আমাদের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি একটি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। আসলে, জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সংবাদ-মাধ্যমে যেভাবে রাজনৈতিক নেতা ও কিছু ঘোষিত রাজনীতির ঘোষিত সমর্থক তথাকথিত বুদ্ধিজীবির বক্তব্য প্রচার করা হয় – তাতে অন্ততঃ এই রাজ্যে শিক্ষানীতি নিয়ে সাধারন মানুষের সঠিক ধারনা করা প্রায় অসম্ভব। সংবাদ-মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত ধারনা অনেকটাই অপরের মুখে ঝাল খাওয়ার মত! শিক্ষানীতি নিয়ে আগে এই জায়গায় বিস্তৃত আলোচনা করায় তা আবার বিবৃত করার কোন অভিপ্রায় নেই। শুধু, সে সময় এই নীতি প্রয়োগে কিছু সতর্কতা ও সন্দেহের কথা বলেছিলাম। এখন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষায় বিদেশী বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্রে fall-outএর ব্যপারে আলোচনা করছি।
নতুন শিক্ষানীতির দিশা অবশ্যই প্রশংসনীয়। যদিও বিরোধী রাজনীতিকদের অন্ধ বিরোধীতা এবং সরকার পক্ষের রাজনীতিকদের অন্ধ সমর্থনের মধ্যে অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিকদের শিক্ষার দৈণ্যতাই প্রকাশ পায়। মেকলে নির্দেশিত শিক্ষা-ব্যবস্থায়, কম্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত শিক্ষানীতির পরিবর্তন দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে অতীব জরুরী ছিল। এই নতুন শিক্ষানীতির অভিমুখ যেহেতু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ব্যবস্থার মেলবন্ধন করা – সেটি পূর্ববর্তী শিক্ষা-ব্যবস্থার ধারক ও বাহকদের না-পসন্দ্ হওয়াই স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন্য যা সবচেয়ে জরুরী তা হল শিক্ষকদের যোগ্যতা ও তাদের শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগের সদিচ্ছা! চল্লিশ বছরের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাদান ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা জগতে শিক্ষক-চয়ন থেকে শুরু করে তাদের নিয়োগ ব্যবস্থা কখনো স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল না! সেখানে প্রার্থীর শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতা অপেক্ষা অন্য যোগাযোগ প্রাধান্য পেয়ে এসেছে! ইউজিসি বেতন কাঠামো পূর্ববর্তী যুগে সাধারণতঃ শিক্ষকরা তাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীকে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকাতে যার-পর-নাই চেষ্টা করতেন। এভাবেই তখন বেশীরভাগ শিক্ষক-চয়ন করা হত। ইউজিসি বেতন কাঠামো পরবর্তী সময়ে কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলে তার চাপে স্কুল শিক্ষকদেরও বেতনে অনেকটাই বৃদ্ধি হয়। স্কুল, কলেজ উভয় ক্ষেত্রেই সার্ভিস-কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলেও রাজনীতির কোলে চড়ে থাকা এইসব ‘কমিশন’গুলি তাদের ‘বিশেষজ্ঞ’ চয়ন থেকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পন্ন করতে লাগল যে, প্রায় সমস্ত শিক্ষক নির্বাচনই রাজনীতির ক্ষমতায় থাকা দল ও তাদের নেতাদের অঙ্গুীহেলনে করা হত! যেজন্য এক সময় কলেজ সার্ভিস কমিশনের নাম লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল “কমরেড সার্ভিস কমিশন”! আর বিশ্ববিদ্যালয়! যত কম বলা যায় ততই ভালো! এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-চয়নে কোন স্বচ্ছতা নেই। কোথাও শিক্ষক চয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে সার্ভিস কমিশন নেই। প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগের কথা – ঐ সময় আমি কলকাতা থেকে বহুদূরের এক সরকারী কলেজে সহকারী অধ্যাপক। সে সময়ে প্রায় এক বছরের মধ্যে আমার কলেজের ৩-৪ জন সহকর্মী কলকাতার ২-৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নির্বাচিত’ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীতে যোগ দিলেন। এরা সকলেই ছাত্রাবস্থা থেকে তখনকার রাজ্যের শাসকদলের সক্রিয় কর্মী! শুধু একজন ছিলেন, যিনি বৈবাহিক সূত্রে শাসকদলের শিক্ষকনেতার সহধর্মীনী! এই অসততা সমর্থকদের একটাই বক্তব্য – বাশ্ববিদ্যালয়ের অটোনমি! অর্থাৎ, শিক্ষক নিয়োগে দূর্ণীতির দোহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোনমি!
আরো বড় কথা – বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ্যাপক পদে উত্তরণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কলেজগুলোতে সে সুযোগ নেই – সহযোগী অধ্যাপক পদেই তা সীমাবদ্ধ! এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কলেজগুলিতেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে শিক্ষাদান এবং গবেষণার সুযোগ থাকলেও অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই! সংযোগ ও রাজনৈতিক মতাদর্শ এই শিক্ষকদের নিযুক্তি এবং পদোন্নতির কারন হওয়ায় তাদের যোগ্যতার যথার্থতা কখনোই প্রমাণিত হয়নি। পৃথিবীর কথা বাদ দিলেও, শুধু সারা ভারতের নিরিখে এই রাজ্যের শিক্ষার মান যে ক্রমশই নিম্নগামী, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণ চুলোয় গেছে – এমনকি সরকারি কলেজে জীব-বিজ্ঞান বিভাগে specimen কেনার অর্থ না থাকায় জীবদেহ ব্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়া শিক্ষা বন্ধ!
যেহেতু এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদের ভিত্তিতে বেতনক্রম নির্ধারিত হয়, এখানে যোগ্যতা গৌণ – মূখ্য হচ্ছে রাজনৈতিক খুঁটির জোরে পদোন্নতি প্রাপ্তি! সুতরাং এ নিয়ে স্তাবক শিক্ষককুলের মধ্যে কোন হেলদোল ছিল না। এবার মুস্কিল হল নয়া শিক্ষানীতির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। কারন, বিশ্বজনীন শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও একটি বুনিয়াদী স্তরের উপরে – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষাকে – পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে পণ্যের ক্রেতার পণ্য, তার মান ও বিক্রয়কেন্দ্র চয়নের স্বাধীনতা থাকছে! শুধু তাই নয়, পণ্য বিক্রেতার দায়বদ্ধতা এবং পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগীতাও থাকবে – তা’হলে একমাত্র উন্নতমানের পণ্যই বাজারে চলবে! আমাদের এতদিনের চালু শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন দায়বদ্ধতার কোন ব্যাপার ছিলনা। শিক্ষা রাজনীতির নিয়ন্ত্রনাধীন থাকায় ছাত্রদের শিক্ষকের ও শিক্ষার গুণগত মানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। “সকলের জন্য সর্বস্তরের শিক্ষা” এবং “শিক্ষা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের দায়িত্ব” বলা কম্যুনিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল অর্ধশিক্ষা ও কুশিক্ষার আলোতে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখা। কারন, চীন, রাশিয়ার মত কম্যুনিস্ট দেশগুলিও উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় অর্থবিনিয়োগ কমিয়ে তার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার বেসরকারীকরনের মত নীতি নিয়ে চলছে। এ বিষয়ে ভারতীয় কম্যুনিস্ট ও তাদের সমর্থনকারী সংবাদ-মাধ্যমগুলি নিশ্চুপ! এছাড়া এখানে অন্যরকম বাদ-বিসম্বাদ আসতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের যোগ্য ছাত্রদের জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির ভারতে তাদের ক্যাম্পাস খোলার পথ সুগম করা হচ্ছে। গুজরাট আন্তর্জাতিক অর্থ প্রযুক্তি শহর (Gujarat International Finance Tec-City) বা সংক্ষেপে GIFT গান্ধীনগরে বিদেশী উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভারতে তাদের ক্যাম্পাস খোলার জন্য ২০২২এর বাজেটে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন ‘পক্ষ’ মাছের বাজারের চিৎকার শুরু করেছে – অবশ্যই স্বার্থহানির আশঙ্কায়!
যা বলা হচ্ছেনা তা’হল, ২০০৫ সালে ইউপিএ জমানায় UGC এইভাবে আগ্রহী বিদেশী উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে ভারতে তাদের অতিরিক্ত ক্যাম্পাস খোলার জন্য স্পেশাল ইকনমিক জোন খোলার পরিকল্পনা করে – উদ্দেশ্য, কম খরচে ভারতের যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া। সুতরাং এটি নতুন কোন চিন্তা নয়। তবে, এতে অসুবিধা কেন এবং কোথায়?
প্রথম কথা হল, রাজনৈতিক বিরোধীতা নির্বোধের প্রতিক্রিয়া বলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন (যার মধ্যে বিজেপিপন্থী সংগঠনও আছে) এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে! তার কারন, আমাদের দেশে শিক্ষা – বিশেষতঃ উচ্চশিক্ষা হচ্ছে শিক্ষকদের করেকম্মে খাওয়ার জায়গা – যেখানে বেতনভূক কর্মচারীর (পড়ুন শিক্ষক) কোন দায়বদ্ধতা নেই। এখানে দায়বদ্ধতা বলতে শিক্ষাদানের গুণগত মানের কথা বোঝানো হচ্ছে। এবার যদি এইসব আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে গুণমানের প্রতিযোগীতায় নামতে হয়, তা’হলে এই শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিমাপ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। বার্সিলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ফুটবল খেলতে নামলে যেভাবে এই দেশের টিমের খেলোয়ারদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার ধুলিস্যাৎ হবে – সে ভয়টাই এই শিক্ষকদের মনে কাজ করছে। এতে একটি মূল্যবান তথ্য বেরিয়ে এসেছে – এতদিন আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের চাহিদা ও মতামতকে গুরুত্ব দিইনি। আমরা শিক্ষার উৎকর্ষের বদলে শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতিকে শিক্ষার বিকাশ মনে করে তৃপ্তি অনুভব করেছি।
এখন সময় এসেছে – নতুন শিক্ষানীতির হাত ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামতে বাধ্য করা। উচ্চশিক্ষার নামে বহুবিধ ধ্যাষ্টামো বন্ধ হলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়তে বাধ্য। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই GIFTর অধীনে বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ক্যাম্পাস তৈরী হলে তারা UGCর অধীনে আসবে না – তা বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্য UGCর পরামর্শ মেনে সরকার বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য কয়েকটি অলঙ্ঘণীয় শর্ত পালনের নিয়ম জারি করেছে। যেমন তাদের এদেশের ক্যাম্পাসে যে ডিগ্রি দেওয়া হবে তার মান ও ডিগ্রির মূল্য তাদের মূল প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের সঙ্গে যেন অভিন্ন হয়। অর্থাৎ, ক্যাম্পাস ভেদে ডিগ্রির ভেদ করা যাবে না। এছাড়া, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অবকাঠামো তৈরী করার জন্য দেশীয় সহযোগী নেওয়া যাবে। এটা বাস্তব ও যুক্তিসম্মত। এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের শিক্ষাদানের মান, ডিগ্রির মূল্য ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেবে।
আমার মনে হয়, protective শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শিক্ষককুল শিক্ষকতার পেশায় শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কাজে (!) বেশী আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের পক্ষে এই প্রতিযোগীতা অস্বস্তিকর। সেজন্য তারা বেশী চেঁচামেচি করছে! অনেকে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচের কথা তুলেছেন! তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, অক্সফোর্ড, কেম্বিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ তাঁরা জানেন? এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি অর্জনের জন্য খরচ দেশের ছাত্রদের নাগালের বাইরে যাবে না। জেএনইউ মার্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর জন্য কেন দেশের সাধারন মানুষের করের টাকা লাগামছাড়াভাবে ব্যয় করা হবে? elitist তকমা পাওয়া এইসব জায়গার ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রদের থেকে জনসাধারন কি প্রতিদান পায়? যে উচ্চ বেতন পাওয়া শিক্ষককুল এই বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির দেশীয় ক্যাম্পাস স্থাপনের বিরোধীতা করছেন, তাঁরা শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁদের বেতনের কত শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছেন তা জানা নেই! আসলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো মোটা মাইনের শিক্ষককুল এখন ধরা পড়ার ভয়ে শোরগোল করছেন! দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ণ প্রক্রিয়া এভাবে আটকানো যাবে না।
বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশীয় ক্যাম্পাসের বিরোধীতা কেন
