়ার অধিকারী! বামফ্রন্টের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ম চালু আছে! এদের নিয়োগের কোন নির্দিষ্ট যোগ‍্যতা নেই। এরা কোন নির্বাচন পদ্ধতির মধ‍্যে দিয়ে নির্বাচিত নয়! এদের একটাই যোগ‍্যতা – পার্টির লোক এবং মন্ত্রীর ইচ্ছেয় চাকরী করছেন! এদের কাজও রাজনৈতিক স্বার্থ ও রাজনীতিকের স্বার্থ দেখা! এখানে কেরলের মাননীয় রাজ‍্যপাল প্রশ্ন তুলেছেন – সরকারি অর্থ ব‍্যয় করে এইসব রাজনৈতিক কর্মীদের আজীবন পেনশন দেওয়া হচ্ছে কেন? আশ্চর্যের ব‍্যাপার হল, রাজ‍্য-সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে পেনশন পাওয়ার জন‍্য যে নূন‍্যতম বছর চাকরি করার প্রয়োজন, তা এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ‍্য নয়! এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পেনশন দিতে খরচের ব‍্যাপারে কেরলের রাজ‍্যপাল সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ‍্যণীয়, পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন থেকে ধরে বর্তমান রাজ‍্যপাল – কেউ এ ব‍্যাপারে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক কর্মীদের মধ‍্যে বিলি করার নৈতিক অনুমোদন পাওয়া যায় কি? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মীরা, পেনশনভোগী বৃদ্ধ প্রাক্তণ সরকারি কর্মীরা ডিএ না পাওয়ায় যে অর্থকষ্টে ভুগছে, তাদের রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচাল করার জন‍্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে এদের ঘুঁষি মারা হচ্ছে, লাঠিপেটা করা হচ্ছে! অথচ, এমন নীতিবিরুদ্ধ কাজের জন‍্য কোন প্রতিবাদ নেই! তাই, ধন‍্যবাদ মাননীয় রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খানকে। তিনি এব‍্যপারে মুখ খুলেছেন। অথচ, কোন রাজনীতিক এই অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে দলের লোককে সরকারি অর্থ পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রথম শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের হাত ধরে। তারপর তা অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এবার কথা হল, সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক রাজ‍্যপাল নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলে কেরল সরকারের মনোনীত রাজ‍্যপালকখনোই সরকারের এই নীতি বিরুদ্ধ কাজ নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতেন না। আবার পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী দাবী করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের নব-নিযুক্ত রাজ‍্যপাল ডঃ সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়োগের সময় তাঁর পরামর্শ চাওয়া হয়নি! আইন ও সংবিধান মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার কোন রাজ‍্য-সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করে ঐ রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল নিয়োগ করে না।একটি রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ‍্য-সরকারের কাজকর্মের ব‍্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন রাজ‍্যের মানুষের স্বার্থে। তিনি নির্বাচনে জেতা দলীয় প্রতিনিধি নন। রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, রাজ‍্যপালের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব রাজ‍্য-সরকারের উপর। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে রাজ‍্যপালের সক্রিয়তা জরুরী।
অথচ, রাজ‍্য-সরকারের কোন কাজকে সঠিক দিশা দেখানোর জন‍্য যদি রাজ‍্যপাল তাঁর সরকারকে পরামর্শ দেন, তখন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আবার শিক্ষার মানদন্ড না থাকায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন রাজ‍্যের ক্ষমতায় বসেন, তখন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতার সীমা ও এক্তিয়ার সম্পর্কে তাঁরা নিজেরাই বিশেষ অবগত থাকেন না। বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে বলা যায়, সরকারের জন-বিরোধী বা বেআইনি কাজকে যখন কোন রাজ‍্যপাল সামনে এনেছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তখনই সেই রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে সরকার তথা শাসক দলের পক্ষে প্রতিবাদের ঝড় তোলা হয়েছে – অনেক সময় এই প্রতিবাদ শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। এতে হয়ত রাজনৈতিক ফয়দা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
এইভাবে এই রাজ‍্যে হয় রাজ‍্য-সরকারের রাবার-স্ট‍্যাম্প রাজ‍্যপাল অথবা দায়িত্বশীল রাজ‍্যপালের জন‍্য বরাদ্দ হয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির তকমা! লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের; ক্ষতি সাধারণ মানুষের। এখানেও বলতে হয়, সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্টের রাজত্বকালেই রাজ‍্যপালের সঙ্গে অসভ‍্যতা করা শুরু হয়। রাজ‍্যপাল ধর্মবীরার সময় কিভাবে তাঁকে অপমান করা হয়, মিছিল সংঘবদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করা হয় – তা এখনো পশ্চিমবঙ্গের জনগণ মনে রেখেছে। এখন “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী”র রাজত্বে এই নোংরামো বহুগুণ বেড়েছে।
যে রাজ‍্যে বড় কল-কারখানা থেকে ছোট শিল্প, SEZ ইত‍্যাদি ধ্বংস করে রাজ‍্যের মানুষকে ভাতা কেন্দ্রীক জীবন ধারনে বাধ‍্য করা হয়েছে, তার দায় এই রাজ‍্যে বিভিন্ন সময়ে (গত ষাট বছর) শাসন করা রাজনৈতিক দলগুলির। এখন রাজ‍্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই শাসকদলের মদতে একমাত্র ব‍্যবসা হল ‘কাটমানি’ ব‍্যবসা। এইসবের বিরুদ্ধে যে রাজ‍্যপাল সরব হবেন, তাঁকেই শাসক বাহিনীর বিদ্রুপ ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে অপমান সহ‍্য করতে হবে। এর শুরু সেই ধর্মবীরের সময় থেকে। সে সময়ের শাসকদল এখন বিধানসভায় একজনকেও জিতিয়ে আনতে পারে না! কারন, এ রাজ‍্যে শাসকদল শোষকদলে পরিণত হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্ণীতির নাগপাশে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের জন‍্য কেন্দ্রের প্রতিভূ রাজ‍্যপাল যখনই কোন পদক্ষেপ করতে গেছেন, তখনই তাঁকে শাসকদলের সমবেত আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। সেটাই এখন এ রাজ‍্যের রাজনৈতিক ঐতিহ‍্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে রাজ‍্যপালকে কাজ করতে না দেওয়ার কারন একটাই – রাজ‍্যের শাসকদলের দুর্ণীতি কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখার অসৎ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।
আরেকটি রাজনৈতিক কারন এখানে উল্লেখ করা যায় – বিশেষতঃ দেশের গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে। এই রাজ‍্যে ভোটের সময় যত সন্ত্রাস, হিংসাত্মক ঘটনা, খুণ-জখম এবং রক্ত ঝরানোর ঘটনা ঘটে, সারা দেশে তার অর্ধেক হিংসা ঘটে না। ভোট-পরবর্তী হিংসাও এই রাজ‍্যের বিশেষত্ব। এর বেশ কয়েকটি কারন আছে – প্রথমতঃ রাজ‍্যে কর্মসংস্থান ও অর্থ উপার্জনের সুযোগ অত‍্যন্ত সীমিত হওয়ায় রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে অনৈতিক উপায়ে দালালী, কাটমানি ইত‍্যাদি রাজ‍্যের এক বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগারে পরিণত হয়েছে। এখানেও সেই বামপন্থী রাজত্বের থেকে শাসকদলের হয়ে বিভিন্ন রকম প্রচার, তাদের দলের স্বার্থে হিংসাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে বহু মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এ ধরনের কাজে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ‍্য আসায় এবং রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপে পুলিশের ছত্রছায়ায় এই কাজে রিস্ক কম থাকায় বহু অল্প বয়সী ছেলেপিলে একে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে – বিশেষতঃ অন‍্য কাজের সুযোগ না থাকায়।
এভাবে ধীরে ধীরে রাজ‍্য-রাজনীতিতে যেমন দুর্ণীতি ও হিংসা বাড়তে থাকে, তেমনি ক্ষমতা দখলে রাখার মরিয়া চেষ্টায় রাজনৈতিক হিংসাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ভোটের সময় স্বাভাবিক কারনেই স্বার্থ ও জীবিকা বাঁচানোর তাগিধেই এ ধরনের লুম্পেন কর্মীদের দ্বারা রাজনৈতিক স্বার্থে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হয়। এ রাজ‍্যে নির্বাচন পরিণত হয়েছে লুম্পেন কর্মীদের রুজি-রোজগার বজায় রাখা অথবা তা ছিনিয়ে নেবার সংগ্রাম হিসাবে! এইভাবে রাজ‍্যে হিংসাত্মক রাজনীতির জন্মও হয় বামপন্থী ও অতি-বামপন্থী রাজনীতির অনুসঙ্গ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে বামপন্থীসহ কিছু রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এই হিংসাত্মক রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। রাজ‍্যে শিল্প ও ব‍্যবসা-বাণিজ‍্যের প্রতিকুল পরিবেশে এই লুম্পেন রাজনীতির হাত ধরে বামপন্থী রাজত্বেই আসে কাটমানি বাণিজ্য – যা ২০১১ সালে পালা বদলের পর রাজ‍্যের বর্তমান শাসককুল প্রায় সব ধরনের বাণিজ‍্যিক আদান প্রদানে বাধ‍্যতামূলক করে দিয়েছেন! এ কাজের গণতন্ত্রীকরনের জন‍্য রাজ‍্যের আইনের রক্ষকদের এমনভাবে কাজে লাগানো হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে শাসকদলের লিগ‍্যালাইজড্ গুন্ডাবাহিনীর মত আচরণের অবিযোগ বিস্তর।
এমতাবস্থায় রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব রাজ‍্যপালের। তিনি যদি সেটিং তত্ত্বের ক্রীড়নক হয়ে পড়েন, তাহলে বলতে হয়, দেশে আইনের শাসন ও সংবিধানের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গেছে। তার দায় তখন রাজ‍্যপাল ও তিনি যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ‍্যে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন – সেই সরকারের কুশীলবদের উপরেই বর্তায়। এখানে গত শতাব্দীর শেষপাদ থেকে কাশ্মীর রাজ‍্যের কথা মনে করিয়ে তার ফলাফল বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার কথা মনে হল। অতয়েব, সাধু সাবধান।

বঙ্গ রাজনীতিতে এত কটুক্তির বন‍্যা কেন

ভোলা ময়রার বহুল প্রচলিত কবিগানের উক্তি : “জন্ম যেমন যার, কর্ম তেমন তার; এ ব‍্যাটা ভেড়ের ভেড়ে, নিমক ছেড়ে কবির ব‍্যবসা ধরেছে” – এই কথাগুলি যেন মনে হয় বর্তমান সময়ে রাজ‍্যের রাজনীতিকদের নিয়ে বলা হয়েছে!
বাঙ্গালীরা বরাবর আবেগপ্রবণ জাত। এই আবেগের বশেই একসময় শিক্ষিত বাঙ্গালীকুলের বড় অংশ দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের বলিদান দিয়েছিল। সেই সময় যারা রাজনীতির আঙ্গিনায় এগিয়ে এসেছিল, সেই বাঙ্গালীদের অধিকাংশই স্বচ্ছল পরিবারের যুবক। তাদের উদ্দেশ‍্য ছিল দেশের জন‍্য, সমাজের জন‍্য ভালো কিছু করা – রাজনীতি তাদের কারোর জীবিকা ছিল না। সে কারনে রাজনীতির মাধ‍্যমে রোজগার করার ধারনাটাই তখন ছিল না।
দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই একদল রাজনীতিকের আবির্ভাব হয়, যারা ” ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” বলে এই সমাজসেবা করাকে তাচ্ছিল্য করে এবং নির্বাচনে জেতাকে রাজনীতির মঞ্চে পরম সাফল্য বলে মনে করে। এভাবে অহঙ্কারী ও লোভী মানুষের মধ‍্যে রাজনীতির মঞ্চে ভীড় করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয় – ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় যে মানুষদের হাতে ক্ষমতার ‘মধুভান্ড’ আসে, তারা সততা ও দেশপ্রেম থেকে বহু যোজন দূরে থাকা মানুষজন! সম্ভ্রান্তের তকমা পাওয়া কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে এসে যে মধুভান্ডের স্বাদ পান, তারজন‍্য তাদের অনেকেই নিজের অপদার্থ, অযোগ্য, অসৎ বংশধরদের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। এরাই ভারতে বংশপরম্পরায় রাজনীতির ব‍্যবসা শুরু করেন। প্রথম উদাহরণ অবশ‍্যই নেহরুর পরিবার। প্রশাসনিক দুর্ণীতির অংশ হয়ে এই রাজনীতিকরা এমন ধনবান হয়ে পড়ে যে তারা অন‍্য ব‍্যবসায় কিছুতেই এত অর্থের মালিক হতে পারতেন না।
ভারতীয় রাজনীতির এই অসততার শিকড় আমাদের রাজ‍্যেও সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। এমনকি, এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত মানুষজন – জজ, আইএএস, শিক্ষাবিদ – অনেকেই অবসরগ্রহণের পরেপরেই কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করতে নেমে পড়েন। জীবনের শেষপাদে এসে তাঁদের দেশসেবার ইচ্ছা চাগিয়ে ওঠে! এদের কার্যকলাপে সন্দেহ জাগে তাদের কর্মজীবনের কাজে নিরপেক্ষতা উপর।
আমাদের সাধারন মানুষকে বুঝতে হবে, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অপগন্ড থেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব‍্যাক্তি, প্রতিষ্ঠিত খেলোয়ার, গায়ক, অভিনেতা – সকলের এত দেশসেবার হিড়িক জাগল কেন! আসলে, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বিনা বিনিয়োগে সবচেয়ে লাভজনক ব‍্যবসার নাম – রাজনীতি! এ আর “দেশসেবা” নয় – profession। সেজন‍্য অনেক রাজনীতিক তাঁদের ফর্ম পুরনের সময় professionএর জায়গায় লেখেন – রাজনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় কয়েকটি পরিবার রাজনীতির ‘মধুভান্ড’ কুক্ষিগত করে রাখেন। ভারতের মসনদে যেমন নেহরু-গান্ধী পরিবার, কাশ্মীরে আবদুল্লা পরিবার ইত‍্যাদির ধনবৃদ্ধিতে প্রলুব্ধ হয়ে, বহু মানুষ রাজনীতিকে profession হিসেবে গ্রহণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে! রাজনীতি করতে যেহেতু কোন যোগতা লাগে না, সে কারনে বহু লোভী ও অসৎ মানুষ রাজনীতির আঙ্গিনায় ভিড় করে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলতে হয়, স্বাধীনতার অব‍্যবহিত আগে সুরাবর্দী তাঁর অসৎ উদ্দেশ‍্যে রাজ‍্যের পুলিশকে ব‍্যবহার করে এবং সেইসঙ্গে রাজনীতির আঙ্গিনায় দলীয় গুন্ডাগর্দীর প্রচলন করেন। আবার সময়ের সঙ্গেসঙ্গে বঙ্গ রাজনীতিতে দলীয় মাসলম‍্যানদের গুরুত্বের পরিবর্তন হয়। প্রথমদিকে, বিশেষতঃ কংগ্রেসের প্রথম ১৫-১৬ বছরের শাসনকালে এই গুন্ডাবাহিসীর কিছুটা ভূমিকা দেখা গেলেও তারা কখনোই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্ব পেত না।একটা ব‍্যাপার লক্ষ‍্য রাখা হত, এরা যেন সমাজে সাধারন মানুষের অসুবিধে না করে।
তারপর রাজ‍্য-রাজনীতির আঙ্গিনায় উত্থান হল বামপন্থীদের। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন‍্য যতটা আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেল, তার চেয়ে তারা অনেক বেশী আগ্রাসী ভঙ্গিতে প্রধান বিরোধী দলকে ছলে-বলে-কৌশলে হেয় করার প্রয়োগ-কৌশল দেখালো – এখানে কোন নিয়ম, নীতির তোয়াক্কা করল না! নির্বাচনের সময় বামপন্থার বকলমে সিপিএমের দেওয়াল লিখনে ও চিত্রাঙ্কনে শুধু ইন্দিরা-কংগ্রেসকে গালি দেওয়া নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক রক্ত-পিপাসু ডাইনীর রূপে চিত্রিত করে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দেওয়াল লিখন করা হল!
এভাবে নির্বাচনে বিরোধীতার আগ্রাসী চরিত্র সামাজিক ক্ষেত্রেও গতি পেল যখন রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু বানতলার নৃশংস ধর্ষণও হত‍্যার ঘটনা প্রসঙ্গে বললেন, “এমন ত কতই হয়”! এভাবে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার পর, গুন্ডাগর্দীর মাধ‍্যমে দলে উঠে আসা মানুষদের নেতৃত্বে বসানো শুরু হল। যার বিরুদ্ধে স্বহস্তে গুলি করে এক থানার ওসিকে নিধনের অভিযোগ, তাকে শুধু এমএলএ নয়, মন্ত্রী করা হল! এইভাবে এই রাজ‍্যে গুন্ডাগিরি রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাওয়ার সোপান হিসেবে দেখা শুরু হল! ইতিমধ‍্যে অতিবামদের খুন খারাবির রাজনীতি শুরু হল। তাদের শ্লোগান – “চীনের চেয়ারম‍্যান আমাদের চেয়ারম‍্যান” আর “ধনীর গায়ের চামড়া দিয়ে গরীবের পায়ের জুতো তৈরী হবে” – এমন অবাস্তব, অসাড় শ্লোগানসহ তারা এক প্রৌঢ় বা বৃদ্ধকে আট-দশজন যুবকদ্বারা নৃশংসভাবে হত‍্যা করার মধ‍্যে বিপ্লব সাফল‍্যমন্ডিত হল – বলে প্রচার করল! এমন চরম সামাজিক ও আইন-শৃঙ্খলার চরম অবক্ষয়ের পর্যায়ে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তিনি পুলিশ দিয়ে তথাকথিত বিপথগামী যুবকদের ‘খুন’ করালেন। সুরাবর্দীর পর, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এভাবে পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে রাজনৈতিক কারনে হত‍্যার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রথম কারিগর এই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। এর সুদূরপ্রসারী ফল হল, যখন পশ্চিমবঙ্গে জ‍্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন প্রতিষ্ঠা হল, তখন প্রথম থেকেই পুলিশকে রাজ‍্যের শাসকদলের স্বার্থে ব‍্যবহার করা হতে লাগল। আবার সিদ্ধার্থ জমানায় যে হাতকাটা জিতু বা কানকাটা ছেনোর দল রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহৃত হত, রাজ‍্যের পুলিশবাহিনী তাদের সঙ্গে আপোষ করার রাস্তা নিল।
সিপিএম জমানায় সাধারন নির্বাচন থেকে লোকাল বডি, এমনকি স্কুল, কলেজের গভর্নিং বডি নির্বাচনে পর্যন্ত গুন্ডা-বাহিনী শাসকদলের সমর্থনে রাস্তায় নামত। এদের রক্ষা করত রাজ‍্যের পুলিশ বাহিনী। তৈরী হল শাসক-গুন্ডা-পুলিশ জোট। সাধারন মানুষ এই জোটের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করত না – শুধু ভয় দেখিয়েই কাজ হাসিল করা হত। বিরোধী বা সংঘবদ্ধ জোট হলে তার বিরুদ্ধে একযোগে এই গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হত। যত সময় গড়ালো, তত নির্বাচনে গুন্ডাগর্দী দেখানো কর্মীরা পার্টির নেতৃত্বে যেতে লাগল। এদের চারিত্রিক ও বাণিজ্যিক গুণগুলি (!) রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করল – এভাবে রাজনীতি একটি সর্বাপেক্ষা লাভজনক ব‍্যবসায় পরিণত হল। যার মধ‍্যে গুন্ডাগর্দী, অসততা, মিথ‍্যাচারসহ সকল চারিত্রিক অনাচার দেখা গেল – তিনি ততই সার্থক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন।শুধু শাসক দল নয়, রাজনীতির এই অবক্ষয় দলমত নির্বিশেষে সব দলের রাজনীতির মধ‍্যেই দেখা গেল। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন নির্বাচনে রক্ত ঝরা একটি স্বাভাবিক ব‍্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
শিল্পায়ণের চেষ্টা, অর্থনীতির উন্নতির চেষ্টা এফং দলীয় নেতাদের তোলাবাজির প্রশ্রয় না দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কুকথার ফুলঝুড়ি ছড়ানো দলীয় নেতাদের প্রশ্রয় না দিয়ে মূখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের এক বড় অংশের কাছে অপ্রিয় হলেন। তাছাড়া, তুচ্ছ কারনে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারনে কংগ্রেস তার নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতার এমন মিশেল ঘটালো যে তারা রাজ‍্যে সহযোগী দল তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় নিয়ে এলো! তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জী ২০১১ সালে রাজ‍্যের নতুন মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন। এই মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর দল তৈরী করেন কংগ্রেস ভেঙ্গে। তিনি সর্বসমক্ষে একাধিকবার সিদ্ধার্থ শঙ্গর রায়কে তাঁর গুরু মেনেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়নের জনক জ‍্যোতি বসুর পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ নিয়েছেন। সিপিএমের এই মেধাবী ছাত্রীর দলে তিনিই প্রথম ও শেষ কথা! দলে একটাই পোষ্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোষ্ট! প্রশাসন চলে তাঁর অনুপ্রেরনায়!
গত এগারো বছরে মমতা ব‍্যানার্জীর শাসনকালে এই গুন্ডাগর্দী ও তোলাবাজীর রাজনীতিকরন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমোকে বারবার তাঁর দলের নেতাদের তোলাবাজি ও গুন্ডামীর জন‍্য সতর্ক করতে হয়েছে! এভাবে এখন পশ্চিমবঙ্গে দলীয় রাজনীতিতে হিংসা ও তোলাবাজির গণতন্ত্রীকরন সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। রাজনীতি যেহেতু আর সমাজসেবা নয় – শুধুই ক্ষমতা ভোগ ও টাকা কামানোর জায়গা – সেহেতু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার স্বার্থজনিত কারনে এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির অভাবে নেতা-নেত্রীরা কুকথার ফুলঝুড়ি ছোটান – তাঁরা মনে করেন, এভাবেই তাঁরা দলীয় নেতৃত্বের কাছে অধিক গুরুত্ব পাবেন! আসলে এইসব নেতা-নেত্রীদের সভ‍্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই ব‍্যবহার তাদের কটুক্তির মাধ‍্যমে বেরিয়ে আসছে। এই রাজ‍্যের নেতা-নেত্রীরা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ধরে আনবেন!তারা অসম্মান করে কটু কথা বলতে পারেন রাজ‍্যপাল ও দেশের প্রেসিডেন্টকে! আবার বিরোধী দলের দায়িত্বশীল নেতা রাজ‍্যের মহিলা মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব‍্য করতে পিছপা হন না! তাদের রাজনীতি ব‍্যবসার স্বার্থে ঘা লাগায় তারা এসব কটুক্তি করেন। এর সবচেয়ে বড় কারন, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার জন‍্য কোন শিক্ষা,দীক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির দরকার হয় না!
এ বিষয়ে রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যমের দায়িত্ব অপরিসীম।তারা এইসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নেতা-নেত্রীর বক্তব‍্য গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করে। ফলে, নিম্ন-সংস্কৃতির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আরো বেশী করে প্রতিপক্ষকে কটুক্তি করার জন‍্য প্ররোচিত হন! সেজন‍্য এখন রাজ‍্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন রাজনীতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছেন! এটি রাজ‍্যের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় অশনি সংকেত। এখন রাজনীতিক এমনকি পায়াভারি মন্ত্রীরাও দুর্ণীতির দায়ে জেল খাটছেন। এমনকি, ব‍্যভিচারের মত কাজ পর্যন্ত রাজনীতিকদের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না! এর ফলে, অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের মানুষের কাছে ত বটেই, অন‍্যান‍্য দেশের মানুষের কাছেও রাজ‍্যের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতির প‍্যাটার্ন আমুল পরিবর্তন না করলে এই অবক্ষয় আটকানো দুরের কথা, ক্রমশঃ তা বেড়ে যাবে। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের আমূল পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন রাজ‍্যের অধিকাংশ সাধারন মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসবে। এই অশুভ রাজনীতির ধারক-বাহকরাও সেটা জানে আর সেকারনেই তারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ও লড়াই লাগিয়ে রাখে! গুন্ডাবাহিনী ও শাসকের অপকর্মের দোসর পুলিশ বাহিনী সদা তৎপর আছে – যে কোন প্রতিবাদের সুর স্তব্ধ করে দেওয়ার জন‍্য। এমন কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল পর্যন্ত নেই যারা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক‍্যবদ্ধ করবে। রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যম পর্যন্ত এই অসৎ রাজনীতির থেকে ফয়দা তুলছে। সুতরাং, কণ‍্যাশ্রী, যুবশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের ভিক্ষে পাওয়া জনগণকে রাজ‍্যের নেতারা কুত্তা (Kutta) পদবী দিলেও কারোর কোন হেলদোল নেই।
এই অনাচারের থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা অত‍্যাচারের এই রাজনীতির আড়ালে মুখঢাকা সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলা। জাতীয়স্তরের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ‍্যপাল প্রসঙ্গে

রাজ‍্যের নতুন রাজ‍্যপাল হয়ে এসেছেন ৭১ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত আমলা ডঃ সি ভি আনন্দ বোস। শুধু এটুকু বললে পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। সুলেখক, পন্ডিত আনন্দ বোসের ইংরেজী, মালয়ালী ও হিন্দি ভাষায় প্রায় চল্লিশটি বই আছে। তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রসংঘের একটি পরামর্শদাতা কমিটির প্রধান।
কেরলের কোট্টায়াম জেলায় জন্ম এই প্রাক্তণ আইএএস BITS পিলানি থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে মুসৌরীর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একাডেমির ফেলো হন। আনন্দ বোসজী জওহরলাল নেহরু স্কলারশিপ প্রাপকও বটে। চাকরী জীবনের বিভিন্ন অধ‍্যায় পর্যালোচনা করলে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। প্রাকৃতিক ভারসাম‍্য রক্ষা থেকে সকলের জন‍্য বাসস্থান – বহু প্রকল্পে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। এই শেষোক্ত কারনে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আসেন। তাঁর শিক্ষা জগতে অবাধ বিচরণ মাণ‍্যতা পায় উপাচার্য পদে নিযুক্তির মাধ‍্যমে।
ডঃ আনন্দ বোসের সম্বন্ধে এ কথাগুলি বলার উদ্দেশ‍্য হল, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া। ফলে, ব‍্যক্তি রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনার সুযোগ পাওয়া যাবে। এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়নি। যদিও তিনি কেরলের এক মালয়ালী পরিবারের সন্তান, তাঁর পদবী কিভাবে “বোস” হল! ডঃ সি ভি আনন্দ বোসের বাবা বাসুদেব পিল্লাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের অত‍্যন্ত অনুরাগী এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের সাত সন্তানের সকলের নামের শেষে “বোস” যুক্ত করেন! ডঃ আনন্দ বোসের কাজের প্রশংসা করেছেন কেরলের মূখ‍্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তিনি অত‍্যন্ত পছন্দের আমলা। এরা সকলেই তাঁর সম্পর্কে একটি কথা বলেন – man of ideas।
এমন একজন রাজ‍্যপাল হয়ত পশ্চিমবঙ্গের সময়ের দাবী ছিল। লা গণেশন যেভাবে তাঁর স্বল্প দিনের দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর পরিবারের একজনের জন্মদিনে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেন এবং মূখ‍্যমন্ত্রী সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে অনুষ্ঠানের একদিন আগে চেন্নাই পৌঁছে যান, তাতে যেমন রাজ‍্যপালের পদের গৌরবের প্রশ্নে প্রশ্নচিহ্ন পড়েছে, তেমনি আগের রাজ‍্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সময় সর্বদা মূখ‍্যমন্ত্রী তথা রাজ‍্যের প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে রাজ‍্যপালের রণংদেহী সম্পর্ক তৈরী হয় – তা রাজ‍্যবাসীর কোন মঙ্গল করেনি।
প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সম্বৃদ্ধ এই বিদ্বান রাজ‍্যপাল দায়িত্ব নেওয়ার সময় একটি কথা বলেছেন, যা অত‍্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাজ‍্যপালের পদকে তিনি কোন বিরাট সন্মানের আলঙ্কারিক পদ হিসেবে দেখেন না। তিনি রাজ‍্যের জনসাধারনের মঙ্গলের জন‍্য সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতার মধ‍্যে থেকে কাজ করবেন এবং রাজ‍্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ‍্যে সমন্বয় (bridge) সাধনের কাজ করবেন। এই উক্তিতেই পরিষ্কার যে তিনি তাঁর সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালন করবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ‘রাবার স্ট‍্যাম্প’ রাজ‍্যপাল না হলে রাজ‍্য সরকারের সমূহ বিপদ। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ‍্যের শাসকদল যেমন তার সুপ্রিমোর অঙ্গুলীহেলনে চলে, তেমনি রাজ‍্যের প্রশাসনও তাঁরই অঙ্গুলীহেলনে চলছে! এখানে প্রশাসন চলে ব‍্যক্তিবিশেষের “অনুপ্রেরনা”য়! সেখানে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কোন জায়গা নেই। প্রাক্তণ রাজ‍্যপাল ধনখড়জীর সঙ্গে মমতাদেবী তথা রাজ‍্য সরকারের গন্ডগোল শুরুর কারনও তাই। রাজ‍্যবাসীর দুর্ভাগ্য যে তারা একজন megalomaniac নেত্রীকে দায়ীত্ব দিয়েছেন আর তিনি সর্বদা পরামর্শ নেওয়াকে ঘৃণা করেন (contemptuous to advice)। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা রাজ‍্যের নির্বাচিত সরকারের কাজকর্মের উপর নজর রাখার জন‍্য এবং পরামর্শ দেওয়া, প্রয়োজনে পদক্ষেপ করার জন‍্য রাজ‍্যপালের পদকে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। রাজ‍্যপাল তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেই ধরা হয়। রাজ‍্যপাল কখনোই “রাবার স্ট‍্যাম্প” নন। কোন রাজ‍্যপাল “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপালের মত আচরণ করলে তিনি জনসাধারণের কাছে তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করবেন।
ধনখড়জী তাঁর পদাধিকারবলে সরকারের যে কোন আধিকারিক বা মন্ত্রী – এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত তাঁর কাছে ডাকতে পারেন। পর্যায়ে রাজ‍্যপাল রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, মূখ‍্যমন্ত্রী নন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে ধনখড়জী রাজ‍্য প্রশাসনের কাছে যার-পর-নাই অপদস্ত হন। এমনকি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে উপাচার্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা না করার ঔদ্ধত্ব দেখান! এ ধরনের নোংরামো করতে গিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছেন – রাজ‍্যপালের নয়। উপাচার্যদের এখন রাজ‍্যের মানুষ অল্পশিক্ষিত, ডিগ্রিধারী শাসকদলের কর্মী ছাড়া অন‍্য কিছু মনে করে না। রাজ‍্যের এক ঐতিহ‍্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়! আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যপদে রাজ‍্যপালের নিযুক্ত প্রার্থীকে তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (যিনি বর্তমানে চৌর্যবৃত্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দী) কটুকথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাতিল করেন!
রাজ‍্যপাল ডাকলে বিভিন্ন অযৌক্তিক অজুহাতে রাজ‍্য সরকারের আধিকারিকরা হাজির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখাতেন না! বিভিন্ন সংবাদ-মাধ‍্যমে রাজ‍্যের মন্ত্রীসহ তৃণমূল দলের নেতারা রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে কুকথার বন‍্যা বইয়ে দিতেন। এভাবে শুধু যে প্রশাসনিক দক্ষতাকে পঙ্গু করে প্রশাসনে দলীয় শাসন কায়েম করা হল তাই নয়, সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতায় রাজ‍্য সরকারের প্রশাসনিক ব‍্যর্থতার পরিচয় পাওয়া যায়।
আসলে নেহরু-গান্ধী জমানায় যেভাবে “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল থাকতেন, যারা কেন্দ্রের অঙ্গুলীহেলনে ‘কাজ’ করতেন, সেই যুগ আর নেই। এদিকে মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার চায় এমন রাজ‍্যপাল যিনি বাপুরাম সাপুড়ের কাছে বায়না করা সাপের মত – যিনি একমাত্র megalomaniac নেত্রীর কথা মত “পুতুল নাচের ইতিকথা”র চরিত্র হবেন! সময়ের নিয়মে সেটিও সম্ভব নয়। সংবিধান মোতাবেক রাজ‍্যপালের ভূমিকা রাজ‍্য-প্রশাসনের অভিভাবকের মত। তাঁর নামে প্রশাসন চলে। তাঁর নামে নিয়োগ থেকে কর্মচ‍্যুতি – সব সরকারী কাজ হয় – প্রশাসনিক বদলীও তাঁর নামেই হয়। রাজ‍্যের প্রশাসনের মাথা রাজ‍্যপাল – এই স্বাভাবিক সত‍্য কথাটা মেনে নিতে নির্বাচনে জেতা নেত্রী, যাঁর অনুপ্রেরনায় প্রশাসন চলে – তাঁর মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়! আসলে এই নেত্রী সর্বদা সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা ভোগ করতে আগ্রহী। তা’ছাড়া তিনি ইগো সমস‍্যায় ভোগেন।তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি সর্বদা ‘সংগ্রাম’ করতে আগ্রহী! অথচ, প্রশাসনের কাজে স্বচ্ছতা আনতে এবং প্রশাসনিক ব‍্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন‍্য রাজ‍্যপাল তাঁর রাজ‍্যের মূখ‍্যসচিবসহ যে কোন আধিকারিককে ডাকলে তাদের হাজির হওয়া বাধ‍্যতামূলক। অথচ, নেত্রীর ভয়ে এবং রোষের মুখে পড়ার ভয়ে রাজ‍্যপালকে বারবার অবজ্ঞা করার স্পর্ধা দেখানো হয়েছে। মনে হয়, এসবের পিছনে অন‍্য কোন কারন আছে। রাজ‍্যপাল ধনখড়জী যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব‍্যাপারে উৎসাহ দেখাতে শুরু করলেন, তখন প্রশাসন প্রমাদ গুনলো। তারা ভয় পেল, এবার থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে! নেত্রীর “অনুপ্রেরনায়” তারা রাজ‍্যের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ থেকে রাজ‍্যপালকে অপসারিত করল! নেত্রীর অনুপ্রেরনায় মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ শুরু হল। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলির স্ট‍্যাচুট চুলোয় গেল। তারপর দেখা গেল, উচ্চ আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয়ের অনুসন্ধানের পর বিভাগীয় মন্ত্রী তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। তাঁরা এখন জেল হাজতে আছেন। সুতরাং, প্রশাসনের কাজের ধারা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে রাজ‍্যপালের আইনসম্মত জিজ্ঞাস‍্য থাকলে এই প্রশাসন বিপদের গন্ধ পায়! তখনই তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে “রাজ‍্যপাল হটাও” অভিযান শুরু হয়।
এর প্রেক্ষিতেই মনে হয়, নয়া রাজ‍্যপাল আনন্দ বোসজী তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে অনমনীয় থাকার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। তবে, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই “এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই” ধরনের attitude কে কতটা বাগে আনতে পারবেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
মমতাদেবীর রাজনীতির ধরনে এটা মনে করার কারন নেই যে, তিনি রাজ‍্যপালের সাংবিধানিক পদ্ধতি পালনের এবং রাজ‍্য-কেন্দ্র সম্পর্কে সেতু রক্ষার কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁর সঙ্গে সহযোগীতা করবেন। যতক্ষণ মমতাদেবীর প্রশাসনের কাজে রাজ‍্যপাল ‘পরামর্শ’ ও ‘উপদেশ’ না দিচ্ছেন, ততক্ষণ সব ঠিক থাকবে। কিন্তু রাজ‍্যপাল তাঁর কথা অনুযায়ী কাজ শুরু করলেই ঝামেলা বাঁধবে। মমতাদেবী চান “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল – যিনি তাঁর সব কাজে বিনা জিজ্ঞাসায় সায় দেবেন! আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। সংবিধানও এই রাবার স্ট‍্যাম্পকে মাণ‍্যতা দেয় না। আর, মমতাদেবীর রাজনীতিতে তাঁর অনমনীয় মনোভাবের ফলে, জোট রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট সাড়া জাগিয়ে শুরু করলেও আজ তিনি ও তাঁর দল রাজ‍্য তথা দেশের রাজনীতিতে একা। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি দুটি সর্বভারতীয় দল – বিজেপি ও কংগ্রেস – উভয়ের সঙ্গেই কখনো না কখনো জোট করে সুবিধা নিয়েছেন। আবার একসময় জোটসঙ্গীকে ত‍্যাগ করে বিরোধীতাও করেছেন। সেজন‍্য জোট রাজনীতিতে মমতাদেবী এবং তাঁর দলের কোন বিশ্বাসযোগ‍্যতা নেই। তবে তিনি চিরকাল kitchen politics বা পিছনের দরজা দিয়ে গোপন রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পারদর্শী। এধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ‍্যতা প্রয়োজন – সেটা তিনি কতটা দেখাতে পারেন তা ভবিষ‍্যৎ বলবে। মমতাদেবীর বড় সমস‍্যা হল, তিনি দল ও প্রশাসনকে মিশিয়ে দিয়েছেন। দলীয় নেতৃত্ব থেকে প্রশাসনকে আদেশ করা এবং প্রশাসনের সেই আদেশ পালন করার মধ‍্যেই তা পরিষ্কার। ফলে, দলীয় অসততার আঁচ অবধারিতভাবে সরকারী প্রশাসনে পড়েছে। প্রশাসনিক কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে তাঁর অঘোষিত উত্তরাধিকারীর বিভিন্ন অতিরিক্ত-সাংবিধানিক (extra-constitutional) ক্ষমতা ও কাজকর্ম নিয়েও মানুষের মনে বিস্তর প্রশ্ন।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপাল মহোদয় যদি এইসব অসাংবিধানিক কাজকর্মের ব‍্যাপারে চোখ বুজে থাকেন তবে রাজ‍্য সরকার ও মমতাদেবীর কাছে তিনি খুব ভালো রাজ‍্যপাল! কিন্তু যদি রাজ‍্যের কাজকর্মের ব‍্যাপারে তিনি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, তা’হলে গোলমাল শুরু হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দলের shouting brigadeকে ময়দানে নামিয়ে অসংসদীয় ভাষায় কুকথার প্লাবন বইয়ে রাজ‍্যপালের চেয়ারকে আক্রমণ করার পন্থা নেওয়া হবে। এই দলের নেতৃত্বের মনে রাখা উচিৎ যে তাদের দলের নেতৃত্বের সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ‍্যেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে – ভোটে জিতলেই যা খুশী তাই বলা বা করার অধিকার জন্মায় না! এই দল ও তার নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি কথাটা বুঝবে তত রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপালের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও তাঁর শিক্ষা-সংস্কৃতির পটভূমি বিচার করে মনে হয়, তিনি যা বলেছেন, তাতে রাজ‍্যের সাধারন মানুষের পক্ষে তিনি দাঁড়াবেন এবং সংবিধান সম্মত পদ্ধতিতে রাজ‍্য প্রশাসনকে চালানোর মত অবশ‍্য পালনীয় পরামর্শ দেবেন বলেই মনে হয়। তখন রাজ‍্য প্রশাসন ও মমতাদেবীর দল কি প্রতিক্রিয়া দেয় তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বেহাল দশা

এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষের মাথায় প্রায় ষাট হাজার টাকা ঋণের বোঝা – সৌজন‍্যে গত পঞ্চাশ বছরের রাজ‍্য সরকারের শাসন! এর দায় কার? কে নেবে দায়িত্ব? সঠিক উত্তর দেওয়া ত দূরের কথা, কোন রকম উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত এই রাজ‍্য সরকারের নেই। রাজনীতির আঁচকা আঁচকি থেকে আতাঁত – এসব প্রশ্নে যাওয়া এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য নয় – কোন ব‍্যক্তিবিশেষের দোষ-গুণ বিবেচ‍্য নয়। এখানে প্রশ্ন উঠছে – এভাবে কতদিন? সম্প্রতি রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা এতটাই যে, সুদ দেওয়াসহ তার খরচের পরিমাণের তুলনায় সরকারের রোজগারের পরিমাণ অত‍্যন্ত কম! অর্থাৎ, রাজ‍্য সরকার ঋণজালের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে। এর দায় নিশ্চয়ই রাজ‍্য সরকারের।এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার – আমাদের সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতায় মন্ত্রী, এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীর পর্যন্ত আর্থিক ক্ষমতা নেই! IAS বিভাগীয় প্রধানরা এই ক্ষমতা ভোগ করেন – অবশ‍্যই মূখ‍্যসচিবের অনুমত‍্যানুসারে। তা’হলে এমন আর্থিক হালের জন‍্য দায়ী কে? অবশ‍্যই এই IAS অফিসারেরা নন; কারন প্রশাসন চলে সরকারী নীতি অনুসারে। আর এই নীতি নির্ধারণ করেন বিভাগীয় মন্ত্রীরা – অবশ‍্যই মূখ‍্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার অনুমোদন সাপেক্ষে। শুধু নীতি নির্ধারণের পর তা রূপায়ণের দায় থাকে প্রশাসনিক কর্তাদের উপর। তা’হলে আর্থিক বিশৃঙ্খলার দায় এসে পরে মন্ত্রীসভা ও মূখ‍্যমন্ত্রীর উপর। আর্থিক আয়-ব‍্যয়ের নীতি যারা নির্ধারন করেন, দায় তাদেরই নেওয়ার কথা। সে ভাবে দেখলে এই দায় যৌথভাবে বর্তমান মন্ত্রীসভার। শুধু তাই নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলির আর্থিক বিশৃঙ্খলার দায়ও এই মন্ত্রীসভার! কারন, মন্ত্রীসভা দায়িত্ব নেওয়ার সময় পূর্ববর্তী সরকারের দায় ও সম্পদ (liability and assets) স্বীকার করেই দায়িত্ব নেন। সুতরাং “ঋণং কৃত্ত্বা ঘৃতং পিবেৎ” তত্ত্বের সদব‍্যবহার করতে করতে বর্তমান রাজ‍্য সরকার এই ঋণফাঁদে পড়েছে।
এই রাজ‍্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তার আর্থিক নীতির কারনে রাজ‍্যের আর্থিক হাল ক্রমশঃ খারাপ হয়েছে। বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসনে রাজ‍্যের চালু কলকারখানাগুলি একের পর এক পার্টির নেতাদের মদতে বন্ধ হয়েছে। এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অর্ধশিক্ষিত কম‍্যুনিস্ট নেতারা বুঝিয়েছে, মালিক বড়লোক আর শ্রমিক গরীব; তাই মালিক শ্রমিকের শত্রু! সুতরাং মালিকের লাভ হয় – এমন কাজ কোন শ্রমিকের করা উচিৎ নয়। এভাবে বছরের পর বছর বাঙ্গালী শ্রমজীবী মানুষদের মগজ ধোলাই করে রাজ‍্যের work culture একেবারে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তারপর যখন তাদের বিলম্বিত বোধদয় হল, তখন তাদের জমি দখলের ঔদ্ধত‍্যের খেসারত দিয়ে সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়কে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী পদে বসাতে সাহায‍্য করল!
সিপিএমের নীতি, তা ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন – বাস্তবায়নের একটা দলীয় তাগিদ ছিল। কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিক মমতা বন্দোপাধ‍্যায় তাঁর তৃণমূল দলের শুরু থেকেই কংগ্রেসী কালচারে “এক নেত্রী”র শাসন কায়েম করলেন – দলে একটিই পোস্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোস্ট; একটিই পরিবার, বাকীসব ঢেউয়ে ভাসা হরির দ্বার! এ ধরনের দলে নেত্রীর কর্মদক্ষতার উপর দলের সাফল‍্য নির্ভর করে। মমতা দেবী যেখানেই সিপিএমের নির্যাতন, অপশাসনের খবর পেয়েছেন, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন – প্রতিবাদ করেছেন। এভাবেই তিনি জনপ্রিয়তম নেত্রী হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি ১০০% সফল। কিন্তু বিরোধী নেতৃত্ব দেওয়া আর স্বচ্ছ, সফলভাবে প্রশাসন চালানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব‍্যাপার।
আরেকটি ব‍্যাপার যা আগেও বলেছি, মমতা দেবীর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তাঁর megalomaniac (নিজেকে সব বিষয়ে বিজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ ভাবা) চরিত্র। megalomania ডাক্তারি পরিভাষায় একটি মনোরোগ। ফলে, তিনি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমতী হিসেবে কল্পনা করে নেন। এই কারনেই তিনি তাঁর সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সময় অস্তিত্বহীন – ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির (fake university) ডক্টরেট বলে দাবী করেন! ১৯৮৪ সালে ঐ সময়ের কাগজে সে সংবাদ প্রকাশিতও হয়। এই জাল ডিগ্রির উল্লেখ না করলেও তখন তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কোন অসুবিধা হত না। তথাপি তিনি এ কাজ করলেন।
পরবর্তী সময় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তিনি সব দপ্তরের সমস্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন! এমনকি তাঁর ইগো এতটাই তীব্র যে, কোন টেকনিক‍্যাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করাকে পর্যন্ত অপছন্দ করেন! ফলে, তাঁর আশেপাশের রাজনীতিকদের মত, আমলা ও বিশেষজ্ঞরা তাঁকে যথার্থ পরামর্শ দেওয়ার বদলে স্তাবকতা করে নিজেদের আখের গুছানোকেই পরমার্থ মনে করছেন। এভাবে বেশীদিন সাফল‍্য পাওয়া যায় না। মমতাদেবীর সরকারও তা পাচ্ছেনা। তিনি সর্বদা জনসাধারনকে তুষ্ট রাখার রাজনীতি করেন! এটিই তাঁর USP। ফলে, তিনি যখন সিঙ্গুরের টাটা মোটরসের কারখানা বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্প বিতাড়নের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন, তখন থেকেই তাঁর কাছে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর কোন alternative পরিকল্পনা ছিল না। এদিকে কলকারখানা ও ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য না বাড়ায় রাজ‍্যে কর্মসংস্থানের হাল দিনদিন যত খারাপ হয়েছে, ততই এই megalomaniac নেত্রী তাঁর ইগোর কারনে কর্মসংস্থান বাড়ানোর চেষ্টা না করে বিভিন্ন “শ্রী” যুক্ত প্রকল্পের নামে সরকারী কোষাগার থেকে অনুদান দিয়ে সরকারের অর্থ শুধু ধ্বংসই করেননি, সেইসঙ্গে বিনিময়মূল‍্যহীণ এইসব অনুদানকে “উন্নয়ণ” বলে চালাতে চেয়েছেন।
এভাবে বেশীদিন চললে যা ভবিতব‍্য তাই হচ্ছে! প্রশাসন চালানোর জন‍্য অর্থ-দপ্তরের হাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না আসায় রাজ‍্য সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে।যদিও সরকার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মী সংকোচন করে, অস্থায়ী, অ‍্যাডহক চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে এবং তার কর্মচারী ও পেনশনারদের ন‍্যায‍্য মহার্ঘভাতা না মিটিয়ে – প্রশাসনিক দক্ষতাকে চুলোয় পাঠিয়ে অবস্থা সামাল দিতে চাইছে, তবু ধীরেধীরে রাজ‍্য সরকার ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে বাঁচার সমস্ত রাস্তা পরখ করা হয়েছে! যেমন স্ট‍্যাম্প ডিউটি বৃদ্ধি থেকে ধরে বিভিন্ন সরকারী ও সরকার-পোষিত পৌরনিগমের পরিষেবার মূল‍্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে, সারা রাজ‍্য জুড়ে মদের দোকানের অনুমোদন বৃদ্ধি করে – রাজস্ব আদায়ের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তবু, মূখ‍্যমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাবের জন‍্য পশ্চিমবঙ্গে SEZ সহ শিল্পস্থাপনের যে স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো আছে তা রূপায়ণে রাজ‍্যের অনীহা রাজ‍্যবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ‍্যে ফেলে দিয়েছে।
সরকারী প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতায় জানি যে, সরকারী অর্থ বরাদ্দের হিসেব দেওয়া (UC) বাধ‍্যতামূলক। অডিটেড utilization certificate না দিলে পরবর্তী বছরের অর্থ বরাদ্দ করা যায় না। রাজ‍্য সরকারের অর্থ দপ্তরও এই নিয়মে চলে। কিন্তু যখন কেন্দ্রীয় সরকার বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন প্রকল্পখাতে তাদের দেওয়া অর্থ রাজ‍্য সরকার নেওয়ার পরেও কোন UC দেয়না, তখন আইনত কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যকে ঐ খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। এই রাজ‍্যেও যখন তা হল, রাজ‍্য সরকার এবং তাদের বশংবদ সংবাদ-মাধ‍্যম সরবে কেন্দ্রের বিমাতৃসূলভ আচরণের (!) জন‍্য তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করল! আসলে, ঐ – আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত, তাই কোন হিসেব না দেওয়া আমাদের অধিকার! নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে বোধশূণ‍্য ব‍্যক্তিরা ক্ষমতায় বসলে এমন হতেই পারে!
এর মধ‍্যে সরকারী ও সরকারপোষিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, মূলতঃ শিক্ষকতায়, অযোগ‍্য প্রার্থীদের অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া, স্বজন-পোষণ এবং দলের ক্ষমতাশালী নেতৃত্বের একাংশের জেলযাত্রা – দলীয় নেতাদের টাকার পাহাড় বানানো, বিভিন্ন নেতার বাড়ি অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম হওয়ার খবর মাননীয় উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সৌজন‍্যে রাজ‍্যবাসী দেখছে। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মত তাঁর মত প্রকাশ করা মূখ‍্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের পারিবারিক উত্তরাধিকারী মৌণব্রত অবলম্বন করেছেন!
সামনে পঞ্চায়েত ভোট। রাজ‍্যের বাজেটের আয়-ব‍্যয়ের স্বচ্ছতা না থাকায় এবং রাজ‍্য ঋণফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের হুঁশিয়ারীর পরেও রাজ‍্যের কর্ণধার তাঁর ইগো নিয়ে পড়ে থাকলে এই ভোটের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করা রাজ‍্যের অর্থ দপ্তরের পক্ষে কতটা সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকছে।
তাছাড়া, রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী এই সরকারের আয় অপেক্ষা ব‍্যয় অনেক বেশী। সুতরাং তার পক্ষে ক্রমান্বয়ে ধার নেওয়া আর ক্রমবর্ধমান সুদের ফলে রাজ‍্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেভাবে রাজ‍্যের জনগণের মধ‍্যে বিভিন্ন অনুদান প্রকল্পের নামে সরকারী টাকা বিলানো হচ্ছে, তার ফলশ্রুতি হিসেবে অতি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন দপ্তরের অত‍্যাবশ‍্যকীয় খরচের অর্থেও টান পড়েছে! এভাবে শুধুমাত্র পুলিশ ও কিছু সংবাদ-মাধ‍্যমকে তাঁবে রেখে প্রশাসন চালানো সম্ভব নয় – যদি না কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ‍্য সরকারকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাহায‍্যের হাত বাড়িয়ে দেয়! সুতরাং এই রাজ‍্য সরকারের স্থায়ীত্ব এখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে!
এ ধরনের সব সরকারের যা বৈশিষ্ট্য, তেমনি এই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দূর্ণীতি ও স্বজন-পোষণের ভুত বাসা বেঁধেছে। এখানে সরকার ও ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দল সমার্থক! সংবাদ-মাধ‍্যম এখনো এ কথাটুকু বলতে পারল না যে, বিভিন্ন উন্নয়ণ(!) যা কিছু ভোটারকে সরকারী কোষাগারের অর্থ বিলানোর মধ‍্যে সীমাবদ্ধ, তা দিচ্ছেন বিভাগীয় প্রধানরা – কোন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীও নন। ব‍্যক্তিগতভাবে অর্থের বিনিময়ে চাকরী দেওয়ার জন‍্য দায়ী আমলারা – কোন মন্ত্রী নন। তবে, রাজ‍্য তথা দেশের মানুষ বোঝেন যে ‘যন্ত্র’ চালান ‘যন্ত্রী’! মন্ত্রীসহ যেসব রাজনৈতিক নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু হিসাব বহির্ভূত ‘সম্পত্তি’ করার কারন এবং সে সম্পত্তির উৎস না বলার কারনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এভাবে রাজ‍্য প্রশাসনটাই কাঠগড়ায় উঠেছ। দল তথা প্রশাসনে দূর্ণীতির ক্রমবর্ধমান ‘বিকাশ’-এর খবর যত বেরোবে, দল ততই পুলিশ-গুন্ডারাজের আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে নেবে! প্রশাসনে ধীরে ধীরে দলের কন্ট্রোল হ্রাস পাবে আর লুম্পেনরাজ প্রতিষ্ঠা পাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে প্রকৃত আয়-ব‍্যয়ের হিসেবের কোন মিল না থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া টাকার কোন UC দেওয়া যাবে না। তাই কেন্দ্র থেকে রাজ‍্যের অনুদান খাতে টাকা পাওয়াও সম্ভব হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এমন অর্থনৈতিক নয়-ছয়ের জন‍্য প্রয়োজনীয় আইনী পদক্ষেপ নেয় তা’হলেই রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল।দেখা যাক, অসৎ রাজনীতির কবলে পড়া পশ্চিমবঙ্গবাসীর মুক্তি কবে মেলে।

