বিচার ব‍্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কেন

পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ ন‍্যায়ালয়ের একজন বিচারপতির ঘর তালাবন্ধ রেখে এবং আদালত ও সেই বিচারপতির বাসভবনে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে (অবশ‍্যই নেতৃত্বের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে) যে পোস্টার লাগানো হয় এবং ঐ বিচারপতির আদালত বয়কট করে শ্লোগান দেওয়া হয়, দলবদ্ধভাবে জোর করে উকিল সহ কাউকে তাঁর এজলাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তা নিঃসন্দেহে বিচার ব‍্যবস্থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অশুভ শক্তি প্রয়োগে দমিয়ে রাখার চেষ্টা বলেই মনে হয়। অধিকাংশ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একে সমর্থন করেন না। তবু যেসব আইনজীবি এবং রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁদের ইতিহাসের পাতা উল্টাতে বললে তাঁরা অনেকেই হয়ত লজ্জা পেয়ে চুপ করে যাবেন বা দুকান কাটা রাজনীতিকের মত লাভের অঙ্ক কষে চেঁচামেচি করে জল ঘোলা করবেন!
আমাদের দেশে আদালতের বিচারপতিদের উপর চাপ তৈরী করার ন‍্যক্কারজনক পদ্ধতি অবলম্বন করা একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের বার কাউন্সিলের বড় নেতা, যিনি একসময় তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে এমএলএ হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের হয়ে বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন – তিনি এই ঘটনার নিন্দা করেছেন! এই নিন্দার সময় ওনার কি মনে ছিল যে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল হওয়ার পর পুনরায় কোন আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা না করে সরাসরি সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে হাইকোর্টের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছিলেন? আসলে এখন সাধারণ মানুষ বিদ‍্যজ্জন ও তথাকথিত বুদ্ধীজীবিদের কথার মধ‍্যে শুধু তাঁদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং দলবাজির গন্ধ পান বলে এখন আর কেউ সংবাদ-মাধ‍্যমে এদের প্রচারিত “বাণী” সিরিয়াসলি নেন না।
আমাদের দেশে ত বটেই, এমনকি এই পশ্চিমবঙ্গেও বিচারকদের সঙ্গে চরম অসভ‍্যতার অনেক নমুনা পাওয়া যায়। বর্তমানে রাজ‍্যের বিধানসভায় শূণ‍্য আসন সংখ‍্যার একটি রাজনৈতিক দল, যাদের যুব-আন্দোলনকারীরা অনেক ন‍্যায‍্য ও ভালো কথা বলছে, সেই দলের “পিতামহ ভীষ্ম” মার্কা নেতা তাদের সুখের সময় নিজে হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব‍্য করেছিলেন! তিনি তাঁর দলবল নিয়ে শ্লোগান দেন, “লালা (বিচারক) বাংলা ছেড়ে পালা”! এখানেই শেষ নয়, তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতের ফলে তারা যখন ঐ বিচারককে এই রাজ‍্য থেকে বদলি করাতে সক্ষম হল, তখন দলের ক‍্যাডাররা তাঁর বিদায়বেলায় গাড়ি আটকে ঐ শ্লোগান শুনতে বাধ‍্য করে। এছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রত‍্যক্ষ-অপ্রত‍্যক্ষ ভয় দেখানোর প্রক্রিয়া সেই বামফ্রন্ট আমলেই শুরু হয়। সুতরাং এখন ঐ দলের সাধু সাজার চেষ্টা ভন্ডামি মাত্র। কয়েক বছর আগে সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, যারা ভারতে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় সমর্থক, রামমন্দির সংক্রান্ত রায়ের পর, দেশের সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি মাননীয় রঞ্জন গোগৈকে কুৎসিত ব‍্যক্তি আক্রমণ করে বিবৃতি দেন! বিচারপতিদের “কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও” শ্লোগানের উদ্গাতাও এই দল! দুটি রাজনৈতিক দল – কংগ্রেস ও সিপিএমের ভাবাদর্শে গঠিত দল – তৃণমূল কংগ্রেসও যে প্রয়োজনে বিচারপতিদের “কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”এর পথে হাঁটবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সময় এবং এই প্রদর্শনের কারন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এই রাস্তা নিয়েছে!
এখানে একটি কথা বলা দরকার। এই মূহুর্তে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়, পুরো তৃণমূল দলটাই আদালতের বিভিন্ন প্রকারের দুর্ণীতির রায়ে এবং মাননীয় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে যথেষ্ট বিব্রত। একথা সত‍্যি যে আমাদের দেশে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের দুর্ণীতি নতুন কিছু নয়। নতুন যা সেটি হল, তৃণমূল দল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার আলাদা অস্তিত্ব না রেখে রাজ‍্য-প্রশাসনের সব পর্যায়ে প্রশাসনিক প্রধানদের জায়গাকে দলীয় চেয়ারে পরিণত করেছে! থানার ওসি তৃণমূল দলের সমাবেশে মঞ্চ শোভিত করে দলের দেওয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকেন! এই দলের সর্বাধিনায়িকা – “অনুপ্রেরনা” দিদি সংবাদ-মাধ‍্যমে বিবৃতি দেন, মানুষের জন‍্য এই করলাম……., ঐ দিলাম…… ইত‍্যাদি! অথচ, সংবিধান অনুসারে কোন মন্ত্রী – এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীর ক্ষমতা শুধু নীতি নির্ধারন করাতেই সীমাবদ্ধ। তারা সরকারি কোষাগারের এক টাকাও খরচ করতে পারেন না। তারা আর্থিক অনুদান, “শ্রী” যুক্ত বা শ্রীহীণ প্রকল্পের পরামর্শ দিতে পারেন মাত্র – আর্থিক ব‍্যয়ের ক্ষমতা বিভাগীয় প্রধান IAS প্রশাসকদের হাতে থাকে। সেজন‍্য সরকারি তহবিল তছরুপে কোন মন্ত্রী বা রাজনীতিকের সরাসরি যুক্ত থাকার কথা নয়! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সময়ে সংবিধান মানার চেয়ে তা না মানার ঘটনাই বেশী। প্রশাসনের উপর দলীয় নেতাদের খবরদারি ও তাদের মৌখিক আদেশজারির বহু উদাহরণ আমরা সংবাদ-মাধ‍্যমের দৌলতে অবগত আছি। কিন্তু প্রশাসনের এভাবে দলীয় নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণের নজির আর নেই! পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এর বড় কারন গত ৫৫ বছর ধরে এখানে রাজ‍্যের শাসকদল ক্রমাগত প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে দলদাস তৈরীর চেষ্টা করেছে! প্রথমদিকে কিছু বিরোধীতা থাকলেও ধীরেধীরে সম্পূর্ণ প্রশাসন শাসকদলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে! বর্তমান রাজ‍্য-সরকারে “অনুপ্রেরনা” এবং “ভাইপো” হচ্ছেন সুপ্রিমো! যতদিন শুধু অনুপ্রেরনার অধিনায়কত্ব ছিল, ততদিন ঐ দলের ভিতরের এবং বাইরের গন্ডগোলের খবর পাওয়া যায়নি। পিসি, ভাইপোর মধ‍্যে যখন নেতৃত্ব ভাগ হল, তখন দলীয় আনুগত্যের সঙ্গেসঙ্গে প্রশাসনের আনুগত্যও দুভাগ হল!
সারদা কান্ড এই দলের সরকারে আসার পর প্রথম বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। তাতে সরকারি প্রশাসনের প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগ তেমন না পাওয়া গেলেও “অনুপ্রেরনা”র কাছের মানুষ, রাজ‍্যসভার দলীয় সাংসদ ও সাংবাদিক জেলে গেলেন ঐ কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রত‍্যক্ষ যোগাযোগের কারনে। কয়েক বছর জেলে থাকার সময়ে তিনি বিক্ষিপ্তভাবে সংবাদ-মাধ‍্যমে যা জানিয়েছিলেন তার মর্মার্থ হল, এই সারদা কেলেঙ্কারির মূল কান্ডারী এবং এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল অর্থ আছে “কালিঘাটের টালির চালা”র মালকিনের বাড়িতে! ইঙ্গিত স্পষ্ট – সরাসরি সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে অভিযোগ! অথচ দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে এত বছরেও অভিযোগকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা কোন সরাসরি অভিযোগ আনতে পারেনি! সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এই প্রাক্তণ এমপি, যিনি জামিনে ছাড়া আছেন, তিনি এখন দলের একজন প্রথমসারির নেতা! দুর্জনে বলে, এই জামিনে ছাড়া পাওয়া নেতা নাকি অনুপ্রেরনা নয়, “ভাইপোর লোক”! সে যাই হোক, নেতার কথা সত‍্যি হলে “অনুপ্রেরনা”র “টালির চালা” অনুসন্ধান করা অবশ‍্য কর্তব‍্য ছিল; আর সেখানে কিছু না মিললে মিথ‍্যা ‘অপবাদ’ দেওয়ার কারনে এই নেতার পুনরায় জেলযাত্রা অনিবার্য ছিল! এসব কিছুই হল না! সব কেমন রিপ ভ‍্যান উইঙ্কিলের মত ঘুমিয়ে পড়ল! কারন কেউ জানে না! এর দায় নিঃসন্দেহে ঐ এজেন্সির। এই কেন্দ্রীয় এজেন্সির প্রসঙ্গে অন‍্য মামলায় একজন বিচারক নিন্দাসূচক কথা বলেন তাদের তদন্তে ঢিলেমির জন‍্য। সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে, এই অনুসন্ধানকারী সংস্থা যেন কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলী হেলনে পুতুল নাচের কুশীলবদের মত নাচছে! একবার তেড়েফুঁড়ে অনুসন্ধানে জোড় দেওয়া হচ্ছে – তারপরই কোন সাড়াশব্দ নেই! মনে হয়, কোন অদৃশ‍্য শক্তি চাইছে না যে, এই সব তদন্ত শেষ হোক! এমন ‘খেলা’ দীর্ঘদিন ধরে চললে আমজনতার এইসব দুর্ণীতি তদন্তের ব‍্যাপারে আর কোন মাথাব‍্যথা থাকে না। এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এই কারনে বিচারকের উপর আঘাত হেনে বিচার-ব‍্যবস্থাকে সন্ত্রস্ত করা চেষ্টা হবে কেন? কারন ভিন্ন।
এইসব ব‍্যাপার যদিও রাজনৈতিক ভাবে দল সামলে নিচ্ছিল বিভিন্ন রকমের সমঝোতার মাধ‍্যমে, গোলমাল বাঁধল উচ্চ-আদালতের একাধিক বিচারকের দুর্ণীতির তদন্ত আদেশ দেওয়ার প্রশ্নে। বিচারকরা তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদের সরাসরি আদালতের কাছে তদন্তের অগ্রগতি জানানোর আদেশ দিলেন! কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলিহেলন ব‍্যতিরেকে সংস্থারা বাধ‍্য হল বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল দলীয় নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করতে! এই নেতারা সবাই গ্রেপ্তার হচ্ছেন সরকারি অর্থ তছরুপের দায়ে নয়; তাঁদের গ্রেপ্তারের কারন বেআইনি কাজে মদত দেওয়া এবং আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির কারনে। সুতরাং, যারা ধরা পরল তাদের খলনায়ক বানিয়ে দলের দুই স্তম্ভ যখন ঘুঁটি সাজাতে ব‍্যস্ত, তখন অনুসন্ধানকারী সংস্থাদের থেকে আদালতে পেশ করা তথ‍্য সংবাদ-মাধ‍্যমে বেরোতে লাগল। যার ফলে পিসি- ভাইপো জুটির ইমেজ প্রচন্ডভাবে কালিমালিপ্ত হল। প্রথমতঃ, এই রাজ‍্য-প্রশাসন শাসকদলের সমার্থক হওয়ায় দায় এসে পড়ছে সংবাদ-মাধ‍্যমের দ্বারা larger than life চেহারা দেওয়া “টালির চালা”র “অনুপ্রেরনা”র উপর! কারন, তাঁর উক্তি অনুযায়ী তিনিই সব কিছু করেন!প্রত‍্যেক বিধানসভা ভোটের সময় প্রচারে বলেন, ২৯৪টি আসনেই তিনি প্রার্থী!তাঁকে দেখেই মানুষ যেন তাঁর পছন্দ করা দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেন। মানুষ সে কথা শুনেছে। এখন যারা দুর্ণীতির দায়ে ধরা পরেছেন এবং দলের অন‍্য বড় নেতারা সবাই বলেন, সবই তাঁর”অনুপ্রেরনা”য়! সেজন‍্য এই দুর্নীতি স্বতঃসিদ্ধভাবে তাঁরই অনুপ্ররনায় অনুপ্রানিত হয়ে করা – বলে ধরা উচিৎ! আবার দলের কাটমানি তৈরীর অভিনব পদ্ধতি, এমনকি, শিক্ষা-দপ্তরে টাকার বিনিময়ে অযোগ‍্যদের চাকরি দেওয়ার অভিযোগের সত‍্যতা আদালতে বিচারকের রায়ে প্রমাণিত হয়, তখন তার দায়ও শীর্ষ নেতৃত্বের উপর বর্তায় – কারন এই নীতি উচ্চ পর্যায়ের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। এদিকে যাদের আদালতের রায়ে অবৈধ উপায়ে “কাটমানি” দিয়ে পাওয়া চাকরি চলে যায়, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেওয়া টাকা ফেরৎ চায়! ফলতঃ, দলীয় এজেন্টদের নামও প্রকাশ‍্যে এসে যাচ্ছে! শুরুর দিকে জিহাদী তোষণ করে, সাধারন বাঙ্গালী মুসলমানদের মিষ্টি কথা বলে এবং বিশেষ বিশেষ ইসলামী পরবে হিজাব পড়ে আল্লার দোয়া মাঙ্গার অভিনয় করে বৃহত্তর ইসলামী সমাজকে ধোঁকা দিতে পারলেও তাঁরা অবশেষে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য ধরে ফেলে “অনুপ্রেরনা”র ঝান্ডা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এই ব‍্যাপারের সঙ্গে আবার “অনুপ্রেরনা” অনুগামীর সাথে “শান্তিনিকেতন”এর “ভাইপো” অনুগামীদের গোলমাল বিভিন্ন জায়গায় চরমে পৌঁছেছে! উচ্চ-আদালত নির্দেশিত অনুসন্ধানের ঠেলায় এখন পুরো দলের অবস্থা হল, কে কত কাটমানি তুলে “টালির চালা” বা “শান্তিনিকেতনে জমা দিতে পারে তার প্রতিযোগিতায় দলের সামাজিক পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে – এই ব‍্যাপারটি বিচারকদের অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার উপর নজরদারিতে পুরো দল এবং প্রশাসনকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। আদালতের দৃষ্টির নীচে অনুসন্ধান বন্ধ করার ক্ষমতা দলীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসন কারোরই নেই। সেজন‍্য দলীয় নেতৃত্ব স্বাভাবিক কারনেই বিচার-বিভাগকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তাদের দুর্ণীতির বিরুদ্ধে আদালতের রায়কে নিজেদের পক্ষে আনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা মাননীয় বিচারপতির এজলাস বয়কট সহ তার বসতবাড়িতে পর্যন্ত পোস্টার সাঁটিয়েছে। কাউকে বিচারপতির এজলাসে ঢুকতে দেয়নি!এতে পুলিশ-প্রশাসন-রাজনৈতিক দলের আঁতাত স্পষ্টতই প্রমাণিত।
সরকারি কর্মচারিদের ডিএ বঞ্চনা, সরকারি ও সরকার পোষিত সংস্থায় চাকরির সংকোচনের সঙ্গেসঙ্গে টাকার বিনিময়ে অনৈতিক উপায়ে চাকরি বিক্রি, উন্নয়ণের নামে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব‍্যয়ে “কাটমানি” ইত‍্যাদি অভিযোগে জর্জরিত রাজ‍্য-সরকার জানে, এভাবে বেশিদিন তারা রাজ‍্যপাট ধরে রাখতে পারবে না! এই মূহুর্তে সমস‍্যা হল, এই বিচারপতির এজলাসে এমন একটি কেস এসেছে যেখানে “ভাইপো” এবং তাঁর শ‍্যালিকার যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে! এই কেসে শ‍্যালিকা গ্রেপ্তার হলে “ভাইপো” আর কতদিন খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন! তখন আদালতের আদেশে হয়ত কেন্দীয় সরকারের ‘অনিচ্ছা’ থাকলেও এই রাজ‍্য-সরকারকে বরখাস্ত করতে বাধ‍্য হবে! এই ভয় থেকেই এমন ব‍্যবহার। কোন বিচারপতি কি ধরনের কেসের বিচার করবেন তা ঠিক করেন প্রধান বিচারপতি। সুতরাং এক্ষেত্রে তারা যদি ভীতি প্রদর্শনে সফল হত তাহলে পরবর্তী টার্গেট অবশ‍্যই প্রধান বিচারপতি!
এখন রাজ‍্যের রাজনৈতিক অবস্থা মোটেই সুস্থির নয়। ক্ষমতাসীন দলের দুর্ণীতি সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। আবার কোন বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। এমন পরিস্থিতিতে রাজ‍্যে ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র বিপদ আসতে পারে আদলতের দিক থেকে। তাই তারা পূর্বসূরিদের থেকে আরো aggrasive হয়ে বিচারকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দূর্ণীতির প্রশ্নে আদালতের রায়কে নিজেদের দিকে আনতে চাইছে। ভুল তাদের একটি জায়গায় – আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকদের সহযোগীতায় ভোটের সময় সাধারন ভোটারকে সন্ত্রস্ত করা আর উচ্চ-আদালতের বিচারকদের সন্ত্রস্ত করা এক নয়! শস্তা, নোংরা রাজনীতির রেকর্ড তৈরী হল। এতে ক্ষতি হল রাজ‍্যের শাসকদলেরই।

ভারতের হিমালয়ান ব্লান্ডার

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে ভারতের তদানীন্তন নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ব‍্যর্থতা দেখা গিয়েছিল – এখনো সারা দেশ তার খেসারত দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে ভুলের কথা বলা হয়েছে। দেশের বর্তমান প্রজন্ম আমাদের এই সীমান্ত সমস‍্যা বিষয়ে সম‍্যক অবহিত নয় – তার সবচেয়ে বড় কারন হল, দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমের সংবাদ পরিবেশনের সময় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অপেক্ষা আভ‍্যন্তরীন বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া!
স্বাধীনতার পর ভারত পঞ্চশীল নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে চীনকে অযাচিতভাবে পরম বন্ধু মনে করে তার সঙ্গে সখ‍্যতা স্থাপনের জন‍্য রাষ্ট্রসংঘে চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস‍্য করার পক্ষে সওয়াল করে! আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে সর্বদা দেওয়া-নেওয়ার ব‍্যাপার থাকে। এক্ষেত্রে চীন কি দিয়েছে তা কেউ জানে না! ১৯৫৯ সালে তিব্বতে পূর্ণ দখলদারি কায়েম করার পর চীন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ১৯৬২ সালে বিনা প্ররোচনায় ভারত আক্রমণ করে। ভারতের কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সেই আক্রমণে তারা ভারতকে পর্যুদস্ত করে আকসাই চীন সহ NEFAর অনেকটা এলাকা দখল করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রথম থেকেই তাদের বিস্তারধর্মী আগ্রাসী নীতিতে নতুন নতুন এলাকা দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ঐ আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল যে আকসাই চীন সহ বর্তমান অরুনাচল প্রদেশ যা তদানীন্তন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত ছিল, পুরোটাই নাকি চীনের অংশ! এর স্বপক্ষে চীনের একমাত্র যুক্তি ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি! এভাবে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ভুলের সুবিধা নিয়ে চীন যা করেছে তাকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। একথা বলা বাহুল‍্য, সে সময়ের ভারতের পররাষ্ট্র নীতি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরনে জওহরলাল নেহরুর অনীহা চীনকে ভারত আক্রমণের সাহস জুগিয়েছিল।
অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে, তিব্বত একটি রুক্ষ, পার্বত‍্য জায়গা যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মেই চীনের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আসে! এ বিষয়ে অপপ্রচার ও ক্ষেত্র বিশেষে মৌনতার কারনে যে ভুল ধারনা জন্মেছে তার নিরসনের জন‍্য বলি, তিব্বত ভূখন্ডের আয়তন ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যা চীনের ভূখন্ডের চার ভাগের এক ভাগ এবং ভারতের আয়তনের এক তৃতীয়াংশ। পৃথিবীর উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ হিমালয় এই তিব্বতেই। রাজধানী লাসা। তিব্বতের মোট জনসংখ‍্যা ৬৭ লক্ষ, যার অধিকাংশ বিশেষ মতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মীয় আচার-বিচার চীনাদের থেকে পৃথক। তিব্বতী ভাষাও চীনা ভাষার থেকে আলাদা। এই তিব্বতী জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের কৃষ্টি-সভ‍্যতা ও ধর্মাচরন প্রক্রিয়া চীনাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর থেকে পৃথক। তিব্বতীদের মূল জীবিকা কৃষি ও পশুপালন। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে মূল চীনা ভূখন্ডের কোন সীমানা নেই! ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ আছে তিব্বতের। আমাদের উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দেশগুলি হল – পাকিস্তান, পূর্ব তুর্কিস্তান, তিব্বত, নেপাল, ভূটান ও মায়ানমার। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জন্মের পর থেকেই লক্ষ‍্য ছলে-বলে-কৌশলে তাদের সীমান্তবর্তী দেশগুলিকে ধীরেধীরে আত্মস‍াৎ করা। তাছাড়া, উপমহাদেশে তাদের একচ্ছত্র আধিপত‍্য বিস্তারে একমাত্র বাধা ভারতকে ব‍্যতিব‍্যস্ত রেখে চাপ সৃষ্টি করে স্ট্র‍্যাটেজিক ভূখন্ডের দখল নেওয়া যাতে ভবিষ‍্যতে তাদের সীমানা বিস্তারে সুবিধা হয়। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতায় থাকা নেতারা তা বুঝতে না চাওয়ার খেসারত যেমন তিব্বতকে দিতে হচ্ছে, তেমনি ভারতকেও দিতে হচ্ছে।
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে কামডো (Chamdo) দখলের মাধ‍্যমে চীন তিব্বতে তাদের বিক্ষিপ্ত সামরিক অভিযান শুরু করলেও ১৯৫৯ সালের ২৫শে মার্চ চীনা লালফৌজ লাসা দখল করে। তারা তাদের তাঁবেদার পাঞ্চেন লামাকে চতুর্দশ দালাই লামার স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা করলেও সাধারণ তিব্বতীরা তা মেনে নেয়নি। সে সময় যুদ্ধে ৮৭০০০ তিব্বতীর মৃত‍্যু হয় এবং ১০০০০০ তিব্বতী শরণার্থী বিশেষতঃ ভারত, নেপাল ও ভূটানে পালিয়ে যান। দালাই লামা ভারতে এসে হিমাচলের ধরমশালায় তাঁর Government of Tibet in exile গঠন করেন। রাষ্ট্রসংঘ চীনা আগ্রাসনকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করে এবং ভারতের পুরুষোত্তম ট্রিকমদাসের নেতৃত্বে সাত সদস‍্যের (বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ঘানা, ভারত, মালয়, নরওয়ে ও সিয়াম) কমিটি তৈরী করে তিব্বতের উপর রিপোর্ট দিতে বলে। সেই রিপোর্ট মোতাবেক রাষ্ট্রসংঘের সাধারন সভায় ২১শে অক্টোবর, ১৯৫৯ সালে তিব্বতের উপর একতরফা চীনা আগ্রাসন ও সেখানে চীন দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব নেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ‍্য যে, ১৯৬০-৬২ এই দু বছরে শুধু চীনাদের দ্বারা মনুষ‍্য আরোপিত দুর্ভিক্ষে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ তিব্বতী প্রাণ হারান। এই সময় চাপে পরে চীন সরকার ১৯৬৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর স্বশাসিত তিব্বত অঞ্চল (Tibetan Autonomous Region) গঠন করে। এর সর্বেসর্বা হন একজন চীনা নাগরিক যিনি পার্টির উচ্চ নেতৃত্বে থাকেন! তারপর থেকে ক্রমশঃ তিব্বতের উপর চীনের ফাঁস যত শক্ত হতে থাকে, তত তিব্বতীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা চাপা দেওয়া হতে থাকে। ফলে, উপর উপর কিছু লোক দেখানো পরিবর্তন হলেও তিব্বতের উপর চীনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তেই থাকে। তার ফলশ্রুতিতে যে সব প্রতিবাদ আন্দোলন হয়, সেগুলো মধ‍্যযুগীয় বর্বরতায় দমন করা হয়েছে।
আসলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের লক্ষ‍্য হচ্ছে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়া। যখনই চীনে কোন গোষ্ঠীর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ রাখার কৌশল হিসাবে সব সম্রাটই যুদ্ধ ও সাম্রাজ‍্য বিস্তারের মাধ‍্যমে কৃত্রিম চীনা জাতিসত্তা জাগানোর চেষ্টা করেছে। তা এখনো চলছে। এখানে কোন ‘ইজম’ বা তত্ত্ব বড় কথা নয়, আসল ব‍্যাপার হল, বর্তমান চীনা নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নীতির কোন পরিবর্তন না আসা! সামরিক শক্তিতে দূর্বল ও খনিজ সম্পদে ভরপুর তিব্বতকে স্ট্র‍্যাটেজিক দিক থেকে দখল করে চীন ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তিব্বত দখল করা হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগকে মাথায় রেখে! ইতিমধ্যে জওহরলালের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় আকসাই চীনের ৩৬,৮৪৬ বর্গকিলোমিটার জায়গা চীন দখল করে নিয়েছে এবং অরুনাচল প্রদেশের ৯৩,০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গাকে শুধুমাত্র গায়ের জোরে তাদের বলে দাবী করে আসছে। বর্তমান ভারত সরকার কড়া হাতে সীমান্ত সংঘর্ষ মোকাবিলা করায় চীনের হানাদারি একটু থমকালেও তাদের পরিকল্পনার কোন পরিবর্তন লক্ষ‍্য করা যায়নি।
মনে হয়, চীনা কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর সব flat noseএর মানুষের বাসস্থানকেই তাদের দেশ বলে দাবী করা মনস্থ করেছে! সেজন‍্য চীনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করা দেশ নেপাল, ভূটান, ভারত, লাওস, মায়নামার (পূর্বতন বার্মা), মঙ্গোলিয়ার ভূখন্ড চীন নিজেদের বলে দাবী করছে! আবার যাদের সঙ্গে স্থল নয়, জলপথে যোগ আছে, যেমন, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রুনেইয়ের উপর চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি দেওয়া হচ্ছে চীনের তরফে! লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায়, এসব দেশে flat nose জনগোষ্ঠী আছে। এমন মধ‍্যযুগীয় আগ্রাসন নীতির জন‍্য চরম খেসারত দিতে হচ্ছে তিব্বতীদের। তিব্বতীদের দেশপ্রেমজনিত প্রতিবাদকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন‍্য চীন শুধু সামরিক বাহিনীর উপরেই নির্ভর করছে না; তারা তিব্বতে জাতিগত নির্মূলীকরন (ethnic cleansing)এর দিকে এগোচ্ছে। তিব্বতীদের নিজস্ব ধর্মাচরনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। চীন তিব্বতী মোনাষ্টারি বন্ধ করছে। চীনাদের ধর্মাচরন প্রক্রিয়া অনুসরন করা তিব্বতীদের জন‍্য বাধ‍্যতামূলক। স্কুলে তিব্বতী ভাষা শিক্ষা বন্ধ। শুধুমাত্র চীনা ভাষা শিক্ষা ও চীনা ভাষায় পড়াশুনো করার স্বীকৃতি মিলেছে!
তিব্বতে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি ও উন্নত যোগাযোগ ব‍্যবস্থা করে চীন সরাসরি ভারতকে সামরিক চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সর্দার বল্লভভাই প‍্যাটেল নেহরুকে লেখা ১৯৫০ সালের ৭ই নভেম্বরের চিঠিতে দুঃখ করেছিলেন – তিব্বতী জনগণ তাদের স্বাভাবিক বন্ধু ভারতের থেকে যে সাহায‍্য আশা করেছিলেন, তা পুরন করতে ভারত এগিয়ে আসেনি। পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ‍্যায় তিব্বতের স্বাতন্ত্রতা রক্ষা না হলে ভারতের ঐক‍্য ও স্বাধীনতা বিপন্ন হবে বলে ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল মন্তব‍্য করেন। রাজ‍্যসভায় ১৯৫৪ সালে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকার আসল কথাটি বলেন, “যদি ১৯৪৯ সালে চীনকে স্বীকৃতি না দিয়ে ভারত তিব্বতকে স্বীকৃতি দিত, তাহলে আজকে ইন্দো-চীন কোন সমস‍্যাই তৈরী হত না”। এমনকি লোকসভায় ১৯৬০ সালের ১৭ই মার্চ বিরোধী নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেন যে, তিব্বতের উপর চীনের মারণ আক্রমণ ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং, সে সময়ের বিভিন্ন নেতার সতর্কবার্তা পর্যন্ত নেহরু ও তাঁর সরকারকে আত্মঘাতী ভুল রাস্তা থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। এর দায় তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার ও তার কর্নধার নেহরুর উপরেই বর্তায়।
এখন তিব্বতে সর্বদা নূন‍্যতম পাঁচ লক্ষ চীনা সেনা মজুত থাকছে। তাদের অন্ততঃ ১৫টি সামরিক বিমান বন্দর এবং ১৭টি গোপন রাডার তিব্বতের মধ‍্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এছাড়া ৮টি ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি আছে, যেখানে ৭০টি মধ‍্যপাল্লা এবং ২০টি অন্তর্বর্তী পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র মজুত আছে। ৫০টি ভি-স‍্যাট স্টেশন পুরো TAR জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তিব্বতের খনিজ আকরিক উত্তোলন করে চীনের উন্নয়ণ করা হচ্ছে। কিন্তু এই কাজে নিয়োজিত তিব্বতী শ্রমিকদের নূন‍্যতম মজুরী থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে খনিজ সম্পদ আহরনের কারনে পরিবেশের ভারসাম‍্য দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। হিমবাহ গলে যাচ্ছে কিন্তু তথাকথিত কম‍্যুনিস্ট পরিবেশবিদরা নীরব!
তিব্বতের পরিকাঠামোগত উন্নয়ণের নামে চীন তার সামরিক শক্তিকে দ্রুত ভারতের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করছে। ২০০৬ সালে গোর্মো থেকে লাসা রেল যোগাযোগ ব‍্যবস্থা চালু করে চীন তিব্বতের বুকে তার আধুনিক সমরাস্ত্র এনে জড়ো করেছে। পুরো তিব্বত জুড়ে ৫৮,০০০ কিলোমিটার রাস্তা বানানো হয়েছে সামরিক বাহিনীর দ্রুত চলাচলের জন‍্য। চীন ৩২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে আগামী কয়েক বছরে ১,১৮,০০০ কিলোমিটার হাইওয়ে তৈরীর পরিকল্পনা নিয়েছে। তিব্বতের বিমান বন্দর ও রানওয়েগুলির মূখ‍্য উদ্দেশ‍্য শুধু আকাশ পথে তিব্বত শাসনে নজরদারি চালানোই নয়, ভারতের সঙ্গে সম্ভাব‍্য যুদ্ধে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ শহরকেই তারা আকাশ-নিশানায় এনে ফেলেছে। এরপরও চীন আরো উন্নত বিমানবন্দর বানানোর পরিকল্পনা করছে।
এখন ‘গালওয়ান’ সহ সীমান্তে চীনা কার্যকলাপ এবং ভারত সীমান্ত বরাবর চীনের বিভিন্ন নির্মান তৎপরতা ও সেইসঙ্গে তিব্বতের অভ‍্যন্তরে সামরিক বাহিনী পরিবহন করা ও রসদ সরবরাহের তাগিধে সড়ক ব‍্যবস্থার প্রভূত উন্নতিসাধন শুধুমাত্র ভারতের উপর চীনা আক্রমণের উপক্রমনিকা হিসেবেই দেখার কথা!
ডঃ আম্বেদকারের বক্তব‍্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যেতে পারে, এটাও সত‍্যি যে, পশ্চিমী শক্তি, বিশেষতঃ আমেরিকা এবং সর্বোপরি ভারত এখনো তিব্বতীদের নির্বাচিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি! ফলে, রাষ্ট্রসংঘের আর বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা থাকছে না! প্রথমে চীনের যে অজুহাত ছিল – দালাই লামার শাসনব‍্যবস্থায় কিছুমাত্র গণতন্ত্র না থাকা – তা কিন্তু ধর্মশালার তিব্বত সরকারের বর্তমান ব‍্যবস্থার পরিচায়ক নয়। বহু চেষ্টার পরেও এখনো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তিব্বতী জাতিগোষ্ঠীদের ধর্মীয় নেতার জায়গায় চতুর্দশ অর্থাৎ বর্তমান দালাই লামার স্থান অটুট। তাছাড়া, এই সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। তাঁদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী Rimchen Khandu Khrimey। যদি ভারতীয়রা রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউক্রেনকে বাঁচানোর ব‍্যপারে মনোযোগী হন, তবে একই ভাবে চীনের আগ্রাসন থেকে তিব্বতকে বাঁচানোর চেষ্টায় তাঁদের ব্রতী হওয়ার কথা। এর অবিসম্বাদী ফল হচ্ছে চীন ও ভারতের মধ‍্যে কোন সরাসরি সীমান্ত না থাকলে এবং বন্ধু তিব্বত সরকার পাশে থাকলে চীনের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা অনেক সহজ হবে।
একথা মনে রাখা দরকার, ভারতে বহমান বেশকিছু নদীর উৎসমুখ তিব্বতে এবং সেখানে বিভিন্ন জায়গায় নদীবাঁধ তৈরী করে চীন তার নাশকতামূলক কাজের পরিচয় দিচ্ছে। তারা একদিকে তিব্বতীদের কোথাও শুখা রেখে আর কোথাও কৃত্রিম বন‍্যা বইয়ে তাদের কৃষি-ব‍্যবস্থাকে ধ্বংস করছে, অন‍্যদিকে তাদের এই কাজের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলিতে শুখা ও বর্ষার মরসুমে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে ভারতের অসীম ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করতে পারে। এর ফলে তিব্বতের হিমবাহগুলিকে সংকুচিত করে পরিবেশগত ভারসাম‍্য নষ্ট করা হচ্ছে।
ভারতকে রাষ্ট্রসংঘ এবং পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে মিলিতভাবে একটি কার্যকর, স্থায়ী সমাধান সূত্র বের করে তিব্বতীদের নিজেদের হাতে তাদের ভাগ‍্য-নিয়ন্ত্রনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এই উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন‍্য অতীব জরুরী।

বিশ্বভারতীতে কবিগুরুর স্বপ্নের মৃত‍্যুর কারন

আজকাল বিশ্বভারতী নিয়ে সংবাদ-মাধ‍্যম থেকে রাজনৈতিক নেতারা – সবাই নাকি খুবই চিন্তিত! বিশ্বভারতীর শিক্ষা-ব‍্যবস্থা নাকি ভেঙ্গে পড়ার মুখে! এমনকি, শিক্ষাঙ্গনে আন্দোলন করা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রছাত্রীরা অব্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বহিষ্কার চাইছে! তারা জানে না, তাদের রাজনৈতিক গুরুঠাকুররা অপছন্দের উপাচার্যদের সঙ্গে কেমন পাশবিক ব‍্যবহার করেছে – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যকে দিয়ে যা শুরু! এই দলের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অপেক্ষা আন্দোলনকে (নিজেদের দলীয় মত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পযর্ন্ত) চালিয়ে যাওয়া তাদের প্রাথমিক কর্তব‍্য মনে করে! আবার অন‍্য রাজনৈতিক দলের স্বার্থ যখনই বাধা পায়, তখনই তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা উপাচার্যের বিরুদ্ধে কামান দাগা শুরু করে! মনে হয়, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যেন এইসব রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত আন্দোলনের “পাঞ্চিং ব‍্যাগ”। রাজ‍্য এবং দেশের অন‍্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা দেখা যায় না।
এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা মনে হল, তা হচ্ছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ‍্য কি ছিল তা বর্তমান প্রজন্ম জানে না। ক্ষমতাশালী মানুষজন কখনো সেই উদ্দেশ‍্যকে গুরুত্ব দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে এমন এক শিক্ষাব‍্যবস্থা গড়ে তুলতে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা – বিশেষতঃ শিক্ষার dogmatic বাধ‍্যবাধকতা থাকবে না – যেখানে মুক্ত, খোলা পরিবেশে, শ্রেণীকক্ষের বাইরে, মাটির কাছে থেকে, প্রকৃতিকে উপভোগ করার সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীরা অন্তরের টানে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে। এই শিক্ষা-ব‍্যবস্থা মেকলে প্রবর্তিত নির্দিষ্ট পাঠ‍্যক্রম ভিত্তিক, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই পদ্ধতির অভিনবত্ব লুকিয়ে আছে – তার প্রকৃতির কোলে চড়ে চাপমুক্ত জ্ঞানার্জনের মধ‍্যে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই পদ্ধতি সার্থক রূপ পায়। ১৯২১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ এই আশ্রমিক মডেল শিক্ষায়তনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বলে ধরা হলেও তার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতিপর্ব চলেছিল। প্রথাগত শিক্ষা-ব‍্যবস্থাকে এই শিক্ষা-ব‍্যবস্থা যে চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল, তা রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই সার্থক হয়েছিল।
কবিগুরুর মৃত‍্যুর পর থেকে স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব ছিল তাঁর সুযোগ‍্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। তিনি পিতার স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বহু বছর জড়িত থাকার সুবাদে প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র, ঐতিহ্য এবং মানের ব‍্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতিতে পুরো ছবিটাই দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ইতিমধ‍্যে কবিগুরু এবং অন‍্য আশ্রমিকদের প্রচেষ্টায় বিশ্বভারতীর সুনাম আন্তর্জাতিকস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষবৃদ্ধি ও তার প্রাতিষ্ঠানিক ব‍্যাপ্তির কারনে যে অর্থের প্রয়োজন, তা ঠাকুর পরিবারের পক্ষে যোগানো কষ্টসাধ‍্য ছিল। উপরন্তু, সরকারি দাক্ষিণ‍্য পেলে প্রাতিষ্ঠানিক ব‍্যাপ্তির কাজ অনেক সহজ হয় বলে, রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে ভারত সরকার দ্বারা অধিগ্রহণের প্রস্তাবে সায় দেন। ঠিক হয়, এটি এই রাজ‍্যে প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম বিশ্ববিদ‍্যালয় হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন বজায় থাকবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হয় যেখানে প্রথম উপাচার্য হিসেবে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম অনুমোদন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার যোগানোর দায়িত্ব নেয়। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক হন দেশের রাষ্ট্রপতি এবং আচার্য হন প্রধানমন্ত্রী। সেই মোতাবেক প্রথম আচার্য হলেন জওহরলাল নেহরু। ১৯৫১ সালের মে মাসে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয় পার্লামেন্টে আইন করে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয় হিসেব আত্মপ্রকাশ করে। পরিদর্শক রাষ্ট্রপতি দ্বারা প্রথম উপাচার্য হিসেবে রথীন্দ্রনাথ নিযুক্ত হন।
এর পর থেকে দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকে। বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য, তার বিচারধারা, শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত থাকা রাজনীতিক এবং আমলারা বিশ্বভারতীকে আর পাঁচটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত ভেবে সরকারি সম্পত্তি মানে – “আমাদের সম্পত্তি” মনে করে তার উপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলেন! রাজ‍্যের অধুনা জেল হাজত নিবাসী একজন প্রাক্তণ শিক্ষামন্ত্রী মন্তব‍্য করেছিলেন, রাজ‍্য সরকার শিক্ষকদের মাইনে দেন বলে নাকি শিক্ষকরা তাঁদের “চাকর”! এমন মধ‍্যযুগীয় প্রভুত্ববাদী চিন্তার প্রকাশের জন‍্য সে সময় বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমে আমার মত অনেকেই নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু কথাটা নির্মম সত‍্যি যে, ভারতের রাজনীতিকদের শিক্ষাজগৎ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সঠিক ধারনার অভাব প্রথম থেকেই ছিল। জওহরলাল এবং তাঁর দলবল বিশ্বভারতীকে সরকারি প্রতিষ্ঠান মনে করে তার স্বশাসন ব‍্যবস্থার ডানা ছাটতে উদ‍্যোগী হলেন। “বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ” – আমলারাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন একই অভিপ্রায় নিয়ে। এদের সম্মিলিত ভোগলিপ্সা ও চিন্তার দৈন‍্যতায় কবিগুরুর স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্জলী যাত্রা শুরু হল!
আমাদের দেশে এক অদ্ভুত সিষ্টেম চালু আছে – যদি কাউকে কোন জায়গা বা প্রতিষ্ঠান থেকে হটাতে চাও ত তার বদনাম কর! দেশের মানুষ দুটি বদনাম ভালোভাবে “খায়” – একটি চারিত্রিক অর্থাৎ অবৈধ সম্পর্ক, দ্বিতীয়টি আর্থিক তছরুপ! লক্ষণীয় বিষয় হল, কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অধিগ্রহনের পর স্বশাসিত বিশ্বভারতীর শিক্ষা পদ্ধতিতে অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিক এবং মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষায় শিক্ষিত আমলাদের দুর্বিনীতের মত নাক গলানো মেনে নেওয়া রথীন্দ্রনাথের মত একজন প্রশাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফল যা হবার তাই হল! অযথা প্রতি পদে সরকারের থেকে বাগড়া দেওয়ার পর, কিছু লোভী মোসাহেবকে দিয়ে রথীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পর্ক এবং বিশ্বভারতীর তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হল! এখন কিন্তু এই অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা বীরের সম্মান পান! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রের পক্ষে এ অপমান সহ‍্য করা সম্ভব ছিল না। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কিছুদিনের মধ‍্যে পদত‍্যাগ করলেন।
এটাই কেন্দ্রের রাজনীতিকদের উদ্দেশ‍্য ছিল। তারা তখন তাদের মোসাহেবদের থেকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিভিন্ন “সভা” গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ইয়েসম‍্যানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে শুরু করলেন। বিশ্বভারতীর সংস্কার ও সম্প্রসারণের নামে “আরেকটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়” হিসেবে বিশ্বভারতীর আত্মপ্রকাশ ঘটল! বিষয়ভিত্তিক পঠন-পাঠনে মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা-ব‍্যবস্থার যে কাঠামো অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, তেমনই একটি বিশ্ববিদ্যালয় হল বিশ্বভারতী! রবীন্দ্রচিন্তায় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, রাবীন্দ্রিক চেতনায় যার শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভব, সেখানে কিভাবে set patternএর পদার্থবিদ‍্যা, রসায়ণ ইত‍্যাদির মত বস্তুনিষ্ঠ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয় পড়ানো হতে পারে? ইউজিসি নিয়ন্ত্রিত অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একই ধাঁচে, একই পাঠ‍্যক্রমে বিশ্বভারতীর শিক্ষা ব‍্যবস্থাকে ফেলা হল। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের মানসপুত্র বিশ্বভারতী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মৃত‍্যু ঘনিয়ে আসে।
তারপর সময়ের সাথে সাথে কেন্দ্রে এবং রাজ‍্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় এলেও বিশ্বভারতীর উপর কর্তৃত্ব ফলানোর সুযোগ কেউই ছাড়তে রাজি হয়নি। সম্প্রতি একটি খবর জেনে ভালো লাগছে – যেসব অভিযোগের কারনে রথীন্দ্রনাথ উপাচার্য পদ ছেড়ে চিরদিনের জন‍্য বিশ্বভারতী ত‍্যাগ করে চলে যান, সেসব অভিযোগ মিথ‍্যা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে, স্বার্থান্বেষী মহল বিশ্বভারতীর ঐতিহ‍্য ও গরিমা নষ্ট করার পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে তাদের প্রথম বাধা উপাচার্য রথীন্দ্রনাথকে মিথ‍্যা অপবাদ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল!
এস ওয়াজেদ আলীর গল্পের বিখ‍্যাত লাইন মনে পড়ল – “সেই ট্র‍্যাডিশান সমানে চলেছে” – রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে বিশ্বভারতীর উপর কর্তৃত্ব বাড়ানোর চেষ্টা। ধীরে ধীরে শুধু রাজনৈতিক দল তথা নেতার বশংবদকে উপাচার্য বানিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে বিশ্বভারতীর নীতি নির্ধারন থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া – সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়ে যেতে লাগল। বিশ্বভারতীর একটি মূল‍্যবান asset হল তার প্রভূত স্থাবর সম্পত্তি। এই সম্পত্তির অংশবিশেষ আত্মসাৎ করার চেষ্টায় রাজ‍্য তথা স্থানীয় প্রশাসনের নেতারা সক্রিয় হল! অভিযোগ আছে যে, এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পযর্ন্ত এই বেআইনী দখলদারী প্রক্রিয়ার সুযোগে নিজের ব‍্যক্তি মালিকানার বাড়ির জমির মধ‍্যে বিশ্বভারতীর জমির কিয়দংশকে নিজের বলে দাবী করেছেন! এই অভিযোগের জবাব পর্যন্ত ঐ অর্থনীতিবিদ দেননি – অস্বীকার করা ত দূরের কথা! এক অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা, যিনি তাঁর সাম্প্রতিক জেলযাত্রার আগে পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন বললে ভুল হয় না, প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কাজের সমালোচনা করতেন! শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে বিশ্বভারতীর অবস্থা হার্বিভোরাস ডাইনোসরের মত! বহু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং কিছু শিক্ষিত ধান্দাবাজদের আক্রমণ তাকে সহ‍্য করতে হচ্ছে।
বিশেষতঃ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কংগ্রেস জমানায় কংগ্রেস-কম‍্যুনিস্ট হনিমুনের সুযোগে শিক্ষক নিয়োগ থেকে ছাত্র-সংসদ, সবেতেই উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত কম‍্যুনিস্ট কন্ট্রোল চলে আসে। শিক্ষাকে কন্ট্রোল করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই কম‍্যুনিস্টরা এভাবে এগিয়েছে – বিশ্বভারতী তার ব‍্যতিক্রম হয়নি। দেশের শিক্ষা-ব‍্যবস্থার বামপন্থীকরন নীতির রূপায়নে কোন রকম বাধা এলেই এরা কম‍্যুনিস্ট ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে ধ্বংসাত্নক আন্দোলনের মাধ‍্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্বভারতীতেও একই কায়দা অনুসৃত হচ্ছে। অল্প সংখ‍্যক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সুনজরে আসতে চেষ্টা করে যাতে ভবিষ‍্যতে তারা প্রত‍্যক্ষ রাজনীতিকে জীবিকা হিসেবে নিতে পারে! এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসাত্মক গুরুত্বহীন আন্দোলন চালানো হয়। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন মদত থাকায় এই আন্দোলন দমন করার প্রকৃত ক্ষমতা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বা উপাচার্যর নেই।
একথাও সত‍্য যে, বিশ্ববিদ‍্যালয়ের উপাচার্য চয়ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন – সব জায়গায় হস্তক্ষেপ – তা রাজ‍্য এবং কেন্দ্র উভয় তরফেই – রাজনীতিকদের একটি রুটিন অধিকারে দাঁড়িয়েছে! ফলে, প্রকৃত ক্ষমতাহীন অনুগৃহীত প্রশাসকের পক্ষে ও ধরনের তৈরী করা নৈরাজ‍্য ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতে লাভ কার? শুধু কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা নেওয়া এবং অনৈতিকভাবে পাওয়া অর্থনৈতিক লাভ ছাড়া রাজনীতিকদের আর কোন লাভ নেই। কবিগুরুর স্বপ্ন, দেশের শিক্ষা জগতের গৌরব, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অধিগ্রহণ ও তারপর তাকে আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষায়তনের পর্যায়ে নামিয়ে আনার দায় এই রাজনৈতিক নেতাদের। শিক্ষার দৈন‍্যতা, গগনচুম্বী লোভ, বিশ্বভারতীর স্বতন্ত্রতা বিষয়ে বোধের অভাব – এ সব মিলে আজ এই বিশ্বখ‍্যাত প্রতিষ্ঠানটি মূমুর্ষ অবস্থায় আইসিইউতে! এর দায় শুধু বিশ্বভারতীর প্রশাসককে দিয়ে লাভ নেই। কারন প্রশাসককেও চয়ন করেন একই রাজনীতিবিদরা। এভাবে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষার বদলে ১৯৫১ সালের অধিগ্রহণ ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর ধ্বংসের মূল কারন। একে বাঁচাতে হলে রাজনীতিমুক্ত প্রশাসন এবং প্রকৃত স্বশাসন একমাত্র ওষুধ।

কোভিডের নতুন সংক্রমণে ভয় অমূলক

“মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” – রাবনের স্বগোতক্তি এই বাংলা প্রবাদ বোধহয় কোভিড-১৯, যাকে আমরা করোনা বলে জানি, তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ‍্য। ব‍্যাপার কি?
আসলে WHO সতর্ক করেছে, চীন,জাপান,কোরিয়া, ব্রাজিল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আবার করোনার ওমিক্রণ ভাইরাসের সাব-গ্রুপের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তাই তারা ভাইরাস সংক্রমণের গডফাদার (!) হিসেবে আবার সারা বিশ্বে ত্রাসের সঞ্চার করে চীনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে নেমে পড়েছে!
চীনের Beijing, Zhuozhon, Shanghai ইত‍্যাদি শহরে কোভিড-১৯ এর বাধানিষেধ তোলার পরেই ঘোষণা হয়েছিল চীনে কোভিড টলারেন্স শূণ‍্য! এই ধরনের প্রোপাগান্ডা সর্বস্ব দেশে কোভিড আবার আসতে পারে যদি জনসাধারণ বিধিনিষেধ না মেনে চলে – বিশেষতঃ কোভিড-১৯এর মত RNA ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে। আবার, আমাদের দেশে বড় সমস‍্যা হল, এখানে নীতিনির্ধারণকারী রাজনীতিবিদরা সবজান্তা মূর্খের মত বিশেষ বিশেষজ্ঞদের (যার মধ‍্যে IAS থাকা বাধ‍্যতামূলক) পরামর্শ নিয়ে চলেন! আগে করোনা সংক্রান্ত লেখায় যা বলেছি, তার প্রতিটি কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত‍্যি হলেও আমাদের দেশে মাণ‍্যতা পায় একমাত্র সুবিধাবাদী রাজনীতির স্তাবকদের পরামর্শ! তাঁরা বিশেষ রূপে অজ্ঞ, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ হিসেবে জনসাধারনকে জ্ঞান দেন এবং অনুগ্রাহী সংবাদ-মাধ‍্যম তা প্রচার করে! ফলে, জনগণের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ‍্যতা শূণ‍্য!
RNA ভাইরাসের ধর্ম হল, সে বেঁচে থাকার তাগিদে জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজের প্রতিলিপি (replication) তৈরী করে দ্রুত সংখ‍্যা বৃদ্ধি করে। আবার এটা করতে গিয়ে তার জিন মিউটেশানের সময় কিছু ক্ষেত্রে জেনম কোডের পরিবর্তন হয়। এদিকে আবার herd immunityর কারনে মানবদেহে যে IgG এ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়, তার ক্ষমতা হোস্টের শরীরভেদে আলাদা আলাদা স্তরের হয়। সেজন‍্য ভ‍্যাকসিন নেওয়ার পরেও বিভিন্ন মানুষের উপর এই ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতা বিভিন্ন স্তরের হয়। পরিবর্তিত gene mutation এর কারনে যেমন RNA ভাইরাসের চরিত্র ও সংক্রমণ ক্ষমতা বদলায়, তেমনি পরিবর্তিত ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিং দেখে তার জন‍্য পরিবর্তিত ভ‍্যাকসিন বানানো যাবে। এর জন‍্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সংক্রমিত রোগীদের সনাক্তকরণ এবং তাদের পরীক্ষা করা। তার জন‍্য কেন্দ্রীয় সরকার Indian SARS-CoV-2 Genomics Consortium (INSACOG) এর স্বীকৃত পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিংয়ের উপর জোর দিয়েছে। এই সময় করোনা ভাইরাসের নতুন ঢেউ নিয়ে সতর্ক হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, এই ভাইরাস পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন‍্য changed gene mutation করে যেমন তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তেমনই তার সংক্রমণের তীব্রতা কমছে – এটা যে কোন RNA ভাইরাসের ধর্ম। আবার ভ‍্যাকসিন এবং herd immunity জনিত কারনে মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন‍্য asymptomatic আক্রান্তের সংখ‍্যা যেমন বেড়েছে তেমনি symptom অনেক মৃদু হয়েছে। এসব অনেক আগেই জানিয়েছিলাম। তবু, ঐ যে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে গেল গেল রব তুলে অর্থনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা – যা এখনো চলছে!
চীনে এখন যে করোনা রোগীর সংখ‍্যা হটাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার কারন সে দেশের মানুষের লাপরবাই, সরকারের ভুল কোভিড প্রোটোকল এবং নিম্ন মানের ভ‍্যাকসিনের (চীনা ভ‍্যাকসিনের কার্যকারিতা আন্তর্জাতিকস্তরে স্বীকৃত নয়) কারনেও হতে পারে। তাছাড়া, অন‍্যান‍্য দেশ, যেমন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়ায় যেসব সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরও চীনের মত BF.7 ভ‍্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে। অন‍্যান‍্য দেশে মৃত‍্যুর সংখ‍্যা অনেক কম হলেও চীনে সংখ‍্যাটা অনেক। সেটা কোমর্বিডিটি বা ভ‍্যাকসিনের মানবদেহে IgG এ‍্যান্টিবডি তৈরীর ক্ষমতার তারতম‍্যের কারনেও হতে পারে। শুধু সাংহাই শহরে চীনের রেকর্ড অনুযায়ী আড়াই কোটির জনসংখ্যার শহরে এখন আক্রান্তের সংখ‍্যা ৫৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে। ব্রিটেন থেকে পাওয়া খবর অনুসারে চীনে এখন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষের কোভিডে মৃত‍্যু হচ্ছে! আবার অন‍্যান‍্য দেশের আক্রান্তদের বেশীরভাগের সঙ্গে চীনা সংযোগ পাওয়া গেছে! ভারতের এখনই লকডাউনের মত ব‍্যবস্থা নেওয়া, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায় আঘাত হানবে – তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। তার কারন হল, এই BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে এখনো পর্যন্ত এই দেশে আক্রান্তর সংখ‍্যা মাত্র চার – গত জুলাইয়ে এক, সেপ্টেম্বরে দুই ও নভেম্বরে এক! এদের মধ‍্যে তিনজন গুজরাটের এবং একজন ওড়িশার। এদের অন্তত একজন ওমিক্রনের BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত এক আমেরিকা নিবাসী ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে এসেছিলেন! সুতরাং এমন সময়, যখন করোনার বিধিনিষেধ আর সামাজিক দূরত্বের বিধান মানা হচ্ছে না, তখনো ভারতে এই ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা দেখে চিন্তিত হওয়ার কারন আছে বলে মনে হয় না।
আরেকটি ব‍্যাপারে খটকা লাগছে – গত বেশ কিছুদিন যাবৎ চীনে BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়তে থাকলেও WHO একদম নিশ্চুপ ছিল! বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ জমায়েত – FIFA ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল শেষ হল রবিবার ১৮ই ডিসেম্বর। আর ১৯শে ডিসেম্বর, ঠিক পরের দিন WHO রিপ ভ‍্যান উইঙ্কিলের মত শীতঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসব – খ্রীষ্টমাসের আগে এমন জ‍্যাঠামশাই মার্কা বিজ্ঞপ্তি জারি করল! এর একাধিক উদ্দেশ‍্য। প্রথমতঃ, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনের ব‍্যর্থতা এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার জিন মিউটেড ভ‍্যারিয়েন্টের নিয়ন্ত্রনে তাদের ব‍্যর্থতার দায় আন্তর্জাতিকভাবে অন‍্য দেশের উপর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এছাড়া করোনা উত্তর মন্দার অর্থনীতিতে খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চীনকে উৎসবের কেনাকাটার মরশুমে যতটা সম্ভব সাহায‍্য করা। যদি এই সময় ভয় ভীতিতেও করোনার বিধিনিষেধ লাগু করা যায় তবে, অন‍্য দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পরবে – এতে চীনের অর্থনীতির নেগেটিভ উপায়ে লাভ হবে। এভাবে কৃত্রিম চাহিদা বৃদ্ধি করে দ্রব‍্যমূল‍্য বাড়ানোর চেষ্টা হবে।
চীনের ইউহানের পরীক্ষাগার থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর সময় থেকে চীন তার মোকাবিলায় সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে, শুধুমাত্র দমন-পীড়ন ও তথ‍্য গোপন করে তার মোকাবিলা করতে গিয়ে বারবার ব‍্যর্থ হয়েছে। এখন তারা বিপাকে পড়ে WHOকে তাদের হয়ে মাঠে ব‍্যাট ধরতে নামিয়েছে। WHO তাই FIFAকে তুষ্ট রেখে ফুটবল বাণিজ্য সম্পূর্ণ হওয়ার পর মাঠে নেমেছে।
এখানে একটি সন্দেহজনক প্রচার লক্ষ‍্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশের কোভিড উত্তর অর্থনীতি যখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তখনই তার উপর বাণিজ্যিক স্বার্থে অনৈতিকভাবে আঘাত হানার চেষ্টা হচ্ছে। এখন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়ছে। ব‍্যাঙ্কের আমানতের উপর সুদ বৃদ্ধি পাচ্ছে – বাণিজ‍্যের আয়তন বাড়ছে। আবার ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশেষতঃ ইউরোপের দেশগুলির অর্থনীতি এবং কোভিড উত্তর চীনের অর্থনীতি যথেষ্ট প্রতিকুলতার মধ‍্যে চলছে। বিশ্বসংস্থা WHO এই সময় যে খন্ডিত তথ‍্য সামনে এনে ত্রাস সঞ্চারের চেষ্টা করছে তার অভিপ্রায় মোটেই ভালো নয়। তারা বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতির বাধানিষেধ ফিরিয়ে এনে চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বানানোর চেষ্টা করছে। এভাবে তারা ভারতকে চাপে ফেলে আবার আমাদের দেশকে মন্দার কবলে ঠেলতে চাইছে।
দেশের সংবাদ-মাধ‍্যম মারফৎ যে প্রচার চলছে তা একপেশে, খন্ডিত ও অযৌক্তিকভাবে ভীতিপ্রদ। এর ব‍্যাখ‍্যা প্রয়োজন। কোথাও বলা হচ্ছে না যে, এখন চীনে এবং অন‍্যান‍্য যেসব জায়গায় নতুনভাবে কোভিড আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়ছে, তার ৯৯% এরই BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এই ভ‍্যারিয়েন্ট এখনো এদেশে গত ছ মাসে আক্রান্ত চারজন! আমি আগেই বলেছি, এভাবে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট আসবে, যাবে। ধীরে ধীরে মানবদেহে এর তীব্রতা কমবে, যদিও তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে। এখন এটাই হচ্ছে। জানিনা দেশের রাজনীতিবিদদের মানুষকে অযথা ভয় দেখানোর কারন কি! এভাবে কোভিড একমাস বা এক বছরে বিদায় নেবে – তা ভাবাই ভুল। সেজন‍্য, আগে যেমন বলেছি, আবার তাই বলছি – কোভিড প্রোটোকলকে মাণ‍্যতা দেওয়া জরুরী। চীনে তার অভাবেই এত দ্রুত BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা এত বেড়েছে। সেজন‍্য আমাদের দেশে আবার লকডাউন বা অর্থনৈতিক বাধানিষেধ আরোপ করা অর্থহীন। এতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে, সেইসঙ্গে কিছু ব‍্যবসায়ীর মুনাফা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরবে। বরং চীন এবং অন‍্য যেসব জায়গায় এই ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়ছে, সেখানে ভারতীয়দের যাওয়ার ব‍্যাপারে বাধানিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। এছাড়া আক্রান্তের পরীক্ষা করে ভাইরাসের প্রকৃতি নিরুপণের জন‍্য INSACOG স্বীকৃত কোন পরীক্ষাগার থেকে তা জানা জরুরী। নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ভ‍্যাকসিনকে কার্যকরী করতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা কোনো শক্ত কাজ নয়। আমাদের দেশের ভ‍্যাকসিনের মান সারা বিশ্বে পরীক্ষিত ও আদৃত। শুধু মানুষকে বুঝতে হবে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার সবচেয়ে জরুরী অস্ত্র মাস্ক এবং স‍্যানিটাইজেশান। সেইসঙ্গে ভিড়ের মধ‍্যে অপ্রয়োজনে গুঁতোগুঁতি না করা বাঞ্ছনীয়।
দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির এ ব‍্যাপারে সদর্থক ভুমিকা নেওয়া দরকার। মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি নর্মাল কাজকর্ম চালাতে কোন বাধানিষেধ রাখা উচিৎ নয়। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে কোভিড চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো থাকায় তা পুরোপুরি না ভেঙ্গে নূন‍্যতম বেডের কোভিড ওয়ার্ড চালু রেখে আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় তৈরী থাকা দরকার; সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডারের স্টক মজুত রাখা ছাড়া এই মূহুর্তে আর কিছু করণীয় নেই। ভ‍্যাকসিনে কোভিড সংক্রমণ অনেকটাই ঠেকানো যাবে। সাথে সাথে সমাজে herd immunity (আক্রান্তের সংখ‍্যা বাড়লে) হলে তখন কোভিড আক্রান্তদের সুস্থ হওয়া নিশ্চিত হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যে চারজন BF.7 ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই সুস্থ। সমাজ, সরকার সতর্ক ও দায়িত্বশীল থাকলে এ ধরনের নতুন নতুন কোভিড ভ‍্যারিয়েন্টের থেকে প্রাণহানির ঘটনা প্রায় থাকবে না।

লাভ-জিহাদের মূল উদ্দেশ‍্য

সোশাল মিডিয়ায় বদরুদ্দিন আজমল নামের একজনের বক্তব‍্য দেওয়া হচ্ছে – ইসলামী ছেলেরা ২২ ও মেয়েরা ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করে বলে নাকি তাদের বাচ্চার সংখ‍্যা বেশী! এই লোকটি তার অন্ধ হিন্দু-বিদ্বেষের পরিচয় দিয়ে বলে, হিন্দুরা ৪০ বছরের আগে বিয়ে করে না আর তার আগে তিন, চারটি করে অবৈধ স্ত্রী রাখ – সেখানে মজা লোটে আর বাচ্চা হয় না! ৪০ বছরের পর কোথাও ফেঁসে গিয়ে যখন তারা বিয়ে করে তখন নাকি তাদের বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না! সেজন‍্য নাকি হিন্দুদের বাচ্চার সংখ‍্যা কম!
এমন একজন হিন্দু-বিদ্বেষী উন্মাদকে যদি প্রশ্ন করা যায়, একজন ইসলামী একসঙ্গে কতজন স্ত্রী রাখতে পারেন? তার উত্তর সে দিতে পারবে না। হাদিসে আছে – চারটি! অবশ‍্য ওসামা-বিন-লাদেন বা মোল্লা ওমরের কটি স্ত্রী ছিল তা জানলে পরে, তারা ইসলামকে কতটা মেনেছিলেন, তার ব‍্যাখ‍্যা কোন জিহাদী মোল্লা-মৌলবীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আসলে মৌলবাদী জিহাদীরা ইসলামের আড়ালে তাদের বিস্তারধর্মী কার্যসিদ্ধি করার উদ্দেশ‍্যে মসজিদ, মাদ্রাসাগুলিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে প্রায় ১০০ বছর আগে থেকে – খিলাফৎ আন্দোলন ব‍্যর্থ হওয়ার পর থেকে। এই সময় থেকে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম এবং মোল্লা, মৌলবীদের আর্থিক প্রলোভন দেখানো শুরু হয়। তখন থেকে বিশেষভাবে ভারতের হিন্দু নারীরা তাদের টার্গেট ভিক্টিম!
২০০৯ – ১১ সালে এভাবে অমুসলিম মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে মুসলিম ছেলেরা তাদের সঙ্গে সম্ভোগ-ক্রিয়া করে তাদের ‘নিকাহ’ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার কাজ ব‍্যাপকভাবে শুরু করে। ধর্মীয় সংগঠনগুলি এ কাজে যুক্ত জিহাদী এই ছেলেদের বিভিন্ন ভাবে সাহায‍্য করে বলে অভিযোগ। এতে ইসলামী মৌলবাদীদের একাধিক উদ্দেশ‍্য সার্থক হয়। প্রথমতঃ, এই অমুসলিম মহিলারা ইসলামের ভাষায় “শষ‍্যক্ষেত্র” হিসাবে ইসলামী সন্তান জন্মের জন‍্য ব‍্যবহৃত হয়! এর ফলে ইসলামী জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অমুসলিম জনসংখ‍্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা কমবে। যার অবিসংবাদী ফল হল, ধীরে ধীরে একটি দার-উল-হার্ব রাষ্ট্র একদিন দার-উল-ইসলামে পরিণত হবে। এই কাজকে শুধু যে ইসলামী পুরুষদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী অবশ‍্য পালনীয় করার কথা বলে, তাই নয়, এ কাজের জন‍্য ধর্মীয় সংগঠন ও জিহাদী সংগঠন থেকে অর্থ সাহায‍্য পর্যন্ত করা হয় – সাম্প্রতিক শ্রদ্ধা ওয়ালকার মার্ডার কেসের অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি অনুসারে এই তথ‍্য সামনে এসেছে। একে পশ্চিমী দুনিয়া প্রথম “লাভ জিহাদ” আখ‍্যা দেয়।
গত ২০১৪ সাল থেকে ভারতে এই লাভ জিহাদের ঘটনার পরিসংখ্যান সামনে আসতে শুরু করে। জিহাদী ও কম‍্যুনিস্ট মানসিকতার সংবাদ-মাধ‍্যম ও তাদের বেতনভূক তথাকথিত “বুদ্ধিজীবী”রা রে রে করে নেমে পড়ে একে লাভ জিহাদ না বলে মহিলাদের উপর অত‍্যাচারের “বিচ্ছিন্ন” ঘটনা বলে চালাতে চায়। কয়েকটি ঘটনা-প্রবাহ ও পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে, এইসব সংবাদ-মাধ‍্যম পেইড নিউজ ও পেইড বুদ্ধিজীবী দ্বারা দুর্বল মিথ‍্যাকে সত‍্যি বলে চালাতে চায় – অনেকটা গোয়েবেলসীয় কায়দায়! স্বাধীনতার সময়ে পাকিস্তানের জনসংখ‍্যার ২৪% ছিল হিন্দু। এখন পাকিস্তানে হিন্দু ২% মাত্র! পূর্ব পাকিস্থানে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে ৩৩% হিন্দু থাকলেও এখন সেই সংখ‍্যা এসে ৯% এ দাঁড়িয়েছে! অর্থাৎ দুই দেশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ‍্যা ক্রমশঃ বিলীয়মান হওয়ার পথে। হিন্দুরা দুটি দেশেই মার্জিনালাইজড্।
গান্ধীজীর সমর্থনে জওহরলাল ও অন‍্যান‍্য গান্ধীবাদী নেতাদের আত্মঘাতী নীতিতে স্বাধীনতার সময় ভারতে সর্ব ধর্ম সমন্বয় এবং পরবর্তীতে জওহর কন‍্যা ইন্দিরা গান্ধীর চাতুরীতে ভারত হল ধর্মনিরপেক্ষ (!) রাষ্ট্র। এটি যে “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা”, সেকথা আগে অনেক লেখায় তথ‍্য সহকারে উপস্থাপিত হয়েছে। সে কারনে ভারতে ইসলামী জনসংখ্যা ১০% থেকে বেড়ে ১৪% হয়েছে। ইসলামী জনসংখ‍্যা বৃদ্ধির হার ১৯৯১-২০০১ সালে ৩৬% হয়েছে! এখন তা নিঃসন্দেহে ৪০% অতিক্রম করেছে। এই পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে লাভ জিহাদের বিচার-বিশ্লেষণ আবশ‍্যক।
লাভ জিহাদের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ইসলামী ছেলেদের জড়িত থাকার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব যে ধর্মীয় উন্মাদনার কারনে, সেটা তাদের অপরাধের ধরনেই বোঝা যায় – এই অপরাধের বিভৎসতা সভ‍্য সমাজের চিন্তার অতীত। ২০২০ সালে হলদিয়ার রমা দে (৪০) ও তার মেয়ে রিয়া দে (১৯) কে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মুল অভিযুক্ত হয় শেখ সাদ্দাম নামের এক ইসলামী যুবক। মৃতদেহ দুটির পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যায় মা ও মেয়ে দুজনেই গর্ভবতী ছিল! গ্রেপ্তারের পর সাদ্দামের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, মা ও মেয়ে দুজনেই তার দ্বারা গর্ভবতী হয়! এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন – হিন্দুদের মধ‍্যে নারীদের মা, স্ত্রী, মেয়ে বা বোন হিসেবে দেখা হয়। সেজন‍্য এই ধরনের অপরাধের রেকর্ড তাদের মধ‍্যে নেই। আবার হিন্দু রমনী মাত্রই “শষ‍্যক্ষেত্র” মনে করে শেখ সাদ্দাম মা ও মেয়ে দুজনের সঙ্গেই মিলিত হয়ে তাদের গর্ভবতী করে! একসময় ব‍্যপারটা জানাজানি হতে সে বাধ‍্য হয়ে নাকি বন্ধু মঞ্জুর আলমের সহযোগীতায় রমা ও রিয়াকে একসঙ্গে খুন করে।
সাম্প্রতিক কালে দিল্লীর শ্রদ্ধা ওয়ালকারের কথা ধরা যাক। তার লিভ পার্টনার আফতাব পুনাওয়ালা (পার্শী নয়, মুসলমান) শ্রদ্ধাকে খুন করার পর তার দেহ ৩৫টি টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়! শ্রদ্ধার ২০২০ সালে লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, আফতাব নাকি শ্রদ্ধার উপর রেগে গেলে প্রায়শঃই তাকে মের টুকরো করার হুমকি দিত! অথচ, মুসলিম জাস্টিস ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাফিউদ্দিন কুদরোলি এই ঘটনাকে লাভ জিহাদ মানতে অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে! Times of India ও বেশ কিছু জিহাদী মদতপুষ্ট সংবাদ-মাধ‍্যম সেই লাইনে প্রচার পর্যন্ত করছে! অবশ‍্য হুবলির হিন্দু জাগ্রুতি সমিতি এই লাভ জিহাদের অপরাধী আফতাব পুনাওয়ালার কঠিনতম শাস্তি দাবী করেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, ধর্মীয় এবং অন‍্য গূঢ় কারনে এমন জঘণ‍্য অপরাধীদের আড়াল করার প্রবনতা আছে – যা সমাজকে অবধারিতভাবে নরকের দড়জায় নিয়ে যাবে।
এই দুটি অপরাধের প্রকৃতি অনুধাবন করলে বোঝা যায়, এগুলি সাধারণ শ্লীলতাহাণি করে খুণ নয়। পৃথিবীতে মানুষ দূরের কথা, কোন পশুও একসঙ্গে মা ও মেয়ে দুজনের সঙ্গে সম্ভোগে লিপ্ত হতে পারে না। শেখ সাদ্দামের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ধর্মের আফিমে বিভোর থেকে সে বিধর্মী রমনীদের “শষ‍্যক্ষেত্র” হিসেবে ব‍্যবহার করে ইসলামী শিশুর জন্ম দেওয়ার কাজে ব‍্যবহার করেছে বলে! এখানে কোন ভালবাসার ব‍্যাপার নেই। আজে শুধু যৌণ লালসা চরিতার্থ করা এবং তা বিধর্মী রমণীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রসূত ধর্ষণ হতে পারে মাত্র। বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদের একটি অস্ত্র এই “লাভ জিহাদ”। শ্রদ্ধা হত‍্যাকান্ডও লাভ জিহাদের অন‍্যরকম বহিঃপ্রকাশ। কোন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে খুণের হুমকি দিতে দিতে একসময় খুন করে তার দেহ ৩৫ টুকরো করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে না! একমাত্র হৃদয়হীণ পাকা খুনী সম্ভোগের পর সঙ্গীকে এভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে। সেটাও সম্ভব শুধুমাত্র বিধর্মী শষ‍্যক্ষেত্রের উপর তীব্র ধর্মীয় ঘৃণা প্রসূত বিদ্বেষ থেকে।
এইসব লাভ জিহাদের উদ্দেশ‍্য ও কার্যপ্রণালীর ছক একটাই – ভারতে বিধর্মী, বিশেষতঃ হিন্দু, রমণীদের ছলে-বলে-কৌশলে ঘনিষ্ঠ হও। সুযোগ বুঝে তাদের গর্ভে ইসলামী ‘ফসল’ ফলাও – তারপর “শষ‍্যক্ষেত্র”কে ধর্মান্তরিত করে ইসলামে শামিল কর! এক্ষেত্রে কোন স্তরে কোন বাধা এলে তাদের খতম করে দাও! এই কাজের জন‍্য যদি জিহাদীকে মরতে হয় তবে বেহেস্তের বাহাত্তর হুরী (সুন্দরী স্বর্গ-বেশ‍্যা) সম্ভোগ কর! পুরোপুরি যৌন সম্ভোগের লোভ দেখিয়ে নিজেদের বিস্তারধর্মী কাজের প্রসারের মাধ‍্যমে ভারতকে দার-উল-হার্ব থেকে দার-উল-ইসলামে রূপান্তরিত করা।
অবাক করার মত যা, তা হল, এই কাজে ভারতের অমুসলিম কম‍্যুনিস্ট ও তথাকথিত “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার” ধারক ও বাহক কিছু মানুষ, সংবাদ-মাধ‍্যম তাৎক্ষণিক লাভের কড়ি গুনতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব, ইতিহাস – সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে। এভাবে চললে ভারতের অমুসলিম অধিবাসীদের অবস্থা কুর্দীস্থানের কুর্দ, ইয়াজিরীদের মত হবে। অতঃপর, তাদের সামনে বেছে নেওয়ার রাস্তা একটাই – হয় লাভ জিহাদীদের তাদের দেশে (পাকিস্তান বা বাংলাদেশ) পাঠাও অথবা নিজেদের অস্তিত্ব শেষ কর। এজন‍্যই মহম্মদ আলী জিন্নার অভিমত – মুসলমান একটি পৃথক জাতিসত্বা – তা হিন্দু, শিখ, খৃষ্টান সকলের থেকে পৃথক। তাই মুসলমানরা তাদের জন‍্য পৃথক রাষ্ট্র চায়। এমন সহজ, সত‍্যি কথাটা বুঝেও নিজেদের স্বার্থের জন‍্য গান্ধী-নেহরু তা মানতে চাননি। তাদের “হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই” এর নামে ভারতকে “ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতা”র দেশ করার খেসারৎ আজ ভারতের অমুমসলিম অধিবাসীদের দিতে হচ্ছে। এর সমাধান প্রয়োজন।

লালন শেখের মৃত‍্যু ও কিছু প্রশ্ন

সংবাদের শিরোনামে বগটুই গ্রামের উঠে আসার কারন ছিল ঐ গ্রামের মহিলা ও শিশুসহ গত ২১শে মার্চ ১০ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার খবর। স্থানীয় বাহুবলী টিএমসি নেতা ভাদু শেখের মৃত‍্যুর বদলা নিতে এই হত‍্যাকান্ড বলে অভিযোগ। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর যখন এই হত‍্যাকান্ডের তদন্তভার উচ্চ আদালতের নির্দেশে CBIএর হাতে গেল, তখন থেকেই টিএমসি ও তাদের সরকারের লোকজন খোলাখুলিভাবে CBI তদন্তভার নেওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এখানে একটি কথা বলা দরকার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই রাজ‍্যে শাসকদল টিএমসির অভিযুক্ত লোকজনদ্বারা খুন,জখম, ভীতি প্রদর্শন ও মারধোরের ঘটনার পুলিশী তদন্তের পর ১% অভিযুক্তেরও শাস্তি হয় না! স্বাভাবিকভাবেই টিএমসি বলে থাকে সব “সাজানো ঘটনা”! গত কয়েকটি নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনায় যত মায়ের কোল খালি হয়েছে, তার ১% এর ক্ষেত্রেও অভিযুক্তর কোন শাস্তি হয়নি – তা তদন্ত CBI বা রাজ‍্যের “দলদাস” পুলিশ – যেই করুক না কেন! ফলত, রাজ‍্যে দুষ্কৃতিদের দাপাদাপি বৃদ্ধিতে প্রশাসনিক অপদার্থতা বা নিস্পৃহতা যে অনেকাংশে দায়ী, তা বলাই বাহুল‍্য।
যাক, ফিরে আসি বগটুই প্রসঙ্গে। CBI ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা এই হত‍্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত লালন শেখকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারে ওই ১০ জন মৃতের পরিবার খুশী হয়, তারা অভিযুক্তের শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নে আশাবাদী হতে থাকে। কিন্তু, CBI হেপাজতে থাকাকালীন গত ১২ই ডিসেম্বর লালন শেখের মৃত‍্যু হয়। CBIএর বক্তব‍্য অনুযায়ী, লালন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত‍্যা করেছে। আর, এই খবর প্রকাশের সঙ্গেসঙ্গে নরকের দরজা খুলে গেছে! লালনের পোস্টমর্টেম করা দেহ তার পরিবার গ্রহণ না করে দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের দাবী জানায় যা কোর্ট মেনে নিয়েছে। লালনের পরিবার লালনকে CBI খুন করেছে বলে রাজ‍্য পুলিশের কাছে FIR করে। পুলিশ সক্রিয়তার সঙ্গে এই FIR নিয়ে তদন্ত শুরু করতে চায়! এই রাজ‍্য পুলিশই টিএমসির বিরোধী রাজনীতির তরতাজা যুবক, যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ পর্যন্ত ছিল না, তাদের রহস‍্যজনক মৃত‍্যুর পর ঝুলন্ত দেহের পোস্টমর্টেম করিয়ে সাথেসাথে আত্মহত‍্যা বলে সিলমোহর দিয়েছে! সে সময় বিরোধীদের কোন অভিযোগ পুলিশ ত দূরের কথা, টিএমসির সর্বাধিনায়িকা পুলিশমন্ত্রী এবং মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় পর্যন্ত রাজ‍্য পুলিশের পক্ষে সাফাই ণগেয়েছেন! এ ধরনের মামলায় যেখানে শাসকদল টিএমসির লোকজন অভিযুক্ত, একজনেরও আদালতে শাস্তি হয়নি! মনে রাখতে হবে, আদালতে কেস সাজানো এবং যথাযত তদন্ত রিপোর্ট পেশের দায়িত্ব রাজ‍্য পুলিশের। তারা যদি এমনভাবে কেস সাজায় যে অপরাধ প্রমাণিত হবে না – তখন আদালতের কিছু করার থাকে না। রাজ‍্যে বিভিন্ন রকমের দুর্ণীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি – এসবের অনেক কারন, যুক্তি থাকতে পারে – এখানে সেসব বিবেচ‍্য নয়। উল্লেখিত পরিসংখ্যান বলছে যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ, এমনকি খুন পর্যন্ত করেও অপরাধী বিশেষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পার পেয়ে বহাল তবিয়তে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে পারে! এর ফলে সমাজে যে বার্তা এসেছে, তা হল, বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে থেকে সমাজবিরোধীরা সমস্ত রকম অপরাধমূলক কাজ করতে পারে! এতে রাজ‍্যের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি না হলেও চরম মাৎসন‍্যায় যে চলছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে বড় রকমের লগ্নি দূরের কথা, সামান্য ছোটখাট ব‍্যবসা করতে গেলে পর্যন্ত এত পরিমাণ “কাটমাণি” দিতে হয়, আখেরে ব‍্যবসা অলাভজনক হয়ে পড়ে!
কলকাতায় এই মূহুর্তে ছোট চার চাকা গাড়ির পার্কিং ফি দশ টাকা প্রতি ঘন্টা। অথচ সব জায়গায় নূন‍্যতম কুড়ি টাকা নেওয়া হচ্ছে! এসব ক্ষেত্রে পুলিশে নালিশ জানানোর বা পৌর-নিগমে নালিশ জানানোর সহজ পন্থা জানা নেই। নিউমার্কেটে রাস্তা জুড়ে হকাররা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ব‍্যবসা করছে। পৌরমন্ত্রী দূরের কথা, রাজ‍্য সরকারের এইসব হকার, যারা আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী বটে, তাদের হটানোর ক্ষমতা নেই! এদের দৌরাত্মে নিউমার্কেটের ভিতরের দোকানগুলির বিক্রিবাটায় মন্দা এসেছে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। যেটা বলার তা হল, এই রাজ‍্য সরকার লুম্পেন, অপরাধী ইত‍্যাদিকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, নেতার মর্যাদা দেওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কাজকর্ম অবাধে চালানোর ইজারা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ “দলদাস” হিসেবে কাজ করায় তাদের কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – পুলিশের মধ‍্যে দুর্ণীতি বাড়ছে, বিশেষতঃ এই সরকারের আমলে চাকরী পাওয়াদের মধ‍্যে। পুলিশ কর্মীরা একাধিক ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকায় তা সংবাদ-মাধ‍্যমে খবর হয়!
এইভাবে প্রশাসনের মদতে রাজনীতির অপরাধকরন ধীরে ধীরে সামাজিক অবক্ষয়ের রূপ নেয়। সাধারণ মানুষ এ সময় ভয় ও অসহায়তায় অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও অস্ট্রিচের মত মাটিতে মুখ গুঁজে থাকে। এভাবে মানুষ ঘৃণা মিশ্রিত অভিব‍্যক্তি নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়। এইভাবে regimented অপরাধমূলক রাজনীতি সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লালন শেখের মৃত‍্যু নিয়ে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রথমেই CBIকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন! অথচ রাজ‍্যের অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর ফাঁস ঝোলানো মৃতদেহকে যখন রাজ‍্যের পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়েছে, তখন একটি ক্ষেত্রেও তিনি পুলিশের বক্তব‍্যে অসঙ্গতি খুঁজে পাননি! লালন শেখের মৃত‍্যুতে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। এতে লাভ কার? নিশ্চয়ই CBIএর নয়, বরং তার কর্তব‍্যে অবহেলায় সুনামের ক্ষতি হবে। এই ব‍্যাপারটা বিশ্লেষন করলে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হবে। বগটুইয়ের ১০ জনকে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে মারার পর প্রথমেই বীরভূমের টিএমসির বেতাজ বাদশা অনুব্রত মন্ডল পুরো ঘটনার দায়িত্ব বিরোধীদের উপর চাপিয়ে সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলেন। এমনকি পুলিশকে সেভাবে এগোতে উপদেশ দেন! এই অনুব্রত এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ধরা পরে জেলবন্দী। অনুব্রতর গ্রেপ্তারকে কটাক্ষ করে তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দলনেত্রী মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়। যাক সে কথা। ভাদু শেখের মত দুষ্কৃতির খুনের বদলা নিতে এই দশজনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগের মূল অভিযুক্ত ছিল এই লালন শেখ। ভাদু টিএমসির নেতা এবং তাকে যারা মেরেছে বলে অভিযোগ, তারাও টিএমসির সমর্থক। লালন ভাদুর অনুগামী বলেই সে বদলা নেওয়ার জন‍্য এই কাজ করে বলে অভিযোগ। অনুব্রতর প্রাথমিক চেষ্টায় বগটুই হত‍্যাকান্ডকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টার মধ‍্যেই পরিষ্কার যে টিএমসি তথা অনুব্রত বগটুই কান্ডের আসল অপরাধীদের আড়াল করে পুরো ব‍্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে। কারন এটি একই সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা সকলেই টিএমসিপির লোক, তাদের দুদলের গোষ্ঠীদ্বন্দের ফল। এভাবে দুষ্কৃতিদের প্রশ্রয় দেওয়ার ফলে যে বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল, এখন তার ফল ফলতে শুরু করেছে। মূল অভিযুক্ত লালন যদি CBIএর কাছে স্বীকারোক্তিতে দলের অন‍্য কোন নেতার নাম বলে দেয় বা অর্থনৈতিক গূঢ় কারন নিয়ে মুখ খোলে তবে দলের বড় নেতা বা নেতাদের অনিবার্য বিপদ হতে পারত। আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে এই অনুসন্ধান বন্ধ করা যাবে না – অনুসন্ধান চলছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং CBI ও অন‍্য অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয় সরাসরি উচ্চ আদালতে রিপোর্ট করছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন ভূমিকা নেই।
লালনের মৃত‍্যুর পরে রাজ‍্য পুলিশের কাছে যে FIR দাখিল করা হয়েছে তা যথেষ্ট সন্দেহজনক! এর উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধে অন‍্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! লালনকে CBI খুন করেছে বলে যে অফিসারের নাম দিয়ে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে সেই সুশান্ত ভট্টাচার্য বগটুইয়ের অনুসন্ধানকারী দলের সদস‍্যই নন! তিনি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে গরুপাচার ও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের অনুসন্ধানকারী দলের IO! সুতরাং CBIএর কোন অফিসারকে কেন ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা জলের মত পরিষ্কার। পরন্তু, ঝাড়খন্ড থেকে যখন CBI লালনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তখন তাকে হত‍্যার অনেক সুযোগ ছিল। CBIএর লালনকে হত‍্যার মোটিভ নেই। আবার বলা হচ্ছে, লালনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যার সময় তার পা নাকি মাটিতে ছুঁয়ে ছিল। এ সম্বন্ধে বলি, বিজেপি কর্মীর দেহ একই রকমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়ার সময় যখন দেখা গিয়েছিল যে মৃতের পা মাটি ছুঁয়ে আছে, তখন রাজ‍্য পুলিশ আত্মহত‍্যার তত্ত্বে অনড় থেকে partial hanging তত্ত্বের কথা বলে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পা মাটিতে ঠেকে থাকলেও একজন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যা করতে পারে। তাড়াহুড়োয় কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে এই FIRএর পক্ষে অ‍্যাকশন নিতে গিয়ে কি সেক্ষেত্রে দোষীকে আড়াল করার দায় রাজ‍্য পুলিশ নিজেদের ঘাড়ে নেবে! লালনকে যখন তদন্তের প্রয়োজনে তার আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে নাকি তার নিকটজনদের কাছে বলেছিল যে CBI তাকে প্রচন্ড মারধোর করেছে! CBI অফিসার ও CISF রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত লালনের পক্ষে এমন কথা বলা অসম্ভব। এটা সর্বৈব মিথ‍্যা – এছাড়া post mortemএ লালনের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই লালনের বিরুদ্ধে যে খুনের প্রধান অভিযুক্তের আরোপ ছিল, তাতে তার মত একজন hardened ক্রিমিনালের পরিবার ও তার পারিপার্শিক জগতের কাছে শিশু সুলভ সরলতা আশা করা যায় না।
বরঞ্চ, লালনের মৃত‍্যুকে ব‍্যবহার করে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার গতি বন্ধ করা বা শ্লথ করার অশুভ চেষ্টা করা যায় তবে কার লাভ তা সবাই বুঝতে পারছে। এই অশুভ শক্তির আশু প্রয়োজন সুশান্ত ভট্টাচার্যকে গরুপাচারের তদন্ত থেকে সরে যেতে বাধ‍্য করা! “রাঘব বোয়াল”কে বাঁচাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে তবে, এই মূহুর্তে রাজ‍্যের যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের এই রাজ‍্যে নির্বাচনে ভরাডুবি অবশ‍্যম্ভাবী। মনে হয় না, ঐ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এমন ভুল করবে। সেজন‍্য অবশ‍্য রাজ‍্যে টিএমসি CBI ও ED বিরোধী আন্দোলনে রাজ‍্য সরকারের মদতের জন‍্য যথাসাধ‍্য চেষ্টা চালাবে। যেভাবে সমাজে অপরাধ ও তা আড়াল করার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ছে, তাতে আসলে মদত পাচ্ছে মাৎসন‍্যায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা বন্ধ করা অসম্ভব।

ভারতের রাজনীতিতে বাঙ্গালী ব্রাত‍্য কেন

বাঙ্গালী বলতে কি শুধু বাংলাভাষী, নাকি পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী (বাংলাদেশ পৃথক রাষ্ট্র) বোঝায় – এই প্রশ্ন এখন উঠেছে। এর পিছনে একাধিক কারন রয়েছে। প্রথমে বলতে হয়, বাঙ্গালী – বিশেষতঃ হিন্দু বাঙ্গালী – তারা ভারতীয়। যেমন দ্রাবিড় সভ‍্যতা ও সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা প্রবহমান, তেমনি বাঙ্গালী সভ‍্যতা, তার কৃষ্টি, সংস্কৃতির স্বকীয়তা বর্তমান। ভারতের বিভিন্ন রাজ‍্য তথা মানুষের কৃষ্টি, সভ‍্যতা, সংস্কৃতির বিচিত্র বিবিধতা লক্ষ‍‍্যণীয়। এই বিবিধতার মাঝে মিলনের যোগসূত্রকে ধরে রাখার জন‍্য নেতৃত্বের তিনটি গুণের প্রয়োজন – শিক্ষা, দীক্ষা ও মানসিক ঔদার্য। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে থেকেই এই তিন গুণের অভাব নেতৃত্বের মধ‍্যে রয়ে গেছে। ফলে, ত্রিখন্ডিত স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীস্তরে দুটি খন্ডের মানুষের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হল ইসলাম – কারন, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল – এই সত‍্য বৃটিশসহ পরাধীন ভারতের প্রায় সব নেতাই মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি পাক-ই-স্তান নামের মধ‍্যেই এই ধর্মীয় কারনে বিভাজনের পরিচয় পাওয়া যায়। পাক-ই-স্তান অর্থ আল্লার স্থান। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ভারত-বিদ্বেষের মধ‍্যে দিয়ে এই দুই খন্ড তার অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেল। অথচ ভারত হল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’! অর্থাৎ অখন্ড ভারত বিভাজিত হয়ে জনসংখ‍্যার ভিত্তিতে ইসলামীরা পেল দুটি খন্ড আর বিপুল সংখ‍্যাধিক‍্যের হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন ধর্মীয় মানুষদের জন‍্য আলাদা রাষ্ট্র জুটল না। তারা এই দেশীয় নেতৃত্বের জন‍্য ইসলামী এমনকি খ্রীষ্টানদের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ভাগ করে নিতে বাধ‍্য হল। ভারতভাগের সময় দেশীয় নেতৃত্বের Super leader মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং তাঁর চয়নকরা কংগ্রেস নেতৃত্ব – জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প‍্যাটেল ইত‍্যাদির ইচ্ছায় ভারতের সংখ‍্যাগরিষ্ট ধর্মের মানষের জন‍্য কোন রাষ্ট্র রইল না। সে সময়, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর কাছে ডঃ শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় তদানীন্তন বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সমর্থ হন। সেকারনেই জন্ম হয় নতুন রাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গের – বাঙ্গালী হিন্দুদের একমাত্র বাসস্থান, যা পূর্ব পাক-ই-স্তান থেকে আগত হতভাগ্য হিন্দু শরণার্থীদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়।
গান্ধী-নেহরু-প‍্যাটেল কোম্পানি বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য কিছু করেনি। শুধু তাই নয়, গান্ধী, বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য যেমন কোন বাক‍্যব‍্যয় করেননি, তেমনি তিনি কোন বাঙ্গালী নেতার প্রশংসা করেননি। সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি যে ব‍্যবহার করেছেন, তা মোটেই বড় মনের নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে না। এই গান্ধীজীই ছিলেন স্বাধীনতা পর্বে ভারতের বেশীরভাগ নেতার গডফাদার। এমনকি, সর্দার বল্লভ ভাই প‍্যাটেলের দাদা বিঠল ভাইজী খোলাখুলিভাবে সুভাষ চন্দ্র বোসকে সমর্থন করতেন বলে গান্ধীজী বিঠল ভাইয়ের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই গান্ধীকে “most over rated politician” বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর অদ্ভুত যুক্তি – আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও হিংসা বর্জনীয় – ভারত মায়ের অনেক সুযোগ‍্য সন্তানকে হারাতে সাহায্য করেছে! বাঙ্গালী হিন্দুদের এক বৃহৎ অংশ তাঁর অবহেলার কারনে ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়েছেন। এমনকি গান্ধীজীর শিষ‍্যরা, যারা দেশের নেতা, কেউ এই হতভাগ‍্য বাঙ্গালীদের সাহায‍্যে এগিয়ে আসেনি। Clement Attlee,যিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি BBC তে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা কারনগুলি হল – INA ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে তার কর্মচাঞ্চল‍্য, নৌবিদ্রোহ, ভারতের বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের ত্রিখন্ডিত করার যুক্তি মেনে নেওয়া। এক সাক্ষাৎকারে ডঃ বি আর আম্বেদকরও মোটামুটি এই যুক্তিই দিয়েছিলেন। এমনকি, পরবর্তী সময় যখন Attleeকে প্রশ্ন করা হয়, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব কতটা – তখন তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল – “minimal”!
এভাবে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতার বাংলা ও হিন্দু বাঙ্গালীদের প্রতি অবহেলার আবহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বের বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর অবহেলা থেকে উভয় তরফেই এক অবিশ্বাসের বাতাবরন তৈরী হয়। শুধু সুভাষ চন্দ্র নয়, ভারতীয় বিপ্লবের জনক রাসবিহারী বোসেরও সঠিক মূল‍্যায়নে গোবলয়ের নেতৃত্বে থাকা কংগ্রেসীদের অনীহা লক্ষ‍্যণীয়!
এখন হয়ত সময় ও চিন্তা দুইই বদলেছে। পূর্ব তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে বঞ্চনা করা হয়েছে, তা অনেকাংশে শুধরানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু দুটি কারনে এই চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রথমতঃ, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল কেন্দ্রের শাসকদলের বিরোধী; দ্বিতীয়ত, গান্ধীজী ও তাঁর চ‍্যালাদের সহিংস-বিপ্লব এবং সুভাষ বিরোধী মনোভাব সার্বিকভাবে “বাঙ্গালী” বিরোধীতায় রূপ নিয়েছে! একটি ব‍্যাপার খুব অবাক করার মত ; তা হল, বাঙ্গালী দেশপ্রেমিক নেতা সুভাষ চন্দ্রকে সারা ভারতের মানুষ বীরের সম্মানে ভূষিত করলেও কিছু বাঙ্গালী রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করেছে, এমনকি তাঁকে “তোজোর কুকুর” বলা হয়েছে! অথচ যতই গান্ধীজী তাদের চিন্তাধারার পূর্বসূরী না হোন, কোন গুজরাতি মানুষ নেই যিনি গান্ধীজীকে জাতির জনক “বাপুজী” মনে করেন না। এখানে দুঃখজনক সত‍্যিটা হল, ভারতের সব রাজ‍্যের মানুষ নিজেদের “ভারতীয়” বললেও জাতীয় ঐক‍্যের প্রশ্নে নিজের ভাষা, ঐতিহ‍্য, সংস্কৃতির জাতিভিত্তিক চেতনাকে সবার উপরে স্থান দেন! একজন গুজরাতি যদি গুজরাতি, তামিলি যদি তামিলি, ওড়িয়া যদি ওড়িয়া থেকে যান, তাহলে ভারতীয়ত্ত্ববোধ ধাক্কা খেতে বাধ‍্য। বিশেষতঃ রাজনৈতিক নেতারা এমন বোধের শিকার হন, তা কখনোই কাম‍্য নয়।
হয়ত বাঙ্গালী-বিরোধী চিন্তা থেকেই প্রাদেশিকতার জন্ম হলেও দেশের গত একশ বছরের ইতিহাসে বাঙ্গালী হিন্দুদের ভারত বিরোধীতার পরিচয় নেই। যদিও গান্ধীজীর নেতৃত্বে জওহরলাল অ‍্যান্ড কোং বারবার পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবু স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় (২০ বছর) ধরে পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার কংগ্রেসের হাতে ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশী শহিদ হয়েছেন বাঙ্গালী হিন্দু, তারপরের স্থানে পঞ্জাব। অথচ স্বাধীনতার সময়ে ভারতের নেতাদের, বিশেষভাবে কংগ্রেসের, অনুমতিক্রমে এই দুটি রাজ‍্যকে ভেঙ্গে টুকরো করে পাক-ই-স্তানে জুড়ে দেওয়া হল। তারপরেও পঞ্জাবে হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা ভারত সরকার তথা কংগ্রেসের কাছ থেকে যে সাহায‍্য পেয়েছেন, তার ছিটেফোঁটাও বাঙ্গালী হিন্দু শরণার্থীদের কপালে জোটেনি। এমনকি, গান্ধী ও তাঁর কংগ্রেসী নেতৃত্ব বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তভূর্ক্তিতে কোন আপত্তি করেনি। সে সময় শ‍্যামাপ্রসাদ তাঁর পশ্চিমবঙ্গ গঠনের আন্দোলনে গান্ধীজী ও তাঁর কংগ্রেসী অনুচরদের থেকে খোলাখুলি কোন সাহায‍্য, এমনকি সহানুভূতি পাননি। এসবের জন‍্যই এই দুই রাজ‍্য, পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আগুন জ্বললে তার ফয়দা তুলল আঞ্চলিক দলগুলি। কেন্দ্রে পালা বদল হলেও এখনো পশ্চিমবঙ্গের উপর বিমাতৃসূলভ আচরণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে – বলা যাবে না।
যুক্তি, বিপরীত যুক্তি অনেক দেওয়া যায় – তবে আসল সত‍্যিটা হল, গোবলয়ের রাজনীতিকরা এখনো বাঙ্গালী রাজনীতিকদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। এইখানেই গান্ধীজীর ভাবধারার ক্রমধারাবাহিকতা লক্ষ‍্য করা যায়। কংগ্রেসের নেতা গান্ধীজী কিন্তু এখনকার কংগ্রেস বিরোধী ক্ষমতাসীন দলের কাছেও পুজনীয় ব‍্যাক্তি! এইসব কারনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুদের মনে যদি প্রাদেশিকতার ভাব জন্মায়, তবে তা কতটা দোষের! যেভাবে বাঙ্গালী তার দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছে তার দাম গোবলয়ের রাজনীতিকরা দিয়েছেন কি? এমনকি, বাঙ্গালীর দূর্গাপুজাকে গোবলয়ের মানুষ বাঙ্গালীর পুজা-অনুষ্ঠান বলে; আর রামনবমী থেকে শিবাজী উৎসব, করবা চৌথ হয়ে যায় ভারতীয় উৎসব! এ ধরনের বিভেদকামী প্রভূত্ববাদী প্রচার কখনোই সার্থকভাবে দেশাত্মবোধ জাগাতে পারে না। প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট গোবলয়ের পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই বাঙ্গালী হিন্দুদের নিজের সমগোত্রীয় মনে করেনি। ছোটবেলায় কলকাতায় অবাঙ্গালী গোবলয়ের মানুষদের প্রতিবেশী হওয়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, শুধু “মছলিখোর” বলে তারা আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত। শুধু তাই নয়, সামাজিক মেলামেশায় “মছলিখোর” হওয়ার কারনে আমরা তাদের সমাজে ব্রাত‍্য ছিলাম।
ভারতীয়ত্বের যে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক মেলবন্ধনের কথা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী নেতারা বলে থাকেন, তার সারমর্ম হচ্ছে – গোবলয়ের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ – যা আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। “আমার নেতৃত্বে, আমার ধারনার সঙ্গে মিলে তুমি আমার সংস্কৃতি, পোষাক, খাদ‍্যরুচির অনুসরন করলে জাতীয়তাবাদী” – এমন অদ্ভুত ভাবনা কখনোই ধান্দাবাজ চামচা ছাড়া প্রকৃত দেশভক্ত তৈরী করে না। তামিল, বাঙ্গালী, গুজরাতী, মারাঠি, রাজস্থানী ইত‍্যাদির সমন্বয়ে গত ৭৫ বছরেও ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। যদি তা হত, তবে গোবলয়ের বাঙ্গালী বিরোধী, সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরোধী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এখনো গোবলয়ের, বিশেষ ভাবে গুজরাতীদের হিরো হত না। একই সঙ্গে গান্ধী এবং সুভাষকে সম্মান দেখানো রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ওড়িশা, তেলেগু, দ্রাবিড় অঞ্চলে আঞ্চলিক দলগুলির দীর্ঘ দিনের প্রাধান‍্য এই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার ফল!
জাতীয়স্তরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে তিনটি আবশ‍্যিক গুণের কথা বলা হয়েছে, তার অভাব এখনো অনেকাংশে অনুভূত হচ্ছে। এই “মছলিখোর” বিরোধী মানসিকতার প্রতিফলন দেখা গেছে “বাঙ্গালী”র মছলি খাওয়াকে অবজ্ঞাসূচক বিদ্রুপের মধ‍্যে দিয়ে। যদিও পরবর্তী সময়ে ঐ অভিনেতা-কাম-রাজনীতিক বিশ্লেষণাত্মক ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন, তিনি বাঙ্গালী বলতে রোহিঙ্গা (!) ও বাংলাদেশী বলতে চেয়েছেন! এইসব অর্ধ শিক্ষিত প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট নেতারা জানেন না যে স্বর্গীয় অটল বিহারী বাজপেয়ীজীর প্রিয় খাবারের মধ‍্যে “মছলি” ছিল! উচ্চতম নেতৃত্ব সঠিক নেতা চয়ন না করলে দল তথা দেশকে ভুগতে হবে।
এখন রাজনীতিতে নিম্নবর্গীয় নেতৃত্বের কারনে দলীয় নেতৃত্বের কাছে প্রশ্নাতীত আনুগত্য একমাত্র যোগ‍্যতার মাপকাঠি। হয়ত সে কারনেই পশ্চিমবঙ্গের ঐ দলের পক্ষ থেকে এমন বাঙ্গালী বিদ্বেষী উক্তি নিয়ে কোন প্রতিবাদ হয়নি! আরেকটা কারন হতে পারে, বাঙ্গালীদের প্রতি গোবলয়ের অবিশ্বাস তত্ত্বে দলের বঙ্গ নেতাদের বিশ্বাস আছে বলেই তাঁরা এর সমালোচনা করে উচ্চ-নেতৃত্বের বিরাগভাজন হতে চাননি! আবার এর সমালোচনা করতে গিয়ে থেবলা, গাঠিয়া খাওয়া মানুষদের বিদ্রুপ করার ঘটনাও একই রকম নিন্দনীয়। এভাবে প্রাদেশিকতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা করা – এ ব‍্যাপারটা জাতীয়স্তরের শীর্ষনেতৃত্ব খেয়াল রাখলেই মঙ্গল। শুধু বাঙ্গালী নয়, ভারতের রাজনীতির চিরকালীন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভোগলিপ্সা জাতীয় ঐক‍্য ও মূল‍্যবোধের পরিপন্থী কার্যকলাপের জ‍ন‍্য বহুলাংশে দায়ী। যেমন, দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্বে চাপিয়ে দেওয়া প্রবাসী, ভূঁইফোড় বাঙ্গালী নেতাদের যে রাজ‍্যের মানুষ প্রত‍্যাখ‍্যান করেছে তা তাদের নির্বাচনের ফলেই প্রতিভাত। অসমে যোগ‍্য, নতুন দলে আসা অহমীয়া এবং রাজ‍্যে রাজনীতি করা মানুষকে নেতৃত্বে বসিয়ে সাফল‍্য পেলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী নেতৃত্বকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর দল তাদের অপশাসনের কোন কুফল ত ভোগ করছেই না, পরন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ও তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধ‍্য হচ্ছে এই রাজ‍্য-সরকারকে সাথে নিয়ে চলতে!
পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সবজান্তা মূর্খ, ধান্দাবাজ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দলের জন-বিচ্ছিন্নতার বড় কারন। ফলে, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ব্রাত‍্য বাঙ্গালীর উত্থান সুদূরপরাহত বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।

রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন নয়

১৯৮৩ সালে ভারত সরকার যে কেন্দ্র-রাজ‍্য সম্পর্কের প্রশ্নে রঞ্জিত সিং সারকারিয়া কমিশন গঠন করে, তারা তাদের পর্যবেক্ষণ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পর তা তৎকালীন এবং পরবর্তী কোন সরকারই গ্রহণ করেনি। কিন্তু এই কমিশনের পর্যবেক্ষণগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ‍্য-সরকার তাদের স্বার্থে ব‍্যবহার করার কথা বলেছে! সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্ট মানতে হলে আমাদের দেশের সংবিধানকে জ্বলাঞ্জলী দিতে হবে! বিশেষতঃ, রাজ‍্যপাল নিয়োগের প্রশ্নে তাঁকে কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করার যে সংবিধান স্বীকৃত পন্থা আছে, তা বদলে রাজ‍্য বিধানসভা তথা রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে রাজ‍্যপাল নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে! কোন রাজ‍্য-সরকার যদি দেশের সংহতির পরিপন্থী এবং সংবিধান বিরোধী কাজ করে, তা হলেও কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান মোতাবেক সেই রাজ‍্য-সরকারকে সরাতে পারবে না! মনে পড়ল, কম‍্যুনিস্ট পার্টির প্রাক্তণ সাধারণ সম্পাদক ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীর তত্ত্ব – যেখানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ বলে দেখানো হয়েছে! এদিকে রাজ‍্য-সরকারগুলি তাদের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণে ও উন্নয়ণের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সাহায‍্যের উপর নির্ভরশীল। কিছু রাজ‍্য-সরকারের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বভাব হচ্ছে, একের পর এক প্রকল্পের জন‍্য কেন্দ্র থেকে টাকা নিয়ে তার হিসাব না দেওয়া – এমনকি টাকার Utilization certificate পযর্ন্ত দেওয়া হয় না। এর কারন বহুবিধ। অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম পাল্টে দেওয়া, প্রকল্পের টাকার হিসাব না দেওয়ার বড় কারন হচ্ছে এক খাতের টাকা সম্পূর্ণ অন‍্য খাতে ব‍্যয় করা, প্ল‍্যানড্ ও আন-প্ল‍্যানড্ বাজেটের হিসেব গুলিয়ে ফেলা – সর্বোপরি দুর্ণীতির সুযোগ তৈরী করা!
সারকারিয়া কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করতে হলে বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে রাজ‍্যগুলিকে রক্ষা করা এবং রাজ‍্যগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুসারে তাদের অর্থ প্রদান করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের আর কোন ভূমিকা থাকবে না! রাজ‍্যগুলির কাজকর্মের সঠিক গতি ও পথ নির্ণয়ে রাজ‍্যপালের ভূমিকা বদলে গিয়ে তা রাজ‍্য-সরকার তথা মূখ‍্যমন্ত্রীদ্বারা চয়ন করা একজন “রাবার স্ট‍্যাম্প” হবে মাত্র! এমন অবাস্তব ও সংবিধান-বিরোধী পর্যবেক্ষণের কারনেই স্বাভাবিকভাবে এত বছরে যত সরকার কেন্দ্রে এসেছে, তারা কেউই এই কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি, ব‍্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের কারনে এখনো এই কমিশনের পরামর্শ না মানার জন‍্য কেন্দ্রকে দোষারোপ করে থাকেন। আবার এই নেতারাই যখন কেন্দ্রীয় সরকারে থাকেন, তখন কেউ সারকারিয়া কমিশনের কোন অংশকেই গ্রহণ করার আগ্রহ দেখান না।
সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ কার্যকর না হওয়ার জন‍্যই কেরলের রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খান কেরল সরকারের আইন বিরোধীভাবে সরকারি অর্থ অপচয় করে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ‘পেনশন’ দেওয়ার প্রকল্প নিয়ে আপত্তি করতে পারেন। কেরলে রাজ‍্যের মন্ত্রীরা তাদের ব‍্যক্তিগত কাজের জন‍্য চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে পারেন। এই কর্মীরা যত কম দিন কাজ করুন না কেন, তাঁরা সরকারি স্থায়ী কর্মীদের মত পেনশন পাওয়ার অধিকারী! বামফ্রন্টের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ম চালু আছে! এদের নিয়োগের কোন নির্দিষ্ট যোগ‍্যতা নেই। এরা কোন নির্বাচন পদ্ধতির মধ‍্যে দিয়ে নির্বাচিত নয়! এদের একটাই যোগ‍্যতা – পার্টির লোক এবং মন্ত্রীর ইচ্ছেয় চাকরী করছেন! এদের কাজও রাজনৈতিক স্বার্থ ও রাজনীতিকের স্বার্থ দেখা! এখানে কেরলের মাননীয় রাজ‍্যপাল প্রশ্ন তুলেছেন – সরকারি অর্থ ব‍্যয় করে এইসব রাজনৈতিক কর্মীদের আজীবন পেনশন দেওয়া হচ্ছে কেন? আশ্চর্যের ব‍্যাপার হল, রাজ‍্য-সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে পেনশন পাওয়ার জন‍্য যে নূন‍্যতম বছর চাকরি করার প্রয়োজন, তা এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ‍্য নয়! এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পেনশন দিতে খরচের ব‍্যাপারে কেরলের রাজ‍্যপাল সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ‍্যণীয়, পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন থেকে ধরে বর্তমান রাজ‍্যপাল – কেউ এ ব‍্যাপারে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে সরকারি অর্থ রাজনৈতিক কর্মীদের মধ‍্যে বিলি করার নৈতিক অনুমোদন পাওয়া যায় কি? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মীরা, পেনশনভোগী বৃদ্ধ প্রাক্তণ সরকারি কর্মীরা ডিএ না পাওয়ায় যে অর্থকষ্টে ভুগছে, তাদের রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচাল করার জন‍্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে এদের ঘুঁষি মারা হচ্ছে, লাঠিপেটা করা হচ্ছে! অথচ, এমন নীতিবিরুদ্ধ কাজের জন‍্য কোন প্রতিবাদ নেই! তাই, ধন‍্যবাদ মাননীয় রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খানকে। তিনি এব‍্যপারে মুখ খুলেছেন। অথচ, কোন রাজনীতিক এই অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা নেই। এভাবে দলের লোককে সরকারি অর্থ পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রথম শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের হাত ধরে। তারপর তা অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এবার কথা হল, সারকারিয়া কমিশনের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক রাজ‍্যপাল নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলে কেরল সরকারের মনোনীত রাজ‍্যপালকখনোই সরকারের এই নীতি বিরুদ্ধ কাজ নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতেন না। আবার পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী দাবী করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের নব-নিযুক্ত রাজ‍্যপাল ডঃ সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়োগের সময় তাঁর পরামর্শ চাওয়া হয়নি! আইন ও সংবিধান মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার কোন রাজ‍্য-সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করে ঐ রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল নিয়োগ করে না।একটি রাজ‍্যের রাজ‍্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ‍্য-সরকারের কাজকর্মের ব‍্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন রাজ‍্যের মানুষের স্বার্থে। তিনি নির্বাচনে জেতা দলীয় প্রতিনিধি নন। রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, রাজ‍্যপালের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব রাজ‍্য-সরকারের উপর। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে রাজ‍্যপালের সক্রিয়তা জরুরী।
অথচ, রাজ‍্য-সরকারের কোন কাজকে সঠিক দিশা দেখানোর জন‍্য যদি রাজ‍্যপাল তাঁর সরকারকে পরামর্শ দেন, তখন, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, রাজ‍্যপালের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আবার শিক্ষার মানদন্ড না থাকায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন রাজ‍্যের ক্ষমতায় বসেন, তখন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতার সীমা ও এক্তিয়ার সম্পর্কে তাঁরা নিজেরাই বিশেষ অবগত থাকেন না। বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে বলা যায়, সরকারের জন-বিরোধী বা বেআইনি কাজকে যখন কোন রাজ‍্যপাল সামনে এনেছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তখনই সেই রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে সরকার তথা শাসক দলের পক্ষে প্রতিবাদের ঝড় তোলা হয়েছে – অনেক সময় এই প্রতিবাদ শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। এতে হয়ত রাজনৈতিক ফয়দা হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
এইভাবে এই রাজ‍্যে হয় রাজ‍্য-সরকারের রাবার-স্ট‍্যাম্প রাজ‍্যপাল অথবা দায়িত্বশীল রাজ‍্যপালের জন‍্য বরাদ্দ হয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির তকমা! লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের; ক্ষতি সাধারণ মানুষের। এখানেও বলতে হয়, সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্টের রাজত্বকালেই রাজ‍্যপালের সঙ্গে অসভ‍্যতা করা শুরু হয়। রাজ‍্যপাল ধর্মবীরার সময় কিভাবে তাঁকে অপমান করা হয়, মিছিল সংঘবদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করা হয় – তা এখনো পশ্চিমবঙ্গের জনগণ মনে রেখেছে। এখন “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী”র রাজত্বে এই নোংরামো বহুগুণ বেড়েছে।
যে রাজ‍্যে বড় কল-কারখানা থেকে ছোট শিল্প, SEZ ইত‍্যাদি ধ্বংস করে রাজ‍্যের মানুষকে ভাতা কেন্দ্রীক জীবন ধারনে বাধ‍্য করা হয়েছে, তার দায় এই রাজ‍্যে বিভিন্ন সময়ে (গত ষাট বছর) শাসন করা রাজনৈতিক দলগুলির। এখন রাজ‍্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই শাসকদলের মদতে একমাত্র ব‍্যবসা হল ‘কাটমানি’ ব‍্যবসা। এইসবের বিরুদ্ধে যে রাজ‍্যপাল সরব হবেন, তাঁকেই শাসক বাহিনীর বিদ্রুপ ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে অপমান সহ‍্য করতে হবে। এর শুরু সেই ধর্মবীরের সময় থেকে। সে সময়ের শাসকদল এখন বিধানসভায় একজনকেও জিতিয়ে আনতে পারে না! কারন, এ রাজ‍্যে শাসকদল শোষকদলে পরিণত হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্ণীতির নাগপাশে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের জন‍্য কেন্দ্রের প্রতিভূ রাজ‍্যপাল যখনই কোন পদক্ষেপ করতে গেছেন, তখনই তাঁকে শাসকদলের সমবেত আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। সেটাই এখন এ রাজ‍্যের রাজনৈতিক ঐতিহ‍্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে রাজ‍্যপালকে কাজ করতে না দেওয়ার কারন একটাই – রাজ‍্যের শাসকদলের দুর্ণীতি কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখার অসৎ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।
আরেকটি রাজনৈতিক কারন এখানে উল্লেখ করা যায় – বিশেষতঃ দেশের গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে। এই রাজ‍্যে ভোটের সময় যত সন্ত্রাস, হিংসাত্মক ঘটনা, খুণ-জখম এবং রক্ত ঝরানোর ঘটনা ঘটে, সারা দেশে তার অর্ধেক হিংসা ঘটে না। ভোট-পরবর্তী হিংসাও এই রাজ‍্যের বিশেষত্ব। এর বেশ কয়েকটি কারন আছে – প্রথমতঃ রাজ‍্যে কর্মসংস্থান ও অর্থ উপার্জনের সুযোগ অত‍্যন্ত সীমিত হওয়ায় রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে অনৈতিক উপায়ে দালালী, কাটমানি ইত‍্যাদি রাজ‍্যের এক বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগারে পরিণত হয়েছে। এখানেও সেই বামপন্থী রাজত্বের থেকে শাসকদলের হয়ে বিভিন্ন রকম প্রচার, তাদের দলের স্বার্থে হিংসাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে বহু মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এ ধরনের কাজে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ‍্য আসায় এবং রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপে পুলিশের ছত্রছায়ায় এই কাজে রিস্ক কম থাকায় বহু অল্প বয়সী ছেলেপিলে একে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে – বিশেষতঃ অন‍্য কাজের সুযোগ না থাকায়।
এভাবে ধীরে ধীরে রাজ‍্য-রাজনীতিতে যেমন দুর্ণীতি ও হিংসা বাড়তে থাকে, তেমনি ক্ষমতা দখলে রাখার মরিয়া চেষ্টায় রাজনৈতিক হিংসাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ভোটের সময় স্বাভাবিক কারনেই স্বার্থ ও জীবিকা বাঁচানোর তাগিধেই এ ধরনের লুম্পেন কর্মীদের দ্বারা রাজনৈতিক স্বার্থে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হয়। এ রাজ‍্যে নির্বাচন পরিণত হয়েছে লুম্পেন কর্মীদের রুজি-রোজগার বজায় রাখা অথবা তা ছিনিয়ে নেবার সংগ্রাম হিসাবে! এইভাবে রাজ‍্যে হিংসাত্মক রাজনীতির জন্মও হয় বামপন্থী ও অতি-বামপন্থী রাজনীতির অনুসঙ্গ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে বামপন্থীসহ কিছু রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এই হিংসাত্মক রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। রাজ‍্যে শিল্প ও ব‍্যবসা-বাণিজ‍্যের প্রতিকুল পরিবেশে এই লুম্পেন রাজনীতির হাত ধরে বামপন্থী রাজত্বেই আসে কাটমানি বাণিজ্য – যা ২০১১ সালে পালা বদলের পর রাজ‍্যের বর্তমান শাসককুল প্রায় সব ধরনের বাণিজ‍্যিক আদান প্রদানে বাধ‍্যতামূলক করে দিয়েছেন! এ কাজের গণতন্ত্রীকরনের জন‍্য রাজ‍্যের আইনের রক্ষকদের এমনভাবে কাজে লাগানো হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে শাসকদলের লিগ‍্যালাইজড্ গুন্ডাবাহিনীর মত আচরণের অবিযোগ বিস্তর।
এমতাবস্থায় রাজ‍্যের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব রাজ‍্যপালের। তিনি যদি সেটিং তত্ত্বের ক্রীড়নক হয়ে পড়েন, তাহলে বলতে হয়, দেশে আইনের শাসন ও সংবিধানের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গেছে। তার দায় তখন রাজ‍্যপাল ও তিনি যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ‍্যে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন – সেই সরকারের কুশীলবদের উপরেই বর্তায়। এখানে গত শতাব্দীর শেষপাদ থেকে কাশ্মীর রাজ‍্যের কথা মনে করিয়ে তার ফলাফল বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার কথা মনে হল। অতয়েব, সাধু সাবধান।

বঙ্গ রাজনীতিতে এত কটুক্তির বন‍্যা কেন

ভোলা ময়রার বহুল প্রচলিত কবিগানের উক্তি : “জন্ম যেমন যার, কর্ম তেমন তার; এ ব‍্যাটা ভেড়ের ভেড়ে, নিমক ছেড়ে কবির ব‍্যবসা ধরেছে” – এই কথাগুলি যেন মনে হয় বর্তমান সময়ে রাজ‍্যের রাজনীতিকদের নিয়ে বলা হয়েছে!
বাঙ্গালীরা বরাবর আবেগপ্রবণ জাত। এই আবেগের বশেই একসময় শিক্ষিত বাঙ্গালীকুলের বড় অংশ দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের বলিদান দিয়েছিল। সেই সময় যারা রাজনীতির আঙ্গিনায় এগিয়ে এসেছিল, সেই বাঙ্গালীদের অধিকাংশই স্বচ্ছল পরিবারের যুবক। তাদের উদ্দেশ‍্য ছিল দেশের জন‍্য, সমাজের জন‍্য ভালো কিছু করা – রাজনীতি তাদের কারোর জীবিকা ছিল না। সে কারনে রাজনীতির মাধ‍্যমে রোজগার করার ধারনাটাই তখন ছিল না।
দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই একদল রাজনীতিকের আবির্ভাব হয়, যারা ” ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” বলে এই সমাজসেবা করাকে তাচ্ছিল্য করে এবং নির্বাচনে জেতাকে রাজনীতির মঞ্চে পরম সাফল্য বলে মনে করে। এভাবে অহঙ্কারী ও লোভী মানুষের মধ‍্যে রাজনীতির মঞ্চে ভীড় করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। একথা না বললে সত‍্যের অপলাপ হয় – ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় যে মানুষদের হাতে ক্ষমতার ‘মধুভান্ড’ আসে, তারা সততা ও দেশপ্রেম থেকে বহু যোজন দূরে থাকা মানুষজন! সম্ভ্রান্তের তকমা পাওয়া কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে এসে যে মধুভান্ডের স্বাদ পান, তারজন‍্য তাদের অনেকেই নিজের অপদার্থ, অযোগ্য, অসৎ বংশধরদের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। এরাই ভারতে বংশপরম্পরায় রাজনীতির ব‍্যবসা শুরু করেন। প্রথম উদাহরণ অবশ‍্যই নেহরুর পরিবার। প্রশাসনিক দুর্ণীতির অংশ হয়ে এই রাজনীতিকরা এমন ধনবান হয়ে পড়ে যে তারা অন‍্য ব‍্যবসায় কিছুতেই এত অর্থের মালিক হতে পারতেন না।
ভারতীয় রাজনীতির এই অসততার শিকড় আমাদের রাজ‍্যেও সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। এমনকি, এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত মানুষজন – জজ, আইএএস, শিক্ষাবিদ – অনেকেই অবসরগ্রহণের পরেপরেই কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করতে নেমে পড়েন। জীবনের শেষপাদে এসে তাঁদের দেশসেবার ইচ্ছা চাগিয়ে ওঠে! এদের কার্যকলাপে সন্দেহ জাগে তাদের কর্মজীবনের কাজে নিরপেক্ষতা উপর।
আমাদের সাধারন মানুষকে বুঝতে হবে, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অপগন্ড থেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব‍্যাক্তি, প্রতিষ্ঠিত খেলোয়ার, গায়ক, অভিনেতা – সকলের এত দেশসেবার হিড়িক জাগল কেন! আসলে, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বিনা বিনিয়োগে সবচেয়ে লাভজনক ব‍্যবসার নাম – রাজনীতি! এ আর “দেশসেবা” নয় – profession। সেজন‍্য অনেক রাজনীতিক তাঁদের ফর্ম পুরনের সময় professionএর জায়গায় লেখেন – রাজনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় কয়েকটি পরিবার রাজনীতির ‘মধুভান্ড’ কুক্ষিগত করে রাখেন। ভারতের মসনদে যেমন নেহরু-গান্ধী পরিবার, কাশ্মীরে আবদুল্লা পরিবার ইত‍্যাদির ধনবৃদ্ধিতে প্রলুব্ধ হয়ে, বহু মানুষ রাজনীতিকে profession হিসেবে গ্রহণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে! রাজনীতি করতে যেহেতু কোন যোগতা লাগে না, সে কারনে বহু লোভী ও অসৎ মানুষ রাজনীতির আঙ্গিনায় ভিড় করে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলতে হয়, স্বাধীনতার অব‍্যবহিত আগে সুরাবর্দী তাঁর অসৎ উদ্দেশ‍্যে রাজ‍্যের পুলিশকে ব‍্যবহার করে এবং সেইসঙ্গে রাজনীতির আঙ্গিনায় দলীয় গুন্ডাগর্দীর প্রচলন করেন। আবার সময়ের সঙ্গেসঙ্গে বঙ্গ রাজনীতিতে দলীয় মাসলম‍্যানদের গুরুত্বের পরিবর্তন হয়। প্রথমদিকে, বিশেষতঃ কংগ্রেসের প্রথম ১৫-১৬ বছরের শাসনকালে এই গুন্ডাবাহিসীর কিছুটা ভূমিকা দেখা গেলেও তারা কখনোই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্ব পেত না।একটা ব‍্যাপার লক্ষ‍্য রাখা হত, এরা যেন সমাজে সাধারন মানুষের অসুবিধে না করে।
তারপর রাজ‍্য-রাজনীতির আঙ্গিনায় উত্থান হল বামপন্থীদের। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন‍্য যতটা আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেল, তার চেয়ে তারা অনেক বেশী আগ্রাসী ভঙ্গিতে প্রধান বিরোধী দলকে ছলে-বলে-কৌশলে হেয় করার প্রয়োগ-কৌশল দেখালো – এখানে কোন নিয়ম, নীতির তোয়াক্কা করল না! নির্বাচনের সময় বামপন্থার বকলমে সিপিএমের দেওয়াল লিখনে ও চিত্রাঙ্কনে শুধু ইন্দিরা-কংগ্রেসকে গালি দেওয়া নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক রক্ত-পিপাসু ডাইনীর রূপে চিত্রিত করে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দেওয়াল লিখন করা হল!
এভাবে নির্বাচনে বিরোধীতার আগ্রাসী চরিত্র সামাজিক ক্ষেত্রেও গতি পেল যখন রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু বানতলার নৃশংস ধর্ষণও হত‍্যার ঘটনা প্রসঙ্গে বললেন, “এমন ত কতই হয়”! এভাবে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার পর, গুন্ডাগর্দীর মাধ‍্যমে দলে উঠে আসা মানুষদের নেতৃত্বে বসানো শুরু হল। যার বিরুদ্ধে স্বহস্তে গুলি করে এক থানার ওসিকে নিধনের অভিযোগ, তাকে শুধু এমএলএ নয়, মন্ত্রী করা হল! এইভাবে এই রাজ‍্যে গুন্ডাগিরি রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাওয়ার সোপান হিসেবে দেখা শুরু হল! ইতিমধ‍্যে অতিবামদের খুন খারাবির রাজনীতি শুরু হল। তাদের শ্লোগান – “চীনের চেয়ারম‍্যান আমাদের চেয়ারম‍্যান” আর “ধনীর গায়ের চামড়া দিয়ে গরীবের পায়ের জুতো তৈরী হবে” – এমন অবাস্তব, অসাড় শ্লোগানসহ তারা এক প্রৌঢ় বা বৃদ্ধকে আট-দশজন যুবকদ্বারা নৃশংসভাবে হত‍্যা করার মধ‍্যে বিপ্লব সাফল‍্যমন্ডিত হল – বলে প্রচার করল! এমন চরম সামাজিক ও আইন-শৃঙ্খলার চরম অবক্ষয়ের পর্যায়ে কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তিনি পুলিশ দিয়ে তথাকথিত বিপথগামী যুবকদের ‘খুন’ করালেন। সুরাবর্দীর পর, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এভাবে পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে রাজনৈতিক কারনে হত‍্যার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রথম কারিগর এই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। এর সুদূরপ্রসারী ফল হল, যখন পশ্চিমবঙ্গে জ‍্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন প্রতিষ্ঠা হল, তখন প্রথম থেকেই পুলিশকে রাজ‍্যের শাসকদলের স্বার্থে ব‍্যবহার করা হতে লাগল। আবার সিদ্ধার্থ জমানায় যে হাতকাটা জিতু বা কানকাটা ছেনোর দল রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহৃত হত, রাজ‍্যের পুলিশবাহিনী তাদের সঙ্গে আপোষ করার রাস্তা নিল।
সিপিএম জমানায় সাধারন নির্বাচন থেকে লোকাল বডি, এমনকি স্কুল, কলেজের গভর্নিং বডি নির্বাচনে পর্যন্ত গুন্ডা-বাহিনী শাসকদলের সমর্থনে রাস্তায় নামত। এদের রক্ষা করত রাজ‍্যের পুলিশ বাহিনী। তৈরী হল শাসক-গুন্ডা-পুলিশ জোট। সাধারন মানুষ এই জোটের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করত না – শুধু ভয় দেখিয়েই কাজ হাসিল করা হত। বিরোধী বা সংঘবদ্ধ জোট হলে তার বিরুদ্ধে একযোগে এই গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হত। যত সময় গড়ালো, তত নির্বাচনে গুন্ডাগর্দী দেখানো কর্মীরা পার্টির নেতৃত্বে যেতে লাগল। এদের চারিত্রিক ও বাণিজ্যিক গুণগুলি (!) রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করল – এভাবে রাজনীতি একটি সর্বাপেক্ষা লাভজনক ব‍্যবসায় পরিণত হল। যার মধ‍্যে গুন্ডাগর্দী, অসততা, মিথ‍্যাচারসহ সকল চারিত্রিক অনাচার দেখা গেল – তিনি ততই সার্থক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন।শুধু শাসক দল নয়, রাজনীতির এই অবক্ষয় দলমত নির্বিশেষে সব দলের রাজনীতির মধ‍্যেই দেখা গেল। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন নির্বাচনে রক্ত ঝরা একটি স্বাভাবিক ব‍্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
শিল্পায়ণের চেষ্টা, অর্থনীতির উন্নতির চেষ্টা এফং দলীয় নেতাদের তোলাবাজির প্রশ্রয় না দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কুকথার ফুলঝুড়ি ছড়ানো দলীয় নেতাদের প্রশ্রয় না দিয়ে মূখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের এক বড় অংশের কাছে অপ্রিয় হলেন। তাছাড়া, তুচ্ছ কারনে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারনে কংগ্রেস তার নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতার এমন মিশেল ঘটালো যে তারা রাজ‍্যে সহযোগী দল তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় নিয়ে এলো! তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব‍্যানার্জী ২০১১ সালে রাজ‍্যের নতুন মূখ‍্যমন্ত্রী হলেন। এই মমতা ব‍্যানার্জী তাঁর দল তৈরী করেন কংগ্রেস ভেঙ্গে। তিনি সর্বসমক্ষে একাধিকবার সিদ্ধার্থ শঙ্গর রায়কে তাঁর গুরু মেনেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়নের জনক জ‍্যোতি বসুর পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ নিয়েছেন। সিপিএমের এই মেধাবী ছাত্রীর দলে তিনিই প্রথম ও শেষ কথা! দলে একটাই পোষ্ট, বাদবাকী সব ল‍্যাম্পপোষ্ট! প্রশাসন চলে তাঁর অনুপ্রেরনায়!
গত এগারো বছরে মমতা ব‍্যানার্জীর শাসনকালে এই গুন্ডাগর্দী ও তোলাবাজীর রাজনীতিকরন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমোকে বারবার তাঁর দলের নেতাদের তোলাবাজি ও গুন্ডামীর জন‍্য সতর্ক করতে হয়েছে! এভাবে এখন পশ্চিমবঙ্গে দলীয় রাজনীতিতে হিংসা ও তোলাবাজির গণতন্ত্রীকরন সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। রাজনীতি যেহেতু আর সমাজসেবা নয় – শুধুই ক্ষমতা ভোগ ও টাকা কামানোর জায়গা – সেহেতু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার স্বার্থজনিত কারনে এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির অভাবে নেতা-নেত্রীরা কুকথার ফুলঝুড়ি ছোটান – তাঁরা মনে করেন, এভাবেই তাঁরা দলীয় নেতৃত্বের কাছে অধিক গুরুত্ব পাবেন! আসলে এইসব নেতা-নেত্রীদের সভ‍্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই ব‍্যবহার তাদের কটুক্তির মাধ‍্যমে বেরিয়ে আসছে। এই রাজ‍্যের নেতা-নেত্রীরা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ধরে আনবেন!তারা অসম্মান করে কটু কথা বলতে পারেন রাজ‍্যপাল ও দেশের প্রেসিডেন্টকে! আবার বিরোধী দলের দায়িত্বশীল নেতা রাজ‍্যের মহিলা মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব‍্য করতে পিছপা হন না! তাদের রাজনীতি ব‍্যবসার স্বার্থে ঘা লাগায় তারা এসব কটুক্তি করেন। এর সবচেয়ে বড় কারন, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার জন‍্য কোন শিক্ষা,দীক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতির দরকার হয় না!
এ বিষয়ে রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যমের দায়িত্ব অপরিসীম।তারা এইসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নেতা-নেত্রীর বক্তব‍্য গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করে। ফলে, নিম্ন-সংস্কৃতির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আরো বেশী করে প্রতিপক্ষকে কটুক্তি করার জন‍্য প্ররোচিত হন! সেজন‍্য এখন রাজ‍্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন রাজনীতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছেন! এটি রাজ‍্যের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় অশনি সংকেত। এখন রাজনীতিক এমনকি পায়াভারি মন্ত্রীরাও দুর্ণীতির দায়ে জেল খাটছেন। এমনকি, ব‍্যভিচারের মত কাজ পর্যন্ত রাজনীতিকদের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না! এর ফলে, অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের মানুষের কাছে ত বটেই, অন‍্যান‍্য দেশের মানুষের কাছেও রাজ‍্যের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতির প‍্যাটার্ন আমুল পরিবর্তন না করলে এই অবক্ষয় আটকানো দুরের কথা, ক্রমশঃ তা বেড়ে যাবে। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের আমূল পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন রাজ‍্যের অধিকাংশ সাধারন মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসবে। এই অশুভ রাজনীতির ধারক-বাহকরাও সেটা জানে আর সেকারনেই তারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ও লড়াই লাগিয়ে রাখে! গুন্ডাবাহিনী ও শাসকের অপকর্মের দোসর পুলিশ বাহিনী সদা তৎপর আছে – যে কোন প্রতিবাদের সুর স্তব্ধ করে দেওয়ার জন‍্য। এমন কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল পর্যন্ত নেই যারা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক‍্যবদ্ধ করবে। রাজ‍্যের সংবাদ-মাধ‍্যম পর্যন্ত এই অসৎ রাজনীতির থেকে ফয়দা তুলছে। সুতরাং, কণ‍্যাশ্রী, যুবশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের ভিক্ষে পাওয়া জনগণকে রাজ‍্যের নেতারা কুত্তা (Kutta) পদবী দিলেও কারোর কোন হেলদোল নেই।
এই অনাচারের থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা অত‍্যাচারের এই রাজনীতির আড়ালে মুখঢাকা সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলা। জাতীয়স্তরের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ‍্যপাল প্রসঙ্গে

রাজ‍্যের নতুন রাজ‍্যপাল হয়ে এসেছেন ৭১ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত আমলা ডঃ সি ভি আনন্দ বোস। শুধু এটুকু বললে পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। সুলেখক, পন্ডিত আনন্দ বোসের ইংরেজী, মালয়ালী ও হিন্দি ভাষায় প্রায় চল্লিশটি বই আছে। তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রসংঘের একটি পরামর্শদাতা কমিটির প্রধান।
কেরলের কোট্টায়াম জেলায় জন্ম এই প্রাক্তণ আইএএস BITS পিলানি থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে মুসৌরীর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একাডেমির ফেলো হন। আনন্দ বোসজী জওহরলাল নেহরু স্কলারশিপ প্রাপকও বটে। চাকরী জীবনের বিভিন্ন অধ‍্যায় পর্যালোচনা করলে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। প্রাকৃতিক ভারসাম‍্য রক্ষা থেকে সকলের জন‍্য বাসস্থান – বহু প্রকল্পে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। এই শেষোক্ত কারনে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আসেন। তাঁর শিক্ষা জগতে অবাধ বিচরণ মাণ‍্যতা পায় উপাচার্য পদে নিযুক্তির মাধ‍্যমে।
ডঃ আনন্দ বোসের সম্বন্ধে এ কথাগুলি বলার উদ্দেশ‍্য হল, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া। ফলে, ব‍্যক্তি রাজ‍্যপাল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনার সুযোগ পাওয়া যাবে। এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়নি। যদিও তিনি কেরলের এক মালয়ালী পরিবারের সন্তান, তাঁর পদবী কিভাবে “বোস” হল! ডঃ সি ভি আনন্দ বোসের বাবা বাসুদেব পিল্লাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের অত‍্যন্ত অনুরাগী এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের সাত সন্তানের সকলের নামের শেষে “বোস” যুক্ত করেন! ডঃ আনন্দ বোসের কাজের প্রশংসা করেছেন কেরলের মূখ‍্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তিনি অত‍্যন্ত পছন্দের আমলা। এরা সকলেই তাঁর সম্পর্কে একটি কথা বলেন – man of ideas।
এমন একজন রাজ‍্যপাল হয়ত পশ্চিমবঙ্গের সময়ের দাবী ছিল। লা গণেশন যেভাবে তাঁর স্বল্প দিনের দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর পরিবারের একজনের জন্মদিনে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেন এবং মূখ‍্যমন্ত্রী সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে অনুষ্ঠানের একদিন আগে চেন্নাই পৌঁছে যান, তাতে যেমন রাজ‍্যপালের পদের গৌরবের প্রশ্নে প্রশ্নচিহ্ন পড়েছে, তেমনি আগের রাজ‍্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সময় সর্বদা মূখ‍্যমন্ত্রী তথা রাজ‍্যের প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে রাজ‍্যপালের রণংদেহী সম্পর্ক তৈরী হয় – তা রাজ‍্যবাসীর কোন মঙ্গল করেনি।
প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সম্বৃদ্ধ এই বিদ্বান রাজ‍্যপাল দায়িত্ব নেওয়ার সময় একটি কথা বলেছেন, যা অত‍্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাজ‍্যপালের পদকে তিনি কোন বিরাট সন্মানের আলঙ্কারিক পদ হিসেবে দেখেন না। তিনি রাজ‍্যের জনসাধারনের মঙ্গলের জন‍্য সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতার মধ‍্যে থেকে কাজ করবেন এবং রাজ‍্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ‍্যে সমন্বয় (bridge) সাধনের কাজ করবেন। এই উক্তিতেই পরিষ্কার যে তিনি তাঁর সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালন করবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ‘রাবার স্ট‍্যাম্প’ রাজ‍্যপাল না হলে রাজ‍্য সরকারের সমূহ বিপদ। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ‍্যের শাসকদল যেমন তার সুপ্রিমোর অঙ্গুলীহেলনে চলে, তেমনি রাজ‍্যের প্রশাসনও তাঁরই অঙ্গুলীহেলনে চলছে! এখানে প্রশাসন চলে ব‍্যক্তিবিশেষের “অনুপ্রেরনা”য়! সেখানে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কোন জায়গা নেই। প্রাক্তণ রাজ‍্যপাল ধনখড়জীর সঙ্গে মমতাদেবী তথা রাজ‍্য সরকারের গন্ডগোল শুরুর কারনও তাই। রাজ‍্যবাসীর দুর্ভাগ্য যে তারা একজন megalomaniac নেত্রীকে দায়ীত্ব দিয়েছেন আর তিনি সর্বদা পরামর্শ নেওয়াকে ঘৃণা করেন (contemptuous to advice)। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা রাজ‍্যের নির্বাচিত সরকারের কাজকর্মের উপর নজর রাখার জন‍্য এবং পরামর্শ দেওয়া, প্রয়োজনে পদক্ষেপ করার জন‍্য রাজ‍্যপালের পদকে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। রাজ‍্যপাল তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন বলেই ধরা হয়। রাজ‍্যপাল কখনোই “রাবার স্ট‍্যাম্প” নন। কোন রাজ‍্যপাল “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপালের মত আচরণ করলে তিনি জনসাধারণের কাছে তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করবেন।
ধনখড়জী তাঁর পদাধিকারবলে সরকারের যে কোন আধিকারিক বা মন্ত্রী – এমনকি মূখ‍্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত তাঁর কাছে ডাকতে পারেন। পর্যায়ে রাজ‍্যপাল রাজ‍্যের প্রথম নাগরিক, মূখ‍্যমন্ত্রী নন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে ধনখড়জী রাজ‍্য প্রশাসনের কাছে যার-পর-নাই অপদস্ত হন। এমনকি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে উপাচার্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা না করার ঔদ্ধত্ব দেখান! এ ধরনের নোংরামো করতে গিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছেন – রাজ‍্যপালের নয়। উপাচার্যদের এখন রাজ‍্যের মানুষ অল্পশিক্ষিত, ডিগ্রিধারী শাসকদলের কর্মী ছাড়া অন‍্য কিছু মনে করে না। রাজ‍্যের এক ঐতিহ‍্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়! আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যপদে রাজ‍্যপালের নিযুক্ত প্রার্থীকে তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (যিনি বর্তমানে চৌর্যবৃত্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দী) কটুকথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাতিল করেন!
রাজ‍্যপাল ডাকলে বিভিন্ন অযৌক্তিক অজুহাতে রাজ‍্য সরকারের আধিকারিকরা হাজির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখাতেন না! বিভিন্ন সংবাদ-মাধ‍্যমে রাজ‍্যের মন্ত্রীসহ তৃণমূল দলের নেতারা রাজ‍্যপালের বিরুদ্ধে কুকথার বন‍্যা বইয়ে দিতেন। এভাবে শুধু যে প্রশাসনিক দক্ষতাকে পঙ্গু করে প্রশাসনে দলীয় শাসন কায়েম করা হল তাই নয়, সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতায় রাজ‍্য সরকারের প্রশাসনিক ব‍্যর্থতার পরিচয় পাওয়া যায়।
আসলে নেহরু-গান্ধী জমানায় যেভাবে “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল থাকতেন, যারা কেন্দ্রের অঙ্গুলীহেলনে ‘কাজ’ করতেন, সেই যুগ আর নেই। এদিকে মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার চায় এমন রাজ‍্যপাল যিনি বাপুরাম সাপুড়ের কাছে বায়না করা সাপের মত – যিনি একমাত্র megalomaniac নেত্রীর কথা মত “পুতুল নাচের ইতিকথা”র চরিত্র হবেন! সময়ের নিয়মে সেটিও সম্ভব নয়। সংবিধান মোতাবেক রাজ‍্যপালের ভূমিকা রাজ‍্য-প্রশাসনের অভিভাবকের মত। তাঁর নামে প্রশাসন চলে। তাঁর নামে নিয়োগ থেকে কর্মচ‍্যুতি – সব সরকারী কাজ হয় – প্রশাসনিক বদলীও তাঁর নামেই হয়। রাজ‍্যের প্রশাসনের মাথা রাজ‍্যপাল – এই স্বাভাবিক সত‍্য কথাটা মেনে নিতে নির্বাচনে জেতা নেত্রী, যাঁর অনুপ্রেরনায় প্রশাসন চলে – তাঁর মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়! আসলে এই নেত্রী সর্বদা সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা ভোগ করতে আগ্রহী। তা’ছাড়া তিনি ইগো সমস‍্যায় ভোগেন।তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি সর্বদা ‘সংগ্রাম’ করতে আগ্রহী! অথচ, প্রশাসনের কাজে স্বচ্ছতা আনতে এবং প্রশাসনিক ব‍্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন‍্য রাজ‍্যপাল তাঁর রাজ‍্যের মূখ‍্যসচিবসহ যে কোন আধিকারিককে ডাকলে তাদের হাজির হওয়া বাধ‍্যতামূলক। অথচ, নেত্রীর ভয়ে এবং রোষের মুখে পড়ার ভয়ে রাজ‍্যপালকে বারবার অবজ্ঞা করার স্পর্ধা দেখানো হয়েছে। মনে হয়, এসবের পিছনে অন‍্য কোন কারন আছে। রাজ‍্যপাল ধনখড়জী যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব‍্যাপারে উৎসাহ দেখাতে শুরু করলেন, তখন প্রশাসন প্রমাদ গুনলো। তারা ভয় পেল, এবার থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে! নেত্রীর “অনুপ্রেরনায়” তারা রাজ‍্যের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ থেকে রাজ‍্যপালকে অপসারিত করল! নেত্রীর অনুপ্রেরনায় মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ শুরু হল। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলির স্ট‍্যাচুট চুলোয় গেল। তারপর দেখা গেল, উচ্চ আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয়ের অনুসন্ধানের পর বিভাগীয় মন্ত্রী তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। তাঁরা এখন জেল হাজতে আছেন। সুতরাং, প্রশাসনের কাজের ধারা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে রাজ‍্যপালের আইনসম্মত জিজ্ঞাস‍্য থাকলে এই প্রশাসন বিপদের গন্ধ পায়! তখনই তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে “রাজ‍্যপাল হটাও” অভিযান শুরু হয়।
এর প্রেক্ষিতেই মনে হয়, নয়া রাজ‍্যপাল আনন্দ বোসজী তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে অনমনীয় থাকার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। তবে, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই “এলোমেলো করে দে মা, লুঠেপুটে খাই” ধরনের attitude কে কতটা বাগে আনতে পারবেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
মমতাদেবীর রাজনীতির ধরনে এটা মনে করার কারন নেই যে, তিনি রাজ‍্যপালের সাংবিধানিক পদ্ধতি পালনের এবং রাজ‍্য-কেন্দ্র সম্পর্কে সেতু রক্ষার কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁর সঙ্গে সহযোগীতা করবেন। যতক্ষণ মমতাদেবীর প্রশাসনের কাজে রাজ‍্যপাল ‘পরামর্শ’ ও ‘উপদেশ’ না দিচ্ছেন, ততক্ষণ সব ঠিক থাকবে। কিন্তু রাজ‍্যপাল তাঁর কথা অনুযায়ী কাজ শুরু করলেই ঝামেলা বাঁধবে। মমতাদেবী চান “রাবার স্ট‍্যাম্প” রাজ‍্যপাল – যিনি তাঁর সব কাজে বিনা জিজ্ঞাসায় সায় দেবেন! আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। সংবিধানও এই রাবার স্ট‍্যাম্পকে মাণ‍্যতা দেয় না। আর, মমতাদেবীর রাজনীতিতে তাঁর অনমনীয় মনোভাবের ফলে, জোট রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট সাড়া জাগিয়ে শুরু করলেও আজ তিনি ও তাঁর দল রাজ‍্য তথা দেশের রাজনীতিতে একা। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি দুটি সর্বভারতীয় দল – বিজেপি ও কংগ্রেস – উভয়ের সঙ্গেই কখনো না কখনো জোট করে সুবিধা নিয়েছেন। আবার একসময় জোটসঙ্গীকে ত‍্যাগ করে বিরোধীতাও করেছেন। সেজন‍্য জোট রাজনীতিতে মমতাদেবী এবং তাঁর দলের কোন বিশ্বাসযোগ‍্যতা নেই। তবে তিনি চিরকাল kitchen politics বা পিছনের দরজা দিয়ে গোপন রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় পারদর্শী। এধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ‍্যতা প্রয়োজন – সেটা তিনি কতটা দেখাতে পারেন তা ভবিষ‍্যৎ বলবে। মমতাদেবীর বড় সমস‍্যা হল, তিনি দল ও প্রশাসনকে মিশিয়ে দিয়েছেন। দলীয় নেতৃত্ব থেকে প্রশাসনকে আদেশ করা এবং প্রশাসনের সেই আদেশ পালন করার মধ‍্যেই তা পরিষ্কার। ফলে, দলীয় অসততার আঁচ অবধারিতভাবে সরকারী প্রশাসনে পড়েছে। প্রশাসনিক কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে তাঁর অঘোষিত উত্তরাধিকারীর বিভিন্ন অতিরিক্ত-সাংবিধানিক (extra-constitutional) ক্ষমতা ও কাজকর্ম নিয়েও মানুষের মনে বিস্তর প্রশ্ন।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপাল মহোদয় যদি এইসব অসাংবিধানিক কাজকর্মের ব‍্যাপারে চোখ বুজে থাকেন তবে রাজ‍্য সরকার ও মমতাদেবীর কাছে তিনি খুব ভালো রাজ‍্যপাল! কিন্তু যদি রাজ‍্যের কাজকর্মের ব‍্যাপারে তিনি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, তা’হলে গোলমাল শুরু হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দলের shouting brigadeকে ময়দানে নামিয়ে অসংসদীয় ভাষায় কুকথার প্লাবন বইয়ে রাজ‍্যপালের চেয়ারকে আক্রমণ করার পন্থা নেওয়া হবে। এই দলের নেতৃত্বের মনে রাখা উচিৎ যে তাদের দলের নেতৃত্বের সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ‍্যেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে – ভোটে জিতলেই যা খুশী তাই বলা বা করার অধিকার জন্মায় না! এই দল ও তার নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি কথাটা বুঝবে তত রাজ‍্যবাসীর মঙ্গল।
নবনিযুক্ত রাজ‍্যপালের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও তাঁর শিক্ষা-সংস্কৃতির পটভূমি বিচার করে মনে হয়, তিনি যা বলেছেন, তাতে রাজ‍্যের সাধারন মানুষের পক্ষে তিনি দাঁড়াবেন এবং সংবিধান সম্মত পদ্ধতিতে রাজ‍্য প্রশাসনকে চালানোর মত অবশ‍্য পালনীয় পরামর্শ দেবেন বলেই মনে হয়। তখন রাজ‍্য প্রশাসন ও মমতাদেবীর দল কি প্রতিক্রিয়া দেয় তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।