করোনা অতিমারীর শেষ কথা

করোনায়িত বিশ্বে শান্তি আসুক নেমে। ১লা এপ্রিল, ২০২২ থেকে করোনা সংক্রান্ত সমস্ত রকমের বিধিনিষেধ, যেগুলো কেন্দ্র ও রাজ‍্য সরকার থেকে লাগু করা হয়েছিল, তা উঠে গেল – করোনার থাবা মোটামুটিভাবে চলে গেছে বলা যায়। ১৯১৮-২০ সালের প্লেগের পর দেশে এত মানুষের আক্রান্ত ও মৃত‍্যু খবর জানা নেই। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত প্রায় ৪৯ কোটি মানুষ, যার মধ‍্যে মৃত‍্যু হয়েছে ৬১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ আর মৃত‍্যু হয়েছে ৫ লক্ষ ২২ হাজার মানুষের। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ‍্যা দুটি যথাক্রমে ২০ লক্ষ ২০ হাজার ও ২১ হাজার ২০০ জন। অতি স্তিমিত হয়ে পড়ে যেতে যেতে করোনা হয়ত এই সংখ‍্যাটা অল্প বাড়িয়ে যাবে! বিশ্বব‍্যাপী বিপর্যয়ের আঁচ যখন আমাদের দেশে পড়েছে তখন, বিশেষতঃ কিছু বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ‍্যম মানুষের দুঃখ দুর্দশার ছবি দেখানোর সাথে সাথে কল্পিত ভয় – হরর সিনেমা দেখানোর মত – প্রচার করেছে। তাতে মদত দিয়েছেন ঐসব সংবাদ-মাধ‍্যম দ্বারা ঘোষিত বিশেষজ্ঞের দল! তারপর অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিষ্পেষিত মানুষকে আশার বাণী শোনানোর পরিবর্তে এইসব planted ‘বিশেষজ্ঞ’রা লকডাউনের কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধের বেড়ি পরিয়ে যত মানুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, তত অত‍্যাবশ‍্যকীয় পণ‍্যসামগ্রীর দাম সহ সমস্ত পণ‍্য ও সার্ভিসের বাজার দর ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী হয়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন – রোজগার কমেছে অধিকাংশ মানুষের। শুধু রোজগার বেড়েছে মুনাফাখোর আর ঐ সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির। তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের রোজগার বেড়েছে বৈ কমেনি! সাধারণ মানুষের অশেষ দূর্ভোগের পরেও এইসব সংবাদ-মাধ‍্যম এমন তথ‍্য পরিবেশন করছে যে, মনে হয়, ওমিক্রনের পর আরো মারাত্মক করোনা ভ‍্যারিয়েন্ট আমাদের কাবু করতে ছুটে আসছে! এর কারন একটাই – ভীতির পরিবেশে অর্থনৈতিক শোষণ সুবিধার – সঙ্গে প্রচারকদের “কাটমানি”। এই কারনেই করোনা ভাইরাসের সঠিক বর্তমান পরিস্থিতি ব‍্যাখ‍্যা করার উদ্দেশ‍্যে এই লেখার অবতারনা।
RNA ভাইরাসের বৈশিষ্ট অনুযায়ী করোনা ভাইরাস যত মিউটেশান করবে তত তার মারণ ক্ষমতা কমবে ও সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে – একথা একাধিকবার আলোচনা করেছি। সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ার অর্থ কিন্তু ক্ষতি করার ক্ষমতা বাড়া নয় – এই বৈজ্ঞানিক সত‍্যকে বহুল প্রচারিত সংবাদ-মাধ‍্যমগুলি ভালোভাবে প্রচার করেনি।
আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের টীকাকরণ হয়ে গেছে। তাছাড়া, সজ্ঞানে (পরীক্ষায় প্রমাণিত) বা অজ্ঞানে (পরীক্ষা না করা) সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন – তা যে কোন মিউটেড ভ‍্যারিয়েন্ট হোক না কেন। এর ফলে তাদের দেহে করোনা ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে – যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাভাবিক। আবার করোনা আক্রান্ত হোন বা না হোন, যাদের টীকাকরণ শুরু হয়েছে, তাদের দেহের টি-লিম্ফোসাইট কোষের বৃদ্ধির ফলে কোষের মধ‍্যস্ততায় যোঝার শক্তি (immunity) বেড়ে গিয়ে ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ‍্যান্টিজেনকে নষ্ট করতে অধিকতর সক্ষম হয়। তাছাড়া, বি-লিম্ফোসাইট, যা মূলতঃ বোনম‍্যারোতে পাওয়া যায়, একটি অবিযোজিত (adaptive) যোঝার শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। এই শ্বেত কণিকার মধ‍্যস্ত কোষগুলি ভাইরাসের অ‍্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায‍্য করে। সেইসঙ্গে টি-লিম্ফোসাইট যে বিশেষ কোষ নির্দেশক সাইটোকাইন মোচন করে তা ভাইরাস ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অর্থাৎ একজন টীকা নেওয়া মানুষের করোনা ভাইরাসের সঙ্গে শুধু লড়াইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, ভাইরাসকে ধ্বংস করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, টীকাকরনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে যোঝার শক্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনই ৭০% মানুষের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারনে গোষ্ঠীসংক্রমণে সমাজে herd immunity তৈরী হওয়ায় দ্রুত করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই জয়ী হয়েছে। আবার যেকোন RNA ভাইরাসের এই ভাইরাস যখন মানবদেহে ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা হারাবে, তখন তারা মানবদেহ ছেড়ে আবার পশুদেহে আশ্রয় নেবে এবং ক্রমশঃ সুপ্ত (dorment) অবস্থায় চলে যাবে। আমরা এই মূহুর্তে শেষের অবস্থায় আছি। সুতরাং, বিপর্যয় কেটে গেছে, তা বলাই যায়। অবশ‍্য, ঠিকমত স‍্যানিটাইজ করা এবং স্বাস্থ‍্যবিধি পালন করে যাওয়া আবশ‍্যক – এর বড় কারন হল, এর ফলে বি-লিম্ফোসাইট শক্তিশালী হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, করোনা অতিমারীর প্রভাব এখন বিলীন হওয়ার পথে। কিন্তু, লক্ষ‍্য করলে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে অতিমারীর যে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তার সংক্রমণ ক্ষমতার শক্তি আলোচনা করে জনসাধারনকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের অশুভ প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
আবার অতিমারী ও লকডাউনের অজুহাতে ঊর্ধমূল‍্যের বাজারে দ্রুতগতির মূল‍্যবৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে, বিশেষতঃ বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের কারনে মানুষের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখনএভাফে মানুষকে ভয় দেখানো অত‍্যন্ত ঘৃণ‍্য কাজ।
এখানে একটি কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না – রিজেনারেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিক‍্যাল প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারত তথা আমাদের রাজ‍্যের ক্লিনিশিয়ানদের যথেষ্ট অনীহা আছে। বৈজ্ঞানিক সত‍্য যে, বি-লিম্ফোসাইটের মধ‍্যে হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষ থাকে। এই কোষের বাইরে থেকে সংগ্রহ করার একটি সূত্র হচ্ছে কর্ড ব্লাড। আমাদের রাজ‍্যে সরকারী কর্ড ব্লাড ব‍্যাঙ্ক থাকলেও বহু বছর ধরে তার ব‍্যাবহার করা হয়নি। এর কারন না জানা থাকলেও এটা বলাই যায় যে এভাবে টাকা নষ্ট করার কোন যুক্তি নেই।অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগে কর্ড ব্লাড হয়ত বি-লিম্ফোসাইট বৃদ্ধি করে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। এত জ্ঞান দেওয়া সবজান্তা সাংবাদিককুল কখনো এ ব‍্যাপারে ডাক্তারবাবুদের প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখাতে পারেননি।
এবার শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রেও অর্থনীতির উপর করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আঘাত আসতে শুরু করেছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি পেট্রোল, ডিজেলের দাম লিটারে দশ পয়সা বাড়লে নোটে শাকের আঁটির দাম দশ পয়সা বেড়ে যায়! সেই ট্র‍্যাডিশান সমানে চলেছে। আবার সব পণ‍্য ত বটেই, এমনকি সমস্ত রকম পরিষেবা জিএসটির আওতায় আনলেও একমাত্র পেট্রোল-ডিজেলকে অতিমারী পরবর্তী পর্যায়েও জিএসটির বাইরে রাখা হয়েছে। এর দায় কেন্দ্র, রাজ‍্য উভয় সরকারের। সুতরাং পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন‍্য রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদী আন্দোলন জনগণকে ধাপ্পা দেওয়ার মতলব। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ভোটের ইস্তাহার প্রকাশের সময় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটায়। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো দলের ঘোষিত ইস্তাহারে পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। জনসাধারণকে শোষণ করার এ এক ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়া। বাজার অর্থনীতিতে এই বিষক্রিয়ার ফল ফলতে শুরু করেছে।পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনঅত‍্যাবশ‍্যকীয় সামগ্রীর চাহিদা সাধারন নিয়মেই এখনকার পরিস্থিতিতে বাড়ার কথা। আবার, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হয়ে পড়ায় চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের রাজ‍্যে মূল‍্যস্ফীতি সরাসরি না হয়ে এখন নিশ্চলতা-স্ফীতি (stagflation) চলছে। সরকার যদি সাধারন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়াতে না পারে তবে এই অচল অবস্থা থেকে রাজ‍্যের অর্থনীতি অপ্রতিস্থাপনযোগ‍্য তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে।
এর লক্ষণ এখনই সমাজে পরোক্ষভাবে হলেও, দেখা যাচ্ছে। চারদিকে হিংসা, হানাহানি, অসামাজিক কাজকর্মের অতিবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। এক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি যেন প্লেগ পরবর্তী বৃটিশ সরকারের উদাসীনতাকেই মনে করায়। করোনা অতিমারীর ফিরে আসা ও পুনরায় লকডাউনের অবৈজ্ঞানিক সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, চাহিদা-যোগান-ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখার প্রয়াসকে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *