"মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী" - কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আজ সারা দেশের সঙ্গে আমাদের পশ্চিমবঙ্গকেও ছারখার করে দিচ্ছে। প্রত্যেকদিন সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে কোভিডে মৃতের সংখ্যা দেড়শোর আশেপাশে। এবারের যে ঢেউ প্রবহমান তা একটি বৈশিষ্ট্য হয়ত অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। সেটি হল আক্রান্তের সংখ্যা মফস্বল ও প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারন হল দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তারকালে বিধানসভার নির্বাচন। হ্যাঁ, ঠিক তাই। আর এরজন্য নিঃসন্দেহে বড় এবং স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলি দায়ী। তবে, সবচেয়ে বেশী দায় আমাদের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের। কোভিডবিধি না মানলে এই রোগের সংক্রমণ আটকানো অসম্ভব। হ্যাঁ, যে রাজ্যে নির্বাচন হয়নি, তেমন রাজ্য যেমন, মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ বেশী হয়েছে। কিন্তু তার কারন ভিন্ন। যদি তামিলনাড়ুর দিকে তাকানো যায়, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণ বেড়েছে অসমেও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত আট দফায় তাদের নির্বাচন হয়নি। তামিলনাড়ুতে এক দফা এবং অসমে তিন দফায় নির্বাচন হয়েছে। সেখানে এত হাই ভোল্টেজ প্রচারও হয়নি। মিটিং, মিছিল, জনসমাবেশ - মানুষের ভিড়ে সারা রাজ্য জুড়ে কোভিডবিধি শিকেয় উঠেছে। কোন রাজনৈতিক নেতাই এই বিধি মেনে প্রচার করেননি, আর সাধারণ মানুষকেও মেনে চলতে বলেননি। নেতাদের মধ্যে আক্রান্তরা ভিআইপি চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে যান সাধারণ মানুষ আম আদমী ঠাকুরের দয়ায় বাঁচে বা ছবি হয়ে যায়। কত মানুষ অক্সিজেন না পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে; কোন ভিআইপি রাজনীতিক অক্সিজেনের অভাবে দেহ রেখেছেন - এমন কোন অভিযোগ নেই। এখানেই ছিল নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। তাদের নির্বাচন সংঘটনের সর্বময় ক্ষমতা থাকায় তারা কোভিডবিধি মেনে নির্বাচন করার সমস্ত রকম ব্যবস্থা যাতে মেনে চলা হয় তা দেখতে পারত।
আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনের জন্যই যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যার এমন বৃদ্ধি তার প্রমাণ কি? উত্তর হল, কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় যেসব গ্রাম-গঞ্জ, মফস্বল শহর তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি, সেখানেও নির্বাচনের মিটিং মিছিল, সমাবেশের পর আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে অনেক বেড়েছে। গত শীতের সময় নিউ নর্মালে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের মানুষজনের মনে ধারনা হয়েছিল যে কোভিড বিদায় নিয়েছে। তারপর, নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মিটিং মিছিল, কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের ভিভিআইপি নেতা নেত্রীদের হাই ভোল্টেজ সমাবেশ, পদযাত্রা - সবই মানুষ দেখল। এখন সেখানে স্থানীয় হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে কোলকাতায় আনতে হচ্ছে। অনেককে চিরতরে বিদায় দিতে হয়েছে। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, মালদা - যেসব জায়গায় এই ধরনের মিটিং মিছিল, জমায়েত হয়েছে, তার অধিকাংশ জায়গাতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ বহুগুণ বেড়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর নিউ নর্ম্যালে ঘোষণা করেছিল যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা করোনামুক্ত জেলা।তারপর ভোটের জাঁতাকলে পড়ে সেখানেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে শুধু আক্রান্তই নয়, মৃত্যু ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপারে দাঁড়িয়েছে। জেলাগুলির মধ্যে প্রথম থেকেই খারাপ অবস্থা ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার। এই ভোটপর্বের পর সেই জেলা প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যার শীর্ষে থাকছে। যদিও তারপরেই স্থান কোলকাতার, এখানে কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ যখন মিটিং মিছিল, জমায়েত সব কিছুই বাড়তে শুরু করেছে, তখনই আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। অন্যান্য এলাকাও পিছিয়ে নেই। সুতরাং এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের অতিবৃদ্ধির একটি বড় কারন যে নির্বাচনী প্রচারের সময় কোভিডবিধি না মানা - সে সন্দেহ অমূলক নয়।
এখানে একটি তথ্য দিলে এই যুক্তির সপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যাবে। প্রথম ঢেউয়ের সময় রাজ্যের গ্রাম-গঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল খুবই কম - মোট আক্রান্তের ৫-৭ শতাংশ মাত্র। কিন্তু ভোটের পর এই সংখ্যাটা পৌঁছে গেছে ২৩ শতাংশে! একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে এইসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোটের যে জমায়েত, মিটিং মিছিল হয়েছে তাতে কোভিডবিধি পালনের লেশমাত্র ছিলনা। আবার, এইসব দূরবর্তী অঞ্চলে চিকিৎসা পরিষেবার মান অত্যন্ত খারাপ থাকায় আক্রান্তদের একটি বড় অংশ কার্যকরী চিকিৎসা পাচ্ছেনা। এমন অনেকের মৃত্যু হচ্ছে, যারা হয়ত ঠিক চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেত।
এদিকে যত সময় যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে ভাইরাস তার আক্রমণের গতির পরিবর্তন করছে। এটি কোভিডের মত RNA ভাইরাসের পক্ষে স্বাভাবিক। এই সময় দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিককে যত দ্রুত সম্ভব, টীকাকরন করে সম্ভাব্য সুরক্ষা দেওয়া আশু কর্তব্য ছিল। মনে রাখতে হবে, এটি WHO দ্বারা ঘোষিত "অতিমারী"। আর আক্রান্তের নিরিখে ভারত আছে দ্বিতীয় স্থানে। আমেরিকা প্রথম স্থানে। তাদের ১৬% নাগরিকদের টীকাকরন সম্পূর্ণ হয়েছে। ভারতের ১% নাগরিকের সম্পূর্ণ টীকাকরন পর্যন্ত এখনো হয়নি। এই অবস্থায় আমরা নির্বাচনের পিছনে অযথা অনেকটা সময় ও অর্থ ব্যায় করে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইকেই ঘোরালো করে তুললাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, একবার নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে তা স্থগিত করা যায়কি? এছাড়া এই সংক্রান্ত আরো যেসব প্রশ্ন থাকবে তার সবেরই উত্তর আমাদের সংবিধানে বলা আছে।
প্রথমেই বলি, ভোট যদি অতিমারীর মত অভুতপূর্ব বা অশ্রুতপূর্ব পরিস্থিতিতে করানো সম্ভব না হয় ( জনসাধারণের স্বাস্থ্য ও জীবনের সুরক্ষা মাথায় রেখে ) তাহলে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সময় হয়ে গেলেও, নির্বাচন স্থগিত রাখতে পারেন। এমনকি নির্বাচনের পর্যায় শুরু হলেও পরবর্তী পর্যায়গুলি স্থগিত করা যায়। অতীতে এর উদাহরণ আছে। কোন নির্বাচিত সরকার তার সময়কাল অতিবাহিত করার পর রাজ্যের শাসনভার কি পুরানো সরকারের হাতে থাকবে না অন্য কারো হাতে? এ সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান আছে। তাহল, রাজ্যপাল ঠিক করবেন, তাঁর সরকার আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে কিভাবে পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পুরানো উদাহরণ আছে। তা উল্লেখ করলে হয়ত গত নির্বাচনে সাইনবোর্ডে পর্যবসিত হওয়া দুটি সহযোগী দলের বিড়ম্বনা বাড়বে। তাই সে চেষ্টায় বিরত থাকলাম। কাজেই নির্বাচন নির্দিষ্ট সময় করতেই হবে বা নির্বাচন চলাকালীন তা স্থগিত করা যাবেনা এমন কোন আইনি বা সংবিধানগত বাধা নেই। তবে, নির্বাচন কমিশন কোন রাজনৈতিক চাপে কাজ করে থাকলে তা একমাত্র কমিশনই বলতে পারবে। এব্যপারে আমাদের ধারনার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং এই অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা বৃদ্ধির দায় নিশ্চিতভাবেই যেসব প্রতিষ্ঠানের উপর পরবে তার অন্যতম নির্বাচন কমিশন।
আবার কেমন অদ্ভুত ব্যপার - নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে ভোট প্রচারে কোভিডবিধি মেনে চলতে হবে। শুধু বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শেষ হয়না। সেই বিজ্ঞপ্তি যথাযথ পালিত হল কিনা, না হলে কমিশন কি কি পদক্ষেপ করল - সবই তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার ত একটি ঘটনাও মনে পড়েনা যেখানে নির্বাচন কমিশন কোভিডবিধি না মানার দায়ে প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন! যখন ভোটপর্ব শুরু হল,ভোট কেন্দদের লাইনে আমার অন্ততঃ দু গজের দুরত্বে ভোটারদের লাইন দেওয়ার ব্যপারটা চোখে পড়েনি। হ্যাঁ, দুরত্ব ছিল, ছয় থেকে আট ইঞ্চি! প্রমাণ হিসাবে ঐ সময়ের টিভি ফুটেজগুলি দেখলেই হবে। আবার দেখুন, নির্বাচন কমিশন অশীতিপর ভোটারদের জন্য নিজের বাড়িতে বসে ভোটদানের বড্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ঐসঙ্গে তাঁদের বাড়িতে টীকাকরন প্রক্রিয়াটি ও করানো উচিৎ ছিল - যেমন ভোটকর্মীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থায় টীকাকরন করা হয়েছে। এছাড়া ভোটকক্ষের মধ্যে হাতে কালি লাগানোর সময় বডি কন্ট্যাক্ট অবশ্যম্ভাবী। ভোটের মেশিনে আঙুলের চাপ দেওয়া, ভোটার লিষ্টে সই করা বা টিপছাপ দেওয়া - কোনটাই দৈহিক কন্ট্যাক্ট ছাড়া হয়নি। এমন প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায় যেখান থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং ভোট প্রক্রিয়ায় কোভিড সংক্রমণের কারনগুলি অবশ্যই আছে।আর এই আট দফায় ভোট হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গও সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভোট প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ায় শুধু যে কোভিডের দ্বিতীয় সংক্রমণ গতি পেয়েছে তাই নয়, আমাদের ভাবার সময় এসেছে এই প্রক্রিয়া কি আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লড়াই নাকি 'গণতন্ত্র' নামের এক অচলায়তনের রাজনৈতিক উৎসবের বিয়োগান্তক সফল রূপায়ণ, যার লাভ রাজনীতি ও রাজনৈতিকদের, ক্ষতি অতিমারীর বৃদ্ধিতে সমাজের। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির একটি মূল স্তম্ভ নির্বাচন কমিশন। সেই স্তম্ভই যদি রাজনীতির স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়, তাহলে গণতন্ত্রের অবক্ষয় আটকাবে কে! এখানে জর্জ অরওয়েলের অ্যনিম্যাল ফার্মের একটি লাইন খুব মনে পড়ছে, "In democracy, all are equal; but some are more equal than other equals"। এই নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তাদের জীবন, জীবিকার বিনিময়ে প্রমাণ করে দিল সমাজবদ্ধ গণতান্ত্রিক মানুষ বেঁচে আছে রাজনীতির জন্য, রাজনীতির স্বার্থে, রাজনীতির কাছে বলিপ্রদত্ত হিসাবে।