৪৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা সবে শেষ হল। ১৯৭৬ সালে ময়দানে এখনকার মোহরকুঞ্জে প্রথম বইমেলা শুরু হয়। এটি প্রথমে ছিল কলকাতাস্থিত পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স গিল্ডের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই মূহুর্তে বইয়ের সম্ভারে এই আন্তর্জাতিক বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডনের বইমেলার পরেই। অবশ্য জনসমাগমের হিসেবে কুড়িলক্ষের বেশী হওয়ায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক বইমেলা।
আমি ১৯৭৬ সাল থেকে টানা প্রায় ত্রিশ বছর প্রতিটি বইমেলায় উপস্থিত থেকেছি। মেলার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ করে বই পড়া ও কেনার আনন্দ উপভোগ করেছি। মনে আছে, ১৯৭৮ সালে, ভারতীয় আর্কিটেকচারের উপর একটি মূল্যবান প্রামাণ্য বই এক স্টলে রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কেউ আমায় বাধা দেয়নি – কেউ এগিয়ে এসে বলেনি বইটা দেব; অর্থাৎ, “না কিনলে সরে পরুন” গোছের ভাব – যা পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে। মেলার শেষ দিনে বইটা পড়ে যখন যথাস্থানে রাখছি, একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আপনার পড়া শেষ হল?” আমি তৃপ্তির হাসি নিয়ে বললাম,”হ্যাঁ”। উনি হেসে বললেন,” আমরা লক্ষ্য করেছি, আপনি রোজ এসে বইটা পড়েন। আপনার সুবিধার জন্য আমরা এই বইটা একই জায়গায় রেখেছি”। আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে বললাম,”ধন্যবাদ। আসলে এত দামী বই কেনার ক্ষমতা আমার নেই। তাই রোজ এসে আমি বইটা পড়ে নিলাম” – এই ছিল বইমেলার মর্মার্থ (spirit)। তখন বইমেলায় প্রবেশমূল্য লাগত পঞ্চাশ পয়সা! পরবর্তী সময়ে প্রবেশমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সিজন টিকিটের বন্দোবস্ত হয়। ধীরে ধীরে বইমেলার কলেবর স্ফীত হতে থাকে। মানবিক মূল্যবোধের সামাজিক অবক্ষয়, যা রাজনীতির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের আবহে এ রাজ্যে প্রসার লাভ করে, তা বইমেলাতেও ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হতে থাকে। ক্রমশঃ শুধু পাঠক নয়, উদ্যোক্তাদের চিন্তাধারায়ও অনেক পরিবর্তন আসে। ময়দানের পর, মিলনমেলা ঘুরে, এখন কলকাতা বইমেলার স্থায়ী জায়গা হয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক, বিধাননগর। বেশ কয়েকবছর মেলায় ঢুকতে কোন প্রবেশমূল্য লাগে না। আগে মেলার পাশে নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা ছিল – ঘন্টাপ্রতি কুড়িটাকা হিসেবে। এবারের অভিজ্ঞতা, মেলার উল্টোদিকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পার্কিং – সত্তর টাকা ঘন্টা, কোন রসিদ দেওয়া হয় না! এটা সরকার, পুলিশ ও গিল্ডের অগোচরে হয়েছে বলে কি মনে হয়? আসলে মেলা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র বদল হয়েছে। প্রথমে এই মেলায় স্টল দেওয়া যেত একমাত্র পাবলিশার হলেই – সাধারন বই বিক্রেতাদের স্টল দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ২০০০ সাল থেকে শুধু পাবলিশার্সরাই নয়, বই বিক্রেতারাও স্টল দিতে পারেন। এতে মেলায় অংশগ্রহণের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব অপেক্ষা অর্থনৈতিক লাভের আকাঙ্খা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা অন্যরকম প্রভাব মেলায় পড়েছে। মেলার দর্শক চরিত্র বদলে গিয়ে মেলার বই বিক্রির সংখ্যার কি বৃদ্ধি হয়েছে – এটাই মূল প্রশ্ন। কারন, বইমেলার উদ্দেশ্য দুটি – বইয়ের প্রকাশক ও ক্রেতা-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে মতবিনিময় এবং বই পড়ার উৎসাহ প্রদান করা।
মেলার চাকচিক্য, ব্যাপ্তি ও প্রচারের ক্রমবৃদ্ধিতে গিল্ডের প্রয়াস যেমন মাণ্যতা পায়, তেমনি সরকারী দাক্ষিণ্য ও আনুকুল্য এর একটা বড় কারন। এখানেই বইমেলার সবচেয়ে বড় চরিত্রগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। গত ৫০-৬০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমাজ জীবনে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কাজের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবান্ছিত হস্তক্ষেপ সুবিদিত। সেজন্য আমাদের কলকাতা বইমেলা যত সরকারী দাক্ষিণ্যের বেড়াজালে নিজেকে সঁপে দিয়েছে ততই সে তার লক্ষ্য থেকে একটু একটু করে সরে গিয়েছে। রাজনীতির মোড়কে বইমেলাকে মুড়ে ফেলার উদ্যোগ রাজ্যসরকারের উচ্চতম স্তর থেকে শুরু হওয়ায় তা রোধ করার ক্ষমতা গিল্ডের ছিল না। গিল্ড সে চেষ্টাও করেনি। আবার বইমেলার ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম বৃদ্ধির ফলে এই মেলা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল মেলায় পরিণত হল! এর থেকে লাভের কড়ি সংগ্রহের বিভিন্ন রকম বন্দোবস্ত শুরু হল – আর তার ফলে বইমেলা তার চরিত্র খুঁইয়ে এক অদ্ভুত জনসমাগমের মেলায় পরিণত হল!
এবারের, অর্থাৎ ৪৫তম কলকাতা বইমেলায় দু বছর বাদে পা রেখে যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করেছি, তা প্রথমেই বলি, বই ছাড়া অন্য জিনিষের প্রাচুর্য! যেমন, ভোজনরসিক বাঙ্গালীর জন্য ভারতীয়, চাইনিজ, ও আরো অনেক ফিউশানধর্মী খাবারের দোকান। পুরো মেলার মধ্যে এই দোকানগুলিতেই ক্রেতা ও ভোক্তার ভিড়। এছাড়া বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রয়াত মানুষজনের নামে মুক্ত ও বদ্ধ মঞ্চ! এগুলির কয়েকটি জায়গায় গিয়ে আমার উপলব্ধি – এগুলিতে ব্যক্তি বিশেষের আত্মপ্রচার ও বিশেষ ‘ইজম’ ভিত্তিক প্রচার হচ্ছে যা, বইমেলায় বই দেখতে ও পড়তে আসা মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন। এছাড়া, বইমেলায় পটশিল্পী তাঁর পট ও ছবির পসরা সাজিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে বসেছেন! এমনকি জাঙ্ক জুয়েলারী বিক্রির দোকানও দেখেছি! যত মানুষ বই দেখছেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী মানুষ, বিশেষতঃ যুবক-যুবতীর দল মোবাইলে সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত। বাবা-মার হাত ধরে খুঁদে পড়ুয়ার দল, যারা বই দেখে, গন্ধ আস্বাদন করে বই কিনত, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। বইমেলায় নয়টি প্রবেশদ্বার থাকায়, প্রবেশমূল্য ব্যতীত এই মেলায় দর্শক সমাগমের সঠিক হিসেব পাওয়া সম্ভব নয়। তবে, একটি ব্যাপার পরিষ্কার – বইমেলা তার দর্শক চিত্রে বদল ঘটিয়েছে। এখন বই বিক্রেতা ত বটেই, প্রকাশকরা পর্যন্ত বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচিত হওয়ার সময় দিতে নারাজ – অনেকটা ভোগ্যপণ্যের বাজারের মত – ফেল কড়ি, মাখো তেল – গোছের! তাঁদের বই বিক্রি একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। আবার বইমেলার ক্রেতা চরিত্রের আমূল পরিবর্তন নজরে আসে। বইমেলায় ঘুরতে আসা, সেল্ফি তোলা, ও বিভিন্ন খাবারের দোকানে ভিড় করা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পকেটমারও হাজির! এক অভিনেত্রী-কাম পকেটমার ধরাও পরেছে। আগে বইচোর (এদের চোর বলতে আমার দ্বিধা আছে) ধরা পরত – এখন ভোগের সামগ্রীর মেলার চরিত্র অনুযায়ী পকেটমার ধরা পরছে! এইসঙ্গে ভালো বই দেখা, কেনা ও পড়ার মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিভিন্ন দেশের প্যাভেলিয়ানগুলির মধ্যে নজর কাড়ার কথা থিম কান্ট্রি বাংলাদেশের প্যাভেলিয়ানের। সেখানে ভিড় আছে। হয়ত তাদের বই বিক্রিও হচ্ছে। এখানে একটা কথা অবশ্যই বলা উচিৎ – বইমেলা আসলে বইয়ের সাথে পাঠকের পরিচিত হওয়ার মেলা। কারন, কলেজস্ট্রীটে বই কিনলে বইমেলায় দেয় ১০% এর বেশী ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু কলেজস্ট্রীটে বই বাছার ও বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সুতরাং, বই চয়ন করার জায়গা হল বইমেলা। বইমেলার এই রূপটাই এবারের বইমেলায় খুঁজে পাওয়া গেল না। উচ্চমধ্যবিত্তের ড্রইংরুমে সাজানোর জন্য বই কেনা ও সরকারী দাক্ষিণ্যে ‘অনুপ্রাণিত’ ছোট, বড়, মেজ, সেজ কিছু আধিকারিকের দাপাদাপি দৃশ্যমান! এর মধ্যে পুলিশের দায়িত্ব পালন যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের বইয়ের দাম টাকায় লেখা এবং বাংলাদেশের টাকার আন্তর্জাতিক মূল্যমান ভারতীয় টাকার তুলনায় কম। তবু তারা তাদের দেশের টাকার হিসেবে ভারতীয় টাকায় ১০% ছাড় দিয়ে তাদের বই বিক্রি করছে – অতিরিক্ত মুনাফা লাভের অনৈতিক প্রয়াস। এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। এই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সময় বাংলাদেশের ঢাকার দুটি জায়গায় তাদের সর্ববৃহৎ বইমেলা – ‘একুশে বইমেলা’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে কোন ভারতীয় প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই! এর কারন বোঝা যায়না – অংশগ্রহণে অসুবিধা কোথায়?
শুধু বাংলাদেশই নয়, আরো কয়েকটি দেশের প্যাভেলিয়ানে ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও বইয়ের সম্ভার দেখা যায়নি! আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুবিশাল প্যভেলিয়ান জুড়ে কোন বইয়ের দেখা পেলাম না। হতে পারে এদের উদ্দেশ্য অন্য! তবে, বইমেলার মূল উদ্দেশ্য, বইপড়ার চেতনাবৃদ্ধির কোন প্রচেষ্টা এসব জায়গায় দেখা যায়নি। এছাড়া, লিটল্ ম্যগাজিন ও ছোট ছোট পাবলিশার্সদের যে উৎসাহ, উদ্দীপনার মধ্যে স্টল দেওয়া এবং সেখানে উৎসাহী পাঠকদের আনাগোনা কয়েক বছর আগেও দেখা যেত, তা এখন সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য।
এবারের বইমেলায় ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ‘বইমেলা’ নামের একটি হুজুগে বিনোদনকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। অবশ্য নবীন ও প্রবীন লেখকদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান মেলা প্রাঙ্গনে হয়ে চলেছে অনেকটা বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের মত – মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অভাব প্রায় সব ক্ষেত্রেই। এর থেকে কয়েকটি ব্যাপার সহজেই প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ, এই সময়ে লেখার ও বিষয়ের গুনাগুণের উপর জনপ্রিয়তা নির্ভর করেনা – করে, কোন সংবাদ-মাধ্যম প্রমোট করছে তার উপর! শুধু প্রবন্ধের ক্ষেত্রেই নয়, গল্প, উপন্যাস, কবিতা – সবক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। ফলে গুণমানের অবমূল্যায়নের সাথে বই পড়ার অভ্যাস – বিশেষতঃ বাঙ্গালীর – নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন যেকোন মুদ্রিত বাংলা সংস্করণের বিক্রির সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। গল্প-উপন্যাস এমনকি গান,কবিতায়ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির বদলে ‘ইজম’ এর বহিঃপ্রকাশ – যা মানুষের সৃজনশীলতাকে গোলাম বানানোর চেষ্টায় পরিণত হচ্ছে। এগুলো পাঠককে গেলানোর চেষ্টার অবিসম্বাদী ফল হল – বাঙ্গালী পাঠক ধীরে ধীরে বই পড়ার অভ্যাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
আবার বিভিন্ন রকম কারনে বইয়ের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এই নেগেটিভ চিন্তাধারায় খানিকটা ইন্ধন জুগিয়েছে। পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মনন, চিন্তনের সুস্থ বহিঃপ্রকাশের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল সৃজনশীল, রাজনীতিমুক্ত চিন্তা, যা লেখার মাধ্যমে আমজনতার কাছে পৌঁছায়। এক সময় এই কৃষ্টি-ঐতিহ্য বাঙ্গালীর ছিল। কিন্তু, বাংলার রাজনীতিমুক্ত চিন্তা-ভাবনা ও সৃজনশীলতার ঐতিহ্য যদি আবার কখনো ফিরে আসে, তাহলে বাঙ্গালী আবার তার বইপ্রীতির জগতে ফিরে আসবে। কারন, সামাজিক-মাধ্যম ও বৈদ্যুতিন-মাধ্যম কখনোই বইয়ের প্রতিস্থাপক নয়। তবে, সবচেয়ে প্রথমে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দাক্ষিণ্যের মোহ ত্যাগ করে এই সৃষ্টির জগতকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। আমাদের সবার এই দায়িত্ব থাকলেও প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ডের।
কলকাতা বইমেলা ও কিছু প্রশ্ন
