করোনা বা সার্স-কোভ-২ এখনো জিন মিউটেশানে পরিবর্তন ঘটিয়ে তার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাসের মানবদেহে আক্রমণ করার ক্ষমতার প্রথম প্রমান আমরা পাই চীনের ইউহান প্রদেশে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ইউহানের বিশ্ববিখ্যাত ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের একটি বিশেষ ল্যাব থেকে। এই ল্যাবের তিনজন বিজ্ঞানীর দেহে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের উপসর্গ দেখা যায়। এরা সকলেই করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন। সুতরাং এই ভাইরাসটি ল্যাবোরেটরী সৃষ্ট কিনা, সে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। এই ভাইরাসের সংক্রমণকে অতিমারী আখ্যা দেওয়া হয়েছে আর এর সংক্রমণে ইতিমধ্যেই ত্রিশ লক্ষের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই অতিমারীর জন্মস্থান অর্থাৎ ইউহানের ঐ ল্যাবের প্রথম সংক্রমণের জায়গাটা এখনো, দু বছর বাদেও গভীর রহস্যে ঢাকা। এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টায় আমি বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপরই নির্ভর করে থাকছি। যে তথ্যগুলি পাওয়া যাচ্ছে তা একসঙ্গে গ্রোথিত করে পুরো ব্যপারটা উত্থাপনের চেষ্টা করছি।
মোটামুটিভাবে দুটি প্রারম্ভিক সংক্রমণের সূত্রপাতের তত্ত্ব সামনে এসেছে। প্রথম, এটি প্রাকৃতিকভাবে বাদুরের থেকে কোন পশুর মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকেছে! এই তত্ত্বকে তড়িঘড়ি WHO মান্যতা দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হল, যখন ভাইরাসটি গবেষনাগারে পরীক্ষার স্তরে ছিল, সেই সময় পরীক্ষা নিরীক্ষার ফাঁকে ভাইরাসটি গবেষণাক্ষেত্র থেকে পালায়। ভাইরাসের এই ধরনের পলায়ন (escape) খুবই দুর্লভ হলেও অসম্ভব নয়। তবে, lancet জার্নলে যে চিঠি প্রকাশ নিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড়, সেই বক্তব্যের সারবত্তা ও চিঠি লেখার নেপথ্য কারন নিয়ে ভাবার কথা। চিঠির বয়ান দেখলেই বোঝা যায়, এর ছত্রে ছত্রে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে যে চীনের ঐ ল্যাবোরেটরীতে কখনোই ভাইরাসটিকে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গবেষণা করা হচ্ছিল না! ডঃ পিটার ডাসজেকের নেতৃত্বে ২৭ জন বিজ্ঞানী ও ডাক্তার ঐ চিঠিটা লেখেন। যে মার্কিন সংস্থা ইউহানের ঐ গবেষণাকেন্দ্রে গবেষণা করার জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে, সেই সংস্থার চেয়ারম্যান হলেন ডঃ ডাসজেক। এছাড়া, আরেকজন স্বাক্ষরকারী জেরেমি ফারার, যিনি ইংল্যান্ডের ওয়েলকাম ট্রাষ্টের ডিরেক্টার। এমন অনেকেই আছেন যারা স্বাক্ষরকারী এবং তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ইউহানের ঐ গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত। মনে রাখতে হবে, এটি lancetএ প্রকাশিত একটি চিঠি মাত্র। কোন গবেষণাপত্র নয়। এটিকে গবেষনাপত্রের মর্যাদা দেওয়া ভুল। একটি চিটি, স্বাক্ষর ২৭ জনের! এদের অধিকাংশেরই বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকে নজর রেখে চিঠিটি লেখা হয়েছে এমন ধারনা অযৌক্তিক নয়। কারন, ভাইরাসটিকে জৈব অস্ত্র তৈরীর গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে, এমন প্রমাণ হলে শুধু চীনের সরকারই নয়, ইউরোপ, আমেরিকার যে প্রতিষ্ঠানগুলি এইসব প্রজেক্টকে আর্থিক সহযোগীতা করেছে, তারাও বিশ্বের কাছে অতিমাত্রায় নিন্দিত হবে এবং সমালোচনার জেরে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এমনকি তারা কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। সেজন্য তারা তথ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে, করোনা ভাইরাসকে গবেষণাগারের ভাইরাস বলার তত্ত্ব সাত তাড়াতাড়ি খারিজ করে চিঠি লিখেছে। আবার বলছি, এটি যেহেতু একটি চিঠি মাত্র, lancetএ ছাপার মাহাত্য এই চিঠির সঙ্গে যুক্ত করা যায় না।
এটা ঠিক যে করোনা ভাইরাসের মত একই ধরনের অনেক ভাইরাস জংলী বাদুরদের মধ্যে দেখা গেছে। সুতরাং বাদুর স্বাভাবিকভাবেই এই ভাইরাসের একটি সোর্স হতে পারে যা অন্য কোন পশুর মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে SARS ও MERS এর সোর্সও এই বাদুর। Shan-lu-liuর নেতৃত্বে ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, করোনা ভাইরাস একটি জৈব অস্ত্র হওয়ার মত তথ্য তারা এখনো পাননি। ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিং কয্বরে দেখা গেছে যে, এর সিকোয়েন্সিংএ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর কোন লক্ষণ নেই – যা জৈব অস্ত্র তৈরীতে অবশ্যই থাকতে হবে।
এরপর আসি অন্য সম্ভাব্য বিকল্পগুলিতে। প্রথমটি হল, স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে এমন কান্ড বাধিয়েছে। এখানে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর মিলছে না। প্রথমতঃ, ইউহানের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের যে ল্যাবের যে তিনজন বিজ্ঞানীর (তাঁরা সবাই এখন মৃত) প্রথম করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়, তাঁরা সবাই এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন। অন্য যে খবরে বলা হয়েছে যে মাংসের বাজার থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে, তার সত্যতা খুবই লঘু কারন আক্রান্তদের সবাই ঐ বাজারের মাংস কেনেন নি – অথবা অন্য মানুষজন প্রথম আক্রান্ত হননি। আবার চীন সরকারপ্রথম থেকে এই সংক্রমণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরী করে; শুধু তাই নয়, তারা প্রথমদিকে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে বাধা দেয়। এতেই বোঝা যায়, “ডালমে কুছ কালা হ্যায়”। পরে অবশ্য WHOর প্রতিনিধিদের অনুমতি দেওয়া হয়। তখন চীনা কর্তৃপক্ষ অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। এতে বোঝা যায়, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত পরিস্থিতি সামলানোর মত রসদ ও বিদ্যা দুইই তাদের জানা ছিল। সুতরাং এই ভাইরাস জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত নাহলেও, এর ব্যবহারের গবেষণা যে ঐ ল্যাবে হচ্ছিল তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনো অব্দি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোন জোরালো প্রমাণ পেশ করা যায়নি। উপরন্তু, পারিপার্শিক প্রমাণ এই তত্ত্বের পক্ষেই যাচ্ছে। যেমন, ভাইরাসের সংক্রমণের চিকিৎসায় চীন অতি অল্প সময়ে যে অভূতপূর্ব সাফল্য পেল তার শতাংশের একাংশও অন্য কোন দেশ পায়নি। এটা সম্ভব হয়েছে কারন তারা এই ভাইরাসের সম্পর্কে ও তার আক্রমণের ব্যপারে আগে থেকেই সতর্ক ছিল, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা আগে থেকেই করা ছিল।নাহলে একটি সম্পূর্ণ অজানা RNA ভাইরাসের সংক্রমণ এত অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব। আর এই জন্যই প্রথম অবস্থায় চীন তাদের দেশে কোন রকম অনুসন্ধানী দলকে প্রবেশ করতে দেয়নি। বিশেষতঃ ইউহানের ঐ ইন্সটিটিউট সম্পূর্ণভাবে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
আবার দেখা যায়, চীনের তৈরী প্রতিষেধক টীকা তাদের তাঁবেতে থাকা কয়েকটি দেশ ছাড়া অন্য কেউ নিচ্ছে না। কিন্তু চীন এই টীকায় নাকি প্রভূত সাফল্য পেয়েছে! এই প্রতিষেধকের গবেষণার ব্যপারে সারা বিশ্ব অন্ধকারে! যদি ল্যবে কোন দুর্ঘটনাজনিত কারনে এই ভাইরাস বেরিয়ে পড়ে তবে তার প্রতিষেধক তখনই তৈরী রাখার কথা। এই ধরনের গবেষণায় এই দিকটাও খেয়াল রাখতে হয়। ফলে, প্রথমে দ্রুত ছড়ালেও, ভাইরাসের প্রকৃতি ও গঠন সম্পর্কে ধারনা থাকায় এবং প্রতিষেধক প্রস্তুত থাকায় চীন এত কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমণ সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
এবার আসি কেন ‘জৈব অস্ত্র’ তত্ত্ব পুরোটা ঠিক নয়, সেই যুক্তিতে। প্রথম হচ্ছে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর প্রমাণ এই ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্সিংএ মেলেনি। কিন্তু এমন ত হতে পারে, এই জৈব অস্ত্র তৈরীর গবেষণার অন্তিম পর্যায়ের আগেই ভাইরাস পলায়ণ করে সব গোলমাল করে দিয়েছে। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে চীনের বাণিজ্যিক বাজারের বড় খদ্দের আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারত। এর মধ্যে প্রথম ধাক্কাতেই যদি আমেরিকা ও ইউরোপের বাজার নষ্ট হয়, সঙ্গে ভারতের বাজারও যদি যুক্ত হয়, চীনের অর্থনীতি নিশ্চিতভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে। সুতরাং, এই ভাইরাসের সংক্রমণকে এই মূহুর্তে জৈব অস্ত্রের আক্রমণ বলা ঠিক হবে না। কিন্তু দুর্ঘটনা তত্ত্বের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আবার জৈব অস্ত্র যদি কোন দেশ, যেমন ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তবে তার যে সূদুরপ্রসারী প্রভাব দেখা গেছে তাতে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কিন্তু এর ধ্বংসলীলা থেকে বাদ যাবে না। এর মধ্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১১৫.৭ বিলিয়ন USD (যা ঐ দেশের GDPর অর্ধেক)। এর মধ্যে চীনের কাছে অর্থনৈতিক করিডোর বাবদ ঋণ ১৭.১ বিলিয়ন USD যা বৈদেশিক ঋণের ১৫%। সুতরাং এমন একটি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাওয়া বশংবদ দেশের ক্ষতি চীন করবে না। আবার বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৭০.৭ বিলিয়ন USD যা গত এক বছরে ১৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটি বড় অংশ ঋণ চীনের দেওয়া। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষতিও চীন করতে চাইবে না। সাধারণত জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে। এমন অবশ্য অস্বাভাবিক নয়, পারমানবিক বোমার বিকল্প হিসেবে এই জৈব অস্ত্র তৈরীর প্রক্রিয়া চলছিল। তবে কোনোমতেই এটি সম্পূর্ণ ‘জৈব অস্ত্র’ নয়। কারন এর উদ্ভাবক দেশ প্রতিষেধক সম্পূর্ণ প্রস্তুত না করে এর প্রয়োগ করবে না।
এখন চীনের সঙ্গে ভারতের যে বর্ডার সমস্যা চলছে, যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের অবমূল্যায়ন হয়েছে, তা মাথায় রেখে বলা যায় যে চীন ভারতকে ‘সমঝে দেওয়ার’ মত উপায় পেলে তা প্রয়োগ করবেই। আর ভারত মহাসাসাগর ও চীন সাগর নিয়ে চীনের চিন্তার শেষ নেই। তাদের বহির্বাণিজ্যই শুধু নয়, খনিজ তেল আমদানির জন্যও এই দুটি অঞ্চলের উপর তার প্রাধান্য বিস্তার করার দরকার। এখানে অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানের সাথে ভারতই প্রধান বাধা। কাজেই ভাইরাসের আকস্মিক পলায়নকে কাজে লাগিয়ে চীন সংক্রমণকে নিজের দেশে আয়ত্তে আনলেও অন্য দেশগুলি, বিশেষতঃ উন্নত দেশ এবং অধিক জনঘণত্বের দেশগুলি বিপদের মুখে পড়েছে। এর থেকে বাঁচার রাস্তা দ্রুত টীকাকরণ। কিন্তু একশ ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে দ্রুত টীকাকরণ মোটেই সহজ কাজ নয়। সেছন্য চীন ইউহান ল্যাবোরেটরী থেকে যে RNA ভাইরাস পালিয়ে গেছে তার ব্যপারে নিজের অধিগত জ্ঞান বিশ্বের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করে গেছে।
এখনো অব্দি বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তারদের দল এমন অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেনি যে এই ভাইরাসটি প্রাকৃতিক উপায়ে বাদুর থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। বরঞ্চ ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষনে প্রমান হয় যে এটি ল্যাবোরেটরীতে পরীক্ষা করার জন্য নেওয়া একটি RNA ভাইরাস – যার আকস্মিক পলায়নের সুযোগ পুরোপুরিভাবে চীন নিয়েছে এবং তার অন্তিম লক্ষ্য ভারতকে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলা। সেইজন্য করোনা রোগের জন্য দায়ী এই ভাইরাসকে আমরা অন্য কোন নাম না দিয়ে “ইউহান ভাইরাস” নামকরণ করতে পারি
করোনাকে ইউহান ভাইরাস বলাই ঠিক