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশীয় ক‍্যাম্পাসের বিরোধীতা কেন

আমাদের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি একটি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। আসলে, জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যমে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা ও কিছু ঘোষিত রাজনীতির ঘোষিত সমর্থক তথাকথিত বুদ্ধিজীবির বক্তব‍্য প্রচার করা হয় – তাতে অন্ততঃ এই রাজ‍্যে শিক্ষানীতি নিয়ে সাধারন মানুষের সঠিক ধারনা করা প্রায় অসম্ভব। সংবাদ-মাধ‍্যম নিয়ন্ত্রিত ধারনা অনেকটাই অপরের মুখে ঝাল খাওয়ার মত! শিক্ষানীতি নিয়ে আগে এই জায়গায় বিস্তৃত আলোচনা করায় তা আবার বিবৃত করার কোন অভিপ্রায় নেই। শুধু, সে সময় এই নীতি প্রয়োগে কিছু সতর্কতা ও সন্দেহের কথা বলেছিলাম। এখন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষায় বিদেশী বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্রে fall-outএর ব‍্যপারে আলোচনা করছি।
নতুন শিক্ষানীতির দিশা অবশ‍্যই প্রশংসনীয়। যদিও বিরোধী রাজনীতিকদের অন্ধ বিরোধীতা এবং সরকার পক্ষের রাজনীতিকদের অন্ধ সমর্থনের মধ‍্যে অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিকদের শিক্ষার দৈণ‍্যতাই প্রকাশ পায়। মেকলে নির্দেশিত শিক্ষা-ব‍্যবস্থায়, কম‍্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত শিক্ষানীতির পরিবর্তন দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে অতীব জরুরী ছিল। এই নতুন শিক্ষানীতির অভিমুখ যেহেতু দেশের ঐতিহ‍্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ব‍্যবস্থার মেলবন্ধন করা – সেটি পূর্ববর্তী শিক্ষা-ব‍্যবস্থার ধারক ও বাহকদের না-পসন্দ্ হওয়াই স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন‍্য যা সবচেয়ে জরুরী তা হল শিক্ষকদের যোগ‍্যতা ও তাদের শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগের সদিচ্ছা! চল্লিশ বছরের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাদান ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা জগতে শিক্ষক-চয়ন থেকে শুরু করে তাদের নিয়োগ ব‍্যবস্থা কখনো স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল না! সেখানে প্রার্থীর শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ‍্যতা অপেক্ষা অন‍্য যোগাযোগ প্রাধান‍্য পেয়ে এসেছে! ইউজিসি বেতন কাঠামো পূর্ববর্তী যুগে সাধারণতঃ শিক্ষকরা তাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীকে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকাতে যার-পর-নাই চেষ্টা করতেন। এভাবেই তখন বেশীরভাগ শিক্ষক-চয়ন করা হত। ইউজিসি বেতন কাঠামো পরবর্তী সময়ে কলেজ,বিশ্ববিদ‍্যালয়ের বেতন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলে তার চাপে স্কুল শিক্ষকদেরও বেতনে অনেকটাই বৃদ্ধি হয়। স্কুল, কলেজ উভয় ক্ষেত্রেই সার্ভিস-কমিশনের মাধ‍্যমে শিক্ষক-নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলেও রাজনীতির কোলে চড়ে থাকা এইসব ‘কমিশন’গুলি তাদের ‘বিশেষজ্ঞ’ চয়ন থেকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পন্ন করতে লাগল যে, প্রায় সমস্ত শিক্ষক নির্বাচনই রাজনীতির ক্ষমতায় থাকা দল ও তাদের নেতাদের অঙ্গুীহেলনে করা হত! যেজন‍্য এক সময় কলেজ সার্ভিস কমিশনের নাম লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল “কমরেড সার্ভিস কমিশন”! আর বিশ্ববিদ্যালয়! যত কম বলা যায় ততই ভালো! এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-চয়নে কোন স্বচ্ছতা নেই। কোথাও শিক্ষক চয়নের জন‍্য বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলির ক্ষেত্রে সার্ভিস কমিশন নেই। প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগের কথা – ঐ সময় আমি কলকাতা থেকে বহুদূরের এক সরকারী কলেজে সহকারী অধ‍্যাপক। সে সময়ে প্রায় এক বছরের মধ‍্যে আমার কলেজের ৩-৪ জন সহকর্মী কলকাতার ২-৩টি বিশ্ববিদ‍্যালয়ে ‘নির্বাচিত’ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীতে যোগ দিলেন। এরা সকলেই ছাত্রাবস্থা থেকে তখনকার রাজ‍্যের শাসকদলের সক্রিয় কর্মী! শুধু একজন ছিলেন, যিনি বৈবাহিক সূত্রে শাসকদলের শিক্ষকনেতার সহধর্মীনী! এই অসততা সমর্থকদের একটাই বক্তব‍্য – বাশ্ববিদ‍্যালয়ের অটোনমি! অর্থাৎ, শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতির দোহাই বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অটোনমি!
আরো বড় কথা – বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ‍্যাপক পদে উত্তরণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কলেজগুলোতে সে সুযোগ নেই – সহযোগী অধ‍্যাপক পদেই তা সীমাবদ্ধ! এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কলেজগুলিতেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে শিক্ষাদান এবং গবেষণার সুযোগ থাকলেও অধ‍্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই! সংযোগ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ এই শিক্ষকদের নিযুক্তি এবং পদোন্নতির কারন হওয়ায় তাদের যোগ‍্যতার যথার্থতা কখনোই প্রমাণিত হয়নি। পৃথিবীর কথা বাদ দিলেও, শুধু সারা ভারতের নিরিখে এই রাজ‍্যের শিক্ষার মান যে ক্রমশই নিম্নগামী, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণ চুলোয় গেছে – এমনকি সরকারি কলেজে জীব-বিজ্ঞান বিভাগে specimen কেনার অর্থ না থাকায় জীবদেহ ব‍্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়া শিক্ষা বন্ধ!
যেহেতু এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদের ভিত্তিতে বেতনক্রম নির্ধারিত হয়, এখানে যোগ‍্যতা গৌণ – মূখ‍্য হচ্ছে রাজনৈতিক খুঁটির জোরে পদোন্নতি প্রাপ্তি! সুতরাং এ নিয়ে স্তাবক শিক্ষককুলের মধ‍্যে কোন হেলদোল ছিল না। এবার মুস্কিল হল নয়া শিক্ষানীতির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। কারন, বিশ্বজনীন শিক্ষা-ব‍্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও একটি বুনিয়াদী স্তরের উপরে – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষাকে – পণ‍্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে পণ‍্যের ক্রেতার পণ‍্য, তার মান ও বিক্রয়কেন্দ্র চয়নের স্বাধীনতা থাকছে! শুধু তাই নয়, পণ‍্য বিক্রেতার দায়বদ্ধতা এবং পণ‍্য বিক্রেতাদের মধ‍্যে প্রতিযোগীতাও থাকবে – তা’হলে একমাত্র উন্নতমানের পণ‍্যই বাজারে চলবে! আমাদের এতদিনের চালু শিক্ষা ব‍্যবস্থায় এমন দায়বদ্ধতার কোন ব‍্যাপার ছিলনা। শিক্ষা রাজনীতির নিয়ন্ত্রনাধীন থাকায় ছাত্রদের শিক্ষকের ও শিক্ষার গুণগত মানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। “সকলের জন‍্য সর্বস্তরের শিক্ষা” এবং “শিক্ষা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের দায়িত্ব” বলা কম‍্যুনিস্টদের উদ্দেশ‍্য ছিল অর্ধশিক্ষা ও কুশিক্ষার আলোতে ভারতীয় শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখা। কারন, চীন, রাশিয়ার মত কম‍্যুনিস্ট দেশগুলিও উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় অর্থবিনিয়োগ কমিয়ে তার গুণগত মান বৃদ্ধির জন‍্য শিক্ষার বেসরকারীকরনের মত নীতি নিয়ে চলছে। এ বিষয়ে ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট ও তাদের সমর্থনকারী সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি নিশ্চুপ! এছাড়া এখানে অন‍্যরকম বাদ-বিসম্বাদ আসতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের যোগ‍্য ছাত্রদের জন‍্য বিদেশী বিশ্ববিদ‍্যালয় ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির ভারতে তাদের ক‍্যাম্পাস খোলার পথ সুগম করা হচ্ছে। গুজরাট আন্তর্জাতিক অর্থ প্রযুক্তি শহর (Gujarat International Finance Tec-City) বা সংক্ষেপে GIFT গান্ধীনগরে বিদেশী উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভারতে তাদের ক‍্যাম্পাস খোলার জন‍্য ২০২২এর বাজেটে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন ‘পক্ষ’ মাছের বাজারের চিৎকার শুরু করেছে – অবশ‍্যই স্বার্থহানির আশঙ্কায়!
যা বলা হচ্ছেনা তা’হল, ২০০৫ সালে ইউপিএ জমানায় UGC এইভাবে আগ্রহী বিদেশী উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে ভারতে তাদের অতিরিক্ত ক‍্যাম্পাস খোলার জন‍্য স্পেশাল ইকনমিক জোন খোলার পরিকল্পনা করে – উদ্দেশ‍্য, কম খরচে ভারতের যোগ‍্য ছাত্রছাত্রীদের আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া। সুতরাং এটি নতুন কোন চিন্তা নয়। তবে, এতে অসুবিধা কেন এবং কোথায়?
প্রথম কথা হল, রাজনৈতিক বিরোধীতা নির্বোধের প্রতিক্রিয়া বলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন (যার মধ‍্যে বিজেপিপন্থী সংগঠনও আছে) এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে! তার কারন, আমাদের দেশে শিক্ষা – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষা হচ্ছে শিক্ষকদের করেকম্মে খাওয়ার জায়গা – যেখানে বেতনভূক কর্মচারীর (পড়ুন শিক্ষক) কোন দায়বদ্ধতা নেই। এখানে দায়বদ্ধতা বলতে শিক্ষাদানের গুণগত মানের কথা বোঝানো হচ্ছে। এবার যদি এইসব আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে গুণমানের প্রতিযোগীতায় নামতে হয়, তা’হলে এই শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিমাপ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। বার্সিলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ফুটবল খেলতে নামলে যেভাবে এই দেশের টিমের খেলোয়ারদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার ধুলিস‍্যাৎ হবে – সে ভয়টাই এই শিক্ষকদের মনে কাজ করছে। এতে একটি মূল‍্যবান তথ‍্য বেরিয়ে এসেছে – এতদিন আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের চাহিদা ও মতামতকে গুরুত্ব দিইনি। আমরা শিক্ষার উৎকর্ষের বদলে শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতিকে শিক্ষার বিকাশ মনে করে তৃপ্তি অনুভব করেছি।
এখন সময় এসেছে – নতুন শিক্ষানীতির হাত ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামতে বাধ‍্য করা। উচ্চশিক্ষার নামে বহুবিধ ধ‍্যাষ্টামো বন্ধ হলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়তে বাধ‍্য। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই GIFTর অধীনে বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ক‍্যাম্পাস তৈরী হলে তারা UGCর অধীনে আসবে না – তা বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন‍্য UGCর পরামর্শ মেনে সরকার বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন‍্য কয়েকটি অলঙ্ঘণীয় শর্ত পালনের নিয়ম জারি করেছে। যেমন তাদের এদেশের ক‍্যাম্পাসে যে ডিগ্রি দেওয়া হবে তার মান ও ডিগ্রির মূল‍্য তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের ক‍্যাম্পাসের সঙ্গে যেন অভিন্ন হয়। অর্থাৎ, ক‍্যাম্পাস ভেদে ডিগ্রির ভেদ করা যাবে না। এছাড়া, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো তৈরী করার জন‍্য দেশীয় সহযোগী নেওয়া যাবে। এটা বাস্তব ও যুক্তিসম্মত। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের শিক্ষাদানের মান, ডিগ্রির মূল‍্য ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেবে।
আমার মনে হয়, protective শিক্ষা ব‍্যবস্থায় যে শিক্ষককুল শিক্ষকতার পেশায় শিক্ষকতা ছাড়া অন‍্য কাজে (!) বেশী আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের পক্ষে এই প্রতিযোগীতা অস্বস্তিকর। সেজন‍্য তারা বেশী চেঁচামেচি করছে! অনেকে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচের কথা তুলেছেন! তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, অক্সফোর্ড, কেম্বিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ তাঁরা জানেন? এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি অর্জনের জন‍্য খরচ দেশের ছাত্রদের নাগালের বাইরে যাবে না। জেএনইউ মার্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর জন‍্য কেন দেশের সাধারন মানুষের করের টাকা লাগামছাড়াভাবে ব‍্যয় করা হবে? elitist তকমা পাওয়া এইসব জায়গার ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রদের থেকে জনসাধারন কি প্রতিদান পায়? যে উচ্চ বেতন পাওয়া শিক্ষককুল এই বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির দেশীয় ক‍্যাম্পাস স্থাপনের বিরোধীতা করছেন, তাঁরা শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁদের বেতনের কত শতাংশ অর্থ ব‍্যয় করেছেন তা জানা নেই! আসলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো মোটা মাইনের শিক্ষককুল এখন ধরা পড়ার ভয়ে শোরগোল করছেন! দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ণ প্রক্রিয়া এভাবে আটকানো যাবে না।

ভারতে বিদেশী আক্রমণের আশঙ্কা আদৌ আছে কি

ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত,ভারত কোন প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কি হবে – এমন সব প্রশ্নের উত্তর ইদানিং মানুষ চাইছে – এমনকি এই অভাজনের কাছেও। এই বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞ আছেন; তাঁরা অনেককিছু বিশ্লেষণ করে গুরুগম্ভীর উত্তর দেন – যা এটাও হয়, ওটাও হয় গোছের! এ যেন জ‍্যোতিষীর হস্তরেখা বিচার – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মোড়কে!
এখানে পরিস্থিতি ও পারিপার্শিকতা বিচার করে সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমেই যেটা বলা দরকার তা হল, এই উপমহাদেশে satellite রাষ্ট্র নেপাল ও ভুটানের ভৌগলিক অবস্থান এবং সমরশক্তি এমন নয় যে, তারা ভারতের পক্ষে কোন বড় বিপদ হতে পারে। বরঞ্চ দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের মধ‍্যে buffer states হিসাবে যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমনের কাজে লাগতে পারে – যেমন, এক সময় সাবেক USSR ও চীনের মধ‍্যে buffer state হিসাবে মঙ্গোলিয়ার ভূমিকা ছিল। এখনো এই ধরনের রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আছে। বাকী রইল শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাক-ই-স্তান।
এই তিন দেশের দুর্বল অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে চীন তাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ভারত-বিরোধী কাজের প্ররোচনা দিচ্ছে। এইভাবে তিন দেশেই সরকারকে এরা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজে অথবা বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভারতের অভ‍্যন্তরে অস্থিরতা তৈরী করতে চাইছে বলে অভিযোগ। অর্থাৎ চীন সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে না – অন‍্য দেশের সাহায‍্যে ভারতের অভ‍্যন্তরে এবং সীমান্তে অস্থিরতা তৈরীতে মদত দিচ্ছে। চীনের আভ‍্যন্তরীন সমস‍্যা এবং অর্থনৈতিক স্থিতি বিচার করলে তাদের দেশের বিস্তারধর্মী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামার কোন কারন নেই। তবু, গালওয়ান পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহ প্রমাণ করে, চীন উপযাচক হয়ে ভারত আক্রমণের ঝুঁকি নেবে না।
এর কারন খুঁজতে গেলে আমাদের বর্তমানে চলা রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে তাকাতে হবে। গত আট মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার বাহিনী দ্রুত ইউক্রেনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারলেও যত সময় গড়িয়েছে, ইউক্রেন ততই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হ‍্যাঁ, একথা ঠিক যে আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলি, বিশেষতঃ ন‍্যাটো-শক্তি ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্রসহ গোলাগুলি ও আনুসঙ্গিক সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে উন্নততর ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়ার বাহিনীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে শুধুমাত্র ইউক্রেনীয়দের। এভাবে সময়ের সাথে সাথে অসম যুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্লা দিয়ে লড়াই দেওয়ার মধ‍্যে যুদ্ধের একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের কথা উল্লেখ করা দরকার। সেই রামায়ণ, মহাভারতের সময় থেকে সব যুদ্ধের ফলাফল একই নিয়মে নির্ণীত হয়েছে। তা’হল আদর্শ বা বাঁচার জন‍্য লড়াইয়ের বিরুদ্ধে পেশাগত কারনে আদর্শহীণতার লড়াইয়ে সর্বদা প্রথম পক্ষের জয়। প্রশ্ন থাকতে পারে, ভারতের বুকে ইসলামী শক্তির জয় নিয়ে – এখানে লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, ইসলামী শক্তি তাদের বিস্তারমূলক ধর্মীয় আগ্রাসনের আদর্শকে সামনে রেখে ভারতে তাদের জয় হাসিল করে। পক্ষান্তরে পরাজিত শক্তির ধর্মীয় উগ্রতা না থাকায় তারা লড়াই জেতার জন‍্য অতিরিক্ত শক্তি নিয়োজনের আকাঙ্খা করেনি। আবার মুঘল রাজত্বের শেষদিকে, বিশেষতঃ ঔরঙ্গজেবের সময় ধর্মীয় আগ্রাসনের আড়ালে শুধু অত‍্যাচার নির্ভর প্রশাসনকে শায়েস্তা করার জন‍্য মারাঠা ও রাজপুত বাহিনীর জয় এসেছিল একই কারনে – ধর্মীয় আদর্শ রক্ষার তাগিদে। পরবর্তী সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকার মত সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ শুধু আদর্শহীণতার কারনে দেশপ্রেমিক শক্তির আদর্শের কাছে পরাজিত হয়। এসব ছাড়াও সাম্প্রতিককালে তালিবানদের ইসলামী (তাদের মত করে) আদর্শের কাছে আফগানিস্তানে আগ্রাসী শক্তির পরাজয় ঘটে। সুতরাং, ইউক্রেন যখন তাদের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদে যুদ্ধে নেমেছে, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যত সময় গড়াবে, রাশিয়ার জয় তত শক্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। হ‍্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। এটা ঠিক যে, অন‍্যদেশে যারাই আগ্রাসন চালাতে গেছে, তাদেরই সেখানে সেই যুদ্ধে পরাজয় হয়েছে। অবশ‍্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্ণায়ক হয়েছে জাপানে দুটি পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণ! রাশিয়া যদি এই যুদ্ধ জিততে চায় তবে তাকে প্রতিবেশী ইউক্রেনের উপর পারমাণবিক আঘাত হানতে হবে। এই মূহুর্তে পরমাণু অস্ত্রের ব‍্যবহারের অনুকুল পরিস্থিতি না থাকায় পরমাণু অস্ত্রের ব‍্যবহার সম্ভব নয়।
ফিরে আসি ভারতের উপর চীনের আগ্রাসন প্রসঙ্গে। সেখানে মনে রাখতে হবে, ভারত ও চীন – দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর এবং দুদেশের পারমাণবিক মিসাইল ক্ষেপণ ক্ষমতা এতটাই যে, অতি অল্প সময়ে দুটি দেশই একে অপরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। এইজন‍্যই দুটি দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব‍্যবহার করতে পারবে না। ফলে, চীনের দিক থেকে ছোটখাটো অনুপ্রবেশের চেষ্টা ও সীমান্তে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখলর চেষ্টা ছাড়া সরাসরি বড় ধরনের দখলদারি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা নেই। আবার উপমহাদেশ চীনের একাধিপত‍্য কায়মের প্রধান বাধা ভারত। সেজন‍্য চীন ভারতকে ব‍্যতিব‍্যস্ত রাখার জন‍্য অপ্রত‍্যক্ষ যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর কিছু ভুল নীতি এবং গণতন্ত্রের নামে তার সুযোগের যথেচ্ছাচার দেশের জাতীয়তাবোধের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। দেশের রাজনীতিকদের একাংশ ভারতে রাজনীতি করলেও অন‍্য দেশের সরাসরি লাভ হয় এমন কাজে লিপ্ত থেকে দেশের জাতীয়তাবাদ ও অখন্ডতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। কাশ্মীরের হিন্দু-পন্ডিতদের গণহত‍্যার সময় সেখানে মূখ‍্যমন্ত্রী ছিলেন ফারুখ আবদুল্লা। তিনি সম্প্রতি সেখানে পাক-ই-স্তানের মদতপুষ্ট জেহাদীদের দ্বারা হিন্দু-পন্ডিতদের হত‍্যার বিষয়ে মন্তব‍্য করেছেন, কাশ্মীরিদের পূর্ণ ইন্সাফ না মেলা পর্যন্ত এই হত‍্যালীলা চলবে! কোন সুসভ‍্য দেশ দুরের কথা, তাঁর প্রিয় পাক-ই-স্তানে দাঁড়িয়ে তিনি যদি সেখানকার ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু মানুষদের হত‍্যা প্রসঙ্গে এমন মন্তব‍্য করতেন তবে, হয় তিনি তৎক্ষণাৎ জেলে যেতেন বা তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়া হত। আশ্চর্য হল, এমন মন্তব‍্যের পর্যন্ত এই দেশে কোন বিরোধীতা হয় না। কিছু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি একে সমর্থন করে আর সরকার গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে চুপ করে থাকে। এই ধরনের রাজনীতি ভারতের স্থায়ীত্বের পক্ষে এই মূহুর্তে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। রাজনৈতিক কারনে ধর্মকে সামনে রেখে আসাদউদ্দিন ওয়েসীর মত নেতা দেশের অখন্ডতার বিরুদ্ধাচরন করলে তা নিয়ে বিশেষ প্রতিবাদ হয় না! কম‍্যুনিস্ট রাজনীতিকরা এবং তাদের চিন্তাধারায় লালিত ও পুষ্ট কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম যখন দেশের অখন্ডতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে”র মত নাড়া লাগান, তাদের পযর্ন্ত কোন শাস্তি হয় না। এভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের শিকড়কে স্বাধীনতার পর থেকেই উপড়ে ফেলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বেশীদিন এভাবে চললে এমন সময় একদিন আসবে যখন দেশের এক বড় অংশের মানুষ আর ভারতকে নিজের দেশ বলে মানবে না! চীনের নেতৃত্বে ও উপমহাদেশের অন‍্যান‍্য রাষ্ট্রের কিছু মানুষের মদতে ভারতের অভ‍্যন্তরে এমন বিচ্ছিন্নতার বাতাস লাগানোর কাজ পুরোদমে চলছে। এছাড়া, কিছু রাজনীতিক ভোটের স্বার্থে ভারতের অভ‍্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে পরোক্ষ সমর্থন জোগাচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ ভারতের খন্ডিত স্বাধীনতালাভের সময়েই প্রোথিত হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে ত্রিখন্ডিত হয়ে দুটি খন্ডে ধর্মের ভিত্তিতে শাসনব‍্যবস্থা কায়েম হলেও ভারতে সংখ‍্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগ গুরুত্ব পেল না। বরং যে ধর্মের মানুষদের কারনে দেশ ত্রিখন্ডিত হল, সেই ধর্মের মানুষদের ধর্মাচরণের বিশেষ সুবিধাসহ “ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু”র অধিকার ভারতে স্বীকৃত হল! এখানেই স্বাধীন ভারতে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করা হল। কোন দেশ তার জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ ছাড়া বাঁচতে পারে না। যখন ভারতের জাতীয়তাবোধের উপর আঘাত আসে তখনই কম‍্যুনিস্টসহ বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় ও কিছু রাজনীতিক তাতে বাতাস দেয়! ভারতে যে কোন কাজের জন‍্য যোগ‍্যতার প্রয়োজন হলেও রাজনৈতিক নেতা হতে এবং ভোট রাজনীতিতে টিঁকে থাকতে কোন যোগ‍্যতা লাগে না। এর জন‍্যই দেশের রাজনীতিতে এত অসততার আধিক‍্য।
একটি কথা ভারতের রাজনীতিবিদদের মাথায় আসে না – যদি তাদের মদতে বিদেশী শক্তির হাতে দেশের একটি অংশের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়, তবে সেই বিদেশী শক্তি প্রথম সুযোগেই ভারতীয় রাজনীতিকদের নিকেশ করবে – এটাই স্বাভাবিক। যে কোন রাষ্ট্রের স্থায়ীত্বের ভিত্তি তার জাতীয়তাবাদ এবং জনসাধারণের জাতীয়তাবোধ। এমনকি তথাকথিত কম‍্যুনিস্ট চীনের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ‍্য। ইসলামী মানুষদের সংখ‍্যাধিক‍্যের দেশ ইন্দোনেশিয়া তাদের জাতীয়তাবোধের জন‍্য জাতীয় বীর হিসেবে শ্রীরাম ও অর্জুনকে বেছে নিয়েছে – সে দেশের বিভিন্ন স্ট‍্যাচু ও সংস্কৃতিতে তার ছাপ দেখেছি। দেশের অখন্ডতা ও সুরক্ষার প্রধান হাতিয়ার এই জাতীয়তাবোধকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভারতীয়দের দ্বারাই আঘাত করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে! এটি গভীর দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ। দেশের সরকার যদি এসব দ্রুত বন্ধ না করে তা’হলে অচিরেই তা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।
এবার আসি ভারতের অন‍্য প্রতিবেশীদের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনায়। প্রথমে আসে পাক-ই-স্তানের নাম। খন্ডিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ‍্য ভারতের উপর আগ্রাসন চালানো। তার সেই চেষ্টা পরপর তিনবার ব‍্যর্থ হলেও পাক-ই-স্তানের সেনাবাহিনীর মদতপুষ্ট রাজনৈতিক নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জিহাদকে ধর্মের মোড়কে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন যে এখন সর্বদা ভারতের সক্রিয় বিরোধীতা না করলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। এজন‍্য প্রাক-স্বাধীনতা পর্যায়ে গান্ধী-নেহরু জুটির দায় থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নেহরুর আগবাড়িয়ে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির খেসারত আজও ভারতকে দিতে হচ্ছে। আজ কাশ্মীরকে অশান্ত করার চেষ্টার মূল কান্ডারী পাক-ই-স্তান ও কাশ্মীরের কিছু ইসলামী-ভারতীয় নাগরিক – যারা পাক-ই-স্তানপন্থী ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বিশেষতঃ কাশ্মীরের দু তিনটি ইসলামী রাজনৈতিক পরিবার প্রথম থেকেই ভারতের জাতীয়তা-বিরোধী আন্দোলনে কাশ্মীরি ইসলামীদের শামিল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে – এখনো তা চালানোর সুযোগ খুঁজছে। শক্ত হাতে এই গোষ্ঠীর মোকাবিলা করলে এবং পাক-ই-স্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মুক্তির দাবীর সক্রিয় সমর্থন করলে ভারত অদুর ভবিষ্যতে পাক-ই-স্তানের দিক থেকে ক্ষতির আশঙ্কাকে প্রশমিত করতে পারবে।
বাংলাদেশে কিছু ইসলামী জিহাদী এবং শ্রীলঙ্কার একাংশ মানুষ চীনের প্ররোচনায় পা দিয়ে ভারতের সক্রিয় বিরোধীতার চেষ্টা করলেও এই দুটি দেশের সরকার তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ করার সাহস করবে না। ভূটান বা নেপাল – দুই স্থলবেষ্টিত প্রতিবেশী যতই প্রলোভন থাকুক, ভারতের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের ধৃষ্টতা দেখাতে পারবে না।
সুতরাং, একমাত্র পাক-ই-স্তান, যে একটি পরমাণু অস্ত্র সম্বৃদ্ধ দেশ, ভারতের বিরুদ্ধে তার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আতঙ্কবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে চেষ্টায় ভারতের অভ‍্যন্তর থেকে খোলাখুলি বা গোপনে যেসব মদত দেওয়া হচ্ছে, তার উৎসগুলি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদক্ষপে বন্ধ করলেই পাক-ই-স্তানের ভারত-বিরোধীতার বিষদাঁত ভেঙ্গেদওয়া সম্ভব হবে।
পরিশেষে বলি, পাক-ই-স্তান পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হলেও তার দিক থেকে ভারতের উপর পারমাণবিক আঘাত করার সম্ভাবনা নেই। পাক-ই-স্তান যত সময় নিয়ে ভারতের চার বা পাঁচটি শহরের উপর পারমাণবিক বোমার আঘাত হানতে পারে, তার থেকে কমসময়ে ভারতের পরমাণু বোমার আঘাতে পাক-ই-স্তান দেশটাই একটি তেজস্ক্রিয় জোনে পরিণত হবে – যখন পৃথিবী বলবে “এখানে পাক-ই-স্তান বলে একটি দেশ ছিল” কাজেই পাক-ই-স্তানের দিক থেকে ভারতে পরমাণু আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। তবে পাক-ই-স্তানের পরমাণু অস্ত্র থাকাটা তাদের একটাই স্বস্তি দেবে যে তারা ভারতসহ অন‍্য কোন দেশের পারমাণবিক আক্রমণের শিকার হবে না! ভারতে খুচরো নাশকতামূলক কাজকর্মে মদত দেওয়া বন্ধ করার জন‍্য ভারতের সরকারের তরফে কড়া দাওয়াইয়ের প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক অশান্তি ও অরাজকতা নয়, রাজনীতির অলঙ্ঘনীয় নীতি হোক, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ – যাকে সারা পৃথিবীর অন‍্য সব দেশ মাণ‍্যতা দেয়।

ভারতের সংবিধানের পুনর্মূল‍্যায়ন জরুরী

ভারতমাতার পরনের শাড়িটি যদি দেশের সংবিধান হয়, তাহলে বলতেই হবে, আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুসারে শতদীর্ণ, তালি-তাপ্পার প্রভাবে আসল শাড়ি আর নজরে পড়ছে না! আমাদের ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়ার পর পশ্চিম ও পূর্বদিকের দুই ভূখন্ডের রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম, আর তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বের অদূরদর্শীতায় ভারতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা স্বীকার করে নেওয়া হল।
সংবিধানের ২৫ নং ধারায় আছে – মুক্ত বিবেক, মুক্ত পেশা এবং ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সকল ভারতীয়ের অধিকার। ২৫(২)(বি) অনুচ্ছেদ বলছে, হিন্দুদের সর্বজনীন ধর্মস্থানে হিন্দুদের অবাধ প্রবেশিধার আছে। আবর ২৬ নং ধারা বলছে, ধর্মীয় কাজে ভারতীয়দের অধিকার স্বীকৃত; সেইসঙ্গে বলছে, “This right has to be excercised in a manner that is in conformity with public order, morality and health”! এই conformityর ব‍্যাপারটা খানিক কল্পিত ও ব‍্যক্তিবিশেষের বোধের উপর নির্ভরশীল, আর বাকিটা ধর্মীয়বোধের interpretation এর উপর নির্ভরশীল! ২৭ নং ধারা অনুযায়ী যে কোন ভারতীয়ের ধর্মের জন‍্য অর্থ (tax) দেওয়া স্বীকৃত হলেও বাধ‍্যতামূলক নয় – যেখানে প্রদত্ত অর্থ একটি বিশেষ ধর্মের উন্নতিকল্পে এবং তার খরচখরচা চালানোর জন‍্য ব‍্যবহৃত হয়। ২৮ নং ধারাটি অত‍্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। এখানে বলা আছে যে, সরকারের টাকায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কোন ধর্মীয় নির্দেশ দেওয়া যাবে না।
এই কটি অনুচ্ছেদই ধর্ম সম্পর্কিত। এগুলি ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, সংবিধান প্রণেতারা এগুলি তৈরী করেছিলেন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের কথা বিশেষভাবে মাথায় রেখে। অন‍্য ধর্মগুলি, বিশেষতঃ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত কোন রকম সাংবিধানিক বাধ‍্যবাধকতা রাখা হয়নি; তেমনই সাংবিধানিক অধিকারের কথাও বলা হয়নি! কারন মনে হয়, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের ও অন‍্য দুটি ভূখন্ডের ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে মাণ‍্যতা দেওয়ার কারনে সংবিধান প্রণেতাদের মাথায় ইসলামী ধর্মাবলম্বীদের জন‍্য ভারতীয় সংবিধানে rights and privilege এর ব‍্যাপারে কিছু বলা হয়নি – কারন তাদের জন‍্য ভারতভাগ করে আলাদা দুটি ভূখন্ড দেওয়া হয়েছিল। এগুলি এই মূহুর্তে যথেষ্ট স্ববিরোধী ও পক্ষপাতমূলক মনে হতে পারে।
এখন জনসংখ‍্যার নিরিখে ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ ইসলামী নাগরিকের বাস। পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র নেই যেখানে ৩০ শতাংশ কোন ধর্মের মানুষের বাস থাকলে তাদের ঐ দেশে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বলা হয়। আমাদের নির্বাচনী- গণতন্ত্রে ৪৯ শতাংশ মানুষ যদি কাউকে সমর্থন জানান তা হলেও তিনি পরাজিত হতে পারেন – এমনকি বিরোধী প্রার্থীর তুলনায় এক ভোট বেশী পেলেও একজন বিজয়ী হতে পারেন! এই সংখ‍্যার নিরিখে রাজনীতির গদির ফয়সলা হলেও এভাবে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বা সংখ‍্যাগুরু নির্বাচন করা যায় না। আমাদের সংবিধানে কোথাও ইসলামী মানুষদের ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বলা হয়নি – যা সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা তাদের দলীয় ও ব‍্যক্তিগত স্বার্থে চিহ্নিত করেছেন – এর কোন সাংবিধানিক বৈধতা নেই। হিন্দুরা যদি ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু হন, ইসলামীরা তাহলে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ধর্মীয় সংখ‍্যাগুরু।
ধারা ১৪ অনুসারে যে কোন নাগরিক ভারতে আইনের চোখে সমান। ধারা ১৫ নং অনুযায়ী নাগরিকদের মধ‍্যে ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত, লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম‍্য করা যাবে না। আবার ১৬ নং ধারা অনুসারে যে কোন নাগরিকের চাকরী ও জীবিকার ক্ষেত্রে সমান অধিকার! আর, সকল ভারতীয়ের ছটি মৌলিক অধিকার, যা অলঙ্খনীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় তা হল – বক্তব‍্য প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েতের অধিকার, সংঘ (association) গঠনের অধিকার, দেশের যে কোন স্থানে গমন ও বসবাসের অধিকার এবং নিজের পছন্দের আইনসিদ্ধ কর্মসংস্থানের অধিকার। এগুলি ১৯ নং ধারায় লিপিবদ্ধ আছে।
এবার যেটা লক্ষ‍্য করার বিষয় তা হল, ভারতের নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট মৌলিক অধিকার ও ধর্মাচরনের অধিকার – যা সংবিধানে স্বীকৃত – তা এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে নাগরিকদের কাছে অনেক সময়ই পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলির মধ‍্যে স্ববিরোধীতা – যার সুযোগে খন্ডিতভাবে একটি বা দুটি অনুচ্ছেদ ধরে তার ব‍্যাখ‍্যা করলে তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী!
যেমন, সকল ভারতীয়ের ধর্মাচরনের সমান অধিকার – সংবিধান স্বীকৃত। অথচ ধর্মাচরন ও তার সীমারেখা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। হিন্দুদের গণেশ চতুর্থী থেকে দূর্গাপুজা, কালীপুজা ইত‍্যাদির অধিকার যেমন স্বীকৃত, তেমনি ইসলামে মূর্তিপুজা নিষিদ্ধ – এমনকি মূর্তিপুজার বিরোধীতা করা জায়েজ! অর্থাৎ ইসলামীরা তাদের ধর্মীয় কারনে যখন হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙ্গে, পুজা পন্ড করে, তা তাদের ধর্মাচরণ! এটি কি করে সংবিধান স্বীকৃত হয়? হয়ত এইসব চিন্তা করেই মহম্মদ আলী জিন্না সকল ভারতীয় ইসলামীদের জন‍্য তাদের পাক-ই-স্তান (আল্লার স্থান) চেয়েছিলেন – যুক্তি ছিল, হিন্দু ও ইসলামী দুই পৃথক জাতিসত্বা হওয়ায় তাদের সহাবস্থান অসম্ভব। বাস্তবতা জিন্নার পক্ষে থাকলেও ভারতীয় হিন্দু নেতৃত্ব, বিশেষতঃ কংগ্রেসের নেহরু-গান্ধী এবং তাদের পরম্পরা ভারতের মধ‍্যে এই দুই ভিন্ন জাতিসত্বার সহাবস্থানের জন‍্য জোরজবরদস্তি করে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও সামাজিক অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে।
১৯৭৬ সালে জরুরী অবস্থার সুযোগ নিয়ে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ইতিহাসে বৃহত্তম, ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে দেশের মূল সাংবিধানিক কাঠামোটাকেই পাল্টে দিলেন। তাঁর অত‍্যধিক উচ্চাকাঙ্খা এবং অসার দম্ভ তাঁকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাঁর নির্বাচন বাতিলের রায়কে হজম করতে বাধা দেয়। তিনি সংবিধান সংশোধন দ্বারা সংবিধানে প্রদত্ত আদালতের অধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এই সময় তিনি তাঁর সোশালিষ্ট মনোভাবাপন্ন কিন্তু প্রকারান্তরে কম‍্যুনিস্ট মানসিকতার কাছের মানুষদের সাহায‍্য নিলেন। এরা সর্বদাই ভারত ও হিন্দুত্ব বিরোধী হওয়ায় এদের পরামর্শে শ্রীমতি গান্ধী ভারতীয় সংবিধানকে দুমড়ে মুচড়ে এক কিম্ভুতকিমাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে শেষ কথা বলার অধিকার শুধুই সংসদের ( সংসদীয় গণতন্ত্র নয়, শুধুই সংসদীয় সংখ‍্যাধিক‍্য নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র) শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হল! তিনি সংবিধানের প্রস্তাবণায় দুটি নতুন কথা সংযোজন করলেন – “সমাজতান্ত্রিক” ও “ধর্মনিরপেক্ষ”। তিনি ভারতকে “সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” ঘোষণা করলেন! একেই বলেছি – কিম্ভুতকিমাকার – কয়েকটি পরস্পরবিরোধী শব্দের সমাহার! প্রজাতন্ত্র যদি সমাজতন্ত্র হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক হয় কি করে? এমনকি চীন পর্যন্ত নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে না। তারা গণপ্রজাতন্ত্রী। দেশের সাধারন মানুষকে বোকা মনে করা একশ্রেণীর রাজনীতিকের লালসা ও নোংরা খেলার শিকার হতে হয়েছে দেশবাসীকে। কিছু রাজনীতিক পরিবারের তাৎক্ষণিক লাভ ও ভারতবিদ্বেষীদের দীর্ঘমেয়াদী লাভ ছাড়া এতে কারোর কোন উপকার হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কখনোই সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতা (socialist secular) থাকে না। আশ্চর্যের কথা, আমাদের দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থা কম‍্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এর অপব‍্যাখ‍্যা ছাড়া আর কিছু বলা হয় না। সুতরাং আমাদের দেশের সংবিধান এখন “সোনার পাথর বাটি”র মত এক অবাস্তবতার মোড়কে আবদ্ধ! এখানে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনে সংসদে সংখ‍্যাগরিষ্টের ভোটে দেশে যা খুশী তাই করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে ভারতীয় সংবিধানের বহু ক্ষেত্রেই স্ববিরোধীতার জায়গা তৈরী হচ্ছে। তার সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহল। যেমন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কাশ্মীরের বিশেষ অবস্থান দেওয়া ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ ধারা, যা শেখ আবদুল্লার সঙ্গে জওহরলালের কোন গোপন আঁতাতের ফল বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, তা সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়ায় ভারতের অখন্ডতার বিরোধী দলগুলি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সোচ্চার। আবার কাশ্মীরের সাধারন মানুষদের দারিদ্র‍্যে নিমজ্জিত রেখে তাদের শোষণের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনই তাদের দারিদ্র‍্যের সুযোগ নিয়ে তাদের ভারতবিরোধী শক্তির পুষ্টিকরনের জন‍্য ব‍্যবহার করা শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতে রাজনীতি করা কিছু রাজনৈতিক দলও সমানভাবে চালিয়ে গেছে। এই দলগুলির কারো উদ্দেশ‍্য ভারতের বিরোধীতা করা, আবার কারো উদ্দেশ‍্য – এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই!
ভারতের রাজনীতির স্তর অত‍্যন্ত নিম্নরুচির হওয়ায় রাজনীতিকরা সতত মিথ‍্যাচার করার সাহস দেখায়। সাম্প্রতিক একটি সংবাদে জানা যায় যে, সিপিএমের সাধারন সম্পাদক সীতারাম ইয়েচোরী বলেছেন, হিজাব ইসলামী মহিলার “সাংবিধানিক অধিকার”! এমন ডাহা মিথ‍্যা বলার দুঃসাহস মাত্র দুধরনের মানুষ করতে পারেন – এক, যিনি সবজান্তা ভাব দেখানো এক গন্ডমূর্খ; দুই, যিনি যাদের উদ্দেশ‍্য করে বলছেন, তাদের গন্ডমূর্খ মনে করেন। ইয়েচোরীর হিম্মত থাকলে সততার সঙ্গে এটি সংবিধানের কত ধারায় আছে তা উল্লেখ করতেন! আসলে উনি ভারতীয় সংবিধান না পড়ে এই ধরনের ‘জ্ঞান’ দেন। আবার কংগ্রেসের এক প্রাক্তণ মূখ‍্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া বলেছেন, ইসলামী মহিলাদের “মৌলিক অধিকার” নাকি হিজাব পরিধান করা! ২০১৭ সাল থেকে চীন, উত্তর কোরিয়ায় হিজাব নিষিদ্ধ। ইরানের ইসলামী মহিলারা হিজাবের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। সেখানে তথাকথিত নীতি পুলিশের হাতে ৮০০ র বেশী আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। মনে হচ্ছে সীতারাম আর সিদ্ধারামাইয়ারা ভারতে ইসলামের নীতি পুলিশের ভূমিকা নিচ্ছেন! ইওরোপ ও আমেরিকায় হিজাবের বাধ‍্যবাধকতা নেই – নেই সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতেও। তবু এখানকার অর্ধশিক্ষিত, ধান্দাবাজ, ভারতবিরোধী কিছু রাজনৈতিক নেতারা শুধু জেহাদীদের তুষ্টিকরনের জন‍্য এমন নির্জলা মিথ‍্যা বলে জনমানসে উপহাসের পাত্র হচ্ছেন। এরা কিসের বাধ‍্যতায় এমন মিথ‍্যাচার করছেন তা বোঝা দায়।
যাই হোক, সংবিধানের জায়গা থেকে ভারতের অখন্ডতা রক্ষা, বিভিন্ন ধর্মীয় ও অন‍্যান‍্য সংরক্ষণ নীতির কারনে সমাজে যে বৈসম‍্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তা শুধরে নেওয়ার জন‍্য সংবিধানের সংশোধন ও পরিমার্জন জরুরী।
দেশের সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতা”র কথা বলা হয়েছে। এটা কি? আমরা জানি লিঙ্গ ভিত্তিক সাধারনভাবে দুই প্রজাতি – পুরুষ ও স্ত্রী-জাতি। আর freak of the nature হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব – লিঙ্গনিরপেক্ষ। তেমনি ভারতের মানুষদের ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন। তবে freak of religion হতে পারে – ধর্মনিরপেক্ষ। হিন্দুধর্মে মানুষের ধর্মনিরপেক্ষতার কোন স্বীকৃতি নেই। ইসলামে, কোরানমতে ধর্মনিরপেক্ষতা হালাল অর্থাৎ গর্হিত কাজ। বাইবেলেও ধর্মনিরপেক্ষতার নিন্দা করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মাচরন করা, যা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার, কোন হিন্দু, ইসলামী বা খ্রীষ্টান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। সমাজে প্রচার করা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতা পালনের দায় শুধুই সনাতনী হিন্দুদের! সেজন‍্য একে বহু বছর ধরে “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা” বলে আসছি। কারন, ভারতীয় কম‍্যুনিস্ট ও অর্ধশিক্ষিত বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীকুল ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ইসলামী এলাকায় দূর্গাপুজা ও মন্দিরের সন্ধ‍্যারতির বিরুদ্ধে ; তারা কিন্তু মসজিদের আজানের বিরুদ্ধে নয় – সেটা নাকি ধর্মীয় অধিকার! তারা দূর্গামন্ডপে কোরান, বাইবেল রাখলেও মসজিদ বা গীর্জায় গীতা বা হনুমান চালিশা রাখার কথা ভুলেও বলেন না! সুতরাং এই “ধর্মনিরপেক্ষ”তার ব‍্যবহার সচেতনভাবে করা হচ্ছে শুধু একটি কথা মাথায় রেখে – ভারতে হিন্দুত্বকে ধ্বংস করা গেলেই তার অখন্ডতাকে বিনষ্ট করা যাবে – আর তাতেই গঙ্গাধর অধিকারীর তত্ত্বকে লাগু করা যাবে। কি সেই তত্ত্ব, যা ভারতীয় কম‍্যুনিস্টরা গ্রহণ করেছে? কম‍্যুনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা ও প্রাক্তণ জেনারেল সেক্রেটারীর এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভারত কোন রাষ্ট্র নয়, কিছু সার্বভৌম রাজ‍্যের সমষ্টি মাত্র! আবার “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” নাড়া লাগানো মানুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহুদিনের জিহাদী- কম‍্যুনিস্টের ঐক‍্যবদ্ধ জোটের প্রজেক্ট সফল করা যাবে!
অতয়েব, সাধু সাবধান। সাংবিধানিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে গুরুত্ব দেওয়া হোক – শুধুমাত্র দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও দায়িত্বে। গণতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পরিপন্থী বলে তার উপর লাগাম দেওয়ার আশু প্রয়োজন আছে।

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
সত‍্যি এমন দেশের জুড়ি মেলা ভার! এখানে দেশ বলতে কবির মতই রাজ‍্যকে বলছি। এমন রাজ‍্য এই দেশে কেন, পৃথিবী খুঁজেও দ্বিতীয় একটি পাওয়া যাবে না! শিক্ষকদের কাছে শিক্ষালাভের সময় শুনেছি, কোন দেশকে ধ্বংস করতে হলে যুদ্ধের মত সরাসরি অস্ত্রপ্রয়োগের পথে না গিয়ে অনেক কার্যকরী হচ্ছে, ঐ দেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ‍্য ব‍্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। এই দুটির অবর্তমানে অল্প সময়ের মধ‍্যে দেশ ধ্বংস হবে।
আজকে রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থার উদ্দেশ‍্য ও রাজ‍্যের শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করছি। একসময় দেশের শিক্ষা ব‍্যবস্থার মেরুদন্ড না হলেও মস্তিষ্ক ছিল এই রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা। কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয় ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থার অবমূল‍্যায়ন শুরু হয় সিপিএমের আমলে শিক্ষায় উৎকর্ষতার বিরুদ্ধে সিপিএমের সরকারের জিহাদ ঘোষণার সময় থেকে। স্মরণে আছে, একসময় আমরা কয়েকজন অধ‍্যাপক ডঃ অশোক মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ফ্ল‍্যাটে গিয়েছিলাম। আমাদের দলে স্বর্গীয় শৈবাল মিত্র, স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ ব‍্যানার্জী, পুলকনারায়ণ ধর ও সুব্রত পান্ডা ছিলেন। এই দলের কণিষ্ঠতম সদস‍্য ছিলাম আমি। সেদিনের আগের দিন ডঃ মিত্র জ‍্যোতি বসুর ক‍্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। ঐ দিন ডঃ মিত্র আমাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন – এরা (বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএম) মুড়ি,মিছরির একদর করে দিল! প্রেসিডেন্সী কলেজ আর গোবরডাঙ্গা কলেজ এক হল! দুই কলেজের প্রিন্সিপালের মাইনে সমান হল! এভাবেই বামফ্রন্টের শিক্ষানীতি ও তার প্রয়োগ নিয়ে ডঃ অশোক মিত্র তাঁর অভিমত ব‍্যক্ত করেন। সেই শুরু – শিক্ষায় মেধা, উৎকর্ষতার বদলে জায়গা করে নিল দলের প্রতি আনুগত্য। এই আনুগত‍্যের মাপকাঠিতে শিক্ষকতা চাকরী পাওয়া শুধু নয়, পদোন্নতি পর্যন্ত হতে লাগল! শিক্ষক নিয়োগে যোগ‍্যতা নয়, গুরুত্ব পেল আলিমুদ্দিনের শিক্ষা সেলের recommendation! তারপর, পুরো শিক্ষা ব‍্যবস্থাই সরকারী প্রশাসনের অধীনে থাকলেও রিমোট কন্ট্রোল দলের শিক্ষা সেলের নিয়ন্ত্রনে ছিল। নিয়োগ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চয়ন – পুরো কর্মকান্ডই অলিখিতভাবে দলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। একাধিক উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসির নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও একটা কথা বলা প্রয়োজন। সব কিছুই করা হত অতি সন্তর্পনে ও নীরবে দলের বিশ্বস্ত “কমরেড”দের পরিচালনায়! খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে মেধা দাম পেত – বিশেষতঃ শিক্ষকতা শুরু করার সময়। তবে প্রফেসর ও উপাচার্যদের চেয়ারে বসতে দলের recommendation ছিল আবশ‍্যিক। দলের সবুজ সংকেত ছাড়া কোন কলেজের প্রিন্সিপাল নিয়োগ না করার অলিখিত আদেশ ছিল! এভাবেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অবমূল‍্যায়ন শুরু হয়। আমরা একে “অনিলায়ন” (তখন অনিল বিশ্বাস দলের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী চেয়ার – জেনারেল সেক্রেটারী পদে আসীন) বলতাম। অনিলায়নের ফলে যা হল তার নির্যাস হল রাজ‍্যে শিক্ষার রাজনীতিকরন। এর ফলে রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। তার প্রভাব প্রত‍্যক্ষভাবে রাজ‍্যের ছাত্রসমাজের উপর এসে পড়ল। ছাত্র, শিক্ষক, সকলেই তখন কে কত বড় কম‍্যুনিস্ট, কে ‘আগমার্কা’ সিপিএম – তা প্রমাণ করতেই তাদের সব শক্তি নিয়োগ করত! অনিল বিশ্বাসের মৃত‍্যুর পরেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। তখন এই ব‍্যবস্থাই রাজ‍্যের শিক্ষায় “সিস্টেম” হয়ে গেছে! শিক্ষার অবক্ষয়ের সঙ্গে অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রেও জনসাধারণের অসন্তুষ্টির কারনে ২০১১ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়।
মমতা বন্দোপাধ‍্যায় ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সব দপ্তরের মন্ত্রীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাঁর নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে সচেষ্ট হলেন। যেসব মন্ত্রীরা শতকরা ১০০ ভাগ স্তাবকতা করতে রাজি হলেন না, তাদের ধীরেধীরে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারন করা হল। জনমানসে বার্তা গেল – দল ও সরকারে একটিই পোস্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোস্ট! ধীরে ধীরে নেতৃত্বের megalomaniac চরিত্রের পরিচয় প্রকাশ পেতে লাগল। সব বিভাগীয় মন্ত্রী, আমলারা তাদের সমস্ত নীতিগত এবং রুটিন মন্তব‍্য পর্যন্ত – “মূখ‍্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরনায়” বা “মমতা বন্দোপাধ‍্যায়ের অনুপ্রেরনায়” বলে উল্লেখ করা নিয়মের মধ‍্যে নিয়ে এলেন!
মূখ‍্যমন্ত্রীর বিভিন্ন কাজের মধ‍্যে যেমন দেখনদারি প্রকাশ পেতে লাগল, আসল কাজের ক্ষেত্রে তার সিকিভাগ কাজও অনেকক্ষেত্রেই হল না। যেমন, রাস্তাঘাট সারাই, বিভিন্ন স্তরের কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন‍্য বিভিন্ন নামের স্কীমের থেকে অনুদান দেওয়ার (বিভিন্ন “শ্রী” যুক্ত করা নামে) ঘোষণাকে রাজ‍্য সরকারের তরফে “উন্নয়ণ” বলে চালানো হতে লাগল। শিক্ষা ও চিকিৎসা – উভয় দপ্তরেই এর কোন ব‍্যতিক্রম হল না। অথচ এই দুই দপ্তর সম্পর্কে ধারনা না থাকলে এদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা দুঃসাধ‍্য। শিক্ষায় “উন্নয়ণ”এর সহজ রাস্তা চিনে নেওয়া হল – শুধু বাড়ি,ঘরদোর বানিয়ে বলে দেওয়া হল স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত খুলে দেওয়া হল! মনে হয় না কোন বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তাদের সুপারিশে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। বিশ্বভারতীর মত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক কিলোমিটারের মধ‍্যে “বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয়” খোলা হল! এর জন‍্য মনে হয় না কোন রকম বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তার সুপারিশ নিয়ে এসব হয়েছে।যে জেলায় মহিলা বিশ্ববিদ‍্যালয় খোলা হল, সেখানে তার যত না দরকার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী দরকার ছিল উত্তরবঙ্গে মহিলাদের জন‍্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলার। স্কুল, কলেজও একই পদ্ধতিতে খোলা হয়েছে। কারোর “অনুপ্রেরনা”য় শিক্ষা জগৎ চললে এমন হওয়াই ত স্বাভাবিক। অথচ এইসব শিক্ষাকেন্দ্রের অবকাঠামো (infrastructure) অতি সামান্য বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। শিক্ষা দপ্তরের এমন বাজেট নয় যে আগামী ত্রিশ বছরেও এইসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির যথাযথ অবকাঠামো তৈরী করা যেতে পারে। শুধু বাড়ি তৈরী করলেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী হয় না – অনেকগুণ বেশী অর্থ প্রয়োজন যথার্থ অবকাঠামো নির্মাণে। আবার অনেক জায়গায় রাজনীতির হাততালি কুড়োতে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া হয়েছে! বিশ্ববিদ্যালয় ও তার কাজকর্ম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা থাকলে এভাবে হাস‍্যকর “উন্নয়ণ”এর নামে শিক্ষাদপ্তরকে গৌরবান্বিত করার ধৃষ্টতা দেখানো যায় না। বিশ্ববিদ‍্যালয়ে উপাচার্য, কলেজে প্রিন্সিপাল ও স্কুলে হেডমাস্টারমশাই নিয়োগ করেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ‍্যমে শিক্ষার “উন্নয়ণ” ঘোষণা করা হয়!
যে রাজ‍্যে এত বেকার শিক্ষিত ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ার আছে, সেখানে প্রত‍্যাশিতভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কলেজ গুলিতে ছাত্রভর্তির হার মোটেই আশাব‍্যঞ্জক নয়। এমতাবস্থায় রাজ‍্যে যত্রতত্র ITI খুলে কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের সংখ‍্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিইবা করা যায়! রাজ‍্যে শিল্পস্থাপন হলে এবং ব‍্যবসা-বাণিজ‍্য বাড়লেই মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে ও সাথেসাথে রোজগার বাড়বে। তখনই শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হবে। এখন যেহেতু রাজ‍্যে সরকারী ও সরকার-পোষিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম, সেইসঙ্গে অনুদান নীতির ফলে রাজ‍্যের কোষাগার প্রায় শূণ‍্য, সরকারের পক্ষে নতুনকরে তার নীতি পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও রাজ‍্যের কর্ণধার তাঁর চারিত্রিক গুণের কারনে তাঁর নিজের নীতির থেকে বিচ‍্যুত হবেন না! তিনি গর্ব করে সংবাদ-মাধ‍্যমের কাছে বলেন, ক্ষমতায় আসার পর তিনি নাকি রাজ‍্যে পাঁচশ IIT তৈরী করেছেন! সারা ভারতে পঞ্চাশ কেন, তার অর্ধেক IIT নেই! হয়ত উনি IIT আর ITI এর তফাৎ করতে পারেননি! এভাবেই অনুপ্রাণিত শিক্ষাদপ্তর চলছিল। এক অভিনব পদ্ধতিতে এই দপ্তরের স্কুলস্তরের বিভিন্ন লেভেলে ‘শিক্ষক’ নিয়োগ চলছিল লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ের মাধ‍্যমে। আসলে সরকারের “সততার প্রতীক” ভাবমূর্তি রাখার উদগ্র কামনায় এই আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল এইসব নিয়োগে চরম দূর্ণীতির হদিশ পেয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদ্বয় অনুসন্ধান করে দেখে যে, দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ তাঁর দ্বারা এবং “অনুপ্রেরনা”র অনুমোদনে নিযুক্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা অর্থের বিনিময়ে যাকে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছে! মন্ত্রীসহ রাঘব-বোয়ালরা জেল হাজতে যেতেই থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল।
এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়া “কেন্দ্রের চক্রান্ত” বলার সুযোগ নেই; কারন এটি চলেছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং আদালতের তত্বাবধানে। আশ্চর্যের বিষয় – এই অনুসন্ধানের বিরুদ্ধে উচ্চতম আদালতে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বন্ধ করার আবেদন জানানো হয়েছিল – আদালত অবশ‍্য তাতে সাড়া দেয়নি। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এভাবে যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ও যারা তাদের সেটা করার সুযোগ করে দেয়, তারা শুধু শিক্ষা দপ্তরকেই কলুষিত করছে না, সেইসঙ্গে রাজ‍্যের ভবিষ‍্যৎ প্রজন্মকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই পাপ এক আধটা খুন করার চেয়ে অনেক ঘৃণ‍্য অপরাধ। সংবাদ-মাধ‍্যমের কল‍্যানে আমরা এই রাজনৈতিক চক্রের কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ‍্য জেনেছি। এখানে তার ব‍্যখ‍্যার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, যারা এভাবে অর্থ উপার্জনের পথ করে নিয়েছে, তাদের পশু বললে পশুদের পর্যন্ত অপমান করা হয়। কারন এরা জনগণের ভবিষ‍্যতকে নষ্ট করে রাজ‍্যকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শাসক কেন রাজ‍্যের শিক্ষা ব‍্যবস্থা ধ্বংস করতে চায় – সেটা সত‍্যজিত রায় তাঁর “হীরক রাজার দেশে” ছবিতে পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছাত্ররা শিক্ষা পেলে “মানে কম”! ফলে,”হীরকের রাজা ভগবান” শ্লোগান প্রশ্নের মুখে পড়বে! খেলা,মেলা, অনুদান থেকে দুয়ারে স্ফুর্তির নানাবিধ উপকরণ প্রশ্নের মুখে পড়বে! কোন একনায়ক, যিনি megalomaniacও বটে, কখনোই তা মানতে চাইবেন না। তাই আশা ছিল যে, উচ্চ আদাদালতের নির্দেশের পর রাজ‍্য সরকার তাদের ভুলত্রুটিগুলি শুধরে নেবেন; নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভন্ডামোতে নিযুক্ত, ঘুষ দেওয়া অযোগ‍্য ‘শিক্ষক’ নিয়োগের পুরো প‍্যানেলটাই বাতিল করে শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করবেন!
কিন্তু বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন‍্যরকম গন্ধ পাওয়া গেল। তিনি সংবাদ-মাধ‍্যমে জানালেন যে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁরা নতুনভাবে “যোগ‍্য” প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দেবেন। সেইসঙ্গে তিনি আরো বললেন, যারা আদালত নির্দেশিত ব‍্যবস্থায় চাকরী হারাবেন (যারা অসৎ উপায়ে ও উৎকোচের বিনিময়ে চাকরী পেয়েছেন) তাদের জন‍্যও সরকার চাকরীর ব‍্যবস্থা করবে! এমনিতেই সরকারের ভান্ডারে টাকা নেই; কর্মচারীদের ডিএ বন্ধ থেকে অনেক উন্নয়ণমূলক কাজ অর্থাভাবে বন্ধ। এমতাবস্থায় এই স্বীকৃত অযোগ‍্য এবং অসৎ মানুষদের চাকরীতে বহাল রাখার দায় কেন সরকারের? তাহলে কি সরকারের কর্তাব‍্যক্তিরাই চাকরী সংক্রান্ত অবৈধ লেনদেনে জড়িত? কিছু এমন বার্তা আসছে! এভাবে ঘরের ময়লা কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা কি শুধু ক্ষমতাশালী দোষীদের বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা? আবার এই অতিরিক্ত আর্থিক চাপ নেওয়া কি সরকারের পক্ষে সম্ভব? কারন, বেআইনী চাকরী পাওয়া শিক্ষকের সংখ‍্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে! এভাবে বাজেট বরাদ্দে প্ল‍্যান ও আনপ্ল‍্যান দুরকম বাজেটই গুবলেট হবে। ফলে, অর্থনৈতিক নৈরাজ‍্য ও সেইসঙ্গে সরকারের স্থায়ীত্ব প্রশ্নচিহ্নের মুখে পরবে।

কোভিড-১৯ ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা

কয়েকদিন আগে আমেরিকার ইমিউনোলজিস্ট ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসি (Anthony Fauci) একটি স্বাস্থ‍্য বিষয়ক আলোচনা সভায় বলেছেন যে, যদিও কোভিডের ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের দাপট অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে, তবু আগামী শীতে নাকি কোভিড-১৯ এর একটি নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট আসতে চলেছে! এটি নাকি সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভ‍্যারিয়েন্ট এবং সেইসঙ্গে এটি নাকি সমস্ত বাজার-চলতি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দেবার ক্ষমতা রাখে! তিনি আরো বলেছেন যে, ওমিক্রনের সাম্প্রতিক সময় জানা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.5, যা এই মূহুর্তে সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইন হিসেবে স্বীকৃত – তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.4.6 অনেক বেশী শক্তিশালী স্ট্রেইন হিসাবে ভ‍্যাকসিনের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে!
WHOর প্রতিবেদন অনুসারে, ওমিক্রনের Pango lineage ও তার পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের (BA.5 বা +R346X/+K444X বা +N450D বা +N460X) বিস্তৃত মনিটারিং চলছে। এর কারন, নতুন যেসব সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা যাচাই করা এবং তারা বাজার চলতি ভ‍্যাকসিনকে কতটা ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে – সেই শক্তি পরখ করা। এটি যে RNA ভাইরাস গত দুবছর ধরে বিশ্বত্রাস হয়ে উঠেছিল তার বিষয়ে রুটিন পরীক্ষা।
এক সময় একাধিক লেখায় জানিয়েছিলাম যে, SARS-Cov2এর মত RNA ভাইরাসের ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের মাধ‍্যমে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করা – যারা আবার নিজেদের সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করে। এগুলো ভাইরাসকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখার জন‍্য একান্ত প্রয়োজনীয়। survival of the fittest তত্ত্ব অনুসারে এভাবে পরবর্তী পর্যায়ে যে ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়, তাদের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধির চেষ্টায় কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস সাফল‍্য পেতেই পারে। কিন্তু প্রাথমিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই স্থায়ীত্ব যে মানবদেহে অধিকতর ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম – সে কথা বলা যায় না। আরেকটি ব‍্যাপার, যা সব ইমিউনোলজিস্টের জানা – যদি কোন RNA ভাইরাস তার প্রাথমিক গঠন-বিন‍্যাস ঠিক রেখে পরিবর্তিত জিন মিউটেশান করে, তাহলে ভ‍্যাকসিন তার মডিফায়েড ফর্মে এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এছাড়া আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্য মাথায় রাখা প্রয়োজন – তা হল, গোষ্ঠী-সংক্রমণ হলে ধীরে ধীরে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (herd immunity) তৈরী হয়ে যায়। সমাজে যদি লক্ষণবিহীন ও লক্ষণযুক্ত মানুষের মোট সংখ‍্যা বৃদ্ধি পায় তবে একসময় মানুষের মধ‍্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আক্রান্তের সংখ‍্যা দ্রুত কমে যায়। আমাদের দেশে ঠিক এটাই হয়েছে। সেইসঙ্গে ভাইরাসের কাবু করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এর দুটি কারন – ভ‍্যাকসিনের প্রভাব এবং গোষ্ঠী-সংক্রমণের কারনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হওয়া।
RNA ভাইরাসের ধর্ম অনুযায়ী SARS-Cov2 এর যত ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, তার মারণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হবেই। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে যে, এখন ভাইরাস নিজে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সে এও জানে, তার মানব-দেহে মারণ-ক্ষমতা বাড়লে তার ধ্বংসও ত্বরান্বিত হবে। সেজন‍্য, এই ধরনের ভাইরাসের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এরা যেমন পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে নির্মূল হবে না, তেমনি নিষ্ক্রিয় (dorment) অবস্থায় কোন প্রাণীদেহে আশ্রয় নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করবে। এই মূহুর্তে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের আক্রমণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী। সুতরাং মূল ভাইরাসের যত ভ‍্যারিয়েন্টই আসুক না কেন, জীবদেহে তার বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়লেও মানবদেহে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা নষ্ট হবেই।
এভাবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট বা তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে “আবার অতিমারীর করালগ্রাস ফিরে আসছে” – বলার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। WHO শুধু বলেছে, ভয়ের কিছু নেই; আমরা সতর্ক থাকব এবং গবেষণা চলতেই থাকবে। মানুষকে অযথা ভয় পাইয়ে দেওয়া অমূলক। এ বিষয়ে পৃথিবীব‍্যপী সংবাদ-মাধ‍্যমের ভূমিকা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন সংখ‍্যাতত্ত্বের মাধ‍্যমে অর্ধসত‍্যকে উপস্থাপিত করা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির কাজ নয়। এটা ঠিক যে, WHO নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যেতে বলেছে এবং সেইসঙ্গে অযথা ভয় ও লকডাউনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় কোন একটি বা দুটি গবেষণার খন্ডিত তথ‍্য প্রকাশ করে মানুষের মনে ভয় ধরানো উচিত নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে দেখেছি যে, SARS-Cov2এর শুরু থেকেই শীত বা গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম‍্যের উপর আক্রান্তের সংখ‍্যা বা আক্রমণের তীব্রতা নির্ভর করেনি। এমন উচ্চ জনঘণত্বের দেশে ভাইরাসের আক্রমণের শুরুর দিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ‍্যা দ্রুত বাড়ার সঙ্গে সমাজে লক্ষণবিহীন আক্রান্তের সংখ‍্যাও বাড়ছিল। তার একটি ভালো ফল হল, ভারতে দ্রুত গোষ্ঠী-সংক্রমণ হওয়ায় দ্রুত গোষ্ঠী-অনাক্রম‍্যতা (herd immunity) তৈরী হয়েছে। তারপর যখন ভ‍্যাকসিন নেওয়া শুরু হল, এই জোড়া ফলার আক্রমণে কোভিড ভাইরাস অতি দ্রুত তার মারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এই কথাই বলছে। ১০ই অক্টোবর, ২০২২এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ১৯৯৭ জন আক্রান্ত আছেন আর এক সপ্তাহে দেশে ৯ জনের কোকোভিডে মৃত‍্যু হয়েছে যার ৩ জনই কেরলে। দেশে দূর্ঘটনায় মৃত‍্যুর সংখ‍্যাও এর থেকে অনেক বেশী। অথচ, ভারতে কোভিড-১৯এ মোট আক্রান্ত ৪,৪৬,১৪,৪৩৭, যার মধ‍্যে মৃত ৫,২৮,৮১৪। অর্থাৎ আক্রান্তদের শতকরা ৯৯% সুস্থ হয়ে গেছেন; শুধু ১% এর মৃত‍্যু হয়েছে। অথচ, দেশে ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির সময় মৃতের সংখ‍্যা মোট আক্রান্তের ২.৫% হয়েছিল; তার বেশী কখনোই হয়নি। এখন যে জন‍্য নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত কোভিড-১৯ অতিমারীর ভীতিপ্রদ সংক্রমণ ও প্রাণঘাতী আক্রমণ থেকে মুক্ত হবার মুখে।
এই সময় সাধারণ মানুষকে যেমন অন‍্যান‍্য বায়ুবাহিত রোগকে ধরে, সাধারণ মানুষকে যেমন স্বাস্থ‍্যবিধি মেনে চলতে হবে তেমনি সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা ও ভিড়ের মধ‍্যে মাস্কের ব‍্যবহার এবং যথার্থ স‍্যানিটাইজেশান নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে। তবে, অর্থনীতি ও সমাজজীবনের সুস্থতা মাথায় রেখে অযথা বাধানিষেধ আরোপের কোন প্রয়োজন নেই। এরপর যে কথাটা বলা জরুরী তা হল, নতুন সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট, যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে তা নাকি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম – সেটি একদম ভুল কথা। কারন RNA ভাইরাস যখনই ভ‍্যাকসিন-নিষ্ক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পরিবর্তিত জিন মিউটেট করবে, তার নতুন স্ট্রেইন শণাক্ত করে ভ‍্যাকসিনের উন্নতিকরণ (up-gradation) করে তাকে ধ্বংস না করার কোন বিজ্ঞানসম্মত কারন নেই। তাই, ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসির বক্তব‍্যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র সদা সতর্ক থেকে ভ‍্যাকসিনের সব রকম উন্নতির মাধ‍্যমে কোভিড-১৯কে আয়ত্বে রাখা সম্ভব। যেহেতু এই RNA ভাইরাস জীবদেহের আশ্রয় ছাড়া বেশীক্ষণ বাঁচে না, এরা ভবিষ‍্যতে মানবদেহে সুবিধা করতে না পেরে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে যেতে অন‍্য কোন জীবদেহে অক্ষতিকর ঘুমন্ত (dorment) অবস্থায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। এই মূহুর্তে এটি অনুমান নির্ভর বৈজ্ঞানিক ব‍্যাখ‍্যা মাত্র। তবে একটি কথা নিরদ্বিধায় বলা যায়, মানব সমাজে ত্রাস সঞ্চার করার ক্ষমতা এই একদা মারণ ভাইরাসের আজ আর নেই। বিশেষভাবে ভারতের মত অতি জন-ঘণত্বের দেশে তার ক্ষমতা নিঃশেষিত। আমরা যদি ভ‍্যাকসিন উন্নয়ণ ও সাধারণ স্বাস্থ‍্যবিধি মানার ব‍্যপারে চরম ঔদাসিন‍্য না দেখাই, তবে আমাদের দেশে কোভিড-১৯এর ফিরে আসার সম্ভাবণা নেই।
এত কথার পরেও বলার আছে যে দেশের কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম এই ধরনের খবর প্রচার করছে! তার কারন হল, এই দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির সামাজিক দায়িত্ব-বোধ সম্পর্কে ধারনা পরিষ্কার নয়। তাদের টিআরপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুনাফা ছাড়া আর কোন চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ফলে শুধু সংবাদ পরিবেশনে মানুষকে আকৃষ্ট করা ছাড়া এরা সংবাদের বিস্তৃত বিশ্লেষণে বিশেষ প্রবেশ করে না। এক্ষেত্রে এমন অর্ধসত‍্য সংবাদ পরিবেশনে মানুষ কৌতুহলী হবে এবং তাদের মনে ভয়ের সঞ্চার হলে তাদের থেকে যে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া হবে – তার থেকে কতিপয় ব‍্যবসায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতারা উপকৃত হবে। মনে পড়ে, লকডাইন পর্যায়েও এমনটা হয়েছিল।
তাছাড়া, এ ধরনের সংবাদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভারতের মত বিপুল জনবহুল দেশে মারাত্মক হতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয়স্তরেই বিরোধী দলগুলি যেমন সরকারের অহেতুক সমালোচনা করার সুযোগ পাবে, তেমনি অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।
দেশের বিভিন্ন কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলিতে কোভিড আক্রান্ত রোগীর ক্রমহ্রসমান সংখ‍্যার কথা মাথায় রাখলে বোঝা যায় যে, এই ভাইরাসের দেশ থেকে বিদায় নেবার সময় চলে এসেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথায় বলা যায়, এখানে আর কোন কোভিড আইসোলেশান সেন্টার নেই। সব হাসপাতালের কোভিড ইউনিট রোগী না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত সাতদিনে রাজ‍্যে নতুন কোভিড রোগীর সংখ‍্যা শূণ‍্য। সুতরাং এখানে কোভিড-১৯ বা তার কোন ভ‍্যারিয়েন্ট বা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট,যারা একই গঠনের মধ‍্যে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানে জন্ম নিয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করার জন‍্য ভ‍্যাকসিন ও হার্ড ইমিউনিটির যুগলবন্দীই সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে। কিন্তু যদি বেসিক গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কোন RNA ভাইরাস আক্রমণ করে তবে তখন ভ‍্যাকসিন কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ না হয়ে নতুন কোন নামের হবে। এখনো অবধি এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সুতরাং ভয় পাইয়ে দিয়ে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা অর্থহীন। সাবধানের মার নেই – প্রবাদকে মনে রেখে মাস্ক ও স‍্যানিটেশানের সঠিক প্রয়োগ যথেষ্ট। সেইসঙ্গে ভ‍্যাকসিনের বুস্টার ডোজ যতবার আসবে তা গ্রহণ করাই ঠিক। এইভাবে গবেষণার খন্ডহার উপস্থাপনা সংবাদ-মাধ‍্যমের টিআরপি বাড়ানোর প্রানপণ চেষ্টা বলেই মনে হয়।

তৃতীয় লিঙ্গের তোলাবাজি কি প্রশাসনের মদতে

গত দশ বারো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এক উপদ্রব নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এই উৎপাত যেহেতু একবার একটি পরিবারের উপর সীমাবদ্ধ থাকে, সেজন‍্য এর সামাজিক প্রভাব সীমিত – তাই এ নিয়ে সংবাদ করলে সংবাদ-মাধ‍্যমের টিআরপি বাড়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই! তবে দিন দিন যেভাবে তৃতীয় লিঙ্গের (যাদের সাধারনভাবে হিঁজরে বলা হয়) সংগঠিত তোলাবাজি বেড়ে চলেছে,বিশেষতঃ প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং অবশ‍্যই পুলিশী উদাসীনতায় – তার দায় সরকারের অস্বীকার করার উপায় নেই।
ঝাড়গ্রামের রাধানগর অঞ্চলের একজন ড্রাইভার চন্দন খিলারের স্ত্রী তনিমার জমজ পুত্রের জন্মের পরে শিলদা হাসপাতালের নিও-নাটাল কেয়ারে শিশুদুটিকে একমাস রাখার পর তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তার দিন কুড়ি বাদে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দল বেঁধে এসে ঐ পরিবারের কাছে ১২ হাজার টাকা দাবী করে। চন্দনের পরিবার তাদের অপারগতার কথা জানালে তারা গালাগালের সঙ্গে বিস্তর দরাদরি করে। অবশেষে তারা ২ হাজার টাকায় রফা করে। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও শিশুদুটিকে নিয়ে উদ্দাম নাচানাচি করতে থাকে। তার ফলে দুটি শিশুর মধ‍্যে সুমন নামের একটি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ঐ দলটি শিশুদের ফেরৎ দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করে। শিশুটিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিলদা হাসপাতালে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় পাড়ার লোকজন ঐ দলের তিনজন হিঁজরেকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। চন্দনের FIRএর ভিত্তিতে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। তদানীন্তন এসপি ভরতকুমার রাঠোর পদক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের কোন শাস্তির কথা জানা নেই।
আবার বেহালায় এক পরিবার পুলিশে নালিশ জানায় যে, ঐ বাড়িতে নবজাতক শিশুর জন‍্য তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ দল বেঁধে এসে চারমাসের মধ‍্যে দ্বিতীয়বার ২১ হাজার টাকা দাবী করে! যদিও বাড়ির মানুষরা জানান, তাঁরা আগে একবার টাকা দিয়েছেন, তবু তারা হিঁজরেদের দেওয়া ‘কার্ড’ দেখতে চায়! ঐ কার্ড ঐ মুহূর্তে বাড়ির লোকে কাছে ছিল না। হিঁজরেরা ঐ মুহূর্তে বাড়ির সামনে অসহনীয় চেঁচামেচি ও গালাগাল করতে থাকায় ঐ পরিবার ঠাকুরপুকুর থানায় অভিযোগ জানিয়ে বলে, ঐ গোলযোগের সময় তারা ১০০ ডায়াল করেও কোন রকম রেসপন্স পাননি! তারপর ঐ পরিবার কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে অভিযোগ জানালে তারা জানায় যে, অভিযোগটি ঠাকুরপুকুর থানায় পাঠানো হয়েছে, কারন ঘটনাটি ঘটে ঐ থানার ‘এলাকায়’! ব‍্যাস, ঐ পর্যন্তই। তারপর এই কেস নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ‍্য শোনা যায়নি!
এরপর আসি অতি সাম্প্রতিককালের বিধাননগর থানা এলাকার ঘটনায়। সেখানে বিবাহিত কন‍্যা তার মেয়ের জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে পিত্রালয়ে আসে। শিশুটির জন্মের একমাসের মধ‍্যে একদল হিঁজড়ে এসে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে! তারপর যখন তারা বাড়িটি শিশুর মামাবাড়ি বলে জানে, তখন বিস্তর দর কষাকষির পর ১৬ হাজার টাকা, সঙ্গে নতুন কাপড় নিয়ে একটি কার্ড দিয়ে চলে যায়। ঐ ছাপানো কার্ডে লেখা ছিল, ঐ অঞ্চলের টাকা নেওয়ার দায়িত্ব ঐ ইউনিয়নের! তাদের এলাকাও চিহ্নিত ছিল! এই ঘটনার মাসখানেক বাদে আবার পরপর দু সপ্তাহ হিঁজরেরা ঐ বাড়িতে আসে এবং আবার টাকা দাবী করে! তাদের যখন বলা হয় যে, তাদের দেওয়া কার্ড আছে – তখন প্রথমে তারা চলে গেলেও পরের সপ্তাহে আরো বড় দলে হাজির হয়ে ঐ কার্ড দেখতে চায়! কার্ড জানালার ভিতর থেকে দেখানো হলে তারা বারবার কার্ডটা তাদের হাতে দিতে বলে! যখন তাদের বলা হয়, কোন পরিস্থিতিতেই তাদের হাতে কার্ড দেওয়া হবে না, কারন তাদের টাকা দেওয়ার একমাত্র প্রমাণ ঐ কার্ড, তখন হটাৎ তারা সুর বদল করে ধমকের সুরে বলতে লাগল, ঐ কার্ড জাল! সেজন‍্য তাদের আবার টাকা দিতে হবে। তারা বাড়ির গেট আটকে অকথ‍্য চেঁচামেচি শুরু করলে যখন তাদের পুলিশের কথা বলা হল, তারা বলল, পুলিশ নাকি তাদের কথায় চলে! তারপর টাকা না পাওয়ায় তারা তোলাবাজির পরিমাণ আরো বাড়ানোর দাবী করে!
এমন ধমক-ধামক ঘন্টাখানেক চলার পর তারা লক্ষ‍্য করে যে বাড়িটি cctv কভারেজে মোড়া। তারা বুঝতে পারে যে তাদের বক্তব‍্য ছবিসহ রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তখন তারা পায়ে পায়ে নিজেদের পথ দেখে।
মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হল। এমন অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে। কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের থেকে সদর্থক পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানা নেই। এমনকি, কলকাতায় ট্রাফিক সিগন‍্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে পরলে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন গাড়ির কাঁচে বা গাড়ির গায়ে ধাক্কা মেরে টাকা চায়। না পেলে অনেক সময় গালাগাল পর্যন্ত করে। এইসব ঘটছে ২০১১ সাল থেকে।
এই অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে পুলিশী পদক্ষেপ না করার কারন অবশ‍্যই ভীতি। অনেক সময় এরা দলবদ্ধভাবে থানা ঘেরাও করে – মারমুখী হিঁজরেদের উপর বড়সড় পদক্ষেপ করতে মনে হয় পুলিশের উপর কোন অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
এইসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ইউনিয়ন আছে। তাদের নেতা/নেত্রীর বক্তব‍্য হল, তারা বেঁচে থাকার জন‍্য এই টাকা নাকি বাধ‍্য হয়ে তোলে! আমাদের রাজ‍্যে এদের উপার্জনের কোন ব‍্যবস্থা রাজ‍্যের সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এখানেই রহস‍্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কারন, অন‍্য অনেক রাজ‍্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উপার্জনের জন‍্য একাধিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে।কিন্তু এখানে এধরনের কোন পরিকল্পনার কথা জানা নেই। সাধারণ মানুষের একটি অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – এদের বিকল্প উপার্জন নেই বলেই তারা তোলাবাজি করবে, জোর করে টাকা নিয়ে যাবে, গায়ের জোর দেখিয়ে অসভ‍্যতা করবে – আর রাজ‍্যের পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে! এটা আর যাই হোক, সুশাসনের পরিচয় নয়।
একটি অসমর্থিত খবর হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ‍্যা গত ২০১১ সালের পর অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের সকলের ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড আছে কি? কারন, শোনা যায় যে এদের একটি বড় অংশ নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে! এরা সাধারনত দুটি পদবী ব‍্যবহার করে – ‘মন্ডল’ ও ‘হালদার’। নাম দিয়ে এদের ধর্ম বোঝা যায় না। এরা যদি চোরাই পথে ভারতে আসা বাংলাদেশী হয় এবং এদের এই রাজ‍্যে ভোটার বানিয়ে এমন তোলাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তার দায় অবশ‍্যই বর্তমান প্রশাসন ও শাসকদলের উপর বর্তায়। যে ভাবে বিভিন্ন ‘তোলাবাজি’র ব‍্যবসায় শাসকদলের নেতৃবৃন্দ ধরা পরছেন, এই তোলাবাজিও শাসকের প্রশ্রয়ে হচ্ছে কিনা – সে বিষয়ে জনমানসে সন্দেহ জাগতেই পারে। এখানে একটি পরিসংখ্যান বোধহয় প্রাসঙ্গিক – ভারতের বিভিন্ন কারাগারে যত বিদেশীরা বন্দী আছে তার মধ‍্যে এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী। এর মধ‍্যে সর্বাধিক বন্দী পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলিতে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশী, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সন্দেহ হওয়ার আরো একটি বড় কারন হল, এই জনগোষ্ঠীর উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা রাজ‍্য প্রশাসনের দায়িত্ত্ব হলেও তারা এ ব‍্যাপারে চরম উদাসীন।ফলে এদের বিভিন্ন রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজের নৈতিক দায় যেমন রাজ‍্য প্রশাসনের উপর বর্তায়, তেমনি এদের তোলাবাজির থেকে কাটমানির আমদানির ব‍্যাপারটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার “দুধেল গাই” বাহিনীর সম্প্রসারিত রূপে এই বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলেও মনে হতে পারে। যাই হোক, সরকারি মদতে বা নিষ্ক্রিয়তায় সাধারন মানুষের উপর এভাবে অত‍্যাচারের অধিকার এই গোষ্ঠীকে দেওয়া যায় না। যদি এদের উন্নয়ণের জন‍্য সরকারের সদিচ্ছা থাকে, বেশ কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন‍্য বিভিন্নভাবে যে সব NGO সাহায্য করছে, সেইসব NGOর মাধ‍্যমে রাজ‍্য সরকার এদের উপার্জনক্ষম করার পরিকল্পনা নিতে পারে। আসলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, নইলে নয়। এদের এভাবে একটি ক্রিমিনাল গোষ্ঠী হিসেবে রেখে দিলে হয়ত শাসকের অনেক গোপন বেআইনী কাজের সুবিধা হতে পারে – কে জানে, এখানে অনুসন্ধান করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে কিনা!
একটি comprehensive স্কীম করে এগোতে গেলে প্রথমেই যা দরকার, তা হল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন‍্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ – অবশ‍্যই বিশেষ ক্ষেত্রে তা প্রযোজ‍্য। এছাড়া, জনগণনার সময় সংখ‍্যার বিচারে এদের স্থানভিত্তিক উপস্থিতির রেকর্ড প্রশাসনের কাছে থাকা আবশ‍্যিক। আধার কার্ডে লিঙ্গ উল্লেখিত থাকলে তার রেকর্ড সরকারের কাছে না থাকার কোন কারন নেই। কাজেই এদের পরিচয়ের রেকর্ড থাকার ব‍্যাপারে ধোঁয়াশা নেই। এখন, সবকিছু নির্ভর করছে প্রশাসনের সদিচ্ছার উপর। গত এগারো বারো বছর ধরে যা চলছে তাতে এমন ধারনার যথেষ্ট কারন আছে যে, এদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কোন সদিচ্ছা রাজ‍্য সরকারের নেই। প্রথমতঃ এদের মধ‍্যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী থাকলে তার প্রাথমিক সনাক্তকরণের দায় সরকারের। দ্বিতীয়ত এদের থেকে তোলাবাজির কাটমাণি পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চাওয়া – হতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ‍্য – কাটমানি শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের ধারেকাছে অন‍্য কোন রাজ‍্য আসতে পারবে না। আরেকটি কথা, এই হতভাগ‍্য মানুষগুলিকে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যেমন বদ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, তেমনি এদের ভোটপ্রক্রিয়ায় সুবিধাজনকভাবে ব‍্যবহার করা যায়। সেকথা মাথায় রেখেই ২০১১ সালের পর থেকে এদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি করতে দেওয়া হয়েছে। State sponsored hooliganism এর যে কটি মুখ আছে, তার একটি অন‍্যতম মুখ এদের দৌরাত্ম্য এবং তা দমন করা দুরে থাক, পুলিশী নিষ্ক্রিয়তা এবং তার সমর্থনে হাস‍্যকর যুক্তির অবতারণা করা এই অভিযোগকেই মাণ‍্যতা দেয়।
সারা পশ্চিমবঙ্গে যত শিশু জন্মাচ্ছে, তাদের প্রত‍্যেকের জন‍্য মায়ের পিত্রালয় ও শ্বশুরালয় থেকে তোলার পরিমাণ হিসাব করলে বছরে বহু কোটি টাকার এই ব‍্যবসায় যে কাটমানিচক্র থাবা বাড়াবে – তা অনুমান করা শক্ত নয়। এই অত‍্যাচার বন্ধ করে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের সুস্থ জীবন ও জীবিকার সুলুক-সন্ধান দেওয়া রাজ‍্য সরকারের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তা না করে এদের ব‍্যবহার করে কাটমানির লোভে সমাজ জীবন বিপর্যস্ত করা সুপ্রশাসন ও সুস্থ মনের পরিচয় নয়। ভারতের অন‍্য অনেক রাজ‍্যে এদের জন‍্য ভালো ভালো পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাতে কোন হেলদোল নেই! এমনটি কার স্বার্থে করা হচ্ছে তার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব রাজ‍্য সরকারের।