আমাদের দেশে ওমিক্রন ভাইরাসের বিপদ কতটুকু

আমাদের দেশের মানুষের সামনে নতুন করে যে বিপদ এসেছে সে সম্পর্কে এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীজীও দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে বলেছেন, সেটি হল করোনা ভাইরাসের নতুন রূপ – ওমিক্রন ভাইরাস। যে কোনো RNA ভাইরাসের মত করোনা ভাইরাস, যা প্রাথমিকভাবে SARS-CoV-2 নামে পরিচিত, জিন মিউটেশান করে তার জিন গঠনের বিন‍্যাসের পরিবর্তন করে। কারন, একই গঠনের ভাইরাসগুলির স্থায়ীত্বকাল খুব কম। সেজন‍্য এরা যখন নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে replication বলে, তখন মাঝে মধ‍্যে তাদের জিন মধ‍্যস্থ অ‍্যামিনো এ‍্যাসিডের ট‍্যাগিংস্থানগুলি একে অন‍্যের জায়গায় চলে যায়। একেই জিন মিউটেশান বলে। এতে প্রোটিনের গঠন আলাদা হলেও প্রজাতি একই থাকে। জিন মিউটেশানে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করে RNA ভাইরাস বেঁচে থাকার চেষ্টা করে – নতুবা শুধু replication এ ভাইরাসের অস্তিত্বের স্থায়িত্ব আসে না। সেজন‍্য ভাইরাসের জিন মিউটেশান একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একই রকম জিন বিন‍্যাস করতে করতে যখন নিউক্লিওটাইডের মধ‍্যে প্রোটিনের ট‍্যাগিং বিন‍্যাসের পরিবর্তন হয় তখন নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের সৃষ্টি হয়। এতে কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রজাতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এই ওমিক্রন ভাইরাসও তেমনি করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের নতুন একটি রূপ।
এই ওমিক্রন ভাইরাস নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম দেখা যায় বটসওয়ানায়। তার তিনদিন বাদে পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রায় একই সময়ে হংকংয়ে ওমিক্রন ভাইরাসের সংক্রমন ধরা পড়ে। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ভাইরোলজিস্ট ডঃ টম পিকক প্রথম এই নতুন ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের নিউক্লিওটাইডের স্পাইক প্রোটিনের সর্বাধিক মিউটেশানের কথা বলেন। তিনি আরো বলেন যে, এই ভ‍্যারিয়েন্ট “odd cluster” এর – অর্থাৎ এটির সংক্রমণের তীব্রতা মারাত্মক রকমের নয়। তবে, সমস‍্যাটা অন‍্য জায়গায়। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসার রবি গুপ্তা এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের জেনেটিক ইন্সটিটিউটের প্রফেসার ফ্রাঙ্কো ব‍্যাঁলো দুজনে পৃথকভাবে বলেন যে, এদের অ‍্যান্টিবডি সণাক্তকরনের ক্ষমতা rtPCR এর মার্কারের কম থাকার কারনে এদের সণাক্তকরণ করা শক্ত। প্রফেসার ব‍্যাঁলো আরো বলেন, এরা সিঙ্গল বার্সট মিউটেশানে উদ্ভুত বলে আলফা ও ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের মার্কারকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেজন‍্যই মনে হয়, প্রায় সতেরোটা দেশে ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হয়েছে জানা গেলেও কোথাও মৃত‍্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কমাত্র দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করার মত রোগ যেমন HIV, ক‍্যন্সার ইত‍্যাদির উপস্থিতিতে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর কিন্তু এই তথ‍্যকে অস্বীকার করেনা।
একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সণাক্তকরন পরীক্ষা, rtPCR সহ, এই ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করতে না পারলে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকেই যায়। আর সেই কারনেই WHO এবং আরো কয়েকটি সংস্থা বিশ্বকে সতর্ক থাকতে বলেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও এই সতর্কতার কথাই বলেছেন। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে দেশের বেশ কিছু সংবাদ মাধ‍্যম নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর দিকে লক্ষ‍্য রেখে ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ে ‘যদি’, ‘কিন্তু’র মোড়কে অবৈজ্ঞানিক ব‍্যখ‍্যায় সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করছে। এমনকি একথাও বলা হচ্ছে যে, এই ভাইরাস নাকি বাজারের স্বীকৃত ভ‍্যাকসিনে কাবু হবেনা! এমন অবৈজ্ঞানিক ব‍্যখ‍্যা কোন গবেষণাগারের পরীক্ষায় উঠে এসেছে তা জানা নেই। উপরন্তু, কোন স্বীকৃত গবেষণাপত্র এমন কথা বলছেনা। বলা হচ্ছে, স্পাইক প্রোটিনে এত বেশী সংখ‍্যায় পরিবর্তন এবং ফ‍্যুরিন ক্লিভেজ এই প্রথম ভ‍্যারিয়েন্টে পাওয়া গেল। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। RNA ভাইরাস প্রজাতি না পাল্টালে কোন বড় বিপদ নেই। আর, জিন মিউটেশান যত বেশী হব, ভাইরাসের টিঁকে থাকার ক্ষমতা তত বাড়লেও তার বেঁচে থাকার জন‍্যই সে তা সংক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে হোস্ট বডির ক্ষতি করার মাত্রা কমিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও একই ব‍্যপারের সম্ভাবনা। যেমন SARS-CoV2তে প্রথম সংক্রমিত সব আক্রান্তেরই সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ‍্যেই মৃত‍্যু হয়েছিল। তুলনায় এখনো ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টে কারো মৃত‍্যু হয়নি।
সংবাদমাধ্যমগুলোর টিআরপি বাড়ানো ছাড়াও এ ধরনের ভীতি সঞ্চারের অন‍্য গুঢ় উদ্দেশ‍্য আছে। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলা মনে হয় একটি বড় উদ্দেশ‍্য। এখন সারা দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতি পেয়েছে -যা লকডাউন পর্বে থমকে গিয়েছিল। দেশ জুড়ে পরিবহন, শিক্ষাঙ্গনসহ বিনোদন ও অন‍্যান‍্য কর্মকান্ড অবাধে শুরু হয়েছে। এতে সরকারের সুস্থিরতার সঙ্গে দেশের নুইয়ে পড়া অর্থনীতি আবার গতি পাচ্ছে। এই ধরনের নেতিবাচক, ভীতিপ্রদ প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যদি সরকার লকডাউন বা বিভিন্ন কর্মকান্ডে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করে তাহলে মানুষের সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি বাড়বে এবং দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও অসংশোধনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিনিষপত্রের লাগামছাড়া মূল‍্যবৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি নুইয়ে পরবে। এই উদ্দেশ‍্যে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও দেশ বিরোধী শক্তিগুলির মদতে এক ধরনের সংবাদমাধ্যম এই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে শুরু করেছে। এইভাবে ভুতের ভয় দেখানোর মত কাল্পনিক ভয় দেখানো শুরু হয়েছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জিন মিউটেশানে নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট জন্মালেও ভাইরাসের প্রজাতির পরিবর্তন হয়নি। সোজাভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ইউরোপীয় ও এশিয় মানুষের দাম্পত‍্যে যে নতুন মানুষ জন্মায়, তাকে ইউরেশিয়ান বলে – যে কিনা মানুষ – গরিলা বা ওরাংওটাং নয়! আরো পরিষ্কারভাবে বলা যাক, বাজারে প্রচলিত যে সব স্বীকৃত ভ‍্যাকসিন আছে তাতেই করোনা ভাইরাসের একটি ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্ট ওমিক্রন কাবু হবে। তার কারন, এই ভ‍্যাকসিনগুলি করোনা ভাইরাসের সকল ভ‍্যারিয়েন্টের উপরেই কার্যকরী হওয়ার মত করে তৈরী করা হয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরা যাক, কোন ভ‍্যারিয়েন্টের সমস্ত ট‍্যাগিংবিন্দুগুলির জন‍্য কোন ভ‍্যাকসিনের কার্যকারিতা অনেক কমে গেল। তখন ঐ ভ‍্যাকসিন পরিমার্জন করে নতুন ভ‍্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকরী করা কোন বড় সমস্যা নয়। আরেকটি কথা – সমস্ত ভ‍্যাকসিনকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমার্জন করা হয় – নাহলে তার কার্যকারীতা (efficacy) কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এর জন‍্য জনসাধারনকে ভয় দেখানো অনুচিত।
এখানে আরেকটি কথা জানানো দরকার। এই মূহুর্তে বিশ্বব‍্যপী বিজ্ঞানীরা ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্ট সংক্রান্ত দুটি কাজে মনোনিবেশ করেছেন। প্রথমতঃ, এখনো পর্যন্ত জিনম সিকোয়েন্সিং না করে ওমিক্রন সংক্রমন নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এই পরীক্ষা ব‍্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সেজন‍্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যে, rtPCR টেষ্টে যদি ওমিক্রন ভাইরাসের সঠিক ও নির্দিষ্ট মার্কার পাওয়া যায়। তাঁদের আশা, তাঁরা অল্পদিনের মধ‍্যেই মার্কার পেয়ে যাবেন। তা হলে অল্প খরচে এবং দ্রুততার সঙ্গে ওমিক্রম আক্রান্ত রোগীর সণাক্ত করা যাবে। দ্বিতীয় যে প্রচেষ্টা বিজ্ঞানীরা চালাচ্ছেন তা হল, এই বিশেষ ভ‍্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর উপর স্বীকৃত ভ‍্যাকসিনগুলির কার্যকারিতা পরীক্ষা। বৈজ্ঞানিক যুক্তি বলে, যেসব ভ‍্যাকসিন ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের উপর কার্যকরী তাদের ওমিক্রম ভ‍্যারিয়েন্ট – যা ডেল্টা ভ‍্যারিয়েন্টের একটি রকমফের – তার ক্ষেত্রে সফল না হওয়ার কোনো কারন নেই। যদি সফলতার মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, তখন ভ‍্যাকসিন পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করে নিলেই হয়। এ কাজের জন‍্য সময় লাগলেও তা খুব বেশী নয়। সুতরাং “গেল গেল” রব তোলার কোন যুক্রি নেই।
পরিশেষে বলি, এই নেগেটিভ প্রচারের জন‍্য ভয় না পেয়ে যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন করলে ওমিক্রন আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না। সতর্কতা বলতে সমাজে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা; বাড়ির বাইরে গেলে বা বাড়ির ভেতরে বাইরের মানুষের উপস্থিতিতে যথাযথভাবে মাস্ক ব‍্যবহার করা; বাইরে থাকলে আধঘন্টা থেকে একঘন্টা অন্তর হাত স‍্যানিটাইজ করা; বাইরে থেকে নিজের বাড়িতে এসে সাবান দিয়ে ভালোভাবে স্নান করা আর বাইরের পোষাক একটি নির্দিষ্ট ও isolated স্থানে রেখে দেওয়া। খুব প্রয়োজনীয় হল, সময়ে ভ‍্যাকসিনের ডোজ নেওয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে শিশুদের ভ‍্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের সরকারের কাছে আমার অনুরোধ যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শিশুদের ভ‍্যাকসিনেশান শুরু করুন। ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের এখনো অব্দি যা গতি প্রকৃতি তাতে কোনো কাজ বা ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করার দরকার নেই। শিক্ষাঙ্গন, বাজার-দোকান, এবং পরিবহন ও বিনোদন জগতের উপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না – অবশ‍্যই মানুষ যদি সতর্ক থাকে। শেষে বলি, এই ধরনের প্রচারে ভুলে সরকার যদি বাধানিষেধের পথে হাঁটে তা হলে সরকার এবং দেশের জনগণের সমূহ বিপদ।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *