ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অনন্যসাধারণ ক্যারিশ্মা ও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের দল কংগ্রেসের সরকার হওয়ায় তখন পশ্চিমবঙ্গে “ডাবল ইঞ্জিন”এর সরকার ছিল। পরবর্তী সময়ে কখনোই কেন্দ্রের শাসকদল পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আধিপত্য করতে পারেনি (১৯৭২ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়া)। এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা সবই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। তাই নিরপেক্ষভাবে এর কারন অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হল।
পশ্চিমবঙ্গের জন্মের আগে থেকেই বাঙ্গালীদের স্বাতন্ত্রতা ঔ বোধের উপর ভিনরাজ্যের মানুষজনের বিমাতৃসূলভ ব্যবহারের ইতিহাস বাঙ্গালী জাতির অস্মিতাকে বারবার আঘাত করেছে। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে কয়েকটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে।
জাতীয় কংগ্রেসের ‘পালক পিতা’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর বিভিন্ন সময়ের উক্তি ও ব্যবহার বাঙ্গালী মনে গভীর আঘাত করেছে। এমনকি লাল-বাল-পাল ত্রয়ীর বিপিনচন্দ্র পাল যে “পূর্ণ স্বরাজ” আদায়ের জন্য অরবিন্দের বিপ্লবী পথ অনুসরণ করেছিলেন, তার তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন এই গান্ধীজী! তাঁর তাবেদারী করা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বৃটিশ বিরোধীতার বিপ্লবী পথকে সরাসরি বিরোধীতা করেছিল। এই কারনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে জীবনের শেষ ছ বছর বিপিনচন্দ্র পাল রাজনীতির সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। বাংলা থেকে দুটি বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী সংগঠন, যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি তৈরী হয়েছিল। ইংরেজের কারাগারে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক যে বিপ্লবীদের ফাঁসি হয়েছিল তারা বাঙ্গালী। তার পরেই আছেন পাঞ্জাবীরা। গান্ধীজী অত্যন্ত রূঢ়তার সঙ্গে এই বিপ্লবীদের নিন্দা করতেন ও বৃটিশের রক্ত ঝরানোর কোন পদ্ধতিকেই তিনি সমর্থন করতেন না। তাছাড়া, গান্ধীজী ও জওহরলাল নেহরু নির্বাচিত কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তঞ্চকতাপূর্ণ ব্যবহার করেন। তাদের বাঙ্গালী বিদ্বেষ ও সৈরাচারী কাজকর্ম বাঙ্গালী নেতাদের লাগাতার বিরুদ্ধাচরন বাঙ্গালীকে ‘গান্ধীর চরকায় স্বাধীনতা’ তত্ত্বকে বিদ্রুপ করতে প্ররোচিত করেছে। এমনকি, গুজরাতি রাজনীতিকদের মধ্যে গান্ধীজীর মতের বিরোধী নেতাদের কাউকেই তিনি রেয়াত করেননি। বিঠলভাই প্যাটেলের মত ব্যক্তিত্ব গান্ধীজীর কঠোর সমালোচক ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সমর্থক ছিলেন বলে গান্ধীজীর চেলা জওহরলাল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এখন অব্দি বিঠলভাইয়ের জীবন ও কাজ নিয়ে কোন প্রচার হয়নি। অথচ বিঠলভাইয়ের ছোট ভাই বল্লভভাই প্যাটেল গান্ধীজী ও জওহরলালকে সাথ দেওয়ায় তাঁকে বিশাল স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে দেখানো হয়। এই বল্লভভাই প্যাটেল কিন্তু জওহরলালের মতই নিজের মেয়েকে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করান। এখনকার কেন্দ্রীয় সরকার বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল স্ট্যাচু বানিয়ে তাঁর কর্মকান্ডকে মাণ্যতা দিয়েছেন! এদিকে সুভাষচন্দ্র ও চিত্তরঞ্জন দাশকে সমর্থন করা বিঠলভাইয়ের কপালে জুটেছে অবহেলা, অবজ্ঞা ও বঞ্চনা। বিলভাই তাঁর মৃত্যুর পূর্বে উইল করে তাঁর সম্পত্তির তিন চতুর্থাংশ দিয়ে যান সুভাষচন্দ্র বসুকে তাঁর স্বাধীনতার জন্য লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আশ্চর্যজনকভাবে বিঠলভাইয়ের মৃত্যুর পর বল্লভভাই এই উইলকে চ্যালেঞ্জ করেন। অনেকে বলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে বৃটিশের তলায় তলায় ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে বল্লভভাই আদালতে মামলা জিতে বিঠলভাইয়ের সম্পত্তির দখল নেন। সেখান থেকে কোন অর্থ সুভাষচন্দ্রের কাছে যাতে না যায়, তা একটি বড় কারন ছিল এই মামলার! এসব ঘটনা বাঙ্গালী জানে! সেই বল্লভভাইয়ের স্ট্যাচু পুজারীরা বাঙ্গালী ও বাংলার কাছে কি বিশ্বাস বা সম্মান আশা করেন?
এবছর রিপাবলিক ডের গুজরাতের ট্যাবলোতে বৃটিশরাজের সময় ১৯২২ সালে, ১২০০ আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গুলি করে হত্যা করার একশ বছর পূর্তিতে সসেই ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু, এছাড়া কোন গুজরাতি স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিপ্লবীর খোঁজ মেলে না, যিনি বৃটিশ শাসকের হাতে শহীদ হয়েছেন! আবার, ১৯৪৫ সালে এই বাংলায় নীলগঞ্জের কারাগারে বন্দী প্রায় ২৩০০ জন INAর অফিসার ও জওয়ানকে বিনা প্ররোচনায় বৃটিশ ফৌজ গুলি চালিয়ে হত্যা করে। হিসেব অনুযায়ী ঐ সময় ঐ কারাগারে দশ হাজার INAর যোদ্ধাদের রাখা হয়েছিল। সংখ্যার বিচারে এই হত্যা জালিয়ানওয়লাবাগের চেয়েও অনেক বেশী প্রাণঘাতী। আশ্চর্য হচ্ছে, স্বাধীনতা উত্তর কোন কেন্দ্রীয় সরকার ইতিহাস বই ও পাঠ্য পুস্তকে এই ঘটনাকে স্থান দেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বৃটিশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গিন্ধী ও তার অনুচর জওহরলালের কংগ্রেস সরকার INAর বন্দীদের যুদ্ধবন্দীর স্বীকৃতি দেয়নি। এখনকার কেন্দ্রীয় সরকারও একই পথের পথিক! জানিনা কোন গুজরাতি একাত্মতার ব্যপার আছে কিনা! এসব কিন্তু বাঙ্গালী মনে রেখেছে। অথচ, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা বহুল প্রচারিত – এ কারনে বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃটিশের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে লর্ড মাউন্টব্যটেনের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর চুক্তি মোতাবেক INAর কোন পদাধিকারীর কোন সম্পান, অর্থ এবং অন্য কোন প্রকারের স্বীকৃতি থাকবে না! অধিকন্তু তাদের স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনী বা অন্য কোন সরকারী দায়ীত্বে রাখা যাবে না। জওহরলাল ওই চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে মেনেছিলেন। শুধু তাইনয়, আজ পর্যন্ত কোন কেন্দ্রীয় সরকার এই চুক্তি বাতিলের জন্য পদক্ষেপ করেনি। এতে ক্ষতির চেয়ে বড় কথা – বাঙ্গালীর হৃদয়মণি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর INAকে অপমান করা – যা বৃটিশ সরকারের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার করেছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ও তার পরিচালনায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলি বাঙ্গালীর কাছে শত্রু হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।
যখন জওহরলাল ও তার পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার উন্নয়নের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ দিতে গড়িমসি করেন (যা এখনো অনেকাংশে বজায় আছে), তখন অন্য কিছু রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় উন্নয়নের জন্য অর্থের অভাব হয় না। সেই ট্র্যাডিশান এখনো চলেছে।
১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ ও জেহাদী ইসলামের তাড়নায় পূর্ববঙ্গ থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে বাঙ্গালী হিন্দুর ‘রিফিউজি’ তকমা নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে আগমন এই রাজ্যের মানুষের উপর প্রচন্ড অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে। উদ্বাস্তু পূনর্বাসনের কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় এবং পঞ্জাবের তুলনায় বাংলার রিফিউজিদের সঙ্গে বিমাতৃসূলভ আচরণ করায় কেন্দ্রের শাসক রাজনৈতিক দলের উপর বাঙ্গালীর ক্ষোভ বাড়তেই থাকে। এরপর উদ্বাস্তুদের নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। কেন্দ্রের ও রাজ্যের দুই সরকারই মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই করেননি। রাজ্য সরকার তবু উদ্বাস্তুদের দখলীকৃত সরকারী জমির উপর বসবাসকে আইনী স্বীকৃতি না দিলেও তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করেননি। যার ফল স্বরূপ এই রিফিউজিকুল রাজ্য সরকারের সরাসরি বিরোধীতা না করলেও কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ বাড়তেই থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে দখলীকৃত কলোনিগুলির উদ্ভব শুরু হয়। কলোনিগুলির নামকরনে স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হওয়া বাঙ্গালী বিপ্লবীদের প্রাধান্য দেখে বাঙ্গালী মানসিকতার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ১৯৭৯ সালে মরিচঝাঁপির নির্মম গণহত্যার ঘটনা এই মানুষগুলির অনেককেই রাজ্যের সরকারের বিরোধী করে তুললেও তার জন্য তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক হয়ে ওঠার কোন কারন ঘটেনি।
এদিকে রাজ্যের মানুষের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলগুলির দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে রাজ্যের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙ্গালীকে কেন্দ্র বিরোধী অবস্থান নিতে প্ররোচিত করে। তখন থেকেই বাঙ্গালীর ভাগ্যাকাশে চরম দূর্ভোগ শুরু হয়। ইতিমধ্যে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জন অসন্তুষ্টিকে বিপথগামী করার জন্য এক রাজনৈতিক ছক কষা হয়। তা হল “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি” নীতিতে সেটিংয়ের রাজনীতি! অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, হরিয়ানা ইত্যাদির সঙ্গে এ রাজ্যেও এই রাজনীতি শুরু হল আশির দশকে – ইন্দিরা গান্ধীর দ্বিতীয় ইনিংস ও রাছ্যের বামফ্রন্টীয় মোড়কে জ্যোতি বসুর সিপিএমের সময়ে। প্রথম কয়েক বছর এই খেলা ভালোভাবেই চলল। এমনকি নরসিমহা রাওয়ের সময় পযর্ন্ত অসুবিধা না হলেও দু পক্ষের পরবর্তী কয়েকটি পদক্ষেপে এই সেটিং পাল্টে গেল! পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উল্কার গতিতে উত্থান হল নতুন তারকা শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর। জ্যোতি বসুর রাজনীতি অনুধাবন ও অনুসরণ করে তিনি বাঙ্গালী জণগনের মনের কাছাকাছি চলে এলেন। বাঙ্গালী মানসিকতা বোঝার ক্ষমতা এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশী যে রাজনীতিকের আছে তিনি মমতা ব্যানার্জী। বঞ্চিত, অবহেলিত বাঙ্গালী যখন সিপিএমের রিগিং ও সন্ত্রাস মেশিনারীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল, তখন বাঙ্গালী মননে যে পলায়ণবৃত্তি দেখা দিল তাকে অনেকে মেরুদন্ডহীণতা বলেছেন! আসলে, বাঙ্গালীর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায় তার অর্থনৈতিক পঙ্গুতার কারনে ধীরে ধীরে বাঙ্গালী এক “ভাতাজীবি” জাতিতে পরিণত হল। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অনেক সময় খেটে খাওয়ার কথা বলা হয়; অবশ্যই শ্রমের বিনিময়ে রোজগার সম্মানজনক – কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য যে, কাটমাণি,সিন্ডিকেটের বাঙ্গলায় – কলকারখানাহীণ বাঙ্গলায় – যেখানে পুলিশ শাসকদলের তাঁবেদাদ এবং সংবাদ-মাধ্যমগুলির মধ্যে শাসকের মোসাহেবীর প্রতিযোগিতা চলে – সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে এমন কোন আশার আলো এই রাজ্যের মানুষকে দেখানো হয়েছে কি?
পূর্বের মতই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাঙ্গালীর জন্য লিপ সার্ভিসের চেয়ে বেশী কিছু করেছে বলে ত জানা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৯এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের মানুষ, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে – যাদের ১৮টা লোকসভা সিটে জেতালো (সঙ্গে প্রায় ৫০% ভোট), তারনর থেকে সেই রাজনৈতিক দল কি করল? জেহাদীদের বিরুদ্ধাচরণ করার নামে একটি ধর্মকে ও সেই ধর্মের সকল মানুষকে অপমান করতে লাগল! বাংলার বাইরের কয়েকজন ভূঁইফোড় মানুষকে দলের নেতা নাম দিয়ে এই রাজ্যে মাতব্বরি করতে পাঠানো হল – এর মধ্যে জনা দুয়েক বাঙ্গালী নাম ছিল! মাটির সঙ্গে, মানুষর সঙ্গে সম্পর্কহীণ মানুষরা ২০১৬র নির্বাচনে ভূতের নৃত্য শুরু করল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থন ছাড়া এসব কি সম্ভব ছিল? আজ যখন কেন্দ্র-রাজ্য সেট-ইন দিনের আলোর মত পরিষ্কার, তখন একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না – এই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ২০২১শে র নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দলের জয়লাভ করা নিয়ে নিঃসন্দেহ ছিল! কারন, তাদের দল যদি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার জাতগায় থাকত, তবে নির্বাচনে এমন অর্বাচীনের মত প্রার্থী চয়ন না করে এমনভাবে প্রার্থী নির্বাচন করত, যাতে করে দলের জয়ী প্রার্থীরা প্রশাসন চালানোর মত দক্ষ হন। আরেকটি কথা, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর একটিও এমন রাজ্য আছে কি যেখান থেকে ১৮ জন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরেও একজন এমপিও ক্যাবিনেট মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন না! এই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাঙ্গালীর প্রতি অবিশ্বাস ও অবহেলার জবাব বাঙ্গালী দিতে শুরু করেছে।
শেষে বলি, সেট-ইনের চিত্রনাট্য বড্ড মেলোড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে। সেই এক খেলা – ইডি,সিবিআই, জামিনযোগ্য শমন, তারপত IPGMR এর ভিআইপি কেবিনে ভর্তি এবং সবশেষে ‘দিদিমণি’র দিল্লী আগমণ – বিশেষ আলোচনা – তারপর সব ঠান্ডা ঘরে! এর অবিসংবাদী ফল হচ্ছে, রাজ্যের বিরুদ্ধে মানুষ যখন বিক্ষুদ্ধ হবে, তখন কিন্তু তার গোপন সহযোগী রাজনৈতিক দলকেও ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের বোঝা উচিৎ, বাঙ্গালীকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অবিশ্বাস করে এবং শুধুমাত্র ধর্মের নামে ভোট চাইলে এই রাজ্যে সেট-ইনে থাকা সর্বভারতীয় দলের ঝুলিতে ২০২৪এ একটি আসনও জুটবে না।
Month: February 2023
ধর্ম ও ধর্ম ব্যবসার প্রভাব
ধর্ম জীবকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ করে। যে কারনে মানুষ মাত্রেই তার ধর্ম থাকে। মনুষ্যধর্ম মানুষের আদর্শ ধর্ম। মানুষ যখন স্বার্থ, হিংসা ও লোভকে প্রাধান্য দিয়ে মনুষ্য ধর্মের বিপরীত কর্মে লিপ্ত হয়, তখন মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট হওয়ায় সে পশুর তুল্য আচরণ করে। এই সময় অনেক ক্ষেত্রে সে তার ঘৃণ্য কাজের সমর্থনে যে যুক্তি দেখায়, তা হল ‘ধর্মের দোহাই’! যাকে পৃথিবী জুড়ে বলা হয়, “for the shake of religion” – ধর্ম ও religionএর তফাৎ এখানেই। সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারনা তৈরী করা হয়েছে, ধর্ম হল আফিমের মত নেশার জিনিষ; তাই তা বর্জনীয়! আর সেই একই যুক্তিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সব ধর্ম থেকে দূরে থাকার প্রয়াস বলে তা প্রশংসনীয় একটি গুণ (virtue)! এই অপ-ধারনার বশবর্তী হয়ে আমাদের দেশের, বিশেষতঃ আমাদের রাজ্যের এক বিপুল সংখ্যার মানুষ তাদের নিজেদের জীবন, জীবিকাসহ সামাজিক জীবনে অস্থিরতা ডেকে আনছে।
মানবিক আচরণ ও চিন্তাকে অর্থাৎ মনুষ্য ধর্মকে অন্য পথে চালানোর জন্য সবচেয়ে বেশী যা ব্যবহার করা হয়, তা হল, ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি – যাকে সংক্ষেপে religion বলে। মানুষের religion যাই হোক না কেন, তা কখনো মানুষে মানুষে বিভেদ, হিংসা বা সহাবস্থান বিরোধী অবস্থান নিতে পারে না। আবার ধর্মের যে পরম সত্য – সর্বজ্ঞানের আধার – তা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এক – ধারনা বা বিশ্বাস এক নিরাকার রূপ মাত্র। তিনি অদ্বৈতবাদী হিন্দু ধর্মের ভগবান পরম ব্রহ্ম, ইসলামে আল্লা, আব্রাহামিক ধর্মে ঈশ্বর বা গড।
ভারতবর্ষ যখন ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ত্রিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল, তখন মুসলিম লীগের দাবি মোতাবেক সব পক্ষই মেনেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের সহাবস্থান সম্ভব নয় বলে এই স্বাধীন দুটি খন্ডের ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামীদের বসবাসের জন্য স্বীকৃত হল। অথচ, হিন্দু, শিখ, জৈন ও বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য স্বাধীন ভারতের কোন রাষ্ট্রধর্ম না রেখে ইসলামসহ সব ধর্মের সামান অধিকার (মাইনোরিটির নামে ইসলাম ও খ্রীষ্টীয় ধর্মকে বিশেষ সুবিধা) দেওয়ার সংবিধান রচনা করে তদানীন্তন রাজনীতিকরা ভারতের অমুসলিম নাগরিকদের সঙ্গে তঞ্চকতা করেছিলেন। পৃথিবীর দুই সফল ভন্ড দেশপ্রেমিক জওহরলাল এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। এটি ভারতের জন্মের সময়ের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ভুল। জওহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার খেসারত এখনো ভারতকে দিতে হচ্ছে কাশ্মীরে। এই দেশের রাজনীতিকরা যেমন দেশের স্বার্থের আগে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ ও পারিবারিক স্বার্থকে দেখে সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তেমনি তাঁরা আন্তরিকতাবিহীন সেবা দিয়ে দেশের জনগণের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করেন! এই ধরনের রাজনীতির প্রভাব উপমহাদেশের সবকটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উপর প্রভাব ফেলেছে।
আমাদের ভারতের সংবিধান অনুসারে এই দেশের যে কোন নাগরিকের তাঁর religion অনুযায়ী ধর্মাচরনের অধিকার স্বীকৃত। এখানেই যত গোলমাল! ভারতে স্বেচ্ছায় ও কারো কোন প্রভাব ব্যতিরেকে মানুষ তাঁর ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন। ফলে, বিদেশী সাহায্যে পুষ্ট খ্রীষ্টান মিশনারীগুলি দারিদ্র ও অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন ভারতে ধর্মান্তরকরন শুরু করে। বিশেষতঃ দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণে তারা সাফল্য পায়। এই ধর্মান্তরকরন যেহেতু অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে করা হয়েছে, সেহেতু এটি বেআইনি – সংবিধানগত দিক থেকে। কিন্তু তা মানে কে? কারন, এসব দেখতে গেলে এই হতভাগ্য মানুষগুলোর দারিদ্র ও অসহায়তা দূর করার দায় দেশের সরকারকে নিতে হয়! সরকার চালানো রাজনীতিক ও প্রশাসকেরা সে কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
তারপর গঙ্গা, যমুনা, শতদ্রু, বিপাশা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। ধর্মান্তরকরনের সুবিধা ব্যবহার করে ভারতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় অনুপ্রবেশের সুযোগ নিতে শুরু করল ইসলাম। একথা ঐতিহাসিক সত্য যে, ইসলামের ধর্মীয় অনুশাসনের অনমনীয়তা এবং তার বিস্তারবাদী চরিত্র এ কাজে সহায়ক হয়েছে। সামাজিক অনমনীয়তা ও ধর্মীয় প্রভূত্ববাদী চরিত্র একমাত্র ইসলামকে আবদ্ধ করে না রাখলেও, এই ধর্মীয় আবশ্যকতার দিকগুলিকে সবিস্তারে তুলে ধরার কাজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে এই ধর্মের ঠিকাদার মৌলভীদের মারফৎ ইসলামী সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া চলতে লাগল। ধর্মস্থান ও শিক্ষায়তনগুলিকে ব্যবহার করেই ১৯৪৬ সালের কোলকাতা গণহত্যা ও নোয়াখালী গণহত্যা সংঘটিত হল। তার পরেও এই ধরনের গণহত্যা যাতে আর না ঘটে তার জন্য ভারতীয় রাজনীতিকরা মোটেই যত্নবান ছিলেন না।
এরমধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা তাদের জেহাদী ইসলামী চরিত্র তথাকথিত “ধর্মনিরপেক্ষতা”র আড়ালে লুকিয়ে রেখে সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়াতে যার পর নাই ইন্ধন যোগালো। এরা অবশ্য প্রথম থেকেই হিন্দু ধর্ম বিরোধী এবং ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা শুধু ভারতের ক্ষেত্রে জেহাদী ইসলামের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা হিসেব করে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। কাশ্মীরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু নিধন ও হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপে যেমন, পালঘর সন্ন্যাসী হত্যা, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং তাদের রিফিউজি মর্যাদা দেওয়া – ইত্যাদির দাবীতে এদের ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে জেহাদী ধর্মীয় চরিত্রের রূপ প্রকাশ পেয়েছে। আবার চীনে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর ইসলামীদের উপর সে দেশের সরকারের অমানবিক অত্যাচারের প্রশ্নে এই কম্যুনিষ্টরা সম্পূর্ণ মৌণব্রত নিয়েছে – পাছে পালিত বাবা চীনা কম্যুনিষ্ট পার্টি চটে যায়! এভাবেই এরা ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভেদ ও জেহাদী উত্থানের মদতদাতা হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করেছে।
এরপর আসি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রভাবে। এখানে একটা কথা বোঝা দরকার। তা হল ভারতীয় হিন্দুদের সহিষ্ণুতা – যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। যেমন, সামাজিক চাপসহ বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, লাভ জেহাদের ঘটনা বাড়িয়ে একদিকে যেমন জেহাদী ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তা ব্যুমেরাং হয়ে বিপরীত ক্রিয়ায় হিন্দু-সংহতিকে নতুন ভাবে সজীব করে তুলেছে। এখান থেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতে ধর্মের নামে গোষ্ঠী সংঘাত শুরু হয়। নিউটনের পদার্থবিদ্যার সূত্র – প্রতিক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেই ক্রিয়া যখন শুরু হল, তখনই চারদিকে ‘গেল গেল’ রব উঠল। তখন প্রত্যেক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ – অবশ্যই বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শুরু হল। কোন ভারতীয় নাগরিক – তিনি যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন – কাশ্মীরের প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থান এবং কাশ্মীর থেকে তার ভূমিপুত্র, হিন্দু পন্ডিতদের বিতাড়ণ ও হত্যাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন জানাতে পারে? ভারতের বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দ সে কাজটিই করছে! ফল – রাজনীতিতে হিন্দু-ইসলামী বিভাজন যার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ক্ষতির মুখে দুই ধর্মের মানুষজন। যারা এই বিভাজন শুরু করেছেন ও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বুঝতে হবে যে তাদের অনুগামীদের তারা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলেছেন।
ইসলাম ধর্ম মোতাবেক, যারা পবিত্র রমজানের রোজা রাখেন, তাঁরাই একমাত্র উপবাসভঙ্গের ইফতারে অংশগ্রহনের অধিকারী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মসূত্রে প্রেসিডেন্সী কলেজ লাগোয়া হিন্দু হোস্টেলে আমি কখনো হিন্দু ছেলেমেয়েদের আধুনিক পোষাকে ফেজটুপী পড়ে ইফতার পালন করতে দেখিনি।একে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে না – আত্মসম্মানবোধ হারানো, ধর্মের নামে দালালীর পরাকাষ্ঠা হতে পারে মাত্র। ইসলামে হিন্দু মহিলারা পরিবারের বাইরের পুরুষদের সঙ্গে বসে পুরুষের মত ফেজটুপী পড়ে ইফতার করছে – এই দৃশ্য ইসলামকে কলুষিত করছে। সাচ্চা ইসলামী এসব সমর্থন করেন না। আবার, আজকাল বারোয়ারী দূর্গাপুজায় কোথাও কোথাও কোরান পাঠ হচ্ছে! এতে দূর্গাপুজা ও পবিত্র কোরান উভয়েরই অপমান করা হচ্ছে। এগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধ্যাষ্টামো ছাড়া আর কিছু নয়।
দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ২০১৪ সালে তুরষ্কের ইস্তানবুলে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের শেষে প্রায় শ খানেক গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য বসফরাসের উপর এক গালা ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে দু তিনজন ভারতীয় হিন্দুর সঙ্গে আমিও ছিলাম। ডিনার টেবিলে আমার প্লেট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক অস্বস্তিকর গন্ধ পাওয়ায় ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো টেবিলে সকলের জন্য ‘বিফি’ সহ ডিনার সার্ভ করা হয়েছে। আমার ধর্মীয় পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা প্লেট তুলে নিয়ে গিয়ে আমাকে আলাদা প্লেটে কিছু ভাত, বাটার আর আলুভাজার প্যাকেট দিয়ে গেল। জানালো, এসব পুরোপুরি ‘ভেজ’। এটাই স্বাভাবিক। এদিকে খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ইফতার পার্টিতে আবশ্যক ছিল গোমাংস। এতে অস্বাভাবিকতা নেই। কারন ইফতারের জন্য রোজা রাখা মানুষজন ইসলামী হওয়ায় এটা তাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পড়ে। সমস্যা হল, ইফতারে হিন্দুদের আমন্ত্রণ করা নিয়ে। কোন হিন্দু যদি তার অনুষ্ঠানে ইসলামী মানুষদের নিমন্ত্রণ করে শুয়োরের মাংসের আইটেম পরিবেশন করেন, তখন তা কি শোভন হবে? এই যুক্তিতেই বাংলাদেশের বিএনপি দলের নেত্রীর আচরণকে হিন্দু বিরোধী জেহাদী আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। মুশকিল হচ্ছে, ভারতে এমনই বিনপি মার্কা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার বাণী শুনে শুনে জনসাধারণ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত। এভাবেই ‘হালাল’ জিনিষ ব্যবহার ইসলামী ঐতিহ্য হলেও রাজনীতির ঔদাসীন্যে ও সামাজিক নিষ্ক্রিয়তায় তা হিন্দুদের গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ, হিন্দু ঐতিহ্যের ‘ঝটকা’ মাংসের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগীতা পাওয়া যায় না।
এসবের প্রভাবে সমাজে ধর্মীয় বিভেদের শুরু মৌলবাদী মৌলভী ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভারত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরা করলেও এখন তা মহামারীর আকার নিয়েছে।এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব ধর্মের মানুষই। তাই, দেশের রাজনৈতিক শাসকদের থেকে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ধর্মীয় অনুশাসন আরোপ করা জরুরী।
পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব আর কতদিন
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু বাঙ্গালীদের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৭১ সালের পর সেই পূর্ব পাকিস্তান যখন স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ হল, তখনো হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও তাঁদের পশ্চিমবঙ্গে রিফিউজি হিসেবে আগমন বন্ধ হল না। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” – আল্লাহ্ বিনা কোন সত্য মাবুদ বা উপাস্য নাই, মুহম্মদ ছাড়া কোন নবী নাই। এটি ইসলামের মূল কথা। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে কোন ধর্মীয় নমনীয়তা বা সহনশীলতা নেই। এই কারনে কোন ইসলামী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হতে পারেন না। অথচ, ইসলামে আরো অনেক কিছু আছে – কোরানেও এমন আয়াত আছে, যেখানে অমুসলিমদের রক্ষা করার বার্তা মুসলিমদের দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এটি প্রাথমিক হলেও শেষ কথা নয়। গন্ডগোলের জায়গাটা ভিন্ন। আরব মরুভূমিতে যাযাবর মরুদস্যুদের মধ্যে প্রথম এই ধর্মের সূচনা হয়। সেই মানুষদের চিন্তাধারা ও জীবনশৈলীর প্রতিফলন তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে এবং আচার আচরণে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। আরব মরুভূমির কৃষ্টি, সভ্যতা ও জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য সারা পৃথিবীর মুসলিমদের মত বাংলাদেশের মুসলিমদের বৃহত্তর অংশের মধ্যে দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বের আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে ইসলামী জনগণকে (বিশেষতঃ অশিক্ষা ও দারিদ্রের মধ্যে থাকা মানুষদের) দূরে রাখার প্রচেষ্টা শুরু হয় মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে – যার হোতা মৌলবী ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ১৯৪৬ এর “দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” ও “নোয়াখালী গণহত্যা” থেকে কাশ্মীরের হিন্দু নিধন – সবই শুরু হয় এই ধর্মীয় ও শিক্ষার স্থান থেকেই! আসলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও হিংসার উৎস হচ্ছে ধর্মগ্রন্থের খন্ডিতভাবে কিছু আয়াতের উদ্ধৃতি ও তার অপব্যাখ্যা। যেমন, পৃথিবীতে ভালো কাজের জন্য আল্লাহ্ মুসলমান পুরুষকে জন্নতে আরামে রাখবেন বলা হলেও সেখানে বাহাত্তর হুরী (সুন্দরী বেশ্যা) উপভোগ করার কথা পরবর্তীতে এই সব মৌলভীদের অপব্যাখ্যা। আবার মহিলারা ভালো কাজের জন্য জন্নতে গিয়ে কি পাবেন সে সম্বন্ধে এরা নিশ্চুপ। এভাবে পুরুষদের সকল ভোগ- অধিকার – মহিলাদের নয়- এমন পুরুষতান্ত্রিক মরুদস্যুদের মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাকে আধুনিক যুগে মানানোর জন্য ধর্মের আশ্রয় নেওয়া ভিন্ন আর কিছু নয়। ইসলাম একটি প্রভূত্ত্ববাদী, বিস্তারক চিন্তার ধর্ম হওয়ায় এই ধর্মকে অনৈতিকভাবে তার জেহাদী আগ্রাসনে ব্যবহার করে রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক ফয়দা তোলার চেষ্টা সবসময় দেখা যাচ্ছে। মধ্যযুগের আরব বেদুইনদের (যারা আদি ইসলামী) ধর্ম হওয়ায় এবং তাদের সমাজ পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় এখনো, বিশেষতঃ, জেহাদী ইসলামীরা তাদের সমাজের নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেয় না। অথচ, সেই মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশগুলিতে এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় শিক্ষিত, পরিশীলিত, ভদ্র ইসলামী সমাজে আধুনিকতার স্পর্শে নারী পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত। জেহাদীদের কাছে নারী, বিশেষ করে বিধর্মী নারী (মালাউন) শুধু ‘ভোগের সামগ্রী’। মধ্যযুগীয় আরবী বেদুইন সভ্যতার ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই জেহাদী ধর্মীয় মৌলবাদ শুধু ভারতেই নয়, এরা যখন যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় থাকে, সেখানেই তাদের ধর্মীয় মৌলবাদ কায়েমের চেষ্টা করে। বিজিতের ধনসম্পত্তি লুঠ, হত্যা ও নারীর ইজ্জত হরণ এদের ঐতিহাসিক পরম্পরাকে বহন করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু সভ্যতা আবার এখানকার জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে। সে অর্থে এই উপমহাদেশের হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই একই জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতি থাকার কথা। কিন্তু, নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতি ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা এই মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে পরধর্ম ঘৃণার বাণী ছড়িয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ বপন করে চলেছেন। তা স্বাভাবিক নিয়মেই ভারত বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়েছে। তিন তিনবার ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে decisively হারের পর পাকিস্তান ও জেহাদী শক্তি তাদের আক্রমণের ধরন বদলায়। তারা ভারতের অভ্যন্তরে জেহাদী তৈরী ও অন্য ধর্মের মানুষ অপেক্ষা মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে নজর দেয়। এক্ষেত্রে হিন্দুদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও চিন্তাধারা তাদের কাজের সহায়ক হয়। সঙ্গে তারা তাদের ছদ্মবেশী বন্ধু হিসেবে “ধর্মনিরপেক্ষ” ভারতীয়দের সমর্থন পায়। আগে একাধিক লেখায় দেখিয়েছি, ইসলাম ও খ্রীষ্ট ধর্মে এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ভালো কথা বা ভালো গুণ নয়। ধর্ম – তা সে যে ধর্মই হোক না কেন, জীবকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উন্নীত করে। আবার, ভারতের কিছু দেশবিরোধী ছদ্মবেশী রাজনৈতিক নেতার ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে তাদের “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা”র সপক্ষে যুক্তি সাজানোকে বৃহত্তর হিন্দু সমাজ গ্রহণ না করলেও তারা তাদের কুযুক্তি দেশের কিছু জায়গায় অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে! অজস্র ইসলামী সেকুলার কাজের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এক তথাকথিত হিন্দু অভিনেত্রী কাম রাজনীতিক তাঁর ভালো লাগার কথা প্রকাশ করলেন – দূর্গাপুজোয় তিনি গরুর মাংস খাওয়া পছন্দ করেন! এই অর্ধশিক্ষিত মহোদয়াকে যদি ঈদের দিনে শুয়োরের মাংস খাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়, তিনি আসবেন না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত। আবার এক সর্বভারতীয় কম্যুনিষ্ট দলের (যারা সবাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’) বঙ্গের সর্বোচ্চ নেতা তাঁর ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিজের ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের উপরে ‘ইনশাল্লা’ লেখেন। তার ধর্ম তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ না ইসলাম? এক দেশের এক আইন – সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত ও আদৃত। আমাদের উপমহাদেশের অন্য দেশগুলিতেও তাই ঠিক। কিন্তু ভারতে একই দেওয়ানী আইনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড! ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর এই ল বোর্ডের অস্তিত্ব থাকাটাই ভারতের স্থায়ীত্ব বিরোধী। আবার দেখা যাচ্ছে, মসজিদ থেকে দিনে পাঁচবার মাইকে আজান দেওয়া হচ্ছে! মন্দিরের সকাল সন্ধ্যা মঙ্গলারতি ও ঘন্টাধ্বনি মুসলিমরা তাদের এলাকায় বন্ধ করে দিচ্ছে! এভাবে, দেশের মধ্যে ইসলামাইজেশানের দিকে সমগ্র ভারতকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতারা রাস্তা আটকে পূজো করার বিরুদ্ধে। তারা কেউ কখনো রাস্তা আটকে নামাজ পড়ার বিরোধীতা করেননি! দূর্গাপুজো ও কালীপুজোর সম য় মাইক ও বাজীর আওয়াজে এই নেতাদের অসুবিধা ও সাধারণ মানুষের ক্ষতির খতিয়ান “বাজারী” সংবাদ-মাধ্যমগুলি প্রতি বছর প্রচার করে; আজানের মাইকের শব্দ ও শবেবরাতের বাজীর শব্দ যখন হয় তখন তাদের নিঃশব্দতা অন্য ধারনা জাগায় না কি? এরা রামনবমীর অস্ত্রসহ মিছিলের বিপক্ষে হলেও মহরমের অস্ত্রসহ মিছিলের পক্ষে! ভাবের ঘরে এরা আর কতদিন এভাবে চুরি করতে থাকবে!
বেশ কিছুদিন আগে এক দৈনিক সংবাদপত্রে আমি লিখি, ভুল পদ্ধতিতে TFR (Total Fertility Rate) গণনার কারনে ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শিশু জন্মহার সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। কারন, এক্ষেত্রে মায়েদের জন্ম দেওয়ার হার গণনা করা হয়। কিন্তু একজন ইসলামী পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকতে পারে বলে ইসলামী শিশুর জন্মহার কম দেখানোর সুযোগ আছে। জেহাদী ইসলামের প্রভাবে ভারতে লাভ জিহাদ ও মুসলমানদের মধ্যে যৌন অপরাধ অনেক বৃদ্ধি পেলেও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তথাকথিত হিন্দুরা নিশ্চুপ থেকে যান। এসবের থেকে একটা ছবি পরিষ্কারভাবে উঠে আসে – জেহাদী ইসলামের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত ‘সোনার চাবি’র একাংশ এই নমাজপন্থী সমাজবাদীদের অর্থাৎ “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষ” হিন্দুদের কাছে আসে।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কথা বলতে গেলে তাকে শোচনীয়র থেকেও খারাপ বলতে হয়। একে ত এই রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ মানুষ ইসলামী, উপরন্তু এখানে হিন্দু নামধারী ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। ফলে, এখানে তারা ভোট গণতন্ত্রে জেহাদী মতবাদ ও জেহাদী সভ্যতাকে রাজ্যের জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম। এ রাজ্যের সংবাদ-মাধ্যম পর্যন্ত ‘সোনার চাবি’র গুণে বশীভূত। এ রাজ্যে ‘হালাল মাংসের সমর্থক ধর্মনিরপেক্ষদের একজনকেও ঝটকা মাংসের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখিনি। আসলে এরা মনে প্রাণে “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” গ্যাংয়ের সমর্থক। এদের মত অর্ধশিক্ষিতদের একটা কথা মনে করিয়ে দিই – পৃথ্বীরাজকে মহম্মদ ঘোরী জয়চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতায় হারালেও প্রথম দিনের দরবারে ঘোরী প্রথম যাকে কোতল করে সে হল এই জয়চাঁদ! মহম্মদ ঘোরীদের আরব সভ্যতা এভাবেই বিচার করে।
বাঙ্গালী ‘ভদ্রলোক’ হিন্দু ঐতিহ্যের অপব্যখ্যা করার পরম্পরা পেয়েছেন কম্যুনিষ্ট লিগ্যাসীর উত্তরাধিকার হিসেবে। যেমন “বসুধৈব কুটুম্বকম” এর কম্যুনিষ্ট ব্যখ্যা হল, “জেহাদী, রোহিঙ্গাকো আপনাও, ঔর উসকে বাদ হিন্দুত্ব সে আজাদী লাও”! যেমন কিছু অর্ধশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী “অমৃতস্য পুত্রাঃ”র সমালোচনা করে বলেছিলেন – এখানে নারীর সম্মান নেই! কারন, পুত্রের কথা বলা হলেও পুত্রীর কথা নাকি বলা নেই! এই বাঙ্গালী তথাকথিত বুদ্ধিজীবির দল এখন আমজনতার কাছে বিরক্তি উৎপাদক আর কমিক চরিত্র হয়ে উঠেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পেলেও গুরুকুল সংখ্যা কমে এক দশমাংশ হয়ে গেছে। এই মাদ্রাসাগুলি শুধু এদেশেই নয়, বাংলাদেশও জেহাদী তৈরীর কারখানা। মাদ্রাসা-শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙ্গালীদের দাপটে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অঙ্গ – বাউল গান, কবি গান – এসব অমূল্য সম্পদ বাংলাদেশে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার বদলে আরবী সংস্কৃতির জলসা-মেহফিল বেড়েছে।
এপার ও ওপার, দুই বাংলাতেই আরবী সংস্কৃতির চাপে বাঙ্গালী সংস্কৃতি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমান। তাঁরা না পারছেন বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে ভুলতে; না পারছেন আরবী সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে। এভাবে বেশীদিন চললে পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুরা নিজেদের স্বভূমে পরবাসী মনে করবেন। তাই দরকার, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জেহাদের বিরুদ্ধে সবল প্রতিরোধ। একথাও সত্যি যে, বাঙ্গালীর সংস্কৃতি না বাঁচলে শিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী সংস্কৃতির ক্রীতদাস হয়ে কাটাতে হবে। আর হিন্দু বাঙ্গালী নতুন করে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করার জন্য তৈরী হবে। এই লড়াইয়ের একদিকে বাঙ্গালী মননের শিক্ষিত মুসলমান এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী বাঙ্গালী আর অন্যদিকে জেহাদী ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদের শত্রু,”ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” গ্যাংয়ের সমর্থক হিন্দু।
বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন ও কিছু প্রশ্ন
২১শে এপ্রিল, ২০২২, অনেক ঢক্কানিনাদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হল। করোনা পরিস্থিতির কারনে বিগত দু বছর পশ্চিমবঙ্গবাসী “বাণিজ্য মেলা” দেখেনি। আমাদের মূখ্যমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী এই দু বছরে সারা ভারতের বাণিজ্য পরিস্থিতির অধোগতি হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক অগ্রগতি রেকর্ড করেছে! মমতাদেবীর মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যিক সম্মেলনকে ধরে এটি তাঁর সপ্তম বাণিজ্য সম্মেলন। সম্মেলনের অন্তিমলগ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হল – এবার ৩ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার নতুন লগ্নীর প্রস্তাব এসেছে! এটি একটি রেকর্ড। রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত Bengal Global Business Summit এ মোট লগ্নীর প্রস্তাব ১২ লক্ষ ৩২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকার! আবার কেন্দ্রীয় শিল্প দপ্তরের কাছে পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী তা ৩৭ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা!
রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি বোঝাতে দুটি উদাহরণই যথেষ্ট – প্রথমটি রাজ্যের সিলিকন ভ্যালি, যেটি মূখ্যমন্ত্রীর ছবি সহ হোর্ডিং দিয়ে পাঁচিল তুলে ঘিরে রাখা আছে। পরিত্যক্ত হোগলার জঙ্গল, গরু চড়ানো ছাড়া এর ভেতরের কোন শিল্প সংক্রান্ত কাজকর্মের কথা জানা নেই। দ্বিতীয়টি পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব, যেখানে জমি নেওয়া সজ্জন জিন্দাল সহ অন্যান্য শিল্পপতিরা জমি ফেরত দিয়ে দিয়েছেন! ফলে, ওই হাবও এখন রাজ্য সরকারের হেপাজতে পড়ে আছে।
একটি কথা ঠিক যে, শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের ত বটেই, দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য রাজনীতিকদের মধ্যে সামনের সারিতে আছেন। কিন্তু তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে আমার রিজার্ভেশান আছে। তবে, ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যে তাঁর মত সাহসী আর কেউ নেই। তিনি জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার গগণচুম্বী। সিঙ্গুর থেকে টাটা বিতারণের পর যে পশ্চিমবঙ্গে অমন বৃহৎ শিল্প আর অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয়, তা না বোঝার মত বোকা তিনি নন। আবার, আজকালকার রাজনীতিকদের মত তিনি জনমোহিনী রাজনীতির মাস্টার চ্যাম্পিয়ন। সেজন্য তিনি তাঁর রাজনীতির বিবিধ ক্ষেত্রের মধ্যে একটি ক্ষেত্র হিসেবে BGBSকে দেখছেন। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর সিনিয়র, জ্যোতি বসুর পদাঙ্ক অনসরণ করেছেন। জ্যোতি বসু প্রতি বছর কোলকাতায় গরম পড়লেই সরকারী অর্থব্যায় করে শীতের দেশে, প্রধানতঃ গ্রেট ব্রিটেনে বিশ্রামে যেতেন। রাজ্যের ধামাধরা সংবাদ-মাধ্যমগুলি একসঙ্গে শিয়ালের মত রব তুলত, মূখ্যমন্ত্রী বিদেশ থেকে শিল্পপতি ধরে এনে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপন করানোর কাজে গেছেন! জ্যোতি বসুর দলও এই প্রচারে পুরোপুরি মদত দিত। তারপর, বছরের পর বছর ধরে একই চিত্রনাট্যের নাটক দেখে জনসাধারণ হাসাহাসি শুরু করলে তা বন্ধ হয়। পরবর্তীতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেও নিজের দলের একাংশের অসহযোগীতা এবং শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর আন্দোলনে তা ব্যর্থ হয়। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে শুধু ডঃ বিধানচন্দ্র রায় ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বিদেশে গিয়ে রাজ্যের জন্য লগ্নী এনেছিলেন – একথা ঐতিহাসিক সত্য।
জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কলকারখানাগুলি বেশীরভাগ বন্ধ। যে কটি খোলা, তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। পশ্চিমবঙ্গে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী উৎপাদন শিল্প ও সার্ভিস সেক্টর চালু আছে – যেমন বিদ্যুৎ শিল্প। তাও সঞ্জীব গোয়েঙ্কার CESC বিদ্যুতের যে দাম নিচ্ছে তা রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমের দামের তুলনায় বেশী। CESC লাভজনক বেসরকারী সংস্থা হলেও রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ নিগম ভর্তুকির উপর নির্ভরশীল। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত জানাচ্ছে, আবার তারা জিন্দালদের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানাচ্ছে! আদানী গোষ্ঠী উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ বন্টনের দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। এসব থেকে অন্ততঃ একথা পরিষ্কার যে, রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকায় নতুন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র খোলার সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন নিগমের ভরতুকী ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য রাজ্য সরকার এই সুদৃঢ় ইনফ্রাস্ট্রাকচার সমন্বিত সরকারী প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারী হাতে দিতে চাইছে! এমন কোন শিল্পপতি আছেন কি যিনি লোকসানে চলা এই শিল্পকে নিয়ে ভরতুকীর অর্থ জোগান দিয়ে যাবেন! খেলাটা অন্য জায়গায়। এই সরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়ীত্ব নিয়ে বেসরকারী উদ্যোগপতি তাকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে দুটি দাওয়াই প্রয়োগ করতে পারেন – কর্মী সংকোচন ও কর্মীদের ওয়ার্কলোড বাড়ানো এবং বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি। রাজ্য সরকার এতে রাজি না হলে এই সেক্টারে বিনিয়োগ আসবে না। আবার রাজ্য সরকার রাজি হলে কর্মসংস্থান ত বাড়বেই না, বরং কমবে! বিদ্যুৎ মাশুল বৃদ্ধি হলে তার কারনে জনমনে সরকারের প্রতি অসন্তোষ বাড়বে।
পশ্চিমবঙ্গের এই বাৎসরিক অনুষ্ঠানের বিনিয়োগজনিত সুবিধা রাজ্য সরকার কতটা পাবে তাতে সন্দিহান থাকলেও রাজনৈতিক সুবিধা যে মূখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল আদায় করে নেবেন তা বলাই বাহুল্য। শিল্প বিনিয়োগের জন্য মূখ্যমন্ত্রী রাজ্যের আটটি সুদৃঢ় স্তম্ভের উল্লেখ করেছেন। এই স্তম্ভগুলি তাঁর মতে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে ভালো! এগুলি হল – ১) বিশ্বমানের শিল্প পরিকাঠামো; ২) শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন; ৩) সামাজিক সুরক্ষা ও মহিলাদের ক্ষমতায়ন; ৪) উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ, ৫) বন্ধ মুক্ত রাজ্য; ৬) সরকারী স্বাস্থ্যবীমা; ৭) ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস; 8) ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডারিং। এই বক্তব্যে যৌক্তিকতা কতটা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও রাজনীতি যে শতকরা একশভাগ তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাজ্যের সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন না করে শিল্পপতিরা শুধুমাত্র মূখ্যমন্ত্রীর কথা আর বশংবদ সংবাদ-মাধ্যমের উপর বিশ্বাস করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন ভাবলে মূর্খের স্বর্গে বাস করতে হয়! পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাটের হাল, আইন-শৃঙ্খলা ও সিন্ডিকেটরাজের দৌরাত্ম্য, যার বড় রক্ষাকর্তা শাসকদলের পুলিশ – এসব বিনিয়োগে উৎসাহী শিল্পপতিদের অজানা নয়। ই-টেন্ডারিং ও বন্ধ মুক্ত পরিবেশ এই রাজ্যের বৈশিষ্ট নয়, যে সব রাজ্যে বিনিয়োগ হচ্ছে সেখানকার নূন্যতম চাহিদা। ই-গভর্ন্যান্স কিন্তু এখনো রাজ্যে তৃণমূলস্তরে সম্পূর্ণ হয়নি। সরকারী স্বাস্থ্যবীমা ও সামাজিক সুরক্ষার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের খন্ডিত রূপায়ণের পরও এই রাজ্য গুজরাট, ওড়িশা, কর্নাটক ও অন্ধ্র, তেলেঙ্গানার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। আর উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের কারন যে রাজ্যের শিল্পজগতের গঙ্গাজলী যাত্রা, সে জানতে কোন হবু বিনিয়োগকারীর বাকী নেই! এদিকে, স্বাস্থ্য সেক্টারে যারা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁরা কি এ রাজ্যের সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য-কমিশন দ্বারা চিকিৎসা পরিষেবার মূল্য বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি জানেন? তাঁরা কোন স্তরে কিভাবে কাটমাণি দিতে হয় তার হিসেব জানেন? এই কারনেই স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে বলে ত মনে হয় না।
এ রাজ্যে পরিবহন ব্যবস্থায় সরকারী হস্তক্ষেপ, কাটমাণি এবং রাস্তাঘাটের হাল ও বিভিন্ন রকম করের বাহুল্যে পরিবহণ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে – বিশেষতঃ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিষ্টেম। এই রাজ্যে ‘ওলা’, ‘উবের’ অ্যাপ ক্যাবগুলি বুকিংয়ের সময় এসি গাড়ীর বুকিংয়ের টাকা নিলেও ড্রাইভাররা এসি চালায় না।রাজ্য সরকারের পরিবহণ দপ্তর এসব জানার পরেও কোন গূঢ় কারনে নিশ্চুপ তা জানা যায়নি! এমতাবস্থায় কোন বিনিয়োগকারী পরিবহন সেক্টারে বিনিয়োখের প্রতিশ্রুতি রাখবেন বলে মনে হয় না।
গৌতম আদানীর দশ বছরে দশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ত বটেই, বশংবদ সংবাদ-মাধ্যমগুলিও আনন্দে গদগদ! পোর্ট, ভোজ্যতেল এবং কিছু সার্ভিস সেক্টর মিলিয়ে এই বিনিয়োগ নস্যি। এই প্রসঙ্গে একটি খবর জানাই যা বশংবদ সংবাদ-মাধ্যম জানাতে ভুলে যায় – এক্সাইড কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ না করে কর্নাটকে ৬০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। কর্নাটক সরকার কিন্তু এ নিয়ে আলাদা কোন উচ্ছ্বাস দেখায়নি। আসলে, বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য মেলা একটি বাৎসরিক মিলনক্ষেত্র, যেখানে কয়েকজন বিনিয়োগকারীকে ডেকে এনে জামাই আদর করে, রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে – তা বশংবদ সংবাদ-মাধ্যমকে দিয়ে রাজ্যে ছড়িয়ে, ভোটারদের প্রভাবিত করার কৌশল। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে এই মেলার গুরুত্ব কত তা বোঝা যাবে একটি পরিসংখানে – ২০১৯ এ এই মেলায় ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। এবারে ১৯টি দেশের প্রতিনিধি এসেছেন।
বাণিজ্য মেলার শুরুতে প্রথম দিন এক বহুল প্রচারিত বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখলাম যে, মূখ্যমন্ত্রী বলেছেন দেড় কোটি মানুষের কর্ম সংস্থান হবে! আবার মেলার শেষে মূখ্যমন্ত্রীর মুখে শুনলাম ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে! কোনটা ঠিক? আগের সবকটি বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে মূখ্যমন্ত্রী বেকারদের সাকার বানানোর যে সংখ্যাগুলি বলেছিলেন তার মিলিত যোগফলের হিসেব করলে দেখা যাবে এত বেকার এই রাজ্যে নেই; অন্য রাজ্য থেকে বেকার ভাড়া করে আনতে হবে! তাহলে, রাজ্য সরকার তথ্য প্রমানাদি সহকারে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা জানায় না কেন? এভাবে ‘ভাবের ঘরে চুরি’ আর কতদিন চলবে? এই মেলার বড় উদ্দেশ্য বাণিজ্য না রাজনীতি সেটা বোঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ভারতের প্রথম সারির শিল্পপতি – গৌতম আদানী, মুকেশ আম্বানী, কুমার বিড়লা, জিন্দালদের (এদের প্রত্যেকের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিনিয়োগের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নগন্য পরিমাণ) উপস্থিতিতে রাজ্যের রাজ্যপাল মহোদয়কে সম্বোধন করে মূখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতে বললেন যে, এই কথাটা শিল্পপতিরা বলতে পারছেন না, তাই তিনি শিল্পপতিদের হয়ে বলছেন, কেন্দ্রীয় কোন তদন্তকারী সংস্থা যেন এদের বিরুদ্ধে তদন্ত না করেন! এটি একটি বাণিজ্য সম্মেলন – এখানে এই বক্তব্য কি এই শিল্পপতিদের ; নাকি তাঁরা মূখ্যমন্ত্রীর কথাকে মাণ্যতা দিচ্ছেন! মূখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য কি প্রোটোকল ভাঙ্গা নয়? রাজ্যপাল কিন্তু কোন প্রগলভতা দেখান নি। হাত জোর করে হেসেছেন। মূখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সীগুলির তদন্তের ফলে (যেগুলি আদালতের আদেশে হচ্ছে এবং প্রায় প্রতিটি রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সর্বোচ্চ আদালতে আপীল-সওয়াল করেছে তদন্ত আটকাতে) মূখ্যমন্ত্রীর দলের নেতা-নেত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে, তা পরিষ্কার। এই বক্তব্যের পরে বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরো কমার কথা! রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী কিন্তু মূর্খ নন। তিনি এই কথায় কেন্দ্রকে রাজনৈতিক বার্তা দিলেন। অর্থাৎ, তিনি বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবেই ব্যবহার করলেন।
শেষে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই বাণিজ্য সম্মেলনের আয়োজক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য – পশ্চিমবঙ্গ। উদ্বোধক রাজ্যের মাননীয়া মূখ্যমন্ত্রী এবং বিশেষ অতিথি রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপাল মহোদয়। কিন্তু মূখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ত নয়ই, কোন হোর্ডিংয়ে বা অন্য কোথাও পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখ নেই। সব জায়গায় বলা হচ্ছে – Bengal (বাংলা)। এই বেঙ্গল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট থেকে অস্তিত্বহীণ। জানিনা এর ফলে অন্য একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছে কিনা – তা হল, স্বাধীন বাংলার ধারনা। এটি ভ্রমবশতঃ হয়ে থাকলে সংশোধন করা হোক। সচেতনভাবে করা হলে – সাধু সাবধান। কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষস্থানীয় মানুষদের অনুপস্থিতি একটি অঙ্গ রাজ্যের বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কোন রাজ্য অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক করতে চাইলে কেন্দীয় সরকারের কাছে আবেদন ও তার অনুমোদন আবশ্যক। সুতরাং এই সম্মেলনের ব্যাপারে ধোঁয়াশা রয়েই গেল।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে
ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে ১৯৬৭-৭৭ সাল ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। মূলতঃ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস, তার পর বামফ্রন্টের মোড়কে সিপিএম আর ২০১১ সাল থেকে কংগ্রেস ভেঙ্গে সৃষ্ট আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকায় ব্যক্তি কেন্দ্রিক দল, যার শীর্ষে শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জী। এই পুরো সময়টা যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়, বিধান চন্দ্র রায়ের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও তাঁর প্রশাসনকে উন্নয়ণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করার সফল প্রয়াসে আমরা পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের আধুনিকীকরণ, স্যাটেলাইট টাউনশিপ প্রকল্প – কল্যানী, বিধাননগর পেয়েছি। এটুকু ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জন্মের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস শুধুই রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গবাসীর মেরুদন্ডে আঘাতের পর আঘাত আজ এই রাজ্যের মানুষকে অমেরুদন্ডী প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছে। যে বাঙ্গালীদের থেকে ইংরেজের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ আসমুদ্র হিমাচল সাড়া জাগিয়েছিল তা আজ বিস্মৃত। মেরুদন্ডহীণ, বিভিন্ন ভাতাজীবি একদল বোধহীণ মানুষ! এর কারন ব্যখ্যার প্রয়োজন আছে।
স্বাধীনতার অনিশ্চয়তার সময়, বিশেষতঃ কোলকাতা থেকে নোয়াখালী – একতরফা হিন্দুনিধনের পর ইসলামী রাজনীতিবিদ এবং জওহরলাল-গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের ভূমিকায় বীতশ্রদ্ধ ধন-প্রাণ-মান-ইজ্জত খোয়ানো মানুষগুলোর কাছে হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ – বিশেষতঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিভিন্ন দরবার, আবেদন ও জনমতের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পশ্চিমবঙ্গ প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র জায়গা হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। তারপর, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের পর ভারতের রাজনীতিকদের ভূমিকা যথেষ্ট ন্যক্কারজনক ছিল বললেও কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আদি বাঙ্গালী হিন্দু বাসিন্দারা এই উদ্বাস্তুদের ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ আপদ বলে মনে করে। এর পুরো দায় গান্ধী-জওহরের বাঙ্গালী সম্পর্কে এবং বাংলায় ধর্মীয় দাঙ্গার ব্যপারে ঔদাসীণ্য। আমার মনে হয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে দুইজন বাঙ্গালী সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় ওদের বিরুদ্ধাচরণ করায় ওদের ইগোতে যে আঘাত লাগে তা ওরা বাংলার প্রতি উদাসীনতার মধ্যে দিয়ে মেটাতে চেয়েছেন। এর ফলে বাঙ্গালীর মধ্যে যে পরির্বনগুলি দেখা যায় তা হল, হিন্দু ও মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ – যা আগের দু শতাব্দীতে দেখা যায়নি। আবার বলছি, এর দায় সুরাবর্দী ও তার গ্রীন টুপি বাহিনীর সঙ্গে গান্ধী-জওহরের কংগ্রেসেরও। জওহরলালের এই মনোভাবে আরেকটি উদাহরণ হল, জওহরলাল প্রথমে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়কে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী করেন নি। পরে অবশ্য অবস্থার কারনে তাঁকে মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেন – যদিও পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ণে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে তাঁর প্রথম থেকেই অনীহা ছিল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা ত্রিধাবিভক্ত হয়ে যায় – বাঙ্গালী মুসলমান, এদেশী হিন্দু বাঙ্গালী আর উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালী।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দু ভোটারদের তদানীন্তন বিরোধী কম্যুনিষ্টরা তাদের সমর্থক হিসেবে দলের সঙ্গে যুক্ত করতে ব্রতী হল। সেখানে কম্যুনিষ্টদের মূল আদর্শের সঙ্গে সংঘাতের কারনে বাঙ্গলার কম্যুনিষ্টরা সিপিএমের নেতৃত্বে এক অদ্ভুত অবস্থান নিল।
ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির জন্মের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে ১৯২০ সালে পার্টির জন্মের সময় উদ্যোক্তা এম এন রায় ও তাঁর স্ত্রী ইভলিন রায় ছাড়া ছিলেন প্রথম চেয়ারম্যান দক্ষিণী ব্রাহ্মণ মান্ডয়ম পার্থসারথি তিরুমল আচার্য। আর ছিলেন বাঙ্গালী অবনী মূখার্জী, রাশিয়ান এজেন্ট রোজা ফিটিংগফ এবং খিলাফৎ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর কর্মহীন দুজন ইসলামী মোহাজীর মহম্মদ আলী ও মহম্মদ সফিক। এই মহম্মদ সফিক হলেন পার্টির সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি – জেনারেল সেক্রেটারী। তারপর, মহঃ আলী ও মহঃ সফিকের নেতৃত্বে ভারতীয় ও ভারতীয়ত্ব বিরোধী কাজকর্ম এবং বৃটিশের ভারত শাসনে কোন বড় বাধা সৃষ্টিতে অংশ না নেওয়ার কারনে আচার্য অল্প দিনের মধ্যেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৃটেনে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ও বৃটিশ বিরোধীতার পথ হিসেবে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী পথ বেছে নেন। কম্যুনিষ্ট পার্টির কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠাতা এম এন রায় সপরিবারে পার্টি ত্যাগ করেন ও পরবর্তী সময়ে র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম প্রতিষ্ঠা করেন। সেই শুরুর সময় থেকেই ভারতের কম্যুনিষ্ট দলগুলির প্রাথমিক নীতি হল – ভারতীয়ত্ব ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধীতা করা এবং ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রমোট করা! এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ধারনা কোরান ও বাইবেল, উভয় ধর্মগ্রন্থেই নিন্দার্হ। কোন সাচ্চা মুসলমান ও খ্রীষ্টান কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন না। যেহেতু প্রাথমিকভাবে কম্যুনিষ্ট দলগুলি ভারতীয়ত্বের বিরোধী এবং আরবী ইসলামের সঙ্গে তার কোন বিরোধ নেই; তারা ইসলামকে ধর্মীয় গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু ও হিন্দুত্বের বিরোধী। এজন্যই তারা ভারতের ইসলামীদের ধর্মীয় ভিত্তিতে কম্যুনিষ্ট বানানোর চেষ্টা করে থাকে। এতে একাধারে হিন্দ-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরী করা যাবে এবং জেহাদী ইসলামের আগ্রাসী নীতিকে কাজে লাগিয়ে কম্যুনিষ্ট আগ্রাসন ত্বরান্বিত করা যাবে – এই ধারনায় ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা শুরু থেকেই এগিয়েছে। মনেরাখতে হবে যে এই ভাবনা কিন্তু কম্যুনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের নয়, এটি কম্যুনিজমের ভারতীয় সংস্করণের অঙ্গ।
এবার যখন বঙ্গীয় কম্যুনিষ্ট নেতারা দেখল যে তারা উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের মধ্যে স্বাভাবিক কারনেই ইসলাম প্রীতি জাগাতে পারবে না, তখন তারা এইসব বাঙ্গালীদের চিন্তায় ও মননে ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব ঢোকানো শুরু করল! পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের চরম দুর্দশায় সাহায্য না করার জন্য কংগ্রেসের উপর তাদের তীব্র বিরাগ এবং বেঁচে থাকার নূন্যতম চাহিদার জন্য তাঁরা বঙ্গীয় কম্যুনিষ্টদের দলে ভিড়তে শুরু করল। তার বদলে উদ্বাস্তুদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়ি গলাধঃকরন করে যে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারনে তাঁদের সর্বস্ব – মান, সম্মান, অর্থ, সম্পদ, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এই দেশে পালিয়ে আসতে হয়েছিল, সেখানেই তাদের ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র মকরধ্বজ গিলতে হল। আশ্চর্য হচ্ছে, এই হিন্দু বিতারণ পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুধু ১৯৪৬-৪৭ সালেই হয়নি, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ পরবর্তী সময়ও হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিবারই মৌখিক আশ্বাস ছাড়া এই হতভাগ্যদের জন্য আর কিছুই করেনি। পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিষ্টদের ক্ষমতায় আসার বড় কারন ছিল এই উদ্বাস্তুদের ভোট। এই উদ্বাস্তু জনসংখ্যার চাপে, সরকারি সাহায্য বা অনুদানের অভাবে, এদেশী বাঙ্গালী হিন্দুদেরও যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এদিকে, ক্ষমতা দখলের পর তা কায়েম রাখতে প্রথমেই তাদের নিয়মে কম্যুনিষ্টরা “শোষিত শ্রেণী”র সংখ্যা বাড়াতে সচেষ্ট হল। একের পর এক কর্মী ইউনিয়ন দখল করে কলকারখানাগুলিতে লালবাতি জ্বালানো হল! ইউনিয়নবাজীর আরেক জলজ্যান্ত নিদর্শন হল রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির সার্ভিসের অধোগতি। সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে সাধারন মানুষ এই ইউনিয়নবাজীর oligopolystic জুলুমে ভুগতে লাগল। আশ্চর্য হচ্ছে, এই সময়ে দেশের বৃহৎ কম্যুনিষ্টদলের যে কজন জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন, তাঁদের নিজেদের রাজ্যে তাঁরা এমন ধ্বংসাত্মক ইউনিয়ানবাজী করেন নি! এরপর সিপিএমের বড় ভোটব্যাঙ্ক বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের উপর চরম আঘাত এলো মরিচঝাঁপির গণহত্যা ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও উদ্বাস্তুদের জমির পাট্টা না দেওয়া। এর ফলে, উদ্বাস্তুদের একাংশ ধীরে ধীরে কম্যুনিষ্টদের থেকে আনুগত্য সরিয়ে নিল। এই সময় পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখা বিস্তারের নেপথ্যে এই উদ্বাস্তু পরিবারগুলির অবদান যথেষ্ট। এই পর্যায়ে প্রথমে কংগ্রেসের মধ্যে থেকে এবং পরে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মমতা ব্যানার্জী তৃণমূল কংগ্রেস দল গঠন করে কম্যুনিষ্ট বিরোধী মানুষদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর কম্যুনিষ্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অত্যাচারীতের পাশে থেকে রাজনীতি করাকে মানুষ গ্রহণ করেছিল। তখন বামফ্রন্টের আড়ালে সিপিএম নির্বাচনী যুদ্ধ জয়ের বড় হাতিহার হিসেবে নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন ও হিংসা ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হল। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রশাসনকে কলুষিত করা এবং রাজনৈতিক হত্যা এই সিপিএমই প্রথম শুরু করে।
পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিষ্ট শাসনের যে দুটি পর্যায় আমরা দেখেছি, সেখানে প্রথম পর্যায়ে সমাজের দুষ্কৃতীদের শ্রেণীগতভাবে দলের ক্যাডারে পরিণত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দুষ্কৃতীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তরণ ঘটিয়ে এদের নেতৃত্বে বসানো হতে থাকে। তবে, অনুকুল পরিস্থিতিতে যখন কম্যুনিষ্ট রিগিং মেশিনারী সক্রিয়, সেই সময়ে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল প্রমাণ করল যে, মমতা ব্যানার্জী “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী”! এখনো অব্দি মমতাদেবী রাজ্য শাসনে কোন নতুনত্ব না এনে সিপিএমের রাজ্য শাসনের নীতিগুলিকে আরো বিস্তৃতভাবে, অধিকতর সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন। প্রথমেই তিনি পুলিশের খাতায় দুষ্কৃতী হিসেবে নাম থাকা দলের মানুষদের নেতৃত্বে বসালেন! তারপর সিপিএম যেমন পুলিশ প্রশাসনের একাংশকে ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ নীতির সফল প্রয়োগে দলদাস বানিয়েছিল, তার বিস্তৃত প্রয়োগে শুধু পুলিশ নয়, পুরো রাজ্য প্রশাসনটাকেই দলদাসে পরিণত করলেন। সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলেন রাজ্য সাধারণ সম্পাদক, রাজ্য শাসনে বামফ্রন্টের বাহ্যিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সিপিএমের একদলীয় শাসন চলত। ফলে রাজনৈতিক অপকর্মগুলির দায় আড়াল করার জন্য বামফ্রন্টীয় সংঘবদ্ধ মেকানিজম কাজ করত। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস দল একজন ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও চালিত হওয়ায় তা কখনোই সংঘবদ্ধ নেতৃত্বের মত মনে হয়নি। এখানে দলনেত্রীই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ক্রিয়াকর্মের হোতা – এটি তৃণমূল কংগ্রেস দলের ঘোষিত বক্তব্য। ফলে, দলের দ্বিতীয় থেকে শেষ নেতৃত্ব পর্যন্ত সকলেই নেত্রীর “অনুপ্রেঢ়ণায়” কাজ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরনের রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা প্রফল। এ্যাডলফ্ হিটলারের National Socialist Party এবং যোশেফ স্ট্যালিনের Communist Party of Supreme Soviet তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই ধরনের রাজনৈতিক দলের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে দলের কর্ণধারের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার উপর। প্রথমটিতে মমতাদেবী ভারতের অগ্রণী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেও পরেরটিতে তাঁর সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয়।
যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনৈতিক অনীহা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার, বাঙ্গালীদের মননে স্বভাব-বিরোধীতা একটি জায়গা করে নিয়েছে। আর রাজনৈতিক হিংসা আর বাঙ্গালীর মনে রেখাপাত করে না। কারন, গত ৫৭-৫৮ বছরে মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেই এই হত্যালীলা বন্ধের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একই রকমভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর্থিক বা চারিত্রিক দূর্ণীতিতেও বিচলিত হয় না। অগত্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত বাঙ্গালী ধর্মনিরপেক্ষ ভাতাজীবী হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট। আর এইজন্যই মমতাদেবী তাঁর রাজ্য তহবিলের অধিকাংশ অর্থ বিভিন্ন ভাতা প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিলি করে নিজের ও দলের জনমোহিনী ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আর এই প্রকল্পের মধ্যেই তৃণমূল দলের পতনের বীজ লুক্কায়িত আছে!
এইভাবে অনুৎপাদনশীল খরচের বহর বেড়ে যাওয়ায় রাজ্যের ধারের পরিমাণ সাড়ে পাঁচলক্ষ কোটি ছাড়িয়েছে! এই বছর শেষ হওয়ার আগেই তা শ্রীলঙ্কার ঋণ ছাড়িয়ে যাবে। যদি পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাজ্য হত তাহলে তার অবস্থা কল্পনা করেও শিউরে উঠতে হয়। এদিকে এই ধরনের ব্যায়ের ফলে রাজ্যের জিডিপি বাড়বেনা। ফলে এক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেতে রাজ্যের ঋণ নেওয়ার ঊর্ধসীভা না বাড়ালে অর্থনৈতিক কারনে রাজ্য চালানো সম্ভব নয়। ভারতের একটি অঙ্গ রাজ্য হলেও এই ঋণ পরিশোধ করার দায় কিন্তু তৃণমূল দল বা কোন ব্যক্তিবিশেষের নয় – রাজ্যবাসীর। যে পরিমাণ সুদ দিতে হয়, তাও রাজ্যসরকারের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে, ভাতা বিলোনো কার্যকরীভাবে অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হতে বাধ্য। আবার মমতাদেবীর দলের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফসল এখন ফলতে শুরু করেছে! উচ্চস্তরের সরকারী প্রশাসনকে সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, মমতাদেবীর থেকে ‘তুমি’ সম্বোধনে উচ্চপদস্থ আমলারা খুশী হন না। যার জন্য দায়সারা ও কর্তাভজা পরামর্শ ছাড়া তাঁরা এই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন না। প্রশাসনে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে যে সংবাদ-মাধ্যমকে দেখা হয়, তা এই রাজ্যে শাসকের গোয়েবেলসীয় চাপে মৃতপ্রায় কর্তাভজা জোকারে পরিণত হয়েছে। এই মিডিয়া সৃষ্ট বুদ্ধিজীবীকুল আমজনতার কাছে একাধারে হাস্যকর চরিত্র ও ঘৃণার পাত্র!
মমতাদেবী ক্ষমতায় এসে যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, ২০২২ সালে এসে তার ফল ফলতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক অপচয়ের কারনে এই বছরের পর রাজ্যের পক্ষে কর্মচারীদের মাইনে এবং পেনশন দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে কিনা সে বিষয়ে সংবাদ-মাধ্যমেও সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু হয়েছে।
ধর্মীয় গোঁড়ামী ও বিভেদকে এই রাজ্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনে সুবিধে পাওয়ার অভিপ্রায়ে উস্কে দেওয়ায় এবং দুষ্কৃতীদের দলীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসায় জনমানসে ধারনা হয়েছে যে, এই রাজ্যে রাজনীতি করতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে বেআইনী অর্থ রোজগার ও দুষ্কর্ম করে প্রশাসনের মদতে পার পেয়ে যাওয়া! দুঃখের কথা, এই ধারনাতেই এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাই স্ব স্ব দলে এসেছেন এবং প্রয়োজনে দলবদল করছেন! এই কারনে, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে হিংসা, খুণ, ধর্ষণ সহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত ক্রমবর্ধমান। এমতাবস্থায় আদালতের চাপে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের দিশেহারা অবস্থা – দলীয় কোন্দলের অত্যধিক সংখ্যাবৃদ্ধি তার প্রমাণ। এমতাবস্থায় মমতাদেবী ও তাঁর তৃণমূল দলের অনুকুলে যা আছে তা হল, “রাজ্যে কুস্তি ও কেন্দ্রে দোস্তি” নীতির সফল প্রয়োগে রাজ্য চালানোর চেষ্টা, যা তিনি ২০২১ এর রাজ্য নির্বাচনে জেতার পর থেকেই করছেন! তাছাড়া, রাজ্যের সিপিএমের – বড় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছোট শত্রুকে সাহায্য করার সৃষ্টিছাড়া রাজনীতি – এই দুটিই মমতা দেবী সুচারুভাবে ব্যবহার করছেন। এখানে একটা কথা বলে যাই, এই নীতি ফলপ্রসু হলে রাজ্যে বিজেপি ও সিপিএম, দুই দলই অস্তিত্ত্ব সংকটে পরবে। সুতরাং, সংশোধনী আগতপ্রায়।
এ কোন অচেনা পশ্চিমবঙ্গ
বিস্তীর্ণ দু পারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে
ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছ কেন।
নৈতিকতার শ্খলন দেখেও
মানবতার পতন দেখেও
নির্লজ্জ অলসভাবে বইছ কেন……
তবু যুক্তি বলে মা গঙ্গা এই পাহাড় প্রমাণ অনাচারের মধ্যে স্বাভাবিক গতিতে বয়ে চলেছে – আর তাকেই স্বাভাবিকতার ছবি হিসেবে দেখানো হচ্ছে! হিংসা, অত্যাচার, অনাচারের মরুদ্যানে আমরা একমাত্র ওয়েসিস হিসেবে জানতাম বিচার ব্যবস্থাকে। রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেখিয়েছে, কমিটেড জুডিসিয়ারী কি হতে পারে। সেইসঙ্গে বিচার ব্যবস্থার উপর সংঘবদ্ধ বলপ্রয়োগের খন্ডহার দেখা যাচ্ছে। মনুষ্যত্ত্বহীণ রাজনীতির উলঙ্গ নেতৃত্বের ছবি চারদিকে দৃশ্যমান। আগে অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ্যম এসব ‘ছোট ঘটনা’ প্রকাশের মত তুচ্ছ কাজ করত না! এখন এ ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক অভিজ্ঞতার অঙ্গ হওয়ায় আর তা গোপন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বগটুইয়ের গণহত্যার নৃশংসতা ও তৎপরবর্তী প্রশাসনিক গাফিলতি শুধু শাসকের সংবেদনশীলতার অভাবই প্রমাণ করে না, প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে বিরোধী রাজনীতির উপর মিথ্যা দোষ চাপিয়ে সাম্প্রদায়িক তাস খেলতেও দেখা যায়। তারপর একে একে যত ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা খবর হতে থাকে ও সেখানে অভিযুক্ত হিসেবে শাসকদলের বিভিন্ন নেতার নাম প্রকাশ্যে আসতে থাকে। সংবাদ-মাধ্যম এসব ঘটনা আগে প্রকাশ না করায় শাসকের এই সমস্যা মোকাবেলা করার ইচ্ছে ও যোগ্যতা কোনটাই ছিল না। সেজন্য এখনকার পরিস্থিতিতে শাসকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। হাঁসখালির ঘটনার পর রাজ্যের প্রশাসনের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তি বললেন, যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করার পরদিন মৃত্যু হয় ও বেয়াইনীভাবে তার দেহ সাধারন মৃত্যুর মত পোষ্টমর্টেম না করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সে অন্তঃসত্বা থাকতে পারে, তার ধর্ষকের সঙ্গে ভালোবাসা থাকতে পারে ইত্যাদি! “বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ” – এই নীতির প্রয়োগে ডিস্ট্রিক্টের পুলিশ কর্তা ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে বললেন, ঐ মেয়েটি নাকি মদ্যপান করেছিল আর সে মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল! ভিসেরা টেষ্ট না হলে কিভাবে এ তথ্য পাওয়া যায়! আচ্ছা, রাজ্যের এইসব ‘অনুপ্রাণিত’ কর্তাদের বিদ্যাবুদ্ধি কতদূর – সে প্রশ্ন আজ মানুষের মনে আসাই স্বাভাবিক। আরেকটি কথা – হাইকোর্টের আদেশে CBI এই ঘটনার তদন্ত করছে। এক্ষেত্রে রাজ্যের কোন পুলিশ আধিকারিক এবং স্বয়ং মন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর এ ধরনের প্রমাণবিহীন মন্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, তদন্তকে প্রভাবিত করার জন্য CBI তাঁদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও আশ্চর্য হতে হয়। রাজ্যের এতগুলি ঘটনার তদন্ত করছে CBI – এখনো একটি ঘটনার তদন্ত শেষ করে আদালতে ফাইনাল চার্জশিট পেশ করেনি! আমাদের সকলের কাছে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার। রাজ্যের পুলিশ যেমন রাজ্যের শাসকের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত সংস্থা CBI। রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে কেন্দ্রের অধীন CBI নিঃসন্দেহে তাদের তদন্তের ব্যপারে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য। রাজ্যের সাধারন মানুষ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারী করা যেমন দেখছে, তেমনই CBI এর বিভিন্ন তদন্ত এবং সেগুলির মেগাসিরিয়ালের মত গতি প্রকৃতিও লক্ষ্য করছে। আমি রাজ্য পুলিশ বা CBI এর কর্মদক্ষতার উপর সন্দেহ প্রকাশ করছি না কারন তাদের কর্মদক্ষতার ভূরিভূরি উদাহরণ আছে। তবে দুই সংস্থার রাজনীতিকরন সম্পূর্ণ হয়েছে বলাই যায়। এই CBI মহারাষ্ট্র সরকারের অতি প্রভাবশালী মন্ত্রীকে গেপ্তার করে জেলে রাখতে পারে, সেখানের প্রাক্তণ পুলিশ কমিশনারকে গ্রেপ্তার করতে পারে; আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যখনই রাজ্যের শাসকদলের কোন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নোটিশ জারি করে তখনই তাঁরা একটি বিশেষ সরকারী হাসপাতালের বিশেষ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যান। আস্তে আস্তে CBI ঐ কেসে ঝিমিয়ে পড়ে। বছরের পর বছর একই স্ক্রিপ্টের কৌতুকাভিনয় দেখে দেখে জনসাধারণ ক্লান্ত! প্রত্যেক নেতার বক্তব্য একই – “আইন আইনের পথে চলবে” তারপর ঐ বিশেষ নেতার মামলা CBI দপ্তরে শীতঘুমে চলে যায়। এই রাজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের অদৃশ্য অঙ্গুলীহেলনের ইনভেস্টিগেশনে সাধারন মানুষ বীতশ্রদ্ধ।
মনে প্রশ্ন জাগে, যে ৫৬ ইঞ্চির গর্ব করা হয় কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলোপ করার কৃতিত্ব দিয়ে, সেই একই ‘৫৬ ইঞ্চি’র নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব কি নেই পশ্চিমবঙ্গকে আফগানিস্তান হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর? অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের বিচার-ব্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখে – উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারকদের সততা আজ প্রশ্নের মুখে। আবার উচ্চ ন্যায়ালয়ের এক বিচারকের রায় শাসকদলের অপছন্দ হওয়ায় সেই বিচারকের এজলাস বন্ধ করার আন্দোলনের নামে বলপ্রয়োগ – ফ্যসিবাদী শক্তিকে মনে পড়ায়। শাসকের অসহিষ্ণুতার বলি হচ্ছে সাধারণ নাগরিক। ডিভিশান বেঞ্চের স্থগিতাদেশের সময়সীমা নিঃসন্দেহে ন্যায়ালয়ের সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগায়। ১৩ই মে, ২০২২ অব্দি স্থগিতাদেশ। তারপর উচ্চন্যায়ালয়ের বছরের দীর্ঘতম ছুটি – সামার ভ্যাকেশান। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে বিচারকদের মামলার শিডিউল পাল্টে যাওয়া। তাহলে রায় বাতিল হওয়া আর স্থগিত হওয়ার মধ্যে কার্যকরী তফাৎ হল কি? বরঞ্চ রায় বাতিল হলে যুক্তিগ্রাহ্য রায় দিতে হত – এক্ষেত্রে তার দায়িত্ব নিতে হল না!
এখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা। নির্দিষ্ট বয়সসীমার নাগরিকদের সবাইকে ভোটাধিকার দেওয়ার কুফল এখন বোঝা যাচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী নির্বাচিত শাসককুল তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন থাকলেও দায়িত্ব পালনের দায় তাঁরা নেন না। তাঁরা কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রতিস্থাপিত হওয়ার যোগ্য। যে কোন দেশের (কম্যুনিস্টসহ) রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু এদেশে দলের রাজনৈতিক স্বার্থ, বিশেষতঃ সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীর ব্যাক্তিগত স্বার্থ সর্বদা জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব পায়। সেজন্য দেশের নাগরিকরাও জাতীয় স্বার্থে সংঘবদ্ধ হতে পারে না। ফলে, অসৎ রাজনৈতিক নেতারা দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সমর্থ হন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটি সমধিক প্রযোজ্য।
এখন আবার একটি কৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে – রাজ্যের শাসকদল তিন চার দিনের ব্যবধানে ন-দশটি ধর্ষণের ঘটনায় খানিকটা হলেও ব্যাকফুটে। কারন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শাসকদলের স্থানীয় নেতা বা তার নিকট আত্মীয় অথবা ঘনিষ্ঠ। সেজন্য জনগণের সহানুভূতি আদায়ে দলের কয়েকজন এমপিকে দিয়ে একই রকম কথা বলানো হচ্ছে – দল এসব সমর্থন করে না; দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক….. ইত্যাদি। আবার মূখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পুলিশ সুপার তদন্তের ক্ষেত্রে অন্যরকম ‘টোন’ ঠিক করে দিচ্ছেন!
এই অরাজকতা আরো বেড়েছে শাসকদলের নিজেদের মধ্যে মারামারিতে। বুঝতে অসুবিধা নেই – অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের ভাগাভাগিই এর মূল কারন। বছরের পর বছর সরকারী চাকরীর নামে প্রতারণা, নেতাদের প্রাসাদোপম বাড়ির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনযাপন, পেশীশক্তির জোরে দুষ্কর্ম – ইত্যাদির চাপে রাজ্যের অবস্থা নরকের চেয়ে খারাপ। আবার, রাজ্য অর্থনৈতিক ঋণজালে জড়িয়ে গেছে। এই মূহুর্তে রাজ্য সরকারের ঋণের পরিমাণ সাড়ে পাঁচলক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশী! গত দশ বছরে রাজ্য সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছে। এই টাকা রাজ্যের মানুষের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। টাকা পরিশোধের জন্য বাড়ি-জমির ট্যাক্স থেকে ধরে অন্যান্য ট্যাক্স হাজারগণ বা তার বেশী বাড়াতে হবে! এই রাজ্য উৎপাদনী রাজ্য নয়, বরঞ্চ এটি consuming state। ফলে, এখন রাজ্য যে পরিমাণ GST পাচ্ছে, আগামী জুলাই ২০২২ থেকে তা অনেক কমে যাবে। সেক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ আরো দ্রুত বাড়াতে হবে! আবার এখনকার নিয়মে রাজ্য GDPর সর্বাধিক ৩% পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। প্রথমে রাজ্য সরকার রাজ্যের GDP অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেখানোয় তা কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেয়নি। আবার, রাজ্য এই ৩%এর ক্যাপকে বাড়িয়ে ৫% এনিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে! স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রের এই প্রস্তাব মানার কথা নয়। যদি উচ্চতম নেতৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে কেন্দ্র এই দাবী মেনে নেয়, তবে রাজ্যের নাগরিকদের উপর মাত্রাতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপানোর দায় রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রকেও নিতে হবে।
একটা ব্যপারে খুব অবাক লাগে। এই যে চারদিকে এত অরাজকতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে আইন শৃঙ্খলার বিশেষ অবনতি – সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, তার সাথে প্রশাসনিক মদতে সাধারণ মানুষের উপর দুর্বৃত্তের অত্যাচার – বলা ভালো প্রশাসনের দুর্বৃত্তায়ণ, এর থেকে মুক্তির উপায় রাজনৈতিক স্তরেই হওয়া ভালো না হলে………। ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সিপাহী বিপ্লব ও তার পরবর্তী বঙ্গপ্রদেশের অরাজক অবস্থার দায় যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিল না, তখন বৃটিশ শাসনব্যবস্থার মধ্যে ভারতবর্ষকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করে কোম্পানীর আমলের অরাজক শাসন বন্ধ করা হয় – একথা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় পাওয়া যায়।
আইনের শাসন রক্ষায় মহামাণ্য আদালতের ভূমিকা সব দেশে, সব সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। আদালত ও বিচারকদের উপর পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ কেউ করে না কারন নিরপেক্ষ বিচারের উপর শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ দাঁড়িয়ে থাকে। এই রাজ্যে তার উপরেও বারবার আঘাত করা হয়। এক বিচারপতিকে ” লালা বাংলা ছেড়ে পালা” শ্লোগান দিয়ে ধাওয়া করা কেউ ভোলেনি। শাসকের পছন্দ নয় এমন রায়দানকারী বিচারককে শারীরিক নিগ্রহ করার ঘটনাও এখানে ঘটে। আমেরিকায় বসবাসকারী আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমায় কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে বলে, “sir, politicization of every facets of administration now leads to total corruption”। ওরা পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ বাঙ্গালী মানুষজনের কি হবে!
চীনের গৃহযুদ্ধের সময় লাল ফৌজ ও সাধারণ নাগরিকরা আদালতের পক্ষপাতদুষ্ট বিচারে বারবার নিগৃহীত হত। কারন, বিচারকেরা নিজেদের চিয়াং কাইশেক এর কুওমিনটাং ও ক্ষমতাশালী, বিত্তশালী জমিদারদের কাছের লোক মনে করতেন – এদের থেকে সর্বদা বিচারকরা উপঢৌকন (উৎকোচ বলা যাবে না) পেতেন। ফলে, দেশের মানুষদের বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে যখন চিয়াং কাইশেকের ন্যাশনালিস্ট চীনা পার্টি মূল ভূখন্ড ছেড়ে তাইওয়ানে আশ্রয় নিল, আর মূল ভূখন্ডে মাও জে দং এর নেতৃত্বে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না গঠিত হল, তার প্রথম দিকেমূল ভূখন্ডের বিভিন্ন স্থানে বাতিস্তম্ভে বিচারকদের দেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি বড় মারাত্মক। কোন নাগরিক, তিনি যত বড়ই হোন না কেন, তাঁর চেয়ারের অপব্যবহার করার অধিকার নেই। একটি সঙ্গত প্রশ্ন কেউ কি করেছেন – হাঁসখালির যে মেয়েটি ধর্ষিতা হয়ে পরদিন মারা গেছে, সে নাবালিকা। অর্থাৎ এই মামলায় পকসো আইন লাগু হওয়ার কথা – এক্ষেত্রে বিচারকের অধিকার IPC ও সংবিধান নির্দিষ্ট। সুতরাং এইক্ষেত্রে মামলা CBIএর থেকে নিয়ে নেওয়া বা স্থগিতাদেশ দেওয়া যায় না। অবশ্য এই মামলায় কোন স্থগিতাদেশ কেউ দেয়নি। তবে, সরকারী চাকরী সংক্রান্ত বেআইনী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে কার লাভ ও কার ক্ষতি – এই বিশ্লেষণ মানুষ করছে। তার ফল বিচারব্যবস্থার জন্য সুখকর হবে কি?
এবার আসি শেষ কথায়। এমন আইন শৃঙ্খলার অবণতি, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষহীণতার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যে তীব্র আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তোলার কথা তা কোন গূঢ় কারনে অনুপস্থিত! শুধু টেলিভিশনের পর্দায় কিছু নেতার চেঁচামেচি ও ঝগড়ায় তা সীমাবদ্ধ। আর পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবি’কুল শীতঘুমে থেকে তাঁদের পেশাদারী রুদালী চরিত্রের পরিচয় দিলেন! আজকের রাজনীতির কুশীলবরা পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে কি লাভ করলেন তা ভবিষ্যতের দলিলে লেখা থাকবে।
করোনা অতিমারীর শেষ কথা
করোনায়িত বিশ্বে শান্তি আসুক নেমে। ১লা এপ্রিল, ২০২২ থেকে করোনা সংক্রান্ত সমস্ত রকমের বিধিনিষেধ, যেগুলো কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার থেকে লাগু করা হয়েছিল, তা উঠে গেল – করোনার থাবা মোটামুটিভাবে চলে গেছে বলা যায়। ১৯১৮-২০ সালের প্লেগের পর দেশে এত মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যু খবর জানা নেই। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত প্রায় ৪৯ কোটি মানুষ, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ আর মৃত্যু হয়েছে ৫ লক্ষ ২২ হাজার মানুষের। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ২০ লক্ষ ২০ হাজার ও ২১ হাজার ২০০ জন। অতি স্তিমিত হয়ে পড়ে যেতে যেতে করোনা হয়ত এই সংখ্যাটা অল্প বাড়িয়ে যাবে! বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের আঁচ যখন আমাদের দেশে পড়েছে তখন, বিশেষতঃ কিছু বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ্যম মানুষের দুঃখ দুর্দশার ছবি দেখানোর সাথে সাথে কল্পিত ভয় – হরর সিনেমা দেখানোর মত – প্রচার করেছে। তাতে মদত দিয়েছেন ঐসব সংবাদ-মাধ্যম দ্বারা ঘোষিত বিশেষজ্ঞের দল! তারপর অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিষ্পেষিত মানুষকে আশার বাণী শোনানোর পরিবর্তে এইসব planted ‘বিশেষজ্ঞ’রা লকডাউনের কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধের বেড়ি পরিয়ে যত মানুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, তত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রীর দাম সহ সমস্ত পণ্য ও সার্ভিসের বাজার দর ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী হয়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন – রোজগার কমেছে অধিকাংশ মানুষের। শুধু রোজগার বেড়েছে মুনাফাখোর আর ঐ সংবাদ-মাধ্যমগুলির। তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের রোজগার বেড়েছে বৈ কমেনি! সাধারণ মানুষের অশেষ দূর্ভোগের পরেও এইসব সংবাদ-মাধ্যম এমন তথ্য পরিবেশন করছে যে, মনে হয়, ওমিক্রনের পর আরো মারাত্মক করোনা ভ্যারিয়েন্ট আমাদের কাবু করতে ছুটে আসছে! এর কারন একটাই – ভীতির পরিবেশে অর্থনৈতিক শোষণ সুবিধার – সঙ্গে প্রচারকদের “কাটমানি”। এই কারনেই করোনা ভাইরাসের সঠিক বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে এই লেখার অবতারনা।
RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট অনুযায়ী করোনা ভাইরাস যত মিউটেশান করবে তত তার মারণ ক্ষমতা কমবে ও সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে – একথা একাধিকবার আলোচনা করেছি। সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ার অর্থ কিন্তু ক্ষতি করার ক্ষমতা বাড়া নয় – এই বৈজ্ঞানিক সত্যকে বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ্যমগুলি ভালোভাবে প্রচার করেনি।
আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের টীকাকরণ হয়ে গেছে। তাছাড়া, সজ্ঞানে (পরীক্ষায় প্রমাণিত) বা অজ্ঞানে (পরীক্ষা না করা) সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন – তা যে কোন মিউটেড ভ্যারিয়েন্ট হোক না কেন। এর ফলে তাদের দেহে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে – যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাভাবিক। আবার করোনা আক্রান্ত হোন বা না হোন, যাদের টীকাকরণ শুরু হয়েছে, তাদের দেহের টি-লিম্ফোসাইট কোষের বৃদ্ধির ফলে কোষের মধ্যস্ততায় যোঝার শক্তি (immunity) বেড়ে গিয়ে ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনকে নষ্ট করতে অধিকতর সক্ষম হয়। তাছাড়া, বি-লিম্ফোসাইট, যা মূলতঃ বোনম্যারোতে পাওয়া যায়, একটি অবিযোজিত (adaptive) যোঝার শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। এই শ্বেত কণিকার মধ্যস্ত কোষগুলি ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে টি-লিম্ফোসাইট যে বিশেষ কোষ নির্দেশক সাইটোকাইন মোচন করে তা ভাইরাস ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অর্থাৎ একজন টীকা নেওয়া মানুষের করোনা ভাইরাসের সঙ্গে শুধু লড়াইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, ভাইরাসকে ধ্বংস করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, টীকাকরনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে যোঝার শক্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনই ৭০% মানুষের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারনে গোষ্ঠীসংক্রমণে সমাজে herd immunity তৈরী হওয়ায় দ্রুত করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই জয়ী হয়েছে। আবার যেকোন RNA ভাইরাসের এই ভাইরাস যখন মানবদেহে ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা হারাবে, তখন তারা মানবদেহ ছেড়ে আবার পশুদেহে আশ্রয় নেবে এবং ক্রমশঃ সুপ্ত (dorment) অবস্থায় চলে যাবে। আমরা এই মূহুর্তে শেষের অবস্থায় আছি। সুতরাং, বিপর্যয় কেটে গেছে, তা বলাই যায়। অবশ্য, ঠিকমত স্যানিটাইজ করা এবং স্বাস্থ্যবিধি পালন করে যাওয়া আবশ্যক – এর বড় কারন হল, এর ফলে বি-লিম্ফোসাইট শক্তিশালী হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, করোনা অতিমারীর প্রভাব এখন বিলীন হওয়ার পথে। কিন্তু, লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে অতিমারীর যে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তার সংক্রমণ ক্ষমতার শক্তি আলোচনা করে জনসাধারনকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের অশুভ প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
আবার অতিমারী ও লকডাউনের অজুহাতে ঊর্ধমূল্যের বাজারে দ্রুতগতির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে, বিশেষতঃ বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের কারনে মানুষের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখনএভাফে মানুষকে ভয় দেখানো অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ।
এখানে একটি কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না – রিজেনারেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারত তথা আমাদের রাজ্যের ক্লিনিশিয়ানদের যথেষ্ট অনীহা আছে। বৈজ্ঞানিক সত্য যে, বি-লিম্ফোসাইটের মধ্যে হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষ থাকে। এই কোষের বাইরে থেকে সংগ্রহ করার একটি সূত্র হচ্ছে কর্ড ব্লাড। আমাদের রাজ্যে সরকারী কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক থাকলেও বহু বছর ধরে তার ব্যাবহার করা হয়নি। এর কারন না জানা থাকলেও এটা বলাই যায় যে এভাবে টাকা নষ্ট করার কোন যুক্তি নেই।অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগে কর্ড ব্লাড হয়ত বি-লিম্ফোসাইট বৃদ্ধি করে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। এত জ্ঞান দেওয়া সবজান্তা সাংবাদিককুল কখনো এ ব্যাপারে ডাক্তারবাবুদের প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখাতে পারেননি।
এবার শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রেও অর্থনীতির উপর করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আঘাত আসতে শুরু করেছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পেট্রোল, ডিজেলের দাম লিটারে দশ পয়সা বাড়লে নোটে শাকের আঁটির দাম দশ পয়সা বেড়ে যায়! সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে। আবার সব পণ্য ত বটেই, এমনকি সমস্ত রকম পরিষেবা জিএসটির আওতায় আনলেও একমাত্র পেট্রোল-ডিজেলকে অতিমারী পরবর্তী পর্যায়েও জিএসটির বাইরে রাখা হয়েছে। এর দায় কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকারের। সুতরাং পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদী আন্দোলন জনগণকে ধাপ্পা দেওয়ার মতলব। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভোটের ইস্তাহার প্রকাশের সময় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটায়। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো দলের ঘোষিত ইস্তাহারে পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। জনসাধারণকে শোষণ করার এ এক ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়া। বাজার অর্থনীতিতে এই বিষক্রিয়ার ফল ফলতে শুরু করেছে।পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনঅত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর চাহিদা সাধারন নিয়মেই এখনকার পরিস্থিতিতে বাড়ার কথা। আবার, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়ায় চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের রাজ্যে মূল্যস্ফীতি সরাসরি না হয়ে এখন নিশ্চলতা-স্ফীতি (stagflation) চলছে। সরকার যদি সাধারন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়াতে না পারে তবে এই অচল অবস্থা থেকে রাজ্যের অর্থনীতি অপ্রতিস্থাপনযোগ্য তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে।
এর লক্ষণ এখনই সমাজে পরোক্ষভাবে হলেও, দেখা যাচ্ছে। চারদিকে হিংসা, হানাহানি, অসামাজিক কাজকর্মের অতিবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। এক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি যেন প্লেগ পরবর্তী বৃটিশ সরকারের উদাসীনতাকেই মনে করায়। করোনা অতিমারীর ফিরে আসা ও পুনরায় লকডাউনের অবৈজ্ঞানিক সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, চাহিদা-যোগান-ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখার প্রয়াসকে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
পশ্চিমবঙ্গের জন্ম ও তার পটভূমি
একটি দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য যে শর্ত প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন তা হল, দেশের জনগণের ত বটেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। আজ যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, তার আত্মিক শক্তি হল জাতীয়তাবোধ। এমনকি, কম্যুনিষ্ট চীন থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের দেশগুলিরও চালিকা শক্তি এই জাতীয়তাবোধ। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলি – সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সৌদি আরব বা কাতার – সকলেই ধর্মকে স্বীকার করেও দেশ পরিচালনায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেয় জাতীয় স্বার্থকে। কটু শোনালেও, একথা বাস্তবিক সত্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিকরা তাদের পারিবারিক স্বার্থকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন! তার জন্য ভোটে জেতা জরুরী হওয়ায় তাদের ভোটের স্বার্থে দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপোষ রাজনীতি করতেও দেখা যায়! ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময়ের দুই সফলতম ভন্ড সমাজসেবী হচ্ছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু।
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের জনক চৌধুরী রহমত আলী ১৯৩৩ সালে বৃটিশ ভারতবর্ষের মধ্যে থেকে ইসলামীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাক-ই-স্তান (Land of purity) গঠনের কথা বলেন; যেখানে পাঁচটি প্রদেশ – পঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, সিন্ধ ও বালুচিস্তান ছিল। প্রথমে মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৪০সালে লাহোর সম্মেলনে জিন্না দ্বিজাতীতত্ত্ব (হিন্দু আর মুসলমান দুই আলাদা ‘জাতি’) সামনে এনে সহাবস্থান অসম্ভব ঘোষনা করে তার ভিত্তিতে পাক-ই-স্তান গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। হিন্দু রমণীর পাণিগ্রহণ ও প্রিয় খাদ্য তালিকায় শুয়োরের মাংস এবং হুইষ্কি থাকায় জিন্নাকে ইসলামী আলেমরা ইসলামের প্রতিভূ বা মেসিহা মনে করতেন না। সেজন্য জিন্নাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের মধ্যে থেকে তাঁর প্রাপ্য স্থান ও সম্মান আদায় করে নিতে। কিন্তু কোন স্বাধীনচেতা, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ, সে হিন্দু বা ইসলামী যাই হোন না কেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে টিঁকতে পারতেন না। কংগ্রেসের পালক পিতা হিসেবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রতিষ্ঠার পর, এই দল ধীরে ধীরে গান্ধী ও তাঁর অনুচরদের রাজনৈতিক দলে পরিণত হল। গান্ধীজীর দুই বিশ্বস্ত অনুচর, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল ধীরে ধীরে স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত ও প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষজনকে – যেমন বিঠলভাই প্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য করেছেন। গান্ধীজীর গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না। তার সবচেয়ে বড় নমুনা হল ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে চরম গোষ্ঠীবাজি করে গান্ধী-নেহরু জুটি ও তাদের চামচারা সুভাষকে পদত্যাগ করতে ও কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য করে। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তিনি সর্বদা তাঁর মতই নয়, তাঁর পথকেও চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
এইসব পর্যবেক্ষণ করে শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় বাঙ্গালী হিন্দুদের জন্য বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও চৌধুরী রহমত আলীর যে প্রস্তাবে পাক-ই-স্তান গঠনের কথা প্রথম বলা হয় তাতে বাংলা প্রদেশের কথা ছিল না; পরবর্তীতে গান্ধীর দোদুল্যমান নীতিকে চাপে রেখে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সাল থেকে বাংলাকেও পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেবার দাবী জানায়। এই বাংলা ভাগে পক্ষে তদানীন্তন অখন্ড ভারতের সব মুসলিম নেতাই ছিলেন! গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ভাবগতিক ছিল – যাক, বাংলাটা পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে বাঁচা যায়! এর কারন, কংগ্রেসের তিন নেতা – গান্ধী-জওহর-বল্লভভাইদের নেতৃত্বের সংঘাতে বাংলার রাসবিহারী, সুভাষরা বারবার পর্যুদস্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, সাভারকর থেকে বিঠলভাই, এমনকি সুভাষ পর্যন্ত গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ তোষণ রাজনীতি ধরে ফেলেছিলেন! আজকে কংগ্রেস দলের পারিবারিক নেতৃত্ব ও তাঁদের কর্মচারীসম কংগ্রেসী নেতারা গণতন্ত্রের কথা বললেও তাঁরাই গান্ধীর অগণতান্ত্রিক উপায়ে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারণ ও দল পরিচালনায় হস্তক্ষেপের কথা গোপন করেন কেন? ত্রিপুরী কংগ্রেসে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রার্থীকে ভোটে হারানোর ‘অপরাধে’ (!) সুভাষকে অপমান ও অবহেলা করে চক্রান্তের জাল বিস্তারের মাধ্যমে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ও জওহরলাল এবং বল্লভভাইয়ের সহযোগীতায় সুভাষকে অল্পদিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য করানো – এসব কিন্তু বাঙ্গালী ভোলেনি। স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার ‘দায়িত্ব পাওয়া’ কম্যুনিষ্ট ইতিহাসবিদরা এসব কথা লিখতে ভুলে যান! বাঙ্গালী মননে গান্ধী পুজন ও বল্লভভাইয়ের স্ট্যাচু কোন আনন্দবার্তা বয়ে আনে না। এমনকি, শুধু পঞ্জাবের বিপ্লবীরাই নয়, বাংলার বিপ্লবীদের কাজকর্মের গান্ধীজী এতটাই বিরোধীতা করেছেন যে, তিনি স্বাধীনতা আদায়ের জন্য তাঁর দেখানো অহিংস আন্দোলন ছাড়া অন্য কোন পথকেই সমর্থন করা দুরে থাকুক, তার বিরোধীতাই করেছেন। পথ ভিন্ন, উদ্দেশ্য এক – এমন মতবাদে গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীনতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করলে বোঝা যায়, গান্ধীজী প্রশ্নহীণ আনুগত্য দেখানো অনুচর ছাড়া কাউকে গুরুত্ব দিতেন না। এমন একজন megalomaniac মানুষের হাতে স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থায় সর্বাধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে যে কটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দিকে দেশ এগুলো, তা হল, বাংলার নেতাদের অনেকের নেতৃত্বের ক্ষমতা ও জনভিত্তিকে গান্ধীজী ও জওহরলাল ভয় ও হিংসা করতেন! সে কারনে, বাংলা যদি ভারতের মধ্যে না থাকে তাহলে তাদের বিশেষ ক্ষতি হয়না – এজন্য ভারতভাগের সময় বাংলা ভাগের কোন অভিপ্রায় কংগ্রেসের ছিল না। যদিও গান্ধীজী বারবার আপামর ভারতীয়কে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ভারতভাগের তিনি বিরুদ্ধে; এমনকি এও বলেছেন, ভারতভাগ তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে! এদিকে তিনি জিন্নার সঙ্গে বৈঠক করেছেন; তাঁর শিষ্য জওহরকে স্বাধীন দেশের প্রথম নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এভাবেই তিনি জিন্নাকে কংগ্রেস তথা ভারতের নেতৃত্বে আসার সুযোগ দেননি। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতির মধ্যে আন্দোলনের নামে বৃটিশ শক্তিকে বিব্রত না করা; মুসলিম লীগের সব দাবীগুলিতে নীরবতার দ্বারা (মৌণং সম্মতি লক্ষণম্) সমর্থন করা এবং জওহরলালের নেতৃত্বে তাঁর বশংবদদের হাতে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তা দেখা।
এদিকে তখন কম্যুনিষ্ট পার্টি পুরোপুরি পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে এবং পুরো বাংলা প্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ওকালতি শুরু করে। একাজে তাদের দলের সাধারণ সম্পাদক গঙ্গাধর অধিকারী অগ্রণী ভূমিকা নেন। গঙ্গাধর অধিকারী তাঁর কাজের সমর্থনে ভারতবর্ষের ইতিহাসকেও অস্বীকার করতে পিছপা হননি। তিনি তাঁর লেখায় ভারতবর্ষকে দেশ হিসেবে না দেখে বিভিন্ন প্রদেশের (বা রাজ্যের) সমষ্টি হিসেবে দেখেছেন! এমন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে কম্যুনিষ্ট পার্টি দলগতভাবে পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে ও বাংলা ভাগে বিরোধীতায় নামে। শুধু তাই নয়, তারা মুসলিম লীগ – বিশেষতঃ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করে। এই দলের অগ্রণী নেতাদের মধ্যে মুজফ্ফর আহমেদও ছিলেন! কিছু হিন্দু বাঙ্গালী নেতা, শরৎ চন্দ্র বসু, কিরন শঙ্কর রায় ইত্যাদি পাকিস্তান গঠনের দাবীকে সমর্থন করেন এবং বাংলা ভাগের বিরোধীতা করেন। এই নেতারা তাঁদের ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা করে হিন্দু বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ জ্বলাঞ্জলী দেওয়ার রাস্তা দেখাতে চেয়েছেন।
এই সময় শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় বৃটিশ রাজশক্তিকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন – বাংলায় ইসলামী শাসনের আগে এদেশের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সভ্যতা, খাদ্যাভাস, সবই এক থাকলেও ইসলামী শাসনের পরে তা পাল্টে যায় – একথা মসলিম লীগের তত্ত্বেও উঠে এসেছে আর কংগ্রেসও এতে আপত্তি করেনি। তিনি যুক্তি দিলেন যে, জনসংখ্যার ২৪% যদি এই কারনে আলাদা রাষ্ট্র পায় তবে বাংলার হিন্দুদের (অবিভক্ত বাংলায় ৪৫% মানুষ ছিলেন হিন্দু) উপর অবিচার হবে।ধর্মীয় কারনে বিভাজনের ক্ষেত্রে তিনি হিসেব করে হিন্দু অধ্যুষিত পরগণাগুলিকে নিয়ে আলাদাভাবে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টির সওয়াল করেন। তখন শরৎ বসুরা আবার বাগড়া দিয়ে বললেন, আমরা তাহলে পশ্চিমবঙ্গকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চাই! আসল উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া। শ্যামাপ্রসাদ শুধু হিন্দু মহাসভা দলের থেকেই নয়, সকল বাঙ্গালীর কাছেই পশ্চিমবঙ্গের সমর্থনে এগিয়ে আসার যুক্তি দেখান। হিন্দু মহাসভা ছাড়াও মারোয়ারী সম্প্রদায় এবং কতিপয় পঞ্জাবী ও নেপালীরা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাবে সমর্থন জানান। কম্যুনিষ্ট পার্টি হিন্দু মহাসভাকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর জন্য দায়ী করে মুসলিমলীগের সমর্থনে ও বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবীতে প্রচার চালায়! গঙ্গাধর অধিকারী ছাড়াও মুজফ্ফর আহমেদের মথ মানুষও এতে শামিল ছিলেন! এইভাবেই জেহাদী ইসলামের সমর্থক ও পাক-ই-স্তানের বন্ধু এই কম্যুনিষ্টরা ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে অবলুপ্তির পথে। একমাত্র সংবাদ-মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমেই এদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
এদিকে, বৃটিশ শাসকরা বাংলার রাজনীতির নাড়ি বোঝার জন্য ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের প্রস্তাবকে বাংলার আইনসভায় প্রস্তাব আকারে পেশ করার কথা বললেন। এই সময় কংগ্রেস দলগতভাবে কোন দিকে না গেলেও মুসলিম লীগ তাদের সদস্যদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেবার জন্য হুইপ জারি করে। ভোটাভুটিতে অদ্ভুত বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। ৫৮ জন পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে ভোট দেন এবং ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন! দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ইসলামী সদস্য পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করেন। সেদিন কম্যুনিষ্ট পার্টির ঘোষিত নীতি পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরুদ্ধে থাকলেও তাদের দুই দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। আবার কিছু হিন্দু বাঙ্গালী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
এর থেকে একটি ব্যপার খুব পরিষ্কার। দলমত নির্বিশেষে সকল ইসলামী পাক-ই-স্তানের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাকে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিল। আর বেশীরভাগ হিন্দুরা (কংগ্রেস দলগতভাবে নয়) চেয়েছিল বাংলার বিভাজন ও ভারতের মধ্যে হিন্দু অধ্যুসিত পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্তি। তারপর ২০শে জুন,১৯৪৭ সালে সরকারী নোটিশ জারি হয় যাতে করে ভারতের নতুন প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়।
এই অমানিশা আর কতদিন
একটি আত্মঘাতী জাতি কতদিন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে? হ্যাঁ, বাঙ্গালী জাতির কথাই বলছি। স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের এবং তার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষের উপর বারবার অত্যাচার, অবহেলা ও বঞ্চনার অভিশাপ ঝরে পড়েছে। ১৮৮০র সময় থেকেই বাঙ্গালী যুবশক্তির একটি বড় অংশ সশস্ত্র পদ্ধতিতে বৃটিশের অত্যাচারের প্রতিদান হিংসার মাধ্যমে দেওয়ার শপথ গ্রহণ করে। এই বাঙ্গালী বিপ্লবীরা মোটামুটি দুটি দলে – অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর – বিভক্ত ছিল। যখন বৃটিশ শাসককুল বিপ্লবীদের কাজকর্মে ব্যতিব্যস্ত বোধ করতে লাগল, ইতিহাস বলে, গান্ধীজি তাঁর অতিরিক্ত হাইপ তোলা গণআন্দোলন – অসহযোগ – শুরু করলেন। গান্ধীজি কখনো বিপ্লবীদের শাসক-বিরোধীতাকে সমর্থন করেননি, বরং সক্রিয় বিরোধীতা করেছেন। তিনি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বাঙ্গালীদের, তাঁর ধারনাপ্রসুত ‘ভারতীয়ত্ব’-এর বাইরে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলশ্রুতিতে তাঁরই শিষ্য জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বারবার বাঙ্গালীদের তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বঞ্চনার চেষ্টা করেছেন। এমনকি “দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” এবং “নোয়াখালী হিন্দু গণহত্যা”র পরে প্রতিনিয়ত যখন পূর্বপাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থীর আগমন শুরু হল, তখন জওহরলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার পঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীদের সঙ্গে বিমাতৃসূলভ আচরন করেছেন – এসবের ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ফলে, বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থী পরিবারগুলির মনে কংগ্রেস দলের প্রতি প্রতিকুল মনোভাব জন্ম নেয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস কখনো তা দূর করার চেষ্টা করেনি।
আবার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বাঙ্গালী – হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বিষে আক্রান্ত ছিল না। যেহেতু, সব বাঙ্গালী মুসলমানই হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের কৃষ্টি, সভ্যতা, কথাবার্তা সবই একরকম। আরবী কৃষ্টি, আচার-আচরণ তাদের অজানা ছিল। সেকারনে এই বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী মুসলমানরা নীচুজাত (সাচ্চা মুসলমান নয়) মনে করত! পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী মুসলমান শাসকেরা যখন বুঝল যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের বেশীদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, তখন তারা চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কার্ড খেলল। একই দল, মুসলিম লীগের জিন্নার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য অধিকতর মুসলমান দরদী সাজার চেষ্টায় থাকা হোসেন সুরাবর্দীর নেতৃত্বে “দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” ও “নোয়াখালী গণহত্যা”র মধ্যে দিয়ে হিন্দু-বিদ্বেষের মাপকাঠিতে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতা হতে চেয়েছিলেন। একাজে ধর্মীয়স্থান মসজিদগুলিকে ব্যবহার করে এবং মসজিদের মৌলানা, মৌলভীদেরও এই কাজে যুক্ত করেন; এরা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের উপর বিদ্বেষ জাগাতে অগ্রণী ভূমিকা নেন। যে সাধারন বাঙ্গালী মুসলমানরা বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা জানতেন না, তাদেরকে কোর-আন থেকে বেছে বেছে খন্ডিতভাবে বিভিন্ন সুরার অপব্যাখ্যা করে মৌলভীরা হিন্দু-বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। আর্থিক সাহায্য ও ইন্ধন আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। হিন্দু বিতাড়নও গণহত্যার পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভূত্ব পূর্ব পাকিস্তানের গলায় ফাঁসের মত চাপ বাড়াতে থাকে। ফলে, ১৯৬৯ সাল থেকেই শুরু হয় আন্দোলন, হিংসা, আবার হত্যালীলা, ধর্ষণ। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানে রমনা কালী মন্দির সহ অজস্র মন্দির ধ্বংস করা হয়। সার্বিকভাবে হিন্দুরা বাঙ্গালী মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী নির্যাতিত হন। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় সাহায্যে পাকিস্তানী উর্দুভাষী হানাদারদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়। কিন্তু, ঐ যে মসজিদ থেকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর সেট-আপ, সেটা বহল থাকে। তার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার নামে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে অজস্র মাদ্রাসা তৈরী হয় – যাদের হিন্দু-বিদ্বেষের আঁতুরঘর বলা যেতে পারে। এসবের ফলে দুই বাংলাতেই বাঙ্গালীদের নিজেদের মধ্যে সুদূরপ্রসারী ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ তৈরী করার চেষ্টা করা চলল – যা এখনো চলছে। এর ফলে কার লাভ আর কার ক্ষতি, তা পর্যালোচনা করলেই আমরা এর কারন জানতে পারব।
প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসে আরেকটি কথা বলা দরকার। যে উদ্বাস্তু পরিবারগুলির সক্রিয় সমর্থনের উপর ভিত্তি করে কম্যুনিষ্টরা তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলো, সেই মানুষদের সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়ণের কোন চেষ্টাই তারা করেনি। উপরন্তু, ১৯৭৯ সালে মরিচঝাঁপিতে পুলিশের সহায়তায় কম্যুনিষ্টরা হতভাগ্য উদ্বাস্তুদের গণহত্যা সংঘটিত করে তাঁদের স্থায়ীভাবে কম্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের স্থায়ী বিরোধী করে তোলে।আবার, যখন উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যার চাপে রাজ্যের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, সেই ৫০-৬০এর দশকে কংগ্রেস,কম্যুনিষ্ট নির্বিশেষে উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দাদের ক্ষেপিয়ে তোলার কাজ করা হয়! শুধু হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নয়, “ঘটি-বাঙ্গাল” ভেদও তৈরী করা হল! এমন একটি ভাব যেন, এই “বাঙ্গাল”গুলো এদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানকার সম্পদে অনধিকার ভাগ বসাচ্ছে! তারপর বাম জমানায় নতুন শিল্প ত দুরস্ত্, চালু শিল্পগুলিও শ্রমিক আন্দোলনের অজুহাতে বন্ধ করে দিতে লাগল! তখন কম্যুনিষ্ট দলগুলির যারা সর্বভারতীয় নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের নিজেদের রাজ্য – পাঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেরালাতে এভাবে পাইকারী হাযে চালু শিল্প বন্ধ করা হয়নি! অর্থাৎ, বাম শ্রমিক আন্দোলন প্রতিটি রাজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা! অবাঙ্গালী কর্মচারীরা তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেও এই রাজ্যের বাঙ্গালী শ্রমিকদের অবস্থা হল শোচনীয়। এদিকে, অপারেশন বর্গার কারনে একলপ্তে এই রাছ্যে বড় ছমি না পাওয়ায় উন্নতমানের আধুনিক চাষাবাদ করাও এখানে সম্ভব হল না। কম্যুনিষ্টরা পশ্চিমবঙ্গে সমবায় আন্দোলনকেও সমর্থন দেয়নি। ফলে, চাকরীর বাজার রাজ্যে খুব সংকুচিত হয়েপড়ল। আবার সরকারী চাকরীতে জাতিগত সংরক্ষণের জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারনে বাঙ্গালীর মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষের সূচনা হল। মনে রাখতে হবে, বাঙ্গালীর মধ্যে জাতিগত অশ্পৃশ্যতা কখনো ছিল না।
আবার, পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার আলো যাতে সহজে প্রবেশ করতে না পারে তার চেষ্টা উর্দুভাষী মুসলমানরা প্রথম থেকেই করে আসছে। এর দুটি উদ্দেশ্য : এক, অশিক্ষিত মানুষকে শোষণ করা সহজ; দুই, এদের মাদ্রাসা শিক্ষায় রাখলে জেহাদী বানানো সহজ হয়। পরধর্ম আগ্রাসনের কামনা বাঙ্গালী মুসলমানের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আরবী কৃষ্টি ও সভ্যতার অপভ্রংশ – উর্দুভাষী মুসলমান – আর তা পুরোপুরি নিজেদের স্বার্থে। কারন, এর জন্য বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের আর্থিক বা আত্মিক – কোন উন্নয়ণ হয়নি। বরং হিন্দু বাঙ্গালীদের শত্রু বানিয়ে তাঁরা নিজেদের সামাজিক ক্ষতি ডেকে এনেছে। অবশ্য এটা ঠিক যে, হিন্দু-মুসলমান উভয় বাঙ্গালী সমাজে বহু মানুষ আছেন যাঁরা বাঙ্গালী ঐক্যের মধ্যে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বাকে জাগাতে আগ্রহী। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় নগণ্য। বাঙ্গালী মুসলমানের মনে হিন্দু বিরোধী মনোভাব জাগানোর জন্য শুধু যে নাটক, সিনেমার আশ্রয় নেওয়া হয় তাই নয়, বাংলা ভাষায় আরবী ও উর্দু শব্দ প্রয়োগ করে তা জোরের সঙ্গেচাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ত বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও জলের বদলে বাঙ্গালী মুসলমানকে পাণি বলতে বাধ্য করা হচ্ছে! তাছাড়া ফুফা-ফুফি, চাচা-চাচি, আপা, বুবু ইত্যাদি প্রচুর বিজাতীয় শব্দ বাংলায় ঢুকিয়ে বাঙ্গালী মুসলমানদের বাঙ্গালী হিন্দুর থেকে পৃথক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। এতে করে বাঙ্গালী হিন্দুদের জাতিগত নির্মূলকরন (ethnic cleansing) করার পর যে অল্পসংখ্যক বাঙ্গালী মুসলমান অবশিষ্ট থাকবে তাদের আরবী-উর্দু কৃষ্টি ও সভ্যতা রক্ষার কৃতদাস হিসেবে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
পশ্চিমবঙ্গে যেমন বামফ্রন্টের সময় থেকেই সূক্ষ্মভাবে বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর জন্য মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে জেহাদী শিক্ষা ও জেহাদের ডাক দেওয়া হত, তেমনি প্রশাসন শক্ত হাতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে দিত না। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দল ১১ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর জেহাদী-ইসলামকে শুধু তোল্লা দেওয়াই নয়, জেহাদীদের দলের বিভিন্ন স্থানীয় নেতাদের দলের নেতৃত্বে বসানোর কাজ শুরু হল! বামফ্রন্টের রাজত্বে সিপিএমের নেতৃত্বে যখন গুন্ডাগর্দী শুরু হয়, তখনই বাঙ্গালীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ বর্ধমানের সাঁইবাড়ি হত্যাকান্ডে সিপিএমের ক্যাডারদের নৃশংস বর্বরতা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে শুধু স্তম্ভিত করেনি – রাজ্যের মানুষের প্রতিবাদের ভাষাকে কেড়ে নিয়েছিল। তারপর, সিপিএমের ক্যাডার রাজে বিরোধী কন্ঠ স্তব্ধ করার জন্য একের পর এক হত্যালীলা সংঘটিত হতে থাকে। ১৯৮৫ সালের ২রা জুলাই বর্ধমানের কেশবাড়ি গণহত্যা। ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ছোট আঙারিয়া…….কেশপুর……..। গণহত্যা, ধর্ষণ, ও জোর করে আদায় করা কাটমাণি বা দালালী ইত্যাদি বিভিন্ন রকম অত্যাচারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠল। তৃণমূল রাজত্বে এই অত্যাচার গণতান্ত্রিক রূপ পেল! বহু মানুষ একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করল। যে সিন্ডিকেট রাজ সিপিএম শুরু করেছিল তা তৃণমূলের রাজত্বে মহীরুহে পরিণত হল। প্রশাসনিক প্রশ্রয়ে বা ঔদাসিন্যে, অনৈতিক উপায়ে ও শোষণে সংগৃহীত অর্থের ভাগাভাগির কারনে খুনোখুনির অনেক ঘটনা ঘটতে লাগল! সাম্প্রতিককালে বগটুই গ্রামের নারকীয় ঘটনা এর সাক্ষ্য বহণ করে।
যেকোন নির্বাচনে বিরোধীদের গায়ের জোরে হটাতে প্রতিটি সাধারন নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মৃত্যু মিছিল দেখল। আশ্চর্য লাগে, বগটুই গ্রামের ঘটনায় মূখ্যমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন, পুলিশ কিভাবে তদন্ত করবে, তদন্তের অভিমুখ কি হবে! কে দোষী – কাকে গ্রেপ্তার করতে হবে – এসব সংবাদ মাধ্যম ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে মৌখিক আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা মূখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর আছে কিনা – সংবিধান কিভাবে তাঁকে এই ক্ষমতা দেয় এবং প্রশাসনের উপর এভাবে চাপ সৃষ্টি করা যায় কিনা – তা জানার ইচ্ছা রইল। এমনকি প্রশাসনের বাইরে, শাসকদলের একজন নেতা গণমাধ্যমের সামনে বলে দিচ্ছেন যে, প্রশাসন কিভাবে কেস সাজাবে! প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার এর থেকে বড় লক্ষণ আর কিইবা হতে পারে!
এই রকম ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিতে, হিংসা-দ্বেষের রাজনীতির শিকার হচ্ছে বাঙ্গালী, মারছে বাঙ্গালী, মরছেও বাঙ্গালী – তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন। বাঙ্গালীকে ধর্ম, জাতপাতে ও আঞ্চলিকতায় (বাঙ্গাল, ঘটি, রাজবংশী, ঝাড়খন্ডী ইত্যাদি) বেঁধে রেখে যারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং যে নেতারা তা করতে সাহায্য করছেন, তাদের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার একতা দেখাতে না পারলে বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বই লুপ্ত হবে। আত্মপ্রবঞ্চক, ভ্রষ্ট রাজনীতির যুপকাষ্ঠে বাঙ্গালী জাতি বলিপ্রদত্ত – তার দায় যেমন বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী রাজনীতিকের, তেমনি ধর্ম ব্যবসায়ী সহ মেরুদন্ড খোয়ানো সমগ্র বাঙ্গালী জাতির।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন পথে
আমায় একটি প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়, “আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ‘দিদি’ কি বামফ্রন্টের রেকর্ড ভেঙ্গে দেবেন”? রাজনীতির অতি সরলীকরন করলেও মনে হয় না যে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্টের চেয়ে বেশী সময় পশ্চিমবঙ্গের গদি দখলে রাখতে পারবে! তার প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে, ১৯৬৪ সাল থেকে লাগাতার বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক জমি তৈরী হয়েছে তার ফসল ১৯৭৭ সাল থেকে বামফ্রন্টের মোড়কে সিপিএম ঘরে তুলেছে। পক্ষান্তরে, নকশাল ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের “কংশাল” অত্যাচারের মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর রাজনৈতিক জন্ম হওয়ায় তিনি তাঁর রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন দুটি স্তম্ভের উপর – একটি বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিএমের কুশাসনের ফলে তৈরী হওয়া জনরোষ এবং অন্যটি কৃষকের জমি হারানোর ভয় ও বেকারসংখ্যার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। এতসব সত্ত্বেও বলব, ২০১১ সালে রাজনৈতিক সততার ধ্বজাধারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য না থেকে যদি কোন কট্টর জঙ্গী নেতা বামফ্রন্টের কান্ডারী থাকতেন, তাহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সফল ভূমিকা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জীর মূখ্যমন্ত্রীত্ব পাওয়া হয়ত সম্ভব হত না।
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকায় – বিশেষতঃ রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বিপুল বেকারত্বের চাপের মধ্যে তৃণমূল সরকার যেভাবে রাজ্যের অর্থনীতিকে চালাতে চেষ্টা করছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া রাজ্য সরকারের চলার কথা নয়। প্রতি মাসে প্রায় ছ হাজার কোটি টাকা ওভারড্রাফ্ট (সুদ দেওয়ার করারে ধার) না নিলে সরকার তার অনুদানের প্রজেক্টগুলি ত চালাতে পারবেই না, তারা কর্মচারীদের মাইনে এবং পেনশান দিতেও সমর্থ হবে না। এখানে একটা কথা, অনুমোদিত পেনশান দেওয়া এবং প্রদান করা দুটোই সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পরে। অর্থাৎ, এটা DA দেওয়া নয়; যেদিন সরকারী পেনশান বন্ধ হবে, সেদিন থেকে রাজ্য সরকারের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সংবিধানের ৩৫৫ ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তাবে। এ বিষয়ে সংবিধান এতটাই পরিষ্কার যে, কোন জজ বা কোন ‘সেট ইন’ ব্যবস্থা তা আটকাতে পারবে না। অবশ্য কতদিন এই ধার দেওয়া-নেওয়া চলবে তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর অর্থাৎ বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থনৈতিক কারনে দায়বদ্ধ থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় আটকে গেছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার।
আগে একাধিকবার বলেছি, ২০২১এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জেতেনি – বিজেপি হেরেছে! এর ব্যাখ্যাও দিয়েছি। এখন যত সময় এগোচ্ছে, সেই যুক্তির সত্যতা বেশী বেশী করে প্রমাণিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থা গত পঞ্চাশ বছরে যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অযথা রাজনৈতিক বিবাদের ফলশ্রুতিতে রাজ্য চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা। এটা বুঝেই দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে সুচতুর রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু রাজনীতিতে যে সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন তা অল্প কথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয় – রাজ্যে কুস্তি, কেন্দ্রে দোস্তি! এর ফলে, কেন্দ্রের তখনকার শাসকদল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ছন্নছাড়া অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। এটি জ্যোতিবাবু খুব চাতুর্যের সঙ্গে করতেন এবং সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংষ্কার আন্দোলনের সার্থক রূপ দেওয়া ও পঞ্চায়েতীরাজ চালু করা – এগুলোই বামফ্রন্টকে চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় রেখেছিল। মমতাদেবীর তৃণমূল দলের এমন কোন কাজ না থাকায় এবং অনুদান রাজনীতির জাতাকলে রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় এই সরকারের স্থায়ীত্ব অনেকটাই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল।
দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল গত নির্বাচনে জেতার পরেই হটাৎ করে সর্বভারতীয় দল হওয়ার লক্ষ্যে ত্রিপুরার লোকাল বডি নির্বাচনে তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে গেল। নিজেদের বিজেপির বিরুদ্ধে প্রজেক্ট করল! সেখানে বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রাক্তণ বিরোধীদল সিপিএম যেটুকু ঘর গুছিয়ে নিতে পেরেছিল, তৃণমূলের এই বহুল প্রচারিত লড়াইয়ে তারা সিপিএমের ভোট অনেকটাই কেটে নিয়ে বিজেপির জয় সুনিশ্চিত করল! আশ্চর্যের ব্যাপার – তৃণমূল একটুও দমে না গিয়ে, সাজানো স্ক্রিপ্টের নাটকের মত গোয়ায় গিয়ে এমন প্রচার শুরু করল যে মনে হল তারা এবার সেখানে বিজেপিকে হারিয়ে রাজ্য বিধানসভা দখল করবে! যেন তাদের নির্বাচন জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা! সেখানেও তারা বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রজেক্ট করল! এখানে মনে রাখা দরকার, গোয়ায় ২০১৫ সালের নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল ছিল কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীর মূর্খামী ও বিজেপির রাজনৈতিক পরিপক্কতার কারনে সেখানে বিজেপি কংগ্রেসের দল ভাঙ্গিয়ে এবং এমজিপির সঙ্গে সমঝোতা করে সেবার ক্ষমতায় আসে। সুতরাং এবারের লড়াই শুধু শক্তই নয়, বিজেপির কাছে অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। তৃণমূল, প্রধানত মমতা ব্যানার্জী ও অভিশেক ব্যানার্জী, সেখানে তাদের বিজেপি বিরোধী ইমেজ ভাঙ্গিয়ে যে প্রচার করলেন, তাতে তাদের দল কোন আসন না পেলেও কংগ্রেস ও আপের ভোট কেটে তাদের আসন সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিল – বিজেপির সরকার গঠন অনেক সহজ হল। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সহযোগী দল এমজিপিও তৃণমূলের বিজেপি বিরোধী ইমেজকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটল; ভোট গণনা শুরু হওয়ার মুখে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙ্গে রাজ্যে বিজেপিকে সমর্থন করার ঘোষণা করে দিল!
উত্তর প্রদেশে মমতা ব্যানার্জী সমাজবাদী পার্টির সভায় এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখলেন যে সেখানকার নির্বাচনে, বিশেষতঃ বাঙ্গালী অধ্যুষিত বেনারসে বিজেপি সহজেই জিতে গেল। অর্থাৎ, মমতা ব্যানার্জী বিজেপির পক্ষে দূর্বল জায়গাগুলিতে প্রচার চালালেন এবং সব জায়গাতেই বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভ করল! মমতা ব্যানার্জীর মত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার ধৃষ্টতা করা ঠিক নয়। তিনি ভুল স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এসব করেছেন বলে মনে হয় না। আবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রার্থী চয়ন থেকে দলের নির্বাচন পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ এমনভাবে করল যে, এমন পরিপন্থী কাজ করা তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেও মানা যায় না। হয়ত এভাবেই রাজনৈতিক সৌজন্যের প্রতিদান দেওয়া হয়!
এদিকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যে দলের প্রধান বিরোধীর ভূমিকা পালন করার কথা, সেই জাতীয় কংগ্রেস দল কালের নিয়মে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে এখন বিলীন হওয়ার পথে। তার প্রথম ও প্রধান কারন, এই দল লালবাহাদুর শাস্ত্রী জমানার অল্প সময় ছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পারিবারিক দল হিসেবে রয়ে গেছে। ভারতের মত কর্তাভজা দেশে অবশ্য তাতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কারন প্রায় সব বিরোধী দলই পারিবারিক দল! তবে, এইসব দলের স্থায়ীত্ব ও সাফল্য নির্ভর করে তার নেতৃত্বের যোগ্যতার উপর। ইন্দিরা গান্ধী যে যোগ্যতায় দলকে পরিচালনা করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে তা দেখা না গেলেও সুদৃঢ় ইমারত ভাঙ্গতে আরো ২৫-৩০ বছর লাগছে। কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বে দাম্ভিকতা পুরোপুরি থাকলেও যোগ্যতা বিন্দুমাত্র নেই। সোনিয়া গান্ধী বড়জোর kitchen conspiracyতে দক্ষ হতে পারেন – তাঁর কংগ্রেসের মত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর যোগ্যতা নেই, উপরন্তু দাম্ভিকতা পুরোদস্তুর – ফলে, অযোগ্য চামচা ছাড়া আর কোন সুযোগ্য রাজনীতিকের ঐ দলে থাকা সম্ভব নয়।
সোনিয়া গান্ধী বিদেশিনী হওয়ার কারনে তিনি একটি বিশেষ স্তরের উপরে, সর্বভারতীয় পর্যায়ে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সাহস করেননি। যদিও তিনি ভারতের ডোমিসাইল্ড নাগরিক – ইটালীতে জন্ম এবং ইটালিয়ান বাবা মার সন্তান হওয়ার কারনে তিনি OCI (Oversease Citizen of Italy) হতেই পারেন। ভারত ও ইটালী দুই দেশই দ্বিনাগরিকত্বকে মাণ্যতা দেয় না। তবে ভারতের ওভারসীজ সিটিজেনরা দেশে জমিজমা ও অন্য সম্পত্তি রাখতে পারেন এবং তাঁরা ভারতীয় ইনকাম ট্যাক্সের আওতায় পরেন; কিন্তু তাঁরা ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না। ইটালীর OCIরা কিন্তু এখন সে দেশের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন! তাদের এই আইনটা ভিন্ন। সে দেশের পার্লামেন্টো ইটালীয়ানোতে দু ভাগে বিভক্ত সিনেট ও ডেপুটিজ – দুয়ের ক্ষমতা সমান; দু কক্ষই সরাসরি নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত। এক্ষেত্রে সংবিধানের ল নম্বর ৪৫৯ এ ২৯শে ডিসেম্বর, ২০০১ সালে সংশোধন করে (৪৮, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর সংশোধনী) ওভারসীজ কন্সটিটিউয়েন্সী নামে OCIদের জন্য ৬টি সিনেট ও ১২টি ডেপুটিজ কন্সটিটিউয়েন্সী করে ভোট দেওয়ার নিয়ম করেছে! কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন পরিবার যে ইটালীর OCI নন, তেমন কোন প্রমান এখনো জানা নেই। ভারতের আইনে কিন্তু কোন নাগরিক বিদেশের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। এধরনের রহস্যাবৃত নাগরিকত্ব নিঃসন্দেহে ভোটের ময়দানে অন্য রাজনৈতিক দলকে সুবিধা করে দেবে। পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবারতন্ত্রের কংগ্রেসের তৃণমূল বা বিজেপিকে বেগ দেওয়ার ক্ষমতা আগামী নির্বাচনে অন্ততঃ নেই।
এখন কম্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের পুনরুত্বানের যে গল্প বিভিন্ন মিডিয়ার দৌলতে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার কোন ভিত্তি আছে বলে ত মনে হয় না। লকডাউনের সময় রেড ভলান্টিয়ার্সদের কাজ যেমন প্রশংসার দাবী রাখে, তেমনি আরো অনেক গোষ্ঠীই সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এসেছিল – শুধু একটি বা দুটি গোষ্ঠীকে সংবাদ-মাধ্যমে প্রচার পাইয়ে দিলে তা যে বিশেষ পার্টির ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে – তার কোন কারন আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে কম্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের বড় বাধা হল তাদের জাতীয় নীতি! কম্যুনিষ্টরা স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যেমন হিন্দু-বিদ্বেষের সঙ্গে ভারত বিদ্বেষ ও পাকিস্তানপ্রীতি চালিয়ে গেছে, আজও সেই একইভাবে তাদের নীতি অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছে। ফলে, দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে তাদের কাজকর্ম দেশ-বিরোধী তকমা পাচ্ছে। এভাবেই তারা সারা দেশেই ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত মৌলিক পরিস্থিতিতে যে মৌলিক নীতির পরিবর্তন করতে হয় তা ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের অজানা।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গে ২০২৪ সালের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দলের কোন বিকল্প নেই – যদি না বিজেপি তাদের ‘সেট-ইন’ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসে। এই বিষয়টা পুরোপুরি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। ইডি,সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের বারবার বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে চলা রাজ্যসরকারের পাশে যখন না দাঁড়ানোর সংকেত আসবে এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার মত অভিজ্ঞ টিম যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য বিজেপিতে তৈরী করে তখন বুঝতে হবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আসন্ন। অন্যথায়, পশ্চিমবঙ্গের মসনদ থেকে মমতা ব্যানার্জীকে হটানো সম্ভব নয়। তবে, রাজনীতির দাবা খেলায় তৃণমূলের দিল্লী দখল ত দুরস্ত্, পশ্চিমবঙ্গ তাদের থাকবে কিনা তা বিজেপির উপর নির্ভরশীল।
