জাল ভ‍্যাকসিনকান্ডের আসল নায়ক কারা

আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন সরাসরি শাসকদলের অঙ্গুলীহেলনে চালিত হয়, তা একটি পরীক্ষিত সত‍্য। সেটা একমাত্র শাসকের সমর্থক ও সুবিধা পাওয়া সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর সবাই মেনে নেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তবু প্রশাসনের কিছুটা ঋজুতা ছিল। কিন্তু তথাকথিত বামফ্রন্টের নামে সিপিএম পার্টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল পোস্টিং, প্রমোশান, সর্বোপরি অপছন্দের আধিকারিকদের অফিসার-অন-কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া এসবে রাজ‍্য প্রশাসন ধীরে ধীরে অভ্রস্ত হয়ে উঠল। পঞ্চায়েত ও পুরসভার মাইনে রাজ‍্য সরকার দেয় বলে তাদের পুরো কন্ট্রোল এভাবেই ঐ রাজনৈতিক দল নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। একটি বিখ‍্যাত দৈনিক কাগজকে ধমকে,চমকে, বিতর্কিত অগ্নিকাণ্ডের পর সেও ঐ রাজনৈতিক দলের নেতাদের কন্ট্রোলে চলে এলো। সেই শুরু। বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই প্রথম পুলিশের নীচু তলায় দলের আনুগত‍্য বাড়াতে সক্ষম হল। পুরষ্কার-তিরষ্কারের নতুন স্কিম তৈরী হল। তারপর ধীরে ধীরে উপরতলার আধিকারিকদের ধরা হল। IAS, IPS, WBCS, WBPSরা শুধু তাদের আনুগত‍্যের জার্সিটা পাল্টে নিল। দু তিন বছরের মধ‍্যে “সিপিএম এর মেধাবী ছাত্রী”র তাঁবে চলে এলো পুরো রাজ‍্য প্রশাসন। ইতিমধ‍্যে ঘটল ‘পার্কস্ট্রীট কান্ড’। সেই খবরের সম্প্রচারে যার পর নাই রুষ্ট হয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো সংবাদমাধ্যমগুলোর খানিকটা ‘স্ক্র টাইট’ দিলেন। ব‍্যবহৃত হলো দোধারী তলোয়ার। বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ বিশেষ সংবাদপত্র বিপননে বাধা, সঙ্গে বিজ্ঞাপন বন্ধ – এমনিই নরম মেরুদন্ডের বাংলা প্রচার মাধ‍্যম – একদম নুয়ে পড়ল।
যত সময় অতিবাহিত হল, সংবাদমাধ্যমগুলোর উপর শাসকের চাপ বৃদ্ধি পেতে পেতে তা এমন জায়গায় চলে গেল যে, “বাবু যত বলে, পারিষদদলে বলে তার শতগুণ”। এই সংবাদমগুলি যত স্তাবকতা করতে লাগল, তত তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমতে লাগল। কিন্তু প্রশাসনিক বিজ্ঞাপন দাক্ষিণ‍্যে এদের লাভের অঙ্ক আরো স্ফীত হল। এদের গ্রাহকসংখ‍্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে এরা এদেরই মত কিছু মেরুদন্ডহীন মানুষজনকে শোবিজনেস থেকে, কাউকেবা আনকোরা অবস্থায় তুলে এনে তাদের “বুদ্ধিজীবী” ছাপ মেরে তাদের মুখ দিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে লাগল। সংবাদপত্র ও বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে এদের অবমূল‍্যায়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও, সংবাদমাধ‍্যমের লাভ বৃদ্ধি পেতে লাগল। এদের আর নির্ভিক, নিরপেক্ষ ইত‍্যাদি ভেকধারী হওয়ার প্রয়োজন রইল না। এরা শাসকের বা প্রশাসনের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়, এমন খবর প্রচারের স্পর্ধা হারিয়ে ফেলল। এমনকি, যদিও প্রচার করতে বাধ‍্য হয়, তবে এমনভাবে তা পরিবেশন করে যাতে আসল খবরটাই নষ্ট হয়ে যায়। এমনই একটি ঘটনার খবর হল দেবাঞ্জন কান্ড।
এই দেবাঞ্জন দেব IAS, জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং কোলকাতা পৌর নিগমে কর্মরত এই পরিচয়ে জাল টীকাকরন কেন্দ্র খুলে মানুষকে টীকা দেওয়ার নামে ধোঁকা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, শাসকদলের লোকসভা সদস‍্যা শ্রীমতী মিমি চক্রবর্তী এখানে টিকা নিয়ে সার্টিফিকেট না পাওয়ায় তাঁর ব‍্যক্তিগত সচিবকে দিয়ে থানায় FIR দায়ের করেন এবং তার ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করে জানতে পারে যে এই দেবাঞ্জন দেব একটি জাল IAS এবং সে কোলকাতা পৌর নিগমের কোন অফিসার নয়! সে জাল টীকাকেন্দ্র কোলকাতা পৌর নিগমের নামে চালাচ্ছিল এবং মানুষজনকে বিনামূল‍্যে টীকা (!) দিচ্ছিল। পুলিশ ঐ ক‍্যাম্প বন্ধ করে তদন্ত শুরু করে। এই জালিয়াতকে ধরার কৃতিত্ব সংবাদমাধ্যম লক্ষ‍্যণীয়ভাবে শাসকদলের সাংসদ তথা শাসকদলের উপর দেয়! দেবাঞ্জন কত বড় জালিয়াত এবং শিক্ষক থেকে আরো কত মানুষজনকে সে ঠকিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরন দেওয়া শুরু হল! এরসঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ‍্য নিয়ে যে ধোঁকা দেওয়া হল তার কি সম্পর্ক তার কোন ব‍্যখ‍্যা পাওয়া যায়না। সুতরাং সন্দেহ করার যথেষ্ট কারন আছে যে তদন্ত প্রভাবিত হচ্ছে এবং আসল জায়গা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। করন এটি কোন সাধারণ জালিয়াতি নয়। সবচেয়ে বড় কথা, যারা জাল টীকা পেয়েছেন তাঁদের নাকি কোভিশিল্ড নয়, অ‍্যামিকাসিন৫০০ নামের অ‍্যান্টিবায়োটিক পুশ করা হয়েছে! এই অ‍্যান্টিবায়োটিক বশী হলে ইউরিক অ‍্যাসিড বৃদ্ধি পায়। এতে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সরাসরি মৃত‍্যু হয় না। এদিকে সরকার নাকি দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে “অনিচ্ছাকৃত মৃত‍্যু” ঘটানোর অভিযোগ আনছে!
অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন। প্রথম, একটি বা দুটি জাল ভায়ালে অ‍্যামিকাসিন পাওয়া গেলেও এটা কিকরে বলা যায় যে, একাধিক ক‍্যাম্প করে কয়েক হাজার মানুষকে জাল টীকা দেওয়া সবাই একই জিনিষ পেয়েছেন? জৈব বা অজৈব ক্ষতিকারক কিছু ত থাকতেই পারে। আবার যদি এতে মৃত‍্যু হয়ও তা অনিচ্ছাকৃত বলে লঘুকরণ করায় অন‍্য ‘গন্ধ’ পাওয়া যেতেই পারে। আবার দেখা যাচ্ছে এই জাল IASটি বহুদিন ধরে ঘুরন্ত নীলবাতি (যা জয়েন্ট সেক্রেটারীরা পান না) গাড়িতে বডিগার্ড সহ চলাফেরা করতেন। কোলকাতা পৌর নিগমের মূল ভবনে নাকি এর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে পার্কিংলটে তার গাড়ি থাকার কথা। আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই লোকটি সাধারণ চিটিংবাজ হলে এভাবে দিনের পর দিন পৌর নিগমের উচ্চপদস্থ আমলা সেজে সাধারণ কর্মচারীদের চোখে ধূলো দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ অতি উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ ও প্রোটেকশান না থাকলে এভাবে পার পাওয়া যায় না। আমরা একাধিক ছবিতে নিগমের মেয়র ও মন্ত্রী জনাব ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ছবি দেখেছি। শুধু তাই নয়, তালতলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ট‍্যাচু উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও স্থানীয় এমএলএ মহাশয়ার নামের সাথে এই জাল আধিকারিকের নামও প্রস্তর ফলকে জ্বলজ্বল করছিল। আচ্ছা, এটা কি বিশ্বাসযোগ‍্য যে পৌর নিগমের মেয়র, ডেপুটি মেয়র তাদের নিগমের উচ্চপদস্থ আমলাকে চেনেননা! এই ঘটনা জানাজানি হতে বালখিল‍্য বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এই জালিয়াতের নামে কালো কালি লেপে দওয়া হয়েছে। পরে এই ফলক খুলে নেওয়া হয়। আবার দেখা যাচ্ছে, এক অনুষ্ঠানে এই জালিয়াত মঞ্চ আলো করে সিনিয়ার মন্ত্রী শ্রী সুব্রত মূখোপাধ‍্যায়ের পাশে বসে আছে! এই সব সরকারী অনুষ্ঠানে যারা ফলক লাগানোর দায়িত্ব পান তারা খসরা ফলক তৈরী করে প্রধান অনুষ্ঠানকারী, এক্ষেত্রে মেয়র, বা তার সচিবকে দেখিয়ে অনুমোদন করে নেন। এটাই দস্তুর। এমন জালিয়াতি সখানে ধরা না পরাটাই বিস্ময়ের। মন্ত্রীরা কোন অনুষ্ঠানে থাকলে তার একটা প্রোটোকল থাকে। এছাড়া আলাদা সিকিউরিটি চেকিং থাকে। পুলিশ এই জাল IAS তথা জাল পৌর নিগম আধিকারিক সম্পর্কে কিছু জানত না বললে তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কেই প্রশ্ন জাগে। এদিকে
সমস্ত সংবাদমাধ্যম এই জাল IAS কে জালিয়াত প্রমাণ করতে ও রাজ‍্য পুলিশের তৎপরতার পক্ষে মূহুর্মূহ প্রচার করতে ব‍্যস্ত। এখন তাদের তোতাপাখি ‘বুদ্ধিজীবি’কুল শীতঘুমে আছেন! পুরো ব‍্যপারটাই মনে হয় আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন‍্য।
আজ মানুষকে ভাবতে হবে যে দেবাঞ্জন সামান্য ৪২০ ধারার চিটিং বাজী, এমনকি অনিচ্ছাকৃত খুণের চেষ্টার অপরাধী কি? সে কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ‘টীকাকরন’ করছিলনা। বরঞ্চ সে তার টীকাকরন কেন্দ্র চালানো এবং তার প্রচারের জন‍্য টাকা খরচ করেছে। এখানে প্রশ্ন দুটি। এক, কেন সে এটা করেছে এবং দুই, কে তাকে এর জন‍্য অর্থ দিয়েছে এবং কি উদ্দেশ্যে দিয়েছে। এই দৃষ্টিকোনে তদন্ত চালানোর ক্ষমতা রাজ‍্যের CID বা যতই SIT গঠন করা হোক, কারোরই নেই। এমনকি রাজ‍্যের বিরোধীদল বিজেপিও তা বুঝেছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের অনেক নেতা রাজনৈতিক কারনে CBI তদন্ত চেয়েছেন। এটা CBIএর এক্তিয়ারেও পড়ে না। একমাত্র NIA এই তদন্ত করতে পারে। কারন, এখানে এমন শক্তির জড়িত থাকার সম্ভাবনা যারা দেশের মানুষের ক্ষতি করতে চায়। এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ‍্য নয় যে, একজন সাধারণ জালিয়াত শুধু নাম কেনার জন‍্য এত টাকা খরচ করে ভূয়ো টীকাকরনকেন্দ্র চালাবে। এর কর্মপদ্ধতি লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, এই শ্রীমান প্রথমে রাজ্রের ক্ষমতাশালী মানুষজন, মূলতঃ শাসকদলের VIPদের কাছে নিজেকে আস্থাভাজনকরেছে, তারপর সে এই জাল টীকার ফাঁদ পেতেছে। সে কিন্তু একটি নয়, পরপর বিভিন্ন টীকাকেন্দ্র খুলে জাল টীকা দিচ্ছিল। অর্থাৎ তার প্রধান উদ্দেশ‍্য ছিল এই জাল টীকা দেওয়া। তার বাজেয়াপ্ত করা কোন ভায়ালে অ‍্যামিকাসিন৫০০ পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয় যে সে অন‍্য কিছু, যেমন ক্ষতিকারক ভাইরাস বা অন‍্য জৈব বা অজৈব ক্ষতিকারক কিছু প্রয়োগ করছিল না?
এখানে কিছু ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে মালদার সুলতানপুর চেকপোষ্ট দিয়ে একজন চীনা নাগরিক হান জুনওয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ভারতে প্রবেশ করার পর ধরা পড়ে। তার এক শাকরেদ সুন জিয়াং উত্তর প্রদেশে কিছুদিন আগে ধরা পড়ে। এই হান জুনওয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট থাকায় ভারত সরকার তার ভিসার আবেদন নামঞ্জুর করে। তখন সে নেপাল ও বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে চীন থেকে নেপাল হয়ে বাংলাদেশের মধ‍্যে দিয়ে ভারতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে। তার কর্মপদ্ধতিই বলে সে অসৎ উদ্দেশ‍্যেই একাজ করেছে। আমরা এও লক্ষ‍্য করেছি যে, চীন ইউহানের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের ল‍্যাবোরেটরীতে ভাইরাসের থেকে জৈব অস্ত্র বানানোর প্রক্রিয়ার সাথে সাথে অন‍্য অনেক রকমভাবে ভারতে নাশকতামূলক কাজকর্ম বাড়াতে চাইছে। একাজে সে ইতিমধ‍্যেই পাক-ই-স্তানকে ঘোষিত দোসর হিসাবে পেয়েছে। আবার, কিছুদিন আগে নিউটাউনে রাজ‍্য পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত দুই দুষ্কৃতির পাক-ই-স্তান যোগ এবং ড্রাগ মাফিয়া যোগের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তারপর আর তদন্তের বিষয়ে কিছু শোনা যাচ্ছে না! ভূয়ো টীকাকরন শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, মহারাষ্ট্রেও ধরা পড়েছে।
এসব থেকে একটি জিনিষ খুব পরিষ্কার। আমাদের দেশকে অস্থির করতে বিদেশী শত্রুরা কোমর বেঁধে নেমেছে। আর এ কাজে তাদের ‘পঞ্চম স্তম্ভ’ এই দেশেরই কিছু মানুষ। নাহলে শুধু বিদেশীদের পক্ষে আমাদের দেশের অভ‍্যন্তরে লাগাতার নাশকতা চালানোর চেষ্টা করাও সম্ভব ছিলনা। কে বলতে পার, এইসব দেবাঞ্জনরা তাদের সহযোগী হিসেবে নেমেছে কিনা। টাকার সংস্থানও নিশ্চয়ই বিদেশী শক্তির থেকে আসছে। আশ্চর্য হচ্ছে, আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি বড় অংশ বুদ্ধিহীণ অমেরুদন্ডী প্রাণীর মত “কাকে নিয়ে গেল কান” বলে চিল চীৎকারে কাকের পিছনে ছুটতে লেগেছে। সুতরাং এই দেবাঞ্জনদের পিছনের আসল কুশীলবদের ধরার জন‍্য একমাত্র NIA তদন্তই যথার্থ হতে পারে। তাতে কোন রাজনৈতিক নেতা যদি জড়িয়ে যান তাহলে তাঁকে বাঁচানোর জন‍্য যথার্থ তদন্ত না করা বা তদন্তের পরে লঘু ধারায় চার্জসিট দেওয়া কি দেশের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী নয়?
এখানে তদন্তের আরো একটি সম্ভাব‍্য দিকের আলোচনা করাও জরুরী। সেটি হল ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদীজী বা বিজেপি যাতে কোনওভাবে ক্ষমতায় না আসতে পারে তার রাস্তা প্রশস্ত করা। কিভাবে? ধরা যাক, এই ধরনের ভূয়ো টীকাকরন ক‍্যাম্প যা দেবাঞ্জন দেব কয়েকটি জায়গায় সংঘটিত করার পর কয়েক হাজার (আনুমানিক) মানুষের শরীরে টীকার নামে অজানা কিছু ঢুকিয়ে দিল। মহারাষ্ট্রেও জাল টীকাকরন কেন্দ্র থেকে এমন অনেকে টীকা নিয়েছেন। হয়ত আরো জায়গায় জাল টীকা দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল একটি সংগঠিত কাঠামোতে পুলিশ, প্রশাসন ও বড় মিডিয়া হাউসগুলির মিলিত প্রচেষ্টায় চলে। যদি এই ভূয়ো টীকা নেওয়ার পর কয়েকজনেরও মৃত‍্যু হয় তবে এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশে সব একসঙ্গে গেল গেল করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে রব উঠবে মোদী টিকা দিয়ে দেশের মানুষদের খুণ করছে! “মোদী হটাও – দেশ বাঁচাও”। এতে হয়ত দেশে রাজনৈতিক পালা বল হত, কিন্তু বিদেশী শক্তি দেশের অভ‍্যন্তরে যে বিভেদ তৈরীতে সক্ষম হবে তাতে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। দেশের স্থায়িত্বের বিনিময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ দেশদ্রোহিতার নামান্তর। তবে, ধন‍্যবাদ শাসকদলের সাংসদকে তার এই জাল টীকার কার্যকলাপের মৌচাকে আঘাত করার জন‍্য। এটা খুবই চিন্তার কথা যে, কি বিরোধী, কি সরকার – কেউই এর কার্যকরী ও সঠিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চাইছে না। NIA কে দিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান আশু প্রয়োজন।

গান্ধীজীর বার-এট-ল ডিগ্রী কোথায়

আধুনিক ভারতের ইতিহাসে কোন অবিসংবাদী জননেতার নাম করতে হলে রাজনীতির পক্ষপাত ছাড়া মানুষ একটিই নাম করবে- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি ‘মহাত্মা গান্ধী’ বা ‘বাপুজী’ নামেই আপামর ভারতবাসীর কাছে পরিচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিনগুলিতে যে মানুষটির ডাকে আসমুদ্র হিমাচলের মানুষ আন্দোলিত হয়েছে, যে মানুষটির ‘অসহযোগ’ ও ‘অহিংস’ আন্দোলন শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ছিল সংশয়াতীত। এই মানষটির সমাজ-চেতনা, সামাজিক ধ‍্যান-ধারনা, দেশগঠনের ভাবনা ও ‘অহিংসা’ এবং সত‍্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা তাঁকে ‘মহাত্মা’ আখ‍্যা দিয়েছে।
এমন একজন মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া আমার মত কোটি কোটি মানুষের কাছে আবশ‍্যিক। অথচ বিভিন্ন ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের গ্রন্থগুলিতে তাঁর জীবন ও কর্মধারার মধ‍্যে কিছু ধোঁয়াশা লক্ষ‍্য করা যায়। এই ধোঁয়াশাগুলি যদি তথ‍্য সহযোগে মুক্ত করা যায়, তবে আমাদের জাতীয় নেতা এবং দেশের জনক গান্ধীজীর প্রতি সুবিচার করা হবে।
গান্ধীজী ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর কাথিয়াবার এজেন্সির পোরবন্দর শহরে করমচাঁদ ও তাঁর চতুর্থ স্ত্রী পুতলীবাইয়ের কণিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। আর ৭৮ বছর বয়েসে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর পরিবার,মা-বাবা, ভাই-বোন সম্পর্কে সমস্ত তথ‍্য থাকায় তাঁর পরিবার সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারনা আছে। তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু তথ‍্য পাওয়া গেলেও অপেক্ষাকৃত কম জানা আছে। হ‍্যাঁ, তিনি আলফ্রেড হাইস্কুল, রাজকোটে ১৮৮০ থেকে ১৮৮৭ সাল অব্দি পড়াশুনা করেন এবং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভাবনগর স্টেটের সামালদাস আর্টস কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ‍্যেই তিনি কলেজ যাওয়া বন্ধ করেন এবং কলেজ ড্রপআউট হন। এর মধ‍্যে তিনি তেরো বছর বয়েসে বিবাহ করেন এবং তারপর তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। তাঁর জীবনীকারদের থেকে এবং তাঁর নিজের আত্মজীবনী থেকে যেটুকু জানা যায় তা হল, গান্ধীজী ছাত্র হিসেবে অতি সাধারন মানের ছিলেন এবং কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে গ্র‍্যজুয়েশান কমপ্লিট করতে পারেননি। কলেজ ড্রপআউট হয়ে তিনি স্থির করলেন, লন্ডন গিয়ে তিনি ব‍্যরিস্টারী ডিগ্রী করবেন। গান্ধীজীর মা পুতলীবাই তাঁর কণিষ্ঠ পুত্রের বিদেশ যাত্রায় রাজি ছিলেন না। কিন্তু গান্ধীজী সকল বাধা উপেক্ষা করে মুম্বাই (তখনকার বোম্বে) হয়ে লন্ডন পৌঁছালেন এবং তাঁর আত্মজীবনী অনুযায়ী তিনি ‘ইনার টেম্পল’এ ভর্তি হলেন। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন, ফ‍্যাকাল্টি অফ ল কিন্তু ব‍্যারিস্টারদের ডিগ্রী দেয়। আর ল যাঁরা প্র‍্যকটিস করেন, অ‍্যাটর্নি ও বিচারকদের চারটি ইন্ এ বিভক্ত হয়ে তাদের মেম্বার হতে হয়। এই চারটি ইন্ হল – গ্রে’জ ইন্, লিঙ্কনস ইন্, মিডল টেম্পল, এবং ইনার টেম্পল। এই চারটি ইন্ এ ল এর ছাত্ররা লেকচার শোনে। সেখানে ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট সংখ‍্যক ‘ডিনার’ হোষ্ট করতে হয়। ডিনারের পর লেকচার ও আলাপচারিতার মাধ‍্যমে ছাত্রদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। পুরো ডিনার সংখ‍্যার মধ‍্যে ছাত্রদের ন‍্যূনতম সংখ‍্যার ডিনারে উপস্থিত থাকা বাধ‍্যতা মূলক। রেকর্ড থেকে জানা যায় যে গান্ধীজী এই ইনার টেম্পলে ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তবে তাঁর নাম রেকর্ড করা ছিল “Informal auditing student” হিসেবে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের খাতায়! এই ব‍্যপারে ইনফরম‍্যাল অডিট স্টুডেন্টের ব‍্যখ‍্যাও দেওয়া আছে। অডিট স্টুডেন্ট তাঁরাই যারা জ্ঞান আহরনের জন‍্য ক্লাস করেন, কিন্তু তাঁদের মূল‍্যায়ণ হয় না এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের গ্রেড পাওয়ার কথা নয়। ফলে গ্রেড, তা পাশ বা ফেল যাই হোক না কেন, অডিট স্টুডেন্টদের পাওয়ার প্রশ্ন আসে না। আর ইনফর্মাল স্টুডেন্ট মানে ফর্মাল স্টুডেন্ট নন – এটাই ত স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, যে চারটি ইন্ এর কথা বলা হয়েছে, তারা লএর ছাত্রদের, যারা ভবিষ্যতে বার-এট-ল হবেন, তাঁদের ট্রেনিং দেয় এবং এই ট্রেনিং ইংল‍্যান্ড ও ওয়েলশে প্র‍্যাকটিস করার জন‍্য আবশ‍্যিক। এই ইন্ গুলি ট্রাষ্টিবোর্ডের অধীনে কাজ করে, এরা কিন্তু ল গ্র‍্যাজুয়েটের ডিগ্রী দেয়না। ডিগ্রী একমাত্র দিতে পারে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন। সেখানে আবার গান্ধীজীর রেজিষ্ট্রেশান ইনফর্মাল অডিট স্টুডেন্ট হিসেবে। পুরো ব‍্যপারটাই কেমন ধোঁয়াশা। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন‍্য গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে মনোনিবেশ করা গেল। কারন, গান্ধীজী রাজা হরিশ্চন্দ্রের ন‍্যায় নীতি ও সততার আদর্শে অনুপ্রাণিত। সেখানে তিনি ভারতে ফিরে আসার আগে ইংল‍্যান্ডের হাইকোর্টে তার নিজের নাম নথিভূক্ত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর আত্মজীবনীর ২৪তম অধ‍্যায়ে লেখা, “I passed my examinations, was called to the bar on 10th June 1891 and enrolled in the High Court on the 11th. On 12th, I sailed for home”। এখানে কয়েকটি কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। “called to the bar” এবং আরেকটি কথা, “keeping terms” এর অর্থ করলে দাঁড়ায় যে, ইনার টেম্পলে ২৪টি ডিনার ক্লাসের মধ‍্যে ন‍্যূনতম ৬টি ডিনার ক্লাস যা বাধ‍্যতামূলক, তা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইনার টেম্পলের এই criteria তিনি পূর্ণ করেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীর ব‍্যপারে গান্ধীজীর আত্মজীবনী যেমন নির্দিষ্ট করে কিছু বলে না; তেমনি তাঁর জীবনীকারেরা যেমন, ডি জি টেন্ডুলকার, রবার্ট পেইন, বি আর নন্দা ও জিওফ্রে অ‍্যাশ এবং অন‍্যান‍্যরা কিছু বলেননি। আবার ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের প্রাক্তনীদের তালিকায় গান্ধীজীর নাম আছে – পরিচয় ভারতের স্বাধীনতা ও অসহযোগ আন্দোলনের পুরোধা। এদিকে আবার গান্ধীজী অডিট স্টুডেন্ট ছিলেন; যাদের সম্পর্কে ইউনিভার্সিটিতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে, “In this case audit indicates that the individual merely has received teaching, rather than being evaluated as having a given standard of knowledge of the subject. The term ‘audit’ is Latin, translated as ‘he/she hears’. In other words, the audit student has experience the course, but has not be assessed”।
এরপর গান্ধীজী দেশে ফিরে এসে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে বোম্বে হাইকোর্টে রেজিষ্টার্ড হলেন। সেখানে আবেদন পত্রে গান্ধীজী পরিষ্কার ভাষায় নিজেকে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে উল্লেখ করলেন। হাইকোর্ট যখন সেই আবেদন গ্রহন করেছিল তখন নিশ্চয়ই তারা সঠিক কাগজপত্রের ভিত্তিতেই তা করেছে বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ গান্ধীজীর ব‍্যারিষ্টারী ডিগ্রী পাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথায়? কিভাবে? সে জিনিসটা কোন জীবনীকার পরিষ্কার করে বলেননি। এমনকি তাঁর আত্মজীবনীতেও তা পাওয়া যায় না। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে ঐ ২৪ তম অধ‍্যায়ে যেটুকু বলা আছে তার বাইরে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী নিয়ে আর কোন কথা নেই। এমনকি ইনার টেম্পলে তাঁর সামাজিক ও আর্থিক অসুবিধা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও ল পড়ার ব‍্যপারে বা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ে কোন কথা নেই! এদিকে ২০০৩ সালে লেখা একটি নথি থেকে জানা যায় যে, গান্ধীজী লন্ডনের হাইকোর্টে ১১ই জুন রেজিষ্টার্ড হওয়ার কথা বললেও তার লন্ডনের কোর্টে সওয়াল করার রেকর্ড পাওয়া যায় না। এছাড়া ঐ নথি থেকে এও নিশ্চিতভাবেই জানা যায় যে, কোর্টের যে চারটি ইন্ আছে তারা কোন ল ডিগ্রী দিতে পারে না। সুতরাং গান্ধীজীর ইনার টেম্পল থেকে ব‍্যরিষ্টারী পাশ করার সুযোগ ছিল না। আবার “Informal auditing” ছাত্র হওয়ায় ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে ডিগ্রী পাওয়াও সম্ভব নয়। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতেও তাঁর ল ডিগ্রী পাওয়ার ব‍্যপারে কিছু কথা নেই। ওদিকে লন্ডনের হাইকোর্টেও গান্ধীজীর রেজিষ্টার্ড হওয়ার প্রামাণ্য নথি পাওয়ার প্রশ্ন নেই কারন তিনি সেখানে বার কাউন্সিলের সদস‍্য হননি। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ১১ই জুন তিনি রেজিষ্ট্রি করার আবেদন করেছিলেন আর ১২ই জুন দেশে ফিরে আসেন! সুতরাং আবার ধোঁয়াশা। কিছুই পরিষ্কার হল না।
পরিশেষে আসি গান্ধীজী সম্পর্কে ডঃ বি আর আম্বেদকারের কথায়। তিনি কিন্তু গান্ধীজীর বম্বে হাইকোর্টের সওয়াল প্রত‍্যক্ষ করে মন্তব‍্য করেছিলেন, সওয়াল করতে গিয়ে গান্ধীজীর নাকি হাঁটু কাঁপত! আবার ডঃ আম্বেদকার ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের সব কটিতেই উপস্থিত থাকলেও রাজনৈতিক কারনে গান্ধীজী শুধু দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ঐ বৈঠকে তিনি কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।ঐ বৈঠকে গান্ধীজীর সওয়াল সম্পর্কে মন্তব‍্য করতে গিয়ে পরবর্তী এক সময়ে ডঃ আম্বেদকার বলেন যে, গান্ধীজী তাঁর ল পয়েন্টে সওয়াল না করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস‍্যুগুলিকে তুলে ধরেন। অবশ‍্য এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, হরিজনদের সংরক্ষণ নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে ডঃ আম্বেদকারের তীব্র মতবিরোধ ছিল। ডঃ আম্বেদকার সংরক্ষণের পক্ষে এবং গান্ধীজী তার বিপক্ষে মত পোষন করতেন। যাক, সে ভিন্ন কথা। আমরা ঐ সময়ের অন‍্য ল গ্র‍্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে, যেমন জওহরলাল নেহেরু, মহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী বা হুসেইন সুরাবর্দীদের ক্ষেত্রে কিন্তু বার-এট-ল এর ডিগ্রীতে এমন ধোঁয়াশা দেখা যায় না।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে গান্ধীজীর বার-এট-ল হিসেবে শিক্ষাগত যোগ‍্যতায় একটা ধোঁয়াশা আছে। এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে উনি এই ডিগ্রী অর্জন করেননি। প্রামান‍্য নথি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও গান্ধীজীর আত্মজীবনী – এই সবগুলিই একসঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধোঁয়াশা দেখা যায়। একজন ভারতবাসী এবং গান্ধীজীর গুণগ্রাহী মানুষ হিসেবে এই প্রার্থনাই করি যে আরো তথ‍্য দিয়ে এই ধোঁয়াশা দুর করা উচিত। কারন, আমাদের জাতির জনকের স্থান সমস্ত রকম সমালোচনার ঊর্ধে। বোম্বে হাইকোর্টে গান্ধীজীর আবেদন অনুযায়ী যদি ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের থেকে তাঁর বার-এট-ল পরীক্ষায় বসার এবং গ্রেড লাভের নথি পাওয়া যায়, তাহলে সব বিতর্কের ও ধোঁয়াশার অবসান হতে পারে। সরকারের তরফে এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও নথি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশের অপেক্ষায় রইলাম।

ভারতের বিভেদের রাজনীতির মূল কোথায়

আজকাল আমরা সেজেগুজে থাকা ‘সাজানো’ বিদ্বান মানুষদের কাছে প্রায়শঃই একটি কথা শুনি – দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ দল ‘বিভেদের রাজনীতি করছে! এই ‘বিভেদ’এর রাজনীতি কি এবং কিভাবে দেশে বিভেদের রাজনীতি এল, কখন শুরু হল, তার বিশদ ব‍্যখ‍্যার প্রয়োজন আছে।
এখানে গত একশ বছরে দেশের ঐতিহাসিক চরিত্র, স্বাধীনতার পটভূমি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দেশের সংবিধাধ ও তার বেআইনিভাবে সংশোধন উল্লেখে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যে সাংবাদিকসুলভ আষাঢ়ে গল্পের সঙ্গে উদ্দেশ‍্যমূলক প্রচারের রাস্তায় হাঁটা হয়নি।
যখন স্বাধীনতার আন্দোলন ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক কলেজ ড্রপ-আউট ইনফরমাল ল-ইয়ার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন দিশা দিলেন। কিভাবে? ১৯২০ সালে, যখন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ব্রিটিশরাজে বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হচ্ছে, তখন তিনি এমন একটি পদক্ষেপ করলেন যে তার সুদুরপ্রসারী ফলাফল দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিপন্থী হল। এই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী পরবর্তীতে জাতির জনক হিসেবে চিহ্নিত হন। গান্ধীজী কংগ্রেস পার্টির স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে দেশের মুসলমান সমাজকে জুড়ে দিয়ে সকলের অবিসম্বাদী নেতা হতে চেয়েছিলেন। তার জন‍্য পুরোপুরি মুসলমানদের একটি ধর্মীয় আন্দোলনকে তিনি হিন্দু অধ‍ু‍্যষিত কংগ্রেস পার্টি তথা দেশের তাবৎ হিন্দুদের হয়ে সমর্থন করেন। আন্দোলনটি হচ্ছে খিলিফৎ আন্দোলন। তুরষ্কে খলিফার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করার ইসলামী প্রয়াস। তিনি মুসলিম ভ্রাতৃদ্বয় সৌকত আলী ও মহম্মদ আলী এবং আবুল কালাম আজাদের মত মুসলিম নেতাদের তাঁর প্রবর্তিত ‘অসহযোগ’ আন্দোলন সমর্থন করার শর্তে খিলাফত আন্দোলনকে হিন্দুদের সমর্থন করার ডাক দেন। খিলাফত একটি ধর্মীয় আন্দোলন। এই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের জন‍্য একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর আন্দোলনকে আমজনতার সমর্থন করার যুক্তি দিয়ে তিনি ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন। এর মাসুল এখনো এই উপমহাদেশের আপামর জনসাধারন দিয়ে যাচ্ছেন। ঐ সময় গান্ধীজীকে মানুষ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে বারবার একগুঁয়েমীর প্রমাণ রেখেছেন। নিজের মতামতকেই একমাত্র গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলন সারা ভারতে কৌতুহলের সৃষ্টি করলেও তা যে বৃটিশরাজকে খুব অসুবিধায় ফেলে স্বাধীনতা পেতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। আর চরকা কেটে প্রতীকী প্রতিবাদ করা যায় – কার্যকরী প্রতিবাদ নয়। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির কারণগুলি আলাদা।
গান্ধীজীর এই ঐতিহাসিক ভুলের মাশুল আমরা কিভাবে দিচ্ছি? প্রথমতঃ খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে দেশের সংখ‍্যাগরিষ্ট হিন্দু জনগণের কোনভাবেই কোন যোগসূত্র থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র গান্ধীজীর বৃহত্তর নেতা হওয়ার ইগো পরিতৃপ্তির জন‍্য মুসলিম নেতাগোষ্ঠীর ধর্মীয় আন্দোলনকে হিন্দুদের সমর্থন করা তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি হাস‍্যকর সিদ্ধান্ত। অতঃপর খিলাফত আন্দোলন তেমন গতি পেল না। ওদিকে এর পীঠস্থান তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক অটোমান সাম্রাজ‍্যের অবসানের পর খলিফার শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগও ১৯২৪ সালে শেষ করে দিলেন। এদিকে গান্ধীজীকে মুসলমান নেতারা ব‍্যবহার করেছিলেন, নিজেরা ব‍্যবহৃত হননি। হুসেইন সুরাবর্দী, মহম্মদ আলী জিন্নার মত নেতারা দেখলেন যে আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে নিতে হলে মুসলমান সমাজের নেতা হতে হবে। তখন মুসলমানদের তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করার কাজ শুরু হল। এর প্রথম পর্বে যে মোপালা বিদ্রোহ শুরু হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন আলী মুসলীয়ার, কুঞ্জ আহমেদ হাজী ইত‍্যাদি, তাতে লর্ড কার্জনের বৃটিশ পার্লামেন্টে উল্লিখিত তথ‍্য থেকে জানা যায় যে অন্ততঃ ২৫০০ জন মোপালা বিদ্রোহী মারা গেছিল এবং দশ হাজার হিন্দু নাগরিকদের বিদ্রোহীরা হত‍্যা করে শুধুমাত্র মুসলমান না হওয়ার অপরাধে। অন্ততঃ এক হাজার হিন্দুকে বলপূর্বক ইমসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়, অজস্র হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হন ও হিন্দুদের ধনসম্পত্তি লুঠ করা হয়। মালাবারের ইয়ারানাদ, ভাল্লুবাঁধ এই দুটি তালুকের একটি হিন্দু বাড়িও অক্ষত ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ কিভাবে হিন্দুনিধনে পর্যবসিত হল সেকথা লুকানোর জন‍্য কমু‍্যনিষ্ট প্রভাবিত ইতিহাসে এই হত‍্যাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তখনো গান্ধীজী মোপালা বিদ্রোহকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে হিন্দু জনগণের উপর মুসলমান বিদ্রোহীদের অত‍্যাচারকে গুরুত্বহীন করতে চেষ্টা করেন। এই সময় বেশ কিছু কংগ্রেসের নেতা মোপালা বিদ্রোহকে সমর্থনের বিপক্ষে মত দেন। তখন গান্ধীজী জনসমর্থন হারানোর ভয়ে পিছিয়ে যান। গান্ধীজী সাময়িকভাবে পিছু হটেন। কিন্তু তিনি ভারতের হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নেতা হওয়ার নেশায় ভারতকে এক দ্বিজাতিতত্ত্বের দোরগোড়ায় এনে দিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, অল্প শিক্ষিত গান্ধীজীর তুলনায় (উনি ম‍্যাট্রিক পাশ করার পর ভাবনগরের কলেজ ড্রপ আউট, পরবর্তীতে উনি ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১ অব্দি informal auditing ছাত্র হিসেবে ছিলেন। যদিও ব‍্যরিস্টার হিসেবে তিনি মুম্বাই হাইকোর্টে রেজিস্টার্ড ছিলেন, লপাশ করার কোন formal ডিগ্রি ওনার ছিলনা) তখনকার শিক্ষিত, ব‍্যরিস্টার মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক দুরদর্শিতা অনেক বেশী ছিল। শুধু তাই নয়, গান্ধীজীর নিজের নীতি – তা যতই অবাস্তব হোক, সেটাই অনুসরণ করার একগুঁয়েমীর মূল‍্য ভারতবাসীকে দিতে হয়েছে। মোপলা বিদ্রোহ ও তার দমনের সয়ই বোঝা গিয়েছিল মুসলিম নেতাদের প্রভূত্ব করার উদগ্র কামনা এবং হিন্দুদের প্রতি অসহনশীলতা, আর তা সফল করার সোজা উপায় ছিলহিন্দুদের হত‍্যা, ধর্ষন ও তাদের সম্পত্তি দখল অথবা তাদের ধর্মান্তরকরণ। মনে রাখতে হবে, আধুনিক ভারতে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কের সুচনা হয় এই মোপালা বিদ‍্রোহের সময়ই। এর দায় গান্ধীজী এড়াতে পারেন না। পরবর্তীকালে ১৯৪৬-৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় আরো প্রকটভাবে গান্ধীজী হিন্দুনিধন আটকানোর জন‍্য কোন কার্যকরী ভূমিকা নেননি। এমনকি মুসলিম নেতাদের দ্বারা গ্রেট ক‍্যলকাটা কিলিং এর সময় তিনি হিন্দুদের উপর অত‍্যাচারের সময় কোন বাধা দেননি। পক্ষান্তরে, যখন হিন্দুরা প্রতিরোধ শুরু করে তখন তিনি নিজে ছুটে এসে শান্তির বাণী ছড়ালেন। একই রকমভাবে নোয়াখালীর হিন্দুনিধনের সময় তিনি হিন্দুদের বাঁচানোর কোন চেষ্টা করেননি। সুতরাং একথা আজ মানতে হবে, প্রথমদিকে ভারতের সংখ‍্যাগরিষ্ট মুসলিমরা মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে না নিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও বিশেষতঃ গান্ধীজীর একাধিক ভুল পদক্ষেপ ক্রমশঃ জিন্না, সুরাবর্দী, সৌকত আলীদের মুসলিম জনগণের মধ‍্যে গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
আমাদের একটি বদ্ধমূল ধারনা দেওয়া হয়েছে যে গান্ধীজী সব রকম অস্পৃশ‍্যতার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার কোর্টে সওয়াল করতে গিয়ে তাঁর বক্তব‍্য পাওয়া যায়, “We are fellow members of the Empire. You should not be discriminating against us. We are not like these black people. We are better than they are. We are different from them. And you should not treat us like them.” অর্থাৎ তাঁর বক্তব‍্য ছিল, আমরা ভারতীয়রা বৃটিশদের মতই মহান সাম্রাজ‍্যের প্রজা। সুতরাং ব্রিটিশ সাদা চামড়ার মানুষদের মতই আমাদের ব‍্যবহার পাওয়া উচিৎ। কিন্তু কালো চামড়ার মানুষরা নিকৃষ্ট। তাদের থেকে ভারতীয়রা উৎকৃষ্ট। সুতরাং তারা বৃটিশদের সমান। তবে তিনি যে কালো মানুষদের নিকৃষ্ট মনে করতেন তা তাঁর বক্তব‍্যে পরিষ্কার।
গান্ধীজী সর্বদা হিন্দুদের মধ‍্যে বিভিন্ন socio-economic বিভেদ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। অহিংস উপায়ে হিংসার মোকাবিলা করার মত অবাস্তব পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ‍্যে বিভিন্ন sect এর বিভেদ নিয়ে হয় তাঁর কোন ধারনা ছিলনা, নাহয়, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের নেতা হিসেবে থাকার বাসনায় সর্বদা মুসলমানদের একটা ইউনিট হিসেবে দেখেছেন। সেটা মুসলমানদের মধ‍্যে communal feeling তৈরীতে প্রভূত সাহায‍্য করেছে। জিন্না যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে তিন টুকরো করে তার দুটুকরো মুসলমানদের দেওয়ার যুক্তি দিলেন, তখন গান্ধীজী মৌখিকভাবে তার বিরোধীতা করলেও ‘ডাইরেক্ট অ‍্যকশান’ এর নামে হিন্দু নিধন থামানোর চেষ্টা করেননি। ফলে, দেশভাগ হল। স্বাধীনতা এলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ ) দুটিই ইসলামিক রাষ্ট্র হল, ভারত হিন্দুদের বাসভূমি হিসাবে রইল। তখন বিশেষতঃ গান্ধীজীর প্রভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতকে সকল ধর্মের মানুষের বাসস্থান হিসেবে ঘোষণা করল! ফলে ভারতীয় মুসলমানদের homeland হলেও ভারতীয় হিন্দুদের কোন homeland হলনা। ভারতের সংবিধানে সকল নাগরিকের ধর্মপালনের সমান অধিকার স্বীকৃত হল। মৌলিক অধিকার ২৫,২৬ এবং সরকারের কর্তব‍্য ২৯,৩০ ধারায় সংবিধানে লিপিবদ্ধ হল।
তারপর কাবেরী, গঙ্গা, যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়ালো। কংগ্রেসের, বিশেষভাবে নেহেরুর soft peddaling এর কারনে কাশ্মীরের একটা বড় অংশ পাকিস্তানের কবলে চলে গেল।১৯৬২ সালে চীনের আগ্রাসনের কাছে ভারত পর্য‍্যুদস্ত হল। গান্ধীজীর অহিংস নীতি তাঁর যোগ‍্য শিষ‍্য জওহরলাল নেহেরু পালন করতে গিয়ে দেশের বিদেশনীতিকে যার পর নাই পর্যু‍্যদস্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে পরপারে চলে গেলেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অল্প সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করার সুযোগ ছিল না। তারপর জওহরলাল নেহেরুর উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্বে আসীন হলেন তাঁর কণ‍্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি কংগ্রেসের মধ‍্যে সোশ‍্যালিষ্ট লবির সাহায‍্য নিয়ে বয়ষ্ক ও প্রাচীনপন্থী নেতাদের তাড়ালেন। একাজে তাঁকে প্রত‍্যক্ষ ও অপ্রত‍্যক্ষভাবে যথেষ্ট মদত দিলেন দেশীয় কমু‍্যনিষ্ট ও সোভিয়েত রাশিয়া। ইন্দিরা গান্ধীর একমাত্র ধ‍্যান জ্ঞান ছিল কি করে রাজনৈতিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা যায়। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর সম্মুখীন হলেন, দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে কার্যকরীভাবে একনায়কতন্ত্রী ব‍্যবস্থায় দেশকে নিয়ে গেলেন। সেই সময় তিনি পার্লামেন্টকে avoid করে ভারতের সংবিধানের এমন দুটি সংশোধন করলেন যা ভারতের অস্তিত্বের ভিত্তিই নাড়িয়ে দিল। এতে একাধারে সংফিধানের মৌলিক ধারাগুলির বিরোধীতাই করা হল তাই শুধু নয়, সংবিধানের বিভিন্ন ধারার মধ‍্যে স্ববিরোধীতার সুচনা হল! তিনি ভারতকে “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “প্রজাতান্ত্রিক” রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেন। যেহেতু তখন পার্লামেন্ট বন্ধ করে রেখেছিলেন, পার্লামেন্টে আলোচনা সাপেক্ষে এই সংশোধন হয়নি। কিন্তু তারপর যে সকল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার এসেছে তারা কেন এই সংশোধনী দুটি বাতিল করল না; অন্ততঃ সংশোধন করল না তা বোঝা গেল না। আসলে এই “বেআইনী” সংশোধনের উদ্দেশ‍্য অনেক গভীরে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ ব‍্যখ‍্যার ব‍্যপারটা তাঁর সোশালিষ্ট ও কমু‍্যনিষ্ট বন্ধুদের হাতে ছেড়ে দিলেন।
এই প্রসঙ্গে বহুচর্চিত একটা জিনিস ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাইবেল এবং কোরান দুটি ধর্মগ্রন্থেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষদের ধর্মচ‍্যুত মানুষ হিসেবে দেখা হয়। এদের স্থান বিধর্মীদের চেয়েও নীচে। সেজন‍্য কোন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান বা মুসলমান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হয় না। যেজন‍্য কোন দেশে মুসলমান সংখ‍্যাধিক‍্যের কারনে যখন সেই দেশ ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়, পথমেই ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী কম‍ু‍্যনিষ্টদের তারা বিনাশ করে। যাক সে কথা। এই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার টার্গেট করা হল হিন্দুদের। এখানে একটা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে যে, ভারতের প্রথম কমু‍্যনিষ্ট পার্টি গঠনের দিন থেকে তারা দুটি বিষয়ে কখনো বিচু‍্যত হয়নি। পথম, ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা; দ্বিতীয়, জেহাদী ইসলামকে প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে তোল্লা দেওয়া। এর হাজার উদাহরণ আছে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধী যখন “ধর্মনিরপেক্ষতা” দেশের মানুষদের গেলানোর দায়িত্ব তাঁর সোশ‍্যালিষ্ট ও কমু‍্যনিষ্ট বন্ধুদের দিলেন, তখন থেকেই ভারতীয় কমু‍্যনিষ্টদের সৃষ্ট “ধর্মনিরপেক্ষতা” প্রচারের আলোতে এলো। এর যে রূপ আমরা দেখলাম তাতে নিশ্চিতরূপে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্খিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রেখে manipulative democracy শুরু হল। এখন তার কদর্যতম রূপ আমরা প্রত‍্যক্ষ করছি। যাক, ফিরে আসি ধর্মনিরপেক্ষতায়। যেহেতু মুসলিম ও খৃষ্টানদের ধর্ম বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ঐ দুই ধর্মকে, বিশেষতঃ ইসলাম ধর্মকে সরকারী স্তরে তোল্লা দিয়ে শুরু হল সরাসরি হিন্দু ধর্মের বিরোধীতা। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে হিন্দুদের মস্তিষ্ক প্রক্ষালন বিশেষ ব‍্যপকভাবে শুরু হল। এই কাজ, সঙ্গে দেশের প্রাচীন ইতিহাস চর্চা বন্ধ করে মুসলিম আক্রমনকারী শাসকদের মহত্ব ও দেশ গঠনে তাদের অবদান নতুন করে কমু‍্যনিষ্ট প্রভাবিত ইতিহাস বই রচনায় জায়গা করে নিল। এর একটি চরম নির্লজ্জ উদাহরন হল মোপলা বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে সিপিআইএমএর নিকৃষ্ট মিথ‍্যায় ভরা ‘দলিল’। এখানে হিন্দু নিধনকারী জেহাদীদের দেশপ্রেমিক দেখিয়ে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে যে গণহ‍্যা সংঘটিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে একটি কথাও খরচ করা হল না! সেইশুরু। তারপর, কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিত, যারা ট্র‍্যডিশানালি কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, তাদের হত‍্যা, ধর্ষণ, ধনসম্পত্তি লুঠ করে কাশ্মীরকে মুসলমান সংখ‍্যাগরিষ্ট জেহাদী স্বর্গরাজ‍্যে পরিণত করা হল।
তারপর ধীরে ধীরে যখন হিন্দুরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল তখন হিন্দুদের মধ‍্যে দলিত, পিছড়ে বর্গ, অতি পিছড়েবর্গ – এই সব শ্রেণী বিন‍্যাসে হিন্দু একীকরণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হল।তার সাথে দেশে সরকারী সহায়তায় ও অর্থানুকুল‍্যে মসলমানদের উন্নয়নের নামে ইসলামিক কনসোলিডেশান শুরু হল। মদত দিল চীন ও পাকিস্তান। তাদের ব‍্যপারে মৌণব্রত অবলম্বন করে নিজেদের ঘৃণ‍্য কাজ চালিয়ে যেতে লাগল কংগ্রেস ও কমু‍্যনিষ্টরা। তারপর ধীরে ধীরে মার খেতে খেতে হিন্দু একীকরণ শুরু করার কাজ যে সংগঠণগুলি শুরু করল তাদের উপর সরকারী, জেহাদী ও কমু‍্যনিষ্টদের আক্রমণ নেমে এলো। তা সত্বেও আজ হিন্দু কনসোলিডেশান প্রাধান‍্য পাচ্ছে। যত আক্রমণ নেমে আসছে, হিন্দুদের জোটবদ্ধ হওয়া তত গতি পাচ্ছে।
পরিশেষে একটি কথা বলার আছে। যে মূহুর্তে ভারত আবার টুকরো করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে তখন কয়েকটি নতুন জেহাদী রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যেখানে কংগ্রেস ও কমু‍্যনিষ্ট কোন দলেরই অস্তিত্ব থাকবে না। সুতরাং দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে ১৯৭৬ সালে কালো দিনের সাহায‍্য নিয়ে সংবিধানে যে দুটি পরিবর্তন করা হয়েছিল তা বাতিল করা আশু প্রয়োজন। রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া কোন রাষ্ট্র থাকেনা। সুতরাং ভারতের রাষ্ট্রধর্ম হোক হিন্দুত্ব যা সকল religion কে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কোন ‘ইসলামিক সেকুলারিজম’ ভারতের টুকরো টুকরো হওয়াকে আটকাতে পারবে না।

চীনের জৈব অস্ত্রের প্রথম টার্গেট ভারত

         আজ প্রায় দুবছর ধরে যে ভাইরাস পৃথিবীকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে তার নাম কেন ইউহান ভাইরাস তা আগে আলোচনা করা হয়েছে। যদি জাপানী এনকেফেলাইটিস, স্প‍্যানিশ ফ্লু হতে পারে, তবে ইউহানের ইন্সটিটিউট থেকে নির্গত ভাইরাসের নাম অবশ‍্যই ইউহান ভাইরাস রাখা হবে। এখনো অব্দি পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় আঠারো কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু যেদেশের থেকে এই ভাইরাস ছড়ালো তার কোন মুক্ত আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান করা হল না! অনেক পরে যদিও WHO কন্ট্রোল্ড আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান দল অনুসন্ধান করেছে, সেখানে চীনা পর্যবেক্ষণ ও অনুমতি সাপেক্ষে একটি স্তর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা গেছে। free investigation আজও হয়নি! পৃথিবীতে যার কারনে বৃহত্তম মানবগোষ্ঠী আক্রান্ত হল এবং মৃত্যু হল, সেই অতিমারীর তদন্তে এতটা রাখঢাক করা অবশ‍্যই গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে। যদি চীনের কিছু লুকানোর না থাকত তবে এত রাখঢাক, বাধানিষেধ কেন? আবার ঐ ইন্সটিটিউটেরই একটি ল‍্যাবোরেটরীতে এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সময় একই প্রজেক্টের যে তিনজন বিজ্ঞানী করোনা আক্রান্ত হয়ে এই রোগের প্রথম আক্রান্ত হিসেবে মারা যান, তাঁদের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন তথ‍্য, চীনা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ‍্যের বাইরে  আর কিছু জানা যায়না। সমস্ত তথ‍্যপ্রমাণ যে দিকে ইঙ্গিত করে তা হল, এই ভাইরাসটিকে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারীং করে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব‍্যবহার করার জন‍্য ঐ ল‍্যাবোরেটরীতে গবেষণা করা হচ্ছিল। কিন্তু আকস্মিক কোন অঘটনে ভাইরাস তার site থেকে মুক্ত (escape) হয়ে যায়। এইভাবেই তার সংক্রমণ শুরু হয়। এটি যদি শুধুই প্রাকৃতিক সাধারণ ভাইরাস হত তবে ঠান্ডা, গরম সব পরিবেশে মানুষের থাকার উপযোগী জায়গায় এভাবে একই রকম কর্মক্ষমতা বজায় রেখে বেঁচে থাকতে পারত না।
       এবার প্রশ্ন হল, এই ভাইরাস থেকে চীন কেন জৈব অস্ত্র তৈরী করবে? উত্তর পেতে কিছু বছর পিছিয়ে যেতে হবে। চীনেই গত দু দশকে দুটি ভাইরাস SARS ও MERS বাদুরের থেকে মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ‍্য ঐ ইন্সটিটিউটে আছে। বাদুর থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণ ছড়ায় এমন RNA ভাইরাস নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও পরিকাঠামো, দুইই চীনের হাতে ঐ ল‍্যাবোরেটরীতে মজুত থাকায় একাজে তাদের স্বাভাবিকভাবে ওখানেই এগিয়ে আসার কথা।
        এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চীন জৈব অস্ত্র বানাবে কেন এবং তার টার্গেট কারা? এর উত্তর বিশদে দেওয়া প্রয়োজন। আমেরিকার সঙ্গে চীনের যতই মতবিরোধ থাকুক, তাদের পারস্পরিক বাণিজ‍্যিক প্রয়োজনীয়তাই দু দেশের সম্পর্কের মধ‍্যে যুদ্ধের ছায়া ফেলতে দেবে না। আবার এই মূহুর্তে রাশিয়া চীনের প্রতিদ্বন্দীও নয় এবং তাদের মধ‍্যে কোন সীমান্ত বিরোধ নেই। কিন্তু চীনের ভয় অন‍্য জায়গায়। তারা বিভিন্ন কৌশলগত দিক থেকে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করে আগে যেভাবে সফল হয়েছিল, বিশেষতঃ ১৯৬২ সালের যুদ্ধে, সেই ভারতকে এখন আর দেখতে পাচ্ছে না। যখন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আমেরিকার উচ্চতম মহল থেকে সরাসরি জানানো হয়েছিল যে পাকিস্তানকে কাশ্মীরে free access  দিয়ে তাদের দাবী না মেনে নিলে পাকিস্তান ভারতের উপর পারমানবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে; তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী বলেছিলেন, পাকিস্তান তার সব পরমানু বোমা ভারতের উপর ফেললে ভারতের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ মারা যাবে। সেইসঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে তারপর পৃথিবীর মানুষ ঘুম থেকে উঠে জানতে পারবে যে পাকিস্তান বলে একটি দেশ পৃথিবীতে ছিল। সেইদিনই বোঝা গিয়েছিল, গান্ধী-জওহরলালের শত্রুকে প্রেম নিবেদনের অহিংস নীতি আর নেই। ভারত ঐ সময় থেকেই দ্রুত তার সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয়তাবোধের ভিত্তিও সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু চীনের তাতে বেজায় আপত্তি। কারন, চীনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ বর্ডার বরাবর রাস্তা বানানো, প‍্যাংগং লেকের ও ভুটানের ডোকালামকে নিজেদের মিলিটারী কন্ট্রোলে নিয়ে এলে চীনের এই অঞ্চলের উপর আধিপত‍্য বিস্তার করা খুব সহজ হয়। চীন, দীর্ঘ সময় ধরে ম‍্যাকিয়াভেলীর তত্ত্ব অনুসারে, শুধুমাত্র ভারতকে ব‍্যতিব‍্যস্ত রাখার কারণে পাকিস্তানকে আর্থিক ও সামরিক সাহায‍্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে সর্বদা ভারতের বিরোধীতা করা চীন রুটিন পদ্ধতিতে চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গত আট-নয় বছর ধরে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও ভারতের বিদেশনীতির ব‍্যপক পরিবর্তনেয ফলে, বিশেষতঃ কাশ্মীরে পাকিস্তানের দুঃসাহসিক দুর্বিত্তগিরির ক্ষমতাও কমেছে। আবার চীনের বড় ভরসা ছিল যে তাদের সমস্ত কাজকে ভারতের সব কমু‍্যনিষ্ট দলগুলি সমর্থন করত- তাতেও ভাটা। ভারতীয় রাজনীতিতে কমু‍্যনিষ্টরা এই মূহুর্তে মার্জিনালাইজড - নখদন্তহীণ বাঘ! এদিকে ইরান ও মধ‍্যপ্রাচ‍্য থেকে সরাসরি খণিজ তেল আমদানি এবং চীনের প্রধান রপ্তানীর রাস্তা মসৃণ রাখার জন‍্য দরকার চীন সাগরের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য ও সঙ্গে দরকার ভারত মহাসাগরে তার প্রভূত্ব। এতে ভারতের স্বার্থত বটেই, সার্বভৌমত্ব সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধরে নিয়ে চীন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে উদার হস্তে সাহায‍্য দিয়ে জোট বাঁধতে চেষ্টা করেছে। সেখানে শ্রীলঙ্কা তাদের চাল ধরে ফেলায় আর অবস্থানগত কারনে মালদ্বীপের পক্ষে প্রত‍্যক্ষ বিরোধীতায় অসুবিধা থাকায় চীনের এই চেষ্টা সর্বতোভাবে ফলপ্রসু হয় না। এদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগায় জাপান ও অষ্ট্রেলিয়া ভারতের সঙ্গে জোট বেঁধে এই জলপথে চীনের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তারা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলতাদের আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় বাধা ভারত। আবার চীনের পন‍্যের সর্ববৃহৎ খরিদ্দার আমেরিকা, তার পরেই ভারত। সুতরাং সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা সম্ভব নয়। তার অন‍্য কারনও আছে। ২০১৭সালে যখন ভুটানের ডোকালাম অঞ্চলে চীন রাস্তা বানাতে উদ্দোগী হয়, তখন ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় সৈন‍্য তাদের বাধা দিয়ে চীনা সৈন‍্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরে। চীন ভেবেছিল ১৯৬২ সালে যেভাবে তারা ভারতসৈন‍্যদের পশ্চাদপসারনে বাধ‍্য করেছিল সেভাবেই এবারেও তারা ভারতীয়দের ভাগিয়ে দেবে। তা নাপারায় চীন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একদিকে ভারতের অরুনাচল প্রদেশকে তারা চীনের অংশ বলে দাবী করে, অন‍্যদিকে পাকিস্তানকে সমস্ত রকম নাশকতা চালানোর জন‍্য মদত দিতে থাকে। আগ্রাসী চীন এরপর ভারতকে পয়লা নম্বরের শত্রু বলে ভাবতে শুরু করে। তারপর ২০২০ সালে তারা আবার ভারতের উপর আগ্রাসী হয়ে প‍্যাংগং লেক ও তার আশেপাশের গালওয়ান সীমান্তের  উচ্চতর পাহাড়চূড়াগুলির দখল নিতে চেষ্টা করে। ঐ অঞ্চলে শীতের সময় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন  থাকার কারনে জওয়ানদের সব রসদ এয়ারলিফ্ট করা হয়। এই অসুবিধা দূর করতে ভারত সরকার বর্ডার এরিয়ায় চওড়া রাস্তাই শুধু বানানো নয়, মাটির তলা দিয়ে টানেল তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে সিয়াচীন - লাডাখ সীমান্তে সারা বছর সড়ক যোগাযোগ ব‍্যবস্থা অক্ষুন্ন থাকে। চীনের আগ্রাসন নীতি অনুযায়ী তারা হিমালয়ের কন্ট্রোল রাখার স্বপ্ন দেখে এবং সরাসরি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উপর দিয়ে ইরান পর্যন্ত হাইওয়ে তৈরীর কাজে তারা ইতিমধ্যে বহু অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এই ill conceived প্রজেক্টের জন‍্য চীন ভারতের উত্তর প্রান্তের বর্ডার এরিয়াকে কুক্ষিগত করার জন‍্য সব রকম প্রয়াস চালাচ্ছে।
     ২০২০ সালে প‍্যাংগং লেক ও গালওয়ান হাইটের জন‍্য যে হাতাহাতি (আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া) যুদ্ধ হল তাতে চীনাপক্ষের অধিক ক্ষতি হওয়ায় চীন যুদ্ধ ও আগ্রাসন নীতির দিক পরিবর্তন করল। যেহেতু ভারত ও চীন দুইই পরমাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্র, তাদের মধ‍্যে পরমাণু যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার প্রথাগত যুদ্ধ হলে তাদের ক্ষতি যে বেশী হবে তা কয়েকটি ছোটখাটো সঙ্ঘাতেই চীন বুঝতে পেরেছে। সুতরাং ভারতকে ঘায়েল করার জন‍্য আন্তজার্তিক কুটনীতির স্তরে চেষ্টা করেও যখন চীন কোন সাফল‍্য পেলনা , তখন তাদের হাতে একমাত্র বাকী থাকল জৈব অস্ত্র প্রয়োগ। এই জৈব অস্ত্র এমন হওয়া চাই যা ছোট জায়গার মধ‍্যে প্রয়োগ করলেও সহজেই বড় জায়গায় ছড়িয়ে পরে এবং ধীরে ধীরে আক্রান্তের প্রাণসংশয় হয়। আবার এর প্রয়োগে ধণসম্পত্তির যাতে ক্ষতি না হয় কারণ, বিজিত দল যখন সব ফেলে পালিয়ে যাবে তখন বিজয়ীদল সেসব ভোগ করতে পারবে। ভারতের সুবিশাল আয়তন ও লোকসংখ‍্যা ধরলে এই ধরনের জৈব অস্ত্রের মোকাবিলা করা খুবই শক্ত। এই জৈব অস্ত্র যা RNA বাইরাস থেকে তৈরী হতে পারত তা ভারতের উপর প্রয়োগ করলে খুবই কার্যকরী হবার সম্ভাবনা। কারন চীন শুধু ভারতের উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চলের দখলই চাইছে না, সঙ্গে ভারতকে খন্ডিত হীণবল করে দিলে আর ভারত মহাসাগরে জোট বেধে ভারত চীনের আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে পারবে না।
      লক্ষণীয় যে, বাদুর থেকে প্রাপ্ত এই ধরনের RNA ভাইরাসের উপর চীনের অধিগত জ্ঞান থাকায়, জৈব অস্ত্র হিসেবে এই SARS Cov2 বা করোনা ভাইরাস থেকেই যে চীন জেনেটিঈ ইঞ্জিনিয়ারিং করে জৈব অস্ত্র তৈরীর বেষণা চালাচ্ছিল এবং তার প্রথম লক্ষ‍্য যে ভারত, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
      চীনের বন্ধুত্বের মধ‍্যেও তাদের আগ্রাসী নীতির পরিচয় পাওয়া যায়। চীন যে শর্তে পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য ও পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে তাতে পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়ি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পরবে। এটা বুঝেই মায়নামার ও বাংলাদেশ চীনের থেকে সার্বিক ঋণ নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। আবার শ্রীলঙ্কা চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বন্দর চুক্তি করেও পিছিয়ে আসার জন‍্য ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পরিধি বাড়াচ্ছে। মালদ্বীপের সংখ‍্যাধিক‍্য জনগণ চীনের চাপের কাছে নতিস্বীকারের বিপক্ষে। যদিও ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের লাগাতার অপপ্রচারকে সমর্থন করছে চীন, তারা কিন্তু তাদের নিজেদের দেশে মুসলমানদের উপর চরম অমানবিক অত‍্যাচার চালাচ্ছে যা আমরা পাশ্চাত‍্যের প্রচারমাধ‍্যম থেকে জানতে পারছি। পাকিস্তান আবার এ সম্পর্কে একটি কথাও বলছেনা! সাম্প্রতিক অতীতে চীনের ব‍্যবহারের কারনে যখন তাদের দেশ থেকে সরাসরি বিভিন্ন পণ‍্য আমদানি এবং সফ্টওয়‍্যার ব‍্যবহার ভারত বন্ধ করে, চীন তখন তাদের তাঁবেদার ভারতীয় কমু‍্যনিষ্টদের দিয়ে তার প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত করতে ব‍্যর্থ হয়। ভারতের সঙ্গে লাগাতার একতরফা বিরোধ বাধিয়ে রেখে চীন যে তার আগ্রাসন নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে নতুন অস্ত্র, তা জৈব অস্ত্র হলেও, তারা ভারতের উপর প্রয়োগ করবেই।। চীন যা ভুল করছে তা হল ভারতকে তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া বা মায়নামারের মত ধমকে চমকে তাঁবেতে রাখা সম্ভব নয়। কথায় আছে, "নিজের ভালো পাগলেও বোঝে"। তাই পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কখনোই চীনের উস্কানিতে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে না। অতয়েব ভারতকে ঘায়েল করার একমাত্র রাস্তা জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ। চীন সেই চেষ্টাই করছিল SARS Cov2 ভাইরাস নিয়ে ইউহানের জাতীয় ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজিতে।
        চীনের এই অপচেষ্টা বন্ধ না করলে এই দেশ "রোগ কান্ট্রি" হিসেবে পৃথিবীর মাথা ব‍্যথার কারন হতে পারে। কারন তাদের কোন কাজে স্বচ্ছতা নেই। তবে ভারত তার এক নম্বর টার্গেট। সেজন‍্য শুধু ভারত সরকারই নয়, ভারতীয় কমু‍্যনিষ্টদেরও চীনকে প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দেওয়া থেকে সরে আসতে হবে। কথায় বলে, "আপনি বাঁচলে বাপের নাম"।চীনকে সমর্থন করতে গিয়ে ভারতে কমু‍্যনিজম বিলীন হওয়ার জায়গায় চলে যেতে পারে কারন, চীনকে সমর্থন সরাসরি ভারতের অস্তিত্বের পরিপন্থী।

অতিমারীর মধ‍্যে শিক্ষায় সরকারের দিশাহীনতা

শিক্ষাদানের বিভিন্ন স্তরের মধ‍্যে গত দুবছরে একটি মিল আছে। সেটা হল, নার্শারী থেকে প্রাইমারী, সেকেন্ডারী, হায়ার সেকেন্ডারী এবং উচ্চশিক্ষায় কলেজ ও বিশ্ববিদ‍্যালয় – সবেতেই টোটাল লকডাউন – নাম তার যাই হোক না কেন। এর দায় কার সেটা এখন আর বড় কথা নয়, এর ফল কি দাঁড়ালো সেটাই বড় কথা। আপামর শান্তিপ্রিয়, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাঙ্গালী এর ফল এখনো ভেবে দেখেনি। পরীক্ষা বন্ধ ও পড়াশোনা শিকেয় ওঠায় প্রায় সব ছাত্রছাত্রী খুশী। তাদের অভিভাবকদের উপর অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ কমায় তারাও খুশী। কিন্তু এতে ক্ষতি কার হল, কিভাবে হল? কোন মিডিয়া হাউসের এ নিয়ে মাথা ব‍্যথা নেই। এর সুদুরপ্রসারী ফল জানিয়ে তাদের টিআরপি বাড়বে না – কারন বাঙ্গালী জাতটার মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেলে তাদের লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
প্রত‍্যেক দেশেই কমবেশী করোনা অতিমারীর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কোন একটি উন্নদেশ দেখানো যাবে না যেখানে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে পরীক্ষা বন্ধ। পড়া না পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার হলে তা অবশ‍্যই আরো হাস‍্যকর হত। আমাদের রাজ‍্যে আবার চমৎকার ব‍্যবস্থা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেই যে ক্লাস বন্ধ হল, তা আর কার্যকরীভাবে চালু করা গেল না। সরকারীস্তরে শিক্ষকদের বেতন একই রকমভাবে চলতে লাগল। কিন্তু অতিমারী পরিস্থিতিতে তাঁদের যোগ‍্য কাজে ব‍্যবহার করার কথা ভাবা পর্যন্ত হল না! আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলিতেই শিক্ষকদের মাইনে কমিয়ে ও ছাঁটাই করে কাজ(!) চলতে লাগল। উচ্চন‍্যায়ালয়ের রায়ের পরেও এই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের ব‍্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনই একটি স্কুলে তার মেয়ে পড়ে, এমন এক আত্মীয়ার কাছ থেকে জানলাম, মেয়ের মাসিক ফি প্রায় তিন হাজার টাকা। কোর্টের রায়কে মাণ‍্যতা দিয়ে স্কুল ঐ মাইনে থেকে পনেরো টাকা ফি কমিয়েছে! তারা তাদের ‘অনলাইন’ শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এই লেখায় শিক্ষা জগতের এই ধ‍্যাষ্টামো এবং তার ফলও তুলে ধরছি।
প্রথমত, আমাদের রাজ‍্যে প্রাথমিক ও মাধ‍্যমিকস্তরে কজন অভিভাবক স্মার্টফোন ব‍্যবহার করেন ও সেইসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সংগতি রাখেন তা সরকার বা কোন সংবাদ মাধ‍্যম সার্ভে করেছে বলে জানা নেই। মূর্খের স্বর্গে বাস করার সুখই আলাদা। আসলে ওয়েবিনারের মাধ‍্যমে ক্লাস করার সুবিধা স্কুলস্তরে ১ থেকে ১.৫% ছাত্রছাত্রী পেতে পারে। এর কারন বহুবিধ। বেশীরভাগ অভিভাবকদের আর্থিক অসঙ্গতি, সরকারী ও সরকার পোষিত স্কুলগুলির অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই ভার্চুয়াল শিক্ষার কোন কার্যকরী লাভ পায়নি। আবার বহু জায়গায় মোবাইলের টাওয়ার নেই বা থাকলেও সিগন্যাল এত দূর্বল যে ক্লাস করা অসম্ভব। শিক্ষকদের এই সময় অন‍্যভাবে ব‍্যবহার করা যেত। এই অনলাইন টিচিং পদ্ধতি ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলি শুরুতে আরম্ভ করলেও তারা কিন্তু দ্রুত সব সতর্কতা নিয়ে স্কুলগুলি খুলে দিয়েছে। ব্রিটেন, জার্মানী, ফ্রান্সের মত কিছু দেশ দ্রুত স্কুল খোলায় প্রায়োরিটি দিয়ে ক্লাসরুম শিক্ষা শুরু করে দিয়েছে। সবচেয়ে পরে হলেও আগামী মাস থেকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সির কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলি পর্যন্ত খুলে দেওয়ার নোটিশ জারী হয়েছে। কারন, তারা জানে, অনলাইন ট্রেণিং পুরো স্কুলশিক্ষার প্রতিস্থাপক হিসেবে অচল। এই শিক্ষাটাই আমাদের সরকার নিতে পারল না। দায় এড়ানোর প্রবণতায়, আমলাতান্ত্রিক কুপরামর্শে বাঙ্গালীকে শিক্ষাহীণ জাতিতে পরিণত করার দায় কিন্তু সরকারের উপরেই বর্তাবে।
আসলে দায়িত্ববোধ ও দায়িত্ব নেওয়ার তাগিধের অভাব, এই দুই কারনেই আমাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্কুল চালু করতে গেলে সংক্রমণের আশঙ্কায় স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হল। সেই যুক্তিতে দোকান, বাজার সবই ত বন্ধ রাখার কথা! এখানেই সরকারের ব‍্যর্থতা। যেগুলি না খুললে সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পরবে সেগুলি খুলে দিয়ে শিক্ষা জগতকে স্তব্ধ রেখে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা।
তারপর অতিমারী যত এগিয়েছে, অবস্থা উত্তরোত্তর আরো ঘোরালো হয়েছে। যখন টীকাকরন শুরু হল, ইংল‍্যান্ড তাদের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ টীকার বরাত দিল। আমেরিকাও তাদের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ টীকার বরাত দিল। এদিকে, ভারতে যদিও দুটি পৃথক টীকা কোম্পানির টীকা তৈরী হচ্ছে এবং সরকার তাতে একাধিক উপায়ে সাহায্য করছে, জনসংখ্যার এক ক্ষুদ্র অংশের জন‍্য বরাত দেওয়া হল। পুরো পদ্ধতিটাই গোলমেলে হয়ে গেল বয়েস ভিত্তিক টীকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে এক বয়েসের টীকাকরণ শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই অন‍্য বয়েসের টীকাকরণ শুরু হওয়ায়। টীকার দামেও বিস্তর ফারাক। কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ‍্য সরকারের, বেসরকারী – ভিন্ন ভিন্ন দাম। পুরো পদ্ধতিই ডিরেল্ড হয়ে গেল। অথচ অন‍্য দেশগুলি কাজের প্রায়োরিটি অনুযায়ী টীকাকরণ শুরু করল। চিকিৎসা কর্মীদের পরেই প্রায়োরিটিতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের রাখা হল। স্কুলগুলি স‍্যানেটাইজ করে দ্রুত খোলার ব‍্যবস্থা করা হল যাতে দ্রুত ক্লাশরুম শিক্ষায় ফেরা যায়। এমন চিন্তাধারা সারা দেশের সঙ্গে আমাদের রাজ‍্যেও দেখা গেল না। কারন, আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেন শিক্ষা একটি অপ্রয়োজনীয় আলঙ্কারিক জিনিষ – হলে ভালো, নাহলে ক্ষতি নেই। স্বাধীন ভারতে দেশের ভালোর জন‍্য শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী খরচ সাপেক্ষ উন্নয়ণ প্রায় চোখেই পড়েনা। তার বদলে স্বল্পমেয়াদী আলঙ্কারিক উন্নয়ণেই ঝোঁক দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কেন্দ্র ও রাজ‍্যের কজন নেতার যথার্থ ধারনা আজে যে একটা জাতিকে নষ্ট করার জন‍্য তার শিক্ষা ব‍্যবস্থা ধ্বংস করা সবচেয়ে জরুরী। সমস্ত দেশ যখন তাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থা সচল রাখতে মরিয়া তখন কি কেন্দ্র, কি রাজ‍্য, সবাই আমাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে অতিমারীর সময়ে বাঁচানোর দায়িত্ব পালন না করে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হল।
আমাদের দেশের পরিকাঠামো ও আর্থসামাজিক অবস্থার পর্যালোচনা করলে অনলাইন শিক্ষার ধারনাটাই, বিশেষতঃ স্কুলস্তরে, অলীক কল্পনা মাত্র।পুরো শিক্ষার পরিকাঠামোর খরচ বজায় রেখে, শিক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে, পরপর দুবছর পরীক্ষায় ছাড় দিয়ে আমরা শিক্ষা ধ্বংসের বিনিময়ে নাটকীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করলাম! পড়াশোনার মান নির্ভর করে সুষ্ঠু পরীক্ষা-পদ্ধতির উপর। আর পরীক্ষা-পদ্ধতির সাফল‍্য নির্ভর করে স্বচ্ছ ও সফল মূল‍্যায়ন পদ্ধতির উপর। গত বছর, ২০২০ সালে, অতিমারীর লকডাউনের মধ‍্যে পরীক্ষা-পদ্ধতি ও তার হাস‍্যকর মূল‍্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষা-দপ্তর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা রক্ষার বিনিময়ে শিক্ষার যথাযথ মূল‍্যায়নের বিষয়টিকে শিকেয় তুলে দিলেন। যার ফলে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের পর মুড়ি মুড়কি একই দরে বিকোতে লাগল। তারপর, স্কুল খুলতে না খুলতে প্রশাসনিক ( তা কেন্দ্র ও রাজ‍্য দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ‍্য) ব‍্যর্থতায় যখন আবার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে লাগল, সব পঠন পাঠন বন্ধ করে দেওয়া হল। সমাজে পরিষ্কার বার্তা গেল যে, স্কুল,কলেজ খোলা রাখা সরকারের প্রাথমিক কাজ নয়, পড়াশোনা অত‍্যাবশ‍্যকীয় নয়। এখানেই অন‍্য দেশের সঙ্গে আমাদের তফাৎ। তারা শিক্ষার গুরুত্ব জানে বলেই শিক্ষাকে প্রায়োরিটি সেক্টারে রেখে, স্কুল কলেজে দ্রুত টীকাকরনের ব‍্যবস্থা করে ও কার্যকরীভাবে স‍্যানিটেশান চালু রেখে শিক্ষাদান ব‍্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখেছে – যাতে একটা জেনারেশান শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। আর শিক্ষাই একটি জাতির ভিত্তি। আমাদের দেশের চালকদের এই ‘বোধ’ এর অভাবেই আমরা আমাদের একটা জেনারেশানকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত করলাম।
দুবছর পড়াশোনা বন্ধ রেখে এবং প্রথম বছর অস্বচ্ছ ও অসম্পূর্ণ মূল‍্যায়নে ‘পরীক্ষা’ নিয়ে, পরের বছর সে পাটও চুকিয়ে দিয়ে বিনা পরীক্ষায় প্রমোশনের যে ডামাডোল তৈরী হল, তাতে আর যাই হোক, শিক্ষার গঙ্গাজলী যাত্রা সম্পূর্ণ হল। স্কুলের শেষ পরীক্ষা না হওয়ায় ও সমমূল‍্যায়ন বা স্কুলের অনলাইনে না পড়িয়ে মূল‍্যায়ন, যাই হোকনা কেন, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি, বিশেষত টেকনিক্যাল বিষয়ে, যেমন ডাক্তারী, ইন্জিনীয়ারীং ইত‍্যাদি বিষয়ে মেধাভিত্তিক সঠিক ভর্তি প্রক্রিয়া শুধু ঘেঁটে গেল তাইই নয়, এই শাখাগুলিতে দূর্বল মেধার অনুপ্রবেশ রোখার উপায়ও থাকল না। সঙ্গে টাকার জোরে উচ্চশিক্ষা লাভের ছাড়পত্র পাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হল! ফলে, বিশ্বের দরবারে আমাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থার বিশ্বাসযোগ‍্যতা নষ্ট হল। বলা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মেনে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য, রাজনৈতিক নিয়মে পরিচালিত সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে ‘বিশেষরূপে অজ্ঞ’ স্তাবকবৃন্দ নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সব সময় কর্তাভজা রিপোর্টই দেয়। তবে,তার ফলাউট বিচার করে যথার্থ বিশ্লেষনেই ভুল সংশোধনের সুজোগ থাকে। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শাসকের মানসিকতা। শাসককে আগে ঠিক করতে হবে শিক্ষা প্রায়োরিটি সেক্টারে থাকবে কিনা। তা নাহলে শিক্ষার এই অবমূল‍্যায়ন রোখা সম্ভব নয়।
এবার আসি বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া ফল প্রকাশের বিড়ম্বনায়। এক্ষেত্র, একই মেধার, বিভিন্ন রাজ‍্যের ও বোর্ডের মধ‍্যে, এমনকি একই রাজ‍্যের বিভিন্ন স্কুলের মধ‍্যে নম্বরের বিস্তর ফারাক থাকবে। এতে আমাদের শিক্ষার মানের সামাজিক স্বীকৃতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ফলিত ও ল‍্যাবোরেটরী ভিত্তিক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে এধরনের বিনা পরীক্ষায়, বিনা ক্লাসে ডিগ্রী সামাজিক স্বীকৃতির পরিপন্থী। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ও রাজ‍্যস্তরের শিক্ষা বিভাগের এসব ভাবা উচিৎ ছিল। উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি এখন টাকার খেলায় পরিণত হবে। সেটাই এর পরিনাম।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক।এখানে ভোট ও সরকার গঠন সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। টীকাকরনে অগ্রাধিকার স্বাস্থ‍্যকর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী সান্ত্রীদের! তারপর বাজারের ব‍্যবসায়ী, বয়েসভিত্তিক নাগরিক ইত‍্যাদি। এখানে শিক্ষাজগতের কোন কথা নেই। গত এক বছরে শিক্ষকদের একমাত্র উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ভোটে ভোটকর্ভী হিসেবে কাজ করা। সুতরাং বলা যেতে পারে, সরকারই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে দেশের যাবতীয় ছাত্রদের জীবন থেকে দুটি শিক্ষাবর্ষকে মুছে দিল। এই যে স্কুলশিক্ষায় বাধা পরল, এর একটি অবশ‍্যম্ভাবী ফল হল ড্রপআউট। এই ড্রপআউটের সংখ‍্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে। একত হচ্ছে অভিভাবকদের আর্থসামাজিক অবস্থা, দ্বিতীয় হচ্ছে সরকারের শশিক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে মনোভাব। আমাদের রাজ‍্যের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে এইসব স্কুলছুটদের আবার স্কুলমুখী করা অসম্ভব। দেখা যাবে, খাতায় কলমে ছাত্রছাত্রী থাকবে, তাদের মিডডে মিলের টাকা, চাল ইত‍্যাদি আসবে কিন্তু আসল ক্লাশরুমে ছাত্রছাত্রী অনেক কমবে। এইভাবে গত দুদশকের অত‍্যন্ত সফল কার্যক্রম ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ আমাদের রাজ‍্যে মুখ থুবড়ে পড়বে। সরকার যেন এর জন‍্য তৈরী থাকে।

করোনাকে ইউহান ভাইরাস বলাই ঠিক

করোনা বা সার্স-কোভ-২ এখনো জিন মিউটেশানে পরিবর্তন ঘটিয়ে তার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাসের মানবদেহে আক্রমণ করার ক্ষমতার প্রথম প্রমান আমরা পাই চীনের ইউহান প্রদেশে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ইউহানের বিশ্ববিখ‍্যাত ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের একটি বিশেষ ল‍্যাব থেকে। এই ল‍্যাবের তিনজন বিজ্ঞানীর দেহে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের উপসর্গ দেখা যায়। এরা সকলেই করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন। সুতরাং এই ভাইরাসটি ল‍্যাবোরেটরী সৃষ্ট কিনা, সে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। এই ভাইরাসের সংক্রমণকে অতিমারী আখ‍্যা দেওয়া হয়েছে আর এর সংক্রমণে ইতিমধ‍্যেই ত্রিশ লক্ষের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই অতিমারীর জন্মস্থান অর্থাৎ ইউহানের ঐ ল‍্যাবের প্রথম সংক্রমণের জায়গাটা এখনো, দু বছর বাদেও গভীর রহস‍্যে ঢাকা। এই রহস‍্য ভেদ করার চেষ্টায় আমি বৈজ্ঞানিক তথ‍্যের উপরই নির্ভর করে থাকছি। যে তথ‍্যগুলি পাওয়া যাচ্ছে তা একসঙ্গে গ্রোথিত করে পুরো ব‍্যপারটা উত্থাপনের চেষ্টা করছি।
মোটামুটিভাবে দুটি প্রারম্ভিক সংক্রমণের সূত্রপাতের তত্ত্ব সামনে এসেছে। প্রথম, এটি প্রাকৃতিকভাবে বাদুরের থেকে কোন পশুর মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকেছে! এই তত্ত্বকে তড়িঘড়ি WHO মান‍‍্যতা দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হল, যখন ভাইরাসটি গবেষনাগারে পরীক্ষার স্তরে ছিল, সেই সময় পরীক্ষা নিরীক্ষার ফাঁকে ভাইরাসটি গবেষণাক্ষেত্র থেকে পালায়। ভাইরাসের এই ধরনের পলায়ন (escape) খুবই দুর্লভ হলেও অসম্ভব নয়। তবে, lancet জার্নলে যে চিঠি প্রকাশ নিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড়, সেই বক্তব‍্যের সারবত্তা ও চিঠি লেখার নেপথ‍্য কারন নিয়ে ভাবার কথা। চিঠির বয়ান দেখলেই বোঝা যায়, এর ছত্রে ছত্রে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে যে চীনের ঐ ল‍্যাবোরেটরীতে কখনোই ভাইরাসটিকে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব‍্যবহার করার জন‍্য গবেষণা করা হচ্ছিল না! ডঃ পিটার ডাসজেকের নেতৃত্বে ২৭ জন বিজ্ঞানী ও ডাক্তার ঐ চিঠিটা লেখেন। যে মার্কিন সংস্থা ইউহানের ঐ গবেষণাকেন্দ্রে গবেষণা করার জন‍্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে, সেই সংস্থার চেয়ারম‍্যান হলেন ডঃ ডাসজেক। এছাড়া, আরেকজন স্বাক্ষরকারী জেরেমি ফারার, যিনি ইংল‍্যান্ডের ওয়েলকাম ট্রাষ্টের ডিরেক্টার। এমন অনেকেই আছেন যারা স্বাক্ষরকারী এবং তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ইউহানের ঐ গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত। মনে রাখতে হবে, এটি lancetএ প্রকাশিত একটি চিঠি মাত্র। কোন গবেষণাপত্র নয়। এটিকে গবেষনাপত্রের মর্যাদা দেওয়া ভুল। একটি চিটি, স্বাক্ষর ২৭ জনের! এদের অধিকাংশেরই বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকে নজর রেখে চিঠিটি লেখা হয়েছে এমন ধারনা অযৌক্তিক নয়। কারন, ভাইরাসটিকে জৈব অস্ত্র তৈরীর গবেষণায় ব‍্যবহার করা হয়েছে, এমন প্রমাণ হলে শুধু চীনের সরকারই নয়, ইউরোপ, আমেরিকার যে প্রতিষ্ঠানগুলি এইসব প্রজেক্টকে আর্থিক সহযোগীতা করেছে, তারাও বিশ্বের কাছে অতিমাত্রায় নিন্দিত হবে এবং সমালোচনার জেরে তাদের ভবিষ‍্যৎ কর্মপদ্ধতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এমনকি তারা কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। সেজন‍্য তারা তথ‍্য প্রমাণ ব‍্যতিরেকে, করোনা ভাইরাসকে গবেষণাগারের ভাইরাস বলার তত্ত্ব সাত তাড়াতাড়ি খারিজ করে চিঠি লিখেছে। আবার বলছি, এটি যেহেতু একটি চিঠি মাত্র, lancetএ ছাপার মাহাত‍্য এই চিঠির সঙ্গে যুক্ত করা যায় না।
এটা ঠিক যে করোনা ভাইরাসের মত একই ধরনের অনেক ভাইরাস জংলী বাদুরদের মধ‍্যে দেখা গেছে। সুতরাং বাদুর স্বাভাবিকভাবেই এই ভাইরাসের একটি সোর্স হতে পারে যা অন‍্য কোন পশুর মাধ‍্যমে মানবদেহে প্রবেশ করেছে। এখানে উল্লেখ‍্য যে SARS ও MERS এর সোর্সও এই বাদুর। Shan-lu-liuর নেতৃত্বে ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, করোনা ভাইরাস একটি জৈব অস্ত্র হওয়ার মত তথ‍্য তারা এখনো পাননি। ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং কয্বরে দেখা গেছে যে, এর সিকোয়েন্সিংএ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর কোন লক্ষণ নেই – যা জৈব অস্ত্র তৈরীতে অবশ‍্যই থাকতে হবে।
এরপর আসি অন‍্য সম্ভাব‍্য বিকল্পগুলিতে। প্রথমটি হল, স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে এমন কান্ড বাধিয়েছে। এখানে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর মিলছে না। প্রথমতঃ, ইউহানের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের যে ল‍্যাবের যে তিনজন বিজ্ঞানীর (তাঁরা সবাই এখন মৃত) প্রথম করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়, তাঁরা সবাই এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন। অন‍্য যে খবরে বলা হয়েছে যে মাংসের বাজার থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে, তার সত‍্যতা খুবই লঘু কারন আক্রান্তদের সবাই ঐ বাজারের মাংস কেনেন নি – অথবা অন‍্য মানুষজন প্রথম আক্রান্ত হননি। আবার চীন সরকারপ্রথম থেকে এই সংক্রমণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরী করে; শুধু তাই নয়, তারা প্রথমদিকে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে বাধা দেয়। এতেই বোঝা যায়, “ডালমে কুছ কালা হ‍্যায়”। পরে অবশ‍্য WHOর প্রতিনিধিদের অনুমতি দেওয়া হয়। তখন চীনা কর্তৃপক্ষ অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। এতে বোঝা যায়, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত পরিস্থিতি সামলানোর মত রসদ ও বিদ‍্যা দুইই তাদের জানা ছিল। সুতরাং এই ভাইরাস জৈব অস্ত্র হিসেবে ব‍্যবহৃত নাহলেও, এর ব‍্যবহারের গবেষণা যে ঐ ল‍্যাবে হচ্ছিল তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনো অব্দি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোন জোরালো প্রমাণ পেশ করা যায়নি। উপরন্তু, পারিপার্শিক প্রমাণ এই তত্ত্বের পক্ষেই যাচ্ছে। যেমন, ভাইরাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় চীন অতি অল্প সময়ে যে অভূতপূর্ব সাফল‍্য পেল তার শতাংশের একাংশও অন‍্য কোন দেশ পায়নি। এটা সম্ভব হয়েছে কারন তারা এই ভাইরাসের সম্পর্কে ও তার আক্রমণের ব‍্যপারে আগে থেকেই সতর্ক ছিল, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা আগে থেকেই করা ছিল।নাহলে একটি সম্পূর্ণ অজানা RNA ভাইরাসের সংক্রমণ এত অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব। আর এই জন‍্যই প্রথম অবস্থায় চীন তাদের দেশে কোন রকম অনুসন্ধানী দলকে প্রবেশ করতে দেয়নি। বিশেষতঃ ইউহানের ঐ ইন্সটিটিউট সম্পূর্ণভাবে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
আবার দেখা যায়, চীনের তৈরী প্রতিষেধক টীকা তাদের তাঁবেতে থাকা কয়েকটি দেশ ছাড়া অন‍্য কেউ নিচ্ছে না। কিন্তু চীন এই টীকায় নাকি প্রভূত সাফল‍্য পেয়েছে! এই প্রতিষেধকের গবেষণার ব‍্যপারে সারা বিশ্ব অন্ধকারে! যদি ল‍্যবে কোন দুর্ঘটনাজনিত কারনে এই ভাইরাস বেরিয়ে পড়ে তবে তার প্রতিষেধক তখনই তৈরী রাখার কথা। এই ধরনের গবেষণায় এই দিকটাও খেয়াল রাখতে হয়। ফলে, প্রথমে দ্রুত ছড়ালেও, ভাইরাসের প্রকৃতি ও গঠন সম্পর্কে ধারনা থাকায় এবং প্রতিষেধক প্রস্তুত থাকায় চীন এত কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ‍্যমে এই ভাইরাস সংক্রমণ সমস‍্যা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
এবার আসি কেন ‘জৈব অস্ত্র’ তত্ত্ব পুরোটা ঠিক নয়, সেই যুক্তিতে। প্রথম হচ্ছে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর প্রমাণ এই ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্সিংএ মেলেনি। কিন্তু এমন ত হতে পারে, এই জৈব অস্ত্র তৈরীর গবেষণার অন্তিম পর্যায়ের আগেই ভাইরাস পলায়ণ করে সব গোলমাল করে দিয়েছে। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে চীনের বাণিজ্যিক বাজারের বড় খদ্দের আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারত। এর মধ‍্যে প্রথম ধাক্কাতেই যদি আমেরিকা ও ইউরোপের বাজার নষ্ট হয়, সঙ্গে ভারতের বাজারও যদি যুক্ত হয়, চীনের অর্থনীতি নিশ্চিতভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে। সুতরাং, এই ভাইরাসের সংক্রমণকে এই মূহুর্তে জৈব অস্ত্রের আক্রমণ বলা ঠিক হবে না। কিন্তু দুর্ঘটনা তত্ত্বের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আবার জৈব অস্ত্র যদি কোন দেশ, যেমন ভারতের বিরুদ্ধে ব‍্যবহার করা হয়, তবে তার যে সূদুরপ্রসারী প্রভাব দেখা গেছে তাতে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কিন্তু এর ধ্বংসলীলা থেকে বাদ যাবে না। এর মধ‍্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১১৫.৭ বিলিয়ন USD (যা ঐ দেশের GDPর অর্ধেক)। এর মধ‍্যে চীনের কাছে অর্থনৈতিক করিডোর বাবদ ঋণ ১৭.১ বিলিয়ন USD যা বৈদেশিক ঋণের ১৫%। সুতরাং এমন একটি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাওয়া বশংবদ দেশের ক্ষতি চীন করবে না। আবার বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৭০.৭ বিলিয়ন USD যা গত এক বছরে ১৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটি বড় অংশ ঋণ চীনের দেওয়া। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের স্ট্র‍্যাটেজিক পার্টনার। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষতিও চীন করতে চাইবে না। সাধারণত জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে। এমন অবশ‍্য অস্বাভাবিক নয়, পারমানবিক বোমার বিকল্প হিসেবে এই জৈব অস্ত্র তৈরীর প্রক্রিয়া চলছিল। তবে কোনোমতেই এটি সম্পূর্ণ ‘জৈব অস্ত্র’ নয়। কারন এর উদ্ভাবক দেশ প্রতিষেধক সম্পূর্ণ প্রস্তুত না করে এর প্রয়োগ করবে না।
এখন চীনের সঙ্গে ভারতের যে বর্ডার সমস‍্যা চলছে, যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের অবমূল‍্যায়ন হয়েছে, তা মাথায় রেখে বলা যায় যে চীন ভারতকে ‘সমঝে দেওয়ার’ মত উপায় পেলে তা প্রয়োগ করবেই। আর ভারত মহাসাসাগর ও চীন সাগর নিয়ে চীনের চিন্তার শেষ নেই। তাদের বহির্বাণিজ‍্যই শুধু নয়, খনিজ তেল আমদানির জন‍্যও এই দুটি অঞ্চলের উপর তার প্রাধান্য বিস্তার করার দরকার। এখানে অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানের সাথে ভারতই প্রধান বাধা। কাজেই ভাইরাসের আকস্মিক পলায়নকে কাজে লাগিয়ে চীন সংক্রমণকে নিজের দেশে আয়ত্তে আনলেও অন‍্য দেশগুলি, বিশেষতঃ উন্নত দেশ এবং অধিক জনঘণত্বের দেশগুলি বিপদের মুখে পড়েছে। এর থেকে বাঁচার রাস্তা দ্রুত টীকাকরণ। কিন্তু একশ ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে দ্রুত টীকাকরণ মোটেই সহজ কাজ নয়। সেছন‍্য চীন ইউহান ল‍্যাবোরেটরী থেকে যে RNA ভাইরাস পালিয়ে গেছে তার ব‍্যপারে নিজের অধিগত জ্ঞান বিশ্বের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করে গেছে।
এখনো অব্দি বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তারদের দল এমন অকাট‍্য প্রমাণ দিতে পারেনি যে এই ভাইরাসটি প্রাকৃতিক উপায়ে বাদুর থেকে মানুষের মধ‍্যে সংক্রমিত হয়েছে। বরঞ্চ ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষনে প্রমান হয় যে এটি ল‍্যাবোরেটরীতে পরীক্ষা করার জন‍্য নেওয়া একটি RNA ভাইরাস – যার আকস্মিক পলায়নের সুযোগ পুরোপুরিভাবে চীন নিয়েছে এবং তার অন্তিম লক্ষ‍্য ভারতকে বিব্রত ও ব‍্যতিব‍্যস্ত করে তোলা। সেইজন‍্য করোনা রোগের জন‍্য দায়ী এই ভাইরাসকে আমরা অন‍্য কোন নাম না দিয়ে “ইউহান ভাইরাস” নামকরণ করতে পারি

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বাড়বাড়ন্ত কেন

         "মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী" - কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আজ সারা দেশের সঙ্গে আমাদের পশ্চিমবঙ্গকেও ছারখার করে দিচ্ছে। প্রত‍্যেকদিন সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ‍্যে কোভিডে মৃতের সংখ‍্যা দেড়শোর আশেপাশে। এবারের যে ঢেউ প্রবহমান তা একটি বৈশিষ্ট্য হয়ত অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। সেটি হল আক্রান্তের সংখ‍্যা মফস্বল ও প্রত‍্যন্ত গ্রামের দিকে অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারন হল দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তারকালে বিধানসভার নির্বাচন। হ‍্যাঁ, ঠিক তাই। আর এরজন‍্য নিঃসন্দেহে বড় এবং স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলি দায়ী। তবে, সবচেয়ে বেশী দায় আমাদের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের। কোভিডবিধি না মানলে এই রোগের সংক্রমণ আটকানো অসম্ভব। হ‍্যাঁ, যে রাজ‍্যে নির্বাচন হয়নি, তেমন রাজ‍্য যেমন, মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ বেশী হয়েছে। কিন্তু তার কারন ভিন্ন। যদি তামিলনাড়ুর দিকে তাকানো যায়, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণ বেড়েছে অসমেও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত আট দফায় তাদের নির্বাচন হয়নি। তামিলনাড়ুতে এক দফা এবং অসমে তিন দফায় নির্বাচন হয়েছে। সেখানে এত হাই ভোল্টেজ প্রচারও হয়নি। মিটিং, মিছিল, জনসমাবেশ - মানুষের ভিড়ে সারা রাজ‍্য জুড়ে কোভিডবিধি শিকেয় উঠেছে। কোন রাজনৈতিক নেতাই এই বিধি মেনে প্রচার করেননি, আর সাধারণ মানুষকেও মেনে চলতে বলেননি। নেতাদের মধ‍্যে আক্রান্তরা ভিআইপি চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে যান সাধারণ মানুষ আম আদমী ঠাকুরের দয়ায় বাঁচে বা ছবি হয়ে যায়। কত মানুষ অক্সিজেন না পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে; কোন ভিআইপি রাজনীতিক অক্সিজেনের অভাবে দেহ রেখেছেন - এমন কোন অভিযোগ নেই। এখানেই ছিল নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। তাদের নির্বাচন সংঘটনের সর্বময় ক্ষমতা থাকায় তারা কোভিডবিধি মেনে নির্বাচন করার সমস্ত রকম ব‍্যবস্থা যাতে মেনে চলা হয় তা দেখতে পারত।
             আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনের জন‍্যই যে কোভিড আক্রান্তের সংখ‍্যার এমন বৃদ্ধি তার প্রমাণ কি? উত্তর হল, কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় যেসব গ্রাম-গঞ্জ, মফস্বল শহর তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি, সেখানেও নির্বাচনের মিটিং মিছিল, সমাবেশের পর আক্রান্তের সংখ‍্যা ধীরে ধীরে অনেক বেড়েছে। গত শীতের সময় নিউ নর্মালে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের মানুষজনের মনে ধারনা হয়েছিল যে কোভিড বিদায় নিয়েছে। তারপর, নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মিটিং মিছিল, কেন্দ্র ও রাজ‍্যস্তরের ভিভিআইপি নেতা নেত্রীদের হাই ভোল্টেজ সমাবেশ, পদযাত্রা - সবই মানুষ দেখল। এখন সেখানে স্থানীয় হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে কোলকাতায় আনতে হচ্ছে। অনেককে চিরতরে বিদায় দিতে হয়েছে। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, মালদা - যেসব জায়গায় এই ধরনের মিটিং মিছিল, জমায়েত হয়েছে, তার অধিকাংশ জায়গাতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ বহুগুণ বেড়েছে। সরকারের স্বাস্থ‍্য দপ্তর নিউ নর্ম‍্যালে ঘোষণা করেছিল যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা করোনামুক্ত জেলা।তারপর ভোটের জাঁতাকলে পড়ে সেখানেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে শুধু আক্রান্তই নয়, মৃত্যু ও নিত‍্যনৈমিত্তিক ব‍্যপারে দাঁড়িয়েছে। জেলাগুলির মধ‍্যে প্রথম থেকেই খারাপ অবস্থা ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার। এই ভোটপর্বের পর সেই জেলা প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃতের সংখ‍্যার শীর্ষে থাকছে। যদিও তারপরেই স্থান কোলকাতার, এখানে কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ যখন মিটিং মিছিল, জমায়েত সব কিছুই বাড়তে শুরু করেছে, তখনই আক্রান্তের সংখ‍্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। অন‍্যান‍্য এলাকাও পিছিয়ে নেই। সুতরাং এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের অতিবৃদ্ধির একটি বড় কারন যে নির্বাচনী প্রচারের সময় কোভিডবিধি না মানা - সে সন্দেহ অমূলক নয়।
       এখানে একটি তথ‍্য দিলে এই যুক্তির সপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যাবে। প্রথম ঢেউয়ের সময় রাজ‍্যের গ্রাম-গঞ্জ ও প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের সংখ‍্যা ছিল খুবই কম - মোট আক্রান্তের ৫-৭ শতাংশ মাত্র। কিন্তু ভোটের পর এই সংখ‍্যাটা পৌঁছে গেছে ২৩ শতাংশে! একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে এইসব প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে ভোটের যে জমায়েত, মিটিং মিছিল হয়েছে তাতে কোভিডবিধি পালনের লেশমাত্র ছিলনা। আবার, এইসব দূরবর্তী অঞ্চলে চিকিৎসা পরিষেবার মান অত‍্যন্ত খারাপ থাকায় আক্রান্তদের একটি বড় অংশ কার্যকরী চিকিৎসা পাচ্ছেনা। এমন অনেকের মৃত্যু হচ্ছে, যারা হয়ত ঠিক চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেত।
          এদিকে যত সময় যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে ভাইরাস তার আক্রমণের গতির পরিবর্তন করছে। এটি কোভিডের মত RNA ভাইরাসের পক্ষে স্বাভাবিক। এই সময় দেশের বিপুল সংখ‍্যক নাগরিককে যত দ্রুত সম্ভব, টীকাকরন করে সম্ভাব‍্য সুরক্ষা দেওয়া আশু কর্তব‍্য ছিল। মনে রাখতে হবে, এটি WHO দ্বারা ঘোষিত "অতিমারী"। আর আক্রান্তের নিরিখে ভারত আছে দ্বিতীয় স্থানে। আমেরিকা প্রথম স্থানে। তাদের ১৬% নাগরিকদের টীকাকরন সম্পূর্ণ হয়েছে। ভারতের ১% নাগরিকের সম্পূর্ণ টীকাকরন পর্যন্ত এখনো হয়নি। এই অবস্থায় আমরা নির্বাচনের পিছনে অযথা অনেকটা সময় ও অর্থ ব‍্যায় করে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইকেই ঘোরালো করে তুললাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, একবার নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে তা স্থগিত করা যায়কি? এছাড়া এই সংক্রান্ত আরো যেসব প্রশ্ন থাকবে তার সবেরই উত্তর আমাদের সংবিধানে বলা আছে।
          প্রথমেই বলি, ভোট যদি অতিমারীর মত অভুতপূর্ব বা অশ্রুতপূর্ব পরিস্থিতিতে করানো সম্ভব না হয় ( জনসাধারণের স্বাস্থ‍্য ও জীবনের সুরক্ষা মাথায় রেখে ) তাহলে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সময় হয়ে গেলেও, নির্বাচন স্থগিত রাখতে পারেন। এমনকি নির্বাচনের পর্যায় শুরু হলেও পরবর্তী পর্যায়গুলি স্থগিত করা যায়। অতীতে এর উদাহরণ আছে। কোন নির্বাচিত সরকার তার সময়কাল অতিবাহিত করার পর রাজ‍্যের শাসনভার কি পুরানো সরকারের হাতে থাকবে না অন‍্য কারো হাতে? এ সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান আছে। তাহল, রাজ‍্যপাল ঠিক করবেন, তাঁর সরকার আইনি পরিকাঠামোর মধ‍্যে কিভাবে পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পুরানো উদাহরণ আছে। তা উল্লেখ করলে হয়ত গত নির্বাচনে সাইনবোর্ডে পর্যবসিত হওয়া দুটি সহযোগী দলের বিড়ম্বনা বাড়বে। তাই সে চেষ্টায় বিরত থাকলাম। কাজেই নির্বাচন নির্দিষ্ট সময় করতেই হবে বা নির্বাচন চলাকালীন তা স্থগিত করা যাবেনা এমন কোন আইনি বা সংবিধানগত বাধা নেই। তবে, নির্বাচন কমিশন কোন রাজনৈতিক চাপে কাজ করে থাকলে তা একমাত্র কমিশনই বলতে পারবে। এব‍্যপারে আমাদের ধারনার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং এই অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা বৃদ্ধির দায় নিশ্চিতভাবেই যেসব প্রতিষ্ঠানের উপর পরবে তার অন‍্যতম নির্বাচন কমিশন।
         আবার কেমন অদ্ভুত ব‍্যপার - নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে ভোট প্রচারে কোভিডবিধি মেনে চলতে হবে। শুধু বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শেষ হয়না। সেই বিজ্ঞপ্তি যথাযথ পালিত হল কিনা, না হলে কমিশন কি কি পদক্ষেপ করল - সবই তার দায়িত্বের মধ‍্যে পড়ে। আমার ত একটি ঘটনাও মনে পড়েনা যেখানে নির্বাচন কমিশন কোভিডবিধি না মানার দায়ে প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন! যখন ভোটপর্ব শুরু হল,ভোট কেন্দদের লাইনে আমার অন্ততঃ দু গজের দুরত্বে ভোটারদের লাইন দেওয়ার ব‍্যপারটা চোখে পড়েনি। হ‍্যাঁ, দুরত্ব ছিল, ছয় থেকে আট ইঞ্চি! প্রমাণ হিসাবে ঐ সময়ের টিভি ফুটেজগুলি দেখলেই হবে। আবার দেখুন, নির্বাচন কমিশন অশীতিপর ভোটারদের জন‍্য নিজের বাড়িতে বসে ভোটদানের বড‍্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ঐসঙ্গে তাঁদের বাড়িতে টীকাকরন প্রক্রিয়াটি ও করানো উচিৎ ছিল - যেমন ভোটকর্মীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব‍্যবস্থায় টীকাকরন করা হয়েছে। এছাড়া ভোটকক্ষের মধ‍্যে হাতে কালি লাগানোর সময় বডি কন্ট‍্যাক্ট অবশ‍্যম্ভাবী। ভোটের মেশিনে আঙুলের চাপ দেওয়া, ভোটার লিষ্টে সই করা বা টিপছাপ দেওয়া - কোনটাই দৈহিক কন্ট‍্যাক্ট ছাড়া হয়নি। এমন প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায় যেখান থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং ভোট প্রক্রিয়ায় কোভিড সংক্রমণের কারনগুলি অবশ‍্যই আছে।আর এই আট দফায় ভোট হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গও সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
      ভোট প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ায় শুধু যে কোভিডের দ্বিতীয় সংক্রমণ গতি পেয়েছে তাই নয়, আমাদের ভাবার সময় এসেছে এই প্রক্রিয়া কি আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লড়াই নাকি 'গণতন্ত্র' নামের এক অচলায়তনের রাজনৈতিক উৎসবের বিয়োগান্তক সফল রূপায়ণ, যার লাভ রাজনীতি ও রাজনৈতিকদের, ক্ষতি অতিমারীর বৃদ্ধিতে সমাজের। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির একটি মূল স্তম্ভ নির্বাচন কমিশন। সেই স্তম্ভই যদি রাজনীতির স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়, তাহলে গণতন্ত্রের অবক্ষয় আটকাবে কে! এখানে জর্জ অরওয়েলের অ‍্যনিম‍্যাল ফার্মের একটি লাইন খুব মনে পড়ছে, "In democracy, all are equal; but some are more equal than other equals"। এই নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তাদের জীবন, জীবিকার বিনিময়ে প্রমাণ করে দিল সমাজবদ্ধ গণতান্ত্রিক মানুষ বেঁচে আছে রাজনীতির জন‍্য, রাজনীতির স্বার্থে, রাজনীতির কাছে বলিপ্রদত্ত হিসাবে।

পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ এর নির্বাচনে বিজেপির হার কেন

সদ‍্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে শ্রীমতি মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সফলতম জয় হাসিল করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সফলতম ব‍্যক্তি, যিনি বাঙ্গালী অস্মিতাকে শুধু যে তুলে ধরেছেন তাই নয়, একই সঙ্গে অত‍্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে তিনি বাঙ্গলার উপর অবাঙ্গালী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধীতা করে বাঙ্গালীর প্রতিবাদী চরিত্রকে উস্কে দিয়েছেন। তাঁর প্রচার অভিযানের কয়েকটি নির্দিষ্ট অভিমুখ ছিল। প্রথমতঃ অন‍্যান‍্য রাজ‍্যে সম্ভব হলেও পশ্চিমবঙ্গে মূখ‍্যমন্ত্রীর মূুখ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল সাফল‍্য পায়নি। সেক্ষেত্রে মমতাদেবী একমাত্র মূখ‍্যমন্ত্রীর মুখ। প্রধান দলগুলির মধ‍্যে লড়াইয়ের ময়দানে থাকা একমাত্র দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে মূখ‍্যমন্ত্রীর মুখ ঘোষণা না করে রাজনৈতিকভাবে ভুল করেছে। হয়ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এমন কোন মুখকে মূখ‍্যমন্ত্রী করার বাসনা ছিল, যা আগে ঘোষণা করে দিলে তাঁদের অসুবিধা হত। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা করতে গিয়ে বিজেপি ব‍্যকফুটে চলে গিয়েছিল।
তৃণমূল বোদ্ধা, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের সুকৌশলে কাজে লাগালেও রাজ‍্য বিজেপি আর এস এস ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও অধ‍্যাপক সংঘকে কাজে লাগাতে উৎসাহী ছিল না। মনে হয়, বিজেপি নেতৃত্ব তাঁদের জয়ের ব‍্যপারে এতটাই আত্মতৃপ্ত ছিল যে তাঁরা এই ধরনের প্রচারে কোন আস্থা রাখেনি। বিজেপি তৃণমূলস্তরের রাজনীতিটা বুঝতেই পারেনি। তাঁদের অনেক নেতাই ধমক, চমক, কুকথার রাজনীতির মধ‍্যে দিয়ে নিজেদের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন আর সেইসঙ্গে মানুষের বিরক্তির কারণ হয়েছেন। বিজেপি সর্বভারতীয় দল হওয়ায় তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারে রাজ‍্যে আসবেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের মাত্রাতিরিক্ত প্রচারে উপস্থিতি মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। রাজ‍্য নেতৃত্ব ভেবেছিল, প্রচারের ঔজ্বল‍্য, চাকচিক‍্য, মানুষের ভিড় – তাদের ভোটবাক্সে জিতিয়ে দেবে! এটা তাদের অনভিজ্ঞতার ফল। একটি ঘটনার কথা বলি। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কোলকাতায় এলেন তাঁর দলের প্রার্থীর সমর্থনে জনসভা করতে। মিটিংয়ে জনজোয়ার। তখন মমতাদেবীও কংগ্রেসে। সেইদিন রাতে এক সিপিএম নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, “আমরা অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার ভোটে জিতবো”! আমি বললাম, “আপনি জনসভার ভিড় দেখেছেন”? ত তিনি বলেছিলেন, “ভাই, লোকে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে গেছে, উজ্বল প্রচার দেখতে গেছে, কিন্তু ভোটটা আমাদেরই দেবে”। নির্বাচনের ফল বেরনোর পর ঐ নেতার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছিল। বাঙ্গলার ভোটের যে একটা নিজস্ব ধারা ও সমীকরণ আছে তা এই বিজেপি নেতৃত্বের অজানা। আর এই চাল মমতাদেবীর নখদর্পনে।
আগে বিজেপি নেতৃত্বের ভুল প্রার্থী চয়ন ও দলবদলুদের অতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়ার কথা বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে। কিন্তু এই নির্বাচনের একটা বড় দিক, যা শ্রীমতি ব‍্যানার্জী খুব সূহ্মভাবে ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা বিজেপি খন্ডন করার কোন চেষ্টা করেনি। সেটা হল, ‘বহিরাগত তত্ত্ব’। এটা অত‍্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তৃণমূল নেতারা প্রচারে রাখলেও বিজেপি নেতারা ধরতেই পারেনি যে অভিযোগটি কোন পর্যায়ের।
মমতা ব‍্যানার্জীর গত দশ বছরের শাসনে মানুষ যে স্বস্থিতে নেই, তা প্রচার করে জনমত সংঘটিত করা হল না, আবার “সোনার বাঙ্গলা” যে একজন স্বপ্নের ফেরীওয়ালার স্বপ্ন ফেরীর গল্প, তা বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রতিভাত হল। কিভাবে? অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলি আমমধ‍্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের চরম অসুবিধায় ফেলেছে। আমাদের দেশে সিনিয়ার সিটিজেনদের অধিকাংশই ব‍্যঙ্কের সুদের উপর নির্ভরশীল। সুদ কমছে। নিত‍্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম ঊর্ধমুখী। ইওরোপ, আমেরিকার মত ‘সোশ‍্যাল সিকিউরিটি’ আমাদের দেশে নেই তা বোধহয় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী জানতেন না! আবার দেশ থেকে যে কজন ব‍্যবসায়ী ব‍্যঙ্কের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের একটা লিষ্ট সোশ‍্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। সেখানে ত্রিশজনের নাম দেখা যাচ্ছে। যা মধ‍্যে উনত্রিশজনই গুজরাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং রাজ‍্যসরকারের বিভিন্ন কেলেঙ্কারী, কাটমানির অভিযোগ ইত‍্যাদি ধামাচাপা দিয়ে তোলা হল বহিরাগত তত্ত্ব। অর্থাৎ বাইরের রাজ‍্য থেকে লোকেরা বাঙ্গলা লুঠ করতে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত ভ্রান্ত নীতিগুলিকে মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল। রাজ‍্যের সংবাদমাধ্যমগুলো এই প্রচারকে গুরুত্ব দিল। বিজেপির মিডিয়া সেল নাকি স্বঘোষিত “জাতীয়তাবাদী” বিজেপি সমর্থক জপসাধারনের মন বোঝার চেষ্টা না করে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষতঃ মোদী ভজনায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে আরো বিরক্তির কারন হল। অন‍্যদিকে বিজেপির ট্র‍্যাডিশানাল সমর্থক, অবাঙ্গালী ও একটি বড় অংশের হিন্দু বাঙ্গালী ব‍্যবসায়ীরা চাপের মধ‍্যে পড়ে গেলেন। এইভাবে বাঙ্গালী অস্মিতায় সূক্ষ ধোঁয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “বাংলা তার মেয়েকেই চায়” হোর্ডিং যথেষ্ট মনোগ্রাহী হল। তৃণমূল একের পর এক তাদের বক্তব‍্য বলে গেছে। বিজেপির নেতৃত্ব তাদের ব‍্যঙ্গ, বিদ‍্যুপ করেই কালহরণ করেছে! তৃণমূল নেত্রী অত‍্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অন‍্য দলের, যেমন বামপন্থীদের, মিডিয়া সেলের প্রচারকে নিজের দিকে টেনে নিলেন। বামপন্থী নেতৃত্বের চিন্তার স্থবিরতা ব‍্যপারটাকে বুঝতেই দিল না। প্রথমতঃ, যে ‘বহিরাগত’ তথ‍্য মমতাদেবী দিলেন, তাতে ধুনো দিল নেট দুনিয়ায় বামপন্থীদের প্রচার। এর মধ‍্যে দেশের ব‍্যঙ্কগুলির টাকা মেরে পালিয়ে যাওয়া ব‍্যবসায়ীদের তালিকা অগ্রগণ‍্য। মমতাদেবী বামপন্থীদের প্রচারকে নিজের ভোটবাক্সের স্বার্থে ব‍্যবহার করেছেন আর বিজেপি এ বিষয়ে কোন কথা না বল মৌণং সম্মতি লক্ষণম্ বোঝাতে চেয়েছে! যেহেতু বামপন্থীদের ভোট দিয়ে বিজেপি বিরোধী শক্তি ভোট নষ্ট করতে চায়নি, সেহেতু আসন প্রাপ্তির নিরিখে বামপন্থীরা সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে।
আরেকটি ব‍্যপার লক্ষণীয়। এবারের ভোটের মেরুকরন তৃণমূল ও বিজেপির মধ‍্যে হলেও যেমন মুসলিম ভোট শুধু তৃণমূলে গেছে, তেমনি হিন্দু ভোট তাদের দিকে টানতে বিজেপি ব‍্যর্থ‍। মমতা ব‍্যনার্জীকে অনুদানের রাজনীতি করার জন‍্য বিজেপি নেতৃত্ব দোষারোপ করেছে। কিন্তু শ্রীমতি ব‍্যনার্জী এভাবে অনুদানের রাজনীতি করে নিজে বাহবা নিলেন। আর একই পথের পথিক বিজেপির কিশান বিকাশ যোজনা, অটল পেনশান যোজনা, উজ্জ্বলা যোজনা ইত‍্যাদি প্রকল্পগুলি কি অনুদান নয়? আমার একটা পাঞ্জাবী কথা মনে পড়ল: মেরা কুত্তা কুত্তা, অর তুয়ারা কুত্তা টমি! দেশের মানুষকে নূন‍্যতম ভাত, কাপর আর বাসস্থানের সংস্থান যোগানো সরকারের প্রাথমিক কাজ। সেই কাজে অবহেলা করে প্রান্তিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থনীতিকে বিপথগামী করার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তায়। ভোটে তার ফল বিজেপিকে ভুগতে হয়েছে। ব‍্যঙ্কের টাকা আত্মস্বাৎ করে পালিয়ে যাওয়া নেতাদের সম্পর্কে বিজেপির নেতাদের মৌণীবাবা সাজাটা জনমানসে অভিযোগের সত‍্যতাকে ঘণীভূত করেছে।
কোটা সিস্টেমে বিজেপির এম পিদের কোটায় যেসব প্রার্থী দাঁড়িয়েছে তাদের অধিকাংশই পরাজিত। এতে মন্ডল বা শুধু জেলা সভাপতিদের দোষারোপ করা মনে হয়, ভাবের ঘরে চুরি করা। কারন এই এম পিদের জনসংযোগের হাল কি তা বোঝাই গেল। এই জায়গায় তৃণমূল সুপ্রিমোর দল অনেক বেশী দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে। কোথাও প্রার্থী দাঁড় করানোর জন‍্য শুধু যে আইপ‍্যাকের পেশাদারী পরামর্শ নিয়েছে তাই নয়, স্থানীয় নেতৃত্বের উপর দায়িত্ব দিয়েছে প্রার্থীকে জিতিয়ে আনবার। ফলে দলীয় অসন্তোষ, অন্তর্ঘাতের সম্বাবনা অনেক কমে গিয়েছিল। পক্ষান্তরে, বিজেপি বুথ স্তরের সংগঠনও অধিকাংশ জায়গায় তৈরী হয়নি। কারন সাধারণ কর্মীদের কনফিডেন্সে নেওয়া হয়নি। উপর থেকে আদেশ এসেছে মাত্র। কোলকাতার উপকন্ঠে একটি কেন্দ্রে কর্মরত এক কর্মী মন্তব‍্য করেন, খেতে দেওয়ার নাম নেই, কিল মারার গোঁসাই। ওই কেন্দ্রের সাধারণ মানুষ জানতেন যে বিজেপি প্রার্থী হারছেন; যদিও প্রর্থী নিজে বলেছিলেন, তিনি নাকি ওয়াকওভার পাচ্ছেন! এই এদের জনসমর্থনের ভিত্তি!
এরপর যেকথায় আসতে যাচ্ছি তার গুরুত্ব শুধু বাঙ্গলা বা ভারতের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর প্রভাব পরতে বাধ‍্য। এই মূহুর্তে আমাদের দেশে মুসলমান ও হিন্দু শিশুর জন্মের গড় হল, কুড়ি লক্ষ মুসলমান শিশুর সঙ্গে দশ লক্ষ হিন্দু শিশু প্রতি বছর (প্রতিটি মুসলমান নাগরিকের গড়ে দুজন স্ত্রী ধরে নিয়ে TFR থেকে গণনা করা হয়েছে) জন্মগ্রহণ করছে। ভারতবর্ষের মুসলমান জনসংখ্যা দশ বারোটি রাজ‍্যে ঘণীভূত হয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ‍্য। এখানে আবার প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র থেকে শুধু জেহাদী অনুন্রবেশই নয়, অধিক সংখ‍্যায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরাও ছড়িয়ে পরেছে। বেআইনিভাবে তারা কিছু সময় বাদে অন‍্য অনুপ্রবেশকারীদের মত ভোটার কার্ড করিয়ে নিয়ে ভারতের নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবেই। এদের জঙ্গী ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন‍্য কোন রাষ্ট্র, এমনকি কোন মুসলিম রাষ্ট্র পর্য‍‍্যন্ত আশ্রয় দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় এই রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল তথাকথিত মানবিক কারনে নরম ব‍্যবহার করায় বৃহত্তর মুসলিম সমাজের থেকে ভোটবাক্সে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া সাংঘাতিক। কি ভাবে? প্রথমতঃ, এই মুহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ‍্যার এক তৃতীয়াংশ মুসলমান আর বাকী প্রায় সবাই হিন্দু। মুসলমান শিশুদের বৃদ্ধির হার যদি হিন্দু শিশুদের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এই রাজ‍্যে আর কয়েক বছের মধ‍্যেই হিন্দু জনসংখ‍্যার তুলনায় মুসলমান জনসংখ্যা বেশী হয়ে যাবে। আর তখনই আসল সংঘাত শুরু হবে। কারন পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মুসলিম সংখ‍্যাগুরু রাষ্ট্র, কিন্তু সেখানে অন‍্য ধর্মাচরনের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। এতে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের অসুবিধার জায়গাটা হল – তখন এই রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রাখার তাগিদে উচ্চতম থেকে নিম্নতম সব পদই মুসলিম প্রার্থীদের দ্বারা পূর্ণ করা হবে। ভারতের একটি অঙ্গরাজ‍্যে এ ধরনের অবস্থায় আরেকটি কাশ্মীরের জন্ম হবে। যেভাবে কাশ্মীরে ন‍্যাশনাল কন্ফারেন্সের শাসনের অবসান হয়েছে, সেভাবে এখানে তৃণমূল শাসনেরও অবসান হবে। মমতা ব‍্যানার্জী কিন্তু ভারতের সংবিধান মেনে চলা নির্বাচিত নেত্রী। তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবন তখন বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়তে বাধ‍্য। এই মূহুর্তে মনে হয় এই ইসলামীকরনের চোরা কারেন্টের বিরুদ্ধে শ্রীমতি ব‍্যানার্জীকে তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে মোকাবিলা করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ভোটে এই ইসলামিক মেরুকরণের জন‍্য সবচেয়ে বেশী দায়ী বিজেপির প্রচার। তাঁদের CAA ও NRC নিয়ে আত্মম্ভরী অপপ্রচার রাজ‍্যের মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের মনে অমুলক ভয় ধরিয়ে দিল, এতে ভারতীয় বংশদ্ভুত মুসলমান এমনকি ছিন্নমূল হিন্দুদেরও ঘাড় ধরে কন্সেনট্রেশান ক‍্যাম্প হয়ে অন‍্য দেশে ‘পুশ ব‍্যাক’ করা হবে। এতে ইন্ধন দিল সোশ‍্যাল মিডিয়ায় লাফালাফি করা কিছু স্বঘোষিত বিজেপি সমর্থক এবং সুচারুরূপে কম‍ু‍্যনিষ্ট অপপ্রচার।
যদি ইসলামিক মেরুকরণের ফলে পশ্চিমবঙ্গে শরীয়তি শাসন প্রতিষ্ঠা হয়, তাহলে শুধু হিন্দুরাই নয়, শিক্ষিত, মার্জিত, ভারতীয় মুসলমানদের কাছেও তা সমূহ বিপদের কারন; বিশেষভাবে বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে। উদাহরণ – সিরিয়া, লেবানন, আফগানিস্তান। জঙ্গী জেহাদের আগুন অন‍্যের সঙ্গে নিজের ঘরও পোড়ায়। অতয়েব, সাধু সাবধান।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্যব‍্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সারা দেশের সঙ্গে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও আছড়ে পরেছে। তার প্রভাবে এই মূহুর্তে রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্য পরিষেবা সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়েছে। কারনগুলি খতিয়ে দেখে প্রতিকারের বিধান দেওয়ার চেষ্টায় এই প্রতিবেদন।
২০২০ সালের প্রথম করোনার ঢেউয়ের সময় থেকে এখনকার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কিছু মৌলিক পার্থক‍্য আছে। প্রথমত, এই দ্বিতীয় ঢেউ অনেক অল্প সময়ে বিপুল সংখ‍্যক মানুষকে সংক্রমিত করেছে – অর্থাৎ এর সংক্রমণ ক্ষমতা প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় অনেক বেশী। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাসটি অতি দ্রুত ফুসফুস ও কিডনীকে নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এর চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হল রেমডিসিভির। পাঁচদিনের কোর্সে ওষুধটি IV পুশ করতে হয়। প্রথম দিকে প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রিতার কারনেএর যোগান রাজ‍্যের সরকারী হাসপাতালগুলিতে খুব কম ছিল। সেজন‍্য করোনা রোগীর চিকিৎসায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই আমাদের রাজ‍্য পিছিয়ে পরে। এর দায় রাজ‍্য প্রশাসনের, সঠিকভাবে স্বাস্থ‍্যদপ্তর, বিশেষতঃ স্বাস্থ‍্যভবনের। এরপর আসি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবায়। এই রাজ‍্যে রোগীর আত্মীয় পরিজনেরা অনেক সময়ই অত‍্যন্ত মারমুখী এবং তারা যখন ডাক্তার ও অন‍্যান‍্য স্বাস্থ‍্যকর্মীদের উপর চড়াও হয়ে মারধোর করে সেসব এত বছরেও রাজ‍্য সরকার এবং তার পুলিশ বন্ধ করতে ব‍্যর্থ। ফলে, হাসপাতালের চিকিৎসায় work-to-rule এর উপরে যে মানবিক দিক থাকে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। তবুও বলতে দ্বিধা নেই, ডাক্তার, সিস্টার ও স্বাস্থ‍্যকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজ‍্য সরকার রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্য পরিকাঠামোর মূল সমস‍্যাগুলি সমাধানে ব‍্যর্থ হওয়ায় আজ যখন স্বাস্থ‍্যব‍্যবস্থার উপর করোনা রোগীর অতিরিক্ত চাপ এসে পরেছে, তখন তারা দিশেহারা হয়ে গেছে। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরন অক্সিজেনের ঘাটতি। তাহলে আমাদের রাজ‍্যসহ কোন রাজ‍্যেই অক্সিজেনের ঘাটতি থাকার কথা নয়। সারা দেশে অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা দিন প্রতি সর্বোচ্চ ৭৫০০ মেট্রিক টন। এর মধ‍্যে করোনা পরিস্থিতিতে মেডিকেল অক্সিজেনের গড় চাহিদা দিনপ্রতি ৫৫০০ মেট্রিক টন। সুতরাং বাণিজ্যিক কাজে অক্সিজেনের ব‍্যবহার সাময়িক বন্ধ করে অক্সিজেনের যথাযথ বন্টন ব‍্যবস্থা চালু রাখলে অক্সিজেনের অভাব হওয়ার কথা নয়। আসলে সমস‍্যা অন‍্য জায়গায়। সেটা হল অক্সিজেন বহনকারী সিলিন্ডারের ঘাটতি। সাধারণত দরকারের থেকে ১৫-২০% অব্দি বেশী সিলিন্ডার মজুত রাখা হয়। সেজন‍্য চাহিদা হটাৎ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় এই ঘাটতি। সুযোগ বুঝে একশ্রেণীর অসাধু ব‍্যবসায়ী অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারী শুরু করেছে; কেউবা বাণিজ্যিক কাজে (ওয়েল্ডিং সহ ) এই অক্সিজেন ব‍্যবহার করছে। এর জন‍্যই অক্সিজেনের ঘাটতি। এগুলো রাজ‍্য সরকারের দেখার কথা। তারা এই কাজে এখনো অব্দি ব‍্যর্থ। আবার একই সাপ্লাইয়ের অক্সিজেন ফ্লো-রেগুলেটারের সাহায‍্যে কয়েকজন রোগীকে দেওয়া যায়। অবশ‍্য এই ব‍্যবস্থা সাময়িক আর এতে অক্সিজেনের ব‍্যবহার কম হয় না। কিন্তু সাময়িক অক্সিজেন ঘাটতির সময় রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন‍্য এই ব‍্যবস্থা জরুরী। খবরে দেখলাম, ফ্লো-রেগুলেটার খারাপ থাকায় এক সরকারী হাসপাতালে দুজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অবশ‍্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন‍্য কথা বলেছেন। আমরা প্রতিদিন সংবাদ মাধ‍্যম মারফৎ জানতে পারছি দিল্লী, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় অক্সিজেনের অভাবে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন। করোনার প্রথম আক্রমণের সময় যেমন রাজ‍্য প্রশাসন মৃত ও আক্রান্তের হিসেবের গোলমালে জড়িয়ে গিয়েছিল, এবারেও আবার দেখছি অক্সিজেনের অভাবে নাকি মানুষ এই রাজ‍্যে মারা যাননি। অথচ রাজ‍্যবাসীর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এই অতিমারীর মোকাবিলায় আমাদের রসদ পর্যাপ্ত নয় – সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তরিক চেষ্টা ও সততা নাথাকলে তা অপরাধ।
আমাদের স্বাস্থ‍্যদপ্তর শুধু যে অক্সিজেনের কালোবাজারী রুখতে ব‍্যস্ত তাই নয়, ওষুধের কালোবাজারীও দেদার চলছে। হার্টের সমস‍্যায় কিছু রোগীকে atrial fibrillation আটকানোর জন‍্য একটি ওষুধ rivaroxaban। এটির ১৪ ট‍্যবলেটের পাতার এমআরপিতে দাম ১২০ টাকা। ওষুধটি অনেক জায়গায় করোনা রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাজারে এই ওষুধটি আর পাওয়া যাচ্ছেনা। বহুগুণ বেশী দাম দিলে পরিচিত দোকানে মিলছে!
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা জানাচ্ছি – যদিও এমন ঘটনা আমাদের রাজ‍্যে আকছার ঘটছে। সোদপুরের সুভায়নী হাসপাতালে একজন করোনার রোগী মারা গেলেন। নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের ঐ রোগীর জন‍্য হাসপাতালে একলক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব‍্য, পুরো বিলের তিনলক্ষ আঠারো হাজার টাকা না দিলে মৃতদেহ ছাড়া হবে না! এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্য‍্যন্ত (ত্রিশ ঘন্টা) মৃতদেহ আটকে রাখা হয়েছে। প্রশাসন কি করছে? সরকার এ ব‍্যপারে শুধু ‘অ‍্যডভাইসারি’ জারি করছ! অ‍্যডভাইসারি প্রাইভেট স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রগুলি শুনলেও মানতে আইনত বাধ‍্য নয়। সরকার ‘বিজ্ঞপ্তি’ জারি করলে তারা সেটা মানতে বাধ‍্য। এই দ্বিচারিতা কিন্তু গোপন আঁতাতের সন্দেহ তৈরী করে।
যখন সাধারণ মানুষজন সবাই জানেন যে প্রথম ঢেউয়ের পর করোনার মত RNA ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসা সময়ের অপেক্ষা মাত্র, তখন সরকারের তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারকে কি পরামর্শ দিয়েছিল? আমরা দেখলাম, প্রথম ঢেউয়ের প্রকোপ কমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে সরকারী, বেসরকারী হাসপাতালগুলিতে করোনা রোগীদের জন‍্য নির্দিষ্ট বেড এবং সর্বোপরি পরিকাঠামো বন্ধ করেদেওয়া হতে লাগল। অথচ এই সময় দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন‍্য তৈরী হলে – পরিকাঠামোর আরো উন্নতি করলে, এই বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো যেত। এর সঙ্গে উৎসবের মরসুমে সংযম দেখানো মানুষদের কাছে বিনোদনের সকল উপকরণ, সিনেমা হল, রেষ্টুরেন্টে, শপিং মল, ক্লাব, সুইমিংপুল, চিড়িয়াখানা এমনকি পর্যটন ও হোটেলগুলিও দেশের অর্থনীতির দোহাই দিয়ে খুলে দেওয়া হল! এগুলো রাজ‍্য সরকার অত‍্যন্ত ভুল কাজ করেছে যার খেসারত এখন জনসাধারণকে দিতে হচ্ছে। একজন পরামর্শদাতাও কিন্তু পরিকাঠামো আরো মজবুত করার কথা বললেন না। এরপর ট্রেন, মেট্টো, বাস, অটো সমেত সমস্ত গণপরিবহণের উপর থেকে সব রকমের বাধানিষেধ তুলে নেওয়া হল! হ‍্যাঁ, ইতিমধ্যে সাধারণ নির্বাচনে রাজনীতির মিটিং, মিছিল, জমায়েত দ্বিতীয় ঢেউয়ের দ্রুত ছড়িয়ে পরতে সাহায্য করল। এখন রাজ‍্যে দৈনিক সংক্রমণের সংখ‍্যা বিশ হাজারের উপর। দৈনিক মৃত্যু তিনশো থেকে সাড়েতিনশোর মধ‍্যে। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গে করোনা পরীক্ষার হার অন‍্য রাজ‍্যের তুলনায় কম।
এমনকি করোনা রোগীর মৃত্যুর পরেও শান্তি নেই। সরকার সৎকারের নিয়ম আর মূল‍্য বেঁধে দিয়েছে! কিন্তু এখানে এসব খাতায় লেখা থাকে। মানুষের অভিজ্ঞতা অত‍্যন্ত খারাপ। একভদ্রমহিলা টিভিতে জানিয়ে ছিলেন তাঁর আত্মীয়ের সৎকার করার জন‍্য তাঁকে কিভাবে খেপে খেপে ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এম্বুল‍্যান্স থেকে, শববাহী গাড়ি থেকে, ডোম অব্দি, সব জায়গায় মানুষ তোলাবাজির শিকার। মর্গ থেকে দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য দশ থেকে পঁচিশ হাজার, যে কোন রকম টাকা চাওয়া হচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন‍্য দায়ী করোনা ভাইরাসের পরিবর্তিত জিন মিউটেশান – এটি সব RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য যার ফলে ভাইরাসের চরিত্রগত কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এখন যে কথাটা প্রায়শঃই শোনা যায় – ডাবল মিউট‍্যান্ট, ট্রিপল মিউট‍্যান্ট ভ‍্যরিয়েন্ট ইত‍্যাদি। আমাদের দেশে এখনো অব্দি নয় রকমের মিউটেট করা করোনা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। ভাইরাসের ধর্ম বোঝা যায় তার জিনোম সিকোয়েন্সিং অনুধাবন করলে। এই জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে একবার পরিবর্তন হলে তা সিঙ্গল মিউট‍্যান্ট, দুবার হলে ডাবল মিউট‍্যান্ট, তিনবার হলে ট্রিপল মিউট‍্যান্ট ইত‍্যাদি। এইভাবে পরিবারের যে আলাদা রকমের ভাইরাস তৈরী হয়, তাদের ভ‍্যরিয়েন্ট বলে। আর এই ভ‍্যরিয়েন্টগুলি যখন তাদের ধর্মের পরিভর্তন ঘটিয়ে সংক্রমণ ক্ষমতা, মিউটেশান ক্ষমতা, সণাক্তকরণ ক্ষমতা (যার উপর ভ‍্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে) ইত‍্যাদির পরিবতন করে তখন তাদের বলে আলাদা স্ট্রেইন। আমাদের দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সবচেয়ে বেশী সংক্রমণ পাওয়া গেছে দুটি স্ট্রেইনের – ব্রিটেন স্ট্রেইন (B.1.1.7), এছাড়া E484Q এবং L424R এই দুটি ভ‍্যরিয়েন্টের সংমিশ্রণে উৎপন্ন ডাবল মিউট‍্যান্ট স্ট্রেইন – এটির সংক্রমণ ক্ষমতা অন‍্যদের তুলনায় কয়েকশোগুণ বেশী। এছাড়া সাউথ আফ্রিকা স্ট্রেইন, ব্রাজিল স্ট্রেইন, অষ্ট্রেলিয়া স্ট্রেইন, ক‍্যলিফোর্ণিয়া স্ট্রেইন ইত‍্যাদিও পাওয়া গেছে। আমাদের রাজ‍্যে এখনো অব্দি একটি ট্রিপল মিউট‍্যান্ট ভ‍্যরিয়েন্ট স্ট্রেইন পাওয়া গেছে (B.1.618)। এর দ্রুত সংক্রমণ করার ক্ষমতা এবং replication ক্ষমতার জন‍্য এটি মারাত্মক রূপ ধারন করেছে। যত বেশী ভ‍্যরিয়েন্টের স্ট্রেইন পাওয়া যাচ্ছে, তত আমাদের বায়োটেকনোলজির জ্ঞানে বোঝা যাচ্ছে, এই স্ট্রেইনগুলির ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাও ততই বাড়ছে। নতুন নতুন স্ট্রেইনের জন‍্য নতুন নতুন ভ‍্যকসিনের আবশ‍্যকতা অবশ্যই আছে।
এবার আসি এই রাজ‍্যের ভ‍্যকসিনেশানের কথায়। এখনো অব্দি প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে দেশে সতেরো লক্ষের মত মানুষের টীকাকরন হয়েছে। যদি দুটি ডোজের সম্পূর্ণ টীকাকরনের হিসাব ধরা হয়, তবে ১% মানুষের টীকাকরন শেষ হয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গে এখনো পর্য‍্যন্ত এককোটি বিশলক্ষের মত টীকা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ টীকাকরনের হার ০.৫% মাত্র। কিন্তু এই রাজ‍্যে সবচেয়ে বড় সমস‍্যা হল অনুপ্রাণিত আদেশনামা। এই পরিস্থিতিতে যখন প্রায় সব কিছু লকডাউনের পর্যায়ে চলে গেছে তখন, ১লা মে পরবর্তী টীকাকরনের ক্ষেত্রে সরকারী আদেশ হল, সব বেসরকারী টীকাকেন্দ্রে টীকা ব‍্যবস্থা তুলে দিয়ে শুধু সরকারী হাসপাতাল, সরকারী স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রে এবং পৌরসভা দ্বারা টীকাকরন করতে হবে। এমনকি যারা প্রথম ডোজ বেসরকারী স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রে নিয়েছেন, তাদেরও এই সরকারী ব‍্যবস্থার মধ‍্যে দিয়ে যেতে হবে। আবার ১৮+ বয়েসের মানুষদের টীকাকরন শুরু হয়েছে। সুতরাং টীকাকরনের সংখ‍্যা অনেক বাড়বে। এদিকে টীকাকরনকেন্দ্রের সংখ‍্যা কমবে। আমরা যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে একই লাইনে দাঁড়িয়ে গুঁতোগুঁতি করে টীকা নেব! হয়ত যারা টীকা নেবেন তাদের অনেকেই করোনা সংক্রমণ ফ্রি পাবেন। অথচ যে মানুষছন অল্প কিছু কনভেনিয়েন্স ফি দিয়ে আগের মত বেসরকারী স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রে টীকা নিচ্ছিলেন, সেই ব‍্যবস্থাটা চালু রাখলেসরকারের কি অসুবিধা ছিল তা আমাদের অজানা।
পরিশেষে বলি, করোনা রোগীর চাপে এমনিতেই হাসপাতালের পরিকাঠামো চাপের মধ‍্যে। এখন যদি ডেঙ্গু, ফ্লু ইত‍্যাদির বাড়বাড়ন্ত হয় (বর্ষাকাল আসছে), তবে অন‍্য রোগীরা আমাদের রাজ‍্যে চিকিৎসা পাবে কি করে সেটা যেন প্রশাসন মাথায় রাখে।

করোনা যুদ্ধে রাজ‍্যের অপরিনামদর্শিতার ফল ভুগতে হচ্ছে

       কোভিড১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে সারা ভারতের সঙ্গে আমাদের পশ্চিমবঙ্গও বিপর্যস্ত। এখন অবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে সরকার প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন একমাত্র ভগবান ভরসা। অথচ কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপগুলির সুফল পেয়েছি। আমার মত অনেকেই যখন রাজ‍্য সরকারের ত্রুটিগুলি ধরিয়ে দিয়েছি, বলতে বাধা নেই, রাজ‍্য সরকারও চেষ্টা করেছে সেই ত্রুটি মেরামত করার। ফলে ধীরে ধীরে কোভিড অতিমারী চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির দৌলতে কোভিডবিধি না মেনে প্রচার, মিছিল, এবং পুরো ভোটপর্বটাই কোভিড সম্প্রচারে পুরোদমে সহায়তা করেছে! এর দায় অবশ‍্যই সব রাজনৈতিক দলের। শুধু নির্বাচন কমিশনকে তার নরম মনোভাবের জন‍্য দায়ী করা ঠিক নয়। দ্বিতীয় ঢেউয়ের অব‍্যবহিত আগে অর্থাৎ প্রথম দু দফার পরেই যদি নির্বাচন স্থগিত করা যেত তবে হয়ত এই রাজ‍্যের করুণ পরিণতি অনেকটা আটকানো যেত।অনেক তথাকথিত বোদ্ধা দেখলাম মন্তব‍্য করেছেন, যে একবার নির্বাচনের পর্ব শুরু হলে তা আরস্থগিত করা যায় না - সম্পূর্ণ ভুল কথা। ১৯৯১ সাশে রাজীব গান্ধীর হত‍্যা হয়েছিল নির্বাচন পর্ব চলার মধ‍্যে। সে সময় নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এখনকার নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ দেখে আমার মনে হয়েছে, এই কমিশনের এত শক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহসের অভাব আছে। যাই হোক, শুধু নির্বাচন অতিমারী ছড়ানোর একমাত্র কারন নয়। অন‍্যতম একটি কারন হল, সাধারণ মানুষের মনে বেপরোয়া ভাব, যেন আমরা করোনা জয় করে ফেলেছি। এদিকে রাজ‍্য সরকারও ঘরের বাইরের সকল বিনোদনের জায়গা - সিনেমা হল, হোটেল-রেষ্টুরেন্ট, শপিং মল, চিড়িয়াখানা, পার্ক এমনকি খেলার মাঠ খোলা রেখে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সং?ক্রমণ বাড়াতে সাহায‍্য করেছে।
       একটি অত‍্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে কোভিড মোকাবেলায় আত্মম্ভরী ঢক্কানিনাদ। ভারতে হাসপাতালের পরিকাঠামো থেকে ধরে ভ‍্যকসিন তৈরী - সবেতেই নাকি আমরা বিশ্বসেরা! এর ফলে সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে সরকারী প্রশাসন, সকলেই মিথ‍্যা আত্মতৃপ্তিতে মশগুল ছিল। সরকার হয়ত কিছু ভালো কাজ করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক চাটুকারিতা সরকারের কর্মদক্ষতার উপর অপপ্রভাবও ফেলেছে। এর আরেকটা কারন হল এই সময় ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতার অতিবৃদ্ধি।
     এর ফলে প্রথম যেটির অভাব হল তা কোভিড রোগীর বেডের ঘাটতি। তাও যদিবা সামলানো খেল, তারপর এলো প্রাণদায়ী অক্সিজেনের ঘাটতি। চাহিদার তুলনায় কিছু বেশী অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখাই দস্তুর। কিন্তু রোগীর সংখ‍্যা গুণিতকে বাড়তে থাকায় বর্ধিত অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগানো সম্ভব হলনা। ফল, অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু,যা সারা দেশে সংবাদ মাধ‍্যমগুলি প্রচার করল। এভাবে মানুষকে অযথা ভীত সন্ত্রস্ত ও সরকারকে চাপে ফেলে দিল। কিছু কিছু জায়গায় বন্টন ব‍্যবস্থার গোলমাল ও তজ্জনীত রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার চেষ্টায়বেশী সময় ধরে অবস্থা খারাপ থাকল। আমরা দিল্লীতে, উত্তর প্রদেশে ও হরিয়ানায় বিনা অক্সিজেনে কত মানুষ মারা গেছে তার পরিসংখ‍্যান সংবাদ মাধ‍্যমে দেখেছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বা মহারাষ্ট্রে অক্সিজেনের অভাবে কত রোগী মারা গেলেন তার পরিসংখ‍্যান দেখিনি। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে অক্সিজেনের অভাবে কোন রোগী মারা যায়নি। তাহলে কি অক্সিজেন নিয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার যে অভিযোগ মূখ‍্যমন্ত্রী করেছেন তা অসত‍্য? না। মূখ‍্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। তবে রাজ‍্যের মেরুদন্ডহীণ সংবাদ মাধ‍্যম এমন কোন সংবাদ পরিবেশন করে না যাতে রাজ‍্যের কোনরকম ঘাটতি প্রকাশ পায়। এটা করতে গিয়ে নিজেদের দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে 'চাটুকারিতা পরম ধর্ম' ব্রত উদযাপন করে তারা সরকারকে সঠিক পথ দেখাতে পারছে না।
        পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ‍্যপরিকাঠামো এমনিতেই খুব উন্নতমানের নয়। অধিকন্তু মারমুখী আত্মীয়স্বজনের চাপে রোগী পরিষেবায় ডাক্তার, সিস্টার ও অন‍্যান‍্য স্বাস্থ‍্যকর্মীরা যথেষ্ট চাপের মধ‍্যে থেকে কাজ করেন। এর উপর আছে স্বাস্থ‍্যভবনের ডাক্তার -আমলাদের অপ্রয়োজনীয় এবং অবান্ছিত হস্তক্ষেপ। ফলে, বেশীরভাগ সময়েই হাসপাতালে work-to-rule পরিষেবা পাওয়া যায়। এছাড়া বেসরকারী হাসপাতাল ও বড় নার্সিংহোমগুলির সঙ্গে রাজনীতির উপর মহলের অশুভ আঁতাতের কথা সর্বজনবিদিত। এসবের মিলিত ফলশ্রুতিতেই কোভিড১৯এর দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে এভাবে মুখ থুবরে পড়েছে স্বাস্থ‍্য পরিষেবা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশা করা যায়সরকার এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে। অতিমারী নিয়ে কেন্দ্র-রাজ‍্য কুস্তির একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই রাজ‍্যে প্রধান বিরোধী দল এখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে। সেজন‍্য রাজনীতির খেলায় মেতে এ রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কাছে দরবার করলেন, কোভিডের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি এবং অক্সিজেনের উপর যেন GST মকুব করা হয়। তিনি জবাব পেলেন GST আগেই মুকুব করা হয়েছে! রানীতির টানাপোড়েন চলতেই থাকে। Atrial fibrillation আটকানোর ওষুধের ১৪টি ট‍্যবলেটের দাম mrpতে ১২০ টাকা। যখন থেকে এটি কোভিড রোগীর চিকিৎসায় ব‍্যবহার করা শুরু হল, আর এই ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় না। যাদের হার্টের সমস‍্যার জন‍্য এই ওষুধ লাগে তারা একই compositionএর  অন‍্য কোম্পানির ওষুধ কিনছেন যার দাম ৫০৯ টাকা। কেন্দ্র বা রাজ‍্য, কোন সরকারই এ ব‍্যপারে উচ্চবাচ্য করছেনা! স্বাস্থ‍্যভবনের চিকিৎসক আমলারা, যাদের একমাত্র যোগ‍্যতা চাটুকারিতা, তারা এ খবর রাখেন কিনা জানা নেই।
     এই মূহুর্তে বলা যেতে পারে কোভিড অতিমারীর মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় অস্ত্র টীকাকরণ। আমাদের দেশের সমস্ত মানুষজনের টীকাকরণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ‍্যে শেষ করার জন‍্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ‍্য হচ্ছি, রাজনৈতিক কারণে ামাদের দেশে তৈরী টীকা বিদেশে বিক্রি ও সাহায্য হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষদের সুষ্ঠু টিকাকরনের পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রথমে ষাটোর্ধ মানুষের টীকাকরণ শুরু হল। দুটি কোম্পানির টীকা। আমাদের কোন পছন্দের সুযোগ নেই। যে কোম্পানির টীকা পাওয়া যাবে তাই নিতে হবে। সরকারী বা নির্দিষ্ট বেসরকারী স্বাস্থ‍্যকেন্দ্রে টীকাদান কর্মসূচি শুরু হল। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব প্রথম টীকার পরে দ্বিতীয় টীকা নির্দিষ্ট সময়ের ব‍্যবধানে দিয়ে টীকাকরণ সম্পূর্ণ করা। সরকারের ভুল নীতি এবং কিছুক্ষেত্রে নীতিহীণতার জন‍্য দেশের টীকাকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে। রাজ‍্যের জনসংখ্যা অনুপাতে সব রাজ‍্যকে টীকা সরবরাহ করার কথা কেন্দ্রের। পরের পর্যায়ে রাজ‍্যগুলি তার নাগরিকদের নির্দিষ্ট কর্মসূচির মধ‍্যে দিয়ে টীকাকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করবে। এটাই হওয়ার কথা। অথচ পুরো প্রক্রিয়াই বিপর্যস্ত। কেন?  প্রথম কারন হচ্ছে, দুটি টীকা উৎপাদনকারী সংস্থা তাদের ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে টীকা তৈরী করছে। দেশের জনসংখ্যার হিসেবে প্রত‍্যেক রাজ‍্যকে কেন্দ্রের টীকা পাঠানোর কথা। পাঠানো হয়নি। না কেন্দ্র, না রাজ‍্য, কোথাও সুষ্ঠু প্ল‍্যানিংয়ের কোন ছাপ নেই। এখন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে ভারতে ১৬,৮২,৭৬,২১৪টি টীকা দেওয়া হয়েছে। যদি দুটি ডোজের সম্পূর্ণ টীকাকরণকে ধরা হয়, তা সলে দেশের জনসংখ‍্যার মাত্র ১% এর কাছাকাছি মানুষ এখনো অব্দি সুরক্ষিত হয়েছে। এইভাবে চললে আগামী দু বছরেও টীকাকরণ সম্পূর্ণ হবেনা। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সহাস‍্য মুখ দেখিয়ে প্রচার করা হল, আমাদের মহান প্রধানমন্ত্রী নিজেই টীকা তৈরী করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি তা দান খয়রাত করছেন! এটি সত‍্যি হলে তা সামাজিক অপরাধ আর তা না হয়ে থাকলে এমন প্রচার করা সামাজিক অপরাধ। পশ্চিমবঙ্গে এখনো পযর্ন্ত ১,১৯, ৬৩, ৫৩২ টি টীকা দেওয়া হয়েছে। যদি দুই ডোজের টীকাকরণ ধরে টীকা সম্পূর্ণ করার হিসেব করা হয় তবে এখনো অব্দি ০.৫%  মানুষও এই রাজ‍্যে সুরক্ষিত হয়নি। cowin.gov.in এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজ‍্যের জন‍্য প্রেরিত টীকার সংখ‍্যার সঙ্গে রাজ‍্যের জনসংখ্যার কোন মিল নেই। শতকরা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় মহারাষ্ট্র ও কর্নাটক অনেক বেশী টীকা পেয়েছে। কোন নীতিতে কেন্দ্র টীকা পাঠাচ্ছে তা একদম স্বচ্ছ নয়।
       আবার দেখা যাচ্ছে যে দুটি সংস্থা টীকা তৈরী করছে, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা, কত পরিমাণ টীকা তারা সরকারকে দিচ্ছে তার সঠিক হোমওয়ার্ক না করেই সরকার প্রথমে সিনিয়ার সিটিজেন্স, পরে ৪৫+ বয়েসের এবং সবশেষে ১৮+ বয়েসের সব নাগরিকদের টিকাকরণ শুরু করার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এই রকম অদ্ভুত বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের কর্মদক্ষতার ছাপ নেই। কারন এখনো পর্যন্ত সারা দেশের বয়স্ক নাগরিকের বেশীরভাগেরই এক বা কোন টীকাকরণ হয়নি। এদিকে টীকার সংখ‍্যা কমে যাওয়ায় টীকাকরণ কেন্দ্রগুলিতে টীকা গ্রহীতার লাইন ও দুর্ভোগের শেষ নেই। মনে হচ্ছে নিজের ক্ষমতার যথাযথ পরিমাপ না করতে পেরে কেন্দ্রীয় সরকার ছনসাধারনের জীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছেন। 'কোভ‍্যকসিন' টীকা প্রস্তুতকারী সংস্থা সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় এবং এদের টীকা তৈরীর সব উপাদান দেশীয়। সরকারের উচিৎ ছিল এই সংস্থাটির উৎপাদন বাড়ানোর জন‍্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। প্রয়োজনে এদের multi centered production unit তৈরী করতে আর্থিক ও প্রশাসনিক সাহায‍্য করা। সরকার তা যথাযথভাবে করেনি। আবার 'কোভিশিল্ড' প্রস্তুতকারী সংস্থা যারা সারাদেশে প্রায় ৯০% টীকা সরবরাহ করেছে, তারা ব্রিটিশ সংস্থা অ‍্যস্ট্রাজেনিকার লাইসেন্সে টীকা তৈরী করছে। ফলে, এর একটা আন্তর্জাতিক  সমঝোতার শর্ত আছে। তাছাড়া এর এমন কাঁচামাল লাগে যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সরকার এটি বেশী কিনছে কারন এর দাম কম। আমার প্রশ্ন, সরকারের কাজ কি তার নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ নাকি বানিয়ার মত লাভ-ক্ষতির হিসাব করা।
      জনসাধারণের আরো জানা উচিৎ, এই টীকা তৈরীর জন‍্য বিদেশ থেকে আসা কাঁচামালের আমদানী শুল্ক সরকার তুলে নিয়েছে বলে প্রচার করা হলেও এর অন‍্যান‍্য দেশীয় কাঁচামালের উপর সরকার GST এখনো তুলে নেয়নি। এই ধরনের পদক্ষেপ কিসের সংকেত? অর্থাৎ, এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে সরকারের ভারতীয় নাগরিকদের টীকাকরনের জন‍্য সুষ্ঠু কার্যক্রম নির্মানে ঘাটতি ছিল এবং আছে। সরকারের এবং শাসকদলের কিছু পদাধিকারীর বাগাড়ম্বর পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। আমাদের দেশের টীকা উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে থাকলে এখন সরকার বিদেশের জনসন, ফাইজার, স্পুটনিকের মত টীকাগুলিকে আনার জন‍্য আকুলি বিকুলি করত না।
       এদিকে দেশের সম্পূর্ণ টীকাকরনের প্রক্রিয়া আরো ধীরে চলতে শুরু করার জন‍্যও কেন্দ্রীয় সরকারের অপরিণামদর্শীতাই দায়ী। তারা টীকাপ্রতি ১৫০ টাকা মূল‍্যে স্বল্প কিছু টীকা কিনে টীকাকরণ শুরু করে দিয়ে বাহবা নিতে গেল। তারপর শর্ত অনুযায়ী সংস্থা দুটি যখন দাম বাড়াতে চাইল, তখন টীকা সংগ্রহের দায়িত্ব অনেকাংশে সরকার নিজের ঘাড় থেকে ছেটে ফেলল! তারা রাজ‍্যগুলির ঘাড়ে টীকার বাড়তি বোঝা আর বেসরকারী টীকাকরণ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সংস্থাগুলির ঘাড়ে আরো সুউচ্চ মূল‍্যের বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিল। সারা দেশে একই দামে টীকাকরণ প্রক্রিয়া না চালালে প্রতিবাদ হবেই। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপকারী চরিত্রের বদলে বানিয়া চরিত্র প্রকাশ পেল। সরকার জনসাধারণের উপকার করার বদলে নিজের ব‍্যবসায়িক লাভের দিকটাই দেখল। ফলে সরকারের জনপ্রিয়তার উপর কালো ছায়া পড়ল। সারা দেশে সরকারের ভাবমূর্তি যথেষ্ট কালিমালিপ্ত হল।
      আরেকটি কথা। এই যে কয়েক বছর ধরে টীকাকরন প্রক্রিয়া চালানো - একটি অবাস্তব পদক্ষেপ। কারন এই RNA ভাইরাস তার রূপ বদল করে মানুষের ইমিউন সিস্টেমে আঘাত করে। সুতরাং সে দীর্ঘ সময় পেলে টীকাকে বোকা বানিয়ে তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সরকারের আপাত ব‍্যর্থ পরামর্শদাতাদের এটা মাথায় রাখা উচিৎ।
        পরিশেষে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রুটির জায়গাটা ধরিয়ে দিই। এখানে প্রশাসন চলে অনুপ্রেঢ়নায় আর রাজনৈতিক লক্ষ‍্যে। এমনিতেই টীকাকরণের হার ও মাত্রা অনেক কম হওয়ায় টীকাকরণকেন্দ্রগুলিতে আগ্রহীদের লাইন অনেক বড় হচ্ছে। সরকারের ঘোষিত নীতি সকলকে বিণামূল‍্যে টীকাকরণ - সাধু প্রস্তাব। এদিকে ১লা মে থেকে টীকাকরণের যোগ‍্য মানুষজনের সংখ‍্যা অনেক বেড়ে গেল (১৮+ বয়সের নাগরিকদের টীকাকরন শুরু )। তখনই সরকার বেসরকারী টীকাকরণকেন্দ্রগুলিতে টীকার যোগান বন্ধ করে দিল। ফলে, সরকারী টিকাকরণকেন্দ্রগুলিতে ভিড় বাড়তে লাগায় সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে গেল। অনেক বয়ষ্ক নাগরিক দ্বিতীয় ডোজের সময় হয়ে গেলেও টীকা পাচ্ছেন না। সরকার তাদের জন‍্য বেসরকারী টীকাকেন্দ্রগুলি খোলা রাখলে এই অব‍্যবস্থা এড়ানো যেত। দেশের জনসাধারনকে গিনিপিগ বানানোর প্রক্রিয়া এভাবে আর কতদিন চলবে তার উত্তর এখনো অজানা।

( লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা )