পশ্চিমবঙ্গের জন্ম ও তার পটভূমি

একটি দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন‍্য যে শর্ত প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন তা হল, দেশের জনগণের ত বটেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। আজ যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ‍্যে যুদ্ধ চলছে, তার আত্মিক শক্তি হল জাতীয়তাবোধ। এমনকি, কম‍্যুনিষ্ট চীন থেকে শুরু করে পাশ্চাত‍্যের দেশগুলিরও চালিকা শক্তি এই জাতীয়তাবোধ। মধ‍্যপ্রাচ‍্যের ইসলামী দেশগুলি – সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সৌদি আরব বা কাতার – সকলেই ধর্মকে স্বীকার করেও দেশ পরিচালনায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেয় জাতীয় স্বার্থকে। কটু শোনালেও, একথা বাস্তবিক সত‍্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিকরা তাদের পারিবারিক স্বার্থকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন! তার জন‍্য ভোটে জেতা জরুরী হওয়ায় তাদের ভোটের স্বার্থে দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপোষ রাজনীতি করতেও দেখা যায়! ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময়ের দুই সফলতম ভন্ড সমাজসেবী হচ্ছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু।
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের জনক চৌধুরী রহমত আলী ১৯৩৩ সালে বৃটিশ ভারতবর্ষের মধ‍্যে থেকে ইসলামীদের জন‍্য আলাদা রাষ্ট্র পাক-ই-স্তান (Land of purity) গঠনের কথা বলেন; যেখানে পাঁচটি প্রদেশ – পঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, সিন্ধ ও বালুচিস্তান ছিল। প্রথমে মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব প্রত‍্যাখ‍্যান করে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৪০সালে লাহোর সম্মেলনে জিন্না দ্বিজাতীতত্ত্ব (হিন্দু আর মুসলমান দুই আলাদা ‘জাতি’) সামনে এনে সহাবস্থান অসম্ভব ঘোষনা করে তার ভিত্তিতে পাক-ই-স্তান গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। হিন্দু রমণীর পাণিগ্রহণ ও প্রিয় খাদ‍্য তালিকায় শুয়োরের মাংস এবং হুইষ্কি থাকায় জিন্নাকে ইসলামী আলেমরা ইসলামের প্রতিভূ বা মেসিহা মনে করতেন না। সেজন‍্য জিন্নাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কংগ্রেসের মধ‍্যে থেকে তাঁর প্রাপ‍্য স্থান ও সম্মান আদায় করে নিতে। কিন্তু কোন স্বাধীনচেতা, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ, সে হিন্দু বা ইসলামী যাই হোন না কেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে টিঁকতে পারতেন না। কংগ্রেসের পালক পিতা হিসেবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রতিষ্ঠার পর, এই দল ধীরে ধীরে গান্ধী ও তাঁর অনুচরদের রাজনৈতিক দলে পরিণত হল। গান্ধীজীর দুই বিশ্বস্ত অনুচর, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প‍্যাটেল ধীরে ধীরে স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত ও প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষজনকে – যেমন বিঠলভাই প‍্যাটেল, সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ‍্য করেছেন। গান্ধীজীর গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না। তার সবচেয়ে বড় নমুনা হল ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে চরম গোষ্ঠীবাজি করে গান্ধী-নেহরু জুটি ও তাদের চামচারা সুভাষকে পদত‍্যাগ করতে ও কংগ্রেস ছাড়তে বাধ‍্য করে। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তিনি সর্বদা তাঁর মতই নয়, তাঁর পথকেও চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
এইসব পর্যবেক্ষণ করে শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় বাঙ্গালী হিন্দুদের জন‍্য বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও চৌধুরী রহমত আলীর যে প্রস্তাবে পাক-ই-স্তান গঠনের কথা প্রথম বলা হয় তাতে বাংলা প্রদেশের কথা ছিল না; পরবর্তীতে গান্ধীর দোদুল‍্যমান নীতিকে চাপে রেখে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সাল থেকে বাংলাকেও পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেবার দাবী জানায়। এই বাংলা ভাগে পক্ষে তদানীন্তন অখন্ড ভারতের সব মুসলিম নেতাই ছিলেন! গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ভাবগতিক ছিল – যাক, বাংলাটা পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে বাঁচা যায়! এর কারন, কংগ্রেসের তিন নেতা – গান্ধী-জওহর-বল্লভভাইদের নেতৃত্বের সংঘাতে বাংলার রাসবিহারী, সুভাষরা বারবার পর্যুদস্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, সাভারকর থেকে বিঠলভাই, এমনকি সুভাষ পর্যন্ত গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ তোষণ রাজনীতি ধরে ফেলেছিলেন! আজকে কংগ্রেস দলের পারিবারিক নেতৃত্ব ও তাঁদের কর্মচারীসম কংগ্রেসী নেতারা গণতন্ত্রের কথা বললেও তাঁরাই গান্ধীর অগণতান্ত্রিক উপায়ে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারণ ও দল পরিচালনায় হস্তক্ষেপের কথা গোপন করেন কেন? ত্রিপুরী কংগ্রেসে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রার্থীকে ভোটে হারানোর ‘অপরাধে’ (!) সুভাষকে অপমান ও অবহেলা করে চক্রান্তের জাল বিস্তারের মাধ‍্যমে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ও জওহরলাল এবং বল্লভভাইয়ের সহযোগীতায় সুভাষকে অল্পদিনের মধ‍্যে পদত‍্যাগ করতে বাধ‍্য করানো – এসব কিন্তু বাঙ্গালী ভোলেনি। স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার ‘দায়িত্ব পাওয়া’ কম‍্যুনিষ্ট ইতিহাসবিদরা এসব কথা লিখতে ভুলে যান! বাঙ্গালী মননে গান্ধী পুজন ও বল্লভভাইয়ের স্ট‍্যাচু কোন আনন্দবার্তা বয়ে আনে না। এমনকি, শুধু পঞ্জাবের বিপ্লবীরাই নয়, বাংলার বিপ্লবীদের কাজকর্মের গান্ধীজী এতটাই বিরোধীতা করেছেন যে, তিনি স্বাধীনতা আদায়ের জন‍্য তাঁর দেখানো অহিংস আন্দোলন ছাড়া অন‍্য কোন পথকেই সমর্থন করা দুরে থাকুক, তার বিরোধীতাই করেছেন। পথ ভিন্ন, উদ্দেশ‍্য এক – এমন মতবাদে গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীনতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করলে বোঝা যায়, গান্ধীজী প্রশ্নহীণ আনুগত্য দেখানো অনুচর ছাড়া কাউকে গুরুত্ব দিতেন না। এমন একজন megalomaniac মানুষের হাতে স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থায় সর্বাধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে যে কটি উল্লেখযোগ‍্য পরিবর্তনের দিকে দেশ এগুলো, তা হল, বাংলার নেতাদের অনেকের নেতৃত্বের ক্ষমতা ও জনভিত্তিকে গান্ধীজী ও জওহরলাল ভয় ও হিংসা করতেন! সে কারনে, বাংলা যদি ভারতের মধ‍্যে না থাকে তাহলে তাদের বিশেষ ক্ষতি হয়না – এজন‍্য ভারতভাগের সময় বাংলা ভাগের কোন অভিপ্রায় কংগ্রেসের ছিল না। যদিও গান্ধীজী বারবার আপামর ভারতীয়কে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ভারতভাগের তিনি বিরুদ্ধে; এমনকি এও বলেছেন, ভারতভাগ তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে! এদিকে তিনি জিন্নার সঙ্গে বৈঠক করেছেন; তাঁর শিষ‍্য জওহরকে স্বাধীন দেশের প্রথম নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এভাবেই তিনি জিন্নাকে কংগ্রেস তথা ভারতের নেতৃত্বে আসার সুযোগ দেননি। গান্ধীজীর কর্মপদ্ধতির মধ‍্যে আন্দোলনের নামে বৃটিশ শক্তিকে বিব্রত না করা; মুসলিম লীগের সব দাবীগুলিতে নীরবতার দ্বারা (মৌণং সম্মতি লক্ষণম্) সমর্থন করা এবং জওহরলালের নেতৃত্বে তাঁর বশংবদদের হাতে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তা দেখা।
এদিকে তখন কম‍্যুনিষ্ট পার্টি পুরোপুরি পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে এবং পুরো বাংলা প্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন‍্য ওকালতি শুরু করে। একাজে তাদের দলের সাধারণ সম্পাদক গঙ্গাধর অধিকারী অগ্রণী ভূমিকা নেন। গঙ্গাধর অধিকারী তাঁর কাজের সমর্থনে ভারতবর্ষের ইতিহাসকেও অস্বীকার করতে পিছপা হননি। তিনি তাঁর লেখায় ভারতবর্ষকে দেশ হিসেবে না দেখে বিভিন্ন প্রদেশের (বা রাজ‍্যের) সমষ্টি হিসেবে দেখেছেন! এমন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে কম‍্যুনিষ্ট পার্টি দলগতভাবে পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে ও বাংলা ভাগে বিরোধীতায় নামে। শুধু তাই নয়, তারা মুসলিম লীগ – বিশেষতঃ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করে। এই দলের অগ্রণী নেতাদের মধ‍্যে মুজফ্ফর আহমেদও ছিলেন! কিছু হিন্দু বাঙ্গালী নেতা, শরৎ চন্দ্র বসু, কিরন শঙ্কর রায় ইত‍্যাদি পাকিস্তান গঠনের দাবীকে সমর্থন করেন এবং বাংলা ভাগের বিরোধীতা করেন। এই নেতারা তাঁদের ব‍্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা করে হিন্দু বাঙ্গালীর ভবিষ‍্যৎ জ্বলাঞ্জলী দেওয়ার রাস্তা দেখাতে চেয়েছেন।
