আমরা,যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, তাদের মধ্যে সর্বদা এক দ্বিধা-বিভক্তিজনিত জড়তা কাজ করে। বাঙ্গালী হিন্দুদের মনে যে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে তা হল – আমরা প্রথমে বাঙ্গালী না প্রথমে ভারতীয়! তেমনই বাঙ্গালী ইসলামিদের মনের দ্বন্দ্ব হল – আমরা প্রথমে বাঙ্গালী না প্রথমে ইসলামি! এই দ্বন্দ্বমূলক বিচারধারার পরিণতি না আসায় বাঙ্গালী তার নিজস্ব বোধবুদ্ধির উপর ভরসা না রেখে এক অদ্ভুত কাল্পনিক তত্ত্ব – ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আঁকড়ে ধরে বাঙ্গালী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করছে! তার অবিসংবাদী ফল হচ্ছে, বাঙ্গালী “না ঘরকা, না ঘাটকা” হয়ে সকলের থেকেই তাচ্ছিল্য আর অবহেলা পাচ্ছে।
আমরা যদি বাংলার ইতিহাস দেখি, অবশ্য কাল্পনিক ‘ইজম’ ভিত্তিক নয়, প্রকৃত ইতিহাস – সেখানে আমরা দেখি, বিদেশী হানাদারদের জন্য “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি” শুধু নয়, বিশেষতঃ বর্ষাকালে নদীমাতৃক বাংলায় যুদ্ধ জেতা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সে কারনে মুঘল আমলেও অমিত শক্তিধর দিল্লীর বাদশারা বাংলা দখলের প্রশ্নে সম্পূর্ণ সার্থকতা পাননি। এমনকি সুলতান আমলের শেষপর্বে, ১৩শ শতাব্দীতে, সুবে বাংলার সুবাদার হিসেবে ইসলামি শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন্ বক্তিয়ার খিলজি যে বাংলা জয় করেন বলে লেখা হয়, তা শুধুমাত্র সুবে বাংলার উত্তর ও পশ্চিমের কিয়দংশ। নদীমাত্রিক বাংলার বেশীরভাগ স্থান বাঙ্গালী রাজাদের অধীনেই থাকে।
বাঙ্গালী অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমান ও উদারমনা জাতি হিসেবেই বাইরের জগতে পরিচিত। এই কারনেই উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রেনেসাঁর পুরোভাগে নেতৃত্ব দেন বাঙ্গালীরা – রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন থেকে রাসবিহারী বসু ইত্যাদি। সাহিত্য জগতে – বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং অবশ্যই বাংলা সনেটের প্রথম রচয়িতা মধুসূদন দত্ত। এমনকি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি ভিন্ন ধারা – সহিংস ও অহিংস – দুই ধারাতেই বাঙ্গালীর অবদান সর্বাধিক – একথা না বললে সত্যের অপলাপ হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিস্মরনীয় চরিত্র – নেতাজী সুভাষচন্দ্র, রাসবিহারী বসু, ফাঁসির মঞ্চে দেশের প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরা, মাষ্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,…… অজস্র নাম। বাঙ্গালীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা কখনো পিছন থেকে ছুরি মারে না – অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ইতিহাস নামের মার্কসীয় প্রচার পুস্তিকায় লেখা হয় – ভারতের স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিল পলাশীর প্রান্তরে এবং বাঙ্গালীদের, অর্থাৎ মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ ও ঘসেটি বেগমদের বিশ্বাসঘাতকতায়! কথায় বলে, “গল্পের গরু গাছে চড়ে” – এক্ষেত্রে দেখা যায় ‘ইতিহাস’ নামের প্রচারধর্মী পুস্তিকার কল্যানে সর্বৈব মিথ্যাকে সত্যি বলে চালানো হয়েছে। যাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা কেউ বাঙ্গালী নয়; রাজস্থান, বিহার এমনকি তুরস্ক থেকে আসা মানুষ। এরা কেউ বাংলায় কথাও বলতেন না। আবার ঘসেটি বেগম সিরাজের আত্মীয়। সিরাজউদ্দৌল্লা এবং তার দাদু আলীবর্দী বাংলা না-জানা তুরস্কের মানুষ – এরা আশরাফি মুসলমান হওয়ার সুবাদে বাঙ্গালী হিন্দু ত বটেই, বাঙ্গালী ধর্মান্তরিত ইসলামিদেরও মানুষ মনে করত না। বাঙ্গালী মুসলমানরা সকলেই ধর্মান্তরিত মুসলমান (আতরাফি) হওয়ায় এদের এই উর্দু বা ফার্সীভাষী মুসলমানরা কখনো তাদের স্বগোত্রীয় মনে করত না। অবশ্য এই তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকরা সকলেই কোন না কোনভাবে সিরাজের অত্যাচার, অবিচারের শিকার। ১৯৩৮ সালে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা নাটক ও প্রামাণ্য ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে জানা যায় যে, সিরাজ তুর্কিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ত বটেই, এমনকি বাংলা ভাষার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি দিল্লীর বাদশাহের অধীনে একজন করদ ‘নবাব’ ছিলেন মাত্র। যে জন্য অত্যাচারী, উশৃঙ্খল সিরাজের পরাজয়ে সাধারণ মানুষের থেকে কোন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ হয়নি। মানুষের ভাবখানা এমন, যেন – দিল্লীর পাঠানো নবাবের বদলে কোম্পানীর নবাব এলো! পরবর্তীতে, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক সুন্নি ইসলামি নাট্যকার সিরাজকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে প্রচার করতে সচেষ্ট হন। তার প্রধান কারন ধর্মীয় – প্যান-ইসলামিজম এর সাথে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় জিগির তুলে একাত্মতা!
ভারতের স্বাধীনতালাভের আগে মুসলিম লীগের জন্মের পর তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর কাজে আরবী সংস্কৃতির প্যান-ইসলামিজমের প্রচার শুরু হয়। ফার্সি ও উর্দুতে কথা বলা ইসলামিদের সঙ্গে চারিত্রিক, ভাষাগত ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য হেতু বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ্যে এই আরবী সংস্কৃতির ভ্রাতৃত্বের ডাক প্রথম দিকে বিশেষ দাগ কাটেনি। কিন্তু স্বাধীনতালাভ ও বাংলা ভাগের অব্যবহিত আগে মুসলিম লীগের বাঙ্গালী নেতৃত্ব, বিশেষতঃ হুসেন সুরাবর্দী এবং তাদের কম্যুনিস্ট বন্ধুরা, সঙ্গে কংগ্রেসের একাংশ – সরাসরি হিন্দু, মুসলমানের মধ্যে বিভেদের প্রচার করতে শুরু করে। হিন্দুদের তরফে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলেও বাংলাভাগের দায় বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী মুসলমান রাজনীতিকরা সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর চাপায়! একাজে ধর্মীয় স্থান থেকে ঐ রাজনীতিকদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন মেলে।
ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাগের আকস্মিকতায় হতচকিত বাঙ্গালীদের মধ্যে দু রকমের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ সুন্নি ইসলামি সম্প্রদায় তাদের ছোট চোখে দেখা আশরাফি ইসলামিদের প্রচারে ভুলে এবং লোভের বশবর্তী হয়ে সরাসরি হিন্দুদের উপর অত্যাচার, খুন,ধর্ষণ ও লুঠপাট এবং সম্পত্তি দখল করা শুরু করে। পাকিস্তানের তদানীন্তন মুসলিম লীগের সরকার একাজে সরাসরি মদত দেয়। তারা ভারতের মত সংখ্যালঘু (ভারতের ক্ষেত্রে ইসলামি ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হিন্দু) সম্প্রদায়ের ধন, প্রাণ, সম্পত্তি রক্ষার অঙ্গীকার করেনি! বরঞ্চ, তারা ‘enemy property’ নাম দিয়ে বকলমে হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করাকে প্রশাসনিক বৈধতা দেয়। এই সময় থেকেই বাঙ্গালী ইসলামিদের একাংশ ক্ষমতা ও অর্থের লোভে পাকিস্তানের আশরাফি ইসলামিদের দালালি শুরু করে। যদিও পাকিস্তানের উর্দুভাষী ইসলামিরা বাঙ্গালী ইসলামিদের অত্যন্ত নিম্নবর্গীয় (‘আতরাফি’, অর্থাৎ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত এবং বাংলাভাষায় কথা বলে) বলে তাচ্ছিল্য করে! ১৮৮২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি লর্ড রিপন কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশনে ইসলামিদের তরফে নবাব আব্দুল লতিফের প্রস্তাব ছিল – উচ্চ শ্রেণীর (আশরাফ, অর্থাৎ সৈয়দ,মোঘল,পাঠান) ছাত্ররা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখাপড়া শিখবে। আর নিম্নবর্গীয় (আতরাফ, অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী ইসলামি) ছাত্ররা বাংলায় লেখাপড়া শুরু করবে। এর থেকে পরিষ্কার যে উর্দুভাষী ইসলামিরা প্রথম থেকেই বাংলাভাষী ইসলামিদের ছোট চোখে দেখে। এর একটা বড় কারন হল, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভাস (বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ্যে গরু খাওয়ার প্রবণতা পরে আসে) সব দিক থেকে বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ্যে সাযুজ্য লক্ষণীয়। এমনকি গ্রাম বাংলার পালাগান, বাউল সঙ্গীতের জগতে হিন্দুদের সঙ্গে ইসলামিদেরও দেখা মেলে। বাঙ্গালীর মধ্যে, কি হিন্দু কি ইসলামি, ধর্মীয় ঋজুতা কখনো ছিল না। মসজিদ থেকে বাঙ্গালী ইসলামিদের ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে।
তিনজন ইসলামি বুদ্ধিজীবী, খোন্দকার ফজলে রাব্বি (বই – বাংলার মুসলমান; বাংলা একাডেমি; ঢাকা;১৯৮৬); মহম্মদ আব্দুল রহিম (বই – Social and Cultural History of Bengal,vol.I; Historical Society; Karachi; ১৯৬৩ ও vol.II, ১৯৭৭; এবং মহম্মদ মোহর আলী (বই – History of The Muslims of Bengal; Riyadh, Ibn Soud Islamic University, ১৯৮৫) প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বাঙ্গালী (অধুনা বাংলাদেশী) ইসলামিদের মধ্যে সকলেই আতরাফি নয়, অনেক আশরাফিও আছেন! যদিও সত্যনিষ্ঠ কোন প্রমাণ তাঁদের লেখায় পাওয়া যায় না, এবং এদের দুজনের বই যেহেতু পাকিস্তানের ইসলামি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত, এটি মনে করার যথেষ্ট কারন আছে যে, পাকিস্তানের উর্দুভাষী ইসলামিরা এভাবে বাঙ্গালী ইসলামিদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে ruler and to be ruled শ্রেণী তৈরীর চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা এই তথাকথিত বাঙ্গালী আশরাফিদের ব্যবহার করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের (এবং প্রতিবেশী ভারতের) অভ্যন্তরে ধর্মীয় হিংসার বাতাবরন তৈরীর চেষ্টায় আছে। যদিও বাঙ্গালী ইসলামিদের বড় অংশ অবাঙ্গালী ইসলামিদের দ্বারা এভাবে ব্যবহৃত হতে রাজি নয়, এই অশুভ প্রচেষ্টা নিরন্তর চলছে।
এইখানেই পোঁতা হয়েছে হিন্দু বাঙ্গালী ও ইসলামি বাঙ্গালীর মধ্যে বিদ্বেষের বীজ। যে বাঙ্গালী ধর্মের গোঁড়ামির মধ্যে না থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রাখত, তাকে যখন ধর্ম ও অসহিষ্ণুতার বাঁধনে বেঁধে ফেলা হল, তখন থেকেই সমাজের সব স্তরে বাঙ্গালীর পিছুহটা শুরু হল – বিশেষতঃ বাংলাদেশের মধ্যে অসহিষ্ণুতার ঘাত-প্রতিঘাতে পশ্চিমবঙ্গের দুইধর্মের বাঙ্গালীদের মধ্যে তার প্রতিফলন দেখা দিল। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু হিন্দুরা কিন্তু কখনোই ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়নি। যদিও বাংলা ভাগ ও ভারতের স্বাধীনতার সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি ভোলার জন্য রাজনৈতিক স্তরে চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। বরঞ্চ সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ভারতের ইসলামিদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার জন্যই কিছুকিছু ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক ছাড়া অন্য ইসলামিদের (বিশেষতঃ আতরাফিদের) সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ইসলামি বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রেও একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
এই রাজ্যের হিন্দু বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক উদাসীনতা ও তাদের দাবার ঘুঁটির মত ব্যবহার করার প্রবণতায় ঘটি-বাঙ্গাল সামাজিক লড়াই লাগিয়ে বিভাজন সৃষ্টি করা হল। বাঙ্গালীর চিন্তার মৌলিকতাকে ধীরেধীরে রাজনীতির ‘ইজম’-এ আবদ্ধ করা হল। এদিকে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভাজন, ইসলামি বাঙ্গালীদের অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে রাজনীতিবিদ ও আশরাফি মৌলবাদীদের হাতের পুতুল বানানো হল। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্তিরতা ও আল্ট্রা-লেফ্ট নকশালদের খুনের রাজনীতি বাঙ্গালীর প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের স্পৃহাকে নষ্ট করে দিল। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীর লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের আশরাফি খানসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও এবং বাংলাদেশের জন্মের জন্য ভারতের, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের, প্রভূত অবদান থাকলেও, সে দেশের একদল ইসলামি দালালদের সক্রিয় সাহায্যে খানসেনারা বাঙ্গালী, বিশেষভাবে বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর চরম অত্যাচার করলেও রাজনীতির প্রয়োজনে তখন ভারতের বাঙ্গালীরা কোন কার্যকরী প্রতিবাদ করেনি। এভাবেই দুই বাংলায় হিন্দু মুসলমানের বিভেদ বাড়তে থাকে। তারপর কম্যুনিস্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের মেরুদন্ড শুধু যে ভেঙ্গে দেওয়া হল, তা ই নয়, রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলী গায়ে চড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী নেতারা “ইসলামি ধর্মনিরপেক্ষতা”র প্রবক্তা হয়ে উঠলেন। আর, বাংলাদেশের থেকে বেআইনি ইসলামি অনুপ্রবেশকে চোখ বন্ধ রেখে রাজ্যের শাসককুল পরোক্ষে সমর্থন দিতে লাগল! তখন থেকেই রাজ্যের উন্নয়ন স্তব্ধ থাকায় এবং এভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির চাপে রাজ্যের অর্থনীতি যত দূর্বল হতে লাগল, ততই বাঙ্গালীর অর্থনৈতিক দৈন্যতার সুযোগ নিয়ে কম্যুনিস্টরা ভোটের সময় বিভিন্ন রকমের কারচুপির মাধ্যমে রাজ্যে তাদের আধিপত্য কায়েম রাখল। তারপর ধীরেধীরে তারা তাদের রেজিমেন্টেড শাসনের মাধ্যমে রাজ্যের মানুষকে তাদের অঙ্গুলীহেলনে চলতে বাধ্য করল।
আবার বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে গেল! তারা নিজেদের দেশকে ইসলামি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ হিসেবে ‘ইসলামি’ তত্ত্বে বিভিন্ন ছুঁতোনাতায় বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করল। তখন আবার দফায় দফায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু উদ্বাস্তুর ঢল নামল।
একে শাসকের ভুল সমাজনীতি ও অর্থনীতি, তায় এভাবে জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি, সঙ্গে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগীতার অভাব – সব মিলে শতধা বিভক্ত বাঙ্গালীর অবস্থা এমন হল যে তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেল। এমতাবস্থায় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলেন কম্যুনিস্টদের “মেধাবী ছাত্রী” মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে কম্যুনিস্ট শাসনের রেজিমেন্টেশানকে আরো তীব্র, সর্বব্যাপী ও বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে দিলেন। যে কোন কম্যুনিস্ট শাসনে যেমন শাসক পালিত ছাড়া কোন বিরোধী দল থাকে না – তেমনি পশ্চিমবঙ্গবাসী বিরোধীতার ভাষা হারিয়ে ক্রমশঃ শাসকের ক্রীড়নকে পরিণত হল। এই অবস্থায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আপামর বাঙ্গালীর ভাতা নির্ভরতা খাঁচায় আবদ্ধ সিংহের খাবারের জন্য লোলুপতাকে স্মরণ করায়।
হায় বাঙ্গালী – হিন্দু, মুসলমানের বেড়াজাল ভেঙ্গে কবে তুমি তোমার স্বাভিমানী চরিত্র ফিরে পাবার লড়াইয়ে সামিল হবে? এপার-ওপার, দু পারের বাঙ্গালীর সুদিন কি আর ফিরবে? আশায় থাকতে দোষ নেই।
বাংলা ও বাঙ্গালীর ভাগ্য
