করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের উত্তরোত্তর আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধিতে মনে হল, “মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” রামায়ণের এই বিখ্যাত উক্তিটি। সত্যি, কোভিড১৯ এর সংক্রমণ যখন শুধু পড়তির দিকেই নয়, দৈনিক সুস্থতার হার আক্রান্তের হারের থেকে অনেক বেশী, তখন আমজনতা মনে করতে শুরু করলেন, যাক্ করোনা এতদিনে বিদায় নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেশের মানুষদের টীকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হল।ব্যস,আর যায় কোথায়! সবাই ভাবতে শুরু করলেন যে টীকা নেওয়ার পরমূহুর্ত থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।; এমনকি তাঁদের আর কোন সামাজিক নিরাপত্তার বিধিনিষেধের দরকার নেই। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচটি রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে গেল। শারীরিক দূরত্ববিধি চুলোয় গেল, ভিড়, জমায়েত সবই করোনাপূর্ব পরিস্থিতির মতই চলতে লাগল! বারবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হতে লাগল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!
এর ফলও আমরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছি। আমি গত বারো দিনের শুধু পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্তের সংখ্যা দিচ্ছি।
২৫শে মার্চ: ৫১৬
২৬শে মার্চ: ৬৪৬
২৭শে মার্চ: ৮১২
২৮শে মার্চ: ৮২৭
২৯শে মার্চ: ৬৩৯
৩০শে মার্চ: ৬২৮
৩১শে মার্চ: ৯৮২
১লা এপ্রিল:১২৭৪
২রা এপ্রিল:১৭৩৩
৩রা এপ্রিল:১৭৩৩
৪ঠা এপ্রিল:১৭৩৬
৫ই এপ্রিল:১৯৬১ (শুধু কোলকাতায় ৬০৬)
তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বুলেটিন
এখন মনে হচ্ছে মানুষ, বিশেষতঃ আমাদের রাজ্যের মানুষমাথা খাটিয়েচলার চেয়ে মন দিয়ে বিচার করেন! এই কথা এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি কারন, আগে বহুবার অনেকভাবে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ করোনার টীকা নিলেই করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে - এমন কোন দাবী টীকা কোম্পানী বা ডাক্তার, কেউই করেননি। সাধারণভাবে টীকার (কোভিশিল্ড এবং কোভ্যকসিন) দুটি ডোজ চার থেকে আট সপ্তাহের ব্যবধানে নেওয়ার পরে আরো দু সপ্তাহ বাদে ভ্যকসিন গ্রহীতার দেহে করোনা মোকাবিলার ইমিউন রেসপন্স তৈরী হবে। তাও এই টীকা শতকরা পঁয়ষট্টি থেকে আশি শতাংশ কার্যকর হতে পারে। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হওয়ার দুসপ্তাহ পরেও আমরা কখনোই সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান, স্যানিটেশান এবং শারীরিক দূরত্ববিধি যেন মেনে চলি।
আরেকটি কথা। কোভিড১৯ RNA ভাইরাস হওয়ার কারনে এর পরিবর্তিত জিন মিউটেশান হয়। আবার টীকার ইমিউন রেসপন্স ভাইরাসের একটি বা দুটি বা তিনটি নির্দিষ্ট স্ট্রেইনকেই সণাক্ত করতে পারে। সরল বাংলায় বললে বলতে হয়, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা যে পরিবর্তিত জিন মিউটেড ভাইরাসগুলি পাচ্ছি, তাদের সবাইকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কোন বাজার চলতি ভ্যকসিনের নেই। সুতরাং টীকাকরন সম্পূর্ণ হলেই আমরা করোনামুক্ত থাকবো - এমন ভাবার কারন নেই। তব, শৃঙ্খলাপরায়ণভাবে যদি সাধারণ মানুষ কোভিড আচরণবিধি মেনে চলে আর সঙ্গে সঙ্গে টীকাকরণ চলতে থাকে তাহলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে।
এবার একটি অপ্রিয় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। পাঁচটি রাজ্যে এখন সাধারণ নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচন মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে। আমরা দেখছি কোভিডবিধির বিন্দুমাত্র মানার ব
আলাই নেই। না নেতাদের, না কর্মীদের! আচ্ছা, এটা কি সত্যিই মানুষের স্বার্থে! যে হারে আমাদের রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা লকডাউনের মাঝামাঝি পর্বকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। মহারাষ্ট্রে লকডাউন শুরু হয়েছে। অনেক জায়গায় হোটেল রেষ্টুরেন্ট বন্ধ। এখানে সব খোলা! সিদ্ধান্তগ্রহনকারীরা ভোট যুদ্ধে ব্যস্ত! মানুষ মরে হেজে যাক। তাতে কারোর কিছু যায় আসে না। মনে হচ্ছে, করোনার মৃত্যু মিছিল বড় কথা নয়, বড় কথা হল নির্বাচন, যেখানে কোন নেতারা আগামী পাঁচ বছর রাজ্যের মধুভান্ড দখল করবেন তা নির্ধারন করাই করোনা বিধ্বস্ত রাজ্যের আম আদমীর আশু ও একমাত্র কর্তব্য। নেতাদের এই দেশ সেবার নামে আত্মসেবার আদিখ্যেতা বড়ই দৃষ্টিকটু। মানুষ অসহায়।
কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন দেশ লকডাউন ও অন্যান্য restrictions আনছে। বাদ আমরা। কেন? উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আমার জিজ্ঞাসা। নির্বাচন কমিশন কোন রকম কোভিড restriction মানতে বাধ্য করতে পারেনি বা করেনি।
আমার ধারনা, যখন ২৯শে এপ্রিল নির্বাচন শেষ হবে তখন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ার জায়গায় চলে যাবে।
আমাদের দেশে এই মূহুর্তে সক্রিয় করোনা রোগী: ৭৫৪৯৮৪, এর মধ্যে গুরুতর অসুস্থ : ৮৯৪৪, দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু : ৮৩জনের। পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় রোগী : ১৯২৪৮।
তথসূত্র : ওয়ার্ল্ডোমিটার।
৫ই এপ্রিল, দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা : ১০৩৫৫৮। প্রথম দফায় গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ বিশহাজার থেকে একলাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আশি দিন। এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে এই সংখ্যা পেরোতে লাগল পঁচিশ দিন। সুতরাং দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই সংক্রমণ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারন হিসেবে নিঃসন্দেহে মানুষের কোভিডবিধি না মানা, সরকারী তরফে লকডাউন ও কন্টেনমেন্ট জোন না করার ঢিলেমীকে কাঠগরায় তোলা যায়। অনতিবিলম্বে এই পদ্ধতিগুলি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
টীকাকরন এই দ্বিতীয় ঢেউকে কতটা প্রশমিত করতে পারবে সেসম্বন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা স্পষ্টতই সন্দিহান। সেজন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অধুনা কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি নতুনভাবে অন্বেষণ করছেন। এরমধ্যে একটি হল আমাদের দেহের ইমিউনিটির উপর ভরসা করা। যদি তা সত্ত্বেও ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তা ২০১৯-২০ সালের মত মৃত্যু মিছিল তৈরী করবে না। এর কয়েকটি কারনের মধ্যে একটি যেমন আমাদের দেহে ভাইরাসের এ্যান্টিজেন সণাক্ত হলেই দ্রুত অধিক পরিমাণে এ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে ভাইরাস নিধনে নামবে, তেমনই ভাইরাস তারজিন মিউটেশানগত কারনে ক্রমশঃ মানবদেহে ক্ষতি করার ক্ষমতা হারাতে থাকবে। কিন্তু আরেকটি বিপদ হচ্ছে, এই ভাইরাস মানবদেহের ভাইটাল কয়েকটি অর্গান, যেমন কিডনি, লিভার, লাংস,হার্ট ও নউরন সিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে পারে। ফলে, ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু না হলেও রোগীর আয়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারনে এই ভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় একটি নতুন দিকের সন্ধান করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার বড় একটি অসুবিধার জায়গা হল, একসঙ্গে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্গ্যানের সংক্রমিত হওয়া – যা অতি দ্রুত রোগীর প্রাণ সংশয়ের কারন হয়। প্রতিটি অর্গ্যানকে একসঙ্গে বাঁচানোর লড়াই চালানো ডাক্তারদের পক্ষে দুঃসাধ্য। সেজন্য নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির সন্ধানের পথে আশার আলো দেখা গেছে। সেটি হচ্ছে ফেরোপটোসিস (ferroptosis) – এটি একটি নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া যা সাধারণ কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া apoptosis থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ফেরোপটোসিস দেহের আয়রনের উপর নির্ভরশীল যা লিপিড পারক্সাইড জমায় সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যন্সারের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এখন কোভিড-১৯ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে চলেছে বলেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারনা। আসলে, এই পদ্ধতিতে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত একাধিক অর্গ্যানের কোষগুলিকে বেছে বেছে নষ্ট করার ক্ষমতা থাকায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অনেকটাই সুবিধা করবে। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগের সার্থকতা কতটা তা ভবিষ্যতই বলবে