জলই জীবন

            পৃথিবীর সব ভাষাতেই বলা হয় – “জলই জীবন”। প্রবহমান প্রাণের স্পন্দনের অন‍্যতম শর্ত হল – জল। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষ জানে না যে, পৃথিবীর সমগ্র জলের পরিমাণের মাত্র ২.৭% জল পানীয়! গত ৪০-৫০ বছর ধরে জলের অপচয় বিষয়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরন করা হচ্ছে! ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন UNICEF এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে জল-বিশেষজ্ঞ হিসেবে গিয়েছি, সেখানেও জল সংরক্ষণের ব‍িষয়ে জোর দেওয়া হত। কিন্তু মানুষের লোভ এবং স্বাচ্ছন্দের জন‍্য উন্মত্ততা বর্তমান প্রজন্মকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে!
               গত ১৪ই এপ্রিল, ২০২৩ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী শহর কেপটিউনকে পৃথিবীর প্রথম রাজধানী শহর হিসেবে খরা-প্রবণ বলে ঘোষণা করা হয়। এই সঙ্গে সেখানে প্রশাসন পানীয় জল সরবরাহ করতে অপারগ বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। বুঝুন অবস্থা! কেন্দ্রীয় সরকারের National Aquifer Mapping & Management Programme (NAQUIM) যে সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট পেশ করেছে সেটি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দুই চব্বিশ পরগণা ও হাওড়া জেলার পক্ষে ভয়াবহ। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে কলকাতায় ৭ থেকে ১০ মিটারের মধ‍্যে ভূগর্ভস্থ জল পাওয়া যেত। বর্তমানে তা ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৫ থেকে ১৬ মিটার নীচে নেমে গেছে! ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আলিপুর, বালিগঞ্জ, কালিঘাট ও  পার্কসার্কাস অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ১৪ থেকে ১৬ মিটারে নেমে গেছে!  বাঁশদ্রোণী, গড়িয়া অঞ্চলে, যেখানে আগে ভূগর্ভের ৫ – ৬ মিটারের মধ‍্যে জল পাওয়া যেত, সেখানে এখন ৮ থেকে ১১ মিটারে জল মিলছে! যেজন‍্য রাজ‍্য-সরকার ব‍্যক্তি মালিকানার বাড়িতে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ব‍্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু এখনো সরকারের তরফে কোন comprehensive  কার্যকরী প্ল‍্যান করতে দেখা যাচ্ছে না। যেমন, KMC নিজেই ২৬৪ টি ডিপ টিউবওয়েল এবং প্রায় ১০,০০০ শ‍্যালো টিউবওয়েল চালু রেখেছে, যার থেকে গড়পরতা ৪ হাজার লক্ষ লিটার জল তোলা হচ্ছে।   
            পশ্চিমবঙ্গের “চালের ভান্ড” বলে পরিচিত বর্ধমানে এই ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ার পরিমাণ সর্বাধিক! এই জেলায় উন্নয়নের নামে যেমন ব‍্যপকহারে নগরায়ণ হয়েছে, তেমনি পাম্প করে যথেচ্ছভাবে মাটির তলার জল তোলা হয়েছে, এমনকি সেচের কাজেও পাম্প করে প্রচুর জল তোলা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই জেলার এবং পার্শবর্তী বীরভূমের নদীগুলি গ্রীষ্মকালে প্রায় জলশূণ‍্য হয়ে পড়ছে! এভাবে চললে অদূর ভবিষ‍্যতে এই রাজ‍্যেও কেপটাউনের মত পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে!    
                   রাজ‍্যের ৩৪১ টি ব্লকের মধ‍্যে প্রায় ৮০% ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলস্তর বিপজ্জনকভাবে নামছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে রাজ‍্য বা কেন্দ্র, কোন সরকারই এখনো পর্যন্ত ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত নেয়নি। দ্রুত ও দীর্ঘ নগরায়নের প্রভাবে বৃহত্তর কলকাতায় ভূগর্ভের জলস্তর ৭ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে – এমনই ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় জানা যায়। আবার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ার কারনে বিভিন্ন নদী, জলাশয়ে গ্রীষ্মকালে জলস্তর অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা উচিৎ। দ্রুত নগরায়নে জলের চাহিদা বাড়ায় যেমন ভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি জলস্তর নেমে যাওয়ার কারনে জলে লবণাক্ততা সহ বিষাক্ত রাসায়নিক – যেমন আর্সেনিক, সীসা ইত‍্যাদির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, পেটের রোগ, চামড়ার রংয়ের পরিবর্তন  এমনকি শরীরের ঘা পযর্ন্ত হচ্ছে! যেহেতু এই বিষ জলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষের শরীরে ঢুকছে, এর পুঞ্জীকৃত বিষক্রিয়ায় মৃত‍্যু পযর্ন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু সংবাদ এখানে তুলে ধরছি – পাণীয় জলের সমস‍্যার প্রতিবাদে সিউড়িতে বিক্ষোভ ; প্রতি বাড়িতে কল থাকলেও নলে জল না আসায় দেবেনন্দপুরে রাস্তা অবরোধ; আর্সেনিকমুক্ত জল প্রকল্পের ৮০% মেশিন বিকল, চলছে অবৈধ কারবার; বিদ‍্যুৎ ও পানীয় জলের সমস‍্যায় সাগরদত্তে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ ; গরম পড়তেই উখড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে পানীয় জলের সংকট; পানীয় জলের দাবীতে সাহাপুরে বাসিন্দাদের অবরোধ; রতুয়ার শ্রীপুর ২ পঞ্চায়েতে পরিস্রুত পানীয় জলের সংকট; গরমের দাপট বাড়তেই তীব্র পানীয় জলের সংকট জয়নগরে ; কেতুগ্রামের সীতাহাটি পঞ্চায়েতে ছয়টি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার ভুগছে তীব্র জল সংকটে; দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লক্ষ্মীনারায়ণপুরে জল সংকট। বাড়ি বাড়ি কল থাকলেও নেই জল! ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী।
                 আরেকটি বড় ক্ষতি চাষাবাদের। সেখানে চাষের প্রয়োজনে শ‍্যালো পাম্পের ব‍্যবহার যত বেশী হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর ততো নীচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে বড় গাছের গোড়া শুষ্কতায় ভূগে দ্রুত মৃত‍্যুর দিকে ঢলে পড়ছে। বিশেষভাবে দুই চব্বিশ পরগনায় আম, লিচু এবং পেয়ারা চাষে এর প্রভাব লক্ষ‍্য করা গেছে। যত সময় যাচ্ছে, এই সমস‍্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
                 একথা সত‍্যি যে, সারা বিশ্বেই আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগরায়ণের চাহিদা বৃদ্ধির কারনে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ অ‍্যাকোয়াফার লেভেলকে রিচার্জ করার জন‍্য আমাদের দেশে বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক কারনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। এখন দ্রুত নগরায়ণের কারনে বড় গাছ কেটে ফেলার জন‍্য বৃষ্টিও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সেজন‍্য খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে সমস‍্যা আরো মারাত্নক হচ্ছে। বিশেষভাবে তামিলনাড়ুতে এই অবস্থা সামাল দেওয়ার জন‍্য rain water harvesting ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার কিছু সুফলও মিলেছে।
              আমরা এখুনি সতর্ক হয়ে যদি বহুমূখী পরিকল্পনায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর রিচার্জিংয়ের ব‍্যপারে যত্নবান না হই, তাহলে আগামী দিনে রাজ‍্যে চিরস্থায়ী খরা নেমে আসবে! প্রথমত, উন্নয়নের নামে বৃক্ষছেদন ও নগরায়ণের নামে বহুতল ফ্ল‍্যাট বাড়ি বানানো বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। তাছাড়া, প্রতিটি বড় গাছ কাটার সময় ঐস্থানের আশেপাশে অন্ততঃ দশটি একই ধরনের গাছ লাগানো বাধ‍্যতামূলক করা উচিৎ। তাছাড়া, যে সব পাবলিক টয়লেট ও মিউনিসিপালিটির কল দিয়ে জলের অপচয় হয়, তা বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। বিশেষভাবে ব‍্যবহার করার সময় ছাড়া অন‍্য সময় যাতে কলে জল না আসে, সেই পদ্ধতি ব‍্যবহার করা দরকার। নগরায়ণের প্রশ্নে  ভার্টিকাল এক্সপানশান অপেক্ষা হরাইজন্টাল এক্সপানশানের উপর জোর দেওয়া উচিৎ। সম্প্রতি আইসল‍্যান্ডে আমি দেখেছি, একমাত্র রাজধানী রিকিয়াভিক ছাড়া অন‍্য কোথাও বহুতল বাড়ি নেই! সেখানে তিনতলার চেয়ে উঁচু বাড়ি দেখিনি। বহুতল বাড়ির সংখ‍্যা যত বাড়বে, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর তত নামবে। কারন, বড় শহর ছাড়া অন‍্য সব জায়গায় নদীর জল শোধন করে নলের মাধ‍্যমে সর্বত্র পাঠানো সম্ভব নয়। ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে গেলে আরেকটি সমস‍্যা হল, মাটির বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়া। এর ফলে, যেমন ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়বে, তেমনি এইসব বাড়ির দেওয়ালে দ্রুত ফাটল দেখা দেবে।
          ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় সেচের জন‍্য খরচের পরিমাণ বাড়ছে, সেইসঙ্গে বিদ‍্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। জমির ফসলের পরিমাণ কমছে।
             তার সঙ্গে এই রাজ‍্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত জলাভূমি বুজিয়ে ইট-কাঠ-পাথরের নির্মাণ করে শুধু ভূগর্ভস্থ জলস্তরকেই নীচে ঠেলে দেওয়া নয়, জল-দূষণ অত‍্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে! কলকাতার পূর্বদিক জুড়ে যে বিশাল জলাভূমি একসময় কলকাতাকে তার পানীয় জলের স্তর ঠিক রেখে, বিভিন্ন অ‍্যাকোয়াফারের প্রাকৃতিক ফিল্টারের মাধ‍্যমে জলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায‍্য করত, এবং সেইসঙ্গে বায়ুদূষণ কমিয়ে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখত, তা বুজিয়ে দিতে দিতে আজ পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় ৫% জলাভূমিও অবশিষ্ট নেই। উচ্চ-আদালতের নির্দেশে জলাভূমি বুজিয়ে বাড়ি তৈরী করা বেআইনি – এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকোর দিয়ে জলাভূমি বোজানো চলছে! শুধু কলকাতা নয়, সারা রাজ‍্যে উন্নয়নের জোয়ারে এই একই অবস্থা! যে ভাবে রাজ‍্যের বিভিন্ন জেলায় মাটির নীচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে, তার ফলে আর ১৫-২০ বছরের মধ‍্যে রাজ‍্যে জলের খরা অবশ‍্যাম্ভাবী।
             আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিয়ে ওরিগনের ক্রেটার লেককে সংরক্ষণ করে ক্রেটার ন‍্যাশনাল পার্ক তৈরী করেছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে এই লেকের জলে আর্সেনিক দূষণ পাওয়ার পরসে দেশের সরকার নড়েচড়ে বসে। কিন্তু আমাদের সরকার – কাকস‍্য পরিবেদনা! কলকাতা, দুই চব্বিশ পরগণা সহ রাজ‍্যের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক, সীসা সহ e-coli ও আরো অনেক প্রাণঘাতী বিষের প্রদূষণ বাড়তে থাকলেও রাজ‍্য, কেন্দ্র – উভয় সরকারই কমিটি, আইন এসব করেই ক্ষান্ত! কোন কার্যকরী সুরাহার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের হৃদয় – কলকাতা, তার পার্শবর্তী জেলাগুলি ধীরে ধীরে মঙ্গলগ্রহের মত জলশূণ‍্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে! অন্ততঃ কেপটাউন মিউনিসিপালিটির মত কবে শুনব KMC বিজ্ঞপ্তি জারি করছে – জনগণকে আর পাণীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব নেওয়া হবে না! তবু, তার আগে জলের অপচয়টুকু কি বন্ধ হবে না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *