গত দশ বারো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এক উপদ্রব নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এই উৎপাত যেহেতু একবার একটি পরিবারের উপর সীমাবদ্ধ থাকে, সেজন্য এর সামাজিক প্রভাব সীমিত – তাই এ নিয়ে সংবাদ করলে সংবাদ-মাধ্যমের টিআরপি বাড়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই! তবে দিন দিন যেভাবে তৃতীয় লিঙ্গের (যাদের সাধারনভাবে হিঁজরে বলা হয়) সংগঠিত তোলাবাজি বেড়ে চলেছে,বিশেষতঃ প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং অবশ্যই পুলিশী উদাসীনতায় – তার দায় সরকারের অস্বীকার করার উপায় নেই।
ঝাড়গ্রামের রাধানগর অঞ্চলের একজন ড্রাইভার চন্দন খিলারের স্ত্রী তনিমার জমজ পুত্রের জন্মের পরে শিলদা হাসপাতালের নিও-নাটাল কেয়ারে শিশুদুটিকে একমাস রাখার পর তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তার দিন কুড়ি বাদে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দল বেঁধে এসে ঐ পরিবারের কাছে ১২ হাজার টাকা দাবী করে। চন্দনের পরিবার তাদের অপারগতার কথা জানালে তারা গালাগালের সঙ্গে বিস্তর দরাদরি করে। অবশেষে তারা ২ হাজার টাকায় রফা করে। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও শিশুদুটিকে নিয়ে উদ্দাম নাচানাচি করতে থাকে। তার ফলে দুটি শিশুর মধ্যে সুমন নামের একটি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ঐ দলটি শিশুদের ফেরৎ দিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করে। শিশুটিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিলদা হাসপাতালে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় পাড়ার লোকজন ঐ দলের তিনজন হিঁজরেকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। চন্দনের FIRএর ভিত্তিতে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। তদানীন্তন এসপি ভরতকুমার রাঠোর পদক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের কোন শাস্তির কথা জানা নেই।
আবার বেহালায় এক পরিবার পুলিশে নালিশ জানায় যে, ঐ বাড়িতে নবজাতক শিশুর জন্য তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ দল বেঁধে এসে চারমাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার ২১ হাজার টাকা দাবী করে! যদিও বাড়ির মানুষরা জানান, তাঁরা আগে একবার টাকা দিয়েছেন, তবু তারা হিঁজরেদের দেওয়া ‘কার্ড’ দেখতে চায়! ঐ কার্ড ঐ মুহূর্তে বাড়ির লোকে কাছে ছিল না। হিঁজরেরা ঐ মুহূর্তে বাড়ির সামনে অসহনীয় চেঁচামেচি ও গালাগাল করতে থাকায় ঐ পরিবার ঠাকুরপুকুর থানায় অভিযোগ জানিয়ে বলে, ঐ গোলযোগের সময় তারা ১০০ ডায়াল করেও কোন রকম রেসপন্স পাননি! তারপর ঐ পরিবার কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে অভিযোগ জানালে তারা জানায় যে, অভিযোগটি ঠাকুরপুকুর থানায় পাঠানো হয়েছে, কারন ঘটনাটি ঘটে ঐ থানার ‘এলাকায়’! ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। তারপর এই কেস নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি!
এরপর আসি অতি সাম্প্রতিককালের বিধাননগর থানা এলাকার ঘটনায়। সেখানে বিবাহিত কন্যা তার মেয়ের জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে পিত্রালয়ে আসে। শিশুটির জন্মের একমাসের মধ্যে একদল হিঁজড়ে এসে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে! তারপর যখন তারা বাড়িটি শিশুর মামাবাড়ি বলে জানে, তখন বিস্তর দর কষাকষির পর ১৬ হাজার টাকা, সঙ্গে নতুন কাপড় নিয়ে একটি কার্ড দিয়ে চলে যায়। ঐ ছাপানো কার্ডে লেখা ছিল, ঐ অঞ্চলের টাকা নেওয়ার দায়িত্ব ঐ ইউনিয়নের! তাদের এলাকাও চিহ্নিত ছিল! এই ঘটনার মাসখানেক বাদে আবার পরপর দু সপ্তাহ হিঁজরেরা ঐ বাড়িতে আসে এবং আবার টাকা দাবী করে! তাদের যখন বলা হয় যে, তাদের দেওয়া কার্ড আছে – তখন প্রথমে তারা চলে গেলেও পরের সপ্তাহে আরো বড় দলে হাজির হয়ে ঐ কার্ড দেখতে চায়! কার্ড জানালার ভিতর থেকে দেখানো হলে তারা বারবার কার্ডটা তাদের হাতে দিতে বলে! যখন তাদের বলা হয়, কোন পরিস্থিতিতেই তাদের হাতে কার্ড দেওয়া হবে না, কারন তাদের টাকা দেওয়ার একমাত্র প্রমাণ ঐ কার্ড, তখন হটাৎ তারা সুর বদল করে ধমকের সুরে বলতে লাগল, ঐ কার্ড জাল! সেজন্য তাদের আবার টাকা দিতে হবে। তারা বাড়ির গেট আটকে অকথ্য চেঁচামেচি শুরু করলে যখন তাদের পুলিশের কথা বলা হল, তারা বলল, পুলিশ নাকি তাদের কথায় চলে! তারপর টাকা না পাওয়ায় তারা তোলাবাজির পরিমাণ আরো বাড়ানোর দাবী করে!
এমন ধমক-ধামক ঘন্টাখানেক চলার পর তারা লক্ষ্য করে যে বাড়িটি cctv কভারেজে মোড়া। তারা বুঝতে পারে যে তাদের বক্তব্য ছবিসহ রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তখন তারা পায়ে পায়ে নিজেদের পথ দেখে।
মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হল। এমন অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে। কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের থেকে সদর্থক পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানা নেই। এমনকি, কলকাতায় ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে পরলে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন গাড়ির কাঁচে বা গাড়ির গায়ে ধাক্কা মেরে টাকা চায়। না পেলে অনেক সময় গালাগাল পর্যন্ত করে। এইসব ঘটছে ২০১১ সাল থেকে।
এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুলিশী পদক্ষেপ না করার কারন অবশ্যই ভীতি। অনেক সময় এরা দলবদ্ধভাবে থানা ঘেরাও করে – মারমুখী হিঁজরেদের উপর বড়সড় পদক্ষেপ করতে মনে হয় পুলিশের উপর কোন অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
এইসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ইউনিয়ন আছে। তাদের নেতা/নেত্রীর বক্তব্য হল, তারা বেঁচে থাকার জন্য এই টাকা নাকি বাধ্য হয়ে তোলে! আমাদের রাজ্যে এদের উপার্জনের কোন ব্যবস্থা রাজ্যের সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এখানেই রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কারন, অন্য অনেক রাজ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উপার্জনের জন্য একাধিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ করা হচ্ছে।কিন্তু এখানে এধরনের কোন পরিকল্পনার কথা জানা নেই। সাধারণ মানুষের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – এদের বিকল্প উপার্জন নেই বলেই তারা তোলাবাজি করবে, জোর করে টাকা নিয়ে যাবে, গায়ের জোর দেখিয়ে অসভ্যতা করবে – আর রাজ্যের পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে! এটা আর যাই হোক, সুশাসনের পরিচয় নয়।
একটি অসমর্থিত খবর হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা গত ২০১১ সালের পর অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের সকলের ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড আছে কি? কারন, শোনা যায় যে এদের একটি বড় অংশ নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছে! এরা সাধারনত দুটি পদবী ব্যবহার করে – ‘মন্ডল’ ও ‘হালদার’। নাম দিয়ে এদের ধর্ম বোঝা যায় না। এরা যদি চোরাই পথে ভারতে আসা বাংলাদেশী হয় এবং এদের এই রাজ্যে ভোটার বানিয়ে এমন তোলাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তার দায় অবশ্যই বর্তমান প্রশাসন ও শাসকদলের উপর বর্তায়। যে ভাবে বিভিন্ন ‘তোলাবাজি’র ব্যবসায় শাসকদলের নেতৃবৃন্দ ধরা পরছেন, এই তোলাবাজিও শাসকের প্রশ্রয়ে হচ্ছে কিনা – সে বিষয়ে জনমানসে সন্দেহ জাগতেই পারে। এখানে একটি পরিসংখ্যান বোধহয় প্রাসঙ্গিক – ভারতের বিভিন্ন কারাগারে যত বিদেশীরা বন্দী আছে তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী। এর মধ্যে সর্বাধিক বন্দী পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলিতে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশী, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সন্দেহ হওয়ার আরো একটি বড় কারন হল, এই জনগোষ্ঠীর উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা রাজ্য প্রশাসনের দায়িত্ত্ব হলেও তারা এ ব্যাপারে চরম উদাসীন।ফলে এদের বিভিন্ন রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজের নৈতিক দায় যেমন রাজ্য প্রশাসনের উপর বর্তায়, তেমনি এদের তোলাবাজির থেকে কাটমানির আমদানির ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার “দুধেল গাই” বাহিনীর সম্প্রসারিত রূপে এই বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলেও মনে হতে পারে। যাই হোক, সরকারি মদতে বা নিষ্ক্রিয়তায় সাধারন মানুষের উপর এভাবে অত্যাচারের অধিকার এই গোষ্ঠীকে দেওয়া যায় না। যদি এদের উন্নয়ণের জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকে, বেশ কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বিভিন্নভাবে যে সব NGO সাহায্য করছে, সেইসব NGOর মাধ্যমে রাজ্য সরকার এদের উপার্জনক্ষম করার পরিকল্পনা নিতে পারে। আসলে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, নইলে নয়। এদের এভাবে একটি ক্রিমিনাল গোষ্ঠী হিসেবে রেখে দিলে হয়ত শাসকের অনেক গোপন বেআইনী কাজের সুবিধা হতে পারে – কে জানে, এখানে অনুসন্ধান করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে কিনা!
একটি comprehensive স্কীম করে এগোতে গেলে প্রথমেই যা দরকার, তা হল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ – অবশ্যই বিশেষ ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। এছাড়া, জনগণনার সময় সংখ্যার বিচারে এদের স্থানভিত্তিক উপস্থিতির রেকর্ড প্রশাসনের কাছে থাকা আবশ্যিক। আধার কার্ডে লিঙ্গ উল্লেখিত থাকলে তার রেকর্ড সরকারের কাছে না থাকার কোন কারন নেই। কাজেই এদের পরিচয়ের রেকর্ড থাকার ব্যাপারে ধোঁয়াশা নেই। এখন, সবকিছু নির্ভর করছে প্রশাসনের সদিচ্ছার উপর। গত এগারো বারো বছর ধরে যা চলছে তাতে এমন ধারনার যথেষ্ট কারন আছে যে, এদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কোন সদিচ্ছা রাজ্য সরকারের নেই। প্রথমতঃ এদের মধ্যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী থাকলে তার প্রাথমিক সনাক্তকরণের দায় সরকারের। দ্বিতীয়ত এদের থেকে তোলাবাজির কাটমাণি পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চাওয়া – হতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য – কাটমানি শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের ধারেকাছে অন্য কোন রাজ্য আসতে পারবে না। আরেকটি কথা, এই হতভাগ্য মানুষগুলিকে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে যেমন বদ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, তেমনি এদের ভোটপ্রক্রিয়ায় সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। সেকথা মাথায় রেখেই ২০১১ সালের পর থেকে এদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি করতে দেওয়া হয়েছে। State sponsored hooliganism এর যে কটি মুখ আছে, তার একটি অন্যতম মুখ এদের দৌরাত্ম্য এবং তা দমন করা দুরে থাক, পুলিশী নিষ্ক্রিয়তা এবং তার সমর্থনে হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করা এই অভিযোগকেই মাণ্যতা দেয়।
সারা পশ্চিমবঙ্গে যত শিশু জন্মাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য মায়ের পিত্রালয় ও শ্বশুরালয় থেকে তোলার পরিমাণ হিসাব করলে বছরে বহু কোটি টাকার এই ব্যবসায় যে কাটমানিচক্র থাবা বাড়াবে – তা অনুমান করা শক্ত নয়। এই অত্যাচার বন্ধ করে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের সুস্থ জীবন ও জীবিকার সুলুক-সন্ধান দেওয়া রাজ্য সরকারের কর্তব্য ও দায়িত্ব। তা না করে এদের ব্যবহার করে কাটমানির লোভে সমাজ জীবন বিপর্যস্ত করা সুপ্রশাসন ও সুস্থ মনের পরিচয় নয়। ভারতের অন্য অনেক রাজ্যে এদের জন্য ভালো ভালো পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাতে কোন হেলদোল নেই! এমনটি কার স্বার্থে করা হচ্ছে তার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।
তৃতীয় লিঙ্গের তোলাবাজি কি প্রশাসনের মদতে
