বাঙ্গালীর সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক খুঁজতে বাজারী বুদ্ধিজীবীরা ব্যর্থ! তাদের বক্তব্য হল, রামচন্দ্র উত্তর ভারতের, আর দেবী দূর্গা অর্থাৎ শিব ঠাকুরের গৃহিনী পার্বতী উমা হলেন বাঙ্গালীর নিজের কন্যা – কারন, দূর্গার বাপের বাড়ি বাংলায়! আসলে এইসব বুদ্ধিজীবীদের কেউ অভিনয় জগতে সাফল্য পাওয়া, কেউ বা সাফল্যের খোঁজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষজন – যারা নির্দিষ্ট চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে অভিনয় করেন! এরা সমাজ, সংস্কৃতি বিহীন এমন জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছেন যে, এখন আমজনতা এই বুদ্ধিজীবীকুলকে বিদ্রুপের পাত্র মনে করেন – এদের বিবেক বিশেষ আলমারিতে বন্ধ থাকে। অর্ডারী সময় শুধু তা বেরিয়ে আসে। এদের বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় এমন যে, আশ্বিনের শারদ প্রাতে দেবীপক্ষের সপ্তমীতে যে দূর্গাপুজাকে বাঙ্গালীর নিজস্ব বলে চালানো হয়, তা যে শ্রীরামচন্দ্রের হাত দিয়েই শুরু হয় – তার কথা এদের স্মরণে থাকে না! মহিষাসুর বধের যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত, তা বসন্তকালের পুজা। রাবণ বধের প্রাক্কালে শ্রীরামচন্দ্র যে দূর্গা মায়ের আরাধনা করেন, তাকে “অকাল বোধন” নামে অভিহিত করা হয়। এই অকাল বোধনই আমাদের বাঙ্গালী হিন্দুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুজা – দূর্গাপুজা। অথচ শ্রীরামচন্দ্রকেই এরা উত্তর ভারতীয় বলে বাংলায় ব্রাত্য ঘোষণা করেছে! রাজনৈতিক স্বার্থে এমন আজগুবি চিন্তাধারা একমাত্র বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নামের অর্ধশিক্ষিত ধান্দাবাজদের দ্বারাই প্রচার করা সম্ভব।
বাঙ্গালীর দূর্গাপুজার ইতিহাস যদিও কয়েকশ বছরের পুরোনো, এই পুজায় আমজনতার অংশগ্রহণ শুরু হয় ১৭৯০ সালে। তার আগে বনেদি পরিবারের দূর্গাপুজা অনেক ক্ষেত্রেই খুব ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলেও সেসব পুজায় সাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকত না। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পরবর্তী পর্যায়ে কোম্পানির সাহেবদের খুশী করার জন্য – ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দূর্গাপুজায় সাহেবদের বিশেষ নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নিয়ে আসা হয়। সেইসঙ্গে বাইজী নাচ ও সুরার বিশেষ বন্দোবস্তও করা হল। এই ব্যাপারে বিভিন্ন বনেদি বাড়ির পুজার উদ্যোক্তা পরিবারগুলির মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরী হত! নথি অনুযায়ী কোলকাতার প্রথম দূর্গাপুজার কৃতিত্ব দেওয়া হয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারকে। এদের দূর্গাপুজা শুরু হয় মোঘল আমলে – ১৬১০ সালে। প্রথম দিকে এই পুজাতেও সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারনে সর্বজনীন দূর্গাপুজার উদ্ভব হয়েছে। শুরুটা করেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে। এর থেকেই আসে বারো ইয়ারী – অর্থাৎ বারোয়ারী দূর্গাপুজা। বর্তমানে এই পুজা সর্বজনীন রূপ নেওয়ায় তা সর্বজনীন দূর্গাপুজায় দাঁড়িয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন স্বাধীনতা আন্দোলন বিক্ষিপ্তভাবে দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে, তখন কোলকাতার প্রথম বারোয়ারী পুজার সন্ধান মেলে ১৯০৯ সালে বলরাম বোসঘাট রোডে, যার উদ্যোক্তা ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা। এই পুজার প্রাণপুরুষ ছিলেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী। এই সময় থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার প্রধান কারন হল, দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য যেসব বিপ্লবী তরুণরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে মহিষাসুরমর্দিনী মা দূর্গারূপে বিদেশী অসুর ও তাদের দালালদের বিনাশ করার জন্য মানসিক শক্তি আহরনের উদ্দেশ্যে তাঁরা অসুরদলনী দূর্গার আরাধনা শুরু করেন। সঙ্গে গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল – সামাজিক মিলন।
বাংলার যে দুটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল – যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতি – তার নেতৃত্বে থাকা যুবকরাই এইসব পুজার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। এই প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঐ সময় বাঙ্গালী হিন্দুর মনে সৌভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ তৈরী করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ব্রাহ্ম ছিলেন, তবুও রবীন্দ্রনাথের দূর্গাপুজায় অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায় এই উপলক্ষ্যে তাঁর লেখা বেশকিছু কবিতায় ও গানে। যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বারোয়ারী দূর্গাপুজার গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই পুজার বহিরঙ্গের পরিবর্তন হতে থাকে। প্রথমে ছিল, এক চালের প্রতিমায় মা দূর্গা, মহিষাসুর, সিংহ সহ দুই পুত্র ও দুই কন্যা – সপরিবারে বিরাজমান। বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেকে নিজ নিজ বাহনারূঢ়া। তারপর ক্রমে মায়ের সঙ্গে পুত্র-কন্যারা আলাদা হতে লাগলেন। চালচিত্রেও বৈশিষ্ট্য এলো। শুধু মূর্তিময়ী মা – যেন চিন্ময়ী কন্যা উমা সপরিবারে মৃন্ময়ীরূপে আবির্ভূতা।
এগুলি সমাজে বাঙ্গালী হিন্দুর মননের পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। বারোয়ারী পুজার বর্তমান সংস্করণে আসার আগে বাঙ্গালী মননে দূর্গাপুজা ও তার ইতিহাস না জানলে পুজার বিবর্তনকে শুধু রাজনীতির চোখেই দেখতে হবে – সামাজিক নয়। প্রথমে বাঙ্গালীর সর্বজনীন বারোয়ারী পুজা শুরুর উদ্দেশ্য দেখা যাক। সাধারণ মানুষের কাছে বনেদী বাড়ির দূর্গা পুজায় অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত থাকলেও তাদের মনে পুজায় যোগদান ও সার্বিক অংশগ্রহনের আকাঙ্খা জাগানোর পিছনে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী যুব সমাজ – বিশেষতঃ ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একদল যুবকের মনে যে অসুরদলনী মাতৃরূপের মৃন্ময়ীর আরাধনাকেই আপামর বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ তাঁদের দেবী দূর্গা রূপে পুজা শুরু করে। এর ফলে যেমন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বার্তা দেওয়া হয়, তেমনই চারদিনের পুজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনের প্রক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। এই দুটিই প্রাক-স্বাধীনতা বারোয়ারী দূর্গাপুজার অবদান হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী সমাজের ও বাঙ্গালী মননে মা দূর্গাকে বাঙ্গালী তার নিজের ঘরের বিবাহিত কন্যার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। কৈলাশ থেকে উমা – পুত্র-কন্যাসহ বাপের বাড়ি, অর্থাৎ বাংলায় আসেন। বাপের বাড়িতে বহুদিন পর বিবাহিত কন্যা এলে যেমন আনন্দ-উৎসবে বাড়ি মুখরিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হতে শুরু করে। বিশেষতঃ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অসুরদলনী মহিষাসুরমর্দিনীরূপের প্রয়োজনীয়তা ফুরানোর পর ধীরে ধীরে তা প্রতীকী রূপ নেয় – আত্মিক প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
এইসময় মুসলিম লীগের বাড়বাড়ন্ত ও রাজনৈতিক দলগুলির ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় ইন্ধন দেওয়ার কারনে প্রাক-স্বাধীনতাপর্বের শেষের দিকে, ১৯৪৬ সালে বাঙ্গালীর দূর্গাপুজাকে ঘিরে নতুন ঝামেলার উদ্ভব হয়। বাংলার বশ কয়েকটি জেলায় ইসলামী মানুষের সংখ্যাধিক্য থাকায় এবং তাদের মসজিদ, মাদ্রাসার মৌলভী, ইমাম, মৌলানারা ইসলামী নেতৃবৃন্দের অঙ্গুলীহেলনে ইসলামীদের মূর্তিপুজার সক্রিয় বিরোধীতা করতে প্ররোচিত করে। তার পর থেকে বাঙ্গালী ইসলামীদের একাংশ দূর্গাপুজাকে হাতিয়ার করে ইসলামের পরিপন্থী কাজের অছিলায় দূর্গামুর্তি ভাঙ্গাসহ দূর্গাপুজা বন্ধের অভিযানে নামে। স্বাধীনতা উত্তর পূর্ব পাকিস্তান -অধুনা বাংলাদেশে – একইভাবে দূর্গামুর্তি ভাঙ্গা এবং পুজা পন্ড করার প্রক্রিয়া চালু আছে; যদিও সে দেশের বর্তমান সরকার প্রকাশ্যে এ ধরনের কাজের নিন্দা করছে, তবু তাদের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বর্বরতা বন্ধের পক্ষে যথেষ্ট নয়। আসলে পুরো ব্যাপারে কিছু অপ্রকাশিতব্য মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায় মাত্র। প্রথম যখন বারোয়ারী দূর্গাপুজার প্রচলন হল, তখন হিন্দু মননে যে মাতৃপুজার রূপ চিহ্নিত হয়ে আছে, সেখানে বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শুধু নয়, তাদের সহযোগী হয়ে যেসব দেশীয় মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগীতা করত, তারাও অসুরশ্রেণীর মধ্যে পরত! যে যতীন্দ্রমোহন মুখার্জী ভবানীপুরে বারোয়ারী পুজার প্রচলন করেন, তিনিই বৃটিশ শক্তির হয়ে কাজ করা খান বাহাদুর শামসুল আলমের খুনের (ফেব্রুয়ারী, ১৯১০) নেপথ্যে ছিলেন। একদিকে যেমন মাতৃশক্তির আরাধনায় বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলেন, তেমনি বাঙ্গলার ইসলামী সমাজ এই পুজার মধ্যে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধালাভের সুযোগ না থাকায় ধর্মীয় মোড়কের আড়ালে এর বিরোধীতা করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষতঃ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারে বারোয়ারী দূর্গাপুজার সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুজা আচারের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাঙ্গালী ঘরের মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে চোখের জলে বিদায়ের সময় যে লোকাচার করা হয়, বিজয়া দশমীতে মাতৃবরণের সময় তার প্রতিফলন দেখা যায়। আবার বাঙ্গালী হিন্দু মেয়েদের আরেকটি লোকাচার – সিঁদুর খেলার মাধ্যমে দূর্গাপুজার সমাপ্তিতে বিভিন্ন পরিবারের মেয়েদের মধ্যে মেলবন্ধন দেখা যায়। বিজয়া দশমী অন্তে গুরুজনদের সম্মান জানানো ও অন্যদের স্নেহাশীষ এবং ভ্রাতৃত্ববোধের কোলাকুলি – সবই সামাজিক মেলবন্ধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
এভাবে দূর্গাপুজা কবে যে বাঙ্গালীর নিজস্ব সংস্কৃতিতে জারিত হয়ে নির্ভেজাল বাঙ্গালী হিন্দুর পুজার সঙ্গে উৎসবের মেজাজের মেলবন্ধন হয়ে গিয়েছে তার নির্দিষ্ট সন-তারিখ বলা সম্ভব নয়। তারপর, বাঙ্গালী হিন্দুর – বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুদের দূর্গাপুজায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন – যেটা বাঙ্গালীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এলো। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দলে দলে পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী হিন্দু সর্বস্ব খুঁইয়ে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আসেন। কিছু মানুষ আসাম এবং ত্রিপুরায় যান। এদের জওহরলালের নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হয়। পঞ্জাবে যেমন জন-বিনিময় হয়, তেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও করার প্রস্তাব শ্যামাপ্রসাদ ও বল্লবভাই প্যাটেল সমর্থন করলেও জওহরলালের তীব্র আপত্তিতে তা ঞবাতিল হয়। জওহরের এই বাঙ্গালী বিদ্বেষের পর উদ্বাস্তু বাঙ্গালীদের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার কারনে এদের বামপন্থীরা যে রাজনীতির গোলকধাঁধায় ফেলেছিল, তার মূল শিক্ষা ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা” নামের সোনার পাথর বাটি মার্কা তত্ত্ব যার নির্গলিতার্থ উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের সব পুজা, আচার-অনুষ্ঠানকে বিদ্রুপাত্মকভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। এই “ধর্মনিরপেক্ষতার”র প্রভাব এসে পড়ল বাঙ্গালীর পুজা-আর্চা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর! প্রথমে শুরু হল মায়ের মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্তরালে পুজার ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তিকে বিদ্রুপের সঙ্গে লঘু করা। পর্বত কন্যা উমাকে শুধু কাঁচুলি পড়িয়ে মূর্তি তৈরী হল! তারপর বিভিন্ন পরিত্যজ্য জিনিষ – আবর্জনা দিয়ে মূর্তি গড়া শুরু হল! এই পর্যায়ে আখের ছিবড়ে, বাঁশ, এমনকি মাছের আঁশ, আবর্জনা দিয়ে মূর্তি তৈরী হয়েছে। এক সময় শুরু হল মাটির ভাঁড় নিয়ে ভাঁড়ামো! এদিকে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এবং বাজারী সংবাদ-মাধ্যমের ঢক্কানিনাদে বাঙ্গালী হিন্দুর দূর্গাপুজা কিভাবে যেন “দূর্গোৎসব” হয়ে গেল! রাজনৈতিক অশুভ শক্তির সঙ্গে জিহাদী শক্তির যোগসাজসে হিন্দুত্বকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা ‘আধুনিকতা’ ও ‘শিক্ষিত মনন’-এর পরিচয় হিসেবে ধরা হল! শুধু দূর্গাপুজা নয়, সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর “ভ্যালেনটাইনস্ ডে” হিসেবে অর্ধ-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মার্কা ধান্দাবাজ মানুষজন প্রচার করতে শুরু করল। এটা ঠিক যে, সকল ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন ঐ ধর্মের মানুষদের কাছে বিশেষভাবে পালন করার দিন হিসেবে দেখা হয়। ২৫শে ডিসেম্বর যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনের আনন্দ অনুষ্ঠানের গতি প্রকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হলেও, ঐ দিনের চার্চের প্রাতঃ প্রার্থনার কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার, ইসলামীদের ঈদের অনুষ্ঠান ও প্রার্থনার একচুল পরিবর্তনের কথা বলার সাহস কোন ভাড়াটে ধান্দাবাজ – যাদের পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী বলে, বা কোন ভুঁইফোর সাংবাদিক বা কোন “ধর্মনিরপেক্ষ” রাজনীতিককে বলতে শুনিনি! শুধু হিন্দুদের ‘পুজা’কে ‘পুজা’ না বলে ‘উৎসব’ বলে চালানোর প্রচেষ্টার পিছনে এক গুঢ় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অসততা প্রতীয়মান হয়।
এবার আসা যাক কম্যুনিষ্ট-উত্তর সিপিএমের মেধাবী ছাত্রীর জমানায়। এই সময় “দুধেল গাই” তত্ত্ব ও বাঙ্গালী হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে state sponsored পরিবর্তন – বিশেষতঃ দূর্গাপুজায় – লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখন বারোয়ারী দূর্গাপুজা করা “ক্লাব”গুলি সরকারী অর্থের অনুদানে বলীয়ান। এর সঙ্গে ধর্ম বা পুজার কোন সম্পর্ক নেই। কারন, নির্দিষ্টভাবে পুজা-উপকরন বা মূর্তির জন্য এই অনুদান দেওয়া হয় না! বলা ভালো, এই টাকা ক্লাবগুলিকে কোন শর্ত ছাড়াই ‘দান’ দেওয়া হয়! একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা মনে পড়ে গেল – “there is no free lunch”। তাহলে ক্লাবগুলিকে এই অনুদান দেওয়ার কারন কি? সরকারী বিজ্ঞাপনে বলা হয় – “পুজা যার যার, উৎসব সবার”। অর্থাৎ, দূর্গাপুজা – যা এখন পুজা নয়, উৎসব – সবার! একেবারে সর্বধর্ম সমন্বয়! এর বহিঃপ্রকাশ শুরু হয়েছে দূর্গা মন্ডপে কোরান রাখা, গির্জা, মসজিদের আদলে দূর্গা মন্ডপ নির্মান – এসব দিয়ে! এমনকি জুতোর মন্ডপ পর্যন্ত এসে গেছে! অথচ অন্য ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এমন “সর্বধর্ম সমন্বয়” মার্কা বদ ঐতিহ্য দেখা যায় না। কোন ইসলামী মানুষ ঈদের নমাজে বা মসজিদের প্রার্থনায় হনুমান চালিশা বা গীতা বা বাইবেলের উপস্থিতি মেনে নেবেন কি? এভাবে সরকারী মদতে ইচ্ছাকৃতভাবে দূর্গাপুজার ইসলামীকরণ কাম্য নয়। তাছাড়া দেশের সংবিধান অনুযায়ী শুধু কোন পূজার জন্য সরকারী অর্থ সাহায্য করা যায় না। এর ফলে হয়ত কিছু রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে; বিনিময়ে দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুসলমান বিবাদের খেসারত আপামর বাঙ্গালীকেই দিতে হবে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আচার-আচরণের লঘুকরনের মাধ্যমে তাদের ধর্মবোধকে নষ্ট করে অন্য ধর্মকে অটুট রাখার প্রক্রিয়া হিন্দুত্বকে খতম করার রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ডকে যদি এখুনি প্রতিরোধ করা না যায়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভন্ডামীকে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতায় পরিণত করা হবে! বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বারোয়ারী দূর্গাপুজার যে রূপ আমরা দেখি, তা ভাতাজীবী বাঙ্গালী হিন্দুদের “দুর্গোৎসব” – দূর্গাপুজা নয়। সেখানে স্ফুর্তির বহুবিধ উপকরণ মজুত থাকলেও ভক্তির লেশমাত্র নেই।
আবার দূর্গাপুজাকে UNESCOর হেরিটেজ তকমা পাওয়া নিয়ে ধান্দাবাজ রাজনীতিক ও অর্ধশিক্ষিত সংবাদ-মাধ্যমের লম্ফঝম্ফ দেখে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগে – ঈদ বা খ্রীষ্টমাসের ধর্মীয় উদযাপন করাকে কেউ হেরিটেজ তকমা দিয়েছে কি? আর সেখানে দূর্গার বদলে ‘কোরান’ বা ‘বাইবেল’ পুজা করলেও তা হেরিটেজ হবে ত? এই ‘হেরিটেজ’ খায় না মাথায় মাখে – তাও বোঝা গেল না। আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী হিন্দুদের বলি, আর কতদিন ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত লাফাবেন? যে জাতির ধর্ম নেই – ধর্মবোধ নেই – তার আত্মহনন নিকটপ্রায়।
বাঙ্গালীর দূর্গাপুজা – সেকাল ও একাল
