ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে জাতীয় কংগ্রেস। তারপরেই বলতে হয় কম্যুনিষ্ট পার্টির কথা। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের প্রথম কম্যুনিষ্ট পার্টির জন্ম হয়। রাশিয়ার বলশেভিকদের সাফল্যে আশান্বিত হয়ে মানবেন্দ্রনাথ (পিতৃদত্ত নাম নরেন্দ্রনাথ) রায় এবং তাঁর স্ত্রী ইভলিন রায় ট্রেন্ট, অবনী মুখার্জী, রোসা ফিটিংগভ, মহম্মদ আলী ও মহম্মদ সফিক ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গের মানুষদের নিয়ে – সঙ্গে রাশিয়ার বলশেভিকদের প্রত্যক্ষ মদত ও সাহায্যে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়। এসব ঐতিহাসিক সত্য। তবে, এইটুকু ভূমিকার প্রয়োজন ছিল কম্যুনিষ্টদের বর্তমান দুরবস্থার কারন অনুসন্ধানের জন্য।
প্রথমে বলে রাখি, তাসখন্দের ঐ মিটিংয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন দক্ষিণী ব্রাহ্মণ মান্ডায়াম পার্থসারথি থিরুমল আচার্য। আর কম্যুনিষ্ট কুওমিনটাং (যা এখনকার পলিটব্যুরোর মত) প্রেসিডেন্ট হলেন উদ্যোক্তা মানবেন্দ্র নাথ রায়। শুরুর থেকেই বিভিন্ন বিপরীতধর্মী ও বিপরীত মনের মানুষের সহাবস্থানে এই পার্টি তৈরী হয়েছিল। এর একটি অবিসংবাদী ফলশ্রুতি হল বারবার দলের ভাঙ্গন। এমন বিপরীত চিন্তার মানুষজনের দীর্ঘ সময় সহাবস্থান কখনোই সম্ভব নয়। মানবেন্দ্র ও ইভলিন বলশেভিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ও সর্বহারার ক্ষমতা অধিকারের দাবীতে বিশ্বাসী। এদিকে আচার্য ও অবনীরা বৃটিশদের ভারত থেকে বিতারনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এরা সবাই দরকারে সহিংস পদ্ধতি অবলম্বনে বিশ্বাস করতেন। দলের অন্যতম সংগঠক মানবেন্দ্র ক্যাডার সংগ্রহে প্রথম টার্গেট করেন ভারতের বৃটিশ রাজশক্তির বিরোধী ও প্রয়োজনে সশস্ত্র প্রতিরোধে বিশ্বাসী যুবগোষ্ঠীকে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি অনুশীলন সমিতি ও সেই মানসিকতার যুবকদের থেকে ক্যাডার সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ কাজে বিশেষ সাফল্য না পাওয়ায় তাঁর নজর পড়ল মুসলিম যুবকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর উপর। খলিফার অধিকার ও শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করার কারনে অটোমান সাম্রাজ্য ও তার দোসর বৃটিশদের উপর তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশ বৃটিশদের শত্রু মনে করতে লাগল। তাদের খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করে গান্ধীজী যে ভুল করেছিলেন তার চেয়েও বড় ভুল করলেন মানবেন্দ্র। তিনি এইসব গোঁড়া মুসলমানদের থেকে ক্যাডার সংগ্রহ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সর্বহারার ক্ষমতায়ন। হিন্দু কম্যুনিষ্টদের জাতীয়তাবোধের ব্যাপারে উদ্ভুদ্ধ করার কোন চেষ্টা করা গেল না। কারন মানবেন্দ্র নিজেও জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ্বমানবতাবাদকেই বেশী প্রাধান্য দিতেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। এদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামীর কারনে মুসলমান কম্যুনিষ্টদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ত দুরের কথা, সাম্যবাদের উপরেও বিশ্বাস ছিলনা। তাদের বৃটিশ বিরোধীতা ছিল ধর্মীয় কারনে এবং অস্থায়ী। মহম্মদ সফীক ও মহম্মদ আলীর বিভিন্ন কার্যকলাপেই তা পরিষ্কার। ফলে, খলিফার অপসারন ও কামাল পাশার তুরষ্কের ক্ষমতায় আরোহনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বৃটিশ বিরোধীতাও গতি হারালো। রফিক আহমেদ, সৌকত উসমানী, খুশী মহম্মদরা প্রথমে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও পরে কম্যুনিষ্ট! যখন খিলাফৎ আন্দোলন গুটিয়ে গেল, বৃটিশ বিরোধীতা তখন ভারতের মুসলিম কম্যুনিষ্টদের কাছে গতি হারালো। এরা অনেকটা দিগভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে এইসব মুহাজিরদের একটি বড় অংশ রাশিয়ায় সামরিক ট্রেনিং নিয়ে বলশেভিক, উজবেক বা তুর্কী সেনাদলে সামিল হল। তবে, ভারতের অভ্যন্তরে মুজফ্ফর আহমেদ, ডাঙ্গে, সিঙ্গারা ভেলু চেট্টিয়াররা তাদের সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করতে শুরু করল। তখন কিন্তু সেই চেষ্টায় মুসলমান ক্যাডারের সংখ্যা অনেক কমে গেল তা বলাই বাহুল্য।
সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের সব কম্যুনিষ্ট দল – বিশেষতঃ CPI ও CPM, একটি অদ্ভুত দ্বৈতসত্তায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তা হল, মুসলিম কমরেডরা আগে মুসলিম, পরে কম্যুনিষ্ট। আর হিন্দু কমরেডরা আগে কম্যুনিষ্ট, পরে হিন্দুধর্মের বিরোধী মানুষ! একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ দেওয়া যাক – কোন কম্যুনিষ্ট পুজো আর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না; কিন্তু মুসলিম কমরেডদের মসজিদে না যাওয়া বা নামাজ না পড়ার কোন বিধান দেওয়া নেই। এই দ্বিচারিতার জন্যই কিন্তু “আগমার্কা বিপ্লবী” মানবেন্দ্রনাথ রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই কম্যুনিষ্টদের থেকে সরে গিয়ে র্যাডিক্যাল হিউমানিজমের সুচনা করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় তাঁর এই বিরক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যাক, আমরা আবার ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের কথাতেই ফিরে আসি। যখন মুহাজির সম্প্রদায় কম্যুনিষ্ট আন্দোলন থেকে সরে গেল, তখন মুসলিম কমরেডদের ধরে রাখার যে কৌশল কম্যুনিষ্ট পার্টি নিল তা অনেকটাই গান্ধীজীর অনুসরণে। কি রকম? যেহেতু গোঁড়া মুসলমানদের থেকে মুহাজির সম্প্রদায় আসে এবং তাদের থেকেই মানবেন্দ্রনাথরা কম্যুনিষ্ট পার্টির মুসলিম ক্যাডার নিয়োগ করেছিলেন, সেজন্য ইসলাম ও তার মৌলবী নির্দেশিত পথকে মান্যতা দিয়ে কম্যুনিষ্টরা “ধর্মনিরপেক্ষতা”র পক্ষে সওয়াল শুরু করে দিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কম্যুনিষ্ট পার্টির ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হিন্দুধর্মবিরোধী রয়ে গেল।
ইতিমধ্যে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হল। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ব্যপক পরিবর্তন ঘটালো। ভারতে একদিকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে বৃটিশের সব রকম দমন পীড়ন উপেক্ষা করে সশস্ত্র কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যকলাপ – এই সব কিছুর একসঙ্গে মোকাবিলা করা বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল বৃটিশ শক্তির পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। বৃটিশ অর্থনীতিও যুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল। বৃটিশ পার্লামেন্টে উইনস্টন চার্চিলের পরাজয় ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করল। এই পর্যায়ে বলশেভিক আন্দোলনের পরবর্তীস্তরে যখন রাশিয়ায় যোসেফ স্তালিনের একনায়কতন্ত্রের শাসন কায়েম হল তখন ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি তাদের দমনমূলক শাসনকে পূর্ণ সমর্থন জানালো। এই সমর্থনের বিনিময়ে তারা আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেতে লাগল। এইভাবে কম্যুনিষ্টরা মানুষ ও দেশের মঙ্গলের থেকে পার্টির ও তার নেতাদের মঙ্গলের দিকেই নজর দিত। যেহেতু ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির অস্তিত্ব ও জনসমর্থনের জন্য এই বিদেশী শক্তির সাহায্যের প্রয়োজন, সেহেতু বিদেশী শক্তিকে তৈলমর্দন করা ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের কাছে অবশ্য কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ল। আন্তর্জাতিক পরাস্থিতি ও সমঝোতার প্রেক্ষিতে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি তাদের নীতি অদল বদল করতে লাগল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন রাশিয়া ও বৃটেন পরস্পরের কাছাকাছি আসে তখন, যদিও ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র গতি পেয়েছে, তখন বৃটিশদের স্বার্থের কথা ভেবে কম্যুনিষ্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল হল না! পরন্তু, মুসলমানদের স্বার্থে পাকিস্তান গঠনকে সমর্থন জানালো। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মহম্মদ আলী জিন্না যখন ভারতভাগের প্রস্তাব দিল, নিজেদের মুসলমান কমরেডদের তুষ্ট রাখতে কম্যুনিষ্ট পার্টি সেই প্রস্তাব সমর্থন করল! এই তোষন ও ধান্দাবাজীর নীতিই যে তাদের ভবিষ্যৎ অবক্ষয় ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের কারন হবে তা ঐ সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
কম্যুনিষ্টরা ভারতে তিনটি স্থির নীতির উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক জমি দখল করার স্বপ্ন দেখেছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ক্যাডারদের মন যুগিয়ে তাদের মারফৎ মুসলিম সমাজে নিজেদের রাজনৈতিক বিস্তার; হিন্দু ক্যাডারদের ক্ষেত্রে ছিল ‘সর্বহারা’ সবকিছু পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন। এই সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগ ও আদর্শ যাতে পার্টির বিস্তারে বাধা না হয় তার জন্য “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে সরাসরি হিন্দু ধর্ম ও তার সকল আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা। সব হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অসাড়তা প্রমানের হাস্যকর প্রয়াস চালানো এরই অংশ মাত্র। আর এভাবেই ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা এক “ইসলামিক ধর্মনিরপেক্ষতা”র শিকার হয়ে গেল। ভারতের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কম্যুনিষ্টরা সমাজকে তাদের মত করে তৈরী করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু ভারতীয় সমাজে ভারতীয় ধর্ম (নিজস্ব কৃষ্টি ও সামাজিক সদ্ভাবনা, religion নয়) এতটাই সুপ্রোথিত যে কম্যুনিষ্টদের এই প্রচেষ্টা তাদের ধৃষ্টতায় পর্যবসিত হল। ফলতঃ কম্যুনিষ্ট দল ও তার মতাদর্শ ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল।
কম্যুনিষ্টদের আরেকটি বড় ভুল অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরতা। এর ফলে শুধু যে কম্যুনিষ্ট দলের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হল তাই নয়, তাদের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষের যোগাযোগ ক্ষীণতর হয়ে গেল। আমাদের দেশের মানুষের অন্তরের অন্তরস্থলে দুটি সত্তা অবিনশ্বর – এক, তাদের নিজ নিজ ধর্ম; দুই, জাতীয়তাবোধ। এর জন্যই ধর্মে মুসলমান হলেও ইকবালের অমর সৃষ্টি, “সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা”। আমাদের দেশের নাম ভারত নয়; হিন্দুস্থান বা হিন্দুস্থাঁ – এই দেশ সকল ভারতীয়ের; শুধু হিন্দুদের নয় বা শুধু মুসলমানদের নয়। কম্যুনিষ্টদের তথাকথিত আদর্শ (!) এই দুই সত্তার মূলেই কুঠারাঘাত করল। তারা হিন্দুধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ ও উপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে গেল। আবার তারা মুসলিমদের তোল্লা দিলেও নিজেরা মুসলমান না হওয়ায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলায় ধর্মভীরু ও গোঁড়া মুসলমানদের কাছে “কাফের”দের পার্টি হয়ে রয়ে গেল। যার ফলে তারা “না ঘরকা, না ঘাটকা” হয়ে রইল। আবার তাদের বৃটিশ তোষণ এবং স্বাধীনতা উত্তর শ্লোগান, “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত, ভুলো মত” তাদের জাতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।
ইতিমধ্যে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ভারতকে দুটি বড়সর বৈদেশিক আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৬২ সালে বিনা প্ররোচনায় চীন ভারতের অনেকটা জায়গা, এমনকি অরুণাচল প্রদেশের বড় অংশ দখল করে নেয়। এই সময় ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির নীতিগত সংকট শুরু হয়। ঐ সময় সোভিয়েট রাশিয়ার তাঁবেদারী করত ভারতের কম্যুনিষ্টরা। তখন শক্তিশালী কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চীন। যেহেতু ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা দেশের স্বার্থের আগে তাদের বিদেশী সাহায্যকারী রাষ্ট্রের স্বার্থ দেখে, কম্যুনিষ্ট চীন এই দেশের কম্যুনিষ্টদের একটি বড় অংশকে রাশিয়ার থেকে সরিয়ে নিজেদের দিকে টানতে সমর্থ হল। কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে নতুন দল – ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তৈরী হল। এই দল নির্লজ্জভাবে চীনকে সমর্থন করে ভারতের বিরোধীতা করে!
এভাবেই বিদেশী প্রভুদের অঙ্গুলীহেলনে ও তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতে রাজনীতি করতে করতে কখন যে এই দেশের কম্যুনিষ্টরা সর্বতোভাবে ভারতের জাতীয়স্বার্থের বিরোধীতা ও ইসলামী জঙ্গীবাদের সমর্থন করার নীতি গ্রহণ করলো, নিজেদের বিনাশের সেই সন্ধিক্ষণ বোধহয় কম্যুনিষ্ট নেতারাও বুঝতে পারলনা। এই নীতির সাম্প্রতিক একটি নিদর্শন হল, কম্যুনিষ্ট ছাত্রনেতার উন্মুক্ত সমাবেশে হুঙ্কার, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” – যা পাকিস্তানের ভারতবিরোধী ইসলামী জঙ্গীদের শ্লোগান।
আত্মঘাতী ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা বিশ্বের অন্যান্য সাফল্য পাওয়া কম্যুনিষ্ট দলের থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। চীনের মত একটি কম্যুনিষ্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত দেশে দল কিভাবে কাজ করে তা অনুসরণ করলেও ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের উপকার হত। কিন্তু “সত্তরের দশককে মুক্তির দশক”এ পরিণত করার শ্লোগানে নেতৃত্ব ভাগ হওয়া এবং কোন নেতা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের কত বেশী চামচাবাজী করতে পারে তার পরীক্ষায় অতি দ্রুত কম্যুনিষ্ট দলগুলি ভেঙ্গে গিয়ে ছোট ছোট স্থানীয় উপদলে পরিণত হল। আবার যদি চীনকেই লক্ষ্য করা যায়, সেখানকার কম্যুনিষ্ট পার্টি কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বৃহত্তর সাধারণ মানুষের ধর্মবোধে আঘাত করেনা। সেখানকার বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরগুলির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ পার্টি পরিচালিত সরকারের উপরেই ন্যস্ত। অথচ সেখানে ইসলামের মাথা চাড়া দেওয়া বরদাস্ত করা হয় না। এর কারন কোন ধর্ম বিরোধিতা নয়, শুধু জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে তা করা হয়। কারন ইসলাম কিন্তু হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের মত নয় – এই ধর্ম মুলতঃ আগ্রাসী ধর্ম। সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষতা কোরান অনুযায়ী একটি বড় পাপ। এর প্রেক্ষিতে আমার এক শিক্ষিত, প্রগতিশীল বন্ধুর মন্তব্য খুব প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যে কোন ধার্মিক মুসলমান প্রগতিশীল হতে পারে, ধর্মীয় সহাবস্থানে থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। এই জায়গাতেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে চীনের ভীতি। তারা জানে, আগ্রাসী কোন ধর্মের মানুষের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঐ দেশের অন্য মানুষদের পক্ষে পরাধীণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মত ব্যাপার। সেজন্যই তারা উইঘুর সমাজের উপর এত ক্ষিপ্ত। দুঃখের কথা, ভারতের কম্যুনিষ্টদের এই বোধটাই নেই। তারা জন্মলগ্ন থেকেই সর্বদা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী কাজ করে! তারা এটা কখনো বিচার করে না যে, একটি দেশ, তা সমাজবাদী হোক বা ধনতান্ত্রিক বা অন্য কিছু, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবোধ ছাড়া তাদের জাতীয় অস্তিত্বই অসম্ভব।
ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা তাদের এমন অদ্ভুত আত্মঘাতী নীতির জন্য প্রথম থেকেই যেহেতু ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে অনেক পিছিয়ে, তারা কৌশল ও জোটবন্ধনের মাধ্যমে ক্ষমতার অলিন্দের বিশেষ জায়গাগুলিতে তাদের নিজেদের মানুষজনকে বসাতে তৎপর। যার জন্য কেন্দ্রীয় বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় তারা বিশেষতঃ শিক্ষা, তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগগুলির গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দিকে নজর দেয়। স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন সময়ের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা সামগ্রী তৈরীতে এই কম্যুনিষ্টদের প্রভাব অনস্বীকার্য। তারা যখন দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারালো তখন
তারা তাদের দর কষাকষির সুযোগ হারালো। আবার দেশের সংবাদমাধ্যম ও তথ্য-সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কম্যুনিষ্ট প্রভাদ বেশী থাকায় তাদের চেষ্টায় কম্যুনিষ্টদের রাজনৈতিক শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে দেখাধোর চেষ্টা হতে লাগলো। আবার সামাজিক মাধ্যম (social media) যত শক্তিশালী হতে লাগলো, কম্যুনিষ্ট প্রচার তত বিরোধীতার মুখে পড়ল। যত কম্যুনিষ্টদের শক্তিক্ষয় হতে লাগলো তত দ্রুত তাদের জনসমর্থন কমতে লাগলো। আর ততই কম্যুনিষ্ট দলগুলি হাস্যকর শ্লোগান আউরানো একদল ধান্দাবাজ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করল। এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক বড় কারন হল, দুটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা, এই দুটিতেই কম্যুনিষ্ট শাসনে রাজ্যের মানুষের দুর্দশা বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এদের রাজ্য শাসনে ব্যর্থতা প্রকট হয়েছে। একমাত্র কেরালাতে কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতায় আছে। তার কারন, সেখানকার নির্ণায়ক ভোট যা মুসলিম ও হিন্দু-বিরোধী খৃষ্টানরা মিলিতভাবে কম্যুনিষ্টদের দেয়। এতে করে দেশবিরোধী নীতিতে হয়ত কেরালার মত রাজ্যে সাময়িক ভোট রাজনীতিতে ক্ষমতায় টিঁকে থাকা যায়; কিন্তু সর্বভারতীয়স্তরে সমস্ত কম্যুনিষ্ট দলগুলি তাদের স্বীকৃতি হারিয়েছে বা হারানোর মুখে দাঁড়িয়েছে।
কম্যুনিষ্টদের যদি ভারতের মাটিতে রাজনীতি করে টিঁকে থাকতে হয়, তবে তাদের ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব ছেড়ে জাতীয়তাবাধী শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। বস্তাপচা সমাজতান্ত্রিক শ্লোগান, ভারতবিরোধী ও হিন্দুধর্ম বিরোধী অবস্থান পরিবর্তন ও আশু প্রয়োজন। এতে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা কমবে এবং কম্যুনিষ্টরা ভারতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। নাহলে শুধু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রেরমধ্যে সুবিধাবাদী রাজনীতি করে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ত দুরের কথা, বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম সাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানকার দূর্গাপুজায় ভাঙ্গচুর, ধর্মীয় কারনে হিন্দুহত্যা ও সম্পত্তি লুঠপাটের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের সরকার এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেও ঘটনার প্রকৃত তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদসহ সকল সংখ্যাগুরু (অবশ্যই মুসলমান) সংবেদনশীল মানুষজন এবং বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদে সোচ্চার। এসময়ে ভারতের কম্যুনিষ্টরা হয় মৌণব্রত অবলম্বন করেছেন বা অর্ধশিক্ষিত কমরেড জানাচ্ছেন ভারতের মুসলমানদের কষ্টের কথা। এভাবেই অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত কম্যুনিষ্ট নেতারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই নিজেদের অপাংক্তেয় করে তুলেছেন।
কম্যুনিষ্টদের ধ্বংসের কারন দেশবিরোধী দ্বিচারিতা
