কথায় আছে, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে যুদ্ধ নয়, তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দাও – তা হলেই সে জাতি ধ্বংস হবে। এই কথার গুরুত্ব বুঝেই ভারতের ক্ষতি সাধনে উৎসুক বিদেশী রাষ্ট্র, যারা আবার ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের গডফাদারও বটে, তাদের অঙ্গুলী হেলনে ও কেন্দ্রের পরিবারকেন্দ্রীক সরকারের সহযোগীতায় ভারতের শিক্ষা জগতের সকল দায়িত্ব দেওয়া হল দেশের কম্যুনিষ্টদের! যে কটি নতুন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হল, সবকটি জাতীয়তাবিরোধী এবং জেহাদীদের আঁতুরঘর হিসেবে কাজ করতে লাগল! গভর্নিং বডি থেকে শিক্ষক নির্বাচন – প্রমোশান, ছাত্রভর্তি, সিলেবাস তৈরী – সকল ক্ষেত্রেই এদের মানসিকতা প্রতিফলিত হল। এই কম্যুনিষ্টদের মধ্যে বড় সংখ্যক মানুষ পশ্চিমবঙ্গের হওয়ায় এবং পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ সময় বামফ্রন্টের আড়ালে সিপিএমের শাসন কায়েম থাকায়, শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ বিরোধী চিন্তা, জেহাদীদের সমর্থনকারী চিন্তাধারার স্ফুরণ শুরু হল! শিক্ষক চয়নের ক্ষেত্রে মেধার বদলে কম্যুনিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসীদের শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হল! শিক্ষক চয়নে দলদাস প্রথা একমাত্র প্রাধান্য পেল! পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, আলিমুদ্দিনে অদৃশ্য cv যদি বিবেচিত হত তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়া যেত! ক্রমে তা স্কুল পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ল। প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপাল ও উপাচার্য চয়নেও আলিমুদ্দিনের সবুজ সংকেতের কথা তখন সবাই জানত। ফলে, যারা এসব পদের প্রার্থী হতে আকাঙ্খা করতেন, তাঁরা “আগে কেবা প্রাণ, করিবেক দান” গোছের পার্টিঅন্ত প্রাণ বা আগমার্কা কম্যুনিষ্টের ভেক ধরে কাজ হাসিল করতে চাইতেন!
২০১১ সালে পরিবর্তনের নামে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতার সিংহাসনে বসলেন “সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী” শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জী। তিনি ক্ষমতায় এসেই “টাকা নাই” আর “কেন্দ্র দেয় না” গোছের সিপিএম মার্কা অজুহাতগুলি সামনে রেখে সরকার চালাতে শুরু করলেন। দশ বছর পর তাঁর সরকারের দুর্ণীতিগুলি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করল। সিপিএম শিক্ষা দপ্তরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলেও ব্যক্তিগত অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেনি। কিন্তু ঐ যে “মেধাবী ছাত্রী” – তিনি ত গুরুকেও ছাপিয়ে যাবেন – আর সেটাই ত স্বাভাবিক। শিক্ষা দপ্তর থেকে অর্থ উপার্জনের নতুন নতুন টেকনিক আবিষ্কার হল! এটি সম্ভব হল দুটি কারনে – প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কশূণ্য মানুষজনের দায়ীত্বে শিক্ষা দপ্তরকে আনা; এবং দ্বিতীয় কারন অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের শিক্ষার রাজনীতিকরনের সঙ্গে পরিচিতি থাকায় এই বিষয়ে তাদের অনাগ্রহের কারনে দুর্ণীতির নতুন নতুন টেকনিকের প্রয়োগ!
২০১৬ সালের নির্বাচনে জেতার পর মমতা ব্যানার্জী শিক্ষামন্ত্রী করে আনলেন শিল্পমন্ত্রী হিসেবে চুড়ান্ত অকৃতকার্য এবং নিজের ডক্টরেট ডিগ্রির থিসিসটি প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগে অভিযুক্ত – শ্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এর থেকেই বোঝা যায় মূখ্যমন্ত্রীর শিক্ষা দপ্তর থেকে প্রত্যাশা কি ছিল!
শিক্ষা দপ্তরের দায়ীত্ব নিয়ে পার্থবাবু উন্নয়ণের বন্যা বইয়ে দিলেন! এমনকি, রাজ্যের প্রত্যন্ত জায়গায় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর হিড়িক পড়ে গেল! নির্মানের কন্ট্রাক্ট পাওয়া ঠিকাদাররা সুদৃশ্য নির্মান শুরু করলেন – ঢক্কানিনাদে শিক্ষার উন্নয়ণ ঘোষিত হল! মোসাহেব এবং অর্ধশিক্ষিত পেড ‘বুদ্ধিজীবী’র দল উদ্বাহু হয়ে নৃত্য শুরু করল! নতুন এইসব শিক্ষায়তন দুরের কথা, যেসব শিক্ষায়তন আগে থেকেই চলছে, তাদের পরিকাঠামোর অবস্থা সরকারের পর্যাপ্ত অর্থ না দেওয়ার কারনে ধুঁকছে। ফলে, জোড়াতালি দিয়ে এই শিক্ষায়তনগুলি চালু করলেও এদের শোচনীয় পরিকাঠামোর কারনে শিক্ষার মানের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে। এরপর আসে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের প্রশ্ন। এখানে মন্ত্রী মহোদয় প্রবল শক্তিশালী উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরী করলেন এবং নিয়োগ সংক্রান্ত যে কমিশনগুলি আছে, তার উচ্চপদে কিছু মানুষকে পছন্দমত নিয়োগ করলেন! এই কমিটিতে মন্ত্রী মহোদয়ের OSDকেও তিনি সদস্য করলেন! তাঁরা এমন কাজ করলেন যে, বাগ কমিটির সুপারিশে ও মহামাণ্য হাইকোর্টের আদেশে তদন্তকারী সংস্থা CBI এই কমিটির চেয়ারম্যান শান্তিপ্রসাদ সিনহা সহ মাধ্যমিক বোর্ডের সভাপতি কল্যানময় গাঙ্গুলী, সৌমিত্র সরকার, সমরজিৎ আচার্য ও অশোক কুমার সাহার বিরুদ্ধে পুলিশে FIR দায়ের করেছে! এছাড়া, বাগ কমিটি বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছেন, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, চৈতালী ভট্টাচার্য, শর্মিলা মিত্র, মহুয়া বিশ্বাস, শেখ সিরাজউদ্দিন ও শুভাশিস চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে! এই মন্ত্রীকৃত কমিটি ও বোর্ড যোগ্যতামানের এবং পরীক্ষার নম্বরের তোয়াক্কা না করে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডির কর্মী নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্ণীতি করছে। চাকরী পাওয়া ৩৮১জন প্রার্থীর মধ্যে ২২২ জন পরীক্ষাতেই বসেনি! আকী ১৫৯ জন মেধা তালিকার নীচের দিকে থাকায় তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরী পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না। আবার মেধা তালিকায় নাম থাকলেও ৬৫০০ জনের চাকরী হয়নি! উচ্চ-প্রাথমিক, নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক হারে দুর্ণীতি হয়েছে। গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডির নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়মের জেরে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে ৫৪২ জনের বেতন বন্ধ হয়েছে।
সুতরাং দপ্তরের দুর্ণীতি সর্বব্যাপ্ত – fountain of corruption এর শিখরে আছেন পরম ব্রহ্মরূপী দপ্তরের প্রাক্তণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়! কারন এই মন্ত্রীর নির্দেশেই FIRএ নাম থাকা বিদ্বজনরা (দুর্জনে বলে দালালরা) সকলেই তাঁদের নিয়োগপত্র পান! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি শিক্ষা দপ্তরকে ব্যবহার করে এই পাহাড়-প্রমাণ দুর্ণীতি সংঘটিত হয়েছে? কেন? এর সোজা উত্তর – আর্থিক লেনদেন! সাধারণ মানুষ থেকে ধরে তৃণমূল দলেরই প্রাক্তণ মন্ত্রী তথা প্রাক্তণ CBI আধিকারিকের অভিযোগ – লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এই সব সরকারী চাকরী বিক্রি করা হয়েছে! এখানে দুটি কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রথম হচ্ছে, মন্ত্রী এসবের কিছু জানতেন না – একথা একদম অবিশ্বাস্য – তাহলে বলতে হয় এই রকম অযোগ্য মন্ত্রী পৃথিবীতে কখনো কেউ দেখেনি। দ্বিতীয় হচ্ছে, যিনি ভোটপর্বে সবসময় বলতেন, “২৯৪টা সিটে আমিই প্রার্থী” অর্থাৎ তাঁকে দেখেই সবাই তাঁর দলের প্রার্থীকে ভোট দেবেন; এবং যাঁর অনুপ্রেঢ়ণা ছাড়া যে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় না – সেই মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এই দুর্ণীতির কিছুই জানতেন না – একথা হাস্যকর শোনাবে। যেজন্য CBI একাধিকবার পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যে টাকা দুর্ণীতিতে তোলা হয়েছে তার হদিশ খুঁজলেই আসল মাথাদের খোঁজ মিলবে। CBI একাজে ব্যর্থ হলে কিন্তু সেটিং তত্ত্বের বাতাস গতি পাবে।
এরপর আসি শিক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শ্রী পরেশ অধিকারীর কথায়। এই স্বনামধন্য (!) মন্ত্রী মহোদয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্কুল লেভেলেই সমাপ্ত হয়েছে! এইসব মানুষকে যিনি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রীত্বে চয়ন করেন তাঁর উদ্দেশ্য শিক্ষার বিকাশ কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। এই তালেবর মন্ত্রীর কণ্যা অঙ্কিতা অধিকারী একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষিকা নিয়োগের পরীক্ষায় ৬১ নম্বর পেয়ে ইন্টারভিউতে কোন ডাক পাননি। অথচ অন্য একজন চাকরী প্রার্থী ববিতা বর্মন একই পরীক্ষায় ৬৯ নম্বর পেয়ে ইন্টারভিউতে ডাক পান এবং সেখানে আরো ৮ নম্বর পেয়ে মোট ৭৭ নম্বর পাওয়ায় নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে প্রথম স্থানে থাকেন। যখন চাকরী প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়, দেখা যায়, অঙ্কিতা অধিকারী প্রথম এবং ববিতা বর্মন ওয়েটিং লিস্টে! মন্ত্রী-কণ্যা নিয়োগপত্র পাবার সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির পাশের সরকার পোষিত স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন! হাইকোর্টে করা ববিতা বর্মনের মামলায় এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসে। SSCর চেয়ারম্যানকে মহামান্য বিচারক তথ্য দিতে বলায় চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার এই তথ্য হাইকোর্টে পেশ করেন। ফলে, হাইকোর্ট অঙ্কিতাকে বেআইনী নিয়োগের কারনে বরখাস্ত করার আদেশ দেন। এদিকে এই ঘটনার পরেই সিদ্ধার্থ মজুমদার তাঁর পদ থেকে অব্যহতি নেন! এর থেকে বোঝা যায় যে দুর্ণীতির উন্মোচন করতে যিনি সহায়তা করবেন, এ রাজ্যের প্রশাসনে তাঁর কোন স্থান নেই।
এই পরেশবাবুকে তদন্তকারী সংস্থা CBI জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠালে তিনি সকণ্যা পদাতিক এক্সপ্রেসে চেপে কোলকাতায় আসার বদলে মাঝরাস্তায় ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান। তারপর হয়ত মহামান্য আদালতের কড়া পদক্ষেপের ভয়ে তিনি একদিন পর CBIএর দপ্তরে হাজির হন। শিক্ষা দপ্তরের দুই দুই মন্ত্রীকেই তদন্ত চলার সময় মহামান্য আদালত সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এটি শোভনভাবে দেওয়া পরামর্শ – আদেশ নয়। সুতরাং মূখ্যমন্ত্রী এই পরামর্শ মানতে বাধ্য নন। তিনি তা মানেননি। মন্ত্রীসভার অন্যতম সিনিয়ার সদস্য জনাব ফিরহাদ হাকিম মন্তব্য করেছেন, “পার্থদা দায়ী হলে আমরাও দায়ী” – অর্থাৎ উনি সঠিকভাবেই মন্ত্রীসভার যৌথ দায়ীত্বের কথা বলেছেন। যৌথ দায়ীত্ব থাকলে এই দুর্ণীতির কাদা কি মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য, এমনকি মূখ্যমন্ত্রীর গায়েও লাগবে না? তদন্তকারী সংস্থা মন্ত্রীর বানানো কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্ণীতির জন্য FIR করেছে; মন্ত্রীকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করছে – যা আটকানোর জন্য মন্ত্রী যত রকম সম্ভব, ততরকমভাবে পদক্ষেপ করছেন! আরেক মন্ত্রীর দেশসেবা নিজের পরিবারকে সেবা ও অন্যদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করার মাধ্যমেই স্ফুরিত হয়েছে – এই অভিযোগে তিনি CBIএর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি। এদের মন্ত্রীসভায় রেখে দেওয়া আইনত ঠিক হলেও কতটা শোভন? অবশ্য দু কান কাটা মানুষ শোভনীয়তার ধার ধারেন না। তবে, এই পদক্ষেপের পর সন্দেহের তীর মন্ত্রীসভাসহ মূখ্যমন্ত্রীর দিকে যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তথাকথিত ‘সেটিং তত্ত্ব’ মিথ্যা প্রমাণের দায় এখন CBIএর উপর! পশ্চিমবঙ্গের অগণিত শিক্ষিত বেকারকে বঞ্চিত করে যরা অসৎ উপায়ে শিক্ষার পরিকাঠামোকেই ধ্বংস করছে তাদের ক্ষমা করাও পাপ।
শিক্ষাঙ্গনে দলদাস ছাত্র নামধারী সমাজবিরোধীদের হুঙ্কার, অনলাইন পরীক্ষার নামে গণটোকাটুকির সুযোগ চালু রাখা, রাজনৈতিক স্বার্থে পাঠ্যক্রম তৈরী, শিক্ষকতার নামে শুধুই রাজনীতি আর শিক্ষাঙ্গনের উন্নয়ণের নামে ঠিকাদারদের থেকে কাটমাণি সংগ্রহ – এইসব ব্যাধি রাজ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে তীব্র গণ-আন্দোলন সংগঠিত করা।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দপ্তরে মাৎসন্যায়
