কোভিড-১৯ আবার পশ্চিমবঙ্গের উপর থাবা বসিয়েছে – এটাই সংবাদমাধ্যমগুলি তারস্বরে প্রচার করছে। যেটা তারা বলছে তা এতটাই অর্ধসত্য যে, তাদের বক্তব্যে এর কারন শুধু নয়, রোগের বর্তমান ভয়াবহতাটিও সঠিকভাবে প্রতিভাত হচ্ছেনা। আমরা অনেক আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিলাম দূর্গাপুজোর আগে এবং পুজোর মধ্যে বাজার, দোকান, রেঁস্তোরায় ভিড় ও পুজোর মধ্যে ঠাকুর দেখার ব্যপারে সংযমী না হলে, রাজ্যে পুজো পরবর্তী অতিমারী পরিস্থিতি রাজ্যের আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। পরিসংখ্যান সেই বক্তব্যকেই সন্দেহাতীতভাবে সমর্থন করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সতর্কতামূলক চিঠি থেকেই তা পরিষ্কার। গত এক সপ্তাহে শুধু কোলকাতায় আক্রান্তের হার ২৭% বেড়েছে। এক্ষেত্রে শতকরা হিসেব ছাড়া শুধু সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করা যাবে না। কারন, পুজোর সময় থেকে রাজ্যে কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে! ফলে, আক্রান্তের সংখ্যার বিচারে সংক্রমনের ভয়াবহতা ধরা পড়ছে ঙনা! শতকরা হিসেবে গত পনেরো দিনে রাজ্যে প্রায় ৩০% আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য-সচিব রাজেশভূষণ পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত একমাসে এই রাজ্যে ২০,৯৩৬ জন নতুন আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪৩ জনের এই সময়ে অতিমারীতে মৃত্যু হয়েছে। এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারন ইতিমধ্যে উৎসব মুডে রাজ্যসরকার কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
যা সবচেয়ে খারাপ লাগে তা হল স্বাস্থ্য বিভাগের সচেতনতার অভাব – তা সে রাজনৈতিক বা অন্য কোন কারনে হোক না কেন। এই রাজ্যে শুধু কোভিড সংক্রান্ত কমিটি তৈরী হয়েছে – কিসের “অনুপ্রেরনায়” বা যুক্তিতে তা কেউ জানে না। এখানে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিষ্ট, হার্ট সার্জেনরা সব বিশেষজ্ঞ কোভিড ম্যানেজমেন্টে; সঙ্গে সর্ব ঘটে কাঠালী কলার মত IAS রা ও আছেন। ফলে এই বিশেষজ্ঞ কমিটির কার্যকারিতা বিশেষ চোখে পড়ে না। এ রাজ্যের কোভিড রোগীদের ভরসা হাসপাতালের ফ্রন্টলাইন ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদের ম্যানেজমেন্ট ও রোগীদের নিজস্ব ইমিউনিটি। আগে একাধিকবার সতর্ক করে বিভিন্ন লেখায় জানিয়েছিলাম যে, কোভিড-১৯এর কারন RNA ভাইরাস হওয়ায়, এই ভাইরাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত জিন মিউটেশান করে। সেকারনে যে গবেষণার উপর ভিত্তি করে আজ তার প্রতিষেধক টীকা দেওয়া হচ্ছে, কাল সেই টীকা পরিবর্তিত ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাসের জন্য কার্যকরী নাও হতে পারে। ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট এখন এই রাজ্যে সর্বাধিক। এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক,তা কোভ্যাক্সিন, কোভিশিল্ড, মডার্না বা ফাইজার – যা ই হোক না কেন, কতটা কার্যকরী – সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকেই। এই বক্তব্যই এখন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। কোভিডে আক্রান্তের শতকরা কত ভাগের মৃত্যু হচ্ছে – সেই হিসেব থেকে সহজ পদ্ধতিতে কোভিড ম্যানেজমেন্টের দক্ষতার হিসেব পাওয়া যেতে পারে। কোমর্বিডিটি, মর্বিডিটি, প্রিডিজিস – এসব তথ্য আমার মতে data fudging মাত্র। ওয়ার্লডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে কোভিডে আক্রান্তের মধ্যে ২.০২৯% এর মৃত্যু হয়েছে। ভারতে কিন্তু সেটা ১.৩৩%। আবার এখানে পশ্চিমবঙ্গের হিসেবে আক্রান্তের ২.০৩% এর মৃত্যু হয়েছে। এই তথ্য নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের কোভিড ম্যানেজমেন্টের বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং স্বাস্ত্য দপ্তরের উৎকর্ষতা প্রমাণ করে না। আমাদের দায়িত্ব সরকারকে সচেতন করা, সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষদের সঠিক পথ দেখানো, কোন রাজনীতি করা নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একথা বলতে হচ্ছে যে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পেইড মিডিয়ার মত আচরন করে রাজ্যের মানুষকে বিপদে ফেলছে। কিভাবে? বলছি।
প্রথমতঃ, রাজ্যে তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আমরা বারবার সাধারণ মানুষকে সতর্ক করেছি ; মূখ্যমন্ত্রী নিজে বর্ধিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঘোষণা করেছেন। সবই ভালো। কিন্তু উৎসবের প্রাক্কালে এইসব সংবাদমাধ্যমগুলি তাদের সংবাদ ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ছাড়, ফ্যশান,ও আরো প্রমোদ উপকরণ, রেষ্টুরেন্টের তত্ব-তালাশ – সঙ্গে আকর্ষনের জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপন – সব মিলিয়ে যত রকমভাবে সম্ভব, মানুষের মধ্যে আকাঙ্খা ও চাহিদা তৈরী করা হল। এরা সংযমের বুলি আউরে মানুষকে রাস্তায় নামতে প্রলুব্ধ করল। সংবাদমাধ্যমগুলি বিজ্ঞাপন ও বিক্রির লোভে এ কাজে ইন্ধন যোগালো। ফলে, আমজনতার ঢল নামল – রাস্থাঘাট, যানবাহন, রেষ্টুরেন্ট শপিংমল, বাজার – সঙ্গে থুতনি-মাস্ক বা মাস্কবিহীন বিচরণ। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের বালাই নেই। সব ভিড়েভিরাক্কার। এদিকে উৎসবেয হাওয়া তুলে বিভিন্ন পুজোকমিটিগুলিকে ভিড় নিয়ন্ত্রনের আওতায় নিয়ে আসা হল। এতে লাভ ত হলই না, ক্ষতি হল সাংঘাতিক। আমার বাড়ি বিধাননগরের অন্যতম বড় একটি পুজোমন্ডপের ঠিক পাশে। পুজো শুরুর আগে হাইপ তোলার কায়দায় এই পুজোর থিম’, মন্ডপ-ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম,কোলকাতার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যনেলগুলি রিপোর্টিং শুরু করল। এমন অনেক পুজোয় এভাবে ঠাকুর দর্শনের ক্রেজ তৈরী করা হল! দূর্গাপুজোর প্রথমদিকেই বেশ কিছু তথাকথিত বড় পুরস্কারের (বিশ্ববাংলা সহ) বণ্যায় এই পুজো ভাসল! পঞ্চমী থেকে দুরে দাঁড়িয়ে ঠাকুর ও মন্ডপ দর্শন করে বেড়িয়ে যাবার রাস্তায় হরেক খাবার ও আইসক্রিম, ফুচকার দোকানের সামনে প্রতিদিন সন্ধে থেকে লক্ষাধিক মানুষের আনাগোনা। শতাধিক গাড়ি, অটোরিক্সা, রিক্সা, মোটরসাইকেল – বিনা ঠেলাঠেলিতে মানুষের হেঁটে যাওয়ার পথ বন্ধ। এদিকে সংবাদমাধ্যম ঠাকুরের আর্ট (!) ও তার গুণকীর্তনে ব্যস্ত! এই সময় অল্পসংখ্যক মানুষের মুখে মাস্ক থাকলেও এই ভিড়ে তা কতটা কার্যকরী তাতে সন্দেহ আছে। অন্ততঃ অর্ধেক দর্শনার্থীর মাস্কের বালাই নেই, থুতনি-মাস্কের কথা আর বললাম না! এছাড়া খাওয়া দাওয়া, ফটো ও সেলফি তোলার সময় মাস্ক ত কোন ছার, হাত স্যনিটাইজেশানের কোন ব্যপার নেই। শুধু একটি বড় পুজো – তাও বিধাননগরের – তার হিসেবই এই – ত কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে কি হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। এর ফল এখন ফলতে শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যভগুলি নিজেদের অর্থনৈতিক মুনাফার স্বার্থে একাজ করেছে,এতে সন্দেহ নেই। এই ধরনের প্রচারকে সরকারের শক্ত হাতে মোকাবিলা করা উচিৎ ছিল। দেখা যাক, সামনে দীপাবলী, ভাইফোঁটা, ছটপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজো (বিশেষতঃ চন্দননগর ও নদীয়ায়) এই সময় সরকার কিভাবে সামলায়।
এবার বলি, অনেকে এক বা দুটি টীকা নিয়েই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে তাঁদের আর কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কা নেই, তাঁরা যতই প্রোটোকল অমান্য করুন, তাঁদের আর কোভিড কিছু করতে পারবে না! অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এই বিশ্বাস জন্মেছে! তাঁরা ঠিকমত মাস্ক ব্যবহার করছেন না।, রাস্তায় ধূমপান থেকে থুতু ফেলা – সবই চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা যদি অ্যাসিমটোম্যাটিক পজিটিভ হন, তবে তার ফল মারাত্মক। আমাদের স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের পিএইচডির ছাত্র, আমার ভ্রাতৃসম একটি ছেলে এবং তার স্ত্রীযাদের গত মার্চ মাসে টীকাকরনের দ্বিতীয় ডোজ হয়ে গিয়েছে, উভয়েরই অতি সম্প্রতি কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট হয়েছে। অন্য একটি ঘটনা – এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যঙ্ক অফিসারের স্ত্রী – বরিষ্ট নাগরিক – গত মার্চেই টীকার দ্বিতীয় ডোজ নেন, পুজোর আগেই কোভিডে আক্রান্ত হন এবং পুজোর পর তাঁর মৃত্যু হয়। এখন এমন অনেক উদাহরণ আসছে যাদের দ্বিতীয় ডোজ টীকাকরন শেষ হওয়ার পরেও তাঁরা কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন! আসলে এটাই স্বাভাবিক। ‘সুখবর’ কাগজে আগেও লিখেছি যে টীকাকরনের ফলে যে ইমিউনিটি তৈরী হয়, তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যকরী থাকে। এই সময়টাও নির্ভর করে আমাদের দেহের ব্যক্তিগত ইমিউনিটি ও সাইটোকাইন মুভমেন্টের কার্যক্ষমতার উপর। ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে। এছাড়া, changed gene mutationএর কথা আগেই বলেছি। সুতরাং টীকাকরন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোভিডের বিরুদ্ধে একটা স্তর অতিক্রম করা মাত্র – তার বেশী কিছু নয়।
এদিকে এই মূহুর্তে রাজ্যের অর্থনীতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেখানে লকডাউনের মত বড় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। আবার যার দোষেই হোকনা কেন, সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খোলার ব্যপারে অনেক আগেই যত্নবান হওয়া উচিৎ ছিল। পরীক্ষার নামে গত বছর যা হয়েছে তাকে বোধহয় ধ্যাষ্টামো বললেও কম বলা হয়। ফলশ্রুতি – একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান চাকরীর বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে যে ২০২০সালে পাশ করা কোন ছাত্র যাতে আবেদন না করে! আইনত সরকার কিছুই করতে পারেনা। আসলে ভুল সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা-প্রক্রিয়ার উপরেই মানুষের বিশ্বাস টলে গেছে। যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষদের বাধ্য করা যেত যে, ২০২০তে পাশ করা ডাক্তারদের দিয়েই তাদের চিকিৎসা করাতে হবে ;আর তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার জন্য শুধু ২০২০র পাশ করাদের নিয়োগ করতে হবে – তাহলে এই অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষদের উপযুক্ত শিক্ষা হত! ভাবা যায়, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জৈববিজ্ঞান, শারীরবিদ্যার মত ল্যাবোরেটরী নির্ভর বিষয়ে কোন ল্যাবোরেটরী ওয়ার্ক ছাড়াই ডিগ্রি দেওয়া হল! ডাক্তারী ডিগ্রিও অনলাইনের ক্লাশ করে পাওয়া গেলে ব্যপারটা ডিসট্যান্স এডুকেশানের মত হল না?
এই কারনে ইউরোপ ও আমেরিকায় শুধু উচ্চশিক্ষা ও টেকনিক্যাল শিক্ষাই নয়, সাপ্লাই লাইন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য কিন্ডারগার্টেন থেকে সমস্ত স্কুলশিক্ষাও খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। এখানকার মত ‘ডিগ্রি বিলানো’ হয়নি। আমার এক নাতনি আমেরিকাতে স্কুলে পড়ে – ফার্স্ট স্ট্যন্ডার্ড।সেখানে অনেকদিন আগে থেকেই শিশুদের পুরোদমে ক্লাশ চলছে। সেখানকার শিশুদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়নি। তাহলে? আসলে পুরো জিনিষটাই মানসিকতা। আমাদের রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রশাসক এমনকি জআমজনতা পর্যন্ত চেষ্টা করছে – এলোমেলো করে দে মা লুঠেপুটে খাই। পাওয়ার উইদাউট রেস্পন্সিবিলিটি আমাদের প্রশাসনকে এমন করে তুলেছে।
এখানেই আমাদের খামতি আর ঐসব দেশের সার্থকতা। আমাদের মত ধাপ্পাবাজীর লোকদেখানো স্যানিটেশান আর মাস্ক, সেইসঙ্গে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের নামে ধ্যাষ্টামো সেখানে নেই। প্রথমদিকে ঐসব দেশের অনেক মানুষ সঠিকভাবে প্রোটোকল না মানায় যথেষ্ট ভুগেছে। তারা সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু আমরা ঠেকেও শিখিনি। তার ফল ভুগছি। গত এক মাসে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের তুলনায় মৃতের শতকরা হিসেব ৩% এর উপর। এটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এর দায়ভার সম্পূর্ণভাবে অসৎ ও লোভী সংবাদমাধ্যম দ্বারা প্ররোচিত আমজনতার উৎকট উল্লাসের চাহিদা। এক্ষেত্রে সরকারের যা করণীয় তা হল লকডাউনের রাস্তায় না হেঁটে শক্ত হাতে মানুষকে কোভিড প্রোটোকল মানতে বাধ্য করানো। অসামাজিক ও অসংযত আচরণ করে মানুষ সরকারের উপর অতিমারীর সংক্রমণ বৃদ্ধির দায় চাপাতে পারে না। নতুন করে শুরু করতে যাওয়া লোকাল ট্রেণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে কোভিড প্রটোকল কঠোরভাবে মানানো আশু প্রয়োজন। রাস্তাঘাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কোভিড প্রটোকল মানানো জরুরী। শুধু এভাবেই আমরা এই রাজ্যে তৃতীয় ঢেউয়ের প্রভাব রুখে দিতে সক্ষম হব। সেক্ষেত্রে সমাজের সব স্তরের মানুষের সহযোগীতা ও সরকারের তরফে শক্ত নজরদারী প্রয়োজন।
Month: February 2023
ভারতে কম্যুনিষ্টদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্ধকার
১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানতঃ এম.এন. রায়ের উদ্যোগে তাসখন্দে ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টি গঠিত হয়। এই পার্টির গঠনে রাশিয়ার লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব ও তাদের ক্ষমতা দখল অনুঘটকের কাজ করে। পার্টির প্রথম চেয়ারম্যান যদিও দক্ষিণী ব্রাহ্মণ এম. পি. টি. আচার্য, সংগঠনের প্রাণপুরুষ নিঃসন্দেহে এম.এন.রায় এবং তাঁর সহধর্মীনী ইভলিন রায়। এম.এন.রায় বলশেভিকদের অনুসরনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ইংরেজদের ইংরেজ বিতারণের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেন। তিনি অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের থেকে প্রথমে কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মী সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সে চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি। তারপর তিনি গোঁড়া মুসলমান ‘মুহাজির’ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে নেতা-কর্মী সংগ্রহের চেষ্টা করলে তা অধিকতর সাফল্যলাভ করে। এদের মধ্যে নেতৃত্বে আসা মহম্মদ আলী ও মহম্মদ সফীক উল্লেখযোগ্য। এই সফীক পার্টি গঠনের শুরুতে দলের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারী হন।
মোহাজির সম্প্রদায় আগ্রাসী প্যান-ইসলামিজমে বিশ্বাসী। এদের ইংরেজ বিরোধীতার কারন কিন্তু ভারতের পরাধীনতা নয়। তাদের ইংরেজ বিরোধীতার সূত্রপাত হল অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্কী খলিফার শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করার জন্য। ইংরেজ রাজশক্তি এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের সখ্যতা এবং খিলাফৎ আন্দোলনকে ইংরেজ সরকারের পক্ষে কোনরকম পাত্তা না দেওয়া – এই দুটি কারনে গোঁড়া মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশ ইংরেজদের বিরোধীতায় নামে। সঙ্গে অবশ্যই মুসলিম শাসকদের থেকে ইংরেজদের শাসনভার নেওয়া যা এদের কাছে ইসলামের অবমাননা বলে এরা মনে করে! খিলাফৎ আন্দোলন একটি জিহাদী ইসলামী আন্দোলন। আশ্চর্যজনকভাবে এই আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ ভারতের কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে শুধু যে যুক্ত হল তাই নয়, কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের বড় মুখ হিসেবে তারা চিহ্নিত হল। এরা মননে, স্বপনে পুরোপুরি প্যানইসলামী মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় ‘খ্রীষ্টান’ ইংরেজ শাসককুল এদের কাছে শত্রু হিসেবে পরিগণিত হল। এদিকে খিলাফৎ আন্দোলন যখন ঐতিহাসিক কারনে তার গতি হারালো, তখন থেকে এই জিহাদী প্যানইসলামীরা কম্যুনিষ্ট দলে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় পেল। তারপর যখন কামাল পাশা তুরষ্কের শাসনভার হাতে নিয়ে খলিফা পদেরই অবলুপ্তি ঘটালেন, তখন এই ইসলামী কম্যুনিষ্টদের বড় অংশ রাশিয়ার সামরিক ট্রেণিং পাওয়ার পর ঐ দেশের সামরিক বিভাগে যোগদান করল। আর অন্য কয়েকটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরে। আর বাকীরা ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টিতে রয়ে গেল। এদের রাজনীতি রাশিয়ার বলশেভিকদের, পরবর্তীতে স্টালিনের রাশিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। রাশিয়ার থেকে অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন অনুদান বিবিধ প্রকারে এদের কাছে আসত। এদের বিভিন্ন logistic supportও রাশিয়ার থেকে আসত। এই কম্যুনিষ্টদের মধ্যে রাশিয়ার কম্যুনিষ্টদের অনুকরনে প্রথমেই ধর্মীয় চার্চগুলির অধিকার খর্ব করার জন্য যে ধর্ম বিরোধীতা করার কথা বলা হল তার বহিরাঙ্গিক রূপ হল secularism – ধর্মনিরপেক্ষতা। রাশিয়ায় চার্চের কায়েমী স্বার্থ কম্যুনিষ্টদের স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় সেখানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেওয়া হল তা এখানকার কম্যুনিষ্টরা ভারতে প্রয়োগ করতে গেল। ফল হল মারাত্মক। ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন সব কিছুই হয়েছে ধর্মভিত্তিক। এই দেশের মানুষের মনুষ্যত্বের দিক নির্দেশক হচ্ছে ধর্ম। এ কোন বিশেষ religion নয়।ধর্মের কোন একটি বিশেষ পুস্তক বা ‘আদেশ’ সম্বলিত তথাকথিত ধর্মগ্রন্থ নয়। এই ধর্ম-সংস্কৃতি আমাদের সকল ভারতীয়ের সঙ্গে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওতপ্রোতভাবে সংপৃক্ত। ফলে, কম্যুনিষ্টদের এই ধর্মীয় অপধার্মীকতা প্রথম থেকেই দেশের মানুষ ভালোভাবে নিল না। কিন্তু পার্টি ত রাখতে হবে! তাই একটি কৌশল করা হল। যে ধর্মের বিরোধীতা করলে সেই ধর্মের মানষকে পাওয়া ত যাবেই না, উপরন্তু ঐ ধর্মের মানষরা কম্যুনিষ্টদেরই হর্বতোভাবে বিরোধীতা করবে, সেই ধর্ম সম্পর্কে মৌনং সম্পতি লক্ষণম্ করে ধর্ম বিরোধীতার নামে সরাসরি হিন্দু ধর্মের বিরোধীতা করা শুরু হল! এইভাবে এগোতে গিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রূপ পেল জেহাদী ইসলামী সমর্থকদের মত সরাসরি হিন্দুধর্ম বিরোধীতায়। এর সাম্প্রতিক রূপ হিসেবে আমরা বাংলাদেশে দূর্গাপুজোয় ভাঙ্গচুর ও সরাসরি হিন্দু নিধন, লুঠপাট, ধর্ষনের যে ঘটনার কথা আমরা জেনেছি, যার নিন্দায় সারা পৃথিবী সরব হয়েছে – ব্যতিক্রম শুধু ইসলামী কিছু দেশ এবং তথাকথিত কম্যুনিষ্ট শাসিত দেশ কোনো প্রতিবাদ করেনি – সেই ঘটনার সম্পর্কে ভারতের কম্যুনিষ্ট দলগুলি মৌণব্রত অবলম্বন করেছে। এমনকি কিছু কম্যুনিষ্ট ক্যাডার এই ঘটনাকে পরোক্ষে সমর্থন করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে! এক কম্যুনিষ্ট নেতা তারাপীঠে পুজো দেওয়ার অপরাধে পার্টিতে তিরস্কৃত হলেও এক মুসলমান নেতা তাঁর ছেলের বিবাহের নিমন্ত্রণপত্রে “ইনসা আল্লা” লিখলেও পার্টি নিশ্চুপ থাকে। ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের প্রথম থেকেই বক্তব্য হল ধর্ম আফিম মাত্র! তাই হিন্দু ধর্মাচরন নিন্দনীয়, কিন্তু মুসলমান বা খ্রীষ্টান ধর্ম পালন যার যার ব্যক্তিগত অভিরুচি!
কম্যুনিষ্টদের চিন্তাধারা সর্বদা বিদেশ থেকে আমদানী করা আর তা সেইসব দেশের স্বার্থের কারনে তৈরী বলে তা কখনোই ভারতীয় প্রেক্ষাপটে খাপ খায়নি। যেমন শুরুতে ইংরেজদের বিরোধীতা থাকলেও পরে যখন ইংল্যান্ড ও রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক ফ্রন্টে জার্মানীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামল, ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা জার্মানীর শতেক দোষ ও ইংরেজদের ততোধিক গুণ আবিষ্কার করল! তখন ভারতে কংগ্রেস ও বিপ্লবীরা ভিন্ন পথে দেশ থেকে বৃটিশ বিতারণের চেষ্টা করলেও কম্যুনিষ্টরা ইংরেজ শাসকদের সঙ্গেই নিজেদের সংযুক্ত রাখল। যদিও খিজার হুমায়ুন আনসারী আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত সোশ্যালিষ্ট (যদিও এরাই ভারতীয় কম্যুনিষ্ট) শিক্ষিত মানুষজনের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা বলেছেন, তবে সেই সব বিদ্বজ্জন, যেমন, মৌলানা হাসরত মোহানি, কাজী আব্দুল গফ্ফর, রফি আহমেদ কিদওয়াই, মহঃ হাবিব, সাগীর নিজামি, ইস্মৎ চুঘতাই, ইসরারুল হক মাজাই, কে. এম. আশরফ, আলী সর্দার জাফরী ও জান নিসার আখতার – এদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান নাকি ভারতীয় ইতিহাসবিদরা ঠিকমত তুলে ধরেন নি!
আসলে আমাদের অভিজ্ঞতা হল, কম্যুনিষ্ট প্রচার গোয়েবেলসীয় প্রচারকেও হার মানায়। কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করা যাক। প্রথমতঃ খিলাফৎ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ভারতীয় শিক্ষিত মুসলিম সমাজের এক বড় অংশ সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পরেছিল আর অন্য একটি অংশ সরাসরি কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। এর একটি কারন হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে। কোরান-হাদিস পড়া শিক্ষিত মুসলমানের কাছে হিন্দুরা ‘কাফের’। কোরান অনুসারী মুসলিম মাত্রই কাফেরদের পুতুল পুজার বিরোধী। কম্যুনিষ্টরা এই পুজার সরাসরি বিরোধীতা করলেও মুসলিম ধর্মের আচার আচরনের কোন বিরোধীতা করেনি। সুতরাং ইসলামী আচার আচরন পালন করেও কম্যুনিষ্ট হওয়া সম্ভব। আমি কর্মসূত্রে এক বিখ্যাত কম্যুনিষ্ট নেতার সঙ্গে মিটিংয়ের সময় জানলাম যে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন! তাই আমাদের পূর্ব নির্ধারিত মিটিং পিছিয়ে গিয়েছিল। এর থেকে একটি জিনিষ পরিষ্কার। ইসলামী আচার অনুষ্ঠান পালন করে কম্যুনিষ্ট হওয়া সম্ভব। কিন্তু কম্যুনিষ্টরা ঘোষিত নীতিতেই হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করায় কোন যথার্থ হিন্দু তাঁর ধর্মপালন করে কম্যুনিষ্ট হতে পারে না। যদি আলিগড়ী কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের এক পরম্পরা হত স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা, তাহলে ক’জন মুসলমান ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন? ক’জন মুসলমান আইন অমান্য করে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জেল খেটেছেন? এই সংখ্যাটা অবিভক্ত ভারতের জনসংখ্যার হিসেবে বিচার করলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আধুনিক শিক্ষা কোন মুসলমানকে সহনশীলতা শেখায় না। কারন ধর্মীয় বিধান অনুসারে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইসলামের অঙ্গ। কোন ধার্মীক মুসলমানের কাছে তা অপরাধ নয়। এই অব্দি ঠিক আছে। কিন্তু যখন ধর্মনিরপেক্ষ কম্যুনিষ্টরা তা মেনে নেয়, সেটা হয়ে যায় “ভাবের ঘরে চুরি”।
আবার স্বাধীনতার পরে কিছু মুসলমান বিদ্বজ্জনকে ভারত সরকারে অন্তর্ভুক্ত করলেও তাদের ধর্মীয় প্রভুত্ব করার স্পৃহা কমেনি – তাঁরা কেউই ধর্মনিরপেক্ষতা দুরের কথা, সর্বধর্ম সমন্বয়ের তত্ব সমর্থন করেছেন বলেও জানা নেই। যখন মুসলিম লীগ জিন্নার নির্দেশে ডাইরেক্ট অ্যাকশানের নামে বিনা প্ররোচনায় হিন্দুদের হত্যা, ধর্ষন ও লুন্ঠনে নেমেছিল – জিন্নার শিষ্য গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে বাংলা জুড়ে হিন্দুদের উপর শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে চরম অত্যাচার করছিল; তখন মুসলিম লীগে জিন্নার প্রতিদ্বন্দী আরেক উচ্চশিক্ষিত ব্যরিষ্টার হুসেন সুরাবর্দী অত্যাচারে জিন্নার দলবলকেও ছাপিয়ে গেলেন। সেই সময় ক’জন আলিগড়ীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান এই হিন্দু নিধন বন্ধ করার জন্য কি করেছেন? ক’জন কার্যকরীভাবে এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেছেন? ক’জন কম্যুনিষ্ট নেতা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন?
কম্যুনিষ্টরা স্বাধীনতার আগে যেমন রাশিয়ার নির্দেশে ইংরেজ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারই উত্তরাধিকারী হিসেবে নতুন শ্লোগান তুলেছেন, “ইয়ে আজাদী ঝুঠা হ্যায়, ভুলো মৎ, ভুলো মৎ”। এইভাবে স্ববিরোধী ও দেশের বৃহত্তর অংশের মূল্যবোধকে মাণ্যতা না দেওয়ায় কম্যুনিষ্ট পার্টি বারবার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। তারা চোখ বন্ধ রেখে এইসব ভাঙ্গনকে ideological difference বলে চাপা দিতে চেষ্টা করেছেন। যেমন, চীন যখন ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ করে তখন একদল কম্যুনিষ্ট চীনের প্রসাদ পাওয়ার লোভে প্রচার করতে শুরু করে যে চীন নয়, আক্রমণকারী দেশ হচ্ছে ভারত! নেতা হওয়ার উদগ্র কামনার সাথে সাথে চীনের উচ্ছিষ্ট লাভের জন্য এই নেতারা ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে কম্যুনিষ্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) তৈরী হয়। তা’হলে কম্যুনিষ্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া কি মার্কসবাদকে স্বীকার করনি! আবার এই নতুন পার্টি কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙ্গে চীনের প্রচ্ছন্ন মদতে ভেঙ্গে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এমন সব কিম্ভুতকিমাকার নাম দিয়ে ধীরে ধীরে টুকরো হতে লাগল। আসলে এসবের মূল কারন নেতৃত্বের লোভ, সত্যিকারের নীতিহীনতা এবং বিদেশী শক্তির নিজেদের জাতীয় স্বার্থে তাদের হাতে ক্রীড়নক হওয়ার ফল।
এভাবে ভারতের সকল জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা এবং দেশের শত্রু রাষ্ট্রের সমর্থনে কথা বলা – এমন সব কাজ করতে করত কবে যে কম্যুনিষ্ট দলগুলি ভারতের জাতীয়তা বিরোধী হয়ে গেছে তা এরা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। এখানে উল্লেখ্য, পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যেখানে জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করার রাজনীতি করা হয়। ব্যতিক্রম – ভারত। এর দায় কিন্তু দেশের সরকারের উপরেও বর্তায় – এদের এমনভাবে বাড়তে দেওয়ার জন্য। এর ফল, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্যুনিষ্টদের সমাবেশে শ্লোগান ওঠে, “ভারত তেরত টুকরে হোঙ্গে” – যা পাকিস্তানের ভারত বিরোধী জেহাদীদের শ্লোগান!
এইসব ঘটনা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী জেহাদী শুধু নয়, সমগ্র ভারত বিরোধী শক্তির সঙ্গে অশুভ আঁতাত বা তাদের সমস্ত ধ্বংসাত্মক কাজের সমর্থন করে ধীরে ধীরে কম্যুনিষ্টরা ভারতের জাতীয়তাবাদী শক্তি ও জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী কাজেই নিজেদের নিয়জিত করেছে। কোন দেশের এমন কোন দল নেই যারা এমন দেশবিরোধী নীতি নিয়ে চলতে পারে। এর ফলে, সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের মত সর্বজনগ্রাহ্য নীতি নিয়ে চললেও কম্যুনিষ্টদের জন্মলগ্ন থেকে দুটি মারাত্মক আত্মঘাতী নীতি – ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পড়ে ইসলামী জেহাদী তোষণ ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর আচরণ – এর জন্যই কম্যুনিষ্টরা আজ ভারতে জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি রাজ্যে যে তাদের নামমাত্র সংসদীয় উপস্থিতি আছে তা স্থানীয় আঞ্চলিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে পাওয়া! এর একমাত্র ব্যতিক্রম কেরল। তার কারন ভিন্ন। কেরলের জনসংখ্যার বিন্যাস এমন যে, এখানে মুসলমান ও খ্রীষ্টানদের প্রায় পুরো ভোটটাই তাদের হিন্দুবিরোধী অবস্থানের জন্য কম্যুনিষ্টরা পায়। সেজন্য একমাত্র এই রাজ্যেই তারা ক্ষমতায় থাকতে পারে। সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট আর এই মূহুর্তে কম্যুনিষ্টদের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার সবচেয়ে বড় কারন ধর্ম সম্পর্কে তাদের অবস্থান। একথা সত্যি যে, ভারতে ধর্ম বাদ দিয়ে রাজনীতি বা এক ধর্মকে তোল্লা দিয়ে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধাচরন করে রাজনীতি – এর কোনটাই সাফল্য পাবেনা। কম্যুনিষ্টদের ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তন না করলে ভারতে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্ধকার।
কম্যুনিষ্টদের ধ্বংসের কারন দেশবিরোধী দ্বিচারিতা
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে জাতীয় কংগ্রেস। তারপরেই বলতে হয় কম্যুনিষ্ট পার্টির কথা। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের প্রথম কম্যুনিষ্ট পার্টির জন্ম হয়। রাশিয়ার বলশেভিকদের সাফল্যে আশান্বিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ (পিতৃদত্ত নাম নরেন্দ্রনাথ) রায় এবং তাঁর স্ত্রী ইভলিন রায় ট্রেন্ট, অবনী মুখার্জী, রোসা ফিটিংগভ, মহম্মদ আলী ও মহম্মদ সফিক ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গের মানুষদের নিয়ে – সঙ্গে রাশিয়ার বলশেভিকদের প্রত্যক্ষ মদত ও সাহায্যে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়। এসব ঐতিহাসিক সত্য। তবে, এইটুকু ভূমিকার প্রয়োজন ছিল কম্যুনিষ্টদের বর্তমান দুরবস্থার কারন অনুসন্ধানের জন্য।
প্রথমে বলে রাখি, তাসখন্দের ঐ মিটিংয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন দক্ষিণী ব্রাহ্মণ মান্ডায়াম পার্থসারথি থিরুমল আচার্য। আর কম্যুনিষ্ট কুওমিনটাং (যা এখনকার পলিটব্যুরোর মত) প্রেসিডেন্ট হলেন উদ্যোক্তা মানবেন্দ্র নাথ রায়। শুরুর থেকেই বিভিন্ন বিপরীতধর্মী ও বিপরীত মনের মানুষের সহাবস্থানে এই পার্টি তৈরী হয়েছিল। এর একটি অবিসংবাদী ফলশ্রুতি হল বারবার দলের ভাঙ্গন। এমন বিপরীত চিন্তার মানুষজনের দীর্ঘ সময় সহাবস্থান কখনোই সম্ভব নয়। মানবেন্দ্র ও ইভলিন বলশেভিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ও সর্বহারার ক্ষমতা অধিকারের দাবীতে বিশ্বাসী। এদিকে আচার্য ও অবনীরা বৃটিশদের ভারত থেকে বিতারনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এরা সবাই দরকারে সহিংস পদ্ধতি অবলম্বনে বিশ্বাস করতেন। দলের অন্যতম সংগঠক মানবেন্দ্র ক্যাডার সংগ্রহে প্রথম টার্গেট করেন ভারতের বৃটিশ রাজশক্তির বিরোধী ও প্রয়োজনে সশস্ত্র প্রতিরোধে বিশ্বাসী যুবগোষ্ঠীকে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি অনুশীলন সমিতি ও সেই মানসিকতার যুবকদের থেকে ক্যাডার সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ কাজে বিশেষ সাফল্য না পাওয়ায় তাঁর নজর পড়ল মুসলিম যুবকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর উপর। খলিফার অধিকার ও শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করার কারনে অটোমান সাম্রাজ্য ও তার দোসর বৃটিশদের উপর তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশ বৃটিশদের শত্রু মনে করতে লাগল। তাদের খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করে গান্ধীজী যে ভুল করেছিলেন তার চেয়েও বড় ভুল করলেন মানবেন্দ্র। তিনি এইসব গোঁড়া মুসলমানদের থেকে ক্যাডার সংগ্রহ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সর্বহারার ক্ষমতায়ন। হিন্দু কম্যুনিষ্টদের জাতীয়তাবোধের ব্যাপারে উদ্ভুদ্ধ করার কোন চেষ্টা করা গেল না। কারন মানবেন্দ্র নিজেও জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্বমানবতাবাদকেই বেশী প্রাধান্য দিতেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। এদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামীর কারনে মুসলমান কম্যুনিষ্টদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ত দুরের কথা, সাম্যবাদের উপরেও বিশ্বাস ছিলনা। তাদের বৃটিশ বিরোধীতা ছিল ধর্মীয় কারনে এবং অস্থায়ী। মহম্মদ সফীক ও মহম্মদ আলীর বিভিন্ন কার্যকলাপেই তা পরিষ্কার। ফলে, খলিফার অপসারন ও কামাল পাশার তুরষ্কের ক্ষমতায় আরোহনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বৃটিশ বিরোধীতাও গতি হারালো। রফিক আহমেদ, সৌকত উসমানী, খুশী মহম্মদরা প্রথমে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও পরে কম্যুনিষ্ট! যখন খিলাফৎ আন্দোলন গুটিয়ে গেল, বৃটিশ বিরোধীতা তখন ভারতের মুসলিম কম্যুনিষ্টদের কাছে গতি হারালো। এরা অনেকটা দিগভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে এইসব মুহাজিরদের একটি বড় অংশ রাশিয়ায় সামরিক ট্রেনিং নিয়ে বলশেভিক, উজবেক বা তুর্কী সেনাদলে সামিল হল। তবে, ভারতের অভ্যন্তরে মুজফ্ফর আহমেদ, ডাঙ্গে, সিঙ্গারা ভেলু চেট্টিয়াররা তাদের সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করতে শুরু করল। তখন কিন্তু সেই চেষ্টায় মুসলমান ক্যাডারের সংখ্যা অনেক কমে গেল তা বলাই বাহুল্য।
সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের সব কম্যুনিষ্ট দল – বিশেষতঃ CPI ও CPM, একটি অদ্ভুত দ্বৈতসত্তায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তা হল, মুসলিম কমরেডরা আগে মুসলিম, পরে কম্যুনিষ্ট। আর হিন্দু কমরেডরা আগে কম্যুনিষ্ট, পরে হিন্দুধর্মের বিরোধী মানুষ! একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ দেওয়া যাক – কোন কম্যুনিষ্ট পুজো আর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না; কিন্তু মুসলিম কমরেডদের মসজিদে না যাওয়া বা নামাজ না পড়ার কোন বিধান দেওয়া নেই। এই দ্বিচারিতার জন্যই কিন্তু “আগমার্কা বিপ্লবী” মানবেন্দ্রনাথ রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই কম্যুনিষ্টদের থেকে সরে গিয়ে র্যাডিক্যাল হিউমানিজমের সুচনা করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় তাঁর এই বিরক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যাক, আমরা আবার ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের কথাতেই ফিরে আসি। যখন মুহাজির সম্প্রদায় কম্যুনিষ্ট আন্দোলন থেকে সরে গেল, তখন মুসলিম কমরেডদের ধরে রাখার যে কৌশল কম্যুনিষ্ট পার্টি নিল তা অনেকটাই গান্ধীজীর অনুসরণে। কি রকম? যেহেতু গোঁড়া মুসলমানদের থেকে মুহাজির সম্প্রদায় আসে এবং তাদের থেকেই মানবেন্দ্রনাথরা কম্যুনিষ্ট পার্টির মুসলিম ক্যাডার নিয়োগ করেছিলেন, সেজন্য ইসলাম ও তার মৌলবী নির্দেশিত পথকে মান্যতা দিয়ে কম্যুনিষ্টরা “ধর্মনিরপেক্ষতা”র পক্ষে সওয়াল শুরু করে দিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কম্যুনিষ্ট পার্টির ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হিন্দুধর্মবিরোধী রয়ে গেল।
ইতিমধ্যে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হল। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ব্যপক পরিবর্তন ঘটালো। ভারতে একদিকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে বৃটিশের সব রকম দমন পীড়ন উপেক্ষা করে সশস্ত্র কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যকলাপ – এই সব কিছুর একসঙ্গে মোকাবিলা করা বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল বৃটিশ শক্তির পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। বৃটিশ অর্থনীতিও যুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল। বৃটিশ পার্লামেন্টে উইনস্টন চার্চিলের পরাজয় ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করল। এই পর্যায়ে বলশেভিক আন্দোলনের পরবর্তীস্তরে যখন রাশিয়ায় যোসেফ স্তালিনের একনায়কতন্ত্রের শাসন কায়েম হল তখন ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি তাদের দমনমূলক শাসনকে পূর্ণ সমর্থন জানালো। এই সমর্থনের বিনিময়ে তারা আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেতে লাগল। এইভাবে কম্যুনিষ্টরা মানুষ ও দেশের মঙ্গলের থেকে পার্টির ও তার নেতাদের মঙ্গলের দিকেই নজর দিত। যেহেতু ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির অস্তিত্ব ও জনসমর্থনের জন্য এই বিদেশী শক্তির সাহায্যের প্রয়োজন, সেহেতু বিদেশী শক্তিকে তৈলমর্দন করা ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের কাছে অবশ্য কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ল। আন্তর্জাতিক পরাস্থিতি ও সমঝোতার প্রেক্ষিতে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি তাদের নীতি অদল বদল করতে লাগল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন রাশিয়া ও বৃটেন পরস্পরের কাছাকাছি আসে তখন, যদিও ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র গতি পেয়েছে, তখন বৃটিশদের স্বার্থের কথা ভেবে কম্যুনিষ্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল হল না! পরন্তু, মুসলমানদের স্বার্থে পাকিস্তান গঠনকে সমর্থন জানালো। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মহম্মদ আলী জিন্না যখন ভারতভাগের প্রস্তাব দিল, নিজেদের মুসলমান কমরেডদের তুষ্ট রাখতে কম্যুনিষ্ট পার্টি সেই প্রস্তাব সমর্থন করল! এই তোষন ও ধান্দাবাজীর নীতিই যে তাদের ভবিষ্যৎ অবক্ষয় ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের কারন হবে তা ঐ সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
কম্যুনিষ্টরা ভারতে তিনটি স্থির নীতির উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক জমি দখল করার স্বপ্ন দেখেছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ক্যাডারদের মন যুগিয়ে তাদের মারফৎ মুসলিম সমাজে নিজেদের রাজনৈতিক বিস্তার; হিন্দু ক্যাডারদের ক্ষেত্রে ছিল ‘সর্বহারা’ সবকিছু পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন। এই সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগ ও আদর্শ যাতে পার্টির বিস্তারে বাধা না হয় তার জন্য “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে সরাসরি হিন্দু ধর্ম ও তার সকল আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা। সব হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অসাড়তা প্রমানের হাস্যকর প্রয়াস চালানো এরই অংশ মাত্র। আর এভাবেই ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা এক “ইসলামিক ধর্মনিরপেক্ষতা”র শিকার হয়ে গেল। ভারতের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কম্যুনিষ্টরা সমাজকে তাদের মত করে তৈরী করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু ভারতীয় সমাজে ভারতীয় ধর্ম (নিজস্ব কৃষ্টি ও সামাজিক সদ্ভাবনা, religion নয়) এতটাই সুপ্রোথিত যে কম্যুনিষ্টদের এই প্রচেষ্টা তাদের ধৃষ্টতায় পর্যবসিত হল। ফলতঃ কম্যুনিষ্ট দল ও তার মতাদর্শ ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল।
কম্যুনিষ্টদের আরেকটি বড় ভুল অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরতা। এর ফলে শুধু যে কম্যুনিষ্ট দলের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হল তাই নয়, তাদের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষের যোগাযোগ ক্ষীণতর হয়ে গেল। আমাদের দেশের মানুষের অন্তরের অন্তরস্থলে দুটি সত্তা অবিনশ্বর – এক, তাদের নিজ নিজ ধর্ম; দুই, জাতীয়তাবোধ। এর জন্যই ধর্মে মুসলমান হলেও ইকবালের অমর সৃষ্টি, “সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা”। আমাদের দেশের নাম ভারত নয়; হিন্দুস্থান বা হিন্দুস্থাঁ – এই দেশ সকল ভারতীয়ের; শুধু হিন্দুদের নয় বা শুধু মুসলমানদের নয়। কম্যুনিষ্টদের তথাকথিত আদর্শ (!) এই দুই সত্তার মূলেই কুঠারাঘাত করল। তারা হিন্দুধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ ও উপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে গেল। আবার তারা মুসলিমদের তোল্লা দিলেও নিজেরা মুসলমান না হওয়ায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলায় ধর্মভীরু ও গোঁড়া মুসলমানদের কাছে “কাফের”দের পার্টি হয়ে রয়ে গেল। যার ফলে তারা “না ঘরকা, না ঘাটকা” হয়ে রইল। আবার তাদের বৃটিশ তোষণ এবং স্বাধীনতা উত্তর শ্লোগান, “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত, ভুলো মত” তাদের জাতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।
ইতিমধ্যে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ভারতকে দুটি বড়সর বৈদেশিক আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৬২ সালে বিনা প্ররোচনায় চীন ভারতের অনেকটা জায়গা, এমনকি অরুণাচল প্রদেশের বড় অংশ দখল করে নেয়। এই সময় ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির নীতিগত সংকট শুরু হয়। ঐ সময় সোভিয়েট রাশিয়ার তাঁবেদারী করত ভারতের কম্যুনিষ্টরা। তখন শক্তিশালী কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চীন। যেহেতু ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা দেশের স্বার্থের আগে তাদের বিদেশী সাহায্যকারী রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখে, কম্যুনিষ্ট চীন এই দেশের কম্যুনিষ্টদের একটি বড় অংশকে রাশিয়ার থেকে সরিয়ে নিজেদের দিকে টানতে সমর্থ হল। কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে নতুন দল – ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তৈরী হল। এই দল নির্লজ্জভাবে চীনকে সমর্থন করে ভারতের বিরোধীতা করে!
এভাবেই বিদেশী প্রভুদের অঙ্গুলীহেলনে ও তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতে রাজনীতি করতে করতে কখন যে এই দেশের কম্যুনিষ্টরা সর্বতোভাবে ভারতের জাতীয়স্বার্থের বিরোধীতা ও ইসলামী জঙ্গীবাদের সমর্থন করার নীতি গ্রহণ করলো, নিজেদের বিনাশের সেই সন্ধিক্ষণ বোধহয় কম্যুনিষ্ট নেতারাও বুঝতে পারলনা। এই নীতির সাম্প্রতিক একটি নিদর্শন হল, কম্যুনিষ্ট ছাত্রনেতার উন্মুক্ত সমাবেশে হুঙ্কার, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” – যা পাকিস্তানের ভারতবিরোধী ইসলামী জঙ্গীদের শ্লোগান।
আত্মঘাতী ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা বিশ্বের অন্যান্য সাফল্য পাওয়া কম্যুনিষ্ট দলের থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। চীনের মত একটি কম্যুনিষ্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত দেশে দল কিভাবে কাজ করে তা অনুসরণ করলেও ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের উপকার হত। কিন্তু “সত্তরের দশককে মুক্তির দশক”এ পরিণত করার শ্লোগানে নেতৃত্ব ভাগ হওয়া এবং কোন নেতা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের কত বেশী চামচাবাজী করতে পারে তার পরীক্ষায় অতি দ্রুত কম্যুনিষ্ট দলগুলি ভেঙ্গে গিয়ে ছোট ছোট স্থানীয় উপদলে পরিণত হল। আবার যদি চীনকেই লক্ষ্য করা যায়, সেখানকার কম্যুনিষ্ট পার্টি কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বৃহত্তর সাধারণ মানুষের ধর্মবোধে আঘাত করেনা। সেখানকার বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরগুলির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ পার্টি পরিচালিত সরকারের উপরেই ন্যস্ত। অথচ সেখানে ইসলামের মাথা চাড়া দেওয়া বরদাস্ত করা হয় না। এর কারন কোন ধর্ম বিরোধিতা নয়, শুধু জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে তা করা হয়। কারন ইসলাম কিন্তু হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের মত নয় – এই ধর্ম মুলতঃ আগ্রাসী ধর্ম। সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষতা কোরান অনুযায়ী একটি বড় পাপ। এর প্রেক্ষিতে আমার এক শিক্ষিত, প্রগতিশীল বন্ধুর মন্তব্য খুব প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যে কোন ধার্মিক মুসলমান প্রগতিশীল হতে পারে, ধর্মীয় সহাবস্থানে থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। এই জায়গাতেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে চীনের ভীতি। তারা জানে, আগ্রাসী কোন ধর্মের মানুষের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঐ দেশের অন্য মানুষদের পক্ষে পরাধীণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মত ব্যাপার। সেজন্যই তারা উইঘুর সমাজের উপর এত ক্ষিপ্ত। দুঃখের কথা, ভারতের কম্যুনিষ্টদের এই বোধটাই নেই। তারা জন্মলগ্ন থেকেই সর্বদা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী কাজ করে! তারা এটা কখনো বিচার করে না যে, একটি দেশ, তা সমাজবাদী হোক বা ধনতান্ত্রিক বা অন্য কিছু, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবোধ ছাড়া তাদের জাতীয় অস্তিত্বই অসম্ভব।
ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা তাদের এমন অদ্ভুত আত্মঘাতী নীতির জন্য প্রথম থেকেই যেহেতু ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে অনেক পিছিয়ে, তারা কৌশল ও জোটবন্ধনের মাধ্যমে ক্ষমতার অলিন্দের বিশেষ জায়গাগুলিতে তাদের নিজেদের মানুষজনকে বসাতে তৎপর। যার জন্য কেন্দ্রীয় বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় তারা বিশেষতঃ শিক্ষা, তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগগুলির গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দিকে নজর দেয়। স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন সময়ের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা সামগ্রী তৈরীতে এই কম্যুনিষ্টদের প্রভাব অনস্বীকার্য। তারা যখন দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারালো তখন
তারা তাদের দর কষাকষির সুযোগ হারালো। আবার দেশের সংবাদমাধ্যম ও তথ্য-সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কম্যুনিষ্ট প্রভাদ বেশী থাকায় তাদের চেষ্টায় কম্যুনিষ্টদের রাজনৈতিক শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে দেখাধোর চেষ্টা হতে লাগলো। আবার সামাজিক মাধ্যম (social media) যত শক্তিশালী হতে লাগলো, কম্যুনিষ্ট প্রচার তত বিরোধীতার মুখে পড়ল। যত কম্যুনিষ্টদের শক্তিক্ষয় হতে লাগলো তত দ্রুত তাদের জনসমর্থন কমতে লাগলো। আর ততই কম্যুনিষ্ট দলগুলি হাস্যকর শ্লোগান আউরানো একদল ধান্দাবাজ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করল। এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক বড় কারন হল, দুটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা, এই দুটিতেই কম্যুনিষ্ট শাসনে রাজ্যের মানুষের দুর্দশা বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এদের রাজ্য শাসনে ব্যর্থতা প্রকট হয়েছে। একমাত্র কেরালাতে কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতায় আছে। তার কারন, সেখানকার নির্ণায়ক ভোট যা মুসলিম ও হিন্দু-বিরোধী খৃষ্টানরা মিলিতভাবে কম্যুনিষ্টদের দেয়। এতে করে দেশবিরোধী নীতিতে হয়ত কেরালার মত রাজ্যে সাময়িক ভোট রাজনীতিতে ক্ষমতায় টিঁকে থাকা যায়; কিন্তু সর্বভারতীয়স্তরে সমস্ত কম্যুনিষ্ট দলগুলি তাদের স্বীকৃতি হারিয়েছে বা হারানোর মুখে দাঁড়িয়েছে।
কম্যুনিষ্টদের যদি ভারতের মাটিতে রাজনীতি করে টিঁকে থাকতে হয়, তবে তাদের ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব ছেড়ে জাতীয়তাবাধী শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। বস্তাপচা সমাজতান্ত্রিক শ্লোগান, ভারতবিরোধী ও হিন্দুধর্ম বিরোধী অবস্থান পরিবর্তন ও আশু প্রয়োজন। এতে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা কমবে এবং কম্যুনিষ্টরা ভারতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। নাহলে শুধু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রেরমধ্যে সুবিধাবাদী রাজনীতি করে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ত দুরের কথা, বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম সাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানকার দূর্গাপুজায় ভাঙ্গচুর, ধর্মীয় কারনে হিন্দুহত্যা ও সম্পত্তি লুঠপাটের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের সরকার এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেও ঘটনার প্রকৃত তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদসহ সকল সংখ্যাগুরু (অবশ্যই মুসলমান) সংবেদনশীল মানুষজন এবং বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদে সোচ্চার। এসময়ে ভারতের কম্যুনিষ্টরা হয় মৌণব্রত অবলম্বন করেছেন বা অর্ধশিক্ষিত কমরেড জানাচ্ছেন ভারতের মুসলমানদের কষ্টের কথা। এভাবেই অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত কম্যুনিষ্ট নেতারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই নিজেদের অপাংক্তেয় করে তুলেছেন।
তালিবানরা ইসলাম ধর্ম মানে না
তালিবান শাসন এখন সারা আফগানিস্তান জুড়ে প্রতিষ্ঠিত। তালিবানদের একক ক্ষমতায় পঞ্জশিরের আহমেদ মাসুদ ও আমরুল্লা সালেহর প্রতিরোধ ভাঙ্গা সম্ভব নয় দেখে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সরাসরি পঞ্জশিরের উপর বোমাবর্ষণ করে। এই ঘটনা একসঙ্গে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। এতে প্রমাণ হল যে, পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী তালিবানদের হয়ে আফগানিস্তানের মানুষদের বিরুদ্ধে সরাসরি অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে। আবার তালিবানদের সমর্থন ও স্বীকৃতির মাধ্যমে চীন প্রমান করল, তারা তাদের স্বার্থে যে কোন জঙ্গী গোষ্ঠীকে মদত দিতে পারে। আবার পাকিস্তানকে “বিশ্বস্ত বন্ধু” বলে বাইডেন প্রশাসনের প্রকাশ্য বার্তা এবং আমেরিকার বর্তমান সরকারের কর্মপদ্ধতি প্রমাণ করে যে এই প্রশাসন এমনকি আমেরিকার জনসাধারণের মানসিকতা বুঝতে অক্ষম। ওয়াশিংটন পোষ্টের মত কাগজও বলছে, আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানোর সিদ্ধান্ত (যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে নেওয়া) সঠিক হলেও বর্তমান প্রশাসন যেভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে তালিবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে পালিয়ে গেল তাতে আমেরিকার বিদেশনীতির চরম ক্ষতি হল। অথচ বাইডেন প্রশাসন এখনো পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য সহ সমস্ত রকম সাহায্য করে যাচ্ছে। এতে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে প্রমাণ করে দিল, তারা মুখে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বললেও আমেরিকা জঙ্গী তোষনকারী দেশ এবং ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ হিসেবে আমেরিকার আর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা রইল না। এভাবে চললে মহাশক্তিধর ‘সুপার পাওয়ার’ তকমা থেকে যে আমেরিকার নাম বাদ যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এবার আসি তালিবান সরকারের আফগানিস্তান শাসনের শুরুতে। তালিবানরা সরকার গঠনের আগে গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা – বিশেষতঃ মহিলাদের লেখাপড়া, চাকরীর স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যপারে অনেক বড় বড় কথা বলেছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে তালিবানদের পাস্তুন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের মানষজন সরকার গঠনে প্রাধান্য পেল। সরকারের প্রধান হল হাক্কানি নেটওয়ার্ক থেকে। ফলে, তালিবান সরকারের বকলমে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসন প্রতিষ্ঠার পথেই আফগানিস্তান এগিয়ে গেল। মনে হয়, প্রথম তালিবান সরকারের থেকেও এই দ্বিতীয় তালিবান সরকারের শাসন আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের আরো খারাপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
একটি দেশের ক্ষমতায় ব্যপকভাবে নাক গলানোর জন্য যে অর্থনৈতিক শক্তির প্রয়োজন তা পাকিস্তানের নেই। পশ্বিমী দেশগুলির থেকে সাহায্য এবং ঐ দেশগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়া পাকিস্তানের দিনগুজরান অসম্ভব। এজন্য প্রথমেই তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য করার সর্ত রেখেছে যে তা করতে হবে পাকিস্তানের টাকা – যার কোন মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে নেই। এতে আফগানিস্তানের সমূহ ক্ষতি। পাকিস্তানের চাপে তালিবানদের পাস্তুন গোষ্ঠী, যেখানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব, ক্ষমতা দখল করায় আফগানিস্তানের অন্যান্য জনগোষ্ঠী যেমন হাজারা, তাজিক, উজবেকরা অসন্তুষ্ট, তেমনি ইরান ও রাশিয়াও এখন এদের সন্দেহের চোখে দেখছে। তালিবানদের বড় অংশও এইভাবে পাখিস্তানের হস্তক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়। তালিবানদের মধ্যে গন্ডগোল শুরু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এর মধ্যেই তাদের একমাত্র এ্যজেন্ডা – কাশ্মীর দখল ও ভারতের খন্ডিতকরন – এর জন্য জঙ্গী মনোভাবাপন্ন পাকিস্তান তালিবানদের প্ররোচনা দিতে শুরু করেছে। যত সময় গড়াবে, তত পাকিস্তানের উপর তালিবানদের নির্ভরতা বাড়তে থাকবে এবং পাকিস্তানের চাপও বাড়বে। শেষমেষ এই চাপ ব্ল্যাকমেলের পর্যায়ে যাবে। কারন তালিবান তাদের অন্য বন্ধু রাষ্ট্র চীনের থেকে তাদের অর্থনীতি, বিশেষতঃ পরিকাঠামো উন্নয়ণে বিশেষ সাহায্য পাবে না। চীনের বৈদেশিক সাহায্যের নীতি নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, তারা নিযেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নরম সুদে ধার দিয়ে সাহায্য গ্রহনকারী দেশকে ঋণ ফাঁদে জড়িয়ে দেয়! এখানে চীনের স্বার্থ হল ভারত ও পাকিস্তানের উপর চাপ রাখার জন্য বাগরাম এয়ারপোর্টের পূর্ণ সত্ত্ব এবং আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে সড়ক নির্মান করে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সড়ক সংযোগ। এতে আফগানিস্তানের জনগনের আর্থিক বিকাশের সুযোগ নেই। কারন চীন এসব কাজে নিজের দেশের মানষজনকে নিয়োগ করে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই করেছে।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান ভারতে ইসলাম বিপন্ন বলে অনেক কাল্পনিক অভিযোগ করে। কিন্তু এই পাকিস্তান চীনে উইঘুর মুসলমানদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের পরেও এ ব্যপারে সম্পূর্ণ নীরব। এভাবে পাকিস্তান তার কাজের মাধ্যমে নিজেদের এক ‘বর্বর দেশ’ (rouge country) তে পরিণত করেছে। সম্প্রতি EU পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহনের যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছে। যদি রাষ্ট্রসংঘ অদুর ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে “বর্বর দেশ” ঘোষণা করে তাহলে এই উপমহাদেশের সবকটি দেশের পক্ষেই মঙ্গল। পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সমাজনীতি, পুরোটাই নির্ভর করে কিভাবে ভারতের ক্ষতিসাধন করা যায় তার উপর। এই নীতি রূপায়নে পাকিস্তান যে ধর্মকে আঁকরে ধরেছে তা এখন পৃথিবীর বেশীরভাগ রাষ্ট্রের কাছে (এমনকি ইসলামিক রাষ্ট্রের কাছেও) ধর্ম বিকৃতি মনে হচ্ছে। একটু বিশদে ব্যখ্যা করা যাক।
ধ্রুপদী ইসলামী আইন অনুযায়ী পৃথিবীতে তিন ধরনের রাষ্ট্র আছে। দার-আল-ইসলাম – যেখানে ইসলামী আইন মোতাবেক রাষ্ট্র শাসিত হয়। দার-আল-সুলহ – যেগুলি অমুসলিম রাষ্ট্র হলেও সেখানে মুসলমানদের ধর্মাচরনে বাধা দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, এই রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রগুলির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চুক্তি সম্পাদিত আছে। দার-আল-হার্ব – যে রাষ্ট্রগুলি ইসলামী রাষ্ট্র নয় এবং যাদের সঙ্গে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অনাক্রমণ বা শান্তি চুক্তি নেই।
এই তিন প্রকার দার অর্থাৎ স্থানের কথা কিন্তু কোরান বা হাদাশে পাওয়া যায়না। একমাত্র কোরানে অপ্রত্যক্ষভাবে দার-আল-সুলহ এর উল্লেখ আছে। আবু আল ফদলের বক্তব্য অনুযায়ী, কোরানে দুই দার-এর উল্লেখ আছে। মানব জীবনের পরবর্তী স্তরের দার ও ভোগবিলাসী মানব জীবনের দার। এর মধ্যে প্রথমটি অবশ্যই উৎকৃষ্টতর। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধজয় ও রাজ্য দখলের পর এই তিন ধরনের দার-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দার-আল-ইসলামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আবু হানিফা এবং তাঁর শিষ্যদ্বয়, আবু ইউসুফ ও আল-সায়বানীর বক্তব্যে। ইসলামী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার বিভাজন ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারনে এখনকার সময়ে দার-আল-ইসলাম ও দার-আল-হার্ব এর পৃথকীকরন শুধু অবাস্তবই নয়, যুদ্ধবাজদের রাজনৈতিক অপচেষ্টা মাত্র। ইসলামী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও ধর্ম পালনের বিস্তর প্রকারভেদ, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অমুসলিম দেশগুলির মুসলমান নাগরিকদের অবাধ ধর্মাচরন এই দুই দারকেই অকেজো করে দিয়েছে। বিশেষতঃ ইসলামী রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রসংঘে যোগদানের পর এখনকার আধুনিক বিশ্বে দার-আল-সুলহ ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র নাই। সুরা ৪:৯০ অনুযায়ী এমন রাষ্ট্র যার সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের অনাক্রমণ নীতি প্রযোজ্য, আল্লা তেমন রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার অনুমতি দেন না।
এত কথা বলার কারন একটাই। যে ইসলামের দোহাই দিয়ে অসামাজিক ও অমানবিক কাজের ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা ইসলাম ধর্ম অনুমোদিত তা জানা। এবার আফগানিস্তানের তালিবানী ফতোয়াগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক। অশিক্ষা, কুশিক্ষার আলোতে দেশবাসীকে আচ্ছন্ন করে রাখলে তারা নিজেদের ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা হারাবে। সেজন্য তালিবানী শিক্ষামন্ত্রী বললেন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি – এসবের কোন মূল্য নেই! মনে পড়ে গেল হীরকরাজার দেশের এক অবিস্মরনীয় উক্তি : “যত জানে, তত কম মানে”। দেশের মানুষ শিক্ষা পেলে প্রশ্ন করবে; ভালোমন্দ বুঝতে শিখবে – বিশেষতঃ নারীরা। আরেকটা কথা, মেয়েদের অশিক্ষিত রাখলে তাদের সন্তানরাও অশিক্ষিত থাকবে – এমন সম্ভাবনাই বেশী। ফলে, তালিবান রাজত্বে উচ্চশিক্ষা প্রথমেই বন্ধ হল। যে কোন ধর্ম-শিক্ষা সম্পন্ন করলে তা মানষকে সহিষ্ণুতা শেখায়। সুতরাং যুদ্ধবাজ তালিবান এবং তাদের পালক পিতা পাকিস্তান কখনোই আফগানিস্তানের নাগরিকদের যথার্থ ধর্ম-শিক্ষার সুযোগ দেবেনা। পক্ষান্তরে তারা মোল্লা-মৌলভী মারফৎ নিজেদের সুবিধার্থে বিভিন্ন বাধা-নিষেধ ও বিদ্বেষ ছড়ানো ফতোয়া জারি করবে। ইতিমধ্যে সে কাজও শুরু হয়েছে। তালিবানরা সরকার গঠনের আগে মেয়েদের পড়াশোনা ও খেলাধুলা এবং চাকরীতে বাধা দেবেনা বলে প্রতাশ্রুতি দিয়েছিল। সরকার গঠন করতে না করতেই তারা মেয়েদের খেলাধুলা ও চাকরী বন্ধ করতে শুরু করল। মেয়েদের পড়াশোনার জায়গায় হাজারো বাধানিষেধ আরোপ করে পড়াশোনাও কার্যত বন্ধ করে দিল। এটা খুব অদ্ভুত যে এইসব অশিক্ষিত মোল্লারা তাদের কাজকে শরিয়তের দোহাই দিয়ে সমর্থন করতে বলে! এখানে পরিষ্কারভাবে বলা যাক যে কোরানে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, যেসব অমুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মের কারনে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা হয় এবং তাদের ধর্মাচরনে বাধা দেওয়া হয়, সেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে ক
য়ন সাচ্চা মুসলমান সম্পর্ক রাখবে না। তাদের থেকে সুবিধা নিলে সেই মুসলমানের আল্লার নির্দেশে দোজখ প্রাপ্তি হবে। সুতরাং, উইঘুর ধ্বংস দের উপর অত্যাচার ও তাদের মসজিদ ধ্বংস করার পরেও চীনের সঙ্গে তালিবানদের দোস্তি ও চীনের থেকে সুবিধা গ্রহন করে তালিবান নেতৃত্ব অত্যন্ত গর্হিত পাপ করেছে এবং ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছে! পাকিস্তান সরকারও এই একইদোষে দুষ্ট। কজন মুসলমান ধর্ম যাজক এরজন্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন! আসলে rogue state পাকিস্তান এই মূহুর্তে সারা বিশ্বজুড়ে জঙ্গী যোগান দেওয়ার কাজে লিপ্ত। এই জঙ্গীদের পরিকল্পনা হচ্ছে ধর্মের নামে নাশকতা চালিয়ে যাওয়া। এতে কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিশ্বের ইসলাম ধর্মী সাধারণ মানুষ। আমাদের সৌভাগ্য যে বেশীরভাগ ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের চাল ধরে ফেলেছে। ফলতঃ, এখনো অব্দি বিশ্বব্যপী ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আওয়াজ তুলেও পাকিস্তান সেভাবে ইসলামী রাষ্ট্রগুলির থেকে মদত পায়নি। উপরন্তু হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও পাস্তুনদের নিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল আশেপাশের ইসলামীদেশের কাছে ভালো ঠেকবে না। শুধু তাই নয়, তালিবানের মধ্যে হাজারা ও তাজিকরাও এদের কর্তৃত্ব বেশীদিন মানবেনা। কোন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কথায় মজে গিয়ে এখনো অব্দি বর্তমান তালিবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। পক্ষান্তরে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইরান ওউজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান তাদের অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছে। রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত জঙ্গীদের নিয়ে পাকিস্তানের মদতে গঠিত সরকারকে একমাত্র স্বীকৃতি দিয়েছে চীন। এমনকি তালিবানের ঘোষিত সদর দপ্তর কিছুদিন আগেও যে দেশে ছিল, সেই কাতার অব্দি ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে চলছে।
জঙ্গী তালিবানদের উপর পাকিস্তানি শাসন বন্ধ করার জন্য; এই বিশ্বকে স্থায়ীভাবে জঙ্গী সন্ত্রাস মুক্ত করার জন্য, অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রসংঘের যে যে উপায় অবলম্বন করা উচিৎ তার প্রথমেই এই পাকিস্তান নামের বর্বর দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর তত্বাবধানে ভেঙ্গে দিয়ে জঙ্গী উৎপাদন ও তার সাপ্লাই চনটিকেই ধ্বংস করে দিতে হবে। অবশ্যই প্রবল বাধা আসবে চীনের থেকে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সেই বাধার সফল মোকাবিলা করতেই হবে বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য। আর হ্যাঁ, আফগানিস্তানের সকল নাগরিকের মুক্ত ভোটাধিকার প্রয়োগে যে সরকার তৈরী হবে তাকেই রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ।
আফগানিস্তানে বাইডেনের দাদাগিরির পরিসমাপ্তি
জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যে নাটক শুরু হয়েছিল তা ক্লাইমাক্সে পৌঁছালো ১৫ই আগষ্ট,২০২১এ বিনা রক্তপাতে কাবুল দখলের মধ্যে দিয়ে। শুরুটা অবশ্য করে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আফগানিস্তান থেকে ধাপে ধাপে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। কাতারের দোহাতে এনিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীতে অতিমারী ও নির্বাচনের গুরুত্বে এই সৈন্য অপসারণ প্রক্রিয়া আর বিশেষ এগোয়নি। আফগানিস্তানের শেষ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি তখন থেকেই বলতে থাকেন যে পাকিস্তানের জঙ্গীরা আফগানিস্তান দখলের চক্রান্ত করছে। এমনকি আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই কথাকে পাত্তা না দিয়ে পাকিস্তান দ্বারা লালিত-পালিত তালিবানগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে বাইডেন প্রশাসন তাদের সৈন্য অপসারণ প্রক্রিয়ার ব্যপারে শুধু তাদের সঙ্গেই কথা বলে। ফলে, তালিবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে শুধু এগিয়েই যায়নি, তারা আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। আমেরিকার ইচ্ছে ছিল, তারা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী আফগান সৈন্যদল তৈরী করতে আফগান সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে তালিবান, আইসিস বা অন্য কোন জঙ্গী সংগঠন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজ করতে পারবেনা। প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ না বলা কথা থাকে। এখানে আমেরিকা তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রাখার ব্যবস্থা হিসেবে তালিবানদের দূর্বল দেখতে চাইলেও নির্মূল করতে চায়নি।
ফলে, ২০০১ সালে যখন তালিবান আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো তখন তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় রেখে তাদের সংগঠন টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয় পাকিস্তান এবং একাজে তারা তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগায়। তালিবানের মাদক চোরাচালানের ব্যবসা সম্প্রসারণের পেছনে পাকিস্তানের অবদান প্রচুর। তাছাড়া, ওয়াহাবী ইসলামের চিন্তাধারায় সুন্নি তালিবান পাকিস্তানের মধ্যে সহমর্মিতার সন্ধান পায়।
এদিকে আমেরিকায় গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ই বোঝা গিয়েছিল যে আমেরিকান মুসলমানেরা একযোগে বাইডেনকে ভোট দিয়েছে। বাইডেনের ডেপুটি কমলা হ্যারিসের কথাবার্তায় পরিষ্কার যে তারা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তুলনায় পাকিস্তানকে অধিকতর বন্ধু মনে করে। কাশ্মীর প্রশ্নেও কমলা হ্যারিসের অবস্থান সন্দেহজনক। যাই হোক, আফগানিস্তানে বাইডেন প্রশাসন প্রথম থেকেই তালিবানদের সাথে ও তাদের বিশেষ বন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা এবং পাকিস্তানের উপর নির্ভর করে এখন এমন অবস্থায় পড়েছে যে তাতে বাইডেনের ভোট ব্যাঙ্কের তেমন ক্ষতি না হলেও কিন্তু বিশ্বের দরবারে আফগানিস্তানের থেকে আমেরিকার শর্তহীন পলায়ন তাকে বিশ্ব-দাদাগিরির মর্যাদা থেকে এক ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। এমনকি অন্তিম পর্যায়ে তালিবানের ধমকে ভীত সন্ত্রস্ত মনোভাব দেখিয়ে তাদের দাবিমত বাইডেন ৩০শে আগষ্টের মধ্যে আমেরিকার সৈন্যদের আফগানিস্তানের থেকে বের করে আনল। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এমনকি বিমান, হেলিকপ্টার ফেলে আমেরিকা পালিয়ে গেল। তারপর কুড়ি বছরের যুদ্ধ শেষে বাইডেন পরাজিত সৈন্যদলের নেতার মত সংবাদ মাধ্যমে বার্তা দিলেন যে তিনি কত দ্রুততার সঙ্গে এই ‘পলায়ন’ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করেছেন! প্রথম থেকেই আমেরিকা পরিকল্পনা করেছিল যে তারা তালিবানের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কারন তারা আলোচনা পর্বে তালিবান ছাড়া আর কোন আফগান গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কথা বলেনি। অথচ ২০০১ সালে যখন তালিবানদের তারা হঠিয়ে দেয়, তারপর থেকে আফগানিস্তানে জনগোষ্ঠীগুলির রাজনৈতিক ও সামাজিক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবার কুড়ি বছরেও আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারগুলি যদি শক্তিশালী সৈন্যদল তৈরী করতে না পারে তার দায় কিন্তু আমেরিকার সরকার এড়াতে পারে না। অধিকন্তু মহিলা সহ নাগরিকদের অধিকার এফং আইনের শাসন, যা তালিবান জমানায় একেবারেই ছিল না সেটি অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব আফগান সরকারের প্রাপ্য। আমেরিকা হটাৎ একদিন মনে করল যে তাদের অনেক অর্থ খরচ হচ্ছে এবং তাদের সৈন্যদলের প্রাণহানি হচ্ছে, তাই রাতারাতি তালিবানদের ডেকে তাদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমেরিকার পলায়ন – আর যাই হোক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের নাক গলানোর অভিপ্রায়ে চরম আঘাত করল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পেট্রোলিয়াম কেনার টাকা মেটানোর জন্য প্রধান মাধ্যম হল আমেরিকান ডলার! এটাই তাদের দাদাগিরি। ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ভারত ইরান থেকে তেল আনলে তা ভারতের টাকায় মেটাতে পারে। ইরানের সঙ্গে আমাদের দেশের এই চুক্তির সবচেয়ে বেশী বিরোধিতা করেছে আমেরিকা। অবশ্যই অন্য যুক্তি সাজিয়ে। এই সব দাদাগিরি এখন বন্ধ হবে। আবার বন্ধু হিসেবে আমেরিকা যে একদম বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাও প্রমানিত হয়ে গেল। আরো বোঝা গেল যে আমেরিকার ধারনা,কথা ও কাজে স্বচ্ছতার বড়ই অভাব।
এখানে আফগানিস্তানের নাগরিকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী, তাদের পরিচয় ও ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। আফগানিস্তানের মানুষজন সতেরোটির বেশী গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর মধ্যে সংখ্যা ও প্রতিপত্তির দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হল পাস্তুন, তাজিক, উজবেক, হাজারা, তুর্কমেন ও বালুচগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীগুলিতে এমন নেতারা আছেন যারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি রাখেন। কিন্তু আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী এই গোষ্ঠীগুলির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে শুধু তালিবানদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে – তাঁরা তালিবানদের হাতেই শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের নক্সা করেছে বলেই মনে হয়। কে এই তালিবান? তালিবান কথাটির অর্থ হল ‘ছাত্র’। তালিবানরা মূলতঃ আফগান হলেও তারা একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত নয়। এদের মধ্যে অল্পসংখ্যক অআফগানও থাকতে পারে। এরা বিশেষতঃ পাকিস্তানের, এবং অল্প কিছু ক্ষেত্রে ভারতের মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ওয়াহাবী মতের সুন্নি মুসলমান যাদের তৈরী করা হয়েছে দেওবন্দী ইসলামী আন্দোলন এবং সাভরিক সংগঠন ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরা বেশীরভাগই পাস্তুনগোষ্ঠীর।ফলে, এরা ওয়াহাবী সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তানের সঙ্গে ধর্মীয় একাত্মতা অনুভব করে। ২০১৬ সাল থেকে এদের উচ্চতম নেতা মৌলভী হাইবাতুল্লা আখুন্তজাদা। এদের মধ্যে পাস্তুন ছাড়া বেশ কিছু সংখ্যক তাজিকও আছে। এদের শিক্ষা, ঐতিহ্য ও চিন্তাধারা জিহাদধর্মী। এরা ইসলামী মৌলবাদ ও অসহিষ্ণুতার ধারক এবং বাহক। এরা বাইরে যতই দেখাক যে আইসিস এদের শত্রু, চিন্তাধারা, ভাবাদর্শ এবং কাজকর্মে কিন্তু তা দেখা যায়নাহ ভারতের ক্ষতি করা যাদের জিহাদের মূখ্য উদ্দেশ্য সেই জৈশী মহম্মদ ও আল কায়দা এদের বন্ধু। এছাড়া এরা হাক্কানি নেটওয়ার্কেরও ঘনিষ্ঠ। চীন, তুরষ্ক, কাতার ও বিশেষতঃ পাকিস্তান এদের আফগানিস্তানের একচ্ছত্র ক্ষমতায় দেখতে চায়। এরা এবার আফগানিস্তানে যে ইসলাভী এমিরেটস এর কথা বলছে, ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে এরা একই কাজ করেছিল। ২০০১ সাল অব্দি এদের অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহিলাদের সামান্যতম স্বাধীনতা এরা দেয়না। মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এরা বিরোধী। বহু হাজার মানুষ, লক্ষাধিক, এদের দ্বারা নিহত হয়। বিশেষতঃ মহিলাদের এরা নির্দয়ভাবে হত্যা করে। ২০০১ সালে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে এরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এখানে উল্লেখ্য যে সে সময়ও নর্দার্ন এ্যালায়েন্স পঞ্জশির এলাকায় তালিবানদের রুখে দিয়েছিল। এবারেও তারা একই ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তালিবানরা এবারে ক্ষমতায় এসে ফলেছে শরিয়তী আইন মোতাবেক এরা দেশ চালাবে! নারী স্বাধীনতাও তারা দেবে শরিয়তী আইন মোতাবেক! কিন্তু এটা বলছে না যে শরিয়তী আইনের ব্যখ্যা এরা নিজেদের মত করবে। তাই এদের সাধারণ স্বাধীনচেতা আফগান জনগন বিশ্বাস করছে না। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর অবস্থানের সময় আফগানদের দেশত্যাগের ঐকান্তিক চেষ্টাই তার প্রমাণ।
তালিবানরা অত্যাচার ও ভয়ের বাতাবরন তৈরী করতে পারে। কিন্তু একটা দেশকে কি করে শাসন করতে হয় সেটা এদের জানা নেই। যখন প্রথমবার ২০০১ সালে তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে বিতারিত হল, তখন এক প্রান্তিক জায়গায় তারা বিদ্রোহী যোদ্ধা হিসেবে আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে। এদের রক্ষণাবেক্ষণ, ট্রেনিং ও অন্যান্য কৌশলগত সাহায্য – সব কিছুই পাকিস্তান যোগায়। এদের বেশীরভাগ মানুষ পাস্তুন হওয়ায় পাকিস্তানেরও সুবিধা হয়। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য একটা। তা হল, এদের নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তান প্রসুত জৈশী মহম্মদ ও অন্যান্য ভারতবিরোধী জঙ্গী সংগঠনগুলিকে যুক্ত করে ভারত থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং ফৌজীরা সরাসরি সেকথা বলছেও। এই উদ্দেশ্যে এদের সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদার লালন-পালনও পাকিস্তান করছে। এখন পাকিস্তান একারনেই ইসলামিক সন্ত্রাসের আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে। এই সন্ত্রাস দমনের জন্য যখন বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের সাহায্য নেয় তখন মার্কিনীদের উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ব-জনমতের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, এই তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এদের অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করার লক্ষ্যে এদের পৃথিবী জুড়ে মাদক চোরাচালানের ব্যবসা ও তোলাবাজির কাজে পাকিস্তান পুরোদস্তুর সহযোগিতা করেছে। এখন তালিবানদের ‘ভালো’ সার্টিফিকেট দেওয়া এবং বিভিন্ন দেশ, বিশেষতঃ ইসলামিক দেশগুলি যাতে তালিবান সরকারকে মান্যতা দেয়, তার জন্য পাকিস্তান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মত।
আফগানিস্তানের আশরফ গণি সরকারের অযোগ্যতা ও পাহাড়প্রমান দূর্ণীতির পর পশ্চিমী দেশগুলির আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারনে আফগানিস্তানের অথনীতি এখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। বিদেশী সাহায্য ছাড়া এই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই। আজ তালিবানদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আফগান জনসাধারণের মুখে খাবার যোগানো। এই মূহুর্তে চীন তাদের রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও বিপুল পরিমান বিনিয়োগ যে করবে না তা বলাই বাহুল্য। যে জন্য পাকিস্তান দ্বারা প্রতিপালিত তালিবান নেতৃত্ব একাধিকবার ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলে ভারতের চলতে থাকা বিনিয়োগগুলি বন্ধ না করতে অনুরোধ করেছে। এক্ষেত্রেও ভারতকে অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। কারন দেশ শাসন সম্পর্কিত তাদের ঘোষিত নীতিই তালিবানদের আধুনিক সভ্য সমাজের কাছে সন্দেহভাজন করে তুলেছে। আবার পাকিস্তান তাদের ‘পালক পিতা’ হলেও পাকিস্তানের অর্থনীতি এমন যে তাদের নিজেদেরই বিদেশী সাহায্য ছাড়া চলেনা। সুতরাং পাকিস্তানের দিক থেকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবেনা ধরে নিয়ে তালিবান পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ২৬৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী যাতে সাধারণ আফগানরা এবং অবশ্যই তালিবানরা, পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে পারে। তাজিকিস্তানের সঙ্গে ১৩৫৭ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও তাদের সঙ্গে তালিবানের সম্পর্ক খারাপ। তাছাড়া তালিবান বিরোধী নর্দার্ন এ্যালায়েন্সকে তাজিকিস্তান সাহায্য করছে। এরপর ইরানের সঙ্গে ৯২১ কিলোমিটার সীমান্ত ইরান বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে ৮০৪ কিলোমিটার ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও ঐ দুই দেশের সঙ্গে তালিবানদের সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। চীনের সঙ্গে ৯১ কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও চীন নিজের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারে। তালিবানের প্রয়োজনে নয়। যদিও পাকিস্তান সর্বদা তালিবানদের প্ররোচিত করবে ভারতবিরোধী কাজের জন্য, তবু তালিবান ভৌগলিক কারনে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করেই ভারতে আসতে পারবে। এই মূহুর্তে আফগানিস্তানে তালিবানের যে অবস্থা তাতে অতি বড় মূর্খও ভারত আক্রমণের ঝুঁকি নেবে না। সুতরাং ঢালাও আন্তজার্তিক সাহায্য না পেলে তালিবানের একমাত্র বাঁচার রাস্তা পাকিস্তানকে দোহন করা।
এই আশঙ্কা থেকে পাকিস্তান তার সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্তকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সিল করার প্রস্তাব দয়। তালিবান তৎক্ষণাৎ সে প্রস্তাব নস্যাৎ করে দেয়। তারা যুক্তি দেয়, এতে দু দেশের সাধারণ নাগরিকদের অসুবিধা হবে। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের গরিষ্ট অংশই পাস্তুন। আবার তালিবানরাও পাস্তুন। ফল, তালিবান তাদের অসুবিধা দুর করার জন্য পাকিস্তানীদের উপরেই নির্ভর করবে। আর একানেই রয়েছে পাকিস্তানের মৃত্যুবাণ। কিভাবে?
আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক চাহিদার কিয়দংশ মেটানোর ক্ষমতাও পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের নেই। তালিবান তার শিকার খুঁজবে পাকিস্তানের মধ্যেই। তালিবানের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে সহজ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তান স্বাভাবিক কারনেই তাতে বাধা দেবে। আর তখনই শুরু হবে সংঘর্ষ। এমতাবস্থায় পাকিস্তান হয়ত জৈশী মহম্মদ ও অন্যান্য জঙ্গীগোষ্ঠীর সহযোগিতায় ভারতে অনুপ্রবেশ ও নাশকতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। রিবর্তিত পরিস্থিতে ভারত সরকারের উচিৎ শক্ত হাতে এসবের মোকাবিলা করা – প্রয়োজনে বারবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে জঙ্গী ঘাঁটিগুলি ভেঙ্গে দেওয়া ও আইএসআইয়ের logistic support networkগুলি নষ্ট করে দেওয়া। এই সময় আফগানিস্তানের সরকারের সঙ্গে ভারতের চানক্যনীতি অনুযায়ী সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। চীন পাকিস্তানকে মদত দেয় তার অর্থনৈতিক করিডোর তৈরীর জন্য। যখন আফগানিস্তানে চীনের বন্ধু সরকার থাকবে তখন পাকিস্তানের মত একটি জঙ্গী তোষনকারী দেশের দায় চীন নেবেনা।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানে তালিবান সরকার প্রতিষ্ঠার পিছনে পাকিস্তানের অবদান ও আমেরিকার সরকারের আত্মহনন যেমন দায়ী, তেমনি বেশীদিন যদি তালিবান আফগানিস্তানের মসনদে থাকে তবে তা পাকিস্তানের স্থায়ীত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। এখানে ভারতের বিচক্ষণ ভূমিকা থাকা আবশ্যক।
তালিবানিস্থান ও তার প্রভাব
১৫ই আগষ্ট,২০২১ এর নাটকীয় পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তানে নতুন করে তালিবানি যুগের সুচনা হল। আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী নিরাপত্তা দিলেও আফগান সরকারের পাহাড়প্রমাণ দূর্ণীতি ও স্বজনপোষনের কারনে আফগানিস্তান সরকার কুড়ি বছর সময় পেলেও শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরী করতে পারেনি। তার ফলে তালিবান বাহিনী প্রায় বিনা রক্তপাতে কাবুল-কান্দাহারসহ আফগানিস্তানের ৯৫% জায়গা দখল করতে সক্ষম হল। এর কারন পরপর আলোচনার শেষে এই ঘটনাপ্রবাহ প্রতিবেশী দেশগুলির উপর কি প্রভাব ফেলতে পারে তা ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা সম্ভব হবে।
আফগানিস্তান সরকারের দূর্ণীতির কারনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উপর রাজনৈতিক কন্ট্রোল প্রায় ছিলই না। উপরন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই আমেরিকা তার পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে বড় রকমের ভুল করে বসেছিল। তালিবানদের দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা ও তাদের নীতির কথা মনে থাকলে এই গোষ্ঠীকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়ার মত কাজ অতিবড় মূর্খও করবেনা। বারাক ওবামা লাদেন নিধনে সাফল্য পেয়ে এতটাই সন্তুষ্ট ও আত্মতৃপ্ত ছিলেন যে তালিবানদের ধ্বংস করার কোন চেষ্টাই আর করেননি। হয়ত ভবিষ্যতে রাশিয়া বা চীনের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করার সুপ্ত ইচ্ছা এক্ষেত্রে কাজ করে থাকতে পারে। পরবর্তীতে ট্রাম্প প্রশাসন তালিবানদের মাদক পাচার ব্যবসা ও তোলবাজির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আবার পাকিস্তানের মাধ্যমে তালিবানদের ট্রেনিং ও অন্যান্য লজিস্টিক সহায়তা তারা করে গেছে। ভারতের কুটনৈতিক চ্যানেল এ ব্যপারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরব হলেও তা আসল সত্যিটা খানিক আড়াল করেছে মাত্র। কারন, ন্যাটো এবং আমেরিকার আর্থিক অনুদান যে পাকিস্তান আল কায়েদা ও তালিবান জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ, বিস্তার এবং আধুনিকীকরনে ব্যবহার করছে তা আমেরিকা জানত না – একথা কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করবেনা। পক্ষান্তরে, আমেরিকা ও ন্যাটো দেশগুলি চেয়েছে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও কাশ্মীরে টেনশান এবং জঙ্গী কাজকর্ম অব্যহত থাকুক। তারা মনে করেছে এর ফলে এই উপমহাদেশে অসন্তোষ ও জঙ্গী কাজকর্ম চলতে থাকলে তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বাড়বে আর ভারতকে পাকিস্তানের মত বেশী করে তাদের মুখাপেক্ষী করে রাখা যাবে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমী দেশগুলি কখনো চায়নি যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক। সেকারনে পরপর এমন সরকারকে তারা পাকিস্তানে বহাল রাখতে চেয়েছে যারা ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদকেই মূলমন্ত্র হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশের জন্মকে না মানতে পেরে পাকিস্তান এবং তাদের এজেন্টরা “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” শ্লোগান তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “দিল্লীর এজেন্ট” বলে প্রচার করছে। ভারত বিরোধী ও ভারতের বিভাজনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বানিয়ে পাকিস্তান শুধু আল কায়েদা বা তালিবান নয়, বিশ্বের তাবৎ ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলির আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে।
যখন ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য অপসারণের কথা ঘোষণা করে তখন থেকেই পাকিস্তান আল কায়েদা ও তালিবান জঙ্গীদের আফগানিস্তান দখলের ব্লুপ্রিন্ট তৈরী করে। এই সময় অতিমারী ও নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পরায় সুষ্ঠুভাবে সেনা অপসারণের কোন পরিকল্পনা ট্রাম্প করতে পারেননি। পরবর্তীতে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে সৈন্য তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেন। এর দুটি প্রাথমিক কারন অনুমান করা য
আয়। প্রথম হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনীর বিপুল খরচ বহন কর
আ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পরেছিল। দ্বিতীয়তঃ, বাইডেন প্রশাসন এই উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পাকিস্তানকে অধিকতর নিকট সহযোগী মনে করে। বিশেষতঃ ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের কথাবার্তা ও কাজকর্ম সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। সেই পূর্বনির্ধারিত ধারনা থেকে আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন আন্তর্জাতিক নীতিতে কয়েকটি বালখিল্যসুলভ ভুল সিদ্ধান্ত নিল।
আফগানিস্তানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হাজারা, পাস্তুন, উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন ও বালুচ। এছাড়া আরো কিছু ছোট ছোট গোষ্ঠীও আছে। এইসব বড় গোষ্ঠীর সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন সৈন্য অপসারণের ব্যপারে কোন বৈঠক করেছে বলে জানা যায়না। শুধু তাই নয়, উত্তরের পঞ্জশির অঞ্চল, যা আগের তালিবান সরকার দখল করতে পারেনি; এমনকি সোভিয়েত রাশিয়াও পঞ্জশিরের উপর রাজ করতে পারেনি। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত আফগানরা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা প্রকৃতির। পঞ্জশির তার ব্যতিক্রম নয়। এই দূর্গম এলাকায় সেখানকার জাতীয় বীর আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে প্রথমবার তালিবান বাহিনীকে রুখে দিয়েছিল। তারপর ওসামা বিন লাদেনের চক্রান্তে এই আহমদ শাহ মাসুদকে হত্যা করা হয়। সেজন্য এখন তাদের নেতা এবং আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমেদ মাসুদ এদের নেতা। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, এবারও তালিবান বিনাযুদ্ধে পঞ্জশির দখল করতে পারবেনা। আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহ তাঁর দলবল সহ এই আহমেদ মাসুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তিনি আফগানিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। এই মুহূর্তে পঞ্জশিরের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা বাগলানের তিনটি জায়গা – পুল-ই-হিসার, দেহ-সালাহ এবং বালুতে এদের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের লড়াই অব্যহত। ওদিকে রাশিয়ার ঘনিষ্ট তাজিকিস্তান তালিবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এবারের পরিস্থিতি আগের বারের থেকে খানিকটা ভিন্ন। প্রথমতঃ, বাইডেন প্রশাসন তালিবানদের সঙ্গে ছাড়া আর কোন আফগান গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় বসেনি! অধিকন্তু, পাকিস্তান যে আফগানিস্তানে জঙ্গীদের মদত দিচ্ছে তা জানা সত্বেও আমেরিকা পাকিস্তানকে বিশ্বাস করেছে! ফলে, তালিবান হুমকির কাছে শর্তবিহীন নতিস্বীকার করে মার্কিন সৈন্য অপসারণের কাজ ৩১শে আগস্টের মধ্যেই করবে বলে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে। এদিকে তালিবানদের সমর্থন করে চীন এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সমর্থ হল। সঙ্গে রাশিয়াও তালিবানদের প্রতি এখনো পযর্ন্ত নরম মনোভাব নিয়ে চলছে। বাইডেনের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বে আমেরিকার দাদাগিরির অবসানের সুচনা হল। এখন বাইডেন প্রশাসনের অবস্থা সাপের ছুঁচো গেলার মত। না পারছে তালিবানদের গিলতে; না পারছে উগরে ফেলতে। এগুলেও বিপদ, আবার পিছলেও বিপদ।
এবার আসি পাকিস্তান-যোগের কথায়। পাকিস্তানের অর্থনীতি বিদেশী সাহায্য ছাড়া দেউলিয়া হওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সাহায্য পাওয়া বিদেশী মুদ্রার প্রায় পুরোটাই দুটি খাতে ব্যয় করছে। একটি হল, ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি ও অন্যটি হল তালিবান, আল কায়দা, জৈশি মহম্মদ ইত্যাদি জঙ্গী সংগঠনগুলির লালন, পালন ও ট্রেনিং। কয়েকদিন আগে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জৈশি মহম্মদ ও লস্কর-ই-তৈবার মত জঙ্গী গোষ্ঠীগুলি তালিবানের সমর্থনে মিছিল বের করেছে। প্রথম থেকেই তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালিবানদের দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সর্বোপরি ইমরানের দলের এক নেত্রী নীলম ইরশাদ শেখ এক টিভি সাক্ষাতকারে বলেছে যে, ভারত থেকে কাশ্মীরকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন করতে পাকিস্তানের সঙ্গে তালিবানরাও যোগ দেবে। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান ফৈজ হামিদের সঙ্গে তালিবানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মোল্লা বেরাদরের বৈঠক হয়েছে। বলা হচ্ছে, তালিবান প্রধান হায়বাতুল্লা আখুন্দজাদা পাকিস্তানে বসেই তার কার্যকলাপ চালাচ্ছে। এসবই পাকিস্তান করে চলেছে ভারতকে ভাঙ্গার বাসনা নিয়ে। কিন্তু তাদের কয়েকটি মারাত্মক ভুলের জন্য পাকিস্তানকেই চরম মূল্য দিতে হবে। কিভাবে?
প্রথমতঃ তালিবান এমন একটি জঙ্গীগোষ্ঠী যারা যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়া আর কিছুই জানে না। দেশ শাসন ও অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ধারনা বা বোধ, কোনটাই তাদের নেই। ফলে সম্পূর্ণ আফগানিস্তান তাদের দখলে এলে তারপর তারা নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বাড়াতে চাইবে। এরজন্য ভারতের কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে পাকিস্তানের বালুচিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে তাদের শাসন আগে কায়েম করতে হবে। মহিলাদের সঙ্গে আচরনসহ বিভিন্ন কারনে পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাঁধা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কান তাদের ‘শরিয়তী শাসন’ পাকিস্তান মানেনা। ওদিকে আবার আফগানিস্তান থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পাকিস্তানে ঢুকছে। পাকিস্তানের তালিবান মদতের কারনে তার সঙ্গে আফগান সীমান্ত বন্ধ করা অসম্ভব। পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর চাপে বিপর্যস্ত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে পাশ্চাত্যশক্তিগুলির অর্থসাহায্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ। উপরন্তু অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য পাকিস্তানের উপর চীনে নির্ভরতা অনেকটা কমে যাবে যদি আফগানিস্তানের তালিবানিদের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকে। বিশ্বের জঙ্গী সাপ্লাইয়ের কারখানা পাকিস্তানকে সেই অর্থে চীন সহ কোন দেশই বিশ্বাস করে না। এমতাবস্থায় পাকিস্তান চেষ্টা করে যাবে যাতে আফগান শরণার্থীদের বড় অংশকে ভারতবিরোধী জঙ্গীগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে এই ধরনের মানসিকতার কোন মানুষ শরণার্থী হয়ে আসবেনা। যারা আসবে তারা তালিবান-বিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষ। জঙ্গী মানসিকতার বিরোধী বলেই তারা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হয়ে আসছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আবার তালিবান তাদের তোলাবাজির জন্য পাকিস্তানকেই সহজ শিকার হিসেবে পাবে। আর তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের বিবাদ শুরু হলেই তালিবান পাকিস্তানকে খন্ড বিখন্ড করার চেষ্টা করবে। তখন এই পুরো অঞ্চলটায় চীনের দাদাগিরি বাড়বে – একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এদিকে ক্রমশঃ তালিবানের দখলে থাকা আফগানিস্তানে যেভাবে মহিলা ও সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার আর ফতোয়ার মাত্রা বাড়ছে তাতে রাশিয়ার তাঁবে থাকা তাজিকিস্তান তালিবানের বিরুদ্ধে চলে গেছে। মনে রাখতে হবে যে আফগানিস্তানের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ৪৬ শতাংশ মানুষ তাজিক – যাদের সঙ্গে তাজিকিস্তান একাত্মতা অনুভব করে। পাকিস্তানের শত চেষ্টাতেও তাজিকিস্তান তালিবানদের দখলকে স্বীকার করেনি, উপরন্তু তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি এক জঙ্গী হানায় কাবুলে তেরোজন মার্কিন সেনা সহ প্রায় দেড়শো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর দায় এর মধ্যেই সরাসরি বাইডেন প্রশাসনের উপর পড়েছে। তালিবান জঙ্গীদের উপর নরম থাকায় বাইডেন প্রশাসনকেই এর জবাব দিতে হবে। তালিবান অবশ্য এই নাশকতার দায় আইসিসের উপর চাপিয়েছে। তবে এই মূহুর্তে তালিবান কন্ট্রোলে থাকা কাবুলে আইসিস এসে নাশকতা চালিয়ে চলে গেল- এমন গল্প বিশ্বাস করার মানুষ খুঁজে পাওয়া শক্ত। আবার পাকিস্তান ও বাইডেন প্রশাসন মিলিতভাবে ‘ভাল তালিবান’ আর ‘খারাপ তালিবান’ তত্ত্ব খাড়া করার অক্ষম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
এখনো অব্দি ভারতের ভূমিকা এ ব্যপারে যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে। ভারত শত উস্কানিতেও কোন বেফাঁস মন্তব্য করেনি। আর তার একমাত্র প্রায়োরিটি রেখেছে আফগানিস্তানে আটকে পরা ভারতীয়দের ও আফগান নাগরিকদের মধ্যে শিখ ও হিন্দু, যারা ভারতে আসতে চায়, তাদের ভারতে নিয়ে আসা। এদিকে ভারতীয় দুতাবাসে ভাঙ্গচুর ও বহু ভারতীয় ভিসা লুঠপাট করার ঘটনার পর ভারত শুধু ই-ভিসা ছাড়া আর সব ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। ফলে, ওই লুঠ করা ভিসা ব্যবহার করে কোন অবান্ছিত মানুষ ভারতে ঢুকতে পারবেনা।
পরিশেষে বলি, আন্তজার্তিক স্বীকৃতি না পেলে ও অর্থ সাহায্য না মিললে পাকিস্তান ও তালিবান – কারো পক্ষেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যত তারা চাপে মধ্যে পড়বে, তত শরিয়তী আইনের নামে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকবে। ফল, একমাত্র শক্তিশালী রাষ্ট্র যে এখনোসতালিবানের সঙ্গে আছে, অর্থাৎ চীন – সেও তাদের সম্পর্কে নতুন করে পর্যালোচনা করতে বাধ্য হবে।
কোভিড ১৯ এর জেরে মানুষের হয়রানি
কোভিড ১৯ এর দাপট এখনো পুরোদমে সারা দেশ জুড়ে চলছে। একের পর এক ‘ভ্যারিয়েন্ট’ আর ‘স্ট্রেইন’ আবিষ্কার হচ্ছে। ল্যাটিন অক্ষরের নামে পরপর ভ্যারিয়েন্ট বেরিয়েছে। আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা (আবার ডেল্টা+ ও চলছে)। এখন শুনছি ল্যমডা আর এফসাইলনও বেরিয়েছে! মনে হয়, হমস্ত ল্যাটিন অক্ষরই একের পর এক আসবে। অর্থাৎ জিটা অব্দি আমাদের এই ভোগান্তি চলবে! মানুষের ভোগান্তি ত শুধু অতিমারী নয়, এই অতিমারীতে কারুর সর্বনাশ ত কারুর পৌষমাস। যেদিন থেকে দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে যত না মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে; রাজনীতি হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশী। কোথাও বলা হচ্ছে, দেশের সব মানুষকে বিনাপয়সায় ভ্যাকসিন দিচ্ছেন প্রধাণমন্ত্রী! অর্থাৎ ১৪০×২ = ২৮০ কোটি ভ্যাকসিন ‘বিনাপয়সা’য় দেওয়ার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর! অথচ এমন কোন ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা অন্য সরকারী ঘোষণায় নেই। এটি চাটুকারীতার নিম্নরুচির রূপ মাত্র। এদিকে রাজ্যে বলা হচ্ছে, মূখ্যমন্ত্রী নিজে রাজ্যের সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেবার দায় নিয়েছেন! এমন কথা রাজের কোন সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে নেই। আর এটা কোন রাজ্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেও চাটুকারীতা ‘গল্পের গরু গাছে’ তুলেছে। কিছু স্বঘোষিত ‘প্রথম শ্রেণী’র সংবাদ মাধ্যমও একাজে নেমে নিজেদের খেলো করছে। কেন্দ্রীয় সরকার অগ্রাধিকার মূল্যে (preferencial price) কিনে তারপর বিভিন্ন রাজ্যে চাহিদা অনুযায়ী পাঠাচ্ছে। আর রাজ্য সরকারের উপর দায়িত্ব বর্তায় সঠিক ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে এর প্রয়োগ করা। আবার দেশের ও রাজ্যের বড় সংখ্যক মানুষ বাজারের বেসরকারী টিকাকরণ কেন্দ্র থেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে টীকা নিচ্ছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার, টীকার যোগান বিভিন্ন রাজ্যে যে সর্বদা জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে তা নয়। কিসের ভিত্তিতে রাজ্যে রাজ্যে কত সংখ্যক টীকা পাঠানো হচ্ছে তার কোন স্বচ্ছ নিয়ম জানানো হচ্ছেনা। আবার রাজ্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গাফিলতিতে যে টীকাকরণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তারও যথেষ্ট উদাহরণ আছে। যেমন বেশ কিছুদিন কোভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও কোভ্যাকসিন টীকা দেওয়া যায়নি টীকা না থাকার দরুন। ‘বাজারী’ মাধ্যম যথারীতি কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘গালাগাল’ শুরু করার পর জানা গেল, পৌরসভা দ্বিতীয় ভ্যাকসিন প্রাপকদের কোটা সরিয়ে রেখে প্রথম ডোজের কোভ্যাকসিন দেওয়ার সরকারী নির্দেশ না মেনে প্রথম ডোজেই টীকা খরচ করে ফেলেছে! এটা পৌরসভার গাফিলতি। আশ্চর্য লাগে, বিষয়টা জানাজানি হবার পরে ‘বাজারী’ সংবাদ মাধ্যম একদম চুপ করে গেল! অদ্ভুত প্রবৃত্তি। বোঝাই যাচ্ছে, কোভিড১৯ এর ব
ইরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের মত করে লড়াই করছে – আর সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি চাটুকারদের সহযোগীতায় এর থেকে রাজনৈতিক ফয়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এবার আসি অন্যান্য ক্ষেত্রে কোভিড১৯ এর প্রভাবে। বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্য সরকারগুলির উপর কোভিড১৯ এর আচরনবিধি তৈরী ও তা পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। শুধু বিদেশে উড়ান সংক্রান্ত এবং আন্তররাজ্য রেল চলাচলের ব্যপারটা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করছে। ফলে, আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনের ব্যপারগুলি রাজ্য সরকার নিজের মত করে নিয়ম ও তা পালন করার নির্দেশ দিচ্ছে। যেমন উত্তরপ্রদেশে গাড়ী চলাচলে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন ইটারী হাউসের মধ্যে বসে খাওয়া নিষেধ। তবে, খাবার প্যাক করে নিয়ে যাঔয়া ও হোম ডেলিভারী চালু আছে। এদিকে দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ। কাঁচা বাজার খোলা। সেখানে কোন বাধানিষেধ নেই। আবার আমাদের রাজ্যে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট সব খোলা। যানবাহন চলছে। শুধু লোকাল ট্রেণ বন্ধ! এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? যেসব খোলা আছে তাতে সংক্রমণ হচ্ছেনা, এমনকি ভিড় বাসেও সংক্রমণ বাড়বে না – শুধু লোকাল ট্রেণ (দুরপাল্লার ট্রেণ চলছে) চললেই তাতে সংক্রমণ বাড়বে! এমন অবাস্তব যুক্তির কারন কি? এখানে উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র, যেখানে সংক্রমণ সর্বাধিক, তারাও লোকাল ট্রেণ চালু করেছে।
এই অদ্ভুত খেয়ালী সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের পেটে শুধু যে টান পরেছে তাই নয়, আপামর রাজ্যবাসীই ভুগছে। প্রথমতঃ, এইসব মানুষের রুজি রোজগারের জন্য যাতায়াতের সবচেয়ে শস্তা মাধ্যম লোকাল ট্রেণ। ফলে তারা অনেক বেশী টাকা খরচ করে সড়কপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে অথবা রুজি রোজগার হারাচ্ছে। আবার দুধ, কাঁচা তরকারী ও লোকাল মাছের যোগানের প্রধান মাধ্যম ছিল লোকাল ট্রেণ। সেজন্য শহরে এইসব জিনিষের যোগানে ঘাটতি হচ্ছে। এর ফলে এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। তেমনি উৎপাদনের জায়গায় পরিবহনের অভাবে চাষীরা ফসলের সঠিক মূল্য পাচ্ছেনা। এদিকে আবার পরিবহন-জ্বালানীর সরকারী শুল্কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির শিকার দেশের আমজনতা। আর ‘অতিরিক্ত লাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’ যা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান ধর্ম, তা এখন নির্বাচিত সরকারের কাজ হয়েছে। ফলে, সরকার যদি শতকরা পাঁচভাগ শুল্ক বাড়ায়, ব্যবসায়ীরা কুড়িভাগ মূল্যবৃদ্ধি করে! ফলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া আর সব পণ্যের বিক্রিতে চরম মন্দা।
আমাদের দেশের বরিষ্ট নাগরিকদের শতকরা একভাগ মাত্র পেনশন পান। এখানে আমেরিকার মত সোশ্যাল সিকিউরিটির কোন সংস্থান নেই। এই নাগরিকদের জীবনধারনের জন্য ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সুদের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই সুদ সরকার ক্রমশঃ কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারের বক্তব্য, তাহলে ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা কম সুদে ব্যাঙ্গের থেকে টাকা ধার নেবে! এইসব অর্থনীতিবিদরা কোথায় জন্মায় কে জানে! সুদ কমিয়ে মানুষের হাতের নগদের যোগান হ্রাস করলে বাজারের দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস পাবে। তার ফলে কোন লগ্নিকারী দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস পেলে তা উৎপাদনের জন্য ব্যাঙ্কঋণ নেবেনা। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে। আবার আমাদের সরকার (কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ই ) অনুৎপাদক অনুদানে দেদার টাকা খরচ করছে। তাতে সরকারী কোষাগারে যে টান পড়ছে তা মেটানোর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় করই বৃদ্ধি করছে। এভাবেই কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারের ভুল নীতির ফলে আমজনতা – বিশেষতঃ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলশ্রেণীর মানুষের উপর অত্যধিক চাপ বেড়েছে।
এরপর আসি ভবিষ্যত প্রজন্মের পড়াশোনার প্রশ্নে। সেই ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় – সব স্তরের ক্লাসরুম লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল; তারপর এখন অব্দি এসব খোলার নামগন্ধ নেই! উঁচু ক্লাসের কিছু কিছু মাঝখানে খুললেও কয়েকদিনের মধ্যে সেসব বন্ধ করে দেওয়া হল। সিনেমা হল, খেলার মাঠ, পার্ক, বাস, অটো, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল – সব খোলা। এই অদ্ভুত মানসিকতার কোন ব্যখ্যা দেওয়া যায়না। এমনকি দুরপাল্লার ট্রেণ, বিমান সব চলছে। মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে! শুধু ক্লাশরুমে পড়াশোনা বন্ধ। শিক্ষকরাও এখন “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করছেন। চল্লিশ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জরিত থাকার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যে, আমাদের দেশে যা পরিকাঠামো, তাতে অনলাইনে প্র্যাকটিক্যালসহ সবরকম শিক্ষা দেওয়া ও নেওয়া একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা মাত্র।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমেরিকায় শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও নীতির বাস্তবায়ন সর্বদা অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের হাতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এর দায়িত্ব কোন আই এ এস অফিসারের হাতে! এদের না আছে অভিজ্ঞতা, না আছে জ্ঞান। ফলে এরা কর্তাভজা নীতি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভুরা যা চান তাতেই সায় দেন! এরা সর্বদা হীনমণ্যতায় ভোগায় নিজেদের জাহির করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ‘গবুচন্দ্র’ মন্ত্রীর মত নিদান দেন। আর অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ‘হবুচন্দ্র’ রাজা রাজনীতিক তা অনুমোদন করেন। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ত বটেই, আমেরিকাও তাদের সমস্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি নার্শারী ক্লাশও খুলে দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশে “খেলা”, “মস্তি” সব হবে – শুধু পড়াশোনা বন্ধ!
এরপর আসি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে সেরা রসিকতায়। দশ ক্লাস ও বারো ক্লাসের বিনা পরীক্ষায় ‘পাশ’ ও ‘নম্বর’ পাওয়ার কথায়! শিক্ষার হর্তা-কর্তা-বিধাতারা ভুলে গেছেন যে, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং মূল্যায়ণ একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পদ্ধতি এবং পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ আবশ্যিক। আর তা নাহলে পরীক্ষা এবং পুরো শিক্ষা পদ্ধতিটিই তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। এক্ষেত্রে অতিমারীর দোহাই দিয়ে পুরো শিক্ষাপদ্ধতি ও তার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করে দেওয়া হল। প্রথমতঃ, যদি স্কুলের পরীক্ষার ভিত্তিতে নম্বর দিতে হয় তবে স্কুল থেকে sent up করা সমস্ত ছাত্রছাত্রীই স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করেছে ধরে নিতে হবে। তা নাহলে তাদের sent up হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন স্কুলের মান ও পরীক্ষার নম্বরের মানের মধ্যেও কোন সাম্যতা নেই। তারপর পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল CBSEতে ০.৬৩% ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে! কিভাবে হল? মূল্যায়নের পদ্ধতিতে কোন স্বচ্ছতা নেই। আবার আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে ফেলের সংখ্যার শতকরা হার আরো বেশী। নম্বর পাওয়া – পাশ-ফেল পুরো পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। সবচেয়ে বড় কথা, এইসব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষায় গিয়ে কি করবে? অতিমারীর দোহাই দিয়ে অযোগ্য প্রশাসকদের গাফিলতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার বীজ রোপন করা হল। উচ্চপদস্থ মানুষজন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের সন্তান সন্ততিদের ইউরোপ, আমেরিকায় পড়তে পাঠাবে। তাদের ব্যক্তিগত কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু সাধারন ঘরের ছাত্রছাত্রীরা তাদের ভবিষ্যত ধ্বংসের চিত্রনাট্যের কুশীলব হয়ে রইল – এটাই দুঃখের।
অনেক হয়েছে। WHOর নিদান মেনে এখুনি সমস্ত স্কুল, কলেজ খোলা হোক।যদি সব সতর্কতা মেনে সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্লাসরুম পঠন-পাঠন শুরু করা যায়, তখন আগের অতিমারীর ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় ট্রেণিং দিয়ে দুবছরের মধ্যে তাদের ঘাটতির জায়গাগুলি make-up করা যেতে পারে। অন্যথায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আর ফেরানো যাবেনা।
গণতন্ত্রের নামে দেশাত্মবোধের বিরোধীতা রাজনীতি নয়
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট যে শিশু ভূমিষ্ট হয়, এখন তার পঁচাত্তরতম জন্মদিন পূর্ণ হতে চলেছে। প্রথম পঁচিশ বছর কেটেছে শৈশবে, দেহের পূর্ণতা পেতে এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উন্নতিকল্পে। পরের পঁচিশ বছর কাটলো বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণের চেষ্টায়। আর শেষ পঁচিশ বছর পূর্ণতা প্রাপ্ত দেশ উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের পরের পঁচিশ বছরের কর্মসূচী হোক “নাগরিকের কর্তব্যবোধ”।
আমরা অর্থাৎ ভারতের জনগণ স্বাধীনতার আগে থেকেই এক অদ্ভুত আত্মঘাতী রাজনীতির শিকার। কেমন করে? যেমন ধরা যাক, বড় নেতার কাউকে অপছন্দ। তাই বড় নেতা ও তার দলবল (বলা ভাল, স্তাবককুল) অপছন্দের নেতাকে সরাতে দরকারে শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হয়না। এই ঔদ্ধত্ব ও স্তাবকতা ভারতীয়দের মজ্জাগত। ইতিহাসে তার ভূরিভূরি প্রমাণ আছে। এখানে নির্দিষ্ট পরিসরে সেসব আলোচনার জায়গা নেই। তবে এটা না বললেই নয় যে এর ফলে আমাদের দেশের অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে। এই জায়গাতেই মানসিকতার বদল দরকার। কারন, দেশের উন্নতির প্রথম সোপান হল সমাজের উন্নতি। আর সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন আমাদের কর্তব্যবোধ ও সচেতনতা আসবে।
স্বাধীনতা উত্তর যুগে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারনা হয়েছে – যে সরকার (অবশ্যই দলীয়) যত বেশী অনুদান দেবে সেই সরকারই তত ভালো কাজ করছে! এটি কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের পরিপন্থী। সরকার যখন এ ধরনের অনুদান বাড়াবে, তখন তার অর্থভান্ডারের উপর অনুৎপাদক খরচের বোঝা বৃদ্ধি পাবে। আর এই অতিরিক্ত অর্থের যোগানের জন্য সরকার সাধারণ মানুষের উপর বিভিন্ন খাতে করের বোঝা বাড়াবে। এর ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ণ, কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা – সবই বাধা পাবে। তথাকথিত ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির থিওরী আউরে কিছু নোবেল প্রাইজ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে সেই ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি মেনে চলা সরকারগুলি যে তাদের দেশের দারিদ্র ঘোঁচাতে পেরেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবশ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে কম্যুনিষ্টরা সর্বদা এই অনুদান প্রথাকে সমর্থন করে। তার কারন দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, এতে দরিদ্র জনসাধারণের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের সরকারি টাকায় অনুদানের মাধ্যমে দলীয় কন্ট্রোলে রাখা যায়। দ্বিতীয়তঃ, দরিদ্র জনগনের পক্ষে সরকারি ও দলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কোন দেশেই এই পদ্ধতিতে দেশের ও সমাজের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।
এবার আসি অন্যান্য কর্তব্যবোধের কথায়। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে সামাজিক বৈষম্যের শিকার। সমাজে একদল মানুষ শুধুমাত্র জন্মের ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবে আর অন্যেরা বঞ্চিত থাকবে – এতে শুধু যে সামাজিক সাম্য ব্যহত হচ্ছে তাই নয়, সামাজিক উত্তেজনা ও হিংসার ঘটনা ঘটছে। এতে দেশাত্ববোধের মূলেও কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। এর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্ণধারদেরই শুধু নয়, সমস্ত দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে।
সমাজের সকল স্তরে সার্বিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ না থাকলে একটি জাতি শুধুমাত্র স্বাধীন দেশের পতাকাসম্বল করে বিশ্বের দরবারে কোন ছাপ ফেলতে পারেনা। সবচেয়ে আগে যে বোধটা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে থাকা প্রয়োজন তাহল দেশাত্মবোধ। আমাদের ভারতীয়দের মধ্যেই দেশাত্মবোধের ধারনায় ফারাক আছে। এই অবস্থার জন্য বর্তমান সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষই দায়ী। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর সংসদে বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী একদিন সন্ধ্যায় অটলজীকে জরুরী তলব করলেন। তারপর অটলজী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। অটলজী বেরিয়ে যাবার পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাংবাদিক বৈঠকে জানানো হল, রাষ্ট্রসংঘে কাশ্মীর প্রশ্নে তোলা বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করবেন বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী এবং অটলজীর রাজনৈতিক দর্শনের ফারাক বিস্তর। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জানতেন যে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও অন্যান্যদের মুখের উপর জবাব দেওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি হলেন অটলবিহারী। আর অটলবিহারীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যতই রাজনৈতিক দূরত্ব থাকুক, দেশের স্বার্থে তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁরা একমাত্র দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এখন! পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর উপর জঙ্গী হামলার ঘটনাকে অস্বীকার ও বিকৃত করার চেষ্টায় বেশ কিছু বিরোধী নেতৃত্বের ভূমিকা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এখন রাজনীতি সর্বদা বিরোধীতায় শুরু আর বিরোধীতায় শেষ হয়। একমাত্র কম্যুনিষ্ট দলগুলিই যেকোন ভারতবিরোধী কাজে উল্লসিত হয় বা নীরব থেকে বুঝিয়ে দেয় যে তারা ভারত সরকারের সঙ্গে নেই। ১৯৬২ সালের চীনা আগ্রাসনের সময় থেকে সাম্প্রতিক জঙ্গী হানা, এমনকি লাদাখ-প্যাংগং লেকের ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিন্দায় তারা ব্যপৃত ছিল। এই ট্রেন্ড এখন বিরোধী নেতাদের মধ্যে বহুলাংশে দেখা যাচ্ছে। আসলে রাজনীতি এখন পেশা হওয়ায় এবং তার জন্য কোন যোগ্যতামান না থাকায় নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের মধ্যে শুধু যে প্রগলভ বা রুচিহীন কথাবার্তার চল হয়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক বিরোধীতা করতে গিয়ে কখন যেন দেশের বিরোধীতা করা হচ্ছে। রাজনীতির মান বাড়ানোর জন্য দেশের স্বার্থে এদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের শিক্ষার আশু প্রয়োজন।
আবার ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অথবা রাজনীতিগত লাভ-ক্ষতির বিচারে সমাজের তথা দেশের প্রতি কর্তব্যবোধও জলাঞ্জলী দেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব্যক্তিগত লাভ ও সুযোগসুবিধা বৃহত্তর সমাজের লাভের চেয়ে আছ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সমাজে মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে বিশেষসুবিধাভোগের প্রত্যাশী। আমাদের দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধাভোগের প্রত্যাশী। দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে শিক্ষা ও চাকরীর সংরক্ষণের পঁচাত্তর বছর পরেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষজন সমাজের বৈষম্য দূরীকরনের চেষ্টার পরিবর্তে এই বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন ব্যতিরেকেও পাওয়ার প্রত্যাশী। একই রকমভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সরকার প্রদত্ত অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুযোগসুবিধা এই অনুদানের রাজনীতিতে ভোটের অংকে ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষকে সুবিধা দিলেও আখেরে দেশের মধ্যে সামাজিক বৈসম্য ও বিভেদের সূচনা করেছে। বিভিন্ন কারনে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত এই বৈসম্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আসলে শ্রেণীবিশেষের মানুষকে বিভিন্ন রকমের অনুদান দিয়ে খুশী রাখা রাজনৈতিক লাভের জন্য ফলপ্রসু হলেও তা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ণের পরিপন্থী। কিভাবে? সরকারী কোষাগারের অর্থ দিয়ে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত কিছু মানুষকে অনুদান দিলে ঐ মানুষদের শ্রমবিমুখ করে তোলা হয় আর সেই সঙ্গে সরকারী কোষাগারের যে অর্থ উন্নয়নের জন্য ব্যয় হওয়ার কথা তাও নষ্ট হয়। অনুন্নয়ণ কর্মসংস্থানকে ব্যহত করে এবং অনুদান মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। এভাবে সমাজে কর্মবিমুখতার সঙ্গেসঙ্গে কর্তব্যবোধেরও অভাব দেখা দেয়। আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা প্রকৃতপক্ষে তাই।
ম্যালথাসিয়ান তত্ত্বের এক অদ্ভুত প্রয়োগ আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যায়। সমাজের যে গোষ্ঠীর কাছে সরকারী অনুদান বেশী পৌঁছায় তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাকি অংশের চেয়ে বেশী। এর বড় কারন, অনুদানের নিশ্চিতকরন যেমন ঐ জনগোষ্ঠীকে বংশবৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা করেছে, তেমনই তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য রাজনীতিকরা দেশের উন্নয়নের চেয়ে এদের অনুদান বৃদ্ধি করে ‘ভোটযুদ্ধে’ জিতে ক্ষমতার মধুভান্ড ভোগ করার সহজ সরল পথটাই বেছে নিচ্ছে। ফলে, খাদ্যভান্ডারের উপর চাপ পড়ছে। খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। আবার এইসব প্রক্রিয়ার ফলে এধরনের মানুষের মধ্যে দেশের ও সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধের বিকাশই হয়নি। এরা ব্যক্তি বা দলবিশেষের প্রতিই বিশ্বস্ত থাকছে।
এর প্রতিফলন আমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। সংবাদমাধ্যমগুলোর, এমনকি সোশালমিডিয়া অব্দি তাদের সঠিক
সংবাদ পরিবেশনের বদলে ব্যক্তিবিশেষ বা রাজনৈতিক দলের প্রচারেই যত্নবান হচ্ছে। বিশেষ সংবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে বা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে জনমত গঠন করার মত অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে এদের তথাকথিত সংবাদ পরিবেশন দেশের ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে।
আগে সমাজে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কথার গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এইসব ‘বিক্রিত’ সংবাদমাধ্যমের প্রচারের ঢক্কানিনাদে তারা ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করেন যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে তাদের দলীয় স্বার্থে মুখখোলা বা কলম ধরা – অন্য সময় তাঁরা কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রামগ্ন থাকেন! আজকাল আবার সব প্রফেশানের মানুষজন ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে বিবেচিত হন! সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে ধরে খেলোয়ারাও নাকি বুদ্ধিজীবী! এর ফলে এদের বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট হয়ে গেছে। এদের কাছে সমাজের সাধারন মানুষের কোন প্রত্যাশাও নেই আর এইসব মানুষজনদের কর্তব্য শুধু বুদ্ধি করে নিজের আখের গুছোনোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আজ, স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে এসে দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কোন রাজনীতিক, কোন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলছেন না যে, আমরা ভারতীয়রা যদি ভারতীয়ত্ব জলাঞ্জলী দিই, তাহলে ভারতের অস্তিত্বই থাকবেনা – সেক্ষেত্রে আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকবেনা। আর আমাদের সমাজের, দেশের প্রতি প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্যবোধ যদি জাগ্রত হয়, আমরা যদি ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে দেশের ও সমাজের স্বার্থে কাজ করি, তবে আমাদের ভারত আবার “জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। এতে কিন্তু ভারতবাসী হিসেবে আমাদের সবার গুরুত্ব বাড়বে।
রাজ্য সরকারের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড একটি রাজনৈতিক চাল
পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্ত বিজ্ঞজনেরা যথারীতি তাদের মালিকের পক্ষে এই প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে আকাশকুসুম বোঝাতে লেগেছে। এই প্রকল্পের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার আগে প্রকল্পটি কি, কেন আর কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার সম্পর্কে না জেনেই অনেকে খুশীতে গদগদ হচ্ছেন; আবার কেউ কেউ নিন্দায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন! সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি একটি রাজনৈতিক গিমিক যা অনুধাবনে বিরোধীরাও সক্ষম নয়।
একের পর এক এমন মনভোলানো পরিকল্পনা গত দশ বছরে রাজ্য সরকার চালু করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এমন কিছু প্রকল্প এনেছে যাতে কাজের থেকে অকাজ বেশী হয়েছে। এমনই একটি স্কীম এই রাজ্য সরকারের নবতম স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প। এটি আদতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি অঙ্গীকার পত্র যা গেজেটে ৩০শে জুন,২০২১ এ প্রকাশিত হয় এবং পরদিন থেকেই কার্যকর হয়। এই প্রকল্পটি নিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এটি কিন্তু ব্যাঙ্ক কৃষককে টাকা ঋণ দিল আর কৃষক টাকা নিয়ে শোধ দিলনা – তখন সরকার ব্যাঙ্কের ঋণ মুকুব করে দিল – এমন নয়। এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে একটি ঘোষণাপত্র যাতে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে পশ্চিমবঙ্গে দশ বছর বা তার বেশীদিন ধরে বসবাসকারী ছাত্র-ছাত্রী বা তার অভিভাবক থাকলে তারা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে প্লাস্টিক কার্ড যা আদতে ক্রেডিট কার্ড পাবে এবং এই কার্ডে শর্ত সাপেক্ষে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবে। এই ঋণ পনেরো বছর বা চাকরী পাওয়ার পর, যেটি আগে হবে, পরিশোধ করতে হবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বহু বছর আগে থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের স্টাডি লোনের ব্যবস্থা ব্যাঙ্কগুলি থেকে চালু আছে যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম মেনে ব্যাঙ্কগুলি উৎসাহী ও যোগ্য ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে থাকে। সুতরাং এটি নতুন কিছু নয়। এখানে কয়েকটি চমক দেখানোর চেষ্টা হয়েছে মাত্র।
যে ব্যাঙ্কগুলি ক্রেডিট দেবে তাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদেশে ক্রেডিট দেওয়ার কথা নয়। তারা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ ও গাইডলাইন মেনে চলে। এরা কেউই পশ্চিমবঙ্গের সরকারের অধীনস্ত নয়। এখানে রাজ্য সরকারের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়। রাজ্য সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলির উপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তীক্ষ্ণ নজর ও পর্যবেক্ষণ থাকার কারনে তারাও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গাইডলাইনের বাইরে কিছু করতে পারবে না। এদিকে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা অনুচ্চারিত! বিদেশে পড়ার ব্যপারেও এই ঋণ নাকি পাওয়া যাবে! তাতে কেন্দ্রীয় সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ঋণগ্রহীতা ও ঋণ দেওয়া ব্যাঙ্কের ভূমিকা থাকে। এখানে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কি? সে ত গ্যারান্টারও নয়!
হ্যাঁ, এই ধরনের ক্রেডিট ঋণের সুদ ৬.৫-৭.৫% হওয়ায় এই ঋণগ্রহীতাদের সুদের ২.৫-৩.৫% রাজ্যসরকার দেবে এবং ঋণগ্রহীতাকে ৪% সুদ দিতে হবে। আর ৪ লাখ টাকার উপরে যে ৫% মার্জিন মানি দেওয়ার কথা,সেটি স্টাডি লোনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। এমনকি ছাত্রদের নিজেদের খরচে ইন্সিওরেন্স অবধি এক। প্রায় পুরো প্রকল্পটিই চালু স্কীমকে টুকে দেওয়া। শুধু তফাতের জায়গাগুলি বলছি। প্রথমেই আসি, এধরনের লোনের ক্ষেত্রে ৬.৫-৭.৫% সুদের ব্যপারটায়। এখানে সরকার যে ২.৫-৩.৫% সুদ মেটাবে তার জন্য সরকারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক নিশ্চয়ই আলাদা চুক্তি করবে। শুনতে ভালো। কিন্তু ওর বাস্তবায়ন কতটা হবে! ঋণ দেওয়ার ব্যাঙ্কগুলি রাজ্য সরকারের অধীন নয় এবং তারা তাদের নিজেদের নিয়মে কোল্যাটারাল সিকিউরিটি চাইবে। কারন, ঋণ খেলাপের দায়িত্ব ঋণ দানকারী ব্যাঙ্কের অফিসারদের উপর বর্তায়। এদিকে রাজ্য সরকার গ্যরান্টার হলে যে বাস্তব অসুবিধাগুলো আছে সেগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য সরকার কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষ বা কোম্পানি নয় যে তার সম্পদ সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে মর্টগেজ রাখবে। অর্থাৎ কোন ছাত্রের ঋণের কোল্যাটারাল সিকিউরিটি রাজ্য সরকার দিতে পারে না। আবার ব্যাঙ্কও এই ধরনের সিকিউরিটি নেবে না কারন তা কার্যকর করার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। সুতরাং, রাজ্য সরকার যদি এই ঋণের কো-গ্যরান্টার (ছাত্র বা অভিভাবক গ্যরান্টার) হয় তাহলে, সম্পূর্ণ ঋণের সরকারের ভাগের সুদ মেটানোর বাৎসরিক সংস্থান রাজ্য সরকারের বাজেটে আলাদাভাবে থাকতে হবে। যতদূর জানি, আমাদের রাজ্য বাজেটে এ ধরনের সংস্থান আলাদাভাবে দেখানো হয়নি।
এরপর আরেক জায়গায় স্টাডি লোনের সঙ্গে এই প্রকল্পের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কোন চাকরীর পরীক্ষা, যেমন IAS, IPS, WBCS, SSC ইত্যাদির ট্রেণিং নেওয়ার বেসরকারী ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার জন্যও ঋণ মিলবে! ফি ছাড়াও থাকা-খাওয়া ও বইপত্র ইত্যাদি কেনার জন্য যথাক্রমে ২০% ও ৩০% ঋণ মিলবে! তারপর যদি সেই ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় কৃতকার্য না হতে পারে তবে সে পনেরো বছরের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কিভাবে ঋণ শোধ করবে? সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কি? তারা কি ঋণ পরিশোধ ও সুদের দায়িত্ব নেবে? যদি না নেয়, তবে কোন ভরসায় ব্যাঙ্ক এই ধরনের ঋণ দেবে? বিশেষতঃ যেখানে ঋণের কোন সিকিউরিটি নেই।
এবার শেষ তফাৎটির কথা বলি। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, ক্লাশ টেন পাশ করার পরই কোন ছাত্র বা ছাত্রী এই ঋণের আবেদন করতে পারবে! অর্থাৎ হায়ার সেকেন্ডারী ক্লাসে পড়ার জন্যও এই ঋণ পাওয়া যাবে। কাজেই একে শুধু উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ বলা যাবেনা। এই ঋণ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কীম নাম দিয়ে রাজ্য সরকার এমন একটি প্রকল্প ঘোষণা করে দিল যার উপর সরকারের কোন কার্যকরী কন্ট্রোলিং ভূমিকা নেই। এটা অনেকটা রাজ্যের মানুষের সুবিধার নাম দিয়ে ব্যাঙ্কের বিভিন্ন স্কীম ঘোষণা করার মত! সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্রেডিট কার্ড রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক নয়, ব্যাঙ্কগুলি একমাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদন সাপেক্ষে দিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বুদ্ধিমানের মত এমন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যেটা প্রায় ৯০ শতাংশ হচ্ছে বহু বছর ধরে চালু স্টাডি লোনের নামান্তর মাত্র। শুধু তফাৎগুলি এখানে আলাদাকরে উল্লেখ করা হল।
কি অদ্ভুত ছেলেভোলানো বিজ্ঞপ্তি! ক্রেডিট কার্ড দেবে ব্যাঙ্ক যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মে চলে। ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা, ঋণ প্রদানের নিজস্ব পদ্ধতি ও নিয়ম নীতি আছে। মানলাম, সেসব মেনেই ব্যাঙ্কগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের ঋণ দিল। এবার এই ঋণের পদ্ধতিগত রিলিজের কথা যা বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, তার সঙ্গে কিন্তু প্রচলিত স্টাডি লোনের কোন তফাৎ নেই।
এবার আসি এই সরকারী আদেশনামার অসারতার বিষয়ে। এখানে দশ ক্লাশ পাশ করার পর কোন ছাত্র এগারো ক্লাশে ভর্তি হয়ে ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তির পরীক্ষার প্রাইভেট কোচিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হলেও তার ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হবে! তারপর সেই ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার ঋণ মেটানোর ক্ষমতা না থাকায় রাজ্য দেওয়ার কি সেই দায়িত্ব নেবে? মনে হয়না। দ্বিতীয় একটি বিষয় হল, ছাত্রদের ঋণের টাকা সুদসমেত ফেরৎ দেওয়ার দায়িত্ব – এই ধরনের গ্রুমিং না থাকার কারনে অনাদায়ী ঋণ বাড়ার আশঙ্কায় কোন ব্যাঙ্ক এই ঋণ দিতে আগ্রহী হবেনা। আবার HOIদের উপর ছাত্রদের ঋণ পাওয়ার প্রাথমিক কাগজপত্র পরীক্ষা করে সরকারের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করার দায়িত্ব থাকায় তাঁরা অসুবিধায় পরবেন। কারন বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক চাকরীর পরীক্ষা ও বৃত্তিগত কোর্সে ভর্তির ট্রেনিং ইন্সটিটিউটগুলির স্থায়ীত্ব ও স্বচ্ছতা কিভাবে HOIরা বিচার করে সন্তুষ্ট হবে! কারন ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে তাদের Head of the Institutionএর কাছে কাগজপত্র যেমন আধার কার্ড, দশ বছর রাজ্যে থাকার রেকর্ড ও যেখানে ভর্তি হবে তার অফার লেটার, ফি স্ট্রাকচার সব জমা দেবে। HOI সেগুলি সঠিক থাকল (?) তা উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করবে (যদিও উচ্চমাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীন নয়)। তারপর ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে হবে! ব্যাঙ্ক সন্তুষ্ট হলে তবেই ঋণ পাওয়া যাবে। যেহেতু ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে নয়, তারা তাদের ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা চাইবে। রাজ্য সরকার সেই নিশ্চয়তা দিলে তার জন্য তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণের বাজেট allocation রাখতে হবে। এই বিজ্ঞপ্তি বেরোনোর পর বাজেট পেশ হলেও এমন কোন allocation নেই এবং তা কোন provision ও নেই।
তাহলে নিট ফল কি দাঁড়ালো? প্রথমতঃ HOIএর উপর চাপ বাড়ানো হল, তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিং করতে বলা হল যাতে তারা বেশী সংখ্যায় আবেদন করে। ছাত্ররা যদি তাদের আবেদনের কাগজপত্র ঠিকমত আপলোড করতে না পারে তবে বদনাম হবে HOIদের! আবার যদি ঋণের আবেদনের বৃহদাংশ ঋণের সিকিউরিটির অভাবে এবং অস্বচ্ছতার কারণে বাতিল হয় ত বদনাম হবে ব্যাঙ্কের! তখন শাসকদল তার রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে পারবে। তারা প্রচার করবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ঋণ দিচ্ছেনা – যদিও রাজ্য সরকার তাদের আর্থিক দায়িত্ব নিতে রাজী(!)।
সুতরাং রাজ্য সরকার এমন একটি প্রকল্প আনলো যাতে তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ল, আবার সেইসঙ্গে এইধরনের ঋণ বিশেষ মঞ্জুর না হওয়ায় সরকারের উপর সুদের আর্থিক চাপও বাড়লনা। এটি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল যা অন্য অনেক তথাকথিত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পরবে আবার রাজ্যের শাসক দলকে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডও দেবে।
নব মূল্যায়নে শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়
ভারতের স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্র, যিনি তাঁর ১২০ তম জন্মদিনের প্রাক্কালে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে ভারত তথা বাংলার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন – স্যার আশুতোষ মূখোপাধ্যায় ও শ্রীমতি যোগমায়া দেবীর দ্বিতীয় সন্তান শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়।
শ্যামাপ্রসাদের জীবনে তাঁর মা, মহিয়সী নারী যোগমায়া দেবীর গভীর প্রভাব পড়েছিল। মা ই তাঁকে শিখিয়েছিলেন সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে। এই লড়াইয়ে তিনি আপোষহীন ছিলেন বলেই তাঁকে বারবার দল ও চেয়ার, মন্ত্রীত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। তাঁর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত কোন সংঘাত ছিলনা। নেহরু যখন দেশের স্বার্থের পরিপন্থী অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, শ্যামাপ্রসাদ তখনই তার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। বিবেক সায় না দেওয়ায় তিনি কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতার ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারার বিরোধিতা করে মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন। এতে যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে তারাই তাঁর নামে কুৎসা করেছে। তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠা করেন যা আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি রূপে পরিচিত। সুতরাং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরীর কৃতিত্ব কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়ের প্রাপ্য।
শ্যামাপ্রসাদের শিক্ষা ও শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে আবেগ ছিল লক্ষ্যণীয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে দিয়েছিলেন। এর জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। একজন জাতীয়তাবাদী শিক্ষানুরাগী, যাঁর প্রথম প্রেম ছিল আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষায় সমাজকে শিক্ষিত করে তোলা এবং সর্বস্তরে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো – শুধু এই আলোতেই শ্যামাপ্রসাদের নব-মূল্যায়ন করা যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতকস্তরে ইংরেজিতে প্রথম হওয়ার পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায়ও প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর ল এর স্নাতক হন। এরপর তিনি লন্ডনের লিঙ্কন ইন্ থেকে ব্যারিস্টার-এট-ল হন। তিনি মাত্র তেত্রিশ বছর বয়েসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কণিষ্ঠতম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শুধু হিন্দুদের নেতা হিসেবে চিহ্নিতকরণ যে কত বড় মিথ্যা তা তিনি উপাচার্য হিসেবে তাঁর কাজের মধ্যেই প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর সময়ই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন vernacular বিষয়ে পঠন-পাঠন শুরু হয়। তাঁর উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের islamic history কোর্স চালু হয়। তাঁর পিতা স্যার আশুতোষ মূখোপাধ্যায়ের উপাচার্য থাকার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে industrial chemistry চালু হলেও তাঁর সময়ই তা বিস্তার লাভ করে। তিনি যে industrial physics এর সূচনা করেছিলেন, আজ সেখানেই তা information technology নামে পরিচিত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ক গবেষণা বিভাগ শুরু করেন। তিনি শিক্ষায় উৎকর্ষতা বাড়ানোর জন্য ছাত্রদের মধ্যে বিদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে exchange programme চালু করেন। medicine এবং engineering এর সিলেবাস পরিবর্তন করে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের উপযোগী করে তোলেন। তিনি সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পরা ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপের প্রচলন করেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষন দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। সেই প্রথম, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলায় ভাষন দেওয়া হয়। তাঁর শিক্ষাজগতের প্রতি অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে।
শ্যামাপ্রসাদ উপাচার্য হওয়ার পরেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা মাতৃভাষায় দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় থিওরীর সঙ্গে আলাদাভাবে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা নেওয়ার বিধি চালু করেন। শ্যামাপ্রসাদ বালিগঞ্জে জীববিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, শরীরবিদ্যা ইত্যাদি সকল প্রাণ-বিদ্যা অধ্যয়ণের বিষয়গুলিকে আলাদাভাবে অধ্যয়ণের সুযোগ করে দেন। এর পাশেই তিনি ফলিত রসায়ণের জন্য আলাদা ভবন নির্মানের নির্দেশ দেন।
যদিও শ্যামাপ্রসাদ বিজ্ঞানের লোক ছিলেন না, তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তিনিই প্রথম এগ্রিকালচারাল সায়েন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মধ্যে আনেন। তাঁর বন্ধু মেঘনাদ সাহা নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে উচ্চতর গবেষণা করার জন্য সাহায্য চাইলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৯৫০ সালেই এই কাজের জন্য একটি গবেষণাকেন্দ্র তৈরী হয়। সেটি এখন সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কলকাতায় কেন্দ্রীয় গ্লাস ও সিরামিক রিসার্চের অটোনমাস কেন্দ্র গঠনেও তিনি অনেক সাহায্য করেন। তখন শ্যামাপ্রসাদ কমার্সও ইন্ডাস্ট্রীর মন্ত্রী। এটি এখন CSIR এর অধীন একটি ‘flagship institute’। তিনিই প্রথম CSIR এর সহ-সভাপতি। শ্যামাপ্রসাদ ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবোরেটরী গঠনে পরিকল্পনা ও সফল রূপায়ণ করেন। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত IACS, Kolkata, এর বিস্তারে শ্যামাপ্রসাদ সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন।
ভারতের ইতিহাসে নেহরুইয়ান সোশালিষ্ট রাজনীতির কম্যুনিষ্ট কন্ট্রোল ও সোশাল সায়েন্স কন্ট্রোল থাকায় আমরা সত্তরের দশক থেকে আমরা পত্রপত্রিকায় ও পাঠ্যপুস্তকাদিতে কম্যুনিষ্টসুলভ বিকৃত ইতিহাস রচনার পরিচয় পেতে শুরু করি। এই প্রেক্ষাপটেও শ্যামাপ্রসাদের সঠিক মূল্যায়ণ প্রয়োজন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জিতে আসার পরে মতবিরোধের জেরে অল্পদিনের মধ্যে পদত্যাগ করে আবার নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে আসেন। এখানেই কংগ্রেসের নেতারা তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পান। তারপর ১৯৪১-৪২ সালে তিনি ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টির সঙ্গে মিলিজুলি সরকারের মন্ত্রী হলেন। ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতি ও পীড়নের প্রতিবাদে এই মন্ত্রীসভা থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর প্রবল বন্যায় মেদিনীপুরের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মহাবোধী সোসাইটি, রামকৃষ্ণ মিশন ও মারোয়ারী রিলিফ সোসাইটির সঙ্গে মিলে ত্রাণ বিলিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। ঐ সময় শ্যামাপ্রসাদ বাঙ্গালী হিন্দু ও বাংলায় বসবাসকারী হিন্দু অবাঙ্গালী উভয়ের কাছেই নেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। অবশ্য তার পিছনে একটি ইতিহাস আছে। তিনি দেখলেন যে, ব্রিটিশ লালিত, উগ্র ধর্মান্ধতার নিরিখে ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ বিভাজনকারী মুসলিম লীগ ও তার নেতা মহম্মদ আলী জিন্না ও তার দলবল ভারত ভাগ করে দুটো আলাদা মুসলিম খন্ড নিয়ে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনের লালসায় উন্মাদ। সঙ্গে ব্রিটিশের প্রশ্রয়ে লালিত নেহরুর প্রতি গান্ধীজীর অন্ধ সমর্থন শ্যামাপ্রসাদের মনে ‘হিন্দুদের বলির পাঁঠা’ করার ভীতির উদ্রেক করে। তিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় নেতা হয়ে ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে মিলিতভাবে, গঠিতব্য পাক-ই-স্তানের হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির দাবী তোলেন। এরথেকে আজকের পরিস্থিতিতে মূল্যায়ন করতে বসে সহজেই বলা যায় যে, তখনকার রাজনীতিকদের মধ্যে তাঁর মত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আর একজন নেতাও ছিলেন না। শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু আদতে হুগলী জেলার জিরাতের লোক। তবুও পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দূরবস্থা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এটাই রাজনৈতিক ও সামাজিক দূরদৃষ্টি।
১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম বাংলা ভাগের কথা বলেছিলেন। এর পিছনের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে শ্যামাপ্রসাদের সঠিক মূল্যায়নে সুবিধা হবে। জওহরলাল নেহরুর স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ভারতবর্ষে বসবাসকারী মুসলমানদের ধন, সম্পত্তি, ধর্ম ও প্রাণ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে তৈরী থাকলেও পাক-ই-স্তানে অনুরূপ আইন নির্মানে জিন্না, লিয়াকত আলীদের কোন আগ্রহ ছিলনা। এদিকে শরৎ চন্দ্র বোস ও হুসেইন শাহিদ সুরাবর্দীরা দাবী করলেন বঙ্গপ্রদেশকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র তৈরী হোক। বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের ধারনা ছিল, এইভাবে গঠিত রাষ্ট্রে তারাও নেহরু ও জিন্নার মত নেতা হতে পারবে আবার সেইসঙ্গে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হওয়ায় তারা ধর্মীয় প্রভাব বজায় রেখে মুসলিম শাসনের আরো একটি রাষ্ট্র পাবে। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে এই নেতারা সত্যকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখান। এই সময়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখিতভাবে শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করেন। শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ করে হিন্দু প্রধান অঞ্চলকে ভারতভুক্তির প্রস্তাব পেশ করেন। অকাট্য যুক্তি সাজিয়ে তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লেখেন। তাঁর দাবীর সমর্থনে জনমত বাড়তে থাকে। এতেই বঙ্গীয় মুসলিম নেতাদের স্বার্থে আঘাত পড়ে। তারা জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশানের ডাকে বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৬ই আগস্ট জিন্নার ডাকে কলকাতায় যে হিন্দু নিধন শুরু হয়, তাতে বৃটিশ রেকর্ড অনুযায়ী চার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় ও এক লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়। যেহেতু সুরাবর্দীর সরকার এই হত্যালীলার মদতদাতা সেহেতু তার পুলিশ হিন্দুদের কোন নিরাপত্তা দেয় না। এরপর যখন হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে তখন কংগ্রেসের পক্ষে গান্ধীজী তাঁর পেটেন্ট শান্তির বাণী বিতরন করে হিন্দুদের থামান। তখন মুসলমানরাও প্রতিরোধের ভয়ে পিছিয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে বঙ্গের বেশ কয়েকটি মুসলমান অধ্যুষিত জায়গায় হিন্দুনিধন শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিভৎস নোয়াখালী কিলিং। ওই বছরের লক্ষীপূজোর দিন নোয়াখালীতে হিন্দুনিধন, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ ও সম্পত্তি লুঠ করা শুরু হয়। এটি একতরফাভাবে সংঘটিত হয়। এর একমাত্র কারন যারা অত্যাচারিত তাদের ধর্ম হিন্দু! পৃথিবীর ইতিহাসে আর এমন কোন ধর্মীয় কারনে হত্যার উদাহরণ নেই। আশ্চর্যের কথা, কংগ্রেস লালিত কম্যুনিষ্ট ইতিহাসবিদরা এর জন্য শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাবকে দায়ী করেন। দেশবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, জিহাদী ইসলামের সমর্থনকারী কম্যুনিষ্টদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য তাদের এই নীতিই দায়ী। এই সময়ে গান্ধীজীকে মুসলিম লীগ নেতারা বিদ্রুপ করতেন। সেইজন্য তিনি নেতৃত্ব বজায় রাখার তাগিধে মুসলমানদের কিছু না বলে হিন্দুদের ইসলামের নামে অত্যাচার সহ্য করার (!) পরামর্শ দেন। কিন্তু এই ঘটনাগুলির ফলে জওহরলাল নেহরু থেকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও শেষে বৃটিশ সরকারও বাংলা ভাগ মেনে নিতে বাধ্য হন। একমাত্র মুসলিম নেতারা মানতে আজো তা মনে মনে মানতে পারেনি। বাঙ্গালী হিন্দুরা যে ভারতের মধ্যে তাদের সেফ হোমল্যান্ড পেয়েছে তার পুরোপুরি কৃতিত্ব শ্যামাপ্রসাদের। পরবর্তীতে কাশ্মীরের যে বিশেষ ক্ষমতার বিরোধীতা করে তিনি ও কে সি নিয়োগী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তাঁর সেই দাবী বর্তমান সরকার পুরণ করেছে। নেহরুর সঙ্গে লিয়াকত আলীর চুক্তি নেহরু মানলেও জিন্না মানেননি। শ্যামাপ্রসাদ শুধু যে একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন তাই নয়, সমাজসেবা ও শিক্ষার বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
ভারতের ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়ের নতুন করে মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন।
