পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ভারতের অন্য রাজ্যগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যে কারনে স্বাধীনতা উত্তর যুগে বিধান রায় ও প্রফুল্ল সেনের পর সর্বভারতীয় কোন দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সিংহাসনে বসতে পারেনি (সিদ্ধার্থ রায়ের ১৯৭২ সালের নির্বাচনে বিতর্কিত জয় বাদ দিলে)। এইজন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চরিত্র ও চাহিদা বুঝে রাজনীতি না করলে এই রাজ্যে রাজনৈতিক সাফল্য পাওয়া দুষ্কর। যদি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠনের পর থেকে রাজনৈতিক পটভূমি ও ইতিহাসের দিকে তাকানো যায়, তাহলে শুরু থেকেই এ রাজ্যের বঞ্চনার ইতিহাসের কাহিনী পাওয়া যাবে। প্রথমে এ রাজ্যের সফলতম মূখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে নেহরু গোড়াতে ডঃ রায়কে এই চেয়ারে বসাতে চাননি – পরে অবশ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বসাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর বহুবার রাজ্যের উন্নয়ণের প্রস্তাবে নেহরু সরকারের অসহযোগীতায় ডঃ রায় বিরক্তি প্রকাশ করেন। একবার তিনি তাঁর চিকিৎসার দ্বারা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে সুস্থ করার বিনিময়ে সে দেশের সরকারের থেকে রাজ্যের উন্নয়ণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য গ্রহণ করেন! তখন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর অবিরাম বহমান স্রোতে পশ্চিমবঙ্গ দিশেহারা। যদিও পাঞ্জাবে একই রকম উদ্বাস্তু সমস্যা হয়েছিল, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের পরিমাণ অনেক বেশী সদর্থক ও কার্যকরী হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক সেবা কাজে নিযুক্ত সেবামূলক সংস্থা সেখানে অনেক বেশী সক্রিয় ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘ ছাড়া আর কোন সংস্থা কার্যকরী সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। তাছাড়া, ভারতের অন্য কোন রাজ্যকে এই রাজ্যের মত ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত সামলাতে হয়নি। এই দুবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের বদলা নিতে পাকিস্তান তাদের হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর চরম অত্যাচার করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। পূর্বপাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের উপর অত্যাচার তাদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে উদ্বাস্তু হিসেবে হিন্দুরা ভারতে পালিয়ে আসতে থাকে। যদিও কিছু শরণার্থী আসাম ও ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন, তবু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের শতকরা নব্বইভাগের বেশী উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সত্য বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, নেহরু ও তাঁর পরবর্তী কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রীয়স্তরে যেমন এই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কোন সঠিক পরিকল্পনা করেননি, তেমনই তাঁদের জন্য কোন আর্থিক সাহায্য মেলেনি। রাজ্যের সরকারও সেভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ কিছু শরণার্থীকে পান্ডব বিবর্জিত, জনমানবশূণ্য, চাষের অযোগ্য শুখা জায়গা দন্ডকারণ্যে পাঠিয়ে এই সমস্যা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পশ্বিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলিও এদের হিন্দু-বাঙ্গালী পরিচয় এবং সেকারনেই উদ্বাস্তু হয়ে আসা হতভাগ্য মানুষদেরকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-বাঙ্গালী সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু সমাজে এদের বাংলা ভাষাগত উচ্চারণের পার্থক্যের কারনে এই হতভাগ্য মানুষদের বিদ্রুপ ও অবহেলার শিকার হতে হয়েছে! সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এদের সঙ্গে এপার বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীদের(এদেশী) আলাদা করার প্রয়াস করা হয় – পাঞ্জাবীদের সঙ্গে এখানেই বাঙ্গালীদের তফাৎ। এই অভাগা মানুষরা যখন ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হয়ে অর্থ, সম্পদ, মান-সম্মান, সমস্ত কিছু খুঁইয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তখন তাদের প্রতি সহমর্মীতা দূরের কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসহযোগীতা করা হয়েছে। এই বাস্তবতার এক অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ হল পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উদ্বাস্তু কলোনী গড়ে ওঠা – এই উদ্বাস্তু পরিবারদের বাঁচার সামাজিক মূলধন বলতে সংঘবদ্ধতাই একমাত্র অবশিষ্ট ছিল।
এই সময় পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিস্টরা রাজনৈতিক জমি শক্ত করার কাজে মনোনিবেশ করে। তারা এইসব উদ্বাস্তু পরিবারের থেকে কর্মী সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে এদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এদের উন্নয়ণের ও বাসস্থান এবং খাবার সংস্থানের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। তখন উদ্বাস্তুরাও সরকারী এবং সামাজিক অবহেলায় সব আশা ভরসা হারিয়ে এদেরকেই খরকুটোর মত আঁকড়ে ধরে। তারপর কম্যুনিস্টরা যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলো তখন তাদের আদর্শগত দ্বন্দ সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ তৈরী হলো! সবচেয়ে বড় দ্বন্দের কারন, এই উদ্বাস্তু পরিবারের প্রায় সবাই কম্যুনিস্টদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভোটার আর এদের মধ্যে প্রচুর অল্পবয়সী সক্রিয় কম্যুনিস্ট কর্মী থাকলেও তাদের সকলের মুসলমান বিদ্বেষ ছিল – যা পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাভাবিক। এদিকে ভারতীয় কম্যুনিস্টরা শুরু থেকেই জেহাদী ইসলামের সমর্থন ও পাকিস্তানের পক্ষে সওয়াল করে আসছে; শুধু তাই নয়, আদর্শগতভাবে তারা হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের এই অবস্থান যে সমর্থন পাবে না – সেটা বুঝেই তারা এক অদ্ভুত শব্দ – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ – আমদানী করল। যদিও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইসলাম এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম স্বীকৃত নয়, তবু তারা এটি হিন্দুদের অবশ্য পালনীয় একটি কর্তব্য – যা তাদের কৃষ্টি ও সভ্যতার মেরুদণ্ড – এমন প্রচার শুরু করল! বেঁচে থাকার তাগিধে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি কোন আপত্তি করার সাহস পেল না।তারপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের (committed intellectuals) দিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখানো, সিনেমা, থিয়েটার দেখানো ইত্যাদি শুরু হল যেখানে ইসলামী ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের প্রেম ও পরিণতিতে ইসলামী পরিবারের উদারতার কথা প্রচার করা হতে লাগল। যদি ভিন্ন ধর্মীয় ছেলে মেয়ের প্রেমের গল্প দেখানো হয়, সেখানে সমকালীন সাহিত্যে কোন হিন্দু ছেলের সঙ্গে ইসলামী মেয়ের প্রেম এবং সেখানে মেয়ের পরিবার ধর্মীয় উদারতা দেখিয়েছে – এমন একটি গল্প-উপন্যাস বা সিনেমা আমার চোখে পড়েনি। কম্যুনিস্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গে যে সব পরিবর্তন হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল দলদাস ‘বুদ্ধিজীবী’ তৈরী করা। এই বুদ্ধিজীবীরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হবেন এমন কোন কথা নেই – তবে তাদের দলদাস সংবাদ-মাধ্যম বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রচার করেছে আর এরাই দলের নীতি জনগনকে ‘গেলানো’র দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মাধ্যমেই বাঙ্গালী হিন্দুদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মাহাত্য বোঝানো শুরু হল। বঙ্গীয় হিন্দু বাঙ্গালীদের উদ্বাস্তু ও এদেশীরা উভয়েই ধীরে ধীরে কম্যুনিস্টদের এই চালে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হল। সমাজজীবনে এবং অর্থনৈতিকভাবে কোন সাহায্য না পাওয়ায় যেমন সর্বভারতীয় দলগুলির থেকে বাঙ্গালীরা মুখ ফিরিয়ে নিল তেমনি কম্যুনিস্ট নিষ্পেষণ ও ভোটের হিংসা বাঙ্গালীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল। বাঙ্গালীর আল্ট্রা কম্যুনিস্টদের হিংসায় প্রতিবাদী চরিত্র অবধি নষ্ট হল। “কম্যুনিস্ট প্রচার নাৎসী প্রচারকেও হার মানায়” বলে প্রবাদ আছে। কয়েকবছর আগে চীনে গিয়ে আমি সাংহাইয়ের চাকচিক্যের আড়ালে জিয়ান থেকে বেজিংয়ের বিভিন্ন অনুন্নয়ণের ছবি দেখেছি। এনিয়ে ভারতীয় কম্যুনিস্টদের কথা বলতে দেখিনি। যেমন রাশিয়ার ইউক্রেনের উপর দখলদারীর আক্রমণ বিষয়ে কম্যুনিস্টরা আর তাদের প্ল্যান্টেড বুদ্ধিজীবীদের ভাষা বন্ধ হয়ে আছে!
আবার ২১শে ফেব্রুয়ারীকে বাংলা ভাষা দিবস বলে দলদাস বুদ্ধিজীবী – সংবাদ-মাধ্যমের পশ্চিমবঙ্গ আর সোশ্যাল মাধ্যম জুড়ে সেকি লাফালাফি! বাংলা ভাষা নিয়ে আমার জানা আন্দোলনগুলির কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল বাঙ্গালী জাতি হিসেবে শতধাবিভক্ত – ভাষা হিসেবেও তাই! বিশুদ্ধ বাঙ্গালী আর বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা – দুইই অস্তিত্বহীন! পশ্চিমবঙ্গে ভাষা দিবসের নামে যা হয়, তা অন্য একটি রাষ্ট্রের প্রচার মাত্র। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতীতত্ত্বের (হিন্দু ও মুসলমান) ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান, দুটি খন্ডিত অংশ নিয়ে পাকিস্তান তৈরীর পর থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানে এবং দুই অংশেরই রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম। এই ধর্মের সুযোগ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের লাঞ্ছনা ও ইজ্জত হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সর্বস্ব খুঁইয়ে ভারত ভূখন্ডে (প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গে) উদ্বাস্তু হয়ে আসার ঢল নামে। তাঁদের সম্পত্তি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা দখল করলেও আইন হিন্দুদের কোন সুরাহা দিল না (কুখ্যাত এনিমি প্রপার্টি আইন)। প্রথম ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে সংশোধনী এনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদায় সরকারী ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব পেশ করেন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁকে সমর্থন জানান পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হিন্দু সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টপাধ্যায়। যে কথা বলা হয় না তাহল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন্যান্য ইসলামী বাঙ্গালী সদষ্যরা, যারা মুসলিম লীগের সদস্য, তারা মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের নেতৃত্ত্বে বাংলা ভাষার জন্য আনা এই সংশোধনীকে বিরোধীতা করে খারিজ করেন। সুতরাং বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন সে দেশের মুসলমান বাঙ্গালীর আন্দোলন নয়! গোল বাঁধল ১৯৫০ সালের পর – যখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে চাকরী ও অন্যান্য সরকারী সুবিধার জন্য একমাত্র উর্দু ভাষাকে স্বীকৃতি দিল। বাংলা ভাষা সরকারের কাছে শুধু গুরুত্বহীণ হয়ে গেল তা নয়, বাংলায় শিক্ষাপ্রাপ্ত উর্দু না জানা সিংহভাগ পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকের (ধর্ম নির্বিশেষে) ভাষার কারনে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার উপক্রম হল। তখন মুজিবুর রহমানসহ মুসলীম লীগ নেতারা প্রমাদ গুনলেন। এই কারনেই, মূলতঃ অর্থনৈতিক বঞ্চনার ভয়ে তাঁরা বাংলাকে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন শুরু করলেন। এটা ভাষা আন্দোলন নয় – উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানকে ভাতে মারার চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন। বহু বছর আগে ‘দি স্টেটসম্যান’ কাগজে প্রখ্যাত লেখক আব্দুল গফ্ফর খান এই লাইনেই একটি লেখা লিখেছিলেন। যে কারনে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের পুরোধা গণপরিষদের হিন্দু সদস্যদের ২১শে ফেব্রুয়ারীর সম্মাননা অনুষ্ঠানে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় না। এটি উর্দুভাষী ইসলামীদের বিরুদ্ধে বাংলাভাষী ইসলামীদের ক্ষমতা দেখানোর লড়াইয়ের একটি অধ্যায়।
আবার দেখা যাচ্ছে, বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের অন্য যে রাজ্যে থিতু হয়েছে, সেখানেই তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন্য লড়াই করেছে। আসামে ১৯৬০-৬১ সালে যখন মূখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা রাজ্যে অহমীয়া ভাষাকেই একমাত্র সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, হিন্দু উদ্বাস্তু অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার মানুষ তীব্র ক্ষোভে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে এই হিন্দু বাঙ্গালীদের ১১ জনকে অসম পুলিশের বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। তারপর প্রতিবাদের আগুন তীব্রতর হওয়ায় চালিহা বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। এ সময় আন্দোলনে কোন বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহনের প্রমাণ মেলে না! পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলি ও ভাড়াটে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলন বলে চালান; আর ১৯৬১র ১৯শে মে’র বাংলা ভাষার জন্য বাঙ্গালীর আত্মবলিদানকে ভুলে যান, তখন তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইসলামী সেকুলারিজমকে আপামর বাঙ্গালীর হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার গূঢ় অভিপ্রায় প্রতীয়মান হয়। এভাবে ছত্রিসগড়ের দন্ডকারণ্য, কর্ণাটকের রায়চুড় জেলা, বিহারের মানভূম ও ঝাড়খন্ডের শিকার জেলায় উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনে ভাড়াটে সংবাদ-মাধ্যম ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনগুলিকে ভাষা আন্দোলন বলে না, কারন এগুলি তাদের এ্যাজেন্ডায় নেই!
ভারতে বাংলা ভাষার জন্য যে কটি আন্দোলন হয়েছে, তার সবকটিই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালীর নেতৃত্বে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কুটচালে এই বাংলার ‘এদেশী’ বাঙ্গালী এই আন্দোলনে কখনো সামিল হননি। এর কারন একটাই, কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল দল ত বটেই, পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত বামপন্থীরাও তাদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সামাজিক পরিবেশে হিন্দু বাঙ্গালীদের বিভক্ত করে রেখেছে। অথচ, এরাই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামী সম্প্রদায়ের সামাজিক ও কার্যকরী শিক্ষার উন্নতি না করে শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে মুসলমান সমাজকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে।
এইভাবে ধীরে ধীরে কম্যুনিস্ট প্রভাবে রাজনীতি বাঙ্গালীর সমাজনীতিতেও ঢুকে গেল। রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনে কেন্দ্রের ঔদাসীন্য এবং কম্যুনিস্ট দলতন্ত্র কায়েমের ঘটনা রাজ্যের সাধারন মানুষকে সরকারী তথা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ্য নির্ভর করে তুলতে বাধ্য করল। প্রথমে উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য হলেও পরে রাজ্যের অর্থনীতির বন্ধ্যাত্বের কারনে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীই সরকারী দাক্ষিণ্য ও ভাতাজীবী হওয়ার দিকে ঝুঁকে গেল। কম্যুনিস্টদের নেতৃত্বে যখন প্রকৃত ভদ্রলোক বাঙ্গালী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এলেন এবং তিনি ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার আফিমের বদলে বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করলেন। তখন বাঙ্গালীর মানসিক গঠনের পরিবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ায় বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভোটে বামপন্থী দলকে হটিয়ে মমতা ব্যানার্জীর আঞ্চলিক দলকে রাজ্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলো। ইতিমধ্যে ভোটে হিংসা ও সরকারী প্রশাসনকে ব্যবহার করে বারবার নির্বাচন জেতা কম্যুনিস্টদের অত্যাচারে হিন্দু-মুসলমান সবারই মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। শুধু বুদ্ধদেববাবুর সততা ও সমাজের উন্নয়নের প্রকল্প ব্যর্থ হল! মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতা দখলের পর কম্যুনিস্ট কায়দায় প্রশাসন ও সংবাদ-মাধ্যমকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে দলদাসে পরিণত করে একই কায়দায় নির্বাচনে বিভিন্ন পর্যায়ের অসততা ও ভীতির আশ্রয় নিয়ে তাঁর দলের জয়লাভ সুনির্দিষ্ট করলেন! কখনো কেন্দ্রীয় সরকারের কোন সদর্থক পদক্ষেপ না থাকায় এবং জাতীয় দলগুলির নেতৃত্বকে এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোন কার্যকরী সাহায্য না করায় তাদের রাজ্য নেতৃত্ব রাজনৈতিক জোকারে পর্যবসিত হলেন! এতে অবশ্যই তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, রাজ্য নেতৃত্ব ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কুটনীতির সাফল্য দায়ী – ক্ষতি অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীর। মমতাদেবী পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নিয়ে সরকারী দাক্ষিণ্য নির্ভর হিন্দু বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার অক্সিজেন হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করলেন – সঙ্গে অবশ্যই ইসলামী ধর্ম নিরপেক্ষতার তাস খেলতে লাগলেন। তার বড় কারন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারনে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামী ভোটারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্যুনিস্টদের কায়দায় তিনিও তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চরিত্রের মধ্যে তফাৎ ঘুচিঁয়ে দিয়ে দল ও প্রশাসনকে সমার্থক করার প্রয়াস করলেন।
আমরা বাঙ্গালী হিন্দুরা এখনো ঘটি, বাঙ্গাল, অসমীয়া বাঙ্গালী, বিহারী বাঙ্গালী, প্রবাসী বাঙ্গালী ও সেকুলার বাঙ্গালী ইত্যাদি মেরুদন্ডহীণ কয়েকটি ক্লীবশ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ দলাদলিতে মগ্ন – সমষ্ঠীস্বার্থ সম্পর্কে জ্ঞানহীন জীব হয়েই রইলাম। কিন্তু ইসলামীরা, বাঙ্গালী হোক বা না হোক – প্রথমে তারা ইসলামী, শেষেও তারা ইসলামী। তাদের কাছে হিন্দুরা “মালাউন”। সুতরাং হিন্দু-মুসলিম সামাজিক ঐক্য সোনার পাথরবাটি মাত্র – ধর্মকে কার্যকরীভাবে ভুলতে পারলেই শুধু বাঙ্গালী ঐক্য সম্ভব। এখন তার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
পরিশেষে বলি, বাঙ্গালীর মধ্যে কোন জাতিগত একতা না থাকায় বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদের বোধও তৈরী হয়নি। সেজন্য জাতীয় স্বার্থ, বিদেশনীতি, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বাঙ্গালীর বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে অনুপস্থিত। ভাতাজীবী বাঙ্গালী, ও ইসলামী ঐক্যের সমন্ধয়ে বাঙ্গালীর থেকে কোন জাতীয়তাবাদী বা সর্বভারতীয় দলের সমর্থন পাওয়ার কথা নয়, কারন, বাঙ্গালী নিজের মূল থেকে উৎপাটিত হওয়ায় তার মধ্যে ভারতীয়ত্ব খোঁজা বাতুলতা মাত্র। সেজন্য সুবিধাবাদী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া অদূর ভবিষ্যতে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। বাঙ্গালীর ভবিতব্য গর্বিত ক্রীতদাসের ভাতাজীবী জীবন!
বঙ্গ রাজনীতিতে জাতীয়দল ব্রাত্য
