পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ‍্যৎ কোন পথে

ভারতের রাজ‍্যগুলির মধ‍্যে পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ‍্য যেখানে ১৯৬৭-৭৭ সাল ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তন খুব কমই হয়েছে। মূলতঃ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস, তার পর বামফ্রন্টের মোড়কে সিপিএম আর ২০১১ সাল থেকে কংগ্রেস ভেঙ্গে সৃষ্ট আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকায় ব‍্যক্তি কেন্দ্রিক দল, যার শীর্ষে শ্রীমতি মমতা ব‍্যানার্জী। এই পুরো সময়টা যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়, বিধান চন্দ্র রায়ের ব‍্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও তাঁর প্রশাসনকে উন্নয়ণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করার সফল প্রয়াসে আমরা পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের আধুনিকীকরণ, স‍্যাটেলাইট টাউনশিপ প্রকল্প – কল‍্যানী, বিধাননগর পেয়েছি। এটুকু ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জন্মের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস শুধুই রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গবাসীর মেরুদন্ডে আঘাতের পর আঘাত আজ এই রাজ‍্যের মানুষকে অমেরুদন্ডী প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছে। যে বাঙ্গালীদের থেকে ইংরেজের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ আসমুদ্র হিমাচল সাড়া জাগিয়েছিল তা আজ বিস্মৃত। মেরুদন্ডহীণ, বিভিন্ন ভাতাজীবি একদল বোধহীণ মানুষ! এর কারন ব‍্যখ‍্যার প্রয়োজন আছে।
স্বাধীনতার অনিশ্চয়তার সময়, বিশেষতঃ কোলকাতা থেকে নোয়াখালী – একতরফা হিন্দুনিধনের পর ইসলামী রাজনীতিবিদ এবং জওহরলাল-গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের ভূমিকায় বীতশ্রদ্ধ ধন-প্রাণ-মান-ইজ্জত খোয়ানো মানুষগুলোর কাছে হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ – বিশেষতঃ শ‍্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিভিন্ন দরবার, আবেদন ও জনমতের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পশ্চিমবঙ্গ প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র জায়গা হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। তারপর, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের পর ভারতের রাজনীতিকদের ভূমিকা যথেষ্ট ন‍্যক্কারজনক ছিল বললেও কম বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আদি বাঙ্গালী হিন্দু বাসিন্দারা এই উদ্বাস্তুদের ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ আপদ বলে মনে করে। এর পুরো দায় গান্ধী-জওহরের বাঙ্গালী সম্পর্কে এবং বাংলায় ধর্মীয় দাঙ্গার ব‍্যপারে ঔদাসীণ‍্য। আমার মনে হয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে দুইজন বাঙ্গালী সুভাষচন্দ্র বসু ও শ‍্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ‍্যায় ওদের বিরুদ্ধাচরণ করায় ওদের ইগোতে যে আঘাত লাগে তা ওরা বাংলার প্রতি উদাসীনতার মধ‍্যে দিয়ে মেটাতে চেয়েছেন। এর ফলে বাঙ্গালীর মধ‍্যে যে পরির্বনগুলি দেখা যায় তা হল, হিন্দু ও মুসলমান বাঙ্গালীর মধ‍্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ – যা আগের দু শতাব্দীতে দেখা যায়নি। আবার বলছি, এর দায় সুরাবর্দী ও তার গ্রীন টুপি বাহিনীর সঙ্গে গান্ধী-জওহরের কংগ্রেসেরও। জওহরলালের এই মনোভাবে আরেকটি উদাহরণ হল, জওহরলাল প্রথমে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়কে পশ্চিমবঙ্গের মূখ‍্যমন্ত্রী করেন নি। পরে অবশ‍্য অবস্থার কারনে তাঁকে মূখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেন – যদিও পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ণে অর্থ বরাদ্দের ব‍্যাপারে তাঁর প্রথম থেকেই অনীহা ছিল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা ত্রিধাবিভক্ত হয়ে যায় – বাঙ্গালী মুসলমান, এদেশী হিন্দু বাঙ্গালী আর উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালী।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দু ভোটারদের তদানীন্তন বিরোধী কম‍্যুনিষ্টরা তাদের সমর্থক হিসেবে দলের সঙ্গে যুক্ত করতে ব্রতী হল। সেখানে কম‍্যুনিষ্টদের মূল আদর্শের সঙ্গে সংঘাতের কারনে বাঙ্গলার কম‍্যুনিষ্টরা সিপিএমের নেতৃত্বে এক অদ্ভুত অবস্থান নিল।
ভারতের কম‍্যুনিষ্ট পার্টির জন্মের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে ১৯২০ সালে পার্টির জন্মের সময় উদ‍্যোক্তা এম এন রায় ও তাঁর স্ত্রী ইভলিন রায় ছাড়া ছিলেন প্রথম চেয়ারম‍্যান দক্ষিণী ব্রাহ্মণ মান্ডয়ম পার্থসারথি তিরুমল আচার্য। আর ছিলেন বাঙ্গালী অবনী মূখার্জী, রাশিয়ান এজেন্ট রোজা ফিটিংগফ এবং খিলাফৎ আন্দোলনের ব‍্যর্থতার পর কর্মহীন দুজন ইসলামী মোহাজীর মহম্মদ আলী ও মহম্মদ সফিক। এই মহম্মদ সফিক হলেন পার্টির সবচেয়ে শক্তিশালী ব‍্যক্তি – জেনারেল সেক্রেটারী। তারপর, মহঃ আলী ও মহঃ সফিকের নেতৃত্বে ভারতীয় ও ভারতীয়ত্ব বিরোধী কাজকর্ম এবং বৃটিশের ভারত শাসনে কোন বড় বাধা সৃষ্টিতে অংশ না নেওয়ার কারনে আচার্য অল্প দিনের মধ‍্যেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৃটেনে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ও বৃটিশ বিরোধীতার পথ হিসেবে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী পথ বেছে নেন। কম‍্যুনিষ্ট পার্টির কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠাতা এম এন রায় সপরিবারে পার্টি ত‍্যাগ করেন ও পরবর্তী সময়ে র‍্যাডিক‍্যাল হিউম‍্যানিজম প্রতিষ্ঠা করেন। সেই শুরুর সময় থেকেই ভারতের কম‍্যুনিষ্ট দলগুলির প্রাথমিক নীতি হল – ভারতীয়ত্ব ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধীতা করা এবং ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রমোট করা! এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ধারনা কোরান ও বাইবেল, উভয় ধর্মগ্রন্থেই নিন্দার্হ। কোন সাচ্চা মুসলমান ও খ্রীষ্টান কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন না। যেহেতু প্রাথমিকভাবে কম‍্যুনিষ্ট দলগুলি ভারতীয়ত্বের বিরোধী এবং আরবী ইসলামের সঙ্গে তার কোন বিরোধ নেই; তারা ইসলামকে ধর্মীয় গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু ও হিন্দুত্বের বিরোধী। এজন‍্যই তারা ভারতের ইসলামীদের ধর্মীয় ভিত্তিতে কম‍্যুনিষ্ট বানানোর চেষ্টা করে থাকে। এতে একাধারে হিন্দ-মুসলমানের মধ‍্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরী করা যাবে এবং জেহাদী ইসলামের আগ্রাসী নীতিকে কাজে লাগিয়ে কম‍্যুনিষ্ট আগ্রাসন ত্বরান্বিত করা যাবে – এই ধারনায় ভারতীয় কম‍্যুনিষ্টরা শুরু থেকেই এগিয়েছে। মনেরাখতে হবে যে এই ভাবনা কিন্তু কম‍্যুনিষ্ট ইন্টারন‍্যাশনালের নয়, এটি কম‍্যুনিজমের ভারতীয় সংস্করণের অঙ্গ।
