বাঙ্গালী জাতি হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে যে একতা ও দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছিল, তার উপর স্বাধীণতার অব্যবহিত পূর্বেই আঘাত হানা শুরু হয়েছিল। এই আঘাতের জন্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও তার সহযোগী দলগুলি যেমন দায়ী, তেমনি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দও একই রকম দায়ী। বাঙ্গালী অস্মিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে বৃটিশের ধামাধরা দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ইংরেজরা দেশের শাসনভার ছেড়ে যেত না - এ্যাটলের একটি ছোট্ট কথাতেই তা পরিষ্কার। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ভারতের স্বাধীনতায় গান্ধীজীর অবদান কতটা - তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "minimal"। এটা নিয়ে পেইড ইতিহাসবিদরা কিছু বলেন না। গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের নেতারা সুভাষচন্দ্র বসুকে ভয় পেতেন। সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে জার্মানী ও জাপানের সহযোগীতায় সশস্ত্র বিপ্লবের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাতে তাঁর নেতৃত্বে শুধু হিন্দুরাই নয়, বহু দেশপ্রেমিক মুসলমান মানুষও শামিল হয়েছিলেন।নেতাজীর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সততাকে ভয় ও ঈর্ষা করতেন স্বয়ং গান্ধীজী সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতা। এই ভয় দেশের স্বার্থে নয়, তা ব্যক্তিস্বার্থে - নেতৃত্বের মধুভান্ড হারানোর ভয়! এই কংগ্রেসের নেতারাই কিন্তু মহম্মদ আলী জিন্নাকে কংগ্রেসের নীতি নির্ধারন করার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কখনো শামিল হতে দেয়নি। গান্ধীজী ও তাঁর পেটোয়া হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের মধ্যে একটা কোটারি তৈরী করে সর্বদা চালিয়েছে। এরাই জিন্নাকে একঘরে করার নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকায় শেষে জিন্না বাধ্য হয়ে রাজনীতিতে ভেসে থাকার জন্য মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলিম কার্ড খেললেন। গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামী কংগ্রেসের নেতারা বারবার এই কৌশল নিয়েছে। তারপর মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগের দাবীতে সরব হল। খন্ডিত ভারতের নেতৃত্ব পাওয়ার প্রস্তাবে গান্ধীজী প্রথমে প্রতিবাদ অনশন করলেও সে আন্দোলন তাঁর অন্য আন্দোলনগুলির মতই কিছুদিন চলার পর বন্ধ হল! গান্ধীজী একসময় জেহাদী মুসলিম নেতাদের প্রাধান্য দিয়ে নিজের নেতৃত্ব টিঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ দ্বারা প্রত্যাখাত হলেন। তাঁর কায়দা চতুর রাজনীতিক জিন্না ধরে ফেলেছিলেন।
একটি তথ্য এখানে অত্যন্ত খুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল ভারতের স্বাধীনতা কেন ১৯৪৭ সালে এসেছিল। এর মূল কারন হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ, নির্বাচনে চার্চিলের পরাজয়, সুভাষের INAর চাপ এবং ভারতের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খন্ডিত ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে বৃটিশদের কাছের দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দুই দেশের শাসনভার অর্পনের মাধ্যমে ভারতে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বজায় রাখা। এসব কারনের সম্মিলিত ফল হল ভারতের স্বাধীনতা লাভ। এখানে একটি ব্যপার অবশ্য লক্ষণীয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে যে দুটি প্রদেশ বৃটিশদের সবচেয়ে বেশী বেগ দিয়েছে সেই দুটি - পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন! যদিও মুসলমান জনসংখ্যা অবিভক্ত ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ভালো সংখ্যায় উপস্থিত ছিল। বাংলাকে পুরোটাই পাকিস্থানে দিয়ে দেওয়ার আলোচনায় গান্ধীজী ও তাঁর প্রিয় কংগ্রেস নেতাদের থেকে কোন আপত্তি হয়েছে বলে জানা যায় না। এই সময় শ্যামাপ্রসাদ যুক্তি দিয়ে বোঝান যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট বাংলাকে পাকিস্তানে দিয়ে দিলে এই বিপুল সংখ্যক হিন্দুর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বরং বাংলাকে খন্ডিত করে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম অংশকে ভারতের প্রদেশ হিসেবে ভাগ করা অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ তার বাঙ্গালী মুসলমান সদস্য সমর্থকদের দিয়ে হিন্দু বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। এই সময় মুসলিম লীগের কিছু নেতা, যেমন হুসেইন সুরাবর্দী জিন্নাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য 'দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' এর মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের প্ররোচিত করে। দুঃখের বিষয় হল, সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বিপুল অংশ সেই প্ররোচনায় পা দেয়। এর সঙ্গে খুণ,লুঠতরাজ ও ধর্ষন ত আছেই। দুঃখের কথা, হিন্দু ধর্মীয় স্থান থেকে প্ররোচনা না দিলেও মসজিদ ও মজলিস থেকে তাদের এই ঘৃণ্য কাজের ধর্মীয় সমর্থন দেওয়া হতে লাগল। এখানেই বাঙ্গালী ঐক্য - যা বাঙ্গালীর গর্ব এবং বৈশিষ্ট্য ছিল - চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। দুই ভিন্ন ধর্মের বাঙ্গালীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা জন্ম নিল। বাংলায় যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গাগুলি ঘটেছিল তার কারন কিন্তু লোভ ও অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে অত্যাচারের লিপ্সা। এই পাশবিক প্রবৃত্তিকে স্বাভাবিকতার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ধর্মকে আশ্রয় করা হয়েছিল। যার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হল ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা। আর এই কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল উচ্চ প্রশাসনিক মহলের সমর্থন এবং আত্মিক অনুমোদন। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই দুটোই সহজে পাওয়া গিয়েছিল। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে হুসেইন সোরাবর্দী ও মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ দুটি কারনে এই গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের ভারতে অন্তর্ভূক্তি - যা তারা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছাড়া ভাবতে পারেনি। দ্বিতীয় কারন হল মহম্মদ আলী জিন্নাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে বার্তা দেওয়া যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ অধিকতর মুসলিম দরদী! সেইসঙ্গে বহু বাঙ্গালী মুসলমান, যারা এত বছর হিন্দু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এসেছে, তাদের মনে হিন্দুবিদ্বেষের বীজ বপন করার জন্য ধর্মের নামে - ইসলামের নামে - বিভেদের আগুন জ্বালালেন মসজিদ, মহল্লা থেকে জিহাদে হিন্দু নিধনের ডাক দিয়ে। এইভাবে বাঙ্গালীদের মধ্যে একটি স্থায়ী বিবাদের সূচনা হয়। এর ফলে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে যেমন মুসলমান বিদ্বেষ চলে এলো তেমনি বাঙ্গালী মুসলমানদের পশ্চিমী মুসলমানরা ছোট জাত বলে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পেল। তখন থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের আরবী সংস্কৃতির গোলামী করা ছাড়া উপায় থাকল না। সেজন্য এখনো বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে কোরআন, হাদিশের থেকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে হিন্দু বিরোধী জেহাদ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের (আগের পূর্ব পাকিস্তান ) বাঙ্গালী মুসলমানদের একাংশ এই ফাঁদে না পড়ে, বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সভ্যতার ধারক-বাহক হয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙ্গালীদের রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে চেষ্টা চালাচ্ছে - যদিও এই প্রচেষ্টা মহৎ, কিন্তু এর প্রভাব সাম্প্রদায়িক জেহাদের তুলনায় এখনো কম।
আবার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একটি বড় অংশ কম্যুনিস্ট শাসনের প্রভাবে কম্যুনিজমকেই বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক জ্ঞানে পুজো(!) করছে। ভারতীয় কম্যুনিজমের জন্ম, আদর্শ ও অভিমুখ সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ ধারনা না থাকার কারনে তারা গড্ডালিকা প্রবাহে কম্যুনিজমে দীক্ষা নেয়! পারিপার্শিকতার প্রভাবে বিশেষতঃ যুবা বয়সে কম্যুনিজম একটি রোমান্টিক মিথ্ তৈরী করে। এইসব "শুনে কম্যুনিষ্ট"রা সর্বদা দাদা অথবা দিদি নির্ভর। এখানে প্রবাদপ্রতিম পদার্থবিদ শ্রী সত্যেন বসুর জীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সত্যেন বসুর পদযুগল স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। যে সময়ের ঘটনা, তখন পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিস্টদের স্বর্ণযুগ চলছে। ঐ সময় শিক্ষা জগতে কোন নিয়োগ, উন্নতি - কিছুই কম্যুনিস্টদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ত বটেই, অধ্যাপকরা পর্যন্ত নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবীদের জন্য কৌটো নেড়ে বা রসিদ দিয়ে চাঁদা তুলতেন। তাঁরা কলকাতায় বিপ্লব করতেন কিউবা ও কোরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! অধ্যাপকরা তাঁদের উন্নতির শর্টকাট রাস্তা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এমনই একজন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বি ডি নাগচৌধুরী। তাঁর পৌরহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল।
বিষয় – পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ পরীক্ষা করে আমেরিকা কিভাবে তেজস্ক্রিয় ছাই ছড়িয়ে পৃথিবীর ক্ষতি করছে। প্রধান বক্তা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন সেন। তিনি শুধু বিজ্ঞান আলোচনা করা হবে – এই প্রতিশ্রুতিতে সভায় আসতে সম্মত হন। বক্তারা, বিশেষতঃ অধ্যাপক নাগচৌধুরী, মার্কিন সরকারের সবিশেষ মুন্ডুপাত করার পর শেষে বলতে ওঠেন সত্যেন বসু। তিনি তথ্য সহযোগে জানান যে, সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত সরকার যে পরিমাণ পারমাণবিক বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছে তা মার্কিন বিস্ফোরণের তুলনায় বহুগুণ বেশী। তাঁর একটিই জিজ্ঞাস্য ছিল যে, এর প্রতিবাদে ঐ সভার অধ্যাপক ও বিদগ্ধজনেরা কটি প্রতিবাদ সভা করেছেন! সভায় গুঞ্জন ওঠে – শেষে সভা তালকাটা পরিবেশে শেষ হয়। এভাবেও বাঙ্গালীদের মনে ভ্রান্ত ধারনা ঢুকিয়ে বিদ্বেষের বিষ গেঁথে দেওয়া শুরু হয়।
সত্যি বলতে কি, শুরু থেকে বাঙ্গালীদের মধ্যে জাতিগত ও ধর্মগত বিদ্বেষ ছিল না। এমনকি বাঙ্গালীদের মধ্যে বর্ণগত পরিচয় বল্লাল সেনের আগে ছিল না। তখন বর্ণভেদ ছিল কর্মের ভিত্তিতে – জন্মের ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ উচ্চ ও নিম্ন বর্ণে উত্তরণ ও অবনমন ছিল বাস্তব। আবার বাঙ্গালী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা সকলেই হিন্দু ছিলেন – এটি ঐতিহাসিক সত্য। বাঙ্গালীদের মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারন রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ। সেজন্য বাঙ্গালী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে চেহারায় ও কথাবার্তায় শুধু মিল নয়, তাদের DNAতেও সাদৃশ্য আছে। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে বাঙ্গালী হিন্দু, বাঙ্গালী মুসলমান, এমনকি এই হিন্দুদের মধ্যে সমস্ত জাতপাতের মানুষজন ভাই-বোন। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু গত প্রায় একশ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে এবং ধর্মীয় সুবিধাবাদের চাদরে ভাই-বোন ও ভাই-ভাইয়েরসম্পর্কটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন একাংশ বাঙ্গালী আরবী সভ্যতার পদলেহনকারী; অপর অংশ আন্তর্জাতিক ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে দেশবিরোধী শক্তির কমিশন এজেন্ট অথবা দেশভক্তের মুখোশের আড়ালে অবাঙ্গালী বানিয়াদের অনুচর ইত্যাদি। এইভাবে বাঙ্গালী পরিচয়টাই আজ অবলুপ্তির পথে।
তারপর গত দশ বারো বছর ধরে বাংলার মাটিতে চলছে অন্য খেলা। দুই বাংলাতেই রাজনীতিকদের লক্ষ্য সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীর ইচ্ছাতে সুরসুরি দিয়ে ভোটযুদ্ধে জেতা। তারপর ক্ষমতার মধুভান্ড দখল করা বা দখলে রাখা। এজন্য তারা চটজলদি সমাধানের মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। প্রথমে বাংলাদেশের কথা বলা যাক। সেখানে বর্তমান সরকার বাঙ্গালী অস্মিতার কথা ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের চোখের মণির মত রক্ষা করার কথা বললেও কখনো দেশবিরোধী জেহাদী সংস্কৃতির বাহকদের – যারা ইসলামের নামে আরবী সংস্কৃতি, সে দেশের মানুষের উপর তালিবানী কায়দায় চাপাতে চায় – তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ইতস্ততঃ করে। অবশ্যই সংখ্যাগুরু ভোটব্যঙ্কের কথা মাথায় রাখার জন্য এই ঢিলেমী। ফলে, সে দেশে মাঝেমধ্যেই সংখ্যালঘু হিন্দুরা বক্সিংয়ের পাঞ্চিং ব্যাগের মত ব্যবহৃত হয়। অনেক বাঙ্গালী মুসলমান এর সঙ্গে সহমর্মীতা পোষণ না করলেও ভয়ের পরিবেশে নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।
আবার পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টা অন্য। এখানে মানুষ মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত। সকলেই নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে গর্বিত – যা অবশ্যই বাঙ্গালী অস্মিতার অবক্ষয়ের বড় কারন। একভাগ তথাকথিত আন্তর্জাতিক কম্যুনিজমের আদর্শে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। এরা কোনো ধর্ম সম্বন্ধেই জ্ঞান না থাকায় সহজেই হিন্দুধর্মের নামে কুৎসা রটনাকে ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাচ্ছিল্য এবং অবমাননাকর বহিঃপ্রকাশকে প্রগতিশীলতা মনে করে। আরেকভাগ বাঙ্গালী বাঙ্গালীয়ানাকে বিসর্জন দিয়ে কোরআন, হাদীসের জেহাদী রূপান্তরকে মোক্ষ করে বাঙ্গালীস্থানকে পাক-ই-স্তান বানানোর কারিগর হিসেবে নিজেদের দেখতে চায়। এই দুই ধরনের বাঙ্গালী এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে শাসকানুকুল্য পাচ্ছে – কারন এদের মিলিত ভোটেই শাসকের নির্বাচনে জয়লাভ সুগম হচ্ছে। উপরের দুই দলের ক্রিয়াকর্মের প্রভাবে আরেক ধরনের বাঙ্গালীকুল মাথাচাড়া দিয়েছে। তারা নিজেদের একমাত্র দেশভক্ত এবং হিন্দুধর্মের একমাত্র ঠিকাদার হিসেবে বাঙ্গালী ঐতিহ্যের পরিপন্থী আচরণ করছে এবং অবাঙ্গালী বানিয়াগোষ্ঠীর তাঁবেদারী করে জেহাদী বাঙ্গালীকুলের মতই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। এখানে একটি ব্যাপার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল যেমন শাসকদলের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে মদতপ্রাপ্ত, তেমনি তৃতীয়দলও শাসকের প্রচ্ছন্ন মদতে শক্তিশালী থাকছে। কারন তৃতীয়দলের আচরণ ও ক্রিয়াকর্ম প্রথম ও দ্বিতীয়দলকে শাসকের পক্ষে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।
এবার আসি আমাদের সংবাদ-মাধ্যমগুলির ভূমিকায়। তারা এই তিন বিভাগের মানুষদের থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকুল হবে এমন মানুষদের বেছে নিয়ে তাদের ‘বুদ্ধিজীবি’ তকমা দিয়ে এমন প্রচার চালাচ্ছে যে, এই ‘সর্বজ্ঞ’ মানুষেরা যা বলছে তা যেন ধ্রুবসত্য! এই ‘বুদ্ধিজীবি দলে ভিড় করা মানুষদের মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, চিত্রনাট্য লেখক থেকে মায় খেলোয়ার অব্দি আছেন! আচ্ছা, আগে কেউ কখনো কে এল সায়গল, হেমন্ত মূখার্জী, মান্না দে, উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনকে কেউ ‘বুদ্ধিজীবি’ হিসেবে কল্পনা করেছেন! আসলে পুরোটাই একটি প্ররোচনার প্যাকেজ। বাঙ্গালীকে শতধা বিভক্ত করে তার জাতিগত সত্তাকে নষ্ট করে দাও। বাঙ্গালী না থাকলে রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, শিক্ষা থেকে বিনোদন – সমস্ত জায়গায় অন্য সংস্কৃতি দখলদারি কায়েম করতে পারবে। বাঙ্গালীর মেধা, মনন ও যোগ্যতা তার বিপক্ষে গেল। ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বহু বাঙ্গালী সেকারনে এই ব্যক্তিস্বার্থসঞ্জাত রাজনৈতিক নোংরামো থেকে সরে থাকছে। এদের সংখ্যা যখন আরো বাড়বে তখন হয়ত বাঙ্গালীর সুদিন আসতে পারে। অন্যথায় তার ধ্বংস অনিবার্য। শেষে বলি, সম্মিলিত বাঙ্গালী বিরোধীতার বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র হাতিয়ার ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী ঐক্য ও তার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো অর্থগৃধ্নু সংবাদ-মাধ্যম বর্জন করা। তবে,তার জন্য উপযুক্ত বাঙ্গালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। গুলিস্তাঁ বরবাদ করনেকো একই উল্লু কাফি হ্যায়, হর শাখ পর উল্লু বৈঠা হ্যায় ত গুলিস্তাঁকো ক্যয়া হোগা।