কোভিড ১৯ এর দাপট এখনো পুরোদমে সারা দেশ জুড়ে চলছে। একের পর এক ‘ভ্যারিয়েন্ট’ আর ‘স্ট্রেইন’ আবিষ্কার হচ্ছে। ল্যাটিন অক্ষরের নামে পরপর ভ্যারিয়েন্ট বেরিয়েছে। আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা (আবার ডেল্টা+ ও চলছে)। এখন শুনছি ল্যমডা আর এফসাইলনও বেরিয়েছে! মনে হয়, হমস্ত ল্যাটিন অক্ষরই একের পর এক আসবে। অর্থাৎ জিটা অব্দি আমাদের এই ভোগান্তি চলবে! মানুষের ভোগান্তি ত শুধু অতিমারী নয়, এই অতিমারীতে কারুর সর্বনাশ ত কারুর পৌষমাস। যেদিন থেকে দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে যত না মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে; রাজনীতি হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশী। কোথাও বলা হচ্ছে, দেশের সব মানুষকে বিনাপয়সায় ভ্যাকসিন দিচ্ছেন প্রধাণমন্ত্রী! অর্থাৎ ১৪০×২ = ২৮০ কোটি ভ্যাকসিন ‘বিনাপয়সা’য় দেওয়ার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর! অথচ এমন কোন ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা অন্য সরকারী ঘোষণায় নেই। এটি চাটুকারীতার নিম্নরুচির রূপ মাত্র। এদিকে রাজ্যে বলা হচ্ছে, মূখ্যমন্ত্রী নিজে রাজ্যের সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেবার দায় নিয়েছেন! এমন কথা রাজের কোন সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে নেই। আর এটা কোন রাজ্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেও চাটুকারীতা ‘গল্পের গরু গাছে’ তুলেছে। কিছু স্বঘোষিত ‘প্রথম শ্রেণী’র সংবাদ মাধ্যমও একাজে নেমে নিজেদের খেলো করছে। কেন্দ্রীয় সরকার অগ্রাধিকার মূল্যে (preferencial price) কিনে তারপর বিভিন্ন রাজ্যে চাহিদা অনুযায়ী পাঠাচ্ছে। আর রাজ্য সরকারের উপর দায়িত্ব বর্তায় সঠিক ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে এর প্রয়োগ করা। আবার দেশের ও রাজ্যের বড় সংখ্যক মানুষ বাজারের বেসরকারী টিকাকরণ কেন্দ্র থেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে টীকা নিচ্ছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার, টীকার যোগান বিভিন্ন রাজ্যে যে সর্বদা জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে তা নয়। কিসের ভিত্তিতে রাজ্যে রাজ্যে কত সংখ্যক টীকা পাঠানো হচ্ছে তার কোন স্বচ্ছ নিয়ম জানানো হচ্ছেনা। আবার রাজ্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গাফিলতিতে যে টীকাকরণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তারও যথেষ্ট উদাহরণ আছে। যেমন বেশ কিছুদিন কোভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও কোভ্যাকসিন টীকা দেওয়া যায়নি টীকা না থাকার দরুন। ‘বাজারী’ মাধ্যম যথারীতি কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘গালাগাল’ শুরু করার পর জানা গেল, পৌরসভা দ্বিতীয় ভ্যাকসিন প্রাপকদের কোটা সরিয়ে রেখে প্রথম ডোজের কোভ্যাকসিন দেওয়ার সরকারী নির্দেশ না মেনে প্রথম ডোজেই টীকা খরচ করে ফেলেছে! এটা পৌরসভার গাফিলতি। আশ্চর্য লাগে, বিষয়টা জানাজানি হবার পরে ‘বাজারী’ সংবাদ মাধ্যম একদম চুপ করে গেল! অদ্ভুত প্রবৃত্তি। বোঝাই যাচ্ছে, কোভিড১৯ এর ব
ইরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের মত করে লড়াই করছে – আর সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি চাটুকারদের সহযোগীতায় এর থেকে রাজনৈতিক ফয়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এবার আসি অন্যান্য ক্ষেত্রে কোভিড১৯ এর প্রভাবে। বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্য সরকারগুলির উপর কোভিড১৯ এর আচরনবিধি তৈরী ও তা পালনের দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। শুধু বিদেশে উড়ান সংক্রান্ত এবং আন্তররাজ্য রেল চলাচলের ব্যপারটা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করছে। ফলে, আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনের ব্যপারগুলি রাজ্য সরকার নিজের মত করে নিয়ম ও তা পালন করার নির্দেশ দিচ্ছে। যেমন উত্তরপ্রদেশে গাড়ী চলাচলে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন ইটারী হাউসের মধ্যে বসে খাওয়া নিষেধ। তবে, খাবার প্যাক করে নিয়ে যাঔয়া ও হোম ডেলিভারী চালু আছে। এদিকে দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ। কাঁচা বাজার খোলা। সেখানে কোন বাধানিষেধ নেই। আবার আমাদের রাজ্যে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট সব খোলা। যানবাহন চলছে। শুধু লোকাল ট্রেণ বন্ধ! এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি? যেসব খোলা আছে তাতে সংক্রমণ হচ্ছেনা, এমনকি ভিড় বাসেও সংক্রমণ বাড়বে না – শুধু লোকাল ট্রেণ (দুরপাল্লার ট্রেণ চলছে) চললেই তাতে সংক্রমণ বাড়বে! এমন অবাস্তব যুক্তির কারন কি? এখানে উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র, যেখানে সংক্রমণ সর্বাধিক, তারাও লোকাল ট্রেণ চালু করেছে।
এই অদ্ভুত খেয়ালী সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের পেটে শুধু যে টান পরেছে তাই নয়, আপামর রাজ্যবাসীই ভুগছে। প্রথমতঃ, এইসব মানুষের রুজি রোজগারের জন্য যাতায়াতের সবচেয়ে শস্তা মাধ্যম লোকাল ট্রেণ। ফলে তারা অনেক বেশী টাকা খরচ করে সড়কপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে অথবা রুজি রোজগার হারাচ্ছে। আবার দুধ, কাঁচা তরকারী ও লোকাল মাছের যোগানের প্রধান মাধ্যম ছিল লোকাল ট্রেণ। সেজন্য শহরে এইসব জিনিষের যোগানে ঘাটতি হচ্ছে। এর ফলে এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। তেমনি উৎপাদনের জায়গায় পরিবহনের অভাবে চাষীরা ফসলের সঠিক মূল্য পাচ্ছেনা। এদিকে আবার পরিবহন-জ্বালানীর সরকারী শুল্কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির শিকার দেশের আমজনতা। আর ‘অতিরিক্ত লাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’ যা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান ধর্ম, তা এখন নির্বাচিত সরকারের কাজ হয়েছে। ফলে, সরকার যদি শতকরা পাঁচভাগ শুল্ক বাড়ায়, ব্যবসায়ীরা কুড়িভাগ মূল্যবৃদ্ধি করে! ফলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া আর সব পণ্যের বিক্রিতে চরম মন্দা।
আমাদের দেশের বরিষ্ট নাগরিকদের শতকরা একভাগ মাত্র পেনশন পান। এখানে আমেরিকার মত সোশ্যাল সিকিউরিটির কোন সংস্থান নেই। এই নাগরিকদের জীবনধারনের জন্য ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সুদের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই সুদ সরকার ক্রমশঃ কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারের বক্তব্য, তাহলে ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা কম সুদে ব্যাঙ্গের থেকে টাকা ধার নেবে! এইসব অর্থনীতিবিদরা কোথায় জন্মায় কে জানে! সুদ কমিয়ে মানুষের হাতের নগদের যোগান হ্রাস করলে বাজারের দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস পাবে। তার ফলে কোন লগ্নিকারী দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস পেলে তা উৎপাদনের জন্য ব্যাঙ্কঋণ নেবেনা। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে। আবার আমাদের সরকার (কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ই ) অনুৎপাদক অনুদানে দেদার টাকা খরচ করছে। তাতে সরকারী কোষাগারে যে টান পড়ছে তা মেটানোর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় করই বৃদ্ধি করছে। এভাবেই কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারের ভুল নীতির ফলে আমজনতা – বিশেষতঃ, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলশ্রেণীর মানুষের উপর অত্যধিক চাপ বেড়েছে।
এরপর আসি ভবিষ্যত প্রজন্মের পড়াশোনার প্রশ্নে। সেই ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় – সব স্তরের ক্লাসরুম লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল; তারপর এখন অব্দি এসব খোলার নামগন্ধ নেই! উঁচু ক্লাসের কিছু কিছু মাঝখানে খুললেও কয়েকদিনের মধ্যে সেসব বন্ধ করে দেওয়া হল। সিনেমা হল, খেলার মাঠ, পার্ক, বাস, অটো, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল – সব খোলা। এই অদ্ভুত মানসিকতার কোন ব্যখ্যা দেওয়া যায়না। এমনকি দুরপাল্লার ট্রেণ, বিমান সব চলছে। মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে! শুধু ক্লাশরুমে পড়াশোনা বন্ধ। শিক্ষকরাও এখন “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করছেন। চল্লিশ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জরিত থাকার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যে, আমাদের দেশে যা পরিকাঠামো, তাতে অনলাইনে প্র্যাকটিক্যালসহ সবরকম শিক্ষা দেওয়া ও নেওয়া একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা মাত্র।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমেরিকায় শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও নীতির বাস্তবায়ন সর্বদা অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের হাতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এর দায়িত্ব কোন আই এ এস অফিসারের হাতে! এদের না আছে অভিজ্ঞতা, না আছে জ্ঞান। ফলে এরা কর্তাভজা নীতি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভুরা যা চান তাতেই সায় দেন! এরা সর্বদা হীনমণ্যতায় ভোগায় নিজেদের জাহির করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ‘গবুচন্দ্র’ মন্ত্রীর মত নিদান দেন। আর অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ‘হবুচন্দ্র’ রাজা রাজনীতিক তা অনুমোদন করেন। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ত বটেই, আমেরিকাও তাদের সমস্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি নার্শারী ক্লাশও খুলে দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশে “খেলা”, “মস্তি” সব হবে – শুধু পড়াশোনা বন্ধ!
এরপর আসি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে সেরা রসিকতায়। দশ ক্লাস ও বারো ক্লাসের বিনা পরীক্ষায় ‘পাশ’ ও ‘নম্বর’ পাওয়ার কথায়! শিক্ষার হর্তা-কর্তা-বিধাতারা ভুলে গেছেন যে, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং মূল্যায়ণ একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পদ্ধতি এবং পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ আবশ্যিক। আর তা নাহলে পরীক্ষা এবং পুরো শিক্ষা পদ্ধতিটিই তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। এক্ষেত্রে অতিমারীর দোহাই দিয়ে পুরো শিক্ষাপদ্ধতি ও তার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করে দেওয়া হল। প্রথমতঃ, যদি স্কুলের পরীক্ষার ভিত্তিতে নম্বর দিতে হয় তবে স্কুল থেকে sent up করা সমস্ত ছাত্রছাত্রীই স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করেছে ধরে নিতে হবে। তা নাহলে তাদের sent up হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন স্কুলের মান ও পরীক্ষার নম্বরের মানের মধ্যেও কোন সাম্যতা নেই। তারপর পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল CBSEতে ০.৬৩% ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে! কিভাবে হল? মূল্যায়নের পদ্ধতিতে কোন স্বচ্ছতা নেই। আবার আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে ফেলের সংখ্যার শতকরা হার আরো বেশী। নম্বর পাওয়া – পাশ-ফেল পুরো পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। সবচেয়ে বড় কথা, এইসব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষায় গিয়ে কি করবে? অতিমারীর দোহাই দিয়ে অযোগ্য প্রশাসকদের গাফিলতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার বীজ রোপন করা হল। উচ্চপদস্থ মানুষজন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের সন্তান সন্ততিদের ইউরোপ, আমেরিকায় পড়তে পাঠাবে। তাদের ব্যক্তিগত কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু সাধারন ঘরের ছাত্রছাত্রীরা তাদের ভবিষ্যত ধ্বংসের চিত্রনাট্যের কুশীলব হয়ে রইল – এটাই দুঃখের।
অনেক হয়েছে। WHOর নিদান মেনে এখুনি সমস্ত স্কুল, কলেজ খোলা হোক।যদি সব সতর্কতা মেনে সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্লাসরুম পঠন-পাঠন শুরু করা যায়, তখন আগের অতিমারীর ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় ট্রেণিং দিয়ে দুবছরের মধ্যে তাদের ঘাটতির জায়গাগুলি make-up করা যেতে পারে। অন্যথায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আর ফেরানো যাবেনা।
কোভিড ১৯ এর জেরে মানুষের হয়রানি
