ভারতীয় গণতন্ত্রে সামাজিক মূল‍্যবোধ আজ অবহেলিত

আমরা আমাদের দেশের শাসনব‍্যবস্থা নিয়ে কেউ উচ্ছসিত হই, কেউবা আবার তীক্ষ্ণ সমালোচনায় তাকে বিদ্ধ করি। কিন্তু সবাই একটি ব‍্যপারে একমত যে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় শাসিত হয়। আবার ভারী অদ্ভুত লাগে, যখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জিজ্ঞেস করা যায় যে এই গণতন্ত্র কি তা ব‍্যখ‍্যা করুন ত! আমি নিশ্চিত যে বিভিন্ন উত্তর ৩৬০ ডিগ্রি কোনেই বিস্তৃত থাকবে। আজ অব্দি গণতন্ত্রের কোন সর্বজনগ্রাহ‍্য সংজ্ঞা পাওয়া গেল না। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল মানুষকে মানুষের দ্বারা, মানুষের জন‍্য লাঠিপেটা করার প্রক্রিয়া”। আবার জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হল কিছু অসৎ ব‍্যক্তিকে অনেক অপদার্থ মানষ দ্বারা চয়নের প্রক্রিয়া”। যদিও উক্তি দুটিকে cynical বক্তব‍্য হিসেবে নস‍্যাৎ করা যায়, তবুও আজকের দিনে এর যথার্থতাকে অস্বীকার করা যায় কি? উইনস্টন চার্চিল একবার গণতন্ত্র সম্বন্ধে বলেছিলেন, “it is the worst form of government”। গণতন্ত্র কথাটির মধ‍্যেই স্ববিরোধীতা লুকিয়ে আছে।
সেটি ব‍্যখ‍্যা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে গণতন্ত্রে সবাই সমান! তা হলে রাজনীতিকদের নেতা হয়ে কি লাভ হবে! মানুষের মনে রাজা-প্রজা সম্পর্কের ব‍্যপারটা আমাদের DNAতে আছে। সুতরাং ruler আর te ruled কখনো সমান হতে পারে না। জর্জ অরওয়েলের Animal farm এর পশুর মনুষ‍্যত্বে অবনমনের গল্পের animal এর জায়গায় মনুষ‍্যরূপী ভোটারদের সম্পর্কে বলা যায়, in democracy, all are equal; but some are more equal than other equals! রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভোট করায়ত্ব করার উদগ্র কামনার মধ‍্যেই গণতন্ত্রকে পদদলিত করার লক্ষণ নিহিত আছে। এখানে কার্ল মার্কসের রচনার যে central pillar – দ্বন্দ মূলক বস্তুবাদ, এর সমর্থকরা কি করে গণতান্ত্রিক হলেন তা বোধহয় কেউ বলতে পারবেন না। হেগেলকে সম্পূর্নভাবে সমর্থন না করেও এটুকু বলাই যায় যে মানুষের ‘মন’ সর্বদা বিপরীতধর্মী বস্তুবাদের মধ‍্যে নিজের স্বার্থ অনুসারী পন্থা গ্রহণ করে। আর এই মানসিকতাই গণতন্ত্রকে একটি তরল তত্ত্ব (fluid concept ) হিসেবে উপস্থাপিত করেছে – অর্থাৎ গণতন্ত্র নামক সিস্টেমটির কোন রূপরেখা নেই। যে দেশে, যে সমাজে ক্ষমতাশালীদের যেভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বা দখলের লড়াই করা হয়, সেই দেশে, সেই সমাজে সেটাই গণতন্ত্র!
আমেরিকায় গণতন্ত্র নেই – এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু সে দেশে plural voting system আমাদের দেশে গ্রহণ করলে বলা হবে গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রা হল! প্রথমে Plato বর্ণিত ও তারপরে Jason Brennan সহ অনেকের সমর্থিত selective voting right of wise একদিক দিয়ে বিচার করলে ভালো ; আবার আরেকদিক দিয়ে সমালোচনাযোগ‍্য। যে দেশ ৭০ বছরের উপর স্বাধীন রাষ্ট্র সেখানে প্রার্থীর নামের পাশে প্রতীক দেখে ভোট দেওয়াতে কি সত‍্যিই গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার প্রতিফলন দেখায়? বরঞ্চ অনেকটা বামপন্থী oligopolystic control পদ্ধতির প্রতিফলন দেখায় – নাম তার পলিটব‍্যুরো, হাইকমান্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব – যাই হোকনা কেন। আর এখানেই গণতন্ত্রের সার্থকতা ও ব‍্যর্থতা দুইই নিহিত আছে।
সত‍্যি কথা বলতে কি – গণতন্ত্র, যেখানে সকল নাগরিকের দেশ শাসনে যোগদানের অধিকার স্বীকৃত আছে, তা কিন্তু আবহমান কাল থেকে চলে আসা “বীরভোগ‍্যা বসুন্ধরা”র রকমফের মাত্র। বিশদে ব‍্যখ‍্যা করা যাক। যেমন ধরুন সব নাগরিকের ভোটদানের অধিকারের মধ‍্যেও আঠারো বছর বয়সের কম হলে বা পাগল হলে তাদের ভোটাধিকার থাকে না। যুক্তি হিসেবে বলা হতে পারে যে তাদের সঠিক বিচারবোধ নেই। আবার যে মানুষটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধুমাত্র প্রতীক চিহ্ন দেখে ভোট দিচ্ছেন তাঁর সঠিক বিচারবোধ আছে ত! যাকে তিনি ভোট দিচ্ছেন তার যোগ‍্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়ে শুধুমাত্র দলীয় প্রার্থী বিচারে তিনি ভোট দিচ্ছেন। এর থেকে যুক্তিযুক্ত হল epistocracy (যা একমাত্র শিক্ষিত ও ওয়াকিবহাল মানুষদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়)। আমরা যখন রাজনীতির কথা বলি তখন দেশের সাধারণ মানুষের উপর ‘রাজ’ করার জন‍্য যে ‘নীতি’ (ছলে, বলে, কৌশলে) তার কথা বলি। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ ছলনার কথা স্বীকার করে না। আবার মার্কসীয় নীতির অনুসরনকারী রাজনীতিকরা যখন শোসিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন‍্য সামাজিক লড়াই করেন তখন সেটা প্রশংসনীয়। তারপর ‘havenots’ থেকে কিছু পেয়ে যখন মানুষ ‘have’ হয়ে গেলেন, তখনই সর্বহারার মানসিক পরিবর্তনে তিনি ‘বুর্জোয়া’ হয়ে গেলেন। সোজা উদাহরণ – অফিসে ডিএ বাড়ানো, মাইনে বাড়ানোর আন্দোলনে শামিল বামপন্থী মানুষ বাড়িতে কাজের পরিচারিকার দশ, বিশ টাকা মাইধে বাড়ানোর তীব্র বিরোধীতা করেন। এইটি শুধু বামপন্থীদের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবনতা।
একই রকমভাবে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা থেকে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রন করার ফন্দি ফিকিরের মধ‍্যেই গণতন্ত্রের কন্ঠরোধের মত কার্যক্রম নিহিত থাকে। ফলে, নামে গণতন্ত্র হলেও manipulative democracy এখন কালের নিয়ম। দলভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি অনুসারে এই ধরনের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি একমাত্র পথ। কারন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণতঃ দলীয় প্রার্থী হন। তাঁরা দলের অনুশাসন মেনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হন। এটি নামে জনসেবা হলেও কাজে তা মোটেই নয়। দলীয় প্রার্থী হতে গেলে দল বা তার ব‍্যক্তিবিশেষকে খুশী করার পরেই দলীয় টিকিট পাওয়া যায়। আর এই খুশী করার বিভিন্ন পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল কাঞ্চনমূল‍্য। অনেকে যুক্তি দেখাবেন, দল চালাতে অর্থের প্রয়োজন, ঠিক কথা।কিন্তু তা কি এভাবে তুলতে হবে! এই যুক্তিতে দলের জন‍্য ‘কাটমাণি’ যা আগে স্পিডমাণি বা ঘুষ হিসেবে অভিহিত হত তা নিতে অপরাধ কোথায়! এইভাবে যারা রাজনীতিতে লগ্নি করছেন তারা নিশ্চয়ই সমাজসেবা করতে আসছেন না। তারা ভোট ব‍্যবসায় লগ্নি করে ব‍্যবসায়িক মুনাফা তোলার চেষ্টা অবশ‍্যই করবেন। সুতরাং এধরনের গণতন্ত্র যত এগোবে, সাধারন মানুষের দুর্দশা তত বাড়বে। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যপার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব‍্যক্তিবিশেষের বিশেষ ক্ষেত্রের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর জন‍্য তাদের দলীয় প্রার্থী করে ভোটে নামিয়ে দেন। এক্ষেত্রে সেই প্রার্থীর যোগ‍্যতা ও integrity দেখা হয় না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে ভোটে জেতাই গণতন্ত্র! এইসব মানুষদের রাজনৈতিক সচেতনতা পরীক্ষিত না হওয়ার কারনে এদের নির্বাচন যেমন বু‍্যমেরাং হতে পারে, তেমনি এদের প্রার্থীপদ দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
গণতন্ত্র মানুষকে তাদের বক্তব‍্য ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে। আবার সেই মানুষই যদি দেশবিরোধী বক্তব‍্য রাখে তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব‍্যবস্থা নিলে তা গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করবে না ধ্বংসের কাজে সাহায্য করবে? আবার শাসকের কাজের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদকেও শাসক বিরোধী না বলে সরাসরিরাষ্ট্রবিরোধী বললে তা কি গণতন্ত্রকে পদদলিত করা হয় না? আসলে গণতন্ত্র একটি এমন প্রক্রিয়া, যা সব রাজনৈতিক দল নিজের স্বার্থে ব‍্যবহার করে – রূপ গন্ধহীণ একটি চিন্ময় মূর্তি। যথার্থ গণতন্ত্রের পয়োগ ও পালনের জন‍্য পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও শিক্ষার প্রয়োজন। সেই শিক্ষা ব‍্যতিরেকে গণতন্ত্রের প্রয়োগ ও পালন রাজনীতিতে অসম্ভব।
সুতরাং গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা রক্ষার শ্লোগান কখনোই গণতন্ত্র রক্ষার কাজ করে না। সেটি দলীয় স্বৈরতন্ত্র রক্ষার্থেই ব‍্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রথম কথা, জনগণের ‘অংশগ্রহণ’কেই প্রতীকীরূপে নামিয়ে এনেছে। শাসনব‍্যবস্থায় স্বচ্ছতার কথা বারবার বলা হলেও তা কখনো মানা হয়নি। যদিও সমস্ত রাজনৈতিক দলই তাদের আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্রের কথা বলে, তা আসলে কয়েকটি মানুষের ইচ্ছানুসারে চালিত হয়। জনগণের অংশগ্রহনে চালিত গণতন্ত্র এই মূহুর্তে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছেনা। এর সবচে বড় কারন জনগণের ‘অশিক্ষা’ এবং ‘কুশিক্ষা’। যেমন, রাজনীতির দুর্বিত্তায়ন সাধারণ মানুষকে মূক-বধির থাকতে বাধ‍্য করেছে, অন‍্যদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও তথাকথিত শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী মানষজন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির তাগিধে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের তাবেদারী করেন। ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এইসব ‘বুদ্ধিজীবি’ বা ‘প্রবুদ্ধ’জনেদের দল ও নীতি পরিবর্তন – সকাল, বিকেল জামাকাপড় পাল্টানোর মত দেখছি!
এই অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিণতির কথা কোন ধরনের সংবাদমাধ্যমই দেখাচ্ছেনা। সেটা কি? প্রথমেই বলি, যে মানুষজন নিজেদের ব‍্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার তাগিধে এখন কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের জনগণ চিনে নিয়েছেন – প্রকাশ‍্যে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, এরা নাকি রং পরিবর্তনে গিরগিটিকেও হারিয়ে দিয়েছেন! সমাজের উন্নতি, আর্থিক বিকাশের রাস্তা না দেখিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে মানুষের কাছে ভোট চাইছে – কেউ ভোটারদের মধ‍্যে বিভেদের ঠেকা নিয়েছে, কেউবা ডোল (অবশ‍্যই সরকারী কোষাগারের অর্থ) দিচ্ছে, কেউবা মার্কসীয় সাম‍্যাবস্থার বস্তাপচা নীতি আউরে – সকলেই অন‍্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে যে ভোট প্রার্থনা করছে, তাতে একটি জিনিষ পরিষ্কার। কোন রাজনৈতিক দলই সাধারণ মানুষকে নূ‍্যনতম গুরুত্ব দেয় না। কোন রাজনৈতিক দলই সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার সুস্পষ্ট নীতির কথা বলেনি।
এর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল, জনসাধারণের মনে রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্বাস হারানো। এর পরবর্তীস্তরে কিন্তু জাতীয়তাবোধের উপর বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। আমাদের দেশের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবোধ রক্ষা করাটা সবচেয়ে জরুরী। আর তা করতে গেলে সব রাজনৈতিক দলের প্রচার ও কর্মধারায় লক্ষণরেখা মেনে চলা একান্ত প্রয়োজনীয়। একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গণমাধ্যম ব‍্যবহার করে জাতীয়তাবাদের একমাত্র ঠেকাধারী হওয়ার চেষ্টা করলে সেটা যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি তার বিরোধীতায় অন‍্য রাজনৈতিক দলগুলি দেশের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে দূর্বল করার চেষ্টা করলে সেটিও একই রকম বিপজ্জনক ও নিন্দনীয়। এর কারন খুঁজতে গিয়ে আমার যেটা মনে হয়েছে, তা হল, দুটি জিনিষ – এক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিক্ষার অভাব, দুই হল, তথাকথিত ডিগ্রিধারী ‘শিক্ষিত’ রাজনীতিকদের অত‍্যধিক লোভ, লালসা। এর জন‍্যই আমাদের দেশ বারবার প্রতিবেশীদের তুলনায় রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাকে কিছুদিন আগে ইউরোপের এক শক্তিশালী উন্নত দেশের একজন অধ‍্যাপক গল্পের ছলে বলেছিলেন, আপনাদের ভারত হল একটি herbivorous dinosaur! আসলে অশিক্ষাজনিত কারনে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা দেশের integrityর উপরে নিজেদের লোভ, লালসাকে স্থান দেন। অদুর ভবিষ‍্যতে যদি দেশ আবার বিভাজিত হয় তবে তার জন‍্য দায়ী থাকবে রাজনীতিকদের স্বার্থান্বেষী খেয়োখেয়ি।
সুতরাং, ভোট যুদ্ধে হার-জিত বড় কথা নয়, জেতার জন‍্য গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করা কখনোই দেশের স্থায়িত্বের জন‍্য কাম‍্য নয়। সুশিক্ষা, দায়িত্ববোধ ও নির্লোভ মানসিকতার রাজনীতিকের আজ বড় প্রয়োজন।