এই সময় শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় বৃটিশ রাজশক্তিকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন – বাংলায় ইসলামী শাসনের আগে এদেশের কৃষ্টি, ঐতিহ‍্য, সভ‍্যতা, খাদ‍্যাভাস, সবই এক থাকলেও ইসলামী শাসনের পরে তা পাল্টে যায় – একথা মসলিম লীগের তত্ত্বেও উঠে এসেছে আর কংগ্রেসও এতে আপত্তি করেনি। তিনি যুক্তি দিলেন যে, জনসংখ্যার ২৪% যদি এই কারনে আলাদা রাষ্ট্র পায় তবে বাংলার হিন্দুদের (অবিভক্ত বাংলায় ৪৫% মানুষ ছিলেন হিন্দু) উপর অবিচার হবে।ধর্মীয় কারনে বিভাজনের ক্ষেত্রে তিনি হিসেব করে হিন্দু অধ‍্যুষিত পরগণাগুলিকে নিয়ে আলাদাভাবে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টির সওয়াল করেন। তখন শরৎ বসুরা আবার বাগড়া দিয়ে বললেন, আমরা তাহলে পশ্চিমবঙ্গকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চাই! আসল উদ্দেশ‍্য পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া। শ‍্যামাপ্রসাদ শুধু হিন্দু মহাসভা দলের থেকেই নয়, সকল বাঙ্গালীর কাছেই পশ্চিমবঙ্গের সমর্থনে এগিয়ে আসার যুক্তি দেখান। হিন্দু মহাসভা ছাড়াও মারোয়ারী সম্প্রদায় এবং কতিপয় পঞ্জাবী ও নেপালীরা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাবে সমর্থন জানান। কম‍্যুনিষ্ট পার্টি হিন্দু মহাসভাকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর জন‍্য দায়ী করে মুসলিমলীগের সমর্থনে ও বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির দাবীতে প্রচার চালায়! গঙ্গাধর অধিকারী ছাড়াও মুজফ্ফর আহমেদের মথ মানুষও এতে শামিল ছিলেন! এইভাবেই জেহাদী ইসলামের সমর্থক ও পাক-ই-স্তানের বন্ধু এই কম‍্যুনিষ্টরা ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে অবলুপ্তির পথে। একমাত্র সংবাদ-মাধ‍্যম ও সামাজিক মাধ‍্যমেই এদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
এদিকে, বৃটিশ শাসকরা বাংলার রাজনীতির নাড়ি বোঝার জন‍্য ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের প্রস্তাবকে বাংলার আইনসভায় প্রস্তাব আকারে পেশ করার কথা বললেন। এই সময় কংগ্রেস দলগতভাবে কোন দিকে না গেলেও মুসলিম লীগ তাদের সদস‍্যদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেবার জন‍্য হুইপ জারি করে। ভোটাভুটিতে অদ্ভুত বিভাজন লক্ষ‍্য করা যায়। ৫৮ জন পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে ভোট দেন এবং ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন! দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ইসলামী সদস‍্য পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরোধীতা করেন। সেদিন কম‍্যুনিষ্ট পার্টির ঘোষিত নীতি পশ্চিমবঙ্গ গঠনের বিরুদ্ধে থাকলেও তাদের দুই দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা জ‍্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। আবার কিছু হিন্দু বাঙ্গালী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
এর থেকে একটি ব‍্যপার খুব পরিষ্কার। দলমত নির্বিশেষে সকল ইসলামী পাক-ই-স্তানের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাকে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিল। আর বেশীরভাগ হিন্দুরা (কংগ্রেস দলগতভাবে নয়) চেয়েছিল বাংলার বিভাজন ও ভারতের মধ‍্যে হিন্দু অধ‍্যুসিত পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্তি। তারপর ২০শে জুন,১৯৪৭ সালে সরকারী নোটিশ জারি হয় যাতে করে ভারতের নতুন প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *