গান্ধীজীর বার-এট-ল ডিগ্রী কোথায়

আধুনিক ভারতের ইতিহাসে কোন অবিসংবাদী জননেতার নাম করতে হলে রাজনীতির পক্ষপাত ছাড়া মানুষ একটিই নাম করবে- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি ‘মহাত্মা গান্ধী’ বা ‘বাপুজী’ নামেই আপামর ভারতবাসীর কাছে পরিচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিনগুলিতে যে মানুষটির ডাকে আসমুদ্র হিমাচলের মানুষ আন্দোলিত হয়েছে, যে মানুষটির ‘অসহযোগ’ ও ‘অহিংস’ আন্দোলন শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তাঁর ব‍্যক্তিত্ব ছিল সংশয়াতীত। এই মানষটির সমাজ-চেতনা, সামাজিক ধ‍্যান-ধারনা, দেশগঠনের ভাবনা ও ‘অহিংসা’ এবং সত‍্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা তাঁকে ‘মহাত্মা’ আখ‍্যা দিয়েছে।
এমন একজন মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া আমার মত কোটি কোটি মানুষের কাছে আবশ‍্যিক। অথচ বিভিন্ন ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের গ্রন্থগুলিতে তাঁর জীবন ও কর্মধারার মধ‍্যে কিছু ধোঁয়াশা লক্ষ‍্য করা যায়। এই ধোঁয়াশাগুলি যদি তথ‍্য সহযোগে মুক্ত করা যায়, তবে আমাদের জাতীয় নেতা এবং দেশের জনক গান্ধীজীর প্রতি সুবিচার করা হবে।
গান্ধীজী ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর কাথিয়াবার এজেন্সির পোরবন্দর শহরে করমচাঁদ ও তাঁর চতুর্থ স্ত্রী পুতলীবাইয়ের কণিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। আর ৭৮ বছর বয়েসে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর পরিবার,মা-বাবা, ভাই-বোন সম্পর্কে সমস্ত তথ‍্য থাকায় তাঁর পরিবার সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারনা আছে। তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু তথ‍্য পাওয়া গেলেও অপেক্ষাকৃত কম জানা আছে। হ‍্যাঁ, তিনি আলফ্রেড হাইস্কুল, রাজকোটে ১৮৮০ থেকে ১৮৮৭ সাল অব্দি পড়াশুনা করেন এবং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভাবনগর স্টেটের সামালদাস আর্টস কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ‍্যেই তিনি কলেজ যাওয়া বন্ধ করেন এবং কলেজ ড্রপআউট হন। এর মধ‍্যে তিনি তেরো বছর বয়েসে বিবাহ করেন এবং তারপর তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। তাঁর জীবনীকারদের থেকে এবং তাঁর নিজের আত্মজীবনী থেকে যেটুকু জানা যায় তা হল, গান্ধীজী ছাত্র হিসেবে অতি সাধারন মানের ছিলেন এবং কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে গ্র‍্যজুয়েশান কমপ্লিট করতে পারেননি। কলেজ ড্রপআউট হয়ে তিনি স্থির করলেন, লন্ডন গিয়ে তিনি ব‍্যরিস্টারী ডিগ্রী করবেন। গান্ধীজীর মা পুতলীবাই তাঁর কণিষ্ঠ পুত্রের বিদেশ যাত্রায় রাজি ছিলেন না। কিন্তু গান্ধীজী সকল বাধা উপেক্ষা করে মুম্বাই (তখনকার বোম্বে) হয়ে লন্ডন পৌঁছালেন এবং তাঁর আত্মজীবনী অনুযায়ী তিনি ‘ইনার টেম্পল’এ ভর্তি হলেন। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন, ফ‍্যাকাল্টি অফ ল কিন্তু ব‍্যারিস্টারদের ডিগ্রী দেয়। আর ল যাঁরা প্র‍্যকটিস করেন, অ‍্যাটর্নি ও বিচারকদের চারটি ইন্ এ বিভক্ত হয়ে তাদের মেম্বার হতে হয়। এই চারটি ইন্ হল – গ্রে’জ ইন্, লিঙ্কনস ইন্, মিডল টেম্পল, এবং ইনার টেম্পল। এই চারটি ইন্ এ ল এর ছাত্ররা লেকচার শোনে। সেখানে ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট সংখ‍্যক ‘ডিনার’ হোষ্ট করতে হয়। ডিনারের পর লেকচার ও আলাপচারিতার মাধ‍্যমে ছাত্রদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। পুরো ডিনার সংখ‍্যার মধ‍্যে ছাত্রদের ন‍্যূনতম সংখ‍্যার ডিনারে উপস্থিত থাকা বাধ‍্যতা মূলক। রেকর্ড থেকে জানা যায় যে গান্ধীজী এই ইনার টেম্পলে ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তবে তাঁর নাম রেকর্ড করা ছিল “Informal auditing student” হিসেবে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের খাতায়! এই ব‍্যপারে ইনফরম‍্যাল অডিট স্টুডেন্টের ব‍্যখ‍্যাও দেওয়া আছে। অডিট স্টুডেন্ট তাঁরাই যারা জ্ঞান আহরনের জন‍্য ক্লাস করেন, কিন্তু তাঁদের মূল‍্যায়ণ হয় না এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের গ্রেড পাওয়ার কথা নয়। ফলে গ্রেড, তা পাশ বা ফেল যাই হোক না কেন, অডিট স্টুডেন্টদের পাওয়ার প্রশ্ন আসে না। আর ইনফর্মাল স্টুডেন্ট মানে ফর্মাল স্টুডেন্ট নন – এটাই ত স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, যে চারটি ইন্ এর কথা বলা হয়েছে, তারা লএর ছাত্রদের, যারা ভবিষ্যতে বার-এট-ল হবেন, তাঁদের ট্রেনিং দেয় এবং এই ট্রেনিং ইংল‍্যান্ড ও ওয়েলশে প্র‍্যাকটিস করার জন‍্য আবশ‍্যিক। এই ইন্ গুলি ট্রাষ্টিবোর্ডের অধীনে কাজ করে, এরা কিন্তু ল গ্র‍্যাজুয়েটের ডিগ্রী দেয়না। ডিগ্রী একমাত্র দিতে পারে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন। সেখানে আবার গান্ধীজীর রেজিষ্ট্রেশান ইনফর্মাল অডিট স্টুডেন্ট হিসেবে। পুরো ব‍্যপারটাই কেমন ধোঁয়াশা। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন‍্য গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে মনোনিবেশ করা গেল। কারন, গান্ধীজী রাজা হরিশ্চন্দ্রের ন‍্যায় নীতি ও সততার আদর্শে অনুপ্রাণিত। সেখানে তিনি ভারতে ফিরে আসার আগে ইংল‍্যান্ডের হাইকোর্টে তার নিজের নাম নথিভূক্ত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর আত্মজীবনীর ২৪তম অধ‍্যায়ে লেখা, “I passed my examinations, was called to the bar on 10th June 1891 and enrolled in the High Court on the 11th. On 12th, I sailed for home”। এখানে কয়েকটি কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। “called to the bar” এবং আরেকটি কথা, “keeping terms” এর অর্থ করলে দাঁড়ায় যে, ইনার টেম্পলে ২৪টি ডিনার ক্লাসের মধ‍্যে ন‍্যূনতম ৬টি ডিনার ক্লাস যা বাধ‍্যতামূলক, তা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইনার টেম্পলের এই criteria তিনি পূর্ণ করেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীর ব‍্যপারে গান্ধীজীর আত্মজীবনী যেমন নির্দিষ্ট করে কিছু বলে না; তেমনি তাঁর জীবনীকারেরা যেমন, ডি জি টেন্ডুলকার, রবার্ট পেইন, বি আর নন্দা ও জিওফ্রে অ‍্যাশ এবং অন‍্যান‍্যরা কিছু বলেননি। আবার ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের প্রাক্তনীদের তালিকায় গান্ধীজীর নাম আছে – পরিচয় ভারতের স্বাধীনতা ও অসহযোগ আন্দোলনের পুরোধা। এদিকে আবার গান্ধীজী অডিট স্টুডেন্ট ছিলেন; যাদের সম্পর্কে ইউনিভার্সিটিতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে, “In this case audit indicates that the individual merely has received teaching, rather than being evaluated as having a given standard of knowledge of the subject. The term ‘audit’ is Latin, translated as ‘he/she hears’. In other words, the audit student has experience the course, but has not be assessed”।
এরপর গান্ধীজী দেশে ফিরে এসে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে বোম্বে হাইকোর্টে রেজিষ্টার্ড হলেন। সেখানে আবেদন পত্রে গান্ধীজী পরিষ্কার ভাষায় নিজেকে ব‍্যারিষ্টার হিসেবে উল্লেখ করলেন। হাইকোর্ট যখন সেই আবেদন গ্রহন করেছিল তখন নিশ্চয়ই তারা সঠিক কাগজপত্রের ভিত্তিতেই তা করেছে বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ গান্ধীজীর ব‍্যারিষ্টারী ডিগ্রী পাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথায়? কিভাবে? সে জিনিসটা কোন জীবনীকার পরিষ্কার করে বলেননি। এমনকি তাঁর আত্মজীবনীতেও তা পাওয়া যায় না। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতে ঐ ২৪ তম অধ‍্যায়ে যেটুকু বলা আছে তার বাইরে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী নিয়ে আর কোন কথা নেই। এমনকি ইনার টেম্পলে তাঁর সামাজিক ও আর্থিক অসুবিধা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও ল পড়ার ব‍্যপারে বা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ে কোন কথা নেই! এদিকে ২০০৩ সালে লেখা একটি নথি থেকে জানা যায় যে, গান্ধীজী লন্ডনের হাইকোর্টে ১১ই জুন রেজিষ্টার্ড হওয়ার কথা বললেও তার লন্ডনের কোর্টে সওয়াল করার রেকর্ড পাওয়া যায় না। এছাড়া ঐ নথি থেকে এও নিশ্চিতভাবেই জানা যায় যে, কোর্টের যে চারটি ইন্ আছে তারা কোন ল ডিগ্রী দিতে পারে না। সুতরাং গান্ধীজীর ইনার টেম্পল থেকে ব‍্যরিষ্টারী পাশ করার সুযোগ ছিল না। আবার “Informal auditing” ছাত্র হওয়ায় ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে ডিগ্রী পাওয়াও সম্ভব নয়। গান্ধীজীর আত্মজীবনীতেও তাঁর ল ডিগ্রী পাওয়ার ব‍্যপারে কিছু কথা নেই। ওদিকে লন্ডনের হাইকোর্টেও গান্ধীজীর রেজিষ্টার্ড হওয়ার প্রামাণ্য নথি পাওয়ার প্রশ্ন নেই কারন তিনি সেখানে বার কাউন্সিলের সদস‍্য হননি। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ১১ই জুন তিনি রেজিষ্ট্রি করার আবেদন করেছিলেন আর ১২ই জুন দেশে ফিরে আসেন! সুতরাং আবার ধোঁয়াশা। কিছুই পরিষ্কার হল না।
পরিশেষে আসি গান্ধীজী সম্পর্কে ডঃ বি আর আম্বেদকারের কথায়। তিনি কিন্তু গান্ধীজীর বম্বে হাইকোর্টের সওয়াল প্রত‍্যক্ষ করে মন্তব‍্য করেছিলেন, সওয়াল করতে গিয়ে গান্ধীজীর নাকি হাঁটু কাঁপত! আবার ডঃ আম্বেদকার ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের সব কটিতেই উপস্থিত থাকলেও রাজনৈতিক কারনে গান্ধীজী শুধু দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ঐ বৈঠকে তিনি কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।ঐ বৈঠকে গান্ধীজীর সওয়াল সম্পর্কে মন্তব‍্য করতে গিয়ে পরবর্তী এক সময়ে ডঃ আম্বেদকার বলেন যে, গান্ধীজী তাঁর ল পয়েন্টে সওয়াল না করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস‍্যুগুলিকে তুলে ধরেন। অবশ‍্য এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, হরিজনদের সংরক্ষণ নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে ডঃ আম্বেদকারের তীব্র মতবিরোধ ছিল। ডঃ আম্বেদকার সংরক্ষণের পক্ষে এবং গান্ধীজী তার বিপক্ষে মত পোষন করতেন। যাক, সে ভিন্ন কথা। আমরা ঐ সময়ের অন‍্য ল গ্র‍্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে, যেমন জওহরলাল নেহেরু, মহম্মদ আলী জিন্না, লিয়াকত আলী বা হুসেইন সুরাবর্দীদের ক্ষেত্রে কিন্তু বার-এট-ল এর ডিগ্রীতে এমন ধোঁয়াশা দেখা যায় না।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে গান্ধীজীর বার-এট-ল হিসেবে শিক্ষাগত যোগ‍্যতায় একটা ধোঁয়াশা আছে। এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে উনি এই ডিগ্রী অর্জন করেননি। প্রামান‍্য নথি, পরীক্ষা পদ্ধতি ও গান্ধীজীর আত্মজীবনী – এই সবগুলিই একসঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধোঁয়াশা দেখা যায়। একজন ভারতবাসী এবং গান্ধীজীর গুণগ্রাহী মানুষ হিসেবে এই প্রার্থনাই করি যে আরো তথ‍্য দিয়ে এই ধোঁয়াশা দুর করা উচিত। কারন, আমাদের জাতির জনকের স্থান সমস্ত রকম সমালোচনার ঊর্ধে। বোম্বে হাইকোর্টে গান্ধীজীর আবেদন অনুযায়ী যদি ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের থেকে তাঁর বার-এট-ল পরীক্ষায় বসার এবং গ্রেড লাভের নথি পাওয়া যায়, তাহলে সব বিতর্কের ও ধোঁয়াশার অবসান হতে পারে। সরকারের তরফে এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও নথি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশের অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *