তুঘলকী প্রশাসন ও ওমিক্রন ভূত

আবার করোনার ভ্রুকুটি – আবার গরীবের পেটে লাথি। এবারের করোনা ভূত – তার নাকি ওমিক্রন রূপ! অতয়েব আবার বিধিনিষেধ – আবার ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের দীর্ঘনিশ্বাস – চোখের জলে মাটি ভিজবে – বেসরকারী হাসপাতালগুলির লাভের ঘর স্ফীত হবে – ‘অনুপ্রাণিত’ মানুষদের ঘরে অতিরিক্ত সম্পদের সংস্থান হবে। এমন অবস্থা কেন, কিভাবে হল – এর পেছনে কুশীলব কারা – সেই তথ‍্য বিশ্লেষণ করা অতি প্রয়োজন।
বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট, যাতে ৩৭ জায়গায় প্রোটিনের কার্বোহাইড্রেট ও অ‍্যামিনো অ‍্যাসিডের ট‍্যগিং পয়েন্ট পরিবর্তিত হয়েছে, সেটি অত‍্যন্ত বেশী মাত্রায় সংক্রামক ও তার ফলেই নাকি করোনা আক্রান্তের সংখ‍্যার এই বাড়বাড়ন্ত! এমন ভাবের ঘরে চুরি বোধহয় এখনকার প্রশাসনের পক্ষেই সম্ভব। পরিসংখ্যান কিন্তু সম্পূর্ণ অন‍্য কথা বলছে। গত ১লা জানুয়ারি, ২০২২এর সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের একদিনে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ‍্যা সাড়ে ঢার হাজার, যার মধ‍্যে ওমিক্রন আক্রান্ত মাত্র ১৯। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, আমাদের রাজ‍্যের ক্ষেত্রে ওমিক্রন নয়, সবচেয়ে ভয়াবহ ভ‍্যরিয়েন্ট ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাসে আক্রান্তের সংখ‍্যায় অতিবৃদ্ধি হয়েছে। আবার এই সময়ে লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে যে, উত্তর-পূর্বের রাজ‍্যগুলিতে – বিশেষতঃ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ‍্যুষিত নাগাল‍্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত কয়েকদিনে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া দেশের বড় শহরগুলির মধ‍্যে মুম্বাই, পুণে, দিল্লী, কোলকাতা ও ব‍্যাঙ্গালোরে করোনা রোগীর সংখ‍্যা ১০% এর মত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোলকাতায় এই বৃদ্ধি সর্বোচ্চ – ২৩% এর উপর!
এই পরিসংখ্যান আমাদের যে তথ‍্য দিচ্ছে তার থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বর্ষপূর্তি ও খ্রীষ্টমাসের আনন্দে বাঁধনহারা মানুষের কোভিড প্রোটোকল বিরোধী জমায়েত, মাস্ক না পড়ে, সামাজিক দূরত্ববিধি না মানা – এসব যেখানেই বেশী হয়েছে সেখানেই করোনার আক্রমণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর দ্বারা উন্মোচিত,সরকারী খরচে আলোর মেলা – যা দেখতে লক্ষ মানুষের ভিড় জমেছে – তা যেকোন পুজোর ভিড়কে ছাপিয়ে যায়। কোর্টের আদেশে প্রশাসন ও পুজো কমিটিরা এই ব‍্যপারে সতর্ক থাকায় পুজোর সময় রাজ‍্যে তৃতীয় ঢেউ আটকানো গেছে। তবে এবারের এই বিপর্যয়ের দায় বহুলাংশে রাজ‍্যের বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগোষ্ঠীগুলিকে নিতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্মের জন‍্য এরা আগেই যথেষ্ট পরিচিত। পুরোনো নানা ঘটনার উল্লেখে বিড়ম্বনা বাড়ানো এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য নয়। তবু একথা মানতে হবে, আমদের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি আগে থেকে কোন অনুষ্ঠানের বা উৎসবের ‘হাইপ’ তুলতে থাকে। এর কারন এখন সবাই বোঝেন। নিজেদের লাভের কড়ি বাড়াতে গিয়ে এরা এই খ্রীষ্টমাস ও ইংরেজী বর্ষবরণের ‘হাইপ’ তুলতে একে অন‍্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামল। ওদিকে ‘কম জানা, বেশী বোঝা’ ধর্মনিরপেক্ষ (!) বাঙ্গালী মধ‍্যবিত্ত তাদের স্ট‍্যাটাস দেখানোর জায়গা হিসেবে করোনা রোগীর সংখ‍্যাবৃদ্ধিতে সরাসরি ইন্ধন জুগিয়েছে। প্রাথমিক তথ‍্য বলছে, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা এবং বয়স্ব নাগরিকরা এই হুজুগ থেকে দূরে থাকায় তাঁদের মধ‍্যে করোনা আক্রান্তের সংখ‍্যা তুলনামূলকভাবে কম। যখন উৎসব শেষ, বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি বাঙ্গালীর কফিনে পেরেক পোঁতার কাজে নেমে পড়ল। এবারের উদ্দেশ‍্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ঘরে আটকে রেখে অর্থনীতির চরম ক্ষতি করা। নেপথ‍্য কারন মনে হয়, ‘অনুপ্রেঢ়ণা’ ও ‘অনুপ্রাণিত’ প্রশাসনকে জনসাধারনের রোষ থেকে বাঁচানো।
তারজন‍্য প্রথমেই ওমিক্রন ও তার সংক্রমনের ভয়াবহতা নিয়ে নিয়ে ভূতের গল্প শোনানোর মিথে জনমনে ভীতি ছড়ানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সাংবাদিকের জ্ঞানগর্ভ লেখায় সেকি জোশ!…… আমার মনে পড়ল, প্রমথনাথ বিশীর এক অসাধারণ উক্তি। এই প্রথিতযশা সাহিত‍্যিক বহু বছর এক বৃহৎ সংবাদপত্রে সাংবাদিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যাপনার কাজে যোগদান করেন এবং সেখান থেকেই কর্মজীবনে অবসর নেন। তারপর তিনি কোন এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলকাতা সেনেট হলে একটি আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিতে আসেন। বক্তৃতার শেষে তিনি যখন চলে যাচ্ছেন, তখন কিছু সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে জানতে চান যে তিনি তাঁর কর্মজীবনে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে কাজ করেছেন। তারা খুব অল্প কথায় তাঁর কাছে জানতে চান দুই জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। প্র.না.বি.(এই নামে তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন) অল্প কথায় বললেন, “প্রথম জীবনে আমি দেখেছি মূর্খের পান্ডিত্ব আর পরের জীবনে দেখছি পন্ডিতের মূর্খামি”। এর থেকেই বোধহয় বোঝা গেল, ওমিক্রন সংক্রান্ত আমাদের জ্ঞান বিভিন্ন প্রকাশিত গবেষনাপত্র থেকে নয়, মধ‍্যবিত্ত বাঙ্গালী এই জ্ঞান নিয়েছে সাংবাদিকদের থেকে! তবে, আজকের দিনে মানুষ উদ্দেশ‍্যবিহীন কোন কাজ করেনা। সংবাদ-মাধ‍্যমও তার ব‍্যতিক্রম নয়।
এবার দেখা যাক, আমাদের রাজ‍্যে, বিশেষতঃ কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে করোনা রোগীর এমন অকস্বাৎ বৃদ্ধির কারন কি। ‘অনুপ্রাণিত’ সংবাদ-মাধ‍্যম কখনোই এই বিশ্লেষণ করবে না। এর সবচেয়ে বড় কারনগুলির একটি হল উৎকট উল্লাসে সমস্ত কোভিড বাধানিষেধকে ছুঁড়ে ফেলে ‘উৎসব’ উদযাপন। দ্বিতীয় কারন অবশ‍্যই কোলকাতা পুরসভার সাম্প্রতিক নির্বাচন। পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে রাজ‍্যে সাম্প্রতিক মোট আক্রান্তের মধ‍্যে শতকরা ষাট-সত্তর ভাগ হচ্ছে কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এই কঠিন সময় পুর নির্বাচনের কি বিশেষ প্রয়োজন ছিল? আবার বিধাননগর, শিলিগুড়ি, আসানসোল সহ কয়েকটি পুরসভার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই নির্বাচন আর কয়েকদিন বাদে নির্ধারিত। প্রার্থীরা উৎকট দেশসেবার উদগ্র কামনায় যে কোভিড আচরণবিধি জলাঞ্জলি দেবেন তা আমাদের পূর্ব নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় সবাই দেখেছি। নির্বাচন হবে – তবে কতো করোনার বলি চড়ানো হবে সেই আশঙ্কায় শঙ্কিত হচ্ছি।
আবার, গঙ্গাসাগরের মেলা ও পূণ‍্য সঙ্গমস্নান চলবে বলে সুপ্রিম ‘অনুপ্রেঢ়ণার’ আদেশে অনুপ্রাণিত প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোন সুস্থ বোধবুদ্ধিতে এ রাজ‍্যে সমস্ত মেলা,খেলা,উৎসব, অনুষ্ঠানের ভিড় চলছে কে জানে! মনে হচ্ছে, প্রশাসন মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, চলছে হৃদয়ের অনুপ্রেঢ়ণায়। এদিকে, কোভিডপ্রোটোকল মেনে এই সব করার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের রাজ‍্যের মানুষজনের আচরণ দেখে মনে হয়, এ যেন যৌনকর্মীর কাছে কুমারীত্ব দাবী করা! পার্কস্ট্রীটের যে জনসমুদ্রের ছবি বিভিন্ন সংবাদ-মাধ‍্যমে দেখা গেছে তা কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানের দিনগুলি জুড়েই চলেছে। প্রশাসন এই সবের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিয়েছে সে সম্বন্ধে সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির নিরবতা লক্ষ‍্যণীয়। অতএব, গঙ্গাসাগররের উৎসব-পার্বণের আনন্দ ও ভোট “খেলা” আরো দুটি বড় সংক্রমণের কারন হতে চলেছে।
একটা ব‍্যপার খুব অদ্ভুত লাগছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকান্ড বেগবতী পাহারী নদীর মত সতত প্রবহমান – এখানে কখনো লকডাউন করা যাবে না – যানবাহন ও রেল সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না – এসব করলে রাজ‍্যের ভঙ্গুর স্বাস্থ‍্যের অর্থনীতি যে ভেঙ্গে পড়বে সে বিষয় সবাই একমত। তাহলে উপায় কি? প্রচারবিহীন ‘অনুপ্রেঢ়ণা’ ও জলছাড়া মাছ একই রকম। সুতরাং রাজ‍্য প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ শুরু করল। কি? ইংল‍্যান্ড থেকে আসা বিমানের অবতরন এই রাজ‍্যে বন্ধ করা হল। কেমন অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা – কোন যাত্রী যদি ইংল‍্যান্ড থেকে দুবাই হয়ে কোলকাতায় আসে? যদি দুবাই না হয়ে ভারতের অন‍্য কোন এয়ারপোর্টে নেমে তার পর চেক-আউটের পরে দেশীয় উড়ানে কোলকাতায় আসে – তাদের ক্ষেত্রে কি ব‍্যবস্থা; এভাবে সংক্রমণ আটকানো যাবে কি? “pennywise pound foolish” – এই প্রবাদটা মনে পড়ল। যেসব দেশে খ্রীষ্টমাস ও নিউ ইয়ার উদযাপন সবচেয়ে বড় উৎসব সেখানে ওমিক্রন সংক্রমণ বিপুল হারে বাড়ছে। আমাদের রাজ‍্যে কিন্তু ওমিক্রনের থেকে ডেল্টা প্রজাতির সংক্রমণের সমস‍্যা অনেক বেশী। আর এই সমস‍্যার উদ্ভব যেমন উৎসব ও উদ্দাম আনন্দের মুক্ত-মিলনের কারনে গতি পেয়েছে, তেমনি নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডও এই বৃদ্ধির জন‍্য দায়ী। প্রশাসন রাজনৈতিক কর্মকান্ড পুরোপুরি বজায় রাখছে! রাস্থায় বেরিয়ে মানুষের কোভিডবিধি না মানার জন‍্য শাস্তির বিধানের প্রয়োগ ত বিশেষ করছেই না; পরন্তু প্রশাসনের মানষজনের মধ‍্যেও সামাজিক দূরত্ব না-মানা, থুতনি-মাস্ক পড়ে অফিসে কাজ করা – এইসব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা কথা সবাইকে জানানো হচ্ছেনা যে WHO জানিয়েছে, ওমিক্রণ একটি অতি সাধারন সংক্রমণ। এতে সরাসরি মৃত‍্যু হয় না (আগের একটি লেখায় তা বিশদে আলোচিত করা হয়েছে)। কিন্তু আমাদের রাজ‍্যে ত বাড়ছে করোনার সবচেয়ে ভয়াবহ ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ।
প্রশাসনের আরেকটি ব‍্যর্থতার জায়গা অবশ‍্যই সব পানশালাসহ হোটেল, রেস্টুরেন্ট খুলে রাখা। ৫০% বুকিং-এর কথা বলা হলেও তার সঠিক পর্যবেক্ষণ ও স্টেপ নেওয়ার পরিকাঠামো রাজ‍্যসরকারের আছে কি? রাত বারোটায় উত্তর কোলকাতার যে রেস্তোরাঁ খুলে রাখা হয়েছিল এবং খাবার নিয়ে বচসার জেরে রেস্তোরাঁর লোকজনের হাতে খদ্দেরদের শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার পর সেই রেস্তেরাঁর ঘটনায় কজন কি শাস্তি পেল তা কেউ জানে না। এ সব ঘটনা প্রশাসনের নিয়ম পালন করার নির্দেশকে বিদ্রুপ করে। আবার এই উৎসবের হাইপ তুলে বছরের শেষে মদের দোকান থেকে রেকর্ড পরিমাণ শুল্ক আদায় হলেও তার পরোক্ষ প্রভাব করোনা সংক্রমণের সংখ‍্যাবৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সুতরাং শুধু ইংল‍্যান্ড থেকে আসা উড়ানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা মনেহয় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হয়ে গেল। এভাবে করোনার সঙ্গেলড়াইয়ে এঁটে ওঠা যাবেনা। যদি সাধারণ মানুষকে কোভিডবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করাতে বাধ‍্য করা না যায়, প্রশাসনের সেই ব‍্যর্থতার দায় কিন্তু ভুগতে হবে আমাদের সবাইকে – মূর্খস‍্য লাঠৌষধি।
আরেকটি কথা। রাজনৈতিক কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন উৎসব চলতেই পারে। কিন্তু এই নিউ নর্মাল সময়ে তা নর্মালভাবে করা যাবে না। এই সহজ সরল কথাটা রাজনৈতিক নেতাদের বোঝা উচিৎ। রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনারের উচিৎ এখুনি পুরনির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। একটা কথা মনে পড়ল। সৌরভ গাঙ্গুলীর করোনা হয়েছে বলে সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি প্রধান খবর হিসেবে রিপোর্ট করেছে। অথচ, তাঁর ভাইরাল লোড মাত্র সাড়ে উনিশ! করোন হলেও তা মার্জিনাল। শুধু এর জন‍্য সাধারণ মানুষজন কেউই হাসপাতালে ভর্তি হবেন না। অথচ জনসাধারনের মধ‍্যে করোনার বিপুল সংক্রমণ নিয়ে বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির কোন সদর্থক সংবাদ চোখে পড়ে না। অর্থাৎ, আমাদের দেশের গণতন্ত্রে সব মানুষ সমান হলেও কিছু মানুষের অবস্থান বিশেষে তারা উপরে! একই রকমভাবে প্রশাসন, বিচার-ব‍্যবস্থা ও সংবাদ-মাধ‍্যম যদি দেশের সব মানুষের ভালোর জন‍্য ভাবত, তবে হয়ত আজ এমন অবস্থা হত না। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। কোন অনুপ্রেঢ়ণায় প্রশাসন চলে না। প্রশাসনকে যুক্তি সহকারে আইনের পথে চলতে হয়। বিশেষ কারো ego satisfy করা প্রশাসনের সাজে না। কারন তাদের কাজের দায় পুরোটাই প্রশাসনের – কোন রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীর নয়। আমাদের সংবিধানের এই জায়গাটা বোধহয় শাসক ও শাসনকর্তারা জানেন না। তেমনি সাধারণ মানুষের, বিশেষতঃ বিভিন্ন ছোট ব‍্যবসায়ী ও অন‍্যান‍্য ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের রুজিরোজগার যাতে সচল থাকে তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু প্রশাসনের। সুতরাং ওমিক্রনের কল্পিত ভূতের ভয় না দেখিয়ে করোনার সংক্রমণ বন্ধ করার জন‍্য জনসাধারণকে কোভিড প্রোটোকল সঠিকভাবে মানতে বাধ‍্য করাতে হবে। এটা প্রশাসনের দায়িত্ব। সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে,রাজ‍্যের অর্থনীতি ও প্রান্তিক মানুষজনের রুজিরোজগার যাতে বন্ধ না হয়। সেকাজে ব‍্যর্থ হলে তা প্রশাসনেরই ব‍্যর্থতা। সেক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত প্রশাসন কিনা তা বিচার্য নয়।

Dakshineswar Temple – Saga of
Hindu Religious Renaissance

Dakshineswar temple is the most revered Kali temple of Bengal. Ma Kali, in her different image and attitude, is the most revered goddess of the country – particularly in eastern part of India, three states namely Bengal, Assam and Tripura. Actualy, Dakshineswar Kali temple is only second to Kamakhya Kali temple in reverence. Kamakhya Kali temple goddess is Tantrik Kali where sacrifice of animal blood is must. Whereas Dakshineswar Kali is known as Ma Bhabatarini – a form of Adyashakti Kali Mata – Ma is standing over Shiva, her consort. Therefore, following our hindu custom, Ma is ashamed of standing on her husband and consequently she being ashamed, opens her mouth and holds her tongue with her teeth. Adyashakti is the primordial energy-consciousness-bliss, she is the creator of the universe and liberates jivia from the clutches of Maya. The amazing fact of the idol is that, the face of Ma Kali is so calm and soothing that it seems to be our mother – own family. There is also a striking difference between Dakshineswar Bhabatarini with Kamakhya and Tripureswari temples – that is, the puja at Dakshineswar is performed with complete vegetarian voga consisting of sweets, fruits and vegetables. But in other two Shaktipeeths the voga must contain animal bloods! Only from 2019, the sacrifice of animals become prohibited at Tripureswari – Ma Kali is a form of Ma Chandi here. There is another peculiarity in Tripureswari temple. There are two idols in the garbha griha – one is of 5 feet height and the other one is of 2 feet only – known as Chhotoma. So, among the three most famous Shakti peeths of three states, Dakshineswar temple stands alone with its idol and style of puja rituals. Ma Bhabatarini is like a lady of our home – so, the Sahajia way of Kali puja, adopted by its legendary chief priest Sri Ramkrishnadev, is different from the style of rituals at the other two Shakti peeths.
Dakshineswar temple was built like navaratna, a typical Bengal style of temple architecture. There is a large roof over the temple with four spires at the four corners of the roof. It is followed by a smaller roof over it where four corners of this roof also have four spires. At the middle of this roof is the biggest spire. The two roofs are in such angles that all nine spires can be seen from any place. Altogether, there are nine spires.
Dakshineswar temple has an interesting history. Rani Rashmoni, an intelligent, philanthropist bengali widow, who was in-charge of his husband’s zamindary, was set to sail to Kashi for Ma Kali’s ‘darshan’ in 1847. But in the night before her scheduled pilgrimage, Rani dreamt of Divine Mother goddess Kali who adviced her not to go to Kashi, instead, Rani should make a temple of Ma Kali at the bank of river ganges and should arrange her worship there. Divine mother also told her in the dream that she will manifest her image in the idol of the temple.
Profoundly influenced by the dream, the spirited lady Rani Rashmoni, who was not only a devoted benevolent zaminder and pious widow, but also a shrewd administrator, immediately started searching the suitable land for the construction of the temple. She bought 20 acres of land at the bank of river ganges from James Hasty, an Englishman. The land resembled the hump of a tortoise. The total temple area is of 60 bighas though,in the record book of the Trustee Board of the temple, it is 54.5 bighas. A portion of the purchased land was an abundoned muslim burial ground. As per records, the total cost of the land was 42 thousand and 500 rupees. According to the record book, some portion of the temple land was donated for the construction of Vivekananda bridge over the river ganges. Accordingly, present temple land is of 58 bighas. The construction of the temple building started in1847 and was completed in 1855. The idol was installed on Snan Yatra day, 31st May, 1855. The main navaratna temple was of 14 square meter area and 30 meter high. The idol was placed in the Garbha Griha (sanctum sanctorium) on a thousand petaled lotus throne made of silver. The idol is south facing. Apart from this main temple, within the temple premises, there are a series of 12 identical Shiva temple in a single line at the river side. Each of these temples are painted white and the black Shiva lingas made of stone are placed inside. All the Shiva temples are east facing and are in ‘aat chala’ architecture – a typical bengal way. The Shiva temples are equally divided by a river bank. At the north-east of the temple premises, there was a Vishnu temple (popularly known as Radha-Krishna temple). 550 mm idol of Krishna and 410 mm idol of Radha were placed on a silver throne in the sanctum sanctorium. It was repaired later and ultimately replaced by the present Devottar estate in 1930.
Dakshineswar temple was opened on the Snan Yatra day of Sri Jagannathji in 1955. The first chief priest of the temple was Ramkumar Chattopadyay and his younger brother Gadadhar as his assistant.
Rani Rashmoni was a spirited patriotic lady. Because of her impartial governance, she annoyed many including the high-ups of East India Company officials. When the inauguration day was approaching, the Brahmin Samaj objected to Rani’s ownership of the temple of goddess Kali! They cited two reasons for objection. First, Rani being widow of low caste Mahishya and married to a further lower caste – dhobi community -, cannot own the temple ; secondly, Rani’s order of opening the temple to people of all castes with equal rights, that is, any hindu can offer puja to the goddess Kali in the temple. Rani with her indomitable energy and indefatigable industry, managed to retrieve the situation to a large extent. The Brahmins relented when Rani made the chief priest from a high caste Brahmin and she declared that she should not have any role in the affairs of the temple. A Trustee Board was made to run the temple administration choosing its members from Brahmin caste. For the maintenance of the temple, Rani donated the earnings from her newly acquired zamindary of Dinajpur (now in Bangladesh) to the temple Trust. Rani completed the registration of the Board of Temple Trust on 18th February,1861 and conspicuously she died on the next day. The head priest Ramkumar Chattopadhyay died about one year after assuming the charge of head priest of the temple. After the death of Ramkumar, Rani Rashmoni had chosen the young Gadadhar – famous in the name Ramkrishna – as head priest. The Brahmins again opposed it strongly. Their main opposition was the way Ramkrishna mingled with and allowed the lower caste people of the society and his way of simplicity in performing the puja. This time, they also tried to destroy the temple property and even attempted do harm, to the extent of physical assault to Ramkrishna. Opposition to the appointment of Ramkrishna was not only from Brahmin Samaj, but also from the family of Rani. At this point of time, with her administrative acumen and outrageous courage, Rani overcame these obstacles and went ahead with the appointment of Ramkrishna Chattopadyay alias Gadadhar as Chief priest of Dakshineswar Bhabatarini temple. In this venture, Rani was ably assisted by one of her sons-in-law Mathurbabu. Afterwards, with his immense help, Rani was able to make the Board of Trustee of the temple registered just before her death.
After the death of Rani Rashmoni, the name of the Bhabatarini temple of Dakshineswar became immensely popular with the people including so called high society of Bengal. The fame and carishma of Bhabatarini and her priest son Ramkrishna became known to not only the people of bengal, but also of whole India. The credit was completely of Gadadhar, now famous in the name Ramkrishna. After some years, Ramkrishna became Kalpataru to his desciples on1st January. From then, he became Sri Ramkrishna Parmhansha (supreme knowledgeable) to his followers. Ramkrishna may not have much formal education, but his way of puja to Bhabatarini and his embracing everyone, without considering caste and social status, made everyone feel oneness with him and at the same time, Ma Kali, in the form of Ma Bhabatarini became mother of everyone’s house. Hindus began to feel that Ma is the protector of everyone. Devoid of hard rituals and tantrik way of puja offerings with fresh blood, Ramkrishnadev made the Sahajia way of puja. He was a philosopher of highest order and he preached the philosophy of equality and offering love and respect to the god from the core of the heart. All his basic principles were preached by his most illustrious desciple Swami Vivekananda. Ramkrishnadev stayed in a small room at a corner of the temple premises with his wife Saradamoni Devi. Saradamoni propagated her husband’s philosophy of love and respect to everyone including animals and trees. It made her known as Ma (mother of all lives). After the death of Saradamoni, their room inside the temple became a place of pilgrimage.
The philosophy of Sri Ramkrishna was propagated by his desciples, the most prominent among them is Narendranath Datta, known as Swami Vivekananda – his post sanyash name. Vivekananda and other desciples of Sri Ramkrishna reffered him as Thakur (god) and Saradamoni as Ma. Actually, the philosophy of love for all, along with treating Ma Bhabatarini as the lady if our own fanily – attracted people’s mind most. This made the Dakshineswar Kali temple most famous shaktipeeth of bengal.
The temple of Ma Bhabatarini of Dakshineswar is still run by the Trustee Board. It has no legal attachment with Ramkrishna Mission of Belur. At present, managing trustee is Sri Kushal Chakraborty. Special puja are offered every year on three special days; the inception day of the temple, that is Snan Yatra day, in the night of amabashya day after Durga puja, and Kalpataru day.

(Author is a retired Professor and former Director & Consultant of West Bengal Biotech Development Corporation)

ভারতীয় চিকিৎসার গৌরব ফিরিয়ে আনা জরুরী

আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হতে আর কয়েকমাস বাকি। এই সুদীর্ঘ সময়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ অনেক বিষয়ে দেশ যেমন উন্নতি করেছে, তেমনই অনেক বিষয়ে অবহেলাজনিত কারনে এবং আরো কয়েকটি অনুঘটকের নিমিত্ত পিছিয়ে পড়েছে। এমনি একটি পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা হল চিকিৎসা ও স্বাস্থ‍্য। একবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের চিকিৎসা মৌলিক অধিকার হওয়া উচিৎ। বিভিন্ন সরকার এবং রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে সেকথা বারংবার উল্লেখ করলেও তা অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হিসেবেই রয়ে গেছে। আমাদের রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্যসাথী প্রকল্পের প্রচার যত, কার্যকারিতা তার শতাংশের একাংশও নয়।
এর কারন হিসেবে কয়েকটি প্রায় অনালোচিত বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমতঃ আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসা ব‍্যবস্থা পাশ্চাত‍্যের থেকে নেওয়া। আর বিভিন্ন ওষুধ হয় বিদেশী লাইসেন্সে এদেশে তৈরী করি অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশীয় সংস্থা তার বিপণন করে। সাম্প্রতিক করোনা ভ‍্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ‍্য। এইসব বিদেশী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার লাভের পরিমাণ সম্পর্কে আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে। যে ওষুধটি বানাতে ১ টাকা খরচ হয়, সেই ওষুধের এমআরপি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। এই ওষুধ কোম্পানীগুলি অসীম শক্তিধর। এদের নেটওয়ার্ক সারা পৃথিবীতে, এমনকি আমাদের দেশেও ছড়িয়ে আছে। এদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত আছে আমেরিকার FDAর। FDAএর ছাড়পত্র না পেলে বিশ্বজুড়ে কোন ওষুধ বিক্রির ক্ষমতা কারো নেই। এমনকি WHO অব্দি FDAকে সমীহ করে চলে। করোনার ভ‍্যাকসিনের ক্ষেত্রেও সব ভ‍্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থাকে FDAর ছাড়পত্র নিতে হয়েছে। এই FDA বিভিন্ন অজুহাতে, কখনো কখনো অযৌক্তিকভাবে তাদের দেশীয় কোম্পানীর অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত পড়তে পারে এমন ওষুধের অনুমোদন দেয় না। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি চিকিৎসার নামে উন্নত দেশগুলির ওষুধ কোম্পানীগুলির শোষণের শিকার। চীন সরকার তাদের দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ও দেশীয় ওষুধগুলিকে মাণ‍্যতা দিয়ে FDAর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছুঁড়ে দিয়েছে। আমাদের বিপুল জনসংখ‍্যার দেশ ভারত যদি সেই পথে শক্ত হাতে রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে এগোয় তাহলে আমাদের দেশেও চিকিৎসা অনেক সুলভ হতে বাধ‍্য।
আমাদের দেশের অনেক মানুষই জানেন না যে, প্রাচীন কাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পযর্ন্ত আমাদের দেশের চিকিৎসা ব‍্যবস্থা পৃথিবীতে সেরা ছিল। সুশ্রুত-সংহিতার রচয়িতা সুশ্রুতকে সারা পৃথিবী সার্জারী – বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারীর জনক হিসেবে মাণ‍্যতা দেয়। মনে রাখতে হবে, সুশ্রুত ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মারা যান। তাঁর লেখা সুশ্রুত-সংহিতার সংকলন নেপালের কাইজার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এটি ১২-১৩ শতাব্দীতে তালপাতার পুঁথিতে সংকলিত। সুশ্রুত-সংহিতায় সার্জারীর যে বিভাগগুলির কথা বলা হয়েছে তা আজও সার্জারীর মূল কথা। তিনি reconstruction ও প্লাস্টিক সার্জারীর কথা লিখতে গিয়ে ৩০০ রকম বিভিন্ন প্রকারের সার্জারীর বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর ১২০ রকম সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের ছবি দেখলে এখনকার ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে অনেক সাযুজ‍্য লক্ষ‍্য করা যায়। তিনি সে যুগে সার্জারী করার সময় অ‍্যানাস্থেশিয়া ব‍্যবহার করতেন – মদ ও ভেষজ henbane ব‍্যবহারের উল্লেখ আছে। তিনি rhinoplasty (কাটা নাক জোড়া দেওয়া), autoplasty (ছেঁড়া কান জোড়া দেওয়া), ছানি অপারেশান ইত‍্যাদি করতেন। কিডনীর পাথর বের করবার শল‍্য চিকিৎসার উল্লেখও তাঁর সুশ্রুত-সংহিতায় পাওয়া যায়। এখনকার আধুনিক শল‍্য চিকিৎসার অনেক কিছুই সুশ্রুত-সংহিতায় পাওয়া যায় – যেমন, রক্তধাতু সঞ্চালন, হৃৎসুলা (heart pain), মধুমেহ ও স্থুলতা, কুষ্ঠ এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত চিকিৎসা।
এরপর আসি পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া চরকের কথায়। চরক কাশ্মীর উপত‍্যকার মানুষ ছিলেন। চরক-সংহিতার রচনাকাল হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর সময়কালকে মাণ‍্যতা দেওয়া হয়েছে। অথচ, খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চরকের চিকিৎসার উল্ল্কেখ পাওয়া যায়। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোন কারন নেই। স্থানীয় ভাষায় ‘চরক’ শব্দের অর্থ হল ‘ভ্রাম‍্যমান চিকিৎসক’। এখানে আরেকটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন – চরক-সংহিতা, যা চরকের রচনা বলে মনে করা হচ্ছে, তার রচনাকাল দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ‍্যে হলেও সেটি একাধিক মানুষের দ্বারা – বিস্তৃত সময়কাল ধরে অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের রচনা হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গ। অভিজ্ঞতার নিরিখে কোন বিষয়কে লিপিবদ্ধ করে বিভিন্ন প্রবুদ্ধজনের জ্ঞানে সম্বৃদ্ধ প্রায় সবকটি প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ। চরক-সংহিতা এর ব‍্যতিক্রম নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় চিকিৎসার গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফসল হল সুশ্রুত-সংহিতা এবং চরক-সংহিতা। যে কারনে বেদের যুগেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ভারতীয় চিকিৎসার পরম্পরাই হল আয়ুর্বেদ।
চরক-সংহিতার মোট ৮টি বইয়ের মধ‍্যে ১২০টি অধ‍্যায় আছে – যার মধ‍্যে শেষ দুটি বই দৃধবলা সংযোজিত। এগুলিতে চিকিৎসা-দর্শন, স্বাস্থ‍্যকর অভ‍্যাসে রোগ প্রতিরোধ থেকে নিয়ে প‍্যাথলজি, অ‍্যানাটমী, এমব্রায়োলজি, থেরাপিউটিক্স, ফার্মাসিউটিক্স ও টক্সিকোলজি যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি চিকিৎসকদের ট্রেণিং, চিকিৎসার এথিক্স ইত‍্যাদি বিষয়ে বিশদে আলোচিত হয়েছে। এই বইগুলি এবং তাদের অধ‍্যায় বিভাজন ও বিন‍্যাস দেখলে বোঝা যায় যে, ভারতীয় আয়ুর্বেদের আধুনিক রূপ হল অ‍্যালোপ‍্যাথি।
তাহলে আজকে আধুনিক চিকিৎসায় অ‍্যালোপ‍্যাথি আদৃত হলেও আয়ুর্বেদ অবহেলিত কেন? এর কারন জানতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে অ‍্যালোপ‍্যাথািক ওষুধের পার্থক‍্য কেন এবং কোথায়। একটি কথা সকলের মনে রাখা দরকার যে, শরীরবিদ‍্যা – physiology ও anatomy আয়ুর্বেদ ও অ‍্যালোপ‍্যাথি দুইয়েই এক ; যেজন‍্য সার্জারীতে সুশ্রুতের ব‍্যবহৃত সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে বর্তমান সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের অনেক মিল পাওয়া যায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে চিকিৎসা বিজ্ঞান একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে নতুন ও উন্নততর উদ্ভাবনী এখানে সতত বহমান। পাথমিকভাবে প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতিতে ওষুধ হিসেবে সবচেয়ে বেশী ব‍্যবহার করা হত বিভিন্ন গাছগাছড়ার মূল ও অন‍্যান‍্য অংশ। এটি শুধু আয়ুর্বেদ নয়, অ‍্যালোপ‍্যাথির ক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য। যেমন, নয়নতারা গাছের মূলকে আয়ুর্বেদে প্রাচীন সময় থেকেই কয়েক প্রকারের ক‍্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হত। এই গাছের মূলে ভিনব্লাস্টিন ও ভিনক্রিস্টিন নামের দই প্রকারের অ‍্যালকালয়েড থাকে যারা এখন অ‍্যালোপ‍্যাথিতে ক‍্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয়। আধুনিক অ‍্যালোপ‍্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিশেষ যৌগগুলিকে পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ করা হয়েছে। এমনকি এই যৌগগুলি কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ একটি অবশ‍্য পালনীয় কর্তব‍্য। কারন, এই গাছের মূলে উল্লেখিত যৌগগুলি ছাড়াও এমন অনেক যৌগ থাকে যেগুলি ক‍্যান্সার সারানোর পরিবর্তে তার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় – যেমন ভিন্ডোলিন জাতীয় যৌগ। এই যৌগটিও নয়নতারা গাছের মূলে থাকায় পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ ওষুধ প্রস্তুত করার একটি অতি প্রয়োজনীয় পর্যায়। উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে আয়ুর্বেদকে হেয় করার জন‍্য আয়ুর্বেদীয় ওষুধের ক্ষেত্রে আধুনিক পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ পদ্ধতির অভাবের জন‍্য এই চিকিৎসা পদ্ধতিকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। আয়ুর্বেদ একটি উদ্দেশ‍্যমূলক অপপ্রচারের শিকার। আয়ুর্বেদ এই পদ্ধতি স্বীকার করে – কারন আয়ুর্বেদেও টক্সিকোলজির বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এই নয়নতারা গাছই যেমন বিষাক্ত। সেজন‍্য সমস্ত আয়ুর্বেদ ওষুধই যথার্থ শোধন করা হয় – প্রাচীন শোধন প্রক্রিয়াই আধুনিক পৃথকীকরণ ও শুদ্ধিকরণ। কারন, প্রাচীন আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুতিতে বর্তমান অ‍্যালোপ‍্যাথির ফাইটোমেডিসিন তৈরীর জন‍্য ব‍্যবহৃত সক্সলেট, রিটর্ট ও ক্রোমাটোগ্রাফীর বিভিন্ন ছবি প্রাচীন আয়ুর্বেদের বইগুলিতে পাওয়া যায়। সুতরাং, প্রাচীনকালের ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার স্বাভাবিক ও সময়োপযোগী রূপান্তরই হল বর্তমানের অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসা।
আয়ুর্বেদের বর্তমান অবহেলার কারন খুঁজতে গেলে দেখা যায় তা চিকিৎসাবিজ্ঞানজনিত নয় – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারনে। ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার সুনাম দ্বাদশ শতাব্দী অবধি অক্ষুন্ন ছিল। বহির্বিশ্বের যবন আক্রমণের সময় থেকেই ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পের যে দ্রুত অবক্ষয় শুরু হল, তার ঢেউ এসে লাগল চিকিৎসায়। নতুন যবন শাসকদল দেশের মানুষের চিকিৎসার ব‍্যপারে উদাসীন ত ছিলই, পরন্তু তারা আয়ুর্বেদ নয়, ইউনানী চিকিৎসার উপর নির্ভর করত। এই সময় চিকিৎসা সম্পর্কিত বহু পুঁথি ও নথিপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা ভারতের শাসনভার নেওয়ার পরে ভারতীয় এই চিকিৎসাবিদ‍্যাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেনি। কিছু ক্ষেত্রে এর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিজেদের চিকিৎসাশাস্ত্রে (যা এখন অ‍্যালোপ‍্যাথি নামে পরিচিত) ব‍্যবহার করেছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার একটি অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ‍্যায় ‘শোধন’ এইভাবে রাজনৈতিক কারনে হারিয়ে যায়। তারপর, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিদেশে – বিশেষতঃ জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপে (সুশ্রুত-সংহিতা আরবী ও ল‍্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল) এই দুটি সংহিতা নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং তার বিস্ময়কর ফল জানার পর ভারত সরকার নড়েচড়ে বসে। কিন্তু এনিয়ে বেশীদূর এগোনো যায়নি। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, বিশ্বের সবচেয়ে বেশী টাকার বাণিজ‍্য করে ওষুধ শিল্প – যার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি উন্নত দেশ। এখানে যদি আয়ুর্বেদশাস্ত্র সম্মত ওষুধ তৈরী ও আধুনিক উপায়ে তার শোধন প্রক্রিয়ার পর আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে এই ওষুধের এফিকেসি পরীক্ষার পর তাকে বাজারে বিক্রির ছাড়পত্র দেওয়া হয় তবে তুলনামূলকভাবে বহুগুণ বেশী দামে বিক্রিত এই আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানীগুলির ওষুধ আর বিক্রিহবেনা – ভারতসহ সারা পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হলেও ঐ ওষুধ কোম্পানীগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সেজন‍্য আমেরিকার FDA আর সেইসঙ্গে WHO ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধকে মাণ‍্যতা দেয়না। অথচ ঐ একই পদার্থ যখন ল‍্যাবোরেটরীতে কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত করে এই ওষুধ কোম্পানীগুলি বাজারে বিক্রি করছে,তার ক্ষেত্রে দ্রুত ছাড়পত্র মিলছে!
এখানে ভারত সরকারের ভূমিকা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও জাপান সরকার তাদের দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরী ওষুধের স্বীকৃতির জন‍্য অনেক লড়াই করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু ভারতের উচ্চমানের স্বীকৃত চিকিৎসাশাস্ত্রের ওষুধ যাতে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায় তার জন‍্য গবেষণার infrastructure গঠন ও তার আধুনিক রূপ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। FDA যাতে ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় ওষুধ, যা অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের চেয়ে উৎকৃষ্ট বা সমমানের – সেইসব কমমূল‍্যের ওষুধকে স্বীকৃতি দেয়, তার জন‍্য সব রকম কুটনৈতিক চাপ দেওয়া প্রয়োজন। দেশ এই কাজে সফল হলে চিকিৎসার খরচ কমবে তাই নয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসায় ভারত আবার বিশ্ব-শ্রেষ্ঠত্বের আসনের দাবীদার হবে।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ জৈবপ্রযুক্তি নিগমের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)।

আয়ুর্বেদশাস্ত্রের উত্তরসূরি অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসা

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা যেমন পৃথিবীর কাছে আমাদের দেশকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে মেলে ধরেছি, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পকলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছি। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষতা প্রাচীন যুগে এতটাই লক্ষণীয় ছিল যে, প্লিনী অনুযোগ করেন – আর্যাবর্ত দেশ তাদের কাছে বড়লোক, রাজারাজরাদের ব‍্যবহারের জন‍্য মূল‍্যবান ও বহু দুর্মূল‍্য সামগ্রী রপ্তানীর মাধ‍্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করছে! আমরা গুপ্তযুগে নির্মিত যে বিশাল লৌহ মিনারটিকে বানিয়েছিলাম – যেটি কুতুব মিনারের বাগানে ফেলে রাখা আছে – প্রায় দেড়হাজার বছর আগের তৈরী হলেও তাতে একটুও মরচে ধরেনি! ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ঢালাই কারখানাগুলি একশ বছর আগেও এমন মিনার বানানোর কথা কল্পনা করতে পারত না। আমাদের দেশের মসলিন কাপড় বানানোর শিল্পকে ইংরেজ বণিকের দল পশুসুলভ হিংস্রতায় ধ্বংস করেছে। আবার আমাদের নতুনভাবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
আমরা অনেকেই বলে থাকি, ইউরোপ, আমেরিকা চিকিৎসাবিদ‍্যায়, বিশেষতঃ অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসায় অনেক উন্নত – আমাদের আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র তাদের থেকেই শেখা! এমন একটি myth ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। কিছু ডিগ্রিধারী মূর্খ আমাদের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি – আয়ুর্বেদ সম্পর্কে না জেনে উন্নাসিকতা দেখাতে গিয়ে এমন ধারনা ব‍্যক্ত করেন। আমরা যখন কোলকাতার ট্রপিক‍্যাল মেডিসিনে ক্লাস করতাম, তখন রিজেনারেটিভ মেডিসিনের একজন প্রফেসার ক্লাসে প্রায়শঃ বলতেন, আধুনিক অ‍্যালোপ‍্যাথি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মধ‍্যে প্রভূত মিল আছে। তিনি আরো বলতেন, সার্জারী এবং অ‍্যনাটমীর ক্ষেত্রে দুটোই এক। তিনি অবশ‍্য ইউনানী ও হোমিওপ্যাথিকে বিদ্রুপ করতেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিভাবে আমাদের দেশে উৎকর্ষতা লাভ করে এবং আয়ুর্বেদ থেকেই অ‍্যালোপ‍্যাথি চিকিৎসার উৎপত্তি হল বলছি কেন তার বিস্তারিত আলোচনায়। ভারতীয় সভ‍্যতার আদি জ্ঞানভান্ডার হল বেদ। ঋগ্বেদ থেকে আমরা প্রথম জানতে পারি চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা ধন‍্যন্তরীর কথা। অথর্ববেদে সার্জারীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। Xenotransplantation (পশুর অঙ্গ মানুষের দেহে সংস্থাপন) এর প্রয়োগ করেছিলেন স্বয়ং ধন‍্যন্তরী অর্থাৎ বিষ্ণু (ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী)। ভগবান গণপতি এই প্রতিস্থাপনের প্রথম সফল প্রয়োগ।
অর্ধশিক্ষিত মূর্খরা যুক্তিজাল বিস্তার করে বলতেই পারেন – এসব ইতিহাসের প্রামাণ‍্য তথ‍্য নয়। তাদের বলি, পৃথিবীর ইতিহাস শুরু হয়েছে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম বা মহম্মদের মদিনা যাত্রার সময় থেকে কি! ইতিহাস পৃথিবীর জন্মের পর মূহুর্ত থেকে শুরু। কোন উদ্দেশ‍্য প্রণোদিত ইতিহাস কিন্তু ইতিহাস নয়, প্রচারের হ‍্যান্ডবিল। যাদের এসব স্বীকার করতে বাধা আছে তাদের বলি, আধুনিক বিশ্ব পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাকে তিনি হলেন চরক – তাঁকেই আয়ুর্বেদের জনক বলা হয়েছে। তিনি কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘চরক সংহিতা’ চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। চরক সংহিতা প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ‍্যে রচিত। এতে মোট আটটি বই মিলিয়ে ১২০টি অধ‍্যায় আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে চরক সংহিতা কোন একজন মানুষের রচনা নয় – শতাব্দীর পর শতাব্দীব‍্যাপী চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির ফসল। বইগুলির বিষয়ে আরো বিশদে আলোচনা করলে বোঝা যাবে, প্রাচীন আয়ুর্বেদের সঙ্গে বর্তমান অ‍্যালোপ‍্যাথির তত্ত্বের তফাৎ বিশেষ নেই।
এবার বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রাথমিকভাবে দুটি বিভাগ – মেডিসিন ও সার্জারী বা শল‍্য চিকিৎসা। আমরা একাধিক বেদে সার্জারীর উল্লেখ পাই। এই সার্জারীর, বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারীর জনক হিসেবে বিশ্বে যিনি পরিচিত, তিনিও একজন ভারতীয় – সুশ্রুত। প্রামান‍্য নথি থেকে ধারনা করা যায় যে, সুশ্রুতের মৃত‍্যু হয় ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। সুশ্রুতের সুশ্রুত সংহিতায় মোট ১৮৬টি অধ‍্যায় আছে। যেখানে ১১২০ রকমের অসুখ এবং ৭০০ রকমের মেডিক্যাল প্ল‍্যান্ট, ৬৪ রকমের আকরিক উৎসের ও ৫৭ রকমের প্রাণী উৎসজাত ওসুধ তৈরীর বিবরণ বর্নণা করা হয়েছে। তাঁর বইটি মেডিসিন ও সার্জারীর শিক্ষার জন‍্য অত‍্যন্ত মূল‍্যবান। সুশ্রুত সংহিতায় সার্জারীকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হল – ছেদ‍্য (excision), লেখ‍্য (sacrification), ভেদ‍্য (puncture), এস‍্য (exploration), আহর্য (extraction), স্বরায‍্য (evacuation), এবং সিব‍্য (suturing)। শুধু ৬০ রকমের ঘা সারানোর উপকর্মের কথা লিখেছেন। এমনকি তিনি reconstruction ও প্লাস্টিক সার্জারীর কথাও বিশদে লিখেছেন। ৩০০ রকমের বিভিন্ন সার্জারীর কথা তিনি লিখেছেন। ১২০ রকমের সার্জিক‍্যাল ইন্সট্রুমেন্টের কথাও তাঁর বইতে পাওয়া যায়। সুশ্রুত সুষ্ঠুভাবে সার্জারীর জন‍্য অ‍্যনাস্থেসিয়া – মদ, henbane (cannabis indica) প্রয়োগের উল্লেখ করেছেন। তিনি কর্তিত নাকের রোগীয নাকের সার্জারী (rhinoplasty) করতেন। এছাড়া ছেঁড়া কান জোড়া দেওয়া (autoplasty) ও ছানি অপারেশান করতেন। এজন‍্যই তাঁকে প্লাস্টিক সার্জারীর জনক আখ‍্যা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়, সুশ্রুত সংহিতার সংকলন নেপালের কাইজার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এটি ১২-১৩ শতাব্দীতে তালপাতার পুঁথিতে লেখা। এখনকার যে চিকিৎসাগুলি আমরা বিদেশ থেকে ধার করি, সেগুলি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ও শল‍্যচিকিৎসার কথা সুশ্রুত লিখে গেছেন। এর মধ‍্যে আছে রক্তধাতু সঞ্চালন, রসধাতু (lymph), হৃৎসুলা (heart pain), মধুমেহ, স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগের চিকিৎসা। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার কথাও সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত আছে। কিডনীর পাথর বের করার শল‍্য চিকিৎসার কথাও এখানে বলা আছে।
যদিও খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চরকের চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা নিয়ে বিভ্রান্তির কোন কারন নেই। প্রথমতঃ, চরক শব্দের অর্থ ‘ভ্রাম‍্যমান চিকিৎসক’। এখানে আরেকটি কথাও অত‍্যন্ত যুক্তিযুক্ত – চরক সংহিতার প্রকাশকাল দ্বিতীয় শতাব্দীতে হলেও তা একাধিক মানুষদ্বারা গ্রন্থিত। এই ধারা হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন হিন্দু-চিকিৎসাবিদ‍্যা, যা আয়ুর্বেদ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত, তা কোন একজন মানুষের রচনা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গবেষণা ও চিকিৎসাবিদ‍্যার গ্রন্থিত সংকলন। নিঃসন্দেহে এবিষয়ে প্রথম প্রামাণ‍্য রচনা চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। সে কারনেই বেদেও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সুশ্রুতের মৃত‍্যু হয়, পরবর্তীকালে আরো অনেকে সুশ্রুত সংহিতায় অধ‍্যায় সংযোজন করেন। তেমনি আত্রেয় ঋষির তত্ত্বাবধানে অগ্নিবেশ অষ্টম খৃষ্টপূর্বাব্দে অগ্নিবেশ সংহিতা রচনা করেন – যার পূর্ণাঙ্গরূপ দেন চরক। জন্ম হয় চরক সংহিতার। চরক সংহিতায় মোট আটটি বই – ১২০টি অধ‍্যায়। এরমধ‍্যে শেষ দুটি বই – কল্পস্থান ও সিদ্ধিস্থান এবং সর্বমোট ১৭টি অধ‍্যায় দৃধবলা সংযোজন করেন।
চরক সংহিতার বইগুলি ও তার অধ‍্যায়ের কথা জানলে সবাই বুঝতে পারবেন, আমাদের আয়ুর্বেদ আধুনিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছে অ‍্যালোপ‍্যাথিতে। চরক সংহিতার বইগুলি হল –
১) সূত্রস্থান (৩০টি অধ‍্যায়) – আলোচ‍্য বিষয় সাধারণ নীতি, চিকিৎসা দর্শন, স্বাস্থ‍্যকর জীবনযাত্রায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
২) নিদানস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – প‍্যাথোলজি, রোগের কারণ।
৩) বিমনাস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – রোগ নির্দিষ্টকরণ, চিকিৎসকদের ট্রেণিং, নীতিশাস্ত্র (ethics), পথ‍্য ও ওষুধের স্বাদ।
৪) শরীরস্থান (৮টি অধ‍্যায়) – শরীরবিদ‍্যা (anatomy), এমব্রায়োলজি।
৫) ইন্দ্রিয়স্থান (১২টি অধ‍্যায়) – সংবেদনশীল অঙ্গজনিত পূর্বাভাস – বিশেষতঃ রোগীর সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার মাধ‍্যমে সণাক্তকরণ।
৬) চিকিৎসাস্থান (৩০টি অধ‍্যায়) – থেরাপিউটিকস্, রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ।
৭) কল্পস্থান (১২টি অধ‍্যায়) – ওষুধ প্রকরণ বিষয় (pharmaceutics) ও বিষবিদ‍্যা (toxicology)।
৮) সিদ্ধিস্থান (১২টি অধ‍্যায়) – চিকিৎসার উৎকর্ষতা,আরোগ‍্যের লক্ষণ, স্বাস্থ‍্যবিধি সম্মত সুস্থ‍্য জীবনযাত্রা।
এই দুটি সংহিতা বিশদে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা, যাদের অধিকাংশ ইউরোপ, আমেরিকার, অবাক বিস্ময়ে আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিকধারার প্রাচীন ভারতের এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে বর্তমানের অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের মিল-অমিল বিষয়ে। এ ব‍্যপারে প্রথমেই বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে আয়ুর্বেদিক ওষুধের উপকারীতা আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান অস্বীকার করে না। অল্প কিছু উদাহরণে ব‍্যপারটা পরিষ্কার হবে। অশ্বগন্ধার (withania somnifera) মূল-এ ক্লান্তি, বেশ কিছু চর্মরোগ, মধুমেহ, গেঁটে বাত (rheumatic arthritis) এবং বেশ কিছু পেটের রোগসহ কয়েকপ্রকারের ক‍্যান্সারের উপশম হয়। সর্পগন্ধা (raulfia serpentina) উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্তে রাখে। নয়নতারা (canthranthus roseus) এখনো ক‍্যান্সারের চিকিৎসায় সারা বিশ্বে ব‍্যবহার করা হয়। এতে ভিনব্লাস্টিন ও ভিনক্রিস্টিন অ‍্যালকালয়েড পাওয়া যায় – এই দুটি অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহৃত হচ্ছে। আবার নয়নতারা গাছের মূলসহ সমস্ত গাছেরই বিষক্রিয়া আছে। অশোধিত মূলে এমন অ‍্যালকালয়েড পাওয়া যায়, যেমন ভিনডোলিন, যা ক‍্যান্সার কোষের বৃদ্ধির সহায়ক। প্রায় সব আয়ুর্বেদিক ওষুধের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ‍্য। সে কারনে গাছের কোন অংশকে সরাসরি ওষুধ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয় না। আয়ুর্বেদে তার জন‍্য উপযুক্ত ‘শোধন’ এর নিদান দেওয়া আছে। তাকে আধুনিক চিকিৎসার পরিভাষায় isolation and purification বলে। এখানেই যত গোলমালের সুযোগ। এই শোধনক্রিয়ার কথা কিন্তু কোথাও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা নেই। এর একমাত্র কারণ, ইচ্ছাকৃতভাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ওষুধের বিলুপ্তি ঘটানোর চেষ্টা। আমরা যেসব ওষুধ প্রস্তুতির প্রাচীন ছবি দেখি সেখানে রিটর্ট ও সক্সলেট জাতীয় যন্ত্রপাতি, যা আধুনিক সময়ে ওষুধের isolation and purification এ ব‍্যবহার করা হয়, সেসবের উপস্থিতির প্রমাণ পাই। সুতরাং এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে এসবের সাহায‍্যে এবং ক্রোমাটোগ্রাফির বিভিন্ন পদ্ধতি ব‍্যবহার করে ওষুধের শোধন করা হত। এতে প্রমাণ হয় যে, প্রাচীনকালে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি আজকের তথাকথিত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের উৎকর্ষতায় মোটেও পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু এত উন্নত ও সফল চিকিৎসা পদ্ধতি তার শ্রেষ্ঠত্ব হারালো কেন!
এর যথাযথ উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে। ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা, যা তখন একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ছিল, তার সুনাম দ্বাদশ শতাব্দী পযর্ন্ত অমলিন ছিল। কিন্তু তারপর, যবন আক্রমণের সময় থেকে এদেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প সম্বৃদ্ধির অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। যবন আগ্রাসনের সময় থেকে তাদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক প্রভাব চিকিৎসাবিদ‍্যার উপরেও আঘাত হানল। নতুন যবন শাসককুল আয়ুর্বেদের পৃষ্ঠপোষকতা দুরস্ত, তার ধ্বংসসাধনে ব্রতী হল। তারা আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বদলে ইউনানি চিকিৎসায় বিশ্বাস করত। তারা নিজেদের কথাই ভাবত। দেশের মানুষের স্বাস্থ‍্য সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনার কথা জানা যায়না। এই সময় বিস্তর দুর্মূল‍্য পুঁথি ও নথি নষ্ট করে ফেলা হয়। আমার মনে হয়, ঐ সময়ই আয়ুর্বেদ চিকিৎসার নথি – বিশেষতঃ শোধনক্রিয়ার বিভিন্ন কলাকৌশল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর ইরেজ বণিকের দল দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদেরও দেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার কোন চেষ্টা ছিলনা। তার কারণ তাদের উন্নাসিকতা। তারা তাদের শিক্ষা থেকে চিকিৎসা – সব ক্ষেত্রেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকত।
দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং তারপরে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আয়ুর্বেদশাস্ত্র নিয়ে বিদেশে চর্চা শুরু হলে তখন আমাদের দেশের সরকারের টনক নড়ে। আবার সেখানেও গন্ডগোল। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টাকার বাণিজ্য করে ওষুধ-শিল্প। সুতরাং নথির ভিত্তিতে আয়ুর্বেদকে মান‍্যতা দিতে বাধ‍্য হলেও পাশ্চাত‍্য-দুনিয়া তার ওষুধ শিল্পকে মান‍্যতা দেয়না। তাদের অস্ত্র হল ঐ isolation and purification অর্থাৎ শোধন। আয়ুর্বেদ ওষুধের এই অপূর্ণতাকে আশ্রয় করেই পাশ্চাত‍্যের ওষুধশিল্প তাদের লাভের ব‍্যবসায় আয়ুর্বেদকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছেনা। এ ব‍্যপারে অগ্রণী হল ওষুধ শিল্পের আন্তর্জাতিক কন্ট্রোলার আমেরিকার FDA. এই FDAর বিরুদ্ধে একাধিকবার সফল লড়াইয়ের ইতিহাস আছে একমাত্র জাপানের। সেজন‍্য FDA শুধু তাদেরকেই সমীহ করে।
এখন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে যথাযথ নজর দেওয়া আয়ুর্বেদ রিসার্চ ও শোধনে সাম্প্রতিকতম পদ্ধতি অবলম্বন করা, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে drug efficacy পরীক্ষা করা এবং তার অনুমোদন ও বাজারে আনা – এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক ডাক্তারীশাস্ত্রে এই আয়ুর্বেদীয় ওষুধের সংযোজন এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর গুণাগুণ পরীক্ষা করে তা যে অ‍্যালোপ‍্যাথিক ওষুধের সমতুল বা উৎকৃষ্টতর তার প্রমাণ রাখার জন‍্য যথার্থ পরীক্ষা নিরীক্ষার ব‍্যবস্থা করার প্রয়োজন। তারপর কুটনৈতিকভাবে সরকারকে FDAর উপর চাপ তৈরী করতে হবে এই ভারতীয় পেটেন্টের আয়ুর্বেদীয় ওষুধকে স্বীকৃতি প্রদানের জন‍্য। আর হ‍্যাঁ, সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিদেশের দালাল ও অর্ধশিক্ষিত ‘বিশেষজ্ঞ’দের থেকে দূরে থেকে এই মিশনকে সাফল‍্যমন্ডিত করতে হবে। দেশ এ কাজে সফল হলে বিশ্বের দরবারে ভারত আবার চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে “শ্রেষ্ঠ আসন লবে”।

                                     ( লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ‍্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গ জৈবপ্রযুক্তি উন্নয়ণ নিগমের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)

ভারতীয় গণতন্ত্র সোনার পাথরবাটি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ এমন একটি কথা যার অসংখ‍্য সংজ্ঞার মধ‍্যে কোন বিশেষ একটি সর্বজনগ্রাহ‍্য সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। এ যুগের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী শোনা যায় ‘গণতন্ত্র’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এই দুটি কথা। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে আগে একাধিক লেখায় আলোচনা করেছি যে, কোরান ও বাইবেল মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতা মোটেই ভালোকথা নয়। কোন ধর্মপ্রান মুসলমান বা খ্রীষ্টান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে প্রায় সমস্ত ইসলামী ও খ্রীষ্টান রাজনীতিক নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেন এবং তা প্রমাণ করার জন‍্য প্রণান্তকর প্রচেষ্টা চালান। এখানেই আমাদের রাজ‍্যের তথা দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট‍্য! ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের ট্রেণিংয়ের গোড়ার কথা – “যা ভাববে তা বলবেনা, যা বলবে তা করবেনা, যা করবে তা বলবেনা আর কাউকে কোন অবস্থায় না বলবেনা” – এটি জানিনা ফরেন সার্ভিসে কতটা প্রযোজ‍্য, তবে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে শতকরা একশ ভাগ প্রযোজ‍্য।
ভারতীয় গণতন্ত্র তার সংবিধান অনুসারে চলার কথা। আবার আমাদের সংবিধানের অবস্থা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাউলদের পোষাকের মত – তালিতাপ্পার মহিমায় আহল পোষাকের রূপ ও গুণের কিছুই আর বোঝা যায় না। তেমনি সংশোধনের পর সংশোধনে আমাদের সংবিধানের আসল চেহারাটাই হারিয়ে গেছে। তবু সব রাজনৈতিক নেতাই এদেশের গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করে। এমনকি সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশীয় কম‍্যুনিষ্টরা পর্যন্ত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছে! অবশ‍্য এ বিষয়ে তাদের অনেকের ‘আদর্শগত পিতা’ চীনের একনায়ক জি জিনপিংও সম্প্রতি চীনকে জনগণের গণতন্ত্রের (people’s democracy) দেশ বলেছেন। এখন এই গণতন্ত্রের রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজতন্ত্র থেকে পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র থেকে পলিটব‍্যুরোর কন্ট্রোলে থাকা রাষ্ট্র – এমনকি জেহাদী তালিবানরাও তাদের নিজেদেরকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবী করছে!
এবার এসবের কারন বিশ্লেষণ করা যাক। গণতন্ত্রের বিদ্রুপাত্মক সংজ্ঞা ছাড়া আর যত রকম সংজ্ঞা আছে, তার সবকটিতেই শাসন ক্ষমতায় মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলা আছে। যেহেতু একটি দেশের সকল মানুষের পক্ষে দেশের শাসনব‍্যবস্থায় সরাসরি অংশ নেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তারা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন এবং সেই প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে সরাসরি দেশের শাসনব‍্যবস্থায় অংশ নেবেন। এখানেই লুকিয়ে আছে অশান্তি, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী স্বার্থে ‘ভোটদান’ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করার বীজ। এভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন চালানোই এখন আধুনিক গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রে পরিষ্কারভাবে minority representation এর কথা বলা থাকলেও আমাদের দেশে তার কোন প্রয়োগ নেই – সব মানুষের
পছন্দকে মাণ‍্যতা দেওয়ার পদ্ধতি গণতন্ত্রের অঙ্গ। কিন্তু আমাদের দেশে ভোটের ময়দানে কেউ ৫০.১% ভোট পেলেই বিজয়ী হয়; অন‍্য কেউ ৪৯.৯% ভোট পেলেও পরাজিত। আবার ভোটে অনেক প্রার্থী থাকলে কেউ ২০ – ৩০% মাত্র ভোট পেলেও বিজয়ী হতে পারে। ফলে, দেশের মানুষের ভোটের সঠিক ও গণতান্ত্রিক মূল‍্যায়ণ হয় না। এর ফলশ্রুতিতে আমরা ভোট জালিয়াতির বিভিন্ন পদ্ধতি দেখি এবং জনগণের ইচ্ছার সঠিক মূল‍্যায়নকে কায়েমী স্বার্থে পরিবর্তিত হতে দেখি। একাজের জন‍্য রাজনৈতিক দলগুলিতে আলাদা মেশিনারী তৈরী হয়েছে। corruption begets corruption। আর কম‍্যুনিষ্টরা ‘ভোটযুদ্ধ’ জেতার জন‍্য তাদের মেশিনারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ময়দানে নামিয়ে দেয়!
প্রথম দফার ভোট জালিয়াতি শুরু – ভোটার লিস্টে নাম বাদ দেওয়া ও নাম তোলায়। আমাদের দেশে মানুষের পরিচয়পত্র, এমনকি ব‍্যঙ্ক ও অন‍্যান‍্য অনেক ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিযুক্ত আধার কার্ড একমাত্র প্রামাণ‍্য পরিচয়পত্র হলেও ভোটদানের ক্ষেত্রে ভোটার কার্ড হলেই চলবে! এই কার্ডের সঙ্গে বায়োমেট্রি না থাকায় যে কেউ এই কার্ড বানিয়ে ( নকল মানুষের আসল ভোটার কার্ড হতেই পারে) ভোট দিতে পারে। বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রেও এভাবে ভোটার হওয়ার সুযোগ থাকে। এমনকি আমাদের দেশের মানুষেরও একাধিক ঠিকানায় একাধিক ভোটার কার্ড থাকতে পারে। এছাড়া অনেক আসল ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয় মৃত বা লেফ্ট দেখিয়ে। এক্ষেত্রে ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারী প্রশাসনকে শাসকদল কাজে লাগায়। এর পরের পর্যায়ে ভোটের দিনের প্রাক্কালে সন্দেহজনক ভোটার যে শাসকের পক্ষে ভোট দেবেনা এমন মানুষদের উপর বিভিন্ন উপায়ে চাপ সৃষ্টি ও ভয় দেখানো শুরু হয়। একাজে শুধু রাজনৈতিক দলের ভোট মেশিনারীই নয়, বড় ভূমিকাসহ সহযোগীতা থাকে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারী প্রশাসন এভাবে কেন দলীয় স্বার্থে নিজেদের ব‍্যবহৃত হতে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনকার রাজনৈতিক সিস্টেমের দিকে তাকাতে হবে।
সেই সিস্টেম সম্পর্কে অল্প কথায় বলা যাক। এটি হল এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীতে এবং ভারতের বি‍ভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আদৃত ‘পপুলিজম থিওরী’। এই তত্ত্ব অনুসরণ করে একাধিক রাজনৈতিক দল ভারতের রাজ‍্যে রাজ‍্যে ক্ষমতা দখল করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লী। মানুষ যা চায় তার সব, এমনকি তার চেয়ে আরো বেশী পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথমে ক্ষমতায় এসো। তারপর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে একেএকে ধ্বংস কর। এর জন‍্য যাদের সাহায‍্য প্রয়োজন যেমন, সংবাদমাধ্যম ও প্রশাসন, বিশেষতঃ পুলিশ প্রশাসন – তাদের ‘পুরষ্কার ও তিরস্কার’ নীতির প্রয়োগে উপঢৌকন ও পদাঘাত করে নিজের দলের তাঁবে করে ফেল। ভারতকে যদিও গণতান্ত্রিক দেশ হলা হয়, এখানে মানুষ রাজারাজড়া ও অভিজাতশ্রেণীর প্রজা হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। তাদের পছন্দ benevolent dictatorship। দেশের রাজন‍্যবর্গের থেকে দেশটাকে ধীরে ধীরে ইংরেজরা ছিনিয়ে নিলেও তারা এদেশের মানুষদের ভালোই চিনেছিল। সে কারনে দেশের বহু জায়গায় তারা রাজন‍্যবর্গের প্রতীকী শাসন বজায় রেখেছিল। ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেঁধেছিল এক অনন‍্যসাধারণ ব‍্যক্তিত্বকে অতিমানবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দেশের সুপ্রিম নেতৃত্বে বসিয়ে। হ‍্যাঁ, গান্ধীজীর কথাই বলছি। তিনি কংগ্রেস দলের কোন পদাধিকারী না হয়েও এবং আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেও ছিলেন সর্বোচ্চ নেতা! একেই সুচতুরভাবে ব‍্যবহার করে জওহরলাল নেহরু দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তাঁর পারিবারিক শাসনব‍্যবস্থার বীজ রোপন করেন – যা পরবর্তীকালে মহীরুহ হয়ে কংগ্রেস নামক দলটাই তাঁর উত্তরপুরুষদের ব‍্যক্তিগত মালিকানায় চলে গেল। এর জন‍্য সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে (জওহরলাল কন‍্যা ইন্দিরা গান্ধী) অতিমানবের স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রশাসনিক ও সংবাদমাধ্যমগুলির সহযোগীতায় আলাদা মাত্রা পেল। এর সঙ্গে প্রয়োগ শুরু হল পপুলিজম তত্ত্বের। জনগণের গণতন্ত্র সম্বন্ধে নূন‍্যতম জ্ঞান নেইধরে নিয়ে তাদের গণতন্ত্রের নামে খুশী রাখার জন‍্য অর্থ, খাদ‍্য ইত‍্যাদির সঙ্গে আমোদপ্রমোদের জোগান দেওয়া শুরু হল। জনপ্রিয় শ্লোগান ‘গরীবি হটাও’ দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কাজ এগিয়ে গেল।
এই নীতি যেসব দেশ গ্রহন করেছে তারা ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে। স্বল্প পরিসরে ভেনেজুয়েলার উদাহরণ আদর্শ হতে পারে। এক সময় প্রাকৃতিক সম্পদে সম্বৃদ্ধ এই দেশ দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালে কম‍্যুনিষ্ট নেতা হুগো স‍্যাভেজ ভেনেজুয়েলার শাসনভার দখল করে দেশের মানুষকে ভর্তুকিযুক্ত খাবার ও অন‍্যান‍্য নিত‍্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিষ দিয়ে জনগণের মনে পপুলিজম তত্ত্বের উপর বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করলেন। এরজন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারী অর্থভান্ডার থেকে দেওয়ায় আর্থিক ঘাটতি বেড়ে গল। যার ফলে দেশের উন্নয়ণ ও বিকাশের কাজ ব‍্যহত হতে শুরু করল। ষ‍্যাভেজের মৃত‍্যুর পর ২০১৩ সালে তাঁর শিষ‍্য নিকোলাস মাদুরো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ফ্রি করে দিলেন। ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ত বটেই, এমনকি সব রকম উন্নয়ণ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, উৎপাদন শিল্প – সব বন্ধ হয়ে গেল। দেশের আমদানীর পরিমাণ রেকর্ড বৃদ্ধি পেল।ফলে সরকারের রোজগার দ্রুত কমতে লাখল। এক সময় এমন অবস্থা হল যে ভর্তুকিতেও মানুষের নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার ক্ষমতা রইল না। দেশের আশি শতাংশ মানুষ দরিদ্রতম বলে চিহ্নিত হল। কর্মসংস্থান বন্ধ হল। দেশে অতি উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটল। জনগণের বিক্ষোভ শুরু হল। সেই বিক্ষোভ দমনে গুলি চালানো, মৃত‍্যু – সব ঘটল। এমতাবস্থায় ২০১৯ সালে জুয়ান গুয়ায়িদো সংযুক্ত বিরোধীদের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করলেন! এখানে উল্লেখ‍্য যে ২০¹৮ সালে সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন‍্য মাদুরো সব রকমের পকৌশল ও দূর্ণীতির আশ্রয় নেওয়ায় বিরোধীরা সেই নির্বাচন অবৈধ বলে। পাশ্চাত‍্য দুনিয়া এবং পৃথিবীর বহু গণতান্ত্রিক দেশ তাদের সমর্থন করে। এবং পরবর্তীতে তারা গুয়ায়িদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাণ‍্যতা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর সাহায‍্য নিয়ে মাদুরো দেশের মধ‍্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। এভাবে এক দেশে দুই প্রেসিডেন্ট! মাদুরো এই বিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ‍্যে যুক্তিহীন ও অনৈতিকভাবে দেশের সেনাবাহিনীর বেতন ও সুখসুবিধা বাড়িয়ে চলেছেন।
এই উদাহরণ দেওয়া উদ্দেশ‍্য হল, আমাদের দেশে বেশকিছু রাজ‍্যের মানুষকে এই রকম পপুলিজম তত্ত্ব মোতাবেক অনুদান দেওয়ার প্রভূত প্রকল্প দেখতে পাই। দুয়ের সমন্নয় লক্ষ‍্যণীয়। পশ্চিমবঙ্গে মাদুরো নীতির প্রয়োগ চলছে বললে অত‍্যুক্তি করা হয়না।
আমাদের দেশে এর জন‍্য সমস‍্যা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের কথায় এলে বলতে হয়যে, ষাটের দশকের পর থেকে এই রাজ‍্যে যেমন শিল্পের বিকাশ হয়নি তেমনই জঙ্গী কম‍্যুনিষ্ট আন্দোলন ও তার উত্বরকালে কম‍্যুনিষ্ট শাসনে এই রাজ‍্যে কলকারখানা স্থাপন ত দূরঅস্ত, একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরাজ‍্যের শিল্পে ‘ঘেরাও’ কথাটি এত চালু হয়েছিল যে তা অক্সফোর্ড ডিক্সনারিতেও স্থান পেয়েছে! সরকারী বেতন কাঠামোয় প্রচুর স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার পোষিত সংস্থায় অত‍্যধিক বেতনবৃদ্ধি, সঙ্গে নিয়মিত ডিএ বাড়ানো ইত‍্যাদি কারনে সরকারের কোষাগারে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেতনের টাকা মেটাতে ওভার-ড্রাফ্ট নেওয়া শুরু হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ণ না করে এই অনুদান নীতি যখন আর চলছিলনা তখন বড় শিল্প স্থাপনের চেষ্টা করতে গিয়ে সেই সরকারের পতন হল। আরো বেশী অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান শাসকদল রাজ‍্যসরকারে ক্ষমতায় এলো। হুগো স‍্যাভেজের কায়দায় বিরোধী উৎখাত, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশ প্রশাসন – সব কিছুই পার্টি তথা ব‍্যক্তি নিয়ন্ত্রনে এসে যাওয়ায় এবার সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চালানোর প্রশ্ন এলো। “অনুপ্রাণিত” প্রশাসন তার স্বচ্ছতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হিরিয়েছে তার দক্ষতাও। তখন ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী larger than life নেতা (নেত্রী) বানানো হল! সব সমষ‍্যার সমাধান করে বিভিন্ন নামে ভোটারদের অনুদান দেওয়া শুরু হল। এছাড়া অবশ‍্য শাসকের আর কিছু করার ছিল না। তাই ভেনেজুয়েলার নির্বাচনের মত এখানেও এখানেও নির্বাচনী গণতন্ত্রের মূল কথা – সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত – এই তিনটিই নির্বাচনের সময় অবলুপ্ত হয়ে গেল।
আমরাশুধু এ রাজ‍্যে নয়, অন‍্যান‍্য রাজ‍্য, এমনকি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও এই রাজ‍্যের প্রভাব অনুভব করছি। জওহরলালের পর যখন ইন্দিরা দেশের শাসনভার ‘দখল’ করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে গণতন্ত্রের মোড়কে পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে সচেষ্ট হন, তখন থেকেই আবার দেশের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে larger than life বানানোর চেষ্টা শুরু হয় – যা এখনো চলছে। কুশীলব বদলাচ্ছে – নীতি নয়! এই সময়ে এসে দেশের মানুষের স্বভাব পরিবর্তনের একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করে এই লেখা শেষ করব। বর্তমানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নবম মূখ‍্যমন্ত্রী হচ্ছেন শ্রীমতি মমতা মূখোপাধ‍্যায়। এর আগের কোন মূখ‍্যমন্ত্রী সম্পর্কে রাজ‍্যের মানুষ তথা মন্ত্রী সান্ত্রীদের ‘মাননীয়’ সম্বোধন করতে শুনিনি। কিন্তু এখন মনে হয়, কোন অলিখিত নীতির প্রয়োগে এটা বলা বাধ‍্যতামূলক! আবার জনসাধারনের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন জনগণের টাকায় কোন প্রকল্প উদ্বোধন বা শুরু করেন, তখন “মাননীয়া” ও “অনুপ্রেঢ়নায়” – কথাদুটি অত‍্যন্ত শ্রুতিকটুভাবে কানে বাজে। এতে কি মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মান বাড়ে? মনেহয়, অশিক্ষাজনিত চাটুকারীতার উজ্জ্বল নিদর্শন এই ধরনের চামচাবাজি। সত‍্যি কথা বলতে কি, কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক লঘুভার মন্ত্রী ও আধামন্ত্রী (MOS) কেও আমরা বারবার “মান‍্য নরেন্দ্রমোদীজী” বলতে শুনি আর কেন্দ্রীয় সব প্রকল্পই যেন তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সাধিত হয়! এভাবেই ইমেজ বিল্ডিং হয় ও গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রার দিকে দেশ এগিয়ে চলে।
গণতন্ত্রকে রক্ষা কযার জন‍্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন ভোটারদের যথার্থ শিক্ষিত করা। একাজ করতে কায়েমী স্বার্থের কারনে রাজনীতিকরা সর্বতোভাবে বাধা দেবে। ভোটারদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মাধ‍্যমে বুঝতে হবে, অর্থ ও খাদ‍্যের বিনিময়ে যারা আমাদের ভোট কিনছে তারা আজকের জন‍্য সাময়িক সংস্থান করলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আগামী সংস্থানকে ধ্বংস করছে। এই শিক্ষা না থাকলে তার গণতন্ত্রে ভোটাধিকার থাকা উচিৎ নয়। এছাড়া, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের জন‍্য সমাজ যদি তৈরী না হয়, তাহলে আমাদের দেশে কোথাও মুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সফল হবেনা। পক্ষান্তরে, উপমহাদেশের পরিস্থিতি মাথায় রেখে বলা যেতে পারে, ভবিষ‍্যতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দুষ্কর হতে পারে।

আমাদের দেশে ওমিক্রন ভাইরাসের বিপদ কতটুকু

আমাদের দেশের মানুষের সামনে নতুন করে যে বিপদ এসেছে সে সম্পর্কে এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীজীও দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে বলেছেন, সেটি হল করোনা ভাইরাসের নতুন রূপ – ওমিক্রন ভাইরাস। যে কোনো RNA ভাইরাসের মত করোনা ভাইরাস, যা প্রাথমিকভাবে SARS-CoV-2 নামে পরিচিত, জিন মিউটেশান করে তার জিন গঠনের বিন‍্যাসের পরিবর্তন করে। কারন, একই গঠনের ভাইরাসগুলির স্থায়ীত্বকাল খুব কম। সেজন‍্য এরা যখন নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে replication বলে, তখন মাঝে মধ‍্যে তাদের জিন মধ‍্যস্থ অ‍্যামিনো এ‍্যাসিডের ট‍্যাগিংস্থানগুলি একে অন‍্যের জায়গায় চলে যায়। একেই জিন মিউটেশান বলে। এতে প্রোটিনের গঠন আলাদা হলেও প্রজাতি একই থাকে। জিন মিউটেশানে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করে RNA ভাইরাস বেঁচে থাকার চেষ্টা করে – নতুবা শুধু replication এ ভাইরাসের অস্তিত্বের স্থায়িত্ব আসে না। সেজন‍্য ভাইরাসের জিন মিউটেশান একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একই রকম জিন বিন‍্যাস করতে করতে যখন নিউক্লিওটাইডের মধ‍্যে প্রোটিনের ট‍্যাগিং বিন‍্যাসের পরিবর্তন হয় তখন নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের সৃষ্টি হয়। এতে কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রজাতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এই ওমিক্রন ভাইরাসও তেমনি করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের নতুন একটি রূপ।
এই ওমিক্রন ভাইরাস নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম দেখা যায় বটসওয়ানায়। তার তিনদিন বাদে পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রায় একই সময়ে হংকংয়ে ওমিক্রন ভাইরাসের সংক্রমন ধরা পড়ে। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ভাইরোলজিস্ট ডঃ টম পিকক প্রথম এই নতুন ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের নিউক্লিওটাইডের স্পাইক প্রোটিনের সর্বাধিক মিউটেশানের কথা বলেন। তিনি আরো বলেন যে, এই ভ‍্যারিয়েন্ট “odd cluster” এর – অর্থাৎ এটির সংক্রমণের তীব্রতা মারাত্মক রকমের নয়। তবে, সমস‍্যাটা অন‍্য জায়গায়। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসার রবি গুপ্তা এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের জেনেটিক ইন্সটিটিউটের প্রফেসার ফ্রাঙ্কো ব‍্যাঁলো দুজনে পৃথকভাবে বলেন যে, এদের অ‍্যান্টিবডি সণাক্তকরনের ক্ষমতা rtPCR এর মার্কারের কম থাকার কারনে এদের সণাক্তকরণ করা শক্ত। প্রফেসার ব‍্যাঁলো আরো বলেন, এরা সিঙ্গল বার্সট মিউটেশানে উদ্ভুত বলে আলফা ও ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের মার্কারকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেজন‍্যই মনে হয়, প্রায় সতেরোটা দেশে ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হয়েছে জানা গেলেও কোথাও মৃত‍্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কমাত্র দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করার মত রোগ যেমন HIV, ক‍্যন্সার ইত‍্যাদির উপস্থিতিতে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর কিন্তু এই তথ‍্যকে অস্বীকার করেনা।
একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সণাক্তকরন পরীক্ষা, rtPCR সহ, এই ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করতে না পারলে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকেই যায়। আর সেই কারনেই WHO এবং আরো কয়েকটি সংস্থা বিশ্বকে সতর্ক থাকতে বলেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও এই সতর্কতার কথাই বলেছেন। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে দেশের বেশ কিছু সংবাদ মাধ‍্যম নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর দিকে লক্ষ‍্য রেখে ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ে ‘যদি’, ‘কিন্তু’র মোড়কে অবৈজ্ঞানিক ব‍্যখ‍্যায় সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করছে। এমনকি একথাও বলা হচ্ছে যে, এই ভাইরাস নাকি বাজারের স্বীকৃত ভ‍্যাকসিনে কাবু হবেনা! এমন অবৈজ্ঞানিক ব‍্যখ‍্যা কোন গবেষণাগারের পরীক্ষায় উঠে এসেছে তা জানা নেই। উপরন্তু, কোন স্বীকৃত গবেষণাপত্র এমন কথা বলছেনা। বলা হচ্ছে, স্পাইক প্রোটিনে এত বেশী সংখ‍্যায় পরিবর্তন এবং ফ‍্যুরিন ক্লিভেজ এই প্রথম ভ‍্যারিয়েন্টে পাওয়া গেল। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। RNA ভাইরাস প্রজাতি না পাল্টালে কোন বড় বিপদ নেই। আর, জিন মিউটেশান যত বেশী হব, ভাইরাসের টিঁকে থাকার ক্ষমতা তত বাড়লেও তার বেঁচে থাকার জন‍্যই সে তা সংক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে হোস্ট বডির ক্ষতি করার মাত্রা কমিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও একই ব‍্যপারের সম্ভাবনা। যেমন SARS-CoV2তে প্রথম সংক্রমিত সব আক্রান্তেরই সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ‍্যেই মৃত‍্যু হয়েছিল। তুলনায় এখনো ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টে কারো মৃত‍্যু হয়নি।
সংবাদমাধ্যমগুলোর টিআরপি বাড়ানো ছাড়াও এ ধরনের ভীতি সঞ্চারের অন‍্য গুঢ় উদ্দেশ‍্য আছে। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলা মনে হয় একটি বড় উদ্দেশ‍্য। এখন সারা দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতি পেয়েছে -যা লকডাউন পর্বে থমকে গিয়েছিল। দেশ জুড়ে পরিবহন, শিক্ষাঙ্গনসহ বিনোদন ও অন‍্যান‍্য কর্মকান্ড অবাধে শুরু হয়েছে। এতে সরকারের সুস্থিরতার সঙ্গে দেশের নুইয়ে পড়া অর্থনীতি আবার গতি পাচ্ছে। এই ধরনের নেতিবাচক, ভীতিপ্রদ প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যদি সরকার লকডাউন বা বিভিন্ন কর্মকান্ডে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করে তাহলে মানুষের সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি বাড়বে এবং দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও অসংশোধনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিনিষপত্রের লাগামছাড়া মূল‍্যবৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি নুইয়ে পরবে। এই উদ্দেশ‍্যে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও দেশ বিরোধী শক্তিগুলির মদতে এক ধরনের সংবাদমাধ্যম এই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে শুরু করেছে। এইভাবে ভুতের ভয় দেখানোর মত কাল্পনিক ভয় দেখানো শুরু হয়েছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জিন মিউটেশানে নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট জন্মালেও ভাইরাসের প্রজাতির পরিবর্তন হয়নি। সোজাভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ইউরোপীয় ও এশিয় মানুষের দাম্পত‍্যে যে নতুন মানুষ জন্মায়, তাকে ইউরেশিয়ান বলে – যে কিনা মানুষ – গরিলা বা ওরাংওটাং নয়! আরো পরিষ্কারভাবে বলা যাক, বাজারে প্রচলিত যে সব স্বীকৃত ভ‍্যাকসিন আছে তাতেই করোনা ভাইরাসের একটি ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট ওমিক্রন কাবু হবে। তার কারন, এই ভ‍্যাকসিনগুলি করোনা ভাইরাসের সকল ভ‍্যারিয়েন্টের উপরেই কার্যকরী হওয়ার মত করে তৈরী করা হয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরা যাক, কোন ভ‍্যারিয়েন্টের সমস্ত ট‍্যাগিংবিন্দুগুলির জন‍্য কোন ভ‍্যাকসিনের কার্যকারিতা অনেক কমে গেল। তখন ঐ ভ‍্যাকসিন পরিমার্জন করে নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকরী করা কোন বড় সমস্যা নয়। আরেকটি কথা – সমস্ত ভ‍্যাকসিনকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমার্জন করা হয় – নাহলে তার কার্যকারীতা (efficacy) কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এর জন‍্য জনসাধারনকে ভয় দেখানো অনুচিত।
এখানে আরেকটি কথা জানানো দরকার। এই মূহুর্তে বিশ্বব‍্যপী বিজ্ঞানীরা ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট সংক্রান্ত দুটি কাজে মনোনিবেশ করেছেন। প্রথমতঃ, এখনো পর্যন্ত জিনম সিকোয়েন্সিং না করে ওমিক্রন সংক্রমন নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এই পরীক্ষা ব‍্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সেজন‍্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যে, rtPCR টেষ্টে যদি ওমিক্রন ভাইরাসের সঠিক ও নির্দিষ্ট মার্কার পাওয়া যায়। তাঁদের আশা, তাঁরা অল্পদিনের মধ‍্যেই মার্কার পেয়ে যাবেন। তা হলে অল্প খরচে এবং দ্রুততার সঙ্গে ওমিক্রম আক্রান্ত রোগীর সণাক্ত করা যাবে। দ্বিতীয় যে প্রচেষ্টা বিজ্ঞানীরা চালাচ্ছেন তা হল, এই বিশেষ ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর উপর স্বীকৃত ভ‍্যাকসিনগুলির কার্যকারিতা পরীক্ষা। বৈজ্ঞানিক যুক্তি বলে, যেসব ভ‍্যাকসিন ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের উপর কার্যকরী তাদের ওমিক্রম ভ‍্যারিয়েন্ট – যা ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের একটি রকমফের – তার ক্ষেত্রে সফল না হওয়ার কোনো কারন নেই। যদি সফলতার মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, তখন ভ‍্যাকসিন পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করে নিলেই হয়। এ কাজের জন‍্য সময় লাগলেও তা খুব বেশী নয়। সুতরাং “গেল গেল” রব তোলার কোন যুক্রি নেই।
পরিশেষে বলি, এই নেগেটিভ প্রচারের জন‍্য ভয় না পেয়ে যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন করলে ওমিক্রন আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না। সতর্কতা বলতে সমাজে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা; বাড়ির বাইরে গেলে বা বাড়ির ভেতরে বাইরের মানুষের উপস্থিতিতে যথাযথভাবে মাস্ক ব‍্যবহার করা; বাইরে থাকলে আধঘন্টা থেকে একঘন্টা অন্তর হাত স‍্যানিটাইজ করা; বাইরে থেকে নিজের বাড়িতে এসে সাবান দিয়ে ভালোভাবে স্নান করা আর বাইরের পোষাক একটি নির্দিষ্ট ও isolated স্থানে রেখে দেওয়া। খুব প্রয়োজনীয় হল, সময়ে ভ‍্যাকসিনের ডোজ নেওয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে শিশুদের ভ‍্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের সরকারের কাছে আমার অনুরোধ যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শিশুদের ভ‍্যাকসিনেশান শুরু করুন। ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের এখনো অব্দি যা গতি প্রকৃতি তাতে কোনো কাজ বা ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করার দরকার নেই। শিক্ষাঙ্গন, বাজার-দোকান, এবং পরিবহন ও বিনোদন জগতের উপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না – অবশ‍্যই মানুষ যদি সতর্ক থাকে। শেষে বলি, এই ধরনের প্রচারে ভুলে সরকার যদি বাধানিষেধের পথে হাঁটে তা হলে সরকার এবং দেশের জনগণের সমূহ বিপদ।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)

ওমিক্রন ভাইরাসে অতিরিক্ত ভীতি অমূলক

করোনা ভাইরাসের সাম্প্রতিকতম জিন মিউটেড রূপ B.1.1.529 যার সাধারণ নাম ওমিক্রন, সেই ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন দেশের মত আমাদের দেশেও শোরগোল শুরু হয়েছে। আমাদের পত্রপত্রিকাগুলি এ বিষয়ে স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞের মত তাদের কল্পিত করোনা ঢেউ ও তার পরবর্তী লকডাউন(!), ইত‍্যাদি বিষয়ে নানা কথা ছড়াতে শুরু করেছে। ব‍্যপারটা কি? সত‍্যিই এর থেকে আমাদের অতিরিক্ত বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা তা বিশ্লেষণ করাই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ‍্য।
প্রথমে ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের ইতিহাস ব‍্যখ‍্যা করা যাক।
ইম্পিরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট ডঃ টম পিকক প্রথম এই নতুন ভাইরাসটির জেনম সিকোয়েন্সিং করতে গিয়ে দেখেন, SARS-CoV2 এর স্পাইক প্রোটিনের প্রায় ছাব্বিশ জায়গায় মিউটেশান হয়েছে। এটি সেজন‍্য স্বাভাবিকভাবেই “odd cluster” মিউটেশান। অর্থাৎ এটির সংক্রমণের তীব্রতা খুব একটা বেশী হওয়ার কথা নয়। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ‍্যালয়ের প্রফেসর রবি গুপ্তাও এর সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে, সণাক্তকরণের ব‍্যপারে তিনি জানিয়েছেন যে, এটি ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট প্রজাতির হলেও এর অ‍্যান্টিবডি সণাক্তকরণ ক্ষমতা কম। স্পাইক প্রোটিনের এস্ জিনের অনুপস্থিতির কারনে এখনকার rtPCR কিটে এর সণাক্তকরণ সম্ভব নাও হতে পারে। ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের জেনেটিক ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ফ্রাঙ্কো ব‍্যাঁলো বলেছেন, এটি ‘সিঙ্গল বার্সট্’ মিউটেশানে সৃষ্ট। তার ফলে এর আলফা বা ডেল্টা অ‍্যান্টিবডি শণাক্তকরণের ক্ষমতা কম। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা একটি ব‍্যপারে মোটামুটি সহমত পোষন করছেন যে, SARS-CoV2 এর মত এই নবতম রূপের ওমিক্রন ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা নেই।
২০২০ সালের প্রথম থেকেই আমি বলে এসেছি যে, এই RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হল জিন মিউটেশান করে পৃথিবীতে টিঁকে থাকা। আবার যত বেশী মিউটেড ভাইরাসের জন্ম হবে, তত তার মারণ ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এইভাবে ধীরে ধীরে এই RNA ভাইরাস একসময় মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এখন দেখা যাচ্ছে, মানবদেহ থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে ভাইরাস বেঁচে থাকার জন‍্য সিঙ্গল বার্সট্ মিউটেশান করছে। আর এর জন‍্য ওমিক্রন ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা অনেক কম। এর মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষমতাও দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কথা। একমাত্র HIV, ক‍্যান্সার ইত‍্যাদির মত মারণ রোগের উপস্থিতিতে মানবদেহে ইমিউনিটি কম থাকার কারনে এটি মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। এখনো অব্দি এর সংক্রমণের ধারা অনুধাবন করলে একথা ‘অসত‍্য’ বলা যায়না।
গত ১১ই নভেম্বর বটসওয়ানায় এই ভাইরাসের প্রথম দেখা মেলে। তার তিনদিন বাদে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ভাইরাসে আক্রান্তের সন্ধান মেলে। হংকংয়ে যে রোগীর দেহে গত ১৩ই নভেম্বর ওমিক্রন ভাইরাসের সংক্রমণ মেলে তার কয়েকদিন আগে সেই রোগীর rtPCR টেষ্টের রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ ছিল। কিন্তু কম্পালসারী কোয়ারেন্টাইনের সময় তার দ্বিতীয়বার টেষ্টের রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ আসে। এরপর জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে তার সংক্রমণ ওমিক্রন ভাইরাসের জন‍্য বলে জানা যায়। এখানে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তা হল, এখনো পর্যন্ত যেসব মানুষ এই নতুন মিউটেড ভাইরাসে আক্রান্ত তারা কোয়ারেন্টাইনে থাকলেও তাদের কারো শারীরিক অবস্থা গুরুতর নয়। এখনো পযর্ন্ত কোথাও মৃত‍্যুর খবর নেই। আবার ওমিক্রন ভাইরাসের বর্তমান rtPCR টেষ্ট ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতার জন‍্য অসতর্ক মানুষের পক্ষে এই ভাইরাস মারাত্মক। শুধু এই কারনের জন‍্যই এখনো অব্দি প্রায় তেরোটি দেশে এর ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই একটি কারনের ছন‍্যই WHO এই ভ‍্যারিয়েন্ট সম্পর্কে পৃথিবীতে সতর্কবার্তা দিয়েছে। ভবিষ‍্যতে যদি এই ভ‍্যারিয়েন্টের মারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় – অবশ‍্যই আরো মিউটেশানের পর, তখন এর সণাক্তকরণের অসুবিধাজনিত কারনে সংক্রমিতের কোয়ারেন্টাইন হওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়ে সংক্রমনের অতিবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। যদিও এতসব ‘হয়ত’, ‘কিন্তু’র পর, এমন চিন্তার বাস্তবসম্মত ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়নি; তবুও আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে সুযোগসন্ধানী সংবাদমাধ‍্যমগুলি টিআরপি রাড়ানোর লোভে অনেক প্রকারের ভীতিপ্রদ সংবাদ প্রচার করতে শুরু করেছে। তবে, এই মূহুর্তে সতর্কতার প্রয়োজন থাকলেও কোনরকম বিধিনিষেধের আওতায় দেশকে আনলে পরে আমাদের দেশের অর্থনীতির উপর সূদুরপ্রসারী খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ‍্য। সংবাদমাধ্যমে এমন কথাও দেখা গেল যে, এই ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট নাকি এমন ভাইরাস যার উপর বাজারের পরীক্ষিত ও স্বীকৃত কোন ভ‍্যাকসিনই কাজ করবেনা! উপযুক্ত সম্মান সহকারে জানতে চাই, সংবাদমাধ‍্যম এই তথ‍্য কোন গবেষনাগারের কোন পরীক্ষায় পেয়েছেন! এমনকি কোনো স্থীকৃত জার্নালে এমন তথ‍্য এখনো পাওয়া যায়নি। সুতরাং ভুতের ভয় না দেখিয়ে আমাদের সংবাদমাধ‍্যমগুলি ভুতের স্বরূপ প্রকাশ করলেই সঠিক কাজ করতেন।
এখানে আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। এখনো পযর্ন্ত ব‍্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ জিনোম সিকোয়েন্সিং না দেখে এবং ওমিক্রন ভাইরাসের সঙ্গে তার ম‍্যাচিং না করিয়ে এই বিশেষ ডেল্টা প্রজাতির ভাইরাসের চিহ্নিতকরন সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ে মনোনিবেশ করেছেন। একটি হল এই ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি মার্কার সণাক্ত করা – যাতে এর সণাক্তকরণ দ্রুত হয় এবং তার ব‍্যয় মানুষের সাধ‍্যের মধ‍্যে থাকে। অপরটি হল এই ভাইরাসের উপর ভ‍্যাকসিনের প্রভাব পরীক্ষা করা। এর জন‍্য সময় প্রয়োজন। তবে, মেডিক‍্যাল সায়েন্সের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটুকু বলা যায় যে, ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের প্রজাতিগুলির উপর যেসব ভ‍্যাকসিন সফল হচ্ছে তাদের ওমিক্রন ভাইরাসের উপর সফল না হওয়ার কোন কারন নেই। অর্থাৎ এই ভাইরাসও ভ‍্যাকসিনে কাবু হবে। নাহলে, ভ‍্যাকসিনের পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে সহজেই এই ভাইরাসকে কাবু করার ব‍্যপারে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুতরাং এই ভয়ের ব‍্যপারটাই অমূলক।
বলা হচ্ছে, স্পাইকপ্রোটিনের মধ‍্যে এই প্রথমবার এত বেশী পরিবর্তন দেখা গেল এবং প্রথমবার ফ‍্যুরিন ক্লিভেজ পাওয়া গেল। এতে ভীত হওয়ার ব‍্যপার নেই। কারন, RNA ভাইরাস প্রজাতি না পাল্টালে বিপদ নেই। যত জিন মিউটেশান হয়, ভাইরাস নিজে বেঁচে থাকার জন‍্য তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়লেও হোস্ট বডির ক্ষতি করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়! এক্ষেত্রেও একই ব‍্যপার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর সেজন‍্যই এত ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংক্রমিত কোন মানুষের এখনো পর্যন্ত মৃত‍্যু হয়নি। কিন্তু SARS-CoV2 সংক্রমণের শুরুতে যে তিন ব‍্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের সকলের অল্পদিনের মধ‍্যেই মৃত‍্যু হয়েছিল। এর সঙ্গে এখন আরেকটি ব‍্যপার যোগ হয়েছে। বিশ্বে এত বিপুল সংখ‍্যক মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় এই প্রজাতির সব মিউটেড ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের দেহে অ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়ে গেছে। সেজন‍্য, সংক্রমণের সংখ‍্যা বৃদ্ধি পেলেও সংক্রমণের মাত্রা অর্থাৎ তীব্রতা কমেছে। আরো একটি কথা জানা দরকার – কোন ভাইরাস জিন মিউটেট করে প্রজাতি বদল করতে পারে না। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ও এশিয়ান মানুষের মিলনে ইউরেশীয় মানুষ জন্ম নেয়; গরিলা নয়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণের তীব্রতা হ্রাস পাওয়া একটি পরীক্ষিত সত‍্য।
তা হলে আমাদের করণীয় কি?
করণীয় হচ্ছে, অযথা ভয় না পেয়ে আমরা সর্বদা অফশ‍্য পালনীয় সতর্কতা মেনে চলব। অর্থাৎ, বাড়ির বাইরে বেরোলে বা বাড়ির মধ‍্যে বাইরের মানুষের উপস্থিতিতে মাস্ক যথাযথভাবে পরে থাকা। ফাইরে থাকলে আধঘন্টা থেকে একঘন্টা অন্তর হাত স‍্যানিটাইজ করাহ সামাজিক স্থানে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা। এবং সর্বোপরি ভ‍্যাকসিনেশানের ডোজ যথাযথভাবে ও যথা সময়ে নেওয়া। ইউরোপ, আমেরিকায় শিশুদের ভ‍্যাকসিনেশান শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে যত তাড়াতাড়ি সম্বভ শিশুদের ব‍্যাকসিনেশান শুরু করা উচিৎ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে কাজ করার পর বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমে সাবান দিয়ে স্নান করা – সঙ্গে বাইরে পরার পোষাক আলাদা করে পৃথক স্থানে রাখা।
এই কটি নিয়ম মেনে চললে ওমিক্রন ভাইরাস কিছুদিনের মধ‍্যেই মানুষের হাতে পরাস্ত হবে – সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনৈতিক সার্কাসের শিকার

আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্ভাগ্য হল, তারা রাজ‍্য বা কেন্দ্র কোন সরকারের সঙ্গেই একাত্মতা অনুভব করার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেনা – অবশ‍্য, দুই রাজনৈতিক দলের সদস্য, সমর্থকদের বাদ দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হল, পশ্চিমবঙ্গে দুই রাজনৈতিক দল – ক্ষমতাসীন তৃণমূল আর বিরোধী বিজেপি এমন বিবৃতির বন‍্যা বইয়ে দিচ্ছে যে তাদের মত জনদরদী ও অন‍্য দলের মত জনবিরোধী দল পৃথিবী(!) খুঁজেও পাওয়া যাবেনা। দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের হম্বিতম্বি ও অসাংবিধানিক মন্তব‍্য এতে নিঃসন্দেহে ইন্ধন যোগাচ্ছে। কিন্তু এই আপাত লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের কি কিছু লাভ হচ্ছে?
আমরা একটি কথা সহজে বুঝতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গের এবং কেন্দ্রের সরকার উভয়ই সরাসরি ধর্মীয় মেরুকরন করছেনা। কিন্তু তারা যা করছে তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধিতে পরোক্ষে উস্কানি দিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলই তার ফায়দা লুঠতে চাইছে। এর ফলে সমাজে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ‍্যে বিভেদ, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সুযোগে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা ও অনুন্নয়নের কায়েমী স্বার্থে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করছে। ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের আমলের পর পশ্চিমবঙ্গে কটি বড় শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়েছে – তা কেউ বলতে পারবেন কি! এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা প্রবাহের উল্লেখ করা যেতে পারে, যা রাগ নয়, হাসির উদ্রেক করে। এক সময় পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রতি বছর নিয়ম করে বিদেশী শিল্প ধরে আনতে যেতেন! তারপর সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হত কত বিশাল অংকের টাকার মৌ স্বাক্ষর করা হয়েছে। এদিকে পোঁ ধরা সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ‍্যমগুলি এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করত, মনে হত, নতুন নতুন কলকারখানা প্রয় খুলেই গেছে; শুধু যা ফিতে কাটাই বাকী! তারপর জনসাধারণ ঠেকে শিখল, ‘মৌ সাক্ষর’ মানে এই শিল্প হবে তার অঙ্গীকারপত্র। এর কোন আইনি বাধ‍্যবাধকতা নেই যে শিল্প হবে বা হচ্ছে। এদিকে রাজনৈতিক দলের দাদাগিরির চাপে একেএকে সব চালু কলকারখানাই একে একে বন্ধ হতে লাগল। সেই সরকার যখন বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বুঝল, তখন তারা টাটা মোটরসের গাড়ীর কারখানা করার চেষ্টা করেও জনসাধারণের অনীহা ও যে জঙ্গীপনা তারা শুরু করেছিল, সেই একই দাওয়াই প্রয়োগ করে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল ২০১১তে ক্ষমতাসীন হল। তারপর আমরা ওয়াজেদ আলীর বিখ‍্যাত গল্পের অতি বিখ‍্যাত উক্তি, “সেই ট্র‍্যাডিশান সমানে চলেছে” দেখলাম। আসলে বড় রাজনৈতিক বদল এনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বদল আনার জন‍্য মানুষের ধ‍্যানধারনা ও চরিত্র বদলের প্রয়োজন। এখানেই রাজনীতির ব‍্যর্থতা প্রতীয়মান। নেতারা জনগনের সেবার বদলে আত্মসেবা ও ক্ষমতার অপব‍্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে উত্তেজিত করে তাদের ভোট পাওয়াই ক্ষমতায় থাকার একমাত্র পথ মনে করেন। ফলে, বামফ্রন্টের সময় যে কর্মবিমুখতা, ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, collective burgaining যা পরবর্তী পর্যায়ে শাসকের প্রশ্রয়ে তোলাবাজীর রূপ নেয়, তা এখন মারাত্মক সামাজিক ব‍্যধিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন ও শিক্ষার মত জায়গায় যোগ‍্যতার বদলে দলীয় সুপারিশ এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ‍্যমে নিয়োগ শুরু হয়। এমন অবস্থায় তৃণমূলদল ক্ষমতায় এসে এসব দুর করার চেষ্টা ত করলনা, পরন্তু, দূর্ণীতির গণতান্ত্রিক বিস্তার করে সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। এখন রাজ‍্য বা কেন্দ্র, সব জায়গার সরকারই প্রশাসন চালানোয় স্টিক এন্ড ক‍্যারট অর্থাৎ তিরস্কার এবং পুরস্কার নীতিতে শাসকদলের স্বার্থে পুরো প্রশাসন চলে। এখন দেশে নিরপেক্ষ প্রশাসন বলে কার্যকরী কোন প্রশাসন হয় না – শাসকদল নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন সমস্ত জায়গায় কাজ করছে। আবার সংবাদ মাধ‍্যম ও বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমগুলিও শাসকের চাপের মুখে পুরস্কার ও তিরস্কার নীতির প্রথমটিই অবলম্বন করে। সংবাদ মাধ‍্যমগুলি নিজেদের মধ‍্যে চাটুকারীতার এমন প্রতিযোগীতা শুরু করে যে পাঠকের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার বহু বছরের অভ‍্যাসে আমাদের রাজ‍্যে নিজের পছন্দের খবর দেখতে ও পড়তেই বেশ কিছু মানুষের আগ্রহ থাকায় সংবাদ মাধ‍্যমগুলি খবর পরিবেশন করার বদলে নিজেদের নীতি(!)র মোড়কে খবর দিয়ে থাকে। উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। ধরা যাক, হিন্দু পুলিশের গুলিতে কোন মুলমানের মৃত‍্যু হলে তা যদি পশ্চিমবঙ্গে ঘটে ত সংবাদ মাধ‍্যম বলবে পুলিশের সতর্কতায় দুষ্কৃতির দুষ্কর্ম করতে বাধা দেওয়ায় মৃত‍্যু! আবার এই ঘটনা যদি কেন্দ্রের শাসকদলের ক্ষমতায় থাকা রাজ‍্যে হয়, তখন সংবাদ মাধ‍্যম জানাবে হিন্দু পুলিশের জিঘাংসার বলি নিরীহ গরীব মুসলমান যুবকের মৃত্যু! এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনায় মরাকান্না গেয়ে তারা ফিচার লিখে ফেলবে। হয়ত অর্ধশিক্ষিত, শো বিজনেসের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা অভিনেত্রীদের (পৃথিবীতে একমাত্র এখানেইএদের বুদ্ধিজীবী বলে) দিয়ে মোমবাতি মিছিল করাবে। এভাবে এই বৃহৎ সংবাদ মাধ‍্যমগুলি অর্থের লালসায় সমাজে ধর্মীয় বিভেদ ও ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। মানুষ না বুঝে এর বলি হচ্ছে। আবার কেন্দ্রের শাসকদলের অধীনে থাকা রাজ‍্যেও একই রকম চরিত্র সেখানের সংবাদ মাধ‍্যমগুলির। খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে সংবাদ মাধ‍্যমগুলির বড় কাজ হল সমাজে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ও সন্দেহের বাতাবরন তৈরী করা। এতে সুবিধা পায় রাজনৈতিক দলগুলি – তাদের জনবিরোধী কাজের দিক থেকে মানুষের মন যাতে সরে থাকে তার চেষ্টা করে যায় এরা। সেজন‍্য এদের বিশ্বাসযোগ‍্যতা আজ তলানিতে।
আগে সাধারন মানুষের মধ‍্যে কিছু রাজনৈতিক দলের সমর্থক থাকতেন। তবে, বেশীরভাগ মানুষ সরকার ও বিরোধী দলের কাজকর্মের নিরিখে ভোট বাক্সে তাদের সমর্থন ব‍্যক্ত করতেন। বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশকে রাজনীতির এমন প্রভাব পড়েছে যে এখন থাকছে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্ধ,উগ্র সমর্থক যাদের চলতি বাংলায় ‘চামচা’ বলে, এবং রাজনীতির অপসংস্কৃতি ও ধান্দাবাজীতে বীতশ্রদ্ধ বিপুল সংখ‍্যক মানুষ। এদের মধ‍্যে বেশ কিছু মানুষ ভোট দিতে গিয়ে হয়ত দুই খারাপ দলের প্রার্থীর মধ‍্যে তুলনামূলকভাবে কম খারাপ দলের প্রার্থীকে ভোট দেন। এই বিপুল সংখ‍্যক মানুষ অসংগঠিত এবং এদের সমাজের ভালো করার ক্ষমতা নেই। সেটা রাজনৈতিক নেতারা জানেন। তাই ভোট রাজনীতিতে কোন দলই নিশ্চিত নয় যে তারা সংখ‍্যাগরিষ্ট মানুষের ভোটে জিতবে। সেজন‍্য ভোটের সময় হিংসা, হানাহানি ও খুনখারাবি পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক ঘটনা। এরজন‍্য বৃহৎ সংবাদ মাধ‍্যমগুলি, যারা ফাঁদ পেতে মানুষে মানুষে বিভেদ ও হিংসা তৈরীতে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তারাই সবচেয়ে বেশী দায়ী। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে চালু রাখতে যে নূন‍্যতম সততা ও শিক্ষার দরকার তার কোনটাই মনে হয় সংবাদ মাধ‍্যম ও নেতাদের মধ‍্যে নেই। সেজন‍্য আজ সাধারণ মানুষ আইনের শাসনের জায়গায় আইনের অপশাসন দেখতে অভ‍্যস্ত! সেই সিনিক‍্যাল মন্তব‍্যটি এখানে সুন্দরভাবে প্রযোজ‍্য, “in democracy, all are eqyal; but sine are more equal than other equals” : পশুখামারের এই উক্তির যথার্থতা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। পুলিশ, প্রশাসনের সর্বত্র দলদাসতন্ত্র কায়েম হওয়ায় মানুষকে সুস্থ দেহে বেঁচে থাকার জন‍্য ‘দলদাস’ হওয়া প্রয়োজন। ফলে, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়েছে। এখানে একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন। এই কায়েমী সৈরতন্ত্র যে এই রাজ‍্যেই হয়েছে তা নয়, অন‍্য অনেক রাজ‍্যে, এবং অবশ‍্যই কেন্দ্রেও একই অবস্থা!
দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন তদন্তকারী সংস্থা CBI ও ED রাজ‍্যের রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীদের ধরছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে – আবার কিছুদিন বাদে সবকিছু পুনর্মুসিকো ভব। এভাবে ছ-সাত বছর এই খেলা দেখে এসব সস্তা চিত্রনাট‍্যের নাটক হিসেবে দেখছে। এতে অবশ‍্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব তীব্রতম ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির সমালোচনা করে কোন বিল রাজ‍্যসভায় পাশ করার সুবিধা করে দিচ্ছেন বিলের বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে সভায় ওয়াক আউট করে। পেট্রোল-ডিজেলের মূল‍্যহ্রাসের ব‍্যপারে দুই দলের তুতু-ম‍্যায়ম‍্যায় নীতি জনসাধারণের মনে বিরক্তি উদ্রেক করে মাত্র। যদি এক বা একাধিক বড় রাজ‍্যে নির্বাচন আসন্ন হয়, তখন আমরা কেন্দীয় সরকারের বদান‍্যতায় পেট্রোল-ডিজেল ও রান্নার গ‍্যাসের দাম কিছুটা কমতে দেখি। আর আমরা জানি যে ভোট শেষ হওয়ার পরে ফলাফল ঘোষণার আগেই এই দাম আরো বাড়বে। এতে মানুষ অভ‍্যস্ত।
রাজনীতিতে পশ্চাদপসারন নিঃসন্দেহে পরাছয়ের ভূমিকা রচনা করে। আমি তিনটি কৃষি বিলের প্রশংসা করে লিখেছিলাম, এই বিলখুলির সম্মিলিত প্রয়োগ যদি ঠিকমত করা হয় তবেই এর সার্থকতা আসবে। কিন্তু আমরা দেখলাম উত্তরভারতের দু-তিনটি রাজ‍্যের সম্পন্ন কুলাকশ্রেণী তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত লাগায় আন্দোলন শুরু করল। বিলের সুবিধা নিয়ে বড় বানিজ‍্যিক সংস্থাখুলি কৃষিদ্রব‍্য বিপননে নেমে পড়ল! হুহু করে খাদ‍্য শস‍্য সহ কৃষি পণ‍্যের খুচরো দাম বাড়তে লাগল। আমাদের রাজ‍্যে অপারেশান বর্গার পর কুলাক-জমিদার শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এ রাজ‍্যে কৃষি বিলের জন‍্য আন্দোলন হল না বটে, তবে, কর্পোরেট জখতের কৃষিপণ‍্যের বিপননের বাজার ধরার সঙ্গে সঙ্গে খাদ‍্যশস‍্যের দাম গুনিতকে বাড়ল। সুতরাং কৃষিবিলের কুপ্রভাব পড়ল সব রাজ‍্যের মানুষের উপর। কৃষিদ্রব‍্য মার্কেটিংয়ে সরকারের নজরদারির ব‍্যর্থতায় মানুষ অসন্তুষ্ট হতে লাগল। এখন কৃষিবিল প্রত‍্যাহার করার কথা বললেও কৃষিপন‍্যের দাম কমানোর চেষ্টা কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজনৈতিকদল – কারোরই নেই। আশ্চর্যজনকভাবে এব‍্যপারে রাজ‍্যের শাসকদল কোন সদর্থক পদক্ষেপ করল না।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন দেশের বরিষ্ট নাগরিকরা। ব‍্যাঙ্কগুলি ফলাও করে প্রচার করে যে সত্তরোর্ধ নাগরিকদের ব‍্যাঙ্কে যেতে হবে না – দরকারে ব‍্যাঙ্ক তাদের কাছে আসবে! সরকার ফলাও করে প্রচার করে রিষ্ট নাগরিকদের সুবিধা দেওয়ার ফিরিস্তি! দুয়ারে সরকারের মত এই দুয়ারে ব‍্যাঙ্কও ভাঁওতা। কোন সরকারি ব‍্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গে নিখরচায় এই সুবিধা দিচ্ছে বলে জানা নেই। এরপর আসি প্রবীনদের ট‍্যাক্স কাঠামোর সুবিধায়! প্রবীনদের পেনশান ও ব‍্যাঙ্কের সুদ অন‍্য সবার মত করযোগ‍্য! ষাটোর্ধ নাগরিকদের মোট রোজগারের উপর বছরে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা করছাড়ের ভিক্ষা দেওয়া হয়। যাঁরা দেশ গঠনে তাঁদের যৌবনের শ্রম দিয়েছেন, তাঁদের জন‍্য এদেশে কোন সোশ‍্যাল সিকিউরিটি স্কীম এদেশে নেই। অথচ যাঁরা একবার এমপি হয়েছেন তাঁরা লক্ষ টাকা এবং এম এল এ হয়েছেন তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা নূন‍্যতম পেনশান পান। এছাড়া আজীবন বিস্তর সুবিধা তাদের জন‍্য দেওয়া হয়। এ ব‍্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সব নেতা-নেত্রীই এক। এই দেশে সাংসদরা তাদের যাতায়াতের জন‍্য এয়ার ইন্ডিয়ায় বিজনেস ক্লাসে সরকারি খরচে ভ্রমনের সুবিধা পান। এসব দেখে মনে হয়, স্বাধীনতার আগের ‘বিদেশী শাসক’ চলে গিয়ে এখন ‘দেশী শাসক’রা জনসাধারনকে শাসকের স্বার্থে শাসন করছেন।
আশার কথা, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে বহু ব‍্যবহারে জীর্ণ, দীর্ণ চিত্রনাট্য যদিও কুশলী অভিনেতাদের অভিনয়গুণে মাজেমধ‍্যে উপভোগ‍্য হয়, তবুও এখন তা বেশী বেশী করে মানুষের বিরক্তির কারন হচ্ছে। একদল রাজনীতিবিদ বিদেশী অনুপ্রবেশ ও হানাদারদের হটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেটা যখন তারা সম্পন্ন করবে তখন অর্থনৈতিকভাবে শোষিত জনগণের কঙ্কালের উপর দিয়ে সেই জয়(!) আসবে। আবার তাদের বিরোধী, বিভিন্ন প্রদেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকরা কেন্দ্রীয়স্তরে ক্ষমতা দখলের লোভে শত্রুদেশের সঙ্গে আঁতাত করতেও হয়ত পিছপা হবে না! এভাবে চললে এই দেশের উপর আবার পরাধীনতার কালো মেঘ ঘণীভূত হবে। অতয়েব সাধু সাবধান। রাজনীতিকদের উদ্দেশ‍্যে একটাই কথা বলার – সাধারণ মানুষ যদি রাজনীতির উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশের মাটির সঙ্গে একাত্মতা অনুবব না করে, তবে দেশের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

ভারতীয় গণতন্ত্রে ব‍্যক্তি পুজা

ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে শুধু রাজ‍্য বা দেশেরই নয়, বিদেশ থেকেও অনেক বিশেষজ্ঞ তাঁদের বক্তব‍্য রেখে থাকেন। আমার মত আম আদমিও সেসব পড়ে “কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ” করতে পারিনা। কারন প্রতিটি লেখা – বিশ্লেষণ, সব কিছুই লেখকের রাজনৈতিক চিন্তাধারার আঙ্গিকে লেখা – একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট। সেজন‍্য বহু সুধীজনের অনুরোধে এই বহুল চর্চিত বিষয়ের উপর লিখতে বসলাম। আমার লেখা পক্ষপাতদুষ্ট কিনা তার বিচারের ভার রইল পাঠকমন্ডলীর উপর।
পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলা হলেও তেমন কোন কিছু আমার মনে হয়না। এই মূহুর্তে এ রাজ‍্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কাম‍্য নয়। আমার ধারনা, এবিষয়ে রাজ‍্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সহমত পোষণ করে। সেজন‍্য, যদিও প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের ভাষণবাজী আর রাজনীতির তরজা রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যেই চালিয়ে যাচ্ছে, কোথাও রণংদেহী ভাব একটি পর্যায়ে গিয়ে তারপর আলাদিনের দৈত‍্যের মত উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখানে এই রাজনীতির বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকটা পিছনে যেতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের রাজনীতির ধরন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, আমরা ভারতীয়রা আমাদের রাজনৈতিক চেতনা একটি বিশেষ দিকে প্রবাহিত হতে দিয়েছি। ভারতীয়দের মধ‍্যে সকল ধর্ম নির্বিশেষে ব‍্যক্তি অর্চনা বা ব‍্যক্তি পুজনের প্রথা সর্বদা গুরুত্ব পেয়েছে। আধুনিক খন্ডিত ভারত তার ব‍্যতিক্রম নয়। ১৮৫৭র প্রথম বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম কিন্তু ভ্রান্তভাবে “সংঘবদ্ধ বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম” হিসেবে দেখানো হয়। তান্তিয়া টোপী, নানা ফড়নবীশ থেকে ধরে মঙ্গল পান্ডে ইত‍্যাদি সকলেই তাঁদের অনুচর বা অনুগামীদের নিয়ে – আলাদা আলাদা কারনে বৃটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থাকায় তার প্রতিবাদে লড়াই করেন। কিছু তাৎক্ষনিক যোগাযোগ ছাড়া এই প্রতিবাদকে ভারতব‍্যপী সংঘবদ্ধ বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম বলা যায়না। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর মধ‍্যে প্রথম বৃটিশ বিরোধী সংঘবদ্ধ আন্দোলন যার নেতৃত্বে শুরু হয় তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীজিই নিঃসন্দেহে প্রথম নেতা যিনি ভারতীয় মননে বৃটিশ বিরোধী হাওয়া তুলতে পেরেছিলেন। অবশ‍্য তাঁর মত ও পথ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে – যদিও এখানে তা আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের ভারতীয়দের ধর্মই হল আমাদের নেতাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যা ব‍্যক্তি পুজনের জায়গায় পড়ে – নেতার ছবি স্বপনে, মননে পুজো করা! আর এই ধরনের personality cult সর্বদাই নেতৃত্বকে স্বৈরাচারী মনোভাবের দিকে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে কথাই বলে। গান্ধীজির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ‍্য। সাভারকর, ভগৎ সিং, সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল ও মহম্মদ আলী জিন্না – এমন অসংখ্য উদাহরন আছে যেখানে গান্ধীজির দৃষ্টিবঙ্গি ও ব‍্যবহারের পরিবর্তন হলে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস অন‍্য খাতে বইত। এই ব‍্যক্তি পুজনের বিরুদ্ধে যখন ব‍্যক্তি বিশেষের প্রতিবাদ সফল হয়, তখন নতুন নেতার ব‍্যক্তি পুজন শুরু হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ‍্যেই নতুন নেতার ব‍্যক্তি পুজনের নানা ঘটনা আমরা প্রত‍্যক্ষ করি। জিন্নার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারত, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর পাকিস্তানের নেতা হওয়ার পিছনে যে ধর্মীয় মৌলবাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল; সেই শক্তিই তাঁর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে গেল। জিন্না অবশ‍্য তাঁর অকালমৃত‍্যুর কারনে এই লড়াই চালানোর সুযোগ পাননি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের অস্তিত্ব দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে – যে দুটির অবদানও জিন্নার। একটি হল ধর্মীয় মৌলবাদ ও অন‍্যটি তীব্র, বিজাতীয় ভারত বিদ্বেষ। যেহেতু ভারতবর্ষ ভেঙ্গে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অন‍্য কোন নীতিতে রাষ্ট্র চালিত হওয়ার কথা নয়। তবে, প্রাক্তন পূর্বপাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ যখন ভারতের প্রত‍্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাধীন হয়, তখন সেটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ‘ নামে আত্মপ্রকাশ করলেও এই উপমহাদেশের ইসলামী শাসনধারার সঙ্গে সামঞ্জস‍্য রেখে রক্তক্ষয়ী ব‍্যক্তিহত‍্যা ও মৌলবী প্রাধান‍্যের ইসলামী গনতন্ত্রে (!) পরিণত হয়। সেখানে গোঁড়া, অসহিষ্ণু ইসলামী মতবাদের সঙ্গে সহনশীল তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় সংখ‍্যালঘুদের স্বার্থ দেখার চেষ্টাও করা হয়। এই কারনে ইসলামী নীতির আলগা প্রয়োগ করা বাংলাদেশে ব‍্যক্তি পুজনের রাজনীতি গভীরভাবে দাগ কাটতে পারেনি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে তাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে এখনকার শেখ হাসিনা অব্দি যে যখন ক্ষমতার শীর্ষে থেকেছেন, তাঁর দলবল সর্বদা এই ব‍্যক্তি পুজনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
এবার আসি আমাদের ভারতের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কথায়। জওহরলাল তাঁর ১৯৫১-৫২ সালের জয়লাভের পরে পরেই স্তাবকবাহিনীর একটি বড় অংশকে মন্ত্রীত্বসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন। এর প্রথম উদ্দেশ‍্য হয়ত মন্ত্রীসভা ও প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রীর আনুগত‍্য নিশ্চিত করা। তবে একাজ করতে গিয়ে যোগ‍্যতার বদলে ব‍্যক্তি আনুগত‍্যের উপরে বেশী জোর দেওয়া হয়। তার ফলে ঐ ক্ষমতাশালী মানুষজন তাঁদের ক্ষমতার মধুভান্ড বহাল রাখার জন‍্য প্রধানমন্ত্রীর তৈলমর্দন অবশ‍্য ও একমাত্র কর্তব্য মনে করেন। এভাবে জওহরলালের প্রধানমন্ত্রীত্বের বিশেষ করে শেষ দশ বছর ভারতের রাজনীতিতে চাটুকারিতা এবং ব‍্যক্তি পুজন এক নতুন মাত্রা পায়। সেই শুরু। তারপর লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্বল্প সময়ে পাক
সঙ্গে যুদ্ধ সামলে তাসখন্দে তাঁর আকস্মিক মৃত‍্যু – এছাড়া বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ও অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকারের বাধ‍্যবাধকতায় এই ব‍্যক্তি পুজনের রাজনীতি তার উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর দুই পর্যায়ে এবং রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বে এই ব‍্যক্তি পুজন এমন এক মাত্রা পেল যে পুরো শাসক দলের মালিকানা চলে গেল একটি পরিবারের হাতে! এই সময় ভারতের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে রমরমা শুরু হল, তা এখনো পুরোপুরি চলছে। বিভিন্ন রাজ‍্যে প্রাদেশিক সুলতানের মত ব‍্যক্তি পুজনের মাধ‍্যমে নেতা তাঁর পরিবারকে রাজনীতির মধ‍্যে এনে উত্তরাধিকারকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কোথাও স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে আবার সেসব না থাকলে জামাই বা ভাইপো – মোদ্দাকথা হল রাজনীতির ক্ষমতা ও অর্থ পারিবারিকভাবে কুক্ষিগত করা ‘জনসেবা’র মোক্ষ উদ্দেশ‍্য! নেতা বা নেত্রীর বড় বড় কাটআউটকে সাধারন মানুষের কাছে বাবা, মা বা দিদি হিসাবে দেখানো ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান রূপ। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় বা রাজ‍্যের সরকারগুলির যেখানে পরিবারতন্ত্রের শাসন (অবশ‍্যই গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ‍্যে) নেই, সেখানেও এই ব‍্যক্তি পুজনের চরিত্র পুরোপুরি বর্তমান। ছোট ছোট বৈশিষ্ট উল্লেখ করা যেতে পারে। নেতা বা নেত্রীর জন্মদিনে শুধু সংবাদ মাধ‍্যমগুলিতেই নয়, সামাজিক মাধ‍্যমেও দলের বিভিন্ন পদাধিকারী – এমনকি মন্ত্রী মহোদয় বা মহোদয়া অত‍্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে মন্ত্রীসভার প্রধান ও অন‍্যান‍্য প্রভাবশালীদের এমনভাবে বন্দনা করেন যে, সুস্থ চেতনা সম্পন্ন মানুষজনের মনে হবে নিম্নমানের তৈলমর্দন-প্রতিযোগীতা হচ্ছে! গণতন্ত্রে জনগনের সেবার জন‍্য নির্বাচিত মানুষজন যদি তাদের নৃতৃত্বকে এমনভাবে তোল্লা দেন তাহলে নেতৃত্বের মনে হতেই পারে যে তারা জনগনের সেবক নন – জনগনের মসিহি বা ভগবানের অবতার হিসেবে তারা জনগনের সেবা পাওয়ার হকদার।
এইভাবে আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতির একটটি ধারা তৈরী হয়েছে। এখানে মানুষ ভোট দিয়ে মানুষের সেবার জন‍্য যাদের নির্বাচিত করেন, তাদের গণতান্ত্রিক নিয়মকানুনের মধ‍্যেই তৈরী হওয়া একনায়কতন্ত্রী কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের তথা সমাজের উন্নয়নের পরিপন্থী হয়। এর প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে প্রশাসন ও মন্ত্রীত্বে এবং অন‍্যান‍্য ক্ষমতাশালী পদের জন‍্য চয়নের মাপকাঠি হল চাটুকারীতার ক্ষমতা – তাদের পদের জন‍্য যোগ‍্যতা কোন নির্নায়ক বিষয় নয়। এর ফলে সমস্ত জায়গায় অযোগ‍্য মানুষের ভিড়! আবার আমলাদের কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ফলে এবং অযোগ‍্য নিয়োগে প্রশাসনের কর্মদক্ষতা প্রশ্নের মুখে। এভাবে কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয় স্তরেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার সৈরাচারী রূপ ধারন করে – তার বিরুদ্ধে স্বজনপোষন, দুর্ণীতি ও খুনখারাবি সহ বিভিন্ন অভিযোগ আসে। ক্ষমতায় থাকার সময় বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুর্ণীতি ও অত‍্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তখন স্বৈরাচারী, ব‍্যক্তিপুজনে অভ‍্যস্ত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের টেকনিক পাল্টায়। এই টেকনিক পাল্টানোর ব‍্যপার বামফ্রন্টের পরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল দল, বিশেষতঃ, তাদের সুপ্রিমো মমতাদেবী অত‍্যন্ত সুচারু দক্ষতায় সম্পন্ন করার ক্ষমতা রাখেন। দীর্ঘ সময়ের দুর্ণীতি ও অপশাসনের নিষ্পেষনে সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হয়েছে তাবুঝে নিয়ে তিনি কল‍্যানকর একনায়কতন্ত্রের (benevolent dictatorship) একটি উৎকৃষ্ট নমুনা পেশ করেন। যেহেতু মানুষের কর্মসংস্থান ও অন্নসংস্থান অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন, মমতাদেবী বিভন্ন রকমের কল‍্যানকর প্রকল্পের নামে মানুষকে সরাসরি সরকারি অনুদান দিয়ে শুধু মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বন্ধ করলেন তাই নয়, মানুষের কাছে তাঁর ইমেজ যথেষ্ট বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলেন। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাজেটের দিকে তাকিয়ে দেখলে এই ব‍্যপারটা পরিষ্কার হয়। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট থেকে ধরে সমস্ত রকমের উন্নয়ন বন্ধ। এমনকি পরিকল্পনাখাতে অনেক প্রজেক্ট কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের পরেও রাজ‍্যসরকার ম‍্যাচিং গ্র‍্যান্টের লায়াবিলিটি নেওয়ার অপারগতায় বন্ধ বা ধুঁকছে। এর ফলে পরিকল্পনা বহির্ভূতখাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি বিভিন্ন নামের অনুদান প্রকল্পে দান খয়রাতি করে ভোট কিনে নিজের জনপ্রিয়তা এক অনন‍্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হলেন। কন‍্যাশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থসাথী থেকে হালের স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড, লক্ষ্মীর ভান্ডার, বার্ধক‍্যভাতা এর সাক্ষ‍্য বহন করছে। আর এইসব করতে গিয়ে তিনি সরকার ও সরকার পোষিত বিভিন্ন সংস্থায় পুরো সময়ের নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে সেখানে অ‍্যাডহক ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে প্ল‍্যান্ড এক্সপেন্ডিচার থেকে এই টাকা সরিয়ে নিয়ে আনপ্ল‍্যান্ড এক্সপেন্ডিচারে নিয়ে গিয়ে অনুদানের বহর বাড়িয়ে নিজের তথা দলের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে চলেছেন।
কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের রাজ‍্য নেতারা এসবের সমালোচনা সমালোচনা করলেও তার কোন প্রভাব জনমানসে পড়ছেনা। কেন? কারন মমতাদেবীর অনুদান বিলানো যেমন সংবাদমাধ‍্যমে ব‍্যপক প্রচার পাচ্ছে, তেমনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনুদান নীতি দেখে মনে হয় তারা যেন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অনুদান প্রতিযোগীতায় নেমেছে! মমতাদেবী যদি ব‍্যক্তিপুজনের রাজ‍্যস্তরের উদাহরণ হন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে সেটাও নিঃসন্দেহে ব‍্যক্তিপুজন। এক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ণ যে ব‍্যহত হচ্ছে তাই নয়; দেশের অর্থনীতিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – মূল‍্যবৃদ্ধি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। উজালা গ‍্যাসের ভর্তুকির টাকা গুনতে গিয়ে মধ‍্যবিত্তের রান্নার গ‍্যাসের মাসিক খরচ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। অনুৎপাদক বিলাসিতায় সেই কল‍্যানকর একনায়কতন্ত্রের মধ‍্যে নিজের image building এ মেতে দেশের প্রধানমন্ত্রীও এক অঙ্গরাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন – আপাতদৃষ্টিতে এটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু না, বিষয়টা খতিয়ে পর্যালোচনা করলে ব‍্যপার পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ভারতীয় রাজনীতির ধারা অনুযায়ী প্রত‍্যেক ক্ষমতাসীন রাজনীতিক চান তাঁর কুর্সীর উপর দখলদারি অক্ষয় হোক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ণীতি ও অপশাসন দেশের সরকারি প্রশাসনের অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হওয়ায় জনগণের মনে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। রাস্তায় কান পাতলে রাজনৈতিক সাধারণ মানষের কাছ থেকে যা শোনা যায় তার নির্গলিতার্থ অর্থ হল, “যেই যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ”! এই ক্ষোভ যাতে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চতম নেতৃত্বকে স্পর্শ করতে না পারে, তার জন‍্য সুচারুভাবে তাদের ইমেজ বিল্ডিং করা হয় – এতে পেইড সংবাদ মাধ‍্যমগুলিও প্রভূত সাহায‍্য করে। ফলে, সরকারের সর্বাধিনায়ক বা সর্বাধিনায়িকাকে প্রায় দেব-দেবীর পর্যায়ে উন্নীত করে ব‍্যক্তিপুজন শুরু হয়। কিন্তু শুধু কথায় ত আর চিঁড়ে ভেজে না। তখন শুরু হয় ‘অনুদান’ নামক সরকারি অর্থ বালানো। এই কাজে কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয় সরকারের শীর্ষস্থানীয়দের একই রকম স্বার্থ জড়িত থাকায় তাঁরা একে অন‍্যকে মানিয়ে চলেন! কখনোই এক নেতা অন‍্য নেতাকে রাজনৈতিকভাবে ‘খতম’ করেন না। ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে এই ‘সেটআপ’ কায়েম থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। আর রাজনীতিতে নেতৃত্বের পথ সুরক্ষিত করতে বলিপ্রদত্ত রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। যেদিন দেশ ও রাষ্ট্র এই ধরনের কুটিল, নেতৃ-স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে জনগনদ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, সেদিন আমাদের রাজনৈতিক সুদিন আসবে।

ভারত টীকাকরনে সাফল‍্যের শিখরে

পৃথিবীর দ্রুততম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দেশ আমাদের ভারত। একশ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে কোভিডের টীকাকরন চালানো যে কতটা দুরূহ তা WHOর প্রতিবেদনেও পরিষ্কার। নভেম্বর, ২০২১এর শুরুতে, এখনো পর্যন্ত সরকারী পরিসংখ‍্যান অনুযায়ী দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ‍্যে ত্রিশ কোটি মানুষের টীকাকরনের দুটি ডোজ হয়ে গিয়েছে। তাঁরা টীকাকরন সমাপ্ত হওয়ার শংসাপত্র পযর্ন্ত পেয়ে গিয়েছেন। এই সংখ‍্যাটি মোট টীকাকরনযোগ‍্য মানুষের ৩০%। এছাড়া দেশের সত্তরকোটি মানুষ টীকাকরন প্রক্রিয়ার মধ‍্যে আছেন। অর্থাৎ তাঁদের দুটি ডোজের প্রথম ডোজ পাওয়া হয়ে গেছে; এখন দ্বিতীয় ডোজের প্রতিক্ষায়। তাহলে আগামী নব্বই দিনের মধ‍্যে এদের সবার পূর্ণ টীকাকরন হয়ে যাবে। অর্থাৎ, শুধু যে একশকোটি মানুষের টীকাকরন হয়ে গেছে তাই নয় – আগামী জানুয়ারী মাসের মধ‍্যে দেশের ৭০% মানুষের টীকাকরন সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এতে সময় লাগছে এক বছরের কাছাকাছি। অনেক তথাকথিত ‘বোদ্ধা’ বলেছিলেন যে ভারতে নাকি আগামী দশ বছরেও টীকাকরনের লক্ষ‍্যমাত্রা পূরণ করা যাবে না! প্রশাসনিক তৎপরতা, বিশেষতঃ আমাদের ভারতীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কঠোর তত্ত্বাবধানে এই কাজ করার জন‍্য সরকারকে অসংখ‍্য ধন‍্যবাদ। রাজনীতি বাদ দিয়ে, WHO কিন্তু ভারতে টীকাকরন কর্মসূচীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
ভারতের মত বিশাল, বিভিন্ন ভাষা-ভাষী, ঐতিহ্য ও রাজনীতি সচেতন দেশে টীকাকরনের ক্ষেত্রে অসংখ‍্য বাধা আসার কথা – আর অবধারিতভাবে তা এসেছেও। আমাদের দেশের বিরোধী রাজনীতি – বিশেষতঃ ইন্দিরা-উত্তর জমানায় – ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। কান্ডজ্ঞানহীণ বিরোধীতায় সর্বদা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টীকাকরন তার ব‍্যতিক্রম নয়। টীকাকরনে সরকারী প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার বদলে অনেক রাজনৈতিক নেতা টীকাকরনের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন করতে শুরু করেন! টীকাকরন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি উল্লেখযোগ্য স্তর। কখনো কেউ বলেনি যে টীকাকরন হলেই আর কোভিড সংক্রমণ হবেনা। এই নিয়ে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির অপচেষ্টাকে রুখতে অযথা শক্তিব‍্যয় হয়েছে। এরপর আছে টীকাকরনের বিপুল খরচ। ইউরোপ, আমেরিকায়, এমনকি এশিয়ার উন্নত দেশগুলির কোথাও নিখরচায় টীকা দেওয়া হয়নি। হ‍্যাঁ, অনেকক্ষেত্রেই সরকারী ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে শুধুযে ভর্তুকিতে টীকাকরন প্রক্রিয়ার বিপুল কর্মযজ্ঞ সাধিত হচ্ছে তাই নয়, দেশের বিপুল সংখ‍্যক জনগণের এক বড় অংশকে নিখরচায় টীকা দেওয়া হচ্ছে। এই বিপুল ব‍্যয়ভার দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে বাধ‍্য। সরকারকে ধন‍্যবাদ যে, সরকার সেই ব‍্যয়ভার বহন করছে। পৃথিবীতে আর একটিও এমন দেশ নেই যেখানে এত বিশাল সংখ‍্যার মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল‍্যে টীকা দেওয়া হয়েছে – কোন কম‍্যুনিষ্ট দেশ ত নয়ই! এটা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারত কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়নামারের মত ফ্রিতে বিদেশ থেকে টীকা উপহার পায়নি। ভারতে ব‍্যবহৃত টীকা আমাদের দেশের দুটি কোম্পানি তৈরী করেছে। এই টীকা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে তারা আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারকে স্ফীত করেছে। ভারতের দুটি টীকাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
রাজনৈতিক বিরোধীতার নামে যারা ভারত বিরোধীতায় মেতে উঠে চীনের টীকাকরনের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের বিরোধীতা করে, তাদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি তথ‍্য জানানো যাক। পাঁচটি চীনা টীকা বাজারে আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র পেয়েছে। সবচেয়ে বেশী ব‍্যবহৃত সরকারী মালিকানার কোম্পানি sinopharmএর coronavac। তাদের পাঁচটি টীকার কার্যকারিতা (efficacy) ৫০% থেকে ৭০% এর আশেপাশে। আমাদের ভারতের দুটি টীকাই তুলনায় অনেক বেশী কার্যকারিতার মাণ‍্যতা পেয়েছে। সেজন‍্য চীনের টীকার তুলনায় ভারতের টীকার রপ্তানির রেকর্ড ভালো। এমনকি রাশিয়ার টীকা স্পুটনিকের তুলনায় ভারতের দুটি টীকার কার্যকারিতাই অনেক ভালো। রাশিয়া কিন্তু তার সব নাগরিককে নিখরচায় টীকা দেয়নি। চীনের স্থানীয় প্রশাসনগুলি প্রথমে বিভিন্ন রকম পরিষেবার ফি নিয়ে টীকাকরন শুরু করেছিল। তারপর চীন সরকার পরবর্তী সময়ে এই টীকা বিনিমূল‍্যে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা বিনামূল‍্যে সরকারী কোম্পানি sinopharmএর টীকা দিচ্ছে। ভারত বা অন‍্যান‍্য দেশে সরকারী মালিকানার সংস্থায় এই টীকা তৈরী হয়না। তাই অন‍্য কোন দেশ নিঃশুল্ক টীকাকরন করতে পারে না। চীনের এই টীকার গবেষণা, উৎপাদন ও পরিবহনের খরচ সরকার দিলেও কোভিড সেসের মাধ‍্যমে চীন এই অর্থ জনসাধারণের থেকেই তুলেছে। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। বাংলাদেশ, বাহারিন ও UAE প্রথমে চীনা টীকা আমদানি করলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বব‍্যপী সন্দেহের বাতাবরন ও কর্মক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় এই দেশগুলিও এখন ভারতীয়, আমেরিকান বা ইউরোপীয় টীকার দিকে ঝুঁকেছে। তুরষ্ক, ব্রাজিল ও চিলি প্রথমে বরাত দিলেও এখন আর চীনা টীকা আমদানী করছেনা। এর সবচেয়ে বড় কারন, চীনা টীকার গবেষনালব্ধ ফল প্রকাশের অস্বচ্ছতা ও তার কার্যকারিতা কম হওয়া।
এত সব সত্ত্বেও চীন এবং ভারত দুটি দেশই তার নাগরিকদের মধ‍্যে একশকোটিকে টীকাকরনের আওতায় এনেছে। এর মধ‍্যে ভারতের শতকরা হিসেবে ও টীকার কার্যকারিতায় আমরা অনেক এগিয়ে। একটা ছোট ঘটনার উল্লেখ করছি। পাকিস্তানকে চীন ও ভারত উভয় দেশই মানবিক কালনে তাদের নিজেদের দেশে প্রস্তুত টীকা পাঠায়। এর মধ‍্যে ভারতে প্রস্তুত টীকার পুরোটা পাকিস্তান ব‍্যবহার করলেও চীনের পাঠানো টীকার পুরো কোটা তারা ব‍্যবহার করেনি। রাজনীতি অন‍্য ব‍্যপার। কিন্তু এর থেকে এটা পরিস্কার যে টীকার বিশ্বাসযোগ‍্যতায় চীনা টীকাকে ভারতীয় টীকা ছাপিয়ে গেছে।
এবার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক। যেহেতু আমাদের দেশের নাগরিকদের ৭০%এর টীকাকরন ২০২২ সালের প্রথমদিকেই সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আমাদের মধ‍্যে herd immunity তৈরী শুরু হয়েছে। এটা অত‍্যন্ত খুশীর খবর। দেশের ক্রমহ্রসমান আক্রান্তের সংখ‍্যা এই তথ‍্যকেই সমর্থন করে।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। চীন আমাদের দু মাস আগে টীকাকরন শুরু করেও ভারতের আগে এগিয়ে থাকতে পারেনি। এর কৃতিত্ব সাধারন নাগরিক, স্বাস্থ‍্যকর্মী, সরকারী প্রশাসন থেকে ধরে প্রশাসনিকস্তরের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনকারীদের উপর বর্তায়। রাছনৈতিক বিরোধীতা করার নামে টীকাকরনের বিরোধীতা কিন্তু দেশের মানুষের স্বাস্থ‍্য-সুরক্ষার বিরোধিতা করা। কারন, টীকাকরনের বিপুল কর্মযজ্ঞে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে স্থানীয় স্তর, সকলের ঐকান্তিক সহযোগীতাতেই এই সাফল‍্য এসেছে। পরিকল্পনা ও তার সফল রূপায়নের জন‍্য তাঁদের সকলের ধন‍্যবাদ প্রাপ‍্য।
অনেক রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের মন যুগিয়ে চলা সংবাদপত্র দাবী তুলেছিল যে সব নাগরিকদের বিনামূল‍্যে টীকা দিতে হবে! এ কিভাবে সম্ভব? সরকারকে টীকা কিনতে হচ্ছে। তারপর টীকাকরনের আনুষঙ্গিক খরচ, পরিবহনের খরচ – এইসব সরকারকেই দিতে হবে! এই টাকা সরকারের কাছে আসবে কোথা থেকে? যেজন‍্য কোন দেশই বিনামূল‍্যে সম্পূর্ণ টীকাকরন করতে পারেনি। কিন্তু ভারত সরকার ফেশ কিছু টীকা বিনামূল‍্যে দিয়েছে এবং যথারীতি সেই খরচের চাপ সরকারী কোষাগারের উপর পড়েছে। এটাই নিয়ম। চীনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তারা ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’র মত নীতিতে ‘বিনা পয়সায় টীকা’ দিয়েছে। তবুও বলব, আমাদের দেশে অত‍্যন্ত কম টাকায় টীকা দেওয়া হয়েছে। আমি প্রথম ডোজ ২৫০ টাকা ও দ্বিতীয় ডোজ ৭৮০ টাকার বিনিময়ে পেয়েছি। অথচ আমেরিকায় টীকার নূন‍্যতম মূল‍্য ৬ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৪৮০ টাকা – সঙ্গে টীকা দেওয়ার খরচ। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার টাকা। আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের সঠিক পরিকল্পনার সুফল আমরা পেয়েছি। যে দুটি সংস্থা আমাদের দেশে টীকা তৈরী করছে – কোভিশিল্ড ও কোভ‍্যাকসিন – ভারত সরকার তাদের বিভিন্ন সুবিধে দিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ভর্তুকিমূল‍্যে কিনে বিভিন্ন রাজ‍্যসরকারের মারফৎ সরবরাহ করায় এত সুলভ মূল‍্যে টীকা পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের ছনসংখ‍্যার কথা মাথায় রেখে বলতে হয় যে এত বিপুল পরিমান ভর্তুকি আর কোন দেশকে দিতে হয়নি। এই সুবিশাল কর্মকান্ডের পরিকল্পনা ও তার সফল রূপায়ণ যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
পরিশেষে জানাই, এবাবে চললে আমরা দুবছরের (যা শুরুতে সংখ‍্যাতত্ত্বের বিচারে নূন‍্যতম মনে হয়েছিল) অনেক কম সময়ে আমাদের দেশের কোভিড টীকাকরন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারব।