আমরা আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে কেউ উচ্ছসিত হই, কেউবা আবার তীক্ষ্ণ সমালোচনায় তাকে বিদ্ধ করি। কিন্তু সবাই একটি ব্যপারে একমত যে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসিত হয়। আবার ভারী অদ্ভুত লাগে, যখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জিজ্ঞেস করা যায় যে এই গণতন্ত্র কি তা ব্যখ্যা করুন ত! আমি নিশ্চিত যে বিভিন্ন উত্তর ৩৬০ ডিগ্রি কোনেই বিস্তৃত থাকবে। আজ অব্দি গণতন্ত্রের কোন সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা পাওয়া গেল না। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল মানুষকে মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য লাঠিপেটা করার প্রক্রিয়া”। আবার জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল কিছু অসৎ ব্যক্তিকে অনেক অপদার্থ মানষ দ্বারা চয়নের প্রক্রিয়া”। যদিও উক্তি দুটিকে cynical বক্তব্য হিসেবে নস্যাৎ করা যায়, তবুও আজকের দিনে এর যথার্থতাকে অস্বীকার করা যায় কি? উইনস্টন চার্চিল একবার গণতন্ত্র সম্বন্ধে বলেছিলেন, “it is the worst form of government”। গণতন্ত্র কথাটির মধ্যেই স্ববিরোধীতা লুকিয়ে আছে।
সেটি ব্যখ্যা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে গণতন্ত্রে সবাই সমান! তা হলে রাজনীতিকদের নেতা হয়ে কি লাভ হবে! মানুষের মনে রাজা-প্রজা সম্পর্কের ব্যপারটা আমাদের DNAতে আছে। সুতরাং ruler আর te ruled কখনো সমান হতে পারে না। জর্জ অরওয়েলের Animal farm এর পশুর মনুষ্যত্বে অবনমনের গল্পের animal এর জায়গায় মনুষ্যরূপী ভোটারদের সম্পর্কে বলা যায়, in democracy, all are equal; but some are more equal than other equals! রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভোট করায়ত্ব করার উদগ্র কামনার মধ্যেই গণতন্ত্রকে পদদলিত করার লক্ষণ নিহিত আছে। এখানে কার্ল মার্কসের রচনার যে central pillar – দ্বন্দ মূলক বস্তুবাদ, এর সমর্থকরা কি করে গণতান্ত্রিক হলেন তা বোধহয় কেউ বলতে পারবেন না। হেগেলকে সম্পূর্নভাবে সমর্থন না করেও এটুকু বলাই যায় যে মানুষের ‘মন’ সর্বদা বিপরীতধর্মী বস্তুবাদের মধ্যে নিজের স্বার্থ অনুসারী পন্থা গ্রহণ করে। আর এই মানসিকতাই গণতন্ত্রকে একটি তরল তত্ত্ব (fluid concept ) হিসেবে উপস্থাপিত করেছে – অর্থাৎ গণতন্ত্র নামক সিস্টেমটির কোন রূপরেখা নেই। যে দেশে, যে সমাজে ক্ষমতাশালীদের যেভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বা দখলের লড়াই করা হয়, সেই দেশে, সেই সমাজে সেটাই গণতন্ত্র!
আমেরিকায় গণতন্ত্র নেই – এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু সে দেশে plural voting system আমাদের দেশে গ্রহণ করলে বলা হবে গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রা হল! প্রথমে Plato বর্ণিত ও তারপরে Jason Brennan সহ অনেকের সমর্থিত selective voting right of wise একদিক দিয়ে বিচার করলে ভালো ; আবার আরেকদিক দিয়ে সমালোচনাযোগ্য। যে দেশ ৭০ বছরের উপর স্বাধীন রাষ্ট্র সেখানে প্রার্থীর নামের পাশে প্রতীক দেখে ভোট দেওয়াতে কি সত্যিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিফলন দেখায়? বরঞ্চ অনেকটা বামপন্থী oligopolystic control পদ্ধতির প্রতিফলন দেখায় – নাম তার পলিটব্যুরো, হাইকমান্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব – যাই হোকনা কেন। আর এখানেই গণতন্ত্রের সার্থকতা ও ব্যর্থতা দুইই নিহিত আছে।
সত্যি কথা বলতে কি – গণতন্ত্র, যেখানে সকল নাগরিকের দেশ শাসনে যোগদানের অধিকার স্বীকৃত আছে, তা কিন্তু আবহমান কাল থেকে চলে আসা “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা”র রকমফের মাত্র। বিশদে ব্যখ্যা করা যাক। যেমন ধরুন সব নাগরিকের ভোটদানের অধিকারের মধ্যেও আঠারো বছর বয়সের কম হলে বা পাগল হলে তাদের ভোটাধিকার থাকে না। যুক্তি হিসেবে বলা হতে পারে যে তাদের সঠিক বিচারবোধ নেই। আবার যে মানুষটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধুমাত্র প্রতীক চিহ্ন দেখে ভোট দিচ্ছেন তাঁর সঠিক বিচারবোধ আছে ত! যাকে তিনি ভোট দিচ্ছেন তার যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে শুধুমাত্র দলীয় প্রার্থী বিচারে তিনি ভোট দিচ্ছেন। এর থেকে যুক্তিযুক্ত হল epistocracy (যা একমাত্র শিক্ষিত ও ওয়াকিবহাল মানুষদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়)। আমরা যখন রাজনীতির কথা বলি তখন দেশের সাধারণ মানুষের উপর ‘রাজ’ করার জন্য যে ‘নীতি’ (ছলে, বলে, কৌশলে) তার কথা বলি। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ ছলনার কথা স্বীকার করে না। আবার মার্কসীয় নীতির অনুসরনকারী রাজনীতিকরা যখন শোসিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্য সামাজিক লড়াই করেন তখন সেটা প্রশংসনীয়। তারপর ‘havenots’ থেকে কিছু পেয়ে যখন মানুষ ‘have’ হয়ে গেলেন, তখনই সর্বহারার মানসিক পরিবর্তনে তিনি ‘বুর্জোয়া’ হয়ে গেলেন। সোজা উদাহরণ – অফিসে ডিএ বাড়ানো, মাইনে বাড়ানোর আন্দোলনে শামিল বামপন্থী মানুষ বাড়িতে কাজের পরিচারিকার দশ, বিশ টাকা মাইধে বাড়ানোর তীব্র বিরোধীতা করেন। এইটি শুধু বামপন্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবনতা।
একই রকমভাবে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা থেকে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রন করার ফন্দি ফিকিরের মধ্যেই গণতন্ত্রের কন্ঠরোধের মত কার্যক্রম নিহিত থাকে। ফলে, নামে গণতন্ত্র হলেও manipulative democracy এখন কালের নিয়ম। দলভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি অনুসারে এই ধরনের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি একমাত্র পথ। কারন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণতঃ দলীয় প্রার্থী হন। তাঁরা দলের অনুশাসন মেনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হন। এটি নামে জনসেবা হলেও কাজে তা মোটেই নয়। দলীয় প্রার্থী হতে গেলে দল বা তার ব্যক্তিবিশেষকে খুশী করার পরেই দলীয় টিকিট পাওয়া যায়। আর এই খুশী করার বিভিন্ন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল কাঞ্চনমূল্য। অনেকে যুক্তি দেখাবেন, দল চালাতে অর্থের প্রয়োজন, ঠিক কথা।কিন্তু তা কি এভাবে তুলতে হবে! এই যুক্তিতে দলের জন্য ‘কাটমাণি’ যা আগে স্পিডমাণি বা ঘুষ হিসেবে অভিহিত হত তা নিতে অপরাধ কোথায়! এইভাবে যারা রাজনীতিতে লগ্নি করছেন তারা নিশ্চয়ই সমাজসেবা করতে আসছেন না। তারা ভোট ব্যবসায় লগ্নি করে ব্যবসায়িক মুনাফা তোলার চেষ্টা অবশ্যই করবেন। সুতরাং এধরনের গণতন্ত্র যত এগোবে, সাধারন মানুষের দুর্দশা তত বাড়বে। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ ক্ষেত্রের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের দলীয় প্রার্থী করে ভোটে নামিয়ে দেন। এক্ষেত্রে সেই প্রার্থীর যোগ্যতা ও integrity দেখা হয় না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে ভোটে জেতাই গণতন্ত্র! এইসব মানুষদের রাজনৈতিক সচেতনতা পরীক্ষিত না হওয়ার কারনে এদের নির্বাচন যেমন বু্যমেরাং হতে পারে, তেমনি এদের প্রার্থীপদ দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
গণতন্ত্র মানুষকে তাদের বক্তব্য ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে। আবার সেই মানুষই যদি দেশবিরোধী বক্তব্য রাখে তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিলে তা গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করবে না ধ্বংসের কাজে সাহায্য করবে? আবার শাসকের কাজের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদকেও শাসক বিরোধী না বলে সরাসরিরাষ্ট্রবিরোধী বললে তা কি গণতন্ত্রকে পদদলিত করা হয় না? আসলে গণতন্ত্র একটি এমন প্রক্রিয়া, যা সব রাজনৈতিক দল নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে – রূপ গন্ধহীণ একটি চিন্ময় মূর্তি। যথার্থ গণতন্ত্রের পয়োগ ও পালনের জন্য পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও শিক্ষার প্রয়োজন। সেই শিক্ষা ব্যতিরেকে গণতন্ত্রের প্রয়োগ ও পালন রাজনীতিতে অসম্ভব।
সুতরাং গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার শ্লোগান কখনোই গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করে না। সেটি দলীয় স্বৈরতন্ত্র রক্ষার্থেই ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রথম কথা, জনগণের ‘অংশগ্রহণ’কেই প্রতীকীরূপে নামিয়ে এনেছে। শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতার কথা বারবার বলা হলেও তা কখনো মানা হয়নি। যদিও সমস্ত রাজনৈতিক দলই তাদের আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রের কথা বলে, তা আসলে কয়েকটি মানুষের ইচ্ছানুসারে চালিত হয়। জনগণের অংশগ্রহনে চালিত গণতন্ত্র এই মূহুর্তে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছেনা। এর সবচে বড় কারন জনগণের ‘অশিক্ষা’ এবং ‘কুশিক্ষা’। যেমন, রাজনীতির দুর্বিত্তায়ন সাধারণ মানুষকে মূক-বধির থাকতে বাধ্য করেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও তথাকথিত শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী মানষজন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির তাগিধে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের তাবেদারী করেন। ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এইসব ‘বুদ্ধিজীবি’ বা ‘প্রবুদ্ধ’জনেদের দল ও নীতি পরিবর্তন – সকাল, বিকেল জামাকাপড় পাল্টানোর মত দেখছি!
এই অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিণতির কথা কোন ধরনের সংবাদমাধ্যমই দেখাচ্ছেনা। সেটা কি? প্রথমেই বলি, যে মানুষজন নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার তাগিধে এখন কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের জনগণ চিনে নিয়েছেন – প্রকাশ্যে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, এরা নাকি রং পরিবর্তনে গিরগিটিকেও হারিয়ে দিয়েছেন! সমাজের উন্নতি, আর্থিক বিকাশের রাস্তা না দেখিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে মানুষের কাছে ভোট চাইছে – কেউ ভোটারদের মধ্যে বিভেদের ঠেকা নিয়েছে, কেউবা ডোল (অবশ্যই সরকারী কোষাগারের অর্থ) দিচ্ছে, কেউবা মার্কসীয় সাম্যাবস্থার বস্তাপচা নীতি আউরে – সকলেই অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে যে ভোট প্রার্থনা করছে, তাতে একটি জিনিষ পরিষ্কার। কোন রাজনৈতিক দলই সাধারণ মানুষকে নূ্যনতম গুরুত্ব দেয় না। কোন রাজনৈতিক দলই সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার সুস্পষ্ট নীতির কথা বলেনি।
এর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, জনসাধারণের মনে রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্বাস হারানো। এর পরবর্তীস্তরে কিন্তু জাতীয়তাবোধের উপর বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। আমাদের দেশের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবোধ রক্ষা করাটা সবচেয়ে জরুরী। আর তা করতে গেলে সব রাজনৈতিক দলের প্রচার ও কর্মধারায় লক্ষণরেখা মেনে চলা একান্ত প্রয়োজনীয়। একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদের একমাত্র ঠেকাধারী হওয়ার চেষ্টা করলে সেটা যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি তার বিরোধীতায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলি দেশের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে দূর্বল করার চেষ্টা করলে সেটিও একই রকম বিপজ্জনক ও নিন্দনীয়। এর কারন খুঁজতে গিয়ে আমার যেটা মনে হয়েছে, তা হল, দুটি জিনিষ – এক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিক্ষার অভাব, দুই হল, তথাকথিত ডিগ্রিধারী ‘শিক্ষিত’ রাজনীতিকদের অত্যধিক লোভ, লালসা। এর জন্যই আমাদের দেশ বারবার প্রতিবেশীদের তুলনায় রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাকে কিছুদিন আগে ইউরোপের এক শক্তিশালী উন্নত দেশের একজন অধ্যাপক গল্পের ছলে বলেছিলেন, আপনাদের ভারত হল একটি herbivorous dinosaur! আসলে অশিক্ষাজনিত কারনে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা দেশের integrityর উপরে নিজেদের লোভ, লালসাকে স্থান দেন। অদুর ভবিষ্যতে যদি দেশ আবার বিভাজিত হয় তবে তার জন্য দায়ী থাকবে রাজনীতিকদের স্বার্থান্বেষী খেয়োখেয়ি।
সুতরাং, ভোট যুদ্ধে হার-জিত বড় কথা নয়, জেতার জন্য গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করা কখনোই দেশের স্থায়িত্বের জন্য কাম্য নয়। সুশিক্ষা, দায়িত্ববোধ ও নির্লোভ মানসিকতার রাজনীতিকের আজ বড় প্রয়োজন।
Month: February 2023
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের উত্তরোত্তর আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধিতে মনে হল, “মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” রামায়ণের এই বিখ্যাত উক্তিটি। সত্যি, কোভিড১৯ এর সংক্রমণ যখন শুধু পড়তির দিকেই নয়, দৈনিক সুস্থতার হার আক্রান্তের হারের থেকে অনেক বেশী, তখন আমজনতা মনে করতে শুরু করলেন, যাক্ করোনা এতদিনে বিদায় নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেশের মানুষদের টীকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হল।ব্যস,আর যায় কোথায়! সবাই ভাবতে শুরু করলেন যে টীকা নেওয়ার পরমূহুর্ত থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।; এমনকি তাঁদের আর কোন সামাজিক নিরাপত্তার বিধিনিষেধের দরকার নেই। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচটি রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে গেল। শারীরিক দূরত্ববিধি চুলোয় গেল, ভিড়, জমায়েত সবই করোনাপূর্ব পরিস্থিতির মতই চলতে লাগল! বারবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হতে লাগল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!
এর ফলও আমরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছি। আমি গত বারো দিনের শুধু পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্তের সংখ্যা দিচ্ছি।
২৫শে মার্চ: ৫১৬
২৬শে মার্চ: ৬৪৬
২৭শে মার্চ: ৮১২
২৮শে মার্চ: ৮২৭
২৯শে মার্চ: ৬৩৯
৩০শে মার্চ: ৬২৮
৩১শে মার্চ: ৯৮২
১লা এপ্রিল:১২৭৪
২রা এপ্রিল:১৭৩৩
৩রা এপ্রিল:১৭৩৩
৪ঠা এপ্রিল:১৭৩৬
৫ই এপ্রিল:১৯৬১ (শুধু কোলকাতায় ৬০৬)
তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বুলেটিন
এখন মনে হচ্ছে মানুষ, বিশেষতঃ আমাদের রাজ্যের মানুষমাথা খাটিয়েচলার চেয়ে মন দিয়ে বিচার করেন! এই কথা এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি কারন, আগে বহুবার অনেকভাবে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ করোনার টীকা নিলেই করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে - এমন কোন দাবী টীকা কোম্পানী বা ডাক্তার, কেউই করেননি। সাধারণভাবে টীকার (কোভিশিল্ড এবং কোভ্যকসিন) দুটি ডোজ চার থেকে আট সপ্তাহের ব্যবধানে নেওয়ার পরে আরো দু সপ্তাহ বাদে ভ্যকসিন গ্রহীতার দেহে করোনা মোকাবিলার ইমিউন রেসপন্স তৈরী হবে। তাও এই টীকা শতকরা পঁয়ষট্টি থেকে আশি শতাংশ কার্যকর হতে পারে। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হওয়ার দুসপ্তাহ পরেও আমরা কখনোই সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান, স্যানিটেশান এবং শারীরিক দূরত্ববিধি যেন মেনে চলি।
আরেকটি কথা। কোভিড১৯ RNA ভাইরাস হওয়ার কারনে এর পরিবর্তিত জিন মিউটেশান হয়। আবার টীকার ইমিউন রেসপন্স ভাইরাসের একটি বা দুটি বা তিনটি নির্দিষ্ট স্ট্রেইনকেই সণাক্ত করতে পারে। সরল বাংলায় বললে বলতে হয়, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা যে পরিবর্তিত জিন মিউটেড ভাইরাসগুলি পাচ্ছি, তাদের সবাইকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কোন বাজার চলতি ভ্যকসিনের নেই। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হলেই আমরা করোনামুক্ত থাকবো - এমন ভাবার কারন নেই। তব, শৃঙ্খলাপরায়ণভাবে যদি সাধারণ মানুষ কোভিড আচরণবিধি মেনে চলে আর সঙ্গে সঙ্গে টীকাকরণ চলতে থাকে তাহলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে।
এবার একটি অপ্রিয় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। পাঁচটি রাজ্যে এখন সাধারণ নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচন মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে। আমরা দেখছি কোভিডবিধির বিন্দুমাত্র মানার ব
আলাই নেই। না নেতাদের, না কর্মীদের! আচ্ছা, এটা কি সত্যিই মানুষের স্বার্থে! যে হারে আমাদের রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা লকডাউনের মাঝামাঝি পর্বকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। মহারাষ্ট্রে লকডাউন শুরু হয়েছে। অনেক জায়গায় হোটেল রেষ্টুরেন্ট বন্ধ। এখানে সব খোলা! সিদ্ধান্তগ্রহনকারীরা ভোট যুদ্ধে ব্যস্ত! মানুষ মরে হেজে যাক। তাতে কারোর কিছু যায় আসে না। মনে হচ্ছে, করোনার মৃত্যু মিছিল বড় কথা নয়, বড় কথা হল নির্বাচন, যেখানে কোন নেতারা আগামী পাঁচ বছর রাজ্যের মধুভান্ড দখল করবেন তা নির্ধারন করাই করোনা বিধ্বস্ত রাজ্যের আম আদমীর আশু ও একমাত্র কর্তব্য। নেতাদের এই দেশ সেবার নামে আত্মসেবার আদিখ্যেতা বড়ই দৃষ্টিকটু। মানুষ অসহায়।
কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন দেশ লকডাউন ও অন্যান্য restrictions আনছে। বাদ আমরা। কেন? উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আমার জিজ্ঞাসা। নির্বাচন কমিশন কোন রকম কোভিড restriction মানতে বাধ্য করতে পারেনি বা করেনি।
আমার ধারনা, যখন ২৯শে এপ্রিল নির্বাচন শেষ হবে তখন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ার জায়গায় চলে যাবে।
আমাদের দেশে এই মূহুর্তে সক্রিয় করোনা রোগী: ৭৫৪৯৮৪, এর মধ্যে গুরুতর অসুস্থ : ৮৯৪৪, দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু : ৮৩জনের। পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় রোগী : ১৯২৪৮।
তথসূত্র : ওয়ার্ল্ডোমিটার।
৫ই এপ্রিল, দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা : ১০৩৫৫৮। প্রথম দফায় গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ বিশহাজার থেকে একলাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আশি দিন। এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে এই সংখ্যা পেরোতে লাগল পঁচিশ দিন। সুতরাং দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই সংক্রমণ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারন হিসেবে নিঃসন্দেহে মানুষের কোভিডবিধি না মানা, সরকারী তরফে লকডাউন ও কন্টেনমেন্ট জোন না করার ঢিলেমীকে কাঠগরায় তোলা যায়। অনতিবিলম্বে এই পদ্ধতিগুলি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
টীকাকরন এই দ্বিতীয় ঢেউকে কতটা প্রশমিত করতে পারবে সেসম্বন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা স্পষ্টতই সন্দিহান। সেজন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অধুনা কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি নতুনভাবে অন্বেষণ করছেন। এরমধ্যে একটি হল আমাদের দেহের ইমিউনিটির উপর ভরসা করা। যদি তা সত্ত্বেও ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তা ২০১৯-২০ সালের মত মৃত্যু মিছিল তৈরী করবে না। এর কয়েকটি কারনের মধ্যে একটি যেমন আমাদের দেহে ভাইরাসের এ্যান্টিজেন সণাক্ত হলেই দ্রুত অধিক পরিমাণে এ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে ভাইরাস নিধনে নামবে, তেমনই ভাইরাস তারজিন মিউটেশানগত কারনে ক্রমশঃ মানবদেহে ক্ষতি করার ক্ষমতা হারাতে থাকবে। কিন্তু আরেকটি বিপদ হচ্ছে, এই ভাইরাস মানবদেহের ভাইটাল কয়েকটি অর্গান, যেমন কিডনি, লিভার, লাংস,হার্ট ও নউরন সিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে পারে। ফলে, ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু না হলেও রোগীর আয়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারনে এই ভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় একটি নতুন দিকের সন্ধান করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার বড় একটি অসুবিধার জায়গা হল, একসঙ্গে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্গ্যানের সংক্রমিত হওয়া – যা অতি দ্রুত রোগীর প্রাণ সংশয়ের কারন হয়। প্রতিটি অর্গ্যানকে একসঙ্গে বাঁচানোর লড়াই চালানো ডাক্তারদের পক্ষে দুঃসাধ্য। সেজন্য নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির সন্ধানের পথে আশার আলো দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে ফেরোপটোসিস (ferroptosis) – এটি একটি নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া যা সাধারণ কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া apoptosis থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ফেরোপটোসিস দেহের আয়রনের উপর নির্ভরশীল যা লিপিড পারক্সাইড জমায় সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যন্সারের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এখন কোভিড-১৯ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে চলেছে বলেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারনা। আসলে, এই পদ্ধতিতে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত একাধিক অর্গ্যানের কোষগুলিকে বেছে বেছে নষ্ট করার ক্ষমতা থাকায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অনেকটাই সুবিধা করবে। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগের সার্থকতা কতটা তা ভবিষ্যতই বলবে
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বাঁচার উপায়
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে। প্রথমবারের লকডাউন ও মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজেশান আর সামাজিক দুরত্ববিধি বজায় রাখার যে নির্দেশাবলী জনসাধারণ মেনে চলছিল, তা গত বছরের শেষের দিক থেকেই আলগা হতে শুরু করেছিল। লকডাউনের সময় দেশের অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা মনে রেখে এবং সেইসঙ্গে কন্টেনমেন্ট জোনের উপকারিতা বিচার করে আমার মনে হয়, সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। কিন্তু দেশের যে রাজ্য, মহারাষ্ট্রে শতকরা পঞ্চাশভাগ আক্রান্ত, যেখানে রোগী ভর্তির জন্য বেড অমিল, সেখানে রাতে কার্ফু আর দিনে সবকিছু খোলা রেখে কি মহান কর্ম সাধন করছে তা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াতেই বোঝা যাচ্ছে।
গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে এবছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। প্রথমতঃ, এই দ্বিতীয় ঢেউ অতাস্বল্প সময়ে অনেক বেশী মানুষকে আক্রান্ত করছে। আর এর জন্য সাধারণ মানুষের অসতর্কতাকে অনেকটাই দায়ী করা যায়। নববর্ষের সময় শপিং মল থেকে রেষ্টুরেন্ট, বাস থেকে অটোরিকশা, রাজনৈতিক নেতাদের মিটিং-মিছিলের ভিড় — সবই করোনার আগের সময়কে মনে করায়। আরেকটা কথা, এই ভিড়ের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েকের মুখে সঠিকভাবে মাস্ক লাগানো আছে। সরকার প্রথম ঢেউয়ের সময় যতটা সক্রিয় ছিল, এখন এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ততটাই উদাসীন। এর ফলে দেশে এবং অবশ্যই আমাদের রাজ্যেও মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছে। গত ১৫ই এপ্রিল, ২০২১, এ সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম দু লক্ষ ছাড়ালো; একদিনে দেশে মৃত এক হাজারের বেশী। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে মৃত ২৮ জন। এই ভয়াবহ অবস্থায় সরকার, নির্বাচন কমিশন, সবাই অপেক্ষা করছে – কবে নির্বাচন শেষ হবে! করোনার মোকাবিলা করা যে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য নয়, তা সরকার তার কার্যপ্রণালী দ্বারাই প্রমান করেছে। দ্বিতীয়তঃ, এই বেশী সংক্রমণ ক্ষমতাযুক্ত মিউটেড করোনা ভাইরাস অতি দ্রুত ফুসফুস ও কিডনীর সবিশেষ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। এর চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হল রেমডিসেভির – যা পশ্চিমবঙ্গে চাহিদার তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে। কোন সরকারেরই এদিকে বিশেষ নজর দিতে দেখা যাচ্ছে না। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তারনর, কিডনী বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কিছুদিন বাদে সেই রোগী মারা যাচ্ছে। সুতরাং, অত্যন্ত শক্ত হাতে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করা জরুরী। এখানেই মানুষকে সচেতন করার যে কাজটা প্রশাসনের করার কথা, তা করতে প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পুনরায় লকডাউন করার প্রয়োজনীয়তা জোড়ালোভাবে থাকলেও সেই সময় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কোন বিকল্প পরিকল্পনা সরকারের যে নেই তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এখন কেন্দ্র আর রাজ্য, উভয় সরকারই একে অন্যে
র ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। আপামর জনসাধারন, প্রশাসন, ও রাজনীতিকদের চুড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রথম ঢেউয়ের সময় ইটালীর “হাগ চাইনীজ” শ্লোগান ও কর্মকান্ডকে। এখনই এমন অবস্থা যে হাসপাতালে আর বেড পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বোঝার জন্য নীচের তথ্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে মোট আক্রান্ত – ৬,৫২,১১৬; এখন সক্রিয় রোগী – ৫৬,৬২১; মৃত – ১০,৫৪০। কিন্তু করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৯৬.৩ লাখ ((জনসংখ্যার ১০% মাত্র)। টীকাকরন শুরু হয়েছে ৮৪.৪ লাখের (জনসংখ্যার ৯% মাত্র)। এমতাবস্থায় রোজ কয়েকগুণ করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এপ্রিল মাসের শেষে এমন জায়গায় যাবে যে তখন নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে, করোনার সঙ্গে লড়াই করা প্রশাসনের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে আমরা ইটালী বা ব্রেজিলের মত অসহায় মৃত্যুমিছিল দেখতে থাকব। ১৩ই এপ্রিল থেকে ১৭ই এপ্রিল এই চারদিনে এক লক্ষের বেশী মানুষ দেশে আক্রান্ত হয়েছেন। এটা বিশ্বরেকর্ড!
আরেকটি কথা। এক বছর আগে এই কাগজেই প্লাজমা থেরাপীর কথা প্রথম লিখেছিলাম। তারপর বহু আক্রান্ত মানুষ প্লাজমা পেয়ে সুস্থ হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাদের রাজ্যে প্লাজমার আকাল দেখা দিয়েছে। প্লাজমা না পাওয়ার দায় কিন্তু স্বাস্থ্য দপ্তর এড়াতে পারে না। তারা সময় মত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই অসুবিধা থাকত না। এর মধ্যে দুজন ভোট প্রার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় ঐ দুই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়ে গেছে। জানিনা, ভোট শেষ হতে হতে আরো কত প্রাণ ঝরে যাবে।
‘ল্যন্সেট’এ একটি গবেষণাপত্রে দেখলাম, সামাজিক দূরত্ব থাকলে ভাইরাস ছড়াতে পারে না এমন পুরোনো ধারণা ভুল। গবেষণাকারীদের বক্তব্য যে করোনা ভাইরাস হাওয়ায় ছড়ায়! এই তথ্য কিন্তু মানবজাতিকেই এক ভয়ংকর বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কারন, এই ধারনা সঠিক হলে মানুষ বন্ধ ঘরে কোয়ারেন্টিন থাকলেও নিরাপদ নয়। ফুসফুসের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে সর্বদা মাস্ক পরে থাকাও সম্ভব নয়। তবে বাঁচার রাস্তা কি? যদিও সত্যি বলতে কি, এই গবেষণাপত্র যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রথমতঃ, বদ্ধ ঘরে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেশী – পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলে না। অবশ্য খোলা জায়গায় ভাইরাস যে বেশীক্ষণ বাঁচে না তা প্রমাণিত। কিন্তু এই বায়ুবাহিত ভাইরাসের তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তাহলে মাস্ক কোন সুরক্ষা দিতে পারবে না।
এদিকে আবার ৪৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এখনো টীকাকরন শুরু না হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ হ্মুহু করে বেড়ে চলেছে। ৪৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯০৩ জনের করোনা ধরা পড়ে। আর শুধু এপ্রিলের ১৫ দিনের মধ্যে এই সংখ্যাটা ১৭২৩৩ – রাজ্যের মোট আক্রান্তের ৪৮%! এই অবস্থায় জরুরী অক্সিজেন, রেমডিসেভির ১০০, এ্যাক্টিমেরা ৪০০। এগুলি সমস্ত হাসপাতালে পর্যাপ্ত স্টক রাখতে হবে। এছাড়া convalescent plasma ও monoclonal antibodies treatment এর জন্য আমাদের কোভিড হাসপাতালগুলির তৈরী থাকা উচিৎ। এছাড়া মৃদু থেকে মাঝারি স্তরের সংক্রমিত রোগীদের bamlanivimab ও eteservimab IV form এ পুশ করা যেতে পারে। FDA এটির অনুমোদন দিয়েছে। আদতে এগুলো সবই দেহে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায্য করে। এর ফলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই যেমন তীব্রতর করা যাবে, তেমনি মৃতু্যহার নামিয়ে আনতেও এই চিকিৎসা কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
এরমধ্যে একমাত্র আশার কথা – দুটি প্রতিষেধক টীকার ডোজ নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হওয়ার হার শতকরা পাঁচভাগের চেয়ে কম। আমাদের দেশে যে দুটি টীকা দেওয়া হচ্ছে, কোভ্যক্সিন আর কোভিশিল্ড – দুটিরই প্রথম ডোজের পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ১০-১৫ দিন বাদে এই প্রতিষেধক টীকা সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় হয়। এদিকে আমাদের রাজ্যে টীকা পাওয়া শুরু হয়েছে মাত্র ৯% মানুষের। সুতরাং টীকার পূর্ণ এফেক্ট পাওয়া মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। মনে হয়, এ ব্যপারে প্রশাসন যথেষ্ট সক্রিয় নয়। তাদের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগানোর প্রক্রিয়া চালু করার ব্যপারে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের যথেষ্ট খামতি আছে। এইসঙ্গে অপ্রিয় হলেও একটা সত্যি কথা বলা ভালো – দেরী হওয়ার আগে আমাদের সম্পূর্ণ লকডাউন ছাড়া বাঁচার কোন রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। যেভাবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, গতবছর এর অনেক আগেই পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছিল। প্রান্তিক মানুষদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যেখানে এখনোলকডাউন চলছে, সেখানেও এই একই ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে। মনে রাখতে হবে,কজন মানুষ না খেতে পেয়ে মরেছে আর কজন মানুষ করোনায় মরেছে! রাজনৈতিক সদিচ্ছা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রই যেন ভোটযুদ্ধের মাঝে ভোঁতা হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় ভারতীয় রেল দেরীতে হলেও একটি বিজ্ঞপ্তি জারী করেছে যে মাস্কবিহীন অবস্থায় ট্রেনে ভ্রমণ করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ এবং ঐ যাত্রীর পাঁচশ টাকা অব্দি জরিমানা হতে পারে। পাব্লিকপ্লেসে সিগারেট খাওয়ার বিজ্ঞপ্তির মত এটিও শুধু বিজ্ঞপ্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এর যথার্থ প্রয়োগ হবে তা সময়ই বলবে। এদিকে রানিং স্টাফেরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। এখন WHO বলছে যে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে গোষ্ঠীসংক্রমণ হওয়া আর দু এক দিনের অপেক্ষা মাত্র।
আমাদের রাজ্যে এই সময় আট দফার ভোট ও রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল প্রমাণ করল যে, ভোট-রাজনীতির গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের জীবনের থেকেও বেশী মূল্যবান! প্রশাসন, আধিকারিক থেকে রাজনীতিবিদ সকলেই ভোট নিয়ে ব্যস্ত। রাজ্যের নিউজ চ্যনেলগুলি ভোটের সংবাদ পরিবেশনেই নিবেদিতপ্রাণ, করোনা সতর্কীকরন প্রচার দায়সারাভাবে সেরে নিলেই হল। এর খেসারত কিন্তু পরবর্তী সময়ে মারাত্মকভাবে দিতে হবে। কারন, একমাত্র টোটাল লকডাউন করোনার দাওয়াই হলেও কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনা করে সে পথ মাড়াবে না।
পরিশেষে বাঁচার রাস্তা হিসেবে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের কথা জানাচ্ছি। প্রথমতঃ, ঘরের বাইরে গেলে বা ঘরের মধ্যে বাইরের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য অন্তত ডাবল লেয়ার মাস্ক আবশ্যক। অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। বাইরে থেকে এলে পরনের যাবতীয় পোষাক সাবান দিয়ে কাচার ব্যবস্থা রাখুন। বিটাডাইন বা নিদেন পক্ষে নুনজল দিয়ে গার্গল করুন। তারপর সাবান দিয়ে স্নান করুন। বাইরে পরার জুতো আলাদা রাখুন। এরপর আপনার বডি ইমিউনিটির উপর নির্ভর করছে আপনি আক্রান্ত হবেন কি না।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি – এক আশার আলো
নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। এখন মনে হচ্ছে "ভোট যুদ্ধ" জয়ের তাগিধে নয়া শিক্ষানীতির রূপায়ণ প্রায় স্থগিত হয়ে আছে। জানিনা কবে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণের পরিকল্পনা ও সেই উদ্দেশ্যে কাজকর্ম শুরু হবে।
অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ত বলেই দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করবেন না। তা'হলে এই রাজ্যে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা কি করে হবে! আসলে এ ধরনের রাজনৈতিক ভাষণ পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদেরই শোভা পায়। এই ভাষণ অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত পার্টি কর্মী, সমর্থকদের খুশী করার জন্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশী মন্ত্রী হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করা। এটি একটি অদ্ভুত দলের কিম্ভুত সরকার। মূখ্যমন্ত্রী বলেন, "তুই টাকা দিস যে হিসেব দেব"! দেশের সংবিধান ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে সঠিক ধ্যান ধারনার অভাব আর তার সঙ্গে অশিক্ষা, কুশিক্ষার বহিঃপ্রকাশ এসব সদম্ভ উক্তি।
দেশের শিক্ষানীতি একটি জাতীয় কাঠামো। এর রূপরেখা সর্বদা কেন্দ্রীয়ভাবেই তৈরী হয়। স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে এবং তার দায়িত্বও কেন্দ্রীয় সরকারের। শেষ শিক্ষানীতি, যেটির বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটি রূপায়নের দায়িত্বে ছিল যে কমিটি তার অধিকাংশ সদস্যই বামপন্থী। কিছু ছিল নেহেরু ঘরানার সোশাল ডেমোক্র্যাট। এই বামপন্থীরা সরাসরি তাদের এ্যাজেন্ডা রূপায়িত করার জন্য শিক্ষানীতিকে ব্যবহার করেছে। সেজন্য প্রথমেই তারা এমন সিলেবাস বানিয়েছে যেখানে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে হয় অবহেলা বা বিকৃত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রথমে নরম ইসলামিকরন ও পরে সরাসরি ভারতের বুকে ইসলামি অনুপ্রবেশকে বিকৃত ইতিহাসের মাধ্যমে মহিমান্বিত করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত "বহিরাগত আর্য" সভ্যতার তথ্য Cambridge ও Harvard বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভুল প্রমাণিত হয়েছে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাকে অনার্য সভ্যতা হিসেবে দেখানোও। এই সব কল্পিত ইতিহাস সুক্ষভাবে শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মগজ ধোলাইএ প্রভূত সাহায্য করেছে। আর 'ইসলামিক সেকুলার' তত্ত্ব প্রচার করে অবিভক্ত কমু্যনিষ্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস মোতাবেক ভারতের আরো খন্ডিতকরন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য পরিবেশ তৈরীতে সাহায্য করেছে। যেসব অধ্যাপকদের এই কাজে ব্যপৃত থাকতে দেখা গেছে তাঁরা সকলেই কোন না কোন কমু্যনিষ্ট পার্টির সদস্য বা উগ্র সমর্থক, যেমন, রোমিলা থাপর, ইরফান হাবিব, বিপন চন্দ্র ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, রমেশ মজুমদার কালীকিঙ্কর দত্ত, এইচ সি রায়চৌধুরী ইত্যাদি লেখকের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভান্ডারকে ধীরে ধীরে পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। তাজমহলের গায়ের pietra dura কাজকে নতুনত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হল। এটি সর্বৈব ভুল। Fergusonএর Indian Archtecture বইতে তা জানানোও হয়েছে। তাজমহল তৈরীর আগে অন্ততঃ দুটি জায়গায়, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ও যমুনার অন্য পারে নুরজাঁর তৈরী তার পিতার কবরসৌধে এই কাজ দেখা যায়। মোদ্দা কথা, ইসলামের যা কিছু তা ভালো আর ভারতের প্রাচীন সব কিছু খারাপ!
যতদিন দেশে গান্ধী পরিবারের শাসন চলেছে, অত্যন্ত সূক্ষভাবে হিন্দুবিদ্বেষ ও প্রাথমিকভাবে ইসলামতোষণ এবং তারপর ২০০৪ সাল থেকে কিছুটা হলেও খ্রীষ্টান তোষন। এর একটা কারন নিঃসন্দেহে বলা যায় গান্ধী পরিবারের যে বা যারা যখন ক্ষমতার শীর্ষে থাকেন তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ। যেহেতু এই পরিবারের শাসকদের সঙ্গে লেখাপড়ার যোগ নেই, তাই শিক্ষার আলোকে এদের ধর্মীয় আবেগযুক্তিগ্রাহ্যরূপে প্রকাশ পায়নি। "ধর্মনিরপেক্ষ" ও "সমাজতান্ত্রিক" এই দুটি কথা ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী দেশের সংবিধানে জোর করে ঢোকানোর পর শিক্ষানীতিতেও "ইসলামিক ধর্মনিরপেক্ষতা" ও "সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা" ব্যবস্থার নামে মানব সম্পদ তৈরীর কৌশল প্রয়োগ করায় বামপন্থী শিক্ষানীতির সুপরিকল্পিত ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই শিক্ষানীতিতে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা ভুলিয়ে দিয়ে বিদেশী 'ইজম্' ও মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের লুঠেরাদের মধ্যে 'মহান ব্যক্তিত্ব' খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এধরনের ভ্রান্ত প্রচার চালিয়ে তাদের নিজস্ব শিকরকে ভুলিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুবিশাল দেশ ভারতে তা সম্ভব নয়। টাকা ও ক্ষমতার জেরে এই চাপিয়ে দেওয়া নীতি একসময় উল্টে যেতে বাধ্য। দেশে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র ও কমু্যনিষ্টদের ভন্ডনীতির রাজনীতি যখন অস্তাচলের পথে, তখনই এলো এক নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। এই নীতির প্রথম দিশা পাওয়া গেল শিক্ষার্থীদের "মানব সম্পদ" থেকে "ছাত্র" নামের উত্তরণে। পার্টির স্বার্থে মানুষকে পার্টির মত করে পার্টির নীতি রূপায়ণের শিক্ষার বদলে মুক্ত চিন্তা করার মধ্যে দিয়ে ছোট বয়েস থেকেই ছাত্রদের বৌদ্ধিক বিকাশের দিকে নজর দেওয়া হল। ফলে, ছাত্রদের মস্তিষ্কের বিকাশ উপযোগী শিক্ষার সূচনা করবে এই নতুন শিক্ষানীতি। সাধারণ একটি উদাহরন দেওয়া যাক। একটি বিষয়ের কোন অধ্যায় শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পড়ালেন। কেউ তাঁর মত করে বুঝিয়ে দেন, কেউবা নোটস দেন। পরীক্ষায় তার থেকে প্রশ্ন আসে, ছাত্ররা মুখস্ত করে, স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে সে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। এই ছিল আগের শিক্ষানীতিতে পঠন পাঠনের ধরন। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষক ঐ অধ্যায় বোঝানোর জন্য বিভিন্ন উদাহরণ, যা কেস হিস্ট্রিও বলা হয়, সহযোগে ছাত্রদের বুঝিয়ে দেবেন এবং ছাত্রদের শ্রেণীকক্ষে বসে তাদের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী চিন্তা করে উত্তর দিতে হবে। বিদেশে এধরনের শিক্ষা অনেক আগে থেকেই চালু আছে। এতে ছাত্রদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথ সুগম হয়। ছাত্রদের বিষয় চয়নের স্বাধীনতা দেওয়ার প্রশ্নে বিশ্বজুড়ে যে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি শিক্ষানীতির একটি উল্লেখযোগ্য পজিটিভ দিক। যদিও এই শিক্ষানীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে অবকাঠামো (infrastructure) নির্মাণ সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ, তার সফল রূপায়ণের সদিচ্ছা থাকলে কাজটি দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। এর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তাই শুধু নয়, উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ শিক্ষক তৈরীর ট্রেণিং পরিকাঠামো নির্মাণও জরুরী। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে তার স্তরভিত্তিক বাস্তব রূপায়ণে জোর দিতে হবে।
শিক্ষক নিয়োগ ও তাঁদের নিরন্তর ট্রেণিং অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে। শুধু তাই নয়, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। সকল স্তরের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া রাজনীতিমুক্ত শিক্ষক-নিয়োগ আয়োগের মাধ্যমে করলে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে সুযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির প্রবেশ এবং শিক্ষাকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র চয়ন থেকে পরীক্ষা পদ্ধতির কারসাজি সমস্তই বন্ধ হবে যদি শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির প্রবেশ বন্ধ হয়। অনেক সভ্যদেশেই শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন তাঁদের শিক্ষকতার কাজে নাপড়ে সেটা দেখা হয়। আমাদের দেশেও তা বলবৎ করা অত্যন্ত জরুরী। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে শিক্ষাকে রাজনীতিকরনের জন্য। এটি বন্ধ করা আশু প্রয়োজন।
যেহেতু ছাত্রদের বিষয় চয়নের জন্য ব্যপক পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সমস্ত বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি জায়গায় সব বিষয়ের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সেজন্য এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে পঠন-পাঠনের, বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, গুচ্ছ (cluster) study পদ্ধতির ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষায় উন্নত দেশগুলিতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখেছি। যতটা সম্ভব কাছাকাছি জায়গার মধ্যে বিদ্যায়তনগুলিকে গুচ্ছ করে সবাইকার মধ্যে বিষয়গুলি ভাগ করে ছাত্রদের এক বিদ্যায়তন থেকে নির্দিষ্ট রুটিনে অন্য বিদ্যায়তনে পাঠ নেওয়ার সুযোগ দিলে প্রথমেই ব্যয়সাধ্য পরিকাঠামো উন্নয়ণের খরচ অনেকটাই কমানো যাবে।
একটি ব্যপারে নতুন শিক্ষানীতি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। সেদিকে আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে। তাহল বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে। আমি তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে দেখেছি উচ্চশিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। শহর সীমার মধ্যে আটটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে তুরস্কের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তানবুল ইউনিভার্সিটি ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্ট হাউসে ছিলাম সেটি ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি। এটি ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে পথ চলা শুরু করে। এর প্রশাসনিক ভবনটি গথিক আর্টের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পঠন-পাঠনের মান অত্যন্ত উন্দত। কিন্তু এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, এই শহরেই ত্রিশটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলি প্রাইভেট ফাউন্ডেশান বা ট্রাষ্টের অধীন। এরা অত্যন্ত নিকৃষ্ট মানের বিশ্ববিদ্যালয়। এদের ডিগ্রী দেওয়ার কোম্পানি বলাই বোধহয় ভালো। আমি এমন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি যেটি একটি রেস্তোরাঁর উপরে একটি তলা ভাড়া নিয়ে চলছে! সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান ও বেতন কাঠামো উচ্চমানের হলেও এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অতি নীচু মানের। এদের জন্য ইস্তানবুলের শিক্ষার মান অনেক নেমে যাচ্ছে। আবার আমেরিকায় দেখেছি, সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেমন, ইয়েল, প্রিন্সটন, হারভার্ড ইত্যাদির মানের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও নামতে থাকে। আমেরিকার অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের মান আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তুলনায় নিকৃষ্ট। এইসব মাথায় রেখে শিক্ষকদের উৎকর্ষতা অনুযায়ী বেতন কাঠামো স্থির করা শিক্ষানীতির সঠিক রূপায়ণের জন্য জরুরী। আর এখানেই একটি অনিয়মের ব্যপারে আলোকপাত করা দরকার। আমাদের দেশে বামপন্থী সাম্যবাদী কায়দায় মুড়ি মিছরির একদর বানিয়ে ইউ জি সি নির্ধারিত পেস্কেল সব শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ হল। ফার্স্ট গ্রেড টু লাস্ট গ্রেড, সমস্ত কলেজের প্রিন্সিপালদের বেতনক্রম সমান। এমনকি সরকারপোষিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বেতনসমান! এবার কিন্তু নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োগের সময় আমাদের সরকারের মাথায় রাখতে হবে, কমু্যনিষ্ট আইডিওলজির সাম্যাবস্থার নীতি শিক্ষার ও শিক্ষার উৎকর্ষতা বৃদ্ধির অন্তরায়। কোন জাতীয়তাবজাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র তা করে না।
শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, স্বজনপোষণ, দূর্ণীতি ইত্যাদি থাকায় এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিক্ষকদের উচ্চতর পদ ও বেতন নিশ্চিতকরন করে শিক্ষার উৎকর্ষতার সঙ্গে আপোষ করা হয়েছে। এর পরিবর্তন দরকার। একই রকমভাবে বেসরকারী বিদ্যালয় থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমস্ত স্তরেই শিক্ষক নিয়োগের সূষ্ঠু ও স্বচ্ছ নীতি না থাকায় এবং নির্দিষ্ট বা নূন্যতম পেস্কেল না থাকায় (অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ইউ জি সি নির্ধারিত পেস্কেল দেয় না) এইসব শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের থেকে উপযুক্ত শিক্ষাদান আশা করা যায় না। এইধরনের বিদ্যায়তনগুলি সম্পর্কে সরকারকে একটি সুস্থ ও বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি প্রনয়ণ করতে হবে। কাজের স্থিরতা ও বেতনবৃদ্ধির নিশ্চয়তা যেমন একজন শিক্ষককে অলস ও কর্তব্যবিমুখ করে দিতে পারে, তেমনি শিক্ষকের কাজের উৎকর্ষতার জন্য তাঁর কর্মক্ষেত্রে আর্থিক ও অন্যান্য স্বীকৃতি মেলারও প্রয়োজন আছে।
সুতরাং বলাযেতে পারে যে নতুন শিক্ষানীতি পরিকল্পিত পথে রূপায়িত করতে হলে শিক্ষক শিক্ষন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন, শিক্ষক চয়ন পদ্ধতি ও তাঁদের শিক্ষাদান একটি পূর্ণ সময়ের সূচীর মধ্যে রাখা, শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার হিসেব ও তাঁদের সামাজিক সন্মান - এই বিষয়গুলিতে জোর দিতে হবে। এখন একজন IAS বা WBCS অফিসারের কথা ছেড়ে দিন, শিক্ষা দপ্তরের সাধারণ করণিকও শিক্ষকের প্রাপ্য অর্থনৈতিক চাহিদার ফাইল চালানোর জন্য ঐ শিক্ষককে দপ্তরে ডেকে পাঠান। অনাবশ্যক কারনে দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকেন। এই পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। কারন শিক্ষক তাঁর কাজ অর্থাৎ পড়ানো বন্ধ রেখে অযথা দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করলে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাদান পদ্ধতি। শিক্ষকদের চাকরী সম্পর্কীয় কোন ফাইল আটকে রেখে কোন আমলা, তিনি যত বড়ই হোন না কেন, যদি অনাবশ্যক দীর্ঘসূত্রতা করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা উচিৎ।
পরিশেষে জানাই, বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মান, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির উপর সরকারের কার্যকরী নজরদারি থাকলেই এদের নূন্যতম মান নিশ্চিতকরন সম্ভব হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় ব্যর্থতা কেন
সত্যি বলতে কি, এখন আমাদের দেশের কোভিড পরিস্থিতি চিকিৎসা ব্যবস্থার হাতের বাইরে চলে গেছে। দেশের মানুষদের বাঁচাতে হলে শক্ত, অভিজ্ঞ ও যোগ্য হাতে এর মোকাবিলা করা প্রয়োজন। দুখেঃর সঙ্গে বলতে হয় যে তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। টিভি এবং সোশ্যাল মাধ্যমের দায়িত্ব পালনেও এ ব্যপারে কোন স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। বিশেষতঃ, আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তার পরিচালনার দায়িত্ব যার হাতে, সেই স্বাস্থ্যভবনের ভূমিকা সমালোচনার ঊর্ধে নয়। করোনা মোকাবিলায় পরামর্শ দিতে পারার মত পারদর্শিতা যাদের সবচেয়ে বেশী, তারা হলেন চিকিৎসকদের মধ্যে ভাইরোলজিষ্ট আর চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বায়োটেকনোলজিষ্টদের একটি অংশ। আমাদের রাজ্যে করোনা মোকাবিলায় যত বিশেষজ্ঞ দল তৈরী হয়েছে তাতে এদের স্থান হয়নি। বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে যে ডাক্তারবাবুরা আসেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে থাকেন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিষ্ট আর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জেনরা! থাকে কিছু অভিনেতা/অভিনেত্রী আর সর্বঘটে নৈবেদ্যের কলার মত কিছু মানুষ যাদের সংবাদ মাধ্যম আরোপিত বিশেষজ্ঞ "বুদ্ধিজীবি" সংজ্ঞা! এদের পরামর্শে আমজনতার কি উপকার হচ্ছে তা কেউ জানেনা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত আছে ক্লিনিশিয়ান ডিগ্রিধারী কিছু স্তাবক আমলার দল যারা স্বাস্থ্যভবন আলো করে রাজ্যের মানুষের স্বাস্থ্যের দেখভাল করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
এই ধরনের RNA ভাইরাসের ধর্ম অনুসারে দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ যে আসবে সে সম্পর্কে এইসব বিশেষজ্ঞ (!) সরারকে কোন সঠিক পরামর্শ দিয়েছিলেন কি? এর জন্য যে পরিকাঠামো তৈরী করার কথা তা তৈরী ত করেননি, অধিকন্তু আগের পরিকাঠামোর অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাদের উৎসবের মরসুমে সংযম দেখানো মানুষজনকে প্রলুব্ধ করার জন্য রেষ্টুরেন্ট, সিনেমা হল, শপিং মল ও অন্যান্য বিনোদনের জায়গা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হল। গণপরিবহনে বাস, অটো সবেতে সমস্ত বাধানিষেধ সরিয়ে নেওয়া হল। এমনকি স্কুল,কলেজ খুলতে শুরু করল। এইসব বিশেষজ্ঞরা এমন কোন প্রমান দেখাতে পারবেন যে, তাঁরা সরকারকে দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করে পরিকাঠামো ভাঙ্গার পরিবর্তে আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন? না। অনেক দেশ যেমন বেলজিয়াম, হল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং আরো বহু দেশ লকডাউন অব্দি তোলেনি। এই বিশেষজ্ঞরা কি এমন প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড পরিকাঠামো যখন রোগীর অভাবে বন্ধ করতে হচ্ছে তখন তাদের পরবর্তী ঢেউয়ের ব্যপারে সতর্ক করে পরিকাঠামো চালু রাখতে বলেছেন! রেমডিসেভিরের (স্বল্প থেকে মধ্যমমানের কোভিড সংক্রমণের প্রশমণে ব্যবহার করা হয়) স্টক যে হাসপাতালগুলিতে দ্রুত কমে যাচ্ছে, সরকারী স্টক দ্রুত নামছে,তখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা মাথায় রেখে তা বাড়ানোর কথা কোন আমলা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন কি? এইসব প্রাথমিক কাজগুলোই স্বাস্থ্যভবনের আমলারা করে উঠতে পারেননি।
দেশের অক্সিজেনের মোট চাহিদা দিনপ্রতি ৭৫০০ মেট্রিক টন। এই মূহুর্তে কোভিড পরিস্থিতিতে অক্সিজেনের চাহিদা দিনপ্রতি ৫৫০০ মেট্রিক টন। অভাবরয়েছে অক্সিজেন ট্যাঙ্গার আর সিলিন্ডারের। তার কারন খালি ট্যাঙ্কার এবং সিলিন্ডার বসিয়ে রাখার যুক্তি নেই বলে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশী এগুলো রাখা যায় না। সাধারণ সময়ে এভাবে চলে যায়, কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসার কথা ধরে নিয়ে যে প্রশাসন যত তাড়াতাড়ি এই পরিকাঠামো উন্নত করতে পারবে তারাই সফল। অন্যেরা ব্যর্থ। সেই দিক দিয়ে দেখলে দেশের আরো কয়েকটি রাজ্যের মত পশ্বিমবঙ্গও ব্যর্থ। উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল,তেলেঙ্গানা তাদের পরিকাঠামো দ্রুততার সঙ্গে উন্নত করছে। সেখানে আমরা বাজিয়ে চলেছি কেন্দ্রের বঞ্চনার ভাঙ্গা রেকর্ড। এটা রাজনীতিকদের বক্তব্য হতে পারে, স্বাস্থ্যভবনের আমলাদের নয়। এমনকি ন্যশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মত জায়গায়ও অক্সিজেন মহার্ঘ! এ রাজ্যেও দিল্লী এবং অন্যান্য রাজ্যের মত অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারীতে দর সিলিন্ডার প্রতি দশ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, একটা সিলিন্ডারের অক্সিজেন গড়ে ঘন্টা ছয়েক চলতে পারে। এই কালোবাজারী বন্ধ করতে না পারা জঘন্য অপরাধ। এইসব কালোবাজারীদের সংক্ষিপ্ত বিচারে প্রাণদন্ডের বিধান যুক্তিযুক্ত।
এবার প্রসঙ্গ পাল্টানো যাক। ভোটযুদ্ধের রাজনৈতিক উত্তাপে বাঙ্গালী নিজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার পরিচয় আগেই দিয়েছে। এবার কোভিডের বাড়বাড়ন্তের সময় তার অহংকারী নির্বুদ্ধিতার পরিচয় রাখছে। আমাদের রাজ্যের 'রেডিমেড' বুদ্ধিজীবীর দল, পেশাদার রাজনীতিকরা যেভাবে কোভিডবিধি ভেঙ্গেছেন, যেভাবে বৈদ্যুতিন মাধ্যম বারবার তাদের দেখিয়েছে, তাতে এক বড় অংশের মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে যে এরা যদি কোভিডবিধি না মানে তবে তাদেরও তা মানার দরকার নেই। আমি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য সংক্ষিপ্ত সরকারী পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
এই লেখার সময় দেশে একদিনে আক্রান্ত :৩৪৭ হাজার; মৃত: ২৬২৪। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে আক্রান্ত :১২৮৭৬ ; মৃত: ৫৯। ভ্যাকসিন পেয়েছেন দেশের ১.৫% (২০১৯৭১২২) মানুষ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ১% মানুষ। এই সময় ভাইরাসের চেন ভাঙ্গার জন্য দযকার ছিল ৭ থেকে ১০ দিনের পূর্ণ লকডাউন। এই দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনটাই মনে হয় আমাদের কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের নেই। খন্ডিত শকডাউনে চেন ভাঙ্গা সম্ভব নয়, শুধু সাধারন মানুষের দুর্দশা বাড়বে মাত্র।
এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যপারে কিছু টেকনিক্যাল কথা সাধারণ মানুষের বোঝার মত করে বলতে চেষ্টা ঈরি। প্রথমতঃ করোনা ভাইরাসের পরিবর্তিত জিন মিউটেশান নিয়ে আগে একাধিকবার আলোচনা করেছি। এখন একটা কথা অনেকেই বলছে, ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট, ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট ইত্যাদি। আমাদের দেশে এখনো অব্দি নয় প্রকারের মিউট্যান্ট করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। ভাইরাসের ধর্ম বোঝা যায় তার জিনোম সিকোয়েন্মিং দেখলে। এই জিনোম সিকোয়েন্মিংয়ে যখন কোন পরিবর্তন হয়, তখন তাকে মিউট্যান্ট বলে। যখন একটি জায়গায় পরিবর্তন হয়, তখন সেটা সিঙ্গল মিউট্যান্ট; দুটি জায়গায় হলে তাকে ডাবল মিউট্যান্ট আর তিনটি হলে তাকে ট্রিপল মিউট্যান্ট বলে। এইভাবে জিনোমের পরিবর্তনের ফলে করোনা ভাইরাসের যে নতুন জ্ঞাতি পাওয়া গেল তাকে ভ্যারিয়েন্ট বলে। এই ভ্যারিয়েন্টগুলি যখন আগের ভাইরাসের থেকে চরিত্রগত পরিবর্তন দেখায়, যেমন সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি (replication), বিভিন্ন অর্গ্যানকে আক্রমণ করার ক্ষমতা, মৃত্যুহার বৃদ্ধি ইত্যাদি, তখন তাকে বলে নতুন স্ট্রেইন। আমাদের দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে ব্রিটেন স্ট্রেইন (B.1.1.7)। এছারা সাউথ আফ্রিকা স্ট্রেইন, ব্রাজিল স্ট্রেইনও পাওয়া গেছে। প্রথমঢেউয়ের চার পাঁচটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্বিতীয় ঢেউয়ে পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সিঙ্গল মিউট্যান্ট বেশী, ডাবল ল মিউট্যান্ট ও একটি ট্রিপল মিউট্যান্ট পাওয়া গেছে। এদের ধর্ম যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই নোভেল করোনা ভাইরাসের থেকে আলাদা, আমাদের ভ্যকসিন এই নতুন ভাইরাসের উপর কতটা কার্যকরী হবে তা কেউই সঠিকভাবে বলার জায়গায় নেই। এখানেই কথা হচ্ছে যে, ভ্যকসিনেশানে হয়ত প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে কিন্তু তা full proof না হওয়ায় কোভিড আচরণবিধিতে কোন ঢিলেমি দেওয়া চলবে না। ট্রিপল ভ্যারিয়েন্ট, যেটা আমাদের রাজ্যে পাওয়া গেছে, সেই (B.1.618) ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী হবে তাতে সন্দেহ আছে।
এদিকে, আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল অবস্থার মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও হংকং নতুন করে ভারত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। উল্লেখ্য, বেশীরভাগ ইউরোপের দেশ ২০২০র লকডাউনের সময় ভারতীয়দের উপর ভ্রমণে যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল তা বহাল রেখেছে। আবার টীকাকরনের ঢক্কানিনাদে প্রশাসনিক অপদার্থতা ও রাজনীতিকরনের বিষ মিশে গিয়ে পরিস্থিতি ঘুলিয়ে দিয়েছে। টীকাকরন ক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড অন্য অনেক রাজ্যের থেকে ভালো, যদিও আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। যেমন এই মূহুর্তে ৪৫ বছরের ঊর্ধে সব নাগরিকের টীকা নেওয়ার কথা। তার জন্য জনপ্রতি দুটি ডোজ ধরলে টীকা লাগে ছয় কোটি। কেন্দ্র টীকা পাঠিয়েছে এক কোটি। অর্থাৎ প্রয়োজনের ১৬% মাত্র। সেজন্য পশ্চিমবঙ্গে টীকাকরনের হার ৮% (দুটি ডোজ ধরে) এর বেশী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একটি করে ডোজ নিয়েছেন প্রায় ৯% মাত্র। সুতরাং, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রতিরক্ষা, পুলিশ, ভোটকর্মীদের এই টীকা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেওয়ার পরেও মনে হয় কিছু টীকা যাদের পাওয়ার কথা নয়, তারাও পেয়েছেন। আমাদের কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার সময় একটি ফর্মে ব্যক্তিগত তথ্য নথিভুক্ত করতে হয়েছে। সুতরাং ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সব তথ্য সরকারের কাছে থাকার কথা। তবে, এ রাজ্যে টীকার ভায়াল বা ডোজ নষ্ট হয়নি। সেটা প্রশংসনীয়।
অব্যবস্থার ছাপ সর্বত্র। এক রাজ্যের অক্সিজেন সংকটের মধ্যে সেই রাজ্যে উৎপন্ন অক্সিজেন যাচ্ছে অন্য রাজ্যে। দিল্লীতে কোন অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই। সেখানকার মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। তার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যবস্থার জন্য নয় কি? এটা নিশ্চিতরূপে প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আবার আমাদের রাজ্যে দেখছি কোভিড বেডে ভর্তির জন্র মানুষ কি কি করবে, স্টেপ বাই স্টেপ, সেই গাইডলাইন সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে বহুল প্রচারিত নয়। আমার মনে হয়, দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য, কোন প্রশাসনই তৈরী ছিল না। দেরীতে হলেও কেন্দ্রের ঘুম ভেঙ্গেছে। তবে রাজ্য প্রশাসনের কাজ করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুইই না থাকায় তারা দোষারোপ করেই কর্তব্য সারছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেলের চত্বরে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করেছে - না পড়লে জরিমানা আদায় করছে। কিন্তু রাজ্য পরিবহন, বিশেষতঃ বাস, মিনিবাস, অটোরিক্সার মত গণ পরিবহনে এবং রাস্তাঘাট, বাজারে মানুষ মাস্ক ত দূরের কথা, অন্য কোভিডবিধিও মানছে না। এই ব্যপারে রাজ্য সরকারের কোন হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের কোভিড সংক্রান্ত মিটিংয়ে, যা প্রধানমন্ত্রীর পৌরহিত্যে হয়েছে, হাজির না হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি করোনা থেকে রাজ্যের মানুষকে রক্ষা করতে চান না, করোনা নিয়ে রাজনীতি করতেই তিনি বেশী আগ্রহী।
টীকাকরন প্রসঙ্গে বললে এর পিছনে রাজনীতিকদের নোংরামিটাও পরিস্কার বোঝা যাবে। প্রথমে আসি বহুল ব্যবহৃত কোভিশিল্ডের কথায়। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণ, পুণের সিরাম ইন্সটিটিউট, অক্সফোর্ড অ্যস্ট্রাজেনিকার গবেষণালব্ধ এই টীকা বানানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী টীকা বিক্রির ৫০% টাকা অ্যস্ট্রাজেনিকা পায়। কেন্দ্রীয় সরকারকে সিরাম ইন্সটিটিউট জানায় যে তারা টীকার প্রতি ডোজ ১০০০ টাকা দাম রাখবে। এতে তারা কার্যকরী দাম পাবে ৫০০টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার ঐ দামে কিনতে চায় না। এদিকে তখন সিরাম ইন্সটিটিউট টীকার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে বরাত পেল। ফলে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য তাদের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়ানোর দরকার হল। তখন কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কোন সিকিউরিটি ছাড়া তিন হাজার কোটি টাকা সফ্ট ঋণ দিল। আর একই সঙ্গে চুক্তি করল যে, সিরাম ইন্সটিটিউট আগামী জুলাই মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে এগারো কোটি ডোজ টীকা প্রতিটি ১৫০ টাকা দরে দেবে। তবে তারপর তারা বাজারে ৬০০ টাকা প্রতিডোজ দামে এবং সরকারকে ৪০০টাকা দামে বেচবে। না হলে সিরাম ইন্সটিটিউট লোকসানে ব্যবসা করতে পারবে না। এইভাবে ভারত বায়োটেকের সঙ্গেও কেন্দ্রীয় সরকার একই দামে টীকা কেনার চুক্তি করে। তাদের ১৫০০ কোটি টাকার সফ্ট লোন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার হিসেব করে দেখে যে ডোজ প্রতি রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবহণ, ওঅন্যান্য খরচখরচা মিলিয়ে ১০০টাকা পড়ছে। সেজন্য তারা ডোজপ্রতি দাম ধরে ২৫০ টাকা।মনে রাখতে হবে, এই দাম আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত। তারপর সিরাম ইন্সটিটিউট ডোজ প্রতি১০০০ টাকা দামে সিরাম বেচতে পারবে। তখন আর সরকারের সঙ্গে তার কোন চুক্তি থাকবে না। দেশের বিপুল সংখ্যর মানুষের কথা মাথায় রেখে বলা যায় যে সরকারের পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশেষতঃ কোভিড ভ্যাকসিনের মত জিনিসের, দাম নিয়ন্ত্রণে বেসরকারী কোম্পানীকে লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য করা যায় না। শুধু মাত্র মূর্খ ধান্দাবাজ রাজনীতিকরা এমন কথা বলে বাজার গরম করতে পারে মাত্র। বিনা পয়সায় সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা যারা বলছেন তাদের সবিনয়ে বলি, আপনাদের সরকার এই টাকার বরাদ্দ রেখেছেন কি? সরকারী টাকা মানুষের করের টাকা। বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিলে তার বরাদ্দের টাকাটা কোথা থেকে আসবে সেটাও একই সঙ্গে জানাবেন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণ থেকে টীকা কিনে এবং আনুসঙ্গিক খরচের সংস্থান না রেখে, বাজেট তৈরী না করে এ ধরনের কথা বলা ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানের প্রাক্তণ ডিরেক্টর ও সায়েন্টিফিক কন্সালটেন্ট
রাজ্যের ভোটযুদ্ধে বিজেপির ব্যর্থতা কেন
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট শেষ হল। উত্তপ্ত পরিবেশে এই নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ। কোন দলই ভোটে রিগিংয়ের অভিযোগ করেনি। আবার ভোট গণনাপর্বে কোথাও রিকাউন্টিংয়ের পরিবেশ হয়নি একমাত্র মূখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রাম থেকে হারার পর রিকাউন্টিংয়ের দাবী করবেন বলে তাঁর দল জানিয়েছে। এসবই নির্বাচন কমিশনের মুকুটে নতুন নতুন পালক যোগ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু রিকাউন্টিংয়ের কথা বলা হলেও তা হয়ত বিক্ষুব্ধদের দৃষ্টি ঘোরানোর অপচেষ্টা। কারন, রিকাউন্টিং হলে তার উল্লেখ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে থাকে। এইসবের কোন ভিত্তি নেই। নির্বাচন কমিশন পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস উইথ ডিস্টিংশান।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলাফল রাজনীতির ময়দানের অনেক রথী মহারথীকে অবাক করলেও তা কিন্তু আসলে অবাক করার মত নয়। পশ্চিমবঙ্গের গত ৪০-৪৫ বছরের বিধানসভা নির্বাচনগুলিকে বিশ্লেষণ করলে কিন্তু তা স্বাভাবিক মনে হবে। কারন এই সময়ে যত কটি নির্বাচন হয়েছে সবেতেই একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এই ২০২১এও তার অন্যথা হয়নি।
এবারের নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিপক্ষ নির্বাচনী প্রচারকে আলাদা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। বিজেপি পুরো প্রচারকে হাইটেক ও জৌলুশে ভরিয়ে দিতে চয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে হৃদয়ের টান আর বুদ্ধিমত্তার কোন ছাপ ছিল না। পক্ষান্তরে তৃণমূলের প্রচারে জৌলুষ অনেক কম থাকলেও তারা ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেশী রেখেছিল। ফলে, তাদের বক্তব্য মানুষ অনেক বেশী গ্রহণ করেছে। তবে, তৃণমূলের অভূতপূর্ব জয় ও বিছেপির শোচণীয় পরাজয়ের কারন বহুবিধ। এক এক করে এই ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
সবচেয়ে প্রধান কারন হল, এই ভোট মেরুকরণের ভোট। মেরুকরণ তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে নয়। রাজনীতির পঙ্কিল পরিসর এখন মেধাকে আকর্ষণ করে না। শুধু নিম্ন ও মধ্যমেধার মানুষজন স্বার্থের কামড়া কামড়ির জন্র রাজনীতি করে। এখানে ভোটের লড়াইয়ে বিজেপি বাঙ্গলার ইতিহাস না জেনে রাজনীতি করতে গেছে। বাঙ্গালী অস্মিতাই যে শশাঙ্কের বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জয় পেতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে তাকে নির্বোধের মত ইসলামী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের জয় বলে চালাতে গেছে। প্রচারের মূল সুর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মসিহা হিসেবে বিজেপির অবস্থান! আগে মুসলমান সমাজ ভোট রাজনীতিতে তিন ভাগে বিভক্ত থাকলেও তাদের অস্তিত্বের জন্য বাধ্য করল তৃণমূলকে ভোট দিতে। মোট ভোটারের প্রায় ৩৩% মুসলমান যারা প্রায় শতকরা একশ ভাগ ভোট দিল। মোটা মাথার বিজেপি সেনাপতিরা ধরে নিল, মুসলমানরা তৃণমূলের সঙ্গে আছে বলে হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে! এই অতি সরলীকরন তাদের মূর্খামির প্রতিফলন মাত্র। বিজেপির CAA ও NRC নিয়ে অবস্থান আসামে তাদের সুবিধা দিলেও বাঙ্গলায় তা শুধু সংখ্যালঘু ভোটকেই এককাট্টা করেনি, সেইসঙ্গে তাদের নমশূদ্র ভোটেও ফাটল ধরিয়েছে। এর জন্য মমতা ব্যনার্জীকে কৃতিত্ব দেওয়ার চেয়েও তৃণমূলের দিকে এই ভোট ঠেলে দেওয়ার কৃতিত্ব দেব বিজেপি নেতৃত্বকে!
এই ভোটের একটি লক্ষ্যণীয় দিক হল, ১৯৪৬ সালের পর থেকে কখনো পশ্চিমবঙ্গের এমন বিধানসভা হয়নি যেখানে কম্যুনিষ্ট ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কোন প্রতিনিধি নেই। নীতিহীন, পরিবারতন্ত্র দ্ধারা চালিত কংগ্রেস দল অবক্ষয়ের রাস্তায়। কম্যুনিষ্টদের অবস্থা আরো শোচনীয়।প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বের সময় থেকেই তারা ভারতে অবলুপ্তির পথে এগুচ্ছে। কিন্তু নেহেরু পরিবারের বদান্যতায় তারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমনভাবে নিজেদের গ্রোথিত করেছে যে শিক্ষায় তাদের আদর্শ ও ধান্দা শুধুযে প্রতিফলিত হচ্ছে তাই নয়, তাদের রাষ্ট্রবিরোধী 'ইজম'এ বলীয়ান হয়ে একদল অর্ধশিক্ষিত মানুষ মিডিয়া কন্ট্রোল করছে। সর্বভারতীয় স্তরে ততটা না হলেও এই রাজ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রায় পুরোটা এবং প্রিন্ট মিডিয়ার অনেকটাই তাদের কন্ট্রোলে। এর জন্য সিপিএমের ৩৪ বছরের নোংরা রাজনীতির অবদান যথেষ্ট। একটা অকাট্য প্রমান দিচ্ছি। যে কোন টিভি চ্যনেলে লোচনার যে প্যানেল থাকে তাতে একজন বামপন্থী অর্থাৎ সিপিএম থাকবে। কংগ্রেসীত থাকবেই। অথচ এই বামপন্থীদের বিধানসভা বা লোকসভায় এই রাজ্য থেকে কোন আসন নেই। এই জনসমর্থনহীন দলেয বক্ত্ব্য দর্শক ও শ্রোতাদের শুনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরা খেঁকশিয়ালের মত একযোগে বলতে থাকে তৃণমূল খারাপ কিন্তু বিজেপি বিপজ্জনক। সুতরাং বিজেপিকে একটিও ভোট নয়! ফলে, এই সিপিএম ও কংগ্রেসের সমস্ত সংখ্যালঘু ভোটাররা তৃণমূলের সঙ্গেই গেল। এরা রাজনৈতিক হারিকিরি করল। এর পিছনের গূঢ় কারন পরবর্তী সময়ে বোঝা যাবে।
এরপর আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যক্টরে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮৭ সালের পর থেকে মুসলমান জনসংখ্যা প্রজননের থেকেও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিএমের প্রত্যক্ষ মদতে সীমান্তপারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষতঃ অর্থনৈতিক কারনে অনুপ্রবেশে সাহায্য করে তাদের রেশান কার্ড ও ভোটার কার্ড করে দিয়ে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরী করা শুরু হল। এই সময় অসমীয়াদের প্রতিবাদ আন্দোলনে সেখানকার মুসলমানদের বড় অংশ রাজনৈতিক মদতে পশ্চিমবঙ্গে জামাই আদর পেল। কোন কেন্দ্রীয় সরকার ব্যপারটাকে গুরুত্ব দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জন্মহার দেখলেই তা পরিষ্কার হয়। বঙ্গীয় রাজনীতিকদের মাথায় এর পিছনের পরিকল্পনা ঢোকেনি! এখানে ২০১১ সালে পালা বদলের পর মমতা ব্যানার্জী সরাসরি মুসলিম তোষনের রাস্তায় গেলেন। মুসলমানরাও দেখল এই সুযোগ, অনুপ্রবেশ ও তার সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক কাজকর্ম বাড়িয়ে দিল। এদিকে রাজ্যের ভাড়ারে চাপ বৃদ্ধি ও এই জনবিস্ফোরনের ফলে ভারতীয় মুসলমানদের একটি বড় অংশ অসন্তুষ্ট হলেও তাঁদের অন্যভাবে চুপ করিয়ে রাখা হল। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মসজিদ,মাজার, কবরস্থানের সংখ্যাবৃদ্ধি। সাধারণ একটি হিন্দু পরিবারে একটি সন্তান জন্মালে ঐ সময় গড়ে একটি মুসলমান পরিবারে চারটি সন্তান জন্মায়। এখন যারা তের বা চোদ্দ বছর বয়সের, তারা আগামী বিধানসভায় ভোট দেবে। এখন ৩৩% মুসলমান ভোটার আছে পশ্চিমবঙ্গে। সুতরাং পরের নির্বাচনে এই মুসলমানরা একজোট হয়ে ভোট দিলে তারা ৫০% ভোটার হওয়ার কারনে তাদের মন্ত্রীসভাই গঠিত হবে। এটাই তাদের লক্ষ্য। সুতরাং এখন থেকে তারা এক ব্লক হিসাবে ভোট দেবে। এই নীতির রূপায়নের চেষ্টা প্রথম অসমে শুরু হয়। কারণ সেখানে জনঘণত্ব তুলনায় কম আর অনুপ্রবেশও সেখানেই প্রথম শুরু হয়। তারপর সেখানে ভূমিপুত্রদের আন্দোলন, অসম অ্যাকর্ড, শেষে সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারে NRC শুরু হল। তখন বাধ্য হয়ে বাঁচার জন্য হিন্দু জনগোষ্ঠী সেখানে জোট বেঁধে ব্লক ভোটিং শুরু করল। এরপর এই ভোটিং প্যাটার্নের জন্য সাম্প্রতিক নির্বাচনে কংগ্রেস মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়েও নির্বাচনে পরাস্ত হল। এতে বিজেপি বা তৃণমূল কোন ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হল দখলদারি ও বাঁচার লড়াই। এই একই কায়দায় আমরা কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের বিতাড়নের সময়ও দেখেছি। তবে, সেখানে শাসকগোষ্ঠী একই সম্প্রদায়ের হওয়ায় কাশ্মীর থেকে বড় মাত্রায় হিন্দু নিধন ও বিতাড়ন সম্ভব হয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের জেহাদী আক্রমণ ও সেখানকার আন্তজার্তিক পরিস্থিতি সরকারে আসীন বিজেপি দলকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। এটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জানে বলেই বিজেপির বিরুদ্ধে যে দল লড়াইয়ে জিতবে তাকেই তারা ভোট দিয়েছে। আজ তৃণমূলকে ভোট দিলেও প্রথম সুযোগেই নিজের গোষ্ঠীর শাসন প্রতিষ্ঠা করে তৃণমূলকেও এরা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। দ্রুত জনসংখ্যাবৃদ্ধি এদের নতুন নতুন জমি দখল ও অন্যান্য আগ্রাসনে যাওয়ার চাহিদা বাড়াচ্ছে। ফলে, এরা সেই চেষ্টা করবেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটাররা এই অত্যাচার ও দখলের পরিকল্পনা আঁচ করতে পারেনি। তাই এই ভয় তাদের মনে রেখাপাত করেনি।
এরসঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালীর মনে বহুদিনের কম্যুনিষ্ট শাসনের কুফলে সর্বদা একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী 'ইমেজ' কাজ করে - বিশেষতঃ উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে। যেমন রান্নার গ্যাসের ও পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি। এর সব দায় যেন কেন্দ্রের সরকারের রাজনৈতিক দল বিজেপির! যদি এই দাম কমিয়ে ভর্তুকি দিয়ে আমাদের পকেট থেকে উচ্চহারে ট্যাক্স চাপিয়ে অনেক বেশী টাকা নেওয়া হত তাহলে বোধহয় এদের কিছু বলার থাকত না! এরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী। এদিকে বিজেপির প্রচার বৈভবে তারাই শাসকদল হওয়ার ভাণ করেছে আর তাতে প্রকৃত শাসক দল তৃণমূল ফয়দা পেয়েছে। তাদের দূর্ণীতি, ঘুষ, খুণের মত অপশাসনের কোন প্রভাব ভোটে পড়ল না। বিজেপির নেতারা জনসংযোগ অপেক্ষা চোখধাঁধানো প্রচার, মিছিল, রোড শোতে ব্যস্ত থাকায় মিডিয়াতে তাদের ছবি বারবার এসেছে, বিনিময়ে ভোট কমেছে। উত্তর ভারতের ও বাঙ্গলার প্রচারের ধরন আলাদা। বাঙ্গলায় 'বানিয়ে দেওয়া' নেতাদের এই বোধটাও কাজ করেনি।
বরিষ্ট নাগরিকদের, বিশেষতঃ যাদের সম্মানজনক পেনশানের ব্যবস্থা নেই, তাদের জন্য একমাত্র সামাজিক সুরক্ষাছিল ব্যঙ্কের সুদ। তাঁদের অল্প কিছু সংস্থান (প্রয়োজনের তুলনায় মুষ্ঠিভিক্ষা মাত্র) করেই কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব ছেড়েছে। সুদের হার আমেরিকার মত করেছে, কিন্তু সেখানকার সকল মানুষের সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে সরকার উদাসীন! আবার সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষজন, বিশেষতঃ মহিলাদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের স্কীমগুলিকে চালু না করে রাজ্য সরকার নিজের মত করে ভিন্ন নামে চালু করেছে। এতে মানুষের মনে রাজ্য সরকারের জনদরদী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। পক্ষান্তরে এই টাকা যুগিয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপির ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এভাবে "ভাবের ঘরে চুরি" করে বিজেপির ক্ষতিই হয়েছে। কারন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সুফল মানুষকে বিজেপি নেতৃত্ব বোঝাতে পারেনি। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, টিভিতে বিতর্কসভায় বিজেপির যারা অংশগ্রহন করতেন তাদের দু একজন বাদ দিয়ে অন্যদের যোগ্যতা অত্যন্ত সীমিত। এর দায় বিছেপির মিডিয়া সেলের। পক্ষান্তরে, তৃণমূলের থেকে যারা বিতর্কে যেতেন তাদের সকলেই একই সুরে কথা বলতেন, অর্থাৎ তাদের হোমওয়ার্ক ঠিক ছিল। তৃণমূলের সরকার দ্বারা উন্নয়নের কথা তারা বারবার বলতেন।
তারপর বলতে হয় প্রার্থী নির্বাচন। আইপ্যাকের থেকে পেশাদারী সাহায্য নিয়ে সবকটি কেন্দ্রে প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সফল রাজনীতিক শ্রীমতি মমতা ব্যনার্জী নিজে তৃণমূলের প্রার্থী নির্বাচন করেছেন। অন্যদিকে বিজেপির প্রার্থী কে বা কারা নির্বাচন করেছে তা পরিষ্কার নয়। রাজ্য নেতারা দিল্লীর মুখাপেক্ষী। দিল্লী থেকে জম্মে রাজনীতি না করা লোকজনকে উড়িয়ে এনে প্রার্থী করা হল! এক সাংবাদিক, যিনি আবার মনোনীত সাংসদ, সেই পদের অমর্যাদা করে ভোটে দাঁড়িয়ে পরলেন। দিল্লীর তাবড় নেতারা এসে তার হয়ে বক্তৃতা করলেন। আমি একে যতটা জানি, বাঙ্গলায় ইনি কোন রাজনীতি বা সেবামূলক কাজ করেন নি। যখন তার সাংসদ পদের অমর্যাদা নিয়ে তৃণমূল সরব হল, তখন তিনি বাধ্য হয়ে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। এমন মানুষকে বাঙ্গলা কখনো গ্রহণ করে না। আবার একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর জেনারেলকে ভোটে নামিয়ে বিছেপির মুখ পুড়ল। মনে হয় না, বুথস্তরে এবং মন্ডলগুলিতে প্রার্থীপদ নিয়ে কোন প্রস্তাব দেওয়া নেওয়া হয়েছে। নীচের স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের দলের খানসামা ভাবা, ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা জনসম্পর্কহীন নেতাদের এখন এমন অবস্থা যে দলের কোন নেতাই এই ভোট বিপর্যয়ের দায়িত্ব নিতে রাজী নয়! সংঘ পরিবার পশ্চিমবঙ্গে মোটামুটি শক্তিশালী। কিন্তু তাদের বঙ্গ বিজেপির উদ্ধত, সবজান্তা নেতারা কোন পাত্তাই দেয়নি। উপদেশ শোনা ত দূরের কথা। বহু পুরোনো জাতীয়তাবাদী পার্টিকর্মীদের অপমান করা হয়েছে। দলে জামাই আদরে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে তৃণমূলের 'ছাটমাল' নেতাদের। এভাবে জনসাধারণের কাছে বার্তা দেওয়া হল, বিজেপিতে তাদের নিজেদের যোগ্য প্রার্থী নেই। দু মাস আগে বিজেপিতে আসা একজন কলেজ শিক্ষক, যিনি টিভির পর্দায় বসার নিরিখে নেতা - একসময় সিপিএম, তৃণমূল, সব দলের হয়ে কথা বলা মানুষ, তাকে প্রার্থী করা হল! অবধারিতভাবে ঐ বিধানসভায় দলের কর্মীরাইহতোদ্যম হয়ে পড়ল। উনি ওনার বিধানসভায় সমস্ত পৌর ওয়ার্ডে হেরেছেন। শুধু তৃণমুলের গোষ্ঠীদ্বন্দের কারনে একটিমাত্র ওয়ার্ডে কিছু ভোট বেশী পেয়েছেন। আরেকজন তৃণমূলের বড় নেতা, যাকে তার এলাকার লোকজন তোলাবাজীর জনক বলে জানে, যিনি গত পৌর নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে রিগিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন বলে অভিযোগ, সেই দলত্যাগী নেতাকে বিজেপি প্রার্থী করল। এই উদ্ধত নেতাটি নির্বাচনে দাঁ দাঁড়িয়ে প্রথমেই সাংবাদিকদের বলল, "আমাকে ওয়াকওভার দেওয়া হল"! সেই নেতা তার এলাকাতেই হেরেছে। এই উদ্ধত নেতা তার ব্যবহার ও এলাকার বিজেপি কর্মীদের ব্যবহার না করার জন্য বর্তমান মন্ত্রী ও জনপ্রিয় এমএল একে গতবারের থেকেও বেশী ভোটে জিততে প্রকৃতপক্ষে সাহায্য করল। তৃণমূলের এত সমালোচনা করা হয় অভিনেতা, অভিনেতৃদের দলে নেওয়ার জন্য, অথচ বিজেপি দলে দলে সফল, অসফল অভিনেতা, অভিনেত্রীদের তা মঞ্চ, টিভি, সিরিয়াল, ওটিটি, বড় পর্দা - যাই হোকনা কন - জাপটে ধরে কোন বাছবিচার ছাড়া প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল! অধ্যাপক সংঘ, বিজেপি এবং অন্য সব বিরোধীদল শিক্ষামন্ত্রীর পাহাড়প্রমান ব্যর্থতা নিয়ে সরব। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হল এমন একজন অভিনেত্রীকে যিনি কখনো স্কুলের গন্ডি পেরোননি। তিনি তার নিজের এলাকাতেও কখনো রাজনীতি বা সমাজসেবামূলক কাজ করেননি। উপরন্তু ভোটপর্ব চলাকালীন এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে তার ঘণিষ্টতা সংবাদমাধ্যমে খবর হোল। যিনি বা যারা এইসব প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছেন তারা তার দায় নিতে বাধ্য। সবশেষে বলি এই লেখা পাঠনোর সময় পর্যন্ত কোন বিজেপি নেতা ভোট বিপর্যয়ের দায় নেয়নি। কেউ পদত্যাগ করেনি! তবে কি ধরে নিতে হবে, এইসব নেতারা পদের জন্য রানীতি করছেন - সমাজসেবা ভড়ং মাত্র?
পরিশেষে শ্রীমতি মমতা ব্যনার্জীর উদ্দেশ্যে বলি, আপনি এখন পশ্চিমবঙ্গের সকল মানুষের মূখ্যমন্ত্রী - তৃণমূলের মূখ্যমন্ত্রী নন। এই যুদ্ধে আপনি জিতেছেন তৃণমূলের পজিটিভ ভোটে নয়, বিজেপির বিরুদ্ধে নেগেটিভ ভোটে। আপনি যদি সুষ্ঠুভাবে সমদর্শী নীতিতে রাজ্য চালান, বাঙ্গালী অস্মিতাকে যথাযথ সম্মান করেন, সর্বোপরি বর্ডার রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যত্নবান হোন, তবে আপনি আবারো জিতবেন - অন্যথায় মনে রাখবেন, পলিটিক্যাল সায়েন্সের নীতি অনুসারে কোথাও রাজনৈতিক শূন্যতা (political void) থাকেনা।