শিক্ষাদানের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে গত দুবছরে একটি মিল আছে। সেটা হল, নার্শারী থেকে প্রাইমারী, সেকেন্ডারী, হায়ার সেকেন্ডারী এবং উচ্চশিক্ষায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় – সবেতেই টোটাল লকডাউন – নাম তার যাই হোক না কেন। এর দায় কার সেটা এখন আর বড় কথা নয়, এর ফল কি দাঁড়ালো সেটাই বড় কথা। আপামর শান্তিপ্রিয়, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাঙ্গালী এর ফল এখনো ভেবে দেখেনি। পরীক্ষা বন্ধ ও পড়াশোনা শিকেয় ওঠায় প্রায় সব ছাত্রছাত্রী খুশী। তাদের অভিভাবকদের উপর অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ কমায় তারাও খুশী। কিন্তু এতে ক্ষতি কার হল, কিভাবে হল? কোন মিডিয়া হাউসের এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। এর সুদুরপ্রসারী ফল জানিয়ে তাদের টিআরপি বাড়বে না – কারন বাঙ্গালী জাতটার মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেলে তাদের লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
প্রত্যেক দেশেই কমবেশী করোনা অতিমারীর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কোন একটি উন্নদেশ দেখানো যাবে না যেখানে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে পরীক্ষা বন্ধ। পড়া না পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার হলে তা অবশ্যই আরো হাস্যকর হত। আমাদের রাজ্যে আবার চমৎকার ব্যবস্থা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেই যে ক্লাস বন্ধ হল, তা আর কার্যকরীভাবে চালু করা গেল না। সরকারীস্তরে শিক্ষকদের বেতন একই রকমভাবে চলতে লাগল। কিন্তু অতিমারী পরিস্থিতিতে তাঁদের যোগ্য কাজে ব্যবহার করার কথা ভাবা পর্যন্ত হল না! আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলিতেই শিক্ষকদের মাইনে কমিয়ে ও ছাঁটাই করে কাজ(!) চলতে লাগল। উচ্চন্যায়ালয়ের রায়ের পরেও এই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনই একটি স্কুলে তার মেয়ে পড়ে, এমন এক আত্মীয়ার কাছ থেকে জানলাম, মেয়ের মাসিক ফি প্রায় তিন হাজার টাকা। কোর্টের রায়কে মাণ্যতা দিয়ে স্কুল ঐ মাইনে থেকে পনেরো টাকা ফি কমিয়েছে! তারা তাদের ‘অনলাইন’ শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এই লেখায় শিক্ষা জগতের এই ধ্যাষ্টামো এবং তার ফলও তুলে ধরছি।
প্রথমত, আমাদের রাজ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরে কজন অভিভাবক স্মার্টফোন ব্যবহার করেন ও সেইসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সংগতি রাখেন তা সরকার বা কোন সংবাদ মাধ্যম সার্ভে করেছে বলে জানা নেই। মূর্খের স্বর্গে বাস করার সুখই আলাদা। আসলে ওয়েবিনারের মাধ্যমে ক্লাস করার সুবিধা স্কুলস্তরে ১ থেকে ১.৫% ছাত্রছাত্রী পেতে পারে। এর কারন বহুবিধ। বেশীরভাগ অভিভাবকদের আর্থিক অসঙ্গতি, সরকারী ও সরকার পোষিত স্কুলগুলির অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই ভার্চুয়াল শিক্ষার কোন কার্যকরী লাভ পায়নি। আবার বহু জায়গায় মোবাইলের টাওয়ার নেই বা থাকলেও সিগন্যাল এত দূর্বল যে ক্লাস করা অসম্ভব। শিক্ষকদের এই সময় অন্যভাবে ব্যবহার করা যেত। এই অনলাইন টিচিং পদ্ধতি ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলি শুরুতে আরম্ভ করলেও তারা কিন্তু দ্রুত সব সতর্কতা নিয়ে স্কুলগুলি খুলে দিয়েছে। ব্রিটেন, জার্মানী, ফ্রান্সের মত কিছু দেশ দ্রুত স্কুল খোলায় প্রায়োরিটি দিয়ে ক্লাসরুম শিক্ষা শুরু করে দিয়েছে। সবচেয়ে পরে হলেও আগামী মাস থেকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সির কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলি পর্যন্ত খুলে দেওয়ার নোটিশ জারী হয়েছে। কারন, তারা জানে, অনলাইন ট্রেণিং পুরো স্কুলশিক্ষার প্রতিস্থাপক হিসেবে অচল। এই শিক্ষাটাই আমাদের সরকার নিতে পারল না। দায় এড়ানোর প্রবণতায়, আমলাতান্ত্রিক কুপরামর্শে বাঙ্গালীকে শিক্ষাহীণ জাতিতে পরিণত করার দায় কিন্তু সরকারের উপরেই বর্তাবে।
আসলে দায়িত্ববোধ ও দায়িত্ব নেওয়ার তাগিধের অভাব, এই দুই কারনেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্কুল চালু করতে গেলে সংক্রমণের আশঙ্কায় স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হল। সেই যুক্তিতে দোকান, বাজার সবই ত বন্ধ রাখার কথা! এখানেই সরকারের ব্যর্থতা। যেগুলি না খুললে সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পরবে সেগুলি খুলে দিয়ে শিক্ষা জগতকে স্তব্ধ রেখে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা।
তারপর অতিমারী যত এগিয়েছে, অবস্থা উত্তরোত্তর আরো ঘোরালো হয়েছে। যখন টীকাকরন শুরু হল, ইংল্যান্ড তাদের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ টীকার বরাত দিল। আমেরিকাও তাদের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ টীকার বরাত দিল। এদিকে, ভারতে যদিও দুটি পৃথক টীকা কোম্পানির টীকা তৈরী হচ্ছে এবং সরকার তাতে একাধিক উপায়ে সাহায্য করছে, জনসংখ্যার এক ক্ষুদ্র অংশের জন্য বরাত দেওয়া হল। পুরো পদ্ধতিটাই গোলমেলে হয়ে গেল বয়েস ভিত্তিক টীকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে এক বয়েসের টীকাকরণ শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই অন্য বয়েসের টীকাকরণ শুরু হওয়ায়। টীকার দামেও বিস্তর ফারাক। কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্য সরকারের, বেসরকারী – ভিন্ন ভিন্ন দাম। পুরো পদ্ধতিই ডিরেল্ড হয়ে গেল। অথচ অন্য দেশগুলি কাজের প্রায়োরিটি অনুযায়ী টীকাকরণ শুরু করল। চিকিৎসা কর্মীদের পরেই প্রায়োরিটিতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের রাখা হল। স্কুলগুলি স্যানেটাইজ করে দ্রুত খোলার ব্যবস্থা করা হল যাতে দ্রুত ক্লাশরুম শিক্ষায় ফেরা যায়। এমন চিন্তাধারা সারা দেশের সঙ্গে আমাদের রাজ্যেও দেখা গেল না। কারন, আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেন শিক্ষা একটি অপ্রয়োজনীয় আলঙ্কারিক জিনিষ – হলে ভালো, নাহলে ক্ষতি নেই। স্বাধীন ভারতে দেশের ভালোর জন্য শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী খরচ সাপেক্ষ উন্নয়ণ প্রায় চোখেই পড়েনা। তার বদলে স্বল্পমেয়াদী আলঙ্কারিক উন্নয়ণেই ঝোঁক দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কেন্দ্র ও রাজ্যের কজন নেতার যথার্থ ধারনা আজে যে একটা জাতিকে নষ্ট করার জন্য তার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা সবচেয়ে জরুরী। সমস্ত দেশ যখন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে মরিয়া তখন কি কেন্দ্র, কি রাজ্য, সবাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অতিমারীর সময়ে বাঁচানোর দায়িত্ব পালন না করে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হল।
আমাদের দেশের পরিকাঠামো ও আর্থসামাজিক অবস্থার পর্যালোচনা করলে অনলাইন শিক্ষার ধারনাটাই, বিশেষতঃ স্কুলস্তরে, অলীক কল্পনা মাত্র।পুরো শিক্ষার পরিকাঠামোর খরচ বজায় রেখে, শিক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে, পরপর দুবছর পরীক্ষায় ছাড় দিয়ে আমরা শিক্ষা ধ্বংসের বিনিময়ে নাটকীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করলাম! পড়াশোনার মান নির্ভর করে সুষ্ঠু পরীক্ষা-পদ্ধতির উপর। আর পরীক্ষা-পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে স্বচ্ছ ও সফল মূল্যায়ন পদ্ধতির উপর। গত বছর, ২০২০ সালে, অতিমারীর লকডাউনের মধ্যে পরীক্ষা-পদ্ধতি ও তার হাস্যকর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষা-দপ্তর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা রক্ষার বিনিময়ে শিক্ষার যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টিকে শিকেয় তুলে দিলেন। যার ফলে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের পর মুড়ি মুড়কি একই দরে বিকোতে লাগল। তারপর, স্কুল খুলতে না খুলতে প্রশাসনিক ( তা কেন্দ্র ও রাজ্য দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) ব্যর্থতায় যখন আবার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে লাগল, সব পঠন পাঠন বন্ধ করে দেওয়া হল। সমাজে পরিষ্কার বার্তা গেল যে, স্কুল,কলেজ খোলা রাখা সরকারের প্রাথমিক কাজ নয়, পড়াশোনা অত্যাবশ্যকীয় নয়। এখানেই অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের তফাৎ। তারা শিক্ষার গুরুত্ব জানে বলেই শিক্ষাকে প্রায়োরিটি সেক্টারে রেখে, স্কুল কলেজে দ্রুত টীকাকরনের ব্যবস্থা করে ও কার্যকরীভাবে স্যানিটেশান চালু রেখে শিক্ষাদান ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখেছে – যাতে একটা জেনারেশান শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। আর শিক্ষাই একটি জাতির ভিত্তি। আমাদের দেশের চালকদের এই ‘বোধ’ এর অভাবেই আমরা আমাদের একটা জেনারেশানকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত করলাম।
দুবছর পড়াশোনা বন্ধ রেখে এবং প্রথম বছর অস্বচ্ছ ও অসম্পূর্ণ মূল্যায়নে ‘পরীক্ষা’ নিয়ে, পরের বছর সে পাটও চুকিয়ে দিয়ে বিনা পরীক্ষায় প্রমোশনের যে ডামাডোল তৈরী হল, তাতে আর যাই হোক, শিক্ষার গঙ্গাজলী যাত্রা সম্পূর্ণ হল। স্কুলের শেষ পরীক্ষা না হওয়ায় ও সমমূল্যায়ন বা স্কুলের অনলাইনে না পড়িয়ে মূল্যায়ন, যাই হোকনা কেন, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি, বিশেষত টেকনিক্যাল বিষয়ে, যেমন ডাক্তারী, ইন্জিনীয়ারীং ইত্যাদি বিষয়ে মেধাভিত্তিক সঠিক ভর্তি প্রক্রিয়া শুধু ঘেঁটে গেল তাইই নয়, এই শাখাগুলিতে দূর্বল মেধার অনুপ্রবেশ রোখার উপায়ও থাকল না। সঙ্গে টাকার জোরে উচ্চশিক্ষা লাভের ছাড়পত্র পাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হল! ফলে, বিশ্বের দরবারে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হল। বলা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মেনে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক নিয়মে পরিচালিত সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে ‘বিশেষরূপে অজ্ঞ’ স্তাবকবৃন্দ নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সব সময় কর্তাভজা রিপোর্টই দেয়। তবে,তার ফলাউট বিচার করে যথার্থ বিশ্লেষনেই ভুল সংশোধনের সুজোগ থাকে। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শাসকের মানসিকতা। শাসককে আগে ঠিক করতে হবে শিক্ষা প্রায়োরিটি সেক্টারে থাকবে কিনা। তা নাহলে শিক্ষার এই অবমূল্যায়ন রোখা সম্ভব নয়।
এবার আসি বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া ফল প্রকাশের বিড়ম্বনায়। এক্ষেত্র, একই মেধার, বিভিন্ন রাজ্যের ও বোর্ডের মধ্যে, এমনকি একই রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের মধ্যে নম্বরের বিস্তর ফারাক থাকবে। এতে আমাদের শিক্ষার মানের সামাজিক স্বীকৃতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ফলিত ও ল্যাবোরেটরী ভিত্তিক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে এধরনের বিনা পরীক্ষায়, বিনা ক্লাসে ডিগ্রী সামাজিক স্বীকৃতির পরিপন্থী। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের শিক্ষা বিভাগের এসব ভাবা উচিৎ ছিল। উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি এখন টাকার খেলায় পরিণত হবে। সেটাই এর পরিনাম।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক।এখানে ভোট ও সরকার গঠন সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। টীকাকরনে অগ্রাধিকার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী সান্ত্রীদের! তারপর বাজারের ব্যবসায়ী, বয়েসভিত্তিক নাগরিক ইত্যাদি। এখানে শিক্ষাজগতের কোন কথা নেই। গত এক বছরে শিক্ষকদের একমাত্র উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ভোটে ভোটকর্ভী হিসেবে কাজ করা। সুতরাং বলা যেতে পারে, সরকারই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে দেশের যাবতীয় ছাত্রদের জীবন থেকে দুটি শিক্ষাবর্ষকে মুছে দিল। এই যে স্কুলশিক্ষায় বাধা পরল, এর একটি অবশ্যম্ভাবী ফল হল ড্রপআউট। এই ড্রপআউটের সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে। একত হচ্ছে অভিভাবকদের আর্থসামাজিক অবস্থা, দ্বিতীয় হচ্ছে সরকারের শশিক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে মনোভাব। আমাদের রাজ্যের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে এইসব স্কুলছুটদের আবার স্কুলমুখী করা অসম্ভব। দেখা যাবে, খাতায় কলমে ছাত্রছাত্রী থাকবে, তাদের মিডডে মিলের টাকা, চাল ইত্যাদি আসবে কিন্তু আসল ক্লাশরুমে ছাত্রছাত্রী অনেক কমবে। এইভাবে গত দুদশকের অত্যন্ত সফল কার্যক্রম ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ আমাদের রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়বে। সরকার যেন এর জন্য তৈরী থাকে।
অতিমারীর মধ্যে শিক্ষায় সরকারের দিশাহীনতা
