কোভিড-১৯ ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা

কয়েকদিন আগে আমেরিকার ইমিউনোলজিস্ট ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসি (Anthony Fauci) একটি স্বাস্থ‍্য বিষয়ক আলোচনা সভায় বলেছেন যে, যদিও কোভিডের ওমিক্রন ভ‍্যারিয়েন্টের দাপট অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে, তবু আগামী শীতে নাকি কোভিড-১৯ এর একটি নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট আসতে চলেছে! এটি নাকি সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভ‍্যারিয়েন্ট এবং সেইসঙ্গে এটি নাকি সমস্ত বাজার-চলতি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দেবার ক্ষমতা রাখে! তিনি আরো বলেছেন যে, ওমিক্রনের সাম্প্রতিক সময় জানা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.5, যা এই মূহুর্তে সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইন হিসেবে স্বীকৃত – তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট BA.4.6 অনেক বেশী শক্তিশালী স্ট্রেইন হিসাবে ভ‍্যাকসিনের প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে!
WHOর প্রতিবেদন অনুসারে, ওমিক্রনের Pango lineage ও তার পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের (BA.5 বা +R346X/+K444X বা +N450D বা +N460X) বিস্তৃত মনিটারিং চলছে। এর কারন, নতুন যেসব সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা যাচাই করা এবং তারা বাজার চলতি ভ‍্যাকসিনকে কতটা ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে – সেই শক্তি পরখ করা। এটি যে RNA ভাইরাস গত দুবছর ধরে বিশ্বত্রাস হয়ে উঠেছিল তার বিষয়ে রুটিন পরীক্ষা।
এক সময় একাধিক লেখায় জানিয়েছিলাম যে, SARS-Cov2এর মত RNA ভাইরাসের ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানের মাধ‍্যমে নতুন নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করা – যারা আবার নিজেদের সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট তৈরী করে। এগুলো ভাইরাসকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখার জন‍্য একান্ত প্রয়োজনীয়। survival of the fittest তত্ত্ব অনুসারে এভাবে পরবর্তী পর্যায়ে যে ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়, তাদের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধির চেষ্টায় কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস সাফল‍্য পেতেই পারে। কিন্তু প্রাথমিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই স্থায়ীত্ব যে মানবদেহে অধিকতর ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম – সে কথা বলা যায় না। আরেকটি ব‍্যাপার, যা সব ইমিউনোলজিস্টের জানা – যদি কোন RNA ভাইরাস তার প্রাথমিক গঠন-বিন‍্যাস ঠিক রেখে পরিবর্তিত জিন মিউটেশান করে, তাহলে ভ‍্যাকসিন তার মডিফায়েড ফর্মে এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। এছাড়া আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্য মাথায় রাখা প্রয়োজন – তা হল, গোষ্ঠী-সংক্রমণ হলে ধীরে ধীরে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (herd immunity) তৈরী হয়ে যায়। সমাজে যদি লক্ষণবিহীন ও লক্ষণযুক্ত মানুষের মোট সংখ‍্যা বৃদ্ধি পায় তবে একসময় মানুষের মধ‍্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আক্রান্তের সংখ‍্যা দ্রুত কমে যায়। আমাদের দেশে ঠিক এটাই হয়েছে। সেইসঙ্গে ভাইরাসের কাবু করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এর দুটি কারন – ভ‍্যাকসিনের প্রভাব এবং গোষ্ঠী-সংক্রমণের কারনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হওয়া।
RNA ভাইরাসের ধর্ম অনুযায়ী SARS-Cov2 এর যত ভ‍্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, তার মারণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হবেই। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে যে, এখন ভাইরাস নিজে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সে এও জানে, তার মানব-দেহে মারণ-ক্ষমতা বাড়লে তার ধ্বংসও ত্বরান্বিত হবে। সেজন‍্য, এই ধরনের ভাইরাসের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এরা যেমন পৃথিবীর বুক থেকে একেবারে নির্মূল হবে না, তেমনি নিষ্ক্রিয় (dorment) অবস্থায় কোন প্রাণীদেহে আশ্রয় নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করবে। এই মূহুর্তে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের আক্রমণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী। সুতরাং মূল ভাইরাসের যত ভ‍্যারিয়েন্টই আসুক না কেন, জীবদেহে তার বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়লেও মানবদেহে তার ক্ষতি করার ক্ষমতা নষ্ট হবেই।
এভাবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন ভ‍্যারিয়েন্ট বা তার সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে “আবার অতিমারীর করালগ্রাস ফিরে আসছে” – বলার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। WHO শুধু বলেছে, ভয়ের কিছু নেই; আমরা সতর্ক থাকব এবং গবেষণা চলতেই থাকবে। মানুষকে অযথা ভয় পাইয়ে দেওয়া অমূলক। এ বিষয়ে পৃথিবীব‍্যপী সংবাদ-মাধ‍্যমের ভূমিকা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন সংখ‍্যাতত্ত্বের মাধ‍্যমে অর্ধসত‍্যকে উপস্থাপিত করা সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির কাজ নয়। এটা ঠিক যে, WHO নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যেতে বলেছে এবং সেইসঙ্গে অযথা ভয় ও লকডাউনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় কোন একটি বা দুটি গবেষণার খন্ডিত তথ‍্য প্রকাশ করে মানুষের মনে ভয় ধরানো উচিত নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে দেখেছি যে, SARS-Cov2এর শুরু থেকেই শীত বা গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম‍্যের উপর আক্রান্তের সংখ‍্যা বা আক্রমণের তীব্রতা নির্ভর করেনি। এমন উচ্চ জনঘণত্বের দেশে ভাইরাসের আক্রমণের শুরুর দিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ‍্যা দ্রুত বাড়ার সঙ্গে সমাজে লক্ষণবিহীন আক্রান্তের সংখ‍্যাও বাড়ছিল। তার একটি ভালো ফল হল, ভারতে দ্রুত গোষ্ঠী-সংক্রমণ হওয়ায় দ্রুত গোষ্ঠী-অনাক্রম‍্যতা (herd immunity) তৈরী হয়েছে। তারপর যখন ভ‍্যাকসিন নেওয়া শুরু হল, এই জোড়া ফলার আক্রমণে কোভিড ভাইরাস অতি দ্রুত তার মারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এই কথাই বলছে। ১০ই অক্টোবর, ২০২২এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ১৯৯৭ জন আক্রান্ত আছেন আর এক সপ্তাহে দেশে ৯ জনের কোকোভিডে মৃত‍্যু হয়েছে যার ৩ জনই কেরলে। দেশে দূর্ঘটনায় মৃত‍্যুর সংখ‍্যাও এর থেকে অনেক বেশী। অথচ, ভারতে কোভিড-১৯এ মোট আক্রান্ত ৪,৪৬,১৪,৪৩৭, যার মধ‍্যে মৃত ৫,২৮,৮১৪। অর্থাৎ আক্রান্তদের শতকরা ৯৯% সুস্থ হয়ে গেছেন; শুধু ১% এর মৃত‍্যু হয়েছে। অথচ, দেশে ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির সময় মৃতের সংখ‍্যা মোট আক্রান্তের ২.৫% হয়েছিল; তার বেশী কখনোই হয়নি। এখন যে জন‍্য নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত কোভিড-১৯ অতিমারীর ভীতিপ্রদ সংক্রমণ ও প্রাণঘাতী আক্রমণ থেকে মুক্ত হবার মুখে।
এই সময় সাধারণ মানুষকে যেমন অন‍্যান‍্য বায়ুবাহিত রোগকে ধরে, সাধারণ মানুষকে যেমন স্বাস্থ‍্যবিধি মেনে চলতে হবে তেমনি সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা ও ভিড়ের মধ‍্যে মাস্কের ব‍্যবহার এবং যথার্থ স‍্যানিটাইজেশান নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে। তবে, অর্থনীতি ও সমাজজীবনের সুস্থতা মাথায় রেখে অযথা বাধানিষেধ আরোপের কোন প্রয়োজন নেই। এরপর যে কথাটা বলা জরুরী তা হল, নতুন সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট, যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে তা নাকি ভ‍্যাকসিনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম – সেটি একদম ভুল কথা। কারন RNA ভাইরাস যখনই ভ‍্যাকসিন-নিষ্ক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় পরিবর্তিত জিন মিউটেট করবে, তার নতুন স্ট্রেইন শণাক্ত করে ভ‍্যাকসিনের উন্নতিকরণ (up-gradation) করে তাকে ধ্বংস না করার কোন বিজ্ঞানসম্মত কারন নেই। তাই, ডাঃ এ‍্যান্টনী ফসির বক্তব‍্যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র সদা সতর্ক থেকে ভ‍্যাকসিনের সব রকম উন্নতির মাধ‍্যমে কোভিড-১৯কে আয়ত্বে রাখা সম্ভব। যেহেতু এই RNA ভাইরাস জীবদেহের আশ্রয় ছাড়া বেশীক্ষণ বাঁচে না, এরা ভবিষ‍্যতে মানবদেহে সুবিধা করতে না পেরে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে যেতে অন‍্য কোন জীবদেহে অক্ষতিকর ঘুমন্ত (dorment) অবস্থায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। এই মূহুর্তে এটি অনুমান নির্ভর বৈজ্ঞানিক ব‍্যাখ‍্যা মাত্র। তবে একটি কথা নিরদ্বিধায় বলা যায়, মানব সমাজে ত্রাস সঞ্চার করার ক্ষমতা এই একদা মারণ ভাইরাসের আজ আর নেই। বিশেষভাবে ভারতের মত অতি জন-ঘণত্বের দেশে তার ক্ষমতা নিঃশেষিত। আমরা যদি ভ‍্যাকসিন উন্নয়ণ ও সাধারণ স্বাস্থ‍্যবিধি মানার ব‍্যপারে চরম ঔদাসিন‍্য না দেখাই, তবে আমাদের দেশে কোভিড-১৯এর ফিরে আসার সম্ভাবণা নেই।
এত কথার পরেও বলার আছে যে দেশের কিছু সংবাদ-মাধ‍্যম এই ধরনের খবর প্রচার করছে! তার কারন হল, এই দেশের সংবাদ-মাধ‍্যমগুলির সামাজিক দায়িত্ব-বোধ সম্পর্কে ধারনা পরিষ্কার নয়। তাদের টিআরপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুনাফা ছাড়া আর কোন চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ফলে শুধু সংবাদ পরিবেশনে মানুষকে আকৃষ্ট করা ছাড়া এরা সংবাদের বিস্তৃত বিশ্লেষণে বিশেষ প্রবেশ করে না। এক্ষেত্রে এমন অর্ধসত‍্য সংবাদ পরিবেশনে মানুষ কৌতুহলী হবে এবং তাদের মনে ভয়ের সঞ্চার হলে তাদের থেকে যে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া হবে – তার থেকে কতিপয় ব‍্যবসায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতারা উপকৃত হবে। মনে পড়ে, লকডাইন পর্যায়েও এমনটা হয়েছিল।
তাছাড়া, এ ধরনের সংবাদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভারতের মত বিপুল জনবহুল দেশে মারাত্মক হতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ‍্য উভয়স্তরেই বিরোধী দলগুলি যেমন সরকারের অহেতুক সমালোচনা করার সুযোগ পাবে, তেমনি অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।
দেশের বিভিন্ন কোভিড চিকিৎসাকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলিতে কোভিড আক্রান্ত রোগীর ক্রমহ্রসমান সংখ‍্যার কথা মাথায় রাখলে বোঝা যায় যে, এই ভাইরাসের দেশ থেকে বিদায় নেবার সময় চলে এসেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথায় বলা যায়, এখানে আর কোন কোভিড আইসোলেশান সেন্টার নেই। সব হাসপাতালের কোভিড ইউনিট রোগী না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত সাতদিনে রাজ‍্যে নতুন কোভিড রোগীর সংখ‍্যা শূণ‍্য। সুতরাং এখানে কোভিড-১৯ বা তার কোন ভ‍্যারিয়েন্ট বা সাব-ভ‍্যারিয়েন্ট,যারা একই গঠনের মধ‍্যে পরিবর্তিত জিন মিউটেশানে জন্ম নিয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করার জন‍্য ভ‍্যাকসিন ও হার্ড ইমিউনিটির যুগলবন্দীই সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে। কিন্তু যদি বেসিক গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কোন RNA ভাইরাস আক্রমণ করে তবে তখন ভ‍্যাকসিন কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ না হয়ে নতুন কোন নামের হবে। এখনো অবধি এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সুতরাং ভয় পাইয়ে দিয়ে প‍্যানিক প্রতিক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা অর্থহীন। সাবধানের মার নেই – প্রবাদকে মনে রেখে মাস্ক ও স‍্যানিটেশানের সঠিক প্রয়োগ যথেষ্ট। সেইসঙ্গে ভ‍্যাকসিনের বুস্টার ডোজ যতবার আসবে তা গ্রহণ করাই ঠিক। এইভাবে গবেষণার খন্ডহার উপস্থাপনা সংবাদ-মাধ‍্যমের টিআরপি বাড়ানোর প্রানপণ চেষ্টা বলেই মনে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *