ভাবের ঘরে চুরি : রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গ

সারা দেশের মধ‍্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এর জন‍্য কোন “ইজম”এর দলদাস অর্থনীতিবিদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। যাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উন্নয়নের মাপকাঠি করেছে সেই বিভিন্ন “প্রকল্পে” “অনুদান” পাওয়া মানুষের সংখ‍্যা এই রাজ‍্যেই সর্বাধিক! এমনকি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রজাপতি’ সিনেমায় এইসব “সাথী” প্রকল্প প্রাপকদের নিয়ে তির্যক মন্তব‍্য করা হয়েছে! এছাড়া আরেক মাপকাঠি – রাজ‍্যে উৎপাদনকারী সংস্থার জিএসটি প্রদানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান অন‍্য রাজ‍্যগুলির তুলনায় নীচের সারিতে।
এই দুই মাত্রার মাপকাঠিতে বলা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দৈন‍্যতা অত‍্যন্ত ভয়াবহ। এ ব‍্যাপারে সমালোচনার রাজনীতিতে কারুর কোন লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের উত্থানের নেপথ‍্যে কেন্দ্রের বঞ্চনা অর্থাৎ তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের বিমাতৃসূলভ আচরণের প্রচার অনেকটাই দায়ী। কিন্তু, আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এই বামপন্থীরাই সেই কংগ্রেস (তাদের নীতিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন না হলেও) দলের সঙ্গে মিলিতভাবে রাজ‍্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের মিলিজুলি রাজনীতি করেছে! আবার বর্তমানে দেশের ক্ষমতায় থাকা জাতীয়তাবাদী দল একই সঙ্গে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসুকে আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রনেতা হিসাবে মানে! এ ত সুবিধাবাদী রাজনীতি! যাদের মত ও পথ বিপরীতমুখী, তাদের মধ‍্যে মেলবন্ধনের চেষ্টা সুবিধাবাদের রকমফের মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থার চিত্র শুধু রাজ‍্যের মানুষের নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের পক্ষে ভয়াবহ। শিক্ষা-দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ আধিকারিক, যারা শিক্ষা-দপ্তরে শিক্ষকসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সকলেই জেলে! রাজ‍্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জেলে! এদের অপরাধের তদন্ত চলছে উচ্চ- আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের দ্বারা। সারা দেশ জানে, এরা সবাই শিক্ষক নিয়োগ সহ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে মেধা ও পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের প্রায় সকলের হেফাজত থেকে হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশ। একটি ব‍্যাপারের উল্লেখ করতে হয় যেটাকে সংবাদ-মাধ‍্যম ও সামাজিক-মাধ‍্যম গুরুত্ব দিচ্ছে না! তা হল, অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেসঙ্গে এ ধরনের অপরাধ সমাজের জন‍্য অত‍্যন্ত ঘৃণ‍্য এবং উদ্বেগজনক অপরাধ! সমাজে দুটি সুদৃঢ় স্তম্ভের উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি – শিক্ষক, যার কাজ চরিত্র গঠন সহ শিক্ষার আলোকে সমাজকে শিক্ষিত করা এবং চিকিৎসক, যাদের হাতে সমাজের স্বাস্থ‍্য নির্ভর করে। যদি শিক্ষক নিয়োগে টাকার বিনিময়ে জাল শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তবে পুরো শিক্ষা ব‍্যবস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। তার অবিসম্বাদী ফল হল পুরো জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া। কারন, শিক্ষাই পশুর সঙ্গে মানুষের তফাৎ গড়ে দেয়। এই দুর্ণীতিতে সমাজে শিক্ষকদের এবং সেইসঙ্গে রাজ‍্যের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার গ্রহণযোগ‍্যতাই কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা রাজ‍্যের শাসন-ব‍্যবস্থার চরম অবক্ষয়ের লক্ষণ। রাজ‍্যের প্রাচীনতম এবং সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে আইন না মানার কারনে ঐ উপাচার্যকে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে বরখাস্ত হতে হয়। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ব‍্যাপারও আদালতে বিচারের অপেক্ষায়। শিক্ষা-বিভাগে এই মূহুর্তে একজন শিক্ষা-মন্ত্রী থাকলেও জনমানসে রাজ‍্যের শিক্ষা-দপ্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান শিক্ষা-মন্ত্রীর আমলে সাম্প্রতিকতম শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার দুর্ণীতি ও অনিয়মের প্রমাণ সংবাদ-মাধ‍্যমে প্রকাশিত হওয়ায় দপ্তরের নতুন ‘মাথা’দের বিশ্বাসযোগ‍্যতাও তলানিতে। এ ব‍্যাপারেও ধরা পড়েছে রাজ‍্যের শাসকদলের এক “নেতা”! এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের কাজকর্মে ঢিলেমির জন‍্য উচ্চ-আদালতের একাধিক ন‍্যায়াধীশ বারংবার তাদের তিরষ্কার করেছেন! তবু তারা নির্বিকার! এটা তখনই সম্ভব যখন এই তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদ্বয় বিশেষ কোন কারনে তদন্তে ঢিলে দিতে বাধ‍্য হয়! মনে রাখতে হবে, যদিও তদন্ত চলছে আদালতের নির্দেশে, এই সংস্থাদের প্রশাসনিক কন্ট্রোল কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। আবার শিক্ষা – সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র-রাজ‍্য যৌথ দায়িত্বে থাকায় রাজ‍্যের শিক্ষা-দপ্তরের এমন হালের পরেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের এমন ঢিলেমি নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এখনো পযর্ন্ত যে অভিযুক্তদের হেপাজতে নেওয়া হয়েছে তারা সকলেই রাজ‍্যের শাসকদলের নেতা বা নেতা-নেত্রী ঘনিষ্ঠ। সুতরাং এই দুর্ণীতিতে শাসদলের নেতা-নেত্রীর যোগ যেমন প্রমাণিত, তেমনি রাজ‍্যের বিরোধী দল, যারা কেন্দ্রের শাসক দল, তাদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাদের এমন ঢিলেমির দায় কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়ার রহস‍্যময় ইঙ্গিত দেয়!
শুধু শিক্ষা-দপ্তরের ক্ষেত্রেই নয়, অন‍্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও – যেমন কয়লা পাচার কেলেঙ্কারী, অবৈধ বালি পাচার, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গরু পাচারের মত তদন্তেও ঢিলেমির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে! রাজ‍্যের দুর্ণীতির বিরুদ্ধে পুরো অনুসন্ধান প্রক্রিয়াই যেন দুধ-ভাত খেলা হয়ে যাচ্ছে! এতে শুধু এই সংস্থারাই নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। হয়ত, কেন্দ্রে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতাদের হিসাব-নিকাশ বলছে – আগামী ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে কয়েকটি রাজ‍্যে কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে অনুমান করে কেন্দ্রের শাসক দল পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী! মনে হয়, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিরোধী দলের রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী!
সারা দেশে অনুদান রাজনীতির প্রভাব কম-বেশী থাকলেও তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক। “শ্রী” যুক্ত এবং “শ্রী” হীন অনুদান রাজনীতির কারনেই রাজ‍্যের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু এ রাজ‍্যে বাণিজ্যিক লগ্নীর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম, সেজন‍্য পশ্চিমবঙ্গে অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণের চাহিদা প্রায় নেই! তা সত্ত্বেও এখানে অবকাঠামো উন্নয়ণ দুরের কথা, রক্ষণাবেক্ষণ পযর্ন্ত ঠিকমত হচ্ছে না। আসলে এই রাজ‍্যে এত বেশী দুর্ণীতির অভিযোগ, তার কারনে এখানে লগ্নিকারীরা আসতে সাহস পাচ্ছেন না। সকলের বক্তব‍্য, রাজ‍্যে লগ্নি করার পর রাজনীতির গ‍্যাঁড়াকলে ফেঁসে যেতে হবে না ত! প্রকৃষ্ট উদাহরণ – সিঙ্গুরে টাটাদের পশ্চাদপসরন।
এমন পরিস্থিতিতে চাকরি-বাকরি থেকে ধরে ব‍্যবসা-বাণিজ‍্যে রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরি বিক্রি ও যে কোন প্রাপ‍্য সার্ভিসের বিনিময়ে ‘কাটমাণি’ নেওয়ার অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যেটা স্বাভাবিক পরিণতি, সেদিকে যদি রাজ‍্যটা চলে যায় তবে তার দায় কার? অর্থনৈতিক বিকাশে বারবার বাধা ধীরেধীরে পুরো সমাজকে অসহিষ্ণু অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয় – যার খন্ডহার এখন বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। একে “গোষ্ঠী সংঘর্ষ” বা “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বলে কতদিন ধামাচাপা দেওয়া যাবে! এইসঙ্গে একটি ব‍্যাপার খেয়াল রাখা দরকার – পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়েছে এক বিশেষ ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে এবং জন্মের পর থেকেই এই রাজ‍্যের মানুষকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত রেখে, ধর্মীয় “ইজম” এর ধোঁয়া তুলে কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয়ই রাজনৈতিক ফয়দা তুলেছে। একটি ব‍্যাপার লক্ষণীয় – এই রাজ‍্যে সর্বদা সংসদীয় রাজনীতিতে শাসক ও বিরোধী – দুই ভাগে মানুষের সমর্থন বিভক্ত থেকেছে। অথচ, প্রথমে কংগ্রেস ও তারপর যুক্তফ্রন্টের শাসনকালের পর রাজ‍্যের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। কারন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই রাজ‍্যে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন কায়েম হওয়ার পর তাদের দুটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের থেকে পৃথক অবস্থানে নিয়ে গেল। তারা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে শস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতির দিকে paradigm shift করল। প্রথমে কৃষি-জমি বিল এনে রাজ‍্যের সব চাষ-আবাদের জমিকে ভেঙ্গে দিল এবং রায়তদের জমির মালিকানা পাওয়ার আইনের ফলে বড় ও একলপ্তে থাকা কৃষিজমি আর রাজ‍্যে রইল না। জমির ঊর্ধসীমা সিলিংএর আইনে হয়ত রাজনীতিতে সিপিএমের সমর্থন বাড়ল; কিন্তু সেইসঙ্গে চাষের কাজে আধুনিকীকরনের সুযোগ বন্ধ হল। আধুনিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চাষের জন‍্য একলপ্তে যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন, রাজ‍্যে আর তা রইল না। এখানে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তা “শ্রেণী-সংগ্রাম” বলে প্রচারের সুযোগে রাজ‍্যে সমবায় আন্দোলন দানা বাঁধল না। নিট ফল হল, প্রতি হেক্টর জমিতে একই জাতের ফসল ফলনের নিরিখে পঞ্জাব, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র ইত‍্যাদি রাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক এগিয়ে গেল। দ্বিতীয় হল শিল্পক্ষেত্র – যেখানে অযৌক্তিক দাবী তুলে শ্রমিকদের সংগঠিতভাবে দলীয় সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় তাদের মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে একেএকে শিল্প, কারখানা বন্ধের রাজনীতি শুরু হল। বেকার শ্রমিক ও অভুক্ত কৃষকদের নিয়ে দলীয় সংগঠন স্ফীত করতে সক্ষম হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আর্থ-সামাজিক অধোগতি শুরু হল। তখন, এইসব বিপুল সংখ‍্যক দলীয় সমর্থকদের (ক‍্যাডার) পুষ্টিকরনের উদ্দেশ‍্যে পঞ্চায়েত রাজ চালু হল। উন্নয়ণের নামে এই পঞ্চায়েতের মাধ‍্যমে সরকারী অর্থ খরচের বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হল। সুতরাং দল তথা সরকারে বাফ্রন্টের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়োজনে যেন-তেন-প্রকারেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন‍্য রিগিংয়ের সাথে বলপ্রয়োগ শুরু হল – এর জেরে নির্বাচনে হিংসার আমদানি হল। তার রূপায়নের তাগিধে রাজ‍্যের প্রশাসন ও পুলিশকে ব‍্যবহার করা শুরু হল।
রাজ‍্যের মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমিত করার সঠিক দিশা না পেয়ে রাজ‍্য নেতৃত্ব তখন “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” নীতির সফল রূপায়ন করল! এই নীতির সফল রূপকার নিঃসন্দেহে জ‍্যোতি বসু। যেহেতু সংসদীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সর্বদা দ্বিমেরুভিত্তিক রাজনীতি সমর্থন করে এসেছে, সেজন‍্য মানুষের কাছে ভোটের সময় বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের বিকল্প তৈরী হল না! এই রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ যেমন হল, তেমনই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংসের পথ সুগম হল। রাজনৈতিক চালাকি এই রাজ‍্যের মানুষের না-পসন্দ। এই অবস্থায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে লড়াকু নেত্রী মমতা ব‍্যানার্জী ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ দল গঠন করে নির্বাচনী ময়দানে সিপিএম ও কংগ্রেসের বিকল্পর সন্ধান দিলেন। এই দলের জন্মের পর থেকে সিপিএমের উপর মানুষের অনাস্থার কারনে তৃণমূল দল নির্বাচনে ছাপ রাখতে শুরু করল। নির্বাচনে জেতার জন‍্য ছাপ্পার সঙ্গেসঙ্গে নির্বাচনী ও নির্বাচনোত্তর হিংসা ক্রমশই বাড়তে লাগল। পশ্চিমবঙ্গের সব নির্বাচনে হিংসা অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হিসেবে ভোট ময়দানে স্বীকৃত টেকনিক হিসেবে দেখা দিল! এসবের সবচেয়ে বড় কারন হল, সিপিএম রাজত্বে এই রাজ‍্যের বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগার ছিল রাজনীতির ছত্রছায়ায় তোলাবাজি ও বিভিন্ন অবৈধ পাচারের পথে উপার্জন! ফলে, রোজগার হারানোর ভয়ে এরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে হলেও দলকে নির্বাচনে জয়লাভের রাস্তায় নিয়ে যেত। তৃণমূল দলের শুধুমাত্র বামফ্রন্টের বিরোধীতার জন‍্য জন্ম হলেও, বামফ্রন্টের শেষ মূখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের ভুল নীতির পরিবর্তনের চেষ্টায় দলেরই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন, বিশেষতঃ যারা অসৎ উপায়ে রোজগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব “কুস্তি-দোস্তি”র রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেই নীতির প্রয়োগে মমতা দেবী তাঁর তৃণমূল দলকে ২০১১র সাধারন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা কংগ্রেসের প্রত‍্যক্ষ‍ সাহায‍্যে রাজ‍্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলেন।
ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গে তৃণমূলের সিপিএম বিরোধীতার লড়াই শেষ হল! তখন প্রশাসন চালানোর জন‍্য মমতা দেবী সিপিএমের রাস্তায় আরো উগ্রতা ও ব‍্যাপ্তির সঙ্গে রাজ‍্যকে নিয়ে এলেন। তিনি যথার্থ সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তাঁর শাসন এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তৃণমূল দলটি ব‍্যাক্তি মমতা নির্ভর দল হওয়ায় এরা দ্রুত ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সিপিএম জমানার হিংসা, তোলাবাজি ও অবৈধ পাচারের অর্থসংগ্রহকে বিপুল মাণ‍্যতা দিয়ে অল্প সময়েই রাজ‍্যের হাল শোচনীয় করে তুলল। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ‍্যে কুস্তি” নীতিতে অভ‍্যস্ত‍, মমতা ব‍্যানার্জীও সেই কায়দায় রাজ‍্য চালানোর চেষ্টা করতে লাগলেন!
পশ্চিমবঙ্গ একটি আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী রাজ‍্য হওয়ায় এবং এখানে ভারত-বিরোধী জিহাদী অনুপ্রবেশের প্রচুর ইতিহাস আছে। ভোটের তাড়নায় মমতাদেবী সিপিএমের থেকেও অনেক বেশী জিহাদী তোষণ করতে লাগলেন ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে। এখন কিন্তু রাজ‍্যের সাধারণ ইসলামী নাগরিকরা তাঁর এই অভিসন্ধি ধরে ফেলেছেন। ফলে, তাঁরা যত তৃণমূল দলের থেকে সরে যাবেন, ততই রাজ‍্যে মাথাচাড়া দেবে সিপিএম ও কংগ্রেস জোট। কারন তাদের সঙ্গে আতাঁত রয়েছে ISF এর। হয়ত, রাজ‍্যের বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মমতা ব‍্যানার্জীর দল lesser enemy তত্ত্বের নিরিখে কম ক্ষতিকারক মনে হতে পারে, কিন্তু রাজ‍্যের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস দল এই খেলা খেলতে গিয়ে রাজ‍্যে রাজনৈতিক হারিকিরি করেছিল। তাছাড়া, এখনকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং সীমান্তবর্তী রাজ‍্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অচিরেই পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিতীয় কাশ্মীর বানাতে পারে। ইলাস্টিককে বারবার টানাটানি করলে তা একবার যখন বড় হয়ে যায় তখন আর ব‍্যবহারযোগ‍্য থাকে না। অতয়েব সাধু সাবধান।

বিচার ব‍্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কেন

পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ ন‍্যায়ালয়ের একজন বিচারপতির ঘর তালাবন্ধ রেখে এবং আদালত ও সেই বিচারপতির বাসভবনে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে (অবশ‍্যই নেতৃত্বের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে) যে পোস্টার লাগানো হয় এবং ঐ বিচারপতির আদালত বয়কট করে শ্লোগান দেওয়া হয়, দলবদ্ধভাবে জোর করে উকিল সহ কাউকে তাঁর এজলাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তা নিঃসন্দেহে বিচার ব‍্যবস্থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অশুভ শক্তি প্রয়োগে দমিয়ে রাখার চেষ্টা বলেই মনে হয়। অধিকাংশ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একে সমর্থন করেন না। তবু যেসব আইনজীবি এবং রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁদের ইতিহাসের পাতা উল্টাতে বললে তাঁরা অনেকেই হয়ত লজ্জা পেয়ে চুপ করে যাবেন বা দুকান কাটা রাজনীতিকের মত লাভের অঙ্ক কষে চেঁচামেচি করে জল ঘোলা করবেন!
আমাদের দেশে আদালতের বিচারপতিদের উপর চাপ তৈরী করার ন‍্যক্কারজনক পদ্ধতি অবলম্বন করা একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের বার কাউন্সিলের বড় নেতা, যিনি একসময় তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে এমএলএ হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের হয়ে বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন – তিনি এই ঘটনার নিন্দা করেছেন! এই নিন্দার সময় ওনার কি মনে ছিল যে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল হওয়ার পর পুনরায় কোন আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা না করে সরাসরি সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে হাইকোর্টের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছিলেন? আসলে এখন সাধারণ মানুষ বিদ‍্যজ্জন ও তথাকথিত বুদ্ধীজীবিদের কথার মধ‍্যে শুধু তাঁদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং দলবাজির গন্ধ পান বলে এখন আর কেউ সংবাদ-মাধ‍্যমে এদের প্রচারিত “বাণী” সিরিয়াসলি নেন না।
আমাদের দেশে ত বটেই, এমনকি এই পশ্চিমবঙ্গেও বিচারকদের সঙ্গে চরম অসভ‍্যতার অনেক নমুনা পাওয়া যায়। বর্তমানে রাজ‍্যের বিধানসভায় শূণ‍্য আসন সংখ‍্যার একটি রাজনৈতিক দল, যাদের যুব-আন্দোলনকারীরা অনেক ন‍্যায‍্য ও ভালো কথা বলছে, সেই দলের “পিতামহ ভীষ্ম” মার্কা নেতা তাদের সুখের সময় নিজে হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব‍্য করেছিলেন! তিনি তাঁর দলবল নিয়ে শ্লোগান দেন, “লালা (বিচারক) বাংলা ছেড়ে পালা”! এখানেই শেষ নয়, তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতের ফলে তারা যখন ঐ বিচারককে এই রাজ‍্য থেকে বদলি করাতে সক্ষম হল, তখন দলের ক‍্যাডাররা তাঁর বিদায়বেলায় গাড়ি আটকে ঐ শ্লোগান শুনতে বাধ‍্য করে। এছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রত‍্যক্ষ-অপ্রত‍্যক্ষ ভয় দেখানোর প্রক্রিয়া সেই বামফ্রন্ট আমলেই শুরু হয়। সুতরাং এখন ঐ দলের সাধু সাজার চেষ্টা ভন্ডামি মাত্র। কয়েক বছর আগে সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, যারা ভারতে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় সমর্থক, রামমন্দির সংক্রান্ত রায়ের পর, দেশের সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি মাননীয় রঞ্জন গোগৈকে কুৎসিত ব‍্যক্তি আক্রমণ করে বিবৃতি দেন! বিচারপতিদের “কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও” শ্লোগানের উদ্গাতাও এই দল! দুটি রাজনৈতিক দল – কংগ্রেস ও সিপিএমের ভাবাদর্শে গঠিত দল – তৃণমূল কংগ্রেসও যে প্রয়োজনে বিচারপতিদের “কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”এর পথে হাঁটবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সময় এবং এই প্রদর্শনের কারন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এই রাস্তা নিয়েছে!
এখানে একটি কথা বলা দরকার। এই মূহুর্তে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়, পুরো তৃণমূল দলটাই আদালতের বিভিন্ন প্রকারের দুর্ণীতির রায়ে এবং মাননীয় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে যথেষ্ট বিব্রত। একথা সত‍্যি যে আমাদের দেশে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের দুর্ণীতি নতুন কিছু নয়। নতুন যা সেটি হল, তৃণমূল দল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার আলাদা অস্তিত্ব না রেখে রাজ‍্য-প্রশাসনের সব পর্যায়ে প্রশাসনিক প্রধানদের জায়গাকে দলীয় চেয়ারে পরিণত করেছে! থানার ওসি তৃণমূল দলের সমাবেশে মঞ্চ শোভিত করে দলের দেওয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকেন! এই দলের সর্বাধিনায়িকা – “অনুপ্রেরনা” দিদি সংবাদ-মাধ‍্যমে বিবৃতি দেন, মানুষের জন‍্য এই করলাম……., ঐ দিলাম…… ইত‍্যাদি! অথচ, সংবিধান অনুসারে কোন মন্ত্রী – এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীর ক্ষমতা শুধু নীতি নির্ধারন করাতেই সীমাবদ্ধ। তারা সরকারি কোষাগারের এক টাকাও খরচ করতে পারেন না। তারা আর্থিক অনুদান, “শ্রী” যুক্ত বা শ্রীহীণ প্রকল্পের পরামর্শ দিতে পারেন মাত্র – আর্থিক ব‍্যয়ের ক্ষমতা বিভাগীয় প্রধান IAS প্রশাসকদের হাতে থাকে। সেজন‍্য সরকারি তহবিল তছরুপে কোন মন্ত্রী বা রাজনীতিকের সরাসরি যুক্ত থাকার কথা নয়! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সময়ে সংবিধান মানার চেয়ে তা না মানার ঘটনাই বেশী। প্রশাসনের উপর দলীয় নেতাদের খবরদারি ও তাদের মৌখিক আদেশজারির বহু উদাহরণ আমরা সংবাদ-মাধ‍্যমের দৌলতে অবগত আছি। কিন্তু প্রশাসনের এভাবে দলীয় নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণের নজির আর নেই! পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এর বড় কারন গত ৫৫ বছর ধরে এখানে রাজ‍্যের শাসকদল ক্রমাগত প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে দলদাস তৈরীর চেষ্টা করেছে! প্রথমদিকে কিছু বিরোধীতা থাকলেও ধীরেধীরে সম্পূর্ণ প্রশাসন শাসকদলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে! বর্তমান রাজ‍্য-সরকারে “অনুপ্রেরনা” এবং “ভাইপো” হচ্ছেন সুপ্রিমো! যতদিন শুধু অনুপ্রেরনার অধিনায়কত্ব ছিল, ততদিন ঐ দলের ভিতরের এবং বাইরের গন্ডগোলের খবর পাওয়া যায়নি। পিসি, ভাইপোর মধ‍্যে যখন নেতৃত্ব ভাগ হল, তখন দলীয় আনুগত্যের সঙ্গেসঙ্গে প্রশাসনের আনুগত্যও দুভাগ হল!
সারদা কান্ড এই দলের সরকারে আসার পর প্রথম বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। তাতে সরকারি প্রশাসনের প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগ তেমন না পাওয়া গেলেও “অনুপ্রেরনা”র কাছের মানুষ, রাজ‍্যসভার দলীয় সাংসদ ও সাংবাদিক জেলে গেলেন ঐ কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগের কারনে। কয়েক বছর জেলে থাকার সময়ে তিনি বিক্ষিপ্তভাবে সংবাদ-মাধ‍্যমে যা জানিয়েছিলেন তার মর্মার্থ হল, এই সারদা কেলেঙ্কারির মূল কান্ডারী এবং এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল অর্থ আছে “কালিঘাটের টালির চালা”র মালকিনের বাড়িতে! ইঙ্গিত স্পষ্ট – সরাসরি সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে অভিযোগ! অথচ দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে এত বছরেও অভিযোগকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা কোন সরাসরি অভিযোগ আনতে পারেনি! সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এই প্রাক্তণ এমপি, যিনি জামিনে ছাড়া আছেন, তিনি এখন দলের একজন প্রথমসারির নেতা! দুর্জনে বলে, এই জামিনে ছাড়া পাওয়া নেতা নাকি অনুপ্রেরনা নয়, “ভাইপোর লোক”! সে যাই হোক, নেতার কথা সত‍্যি হলে “অনুপ্রেরনা”র “টালির চালা” অনুসন্ধান করা অবশ‍্য কর্তব‍্য ছিল; আর সেখানে কিছু না মিললে মিথ‍্যা ‘অপবাদ’ দেওয়ার কারনে এই নেতার পুনরায় জেলযাত্রা অনিবার্য ছিল! এসব কিছুই হল না! সব কেমন রিপ ভ‍্যান উইঙ্কিলের মত ঘুমিয়ে পড়ল! কারন কেউ জানে না! এর দায় নিঃসন্দেহে ঐ এজেন্সির। এই কেন্দ্রীয় এজেন্সির প্রসঙ্গে অন‍্য মামলায় একজন বিচারক নিন্দাসূচক কথা বলেন তাদের তদন্তে ঢিলেমির জন‍্য। সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে, এই অনুসন্ধানকারী সংস্থা যেন কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলী হেলনে পুতুল নাচের কুশীলবদের মত নাচছে! একবার তেড়েফুঁড়ে অনুসন্ধানে জোড় দেওয়া হচ্ছে – তারপরই কোন সাড়াশব্দ নেই! মনে হয়, কোন অদৃশ‍্য শক্তি চাইছে না যে, এই সব তদন্ত শেষ হোক! এমন ‘খেলা’ দীর্ঘদিন ধরে চললে আমজনতার এইসব দুর্ণীতি তদন্তের ব‍্যাপারে আর কোন মাথাব‍্যথা থাকে না। এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এই কারনে বিচারকের উপর আঘাত হেনে বিচার-ব‍্যবস্থাকে সন্ত্রস্ত করা চেষ্টা হবে কেন? কারন ভিন্ন।
এইসব ব‍্যাপার যদিও রাজনৈতিক ভাবে দল সামলে নিচ্ছিল বিভিন্ন রকমের সমঝোতার মাধ‍্যমে, গোলমাল বাঁধল উচ্চ-আদালতের একাধিক বিচারকের দুর্ণীতির তদন্ত আদেশ দেওয়ার প্রশ্নে। বিচারকরা তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদের সরাসরি আদালতের কাছে তদন্তের অগ্রগতি জানানোর আদেশ দিলেন! কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলিহেলন ব‍্যতিরেকে সংস্থারা বাধ‍্য হল বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল দলীয় নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করতে! এই নেতারা সবাই গ্রেপ্তার হচ্ছেন সরকারি অর্থ তছরুপের দায়ে নয়; তাঁদের গ্রেপ্তারের কারন বেআইনি কাজে মদত দেওয়া এবং আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির কারনে। সুতরাং, যারা ধরা পরল তাদের খলনায়ক বানিয়ে দলের দুই স্তম্ভ যখন ঘুঁটি সাজাতে ব‍্যস্ত, তখন অনুসন্ধানকারী সংস্থাদের থেকে আদালতে পেশ করা তথ‍্য সংবাদ-মাধ‍্যমে বেরোতে লাগল। যার ফলে পিসি- ভাইপো জুটির ইমেজ প্রচন্ডভাবে কালিমালিপ্ত হল। প্রথমতঃ, এই রাজ‍্য-প্রশাসন শাসকদলের সমার্থক হওয়ায় দায় এসে পড়ছে সংবাদ-মাধ‍্যমের দ্বারা larger than life চেহারা দেওয়া “টালির চালা”র “অনুপ্রেরনা”র উপর! কারন, তাঁর উক্তি অনুযায়ী তিনিই সব কিছু করেন!প্রত‍্যেক বিধানসভা ভোটের সময় প্রচারে বলেন, ২৯৪টি আসনেই তিনি প্রার্থী!তাঁকে দেখেই মানুষ যেন তাঁর পছন্দ করা দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেন। মানুষ সে কথা শুনেছে। এখন যারা দুর্ণীতির দায়ে ধরা পরেছেন এবং দলের অন‍্য বড় নেতারা সবাই বলেন, সবই তাঁর”অনুপ্রেরনা”য়! সেজন‍্য এই দুর্নীতি স্বতঃসিদ্ধভাবে তাঁরই অনুপ্ররনায় অনুপ্রানিত হয়ে করা – বলে ধরা উচিৎ! আবার দলের কাটমানি তৈরীর অভিনব পদ্ধতি, এমনকি, শিক্ষা-দপ্তরে টাকার বিনিময়ে অযোগ‍্যদের চাকরি দেওয়ার অভিযোগের সত‍্যতা আদালতে বিচারকের রায়ে প্রমাণিত হয়, তখন তার দায়ও শীর্ষ নেতৃত্বের উপর বর্তায় – কারন এই নীতি উচ্চ পর্যায়ের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। এদিকে যাদের আদালতের রায়ে অবৈধ উপায়ে “কাটমানি” দিয়ে পাওয়া চাকরি চলে যায়, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেওয়া টাকা ফেরৎ চায়! ফলতঃ, দলীয় এজেন্টদের নামও প্রকাশ‍্যে এসে যাচ্ছে! শুরুর দিকে জিহাদী তোষণ করে, সাধারন বাঙ্গালী মুসলমানদের মিষ্টি কথা বলে এবং বিশেষ বিশেষ ইসলামী পরবে হিজাব পড়ে আল্লার দোয়া মাঙ্গার অভিনয় করে বৃহত্তর ইসলামী সমাজকে ধোঁকা দিতে পারলেও তাঁরা অবশেষে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য ধরে ফেলে “অনুপ্রেরনা”র ঝান্ডা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এই ব‍্যাপারের সঙ্গে আবার “অনুপ্রেরনা” অনুগামীর সাথে “শান্তিনিকেতন”এর “ভাইপো” অনুগামীদের গোলমাল বিভিন্ন জায়গায় চরমে পৌঁছেছে! উচ্চ-আদালত নির্দেশিত অনুসন্ধানের ঠেলায় এখন পুরো দলের অবস্থা হল, কে কত কাটমানি তুলে “টালির চালা” বা “শান্তিনিকেতনে জমা দিতে পারে তার প্রতিযোগিতায় দলের সামাজিক পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে – এই ব‍্যাপারটি বিচারকদের অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার উপর নজরদারিতে পুরো দল এবং প্রশাসনকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। আদালতের দৃষ্টির নীচে অনুসন্ধান বন্ধ করার ক্ষমতা দলীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসন কারোরই নেই। সেজন‍্য দলীয় নেতৃত্ব স্বাভাবিক কারনেই বিচার-বিভাগকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তাদের দুর্ণীতির বিরুদ্ধে আদালতের রায়কে নিজেদের পক্ষে আনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা মাননীয় বিচারপতির এজলাস বয়কট সহ তার বসতবাড়িতে পর্যন্ত পোস্টার সাঁটিয়েছে। কাউকে বিচারপতির এজলাসে ঢুকতে দেয়নি!এতে পুলিশ-প্রশাসন-রাজনৈতিক দলের আঁতাত স্পষ্টতই প্রমাণিত।
সরকারি কর্মচারিদের ডিএ বঞ্চনা, সরকারি ও সরকার পোষিত সংস্থায় চাকরির সংকোচনের সঙ্গেসঙ্গে টাকার বিনিময়ে অনৈতিক উপায়ে চাকরি বিক্রি, উন্নয়ণের নামে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব‍্যয়ে “কাটমানি” ইত‍্যাদি অভিযোগে জর্জরিত রাজ‍্য-সরকার জানে, এভাবে বেশিদিন তারা রাজ‍্যপাট ধরে রাখতে পারবে না! এই মূহুর্তে সমস‍্যা হল, এই বিচারপতির এজলাসে এমন একটি কেস এসেছে যেখানে “ভাইপো” এবং তাঁর শ‍্যালিকার যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে! এই কেসে শ‍্যালিকা গ্রেপ্তার হলে “ভাইপো” আর কতদিন খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন! তখন আদালতের আদেশে হয়ত কেন্দীয় সরকারের ‘অনিচ্ছা’ থাকলেও এই রাজ‍্য-সরকারকে বরখাস্ত করতে বাধ‍্য হবে! এই ভয় থেকেই এমন ব‍্যবহার। কোন বিচারপতি কি ধরনের কেসের বিচার করবেন তা ঠিক করেন প্রধান বিচারপতি। সুতরাং এক্ষেত্রে তারা যদি ভীতি প্রদর্শনে সফল হত তাহলে পরবর্তী টার্গেট অবশ‍্যই প্রধান বিচারপতি!
এখন রাজ‍্যের রাজনৈতিক অবস্থা মোটেই সুস্থির নয়। ক্ষমতাসীন দলের দুর্ণীতি সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। আবার কোন বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে রাজ‍্যে ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র বিপদ আসতে পারে আদলতের দিক থেকে। তাই তারা পূর্বসূরিদের থেকে আরো aggrasive হয়ে বিচারকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দূর্ণীতির প্রশ্নে আদালতের রায়কে নিজেদের দিকে আনতে চাইছে। ভুল তাদের একটি জায়গায় – আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকদের সহযোগীতায় ভোটের সময় সাধারন ভোটারকে সন্ত্রস্ত করা আর উচ্চ-আদালতের বিচারকদের সন্ত্রস্ত করা এক নয়! শস্তা, নোংরা রাজনীতির রেকর্ড তৈরী হল। এতে ক্ষতি হল রাজ‍্যের শাসকদলেরই।

বিশ্বভারতীতে কবিগুরুর স্বপ্নের মৃত‍্যুর কারন

আজকাল বিশ্বভারতী নিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যম থেকে রাজনৈতিক নেতারা – সবাই নাকি খুবই চিন্তিত! বিশ্বভারতীর শিক্ষা-ব‍্যবস্থা নাকি ভেঙ্গে পড়ার মুখে! এমনকি, শিক্ষাঙ্গনে আন্দোলন করা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রছাত্রীরা অব্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বহিষ্কার চাইছে! তারা জানে না, তাদের রাজনৈতিক গুরুঠাকুররা অপছন্দের উপাচার্যদের সঙ্গে কেমন পাশবিক ব‍্যবহার করেছে – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যকে দিয়ে যা শুরু! এই দলের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অপেক্ষা আন্দোলনকে (নিজেদের দলীয় মত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পযর্ন্ত) চালিয়ে যাওয়া তাদের প্রাথমিক কর্তব‍্য মনে করে! আবার অন‍্য রাজনৈতিক দলের স্বার্থ যখনই বাধা পায়, তখনই তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা উপাচার্যের বিরুদ্ধে কামান দাগা শুরু করে! মনে হয়, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যেন এইসব রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত আন্দোলনের “পাঞ্চিং ব‍্যাগ”। রাজ‍্য এবং দেশের অন‍্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা দেখা যায় না।
এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে হল, তা হচ্ছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ‍্য কি ছিল তা বর্তমান প্রজন্ম জানে না। ক্ষমতাশালী মানুষজন কখনো সেই উদ্দেশ‍্যকে গুরুত্ব দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে এমন এক শিক্ষাব‍্যবস্থা গড়ে তুলতে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা – বিশেষতঃ শিক্ষার dogmatic বাধ‍্যবাধকতা থাকবে না – যেখানে মুক্ত, খোলা পরিবেশে, শ্রেণীকক্ষের বাইরে, মাটির কাছে থেকে, প্রকৃতিকে উপভোগ করার সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীরা অন্তরের টানে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে। এই শিক্ষা-ব‍্যবস্থা মেকলে প্রবর্তিত নির্দিষ্ট পাঠ‍্যক্রম ভিত্তিক, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই পদ্ধতির অভিনবত্ব লুকিয়ে আছে – তার প্রকৃতির কোলে চড়ে চাপমুক্ত জ্ঞানার্জনের মধ‍্যে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই পদ্ধতি সার্থক রূপ পায়। ১৯২১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ এই আশ্রমিক মডেল শিক্ষায়তনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বলে ধরা হলেও তার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতিপর্ব চলেছিল। প্রথাগত শিক্ষা-ব‍্যবস্থাকে এই শিক্ষা-ব‍্যবস্থা যে চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল, তা রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই সার্থক হয়েছিল।
কবিগুরুর মৃত‍্যুর পর থেকে স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব ছিল তাঁর সুযোগ‍্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। তিনি পিতার স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বহু বছর জড়িত থাকার সুবাদে প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র, ঐতিহ্য এবং মানের ব‍্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতিতে পুরো ছবিটাই দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ইতিমধ‍্যে কবিগুরু এবং অন‍্য আশ্রমিকদের প্রচেষ্টায় বিশ্বভারতীর সুনাম আন্তর্জাতিকস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষবৃদ্ধি ও তার প্রাতিষ্ঠানিক ব‍্যাপ্তির কারনে যে অর্থের প্রয়োজন, তা ঠাকুর পরিবারের পক্ষে যোগানো কষ্টসাধ‍্য ছিল। উপরন্তু, সরকারি দাক্ষিণ‍্য পেলে প্রাতিষ্ঠানিক ব‍্যাপ্তির কাজ অনেক সহজ হয় বলে, রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে ভারত সরকার দ্বারা অধিগ্রহণের প্রস্তাবে সায় দেন। ঠিক হয়, এটি এই রাজ‍্যে প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম বিশ্ববিদ‍্যালয় হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন বজায় থাকবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হয় যেখানে প্রথম উপাচার্য হিসেবে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম অনুমোদন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার যোগানোর দায়িত্ব নেয়। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক হন দেশের রাষ্ট্রপতি এবং আচার্য হন প্রধানমন্ত্রী। সেই মোতাবেক প্রথম আচার্য হলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৫১ সালের মে মাসে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয় পার্লামেন্টে আইন করে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয় হিসেব আত্মপ্রকাশ করে। পরিদর্শক রাষ্ট্রপতি দ্বারা প্রথম উপাচার্য হিসেবে রথীন্দ্রনাথ নিযুক্ত হন।
এর পর থেকে দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকে। বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য, তার বিচারধারা, শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত থাকা রাজনীতিক এবং আমলারা বিশ্বভারতীকে আর পাঁচটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত ভেবে সরকারি সম্পত্তি মানে – “আমাদের সম্পত্তি” মনে করে তার উপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলেন! রাজ‍্যের অধুনা জেল হাজত নিবাসী একজন প্রাক্তণ শিক্ষামন্ত্রী মন্তব‍্য করেছিলেন, রাজ‍্য সরকার শিক্ষকদের মাইনে দেন বলে নাকি শিক্ষকরা তাঁদের “চাকর”! এমন মধ‍্যযুগীয় প্রভুত্ববাদী চিন্তার প্রকাশের জন‍্য সে সময় বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে আমার মত অনেকেই নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু কথাটা নির্মম সত‍্যি যে, ভারতের রাজনীতিকদের শিক্ষাজগৎ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সঠিক ধারনার অভাব প্রথম থেকেই ছিল। জওহরলাল এবং তাঁর দলবল বিশ্বভারতীকে সরকারি প্রতিষ্ঠান মনে করে তার স্বশাসন ব‍্যবস্থার ডানা ছাটতে উদ‍্যোগী হলেন। “বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ” – আমলারাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন একই অভিপ্রায় নিয়ে। এদের সম্মিলিত ভোগলিপ্সা ও চিন্তার দৈন‍্যতায় কবিগুরুর স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্জলী যাত্রা শুরু হল!
আমাদের দেশে এক অদ্ভুত সিষ্টেম চালু আছে – যদি কাউকে কোন জায়গা বা প্রতিষ্ঠান থেকে হটাতে চাও ত তার বদনাম কর! দেশের মানুষ দুটি বদনাম ভালোভাবে “খায়” – একটি চারিত্রিক অর্থাৎ অবৈধ সম্পর্ক, দ্বিতীয়টি আর্থিক তছরুপ! লক্ষণীয় বিষয় হল, কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অধিগ্রহনের পর স্বশাসিত বিশ্বভারতীর শিক্ষা পদ্ধতিতে অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিক এবং মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষায় শিক্ষিত আমলাদের দুর্বিনীতের মত নাক গলানো মেনে নেওয়া রথীন্দ্রনাথের মত একজন প্রশাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফল যা হবার তাই হল! অযথা প্রতি পদে সরকারের থেকে বাগড়া দেওয়ার পর, কিছু লোভী মোসাহেবকে দিয়ে রথীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পর্ক এবং বিশ্বভারতীর তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হল! এখন কিন্তু এই অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা বীরের সম্মান পান! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রের পক্ষে এ অপমান সহ‍্য করা সম্ভব ছিল না। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কিছুদিনের মধ‍্যে পদত‍্যাগ করলেন।
এটাই কেন্দ্রের রাজনীতিকদের উদ্দেশ‍্য ছিল। তারা তখন তাদের মোসাহেবদের থেকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিভিন্ন “সভা” গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ইয়েসম‍্যানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে শুরু করলেন। বিশ্বভারতীর সংস্কার ও সম্প্রসারণের নামে “আরেকটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়” হিসেবে বিশ্বভারতীর আত্মপ্রকাশ ঘটল! বিষয়ভিত্তিক পঠন-পাঠনে মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা-ব‍্যবস্থার যে কাঠামো অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, তেমনই একটি বিশ্ববিদ্যালয় হল বিশ্বভারতী! রবীন্দ্রচিন্তায় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, রাবীন্দ্রিক চেতনায় যার শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভব, সেখানে কিভাবে set patternএর পদার্থবিদ‍্যা, রসায়ণ ইত‍্যাদির মত বস্তুনিষ্ঠ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয় পড়ানো হতে পারে? ইউজিসি নিয়ন্ত্রিত অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একই ধাঁচে, একই পাঠ‍্যক্রমে বিশ্বভারতীর শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে ফেলা হল। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের মানসপুত্র বিশ্বভারতী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মৃত‍্যু ঘনিয়ে আসে।
তারপর সময়ের সাথে সাথে কেন্দ্রে এবং রাজ‍্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় এলেও বিশ্বভারতীর উপর কর্তৃত্ব ফলানোর সুযোগ কেউই ছাড়তে রাজি হয়নি। সম্প্রতি একটি খবর জেনে ভালো লাগছে – যেসব অভিযোগের কারনে রথীন্দ্রনাথ উপাচার্য পদ ছেড়ে চিরদিনের জন‍্য বিশ্বভারতী ত‍্যাগ করে চলে যান, সেসব অভিযোগ মিথ‍্যা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে, স্বার্থান্বেষী মহল বিশ্বভারতীর ঐতিহ‍্য ও গরিমা নষ্ট করার পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে তাদের প্রথম বাধা উপাচার্য রথীন্দ্রনাথকে মিথ‍্যা অপবাদ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল!
এস ওয়াজেদ আলীর গল্পের বিখ‍্যাত লাইন মনে পড়ল – “সেই ট্র‍্যাডিশান সমানে চলেছে” – রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে বিশ্বভারতীর উপর কর্তৃত্ব বাড়ানোর চেষ্টা। ধীরে ধীরে শুধু রাজনৈতিক দল তথা নেতার বশংবদকে উপাচার্য বানিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে বিশ্বভারতীর নীতি নির্ধারন থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া – সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়ে যেতে লাগল। বিশ্বভারতীর একটি মূল‍্যবান asset হল তার প্রভূত স্থাবর সম্পত্তি। এই সম্পত্তির অংশবিশেষ আত্মসাৎ করার চেষ্টায় রাজ‍্য তথা স্থানীয় প্রশাসনের নেতারা সক্রিয় হল! অভিযোগ আছে যে, এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পযর্ন্ত এই বেআইনী দখলদারী প্রক্রিয়ার সুযোগে নিজের ব‍্যক্তি মালিকানার বাড়ির জমির মধ‍্যে বিশ্বভারতীর জমির কিয়দংশকে নিজের বলে দাবী করেছেন! এই অভিযোগের জবাব পর্যন্ত ঐ অর্থনীতিবিদ দেননি – অস্বীকার করা ত দূরের কথা! এক অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা, যিনি তাঁর সাম্প্রতিক জেলযাত্রার আগে পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন বললে ভুল হয় না, প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কাজের সমালোচনা করতেন! শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে বিশ্বভারতীর অবস্থা হার্বিভোরাস ডাইনোসরের মত! বহু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং কিছু শিক্ষিত ধান্দাবাজদের আক্রমণ তাকে সহ‍্য করতে হচ্ছে।
বিশেষতঃ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কংগ্রেস জমানায় কংগ্রেস-কম‍্যুনিস্ট হনিমুনের সুযোগে শিক্ষক নিয়োগ থেকে ছাত্র-সংসদ, সবেতেই উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত কম‍্যুনিস্ট কন্ট্রোল চলে আসে। শিক্ষাকে কন্ট্রোল করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই কম‍্যুনিস্টরা এভাবে এগিয়েছে – বিশ্বভারতী তার ব‍্যতিক্রম হয়নি। দেশের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার বামপন্থীকরন নীতির রূপায়নে কোন রকম বাধা এলেই এরা কম‍্যুনিস্ট ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে ধ্বংসাত্নক আন্দোলনের মাধ‍্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্বভারতীতেও একই কায়দা অনুসৃত হচ্ছে। অল্প সংখ‍্যক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সুনজরে আসতে চেষ্টা করে যাতে ভবিষ‍্যতে তারা প্রত‍্যক্ষ রাজনীতিকে জীবিকা হিসেবে নিতে পারে! এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসাত্মক গুরুত্বহীন আন্দোলন চালানো হয়। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন মদত থাকায় এই আন্দোলন দমন করার প্রকৃত ক্ষমতা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বা উপাচার্যর নেই।
একথাও সত‍্য যে, বিশ্ববিদ‍্যালয়ের উপাচার্য চয়ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন – সব জায়গায় হস্তক্ষেপ – তা রাজ‍্য এবং কেন্দ্র উভয় তরফেই – রাজনীতিকদের একটি রুটিন অধিকারে দাঁড়িয়েছে! ফলে, প্রকৃত ক্ষমতাহীন অনুগৃহীত প্রশাসকের পক্ষে ও ধরনের তৈরী করা নৈরাজ‍্য ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতে লাভ কার? শুধু কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা নেওয়া এবং অনৈতিকভাবে পাওয়া অর্থনৈতিক লাভ ছাড়া রাজনীতিকদের আর কোন লাভ নেই। কবিগুরুর স্বপ্ন, দেশের শিক্ষা জগতের গৌরব, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অধিগ্রহণ ও তারপর তাকে আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষায়তনের পর্যায়ে নামিয়ে আনার দায় এই রাজনৈতিক নেতাদের। শিক্ষার দৈন‍্যতা, গগনচুম্বী লোভ, বিশ্বভারতীর স্বতন্ত্রতা বিষয়ে বোধের অভাব – এ সব মিলে আজ এই বিশ্বখ‍্যাত প্রতিষ্ঠানটি মূমুর্ষ অবস্থায় আইসিইউতে! এর দায় শুধু বিশ্বভারতীর প্রশাসককে দিয়ে লাভ নেই। কারন প্রশাসককেও চয়ন করেন একই রাজনীতিবিদরা। এভাবে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষার বদলে ১৯৫১ সালের অধিগ্রহণ ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর ধ্বংসের মূল কারন। একে বাঁচাতে হলে রাজনীতিমুক্ত প্রশাসন এবং প্রকৃত স্বশাসন একমাত্র ওষুধ।

ভারতীয় গণতন্ত্রে সামাজিক মূল‍্যবোধ আজ অবহেলিত

আমরা আমাদের দেশের শাসনব‍্যবস্থা নিয়ে কেউ উচ্ছসিত হই, কেউবা আবার তীক্ষ্ণ সমালোচনায় তাকে বিদ্ধ করি। কিন্তু সবাই একটি ব‍্যপারে একমত যে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় শাসিত হয়। আবার ভারী অদ্ভুত লাগে, যখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জিজ্ঞেস করা যায় যে এই গণতন্ত্র কি তা ব‍্যখ‍্যা করুন ত! আমি নিশ্চিত যে বিভিন্ন উত্তর ৩৬০ ডিগ্রি কোনেই বিস্তৃত থাকবে। আজ অব্দি গণতন্ত্রের কোন সর্বজনগ্রাহ‍্য সংজ্ঞা পাওয়া গেল না। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল মানুষকে মানুষের দ্বারা, মানুষের জন‍্য লাঠিপেটা করার প্রক্রিয়া”। আবার জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল কিছু অসৎ ব‍্যক্তিকে অনেক অপদার্থ মানষ দ্বারা চয়নের প্রক্রিয়া”। যদিও উক্তি দুটিকে cynical বক্তব‍্য হিসেবে নস‍্যাৎ করা যায়, তবুও আজকের দিনে এর যথার্থতাকে অস্বীকার করা যায় কি? উইনস্টন চার্চিল একবার গণতন্ত্র সম্বন্ধে বলেছিলেন, “it is the worst form of government”। গণতন্ত্র কথাটির মধ‍্যেই স্ববিরোধীতা লুকিয়ে আছে।
সেটি ব‍্যখ‍্যা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে গণতন্ত্রে সবাই সমান! তা হলে রাজনীতিকদের নেতা হয়ে কি লাভ হবে! মানুষের মনে রাজা-প্রজা সম্পর্কের ব‍্যপারটা আমাদের DNAতে আছে। সুতরাং ruler আর te ruled কখনো সমান হতে পারে না। জর্জ অরওয়েলের Animal farm এর পশুর মনুষ‍্যত্বে অবনমনের গল্পের animal এর জায়গায় মনুষ‍্যরূপী ভোটারদের সম্পর্কে বলা যায়, in democracy, all are equal; but some are more equal than other equals! রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভোট করায়ত্ব করার উদগ্র কামনার মধ‍্যেই গণতন্ত্রকে পদদলিত করার লক্ষণ নিহিত আছে। এখানে কার্ল মার্কসের রচনার যে central pillar – দ্বন্দ মূলক বস্তুবাদ, এর সমর্থকরা কি করে গণতান্ত্রিক হলেন তা বোধহয় কেউ বলতে পারবেন না। হেগেলকে সম্পূর্নভাবে সমর্থন না করেও এটুকু বলাই যায় যে মানুষের ‘মন’ সর্বদা বিপরীতধর্মী বস্তুবাদের মধ‍্যে নিজের স্বার্থ অনুসারী পন্থা গ্রহণ করে। আর এই মানসিকতাই গণতন্ত্রকে একটি তরল তত্ত্ব (fluid concept ) হিসেবে উপস্থাপিত করেছে – অর্থাৎ গণতন্ত্র নামক সিস্টেমটির কোন রূপরেখা নেই। যে দেশে, যে সমাজে ক্ষমতাশালীদের যেভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বা দখলের লড়াই করা হয়, সেই দেশে, সেই সমাজে সেটাই গণতন্ত্র!
আমেরিকায় গণতন্ত্র নেই – এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু সে দেশে plural voting system আমাদের দেশে গ্রহণ করলে বলা হবে গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রা হল! প্রথমে Plato বর্ণিত ও তারপরে Jason Brennan সহ অনেকের সমর্থিত selective voting right of wise একদিক দিয়ে বিচার করলে ভালো ; আবার আরেকদিক দিয়ে সমালোচনাযোগ‍্য। যে দেশ ৭০ বছরের উপর স্বাধীন রাষ্ট্র সেখানে প্রার্থীর নামের পাশে প্রতীক দেখে ভোট দেওয়াতে কি সত‍্যিই গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার প্রতিফলন দেখায়? বরঞ্চ অনেকটা বামপন্থী oligopolystic control পদ্ধতির প্রতিফলন দেখায় – নাম তার পলিটব‍্যুরো, হাইকমান্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব – যাই হোকনা কেন। আর এখানেই গণতন্ত্রের সার্থকতা ও ব‍্যর্থতা দুইই নিহিত আছে।
সত‍্যি কথা বলতে কি – গণতন্ত্র, যেখানে সকল নাগরিকের দেশ শাসনে যোগদানের অধিকার স্বীকৃত আছে, তা কিন্তু আবহমান কাল থেকে চলে আসা “বীরভোগ‍্যা বসুন্ধরা”র রকমফের মাত্র। বিশদে ব‍্যখ‍্যা করা যাক। যেমন ধরুন সব নাগরিকের ভোটদানের অধিকারের মধ‍্যেও আঠারো বছর বয়সের কম হলে বা পাগল হলে তাদের ভোটাধিকার থাকে না। যুক্তি হিসেবে বলা হতে পারে যে তাদের সঠিক বিচারবোধ নেই। আবার যে মানুষটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধুমাত্র প্রতীক চিহ্ন দেখে ভোট দিচ্ছেন তাঁর সঠিক বিচারবোধ আছে ত! যাকে তিনি ভোট দিচ্ছেন তার যোগ‍্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে শুধুমাত্র দলীয় প্রার্থী বিচারে তিনি ভোট দিচ্ছেন। এর থেকে যুক্তিযুক্ত হল epistocracy (যা একমাত্র শিক্ষিত ও ওয়াকিবহাল মানুষদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়)। আমরা যখন রাজনীতির কথা বলি তখন দেশের সাধারণ মানুষের উপর ‘রাজ’ করার জন‍্য যে ‘নীতি’ (ছলে, বলে, কৌশলে) তার কথা বলি। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ ছলনার কথা স্বীকার করে না। আবার মার্কসীয় নীতির অনুসরনকারী রাজনীতিকরা যখন শোসিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন‍্য সামাজিক লড়াই করেন তখন সেটা প্রশংসনীয়। তারপর ‘havenots’ থেকে কিছু পেয়ে যখন মানুষ ‘have’ হয়ে গেলেন, তখনই সর্বহারার মানসিক পরিবর্তনে তিনি ‘বুর্জোয়া’ হয়ে গেলেন। সোজা উদাহরণ – অফিসে ডিএ বাড়ানো, মাইনে বাড়ানোর আন্দোলনে শামিল বামপন্থী মানুষ বাড়িতে কাজের পরিচারিকার দশ, বিশ টাকা মাইধে বাড়ানোর তীব্র বিরোধীতা করেন। এইটি শুধু বামপন্থীদের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবনতা।
একই রকমভাবে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা থেকে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রন করার ফন্দি ফিকিরের মধ‍্যেই গণতন্ত্রের কন্ঠরোধের মত কার্যক্রম নিহিত থাকে। ফলে, নামে গণতন্ত্র হলেও manipulative democracy এখন কালের নিয়ম। দলভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি অনুসারে এই ধরনের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি একমাত্র পথ। কারন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণতঃ দলীয় প্রার্থী হন। তাঁরা দলের অনুশাসন মেনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হন। এটি নামে জনসেবা হলেও কাজে তা মোটেই নয়। দলীয় প্রার্থী হতে গেলে দল বা তার ব‍্যক্তিবিশেষকে খুশী করার পরেই দলীয় টিকিট পাওয়া যায়। আর এই খুশী করার বিভিন্ন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল কাঞ্চনমূল‍্য। অনেকে যুক্তি দেখাবেন, দল চালাতে অর্থের প্রয়োজন, ঠিক কথা।কিন্তু তা কি এভাবে তুলতে হবে! এই যুক্তিতে দলের জন‍্য ‘কাটমাণি’ যা আগে স্পিডমাণি বা ঘুষ হিসেবে অভিহিত হত তা নিতে অপরাধ কোথায়! এইভাবে যারা রাজনীতিতে লগ্নি করছেন তারা নিশ্চয়ই সমাজসেবা করতে আসছেন না। তারা ভোট ব‍্যবসায় লগ্নি করে ব‍্যবসায়িক মুনাফা তোলার চেষ্টা অবশ‍্যই করবেন। সুতরাং এধরনের গণতন্ত্র যত এগোবে, সাধারন মানুষের দুর্দশা তত বাড়বে। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যপার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব‍্যক্তিবিশেষের বিশেষ ক্ষেত্রের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর জন‍্য তাদের দলীয় প্রার্থী করে ভোটে নামিয়ে দেন। এক্ষেত্রে সেই প্রার্থীর যোগ‍্যতা ও integrity দেখা হয় না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে ভোটে জেতাই গণতন্ত্র! এইসব মানুষদের রাজনৈতিক সচেতনতা পরীক্ষিত না হওয়ার কারনে এদের নির্বাচন যেমন বু‍্যমেরাং হতে পারে, তেমনি এদের প্রার্থীপদ দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
গণতন্ত্র মানুষকে তাদের বক্তব‍্য ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে। আবার সেই মানুষই যদি দেশবিরোধী বক্তব‍্য রাখে তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব‍্যবস্থা নিলে তা গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করবে না ধ্বংসের কাজে সাহায্য করবে? আবার শাসকের কাজের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদকেও শাসক বিরোধী না বলে সরাসরিরাষ্ট্রবিরোধী বললে তা কি গণতন্ত্রকে পদদলিত করা হয় না? আসলে গণতন্ত্র একটি এমন প্রক্রিয়া, যা সব রাজনৈতিক দল নিজের স্বার্থে ব‍্যবহার করে – রূপ গন্ধহীণ একটি চিন্ময় মূর্তি। যথার্থ গণতন্ত্রের পয়োগ ও পালনের জন‍্য পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও শিক্ষার প্রয়োজন। সেই শিক্ষা ব‍্যতিরেকে গণতন্ত্রের প্রয়োগ ও পালন রাজনীতিতে অসম্ভব।
সুতরাং গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা রক্ষার শ্লোগান কখনোই গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করে না। সেটি দলীয় স্বৈরতন্ত্র রক্ষার্থেই ব‍্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রথম কথা, জনগণের ‘অংশগ্রহণ’কেই প্রতীকীরূপে নামিয়ে এনেছে। শাসনব‍্যবস্থায় স্বচ্ছতার কথা বারবার বলা হলেও তা কখনো মানা হয়নি। যদিও সমস্ত রাজনৈতিক দলই তাদের আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্রের কথা বলে, তা আসলে কয়েকটি মানুষের ইচ্ছানুসারে চালিত হয়। জনগণের অংশগ্রহনে চালিত গণতন্ত্র এই মূহুর্তে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছেনা। এর সবচে বড় কারন জনগণের ‘অশিক্ষা’ এবং ‘কুশিক্ষা’। যেমন, রাজনীতির দুর্বিত্তায়ন সাধারণ মানুষকে মূক-বধির থাকতে বাধ‍্য করেছে, অন‍্যদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও তথাকথিত শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী মানষজন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির তাগিধে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের তাবেদারী করেন। ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এইসব ‘বুদ্ধিজীবি’ বা ‘প্রবুদ্ধ’জনেদের দল ও নীতি পরিবর্তন – সকাল, বিকেল জামাকাপড় পাল্টানোর মত দেখছি!
এই অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিণতির কথা কোন ধরনের সংবাদমাধ্যমই দেখাচ্ছেনা। সেটা কি? প্রথমেই বলি, যে মানুষজন নিজেদের ব‍্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার তাগিধে এখন কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের জনগণ চিনে নিয়েছেন – প্রকাশ‍্যে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, এরা নাকি রং পরিবর্তনে গিরগিটিকেও হারিয়ে দিয়েছেন! সমাজের উন্নতি, আর্থিক বিকাশের রাস্তা না দেখিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে মানুষের কাছে ভোট চাইছে – কেউ ভোটারদের মধ‍্যে বিভেদের ঠেকা নিয়েছে, কেউবা ডোল (অবশ‍্যই সরকারী কোষাগারের অর্থ) দিচ্ছে, কেউবা মার্কসীয় সাম‍্যাবস্থার বস্তাপচা নীতি আউরে – সকলেই অন‍্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে যে ভোট প্রার্থনা করছে, তাতে একটি জিনিষ পরিষ্কার। কোন রাজনৈতিক দলই সাধারণ মানুষকে নূ‍্যনতম গুরুত্ব দেয় না। কোন রাজনৈতিক দলই সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার সুস্পষ্ট নীতির কথা বলেনি।
এর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, জনসাধারণের মনে রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্বাস হারানো। এর পরবর্তীস্তরে কিন্তু জাতীয়তাবোধের উপর বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। আমাদের দেশের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবোধ রক্ষা করাটা সবচেয়ে জরুরী। আর তা করতে গেলে সব রাজনৈতিক দলের প্রচার ও কর্মধারায় লক্ষণরেখা মেনে চলা একান্ত প্রয়োজনীয়। একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গণমাধ্যম ব‍্যবহার করে জাতীয়তাবাদের একমাত্র ঠেকাধারী হওয়ার চেষ্টা করলে সেটা যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি তার বিরোধীতায় অন‍্য রাজনৈতিক দলগুলি দেশের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে দূর্বল করার চেষ্টা করলে সেটিও একই রকম বিপজ্জনক ও নিন্দনীয়। এর কারন খুঁজতে গিয়ে আমার যেটা মনে হয়েছে, তা হল, দুটি জিনিষ – এক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিক্ষার অভাব, দুই হল, তথাকথিত ডিগ্রিধারী ‘শিক্ষিত’ রাজনীতিকদের অত‍্যধিক লোভ, লালসা। এর জন‍্যই আমাদের দেশ বারবার প্রতিবেশীদের তুলনায় রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাকে কিছুদিন আগে ইউরোপের এক শক্তিশালী উন্নত দেশের একজন অধ‍্যাপক গল্পের ছলে বলেছিলেন, আপনাদের ভারত হল একটি herbivorous dinosaur! আসলে অশিক্ষাজনিত কারনে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা দেশের integrityর উপরে নিজেদের লোভ, লালসাকে স্থান দেন। অদুর ভবিষ‍্যতে যদি দেশ আবার বিভাজিত হয় তবে তার জন‍্য দায়ী থাকবে রাজনীতিকদের স্বার্থান্বেষী খেয়োখেয়ি।
সুতরাং, ভোট যুদ্ধে হার-জিত বড় কথা নয়, জেতার জন‍্য গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করা কখনোই দেশের স্থায়িত্বের জন‍্য কাম‍্য নয়। সুশিক্ষা, দায়িত্ববোধ ও নির্লোভ মানসিকতার রাজনীতিকের আজ বড় প্রয়োজন।

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি – এক আশার আলো

   নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। এখন মনে হচ্ছে "ভোট যুদ্ধ" জয়ের তাগিধে নয়া শিক্ষানীতির রূপায়ণ প্রায় স্থগিত হয়ে আছে। জানিনা কবে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণের পরিকল্পনা ও সেই উদ্দেশ‍্যে কাজকর্ম শুরু হবে।
    অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এই রাজ‍্যের শিক্ষামন্ত্রী ত বলেই দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করবেন না। তা'হলে এই রাজ‍্যে নতুন শিক্ষা ব‍্যবস্থা কি করে হবে! আসলে এ ধরনের রাজনৈতিক ভাষণ পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদেরই শোভা পায়। এই ভাষণ অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত পার্টি কর্মী, সমর্থকদের খুশী করার জন‍্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশী মন্ত্রী হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করা। এটি একটি অদ্ভুত দলের কিম্ভুত সরকার। মূখ‍্যমন্ত্রী বলেন, "তুই টাকা দিস যে হিসেব দেব"! দেশের সংবিধান ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে সঠিক ধ‍্যান ধারনার অভাব আর তার সঙ্গে অশিক্ষা, কুশিক্ষার বহিঃপ্রকাশ এসব সদম্ভ উক্তি।
    দেশের শিক্ষানীতি একটি জাতীয় কাঠামো। এর রূপরেখা সর্বদা কেন্দ্রীয়ভাবেই তৈরী হয়। স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে এবং তার দায়িত্বও কেন্দ্রীয় সরকারের। শেষ শিক্ষানীতি, যেটির বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটি রূপায়নের দায়িত্বে ছিল যে কমিটি তার অধিকাংশ সদস্যই বামপন্থী। কিছু ছিল নেহেরু ঘরানার সোশাল ডেমোক্র্যাট। এই বামপন্থীরা সরাসরি তাদের এ‍্যাজেন্ডা রূপায়িত করার জন‍্য শিক্ষানীতিকে ব‍্যবহার করেছে। সেজন‍্য প্রথমেই তারা এমন সিলেবাস বানিয়েছে যেখানে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে হয় অবহেলা বা বিকৃত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রথমে নরম ইসলামিকরন ও পরে সরাসরি ভারতের  বুকে ইসলামি অনুপ্রবেশকে বিকৃত ইতিহাসের মাধ‍্যমে মহিমান্বিত করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত "বহিরাগত আর্য" সভ‍্যতার তথ‍্য Cambridge ও Harvard বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভুল প্রমাণিত হয়েছে দ্রাবিড়ীয় সভ‍্যতাকে অনার্য সভ‍্যতা হিসেবে দেখানোও। এই সব কল্পিত ইতিহাস সুক্ষভাবে শিক্ষার মাধ‍্যমে ছাত্রদের মগজ ধোলাইএ প্রভূত সাহায‍্য করেছে। আর 'ইসলামিক সেকুলার' তত্ত্ব প্রচার করে অবিভক্ত কমু‍্যনিষ্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস মোতাবেক ভারতের আরো খন্ডিতকরন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন‍্য পরিবেশ তৈরীতে সাহায‍্য করেছে। যেসব অধ‍্যাপকদের এই কাজে ব‍্যপৃত থাকতে দেখা গেছে তাঁরা সকলেই কোন না কোন কমু‍্যনিষ্ট পার্টির সদস‍্য বা উগ্র সমর্থক, যেমন, রোমিলা থাপর, ইরফান হাবিব, বিপন চন্দ্র ইত‍্যাদি। পক্ষান্তরে, রমেশ মজুমদার কালীকিঙ্কর দত্ত, এইচ সি রায়চৌধুরী ইত‍্যাদি লেখকের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভান্ডারকে ধীরে ধীরে পাঠ‍্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। তাজমহলের গায়ের pietra dura কাজকে নতুনত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হল। এটি সর্বৈব ভুল। Fergusonএর Indian Archtecture বইতে তা জানানোও হয়েছে। তাজমহল তৈরীর আগে অন্ততঃ দুটি জায়গায়, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ও যমুনার অন‍্য পারে নুরজাঁর তৈরী তার পিতার কবরসৌধে এই কাজ দেখা যায়। মোদ্দা কথা, ইসলামের যা কিছু তা ভালো আর ভারতের প্রাচীন সব কিছু খারাপ!
        যতদিন দেশে গান্ধী পরিবারের শাসন চলেছে, অত‍্যন্ত সূক্ষভাবে হিন্দুবিদ্বেষ ও প্রাথমিকভাবে ইসলামতোষণ এবং তারপর ২০০৪ সাল থেকে কিছুটা হলেও খ্রীষ্টান তোষন। এর একটা কারন নিঃসন্দেহে বলা যায় গান্ধী পরিবারের যে বা যারা যখন ক্ষমতার শীর্ষে থাকেন তাদের ব‍্যক্তিগত পছন্দ। যেহেতু এই পরিবারের শাসকদের সঙ্গে লেখাপড়ার যোগ নেই, তাই শিক্ষার আলোকে এদের ধর্মীয় আবেগযুক্তিগ্রাহ‍্যরূপে প্রকাশ পায়নি। "ধর্মনিরপেক্ষ" ও "সমাজতান্ত্রিক" এই দুটি কথা ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী দেশের সংবিধানে জোর করে ঢোকানোর পর শিক্ষানীতিতেও "ইসলামিক ধর্মনিরপেক্ষতা" ও "সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা" ব‍্যবস্থার নামে মানব সম্পদ তৈরীর কৌশল প্রয়োগ করায় বামপন্থী শিক্ষানীতির সুপরিকল্পিত ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই শিক্ষানীতিতে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা ভুলিয়ে দিয়ে বিদেশী 'ইজম্' ও মধ‍্যপ্রাচ‍্য এবং পাশ্চাত‍্যের লুঠেরাদের মধ‍্যে 'মহান ব‍্যক্তিত্ব' খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মধ‍্যে এধরনের ভ্রান্ত প্রচার চালিয়ে তাদের নিজস্ব শিকরকে ভুলিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুবিশাল দেশ ভারতে তা সম্ভব নয়। টাকা ও ক্ষমতার জেরে এই চাপিয়ে দেওয়া নীতি একসময় উল্টে যেতে বাধ‍্য। দেশে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র ও কমু‍্যনিষ্টদের ভন্ডনীতির রাজনীতি যখন অস্তাচলের পথে, তখনই এলো এক নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। এই নীতির প্রথম দিশা পাওয়া গেল শিক্ষার্থীদের "মানব সম্পদ" থেকে "ছাত্র" নামের উত্তরণে। পার্টির স্বার্থে মানুষকে পার্টির মত করে পার্টির নীতি রূপায়ণের শিক্ষার বদলে মুক্ত চিন্তা করার মধ‍্যে দিয়ে ছোট বয়েস থেকেই ছাত্রদের বৌদ্ধিক বিকাশের দিকে নজর দেওয়া হল। ফলে, ছাত্রদের মস্তিষ্কের বিকাশ উপযোগী শিক্ষার সূচনা করবে এই নতুন শিক্ষানীতি। সাধারণ একটি উদাহরন দেওয়া যাক। একটি বিষয়ের কোন অধ‍্যায় শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পড়ালেন। কেউ তাঁর মত করে বুঝিয়ে দেন, কেউবা নোটস দেন। পরীক্ষায় তার থেকে প্রশ্ন আসে, ছাত্ররা মুখস্ত করে, স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে সে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। এই ছিল আগের শিক্ষানীতিতে পঠন পাঠনের ধরন। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষক ঐ অধ‍্যায় বোঝানোর জন‍্য বিভিন্ন উদাহরণ, যা কেস হিস্ট্রিও বলা হয়, সহযোগে ছাত্রদের বুঝিয়ে দেবেন এবং ছাত্রদের শ্রেণীকক্ষে বসে তাদের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী চিন্তা করে উত্তর দিতে হবে। বিদেশে এধরনের শিক্ষা অনেক আগে থেকেই চালু আছে। এতে ছাত্রদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথ সুগম হয়। ছাত্রদের বিষয় চয়নের স্বাধীনতা দেওয়ার প্রশ্নে বিশ্বজুড়ে যে আধুনিক শিক্ষা ব‍্যবস্থা চালু আছে তাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি শিক্ষানীতির একটি উল্লেখযোগ্য পজিটিভ দিক। যদিও এই শিক্ষানীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে অবকাঠামো (infrastructure) নির্মাণ সবচেয়ে বড় চ‍্যলেঞ্জ, তার সফল রূপায়ণের সদিচ্ছা থাকলে কাজটি দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। এর জন‍্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তাই শুধু নয়, উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ শিক্ষক তৈরীর ট্রেণিং পরিকাঠামো নির্মাণও জরুরী। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে তার স্তরভিত্তিক বাস্তব রূপায়ণে জোর দিতে হবে।
        শিক্ষক নিয়োগ ও তাঁদের নিরন্তর ট্রেণিং অত‍্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে। শুধু তাই নয়, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং শিক্ষকদের প্রত‍্যক্ষ বা অপ্রত‍্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। সকল স্তরের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া রাজনীতিমুক্ত শিক্ষক-নিয়োগ আয়োগের মাধ‍্যমে করলে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে সুযোগ‍্য শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির প্রবেশ এবং শিক্ষাকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে আনার জন‍্য শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র চয়ন থেকে পরীক্ষা পদ্ধতির কারসাজি সমস্তই বন্ধ হবে যদি শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির প্রবেশ বন্ধ হয়। অনেক সভ‍্যদেশেই শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন তাঁদের শিক্ষকতার কাজে নাপড়ে সেটা দেখা হয়। আমাদের দেশেও তা বলবৎ করা অত‍্যন্ত জরুরী। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে শিক্ষাকে রাজনীতিকরনের জন‍্য। এটি বন্ধ করা আশু প্রয়োজন।
        যেহেতু ছাত্রদের বিষয় চয়নের জন‍্য ব‍্যপক পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সমস্ত বিদ‍্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি জায়গায় সব বিষয়ের পঠন-পাঠনের ব‍্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সেজন‍্য এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে পঠন-পাঠনের, বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, গুচ্ছ (cluster) study পদ্ধতির ব‍্যবহার করতে হবে। শিক্ষায় উন্নত দেশগুলিতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখেছি। যতটা সম্ভব কাছাকাছি জায়গার মধ‍্যে বিদ‍্যায়তনগুলিকে গুচ্ছ করে সবাইকার মধ‍্যে বিষয়গুলি ভাগ করে ছাত্রদের এক বিদ‍্যায়তন থেকে নির্দিষ্ট রুটিনে অন‍্য বিদ‍্যায়তনে পাঠ নেওয়ার সুযোগ দিলে প্রথমেই ব‍্যয়সাধ‍্য পরিকাঠামো উন্নয়ণের খরচ অনেকটাই কমানো যাবে।
     একটি ব‍্যপারে নতুন শিক্ষানীতি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। সেদিকে আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে। তাহল বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে। আমি তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে দেখেছি উচ্চশিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। শহর সীমার মধ‍্যে আটটি সরকারী বিশ্ববিদ‍্যালয়। এর মধ‍্যে তুরস্কের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বিশ্ববিদ‍্যালয়, ইস্তানবুল ইউনিভার্সিটি ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্ট হাউসে ছিলাম সেটি ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি। এটি ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে পথ চলা শুরু করে। এর প্রশাসনিক ভবনটি গথিক আর্টের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পঠন-পাঠনের মান অত‍্যন্ত উন্দত। কিন্তু এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, এই শহরেই ত্রিশটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ‍্যালয় আছে যেগুলি প্রাইভেট ফাউন্ডেশান বা ট্রাষ্টের অধীন। এরা অত‍্যন্ত নিকৃষ্ট মানের বিশ্ববিদ‍্যালয়। এদের ডিগ্রী দেওয়ার কোম্পানি বলাই বোধহয় ভালো। আমি এমন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি যেটি একটি রেস্তোরাঁর উপরে একটি তলা ভাড়া নিয়ে চলছে! সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান ও বেতন কাঠামো উচ্চমানের হলেও এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অতি নীচু মানের। এদের জন‍্য ইস্তানবুলের শিক্ষার মান অনেক নেমে যাচ্ছে। আবার আমেরিকায় দেখেছি, সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেমন, ইয়েল, প্রিন্সটন, হারভার্ড ইত‍্যাদির মানের সঙ্গে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও নামতে থাকে। আমেরিকার অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের মান আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তুলনায় নিকৃষ্ট। এইসব মাথায় রেখে শিক্ষকদের উৎকর্ষতা অনুযায়ী বেতন কাঠামো স্থির করা শিক্ষানীতির সঠিক রূপায়ণের জন‍্য জরুরী। আর এখানেই একটি অনিয়মের ব‍্যপারে আলোকপাত করা দরকার। আমাদের দেশে বামপন্থী সাম‍্যবাদী কায়দায় মুড়ি মিছরির একদর বানিয়ে ইউ জি সি নির্ধারিত পেস্কেল সব শিক্ষকের জন‍্য বরাদ্দ হল। ফার্স্ট গ্রেড টু লাস্ট গ্রেড, সমস্ত কলেজের প্রিন্সিপালদের বেতনক্রম সমান। এমনকি সরকারপোষিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বেতনসমান! এবার কিন্তু নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োগের সময় আমাদের সরকারের মাথায় রাখতে হবে, কম‍ু‍্যনিষ্ট আইডিওলজির সাম‍্যাবস্থার নীতি শিক্ষার ও শিক্ষার উৎকর্ষতা বৃদ্ধির অন্তরায়। কোন জাতীয়তাবজাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র তা করে না।
             শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, স্বজনপোষণ, দূর্ণীতি ইত‍্যাদি থাকায় এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিক্ষকদের উচ্চতর পদ ও বেতন নিশ্চিতকরন করে শিক্ষার উৎকর্ষতার সঙ্গে আপোষ করা হয়েছে। এর পরিবর্তন দরকার। একই রকমভাবে বেসরকারী বিদ‍্যালয় থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমস্ত স্তরেই শিক্ষক নিয়োগের সূষ্ঠু ও স্বচ্ছ নীতি না থাকায় এবং নির্দিষ্ট বা নূন‍্যতম পেস্কেল না থাকায় (অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ইউ জি সি নির্ধারিত পেস্কেল দেয় না)  এইসব শিক্ষায়তনের  শিক্ষকদের থেকে উপযুক্ত শিক্ষাদান আশা করা যায় না। এইধরনের বিদ‍্যায়তনগুলি সম্পর্কে সরকারকে একটি সুস্থ ও বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি প্রনয়ণ করতে হবে। কাজের স্থিরতা ও বেতনবৃদ্ধির নিশ্চয়তা যেমন একজন শিক্ষককে অলস ও কর্তব‍্যবিমুখ করে দিতে পারে, তেমনি শিক্ষকের কাজের উৎকর্ষতার জন‍্য তাঁর কর্মক্ষেত্রে আর্থিক ও অন‍্যান‍্য স্বীকৃতি মেলারও প্রয়োজন আছে।
              সুতরাং বলাযেতে পারে যে নতুন শিক্ষানীতি পরিকল্পিত পথে রূপায়িত করতে হলে শিক্ষক শিক্ষন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন, শিক্ষক চয়ন পদ্ধতি ও তাঁদের শিক্ষাদান একটি পূর্ণ সময়ের সূচীর মধ‍্যে রাখা, শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার হিসেব ও তাঁদের সামাজিক সন্মান - এই বিষয়গুলিতে জোর দিতে হবে। এখন একজন IAS বা WBCS অফিসারের কথা ছেড়ে দিন, শিক্ষা দপ্তরের সাধারণ করণিকও শিক্ষকের প্রাপ‍্য অর্থনৈতিক চাহিদার ফাইল চালানোর জন‍্য ঐ শিক্ষককে দপ্তরে ডেকে পাঠান। অনাবশ‍্যক কারনে দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকেন। এই পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। কারন শিক্ষক তাঁর কাজ অর্থাৎ পড়ানো বন্ধ রেখে অযথা দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করলে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাদান পদ্ধতি। শিক্ষকদের চাকরী সম্পর্কীয় কোন ফাইল আটকে রেখে কোন আমলা, তিনি যত বড়ই হোন না কেন, যদি অনাবশ‍্যক দীর্ঘসূত্রতা করেন, তবে তা শাস্তিযোগ‍্য অপরাধ বলে গণ‍্য করা উচিৎ। 
             পরিশেষে জানাই, বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মান, সুযোগ-সুবিধা ইত‍্যাদির উপর সরকারের কার্যকরী নজরদারি থাকলেই এদের নূন‍্যতম মান নিশ্চিতকরন সম্ভব হবে।