আমায় একটি প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়, “আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ‘দিদি’ কি বামফ্রন্টের রেকর্ড ভেঙ্গে দেবেন”? রাজনীতির অতি সরলীকরন করলেও মনে হয় না যে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্টের চেয়ে বেশী সময় পশ্চিমবঙ্গের গদি দখলে রাখতে পারবে! তার প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে, ১৯৬৪ সাল থেকে লাগাতার বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক জমি তৈরী হয়েছে তার ফসল ১৯৭৭ সাল থেকে বামফ্রন্টের মোড়কে সিপিএম ঘরে তুলেছে। পক্ষান্তরে, নকশাল ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের “কংশাল” অত্যাচারের মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর রাজনৈতিক জন্ম হওয়ায় তিনি তাঁর রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন দুটি স্তম্ভের উপর – একটি বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিএমের কুশাসনের ফলে তৈরী হওয়া জনরোষ এবং অন্যটি কৃষকের জমি হারানোর ভয় ও বেকারসংখ্যার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। এতসব সত্ত্বেও বলব, ২০১১ সালে রাজনৈতিক সততার ধ্বজাধারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য না থেকে যদি কোন কট্টর জঙ্গী নেতা বামফ্রন্টের কান্ডারী থাকতেন, তাহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সফল ভূমিকা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জীর মূখ্যমন্ত্রীত্ব পাওয়া হয়ত সম্ভব হত না।
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকায় – বিশেষতঃ রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বিপুল বেকারত্বের চাপের মধ্যে তৃণমূল সরকার যেভাবে রাজ্যের অর্থনীতিকে চালাতে চেষ্টা করছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া রাজ্য সরকারের চলার কথা নয়। প্রতি মাসে প্রায় ছ হাজার কোটি টাকা ওভারড্রাফ্ট (সুদ দেওয়ার করারে ধার) না নিলে সরকার তার অনুদানের প্রজেক্টগুলি ত চালাতে পারবেই না, তারা কর্মচারীদের মাইনে এবং পেনশান দিতেও সমর্থ হবে না। এখানে একটা কথা, অনুমোদিত পেনশান দেওয়া এবং প্রদান করা দুটোই সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পরে। অর্থাৎ, এটা DA দেওয়া নয়; যেদিন সরকারী পেনশান বন্ধ হবে, সেদিন থেকে রাজ্য সরকারের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সংবিধানের ৩৫৫ ধারা মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তাবে। এ বিষয়ে সংবিধান এতটাই পরিষ্কার যে, কোন জজ বা কোন ‘সেট ইন’ ব্যবস্থা তা আটকাতে পারবে না। অবশ্য কতদিন এই ধার দেওয়া-নেওয়া চলবে তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর অর্থাৎ বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থনৈতিক কারনে দায়বদ্ধ থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় আটকে গেছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার।
আগে একাধিকবার বলেছি, ২০২১এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জেতেনি – বিজেপি হেরেছে! এর ব্যাখ্যাও দিয়েছি। এখন যত সময় এগোচ্ছে, সেই যুক্তির সত্যতা বেশী বেশী করে প্রমাণিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থা গত পঞ্চাশ বছরে যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অযথা রাজনৈতিক বিবাদের ফলশ্রুতিতে রাজ্য চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ার কথা। এটা বুঝেই দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে সুচতুর রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু রাজনীতিতে যে সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন তা অল্প কথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয় – রাজ্যে কুস্তি, কেন্দ্রে দোস্তি! এর ফলে, কেন্দ্রের তখনকার শাসকদল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ছন্নছাড়া অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। এটি জ্যোতিবাবু খুব চাতুর্যের সঙ্গে করতেন এবং সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংষ্কার আন্দোলনের সার্থক রূপ দেওয়া ও পঞ্চায়েতীরাজ চালু করা – এগুলোই বামফ্রন্টকে চৌত্রিশ বছর ক্ষমতায় রেখেছিল। মমতাদেবীর তৃণমূল দলের এমন কোন কাজ না থাকায় এবং অনুদান রাজনীতির জাতাকলে রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় এই সরকারের স্থায়ীত্ব অনেকটাই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল।
দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল গত নির্বাচনে জেতার পরেই হটাৎ করে সর্বভারতীয় দল হওয়ার লক্ষ্যে ত্রিপুরার লোকাল বডি নির্বাচনে তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে গেল। নিজেদের বিজেপির বিরুদ্ধে প্রজেক্ট করল! সেখানে বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রাক্তণ বিরোধীদল সিপিএম যেটুকু ঘর গুছিয়ে নিতে পেরেছিল, তৃণমূলের এই বহুল প্রচারিত লড়াইয়ে তারা সিপিএমের ভোট অনেকটাই কেটে নিয়ে বিজেপির জয় সুনিশ্চিত করল! আশ্চর্যের ব্যাপার – তৃণমূল একটুও দমে না গিয়ে, সাজানো স্ক্রিপ্টের নাটকের মত গোয়ায় গিয়ে এমন প্রচার শুরু করল যে মনে হল তারা এবার সেখানে বিজেপিকে হারিয়ে রাজ্য বিধানসভা দখল করবে! যেন তাদের নির্বাচন জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা! সেখানেও তারা বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রজেক্ট করল! এখানে মনে রাখা দরকার, গোয়ায় ২০১৫ সালের নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল ছিল কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীর মূর্খামী ও বিজেপির রাজনৈতিক পরিপক্কতার কারনে সেখানে বিজেপি কংগ্রেসের দল ভাঙ্গিয়ে এবং এমজিপির সঙ্গে সমঝোতা করে সেবার ক্ষমতায় আসে। সুতরাং এবারের লড়াই শুধু শক্তই নয়, বিজেপির কাছে অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। তৃণমূল, প্রধানত মমতা ব্যানার্জী ও অভিশেক ব্যানার্জী, সেখানে তাদের বিজেপি বিরোধী ইমেজ ভাঙ্গিয়ে যে প্রচার করলেন, তাতে তাদের দল কোন আসন না পেলেও কংগ্রেস ও আপের ভোট কেটে তাদের আসন সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিল – বিজেপির সরকার গঠন অনেক সহজ হল। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সহযোগী দল এমজিপিও তৃণমূলের বিজেপি বিরোধী ইমেজকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটল; ভোট গণনা শুরু হওয়ার মুখে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙ্গে রাজ্যে বিজেপিকে সমর্থন করার ঘোষণা করে দিল!
উত্তর প্রদেশে মমতা ব্যানার্জী সমাজবাদী পার্টির সভায় এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখলেন যে সেখানকার নির্বাচনে, বিশেষতঃ বাঙ্গালী অধ্যুষিত বেনারসে বিজেপি সহজেই জিতে গেল। অর্থাৎ, মমতা ব্যানার্জী বিজেপির পক্ষে দূর্বল জায়গাগুলিতে প্রচার চালালেন এবং সব জায়গাতেই বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভ করল! মমতা ব্যানার্জীর মত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার ধৃষ্টতা করা ঠিক নয়। তিনি ভুল স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এসব করেছেন বলে মনে হয় না। আবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রার্থী চয়ন থেকে দলের নির্বাচন পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ এমনভাবে করল যে, এমন পরিপন্থী কাজ করা তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেও মানা যায় না। হয়ত এভাবেই রাজনৈতিক সৌজন্যের প্রতিদান দেওয়া হয়!
এদিকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যে দলের প্রধান বিরোধীর ভূমিকা পালন করার কথা, সেই জাতীয় কংগ্রেস দল কালের নিয়মে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে এখন বিলীন হওয়ার পথে। তার প্রথম ও প্রধান কারন, এই দল লালবাহাদুর শাস্ত্রী জমানার অল্প সময় ছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পারিবারিক দল হিসেবে রয়ে গেছে। ভারতের মত কর্তাভজা দেশে অবশ্য তাতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কারন প্রায় সব বিরোধী দলই পারিবারিক দল! তবে, এইসব দলের স্থায়ীত্ব ও সাফল্য নির্ভর করে তার নেতৃত্বের যোগ্যতার উপর। ইন্দিরা গান্ধী যে যোগ্যতায় দলকে পরিচালনা করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে তা দেখা না গেলেও সুদৃঢ় ইমারত ভাঙ্গতে আরো ২৫-৩০ বছর লাগছে। কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বে দাম্ভিকতা পুরোপুরি থাকলেও যোগ্যতা বিন্দুমাত্র নেই। সোনিয়া গান্ধী বড়জোর kitchen conspiracyতে দক্ষ হতে পারেন – তাঁর কংগ্রেসের মত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর যোগ্যতা নেই, উপরন্তু দাম্ভিকতা পুরোদস্তুর – ফলে, অযোগ্য চামচা ছাড়া আর কোন সুযোগ্য রাজনীতিকের ঐ দলে থাকা সম্ভব নয়।
সোনিয়া গান্ধী বিদেশিনী হওয়ার কারনে তিনি একটি বিশেষ স্তরের উপরে, সর্বভারতীয় পর্যায়ে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সাহস করেননি। যদিও তিনি ভারতের ডোমিসাইল্ড নাগরিক – ইটালীতে জন্ম এবং ইটালিয়ান বাবা মার সন্তান হওয়ার কারনে তিনি OCI (Oversease Citizen of Italy) হতেই পারেন। ভারত ও ইটালী দুই দেশই দ্বিনাগরিকত্বকে মাণ্যতা দেয় না। তবে ভারতের ওভারসীজ সিটিজেনরা দেশে জমিজমা ও অন্য সম্পত্তি রাখতে পারেন এবং তাঁরা ভারতীয় ইনকাম ট্যাক্সের আওতায় পরেন; কিন্তু তাঁরা ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না। ইটালীর OCIরা কিন্তু এখন সে দেশের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন! তাদের এই আইনটা ভিন্ন। সে দেশের পার্লামেন্টো ইটালীয়ানোতে দু ভাগে বিভক্ত সিনেট ও ডেপুটিজ – দুয়ের ক্ষমতা সমান; দু কক্ষই সরাসরি নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত। এক্ষেত্রে সংবিধানের ল নম্বর ৪৫৯ এ ২৯শে ডিসেম্বর, ২০০১ সালে সংশোধন করে (৪৮, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর সংশোধনী) ওভারসীজ কন্সটিটিউয়েন্সী নামে OCIদের জন্য ৬টি সিনেট ও ১২টি ডেপুটিজ কন্সটিটিউয়েন্সী করে ভোট দেওয়ার নিয়ম করেছে! কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন পরিবার যে ইটালীর OCI নন, তেমন কোন প্রমান এখনো জানা নেই। ভারতের আইনে কিন্তু কোন নাগরিক বিদেশের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। এধরনের রহস্যাবৃত নাগরিকত্ব নিঃসন্দেহে ভোটের ময়দানে অন্য রাজনৈতিক দলকে সুবিধা করে দেবে। পশ্চিমবঙ্গে এই পরিবারতন্ত্রের কংগ্রেসের তৃণমূল বা বিজেপিকে বেগ দেওয়ার ক্ষমতা আগামী নির্বাচনে অন্ততঃ নেই।
এখন কম্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের পুনরুত্বানের যে গল্প বিভিন্ন মিডিয়ার দৌলতে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার কোন ভিত্তি আছে বলে ত মনে হয় না। লকডাউনের সময় রেড ভলান্টিয়ার্সদের কাজ যেমন প্রশংসার দাবী রাখে, তেমনি আরো অনেক গোষ্ঠীই সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এসেছিল – শুধু একটি বা দুটি গোষ্ঠীকে সংবাদ-মাধ্যমে প্রচার পাইয়ে দিলে তা যে বিশেষ পার্টির ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে – তার কোন কারন আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে কম্যুনিষ্ট তথা সিপিএমের বড় বাধা হল তাদের জাতীয় নীতি! কম্যুনিষ্টরা স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যেমন হিন্দু-বিদ্বেষের সঙ্গে ভারত বিদ্বেষ ও পাকিস্তানপ্রীতি চালিয়ে গেছে, আজও সেই একইভাবে তাদের নীতি অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছে। ফলে, দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে তাদের কাজকর্ম দেশ-বিরোধী তকমা পাচ্ছে। এভাবেই তারা সারা দেশেই ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত মৌলিক পরিস্থিতিতে যে মৌলিক নীতির পরিবর্তন করতে হয় তা ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের অজানা।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গে ২০২৪ সালের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দলের কোন বিকল্প নেই – যদি না বিজেপি তাদের ‘সেট-ইন’ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসে। এই বিষয়টা পুরোপুরি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। ইডি,সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের বারবার বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে চলা রাজ্যসরকারের পাশে যখন না দাঁড়ানোর সংকেত আসবে এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার মত অভিজ্ঞ টিম যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য বিজেপিতে তৈরী করে তখন বুঝতে হবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আসন্ন। অন্যথায়, পশ্চিমবঙ্গের মসনদ থেকে মমতা ব্যানার্জীকে হটানো সম্ভব নয়। তবে, রাজনীতির দাবা খেলায় তৃণমূলের দিল্লী দখল ত দুরস্ত্, পশ্চিমবঙ্গ তাদের থাকবে কিনা তা বিজেপির উপর নির্ভরশীল।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন পথে
