ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় ছ’টি মৌলিক অধিকারের কথা স্থীকৃত – বক্তব্য বা মতামত বলা ও লেখার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও সংঘ গঠনের স্বাধীনতা, দেশের যে কোন স্থানে ভ্রমণ ও বসবাস করার স্বাধীনতা এবং পেশার স্বাধীনতা। এগুলোই মৌলিক অধিকার হিসাবে সকল নাগরিকের প্রাপ্য। এখানে কোথাও ইসলামী বা অন্য মহিলাদের হিজাব বা বোরখা পড়ার অধিকারের কথা বলা নেই। অথচ, প্রবীণ কংগ্রেসী ও প্রাক্তণ মন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া ‘হিজাব’কে ইসলামী মহিলাদের “মৌলিক অধিকার” বলেছেন! সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচোরই বলেছেন, হিজাব নাকি সাংবিধানিক অধিকার! তা সীতারামজী এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানের কিনা সেটা বলেননি! তাঁর জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০১৭ সালে তাঁর রাজনৈতিক পিতৃদেবের দেশ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাদের দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি হিজাব উত্তর কোরিয়া ও বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে নিষিদ্ধ। ইসলামী দেশগুলির মধ্যে সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে হিজাবের বাধ্যবাধকতা নেই। আমেরিকাতে সুরক্ষার প্রশ্নে হিজাব খোলা বাধ্যতামূলক। সাম্প্রতিক কালে বোরখা ও হিজাবের প্রতিবাদে ইরানের মহিলাদের বলিষ্ট প্রতিবাদ সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এই আন্দোলনে ইরান উত্তাল। অথচ, ভারতের মত দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান স্বীকৃত, সেখানে এই দেশের কতিপয় রাজনীতিক সংবিধানের নামে মিথ্যা দোহাই দিয়ে আসলে জিহাদী ইসলামী নেতৃত্বকে তুষ্টিকরনের বার্তা দিচ্ছেন।
কিন্তু কেন? এরা ভালো করেই জানেন যে, পৃথিবীতে যে কটি ইসলামী রাষ্ট্র আছে, তাদের কোনটিতেই স্বীকৃত কোন কম্যুনিষ্ট দল নেই! সুতরাং, এই কম্যুনিষ্টদের উদ্দেশ্য ভারতে ইসলামী শাসন কায়েম করা নয়, তাদের উদ্দেশ্য ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তির তুষ্টিসাধন। এইভাবে তারা ভোট রাজনীতির ময়দানে তাদের ভোট-ব্যাঙ্ক স্ফীত করতে আগ্রহী। আবার হিন্দু ভোটারদের জন্য তাদের টোপ হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “সমাজতান্ত্রিক” কথাদুটি আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭৬ সালে ‘জরুরী অবস্থা’র সুযোগে সংসদে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের বৃহত্তম সংশোধন করে ঢোকান। রাষ্ট্রের নাম – সমাজবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ভারত – ঘোষিত হল। ইন্দিরা গান্ধীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তাঁর অনুচরবর্গের শিক্ষার দৈন্যতা এতটাই য তাঁরা দেশের সব নাগরিককেই মূর্খ ভাবার ধৃষ্টতা দেখালেন। “সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র” বা “গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” থাকলেও (ইংল্যান্ড একমাত্র দেশ যেখানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আছে) সমাজবাদী গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কি করে সম্ভব তা একমাত্র সোনার পাথরবাটির মত লাগছে! ভারতের কম্যুনিষ্ট নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের “ধর্মনিরপেক্ষতা”র বড়ি খাওয়াতে নানাভাবে চেষ্টা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোরান ও বাইবেল সরাসরি নিন্দা করায় কোন ইসলামী বা খ্রীষ্টান ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না! শুধুমাত্র হিন্দুদের ধর্মহীণতায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অবতারণা করা! কম্যুনিষ্টদের কাছে হজ করা, ঈদের রমজানের উপবাস ও নমাজ পড়া ইসলামীদের মতই জায়েজ। শুধু দূর্গাপুজার মন্ডপ জুতো দিয়ে সাজানো, পুজো মন্ডপে আজান দেওয়া ও কোরান রাখা “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নিদর্শন! এরা কখনো মসজিদে হনুমান চালিশা বা গীতা পাঠ করতে বলে না। এদের কাছে মক্কায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ জায়েজ। এদের কানে সন্ধ্যারতির আওয়াজ অসহ্য লাগলেও এরা কখনো লাউড স্পিকারে নমাজের আওয়াজে বিরক্তি বোধ করে না। এভাবেই এরা ভারতে “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার চালান শুধুমাত্র হিন্দু মননে নিজ ধর্মের প্রতি বিরূপতা জাগানোর চেষ্টায়।
এভাবে ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা জিহাদী ইসলামের স্বার্থরক্ষা করতে করতে কখন যেন হিন্দু-বিদ্বেষী থেকে ভারত-বিদ্বেষী হয়ে গেল! আর কংগ্রেস সম্পর্কে বলতে হয়, একটি গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রীষ্টান পরিবারের অধীনে এই শতাব্দী প্রাচীন দলটি এখন রাজনীতির আই সি ইউতে অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায়। এর নেতারা সকলেই ঐ পরিবারকে খুশী করার সাথে সাথে হিন্দু-বিদ্বেষের মাপকাঠিতে নিজেদের যোগ্যতাকে বিচার করার মাধ্যমে ঐ পরিবারের সন্তুষ্টি বিধানে ব্যস্ত।
এই মূহুর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিরোধী দলগুলির নীতি নির্ধারণে এই কম্যুনিষ্টদের হিন্দু-বিরোধী নীতিকে প্রাধান্য দেওয়ায় তারা প্রায়শঃই ভারত-বিরোধী লাইন নিয়ে ফেলছে। এর ফলেই দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরী হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মত রাজনীতি সচেতন, শিক্ষিত ভোটারদের রাজ্যেও এই মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।
এইসব বিরোধী নেতারা ভারতীয় হিন্দু রমনীদের চিরাচরিত বেশভূষায় নাকি গেরুয়াকরণের ছাপ দেখছেন! তারা গেরুয়া রংয়ের ওড়না ও দোপাট্টার বিরোধী! তারা কি একবারও মনে করেছে যে, দেশের জাতীয় পতাকার সবচেয়ে উপরের রং গেরুয়া! তারা কি গৈরিকীকরণের প্রতিবাদ করে দেশের পতাকার রংটাই পাল্টে দেবে!
আসলে এসব করার সুযোগ হয়েছে ঐ ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের জন্য। এখানেই ভোট সর্বস্ব রাজনীতির সংসদকে সর্বশক্তিমান বানানোর প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। সংবিধানের ৪৪তম ধারার (৪২তম সংশোধন) বিপুল সংশোধন করে পরবর্তী সময়ে কম্যুনিষ্টদের দাপটে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে জিহাদী অনুপ্রবেশ শুরু হয়। আরবী সংস্কৃতির আদলে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধীরগতিতে পরিবর্তন আনা হয়। রামধনু হয় রংধনু, জল পান করা হয়ে যায় পাণি খাওয়া, জলখাবার পাল্টে হয় নাস্তা করা! শ্যালিকা হয় বেয়াইন, “তোমায় দেখে নেব” কথা হয়, “তোমার খবর আছে” ইত্যাদি। হারিয়ে যায় ইসলামী বাঙ্গালীর মধ্যে বাউল গান, ঝুমুর গান – জায়গা নেয় মেহফিল আর মুজরো মার্কা জলসা। তারপর বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয় ‘লাভ জিহাদ’। হিন্দুদের মধ্যে, বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের সঙ্গে বহিরাগত ইসলামীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস না থাকায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে বিশেষভাবে গান্ধী-নেহরুর বাংলা বিদ্বেষের ভুরিভুরি উদাহরণে বাঙ্গালী হিন্দুর সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মিলনের পথে কিছুটা বাধা উপস্থিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের মধ্যে কম্যুনিষ্ট ও তার উত্তরসূরী এই জায়গাটাই exploit করতে শুরু করে। তারা হিন্দু ঐতিহ্য ও লোকাচারকে ভুলিয়ে দিতে বাঙ্গালী হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে “উৎসব” মুখী করে নতুন সংস্কৃতি আমদানি করে – হিন্দুত্বের শিকড় উপড়ে ফেলার কৌশল। সেখানে “অকাল বোধন” এর দূর্গাপুজা হয়ে যায় দূর্গোৎসব যা শুরু হয় পিতৃপক্ষে! আবার সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর ভ্যালেন্টাইনস্ ডে হিসাবে দেখিয়ে পুজার মাহাত্ম্য অস্বীকার করা হতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই – হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারটা নষ্ট করে দাও; হিন্দু ধর্ম ঘেঁটে ঘ হয়ে যাক! হিন্দুদের দেবদেবীর অপমান ও পুজাকে তাচ্ছিল্য করার অছিলা একটাই – ধর্মনিরপেক্ষতা! আবার, ইসলামী বা খ্রীষ্টীয় ধর্মের কোন রকম লঘুকরনের এরা বিরোধী – অজুহাত – সংখ্যালঘুর ধর্ম রক্ষা! এভাবে একটি ধর্মের অবমাননা ও অন্য ধর্মের রক্ষা করা – এর নামই কম্যুনিষ্ট চর্চিত ও কংগ্রেস প্রযোজিত “ধর্মনিরপেক্ষতা”।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে এরা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রিয় চর্চার বিষয় করে তোলে হিন্দু দেবদেবী ও অবতারদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে আক্রমণ করা। কোন প্ররোচনা ছাড়া এমন অযৌক্তিক আক্রমণের কারন হচ্ছে হিন্দুধর্ম এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকে আক্রমণ করা। আশ্চর্য বিষয় হল, এরা ভুলেও কখনো ইসলামীদের উপাসক বা তাদের অবতারদের নিন্দা করা দুরের কথা, এ বিষয়ে আলোচনাকে অব্দি ‘গুণাহ্” মনে করে। কাজেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে একদল মানুষ সমাজের বৃহত্তর অংশের হিন্দুদের ধর্মকে নষ্ট করে দেশের সংহতিকে আঘাত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে, যেখানে এদের সহযোগী রয়েছে ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তি – যারা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে মদত পাচ্ছে।
একটা ব্যাপার কখনো মাথায় ঢোকে না – যারা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে, তাদের জিজ্ঞাসা করি, দূর্গাপুজায় মাতৃ আরাধনাতে কি কোন ইসলামী মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন? কারন, ইসলামে কোন দেবীরূপ স্বীকৃত নয় – মহিলারা “শষ্যক্ষেত” মাত্র – একথা একাধিক ইসলামী পন্ডিতের কাছে জেনেছি। কাজেই দূর্গাপুজায় ইসলামীদের অংশগ্রহনের অভিনয় হয়ত থাকবে, কিন্তু যথার্থ অংশগ্রহন থাকবে না। আবার ঈদের রমজানের উপবাসের পর রোজা ভাঙ্গার ইফতারে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ অভিনয় হতে পারে, তা কখনোই ধর্মীয় অনমোদনের ইফতার নয়। ইফতারে তারাই থাকতে পারে, যারা সবশক্তিমান আল্লার সেবক এবং রমজানের উপবাস রেখেছে। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির নামে দেশের স্থায়ীত্বের উপর আঘাত করার আরো একটি পরিকল্পনা হল – দেশের কোন রাষ্ট্রধর্ম না থাকা! ধর্ম মানুষের সঙ্গে পশুর তফাৎ গড়ে দেয়। এদেশে এমনকি জাতীয় গান “বন্দেমাতরম্” নিয়ে পর্যন্ত আপত্তি করা হয়! এমন অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়া নির্বুদ্ধিতা বা চরম অসততা। এই আবহাওয়ায় হিজাব নিয়ে যে আন্দোলন, তা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত! হিজাব যদি ধর্মীয় বাধ্য-বাধকতার জন্য হয়, তার নিদান কোরান বা হাদিস – কোথাও নেই কেন? হিন্দুধর্মের মধ্যে যেমন লোকাচারের অনুমোদন খোঁজা বৃথা, তেমনি ইসলামের ধর্মীয় বিধি পালনে হিজাব অপরিহার্য নয়। অবশ্য, যে অশুভ আঁতাত হিজাব নিয়ে শোরগোল করছে, তাদের আসল উদ্দেশ্য ইসলামী মৌলবাদের আড়ালে দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব বিঘ্নিত করা।
পরিশেষে বলি, কে কি পরবে বা খাবে তা যেমন তার নিজস্ব, তেমনি, কোন প্রতিষ্ঠান তার কর্মচারী বা ছাত্রছাত্রীদের কি ধরনের পোষাক পরে ঐ প্রতিষ্ঠানে আসবে, তার অধিকার একমাত্র ঐ প্রতিষ্ঠানের। অবশ্য, অশ্লীলতা ও অন্যের অসুবিধা না করে পোষাক পরার অধিকার শুধু সমাজে নয়, সংবিধানে অবধি স্বীকৃত। এইসঙ্গে সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সমঝোতা বা ধর্মের দোহাই দিয়ে তার লঘুকরণ করা যায় না। এমনকি, ইউরোপ, আমেরিকায় একাধিকবার দেখেছি, পর্দানশীন মহিলাদের বোরখা খুলে পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তারা কিন্তু সেখানে কোন প্রতিবাদ করে না! ধর্মের নামে যত প্রতিবাদ সব ভারতে! এ ধরনের ধর্মীয় জিহাদের বিস্তারকরণ নিঃসন্দেহে দেশের সুরক্ষার পরিপন্থী। সেজন্য এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা আবশ্যক। ইসলামী সংস্কৃতির নামে আরবী সভ্যতার বিস্তারধর্মী আগ্রাসন বন্ধ করতেই হবে।
Month: February 2023
পিসী-ভাইপো সাম্রাজ্যের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিশ্চিতভাবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই রাজ্যে বিধান চন্দ্র রায়ের পরবর্তী সময় রাজনীতি শাসক দল ও একটি বিরোধী দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখানে কখনো জোট রাজনীতি সফল হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকারের হামাগুড়ির পর্যায়েই মৃত্যু হয়েছিল। অবশ্য তারপর বামফ্রন্ট সরকার চালালেও সেখানে প্রকৃত অর্থে শাসক দল ছিল সিপিএম। তাদের সঙ্গে কিছু সহযোগী দলের বিক্রিত নেতা লালবাতি গাড়ি ও মন্ত্রীত্বের লোভে বামপন্থী সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে তাদের যেটুকু অল্পস্বল্প ভোট ব্যাঙ্ক ছিল, তার অন্তর্জলী যাত্রার বন্দোবস্ত করে। এর ফলে, ক্ষমতা ধরে রাখার কারনে এবং প্রতিবাদী বিরোধী শক্তির কন্ঠরোধ করার জন্য বিভিন্নভাবে দলদাস পুলিশবাহিনী তৈরীর সাথে সাথে ক্যাডার বা দলীয় গুন্ডাদের ব্যবহার করা শুরু হল। এ দুটি শ্রেণীর প্রথমটি লাইসেন্সড ও দ্বিতীয়টি আনলাইসেন্সড গুন্ডা বাহিনী যারা শাসকের অঙ্গুলি হেলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এরা শাসকের হয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করার পাশাপাশি অন্য সময় নিজেদের আখের গুছানোর জন্য তোলাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাজে ব্যস্ত থাকত। ফলতঃ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নের মুখে পড়ায় যত শাসকের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়তে লাগল, ততই শাসক নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন পর্যায়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে শুরু করল। এ কাজে তাদের প্রধান সাহায্যকারী ছিল এই দু ধরনের গুন্ডা বাহিনী। একটা সময় এলো, যখন নির্বাচনে জালিয়াতি ও ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও সিপিএম পরাস্ত হল। ২০১১র বিধানসভা নির্বাচনে জিতে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী হলেন মমতা ব্যানার্জী। তাঁর তৃণমূল দলটি প্রথম থেকেই কোন ইজম-ভিত্তিক দল নয়। এদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিও পরীক্ষিত নয়। এই দলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জীর কথাই দলে প্রথম ও শেষ কথা – তিনিই দলের কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক মায় গীতা – তাঁর কথা অলঙ্ঘনীয়! এ ধরনের দলের সহজেই স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠার প্রবণতা থাকে।
মমতাদেবীর মস্তিষ্কপ্রসূত বিভিন্ন “উন্নয়ণ” প্রকল্প রূপায়নের নামে যেমন অনুদান রাজনীতির অর্থনৈতিক প্রভাব রাজ্যের কোষাগারে পড়ল, তেমনি রাজ্যের শিল্প-বাণিজ্যের শোচনীয় অবস্থায় অর্থভান্ডারের অবস্থা অবর্ণনীয়ভাবে খারাম হয়ে পড়ল।মমতাদেবীর দল ও প্রশাসন সমার্থক হয়ে গিয়ে তিনি শুধু স্তাবকবেষ্টিত প্রশাসন চালাতে লাগলেন। বিশেষতঃ ভিনদেশীয় IAS ও IPSরা তাঁর আত্মম্ভরী অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে রাজ্যের ভরাডুবির বন্দোবস্ত করতে উদ্যত হল। এদের চাকরী জীবনে ‘নিজের আখের গুছোনো’ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এ ধরনের প্রশাসনে দুর্ণীতির ফোয়ারা ছোটে – এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। এর সাথে সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী মমতা ব্যানার্জী তাঁর প্রশাসনকে এমনভাবে কাজ করার কথা বললেন যে তাঁর একাধিক মন্ত্রী, দলের জেলা সভাপতিসহ অনেক নেতাই দুর্ণীতির অভিযোগে জেলবন্দী। তৃণমূল দলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী ত বটেই, তাঁর নিজের পরিবারের ধন-সম্পত্তি গত দশ বারো বছরে যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জেনে সাধারণের চোখ কপালে উঠেছে! শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিভাগে টাকার বিনিময়ে চাকরী দেওয়া এবং চাকরি চুরির দায়ে প্রাক্তণ শিক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন রকমে বিশেষভাবে নির্বাচিত আমলারা গারদে ঢুকে গেছে! বিরোধীরা সম্পূর্ণ দুর্ণীতিগ্রস্ত সরকারের আশু পতন দাবী করছে।
এমতাবস্থায় মমতাদেবী কংগ্রেসী ঐতিহ্যে নিজের পরিবারের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরো বেকায়দায় পড়েছেন।তাঁর পরিবারের মানুষজনকে কর্পোরেশনের কাউন্সিলার করা থেকে বিভিন্নভাবে উপার্জনের সুযোগ করে দিলেও তিনি তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায়কে বহু আগে থেকেই মনোনীত করেছেন। গুণধর ভাইপোও নিজেকে পিসীর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরী করেছেন। পিসী যেমন ফেক বিশ্ববিদ্যালয় – ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন বলে দাবী করেছিলেন, ভাইপো তেমনি এমন প্রতিষ্ঠান থেকে এমবিএ করেছেন বলে দাবী করেছেন যার কোন স্বীকৃতি নেই! তিনি যতদিন উত্তরাধিকার সূত্রে তৃণমূল দলের দু নম্বর চেয়ার দখল করে নিজেকে শুধু দলের এমপি হিসেবে রেখেছিলেন, ততদিন কোন গুরুতর সমস্যা হয়নি। কিন্তু যখন তিনি পিসীর থেকে প্রশাসনিক উত্তরাধিকার নেওয়ার জন্য এগোতে শুরু করলেন, তখন গুরুতর সমস্যা তৈরী হল।
যেহেতু তৃণমূল দলের একমাত্র মন্ত্র “নেত্রী ধর্ম, নেত্রী স্বর্গ, নেত্রী হি পরমন্ততপঃ”, দলের বিভিন্ন পোস্টার ও কাটআউটে পিসী-ভাইপো যুগলের ছবির মাধ্যমে দল তথা প্রশাসনে উত্তরাধিকারের ছকটা বুঝিয়ে দেওয়া হল। এ ধরনের একনায়কতন্ত্রী দলের সুবিধা হল, দলীয় কর্মীরা শ্রমিক পিঁপড়ের মত – নেত্রীকে কোন প্রশ্ন করে না, শুধু জয়ধ্বনির শ্লোগান দেয় আর হুকুম তামিল করে। তবে হুকুম দেওয়া ত ফেক ডিগ্রির অনভিজ্ঞ যুবকের দ্বারা সম্ভব নয় – সম্ভব শুধু হাকিমের দ্বারা! ফলে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত নেতার দলবলের (পড়ুন বিশ্বস্ত চামচা) সঙ্গে পিসীর দলবলের সংঘর্ষ শুরু হল। পিসী-ভাইপো তা বন্ধ করতে ব্যর্থ। কারন, ভাইপো তার উত্তরাধিকারের দাম্ভিকতায় ও অনভিজ্ঞতার কারনে সাফল্যের সঙ্গে পশ্চাদাপসারণ (successful retreat) অপমানজনক মনে করে প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও সর্বাত্মক আক্রমণের রাস্তা বেছে নিলেন!
গত ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২২এ বিজেপির নবান্ন অভিযানে যেভাবে রাজ্যের পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে তার ফলে – বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে সাধারণ মানুষের বিরক্তি গিয়ে পড়েছে প্রশাসন ও পুলিশের উপর। আমি মনে করি, মনের অন্দরেঙ কোন গোপন ভীতির কারনে প্রশাসন ও পুলিশ এভাবে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এতে পরিষ্কার যে তৃণমূল দল (এখন শাসক দলের সঙ্গে প্রশাসন-পুলিশ সব মিলেমিশে একাকার!) অত্যন্ত ভীত হয়ে এধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সিপিএম যদিও রিগিং নির্ভর নির্বাচন করত, তৃণমূল এখন নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সম্পূর্ণ রিগিং এবং নেতাদের দৈনিক সুরক্ষার জন্য এই পুলিশ ও দলীয় পেশীশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সুতরাং এদের জনমুখী করার কোন কৌশল এই দলের কাছ থেকে আসা সম্ভব নয়। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দেহ-ভঙ্গিমা ও বক্তব্য ভালো করে অনুধাবনে বোঝা যায়, এই মূহুর্তে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে পিসী-ভাইপো যুগলবন্দী। বাদবাকী কেউ স্থির নয়। দলের সব স্তরে অবিশ্বাসের বাতাবরন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অন্য কাউকে এই পারিবারিক নেতৃত্ব বিশ্বাস করছে না। আবার পিসীকে ল্যাং মেরে প্রথম সুযোগেই পিসীর চেয়ার দখল করতে মরিয়া ভাইপো! কেমন যেন ইতিহাসের পাতা থেকে later Mughalsদের পুনরাবৃত্তি!
এমনটি হওয়ার কারন নিঃসন্দেহে ইডি-সিবিআইয়ের সাম্প্রতিক তৎপরতা। আগে যেভাবে রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেলিংয়ের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থাদ্বয়ের তৎপরতাকে বন্ধ করা গিয়েছিল, সেই এক কায়দায় এবার চরমভাবে নিরাশ হতে হচ্ছে – কারন এবারের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চলছে পুরোপুরি উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং তারই তত্বাবধানে। যদিও রাজনীতি করার জন্য সেটিং-সেটিং রব তোলা হচ্ছে, সে সন্দেহ অমূলক। এখানে রাজনীতির প্যাঁচ পয়জারের কোন সুযোগ নেই। সে কারনেই অত্যন্ত চাপের মধ্যে পড়ে তৃণমূলের “পাপ্পু” যুবরাজ, যিনি “ভাইপোদা” on standing, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দাম্ভিকতায় রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন।
“ভাইপোদা” তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরুই করেছেন পিসীর ভাইপো হিসেবে সর্বোচ্চ স্তর থেকে! ফলে, রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ তাঁর ছিল না। চামচা পরিবেষ্টিত থাকায় তৃণমূলের মত গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতন্ত্রী দলে তাঁর মধ্যে মিথ্যা অসারতা (false vanity) এবং অতিরিক্ত দম্ভ পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পায়। এসব তাঁর প্রশাসন চালানোয় সহযোগিতা ত নয়ই, বরং অন্তরায় হচ্ছে। আমার জিজ্ঞাস্য – “ভাইপোদা” পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কে? কোন অধিকারে তিনি সরকারী প্রশাসন ও পুলিশের কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ তা জনসমক্ষে বলেন? আসলে রাজ্যের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় স্বৈরতন্ত্রী পারিবারিক শাসনের এ এক নমুনা!
এই “ভাইপোদা”র সঙ্গে একটি রাজনৈতিক চরিত্রের কথাবার্তা ও কর্মকান্ডের অনেক মিল পাওয়া যায়। তিনি হলেন অক্টোবর ১৯৭৬ থেকে জানুয়ারী ১৯৭৯ (দু বছর তিন মাস) কাম্বোডিয়ার স্বৈরাচারী কম্যুনিষ্ট প্রধানমন্ত্রী পল পট। তিনি তাঁর শাসনকালে কাম্বোডিয়ায় একদলীয় শাসন ও তাঁর ডিক্টেটরশিপ বজায় রাখার জন্য সব বিরোধীসহ দেশের ২৫ শতাংশ (১৫ থেকে ২০লক্ষ) মানুষকে হত্যা করেন। কাম্বোডিয়ার ইতিহাসে তিনিই সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত শাসক হিসেবে চিহ্নিত। “ভাইপোদা” যেভাবে বিরোধী বিজেপির আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, ক্ষমতায় থাকলে তিনি পুলিশকে কপালের মাঝখানে গুলি করতে বলতেন – তা পল পটের কর্মকান্ডের অনুসরণ! গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক নেতা এভাবে হুমকি দিলে তাঁর মানসিকতার পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠতে হয়। যতই অনুসন্ধানকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদুটির চাপ এই পরিবারের উপর বাড়ছে, ততই বেশী করে আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে তিনি নিজের উদ্ধত, স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রমাণ রাখছেন। “ঠাকুর ঘরে কে” জাতীয় প্রশ্নের উত্তরে তাঁর ব্যবহার “আমি কলা খাইনি” গোছের!
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে মহিলা পুলিশ দিয়ে ঘিরতে যাওয়া যে একটা ফাঁদ ছিল; তা পরবর্তী পর্যয়ে দলের এমএলএ ও নেতাদের আচরণে এবং বালখিল্য প্রতিবাদে(!) প্রমাণ হয়েছে। তাদের টিটকারী অক্ষমের নিষ্ফল প্রয়াসের মত লাগল। মনে হয় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার হতাশা থেকে উদ্ভুত এমন আচরণ। যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রুখে দেওয়ার কাজে মহিলা পুলিশকে ব্যবহার করা হয় মহিলা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আর পুরুষ বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুরুষ পুলিশ দেওয়া হয়। এটাই সারা পৃথিবীর নিয়ম – এতদিন এ রাজ্যেও তাই হয়েছে। জানি না পিসী-ভাইপোর অনুপ্রেরণায় কিনা, মনে হয় “ভাইপোদা”র অনুপ্রেরণায় রাজ্যের পুলিশ গত ১৩ই সেপ্টেম্বর ঠিক উল্টোটাই করেছে! মীনাদেবী পুরোহিতের মত একজন বরিষ্ট নাগরিক, ছ বারের কাউন্সিলার, প্রাক্তণ ডেপুটি মেয়রকে পুরুষ পুলিশ যেভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে তা এদের আরো কালিমালিপ্ত করেছে।আবার শুভেন্দুবাবুর অভিজ্ঞতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কাছে “ভাইপোদা”র পুলিশের ছক বানচাল হয়ে গেছে। হয়ত সেকারনে “ভাইপোদা”র রাগ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ এমন পল পটিয় ভাষায় বেরিয়ে এসেছে!
আগের লেখায় পিসীর অপ্রকৃতিস্থ আচরণের কারন দেখিয়েছি। এখানে ভাইপোর এমন আক্রমণাত্মক হওয়ার কারন ব্যখ্যার চেষ্টা করা হল। যত সময় যাবে, একে একে নিভিছে দেউটির মত যত দলীয় নেতা জেলের ভাত খেতে ঢুকবে, তত পিসী-ভাইপো জুটি রাগ,ভয় ও হতাশায় বেশী করে অরাজনৈতিক উপায়ে আক্রমণ শানাবে। এভাবে তারা অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকবে। যেহেতু প্রশাসন ও শাসক রাজনৈতিক দল এরাজ্যে সমার্থক ও একে অন্যের পরিপুরক, সেহেতু প্রশাসনও অপ্রকৃতিস্ত আচরণ করবে – ফলে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ও শাসন-ব্যবস্থার দ্রুত অবণতি ঘটবে। সেই শেষ অবস্থায় রাজ্যে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব সংবিধানের রক্ষকদের উপর। অপেক্ষা যত দীর্ঘায়িত হবে, জনসাধারণের দুর্দশা তত বাড়বে।
হীরক রাণীর দেশে
বেশ কয়েক বছর আগে নিউ জার্সিতে এক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে যোগদান করতে গিয়ে এক ডাক্তার-বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের সাথে কথোপকথনের সময় উনি একটি কথা বলেছিলেন – ভগবান যাকে ধ্বংস করা মনস্থ করেন, তাকে প্রথমে পাগল করে দেন! সেই কথা আমার এখন মনে পড়ল – সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গের স্বঘোষিত অধিশ্বরীর কার্যকলাপ!
আমরা জানি, ভিতরে ভিতরে মন দেওয়া নেওয়া হয়। এখন জেনেছি ভিতরে ভিতরে খাটের তলায়, ফ্ল্যাটের মধ্যে টাকার পাহাড় থাকে! এর কারন বোধহয় গোপন ব্যবসা! কিন্তু ভিতরে ভিতরে কিভাবে শিল্প হয়- তা ভেবে ভেবে মাথার একশ গাছি চুল ছিঁড়ে ফেলেও কোন উত্তর পেলাম না!
উনি নাকি ত্রিশ হাজার ছেলেমেয়েকে চাকরি দেবেন! নিয়োগ পত্র দেওয়া হল, বেসরকারী শিল্পের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষানবিশের! তাও যে কোম্পানির অধীনে, তারা জানালো তাদের লেটার হেড ব্যবহার করে এই কাজ করা হয়েছে। তারা এ ব্যপারে বিন্দু বিসর্গ জানে না। তারপর তিনি চুপ! বেকারদের তিনি অনেক পরামর্শ দেন – অনেকটা শিবরাম চক্রবর্তীর কৃষি পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার মত! তাঁর শেষ নিদান, পুজোর সময় চা,ঝালমুড়ি, ঘুগনি বিক্রির!
আসলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতির দায় অপ্রত্যক্ষভাবে রাজ্যের অধিবাসীদের (পড়ুন ভোটার)। জনসাধারণ ভোট দেওয়ার আগে প্রার্থীদের রাজ্য ও প্রশাসন পরিচালনায় যোগ্যতা এবং ক্ষমতা বিচার না করে – অর্থাৎ মস্তিষ্ক প্রয়োগ না করে, শুধু হৃদয়ের তাড়নায় ভোট দিয়েছেন। সেজন্য তাঁরা এমন শাসক পেয়েছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার অভাবে তারা ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার উৎকট বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভোটে জিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মত যা খুশী তা বলার এবং করার অধিকার জন্মায় না। সংবিধান মেনে আইন ও ঐতিহ্যকে সম্মান করে শাসন ব্যবস্থা চালাতে হবে – এই সাধারন সীমাবদ্ধতার কথা মনে হয় এই রাজ্যের শাসকদের অজানা!
প্রথমে বলি, গত কয়েকটি সাধারন নির্বাচনের সময় তৃণমূল দলের সুপ্রিমো বলতেন যে, জনগণ যেন মনে করেন, রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের সবকটিতেই তিনিই প্রার্থী – এই বিবেচনায় যেন মানুষ তাঁকে ভোট দেন! অর্থাৎ রাজ্যে তিনি একটিই পোষ্ট, বাকী সব ল্যাম্পপোষ্ট! তাই, এখন যখন রাজ্যের মন্ত্রী, পার্টির জেলা সভাপতি, অন্য নির্বিচিত নেতারা দুর্ণীতি ও নানাবিধ অসততার দায়ে ধরা পড়ে হাজতে যাচ্ছেন – তার দায়ও নিঃসন্দেহে দলের সুপ্রিমোকেই নিতে হবে – অন্ততঃ সহজ যুক্তি তাই বলে। নৈতিকভাবে তিনি সে দায় অস্বীকার করেন কিভাবে? তাঁর আরেকটি বড় সমস্যা হল, তাঁর কথাবার্তায় একজন megalomaniac রোগীর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। এই রোগের লক্ষণ, বেশী কথা বলা এবং সেই কথায় তাঁর অহংভাব ফুটে ওঠা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাঁর অনেকগুণ থাকলেও তিনি সেসব নিয়ে কিছু না বলে, যে সব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান নেই বা সীমিত – সেসব সম্পর্কে জনসমক্ষে জ্ঞান জাহির করতে গিয়ে বাহবা নেওয়ার বদলে হাস্যাষ্পদ হন। বহু উদাহরণ দেওয়া যায় – সরস্বতী-বন্দনার মন্ত্র সর্বসমক্ষে বলতে গিয়ে বললেন “কুচোসিত ভুইতো মুক্তা হারে, বিনা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে”! অথচ আসল মন্ত্র হল, “কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে, বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে”। আবার, ওনার অন্যতম প্রিয়পাত্র বীরভূমের তৃণমূলের সভাপতি – যিনি কথায় কথায় পুলিশকে বোম মারতে বলতেন; বিরোধীদলের মহিলাদের অব্দি গাঁজা কেসে ফাঁসানোর নিদান দিতেন ( নিজেই এখন নানাবিধ দুর্ণীতির দায়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও তত্বাবধানে চলা মামলায় ধরা পড়ে জেলে) – সম্পর্কে স্নেহের সুরে বললেন, ” ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়”! উনি ডাক্তারীর কিছু না জানলেও ওঁর কাছের ডাক্তাররা কেউ কি ওঁকে বলতে পারেননি যে, অক্সিজেন মাথায় নয়, লাংয়ে যায়, যার একাংশ রক্তদ্বারা বাহিত হয়ে ব্রেনে অর্থাৎ মাথায় পৌঁছায়। এর সাপ্লাই কমে গেলে ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যাবে। তাছাড়া, ওনার বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা নিয়ে এমনকি ওঁর নিজের দলের লোকজন পর্যন্ত হাসাহাসি করেন। ভদ্রমহিলার megalomaniac চরিত্রের পরিচয় আমরা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই পেয়েছি। ১৯৮৪ সালে উনি যখন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম সংসদীয় ভোটে দাড়ালেন, তখন হটাৎ নামের আগে ডঃ (পিএইচ ডি ডিগ্রীধারী) লেখাশুরু করলেন। দেখা গেল, উনি নাকি আমেরিকার অস্তিত্বহীণ বিশ্ববিদ্যালয় (!) ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এই ডিগ্রি পেয়েছেন! কিছুদিন আগে উনি বলেন যে, তিনি একসঙ্গে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, পোষ্টগ্র্যাজুয়েট ও ল ডিগ্রি করেছেন! অন্য রাজনীতিকদের সম্পর্কে ওনার বাক্য চয়নেও ওনার পরিচয় মেলে। একবার লোকসভা নির্বাচনের আগে উনি বললেন, নির্বাচনের পর উনি নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে শৃঙ্খলিত করে টেনে আনবেন! উনি প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে তুই-তোকারি পর্যন্ত করেছেন! এগুলো সবই megalomaniac চরিত্রের প্রমাণ। আবার, অন্যান্য বহু আচরণে তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না।
এবার সংবিধান স্বীকৃত ক্ষমতার বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। সরকারী প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, কোন মন্ত্রী, এমনকি মূখ্যমন্ত্রীর পর্যন্ত সরকারী কোষাগার থেকে অর্থ বিতরণের ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানের – সচিব, প্রধান সচিব, অতিরিক্ত মূখ্য সচিব ইত্যাদির উপর ন্যস্ত। বিভাগের নীতি নির্ধারণ ক্ষমতা বিভাগীয় মন্ত্রীদের। তবে তাদের সিদ্ধান্ত মন্ত্রীমন্ডলীর বৈঠকে গৃহীত হবার পরই তা কার্যকর হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মূখ্যমন্ত্রী। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এখন যাঁরা মূখ্য সচিব ও অর্থ সচিব, তাঁরা মৃদুভাষী, সুভদ্র অফিসার। কিন্তু তাঁরা DA মামলায় যদি আদালত অবমাননার দায়ে পড়েন, তাঁদের হাজতবাসের মত কড়া শাস্তি পর্যন্ত হতে পারে। তখন আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে মূখ্যমন্ত্রী কোন ভাবেই পড়বেন না। অথচ এই রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক ঘোষণা এমনভাবে করেন – এটা করলাম, ওটা দিলাম গোছের – সবেতেই ‘আমিত্ব’ ফুটে ওঠে! এগুলো যতদূর জানি, মন্ত্রীসভার যৌথ সিদ্ধান্ত, যা কার্যকর করার দায়িত্ব মূখ্য সচিবের তত্বাবধানে বিভাগীয় সচিবদের। সেজন্য প্রশাসনিক গাফিলতির দায় সচিবদের উপর বর্তালেও তা কখনো মন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর উপর আসে না। রাজনৈতিক নেতারা যখন গ্রেপ্তার হন, এসব কারনে নয়, একমাত্র দূর্ণীতি করে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীণ সম্পত্তি করার জন্য – আর এভাবেই থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। সাধারন মানুষের কাছে বাহবা নেওয়ার জন্য আত্মম্ভরী ঘোষণায় অসুবিধার জায়গাগুলো এবার আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছে। রাজ্য সরকারের বকেয়া DA না দেওয়া, যা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে – সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত – তার দায় সম্পূর্ণভাবে মূখ্য সচিব ও অর্থ সচিবের। মূখ্যমন্ত্রীর এখানে কোন দায় নেই। কিন্তু অনাবশ্যক আত্মম্ভরীতার কারনে রাজ্য সরকারের সমস্ত ব্যর্থতার দায় তাঁর ঘাড়েই চাপছে।
এখানে ১৯৮৯ সালে রুমানিয়ার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। সে দেশের নির্বাচনে রুমানিয়ার কম্যুনিস্ট ডিক্টেটর Nicolae Ceausescu ৯৯.৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তখন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের কারনে যে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হল, তা ভাঙ্গতে সরকার দমন-পীড়ন ও হত্যার যে চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করল, তাতে বিক্ষোভের আগুন প্রবলতর রূপ নিল। Ceausescuর ২৪ বছরের অপশাসনের পরিসমাপ্তি হল ঐ বছরের ২২শে ডিসেম্বর আর সস্ত্রীক Ceausescu ২৫শে ডিসেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিলেন। তিন মাস আগে তিনি দেশের সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন! এই Ceausescu এবং তাঁর স্ত্রী Elena Ceausescu তাঁদের আত্মম্ভরী ও উদ্ধত স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁদের প্রচার, বিশেষতঃ বাইরের দেশে এমন ছিল যেন Ceausescu আধুনিক রুমানিয়ার রূপকার – উন্নয়ণের জোয়ারে তিনি রুমানিয়াকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন! তাঁর পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই মিথ্যার ফানুষ ফেটে গিয়েছিল।সুতরাং, নির্বাচনে জিতে যেমন যা খুশী তা করা যায় না; তেমনি নির্বাচনে বেশী ভোটে জেতা কোন শাশ্বত জনপ্রিয়তার নির্ণায়ক নয়। এই সহজ কথাটা স্মরণ রাখলে রাজ্যবাসীর মঙ্গল। রাজনীতির মঞ্চে আজকের নবাব আগামীকালের ফকির।
আমরা যারা তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনীতি শুরু থেকে দেখে আসছি, তারা তাঁর অতিনাটুকেপনা দেখতে অভ্যস্ত। যেমন, তিনি যখন কংগ্রেসে সোমেন মিত্রদের দ্বারা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কোণঠাসা অবস্থায়, তখন একদিন প্রকাশ্যে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁসের অভিনয় করেছিলেন। আরেকবার ব্রিগেডের জনসভায় বিরাট এক রেডিমেড ঘন্টা বাজিয়ে বামফ্রন্টের বিদায় ঘন্টা বাজিয়েছিলেন! তিনি সর্বদা একদল চাটুকার সাংবাদিক ‘সেট’ করে রাখেন যারা সবেতেই “কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ” বলে বাহবা দেন। এই মেলোড্রামা বহু বছরের পুনঃ পুনঃ ব্যবহারে দীর্ণ। ফলে, গত বিধানসভা ভোটের সময় যখন তিনি নন্দীগ্রামে অজ্ঞাত (!) শত্রুর আক্রমণে (!) পা ভাঙ্গার কথা বলে পুরো নির্বাচন পর্বে হুইল চেয়ার অভিযান করলেন, তখনও তিনি নন্দীগ্রামে নির্বাচনী পরাজয় এড়াতে পারলেন না।
তবে আমি বরাবর তাঁর রাজনৈতিক বোধকে শ্রদ্ধা করি। উনি যথার্থই বুঝতে পারছেন, “একেএকে নিভিছে দেউটি”র মত তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর, মন্ত্রী-সান্ত্রীরা, যারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঔদ্ধত্বে দলের সুপ্রিমোকেও টেক্কা দিত – তারা এখন জেলের ভাত খেতে অভ্যস্ত হচ্ছে। অনেক আগে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলে আমি বলেছিলাম, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মনোভাবের প্রতিফলন হয়েছে রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের কর্মদক্ষতায়! তখন পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী – তিনি বলেছিলেন, শিক্ষকদের তিনি মাইনে দেন, তাই শিক্ষকরা তাঁর চাকর! এই লোকটির আমলে বিধানসভায় বেআইনীভাবে বিল পাশ করিয়ে আচার্য তথা রাজ্যপালকে বাদ দিয়ে দলদাস উপাচার্য নিয়োগ প্রথা চালু হয়! উচ্চ আদালতের নির্দেশে এইভাবে নিযুক্ত দলদাস এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর নিয়োগ বাতিল হয়। এই উপাচার্য, যার অধ্যাপক হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা ছিল না, তিনি তার নিয়োগ কর্তাকে তৈল মর্দনের নতুন রেকর্ড করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান কর্ণধারকে সাম্মাণিক ডি লিট দিয়েছেন! এই কর্ণধার এমনই বিদ্বান যে মুক্ত সভায় দাবী করেন, পশ্চিমবঙ্গে তিনি নাকি পাঁচশটি IIT তৈরী করে দিয়েছেন! অবশ্য রেকর্ড অনুযায়ী সারা দেশে তার পাঁচ শতাংশ IIT নেই! আমার অনুমান, উনি ITI এর সঙ্গে IITকে গুলিয়ে ফেলেছেন। কোন কিছু যদি না জানা থাকে তাতে সমস্যা হয় না; কিন্তু কেউ যদি না জানেন যে তিনি জানেন না, তবে তা বিপদের!
পরিশেষে বলি, তিনি এখনো “দুধেল গাই” তত্ত্ব প্রয়োগে মগ্ন। দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় তিনি ও তাঁর দল বলিষ্ট প্রতিবাদ করেন। হাতরাসের ঘটনায় চারজন হিন্দুকে গ্রেপ্তার করা হল যেখানে নির্যাতিতা একজন ইসলামী মহিলা – তিনি ডেরেকের নেতৃত্বে দলের পুরো টিমকে পাঠালেন। নিজে বারবার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নিশানা করলেন! তাঁর বশংবদ অর্ধশিক্ষিত “বুদ্ধিজীবী” সম্প্রদায় দম দেওয়া পুতুলের মত খুব লাফালাফি করল! তারপর যখন লখিমপুর খেরীর ঘটনা ঘটল, যেখানে একজন হিন্দু মহিলার উপর চরম পাশবিক অত্যাচারের কারনে ছ জন ইসলামী দুষ্কৃতি গ্রেপ্তার হল, তখন তিনি লোক পাঠানো দূরের কথা, এই ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত করলেন না। তাঁর পোষা “বুদ্ধিজীবী”রা শীত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন! এভাবে তিনি কিছু জেহাদীর সমর্থন পেলেও সাধারন ইসলামীদের সমর্থন হারাবেন। দুষ্কৃতি সর্বদা দুষ্কৃতি। নির্যাতিতাও সর্বদা নির্যাতিতা। এভাবে ধর্মের সুড়সুড়ি দেওয়া রাজনীতি বাঙ্গালী পরিত্যাগ করবেই। অনেক রাজনৈতিক গুণের অধিকারী হয়েও ধান্দার রাজনীতি, দুর্ণীতিকে প্রশ্রয়, ও জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে নিতে এক সময় তিনি রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যাবেন।
বাঙ্গালীর দূর্গাপুজা – সেকাল ও একাল
বাঙ্গালীর সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক খুঁজতে বাজারী বুদ্ধিজীবীরা ব্যর্থ! তাদের বক্তব্য হল, রামচন্দ্র উত্তর ভারতের, আর দেবী দূর্গা অর্থাৎ শিব ঠাকুরের গৃহিনী পার্বতী উমা হলেন বাঙ্গালীর নিজের কন্যা – কারন, দূর্গার বাপের বাড়ি বাংলায়! আসলে এইসব বুদ্ধিজীবীদের কেউ অভিনয় জগতে সাফল্য পাওয়া, কেউ বা সাফল্যের খোঁজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষজন – যারা নির্দিষ্ট চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে অভিনয় করেন! এরা সমাজ, সংস্কৃতি বিহীন এমন জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছেন যে, এখন আমজনতা এই বুদ্ধিজীবীকুলকে বিদ্রুপের পাত্র মনে করেন – এদের বিবেক বিশেষ আলমারিতে বন্ধ থাকে। অর্ডারী সময় শুধু তা বেরিয়ে আসে। এদের বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় এমন যে, আশ্বিনের শারদ প্রাতে দেবীপক্ষের সপ্তমীতে যে দূর্গাপুজাকে বাঙ্গালীর নিজস্ব বলে চালানো হয়, তা যে শ্রীরামচন্দ্রের হাত দিয়েই শুরু হয় – তার কথা এদের স্মরণে থাকে না! মহিষাসুর বধের যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত, তা বসন্তকালের পুজা। রাবণ বধের প্রাক্কালে শ্রীরামচন্দ্র যে দূর্গা মায়ের আরাধনা করেন, তাকে “অকাল বোধন” নামে অভিহিত করা হয়। এই অকাল বোধনই আমাদের বাঙ্গালী হিন্দুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুজা – দূর্গাপুজা। অথচ শ্রীরামচন্দ্রকেই এরা উত্তর ভারতীয় বলে বাংলায় ব্রাত্য ঘোষণা করেছে! রাজনৈতিক স্বার্থে এমন আজগুবি চিন্তাধারা একমাত্র বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নামের অর্ধশিক্ষিত ধান্দাবাজদের দ্বারাই প্রচার করা সম্ভব।
বাঙ্গালীর দূর্গাপুজার ইতিহাস যদিও কয়েকশ বছরের পুরোনো, এই পুজায় আমজনতার অংশগ্রহণ শুরু হয় ১৭৯০ সালে। তার আগে বনেদি পরিবারের দূর্গাপুজা অনেক ক্ষেত্রেই খুব ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলেও সেসব পুজায় সাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকত না। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পরবর্তী পর্যায়ে কোম্পানির সাহেবদের খুশী করার জন্য – ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দূর্গাপুজায় সাহেবদের বিশেষ নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নিয়ে আসা হয়। সেইসঙ্গে বাইজী নাচ ও সুরার বিশেষ বন্দোবস্তও করা হল। এই ব্যাপারে বিভিন্ন বনেদি বাড়ির পুজার উদ্যোক্তা পরিবারগুলির মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরী হত! নথি অনুযায়ী কোলকাতার প্রথম দূর্গাপুজার কৃতিত্ব দেওয়া হয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারকে। এদের দূর্গাপুজা শুরু হয় মোঘল আমলে – ১৬১০ সালে। প্রথম দিকে এই পুজাতেও সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারনে সর্বজনীন দূর্গাপুজার উদ্ভব হয়েছে। শুরুটা করেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে। এর থেকেই আসে বারো ইয়ারী – অর্থাৎ বারোয়ারী দূর্গাপুজা। বর্তমানে এই পুজা সর্বজনীন রূপ নেওয়ায় তা সর্বজনীন দূর্গাপুজায় দাঁড়িয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন স্বাধীনতা আন্দোলন বিক্ষিপ্তভাবে দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে, তখন কোলকাতার প্রথম বারোয়ারী পুজার সন্ধান মেলে ১৯০৯ সালে বলরাম বোসঘাট রোডে, যার উদ্যোক্তা ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা। এই পুজার প্রাণপুরুষ ছিলেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী। এই সময় থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার প্রধান কারন হল, দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য যেসব বিপ্লবী তরুণরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে মহিষাসুরমর্দিনী মা দূর্গারূপে বিদেশী অসুর ও তাদের দালালদের বিনাশ করার জন্য মানসিক শক্তি আহরনের উদ্দেশ্যে তাঁরা অসুরদলনী দূর্গার আরাধনা শুরু করেন। সঙ্গে গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল – সামাজিক মিলন।
বাংলার যে দুটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল – যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতি – তার নেতৃত্বে থাকা যুবকরাই এইসব পুজার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। এই প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঐ সময় বাঙ্গালী হিন্দুর মনে সৌভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ তৈরী করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ব্রাহ্ম ছিলেন, তবুও রবীন্দ্রনাথের দূর্গাপুজায় অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায় এই উপলক্ষ্যে তাঁর লেখা বেশকিছু কবিতায় ও গানে। যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বারোয়ারী দূর্গাপুজার গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই পুজার বহিরঙ্গের পরিবর্তন হতে থাকে। প্রথমে ছিল, এক চালের প্রতিমায় মা দূর্গা, মহিষাসুর, সিংহ সহ দুই পুত্র ও দুই কন্যা – সপরিবারে বিরাজমান। বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেকে নিজ নিজ বাহনারূঢ়া। তারপর ক্রমে মায়ের সঙ্গে পুত্র-কন্যারা আলাদা হতে লাগলেন। চালচিত্রেও বৈশিষ্ট্য এলো। শুধু মূর্তিময়ী মা – যেন চিন্ময়ী কন্যা উমা সপরিবারে মৃন্ময়ীরূপে আবির্ভূতা।
এগুলি সমাজে বাঙ্গালী হিন্দুর মননের পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। বারোয়ারী পুজার বর্তমান সংস্করণে আসার আগে বাঙ্গালী মননে দূর্গাপুজা ও তার ইতিহাস না জানলে পুজার বিবর্তনকে শুধু রাজনীতির চোখেই দেখতে হবে – সামাজিক নয়। প্রথমে বাঙ্গালীর সর্বজনীন বারোয়ারী পুজা শুরুর উদ্দেশ্য দেখা যাক। সাধারণ মানুষের কাছে বনেদী বাড়ির দূর্গা পুজায় অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত থাকলেও তাদের মনে পুজায় যোগদান ও সার্বিক অংশগ্রহনের আকাঙ্খা জাগানোর পিছনে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী যুব সমাজ – বিশেষতঃ ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একদল যুবকের মনে যে অসুরদলনী মাতৃরূপের মৃন্ময়ীর আরাধনাকেই আপামর বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ তাঁদের দেবী দূর্গা রূপে পুজা শুরু করে। এর ফলে যেমন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বার্তা দেওয়া হয়, তেমনই চারদিনের পুজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনের প্রক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। এই দুটিই প্রাক-স্বাধীনতা বারোয়ারী দূর্গাপুজার অবদান হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী সমাজের ও বাঙ্গালী মননে মা দূর্গাকে বাঙ্গালী তার নিজের ঘরের বিবাহিত কন্যার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। কৈলাশ থেকে উমা – পুত্র-কন্যাসহ বাপের বাড়ি, অর্থাৎ বাংলায় আসেন। বাপের বাড়িতে বহুদিন পর বিবাহিত কন্যা এলে যেমন আনন্দ-উৎসবে বাড়ি মুখরিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হতে শুরু করে। বিশেষতঃ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অসুরদলনী মহিষাসুরমর্দিনীরূপের প্রয়োজনীয়তা ফুরানোর পর ধীরে ধীরে তা প্রতীকী রূপ নেয় – আত্মিক প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
এইসময় মুসলিম লীগের বাড়বাড়ন্ত ও রাজনৈতিক দলগুলির ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় ইন্ধন দেওয়ার কারনে প্রাক-স্বাধীনতাপর্বের শেষের দিকে, ১৯৪৬ সালে বাঙ্গালীর দূর্গাপুজাকে ঘিরে নতুন ঝামেলার উদ্ভব হয়। বাংলার বশ কয়েকটি জেলায় ইসলামী মানুষের সংখ্যাধিক্য থাকায় এবং তাদের মসজিদ, মাদ্রাসার মৌলভী, ইমাম, মৌলানারা ইসলামী নেতৃবৃন্দের অঙ্গুলীহেলনে ইসলামীদের মূর্তিপুজার সক্রিয় বিরোধীতা করতে প্ররোচিত করে। তার পর থেকে বাঙ্গালী ইসলামীদের একাংশ দূর্গাপুজাকে হাতিয়ার করে ইসলামের পরিপন্থী কাজের অছিলায় দূর্গামুর্তি ভাঙ্গাসহ দূর্গাপুজা বন্ধের অভিযানে নামে। স্বাধীনতা উত্তর পূর্ব পাকিস্তান -অধুনা বাংলাদেশে – একইভাবে দূর্গামুর্তি ভাঙ্গা এবং পুজা পন্ড করার প্রক্রিয়া চালু আছে; যদিও সে দেশের বর্তমান সরকার প্রকাশ্যে এ ধরনের কাজের নিন্দা করছে, তবু তাদের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বর্বরতা বন্ধের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আসলে পুরো ব্যাপারে কিছু অপ্রকাশিতব্য মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায় মাত্র। প্রথম যখন বারোয়ারী দূর্গাপুজার প্রচলন হল, তখন হিন্দু মননে যে মাতৃপুজার রূপ চিহ্নিত হয়ে আছে, সেখানে বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শুধু নয়, তাদের সহযোগী হয়ে যেসব দেশীয় মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগীতা করত, তারাও অসুরশ্রেণীর মধ্যে পরত! যে যতীন্দ্রমোহন মুখার্জী ভবানীপুরে বারোয়ারী পুজার প্রচলন করেন, তিনিই বৃটিশ শক্তির হয়ে কাজ করা খান বাহাদুর শামসুল আলমের খুনের (ফেব্রুয়ারী, ১৯১০) নেপথ্যে ছিলেন। একদিকে যেমন মাতৃশক্তির আরাধনায় বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলেন, তেমনি বাঙ্গলার ইসলামী সমাজ এই পুজার মধ্যে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধালাভের সুযোগ না থাকায় ধর্মীয় মোড়কের আড়ালে এর বিরোধীতা করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষতঃ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুজা আচারের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাঙ্গালী ঘরের মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে চোখের জলে বিদায়ের সময় যে লোকাচার করা হয়, বিজয়া দশমীতে মাতৃবরণের সময় তার প্রতিফলন দেখা যায়। আবার বাঙ্গালী হিন্দু মেয়েদের আরেকটি লোকাচার – সিঁদুর খেলার মাধ্যমে দূর্গাপুজার সমাপ্তিতে বিভিন্ন পরিবারের মেয়েদের মধ্যে মেলবন্ধন দেখা যায়। বিজয়া দশমী অন্তে গুরুজনদের সম্মান জানানো ও অন্যদের স্নেহাশীষ এবং ভ্রাতৃত্ববোধের কোলাকুলি – সবই সামাজিক মেলবন্ধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
এভাবে দূর্গাপুজা কবে যে বাঙ্গালীর নিজস্ব সংস্কৃতিতে জারিত হয়ে নির্ভেজাল বাঙ্গালী হিন্দুর পুজার সঙ্গে উৎসবের মেজাজের মেলবন্ধন হয়ে গিয়েছে তার নির্দিষ্ট সন-তারিখ বলা সম্ভব নয়। তারপর, বাঙ্গালী হিন্দুর – বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুদের দূর্গাপুজায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন – যেটা বাঙ্গালীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এলো। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দলে দলে পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী হিন্দু সর্বস্ব খুঁইয়ে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আসেন। কিছু মানুষ আসাম এবং ত্রিপুরায় যান। এদের জওহরলালের নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হয়। পঞ্জাবে যেমন জন-বিনিময় হয়, তেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও করার প্রস্তাব শ্যামাপ্রসাদ ও বল্লবভাই প্যাটেল সমর্থন করলেও জওহরলালের তীব্র আপত্তিতে তা ঞবাতিল হয়। জওহরের এই বাঙ্গালী বিদ্বেষের পর উদ্বাস্তু বাঙ্গালীদের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কারনে এদের বামপন্থীরা যে রাজনীতির গোলকধাঁধায় ফেলেছিল, তার মূল শিক্ষা ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা” নামের সোনার পাথর বাটি মার্কা তত্ত্ব যার নির্গলিতার্থ উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের সব পুজা, আচার-অনুষ্ঠানকে বিদ্রুপাত্মকভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। এই “ধর্মনিরপেক্ষতার”র প্রভাব এসে পড়ল বাঙ্গালীর পুজা-আর্চা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর! প্রথমে শুরু হল মায়ের মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্তরালে পুজার ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তিকে বিদ্রুপের সঙ্গে লঘু করা। পর্বত কন্যা উমাকে শুধু কাঁচুলি পড়িয়ে মূর্তি তৈরী হল! তারপর বিভিন্ন পরিত্যজ্য জিনিষ – আবর্জনা দিয়ে মূর্তি গড়া শুরু হল! এই পর্যায়ে আখের ছিবড়ে, বাঁশ, এমনকি মাছের আঁশ, আবর্জনা দিয়ে মূর্তি তৈরী হয়েছে। এক সময় শুরু হল মাটির ভাঁড় নিয়ে ভাঁড়ামো! এদিকে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এবং বাজারী সংবাদ-মাধ্যমের ঢক্কানিনাদে বাঙ্গালী হিন্দুর দূর্গাপুজা কিভাবে যেন “দূর্গোৎসব” হয়ে গেল! রাজনৈতিক অশুভ শক্তির সঙ্গে জিহাদী শক্তির যোগসাজসে হিন্দুত্বকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা ‘আধুনিকতা’ ও ‘শিক্ষিত মনন’-এর পরিচয় হিসেবে ধরা হল! শুধু দূর্গাপুজা নয়, সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর “ভ্যালেনটাইনস্ ডে” হিসেবে অর্ধ-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মার্কা ধান্দাবাজ মানুষজন প্রচার করতে শুরু করল। এটা ঠিক যে, সকল ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন ঐ ধর্মের মানুষদের কাছে বিশেষভাবে পালন করার দিন হিসেবে দেখা হয়। ২৫শে ডিসেম্বর যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনের আনন্দ অনুষ্ঠানের গতি প্রকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হলেও, ঐ দিনের চার্চের প্রাতঃ প্রার্থনার কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার, ইসলামীদের ঈদের অনুষ্ঠান ও প্রার্থনার একচুল পরিবর্তনের কথা বলার সাহস কোন ভাড়াটে ধান্দাবাজ – যাদের পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী বলে, বা কোন ভুঁইফোর সাংবাদিক বা কোন “ধর্মনিরপেক্ষ” রাজনীতিককে বলতে শুনিনি! শুধু হিন্দুদের ‘পুজা’কে ‘পুজা’ না বলে ‘উৎসব’ বলে চালানোর প্রচেষ্টার পিছনে এক গুঢ় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসততা প্রতীয়মান হয়।
এবার আসা যাক কম্যুনিষ্ট-উত্তর সিপিএমের মেধাবী ছাত্রীর জমানায়। এই সময় “দুধেল গাই” তত্ত্ব ও বাঙ্গালী হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে state sponsored পরিবর্তন – বিশেষতঃ দূর্গাপুজায় – লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখন বারোয়ারী দূর্গাপুজা করা “ক্লাব”গুলি সরকারী অর্থের অনুদানে বলীয়ান। এর সঙ্গে ধর্ম বা পুজার কোন সম্পর্ক নেই। কারন, নির্দিষ্টভাবে পুজা-উপকরন বা মূর্তির জন্য এই অনুদান দেওয়া হয় না! বলা ভালো, এই টাকা ক্লাবগুলিকে কোন শর্ত ছাড়াই ‘দান’ দেওয়া হয়! একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা মনে পড়ে গেল – “there is no free lunch”। তাহলে ক্লাবগুলিকে এই অনুদান দেওয়ার কারন কি? সরকারী বিজ্ঞাপনে বলা হয় – “পুজা যার যার, উৎসব সবার”। অর্থাৎ, দূর্গাপুজা – যা এখন পুজা নয়, উৎসব – সবার! একেবারে সর্বধর্ম সমন্বয়! এর বহিঃপ্রকাশ শুরু হয়েছে দূর্গা মন্ডপে কোরান রাখা, গির্জা, মসজিদের আদলে দূর্গা মন্ডপ নির্মান – এসব দিয়ে! এমনকি জুতোর মন্ডপ পর্যন্ত এসে গেছে! অথচ অন্য ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এমন “সর্বধর্ম সমন্বয়” মার্কা বদ ঐতিহ্য দেখা যায় না। কোন ইসলামী মানুষ ঈদের নমাজে বা মসজিদের প্রার্থনায় হনুমান চালিশা বা গীতা বা বাইবেলের উপস্থিতি মেনে নেবেন কি? এভাবে সরকারী মদতে ইচ্ছাকৃতভাবে দূর্গাপুজার ইসলামীকরণ কাম্য নয়। তাছাড়া দেশের সংবিধান অনুযায়ী শুধু কোন পূজার জন্য সরকারী অর্থ সাহায্য করা যায় না। এর ফলে হয়ত কিছু রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে; বিনিময়ে দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুসলমান বিবাদের খেসারত আপামর বাঙ্গালীকেই দিতে হবে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আচার-আচরণের লঘুকরনের মাধ্যমে তাদের ধর্মবোধকে নষ্ট করে অন্য ধর্মকে অটুট রাখার প্রক্রিয়া হিন্দুত্বকে খতম করার রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ডকে যদি এখুনি প্রতিরোধ করা না যায়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভন্ডামীকে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতায় পরিণত করা হবে! বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বারোয়ারী দূর্গাপুজার যে রূপ আমরা দেখি, তা ভাতাজীবী বাঙ্গালী হিন্দুদের “দুর্গোৎসব” – দূর্গাপুজা নয়। সেখানে স্ফুর্তির বহুবিধ উপকরণ মজুত থাকলেও ভক্তির লেশমাত্র নেই।
আবার দূর্গাপুজাকে UNESCOর হেরিটেজ তকমা পাওয়া নিয়ে ধান্দাবাজ রাজনীতিক ও অর্ধশিক্ষিত সংবাদ-মাধ্যমের লম্ফঝম্ফ দেখে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগে – ঈদ বা খ্রীষ্টমাসের ধর্মীয় উদযাপন করাকে কেউ হেরিটেজ তকমা দিয়েছে কি? আর সেখানে দূর্গার বদলে ‘কোরান’ বা ‘বাইবেল’ পুজা করলেও তা হেরিটেজ হবে ত? এই ‘হেরিটেজ’ খায় না মাথায় মাখে – তাও বোঝা গেল না। আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী হিন্দুদের বলি, আর কতদিন ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত লাফাবেন? যে জাতির ধর্ম নেই – ধর্মবোধ নেই – তার আত্মহনন নিকটপ্রায়।
দেশভাগের যন্ত্রণার নেপথ্যে
সারা দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির আনন্দে গত আগষ্ট মাস জুড়ে উৎসবে মেতেছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতা “Tryst with destiny” সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ উদ্দীপনা সৃষ্টি না করলেও সম্ভ্রান্ত সমাজ এবং ইউরোপীয় সমাজের কাছে আদৃত হয়েছিল। আজ ভারতের স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসের তথ্য ঘাঁটলে জানা যায়, এটি একটি অলীক কল্পনা মাত্র। ইতিহাসে উপেক্ষিত অসংখ্য মানুষের রক্ত, প্রাণের বিনিময়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর ব্রিটেনের বেহাল আর্থিক হাল ফেরানোর তাগিদে বৃটিশরা ভারত সহ তাদের অধিকাংশ উপনিবেশকে স্বরাজ দিতে বাধ্য হয়। চরকা কেটে আর অহিংসা প্রচার করে যে পৃথিবীর কোথাও স্বাধীনতা অর্জন করা যায়নি তা ইতিহাসই বলছে! বরঞ্চ বলা ভাল, এই খন্ডিত স্বাধীনতা ভারতীয় হিন্দু, বিশেষতঃ বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে যুগের যন্ত্রনা (pangs of era)। ভারতের ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতার আগে ও পরে হিন্দু বাঙ্গালীর উপর যে চরম অত্যাচার – অবিচার নেমে আসে তা, “সমাজতান্ত্রিক” কংগ্রেসী এবং “ধর্মনিরপেক্ষ” কম্যুনিস্ট ঐতিহাসিকদের অবহেলা, অবজ্ঞা ও মিথ্যাচারে দেশের মানুষের কাছে কখনো সঠিকভাবে প্রচার করা হয়নি। বর্ধিষ্ণু বাংলা প্রদেশ ধর্মীয় জিহাদ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের শিকার হয়ে যাওয়ায় এবং তার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পঙ্গুত্বের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রইল।
যে খন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়া গেল, তার হীণবল ও শক্তি হ্রাসের জন্য দায়ী একদিকে ইসলামী মৌলবাদ, অন্যদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অপদার্থ নেতৃত্ব ও গান্ধীজীর অহংকারী, একগুঁয়ে, পক্ষপাতদুষ্ট পরিচালনা এবং সেইসঙ্গে শাসক বৃটিশের নোংরা রাজনীতি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর পূর্ববর্তী সময়ে (১৮৫৭র সিপাহী বিপ্লবের পরবর্তী সময়কালে) দেশে হিন্দু ও ইসলামীদের মধ্যে সর্বব্যাপী ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। এই হিংসার কারন হিসেবে প্রথমতঃ, গান্ধীজীর নির্বোধের মত খিলাফত আন্দোলনকে সার্বিক সমর্থন দেওয়া; দ্বিতীয়ত, প্রাক্তণ খিলাফতী সৌকত আলীকে জেনারেল সেক্রেটারী করে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও তাদের পরবর্তী কার্যপ্রণালী।
খিলাফত আন্দোলন একটি পুরোপুরি ধর্মীয় আন্দোলন – তুরষ্কে খলিফার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার ইসলামী সংগ্রাম। এই আন্দোলনকে কংগ্রেসের সমর্থনের মধ্যে গান্ধীজীর রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় না। হয়ত তাঁর ধারনা ছিল, এই আন্দোলনকে সমর্থন করার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দেশের ইসলামীরাও কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ ও স্বরাজের অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করবে! গান্ধীজীর এই সিদ্ধান্ত ইসলামী ধর্মবিশ্বাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর অজ্ঞতার প্রমাণ। গান্ধীজীর এই জিহাদী ইসলামী প্রীতির খেসারত ভারতকে বিশেষতঃ বাংলাকে চরম মূল্য দিতে বাধ্য করেছে এবং এই লোকটি তার জন্য কখনো দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি! মুস্তাফা কামাল পাশা তুরষ্ক দখলের পর খলিফার অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করেন। ফলে, খিলাফত আন্দোলনের কারন না থাকলেও ঐ সময় এই পরিস্থিতিতে ইসলামী মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের সঞ্চার হয়। আবার, ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণের পর তাদের কাজকর্মের সুবিধার্থে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ও তৎকালীন আধুনিক পড়াশুনার সুযোগ করে দেয়। তখন হিন্দুরা অধিক সংখ্যায় শিক্ষিত হলেও ইসলামীরা সাধারনভাবে ইংরেজী শিক্ষায় বিমুখ ছিল। আবার নবাব আবদুর রহিমের বৃটিশদের কাছে দরবার – যেখানে তিনি উর্দুভাষী আশরাফি ইসলামীদের ইংরেজী ভাষায় শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেও আতরাফি ইসলামীদের (মুলতঃ বাঙ্গালী ইসলামী, যারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত) জন্য শুধু বাংলা ভাষায় শিক্ষার দাবী করেন – যার অবিসংবাদী ফল হল, বাঙ্গালী ইসলামীরা অশিক্ষায় নিমজ্জিত থেকে মূলতঃ শ্রমিক ও মুনিষ খাটার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত।
এমতাবস্থায়, ভারতের ইসলামীরা, বিশেষতঃ আশরাফি ইসলামীরা আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সারা ভারতে ইসলামীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে ইসলামীদের জন্য আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের চেষ্টায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন – মহম্মদ হাসান দেওবান্দী, মহম্মদ আলী জউহর, হাকিম আজমল খান, মুখতার আহমেদ আনসারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তখন থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষতঃ ইসলামী মহল্লায়, মাদ্রাসা তৈরী ও মাদ্রাসা-শিক্ষার ব্যাপ্তি শুরু হয়। মহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী খান, ইস্কান্দার মির্জা, হুসেইন সাহিদ সুরাবর্দী এই প্রয়াসের ফসল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই ইসলামী নেতৃবৃন্দ পরবর্তীকালে ব্যাক্তিগত ক্ষমতা করায়ত্ব করার জন্য তাদের ধর্মকে ব্যবহার করে মসজিদের ইমাম, মৌলভীদের সঙ্গে জোট বেঁধে অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত আরজালি ও আতরাফি ইসলামীদের (এদের ৯৮ শতাংশই অতি দরিদ্র) ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে এবং লোভ-ভোগের অনুভূতিকে জাগ্রত করে ভারতের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইসলামী ঐক্যের আওয়াজ তুলতে শুরু করেন। এভাবে আধুনিক ভারতে যে ইসলামী মৌলবাদ জাগ্রত হল তার দায় গান্ধীজী ও তাঁর অঙ্গুলী হেলনে চলা কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর বর্তায়। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হল ‘মুসলিম লীগ’ নামের ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই দলের নেতৃত্বের উচ্চকোটিতে একমাত্র আশরাফি ইসলামীরাই ছিলেন!
মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব শুরুতে সারা ভারতে গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন ও যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গান্ধীজী আন্দোলন পরিচালনায় তাঁর বশংবদ নেতা ছাড়া আর কাউকে নেতৃত্বের ছিঁটেফোঁটা ভাগ দুরের কথা, স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতেন না! তাঁর দেখানো পথ ও মত, তা যতই অবাস্তব হোক, যিনি অনুসরণ করবেন, তাঁকেই শুধু গান্ধীজী কংগ্রেসে শামিল হওয়ার যোগ্য মনে করতেন। এমনকি তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধসহ সহিংস আন্দোলনের বিরোধীতা করে বৃটিশ সরকারের হাতকেই শক্ত করেছেন। ত্রিপুরী কংগ্রেসের পর গণতান্ত্রিক উপায়ে কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধী-জওহর জুটির আচরণ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়! ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির যৌক্তিকতা আবিষ্কার করেছিলেন গান্ধীজী! এমনকি তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’ ও ‘যুগান্তর’ এর বিপ্লবীদের কার্যকলাপের যে ভাবে নিন্দা করেছেন তা একজন বৃটিশ ভক্তর মুখে মানালেও, দেশভক্তর মুখে মানায় না। যেজন্য একাধিক বিদেশী ইতিহাসবিদ গান্ধীজীর অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা over-hyped আন্দোলন বলেছেন। এর ফলে, কংগ্রেস দলে যেমন সুযোগ্য নেতা ও দেশনায়কের অভাব ছিল, তেমনি গান্ধীজীর অদূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপ বারবার জিন্না ও তাঁর মুসলিম লীগকে জিহাদী মতবাদের দিকে ঠেলে দিতে সাহায্য করেছে। গান্ধীজী যত বেশী বেশী লীগ নেতাদের দাবী মেনে নিয়েছেন, লীগ তাদের দাবী আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে! এই পর্বে গান্ধীজী ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যার্থতা মুসলিম লীগের মূল শক্তি। অনেক ক্ষেত্রেই গান্ধীজী লীগ নেতাদের কংগ্রেসের নেতা, যেমন বিঠলভাই প্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুর চেয়ে বেশী বিশ্বাস করেছেন। গান্ধীজী শিক্ষিত হিন্দু নেতাদের মধ্যে জওহরলাল ও বল্লবভাই প্যাটেলকেই পছন্দ করতেন। তিনি সুভাষচন্দ্র, বাবাসাহেব আম্বেদকর ও শ্যামাপ্রসাদকে খুবই অপছন্দ করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করত। একই ভাবে তিনি জিন্না, লিয়াকত আলী, ইস্কান্দার মির্জা ও সুরাবর্দীকেও অপছন্দ করতেন। আবার এই নেতাদের সঠিক রাজনৈতিক উপায়ে মোকাবিলা করার ক্ষমতা জওহরলালদের ছিল না। ফলে, প্রতিপদে তাঁদের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দেশবাসীকে দিতে হয়েছে।
বারবার কংগ্রেসের থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে মুসলিম লীগ নেতাদের কংগ্রেস, বিশেষতঃ গান্ধীজী সম্পর্কে ধারনা হল, তারা যত চাপের রাজনীতি করবে, ততই কংগ্রেস দল মুসলিম লীগকে জমি ছাড়বে! এই ধারনার বশবর্তী হয়ে জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র ইসলামীদের জন্য ভারত ভেঙ্গে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পুরো পঞ্জাব এবং পুরো বাংলার সঙ্গে অসম ও বিহারের একাংশ দাবী করল। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। এই সময়ে সমাজে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসার প্রকোপ ছিল না। তবু মুসলিম লীগ দাবী করল, হিন্দু ও মুসলিম দুই আলাদা জাতি এবং মুসলিমরা হিন্দুদের সাথে সহাবস্থান করতে পারবে না! শুধুমাত্র মুসলিম লীগ নেতারা ধর্মীয় জিগির তুলে হিন্দুদের সাথে সহাবস্থানে তাঁদের অসহিষ্ণুতার কারনে ভারতভাগ দাবী করে। একাজে তারা দেশের মৌলানা, ইমাম ও মৌলভীদের দেশের সাধারন ইসলামীদের মগজ ধোলাইয়ের কাজে নামিয়ে দেয়।
যথারীতি গান্ধীজী ও কংগ্রেস এর মৌখিক বিরোধীতা করলেও একে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেনি। ফলে, কংগ্রেসের অযোগ্যতা এবং অকর্মণ্যতার কারনে মুসলিম লীগ স্বাধীনতার পূর্বে ধর্মীয় উন্মাদনা ও ইসলামী ঐক্যের মেকী বাতাবরন তৈরীতে সমর্থ হয়। অবশ্য এ কাজে ভারতীয় কম্যুনিস্টদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তারা গোড়া থেকেই ইসলামী ও হিন্দু-বিরোধী জিহাদী শক্তিকে সমর্থন করে এসেছে – অবশ্যই হাস্যকর অজুহাত তৈরী করে। তাদের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক নেতা ও প্রাক্তণ জেনারেল সেক্রেটারী ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী বারবার তাঁর লেখনীতে ভারতের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করেছেন; ভারতকে বিভিন্ন স্বশাসিত প্রদেশের সমষ্টি বলেছেন! শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামী সমাজকে শোষিত, নিপীড়িত সমাজ বলে পাক-ই-স্তান গঠনকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন! এই কারনে (!) পুরো বাংলা সহ অসম, বিহারের কিয়দংশ নিয়ে পূর্ব পাক-ই-স্তান গঠনের প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়েছিলেন! ‘peoples war’ এবং ‘peoples age’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর তত্ত্ব ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে। সম্পূর্ণ বাংলাকে পাকিস্তানে দেওয়ার পক্ষে বঙ্গীয় কম্যুনিস্টদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন মুজফফর আহমেদ ও জ্যোতি বসু। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলী ১৯৪৬ সালে ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য যে ক্যাবিনেট মিশন পাঠালেন তারা ত্রিস্তরীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার কথা জানিয়েছিলেন। সে সময় সেই ব্যবস্থা মেনে নিলে ভারতভাগ আটকানো যেত। কিন্তু জওহরলাল তাঁর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে লর্ড ওয়াভেলকে জানালেন যে এই ব্যবস্থা অমোঘ নয় এবং ভবিষ্যতে কংগ্রেস এর পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারবে! আর এতেই হিন্দু সংখ্যাধিক্যের জোরে মুসলিম লীগের ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা সরাসরি “লড়কে লেঙ্গে পাক-ই-স্তান” এর ডাক দেয় এবং জিন্না জঙ্গী আন্দোলনের স্তরে পাক-ই-স্তান প্রাপ্তির জন্য “devide India else destroy India” শ্লোগান তুললেন!
এদিকে বাংলার শতকরা ৫৫ ভাগ মানুষ ইসলামী হলেও এই প্রদেশের পশ্চিমদিকের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের প্রাধান্য থাকায় বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ভারতের সম্মিলিত বিরোধীদের নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী। রমেশ মজুমদার সহ বাংলার বহু বিদ্বজ্জন এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেন। আবার কৃষকপ্রজা পার্টির সৈয়দ হাবিবউল রহমান হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্য আওয়াজ তুললেও দুই যুযুধান দল – কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতভাগের প্রস্তাব মেনে নিতেই জিন্না মুসলিম লীগের পতাকায় তাঁর পাক-ই-স্তান (আল্লার পবিত্র ভূমি) এর জন্য যত বেশী সম্ভব জায়গার দাবী তুললেন। এদিকে তখন মুসলিম লীগ সমগ্র বাংলাকে পূর্ব পাক-ই-স্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবীতে অনড়। তখন কলকাতাকে পাক-ই-স্তানে অন্তর্ভূক্তির জন্য বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী যে ঘৃণ্য নীল নক্সা তৈরী করেছিলেন তা তার বিগত মাসগুলির কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যেত! মূখ্যমন্ত্রী হয়ে সুরাবর্দী বাংলার পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকহারে বিহার ও ইউনাইটেড প্রদেশ থেকে উর্দুভাষী ইসলামীদের নিয়োগ করতে লাগলেন। ফলে, তাঁর পক্ষে ডাইরেক্ট অ্যাকশানের সময় পুলিশের সহায়তা লাভ সম্ভব হয়।
বাংলাভাগ বন্ধ করার জন্য হিন্দু হত্যালীলার মাধ্যমে বাংলায় হিন্দু নিধনের প্ল্যান কার্যকরী করার প্রশ্নে হুসেইন সাহিদ সুরাবর্দী জিন্নাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। তাঁর গোপন উদ্দেশ্য ছিল ইসলামীদের কাছে জিন্নার চেয়ে নিজেকে বড় নেতা হিসেবে মেলে ধরা! সফল হলে তিনি পাক-ই-স্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকতেন!
এ উদ্দেশ্যেই তিনি জিন্নাকে ইসলামের পবিত্র দিনে (হজরত মহম্মদ এই দিনে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন, তার সমাপ্তিতে জয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি মক্কার উপর অধিকার কায়েম করেন) অর্থাৎ ১৬ই আগষ্ট, ১৯৪৬এ ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে পালনে প্ররোচিত করেন। ঐ দিন জুম্মার নামাজের পর দুপুর থেকে যে হিন্দু-হত্যালীলা শুরু হয়, তা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণিততম ধর্মীয় হত্যার ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
অনুব্রত কান্ড পরবর্তী খেলা হবে আতঙ্ক
ভুতের মতন চেহারা যেমন
নির্বোধ অতি ঘোর –
যা কিছু হারায়,CBI বলে
কেষ্টা ব্যাটাই চোর।
‘দিদি’র সবচেয়ে অনুপ্রাণিত ‘ভাই’, মাথায় অক্সিজেন (পরুন বুদ্ধি) কম যাওয়া, শ্রীমান কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মন্ডল যখন গ্রেপ্তার হন, তখন আমি ব্যস্ত ছিলাম বনগাঁ সীমান্তে ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের দেশের অতন্দ্র প্রহরী বিএসএফের জওয়ানদের রাখি পরানোর অনুষ্ঠানে। সেখানে বহু সাধারন মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন এই অনুষ্ঠান দেখতে। অনুব্রতর গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে মানুষের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ দেখা গেল তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পনের খবরে আনন্দ প্রকাশের সঙ্গে। মানুষের মুড দেখে মনে হচ্ছিল, রাম-রাবনের যুদ্ধে যেন কুম্ভকর্ণের পতন হল। শুধু বীরভূম নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গ যেন এক দুঃশাসনের থেকে মুক্ত হল! ‘দিদি’র অনুগৃহীত সংবাদ-মাধ্যমগুলি পর্যন্ত টিআরপি নষ্ট হওয়ার ভয়ে এই গ্রেপ্তারীর সংবাদ যথেষ্ট উল্লাস, উৎসাহের সঙ্গে পরিবেশন করতে বাধ্য হল।
অনুব্রত মন্ডল বীরভূমের অলিখিত মনসবদার ছিলেন বললেও ভুল হবে – তিনি এই জেলার সরকারি প্রশাসন, পুলিশ ও তাঁর দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ ছিলেন! সেখানে দেশের আইনের শাসনের জায়গায় অনুব্রতীয় আইনশাস্ত্র অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা মানতে জেলার মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল। আইন না মেনে হুঙ্কার, প্রশাসনকে বোম মারা ও মিথ্যা মামলা সাজানোর প্রকাশ্য হুকুম দেওয়া তাঁর কাজের অঙ্গ হিসেবে পরিচিত। প্রশাসন ও দলীয় কর্মীদের দ্বারা তাঁর আজ্ঞা পালনে বীরভূমে রাষ্ট্রের শাসন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর যিনি বলেন যে এই শিশুসূলভ সরল মানুষটির কি অপরাধ ছিল তা তিনি জানেন না – তখন সেই ব্যক্তির অভিনয় দক্ষতার প্রশংসা করেও তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। আমি মনে করি, এই স্থূল বুদ্ধির মানুষটির উচ্চাশা ও লোভের সুযোগ নিয়ে তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। যে বা যারা তাকে ব্যবহার করেছে তারা সকলেই কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থার র্যাডারে ধরা পড়বে। এ সবই অভিযোগ – প্রমাণের দায়িত্ব অনুসন্ধানকারীদের। যদিও অদম্য “অনুপ্রেরনা” বলতে পারেন যে তিনি অনুব্রতকে আগেই চিনতে পেরেছিলেন – কারন তিনিই প্রথম বি-জ্ঞান ভিত্তিক তত্ত্ব “ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়; কথাটা বুঝতে হবে” – বলেছিলেন। আসলে অক্সিজেন বলতে মহান মানুষজন বুদ্ধি বোঝেন! এই বুদ্ধি নিয়েই তিনি জেলার সব অবৈধ কাজকর্মে মদত দিয়েছেন এবং তোলা তুলেছেন – গরু পাচার, বৈধ-অবৈধ বালি খাদানের তোলা, পাথর খাদানের তোলা, গেস্ট-হাউস ও মেলা-হাটের থেকে তোলা, সবেরই বন্দোবস্ত করেছেন। মাননীয়ার কাছে অনুরোধ, তিনি যেন বিদায় বেলায় তাঁর এই আদরের ভাইটিকে তোলাশ্রী বা তোলাভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন!
এবার আসি এই কান্ডের অন্দরে সত্যের সন্ধানে। একটু লক্ষ্য করলে এখানে পার্থ-কান্ডের সঙ্গে যে তফাৎ দেখা যায় তা হল, পার্থ অনেকটা ছুপা-রুস্তম কায়দায় অপারেশন চালালেও কোন এক অদৃশ্য শক্তির অমোঘ অঙ্গুলিহেলনে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা পার্থর ব্যাপারে সমস্ত সূত্র মারফৎ সঠিক খবর পেয়ে অপারেশন-পার্থ সাফল্যমন্ডিত করেছে। কিন্তু অনুব্রত-কান্ডে সেই অদৃশ্য শক্তি অন্যভাবে অপারেশান চালিয়েছে। কারন,অনুব্রতর বুদ্ধির গোড়ায় “অক্সিজেন” কম থাকায় সে নিজেই অফুরন্ত সূত্র রেখে দিয়েছে যা কেন্দ্রীয় সংস্থাকে বিশেষ তদন্তসাপেক্ষে জানতে হয়নি! এখানে দাবার সবচেয়ে বড় বোরে অনুব্রতর দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের গ্রেপ্তারী। অনুব্রতর লম্ফঝম্প, বীরভূমের প্রশাসন ও পুলিশের আচরণ যা জমিদারদের খাস চাকরের মোসাহেবীকেও হার মানায়; ‘দিদি’র আশীবাদের হাত মাথায় থাকা – এসব থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেভাবে কাজ করেছে,তা প্রশাসনের আইএএস ও আইপিএস মহল পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, এই অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয় কেন্দ্রীয় সংস্থা হলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা এই তদন্তে নিয়োজিত হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের রিপোর্টিং অথরিটি হল উচ্চ আদালত। তাই কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির এই অনুসন্ধানে কোন হস্তক্ষেপ করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও যেটা সত্যি তা হল, দীর্ঘ সময় রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় থাকা “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি” নীতির সফল রূপকার সিপিএম সেটিং তত্ত্ব অবতারণা করে ভবিষ্যতে “টালির চালা” বা “শান্তিনিকেতন”কে সমর্থনের সুযোগ বজায় রাখছে। এ রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকরা তাদের ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রাজ্যের জনগণকে গরু-ছাগলের পাল মনে করেন! তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, তারা মিছিল করে ‘অনুসন্ধানে’ কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করছে; একই সঙ্গে তাদের তিন মন্ত্রী উচ্চতর আদালতে আবেদন করেছে – তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীণ সম্পত্তির ব্যাপারে যেন ইডি অনুসন্ধান না করতে পারে! ভারি অদ্ভুত আব্দার – চুরি করলে দোষ নেই, কিন্তু দেশের সংবিধান অনুযায়ী তার তদন্ত যে সংস্থার করার কথা, তাকে তদন্ত করতে দেব না! বোধহয়, এমন পরষ্পর বিরোধী কার্যকলাপ এরাই করতে পারে এবং এরা জনগণকে কতটা মূর্খ ভাবে তা এদের হাস্যকর আন্দোলনের মধ্যেই বোঝা যায়।
যাক এসব কথা। আমার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রতর যে এমন অবস্থা হতে যাচ্ছে তা তার বশংবদ এবং ‘দিদি’র খাস ভৃত্য প্রশাসনিক কর্তারা জানতেন না – তা অসম্ভব। তবে, মোদ্দা কথা হল, প্রমাণ সব আগেই ছিল। কিন্তু বারুদের স্তুপে আগুন কে লাগালো? লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, CBI এর modus operandiতে কোন নতুনত্ব নেই। শুধু পুরাতনভৃত্যর মস্তিষ্কের নিরেট অংশের সুযোগ নিয়ে তার পরামর্শদাতারাই তাকে ডুবিয়েছে। পার্থ-কান্ডের পর SSKMএর ডাক্তাররা আর শাসকদলের অভিযুক্ত VVIP চোর বদমাইশদের বিনোদন এবং বিশ্রামস্থল হতে দিতে পারবেন না – উচ্চ আদালতের তীক্ষ্ণ নজর আছে। কাজেই অনুব্রতর ‘অসুস্থ নাটক’ এর চিত্রনাট্য বদলের প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া অনুব্রতকে দশবার সাক্ষ্য দিতে ডাকলেও একবারের তরে সে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়নি। একবার হাজিরা দিয়েই অসুস্থতার অজুহাতে বেরিয়ে গিয়েছিল! তারপর শেষবার বোলপুরের সরকারি হাসপাতালের সুপার ও ডাক্তারকে অনুব্রতর বাড়ি গিয়ে মিথ্যা অসুস্থতার শংসাপত্র দিতে ‘বাধ্য’ করা হল! এমনভাবে কেস সামনে এল যে, CBIকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করার ক্ষমতা যেন অনুব্রতর আছে! এটা পরিষ্কার, অনুব্রত এই নাটকে এক নিরেট বুদ্ধির আকাট চরিত্র। কিন্তু তার পরামর্শদাতারা কারা? সেই প্রশ্নের উত্তর পেলেই অনুব্রতর উইকেটের চিরতরে পতন নিশ্চিত হবে। সারদা-কান্ডে গ্রেপ্তারী, এমনকি উচ্চপদস্থ IPSকে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টার বিরুদ্ধে রাজ্যের “অনুপ্ররনা” যেভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, তার ছিঁটেফোটাও এবার দেখা গেল না। তার কারন একটাই – দলের এবং প্রশাসনের রাশ পুরোপুরি “অনুপ্রেরনা”র হাতে নেই, অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি নিজের বিরুদ্ধে ত আর আন্দোলন করতে পারেন না – স্নেহ অতি বিষম বস্তু; বিশেষতঃ রক্তের সম্পর্কের মধ্যে। সুতরাং কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে ‘দিদি’র বড় ভরসা কেষ্টর উইকেট পড়ার পেছনে আরেক “শান্তিনিকেতন”এর থেকেই বারুদের স্তুপে দিয়াশলাই কাঠি জ্জ্বালানো হয়েছে বলে অনুমানের যথেষ্ট কারন আছে। মুসল পর্বে এখন “টালির চালা”র সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী হল একই অঞ্চলের “শান্তিনিকেতন”। আমি এইসব ঘটনার শুরু থেকেই বলে আসছি, রাজ্যে দল ও প্রশাসনের রাশ কার হাতে থাকবে বা যাবে তার লড়াই চলছে। তবে, দুই গোষ্ঠীর কুশীলবরা তাদের নির্বুদ্ধিতায় “খেলা হবে”র নেপথ্য খেলা জনসাধারনের কাছে প্রকাশ করে দিচ্ছে। আস্তাকুঁড়ের পাশে পড়ে থাকা দলের এক ছাঁটমালকে বাজারী মাধ্যম “বুদ্ধিজীবী” তকমা দিয়ে দম দেওয়া টাট্টুঘোড়ার মত রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে! তার বুদ্ধির একটি উদাহরণ – দলের এক পথসভায় তিনি সরবে তাঁর নবতম আবিষ্কার ঘোষণা করেছেন! পার্থর “বান্ধবী”র বাড়ি থেকে নাকি ৪০ কোটি নয়, ১০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে! এবং বাকী ৬০ কোটি টাকা নাকি ইডির অফিসাররা পকেটে পুরেছেন! অঙ্গভঙ্গী সহকারে তিনি উপস্থিত গুটি কয়েক শ্রোতাকে বলছেন! এমন আজগুবি স্ক্রিপ্টে অভিনয় বোধহয় সিনেমার সেরা কমেডিয়ানরাও করতে পারবেন না! এই রকম অজ্ঞ, চতুষ্পদীয় সমতুল বুদ্ধির সেনাপতি থাকলে হাগিস পরিহিত রাজনীতিবিদ যুবরাজের পর্যন্ত যুদ্ধজয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে কি! এই “বুদ্ধিজীবী” নেতার সিজার লিষ্ট তৈরীর পদ্ধতি সম্বন্ধে বিন্দুমাত্রও ধারনা নেই। উনি বোধহয় ওনাদের লুঠের বখরা কাড়াকাড়ির পদ্ধতির অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিষয়টা গুলিয়ে ফেলেছেন! আবার তিনি পার্থর হয়ে সাফাই দেওয়ার বদলে তাকে আরো গাড্ডায় ফেললেন! এদিকে বীরভূমের বেতাজ বাদশার গ্রেপ্তারের পর কিছু সাধারণ নাগরিক তার গাড়ি লক্ষ্য করে জুতো দেখাচ্ছিলেন, যা বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদের একটি ভাষা। তার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তৃণমূলের প্রবীন সাংসদ যিনি নাকি তথাকথিত “অধ্যাপক”, বললেন, এ লোকগুলোর গায়ের চামড়া দিয়ে নাকি ওনার পায়ের জুতো তৈরী করাবেন! আবার “অনুপ্রেরনা” যেমন ডিজিটাল মাধ্যমকে কুকুর বলছেন, তেমনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তুই-তোকারি করছেন! এই দলটির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি দেখে বাঙ্গালী হিসেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। পুলিশ, প্রশাসনের নিস্তব্ধতায় মনে হয় তারাও দিশাহারা!
এভাবে তৃণমূল দলের মূষল যুদ্ধে যে ভাবে “টালির চালা”র নেতৃত্ব এবং তাঁর দলবল প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তাতে মনে হয় যেন – চোরের মায়ের বড় গলা! চুরির অভিযোগ করা যাবে না, তার অনুসন্ধান করা যাবে না, সরকারি টাকা খরচের কোন হিসাব দেবে না – এরা কি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক? অবশ্য এসব প্যানিক প্রতিক্রিয়া হতেও পারে! কারন, আমরা জানি, শ্রমিক মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে তা রাণী মৌমাছির কাছে জমা রাখে। রাণী নিজে কোন মধু সংগ্রহ করে না। এভাবে যদি অনুচর নেতৃত্ব বার্তা দিতে থাকে, তাহলে বলতে হবে, “টালির চালা” অপেক্ষা প্রথম দু রাউন্ডে “শান্তিনিকেতন” এগিয়ে গেছে।
সুতরাং, আরো উইকেট পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এখানে বলা দরকার, “টালির চালা”র কাছের নেতা-নেত্রীরাও কিন্তু তেমনভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ঝড় তোলেননি। দলের কিছু তৃতীয় সারির খুচরো নেতা-নেত্রী ছাড়া নিয়ম রক্ষার মিছিলে কোন হেবি ওয়েট নেতার দেখা মেলেনি! শুধু “অনুপ্রেরনা” নিজে এবং কিছু লাইট ওয়েট নেতা, নেত্রী, যাদের উইকেট অদূর ভবিষ্যতে পরার সম্ভাবনা নেই, সংবাদ-মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে হাস্যকর রকমে পার্থ ও অনুব্রতকে সমর্থন করছেন। “অনুপ্রেরনা” বলছেন – কেষ্টকে কেন গ্রেপ্তার করা হল – কি তার অপরাধ! এ বিষয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলে তিনি শিশুসুলভ অজ্ঞতার অভিনয় করছেন – পশ্চিমবঙ্গবাসীর দুর্ভাগ্য। কিন্তু “শান্তিনিকেতন” গ্রুপের কেউ এখনো পর্যন্ত এই দুই অভিযুক্ত অপরাধীর পক্ষে কিছু বলেননি। তৃণমূল যখন দল হিসেবে “জিরো টলারেন্স”এর কথা বলে; আবার একই সঙ্গে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কেষ্টর গ্রেপ্তারের কারন না জানার ভান করেন, তখন এই ধরনের দ্বিচারিতা দলের চরম অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
জানিনা, এই লেখা ছাপার আগে আরো উইকেটের পতন হবে কিনা। তবে, একটা কথা নির্দিধায় বলা যায়, “টালির চালা” বনাম “শান্তিনিকেতনের এই লড়াইয়ের প্রথম পর্যায়ে “শান্তিনিকেতন” শুধু যে এগিয়ে আছে তাই নয়, দলের প্রায় পূর্ণ কর্তৃত্ব তার নিয়ন্ত্রণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলে এবং প্রশাসনে “টালির চালা”র ক্ষমতা খর্ব হতে বাধ্য। এই তৃণমূল দলটি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দল ও সরকারি প্রশাসনের মধ্যে বিভেদ রেখা তুলে দিয়ে প্রশাসনকে দলের অধীনে এনে দলকে সরকারি প্রশাসনের উপরে প্রতিষ্ঠা করে! তাই, মুষল যুদ্ধের পর্বে দলের আভ্যন্তরীন সংঘর্ষের সঙ্গে প্রশাসনিক অরাজকতাও বাড়বে।
তৃণমূলের অস্তিত্ব সংকট কোন পথে
পার্থ ও অনুব্রত কান্ড বর্তমান রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করেছে তার থেকে মুক্তির চেষ্টা করতে গিয়ে তৃণমূলের আভ্যন্তরীন অনৈক্যের যে খবর সংবাদ-মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে তা এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের শিরঃপীড়ার কারন হচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যে গোষ্ঠীকোন্দলের খবর দলের অস্বস্তির কারন, তার প্রায় সবগুলির মূলে আছে বখরার ঝগড়া ও কাটমানির দখল নিয়ে দলের আভ্যন্তরীন লড়াই। দলের সমর্থক ও সাধারন মানুষদের থেকে ‘ঘুষ’ বাবদ টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রির অভিযোগ। সঙ্গে জুড়েছে টাকা দিয়েও চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে পুরোনো কথা মনে পড়ে খেল – তখন ঘোর সিপিএম আমল – আলিমুদ্দিনের অনুমোদন ছাড়া রাজ্যে একটি গাছের পাতা অব্দি নড়ে না! সে সময় রাজ্যে প্রোমোটারী ব্যবসার রমরমা। সব প্রোমোটাররা নিজেরাই ‘লোকাল কমিটি’র নেতা বা আলিমুদ্দিনের নির্দিষ্ট স্থানে ভেট চড়িয়ে ‘বড় ব্যবসায়ী’। এক সময় পার্টির ‘চাহিদা’ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রোমোটার একই ফ্ল্যাট তিন-চারজনকে বেচে দিত! এমন অনেক কেস ধরা পড়ার পর সরকার নড়েচড়ে বসে এই অস্বাভাবিক তোলাবাজিতে রাশ টানতে বাধ্য হয়।
বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে দু রকম পদ্ধতিতে অবৈধ অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ পাওয়া যায় – অবশ্য এসব অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব প্রশাসনের। যেভাবে সংবাদ-মাধ্যমে নিত্য নতুন অবৈধভাবে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে – যার প্রতি ক্ষেত্রেই শাসকদলের যোগসূত্র দেখা যাচ্ছে – তার মূলে আছে বিভিন্ন অযোগ্য প্রার্থীদের সরকারি ও সরকারপোষিত সংস্থায় চাকরির বিনিময়ে মোটা টাকা সংগ্রহ! যে কেসগুলি যোগ্য প্রার্থীদের উচ্চ আদালতে মামলার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করছে তার সংখ্যা নগণ্য। পরবর্তীকালে যেখানেই সরকারি চাকরির কথা জানা যাচ্ছে, সবেতেই দূর্ণীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমার এক ভূতপূর্ব সহকর্মী, যিনি রাজ্য সরকারের অতি উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন, আমাকে কয়েকদিন আগে ফোন করে বললেন, “মনে হচ্ছে এরা গত এগারো বছরে সব সরকারি চাকরিই বিক্রি করেছে!” এই উক্তিতে সত্যতা হয়ত নেই, কিন্তু সারবত্তা আছে। অর্থাৎ, সরকারি চাকরি, তা শিক্ষক নিয়োগ হোক বা অন্য জায়গায়, সবেতেই অনিয়ম করে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চনা করে অযোগ্যদের ঢোকানো হয়েছে! শুধু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই দূর্ণীতির আর্থিক পরিমাণ আনুমানিক তিন হাজার কোটি হবে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনুমান। এছাড়া, জনশ্রুতি আছে যে, কোন নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে গেলে যথাস্থানে লক্ষ লক্ষ টাকার ভেট চড়াতে হয়! যদি কেউ দেশ সেবার সংকল্প নিয়ে নির্বাচনে লড়তে চান, তবে তিনি নিশ্চয়ই চড়া মূল্যে নির্বাচনের ‘সিট’ কিনবেন না! তারাই অর্থ ব্যয় করে নির্বাচনে লড়বেন, যাঁরা নির্বাচনে জিতে বিনিয়োগের বহুগুণ অর্থ, অবশ্যই অবৈধ উপায়ে, অর্জন করবেন! এ অসৎ ব্যবসার র্যাকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে – গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশসেবার রাজনীতির চরম অবক্ষয় হিসেবেই একে দেখা হবে।
এরপর আসি অবৈধ উপায়ে উপার্জনের দ্বিতীয় গণ-অভিযোগে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অভিনব পরিকল্পনা – যা রূপায়নের জন্য সরকারি প্রশাসনের সহযোগীতা আবশ্যক। তার জন্য ধীরে ধীরে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে দলদাসে পরিণত করা হল। তারপর এই পদ্ধতিতে যে কাজটির সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, তা হল, সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অনুদান দেওয়া। এর জন্য বিভিন্ন অকারন, অযৌক্তিক প্রকল্প ঘোষণা করে তাকে রাজ্যের ‘উন্নয়ণ’ বলে চালানো! এটি দু রকমভাবে করা হয় – প্রথমটি সরাসরি জনসাধারণের নির্দিষ্ট অংশকে বিভিন্ন নামের প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদান হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ প্রদান। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ভুয়ো একাউন্টে টাকা যাওয়ার সুযোগ আছে যা ইউসির অডিট হলে ধরা পড়া উচিৎ। আবার প্রাপকদের থেকে কাটমাণি নেওয়ার অভিযোগও আসছে! দ্বিতীয়টি হল, বিভিন্ন NGO এবং অন্যান্য সংস্থাকে ‘উন্নয়ণ’ ও ‘গবেষণা’র স্বার্থে প্রকল্পভিত্তিক অনুদান প্রদান! এই দুটি ক্ষেত্রেই টাকা নয়ছয়ের বিরাট সুযোগ রয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে যে মানুষদের অনুদান দেওয়া হচ্ছে তা প্রকল্প বিশেষে সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে প্রশাসনিক গাফিলতি আছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত তা একমাত্র সঠিক অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে। এমন মানুষের খোঁজ জানা আছে, যার বাড়ি, গাড়ি থাকা সত্বেও তার স্ত্রী ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রাপক! আবার এমন সংবাদ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে যে, স্বামী বর্তমানে স্ত্রী ‘বিধবা ভাতা’ পাচ্ছে! ১০০ দিনের কাজে MGNREGA প্রকল্পে প্রকৃত প্রাপক ও টাকার খরচের মধ্যে কারচুপি না থাকলে রাজ্য সরকার কেন বারবার UC দিতে ব্যর্থ হচ্ছে! যে কোন সরকারি প্রকল্পের কাজে বরাদ্দ অর্থ খরচের utilization certificate দেওয়া আইন অনুসারে বাধ্যতামূলক। না হলে পরবর্তী পর্যায়ে টাকা দেওয়া যায় না। রাজ্য সরকার এই UC না দিয়ে অযথা কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপের নাটক করছেন। তাদের এমন ভাব যেন মনে হচ্ছে, ভোটে জিতলে নির্বাচিত সরকারের দেশের আইন না মানার অধিকার জন্মায়! ভোটে জেতার অর্থ কিন্তু আর্থিক নয়ছয় করার অধিকার নয়। এছাড়া, ‘উন্নয়ণ’ করার তাগিধে যে কাজ করা হচ্ছে, সেখানেও রাজ্য সরকারের থেকে যথাযথ প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান না থাকার কারনে (দুর্জনে বলে, রাজ্যের শাসকদলের চাপে) এসব প্রকল্পের accountability থাকে না। এমন ব্যাপারও জানি, যেখানে গবেষণা প্রকল্পে গবেষক তার পাওয়া টাকার UC না দিলেও রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট পরবর্তী বছরের টাকার গ্রান্ট ‘রিলিজ’ করে দিয়েছেন! এইভাবে “এলোমেলো করে দে মা লুঠেপুটে খাই” নীতির ফলেই আদালতের রায়ের কারনে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারি অডিটের প্রেক্ষিতে ভিজিলান্সের সক্রিয়তাও শুরু হয়েছে বলে খবর।
এরপর আসছে রাজ্যের সম্পদ – কয়লা, বালি খাদান, পাথর খাদান ইত্যাদির অবৈধ উত্তোলন ও পাচার! সঙ্গে বাংলাদেশে অবৈধ উপায়ে গরু পাচার! রাজ্য প্রশাসন ও রাজ্য পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এসব পাচার কখনোই সম্ভব নয়।
এতদিন অনুগৃহীত সংবাদ-মাধ্যমের কর্মদক্ষতায় এবং প্রশাসন-পুলিশ ও দলের “দুষ্টু ছেলে”দের দৌরাত্মে রাজ্যের মানুষ বাধ্য হয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন দলের মধ্যে দুই প্রাসাদের লড়াই ও তার প্রভাবে এই দলের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। আগেও বলেছি, এখনও বলছি, দলের নেতারা যতই আভ্যন্তরীন কোন্দল বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেষ্টা করুন না কেন, আসলে এই লড়াই “টালির চালা”র সঙ্গে একই অঞ্চলের “শান্তিনিকেতন”এর লড়াই। রাজ্যের যুবরাজ ধীরে ধীরে দলীয় প্রশাসনকে নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছেন! যে সব নেতারা শুধু “টালির চালা”য় ‘অনুপ্রানিত’ থাকবেন তাদের উইকেট পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা! একটি কথা মনে রাখা দরকার – যেটা বারবার স্বার্থান্বেষী মহল থেকে ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে – কেন্দ্রীয় সংস্থারা যে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি দলের কোন সম্পর্ক নেই। কারন এই সংস্থাগুলি উচ্চ আদালতের নির্দেশে ও তাদের তত্ত্বাবধানে এই অনুসন্ধান চালাচ্ছে। একে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” বলা হতাশাজনিত বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা মাত্র।
ঠিক একই রকমভাবে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী থেকে তাদের রাজনৈতিক লাভের জন্য সেটিং তত্ত্ব আউরে জনগনের মনে অনুসন্ধানকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদের ও উচ্চ আদালতের সম্মানহানির অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, রাজ্যের যুবরাজের সরাসরি অনুগত ভৃত্যের পর্যায়ে না থাকতে চাওয়া হেবিওয়েট পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দলের জেলা সভাপতিদের মধ্যে নেত্রীর চরমতম প্রশ্রয়ে থাকা অনুব্রত মন্ডলের উইকেট কেন্দ্রীয় সংস্থাদের হাতে চলে গিয়েছে। এর অবিসম্বাদী ফল হল, দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বের কর্মপদ্ধতি বদল। শুধু ‘অনুপ্রানিত’রা নিশ্চুপ – যা কিছু আবোলতাবোল বকছেন “মাননীয়া” – আর “ব্রাহ্মণ যখন মুসলমান হয়, গোস্ত খাওয়ার যম হয়” প্রবাদকে মাণ্যতা দিয়ে যুবরাজ পদতলে “আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান” গোছের বক্তব্য রাখছেন – “আইন আইনের পথে চলবে” অথবা “মানুষকে ঠকিয়ে কেউ কিছু করলে দল তাকে সমর্থন করে না” এবং “আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি”! এসব বুলি এতদিন কোথায় ছিল? একজন পদস্থ পুলিশ কর্মচারিকে বাঁচাতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি যেদিন উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মচারিদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে বসেছিলেন, সেদিনই রাজ্যবাসীর কাছে সিগন্যাল গিয়েছিল যে দূর্ণীতি ও প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার প্রশ্নে রাজ্যের সর্বোচ্চ ব্যক্তির অবস্থান কি! সেদিন থেকে জনমানসে দূর্ণীতির ঝর্ণার উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে প্রশাসনকে বার্তা দেওয়া হল, দূর্ণীতিতে সহযোগিতা করার। তারপর থেকে ঘোমটা খসে গিয়ে দলের মধ্যে দূর্ণীতির গণতন্ত্রীকরন খোলাখুলিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এভাবে অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পর যুবরাজ আসরে নেমে তাঁর মত করে শুদ্ধিকরন প্রক্রিয়া শুরু করলেন! উদ্দেশ্য একটাই – গদির উত্তরাধিকার প্রাপ্তি – যা দ্রুততার সাথে কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হল। হাগিস পরিহিত রাজনীতিবিদের অধৈর্য্য ও অনভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক উত্তরণের প্রধান অন্তরায়। কারন, দুটি উইকেট পড়ার পর ‘অনুপ্রেরনা’র অনুচরদের আরো উইকেট পড়া যখন নিশ্চিত, তখনই এই অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা offence is the best defence নীতি সম্বল করে নেমে পড়বেই। অসমর্থিত খবর- একজন সুপার-হেবিওয়েট নেতার অন্ধকার কাজের প্রধান সহযোগী – তাঁর জামাই রাজ্য বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। এছাড়া, একজন মন্ত্রী এবং কোলকাতার কাছের একজন পৌরনিগমের মেয়রও নাকি একই পথের পথিক! সুতরাং, মুষল পর্ব শুরু হয়েছে – ধ্বংস শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এখানে সব বিরোধীদল, বিশেষতঃ বিজেপিকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন – যাতে ২০২১ এর পুনরাবৃত্তি না হয়। এটা পরিষ্কার, ছাটমাল ও বড় রকমের অসৎ না হলে কেউ তৃণমূল দল পরিবর্তন করবে না। অনেকে, এমনকি বড় মাপের রাজনীতিবিদ পর্যন্ত বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা একজন একনাথ শিন্ডের অপেক্ষায় আছেন! আমার মনে হয়, এই চিন্তা ভুল। কারন, আদর্শগত দিক দিয়ে বিজেপি ও শিবসেনার মধ্যে স্বাভাবিক মিত্রতা থাকার কথা। শুধু ঠাকরে পরিবারের ব্যক্তিগত উচ্চাশার জন্য মহাগোটবন্ধন তৈরী হয়েছিল – যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়াই স্বাভাবিক। শুধু একনাথ শিন্ডে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের কাজটুকু করেছেন।
পরিশেষে একটি উর্দু শায়ের দিয়ে শেষ করি – ” গুলিস্তাঁ বরবাদ করনে মে একই উল্লু কাফি হ্যায়, হর শাখ পর উল্লু বৈঠা হ্যায় ত গুলিস্তাঁ কা ক্যায়া হোগা”। এই এখনকার তৃণমূলের অবস্থা। এ সব ছাঁটমাল, দূর্ণীতিগ্রস্ত নেতারা (যারা মেনে নিয়েছিলেন, একটাই পোস্ট, বাদবাকী ল্যাম্পপোস্ট) বিজেপি বা সিপিএম – যে দলেই যাক না কেন, সেই দলের কর্মী, সমর্থকদের মনোবল নষ্ট করে দলের রাজনৈতিক সমাধি ঘটাবে। এই অনুপ্রানিত দলটির দূর্ণীতি ও বাগাড়ম্বরপ্রিয় অসৎ নেতৃত্বের ভারে চুর্ণ-বিচুর্ণ হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
বঙ্গ রাজনীতিতে সেটিং তত্ত্ব
পার্থ-কান্ড পরবর্তী সময়ে সংবাদ-মাধ্যমের – বিশেষতঃ বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত তথ্য হচ্ছে বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ‘সেটিং’! এটি বুঝতে গেলে সংবাদ-মাধ্যমগুলির স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞবৃন্দ ও রাজনৈতিক দলের থেকে পাঠানো বিশেষজ্ঞরা নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক প্রতিপন্ন করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এই সব আলোচনা সভা প্রায় সব সময়ই মাছের বাজারকেও চিৎকার, চেঁচামেচিতে হার মানায়। এসব দেখে মানুষজন আরো বিভ্রান্ত, বীতশ্রদ্ধ হন।
‘সেটিং’ কথাটা রাজনীতিতে এসেছে বহুদলীয় জোটের শাসন এবং বিরোধী পক্ষের জোটবদ্ধ অবস্থান থেকে। বঙ্গ রাজনীতিতে বহুদলীয় জোটের শাসন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে। এই ফ্রন্টের চালিকাশক্তি ছিল সিপিএম। অবশ্য স্বাধীনতাপূর্ব প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলীতে যে স্বল্প সময়ের পরিবর্তনশীল জোটের দেখা মিলেছিল, তা রাজনীতির নিয়মে বিশেষ পরিস্থিতি এবং পরিবর্তনশীল জাতীয় ও প্রাদেশিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে সময়ের দাবী হিসেবেই দেখা হয়। এখানে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ভারতীয় রাজনীতির কথা বলা হচ্ছে। এই ‘সেটিং’ তত্ত্ব বঙ্গ-রাজনীতির আঙ্গিনায় প্রথম আমদানি করে যুক্তফ্রন্টের বকলমে কম্যুনিষ্টরা – বিশেষভাবে সিপিএম। পরবর্তী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত রূপ দেখা এবং সমাজজীবনে রাজনৈতিক হিংসা রক্তক্ষয়ী দিকে মোড় নেয় বামপন্থী – নরম, চরম, অতিবাম ইত্যাদি বিভিন্ন কম্যুনিষ্ট দলের প্রত্যক্ষ মদতে। এই সময় থেকেই পুলিশকে শাসকদলের অধীনে “সরকারি গুন্ডা”র মত ব্যবহার করা শুরু হয় কম্যুনিষ্ট মদতে – স্ট্যালিনিস্ট ডিক্টেটরশিপের প্রাদেশিক আদলে! সেই সময় থেকেই সাধারণভাবে সমগ্র দেশে, আর নির্দিষ্টভাবে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যম (social and cultural media) প্রভাবিত হতে লাগল বামপন্থী চিন্তাধারায়। এমনকি, সংবাদ-মাধ্যম ও পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ বৈদ্যুতিন মাধ্যমের নীতি ও সাংবাদিক নিয়োগে বামপন্থী চিন্তাধারা সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে লাগল। আশির দশকে উচ্চশিক্ষায় UGC বেতনক্রম চালু হওয়ার পর থেকে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বঙ্গীয় শিক্ষা-জগতকে বামমনস্ক শিক্ষকদের দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হল। এই শিক্ষকদের প্রধান কাজ ছিল তাদের দলের চিন্তাধারা এবং বক্তব্যকে বামপন্থীয় বৈজ্ঞানিক চিন্তা – বলে প্রচার করা এবং তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ দলের বামপন্থায় দীক্ষার সূতিকাগার হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলেন। এভাবে বাঙ্গালী মননে তাদের বামপন্থী রাজনীতি যে বিশেষ বিষয়গুলি ঢুকিয়ে দিচ্ছিল তা হল, বিশ্বের বেশিরভাগ ধর্ম – বিশেষত খ্রীষ্ট ও ইসলাম – ধর্মনিরপেক্ষতাকে নীচু চোখে দেখলেও ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থীয় রূপকে আধুনিক জ্ঞানের স্তম্ভ হিসেবে বাঙ্গালীর মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া! ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা আদর্শগতভাবে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামের প্রতি নরম মনোভাবের কারনে বাঙ্গালীর মধ্যে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতা তৈরী হয়েছে। সে কারনে বাঙ্গালীর কম্যুনিষ্টসূলভ ধর্মনিরপেক্ষতা “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা”য় পর্যবসিত হয়েছে। কম্যুনিষ্টরা সর্বদা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করায় বাঙ্গালী সমাজে জাতীয়তাবোধের অভিব্যক্তি অনেক কমে গেছে। সেইসঙ্গে কম্যুনিষ্টসূলভ গোয়েবেলসীয় প্রচার (যা পরবর্তী সময়ে স্ট্যালিনের বড় ইউএসপি হয়ে দাঁড়ায়) করার ফলে বাঙ্গালী ও বাংলার সংস্কৃতি বলতে আরবীভাষাও সংস্কৃতি সংপৃক্ত বাংলাদেশের ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা সাম্প্রতিককালে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের এই বিশেষ অবস্থানের কথা মাথায় রেখে ‘সেটিং’ তত্ত্বের সাম্প্রতিক রূপের ব্যাখ্যায় আসতে হবে। ২০১১ সালের ঐতিহাসিক পালা বদলের পর পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিষ্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শে কম্যুনিষ্টদের অনুসারী না হলেও চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে কম্যুনিষ্টদের ছাপিয়ে
গেলেন। কম্যুনিষ্টদের আদর্শের নামে লিখিত বা অলিখিত জোট, “lesser enemy” ইত্যাদি তত্ত্ব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পরেই তৃণমূল সুপ্রিমো তাঁর দলের “যখন যেমন, তখন তেমন” নীতির সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে কখনো বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের জোটসঙ্গী, আবার কখনো কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের জোটসঙ্গী হিসেবে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন। আবার নিজের ও দলের স্বার্থে হটাৎ জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেই সরকারের চরম বিরোধীতা করেছেন! সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে কম্যুনিষ্ট ও তৃণমূল শাসনে রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে বিপরীতধর্মী দলের সাথে সমঝোতার লম্বা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। এই সময়ের সমঝোতার গোপন প্রয়াসকেই শ্লেষাত্মক শব্দে ‘সেটিং’ বলে অভিহিত করা হয়েছে!
কম্যুনিষ্ট লবি থেকেই এই ‘সেটিং’ কথাটা বলা হচ্ছে – মমতার তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের চালিকা শক্তি বিজেপি দলের। এ প্রসঙ্গে একটা চালু প্রবাদ মনে এল – “রতনে রতন চেনে” – কারন, রাজনীতির ইতিহাসে এই ধরনের গোপন সমঝোতা বঙ্গীয় কম্যুনিষ্ট নেতৃবৃন্দ, বিশেষতঃ জ্যোতি বসু ও তাঁর দল সিপিএম কেন্দ্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষতঃ রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস এবং পরবর্তী নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেসের সঙ্গে এই ধরনের গোপন সমঝোতা করেছিলেন। তারও আগে থেকে, ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে কম্যুনিষ্টদের সঙ্গে ইন্দিরার দীর্ঘ সময়ের ‘সেটিং’ ছিল। তখন কম্যুনিষ্টদের হাতে শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে ইন্দিরা কম্যুনিষ্টদের সাহায্যে পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিল পাশ করাই শুধু নয়, তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রকে সম্বল করে ইন্দিরা সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করেছেন – বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময়ে তা যথেষ্ট কাজে লেগেছে।একেই এখন কম্যুনিষ্টরা ‘সেটিং’ বলছেন! এমনকি মনমোহন সিংয়ের সরকারের সময়ে যখন কম্যুনিষ্টরা তাদের সমর্থন তুলে নিল, তার পরও এই ধরনের ‘সেটিং’ হয়েছিল বলে শোনা যায়। একে ঐ সময়ের বিরোধী দলগুলি “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি” বলে অভিহিত করত! মজার বিষয় হল, এখন এ রাজ্যে সিপিএম তথা কম্যুনিষ্টরা রাজ্য বিধানসভায় এবং লোকসভায় আসনসংখ্যার নিরিখে শূন্য হলেও, সংবাদ-মাধ্যম ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তাদের অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হয়! এতেই বোঝা যায় যে, এখনো সংবাদ-মাধ্যমে কম্যুনিষ্ট প্রভুত্ব বজায় আছে। রাজীব গান্ধীর সময়ে কম্যুনিষ্টদের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। কারন, তাদের ভাষায় – ‘সেটিং’। সিপিএম তাদের দলের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, যিনি বিভিন্ন উচ্চ আদালতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন, তাঁর রাজ্যসভায় জেতার সময় তৃণমূল দলের সঙ্গে ‘সেটিং’ কতটা কাজ করেছে তা দলের তরফে বলা হয়েছে কি? অঙ্কের নিয়মে কিন্তু বিকাশবাবুর ‘সেটিং’ ছাড়া জেতার কথা নয়। বিকাশবাবুর আগে কংগ্রেসের এক বরিষ্ট নেতার ক্ষেত্রেও রাজ্যসভায় জেতার প্রশ্নে তৃণমূল দলের সঙ্গে ‘সেটিং’ করার কথা আমরা জানি। সুতরাং, ‘সেটিং’ কম্যুনিষ্ট ও কংগ্রেস, সর্বদাই স্বার্থের প্রয়োজনে করে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে এই ‘সেটিং’ তত্ত্ব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাজারে ছাড়া হয়েছে – অবশ্যই সিপিএম এর প্রবক্তা! অথচ কিছুদিন আগে, গত মার্চ মাসের শেষের দিকে কেরলের সিপিএমের মূখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর চেয়ে আরো বড় ও কালারফুল ফুলের বোকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন – একে ‘সেটিং’ বলার সাহস কোন কম্যুনিষ্ট নেতার নেই! সততার পরাকাষ্ঠা দেখানো বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীকুল (১০০% রিডাকসান সেলে বিক্রি হওয়া) ও সিপিএম নেতারা একে ‘সেটিং’ বলুন দেখি! পশ্চিমবঙ্গের ইডি ও সিবিআইয়ের অনুসন্ধানে মূখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের জরিত থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে যদি এই দাবী করা যায় ত, কেরলের মূখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও ইডি, সিবিআই, এমনকি সোনা পাচারের মত গুরুতর অভিযোগের অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। সুতরাং, গোয়েবেলসীয় প্রচারনীতিতে কম্যুনিষ্ট প্রচারের ফানুস – মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘সেটিং’ বা তাঁর তুষ্টিকরনের জন্য গিয়েছেন আর বিজয়নের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা – এই প্রশ্নে কম্যুনিষ্টরাই সন্দেহের র্যাডারে পড়েছেন!
বঙ্গীয় তথা ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের একটি প্রধান দোষ হল, তারা ভারত ও ভারতীয়ত্ত্ব বিরোধী অবস্থান নিলেও সেটি দেশের জনগণকে মিথ্যার বুননে ভালোভাবে ‘গেলানো’র কাজে ধারাবাহিক ব্যর্থতা। এই কারনেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় এবং রাজ্য বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধি সংখ্যা শূণ্য। তবু, এরা এদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন করবে না!
আসলে রাজনীতিতে ‘সেটিং’ বলে কোন তত্ত্ব হয় না। আবার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য marriage of convenience একটি প্রচলিত প্রথা। যেমন, আদর্শগতভাবে কংগ্রেস ও শিবসেনা বিপরীত মেরুতে থাকলেও তারা একসঙ্গে মহারাষ্ট্রে সরকার চালিয়েছে। এ ধরনের সমঝোতা করলে আখেরে যে তা রাজনৈতিকভাবে ভালো হয় না, তা দেরীতে হলেও উদ্ধব এখন বুঝতে পারছেন। কিন্তু বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে কাশ্মীরে জেহাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে কম্যুনিষ্টরা ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হলেও তারা তাদের দেশবিরোধী লাইন পাল্টায়নি! এমনকি ১৯৬২ সালে চীন যখন ভারত আক্রমণ করে তখন অনেক ভারতীয় কম্যুনিষ্ট নেতা উল্লাস প্রকাশ করে বলেন যে, এবার চীন ভারতকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বে কম্যুনিষ্ট চীনের ঝান্ডা তুলবে! এমন ক্যুইসলিং (বাংলায় বললে মীরজাফর) শুধু ভারতীয় কম্যুনিষ্টরাই হতে পারে।
এবার দেখা যাক এই কম্যুনিষ্ট প্রচারিত ‘সেটিং’ তত্ত্বে কার লাভ। যদি ‘সেটিং’ তত্ত্ব সঠিক বলে রাজ্যের জনগণকে বোঝানো যায়, তবে, তৃণমূল সমর্থকদের কাছে মমতা বন্দোপাধ্যায়সহ তৃণমূল নেতাদের উপর অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরী হবে এবং একইভাবে বিজেপি সমর্থকদের কাছে বিজেপির উপরে হতাশা ও অবিশ্বাস জন্মাবে। ফলে দুই দলের ভোটারদের বড় অংশ তাদের দলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা কম্যুনিষ্টদের ভোটবাক্স ভর্তি করবে! এই আশায় নিজেদের কমিটেড সংবাদ-মাধ্যমদের কাজে নামিয়ে তারা ‘সেটিং’ তত্ত্বের হাইপ তুলে জনমানসকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
আমি মনে করি এমন তত্ত্ব বালখিল্য চিন্তার ফসল। কারন marriage of convenience তত্ত্বের নিরিখে তৃণমূল দলকে প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপির কোন প্রয়োজন নেই। রাজ্যসভা বা লোকসভায় তৃণমূল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিক – তাতে ফলের কোন হেরফের হবে না। তৃণমূলের আন্তজার্তিক স্তরেও আলাদা কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। বরঞ্চ তৃণমূলের সঙ্গে সামান্যতম সমঝোতায় রাজ্যে বিজেপির সমূহ ক্ষতি। প্রথমতঃ এ রাজ্যে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্ণীতির দায় বিজেপির ঘাড়ে চাপলে তাদের ভোটব্যাঙ্কে বিশাল ধ্বস নামার সম্ভাবনা। এই কথা মাথায় রেখে স্রেফ ভোট ভাঙ্গানোর রাজনীতি করার জন্যই সিপিএমের এমন অপপ্রচার।
এই অপপ্রচারকে হাওয়া দিচ্ছে কম্যুনিষ্ট তাঁবেদারীতে প্রশিক্ষিত সংবাদ-মাধ্যম ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম। অথচ, এরা একবারের জন্যেও ইতিহাসের পাতা উল্টে বলছে না যে, ‘সেটিং’ তত্ত্বে কম্যুনিষ্টদের একচেটিয়া অধিকার। আবার বলি, এই সেটিং তত্ত্বে বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকলে ক্ষতি তৃণমূল ও বিজেপির – লাভ সিপিএমের। আর, যে কোন রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বদা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন – তার জন্য কম্যুনিষ্টদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়না। কোন রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন করলে তা অনুমোদন করাই দস্তুর। সুতরাং মমতা বন্দোপাধ্যায় বা বিজয়নের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অন্য কোন অর্থ করার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সততার পরিচয় বহন করে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে কাশ্মীরের সাংসদ ফারুখ আবদুল্লার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হেসে হেসে কথা বলার ছবি সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কই, কম্যুনিষ্টরা এক্ষেত্রে ত ‘সেটিং’য়ের আওয়াজ তুলছে না!
এভাবে ‘সেটিং’ তত্ত্বের ভিত্তিহীন গল্প ফেঁদে কম্যুনিষ্ট ও তাদের বশংবদ সংবাদ-মাধ্যম জনগণকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করার জন্য যে নাটক মঞ্চস্থ করেছে তা ফ্লপ হতে বাধ্য। এভাবে পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিষ্টদের অন্তর্জলী যাত্রা ত্বরাণ্বিত হবে মাত্র।
পার্থ-কান্ডের নেপথ্যে কে
পার্থ-কান্ডে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। সংবাদ-মাধ্যম তাদের তৈল-মর্দন-নীতি বজায় রেখে টিআরপি বাড়াতে যার পর নাই সচেষ্ট। এমন হাইপ তোলা হচ্ছে যেন, সর্বকালের সেরা চোর ও লাম্পট্যে বিশ্ব-চাম্পিয়ন প্রাক্তণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়! মানুষ সর্বদা কলঙ্কের রসালো গল্প নিয়ে মশগুল থাকতে ভালোবাসে – এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। মদের সঙ্গে যত মুখরোচক ‘চাট’ থাকে, আসর ততই জমে ওঠে। এখানে ‘চাট’ খুব মুখরোচক। তাই, ভালো মানুষের ছেলেপুলেরা যখন মদের আসরে মাতলামি শুরু করল, তখন জনসাধারণরূপী ‘চাট’খোরেরা ঐ চাটের স্বাদেই বিভোর! লক্ষ্যণীয় হল, দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিকরা পার্থর নিন্দায় মুখর। এভাবে “মিডিয়া ট্রায়াল”এর বিরুদ্ধে একমাত্র তৃণমূলের দলনেত্রী তথা মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সরব হয়েছেন। এমনকি, অত্যন্ত ক্ষমতাশালী “যুবরাজ” পর্যন্ত পার্থর নিন্দায় খুবই সক্রিয়। অবশ্য, যে চিত্রনাট্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হচ্ছে তার ফলে জনসাধারণের কি লাভ এবং তার আসল উদ্দেশ্য কি তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।
গত ৩৪+১১ বছরের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি রাজ্যের জনসাধারণকে দিয়েছে এমন রাজনীতি যা মানুষে মানুষে কুৎসা, হিংসা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে। সেইসঙ্গে এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের চুরি, জোচ্চুরি, ধাপ্পাবাজি, লাম্পট্য যেমন বেড়েছে, নেতৃত্বের সর্বচ্চোস্তরের অভিনয় দক্ষতা সময়ের সঙ্গেসঙ্গে আরো নিপুনতা পেয়েছে! এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় – সমাজের যত ক্রিমিনাল, তারা সব সমাজসেবী হয়ে গেছে! সে কারনে রাজনীতির অন্ধকার, পঙ্কিল সরণীতে চোরাগোপ্তা মার ও “কিচেন কন্সপিরেসি” বেড়েছে – যা মুঘল শাসনের শেষদিকে দিল্লী দরবারে দেখা যেত, তা এখানেও দেখা যাচ্ছে।
কোন এক মণীষী বলেছিলেন, “যা সাদা চোখে দেখছ তা ঘটেনি, যা তুমি চোখে দেখনি সেটাই ঘটেছে” – এই কথার সারবত্তা এখন অনুভব করা যাচ্ছে। বিশেষতঃ পার্থ-কান্ড বিশ্লেষণ ও তার পরবর্তী রাজনীতির ময়দানের প্রতিক্রিয়ায় আমার তাই মনে হয়েছে। মাথায় যদি ঘিলু বলে কোন পদার্থ থাকে, তাহলে কিভাবে মানুষ বিশ্বাস করে যে, পার্থর বিশেষ ‘ঘণিষ্ট’ অর্পিতা এত টাকা, অলঙ্কার, বিভিন্ন ভূয়ো ও কাগুজে কোম্পানীর মালিকানা এফং জমি-বাড়ির দলিল – সব ফটাফট স্পুটনিকের গতির দ্রুততায় তদন্তকারী সংস্থা ইডি বের করে ফেলল! ইডির কর্মদক্ষতার ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। দ্বিতীয় একটি ব্যপার খুবই রহস্যজনক – ইডি যে কটি জায়গায় হিট করেছে, প্রতিটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এবং পার্থ-অর্পিতা ছাড়া এখনো অব্দি তাদের হিট লিষ্টে অন্য কেউ আসেনি! এমন নির্দিষ্ট ও সুচারু অপারেশান বোধহয় দেশের প্রথিতযশা সার্জেনরাও করতে পারতেন না! অথচ অর্পিতার তিনটি মূল্যবান গাড়ি নিখোঁজ! পার্থ-অর্পিতার একটি বাড়ি থেকে নাকি বস্তাবন্দি মালপত্র (!) চুরি হয়ে গেছে – এসবের কোন কিনারা হয়নি! আশ্চর্য লাগে, ইডি পার্থ ঘণিষ্ট বিভিন্নজনের স্থাবর-অস্থাবর কোন সম্পত্তি এখনো বাজেয়াপ্ত করল না, শুধু যে দুটি ফ্ল্যাটে গেল সেখান থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপর সম্পত্তি পেল! এসব দেখে মানুষের মনে হতেই পারে, পার্থর কাছের এবং দলের কোন শক্তিশালী মহল থেকে ইডিকে যেটুকু ‘খবর’ দেওয়া হয়েছে, ইডি সেটুকুই এগিয়েছে! একটা কথা ভুললে চলবেনা যে, এই অনুসন্ধানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির কোন সম্বন্ধ নেই – এটি হাইকোর্ট নির্দেশিত তদন্ত এবং ইডিকে হাইকোর্টের কাছে রিপোর্ট পেশ করতে হচ্ছে। আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার যার একটিই মুখ, মমতা বন্দোপাধ্যায়, তারা প্রতিটি মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেছে, এই কেসে কিন্তু সেভাবে তারা আপীলে যায়নি। যদিও, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কেস ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট যেসব মামলায় হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে তার মধ্যে অন্যতম হল, শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগ দুর্ণীতি। যত সময় এগিয়েছে, তত দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়েছে, গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে যত নিয়োগ হয়েছে তার সমস্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে যেখানেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান করেছে, সেখানেই দুর্ণীতির গন্ধ পেয়েছে। ফলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকারের নৈতিকতার ধ্বজা প্রায় ধুলায় মিশে গেছে। অথচ, ইডির modus operandi দেখলে বোঝা যায় যে, ইডি নির্দিষ্ট খবরের উপর ভিত্তি করে, নির্দিষ্ট মানুষদের টার্গেট করে তাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় তৃণমূল দলের মধ্যে নেতৃত্বের অবস্থান বৈপরীত্য লক্ষ্যণীয়। একদিকে কেন্দ্র তথা বিজেপির বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্র” তত্ত্বের কথা আউরে বিষোদগার ও পার্থর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে মমতা ঘণিষ্ট নেতা নেত্রীদের বক্তব্য প্রথমদিকে ফলাও করে সংবাদ-মাধ্যমে বেরোল; আবার সময়ের সাথে সাথে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়া পার্থকে “যুবরাজ” ঘণিষ্ট নেতারা মন্ত্রীত্ব ও দল থেকে সরাসরি বহিষ্কারের দাবী তোলে। শেষ পর্যন্ত যুবরাজ ঘণিষ্ট নেতাদের চাপে বরিষ্ট নেতা ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মত নেতা, যিনি প্রথমে পার্থর দপ্তরের দুর্ণীতিকে মন্ত্রীসভার “যৌথ দায়িত্ব” বলেছিলেন, তিনিও পরবর্তী সময়ে পার্থর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন! বোঝা যাচ্ছে যে, ফিরহাদ হাকিম যুবরাজের ঘণিষ্ট বৃত্তের সঙ্গে একাত্মতার বার্তা দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করলেন! তৃণমূল নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন বক্তব্য অনুধাবন করলে তাদের দলের আভ্যন্তরীন লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ফলে, শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত হাস্যকর প্রয়াস চালাচ্ছেন। ফিরহাদ হাকিম বললেন, ‘ইচ্ছে’ বাড়িটি ১১ নম্বর প্লটের উপর বসতবাড়ি হিসেবে দেখানো হলেও আদতে এটি একই মালিকের ১০, ১১ ও ১২ নম্বর এই তিনটি প্লটের উপর বানানো হয়েছে এবং এটি কমার্শিয়াল ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত আট বছর ধরে এই বাড়ি ব্যবহার করা হলেও পার্থ-কান্ডের পর ফিরহাদবাবুর ঘুম ভেঙ্গেছে এবং তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছেন, বকেয়া কর জরিমানা সহ আদায় করা হবে; প্রয়োজনে নাকি বেআইনি নির্মাণ ভেঙ্গে দেওয়া হবে! এতদিন বাদে কুম্ভকর্ণের মত জেগে ওঠার পিছনে কি উদ্দেশ্য? হটাৎ ফিরহাদের এমন পার্থ-অর্পিতা বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারন কি যুবরাজকে আনুগত্যের বার্তা দেওয়া – ভবিষ্যত এর উত্তর দেবে।
আবার মমতা বন্দোপাধ্যায় থেকে অভিষেক বন্দোপাধ্যায় একসুরে বলেছেন, ১৮ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ করা হবে – এটি মমতা সরকারের সাফল্য! অনুপ্রাণিত সংবাদ-মাধ্যম এদের জয়ধ্বনির কোরাস শুরু করল! কিন্তু আসল ঘটনা হল, এই নিয়োগ হাইকোর্টের আদেশে করতে হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে পরীক্ষা বা বিনা পরীক্ষা – যেখানেই শিক্ষক নিয়োগের ব্যপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, সেখানেই আর্থিক দুর্ণীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! এসবই এখন হাইকোর্ট নিয়োজিত তদন্তের ফলে প্রকাশ পাচ্ছে; আর মমতা সরকার সব আদেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চ ও তারপর সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে! দুর্ণীতি ঢাকার এমন মরিয়া চেষ্টা সরকারের তরফে ভারতে আগে কখনো হয়েছে বলে জানা যায়নি। এমনকি, মমতাদেবী সর্বসমক্ষে বললেন, “একশটা চাকরী দিলে একটা কি নিজের লোককে দেবে না”! ভারতের অন্য কোন জননেতা প্রশাসনিক পদে থেকে এমন কথা বলেছেন কিনা তা জানা নেই। সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এই কথা সম্পর্কে বলতে হয়, উনি যখন মূখ্যমন্ত্রীত্বে শপথ নিয়েছেন, তখন সংবিধান মোতাবেক “without fear and without favour” কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন! ওনার মতে হয়ত অল্প-চুরি, চুরি নয়! সুতরাং এখন যদি প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্ণীতির গণতন্ত্রীকরন হয়, তাহলে তার দায় কি মমতাদেবী এড়াতে পারেন?
ভারতীয় সংবিধানের ১১ নম্বর পার্টে খুব বিস্তৃত ও নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির ক্ষমতার বিভাজন লিপিবদ্ধ আছে। মমতা বন্দোপাধ্যায় মূখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন কারনে কেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষমতাকে রাজ্যের এক্তিয়ারে বলে জাহির করেন। সে বিষয়ে তিনি শোরগোল তুলে রাজনীতির বাজার গরম করার চেষ্টা করেন। তিনি যুক্তি ও আইনের চেয়ে তাঁর নিজের সুবিধাকে সর্বদা প্রাধান্য দেন! তাঁর অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সংবাদ-মাধ্যমকে ব্যবহার করার দক্ষতা, বিরোধী অনৈক্য এবং অলস বাঙ্গালীর অনুদানজীবি মানসিকতাকে সম্বল করে তিনি এতদিন রাজনীতির মঞ্চে সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর দলের মধ্যে মমতাদেবীর ‘ইচ্ছে’র থেকে অন্য কিছু বেশী গুরুত্ব পেতে চলেছে।
সেই ‘অন্য কিছু’ কি? আমরা দেখেছি যে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ‘যুবরাজ’ এক সময় প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদার থাকলেও তার মা তাকে “পিএম অন ওয়েটিং” করে রাখলেন! তারপর যুবরাজের সঙ্গেসঙ্গে তার দল কংগ্রেসও শুকিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কিন্তু এখানকার “যুবরাজ” রাজ্যের সিংহাসনে এখনই বসতে উদগ্রীব! আমাদের দেশের রাজনীতিকদের বংশানুক্রমিক দেশসেবার ঠিকাদারী নেওয়াই দস্তুর। তাই পশ্চিমবঙ্গের “যুবরাজ”-এর ইচ্ছা খুব স্বাভাবিক। সে কারনে তিনি অনেকদিন ধরে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। প্রথমে দলের মধ্যে তাঁর বশংবদ একটি গোষ্ঠী তৈরী করেছেন। তারপর দলের বরিষ্ট নেতা, যারা তাঁর বশংবদ হতে রাজী হবেন না এবং যাদের রাজ্য রাজনীতিতে কিছুমাত্র প্রতিষ্ঠা আছে, তাদের একএক করে দলে না থাকার মত পরিস্থিতি তৈরী করেছেন। দুই বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী দুরকম ভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন। তারপর এক এক করে যেসব নেতারা একমাত্র “অনুপ্রেঢ়ণা” ছাড়া আর কারোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন না, তাদের বিদায়ের ঘন্টা বাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হল। সুব্রত মূখোপাধ্যায় মরে গিয়ে হয়ত জেল হাজত ও অন্যান্য অপমানকর পরিস্থিতির থেকে রক্ষা পেয়েছেন। ফিরহাদ হাকিম টার্গেটে থাকলেও অনুপ্রেঢ়ণার “দুধেল গাই” তত্ত্ব এবং বগটুই কান্ডের পর এই মূহুর্তে হাকিমের চেয়ার ধরে টান না পড়লেও তিনি নিঃসন্দেহে অপেক্ষমান লিস্টে আছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত নেতা খুব স্বাভাবিকভাবেই টার্গেট হবেন। কারন সুব্রত মূখোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর অনুপস্থিতিতে তিনিই দলীয় ক্ষমতায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন – এটাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাল হল। যেমন, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী প্রথম যে উইকেটের পতন ঘটান তা প্রণব মূখোপাধ্যায়ের। এই মূহুর্তে তৃণমূল দলের জেলা সভাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে মমতা-ঘণিষ্ট হলেন বীরভূমের অনুব্রত মন্ডল। দেখা যাচ্ছে,তাঁর পিছনে নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা লেগে আছে। ইতিমধ্যে তাঁর দেহরক্ষীর থেকে প্রচুর বেআইনি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অনুব্রতবাবুর গাড়ির বেআইনি লালবাতির জন্য রাজ্য পুলিশ তাঁর ফাইন করেছে – এই পুলিশের বিরুদ্ধে তৃণমূল দলের পাইক বরকন্দাজ হিসেবে ব্যবহারের বহু অভিযোগ। পুলিশ অনুব্রতবাবুকে ঘাঁটানোর সাহস (হাইকোর্ট বললেও) কোথা থেকে পায়! তৃণমূলের উচ্চ পর্যায়ের সাহায্য ছাড়া এইসব হাইপ্রোফাইল নেতাদের আর্থিক ও অন্যান্য কেলেঙ্কারীর খবর তদন্তকারী সংস্থাদের জানা সহজ নয়। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে, এই মূহুর্তে তৃণমূল দলের নেতৃত্ব স্পষ্টতই দুভাগে বিভক্ত – বর্তমান ও আগামী। বর্তমানকে আপাত অসম্ভব পুরষ্কারের লোভ দেখানো হচ্ছে – ২০২৪শে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী চেয়ার – প্রধানমন্ত্রীত্ব! তবে তার আগে যুবরাজের রাজ্যাভিষেক পাকা করতে হবে।
এখন, রাজ্যের সাধারণ মানুষের চাকরী, রোজগার কিছুই নেই। শুধু নেই রাজ্য থেকে রাজনীতিকদের কোটি কোটি অসৎ উপায়ে লোক ঠকিয়ে উপার্জন করা অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে! “যুবরাজ” কালো টাকার জন্য মোদীর জবাব চাইছেন! এতেই বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের যুবরাজের সঙ্গে এই রাজ্যের যুবরাজের বুদ্ধির স্তরে কোন তফাৎ নেই। এ অনেকটা বামপন্থীদের শ্লোগান সর্বস্ব আন্দোলনের মত – “নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবীদের উপর মার্কিন আগ্রাসন হল কেন, কেন্দ্র তুমি জবাব দাও”! এদেরকে ব্যঙ্গ করে কোলকাতায় একটি চালু ছড়া ছিল, “ভুলতে পারি বাপের নাম, ভুলবো নাকো ভিয়েতনাম”!
দুর্বল চিত্রনাট্যের আরেক দিক হল, “যুবরাজ” তাঁর পয়লা নম্বরের মোসাহেব, যিনি নিজে সারদা কেলেঙ্কারীতে দীর্ঘদিন হাজতবাসের পর বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন, তাকে সঙ্গে নিয়ে ৫০০ দিন আন্দোলনরত পরীক্ষা উত্তীর্ণ চাকরীপ্রার্থীদের সঙ্গে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন! দেখা গেল, মোসাহেবি করা কিছু সংবাদ-মাধ্যম যুবরাজের উদারতার প্রশংশায় পঞ্চমুখ! আজ, আন্দোলনের ৫০০ দিন বাদে যুবরাজের আন্দোলনরতদের কথা মনে পড়ল! উনি কয়েকজন নির্দিষ্ট আন্দোলনকারীর সঙ্গে আলাদা দেখা করলেন। আমার প্রশ্ন, “যুবরাজ” কোন ক্যাপাসিটিতে তাদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং কোন ক্ষমতাবলে তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন! তার চেয়ে অনেক কার্যকরী হত যদি উনি “অনুপ্রেঢ়ণা”কে দিয়ে এই ছেলেমেয়েগুলির ন্যায্য চাকরীর বন্তোবস্ত করে দিতেন। আসলে উনি কিছুই করতে চান না এবং বর্তমান অবস্থায় কিছু করতেও পারবেন না। উনি শহীদুল্লার মত কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বে এমন ধারনা তৈরীর চেষ্টা করলেন যে,তিনি আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রতি সহানুভূতিশীল! এই নাটকের দুটি উদ্দেশ্য – এক, আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধন্দ্ব সৃষ্টি করা; দুই, নিজের নেতৃত্ব জাহির করা।
এভাবে “অনুপ্রেঢ়ণা”কে সরিয়ে “যুবরাজ”-এর অভিষেক প্রক্রিয়ার চিত্রনাট্য অনুযায়ী নাটক শুরু হয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তদন্ত প্রক্রিয়া আরো জোরদার করবে। বিরোধী দলগুলি আরো চেঁচামেচি করবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে “অনুপ্রেঢ়ণা”কে “যুবরাজ” প্রতিস্থাপন করলে জনগণের কি লাভ? এ হল, “head I win, tail you loose” গোছের ব্যাপার।
পার্থ-কান্ড তৃণমূলের ধ্বংসের অনুঘটক
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে ক্রমশঃ পঙ্কিল আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে, সেকথা অনেকবার লিখেছি। রাজনৈতিক অসততা ও ভোগলিপ্সার সঙ্গে যখন অযোগ্য, অসৎ হাতে প্রশাসনের দায়িত্বভার বর্তায়, তখন এভাবেই নোংরা পঙ্কিল স্রোতে সততা, মনুষ্যত্ব ও সমাজ সেবার ভড়ং ভেসে যায়।
আমি ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দেখে আসছি। ১৯৬৭র ভোটে বামপন্থীদের উত্থান ও তৎপ্রসুত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় থেকে রাজ্যের রাজনীতিতে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন দেখা যায়। সমকালীন গল্প, উপন্যাস, যেমন সমরেশ বসুর বিবর,পাতক ইত্যাদিতে তার ছাপ পাওয়া যায়। তারপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ ধরে নিয়েছে যে, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সরকারি টাকা নয়ছয় করা – রাজনীতিকদের একটি আবশ্যিক বাধ্যবাধকতার মত! এর বড় উদাহরণ হল, সারদা-নারদার মত টাকা আত্মসাৎ করা রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী পর্যায়ে ভোটে জিততে কোন অসুবিধা হয়নি। আর একথা সত্যি যে, রাজনীতিতে নির্বাচন লড়তে, দল চালাতে, তার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড রূপায়ণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সে অর্থ যে প্রথাগত বামপন্থী ভড়ংয়ের কৌটো ঝাঁকিয়ে খুচরো ‘তোলা’ তুলে সম্ভব নয়, তা এখন বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও বোঝে। সুতরাং কার “ঘনিষ্ঠ”র বাড়ি থেকে একুশ কোটি টাকা বেরোলো, তা নিয়ে মিডিয়া তার টিআরপি বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে; তবে তাতে আপাতদৃষ্টিতে দলের কোন রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
তবে, এখনকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিষয়টির গুরুত্ব অন্য রকম। তৃণমূলের সুপার-হেবিওয়েট মন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় সেক্রেটারি জেনারেল, যদিও তৃণমূল দলে সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড বলে কিছু হয় না, অভিজ্ঞতার নিরিখে মন্ত্রীসভায় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পরেই যার স্থান, সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি (যারা ‘পাবলিক মানি’ নয়ছয় ও আর্থিক অপরাধের তদন্ত করে) গত ২৩শে জুলাই, গ্রেপ্তার করেছে। রাজনীতিক ও নেতা-মন্ত্রীরা আগেও আর্থিক অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, এমনকি বিহারের প্রাক্তণ মূখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এই কারনে দীর্ঘদিন অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছেন। এতে কোন নতুনত্ব নেই। এতে রাজনৈতিক দলের ইমেজ নষ্ট হয় না। কারন, এত কিছুর পরেও লালু প্রসাদ যাদবের প্রতিষ্ঠিত এবং এখন তার পুত্র তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে পরিচালিত আরজেডি গত বিধানসভা নির্বাচনে বিহারের ভোটে শুধু বৃহত্তম দল হিসেবেই উঠে আসেনি, ক্ষমতাসীন নীতিশ কুমার-বিজেপির জোট সরকারের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে! কাজেই শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগ থাকলে তৃণমূল দলের চিন্তার বিশেষ কারন ছিল না। এক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারি বা বেনিয়ম নয় – এটি তদন্তাধীন অবস্থায় সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বলা যায় – চুড়ান্ত সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক অবক্ষয়ের নিদর্শন – অবশ্য সব অভিযোগ যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।
এই ঘটনায় তৃণমূল দলের প্যানিক বাটন টেপার জন্যই একথার সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। প্রথমে দলের হয়ে মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সংবাদ-মাধ্যমের কাছে প্রেস কন্ফারেন্স করে জানালেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার (বোধহয় বলতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপি) যে প্রতিহিংসার বশে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তাদের দলের নেতাদের (বহুবচন) বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন, তার কারনে যদি কেউ, অর্থাৎ, অভিযুক্ত, অসুস্থ হন বা তাদের কোন ক্ষতি (!) হয়, তবে ‘দল’ ছেড়ে কথা বলবে না। এই বক্তব্যের পর্যালোচনা করলেই ‘প্যানিক বাটন’ তত্ত্ব প্রমাণিত হয়!
কেন্দ্রের সরকার বা বিজেপি দলের সঙ্গে কিন্তু এই ইডি অনুসন্ধানের কোন সম্পর্ক নেই। অনুসন্ধান চলছে মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে। কোন ভারতীয় নাগরিক – মন্ত্রী, সান্ত্রীসহ সকলেই – ভারতীয় আইন মোতাবেক, আদালত নির্দেশিত অনুসন্ধানকারী সংস্থাকে এভাবে ভয় দেখিয়ে, শর্ত আরোপ করে অনুসন্ধানকারী সংস্থার কাজে বাধা দিতে পারেন কি! এ ত আদালতের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ! তৃণমূল দলের যে কোনো আইনজ্ঞ কোন আইনে এই সমালোচনা ও শর্ত আরোপ করা যায়, তা জানালে তাকে সেলাম জানাবো। অবশ্য এসব কথা কতটা ভয় থেকে আর কতটা হতাশা থেকে বলা হচ্ছে তা অনুমানের বিষয়। কারন, বক্তব্য রাখা মন্ত্রী নিজেও বোধহয় “প্রতিহিংসা” তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তার প্রমাণ হল, তৃণমূলের স্বীকৃত মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেছেন যে, আইনি পদক্ষেপে ‘দল’ কোন বাধা দেবে না; এবং দোষী প্রমাণিত হলে ‘দল’ তাকে কঠোর শাস্তি দেবে! লক্ষ্য করার বিষয়, দলের সুপ্রিমো মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করেননি; উপরন্তু তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এখনো মন্ত্রীত্ব এবং দলের সর্বভারতীয় মহাসচিবের পদে বহাল রেখেছেন! যদিও উচ্চ আদালতের বিচারপতি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে দুর্ণীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রীদ্বয় পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পরেশচন্দ্র অধিকারীকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানো হবে, সে আশায় আগেই “সততার প্রতীক” পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জল ঢেলে দিয়েছেন।
এখনো পর্যন্ত ইডির এই অনুসন্ধানে যা প্রকাশ পেয়েছে তার ফল তৃণমূল দলের পক্ষে মারাত্মক। কিভাবে এবং কেন? তা জানতে গেলে বাঙ্গালীর মানসিকতা ও সামাজিক এবং সাংসারিক বোধ সম্পর্কে ধারনা থাকা দরকার। রাজনীতিকদের সাধারণ আর্থিক দুর্ণীতি নিয়ে বাঙ্গালী যে মাথা বিশেষ ঘামায় না – যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ – গোছের চিন্তাধারা, তা প্রমাণ হয়, নির্বাচনের সময় সারদা-নারদার প্রভাব না পড়ায়। কিন্তু বাঙ্গালী নৈতিক শ্খলনজনিত (moral turpitude) অপরাধকে সর্বদা নিন্দা করে।এই নিন্দার ক্ষেত্রবিশেষে কারন ভিন্ন হলেও অভিমুখ একই থাকে। পার্থর ক্ষেত্রে এই নৈতিক শ্খলনজনিত খবরে জড়িয়েছে অর্পিতা মূখোপাধ্যায় ছাড়াও আরো কয়েকজন ‘ঘনিষ্ঠ’ মহিলার নাম। এদের প্রত্যেকের কাছেই হিসাব বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে অর্পিতা মূখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্কের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে পার্থর বাড়ি থেকে অর্পিতার নামে স্থাবর সম্পত্তির দলিল পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে কথোপকথনের জন্য বিশেষ মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়া, অর্পিতার বাড়িতে পাওয়া সম্পত্তির মধ্যে বিপুল পরিমাণ টাকা ও অলংকার ছাড়াও প্রচুর বিদেশি মুদ্রা পাওয়া গেছে। অর্পিতা কিসের জন্য ঘনঘন বিদেশযাত্রা করতেন, কার সঙ্গে, কি কারনে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অর্পিতা ইতিমধ্যেই পার্থর নাম এবং সম্পর্ক নিয়ে ইডির কাছে মুখ খুলেছে। সুতরাং, বিদেশ সফর জনিত আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা তাও বিচার্য বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ যে, অর্পিতা ও পার্থর নাম মিলিয়ে পার্থ বোলপুরে তার একটি বাংলোর নাম রেখেছে “অপা”। এসব নোংরামো বাঙ্গালী কতটা সইবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। এদিকে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের খামে অর্পিতার বাড়িতে প্রচুর টাকা মিলেছে। তৃণমূলের পক্ষে মারাত্মক খবর হল, অর্পিতার কাছে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের একটি গোপন কালো ডায়েরির খোঁজ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ইডির সিজার লিস্টে ছত্রে ছত্রে দুর্ণীতি, শিক্ষিত বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের হৃদয় বিদারক চাকরি চুরি, এসবের প্রমাণ। একটি অন্য দপ্তরে উচ্চপদে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি এটুকুই বলতে পারি যে, এত বড় দুর্ণীতি এবং সামাজিক দুষ্কর্মের খবর মূখ্যমন্ত্রী জানতেন না, তা অবিশ্বাস্য! পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের modus operandi সম্বন্ধে যে ধারনা আছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের সরকারে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোনো দপ্তরের কোনো কাজ হয় না – সমস্ত বিভাগীয় মন্ত্রীরা জনসমক্ষে একে মূখ্যমন্ত্রীর “অনুপ্রেঢ়না” বলে অভিহিত করেন! সুতরাং, শিক্ষা দপ্তরের এই পাহাড়প্রমাণ দুর্ণীতির “অনুপ্রেঢ়না” কে? কেউ কি জবাব দেবেন? এভাবে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পরল! এইসব কর্মকান্ডে যে টাকা পাওয়া গেছে তা বাঙ্গালীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শিক্ষিত যুবশক্তিকে ধ্বংস করে ভাতাজীবি হতে বাধ্য করার চক্রান্তের ফসল। জাতি ধ্বংসের জন্য দায়ী এই নেতৃত্ব। তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে পার্থর সঙ্গে দল ও দলনেত্রীর পৃথকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে তা যেমন দল ও দলনেত্রীকে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা, তেমনই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে অর্পিতা মুখোপাধ্যায় অপরিচিত নন – তার একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি এবং মমতার নিজের মুখ থেকে অর্পিতার প্রশংসার ক্লিপিংস সংবাদ-মাধ্যমে ঘুরছে। এখানেই শেষ নয়, তৃণমূল দলের সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানে এই অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মঞ্চ আলো করে বসে থাকার ছবি প্রমাণ করে যে, দলের কাছে এবং দলনেত্রীর কাছে অর্পিতা অপরিচিত – এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা। অর্পিতার উপার্জনের কোন নির্দিষ্ট সূত্র জানা না গেলেও তার মডেলিং ও অভিনয়ের প্রশংসা মমতার মুখ থেকে শোনার পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওড়িয়া সহ গোটা চারেক ছবিতে ছোট পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে! এর জন্য মূখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা দৃষ্টিকটু লেগেছে।
ইডি অনুসন্ধানের অন্য একটি অভিমুখ অবশ্যই নোটবন্দী পরবর্তী পুরোনো নোট জমা করার মধ্যে নিহিত আছে। সমাজে ব্যপকভাবে বিস্তৃত এক কলুষিত নেটওয়ার্কের অভিযোগের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ২০১৪-১৬ সালের মধ্যে শিক্ষাদপ্তরের নিয়োগে এই সব ঘুষের বিপুল টাকা এসে থাকলে নোটবন্দীর পরের ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোটে এই টাকা পাওয়া গেল কিভাবে? এটা তখনই সম্ভব, যদি ভালো এবং ব্যপক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, পেট্রোল পাম্প, সর্বপরি সাধারণ মানুষের মাধ্যমে পুরোনো বাতিল নোট জমা দিয়ে তা নতুন নোটে পরিবর্তন করা হয়! এই রহস্যের উদঘাটন জরুরী। এভাবেই সব চোর, জোচ্চোর,বাটপার, অপরাধীরা সব কালো টাকার পুরোনো নোটকে নতুন নোটে বদলে নেওয়ায় সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে, প্রায় সব পুরোনো নোট বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এভাবে কালো টাকার ভান্ডার নষ্ট করা যায়নি। রাজনীতি প্রযোজিত এই সামাজিক ব্যাধি দুর করার দায়ীত্ব ইডির উপর। এই সরকারের আমলের অপরাধের গণতন্ত্রীকরণের কুশীলবদের শণাক্ত করা জরুরী।
আবার অর্পিতার মায়ের কথায় আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট। তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর মেয়ের মডেলিং ও অভিনয় ছাড়া আর কোন ‘কাজ’-এর কথা জানেননা। সেইসঙ্গে এও স্বীকার করেছেন যে, মেয়ের মুখে তিনি মেয়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কথা মেয়ের কাছেই শুনেছেন! এখানেই অনেক না বলা কথা বলা হল! আবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় অনুসন্ধান ও তার পরবর্তী পর্যায়ে যখন অনুসন্ধানকারী দলের কাছ থেকে মোবাইলে কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন, পরপর চারবার তিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়কে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন! মমতা ফোন ধরেননি। এর দুটো কারন হতে পারে। দলের এবং মন্ত্রীসভার গায়ে এভাবে কালি লাগায় তিনি অসন্তুষ্ট, বিরক্ত; অথবা তিনি ভয় পেয়েছেন। প্রথমটি হলে, চার্জসিটে এভাবে পার্থর বিরুদ্ধে বহু গুরুতর অভিযোগ ও প্রমাণ থাকায় এবং পরিষদীয় ও শিল্প এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রীর পদে আসীন পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার দলের সর্বভারতীয় মহাসচিব! এহেন গুরু দায়িত্বে থাকা মানুষের জন্য যদি দলের গায়ে কালি লাগে, খুব স্বাভাবিকভাবেই মমতা তাকে মন্ত্রীসভা থেকে এবং দলের পদ থেকে সরিয়ে দেবেন। যদি আদালতে পার্থ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারে তবে তাকে পুনরায় সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মমতা তা না করায় বোঝা যাচ্ছে যে,মমতা পার্থকে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কেন? কারন অবশ্যই আদালতে পার্থ যদি রাজসাক্ষী হয় এবং……। এই ভয় থেকেই মমতার অবস্থা ছুঁচো গেলার মত – না পারছেন পার্থকে ফেলতে, না পারছেন গিলতে!
পার্থ উপাখ্যানের আরেকদিক হল, এই দুর্ণীতি শুধু আর্থিক নয়, এর সামাজিক ও মানবিক দিক হল – অভিযোগ আছে, এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে যোগ্য ও সফল প্রার্থীদের শিক্ষকতার চাকরীতে নিয়োগ না করে অযোগ্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ করা হয়েছে। এই সরকারের প্রশাসনিক বদলী থেকে ধরে চুক্তিভিত্তিক চাকরীর ক্ষেত্রেও প্রচুর ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই কদিনের অনুসন্ধানে ঘুষের সম্পত্তির পরিমাণ ১২০ কোটির বেশী বলে প্রাথমিক অনুমান করা হচ্ছে। এই টাকা শুধু অর্পিতা নয়, জেলায় জেলায় এমন বহু ‘অর্পিতা’র সন্ধান পাওয়া যাবে। বিদেশী যোগাযোগ ও হাওলা সম্পর্কও বেরিয়েছে! কে জানে, বিদেশীদের সঙ্গে মিলে এই দেশে ধ্বংসাত্মক কাজে, যেমন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ইত্যাদির মত কাজে এই অর্থের অংশ ব্যবহার হত কিনা। একজন বরিষ্ট মন্ত্রীর এমন “ঘনিষ্ঠ” বান্ধবীদের সংখ্যা অনুসন্ধানের সঙ্গেসঙ্গে যত বাড়বে, তত কাদাঘাটা, নোংরা তথ্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মমতাদেবী তবু পার্থকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানোর দুঃসাহস দেখাতে না পারায় তাঁর দুর্বলতা ছাড়া আর কোন কারন নেই।
পার্থ গ্রেপ্তার হওয়ার পর IPGMRএ ভিআই পি ‘রোগী’ হিসেবে ভর্তি হয়ে গেল! এই ভর্তি হওয়ার নাটক আর তার নেপথ্য কাহিনীর পরতে পরতে ছলচাতুরী ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর প্রচেষ্টা প্রবল। পার্থর গ্রেপ্তারের পর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত পুলিশ রিমান্ডের আদেশ দিলেও পরে কোন অদৃশ্য কারনে সেই আদালত দুটি আদেশ দেয়। ২৩শে জুলাইয়ের সেই আদেশে পার্থকে IPGMRএ ভর্তি করার কথা বলা হয় এবং অন্যটিতে ইডির উপর আদেশ হয় যে পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার আইনজ্ঞ সেখানে পার্থর সঙ্গে উপস্থিত থাকবে! এমন অদ্ভুত আদেশকে ইডি তৎক্ষণাৎ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানালে গুরুত্ব অনুধাবন করে মহামাণ্য জজ বিবেক চৌধুরী ২৪ তারিখ দু পক্ষের সওয়াল জবাবের পর এই দুই আদেশ দেশের আইনের পরিপন্থী বলে বাতিল করে দেন। আর ইডির উপর আদেশ হয় যে, ২৫ তারিখ সকালেই পার্থকে দরকার হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে AIIMS, ভুবনেশ্বরে নিয়ে গিয়ে সব শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে তার রিপোর্ট ঐ দিনই দাখিল করতে হবে। তিনি এর সঙ্গে IPGMRএর ক্ষমতাশালী অভিযুক্ত ভিআইপিদের মেডিক্যালি সুরক্ষা দেওয়ার জায়গা বলে কটাক্ষ করেন। যথারীতি AIIMS, ভুবনেশ্বরের রিপোর্টে পার্থর কিছু বয়েসজনিত ক্রনিক অসুবিধে ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না! তারা জানিয়ে দিল, পার্থকে হাসপাতালে ভর্তি রাখার কোনো প্রয়োজন নেই – অথচ, IPGMR পার্থকে ICUতে রেখেছিল। এতেই বোঝা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালকে কিভাবে মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ করে অভিযুক্ত ভিআইপিদের রক্ষা করার কাজে লাগানো হচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার – স্বাস্থ্য বিভাগ, যার অধীনে IPGMR, তার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়! এরপরও পার্থ কান্ডের দায় মমতা সরকারের উপর না পড়ার কারন আছে কি? এখন এটাই দেখার যে, যেসব ডাক্তাররা পার্থর চিকিৎসা করে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করিয়েছিলেন, তারা সমাজের কাছে কতটা অপরাধী হলেন এবং ইডির জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় তাদের ফেলা হয় কিনা। কারন কার আদেশে তারা এসব করছিলেন, সেটিও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
এর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের চালাকি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের চেষ্টার অভিযোগ নতুন করে গতি পেল। যেহেতু পার্থ শারীরিক দিক থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মত সুস্থ আছে, তৃণমূল দলের রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দু সপ্তাহ কাটিয়ে দিলে জুডিশিয়াল কাস্টডি হয়ে যায় বলে তখন অভিযুক্তর কিছুটা সুরাহা মেলে। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে IPGMRএর নাটক শুরু হয়েছিল। কিন্তু বহু অভিনয়ে দীর্ণ একই স্ক্রিপ্ট এবার মঞ্চস্থ করা গেলনা। অবশ্যই দেশের আইনি ব্যবস্থাকে এর জন্য বাহবা দিতে হবে।
যেভাবে শিক্ষায় চাকরী দেওয়ার ব্যপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তেমন সব চাকরীর ক্ষেত্রেই, এমনকি সিভিক পুলিশের বিনা ট্রেণিংয়ের অস্থায়ী চাকরীতে পর্যন্ত অনুসন্ধান শুরু হলে থলে থেকে আরো অনেক বিড়াল বেরোবে। কয়লা, গরুপাচার, বালি খাদানের অবৈধ বালি পাচার, চাকরি চুরি – ইত্যাদি বিভিন্ন কেলেঙ্কারীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীর গায়ে অবৈধ সম্পর্কের তকমাও লাগতে চলেছে। সম্প্রতি মমতা বন্দোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, একশোটা চাকরীর মধ্যে একটাও কি নিজের লোককে দেওয়া যায় না! জানিনা, দেশের অন্য কোন রাজনীতিক এমন অসাংবিধানিক কথা বলতে পারেন কিনা। সংবিধান মোতাবেক শপথ নিয়ে এভাবে সংবিধান বিরোধী কাজের সাফাই কিন্তু চাপের মধ্যে ধৈর্য্য হারানোর লক্ষণ। এই চাপ দল ও দলনেত্রী কতদিন সামলাতে পারেন সেটাই দেখার।