এবার যখন বঙ্গীয় কম‍্যুনিষ্ট নেতারা দেখল যে তারা উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের মধ‍্যে স্বাভাবিক কারনেই ইসলাম প্রীতি জাগাতে পারবে না, তখন তারা এইসব বাঙ্গালীদের চিন্তায় ও মননে ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব ঢোকানো শুরু করল! পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের চরম দুর্দশায় সাহায‍্য না করার জন‍্য কংগ্রেসের উপর তাদের তীব্র বিরাগ এবং বেঁচে থাকার নূন‍্যতম চাহিদার জন‍্য তাঁরা বঙ্গীয় কম‍্যুনিষ্টদের দলে ভিড়তে শুরু করল। তার বদলে উদ্বাস্তুদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়ি গলাধঃকরন করে যে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারনে তাঁদের সর্বস্ব – মান, সম্মান, অর্থ, সম্পদ, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এই দেশে পালিয়ে আসতে হয়েছিল, সেখানেই তাদের ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র মকরধ্বজ গিলতে হল। আশ্চর্য হচ্ছে, এই হিন্দু বিতারণ পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুধু ১৯৪৬-৪৭ সালেই হয়নি, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ পরবর্তী সময়ও হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিবারই মৌখিক আশ্বাস ছাড়া এই হতভাগ‍্যদের জন‍্য আর কিছুই করেনি। পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিষ্টদের ক্ষমতায় আসার বড় কারন ছিল এই উদ্বাস্তুদের ভোট। এই উদ্বাস্তু জনসংখ‍্যার চাপে, সরকারি সাহায‍্য বা অনুদানের অভাবে, এদেশী বাঙ্গালী হিন্দুদেরও যথেষ্ট কষ্ট সহ‍্য করতে হয়েছে। এদিকে, ক্ষমতা দখলের পর তা কায়েম রাখতে প্রথমেই তাদের নিয়মে কম‍্যুনিষ্টরা “শোষিত শ্রেণী”র সংখ‍্যা বাড়াতে সচেষ্ট হল। একের পর এক কর্মী ইউনিয়ন দখল করে কলকারখানাগুলিতে লালবাতি জ্বালানো হল! ইউনিয়নবাজীর আরেক জলজ‍্যান্ত নিদর্শন হল রাষ্ট্রায়ত্ব ব‍্যাঙ্কগুলির সার্ভিসের অধোগতি। সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে সাধারন মানুষ এই ইউনিয়নবাজীর oligopolystic জুলুমে ভুগতে লাগল। আশ্চর্য হচ্ছে, এই সময়ে দেশের বৃহৎ কম‍্যুনিষ্টদলের যে কজন জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন, তাঁদের নিজেদের রাজ‍্যে তাঁরা এমন ধ্বংসাত্মক ইউনিয়ানবাজী করেন নি! এরপর সিপিএমের বড় ভোটব‍্যাঙ্ক বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের উপর চরম আঘাত এলো মরিচঝাঁপির গণহত‍্যা ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও উদ্বাস্তুদের জমির পাট্টা না দেওয়া। এর ফলে, উদ্বাস্তুদের একাংশ ধীরে ধীরে কম‍্যুনিষ্টদের থেকে আনুগত‍্য সরিয়ে নিল। এই সময় পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখা বিস্তারের নেপথ‍্যে এই উদ্বাস্তু পরিবারগুলির অবদান যথেষ্ট। এই পর্যায়ে প্রথমে কংগ্রেসের মধ‍্যে থেকে এবং পরে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মমতা ব‍্যানার্জী তৃণমূল কংগ্রেস দল গঠন করে কম‍্যুনিষ্ট বিরোধী মানুষদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর কম‍্যুনিষ্ট অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অত‍্যাচারীতের পাশে থেকে রাজনীতি করাকে মানুষ গ্রহণ করেছিল। তখন বামফ্রন্টের আড়ালে সিপিএম নির্বাচনী যুদ্ধ জয়ের বড় হাতিহার হিসেবে নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন ও হিংসা ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হল। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রশাসনকে কলুষিত করা এবং রাজনৈতিক হত‍্যা এই সিপিএমই প্রথম শুরু করে।
পশ্চিমবঙ্গে কম‍্যুনিষ্ট শাসনের যে দুটি পর্যায় আমরা দেখেছি, সেখানে প্রথম পর্যায়ে সমাজের দুষ্কৃতীদের শ্রেণীগতভাবে দলের ক‍্যাডারে পরিণত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই দুষ্কৃতীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তরণ ঘটিয়ে এদের নেতৃত্বে বসানো হতে থাকে। তবে, অনুকুল পরিস্থিতিতে যখন কম‍্যুনিষ্ট রিগিং মেশিনারী সক্রিয়, সেই সময়ে মমতা ব‍্যানার্জীর তৃণমূল দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল প্রমাণ করল যে, মমতা ব‍্যানার্জী “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী”! এখনো অব্দি মমতাদেবী রাজ‍্য শাসনে কোন নতুনত্ব না এনে সিপিএমের রাজ‍্য শাসনের নীতিগুলিকে আরো বিস্তৃতভাবে, অধিকতর সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন। প্রথমেই তিনি পুলিশের খাতায় দুষ্কৃতী হিসেবে নাম থাকা দলের মানুষদের নেতৃত্বে বসালেন! তারপর সিপিএম যেমন পুলিশ প্রশাসনের একাংশকে ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ নীতির সফল প্রয়োগে দলদাস বানিয়েছিল, তার বিস্তৃত প্রয়োগে শুধু পুলিশ নয়, পুরো রাজ‍্য প্রশাসনটাকেই দলদাসে পরিণত করলেন। সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ব‍্যক্তি হলেন রাজ‍্য সাধারণ সম্পাদক, রাজ‍্য শাসনে বামফ্রন্টের বাহ‍্যিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ‍্যে সিপিএমের একদলীয় শাসন চলত। ফলে রাজনৈতিক অপকর্মগুলির দায় আড়াল করার জন‍্য বামফ্রন্টীয় সংঘবদ্ধ মেকানিজম কাজ করত। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস দল একজন ব‍্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও চালিত হওয়ায় তা কখনোই সংঘবদ্ধ নেতৃত্বের মত মনে হয়নি। এখানে দলনেত্রীই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ক্রিয়াকর্মের হোতা – এটি তৃণমূল কংগ্রেস দলের ঘোষিত বক্তব‍্য। ফলে, দলের দ্বিতীয় থেকে শেষ নেতৃত্ব পর্যন্ত সকলেই নেত্রীর “অনুপ্রেঢ়ণায়” কাজ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরনের রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ‍্যেও স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা প্রফল। এ‍্যাডলফ্ হিটলারের National Socialist Party এবং যোশেফ স্ট‍্যালিনের Communist Party of Supreme Soviet তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই ধরনের রাজনৈতিক দলের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে দলের কর্ণধারের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার উপর। প্রথমটিতে মমতাদেবী ভারতের অগ্রণী রাজনৈতিক ব‍্যক্তিদের মধ‍্যে অগ্রগণ‍্য হলেও পরেরটিতে তাঁর সীমাবদ্ধতা লক্ষ‍্যণীয়।
যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনৈতিক অনীহা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার, বাঙ্গালীদের মননে স্বভাব-বিরোধীতা একটি জায়গা করে নিয়েছে। আর রাজনৈতিক হিংসা আর বাঙ্গালীর মনে রেখাপাত করে না। কারন, গত ৫৭-৫৮ বছরে মানুষ এতে অভ‍্যস্ত হয়ে গেছে। কোন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেই এই হত‍্যালীলা বন্ধের জন‍্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একই রকমভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর্থিক বা চারিত্রিক দূর্ণীতিতেও বিচলিত হয় না। অগত‍্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত বাঙ্গালী ধর্মনিরপেক্ষ ভাতাজীবী হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট। আর এইজন‍্যই মমতাদেবী তাঁর রাজ‍্য তহবিলের অধিকাংশ অর্থ বিভিন্ন ভাতা প্রকল্পের মাধ‍্যমে জনগণের মধ‍্যে বিলি করে নিজের ও দলের জনমোহিনী ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আর এই প্রকল্পের মধ‍্যেই তৃণমূল দলের পতনের বীজ লুক্কায়িত আছে!
এইভাবে অনুৎপাদনশীল খরচের বহর বেড়ে যাওয়ায় রাজ‍্যের ধারের পরিমাণ সাড়ে পাঁচলক্ষ কোটি ছাড়িয়েছে! এই বছর শেষ হওয়ার আগেই তা শ্রীলঙ্কার ঋণ ছাড়িয়ে যাবে। যদি পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাজ‍্য হত তাহলে তার অবস্থা কল্পনা করেও শিউরে উঠতে হয়। এদিকে এই ধরনের ব‍্যায়ের ফলে রাজ‍্যের জিডিপি বাড়বেনা। ফলে এক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেতে রাজ‍্যের ঋণ নেওয়ার ঊর্ধসীভা না বাড়ালে অর্থনৈতিক কারনে রাজ‍্য চালানো সম্ভব নয়। ভারতের একটি অঙ্গ রাজ‍্য হলেও এই ঋণ পরিশোধ করার দায় কিন্তু তৃণমূল দল বা কোন ব‍্যক্তিবিশেষের নয় – রাজ‍্যবাসীর। যে পরিমাণ সুদ দিতে হয়, তাও রাজ‍্যসরকারের সাধ‍্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে, ভাতা বিলোনো কার্যকরীভাবে অদূর ভবিষ‍্যতে বন্ধ হতে বাধ‍্য। আবার মমতাদেবীর দলের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফসল এখন ফলতে শুরু করেছে! উচ্চস্তরের সরকারী প্রশাসনকে সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, মমতাদেবীর থেকে ‘তুমি’ সম্বোধনে উচ্চপদস্থ আমলারা খুশী হন না। যার জন‍্য দায়সারা ও কর্তাভজা পরামর্শ ছাড়া তাঁরা এই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন না। প্রশাসনে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে যে সংবাদ-মাধ‍্যমকে দেখা হয়, তা এই রাজ‍্যে শাসকের গোয়েবেলসীয় চাপে মৃতপ্রায় কর্তাভজা জোকারে পরিণত হয়েছে। এই মিডিয়া সৃষ্ট বুদ্ধিজীবীকুল আমজনতার কাছে একাধারে হাস‍্যকর চরিত্র ও ঘৃণার পাত্র!
মমতাদেবী ক্ষমতায় এসে যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, ২০২২ সালে এসে তার ফল ফলতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক অপচয়ের কারনে এই বছরের পর রাজ‍্যের পক্ষে কর্মচারীদের মাইনে এবং পেনশন দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে কিনা সে বিষয়ে সংবাদ-মাধ‍্যমেও সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু হয়েছে।
ধর্মীয় গোঁড়ামী ও বিভেদকে এই রাজ‍্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন কাজের মধ‍্যে দিয়ে নির্বাচনে সুবিধে পাওয়ার অভিপ্রায়ে উস্কে দেওয়ায় এবং দুষ্কৃতীদের দলীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসায় জনমানসে ধারনা হয়েছে যে, এই রাজ‍্যে রাজনীতি করতে আসার একমাত্র উদ্দেশ‍্য হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে বেআইনী অর্থ রোজগার ও দুষ্কর্ম করে প্রশাসনের মদতে পার পেয়ে যাওয়া! দুঃখের কথা, এই ধারনাতেই এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাই স্ব স্ব দলে এসেছেন এবং প্রয়োজনে দলবদল করছেন! এই কারনে, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে কাজে লাগিয়ে রাজ‍্যে হিংসা, খুণ, ধর্ষণ সহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত ক্রমবর্ধমান। এমতাবস্থায় আদালতের চাপে রাজ‍্যের ক্ষমতাসীন দলের দিশেহারা অবস্থা – দলীয় কোন্দলের অত‍্যধিক সংখ‍্যাবৃদ্ধি তার প্রমাণ। এমতাবস্থায় মমতাদেবী ও তাঁর তৃণমূল দলের অনুকুলে যা আছে তা হল, “রাজ‍্যে কুস্তি ও কেন্দ্রে দোস্তি” নীতির সফল প্রয়োগে রাজ‍্য চালানোর চেষ্টা, যা তিনি ২০২১ এর রাজ‍্য নির্বাচনে জেতার পর থেকেই করছেন! তাছাড়া, রাজ‍্যের সিপিএমের – বড় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছোট শত্রুকে সাহায‍্য করার সৃষ্টিছাড়া রাজনীতি – এই দুটিই মমতা দেবী সুচারুভাবে ব‍্যবহার করছেন। এখানে একটা কথা বলে যাই, এই নীতি ফলপ্রসু হলে রাজ‍্যে বিজেপি ও সিপিএম, দুই দলই অস্তিত্ত্ব সংকটে পরবে। সুতরাং, সংশোধনী আগতপ্রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *