ধর্ম জীবকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ করে। যে কারনে মানুষ মাত্রেই তার ধর্ম থাকে। মনুষ্যধর্ম মানুষের আদর্শ ধর্ম। মানুষ যখন স্বার্থ, হিংসা ও লোভকে প্রাধান্য দিয়ে মনুষ্য ধর্মের বিপরীত কর্মে লিপ্ত হয়, তখন মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট হওয়ায় সে পশুর তুল্য আচরণ করে। এই সময় অনেক ক্ষেত্রে সে তার ঘৃণ্য কাজের সমর্থনে যে যুক্তি দেখায়, তা হল ‘ধর্মের দোহাই’! যাকে পৃথিবী জুড়ে বলা হয়, “for the shake of religion” – ধর্ম ও religionএর তফাৎ এখানেই। সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারনা তৈরী করা হয়েছে, ধর্ম হল আফিমের মত নেশার জিনিষ; তাই তা বর্জনীয়! আর সেই একই যুক্তিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সব ধর্ম থেকে দূরে থাকার প্রয়াস বলে তা প্রশংসনীয় একটি গুণ (virtue)! এই অপ-ধারনার বশবর্তী হয়ে আমাদের দেশের, বিশেষতঃ আমাদের রাজ্যের এক বিপুল সংখ্যার মানুষ তাদের নিজেদের জীবন, জীবিকাসহ সামাজিক জীবনে অস্থিরতা ডেকে আনছে।
মানবিক আচরণ ও চিন্তাকে অর্থাৎ মনুষ্য ধর্মকে অন্য পথে চালানোর জন্য সবচেয়ে বেশী যা ব্যবহার করা হয়, তা হল, ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি – যাকে সংক্ষেপে religion বলে। মানুষের religion যাই হোক না কেন, তা কখনো মানুষে মানুষে বিভেদ, হিংসা বা সহাবস্থান বিরোধী অবস্থান নিতে পারে না। আবার ধর্মের যে পরম সত্য – সর্বজ্ঞানের আধার – তা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এক – ধারনা বা বিশ্বাস এক নিরাকার রূপ মাত্র। তিনি অদ্বৈতবাদী হিন্দু ধর্মের ভগবান পরম ব্রহ্ম, ইসলামে আল্লা, আব্রাহামিক ধর্মে ঈশ্বর বা গড।
ভারতবর্ষ যখন ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ত্রিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল, তখন মুসলিম লীগের দাবি মোতাবেক সব পক্ষই মেনেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের সহাবস্থান সম্ভব নয় বলে এই স্বাধীন দুটি খন্ডের ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামীদের বসবাসের জন্য স্বীকৃত হল। অথচ, হিন্দু, শিখ, জৈন ও বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য স্বাধীন ভারতের কোন রাষ্ট্রধর্ম না রেখে ইসলামসহ সব ধর্মের সামান অধিকার (মাইনোরিটির নামে ইসলাম ও খ্রীষ্টীয় ধর্মকে বিশেষ সুবিধা) দেওয়ার সংবিধান রচনা করে তদানীন্তন রাজনীতিকরা ভারতের অমুসলিম নাগরিকদের সঙ্গে তঞ্চকতা করেছিলেন। পৃথিবীর দুই সফল ভন্ড দেশপ্রেমিক জওহরলাল এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। এটি ভারতের জন্মের সময়ের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ভুল। জওহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার খেসারত এখনো ভারতকে দিতে হচ্ছে কাশ্মীরে। এই দেশের রাজনীতিকরা যেমন দেশের স্বার্থের আগে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ ও পারিবারিক স্বার্থকে দেখে সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তেমনি তাঁরা আন্তরিকতাবিহীন সেবা দিয়ে দেশের জনগণের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করেন! এই ধরনের রাজনীতির প্রভাব উপমহাদেশের সবকটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উপর প্রভাব ফেলেছে।
আমাদের ভারতের সংবিধান অনুসারে এই দেশের যে কোন নাগরিকের তাঁর religion অনুযায়ী ধর্মাচরনের অধিকার স্বীকৃত। এখানেই যত গোলমাল! ভারতে স্বেচ্ছায় ও কারো কোন প্রভাব ব্যতিরেকে মানুষ তাঁর ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন। ফলে, বিদেশী সাহায্যে পুষ্ট খ্রীষ্টান মিশনারীগুলি দারিদ্র ও অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন ভারতে ধর্মান্তরকরন শুরু করে। বিশেষতঃ দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণে তারা সাফল্য পায়। এই ধর্মান্তরকরন যেহেতু অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে করা হয়েছে, সেহেতু এটি বেআইনি – সংবিধানগত দিক থেকে। কিন্তু তা মানে কে? কারন, এসব দেখতে গেলে এই হতভাগ্য মানুষগুলোর দারিদ্র ও অসহায়তা দূর করার দায় দেশের সরকারকে নিতে হয়! সরকার চালানো রাজনীতিক ও প্রশাসকেরা সে কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
তারপর গঙ্গা, যমুনা, শতদ্রু, বিপাশা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। ধর্মান্তরকরনের সুবিধা ব্যবহার করে ভারতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় অনুপ্রবেশের সুযোগ নিতে শুরু করল ইসলাম। একথা ঐতিহাসিক সত্য যে, ইসলামের ধর্মীয় অনুশাসনের অনমনীয়তা এবং তার বিস্তারবাদী চরিত্র এ কাজে সহায়ক হয়েছে। সামাজিক অনমনীয়তা ও ধর্মীয় প্রভূত্ববাদী চরিত্র একমাত্র ইসলামকে আবদ্ধ করে না রাখলেও, এই ধর্মীয় আবশ্যকতার দিকগুলিকে সবিস্তারে তুলে ধরার কাজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে এই ধর্মের ঠিকাদার মৌলভীদের মারফৎ ইসলামী সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া চলতে লাগল। ধর্মস্থান ও শিক্ষায়তনগুলিকে ব্যবহার করেই ১৯৪৬ সালের কোলকাতা গণহত্যা ও নোয়াখালী গণহত্যা সংঘটিত হল। তার পরেও এই ধরনের গণহত্যা যাতে আর না ঘটে তার জন্য ভারতীয় রাজনীতিকরা মোটেই যত্নবান ছিলেন না।
এরমধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা তাদের জেহাদী ইসলামী চরিত্র তথাকথিত “ধর্মনিরপেক্ষতা”র আড়ালে লুকিয়ে রেখে সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়াতে যার পর নাই ইন্ধন যোগালো। এরা অবশ্য প্রথম থেকেই হিন্দু ধর্ম বিরোধী এবং ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা শুধু ভারতের ক্ষেত্রে জেহাদী ইসলামের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা হিসেব করে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। কাশ্মীরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু নিধন ও হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপে যেমন, পালঘর সন্ন্যাসী হত্যা, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং তাদের রিফিউজি মর্যাদা দেওয়া – ইত্যাদির দাবীতে এদের ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে জেহাদী ধর্মীয় চরিত্রের রূপ প্রকাশ পেয়েছে। আবার চীনে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর ইসলামীদের উপর সে দেশের সরকারের অমানবিক অত্যাচারের প্রশ্নে এই কম্যুনিষ্টরা সম্পূর্ণ মৌণব্রত নিয়েছে – পাছে পালিত বাবা চীনা কম্যুনিষ্ট পার্টি চটে যায়! এভাবেই এরা ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভেদ ও জেহাদী উত্থানের মদতদাতা হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করেছে।
এরপর আসি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রভাবে। এখানে একটা কথা বোঝা দরকার। তা হল ভারতীয় হিন্দুদের সহিষ্ণুতা – যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। যেমন, সামাজিক চাপসহ বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, লাভ জেহাদের ঘটনা বাড়িয়ে একদিকে যেমন জেহাদী ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তা ব্যুমেরাং হয়ে বিপরীত ক্রিয়ায় হিন্দু-সংহতিকে নতুন ভাবে সজীব করে তুলেছে। এখান থেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতে ধর্মের নামে গোষ্ঠী সংঘাত শুরু হয়। নিউটনের পদার্থবিদ্যার সূত্র – প্রতিক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেই ক্রিয়া যখন শুরু হল, তখনই চারদিকে ‘গেল গেল’ রব উঠল। তখন প্রত্যেক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ – অবশ্যই বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শুরু হল। কোন ভারতীয় নাগরিক – তিনি যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন – কাশ্মীরের প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থান এবং কাশ্মীর থেকে তার ভূমিপুত্র, হিন্দু পন্ডিতদের বিতাড়ণ ও হত্যাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন জানাতে পারে? ভারতের বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দ সে কাজটিই করছে! ফল – রাজনীতিতে হিন্দু-ইসলামী বিভাজন যার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ক্ষতির মুখে দুই ধর্মের মানুষজন। যারা এই বিভাজন শুরু করেছেন ও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বুঝতে হবে যে তাদের অনুগামীদের তারা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলেছেন।
ইসলাম ধর্ম মোতাবেক, যারা পবিত্র রমজানের রোজা রাখেন, তাঁরাই একমাত্র উপবাসভঙ্গের ইফতারে অংশগ্রহনের অধিকারী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মসূত্রে প্রেসিডেন্সী কলেজ লাগোয়া হিন্দু হোস্টেলে আমি কখনো হিন্দু ছেলেমেয়েদের আধুনিক পোষাকে ফেজটুপী পড়ে ইফতার পালন করতে দেখিনি।একে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে না – আত্মসম্মানবোধ হারানো, ধর্মের নামে দালালীর পরাকাষ্ঠা হতে পারে মাত্র। ইসলামে হিন্দু মহিলারা পরিবারের বাইরের পুরুষদের সঙ্গে বসে পুরুষের মত ফেজটুপী পড়ে ইফতার করছে – এই দৃশ্য ইসলামকে কলুষিত করছে। সাচ্চা ইসলামী এসব সমর্থন করেন না। আবার, আজকাল বারোয়ারী দূর্গাপুজায় কোথাও কোথাও কোরান পাঠ হচ্ছে! এতে দূর্গাপুজা ও পবিত্র কোরান উভয়েরই অপমান করা হচ্ছে। এগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধ্যাষ্টামো ছাড়া আর কিছু নয়।
দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ২০১৪ সালে তুরষ্কের ইস্তানবুলে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের শেষে প্রায় শ খানেক গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য বসফরাসের উপর এক গালা ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে দু তিনজন ভারতীয় হিন্দুর সঙ্গে আমিও ছিলাম। ডিনার টেবিলে আমার প্লেট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক অস্বস্তিকর গন্ধ পাওয়ায় ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে জানালো টেবিলে সকলের জন্য ‘বিফি’ সহ ডিনার সার্ভ করা হয়েছে। আমার ধর্মীয় পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা প্লেট তুলে নিয়ে গিয়ে আমাকে আলাদা প্লেটে কিছু ভাত, বাটার আর আলুভাজার প্যাকেট দিয়ে গেল। জানালো, এসব পুরোপুরি ‘ভেজ’। এটাই স্বাভাবিক। এদিকে খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ইফতার পার্টিতে আবশ্যক ছিল গোমাংস। এতে অস্বাভাবিকতা নেই। কারন ইফতারের জন্য রোজা রাখা মানুষজন ইসলামী হওয়ায় এটা তাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে পড়ে। সমস্যা হল, ইফতারে হিন্দুদের আমন্ত্রণ করা নিয়ে। কোন হিন্দু যদি তার অনুষ্ঠানে ইসলামী মানুষদের নিমন্ত্রণ করে শুয়োরের মাংসের আইটেম পরিবেশন করেন, তখন তা কি শোভন হবে? এই যুক্তিতেই বাংলাদেশের বিএনপি দলের নেত্রীর আচরণকে হিন্দু বিরোধী জেহাদী আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। মুশকিল হচ্ছে, ভারতে এমনই বিনপি মার্কা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার বাণী শুনে শুনে জনসাধারণ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত। এভাবেই ‘হালাল’ জিনিষ ব্যবহার ইসলামী ঐতিহ্য হলেও রাজনীতির ঔদাসীন্যে ও সামাজিক নিষ্ক্রিয়তায় তা হিন্দুদের গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ, হিন্দু ঐতিহ্যের ‘ঝটকা’ মাংসের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগীতা পাওয়া যায় না।
এসবের প্রভাবে সমাজে ধর্মীয় বিভেদের শুরু মৌলবাদী মৌলভী ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভারত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরা করলেও এখন তা মহামারীর আকার নিয়েছে।এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব ধর্মের মানুষই। তাই, দেশের রাজনৈতিক শাসকদের থেকে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ধর্মীয় অনুশাসন আরোপ করা জরুরী।
ধর্ম ও ধর্ম ব্যবসার প্রভাব
