আত্মহণনকারী বাঙ্গালী

একটা খুব সাধারণ প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বিদেশী বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিল – “তোমাদের দেশে বাঙ্গালী কারা?” উত্তর দিয়েছিলাম,”যারা বাংলায় বাস করে”। বন্ধু আবার প্রশ্ন করল,”কোন বাংলা – বাংলাদেশ নাকি ভারতের একটি অঙ্গরাজ‍্য পশ্চিমবঙ্গ?” আমার তাৎক্ষণিক উত্তর – দুটোই। বন্ধু বলল, “তোমাদের বাঙ্গালীদের দুটি আলাদা দেশ; আলাদা কালচার; আবার তোমরা ভারতীয়রা সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আর বাংলাদেশ ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্র। তোমাদের মধ‍্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশী। এমনকি খাদ‍্যাভ‍্যাসেও প্রচুর তফাৎ”। বুঝলাম, আমার বন্ধুটি বাঙ্গালী জাতির ব‍্যপারে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। সেই থেকে তার বক্তব‍্য বাঙ্গালী হিসেবে আমায় নাড়া দিয়েছে।
জাতি হিসাবে গুজরাতিদের ভাষা, কালচার ইত‍্যাদি এক। মারাঠি থেকে কানাড়ি, তামিলি, ওড়িয়া – সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ‍্য। একটি জাতি তখনই জাতি হিসেবে বিকশিত হয়, যখন তার জাতিসত্ত্বা ও জাতির অস্মিতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুই দেশের তথাকথিত বাংলায় কথা বলা মানুষদের জাতিসত্ত্বায় প্রচুর তফাৎ আর বাঙ্গালী অস্মিতার প্রকাশ দেখি শুধু রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। এর কারন, গত একশ বছরের বাঙ্গালীর ইতিহাস ও তার সামাজিক অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা জল খাওয়ার কথা বলে, উত্তর ভারতীয়রা পানি পিতে হ‍্যায় আর বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা পানি খায়! আচ্ছা, বলুন ত বাঙ্গালী ঐতিহ্য কি? দুজন পরিচিতের দেখা হলে হাত জোড় করে নমষ্কার ও প্রতি নমষ্কার জানানো পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী শিষ্টাচার। আবার বাংলাদেশের দুই বাঙ্গালী তখন এক হাত বুকে ঠেকিয়ে আসলাম ওয়ালেকুম ও আলেকুম সালাম বলে। কোনটা বাঙ্গালীর সঠিক শিষ্টাচার! দুই বাংলার বাঙ্গালীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) বাংলা ভাষার জন‍্য আন্দোলনকারী শহীদদের স্মরণে ভাষা দিবস পালন করে আর একই রকম বাংলা ভাষার জন‍্য আসামে আন্দোলনকারী শহীদদের কথা তারা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না! বাঙ্গালী জাতির কর্মকান্ড এমনই অদ্ভুত যুক্তিহীন দ্বিচারিতায় ভরা।
নিরপেক্ষভাবে এর কারন বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও জানি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারনে সমালোচিত হতে হবে! প্রথমে বলি, উইন্সটন চার্চিলের নির্বাচনে পরাজয়ের পর এ‍্যাটলী বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী না হলে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা আসত না। এমনকি, স্বয়ং এ‍্যাটলী ভারতের স্বাধীনতার কারন হিসেবে গান্ধীজীর অবদানকে “নূন‍্যতম” বলে অভিহিত করেন। ভারতের স্বাধীনতার পিছনে প্রধান কারনগুলি হল – বৃটেনের উপর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, ভারতের দিকে দিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, INAর কর্মকান্ড, এবং মিত্রশক্তির অন‍্যান‍্য সহযোগী যেমন আমেরিকা ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক চাপ। তখন ইংরেজ সরকার চাইল বশংবদ নেটিভ নেতৃত্বের হাতে ভারতের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দায় থেকে মুক্তি পেতে। এর মধ‍্যে নূন‍্যতম অবদান গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন – যা চার্লস্ এ‍্যাটেনবরোর “গান্ধী” ছবিতেও দেখানো হয়েছে। এভাবে ভারত খন্ডিত করে স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গান্ধীজী প্রতিবাদ-অনশন করলেও পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোন অদৃশ‍্য অঙ্গুলীহেলনে ভারতভাগের পক্ষে রাজি হয়ে গেলেন, সেই ইতিহাস আজও অজানা। বাঙ্গালী সুভাষ ও বাঙ্গালী শ‍্যামাপ্রসাদের মৃত‍্যুর ইতিহাস আজও রহস‍্যময়। এতে কার লাভ হয়েছে তা সবাই জানলেও কার ক্ষতি হয়েছে তা নিয়ে চর্চা হয়েছে কি? বিধানচন্দ্র রায়কে বাঙ্গলার উন্নয়ণের প্রশ্নে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার যদি পর্যাপ্ত সাহায‍্য করত তাহলে তাঁকে উন্নয়ণের জন‍্য জন এফ কেনেডির সফল চিকিৎসার বিনিময়ে সাহায‍্য চাইতে হত না! ভারত খন্ডিত হওয়ায় যে দুটি রাজ‍্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা হচ্ছে বাংলা ও পাঞ্জাব। এই দুটি রাজ‍্যে ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় যে ক্ষতি হয়েছিল, মানুষের প্রাণহানি ও সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল, শুধু ধর্মীয় কারনে সেখানে যে গণহত‍্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর শ্লীলতাহানির মত হাজার হাজার পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক সাহায‍্য ও পুনর্বাসন নীতির দরকার ছিল তার থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রশ্নাতীতভাবে বঞ্চিত হয়েছিল। বাংলা ভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের (সুরাবর্দী ছিলেন তাদের নেতা) মুসলমান নেতৃত্বের অনুগামীদের অত‍্যাচারে সম্পত্তি হারানো (এনিমি প্রপার্টি আইনে!), ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তরকরন ও খুনের রক্তস্রোত বইয়ে বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে এবং আসাম ও ত্রিপুরায় যে হিন্দু বাঙ্গালী শরণার্থীরা আশ্রয় নিতে আসে – পৃথিবীর যে কোন আইনে তারা ধর্মীয় শরণার্থী। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে এবং তাদের ‘ধর্মীয় শরণার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করতে জওহরলাল নেহরু সরকার অস্বীকার করে। আর এই ব‍্যপারটা তারপরেও ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের কাছে হারার পরে পুনরাবৃত্তি হয়। হিন্দু বাঙ্গালীদের সেখানে বক্সিংয়ের ‘পাঞ্চিং ব‍্যাগ’ হিসেবে ব‍্যবহার করা হয়েছে। ভারতের অন‍্য কোন রাজ‍্যের এই অভিজ্ঞতা হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ঘৃণিত ঔদাসীন‍্যের সুযোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গের কম‍্যুনিস্টরা। তারা এই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে শরণার্থীদের মধ‍্যে কম‍্যুনিজমের তত্ত্ব প্রচারের মাধ‍্যমে বাঙ্গালীর এই অংশকে তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করার চেষ্টা করতে লাগল। এই হতভাগ্য ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার নূন‍্যতম রসদ জোগাড়ে সাহায‍্য করার বিনিময়ে এদেরকে কম‍্যুনিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেওয়ার নামে ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মকে বিদ্রুপ ও অমান‍্য করার পাঠ দিতে শুরু করল। এইভাবে নরম ব্ল‍্যাকমেলিংয়ের প্রভাব এপারের হিন্দু বাঙ্গালীর মননে পড়তে শুরু করল। ইতিমধ্যে ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের দখলদারি কম‍্যুনিস্টদের হাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙ্গালী হিন্দুদের গৌরবের ইতিহাস, বাঙ্গালীর নিজস্ব, ঐতিহ্যবাহী উৎসব ইত‍্যাদিকে সমাজজীবন থেকে মুছে দিতে তৎপর হল। এই ভাবে বাঙ্গালী হিন্দুদের শ্লো পয়জনিং পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। পেটের জ্বালায়, বাঁচার তাগিদে এরাও নিজেদের জাতিসত্ত্বা ভুলে কম‍্যুনিস্টদের ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ‍্য হল। বাঙ্গালী হিন্দুদের নব‍্য প্রজন্ম পুজোআর্চায় অবিশ্বাসী কম‍্যুনিস্ট, কিন্তু মুসলিম বন্ধুর ডাকে রমজানের ইফতারে মাথায় টুপি পরে হাজির হতে লাগল। এরা জানে না যে ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এই বাঙ্গালী আপরুচি খানার নামে গরুর মাংসের স্বাদ ও উপকারিতা নিয়ে লেকচার দিয়ে তার প্রগতিশীল মনের পরিচয় দিল। আবার তাদের কাউকে মুসলমান বন্ধুকে শুয়োরের মাংস খাওয়ার উপকারিতা বোঝাতে দেখা গেল না! ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দু বাঙ্গালীর আত্মবিস্মরণ তখন থেকে দ্রুততর হল। আবার অন‍্যদিকে মুসলমান বাঙ্গালীদের গরিষ্ঠ অংশ পূর্বপাকিস্তান,অধুনা বাংলাদেশে রয়ে গেল। আর একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে থেকে গেল – ফলে তারা ভারতের বাসিন্দা হয়ে ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যেও ছড়িয়ে পরল। এদিকে পূর্বপাকিস্থানের হিন্দু বাঙ্গালীদের স্বার্থের জন‍্য ধর্মের নামে ক্রমবর্ধমান অত‍্যাচার সইতে হল। দুটো বিকল্প তাদের সামনে ছিল – ধর্মান্তর বা ধন সম্পত্তি ফেলে রেখে একবস্ত্রে ভারতে শরণার্থী হওয়া। এর মূল দায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রতি তাদের বিমাতৃসূলভ আচরণ এই হতভাগ‍্য মানুষগুলোকে বাধ‍্য করেছিল কম‍্যুনিস্টদের ঝান্ডার পিছনে দাঁড়াতে। বিনিময়ে তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল হিন্দুত্বের অস্মিতা। সেইসঙ্গে কম‍্যুনিস্টরা এদের ইসলামী সেকুলারিজমের ধারাপাত মুখস্ত করিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের নামে মহান চিন ও রাশিয়ার বিপ্লবের পাঠ নিতে বাধ‍্য করল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ‍্যক্রম থেকে জাপান ও সুইজারল্যান্ডের বদলে চিন ও রাশিয়ার অন্তর্ভূক্তির মাধ‍্যমে এদের সেকুলারিজমে ব‍্যপটাইজেশান হল। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর বই থেকে হিন্দুধর্ম ও পুরোহিতদের অসম্মান ও বিদ্রুপ করা শেখানো হতে লাগল। আশ্চর্যজনকভাবে মুসলিম ও খ্রীষ্টান ধর্ম নিয়ে কিছু বলা হল না। পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রীকে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন‍্য দল থেকে ভর্তসনা করা হল, কিন্তু অন‍্য এক মুসলিম মন্ত্রীকে হজ যাত্রার জন‍্য ছুটি দেওয়া হল! পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা এভাবেই ইসলামী সেকুলারিজমকে গ্রহণ করল। বাঙ্গালী বিপ্লবীদের শৌর্য, নেতাজী সুভাষ, রাসবিহারী বসু ও শ‍্যামাপ্রসাদ মূখার্জীদের মেধা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় গদি হারানোর ভয়ে ভীত ভারতের শাসককুল জওহরলাল ও প‍্যাটেলভাইদের নেতৃত্বে (অবশ‍্যই গান্ধীজীর সমর্থনে) প্রথম থেকেই বাঙ্গালী তথা স্পষ্ট বক্তা উত্তর-পূর্বের মানুষদের সঙ্গে বৈষম‍্যমূলক আচরন করেন। এর অবিসংবাদী ফল স্বরূপ বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ‍্যে কেন্দ্রবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। ভিন্ন কারনে দুই বাংলার বাঙ্গালীদের মধ‍্যে অনুন্নয়ণ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও পূর্ববাংলায় ধর্মের নামে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজকে ঐক‍্যবদ্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে মৌলভী-মুয়াজ্জিমদের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেখানে সংখ‍্যালঘু বাঙ্গালীদের উপর ধর্মের দোহাই দিয়ে অত‍্যাচার করা হয়েছে, তার আসল উদ্দেশ‍্য ছিল ধন-সম্পত্তি ও জমি-বাড়ি লুঠ করা – দস‍্যুবৃত্তির রকমফের। এর প্রতিবাদে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রতিবাদ করলে মৌলবাদী শক্তি মৌলানা-মৌলভীদের একাংশকে এদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার কাজে নামায়। তারপর ধীরে ধীরে ‘ইসলামী গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা তৈরী করে ইসলাম প্রসারের নামে শিশু বয়স থেকেই মগজ ধোলাই করে হিন্দু (কাফের)দের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে ঘৃণার বীজ বপন শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে সেখানকার জনগোষ্ঠী তাদের বাঙ্গালী সত্ত্বা হারিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের নামে আরবী কালচারের গোলামে পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মধ‍্যে হিন্দু উদ্বাস্তু অংশকে যেমন কম‍্যুনিষ্টরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় দীক্ষিত করেছিল, তারাই আবার ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি মরিচঝাঁপিতে হতভাগ্য মানুষগুলোর গণহত‍্যার মধ‍্যে দিয়ে উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল হিন্দু বাঙ্গালীদের একটি বড় অংশের কাছে কম‍্যুনিষ্টরা খলনায়কে রূপান্তরিত হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক সত‍্য হল, এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে কম‍্যুনিস্টরাই এখানে এনে বসিয়েছিল! তারপর থেকে উদ্বাস্তু পরিবারের একটি বড় অংশ কম‍্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় কম‍্যুনিস্টরাও উদ্বাস্তুদের প্রাপ‍্য অনেক সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিল। ভোটব‍্যাঙ্কের রাজনীতিতে এই লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার জন‍্য কম‍্যুনিস্টরা বাংলাদেশের মুসলমান নাগরিকদের এদেশে যাতায়াতের সুযোগ করে দেওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসন হাতে থাকার সুবাদে তাদের ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ড করিয়ে দিতে মনোযোগী হল। সেইসঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের অপ্রত‍্যক্ষ সহায়তায় এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বড় অংশের সহযোগীতা করার ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে কম‍্যুনিস্টরা তাদের ভোটব‍্যাঙ্কের প্রাধান‍্য অক্ষুন্ন রাখল। এতে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ‍্যে টেনশান শুরু হল। তারপর সময় যত গড়ালো, কম‍্যুনিস্টদের রাজ‍্য থেকে হটানোর জন‍্য আঞ্চলিক দল তৃণমূল সৃষ্টির শুরু থেকেই তারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোটব‍্যাঙ্ক টার্গেট করে রাজনীতি শুরু করল। বাঙ্গালী জাতিটাকেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও আঞ্চলিক ভাগে ভেঙ্গে দেওয়ার কম‍্যুনিস্ট তত্ত্বকে তৃণমূল অত‍্যন্ত সুচারুভাবে প্রয়োগ করল। কম‍্যুনিস্টদের উপর প্রত‍্যাশার চাপবৃদ্ধি, অনুন্নয়ণের ফলে উদ্ভুত বিপুল বেকারত্ব ও সর্বোপরি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন কম‍্যুনিস্টদের হিন্দু, মুসলমান উভয় বাঙ্গালী ভোটব‍্যাঙ্কেই ধ্বস নামালো। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের কম‍্যুনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর একটু একটু করে বোঝা গেল যে, সম্মিলিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসনের প্রভাবে বাঙ্গালীর জাত‍্যাভিমান ও বাঙ্গালী অস্মিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর থেকে তৃণমূল আঞ্চলিক দল হওয়ার সুবাদে তার কোন সর্বভারতীয় নীতির বাধ‍্যবাধকতা না থাকায় এবং ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মত একজন সুপ্রিমো দ্বারা দল পরিচালিত হওয়ার কারনে তারা “যখন যেমন তখন তেমন” নীতিতে ভোটব‍্যাঙ্ক রাজনীতি নিয়ে চলতে লাগল। প্রথম নির্বাচন তৃণমূল জেতে কম‍্যুনিস্টদের অপছন্দ করার জন‍্য ভোট পাওয়ায় এবং তৃণমূলের কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে জোটের কারনে। এরপর কংগ্রেসের এম এল এ ভাঙ্গানো, সিপিএমে ভাঙ্গন ধরানো – এসবে পরিষ্কার হল, রাজ‍্যে ক্ষমতায় আসতে এবং ক্ষমতায় থাকতে গেলে জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় নিদান বড় কথা নয়, আসল হল “আপনা ধান্দা জিন্দাবাদ” নীতি। আর কিছু দিলে কিছু পাওয়া যাওয়ার ‘ব‍্যবসা’ – এই নীতিতে একে একে রাজ‍্যের সবকটি বৃহৎ সংবাদ-মাধ‍্যমকে রাজ‍্যসরকার তথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হল। নতুন করে সমাজে সংস্কার (!) শুরু হল। হিন্দু বাঙ্গালীদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দেগে দেওয়া হল। এই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ হল, হিন্দুদের সার্বজনীন পুজোগুলিকে পুজো না বলে ‘উৎসব’ বলা হতে লাগল – যেমন দূর্গাপুজো হল শারদোৎসব, কালীপূজো হল দেওয়ালী আর সরস্বতী পূজো বসন্ত পঞ্চমী উৎসব! আর এই উৎসব উদযাপনের মধ‍্যে দিয়ে বিকৃত মূর্তির প্রতিমাকে আর্টের উদাহরণ হিসেবে দেখা হতে লাগল। আসলে পূজোর পরিবেশকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন আমোদ-প্রমোদ ও উপভোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সংবাদ-মাধ‍্যমের ঢক্কানিনাদে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পূজোর সময় উৎকট উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। এইভাবে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের লঘুকরনের সাথে সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে যাতে কোনভাবে লঘুকরন করা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হল।
এইভাবে বাঙ্গালী হিন্দু তার বাঙ্গালী সত্ত্বার অনেকটাই হারিয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে আত্মহণনের পরাকাষ্ঠা দেখাল – সেইসঙ্গে তার বাঙ্গালী জাত্মাভিমানকে জলাঞ্জলি দিল। আবার বাংলাদেশের সংখ‍্যাগরিষ্ট মুসলমান বাঙ্গালী তাদের যে জাত‍্যাভিমান দেখাল তা আরবী সংস্কৃতির মিশেলে বাঙ্গালী অস্মিতার সৌরভ বিবর্জিত এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিল। এর প্রভাবে এবং সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দখলদারির মহিমায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিরাপত্তাহীণতায় এবং অপর অংশ সুবিধাবাদী নীতির প্রভাবে বাঙ্গালীর মধ‍্যে বিভেদের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরল। এভাবে জেহাদী ও বিপরীত-জেহাদী রাজনীতির জাঁতাকলে নিজেদের ধরা দেওয়ার ফলে আজ বাঙ্গালী অস্মিতা মূমুর্ষ অবস্থায় দেহ রাখার অপেক্ষায় আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *