অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরোধীতা কেন

সম্প্রতি ভারত সরকার দেশের যুবশক্তির জন‍্য সামরিক ট্রেণিংয়ের একটি ঐচ্ছিক প্রকল্প ঘোষণা করেছে। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে “অগ্নিপথ প্রকল্প”। এর মাধ‍্যমে নির্বাচিত যুবকরা (১৭ থেকে ২৩ বছর পর্যন্ত) তাদের সামরিক ট্রেণিংসহ চার বছর সামরিক বিভাগের কোন একটি জায়গায়, যেমন, স্থলবাহিনী, বিমান বা নৌবাহিনীতে সার্ভিস দেওয়ার পর তারা আবার সমাজের অসামরিক কাজে ফিরতে পারবে। আবার তারা নির্বাচিত হলে সামরিকবাহিনীতে স্থায়ী কমিশন্ড পদে যোগ দিতে পারবে। যে সকল যুবক-যুবতী এই প্রকল্পে যোগ দেবে তাদের “অগ্নিবীর” বলা হবে। এদের মধ‍্যে থেকে দক্ষতার ভিত্তিতে ২৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে স্থায়ী সামরিক কমিশনে নিয়োগ করা হবে। চার বছর শেষে সব অগ্নিবীরকে একটি শংসাপত্র certificate) দেওয়া হবে। এই শংসাপত্রের জোরে এরা বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার কাজে যোগ দিতে পারবে। তাছাড়া, কিছু সরকারী সংস্থায়, যেমন, সিভিল ডিফেন্সে এদের জন‍্য ১০% চাকরী সংরক্ষণ করা হবে। যদিও এই প্রকল্প ঐচ্ছিক, তবু অধিক সংখ‍্যক আবেদন জমা পড়লে বিভিন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়া (যা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সময় দেখা হয়) সম্পন্ন করার পরই এদের অগ্নিপথ প্রকল্পে যোগ দেওয়ানো হবে। এদের ট্রেণিংয়ের শুরুতে বাৎসরিক ৪.৭৬ লক্ষ টাকা (আনুমানিক) স্টাইপেন্ড দেওয়া হবে ; যা ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চতুর্থ বর্ষে ৬.৯২ লক্ষ টাকায় পৌঁছাবে। এছাড়া সামরিক বাহিনীর থাকা, রেশন ইত‍্যাদির সব সুবিধা মিলবে। এছাড়া, এদের স্টাইপেন্ডের থেকে বাধ‍্যতামূলক কেটে রাখা সুদসহ করমুক্ত ১১.৭১ লক্ষ টাকা চার বছরের শেষে ফেরত দেওয়া হবে। এই সময়ে প্রত‍্যেক অগ্নিবীরের জন‍্য সরকারের তরফে ৪৮ লক্ষ টাকার বীমা করানো থাকবে।
অগ্নিপথ একটি সুচিন্তিত প্রকল্প। এটি বিভিন্ন দেশে চালু এধরনের প্রকল্পের মধ‍্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সত্যি বলতে কি, আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের জন‍্য দেশের তথাকথিত নেতা ও রাজনৈতিক দলগুলির যতটা প্রভাব, তার থেকে অনেক বেশী প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ ঠেকাতে বৃটিশ রাজশক্তির ভারত ছাড়ার তাগিধের। মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭ সালে দেশ কিন্তু বৃটিশ রাজশক্তির ছাতার তলায় ভারতীয় নেটিভদ্বারা ভারতীয়দের শাসন করার স্বাধীনতা (dominion status) পেয়েছিল। তখনকার সময় নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের বিনা কারনে ইসলামী-তোষণ ও দেশবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী কম‍্যুনিস্টদের তোল্লা দেওয়া (নেহরু নিজেকে সোশ‍্যালিস্ট বলতে পছন্দ করতেন), কালে কালে দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালো। এদের সম্মিলিত বাধাদানে শুধু যে জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয়ত্বের সার্থক স্ফুরণ হল না তাই নয়, তারা কম‍্যুনিস্ট পার্টির ভারতীয়ত্ব বিরোধী প্রাক্তণ জেনারেল সেক্রেটারী গঙ্গাধর অধিকারীর উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিত থিসিস – যা আমাদের ভারতীয়ত্বের অ‍্যান্টিথিসিস – এখনো আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে! গঙ্গাধর অধিকারীর মূল বক্তব‍্যগুলি হল – (১) ভারত কখনো একটি রাষ্ট্র নয়, কিছু সার্বভৌম রাজ‍্য/ প্রদেশের সমষ্টি; (২) ভারত শাসনের অধিকার শুধু ইসলামীদের আছে কারন তারা বৃটিশ পূর্ববর্তী শাসক; (৩) শুধু পাকিস্তান গঠনকে সমর্থন করা নয়, আসামসহ সম্পূর্ণ বাংলা ও বিহারের একাংশ পাকিস্তানের প্রাপ‍্য। এমন জেহাদী ইসলামী এবং ভারত বিরোধী মানুষের আজগুবী তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে যারা ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত করে ভারত ভাঙ্গার চেষ্টা করছে সেই রাজনীতিবিদরা কতটা ভারতীয় ও কতটা গণতান্ত্রিক তা বোঝা দুষ্কর। পৃথিবীর সমস্ত দেশ তাদের জাতীয়তাবাদকে সবচেয়ে উঁচুতে রেখে তারপর গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার কথা বলে। আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের দেশের তথাকথিত বিরোধী নামধারী রাজনীতিবিদ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের নামে জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করে। এমন এক অস্বস্তিকর পরিবেশে এই “অগ্নিপথ প্রকল্প” শুরু হতে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের যুবক-যুবতীদের মনে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হবে। এখানেই জেহাদী ও ভারতবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ভয়! তারা জানে যে ভারতের যুবশক্তির হৃদয়ে যদি একবার দেশাত্মবোধক জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠে তবে এই রাজনীতিকদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি আর কল্কে পাবে না। সেজন‍্য বিরোধী নেতৃবৃন্দ অগ্নিপথ প্রকল্প আটকাতে দেশের যুবকদের একাংশকে মিথ‍্যাচারের সুচতুর জালে জড়িয়ে নিয়ে এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলন চালাচ্ছে। এভাবে এরা সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা ছেড়ে সরাসরি দেশের বিরোধীতায় নেমে পড়েছে!
এমন কয়েকটি দেশের কথা বলছি যাদের দেশের সেনাদলে বাধ‍্যতামূলক সার্ভিস দিতে হয়। তাদের সকলের প্রকল্পগুলির তুলনায় আমাদের অগ্নিপথ অনেক বেশী নমনীয় ও আর্থিকভাবে লাভজনক। দেশগুলি হল : নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল‍্যান্ড, গ্রীস, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া, ইজরায়েল, সাইপ্রাস, ইরান, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সিঙ্গাপুর, থাইল‍্যান্ড, ব্রাজিল, মেক্সিকো, এরিট্রিয়া এবং বারমুডা। এদের মধ‍্যে শুধু নরওয়ে ও সুইডেনে ছেলে মেয়ে উভয়ই সমানভাবে এবং সম বেতনে একই সময়ের জন‍্য conscripted হয়। অন‍্যদের ক্ষেত্রে বিবিধ পার্থক‍্য আছে। আবার ইরান ও ইজরায়েলের ক্ষেত্রে কিছু ধর্মীয় কারনে এবং উচ্চশিক্ষায় ব‍্যাপৃত থাকার কারনে ছাড় দেওয়া হয়। অন‍্যথায় এগুলো বাধ‍্যতামূলক অর্থাৎ conscription করে এদের নেওয়া হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কিন্তু এই প্রকল্প পুরোটাই ঐচ্ছিক। যার ইচ্ছে নেই সে আবেদন করবে না। যেসব রাজনৈতিক ব‍্যক্তিরা এই প্রকল্পের বিরোধীতা করছেন, তাদের পরিবারের কজন সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশরক্ষার কাজে ব‍্যাপৃত আছেন – জানার অপেক্ষায় রইলাম। আসলে এদের রাজনীতি ফোকটে কিছু পাওয়ার জন‍্য – দেওয়ার জন‍্য নয়। এরা নিজেদের ধান্দায় মানুষকে ক্ষেপায়। এদের আত্মসেবা ও পরিবার পরিসেবার মধ‍্যে দিয়েই এদের সেবাকার্যের পরিসমাপ্তি ঘটে!
অগ্নিপথ প্রকল্পের ফলে দেশের বিপুল যুবশক্তির মধ‍্যে শুধু যে জাতীয়তাবোধ বিকশিত হবে তাই নয়, এর ফলে যেমন দেশের সামরিক বাহিনীতে নতুন রক্তের সঞ্চার হবে, তেমনই দেশের জরুরী প্রয়োজনে ট্রেণিংপ্রাপ্ত দ্বিতীয়সারির সেনাদলের জোগান বাড়বে। এতে একমাত্র দেশবিরোধীশক্তি ছাড়া আর কারোর ত অসুবিধা হওয়ার কারন নেই।
এবার একএক করে এই প্রকল্প সম্পর্কে যে মিথ‍্যাচার করা হচ্ছে তার বিশ্লেষণে আসি। প্রথমে বলি, এটি উপরে উল্লিখিত দেশগুলির মত বাধ‍্যতামূলক নয় – একটি ঐচ্ছিক প্রকল্প – যেখানে আবেদনের পর নির্বাচন পদ্ধতির মধ‍্যে দিয়ে নির্বাচিত হতে হবে। এরপর সাফল‍্যের সঙ্গে চার বছর কাটানোর পর এই অগ্নিবীরদের মধ‍্যে থেকে সেরা ২৫% কে স্থায়ী কমিশন্ড চাকরীতে (যোগ‍্যতা অনুযায়ী) নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ‍্য যে, কম‍্যুনিস্টসহ দেশের যে রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রকল্পের বিরোধীতায় নেমেছেন, তাদের না-পসন্দের একটি বড় কারন, এই প্রকল্পের ফলে যে যুবশক্তি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পাবে তারা আর এই রাজনীতিকদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের জড়াবে না। এছাড়া ট্রেণিংপ্রাপ্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের সেনাদলের প্রয়োজন সব দেশেরই আছে। এরফলে দেশের সুরক্ষা শক্তিশালী হবে। যারা তা চান না, তারাই এই প্রকল্পের বিরোধীতায় নেমেছেন। এদের মনের সুপ্ত বাসনা হল, ভারতের সামরিক শক্তি দূর্বল করতে না পারলেও, কোনভাবেই তাকে আরো শক্তিশালী করা যাবে না। কিন্তু ভারতে রাজনীতি করে সেকথা সরাসরি বলা সম্ভব নয়। তাই ঘুরিয়ে অবাস্তব যুক্তি তুলে এই বিরোধীতা।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষকরা ভাতার বিনিময়ে গবেষণা করেন। গবেষণা অন্তে তাদের ডিগ্রি অর্থাৎ সার্টিফিকেট মিললেও স্থায়ী চাকরীর নিশ্চয়তা কেউ দেয় না। তাহলে, এই রাজনীতিকরা সেসব ক্ষেত্রে আন্দোলন করেন না কেন! এইসব গবেষকদের গবেষণা করিয়ে অধ‍্যাপকরা নিজেদের প্রমোশন নিশ্চিত করেন – আর এই অধ‍্যাপকদের বড় অংশই ভারতীয় কম‍্যুনিস্টদের অনুগামী। গবেষকদের ভাতাও অগ্নিবীরদের ভএভাতার চেয়ে কম। গবেষকদের নূন‍্যতম যোগ‍্যতা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হলেও অগ্নিবীরদের নূন‍্যতম যোগ‍্যতা বারো ক্লাশ উত্তীর্ণ হওয়ার সার্টিফিকেট। অবশ‍্যই শারীরিক দিক থেকে সক্ষম অগ্নিবীরদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরী পাওয়া সহজ হবে।
আবার, কম‍্যুনিস্ট শাসিত কেরল রাজ‍্যসরকার শিক্ষকদের একাংশকে ঝাড়ুদার বানিয়ে দিয়েছে! সেসময় এই রাজনীতিকরা নিদ্রামগ্ন থাকেন! এরা পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ‍্যে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগের সময়ও “শীতঘুম”এ আচ্ছন্ন থাকেন! শুধু “অগ্নিপথ প্রকল্প”এর সময় রিপ-ভ‍্যান-উইঙ্কলের মত জেগে ওঠেন! এইসব রাজনীতিকরা যেখানে ক্ষমতায় আছেন, সেখানে কম বেতনে ‘চুক্তিভিত্তিক’ ও ‘অস্থায়ী’ কর্মী নিয়োগ করলেও তাদের মাথাব‍্যথা শুধু অগ্নিপথ নিয়ে! যদি ভারতের সামরিক শক্তি বেড়ে যায়, যদি যুবশক্তির মধ‍্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়, তবে তাদের বিদেশী “বন্ধু” ও “মনিব”দের অসুবিধা হবে! তাই এমন আন্দোলনের নামে সাধারন মানুষের অসুবিধা করা ও জাতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা।
কম‍্যুনিস্ট ও তাদের জেহাদী বন্ধুদের বলতে চাই যে, তারা কি এধরনের প্রকল্প চালু রাখা দেশগুলির, বিশেষতঃ রাশিয়া, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া, ইরান বা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর নিন্দা করছে? এভাবে “ভাবের ঘরে চুরি” করে ভারতবিরোধী শক্তির হাত শক্ত করা হচ্ছে মাত্র।
পরিশেষে বলতে চাই যে, ইরান, ইজরায়েল এইসব দেশে যেমন ধর্মের ভিত্তিতে conscription থেকে কিছু ছাড় দেওয়া হয়, তেমনই ধর্মের বা ধর্মীয় কারন যেন ভারতীয় বাহিনীতে জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী না হয়, সেদিকে এই প্রকল্প পরিচালকদের নজর রাখা বাঞ্ছনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *