“মরিয়া না মরে রাম, এ কেমন বৈরী” – রাবনের স্বগোতক্তি এই বাংলা প্রবাদ বোধহয় কোভিড-১৯, যাকে আমরা করোনা বলে জানি, তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য। ব্যাপার কি?
আসলে WHO সতর্ক করেছে, চীন,জাপান,কোরিয়া, ব্রাজিল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আবার করোনার ওমিক্রণ ভাইরাসের সাব-গ্রুপের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তাই তারা ভাইরাস সংক্রমণের গডফাদার (!) হিসেবে আবার সারা বিশ্বে ত্রাসের সঞ্চার করে চীনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে নেমে পড়েছে!
চীনের Beijing, Zhuozhon, Shanghai ইত্যাদি শহরে কোভিড-১৯ এর বাধানিষেধ তোলার পরেই ঘোষণা হয়েছিল চীনে কোভিড টলারেন্স শূণ্য! এই ধরনের প্রোপাগান্ডা সর্বস্ব দেশে কোভিড আবার আসতে পারে যদি জনসাধারণ বিধিনিষেধ না মেনে চলে – বিশেষতঃ কোভিড-১৯এর মত RNA ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে। আবার, আমাদের দেশে বড় সমস্যা হল, এখানে নীতিনির্ধারণকারী রাজনীতিবিদরা সবজান্তা মূর্খের মত বিশেষ বিশেষজ্ঞদের (যার মধ্যে IAS থাকা বাধ্যতামূলক) পরামর্শ নিয়ে চলেন! আগে করোনা সংক্রান্ত লেখায় যা বলেছি, তার প্রতিটি কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি হলেও আমাদের দেশে মাণ্যতা পায় একমাত্র সুবিধাবাদী রাজনীতির স্তাবকদের পরামর্শ! তাঁরা বিশেষ রূপে অজ্ঞ, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ হিসেবে জনসাধারনকে জ্ঞান দেন এবং অনুগ্রাহী সংবাদ-মাধ্যম তা প্রচার করে! ফলে, জনগণের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা শূণ্য!
RNA ভাইরাসের ধর্ম হল, সে বেঁচে থাকার তাগিদে জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজের প্রতিলিপি (replication) তৈরী করে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি করে। আবার এটা করতে গিয়ে তার জিন মিউটেশানের সময় কিছু ক্ষেত্রে জেনম কোডের পরিবর্তন হয়। এদিকে আবার herd immunityর কারনে মানবদেহে যে IgG এ্যান্টিবডি তৈরী হয়, তার ক্ষমতা হোস্টের শরীরভেদে আলাদা আলাদা স্তরের হয়। সেজন্য ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও বিভিন্ন মানুষের উপর এই ভাইরাসের আক্রমণের তীব্রতা বিভিন্ন স্তরের হয়। পরিবর্তিত gene mutation এর কারনে যেমন RNA ভাইরাসের চরিত্র ও সংক্রমণ ক্ষমতা বদলায়, তেমনি পরিবর্তিত ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিং দেখে তার জন্য পরিবর্তিত ভ্যাকসিন বানানো যাবে। এর জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সংক্রমিত রোগীদের সনাক্তকরণ এবং তাদের পরীক্ষা করা। তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার Indian SARS-CoV-2 Genomics Consortium (INSACOG) এর স্বীকৃত পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসের সম্পূর্ণ জেনম সিকোয়েন্সিংয়ের উপর জোর দিয়েছে। এই সময় করোনা ভাইরাসের নতুন ঢেউ নিয়ে সতর্ক হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সবচেয়ে বড় কারন হল, এই ভাইরাস পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য changed gene mutation করে যেমন তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তেমনই তার সংক্রমণের তীব্রতা কমছে – এটা যে কোন RNA ভাইরাসের ধর্ম। আবার ভ্যাকসিন এবং herd immunity জনিত কারনে মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য asymptomatic আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি symptom অনেক মৃদু হয়েছে। এসব অনেক আগেই জানিয়েছিলাম। তবু, ঐ যে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে গেল গেল রব তুলে অর্থনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা – যা এখনো চলছে!
চীনে এখন যে করোনা রোগীর সংখ্যা হটাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার কারন সে দেশের মানুষের লাপরবাই, সরকারের ভুল কোভিড প্রোটোকল এবং নিম্ন মানের ভ্যাকসিনের (চীনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা আন্তর্জাতিকস্তরে স্বীকৃত নয়) কারনেও হতে পারে। তাছাড়া, অন্যান্য দেশ, যেমন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়ায় যেসব সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরও চীনের মত BF.7 ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে। অন্যান্য দেশে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হলেও চীনে সংখ্যাটা অনেক। সেটা কোমর্বিডিটি বা ভ্যাকসিনের মানবদেহে IgG এ্যান্টিবডি তৈরীর ক্ষমতার তারতম্যের কারনেও হতে পারে। শুধু সাংহাই শহরে চীনের রেকর্ড অনুযায়ী আড়াই কোটির জনসংখ্যার শহরে এখন আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে। ব্রিটেন থেকে পাওয়া খবর অনুসারে চীনে এখন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষের কোভিডে মৃত্যু হচ্ছে! আবার অন্যান্য দেশের আক্রান্তদের বেশীরভাগের সঙ্গে চীনা সংযোগ পাওয়া গেছে! ভারতের এখনই লকডাউনের মত ব্যবস্থা নেওয়া, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায় আঘাত হানবে – তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। তার কারন হল, এই BF.7 ভ্যারিয়েন্টে এখনো পর্যন্ত এই দেশে আক্রান্তর সংখ্যা মাত্র চার – গত জুলাইয়ে এক, সেপ্টেম্বরে দুই ও নভেম্বরে এক! এদের মধ্যে তিনজন গুজরাটের এবং একজন ওড়িশার। এদের অন্তত একজন ওমিক্রনের BF.7 ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত এক আমেরিকা নিবাসী ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে এসেছিলেন! সুতরাং এমন সময়, যখন করোনার বিধিনিষেধ আর সামাজিক দূরত্বের বিধান মানা হচ্ছে না, তখনো ভারতে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা দেখে চিন্তিত হওয়ার কারন আছে বলে মনে হয় না।
আরেকটি ব্যাপারে খটকা লাগছে – গত বেশ কিছুদিন যাবৎ চীনে BF.7 ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও WHO একদম নিশ্চুপ ছিল! বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ জমায়েত – FIFA ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল শেষ হল রবিবার ১৮ই ডিসেম্বর। আর ১৯শে ডিসেম্বর, ঠিক পরের দিন WHO রিপ ভ্যান উইঙ্কিলের মত শীতঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসব – খ্রীষ্টমাসের আগে এমন জ্যাঠামশাই মার্কা বিজ্ঞপ্তি জারি করল! এর একাধিক উদ্দেশ্য। প্রথমতঃ, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনের ব্যর্থতা এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার জিন মিউটেড ভ্যারিয়েন্টের নিয়ন্ত্রনে তাদের ব্যর্থতার দায় আন্তর্জাতিকভাবে অন্য দেশের উপর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এছাড়া করোনা উত্তর মন্দার অর্থনীতিতে খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চীনকে উৎসবের কেনাকাটার মরশুমে যতটা সম্ভব সাহায্য করা। যদি এই সময় ভয় ভীতিতেও করোনার বিধিনিষেধ লাগু করা যায় তবে, অন্য দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পরবে – এতে চীনের অর্থনীতির নেগেটিভ উপায়ে লাভ হবে। এভাবে কৃত্রিম চাহিদা বৃদ্ধি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর চেষ্টা হবে।
চীনের ইউহানের পরীক্ষাগার থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর সময় থেকে চীন তার মোকাবিলায় সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে, শুধুমাত্র দমন-পীড়ন ও তথ্য গোপন করে তার মোকাবিলা করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা বিপাকে পড়ে WHOকে তাদের হয়ে মাঠে ব্যাট ধরতে নামিয়েছে। WHO তাই FIFAকে তুষ্ট রেখে ফুটবল বাণিজ্য সম্পূর্ণ হওয়ার পর মাঠে নেমেছে।
এখানে একটি সন্দেহজনক প্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশের কোভিড উত্তর অর্থনীতি যখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তখনই তার উপর বাণিজ্যিক স্বার্থে অনৈতিকভাবে আঘাত হানার চেষ্টা হচ্ছে। এখন মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়ছে। ব্যাঙ্কের আমানতের উপর সুদ বৃদ্ধি পাচ্ছে – বাণিজ্যের আয়তন বাড়ছে। আবার ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশেষতঃ ইউরোপের দেশগুলির অর্থনীতি এবং কোভিড উত্তর চীনের অর্থনীতি যথেষ্ট প্রতিকুলতার মধ্যে চলছে। বিশ্বসংস্থা WHO এই সময় যে খন্ডিত তথ্য সামনে এনে ত্রাস সঞ্চারের চেষ্টা করছে তার অভিপ্রায় মোটেই ভালো নয়। তারা বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতির বাধানিষেধ ফিরিয়ে এনে চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বানানোর চেষ্টা করছে। এভাবে তারা ভারতকে চাপে ফেলে আবার আমাদের দেশকে মন্দার কবলে ঠেলতে চাইছে।
দেশের সংবাদ-মাধ্যম মারফৎ যে প্রচার চলছে তা একপেশে, খন্ডিত ও অযৌক্তিকভাবে ভীতিপ্রদ। এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কোথাও বলা হচ্ছে না যে, এখন চীনে এবং অন্যান্য যেসব জায়গায় নতুনভাবে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তার ৯৯% এরই BF.7 ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এই ভ্যারিয়েন্ট এখনো এদেশে গত ছ মাসে আক্রান্ত চারজন! আমি আগেই বলেছি, এভাবে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসবে, যাবে। ধীরে ধীরে মানবদেহে এর তীব্রতা কমবে, যদিও তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়বে। এখন এটাই হচ্ছে। জানিনা দেশের রাজনীতিবিদদের মানুষকে অযথা ভয় দেখানোর কারন কি! এভাবে কোভিড একমাস বা এক বছরে বিদায় নেবে – তা ভাবাই ভুল। সেজন্য, আগে যেমন বলেছি, আবার তাই বলছি – কোভিড প্রোটোকলকে মাণ্যতা দেওয়া জরুরী। চীনে তার অভাবেই এত দ্রুত BF.7 ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেড়েছে। সেজন্য আমাদের দেশে আবার লকডাউন বা অর্থনৈতিক বাধানিষেধ আরোপ করা অর্থহীন। এতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে, সেইসঙ্গে কিছু ব্যবসায়ীর মুনাফা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরবে। বরং চীন এবং অন্য যেসব জায়গায় এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ভারতীয়দের যাওয়ার ব্যাপারে বাধানিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। এছাড়া আক্রান্তের পরীক্ষা করে ভাইরাসের প্রকৃতি নিরুপণের জন্য INSACOG স্বীকৃত কোন পরীক্ষাগার থেকে তা জানা জরুরী। নতুন ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনকে কার্যকরী করতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা কোনো শক্ত কাজ নয়। আমাদের দেশের ভ্যাকসিনের মান সারা বিশ্বে পরীক্ষিত ও আদৃত। শুধু মানুষকে বুঝতে হবে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার সবচেয়ে জরুরী অস্ত্র মাস্ক এবং স্যানিটাইজেশান। সেইসঙ্গে ভিড়ের মধ্যে অপ্রয়োজনে গুঁতোগুঁতি না করা বাঞ্ছনীয়।
দেশের সংবাদ-মাধ্যমগুলির এ ব্যাপারে সদর্থক ভুমিকা নেওয়া দরকার। মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি নর্মাল কাজকর্ম চালাতে কোন বাধানিষেধ রাখা উচিৎ নয়। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে কোভিড চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো থাকায় তা পুরোপুরি না ভেঙ্গে নূন্যতম বেডের কোভিড ওয়ার্ড চালু রেখে আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় তৈরী থাকা দরকার; সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডারের স্টক মজুত রাখা ছাড়া এই মূহুর্তে আর কিছু করণীয় নেই। ভ্যাকসিনে কোভিড সংক্রমণ অনেকটাই ঠেকানো যাবে। সাথে সাথে সমাজে herd immunity (আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে) হলে তখন কোভিড আক্রান্তদের সুস্থ হওয়া নিশ্চিত হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যে চারজন BF.7 ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই সুস্থ। সমাজ, সরকার সতর্ক ও দায়িত্বশীল থাকলে এ ধরনের নতুন নতুন কোভিড ভ্যারিয়েন্টের থেকে প্রাণহানির ঘটনা প্রায় থাকবে না।
কোভিডের নতুন সংক্রমণে ভয় অমূলক
