১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট যে শিশু ভূমিষ্ট হয়, এখন তার পঁচাত্তরতম জন্মদিন পূর্ণ হতে চলেছে। প্রথম পঁচিশ বছর কেটেছে শৈশবে, দেহের পূর্ণতা পেতে এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উন্নতিকল্পে। পরের পঁচিশ বছর কাটলো বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণের চেষ্টায়। আর শেষ পঁচিশ বছর পূর্ণতা প্রাপ্ত দেশ উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের পরের পঁচিশ বছরের কর্মসূচী হোক “নাগরিকের কর্তব্যবোধ”।
আমরা অর্থাৎ ভারতের জনগণ স্বাধীনতার আগে থেকেই এক অদ্ভুত আত্মঘাতী রাজনীতির শিকার। কেমন করে? যেমন ধরা যাক, বড় নেতার কাউকে অপছন্দ। তাই বড় নেতা ও তার দলবল (বলা ভাল, স্তাবককুল) অপছন্দের নেতাকে সরাতে দরকারে শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হয়না। এই ঔদ্ধত্ব ও স্তাবকতা ভারতীয়দের মজ্জাগত। ইতিহাসে তার ভূরিভূরি প্রমাণ আছে। এখানে নির্দিষ্ট পরিসরে সেসব আলোচনার জায়গা নেই। তবে এটা না বললেই নয় যে এর ফলে আমাদের দেশের অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে। এই জায়গাতেই মানসিকতার বদল দরকার। কারন, দেশের উন্নতির প্রথম সোপান হল সমাজের উন্নতি। আর সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন আমাদের কর্তব্যবোধ ও সচেতনতা আসবে।
স্বাধীনতা উত্তর যুগে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারনা হয়েছে – যে সরকার (অবশ্যই দলীয়) যত বেশী অনুদান দেবে সেই সরকারই তত ভালো কাজ করছে! এটি কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের পরিপন্থী। সরকার যখন এ ধরনের অনুদান বাড়াবে, তখন তার অর্থভান্ডারের উপর অনুৎপাদক খরচের বোঝা বৃদ্ধি পাবে। আর এই অতিরিক্ত অর্থের যোগানের জন্য সরকার সাধারণ মানুষের উপর বিভিন্ন খাতে করের বোঝা বাড়াবে। এর ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ণ, কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা – সবই বাধা পাবে। তথাকথিত ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির থিওরী আউরে কিছু নোবেল প্রাইজ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে সেই ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি মেনে চলা সরকারগুলি যে তাদের দেশের দারিদ্র ঘোঁচাতে পেরেছে, তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবশ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে কম্যুনিষ্টরা সর্বদা এই অনুদান প্রথাকে সমর্থন করে। তার কারন দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, এতে দরিদ্র জনসাধারণের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের সরকারি টাকায় অনুদানের মাধ্যমে দলীয় কন্ট্রোলে রাখা যায়। দ্বিতীয়তঃ, দরিদ্র জনগনের পক্ষে সরকারি ও দলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কোন দেশেই এই পদ্ধতিতে দেশের ও সমাজের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।
এবার আসি অন্যান্য কর্তব্যবোধের কথায়। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে সামাজিক বৈষম্যের শিকার। সমাজে একদল মানুষ শুধুমাত্র জন্মের ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবে আর অন্যেরা বঞ্চিত থাকবে – এতে শুধু যে সামাজিক সাম্য ব্যহত হচ্ছে তাই নয়, সামাজিক উত্তেজনা ও হিংসার ঘটনা ঘটছে। এতে দেশাত্ববোধের মূলেও কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। এর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্ণধারদেরই শুধু নয়, সমস্ত দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে।
সমাজের সকল স্তরে সার্বিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ না থাকলে একটি জাতি শুধুমাত্র স্বাধীন দেশের পতাকাসম্বল করে বিশ্বের দরবারে কোন ছাপ ফেলতে পারেনা। সবচেয়ে আগে যে বোধটা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে থাকা প্রয়োজন তাহল দেশাত্মবোধ। আমাদের ভারতীয়দের মধ্যেই দেশাত্মবোধের ধারনায় ফারাক আছে। এই অবস্থার জন্য বর্তমান সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষই দায়ী। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর সংসদে বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী একদিন সন্ধ্যায় অটলজীকে জরুরী তলব করলেন। তারপর অটলজী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। অটলজী বেরিয়ে যাবার পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সাংবাদিক বৈঠকে জানানো হল, রাষ্ট্রসংঘে কাশ্মীর প্রশ্নে তোলা বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করবেন বিরোধী দলনেতা শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইন্দিরাজী এবং অটলজীর রাজনৈতিক দর্শনের ফারাক বিস্তর। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জানতেন যে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও অন্যান্যদের মুখের উপর জবাব দেওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি হলেন অটলবিহারী। আর অটলবিহারীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যতই রাজনৈতিক দূরত্ব থাকুক, দেশের স্বার্থে তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তাঁরা একমাত্র দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এখন! পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর উপর জঙ্গী হামলার ঘটনাকে অস্বীকার ও বিকৃত করার চেষ্টায় বেশ কিছু বিরোধী নেতৃত্বের ভূমিকা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এখন রাজনীতি সর্বদা বিরোধীতায় শুরু আর বিরোধীতায় শেষ হয়। একমাত্র কম্যুনিষ্ট দলগুলিই যেকোন ভারতবিরোধী কাজে উল্লসিত হয় বা নীরব থেকে বুঝিয়ে দেয় যে তারা ভারত সরকারের সঙ্গে নেই। ১৯৬২ সালের চীনা আগ্রাসনের সময় থেকে সাম্প্রতিক জঙ্গী হানা, এমনকি লাদাখ-প্যাংগং লেকের ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিন্দায় তারা ব্যপৃত ছিল। এই ট্রেন্ড এখন বিরোধী নেতাদের মধ্যে বহুলাংশে দেখা যাচ্ছে। আসলে রাজনীতি এখন পেশা হওয়ায় এবং তার জন্য কোন যোগ্যতামান না থাকায় নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের মধ্যে শুধু যে প্রগলভ বা রুচিহীন কথাবার্তার চল হয়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক বিরোধীতা করতে গিয়ে কখন যেন দেশের বিরোধীতা করা হচ্ছে। রাজনীতির মান বাড়ানোর জন্য দেশের স্বার্থে এদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের শিক্ষার আশু প্রয়োজন।
আবার ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অথবা রাজনীতিগত লাভ-ক্ষতির বিচারে সমাজের তথা দেশের প্রতি কর্তব্যবোধও জলাঞ্জলী দেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব্যক্তিগত লাভ ও সুযোগসুবিধা বৃহত্তর সমাজের লাভের চেয়ে আছ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সমাজে মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে বিশেষসুবিধাভোগের প্রত্যাশী। আমাদের দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধাভোগের প্রত্যাশী। দেশে জাতপাতের ভিত্তিতে শিক্ষা ও চাকরীর সংরক্ষণের পঁচাত্তর বছর পরেও সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষজন সমাজের বৈষম্য দূরীকরনের চেষ্টার পরিবর্তে এই বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন ব্যতিরেকেও পাওয়ার প্রত্যাশী। একই রকমভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সরকার প্রদত্ত অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুযোগসুবিধা এই অনুদানের রাজনীতিতে ভোটের অংকে ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষকে সুবিধা দিলেও আখেরে দেশের মধ্যে সামাজিক বৈসম্য ও বিভেদের সূচনা করেছে। বিভিন্ন কারনে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত এই বৈসম্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আসলে শ্রেণীবিশেষের মানুষকে বিভিন্ন রকমের অনুদান দিয়ে খুশী রাখা রাজনৈতিক লাভের জন্য ফলপ্রসু হলেও তা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ণের পরিপন্থী। কিভাবে? সরকারী কোষাগারের অর্থ দিয়ে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত কিছু মানুষকে অনুদান দিলে ঐ মানুষদের শ্রমবিমুখ করে তোলা হয় আর সেই সঙ্গে সরকারী কোষাগারের যে অর্থ উন্নয়নের জন্য ব্যয় হওয়ার কথা তাও নষ্ট হয়। অনুন্নয়ণ কর্মসংস্থানকে ব্যহত করে এবং অনুদান মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। এভাবে সমাজে কর্মবিমুখতার সঙ্গেসঙ্গে কর্তব্যবোধেরও অভাব দেখা দেয়। আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা প্রকৃতপক্ষে তাই।
ম্যালথাসিয়ান তত্ত্বের এক অদ্ভুত প্রয়োগ আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যায়। সমাজের যে গোষ্ঠীর কাছে সরকারী অনুদান বেশী পৌঁছায় তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাকি অংশের চেয়ে বেশী। এর বড় কারন, অনুদানের নিশ্চিতকরন যেমন ঐ জনগোষ্ঠীকে বংশবৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা করেছে, তেমনই তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য রাজনীতিকরা দেশের উন্নয়নের চেয়ে এদের অনুদান বৃদ্ধি করে ‘ভোটযুদ্ধে’ জিতে ক্ষমতার মধুভান্ড ভোগ করার সহজ সরল পথটাই বেছে নিচ্ছে। ফলে, খাদ্যভান্ডারের উপর চাপ পড়ছে। খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। আবার এইসব প্রক্রিয়ার ফলে এধরনের মানুষের মধ্যে দেশের ও সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধের বিকাশই হয়নি। এরা ব্যক্তি বা দলবিশেষের প্রতিই বিশ্বস্ত থাকছে।
এর প্রতিফলন আমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। সংবাদমাধ্যমগুলোর, এমনকি সোশালমিডিয়া অব্দি তাদের সঠিক
সংবাদ পরিবেশনের বদলে ব্যক্তিবিশেষ বা রাজনৈতিক দলের প্রচারেই যত্নবান হচ্ছে। বিশেষ সংবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে বা বিকৃতভাবে পরিবেশন করে জনমত গঠন করার মত অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে এদের তথাকথিত সংবাদ পরিবেশন দেশের ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে।
আগে সমাজে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কথার গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এইসব ‘বিক্রিত’ সংবাদমাধ্যমের প্রচারের ঢক্কানিনাদে তারা ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করেন যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে তাদের দলীয় স্বার্থে মুখখোলা বা কলম ধরা – অন্য সময় তাঁরা কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রামগ্ন থাকেন! আজকাল আবার সব প্রফেশানের মানুষজন ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে বিবেচিত হন! সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে ধরে খেলোয়ারাও নাকি বুদ্ধিজীবী! এর ফলে এদের বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট হয়ে গেছে। এদের কাছে সমাজের সাধারন মানুষের কোন প্রত্যাশাও নেই আর এইসব মানুষজনদের কর্তব্য শুধু বুদ্ধি করে নিজের আখের গুছোনোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আজ, স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে এসে দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কোন রাজনীতিক, কোন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলছেন না যে, আমরা ভারতীয়রা যদি ভারতীয়ত্ব জলাঞ্জলী দিই, তাহলে ভারতের অস্তিত্বই থাকবেনা – সেক্ষেত্রে আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকবেনা। আর আমাদের সমাজের, দেশের প্রতি প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্যবোধ যদি জাগ্রত হয়, আমরা যদি ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে দেশের ও সমাজের স্বার্থে কাজ করি, তবে আমাদের ভারত আবার “জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”। এতে কিন্তু ভারতবাসী হিসেবে আমাদের সবার গুরুত্ব বাড়বে।
গণতন্ত্রের নামে দেশাত্মবোধের বিরোধীতা রাজনীতি নয়
