কোভিডের নতুন সংক্রমণে ভয় অমূলক

“মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” – রাবনের স্বগোতক্তি এই বাংলা প্রবাদ বোধহয় কোভিড-১৯, যাকে আমরা করোনা বলে জানি, তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ‍্য। ব‍্যাপার কি?
আসলে WHO সতর্ক করেছে, চীন,জাপান,কোরিয়া, ব্রাজিল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আবার করোনার ওমিক্রণ ভাইরাসের সাব-গ্রুপের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তাই তারা ভাইরাস সংক্রমণের গডফাদার (!) হিসেবে আবার সারা বিশ্বে ত্রাসের সঞ্চার করে চীনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে নেমে পড়েছে!
চীনের Beijing, Zhuozhon, Shanghai ইত‍্যাদি শহরে কোভিড-১৯ এর বাধানিষেধ তোলার পরেই ঘোষণা হয়েছিল চীনে কোভিড টলারেন্স শূণ‍্য! এই ধরনের প্রোপাগান্ডা সর্বস্ব দেশে কোভিড আবার আসতে পারে যদি জনসাধারণ বিধিনিষেধ না মেনে চলে – বিশেষতঃ কোভিড-১৯এর মত RNA ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে। আবার, আমাদের দেশে বড় সমস‍্যা হল, এখানে নীতিনির্ধারণকারী রাজনীতিবিদরা সবজান্তা মূর্খের মত বিশেষ বিশেষজ্ঞদের (যার মধ‍্যে IAS থাকা বাধ‍্যতামূলক) পরামর্শ নিয়ে চলেন! আগে করোনা সংক্রান্ত লেখায় যা বলেছি, তার প্রতিটি কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত‍্যি হলেও আমাদের দেশে মাণ‍্যতা পায় একমাত্র সুবিধাবাদী রাজনীতির স্তাবকদের পরামর্শ! তাঁরা বিশেষ রূপে অজ্ঞ, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ হিসেবে জনসাধারনকে জ্ঞান দেন এবং অনুগ্রাহী সংবাদ-মাধ‍্যম তা প্রচার করে! ফলে, জনগণের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ‍্যতা শূণ‍্য!
RNA ভাইরাসের ধর্ম হল, সে বেঁচে থাকার তাগিদে জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজের প্রতিলিপি (replication) তৈরী করে দ্রুত সংখ‍্যা বৃদ্ধি করে। আবার এটা করতে গিয়ে তার জিন মিউটেশানের সময় কিছু ক্ষেত্রে জেনম কোডের পরিবর্তন হয়। এদিকে আবার herd immunityর কারনে মানবদেহে যে IgG এ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়, তার ক্ষমতা হোস্টের শরীরভেদে আলাদা আলাদা স্তরের হয়। সেজন‍্য ভ‍্যাকসিন নেওয়ার পরেও বিভিন্ন মানুষের উপর এই ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতা বিভিন্ন স্তরের হয়। পরিবর্তিত gene mutation এর কারনে যেমন RNA ভাইরাসের চরিত্র ও সংক্রমণ ক্ষমতা বদলায়, তেমনি পরিবর্তিত ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিং দেখে তার জন‍্য পরিবর্তিত ভ‍্যাকসিন বানানো যাবে। এর জন‍্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সংক্রমিত রোগীদের সনাক্তকরণ এবং তাদের পরীক্ষা করা। তার জন‍্য কেন্দ্রীয় সরকার Indian SARS-CoV-2 Genomics Consortium (INSACOG) এর স্বীকৃত পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিংয়ের উপর জোর দিয়েছে। এই সময় করোনা ভাইরাসের নতুন ঢেউ নিয়ে সতর্ক হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, এই ভাইরাস পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন‍্য changed gene mutation করে যেমন তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তেমনই তার সংক্রমণের তীব্রতা কমছে – এটা যে কোন RNA ভাইরাসের ধর্ম। আবার ভ‍্যাকসিন এবং herd immunity জনিত কারনে মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন‍্য asymptomatic আক্রান্তের সংখ‍্যা যেমন বেড়েছে তেমনি symptom অনেক মৃদু হয়েছে। এসব অনেক আগেই জানিয়েছিলাম। তবু, ঐ যে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে গেল গেল রব তুলে অর্থনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা – যা এখনো চলছে!
চীনে এখন যে করোনা রোগীর সংখ‍্যা হটাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার কারন সে দেশের মানুষের লাপরবাই, সরকারের ভুল কোভিড প্রোটোকল এবং নিম্ন মানের ভ‍্যাকসিনের (চীনা ভ‍্যাকসিনের কার্যকারিতা আন্তর্জাতিকস্তরে স্বীকৃত নয়) কারনেও হতে পারে। তাছাড়া, অন‍্যান‍্য দেশ, যেমন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়ায় যেসব সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরও চীনের মত BF.7 ভ‍্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে। অন‍্যান‍্য দেশে মৃত‍্যুর সংখ‍্যা অনেক কম হলেও চীনে সংখ‍্যাটা অনেক। সেটা কোমর্বিডিটি বা ভ‍্যাকসিনের মানবদেহে IgG এ‍্যান্টিবডি তৈরীর ক্ষমতার তারতম‍্যের কারনেও হতে পারে। শুধু সাংহাই শহরে চীনের রেকর্ড অনুযায়ী আড়াই কোটির জনসংখ্যার শহরে এখন আক্রান্তের সংখ‍্যা ৫৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে। ব্রিটেন থেকে পাওয়া খবর অনুসারে চীনে এখন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষের কোভিডে মৃত‍্যু হচ্ছে! আবার অন‍্যান‍্য দেশের আক্রান্তদের বেশীরভাগের সঙ্গে চীনা সংযোগ পাওয়া গেছে! ভারতের এখনই লকডাউনের মত ব‍্যবস্থা নেওয়া, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায় আঘাত হানবে – তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। তার কারন হল, এই BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে এখনো পর্যন্ত এই দেশে আক্রান্তর সংখ‍্যা মাত্র চার – গত জুলাইয়ে এক, সেপ্টেম্বরে দুই ও নভেম্বরে এক! এদের মধ‍্যে তিনজন গুজরাটের এবং একজন ওড়িশার। এদের অন্তত একজন ওমিক্রনের BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত এক আমেরিকা নিবাসী ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে এসেছিলেন! সুতরাং এমন সময়, যখন করোনার বিধিনিষেধ আর সামাজিক দূরত্বের বিধান মানা হচ্ছে না, তখনো ভারতে এই ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা দেখে চিন্তিত হওয়ার কারন আছে বলে মনে হয় না।
আরেকটি ব‍্যাপারে খটকা লাগছে – গত বেশ কিছুদিন যাবৎ চীনে BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়তে থাকলেও WHO একদম নিশ্চুপ ছিল! বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ জমায়েত – FIFA ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল শেষ হল রবিবার ১৮ই ডিসেম্বর। আর ১৯শে ডিসেম্বর, ঠিক পরের দিন WHO রিপ ভ‍্যান উইঙ্কিলের মত শীতঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসব – খ্রীষ্টমাসের আগে এমন জ‍্যাঠামশাই মার্কা বিজ্ঞপ্তি জারি করল! এর একাধিক উদ্দেশ‍্য। প্রথমতঃ, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনের ব‍্যর্থতা এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার জিন মিউটেড ভ‍্যারিয়েন্টের নিয়ন্ত্রনে তাদের ব‍্যর্থতার দায় আন্তর্জাতিকভাবে অন‍্য দেশের উপর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এছাড়া করোনা উত্তর মন্দার অর্থনীতিতে খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চীনকে উৎসবের কেনাকাটার মরশুমে যতটা সম্ভব সাহায‍্য করা। যদি এই সময় ভয় ভীতিতেও করোনার বিধিনিষেধ লাগু করা যায় তবে, অন‍্য দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পরবে – এতে চীনের অর্থনীতির নেগেটিভ উপায়ে লাভ হবে। এভাবে কৃত্রিম চাহিদা বৃদ্ধি করে দ্রব‍্যমূল‍্য বাড়ানোর চেষ্টা হবে।
চীনের ইউহানের পরীক্ষাগার থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর সময় থেকে চীন তার মোকাবিলায় সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে, শুধুমাত্র দমন-পীড়ন ও তথ‍্য গোপন করে তার মোকাবিলা করতে গিয়ে বারবার ব‍্যর্থ হয়েছে। এখন তারা বিপাকে পড়ে WHOকে তাদের হয়ে মাঠে ব‍্যাট ধরতে নামিয়েছে। WHO তাই FIFAকে তুষ্ট রেখে ফুটবল বাণিজ্য সম্পূর্ণ হওয়ার পর মাঠে নেমেছে।
এখানে একটি সন্দেহজনক প্রচার লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশের কোভিড উত্তর অর্থনীতি যখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তখনই তার উপর বাণিজ্যিক স্বার্থে অনৈতিকভাবে আঘাত হানার চেষ্টা হচ্ছে। এখন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়ছে। ব‍্যাঙ্কের আমানতের উপর সুদ বৃদ্ধি পাচ্ছে – বাণিজ‍্যের আয়তন বাড়ছে। আবার ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশেষতঃ ইউরোপের দেশগুলির অর্থনীতি এবং কোভিড উত্তর চীনের অর্থনীতি যথেষ্ট প্রতিকুলতার মধ‍্যে চলছে। বিশ্বসংস্থা WHO এই সময় যে খন্ডিত তথ‍্য সামনে এনে ত্রাস সঞ্চারের চেষ্টা করছে তার অভিপ্রায় মোটেই ভালো নয়। তারা বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতির বাধানিষেধ ফিরিয়ে এনে চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বানানোর চেষ্টা করছে। এভাবে তারা ভারতকে চাপে ফেলে আবার আমাদের দেশকে মন্দার কবলে ঠেলতে চাইছে।
দেশের সংবাদ-মাধ‍্যম মারফৎ যে প্রচার চলছে তা একপেশে, খন্ডিত ও অযৌক্তিকভাবে ভীতিপ্রদ। এর ব‍্যাখ‍্যা প্রয়োজন। কোথাও বলা হচ্ছে না যে, এখন চীনে এবং অন‍্যান‍্য যেসব জায়গায় নতুনভাবে কোভিড আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়ছে, তার ৯৯% এরই BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এই ভ‍্যারিয়েন্ট এখনো এদেশে গত ছ মাসে আক্রান্ত চারজন! আমি আগেই বলেছি, এভাবে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট আসবে, যাবে। ধীরে ধীরে মানবদেহে এর তীব্রতা কমবে, যদিও তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে। এখন এটাই হচ্ছে। জানিনা দেশের রাজনীতিবিদদের মানুষকে অযথা ভয় দেখানোর কারন কি! এভাবে কোভিড একমাস বা এক বছরে বিদায় নেবে – তা ভাবাই ভুল। সেজন‍্য, আগে যেমন বলেছি, আবার তাই বলছি – কোভিড প্রোটোকলকে মাণ‍্যতা দেওয়া জরুরী। চীনে তার অভাবেই এত দ্রুত BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা এত বেড়েছে। সেজন‍্য আমাদের দেশে আবার লকডাউন বা অর্থনৈতিক বাধানিষেধ আরোপ করা অর্থহীন। এতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে, সেইসঙ্গে কিছু ব‍্যবসায়ীর মুনাফা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরবে। বরং চীন এবং অন‍্য যেসব জায়গায় এই ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়ছে, সেখানে ভারতীয়দের যাওয়ার ব‍্যাপারে বাধানিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। এছাড়া আক্রান্তের পরীক্ষা করে ভাইরাসের প্রকৃতি নিরুপণের জন‍্য INSACOG স্বীকৃত কোন পরীক্ষাগার থেকে তা জানা জরুরী। নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ভ‍্যাকসিনকে কার্যকরী করতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা কোনো শক্ত কাজ নয়। আমাদের দেশের ভ‍্যাকসিনের মান সারা বিশ্বে পরীক্ষিত ও আদৃত। শুধু মানুষকে বুঝতে হবে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার সবচেয়ে জরুরী অস্ত্র মাস্ক এবং স‍্যানিটাইজেশান। সেইসঙ্গে ভিড়ের মধ‍্যে অপ্রয়োজনে গুঁতোগুঁতি না করা বাঞ্ছনীয়।
দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির এ ব‍্যাপারে সদর্থক ভুমিকা নেওয়া দরকার। মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি নর্মাল কাজকর্ম চালাতে কোন বাধানিষেধ রাখা উচিৎ নয়। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে কোভিড চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো থাকায় তা পুরোপুরি না ভেঙ্গে নূন‍্যতম বেডের কোভিড ওয়ার্ড চালু রেখে আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় তৈরী থাকা দরকার; সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডারের স্টক মজুত রাখা ছাড়া এই মূহুর্তে আর কিছু করণীয় নেই। ভ‍্যাকসিনে কোভিড সংক্রমণ অনেকটাই ঠেকানো যাবে। সাথে সাথে সমাজে herd immunity (আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়লে) হলে তখন কোভিড আক্রান্তদের সুস্থ হওয়া নিশ্চিত হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যে চারজন BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই সুস্থ। সমাজ, সরকার সতর্ক ও দায়িত্বশীল থাকলে এ ধরনের নতুন নতুন কোভিড ভ‍্যারিয়েন্টের থেকে প্রাণহানির ঘটনা প্রায় থাকবে না।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের উত্তরোত্তর আক্রান্তের সংখ‍্যাবৃদ্ধিতে মনে হল, “মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” রামায়ণের এই বিখ‍্যাত উক্তিটি। সত‍্যি, কোভিড১৯ এর সংক্রমণ যখন শুধু পড়তির দিকেই নয়, দৈনিক সুস্থতার হার আক্রান্তের হারের থেকে অনেক বেশী, তখন আমজনতা মনে করতে শুরু করলেন, যাক্ করোনা এতদিনে বিদায় নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেশের মানুষদের টীকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হল।ব‍্যস,আর যায় কোথায়! সবাই ভাবতে শুরু করলেন যে টীকা নেওয়ার পরমূহুর্ত থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।; এমনকি তাঁদের আর কোন সামাজিক নিরাপত্তার বিধিনিষেধের দরকার নেই। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচটি রাজ‍্যে ভোটের দামামা বেজে গেল। শারীরিক দূরত্ববিধি চুলোয় গেল, ভিড়, জমায়েত সবই করোনাপূর্ব পরিস্থিতির মতই চলতে লাগল! বারবার বিভিন্ন গণমাধ‍্যমে মানুষকে সতর্ক করা হতে লাগল। কিন্তু কাকস‍্য পরিবেদনা!
এর ফলও আমরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছি। আমি গত বারো দিনের শুধু পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্তের সংখ‍্যা দিচ্ছি।
২৫শে মার্চ: ৫১৬
২৬শে মার্চ: ৬৪৬
২৭শে মার্চ: ৮১২
২৮শে মার্চ: ৮২৭
২৯শে মার্চ: ৬৩৯
৩০শে মার্চ: ৬২৮
৩১শে মার্চ: ৯৮২
১লা এপ্রিল:১২৭৪
২রা এপ্রিল:১৭৩৩
৩রা এপ্রিল:১৭৩৩
৪ঠা এপ্রিল:১৭৩৬
৫ই এপ্রিল:১৯৬১ (শুধু কোলকাতায় ৬০৬)
তথ‍্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ‍্য বুলেটিন

     এখন মনে হচ্ছে মানুষ, বিশেষতঃ আমাদের রাজ‍্যের মানুষমাথা খাটিয়েচলার চেয়ে মন দিয়ে বিচার করেন! এই কথা এখন বলতে বাধ‍্য হচ্ছি কারন, আগে বহুবার অনেকভাবে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ করোনার টীকা নিলেই করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে - এমন কোন দাবী টীকা কোম্পানী বা ডাক্তার, কেউই করেননি। সাধারণভাবে টীকার (কোভিশিল্ড এবং কোভ‍্যকসিন) দুটি ডোজ চার থেকে আট সপ্তাহের ব‍্যবধানে নেওয়ার পরে আরো দু সপ্তাহ বাদে ভ‍্যকসিন গ্রহীতার দেহে করোনা মোকাবিলার ইমিউন রেসপন্স তৈরী হবে। তাও এই টীকা শতকরা পঁয়ষট্টি থেকে আশি শতাংশ  কার্যকর হতে পারে। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হওয়ার দুসপ্তাহ পরেও আমরা কখনোই সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান, স‍্যানিটেশান এবং শারীরিক দূরত্ববিধি যেন মেনে চলি।
   আরেকটি কথা। কোভিড১৯ RNA ভাইরাস হওয়ার কারনে এর পরিবর্তিত জিন মিউটেশান হয়। আবার টীকার ইমিউন রেসপন্স ভাইরাসের একটি বা দুটি বা তিনটি নির্দিষ্ট স্ট্রেইনকেই সণাক্ত করতে পারে। সরল বাংলায় বললে বলতে হয়, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা যে পরিবর্তিত জিন মিউটেড ভাইরাসগুলি পাচ্ছি, তাদের সবাইকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কোন বাজার চলতি ভ‍্যকসিনের নেই। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হলেই আমরা করোনামুক্ত থাকবো - এমন ভাবার কারন নেই। তব, শৃঙ্খলাপরায়ণভাবে যদি সাধারণ মানুষ কোভিড আচরণবিধি মেনে চলে আর সঙ্গে সঙ্গে টীকাকরণ চলতে থাকে তাহলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে।
   এবার একটি অপ্রিয় কথা বলতে বাধ‍্য হচ্ছি। পাঁচটি রাজ‍্যে এখন সাধারণ নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচন মানুষের জন‍্য, মানুষের স্বার্থে। আমরা দেখছি কোভিডবিধির বিন্দুমাত্র মানার ব

আলাই নেই। না নেতাদের, না কর্মীদের! আচ্ছা, এটা কি সত‍্যিই মানুষের স্বার্থে! যে হারে আমাদের রাজ‍্যে আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়ছে তা লকডাউনের মাঝামাঝি পর্বকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন দৈনিক মৃত‍্যুর সংখ‍্যাও বাড়ছে। মহারাষ্ট্রে লকডাউন শুরু হয়েছে। অনেক জায়গায় হোটেল রেষ্টুরেন্ট বন্ধ। এখানে সব খোলা! সিদ্ধান্তগ্রহনকারীরা ভোট যুদ্ধে ব‍্যস্ত! মানুষ মরে হেজে যাক। তাতে কারোর কিছু যায় আসে না। মনে হচ্ছে, করোনার মৃত‍্যু মিছিল বড় কথা নয়, বড় কথা হল নির্বাচন, যেখানে কোন নেতারা আগামী পাঁচ বছর রাজ‍্যের মধুভান্ড দখল করবেন তা নির্ধারন করাই করোনা বিধ্বস্ত রাজ‍্যের আম আদমীর আশু ও একমাত্র কর্তব‍্য। নেতাদের এই দেশ সেবার নামে আত্মসেবার আদিখ‍্যেতা বড়ই দৃষ্টিকটু। মানুষ অসহায়।
কোভিড আক্রান্তের সংখ‍্যা সারা পৃথিবীতেই বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন দেশ লকডাউন ও অন‍্যান‍্য restrictions আনছে। বাদ আমরা। কেন? উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আমার জিজ্ঞাসা। নির্বাচন কমিশন কোন রকম কোভিড restriction মানতে বাধ‍্য করতে পারেনি বা করেনি।
আমার ধারনা, যখন ২৯শে এপ্রিল নির্বাচন শেষ হবে তখন দৈনিক আক্রান্তের সংখ‍্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। পুরো চিকিৎসা ব‍্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ার জায়গায় চলে যাবে।
আমাদের দেশে এই মূহুর্তে সক্রিয় করোনা রোগী: ৭৫৪৯৮৪, এর মধ‍্যে গুরুতর অসুস্থ : ৮৯৪৪, দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু : ৮৩জনের। পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় রোগী : ১৯২৪৮।
তথসূত্র : ওয়ার্ল্ডোমিটার।
৫ই এপ্রিল, দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ‍্যা : ১০৩৫৫৮। প্রথম দফায় গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ বিশহাজার থেকে একলাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আশি দিন। এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে এই সংখ‍্যা পেরোতে লাগল পঁচিশ দিন। সুতরাং দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই সংক্রমণ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারন হিসেবে নিঃসন্দেহে মানুষের কোভিডবিধি না মানা, সরকারী তরফে লকডাউন ও কন্টেনমেন্ট জোন না করার ঢিলেমীকে কাঠগরায় তোলা যায়। অনতিবিলম্বে এই পদ্ধতিগুলি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
টীকাকরন এই দ্বিতীয় ঢেউকে কতটা প্রশমিত করতে পারবে সেসম্বন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা স্পষ্টতই সন্দিহান। সেজন‍্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অধুনা কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি নতুনভাবে অন্বেষণ করছেন। এরমধ‍্যে একটি হল আমাদের দেহের ইমিউনিটির উপর ভরসা করা। যদি তা সত্ত্বেও ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তা ২০১৯-২০ সালের মত মৃত‍্যু মিছিল তৈরী করবে না। এর কয়েকটি কারনের মধ‍্যে একটি যেমন আমাদের দেহে ভাইরাসের এ‍্যান্টিজেন সণাক্ত হলেই দ্রুত অধিক পরিমাণে এ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়ে ভাইরাস নিধনে নামবে, তেমনই ভাইরাস তারজিন মিউটেশানগত কারনে ক্রমশঃ মানবদেহে ক্ষতি করার ক্ষমতা হারাতে থাকবে। কিন্তু আরেকটি বিপদ হচ্ছে, এই ভাইরাস মানবদেহের ভাইটাল কয়েকটি অর্গান, যেমন কিডনি, লিভার, লাংস,হার্ট ও নউরন সিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে পারে। ফলে, ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত‍্যু না হলেও রোগীর আয়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারনে এই ভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় একটি নতুন দিকের সন্ধান করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার বড় একটি অসুবিধার জায়গা হল, একসঙ্গে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্গ‍্যানের সংক্রমিত হওয়া – যা অতি দ্রুত রোগীর প্রাণ সংশয়ের কারন হয়। প্রতিটি অর্গ‍্যানকে একসঙ্গে বাঁচানোর লড়াই চালানো ডাক্তারদের পক্ষে দুঃসাধ‍্য। সেজন‍্য নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির সন্ধানের পথে আশার আলো দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে ফেরোপটোসিস (ferroptosis) – এটি একটি নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া যা সাধারণ কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া apoptosis থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ফেরোপটোসিস দেহের আয়রনের উপর নির্ভরশীল যা লিপিড পারক্সাইড জমায় সাহায‍্য করে। এই প্রক্রিয়ায় ক‍্যন্সারের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এখন কোভিড-১৯ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ‍্য পদক্ষেপ হতে চলেছে বলেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারনা। আসলে, এই পদ্ধতিতে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত একাধিক অর্গ‍্যানের কোষগুলিকে বেছে বেছে নষ্ট করার ক্ষমতা থাকায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অনেকটাই সুবিধা করবে। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগের সার্থকতা কতটা তা ভবিষ‍্যতই বলবে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বাঁচার উপায়

দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে। প্রথমবারের লকডাউন ও মাস্ক ব‍্যবহার, স‍্যানিটাইজেশান আর সামাজিক দুরত্ববিধি বজায় রাখার যে নির্দেশাবলী জনসাধারণ মেনে চলছিল, তা গত বছরের শেষের দিক থেকেই আলগা হতে শুরু করেছিল। লকডাউনের সময় দেশের অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা মনে রেখে এবং সেইসঙ্গে কন্টেনমেন্ট জোনের উপকারিতা বিচার করে আমার মনে হয়, সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। কিন্তু দেশের যে রাজ‍্য, মহারাষ্ট্রে শতকরা পঞ্চাশভাগ আক্রান্ত, যেখানে রোগী ভর্তির জন‍্য বেড অমিল, সেখানে রাতে কার্ফু আর দিনে সবকিছু খোলা রেখে কি মহান কর্ম সাধন করছে তা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ‍্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াতেই বোঝা যাচ্ছে।
গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে এবছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। প্রথমতঃ, এই দ্বিতীয় ঢেউ অতাস্বল্প সময়ে অনেক বেশী মানুষকে আক্রান্ত করছে। আর এর জন‍্য সাধারণ মানুষের অসতর্কতাকে অনেকটাই দায়ী করা যায়। নববর্ষের সময় শপিং মল থেকে রেষ্টুরেন্ট, বাস থেকে অটোরিকশা, রাজনৈতিক নেতাদের মিটিং-মিছিলের ভিড় — সবই করোনার আগের সময়কে মনে করায়। আরেকটা কথা, এই ভিড়ের মধ‍্যে মাত্র গুটি কয়েকের মুখে সঠিকভাবে মাস্ক লাগানো আছে। সরকার প্রথম ঢেউয়ের সময় যতটা সক্রিয় ছিল, এখন এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ততটাই উদাসীন। এর ফলে দেশে এবং অবশ‍্যই আমাদের রাজ‍্যেও মৃত‍্যুমিছিল শুরু হয়েছে। গত ১৫ই এপ্রিল, ২০২১, এ সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ‍্যা প্রথম দু লক্ষ ছাড়ালো; একদিনে দেশে মৃত এক হাজারের বেশী। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে মৃত ২৮ জন। এই ভয়াবহ অবস্থায় সরকার, নির্বাচন কমিশন, সবাই অপেক্ষা করছে – কবে নির্বাচন শেষ হবে! করোনার মোকাবিলা করা যে সরকারের প্রাথমিক কর্তব‍্য নয়, তা সরকার তার কার্যপ্রণালী দ্বারাই প্রমান করেছে। দ্বিতীয়তঃ, এই বেশী সংক্রমণ ক্ষমতাযুক্ত মিউটেড করোনা ভাইরাস অতি দ্রুত ফুসফুস ও কিডনীর সবিশেষ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। এর চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হল রেমডিসেভির – যা পশ্চিমবঙ্গে চাহিদার তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে। কোন সরকারেরই এদিকে বিশেষ নজর দিতে দেখা যাচ্ছে না। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তারনর, কিডনী বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কিছুদিন বাদে সেই রোগী মারা যাচ্ছে। সুতরাং, অত‍্যন্ত শক্ত হাতে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করা জরুরী। এখানেই মানুষকে সচেতন করার যে কাজটা প্রশাসনের করার কথা, তা করতে প্রশাসন সম্পূর্ণ ব‍্যর্থ। পুনরায় লকডাউন করার প্রয়োজনীয়তা জোড়ালোভাবে থাকলেও সেই সময় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কোন বিকল্প পরিকল্পনা সরকারের যে নেই তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এখন কেন্দ্র আর রাজ‍্য, উভয় সরকারই একে অন‍্যে
র ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব‍্যস্ত। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ‍্য গতিতে। আপামর জনসাধারন, প্রশাসন, ও রাজনীতিকদের চুড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রথম ঢেউয়ের সময় ইটালীর “হাগ চাইনীজ” শ্লোগান ও কর্মকান্ডকে। এখনই এমন অবস্থা যে হাসপাতালে আর বেড পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বোঝার জন‍্য নীচের তথ‍্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে মোট আক্রান্ত – ৬,৫২,১১৬; এখন সক্রিয় রোগী – ৫৬,৬২১; মৃত – ১০,৫৪০। কিন্তু করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৯৬.৩ লাখ ((জনসংখ‍্যার ১০% মাত্র)। টীকাকরন শুরু হয়েছে ৮৪.৪ লাখের (জনসংখ‍্যার ৯% মাত্র)। এমতাবস্থায় রোজ কয়েকগুণ করে আক্রান্তের সংখ‍্যা বেড়ে এপ্রিল মাসের শেষে এমন জায়গায় যাবে যে তখন নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে, করোনার সঙ্গে লড়াই করা প্রশাসনের পক্ষে দুঃসাধ‍্য হয়ে যাবে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে আমরা ইটালী বা ব্রেজিলের মত অসহায় মৃত‍্যুমিছিল দেখতে থাকব। ১৩ই এপ্রিল থেকে ১৭ই এপ্রিল এই চারদিনে এক লক্ষের বেশী মানুষ দেশে আক্রান্ত হয়েছেন। এটা বিশ্বরেকর্ড!
আরেকটি কথা। এক বছর আগে এই কাগজেই প্লাজমা থেরাপীর কথা প্রথম লিখেছিলাম। তারপর বহু আক্রান্ত মানুষ প্লাজমা পেয়ে সুস্থ হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাদের রাজ‍্যে প্লাজমার আকাল দেখা দিয়েছে। প্লাজমা না পাওয়ার দায় কিন্তু স্বাস্থ‍্য দপ্তর এড়াতে পারে না। তারা সময় মত ব‍্যবস্থা গ্রহণ করলে এই অসুবিধা থাকত না। এর মধ‍্যে দুজন ভোট প্রার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় ঐ দুই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়ে গেছে। জানিনা, ভোট শেষ হতে হতে আরো কত প্রাণ ঝরে যাবে।
‘ল‍্যন্সেট’এ একটি গবেষণাপত্রে দেখলাম, সামাজিক দূরত্ব থাকলে ভাইরাস ছড়াতে পারে না এমন পুরোনো ধারণা ভুল। গবেষণাকারীদের বক্তব‍্য যে করোনা ভাইরাস হাওয়ায় ছড়ায়! এই তথ‍্য কিন্তু মানবজাতিকেই এক ভয়ংকর বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কারন, এই ধারনা সঠিক হলে মানুষ বন্ধ ঘরে কোয়ারেন্টিন থাকলেও নিরাপদ নয়। ফুসফুসের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে সর্বদা মাস্ক পরে থাকাও সম্ভব নয়। তবে বাঁচার রাস্তা কি? যদিও সত‍্যি বলতে কি, এই গবেষণাপত্র যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রথমতঃ, বদ্ধ ঘরে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেশী – পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলে না। অবশ‍্য খোলা জায়গায় ভাইরাস যে বেশীক্ষণ বাঁচে না তা প্রমাণিত। কিন্তু এই বায়ুবাহিত ভাইরাসের তত্ত্ব যদি সত‍্যি হয়, তাহলে মাস্ক কোন সুরক্ষা দিতে পারবে না।
এদিকে আবার ৪৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এখনো টীকাকরন শুরু না হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ হ্মুহু করে বেড়ে চলেছে। ৪৫ বছরের কম বয়সীদের মধ‍্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯০৩ জনের করোনা ধরা পড়ে। আর শুধু এপ্রিলের ১৫ দিনের মধ‍্যে এই সংখ‍্যাটা ১৭২৩৩ – রাজ‍্যের মোট আক্রান্তের ৪৮%! এই অবস্থায় জরুরী অক্সিজেন, রেমডিসেভির ১০০, এ‍্যাক্টিমেরা ৪০০। এগুলি সমস্ত হাসপাতালে পর্যাপ্ত স্টক রাখতে হবে। এছাড়া convalescent plasma ও monoclonal antibodies treatment এর জন‍্য আমাদের কোভিড হাসপাতালগুলির তৈরী থাকা উচিৎ। এছাড়া মৃদু থেকে মাঝারি স্তরের সংক্রমিত রোগীদের bamlanivimab ও eteservimab IV form এ পুশ করা যেতে পারে। FDA এটির অনুমোদন দিয়েছে। আদতে এগুলো সবই দেহে ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায্য করে। এর ফলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই যেমন তীব্রতর করা যাবে, তেমনি মৃত‍ু‍্যহার নামিয়ে আনতেও এই চিকিৎসা কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
এরমধ‍্যে একমাত্র আশার কথা – দুটি প্রতিষেধক টীকার ডোজ নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হওয়ার হার শতকরা পাঁচভাগের চেয়ে কম। আমাদের দেশে যে দুটি টীকা দেওয়া হচ্ছে, কোভ‍্যক্সিন আর কোভিশিল্ড – দুটিরই প্রথম ডোজের পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ১০-১৫ দিন বাদে এই প্রতিষেধক টীকা সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় হয়। এদিকে আমাদের রাজ‍্যে টীকা পাওয়া শুরু হয়েছে মাত্র ৯% মানুষের। সুতরাং টীকার পূর্ণ এফেক্ট পাওয়া মানুষের সংখ‍্যা অতি নগণ‍্য। মনে হয়, এ ব‍্যপারে প্রশাসন যথেষ্ট সক্রিয় নয়। তাদের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষের মধ‍্যে সচেতনতা জাগানোর প্রক্রিয়া চালু করার ব‍্যপারে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের যথেষ্ট খামতি আছে। এইসঙ্গে অপ্রিয় হলেও একটা সত‍্যি কথা বলা ভালো – দেরী হওয়ার আগে আমাদের সম্পূর্ণ লকডাউন ছাড়া বাঁচার কোন রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। যেভাবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ‍্যা বাড়ছে, গতবছর এর অনেক আগেই পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছিল। প্রান্তিক মানুষদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পৃথিবীর অন‍্যান‍্য দেশ, যেখানে এখনোলকডাউন চলছে, সেখানেও এই একই ব‍্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে। মনে রাখতে হবে,কজন মানুষ না খেতে পেয়ে মরেছে আর কজন মানুষ করোনায় মরেছে! রাজনৈতিক সদিচ্ছা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রই যেন ভোটযুদ্ধের মাঝে ভোঁতা হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় ভারতীয় রেল দেরীতে হলেও একটি বিজ্ঞপ্তি জারী করেছে যে মাস্কবিহীন অবস্থায় ট্রেনে ভ্রমণ করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ এবং ঐ যাত্রীর পাঁচশ টাকা অব্দি জরিমানা হতে পারে। পাব্লিকপ্লেসে সিগারেট খাওয়ার বিজ্ঞপ্তির মত এটিও শুধু বিজ্ঞপ্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এর যথার্থ প্রয়োগ হবে তা সময়ই বলবে। এদিকে রানিং স্টাফেরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। এখন WHO বলছে যে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে গোষ্ঠীসংক্রমণ হওয়া আর দু এক দিনের অপেক্ষা মাত্র।
আমাদের রাজ‍্যে এই সময় আট দফার ভোট ও রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল প্রমাণ করল যে, ভোট-রাজনীতির গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের জীবনের থেকেও বেশী মূল‍্যবান! প্রশাসন, আধিকারিক থেকে রাজনীতিবিদ সকলেই ভোট নিয়ে ব‍্যস্ত। রাজ‍্যের নিউজ চ‍্যনেলগুলি ভোটের সংবাদ পরিবেশনেই নিবেদিতপ্রাণ, করোনা সতর্কীকরন প্রচার দায়সারাভাবে সেরে নিলেই হল। এর খেসারত কিন্তু পরবর্তী সময়ে মারাত্মকভাবে দিতে হবে। কারন, একমাত্র টোটাল লকডাউন করোনার দাওয়াই হলেও কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনা করে সে পথ মাড়াবে না।
পরিশেষে বাঁচার রাস্তা হিসেবে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের কথা জানাচ্ছি। প্রথমতঃ, ঘরের বাইরে গেলে বা ঘরের মধ‍্যে বাইরের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার জন‍্য অন্তত ডাবল লেয়ার মাস্ক আবশ‍্যক। অত‍্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। বাইরে থেকে এলে পরনের যাবতীয় পোষাক সাবান দিয়ে কাচার ব‍্যবস্থা রাখুন। বিটাডাইন বা নিদেন পক্ষে নুনজল দিয়ে গার্গল করুন। তারপর সাবান দিয়ে স্নান করুন। বাইরে পরার জুতো আলাদা রাখুন। এরপর আপনার বডি ইমিউনিটির উপর নির্ভর করছে আপনি আক্রান্ত হবেন কি না।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় ব‍্যর্থতা কেন

     সত‍্যি বলতে কি, এখন আমাদের দেশের কোভিড পরিস্থিতি চিকিৎসা ব‍্যবস্থার হাতের বাইরে চলে গেছে। দেশের মানুষদের বাঁচাতে হলে শক্ত, অভিজ্ঞ ও যোগ‍্য হাতে এর মোকাবিলা করা প্রয়োজন। দুখেঃর সঙ্গে বলতে হয় যে তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। টিভি এবং সোশ্যাল মাধ‍্যমের দায়িত্ব পালনেও এ ব‍্যপারে কোন স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। বিশেষতঃ, আমাদের রাজ‍্যে স্বাস্থ‍্যব‍্যবস্থা তার পরিচালনার দায়িত্ব যার হাতে, সেই স্বাস্থ‍্যভবনের ভূমিকা  সমালোচনার ঊর্ধে নয়। করোনা মোকাবিলায় পরামর্শ দিতে পারার মত পারদর্শিতা যাদের সবচেয়ে বেশী, তারা হলেন চিকিৎসকদের মধ‍্যে ভাইরোলজিষ্ট আর চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ‍্যে বায়োটেকনোলজিষ্টদের একটি অংশ। আমাদের রাজ‍্যে করোনা মোকাবিলায় যত বিশেষজ্ঞ দল তৈরী হয়েছে তাতে এদের স্থান হয়নি। বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে যে ডাক্তারবাবুরা আসেন তাদের মধ‍্যে বিশেষভাবে থাকেন গ‍্যাস্ট্রোএন্টারোলজিষ্ট আর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জেনরা! থাকে কিছু অভিনেতা/অভিনেত্রী আর সর্বঘটে নৈবেদ‍্যের কলার মত কিছু মানুষ যাদের সংবাদ মাধ‍্যম আরোপিত বিশেষজ্ঞ "বুদ্ধিজীবি" সংজ্ঞা! এদের পরামর্শে আমজনতার কি উপকার হচ্ছে তা কেউ জানেনা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত আছে ক্লিনিশিয়ান ডিগ্রিধারী কিছু স্তাবক আমলার দল যারা স্বাস্থ‍্যভবন আলো করে রাজ‍্যের মানুষের স্বাস্থ‍্যের দেখভাল করতে সম্পূর্ণ ব‍্যর্থ।
     এই ধরনের RNA ভাইরাসের ধর্ম অনুসারে দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ যে আসবে সে সম্পর্কে এইসব বিশেষজ্ঞ (!) সরারকে কোন সঠিক পরামর্শ দিয়েছিলেন কি? এর জন‍্য যে পরিকাঠামো তৈরী করার কথা তা তৈরী ত করেননি, অধিকন্তু আগের পরিকাঠামোর অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাদের উৎসবের মরসুমে সংযম দেখানো মানুষজনকে প্রলুব্ধ করার জন‍্য রেষ্টুরেন্ট, সিনেমা হল, শপিং মল ও অন‍্যান‍্য বিনোদনের জায়গা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হল। গণপরিবহনে বাস, অটো সবেতে সমস্ত বাধানিষেধ সরিয়ে নেওয়া হল। এমনকি স্কুল,কলেজ খুলতে শুরু করল। এইসব বিশেষজ্ঞরা এমন কোন প্রমান দেখাতে পারবেন যে, তাঁরা সরকারকে দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক করে পরিকাঠামো ভাঙ্গার পরিবর্তে আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন? না। অনেক দেশ যেমন বেলজিয়াম, হল‍্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং আরো বহু দেশ লকডাউন অব্দি তোলেনি। এই বিশেষজ্ঞরা কি এমন প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড পরিকাঠামো যখন রোগীর অভাবে বন্ধ করতে হচ্ছে তখন তাদের পরবর্তী ঢেউয়ের ব‍্যপারে সতর্ক করে পরিকাঠামো চালু রাখতে বলেছেন! রেমডিসেভিরের (স্বল্প থেকে মধ‍্যমমানের কোভিড সংক্রমণের প্রশমণে ব‍্যবহার করা হয়) স্টক যে হাসপাতালগুলিতে দ্রুত কমে যাচ্ছে, সরকারী স্টক দ্রুত নামছে,তখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা মাথায় রেখে তা বাড়ানোর কথা কোন আমলা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন কি?  এইসব প্রাথমিক কাজগুলোই স্বাস্থ‍্যভবনের আমলারা করে উঠতে পারেননি।
     দেশের অক্সিজেনের মোট চাহিদা দিনপ্রতি ৭৫০০ মেট্রিক টন। এই মূহুর্তে কোভিড পরিস্থিতিতে অক্সিজেনের চাহিদা দিনপ্রতি ৫৫০০ মেট্রিক টন। অভাবরয়েছে অক্সিজেন ট‍্যাঙ্গার আর সিলিন্ডারের। তার কারন খালি ট‍্যাঙ্কার এবং সিলিন্ডার বসিয়ে রাখার যুক্তি নেই বলে একটি নির্দিষ্ট সংখ‍্যার বেশী এগুলো রাখা যায় না। সাধারণ সময়ে এভাবে চলে যায়, কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসার কথা ধরে নিয়ে যে প্রশাসন যত তাড়াতাড়ি এই পরিকাঠামো উন্নত করতে পারবে তারাই সফল। অন‍্যেরা ব‍্যর্থ। সেই দিক দিয়ে দেখলে দেশের আরো কয়েকটি রাজ‍্যের মত পশ্বিমবঙ্গও ব‍্যর্থ। উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল,তেলেঙ্গানা তাদের পরিকাঠামো দ্রুততার সঙ্গে উন্নত করছে। সেখানে আমরা বাজিয়ে চলেছি কেন্দ্রের বঞ্চনার ভাঙ্গা রেকর্ড। এটা রাজনীতিকদের বক্তব‍্য হতে পারে, স্বাস্থ‍্যভবনের আমলাদের নয়। এমনকি ন‍্যশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মত জায়গায়ও অক্সিজেন মহার্ঘ! এ রাজ‍্যেও দিল্লী এবং অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের মত অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারীতে দর সিলিন্ডার প্রতি দশ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, একটা সিলিন্ডারের অক্সিজেন গড়ে ঘন্টা ছয়েক চলতে পারে। এই কালোবাজারী বন্ধ করতে না পারা জঘন‍্য অপরাধ। এইসব কালোবাজারীদের সংক্ষিপ্ত বিচারে প্রাণদন্ডের বিধান যুক্তিযুক্ত।
     এবার প্রসঙ্গ পাল্টানো যাক। ভোটযুদ্ধের রাজনৈতিক উত্তাপে বাঙ্গালী নিজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন‍্যতার পরিচয় আগেই দিয়েছে। এবার কোভিডের বাড়বাড়ন্তের সময় তার অহংকারী নির্বুদ্ধিতার পরিচয় রাখছে। আমাদের রাজ‍্যের 'রেডিমেড' বুদ্ধিজীবীর দল, পেশাদার রাজনীতিকরা যেভাবে কোভিডবিধি ভেঙ্গেছেন, যেভাবে বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যম বারবার তাদের দেখিয়েছে, তাতে এক বড় অংশের মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে যে এরা যদি কোভিডবিধি না মানে তবে তাদেরও তা মানার দরকার নেই। আমি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন‍্য সংক্ষিপ্ত সরকারী পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
       এই লেখার সময় দেশে একদিনে আক্রান্ত :৩৪৭ হাজার; মৃত: ২৬২৪। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে আক্রান্ত :১২৮৭৬ ; মৃত: ৫৯। ভ‍্যাকসিন পেয়েছেন দেশের ১.৫% (২০১৯৭১২২)  মানুষ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ১% মানুষ। এই সময় ভাইরাসের চেন ভাঙ্গার জন‍্য দযকার ছিল ৭ থেকে ১০ দিনের পূর্ণ লকডাউন। এই দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনটাই মনে হয় আমাদের কেন্দ্র বা রাজ‍্য সরকারের নেই। খন্ডিত শকডাউনে চেন ভাঙ্গা সম্ভব নয়, শুধু সাধারন মানুষের দুর্দশা বাড়বে মাত্র।
     এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব‍্যপারে কিছু টেকনিক্যাল কথা সাধারণ মানুষের বোঝার মত করে বলতে চেষ্টা ঈরি। প্রথমতঃ করোনা ভাইরাসের পরিবর্তিত জিন মিউটেশান নিয়ে আগে একাধিকবার আলোচনা করেছি। এখন একটা কথা অনেকেই বলছে, ডাবল মিউট‍্যান্ট ভ‍্যারিয়েন্ট, ট্রিপল মিউট‍্যান্ট ভ‍্যারিয়েন্ট ইত‍্যাদি। আমাদের দেশে এখনো অব্দি নয় প্রকারের মিউট‍্যান্ট করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। ভাইরাসের ধর্ম বোঝা যায় তার জিনোম সিকোয়েন্মিং দেখলে। এই জিনোম সিকোয়েন্মিংয়ে যখন কোন পরিবর্তন হয়, তখন তাকে মিউট‍্যান্ট বলে। যখন একটি জায়গায় পরিবর্তন হয়, তখন সেটা সিঙ্গল মিউট‍্যান্ট; দুটি জায়গায় হলে তাকে ডাবল মিউট‍্যান্ট আর তিনটি হলে তাকে ট্রিপল মিউট‍্যান্ট বলে। এইভাবে জিনোমের পরিবর্তনের ফলে করোনা ভাইরাসের যে  নতুন জ্ঞাতি পাওয়া গেল তাকে ভ‍্যারিয়েন্ট বলে। এই ভ‍্যারিয়েন্টগুলি যখন আগের ভাইরাসের থেকে চরিত্রগত পরিবর্তন দেখায়, যেমন সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্রুত সংখ‍্যাবৃদ্ধি (replication), বিভিন্ন  অর্গ‍্যানকে আক্রমণ করার ক্ষমতা, মৃত‍্যুহার বৃদ্ধি ইত‍্যাদি, তখন তাকে বলে নতুন স্ট্রেইন। আমাদের দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে ব্রিটেন স্ট্রেইন (B.1.1.7)। এছারা সাউথ আফ্রিকা স্ট্রেইন, ব্রাজিল স্ট্রেইনও পাওয়া গেছে। প্রথমঢেউয়ের চার পাঁচটি নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট দ্বিতীয় ঢেউয়ে পাওয়া গেছে। এরমধ‍্যে সিঙ্গল মিউট‍্যান্ট বেশী, ডাবল ল মিউট‍্যান্ট ও একটি ট্রিপল মিউট‍্যান্ট পাওয়া গেছে। এদের ধর্ম যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই নোভেল করোনা ভাইরাসের থেকে আলাদা, আমাদের ভ‍্যকসিন এই নতুন ভাইরাসের উপর কতটা কার্যকরী হবে তা কেউই সঠিকভাবে বলার জায়গায় নেই। এখানেই কথা হচ্ছে যে, ভ‍্যকসিনেশানে হয়ত প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে কিন্তু তা full proof না হওয়ায় কোভিড আচরণবিধিতে কোন ঢিলেমি দেওয়া চলবে না। ট্রিপল ভ‍্যারিয়েন্ট, যেটা আমাদের রাজ‍্যে পাওয়া গেছে, সেই (B.1.618) ভাইরাসের জন‍্য ভ‍্যাকসিন কতটা কার্যকরী হবে তাতে সন্দেহ আছে।
     এদিকে, আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল অবস্থার মধ‍্যে আমেরিকা, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর  ও হংকং নতুন করে ভারত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। উল্লেখ‍্য, বেশীরভাগ ইউরোপের দেশ ২০২০র লকডাউনের সময় ভারতীয়দের উপর ভ্রমণে যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল তা বহাল রেখেছে। আবার টীকাকরনের ঢক্কানিনাদে প্রশাসনিক অপদার্থতা ও রাজনীতিকরনের বিষ মিশে গিয়ে পরিস্থিতি ঘুলিয়ে দিয়েছে। টীকাকরন ক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড অন‍্য অনেক রাজ‍্যের থেকে ভালো, যদিও আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। যেমন এই মূহুর্তে ৪৫ বছরের ঊর্ধে সব নাগরিকের টীকা নেওয়ার কথা। তার জন‍্য জনপ্রতি দুটি ডোজ ধরলে টীকা লাগে ছয় কোটি। কেন্দ্র টীকা পাঠিয়েছে এক কোটি। অর্থাৎ  প্রয়োজনের ১৬% মাত্র। সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গে টীকাকরনের হার ৮% (দুটি ডোজ ধরে) এর বেশী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একটি করে ডোজ নিয়েছেন প্রায় ৯% মাত্র। সুতরাং, স্বাস্থ‍্যকর্মী, প্রতিরক্ষা, পুলিশ, ভোটকর্মীদের এই টীকা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেওয়ার পরেও মনে হয় কিছু টীকা যাদের পাওয়ার কথা নয়, তারাও পেয়েছেন। আমাদের কোভিড ভ‍্যাকসিন নেওয়ার সময় একটি ফর্মে ব‍্যক্তিগত তথ‍্য নথিভুক্ত  করতে হয়েছে। সুতরাং ভ‍্যাকসিন সংক্রান্ত সব তথ‍্য সরকারের কাছে থাকার কথা। তবে, এ রাজ‍্যে টীকার ভায়াল বা ডোজ নষ্ট হয়নি। সেটা প্রশংসনীয়।
       অব‍্যবস্থার ছাপ সর্বত্র। এক রাজ‍্যের অক্সিজেন সংকটের মধ‍্যে সেই রাজ‍্যে উৎপন্ন অক্সিজেন যাচ্ছে অন‍্য রাজ‍্যে। দিল্লীতে কোন অক্সিজেন প্ল‍্যান্ট নেই। সেখানকার মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। তার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের অব‍্যবস্থার জন‍্য নয় কি? এটা নিশ্চিতরূপে প্রশাসনিক ব‍্যর্থতা। আবার আমাদের রাজ‍্যে দেখছি কোভিড বেডে ভর্তির জন্র মানুষ কি কি করবে, স্টেপ বাই স্টেপ, সেই গাইডলাইন সরকারের স্বাস্থ‍্যদপ্তর থেকে বহুল প্রচারিত নয়। আমার মনে হয়, দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করার জন‍্য কেন্দ্র ও রাজ‍্য, কোন প্রশাসনই তৈরী ছিল না। দেরীতে হলেও কেন্দ্রের ঘুম ভেঙ্গেছে। তবে রাজ‍্য প্রশাসনের কাজ করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুইই না থাকায় তারা দোষারোপ করেই কর্তব‍্য সারছে।
      রেল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেলের চত্বরে মাস্ক পড়া বাধ‍্যতামূলক করেছে - না পড়লে জরিমানা আদায় করছে। কিন্তু রাজ‍্য পরিবহন, বিশেষতঃ বাস, মিনিবাস, অটোরিক্সার মত গণ পরিবহনে এবং রাস্তাঘাট, বাজারে মানুষ মাস্ক ত দূরের কথা, অন‍্য কোভিডবিধিও মানছে না। এই ব‍্যপারে রাজ‍্য সরকারের কোন হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের কোভিড সংক্রান্ত মিটিংয়ে,  যা প্রধানমন্ত্রীর পৌরহিত‍্যে হয়েছে, হাজির না হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি করোনা থেকে রাজ‍্যের মানুষকে রক্ষা করতে চান না, করোনা নিয়ে রাজনীতি করতেই তিনি বেশী আগ্রহী।
       টীকাকরন প্রসঙ্গে বললে এর পিছনে রাজনীতিকদের নোংরামিটাও পরিস্কার বোঝা যাবে। প্রথমে আসি বহুল ব‍্যবহৃত কোভিশিল্ডের কথায়। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণ, পুণের সিরাম ইন্সটিটিউট, অক্সফোর্ড অ‍্যস্ট্রাজেনিকার গবেষণালব্ধ এই টীকা বানানোর জন‍্য চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী টীকা বিক্রির ৫০% টাকা  অ‍্যস্ট্রাজেনিকা পায়। কেন্দ্রীয় সরকারকে সিরাম ইন্সটিটিউট জানায় যে তারা টীকার প্রতি ডোজ ১০০০ টাকা দাম রাখবে। এতে তারা কার্যকরী দাম পাবে ৫০০টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার ঐ দামে কিনতে চায় না। এদিকে তখন সিরাম ইন্সটিটিউট টীকার জন‍্য বিভিন্ন দেশ থেকে বরাত পেল। ফলে সেই প‍্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন‍্য তাদের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়ানোর দরকার হল। তখন কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কোন সিকিউরিটি ছাড়া তিন হাজার কোটি টাকা সফ্ট ঋণ দিল। আর একই সঙ্গে চুক্তি করল যে, সিরাম ইন্সটিটিউট আগামী জুলাই মাসের মধ‍্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে এগারো কোটি ডোজ টীকা প্রতিটি ১৫০ টাকা দরে দেবে। তবে তারপর তারা বাজারে ৬০০ টাকা  প্রতিডোজ দামে এবং সরকারকে ৪০০টাকা দামে বেচবে। না হলে সিরাম ইন্সটিটিউট লোকসানে ব‍্যবসা করতে পারবে না। এইভাবে ভারত বায়োটেকের সঙ্গেও কেন্দ্রীয় সরকার একই দামে টীকা কেনার চুক্তি করে। তাদের ১৫০০ কোটি টাকার সফ্ট লোন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার হিসেব করে দেখে যে ডোজ প্রতি রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবহণ, ওঅন‍্যান‍্য খরচখরচা মিলিয়ে ১০০টাকা পড়ছে। সেজন‍্য তারা ডোজপ্রতি দাম ধরে ২৫০ টাকা।মনে রাখতে হবে, এই দাম আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত। তারপর সিরাম ইন্সটিটিউট ডোজ প্রতি১০০০ টাকা দামে সিরাম বেচতে পারবে। তখন আর সরকারের সঙ্গে তার কোন চুক্তি থাকবে না। দেশের বিপুল সংখ‍্যর মানুষের কথা মাথায় রেখে বলা যায় যে সরকারের পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশেষতঃ কোভিড ভ‍্যাকসিনের মত জিনিসের, দাম নিয়ন্ত্রণে বেসরকারী কোম্পানীকে লোকসানে বিক্রি করতে বাধ‍্য করা যায় না। শুধু মাত্র মূর্খ ধান্দাবাজ রাজনীতিকরা এমন কথা বলে বাজার গরম করতে পারে মাত্র। বিনা পয়সায় সব মানুষকে ভ‍্যাকসিন দেওয়ার কথা যারা বলছেন তাদের সবিনয়ে বলি, আপনাদের সরকার এই টাকার বরাদ্দ রেখেছেন কি? সরকারী টাকা মানুষের করের টাকা। বিনা পয়সায় ভ‍্যাকসিন দিলে তার বরাদ্দের টাকাটা কোথা থেকে আসবে সেটাও একই সঙ্গে জানাবেন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণ থেকে টীকা কিনে এবং আনুসঙ্গিক খরচের সংস্থান না রেখে, বাজেট তৈরী না করে এ ধরনের কথা বলা ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছু নয়

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানের প্রাক্তণ ডিরেক্টর ও সায়েন্টিফিক কন্সালটেন্ট